মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আন্দামানে কয়েকদিন

এম সাখাওয়াত হোসেন :
বিদেশ ভ্রমণ অনেকের কাছে এক ধরনের বিলাসিতা বলে মনে হলেও আমার কাছে কখনই তেমন মনে হয়নি, বিশেষ করে জীবনের এ সময়টাতে। নতুন নতুন জায়গা দেখবার ওই সব জায়গা সম্বন্ধে জানবার আগ্রহ বাল্যকাল থেকে থাকলেও চাকরি সূত্রে বেশ কিছু দেশে যাবার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ে যেমন করে দেখার আগ্রহ ছিল তেমন করে দেখা হয়নি। এখন যখন সুযোগ আসে তখনই বেরিয়ে যাই দেশ-বিদেশ ভ্রমণে। যেতে ইচ্ছা হয় ইতিহাসসিদ্ধ জায়গাগুলোতে। এমন এমন স্থানে যেগুলো সাধারণ ভ্রমণকারীদের কাছে তেমন পরিচিত নয়। বহু শহর বহু দেশে এমন জায়গাও রয়েছে যেগুলো সাধারণত পর্যটন ম্যাপে প্রায় অনুপস্থিত।
বিশ্বের অনেক জায়গা সম্বন্ধে বাল্যকাল হতেই এক ধরনের ঔৎসুক্য জন্মেছিল মনে হতো যদি কখনও এসব জায়গায় ভ্রমণ করতে পারতাম! এর বেশির ভাগই ঐতিহাসিক জায়গা। এমনই একটি জায়গা যার নাম আন্দামান। বর্তমানে আন্দামান নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ। ভারতের ‘ইউনিয়ন টেরিটোরি’। বাংলাদেশের দক্ষিণের উপজেলা টেকনাফ হতে সরাসরি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর আর আন্দামান সাগরের মিলনস্থলে, ভারত মহাসাগরের উত্তরপ্রান্তে। কলকাতা হতে দু’ঘণ্টার বিমানের পথ এ দ্বীপুঞ্জের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার।
ছোটবেলাতেই বাবা মার মুখে শুনেছি ‘কালাপানি’র কথা। ‘কালাপানি’ মানে ‘আন্দামান’। যখন বুঝতে শুরু করেছি তখন ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়তে শুরু করেছি মাত্র। আরও পরে উপরের শ্রেণীতে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৮৫৭ সাল বা বৃটিশ ভারতের ইতিহাসে ‘গ্রেট মিউটিনি’ বা ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ পড়তে শুরু করি তখন যৎসামান্য ধারণা পেয়েছিলাম ‘আন্দামান’ বা ‘কালাপানি’ সম্বন্ধে। বৃটিশ ভারতের কলোনির এক দ্বীপপুঞ্জ যা ব্যবহার হয়েছিল প্রথমে ‘দীপান্তর’ জাবৎজীবন এবং মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের জেল হিসেবে। এদের মধ্যে সিংহভাগ ছিলেন শেষ মোগল সম্রাট বাহাদূর শাহ জাফরের নেতৃত্বে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় বিদ্রোহের অভিযুক্ত দেশান্তরি। আরও পরে বৃটিশ শাসনবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনের নেতাদের, দেশদ্রোহী অভিযোগে অভিযুক্তদের কারাবরণের জন্যে মূল ভূখণ্ড হতে দূরে আন্দামানে পাঠানো হতো। এদের অনেককে নিভৃতে ফাঁসিও দেয়া হয়।
অনেক দিন হতেই মনে হয়েছিল উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের একবড় অধ্যায়ের ছোট একটি জায়গা আন্দামান বা কালাপানি স্বচোখে দেখবার। ভ্রমণের জন্যে মানসিকভাবে তৈরি হলেও যাবার রাস্তা খুঁজছিলাম। খুঁজছিলাম সফরসঙ্গী হবার জন্যে কিছু সমমনা বন্ধুবান্ধবের। খোঁজা শেষ হলো যখন আমাদের প্রায় প্রতিদিনের প্রাতঃভ্রমণের পর প্রথিতযশা ছবির পরিচালক ও ব্যবসায়ী বন্ধু হাবিব খানের নাস্তার অসরে ‘কালাপানি’ ভ্রমণের বিষয়টি কথাচ্ছলে তুললাম।
andaman-port_blair_airport_runway
‘আন্দামান’ নাম উল্লেখ করবার সাথে সাথে সাড়া দিলেন ভ্রমণপিপাসু হাবিব খান। অনেকেই প্রশ্ন তুললেন ‘পৃথিবীর এত জায়গা থাকতে আন্দামান কেন?’ কয়েকজন জায়গাটির নামও শুনেননি বলে জানালেন। আমি যতটুকু জেনেছি বলেছি। দু-এক সপ্তাহের মধ্যে আন্দামান নিকোবার তথা কালাপানি ভ্রমণে প্রায় ৯ জন, সস্ত্রীক, আমাদের সাথে যোগ দিতে রাজি হলেন। এদের কেউই কষ্মিনকালেও এমন জায়গা ভ্রমণের চিন্তাও করেননি। ভ্রমণটির আয়োজনের দায়িত্ব নিলেন হাবিবুর রহমান খান। ভারতের দু’টি শহর হতেই জলপথ ছাড়াও সরাসরি বিমান যোগাযোগ রয়েছে যার মধ্যে অন্যতম শহর কলকাতা আর অপরটি চেন্নাই।
হাবিবুর রহমান খান ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছিলেন; যার মধ্যে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, হালের ‘মনের মানুষ’ এবং বর্তমান প্রযোজনায় রয়েছে ‘শঙ্খচিল’। কাজেই তার কলকাতা যোগাযোগ বেশ বহুদিনের। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় ওই সময় হতেই যোগাযোগ। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই জানালেন যে, ভারতের অন্যতম ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর এজেন্সি ‘মেকমাই ট্রিপ’ আন্দামান-নিকোবারে নিয়মিত গ্রুপ ভ্রমণের আয়োজন করে থাকে এবং আমাদের গ্রুপকেও অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। এই ট্রিপ শুরু হবে কলকাতা হতে। কাজেই ঢাকা-কলকাতা নিজেদের উদ্যোগে যেতে হবে। মেকমাই ট্রিপ’-এর মাধ্যমে ইতিপূর্বে দক্ষিণ ভারত সফর করেছিলাম কাজেই আমাদের মোটামুটি পরিচিত সংস্থাই বলতে হবে। যেহেতু আন্দামান অক্ষরেখার ১০০ উপরে এবং নিকোবার আরও দক্ষিণে তাই আবহাওয়া গরমের দিকেই থাকে। প্রায় সারা বছরই একই ধরনের আবহাওয়া থাকে। তবে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশ হয়। আর্দ্রতা বাড়ে। প্রচুর বৃষ্টি হয়। সে কারণেই আমাদের ভ্রমণ জানুয়ারি মাসের শেষের দিকেই নির্ধারিত হলো। সর্বমোট সাতদিনের সফর যাতায়াত বাদে।
কলকাতা হতে আন্দারমান সফর শুরু হবে সাথে রয়েছেন আমাদের কয়েকজনের সহধর্মিণী; কাজেই ওই শহরে দু-এক রাত না কাটিয়ে কোথাও যাবার উপায় কোথায়। অগত্যা যাত্রা শুরুর আগে কলকাতায় দু’রাত অবস্থানের পর কলকাতা বিমানবন্দর হতে বেসরকারি বিমান সংস্থা ‘স্পাইস এয়ার লাইন্সে’ আন্দামানের রাজধানী বলে কথিত পোর্ট ব্লেয়ারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমাদের বহনকারী বিমান কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতের মূল ভূ-খণ্ডের বাইরে চলে গেল। নিচে তাকিয়ে দেখলাম বঙ্গোপসাগরের অথৈ পানি। অত উপর হতে দেখলাম ছোট ছোট ঢেউয়ের উপরে সূর্যের রশ্মি চিকচিক করছে। মাঝে মধ্যে সাদা মেঘগুলো বাদ সাধছে বঙ্গোপসাগর দেখা। সম্পূর্ণ সময়টাই বিমান পাড়ি দেবে বঙ্গোপসাগর।
বিমানভর্তি যাত্রী। দু-একজন ছাড়া বাকি সবাই ভারতীয়। বেশির ভাগ যাত্রী ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের তরুণ-তরুণী আর মধ্যবয়সের নারী-পুরুষ। এদের মধ্যে আমরা আট বাংলাদেশী। আমিসহ হাবিব আর অপর সঙ্গী জাকারিয়াই সপত্নীক মিসেস জাকারিয়াও ঢাকার একটি ট্রাভেল এজেন্সি ‘রিজেন্সি’-এর পরিচালক। জাকারিয়া একজন প্রকৌশলী। বর্তমানে ‘গার্মেন্ট’ ব্যবসার সাথে যুক্ত। অপর সঙ্গী ড. তানভীর পরের ফ্লাইটে আসবেন। আর দু’জন ডা. নাসরুল্লাহ এবং কামরুল একাই যোগ দিয়েছেন। যাত্রীদের কথোপকথনে মনে হলো বাংলা ভাষাভাষি যাত্রীর সংখ্যা কম। অথচ আন্দামান অঞ্চলে ৭০% বাংলা ভাষাভাষি মূলের লোকের বাস। তারপরেই রয়েছে তামিল ও ভারতের অন্য প্রান্তের মানুষ। বাদবাকি বেশ কিছু উপজাতি বা নৃগোষ্ঠী ছিল তবে বর্তমানে প্রধান ছয়টি উপজাতির তথ্য থাকলেও সাধারণত কয়েকটি প্রধান উপজাতিদের উল্লেখই রয়েছে। এর মধ্যে কার-নিকোবার দ্বীপে ‘শমপেন’ ও মধ্য এবং দক্ষিণ আন্দামানের পশ্চিম তীরের জঙ্গলে রয়েছে ‘জারওয়া’। এদেরই আরেক গ্রুপ রয়েছে ‘ওঙ্গি’ (Ongi) নামে। ‘জারওয়া’ উপজাতিদের ইতিহাস তেমন উদঘাটিত হয়নি তবে ধারণা করা হয় আফ্রিকার ‘পিগমী’ সম্প্রদায়ের কোন প্রশাখা হতে পারে। উচ্চতায় বেশি নয় গায়ের রঙ চকচকে কালো। ধারণা করা হয় বর্তমানে এই উপজাতির সংখ্যা ৩০০ হতে ৩৫০ হতে পারে। নিকোবার দ্বীপে ‘শমপেন’দের বাস। এদের চেহারা ও গায়ের রঙ ‘মঙ্গোলাইট’দের মতো। পূর্ব এশিয়ার বহুদেশের আদিবাসীদের মতো। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের এসব উপজাতি বা আদিবাসী বা নৃগোষ্ঠী এসব দ্বীপের জঙ্গলে নিজের অবস্থানেই রয়েছে। বহির্বিশ্বের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে। অপরদিকে ভারতের আইন এবং উচ্চ আদালতের রায় মোতাবেক সংরক্ষিত আদিবাসী হিসেবে এসব অঞ্চলে বহিরাগতদের এমনকি ভারতীয় নাগরিকদেরও প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র গবেষণার জন্য অনুমতি দেয়ার বিধান থাকলেও সচরাচর তেমন অনুমতিও দেয়া হয় না।
andaman7
২০১০ সালের সুনামিতে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ক্ষতি হলেও এসব আদিবাসীর তেমন ক্ষতি হয়নি। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, সুনামির আগাম আলামত, প্রাকৃতিক অনুভূতি এরাই পেয়েছিল এবং প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট থাকতে পেরেছিল। এদের আচার আচরণ ও জীবনযাত্রায় আদিম অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। সবচাইতে বড় উপজাতি গোষ্ঠী হচ্ছে ‘গ্রেট আন্দামানিজ’ তবে এরা অন্যদের চাইতে বেশি আধুনিক জীবনযাপন করে। প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়েছে বিমান কলকাতার নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস বিমানবন্দর ত্যাগ করেছে। এখনও বঙ্গোপসারের জলরাশির উপরে বিমান। নিচের পানির রঙ অনেকটা কালচে। তাইকি আন্দামানের প্রচলিত নাম ছিল ‘কালাপানি’ বা ‘কালাপানি’ মানেই কি আন্দামান? তেমন না হলেও ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির বিচারকরা অভিযুক্তদের আন্দামান জেলে অথবা নির্বাসনে পাঠাবার রায়ে ‘কালাপানির’ উল্লেখ করতেন।
কোম্পানির বাহিনীতে ভারতীয় হিন্দু উচ্চজাতের ব্রাহ্মণদের সংখ্যা ছিল বেশি। ওই সময়ে ভারতীয় উচ্চবর্ণের হিন্দুরা এক শর্তে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। আর সেটি ছিল যে তারা কখনই সমুদ্র পার করবে না। সমুদ্র মানে ‘কালাপানি’। ওই সময়ের গোঁড়াপন্থী হিন্দুদের ‘বোধায়ন শাস্ত্র’ মতে কুল নষ্ট বা জাতভ্রষ্ঠ হবার একাধিক কারণের মধ্যে সাগর বা কালাপানি পাড়ি দেয়া ছিল অন্যতম প্রধান কারণ। সাগরে চলাচল করাই মানে নিম্নজাতে পরিণত হওয়া আর নিজের জাত হতে বহিষ্কার হওয়া। শুধু তাই নয় বিশ্বাস ছিল যে ‘কালাপানি’ বা সাগর পার হলে পুনঃজন্ম হতে বিচ্যুত হবে। কারণ সমুদ্র যাওয়া মানে পবিত্র গঙ্গা নদী বিধৌত ভারত হতে বিচ্ছিন্ন হওয়া। সিন্ধু নদ পার হওয়াও ছিল কালাপানি তত্ত্বের অন্তর্গত। বৃটিশ ঔপনিবেশিকরা হিন্দু সদস্যদের ধর্মীয় সংস্কৃতি মেনে নিলেও পরে নতুন আইন করে। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীকে ‘কালাপানি’ অতিক্রমের আইনি বৈধতা দেবার প্রচেষ্টায় ১৮২৪ সালে ব্যারাকপুরে হিন্দু ব্রাহ্মণ ও উচ্চ জাতের সৈনিকরা বিদ্রোহ করেছিল। সেই ব্যারাকপুর হতেই ১৮৫৭ সালে মঙ্গলপান্ডে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।
ব্যারাকপুরের প্রথম বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে ছিল প্রথম এঙ্গলো-বার্মিজ যুদ্ধ। নভেম্বর ২, ১৮২৪ সালে ব্যারাকপুরে বেঙ্গল আর্মির ৪৭তম রেজিমেন্টকে পথম এঙ্গলো-বার্মিজ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম পাঠানোর কথা ছিল। স্থলপথে পাঠাবার ব্যবস্থা না থাকায় সমুদ্র পথে পাঠাবার নির্দেশ দেয়াতে বিদ্রোহ দেখা দেয়। উচ্চ বর্ণের হিন্দু সদস্যরা হুকুম মানতে রাজি না হয়ে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ দমনের পর ১৮৫৬ সালে জেনারেল সার্ভিস এস্টাবলিস্টম্যান্ট অ্যাক্ট ১৮৫৬ প্রবর্তন করে সমুদ্র যাত্রা বাধ্যতামূলক করা হলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী সিপাহীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন ১৮৫৭ সালের ব্যাপক বিদ্রোহের অন্তর্নিহিত কারণের অন্যতম কারণ ছিল কথিত আইন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে বেশির ভাগ হিন্দু সিপাহীরা নিজেদের ধর্ম আর জাত বাঁচাতে যোগ দিয়েছিল। বিদ্রোহের অন্যান্য কারণের সাথে যুক্ত হয়েছিল ‘দমদম’ বুলেটের প্রবর্তন। গুজব রটেছিল যে ওই কার্তুজে শুকর এবং গরুর চর্বি ব্যবহার করা হয়েছিল আর কর্তুজ রাইফেলে ভরতে দাঁত দিয়ে অগ্রাংশ ছিঁড়তে হতো। এই ছিল কালাপানির ইতিহাস। পরে অবশ্য হিন্দুবাদের এই তত্ত্ব তেমন টেকেনি। তাও অনেক পরের কথা। বিংশ শতাব্দীর কথা। তবে এখনও ভারতের অনেক প্রান্তের মন্দিরে যারা ‘কালাপানি’ তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না এমন ব্রাহ্মণকে পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় না। দক্ষিণ ভারতের ত্রিপুতি মন্দির এমনই একটি।
andaman-port-blair
প্রায় দু’ঘণ্টা পর দৃশ্যমান হলো আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। মেঘমুক্ত আকাশ তাই বিমানের জানালা দিয়ে দেখলাম চারদিকে সাগরের গাঢ় নীল জলরাশির মধ্যে বড় ছোট সবুজ দ্বীপগুলো। আরও কিছুক্ষণ পর ক্রমেই ভেসে উঠল আন্দামান-নিকোবার জেলার সবচাইতে বড় শহর ‘পোর্ট ব্লেয়ার’। ছোট ছোট পাথুরে পাহাড় আর জঙ্গলে ঢাকা সবচাইতে বড় দ্বীপ আন্দামান উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি এবং কয়েক ভাগে বিভক্ত। উত্তর, মধ্য আর গ্রেট আন্দামান।
আন্দামান-নিকোবার দীপপুঞ্জে ছোট বড় মিলিয়ে রয়েছে প্রায় ৩৭২টি দ্বীপ। এর বেশির ভাগ ছোট ছোট কোরাল দ্বীপ। এসব প্রায় দ্বীপে জনবসিতও তেমন নেই। এখানে বর্তমানে ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে উপজাতীয় ছাড়া প্রায় শতভাগ বসতিস্থাপনকারী যার মধ্যে ১৯৪৭ আর ১৯৭১ সালের পরে বসতিস্থাপনকারীদের মধ্যে পূর্ব বাংলার এবং তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ মূলের বাঙালিই সংখ্যাধিক্য। আন্দামান-নিকোবারে একটিমাত্র লোকসভার আসন রয়েছে যার বর্তমান সংসদ সদস্য পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষাভাষি ভারতীয় জনতা পার্টির বিষ্ণুপদ রায়। তিনি ১৯৯৯ হতে নিরবচ্ছিন্নভাবে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। ইউনিয়ন টেরিটোরি হিসেবে সরাসরি কেন্দ্র হতে শাসিত হয় একজন লেফটেনেন্ট গভর্নরের মাধ্যমে।
নিকোবার দ্বীপের সর্বদক্ষিণে ‘ইন্দিরা পয়েন্ট’ ভারতের সর্বদক্ষিণে স্থলভূমি। বর্তমানে নিকোবারে রয়েছে ভারতের একমাত্র যৌথ কমান্ড সদর যার নেতৃত্বে রয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী। সম্পূর্ণ দ্বীপপুঞ্জ ভারতের ভূ-কৌশলগত দৃষ্টিকোণ হতে অত্যন্ত সংবেদনশীল অঞ্চল। রয়েছে কৌশলগত দিক হতে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি।
andaman-indira-point
অবশেষে আমাদের বহনকারী বিমান ভীর সাভারকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলো। বাকি এম্বোস টুকু হেঁটেই পার হতে হলো। হাঁটতে হাঁটতে দেখে মনে হলো বিমানবন্দরটি নামেই আন্তর্জাতিক তবে এখানে সে চরিত্র পায়নি। এখনও অভ্যন্তরীণ রুটের বিমানই চলাচল করে এখান পর্যন্ত। তবে বিমানবন্দরটির সামরিক গুরুত্ব রয়েছে অনেক। সামরিক কৌশলগত দিক হতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যার কিছু উল্লেখ আগেই করেছি। বিমানবন্দরে বেশ কিছু সামরিক হেলিকপ্টার এবং সামরিক পরিবহন বিমানের উপস্থিতি তেমন বলে।
আগেই বলেছি এতদঞ্চলে ভারতের একমাত্র যৌথ কমান্ড হেডকোয়ার্টার রয়েছে যে কারণে বিমানবন্দরটি ভারতীয় নৌবাহিনীর আইএনএস উৎকর্ষ হিসেবে বিবেচিত। তবে বেসামরিক বিমানবন্দরটি নামকরণ করা হয়েছে বিংশ শতাব্দীর দক্ষিণ ভারতের মহারাষ্ট্রের তৎকালীন হিন্দুবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী নেতা ভিনায়ক দামোদর সাভারকার-এর নামে। ভিনায়ক দামোদর সাভারকার আন্দামানের সেলুলার জেলের সবচাইতে আলোচিত, বিতর্কিত ও আলোকিত দুই দণ্ডে ৫০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত রাজবন্দি। আরও পরে সাভারকারকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
বিমানবন্দরটি মাঝারি গোছের। রানওয়ের একপ্রান্তে সুউচ্চ পাহাড় থাকায় রানওয়ের এক প্রান্ত হতে বিমান উঠানামা করে। বিমানবন্দরের একাংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার অধীন। তবে সার্বিক নিরাপত্তা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর দায়িত্বে।
আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারের বিমানবন্দরটি দক্ষিণ আন্দামানে। উত্তরে উত্তর আন্দামান আর ছোট ল্যান্ডফল দ্বীপ ভূ-কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোকো চ্যানেলদ্বারা বিভক্ত। আন্দামান দ্বীপটিই এই দ্বীপপুঞ্জের সবচাইতে বড় দ্বীপ। দ্বীপটিতে আদিবাসী ব্যতীত প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের বাস। ১৯৬০ পর্যন্ত মাত্র ৫০ হাজার মানুষের বাস ছিল। আন্দামান দ্বীপটি উত্তর দক্ষিণে একটি মহাসড়কদ্বারা যুক্ত। অন্যান্য দ্বীপে তেমন রাস্তাঘাট নেই। দ্বীপগুলোর মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম জলযান; যার বেশির ভাগ বেসরকারি বাণিজ্যিক সংস্থার। তবে সরকারি পরিবহনও রয়েছে। আন্দামান সাগরের পূর্বদিকে মায়ানমারের দক্ষিণাংশ। সিতওয়ে বা পুরাতন আকিয়াব হতে মাত্র ৯৩৪ কিলোমিটার দূরত্বে। এ অঞ্চল হতে অতি সন্নিকটে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌচলাচল রুট মালাকা প্রণালী।
আমরা টার্মিনাল ভবনে প্রবেশ করলে সামনে বোর্ডে দেখলাম লেখা রয়েছে বিদেশীদের জন্য ইমিগ্রেশনের নির্দিষ্টস্থান। আমরা খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। কারণ যেহেতু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাজেই বিদেশী বলতে আমাদের মনে হয়েছিল যারা সরাসরি এখানে আসেন। যেহেতু আমরা অভ্যন্তরীণ রুটে এসেছি কাজেই হয়তো আমাদের জন্য এখানকার ইমিগ্রেশন প্রযোজ্য নয়। সে ভুল ভাঙতে আমাদের বেশি সময় লাগেনি; তবে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। যাই হোক আমরা আমাদের লাগেজ নিয়ে সরাসরি ছোট নন-এসি টার্মিনাল ভবনের বাইরে বের হয়ে আসলাম। টার্মিনাল থেকে বের হতেই আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে দেখলাম ট্যুর অপারেটরের প্রতিনিধি। আমাদের জন্য মাঝারি ধরনের বাস। দেখলাম ওই ট্যুরে আরও সফরসঙ্গী রয়েছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের। তবে বেশির ভাগই নবদম্পত্তি। এবং দক্ষিণ এবং উত্তর ভারতের। আরও পরে উপলব্ধি করলাম বেশির ভাগ নববিবাহিত দম্পত্তি মধুচন্দ্রিমায় এসেছিল। আমরা উঠব ‘সি সেল’ নামক হোটেলে। গাড়ি আমাদের নিয়ে চললো হোটেলের পথে। রাস্তাগুলো মোটামুটি। প্রায় পাহাড়ি পথ। চারদিকে প্রচুর নারকেল বাগান। রয়েছে প্রচুর চেনা-অচেনা গাছ। দোকানপাটগুলো আহামরি তেমন কিছু নয়। বাড়িঘরগুলো বেশিরভাগই টিনের দোচালা। আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে পোর্ট ব্লেয়ার বাজার পার হয়ে প্রায় কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে মধ্যমানের হোটেলে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর প্রায় ১২টা। হোটেলের আশপাশে কিছু বসতবাড়ি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো বাড়িঘরগুলো বেশ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের। এদিকটায় লোকজনের চলাচল বেশ কম।
হোটেলে প্রবেশের পরপরই পড়লাম বিড়ম্বনায়। হোটেল কর্তৃপক্ষ জানালো, যেহেতু আন্দামান ভ্রমণের পারমিট আমরা নিইনি তাই হোটেলে বুকিং থাকা সত্ত্বেও আমাদের রুম দিতে পারছে না। আমরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। অভ্যর্থনা কেন্দ্রে আমাদের কথা শুনে এক তরুণ কর্মকর্তা বাংলায় বললেন, বিমানবন্দরে পৌঁছে আমাদের ইমিগ্রেশন হতে পারমিট সংগ্রহ করার কথা যা আমরা ভুলবশত করিনি। এর কারণ আগেই বলেছি। বিদেশী হিসেবে আমাদের তেমনটা করার কথা ছিল। ভারতীয় ভিসা থাকলেও যেহেতু সম্পূর্ণ দ্বীপপুঞ্জ সংরক্ষিত এলাকা তাই পুনঃরেজিস্ট্রেশন আবশ্যকীয়। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ৫৭২টি দ্বীপই সংরক্ষিত এলাকা। সব দ্বীপ বিদেশী এমনকি ভারতীয় নাগরিকদের জন্যে উন্মুক্ত নয়। শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তব্যে নিয়োজিত সদস্যদের ছাড়া সবার জন্যে সর্বত্র উন্মুক্ত নয়। এমন বিষয়টি আমাদের ট্যুর অপারেটররাও জানায়নি। এমনকি আমাদের মাথায়ও আসেনি। অগত্যা আর কি করা। আমরা সবাই মিলে পুনরায় গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরে রওয়ানা হলাম। সাথে ট্যুর অপারেটর।
বিমানবন্দরের বাইরে দাঁড়াতে হলো কারণ একবার টার্মিনাল হতে বের হওয়ার পর পুনরায় বহির্গমনের উদ্দেশ্য ছাড়া প্রবেশ সম্ভব নয়। অবশেষে বহু আকুতি মিনতির পর একজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার কৃপা হলো। তিনি বাইরে এসে আমাদের সবাইকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোকের পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন নোয়াখালীর বাসিন্দা। তিনি জানালেন, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর পূর্ববাংলার উদ্বাস্তু হিসেবে ভারত সরকারের মাধ্যমে তাদের পরিবার আন্দামানে বসতি স্থাপন করে। তিনি জানালেন এখানের প্রায় ষাট ভাগ বাংলা ভাষাভাষি জনসংখ্যা পূর্ববাংলার, বর্তমানে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু। ভারত সরকার এখানে বসতির জন্যে প্রত্যেক পরিবারকে জঙ্গল পাহাড় আর কৃষিজমি মিলিয়ে তিরিশ একর করে জমি বরাদ্দ দিয়েছিল। ভারত সরকারের এ ব্যবস্থাপনায় অনেক পরিবার বিভিন্ন দ্বীপে বসতি গেড়েছে। অনাবাদি জমিতে এখন সুপারি আর নারকেলসহ অন্যান্য ফলফলাদির বাগান তৈরি করা হয়েছে। আরও পরে পশ্চিম বাংলা হতেও অনেকেই স্থায়ী অথবা অস্থায়ীভাবে বসবাস করতে অথবা চাকরি সূত্রে বসবাস করছে এই দ্বীপপুঞ্জে। তিনি আরও জানালেন সচরাচর বাংলাদেশি পর্যটকদের দেখা পান না। এক সাথে এতজন বাংলাদেশি দেখে তিনি বেশ আনন্দিত।
andaman-road
আমরা প্রত্যেকই দু’পাতার একটি নির্ধারিত ফরম পূরণ করে জমা দেবার পর ওই কর্মকর্তার সহায়তায় ইমিগ্রেশন শেষ করলাম। আমাদের প্রত্যেককে ৩০ দিনের পারমিট দেয়া হলো। পারমিটে প্রায় ২০টির মতো দ্বীপের নাম দেয়া রয়েছে যেখানে পর্যটক হিসেবে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে। তবে এগুলোর মধ্য অনেকটাতে তীরে না নেমে জলযান হতে অবলোকন করার কথা উল্লেখ থাকাতে মনে হলো যে ওইসব জায়গাগুলো অবশ্যই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হবে। ওই তালিকায় নিকোবারের উল্লেখ নেই। নেই কার নিকোবার অথবা সর্বদক্ষিণের ইন্দিরা পয়েন্টের। ভদ্রলোক আমাদের আরও জানালেন, এরপর আমাদের সফরসূচিতে যে দ্বীপগুলো রয়েছে তার প্রত্যেকটিতে পৌঁছানোর পর সেখানে প্রবেশের এবং দ্বীপ ছাড়বার সময় পারমিটের বিপরীতে নাম তালিকাভুক্ত এবং কাটাতে হবে। সাথে অবশ্যই পাসপোর্ট দেখাতে হবে কাজেই পাসপোর্ট সব সময়ের জন্যেই হাতের কাছে রাখতে হবে। এ যেন দেশের ভিতরে দেশ। এরকম ব্যবস্থা ভারতের বহু অঞ্চলের জন্যে রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর বহু জায়গায় পর্যটকদের বিশেষ অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ যেমন অরুণাচল, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিক্কিম এবং লাদ্দাকের কথাই তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ল। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন ব্যবহার প্রয়াশই আমাদের দেশে এক ধরনের ঝড় বয়ে গিয়েছিল।
আমরা ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পুনরায় হোটেলের পথে রওয়ানা হলাম। অনেকটা সময় নষ্ট হলো আমাদেরই কারণে। আমাদের নির্বুদ্ধিতার জন্যে নিজেদের দোষারোপ করা ছাড়া আর কীইবা করার ছিল। স্বগোতিকভাবে বললাম এখানে আমাদের দোষটাই বেশি তবে ট্যুর অপারেটরের উচিত ছিল আমাদের আগাম সতর্ক করার। যাই হোক দ্বীপ ছাড়ার পথে ইমিগ্রেশন হয়ে পারমিট জমা দিয়ে বহির্গমন করতে হবে। সে কারণেই পারমিটটি বিমানবন্দর পার হওয়া পর্যন্ত সাবধানে রাখতে হবে। পুনরায় যখন হোটেলে পৌঁছলাম তখন প্রায় দুটো বেজে গেছে। ট্যুর অপারেটর জানালেন যে মধ্যহ্ন ভোজের পর সাড়ে তিনটায় আমাদের প্রথমে পোর্ট ব্লেয়ার শহরের কেন্দ্রের সব চাইতে উঁচু স্থানে স্থিত ঐতিহাসিক স্থাপনা সেল্যুলার জেল দেখাতে নিয়ে যাবে। পরে পোর্ট ব্লেয়ারের ছোট সমুদ্রতট এবং সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আবার সেলুলার জেলের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো-তে নিয়ে যাবে। এবারই দেখলাম আমাদের ওই হোটেলে আরও আটজন আমাদের গ্রুপে যুক্ত হয়েছে। এরা সবাই সদ্য বিবাহিত মধুচন্দ্রিমা উদযাপনের জন্যে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জকেই বেছে নিয়েছে। অবশ্য আমাদের এখানে আসবার প্রধান আকর্ষণ ছিল সেলুলার জেল দেখা যে স্থাপনা উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
দুপুরের খাবার বেশ তড়িঘড়ি করে শষ করে গাড়িতে উঠলাম। গন্তব্য সেলুলার জেল। দর্শনার্থীদের জন্যে সেলুলার জেল উন্মুক্ত থাকে সকাল ১০টা হতে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। সেলুলার জেল বিকাল ৬টায় সাময়িকভাবে খালি করা হয় সন্ধ্যায় পর্যটকদের জন্যে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ শো’র প্রস্তুতির জন্যে। সেলুলার জেলে মোটামুটি হিন্দিতেই ধারাভাষ্যসহকারে এই জেলের তথা আন্দামান আর কালাপানির ইতিহাসের ধারা বিবরণ দেয়া হয়।
আমরা শহরে প্রবেশ করলাম। এই পুরো দ্বীপপুঞ্জের বহু জায়গা তথা দ্বীপের নাম বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসক ও সামরিক নেতাদের নামে এখনও বিদ্যমান। স্বাধীন ভারতের ৬০ বছর অতিবাহিত হলেও এখনও কোনো নাম বদল হয়নি। হয়তো হবেও না কারণ ইতিহাস ইতিহাসের জায়গাতেই রাখতে চায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এখনও ভারতের বড় বড় শহরের রাস্তাঘাটের নামও তেমন পরিবর্তন হয়নি। আমরা কিছুক্ষণের জন্যে পোর্ট ব্লেয়ার শহরের স্টেডিয়ামের পাশে থামলাম সামনে একটি এক্যুরিয়াম মিউজিয়াম দেখতে। অল্প সময়ের দেখবার কথা। নামলাম পোর্ট ব্লেয়ারের স্টেডিয়ামের এক পাশে। সামনে উঁচু টিলা। সর্বোচ্চ জায়গা। সাইনবোর্ডে সেলুলার জেলের দিক নির্দেশনা। শহরে বেশ কিছু যানবাহন। বেশির ভাগ প্রাইভেট কার আর বড় বাসস্ট্যান্ড। বাসস্ট্যান্ড হতে উত্তর-দক্ষিণে বাস চলাচল করে তবে সেগুলো আন্দামান দ্বীপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখানে রয়েছে বড় ধরনের বন্দর যেখানে প্রতিদিন একাধিক কনটেইনার ও যাত্রীবাহী জাহাজ যাতায়াত করে। মূল ভূখণ্ডের সাথে পণ্য এবং যাত্রী বহনের জন্য প্রধানত সমুদ্র পথই ব্যবহার হয়ে থাকে। স্থানীয়দের জন্য সরকারি বিমান সংস্থা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স মূল ভূখণ্ডে যাতায়াতের জন্য ভতুর্কিতে টিকিট দিয়ে থাকে।
andaman-port-blair2
পোর্ট ব্লেয়ার একাধারে আন্দামান জেলাসদর, মহকুমা এবং মিউনিসিপ্যালিটি। ২০১০ সালের সুনামিতে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলেও তা কাটিয়ে উঠেছে পাঁচ বছরের মাথায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে গড়পড়তা ৫২ ফুট উচ্চতায়। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী প্রায় লক্ষাধিক লোকের বাস এই শহরে। এখানে প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত যা ভারতের যে কোনো অঞ্চল হতে বেশি। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি সামরিক স্থাপনা। পোর্ট ব্লেয়ারের অদূরে পূর্বপাশে রয়েছে নেভীর এক স্থাপনা ‘আইএনএস জরওয়া’। রয়েছে বিমানবাহিনীর ঘাঁটি আর ভারতীয় কোস্টগার্ডের পূর্বপ্রান্তের সদর।
এখানে বৃটিশ উপনিবেশ স্থাপিত হয় ১৭৮৯ খৃষ্টাব্দে বেঙ্গল সরকারের অধীনে। এ জায়গাটিতে প্রথম অবতরণ করেন বৃটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির সার্ভেয়ার লেফটেনেন্ট আর্কিবল্ড ব্লেয়ার। ওই সময়ে নিকোবার ছিল ডাচ্ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির কলোনি। সেই থেকে এই জায়গার নাম পোর্ট ব্লেয়ার। প্রথমে অদূরের চেথাম দ্বীপে সর্বপ্রথম স্থাপিত হয় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের জন্যে অন্তরীণের স্থান। ওই সময় রাখা হতো উন্মুক্ত জেলে। আরও পরে উত্তরে এডমিরাল উইলিয়াম কর্নওয়ালিশকে এখানে পাঠানো হলে তার সদর স্থাপিত হয় উইলিয়াম নামক বন্দরে। তবে ম্যালেরিয়াসহ অন্য রোগের প্রকোপের কারণে পুনরায় পোর্ট ব্লেয়ারে সদর স্থানান্তর করা হয়। পরে বন্দর উইলিয়াম শুধুমাত্র সামরিক বন্দর হিসেবে ব্যবহার হয়। প্রথম এঙ্গলো-বার্মা যুদ্ধে ১৮২৪ সালে। বহুবার স্থানীয় উপজাতি দ্বারা আক্রান্ত হয় পোর্ট উইলিয়ামের ইংরেজ শাসক ও তাদের দোসররা। অবশেষে ১৮৫৫ সালে বৃটিশ সরকার পোর্ট ব্লেয়ারে বসতি গড়ে তোলে। স্থাপিত হয় ‘কালপানি’ শাস্তিভুক্তদের জন্যে উন্মুক্ত জেল। আরও পরের দিকে পোর্ট ব্লেয়ারের সবচাইতে উঁচু স্থানে বৃহৎ আকারের জেল তৈরির কাজে হাত দেয়া হয়। যার স্থাপনার আকৃতির কারণে নাম রাখা হয় সেলুলার জেল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় জেল স্থাপনার কাজ বন্ধ হলেও আন্দামানের এই অঞ্চলকে উন্মুক্ত জেল কলোনি হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর হাজার হাজার ভারতবাসীকে এখানে দেশান্তর করে কলোনি তৈরি করা হয়। এসব ভাগ্যহতরা যাবজ্জীবনের জন্যে রয়ে যায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপাঞ্চলে। এখান থেকে পালানোর পথ ছিল দুর্গম। চারদিকে সমুদ্র। তার পরেও অনেকে পালানোর পথ ধরলেও কেউ মূল ভূখণ্ডে পৌঁছতে পারেনি। আন্দামান হতে বহু সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াতে হয়। তবে এখানে কত লোককে ফাঁসি দেয়া হয়েছে তার সঠিক তথ্য কখনই পাওয়া যায়নি। সমুদ্র পার হয়ে পালাতে গিয়ে বহু কয়েদির সলিল সমাধিও হয়। আরও পরে ছোট দ্বীপ ভাইপারে, ব্লেয়ারের জাহাজের নামে নামাঙ্কিত, প্রথম জেল তৈরি করা হয়। তৈরি করা হয় আরেকটি জেল অদূরের দ্বীপ রস-এ। আরও পরে যখন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে স্বাধীনতা সংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করে সে সময়, ১৮৯৬-১৯০৬ সালের মধ্যে পোর্ট ব্লেয়ার তৈরি হয় এক দুর্ভেদ্য কুখ্যাত সেলুলার জেল। যার একাংশ এখন ভারতের স্বাধীনতার জাতীয় স্মারক। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসেন এই জেল দেখবার জন্যে। আমরাও তাদের মধ্যে সামিল হতে যাচ্ছি।
কিছুক্ষণ এক্যুরিয়াম মিউজিয়ামে কাটাবার পর আমরা রওয়ানা হলাম সেলুলার জেলের উদ্দেশে। বাসটি ক্রমেই বেশ উপরে উঠছে। নিচে তাকিয়ে দেখলাম পোর্ট ব্লেয়ারের ছোট সমুদ্র সৈকত। এমন নীল রঙের জলরাশি ইতিপূর্বে দেখিনি। সমুদ্র সৈকতের পাশে ফেরিঘাট আর পর্যটকদের সামুদ্রিক বিনোদনের জন্যে রয়েছে স্পিডবোট, ওয়াটার স্কুটার আর স্পোর্টস বোট। নিচের রাস্তায় প্রচুর যানবাহন। পোর্ট ব্লেয়ার শহরটি খুব একটা বড় নয়। আমাদের দেশের জেলা শহরের মতো তবে বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আন্দামান যে এতো সুন্দর আর পর্যটনের জায়গা তা এখানে না আসার আগে আন্দাজ করতে পারিনি। শুধু পর্যটনেরই নয় মনে হলো ভারতে অন্যতম মধুচন্দ্রিমা যাপনের জায়গা আন্দামান। আমার সামনে বসা দুই জোড়া সদ্য বিবাহিত যুগল। পরিচয় হলো এক যুগলের সাথে। চেন্নাই হতে এসেছে মেকমাই ট্রিপ-এর মাধ্যমে। হিন্দি মোটেও বুঝে না বলতেও পারে না। দু’জনই সফটওয়ার কোম্পানিতে চাকরি করেন। অন্য আরেক যুগল এসেছে উত্তরপ্রদেশ থেকে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম ভারতের এতো জায়গা থাকতে এখানে কেন? ওদের উত্তর ছিল যে এখানে যে ধরনের ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা হয়েছে তা অন্য কোথাও নেই।
andaman-sea-walk
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে অন্যতম পর্যটন দ্বীপ হ্যাভলকে রয়েছে এশিয়ার দ্বিতীয় সমুদ্রের তলদেশে হাঁটবার (See walk) ব্যবস্থা। এসব তরুণ যুগলের অন্যতম আকর্ষণ ওইসব এডভেঞ্চার। আগামী দিন আমাদের হ্যাভলকে যাওয়ার কথা। এ যাত্রায় আমরা আন্দামান ছাড়াও হ্যাভলক আর নেইল দ্বীপে দু’রাত কাটাবার পরফিরব পোর্ট ব্লেয়ারে। প্রথম রাত আমরা এই শহরেই কাটাবো। হিলটপে পৌঁছলাম। গেটের সামনে বিটুমিনের বড় ধরনের খোলা চত্বর। আমরা বাস থেকে নামলাম। ইতিমধ্যেই আরও কয়েকটি বাস পর্যটকদের নিয়ে আগেই এসেছিল। সামনেই দোতলা বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলের তৈরি লম্বা ব্যারাকমতো দোতালা দালান। এই ব্যারাকসম দোতালা দালানটি ছিল এই জেলের সব ধরনের দপ্তর। মাঝখানে প্রধান ফটক। ফটকের দু’পাশে হলুদ রঙের দু’টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নতুন করে সংরক্ষিত। প্রধান ফটকের উপরের আর্চে লিখা রয়েছে কারাগারের নাম, সেলুলার জেল (ঈবষষঁষবৎ লধরষ)। মাঝখানে হিন্দিতেও নাম লেখা রয়েছে। একটি টাওয়ারের নিচের অংশে ইংরেজিতে লেখা ‘ন্যাশনাল মেমোরিয়াল’ (ঘধঃরড়হধষ গবসড়ৎরধষ)। একইভাবে অপর টাওয়ারে হিন্দিতে কথাগুলো লেখা রয়েছে। প্রবেশ পথের দু’ধারে কালো ফলকে হিন্দি ও ইংরেজিতে সেলুলার জেলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা রয়েছে। জেলে প্রবেশের জন্যে মূল্য আগেই দেয়া রয়েছে, কাজেই টিকিটের জন্য দাঁড়াতে হলো না। এই জেলটি তৈরি হয়েছিল ১৮৯৬ হতে ১৯০৬ সালের মধ্যে। যেমনটা আগেই বলেছি যে প্রথমে বিভিন্ন দ্বীপে ছোট ছোট জেল থাকলেও আন্দামানে ১৮৫৭ সালের পর হতে ‘সিপাহী বিদ্রোহে’ অংশগ্রহণকারী অভিযুক্তদের প্রায় খোলা অবস্থায় রায় হতো। পরে অনেককে এখানে স্থানান্তর করা হয়।
সেলুলার জেলটির স্থাপত্যে বৈশিষ্ট্য ছিল, যে কারণে এই কারাগারের নাম সেলুলার জেল। ছয়টি লম্বালম্বি উইং ছিল। মাঝখানে সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। প্রত্যেকটি উইং দেখলে মনে হতো টাওয়ার হতে শুরু হয়ে সাইকেলের চাকার রূপ ধারণ করেছে। উইংগুলো এমনভাবে তৈরি ছিল যাতে এক উইংয়ের কয়েদিরা সামনের উইংয়ের কয়েদিদের দেখতে না পারে। কোনো উইংই মুখোমুখি ছিল না। বর্তমানে দু’টি উইংয়ের অর্ধেকাংশ এবং মধ্যের বা সেন্ট্রাল টারটিসহ সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এই সেলুলার জেলে ৬৯৩টি কক্ষ ছিল যার প্রতিটির মাপ ১৩.৫ বাই ৭.৫ ফুট। সামনে লোহার গারদের দরজা আর প্রায় ৯ ফুট উপরে ছোট একটি ভেন্টিলেটর। পুরু পাথর এবং ইটের দেওয়াল। এই জেল তৈরি করতে ইট, পাথর এবং যাবতীয় সরঞ্জাম আনা হয়েছিল তৎকালীন বার্মা বর্তমান মিয়ানমার থেকে। প্রতি তলায় লম্বা বারান্দা।
আমরা প্রবেশ করলাম পাশের অন্য একটি ফটক দিয়ে। ভিতরে প্রচুর দর্শনার্থী। সামনে একটি বেদি যার উপরে প্রায় পাঁচশত চেয়ার পাতা। এগুলো রাতের ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ শো-এর জন্যে রাখা হয়েছে। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই প্রথম শো শুরু হবে। তাতে তুলে ধরা হবে এই জেলের ইতিহাস রঙিন আলো আর আঁধারের সমন্বয়ে। রঙিন আলো আর আঁধারের সমন্বয়ে ধারা বর্ণনার মাধ্যমে তুলে ধরা হবে সেলুলার জেলের ইতিহাস। প্রবেশের মুখে বহু পুরাতন একটি পাকুর গাছ। গাছটি অনেক পুরাতন। তথ্যে প্রকাশ এ গাছটি জেল তৈরির পূর্বেই এখানে ছিল। পাহাড়ের চূড়া কেটে সমান করে এখানে এই জেল তৈরি করা হয়েছিল। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এখানে হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে এই কুখ্যাত জেলটি ভেঙে ফেলবার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পরে স্বাধীনতা সেনানী এবং প্রাক্তন বন্দীদের প্রতিবাদের মুখে নেহেরু সরকার বাধ্য হয় দুটি উইং স্মারক হিসেবে রেখে দিতে। আরও বহু পরে এর সংস্কার করে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে আসা হয়। ১৯৬৩ সালে এখানকার এক প্রান্তে ৫০০ শয্যার গোন্দি বল্লব পান্ত হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানে হাসপাতালের চৌহদ্দি হতে জেলের এ অংশ আলাদা রয়েছে।
আমরা ধীর কদমে সামনের দিকে হাঁটছিলাম। বিদ্যমান দুই উইং-এর মাঝে সুন্দর করে দুটো ঘাসের চত্বর। তার মাঝখানে টিনের চালার একটি ব্যারাক। মনে হলো নতুন করে তৈরি। হাতের বাঁয়ে ছোট দুটি টিনের চালার ঘর। প্রথমে ছোট ঘর দুটির সামনে পৌঁছলাম। তথ্যফলকে লেখা রয়েছে এ জায়গাটি ছিল ফাঁসি কাষ্ঠ। ভেতরে তিনটি ফাঁসির মঞ্চ। নিচে ফাঁসিতে লটকানোর জায়গা। এখানেই অনেক বিপ্লবীকে মাঝরাতে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। ফাঁসি দেয়ার আগ মুহূর্তে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হতে মধ্যরাতে পাগলা ঘণ্টা বাজানো হতো। জেগে উঠতো সব কয়েদি। যদিও বারান্দায় দাঁড়াবার উপায় ছিল না। তবে নিজ নিজ সেল হতে ঘণ্টার আওয়াজে বুঝতে পারত যে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। ফাঁসি কার্যকর হলে পাগলা ঘণ্টা থেমে যেত। সন্নিকটের উইং-এর নিচ তলায় ছিল কনডেম সেল, যেগুলো আজও চিহ্নিত রয়েছে। পাগলা ঘণ্টা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সেলগুলো হতে আওয়াজ উঠতো ‘ইনকেলাব জিন্দাবাদ’।
andaman-cellular-jail
ফাঁসির মঞ্চের বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। মনে হলো কানে বাজছে বিপ্লবীদের ধ্বনি ‘ইনকেলাব জিন্দাবাদ’। কত লোকের ফাঁসি হয়েছে তার সঠিক তথ্য এখানে নেই। তবে ধারণা করা হয় যে প্রায় পাঁচশ’ বিপ্লবীকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল এই সেলুলার জেলে। এদের মরদেহ বস্তায় ভরে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হতো। সে সব ভয়াবহ স্মৃতি আর দুর্বিসহ যন্ত্রণা নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে ফাঁসির মঞ্চগুলো। আমাদের কারও মুখে রা নেই। আমাদের গাইড নিয়ে আসলেন সবুজ বাগানের মাঝের ব্যারাকসম জায়গায়। ভেতরে বিভিন্ন স্তরে দেখানো হয়েছে কয়েদিদের কিভাবে নির্যাতন করা হতো। তেলের ঘানি টানতে দেয়া হতো। নারিকেল ছুলে তেল বের করতে হতো, নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। অন্যথায় চলতো বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার। একাংশে ছোটখাট জাদুঘর; যেখানে বেশ কিছু দুর্লভ দ্রব্যাদি রাখা রয়েছে। রয়েছে হাতের ও পায়ের বেড়ি এবং শিকল, কয়েদিদের পোশাক, কিছু বইপত্র, ইত্যাদি।
জাদুঘর থেকে বের হয়ে তিনতলার একটি সেলে ঢুকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম কিভাবে কত কষ্টে জীবন কাটিয়েছিলেন বিপ্লবীরা। এক প্রান্তে একটি সেল বেশ আলাদা করে সংরক্ষিত। তথ্যে প্রকাশ এখানেই যাবজ্জীবন সাজায় অন্তরীণ ছিলেন দক্ষিণ ভারতের মহারাষ্ট্রের কবি, দার্শনিক ও বিপ্লবী রাজনীতিবিদ ভিনায়ক দামোদর সাভারকার। তার সেলটি এখন তীর্থস্থান। অনেক দক্ষিণ ভারতীয় পর্যটকরা আসেন এখানে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অর্ঘ্য চড়াতে। এখনও ওই সেলের সামনে ছোটখাট ভিড়।
আমাদের সফরসঙ্গীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে যার মতো করে ঘুরছেন। আমি তিনতলার বারান্দা দিয়ে চলে আসলাম মধ্য টাওয়ারে। প্রতিটি তলার বারান্দার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল টাওয়ারের। প্রায় পাঁচতলা সম এই পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। বেশ সংস্কার করে রাখা হয়েছে। সর্বোচ্চ তলায় পর্যবেক্ষণ চৌকি। তার ওপরে পিতলের বিশাল আকারের পাগলা ঘণ্টা ছিল। সুউচ্চ স্থান হতে দিনের বেলায় চারদিকে পরিষ্কার দেখা যায়। পাশেই আন্দামান সাগরের নীলপানি সাক্ষী হয়ে রয়েছে সেলুলার জেলের। এখানে আলাদাভাবে জেটি ছিল মূল ভূখণ্ডের কয়েদিদের অবতরণের জন্য।
টাওয়ারের দেয়ালে অনেকগুলো ফলক। প্রতিটির মধ্যে বহু বিপ্লবীর নামাঙ্কিত, যাদের এখানে রাখা হয়েছিল। তবে সবার তথ্য পাওয়া যায়নি। তথ্য ফলকগুলো যে সম্পন্ন নয় তা ফলকেই স্বীকার করা হয়েছে। বহু বাঙালি বিপ্লবীর নাম রয়েছে এখানে, যারা ‘অনুশীলন’ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বেশির ভাগই কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম আর বর্ধমানের বাসিন্দা। অনেকে ছিলেন আসামের বিপ্লবী। ‘অনুশীলন সমিতি’ ছিল বাংলার বৃটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী গোষ্ঠীর সংস্থা। এরা বঙ্কিম চন্দ্রের আদের্শ পালিত ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এ গোষ্ঠীর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বাংলা আর আসামে। প্রথমে কলকাতা পরে ঢাকা ছিল ‘অনুশীলন সমিতির’ শক্ত ঘাঁটি। ‘অনুশীলন সমিতি’ হতেই জন্ম নিয়েছিল ‘যুগান্তর’ সংগঠন। অনুশীলনের মতো যুগান্তরও ছিল সক্রিয় বিপ্লবী সংগঠন। এই দুই সংগঠনের অনেকের ফাঁসিও হয়েছিল এই সেলুলার জেলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সাধারণ ক্ষমায় এদের অনেকে মুক্তি পেয়ে যুক্ত হয়েছিলেন গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে। যুক্ত হয়েছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া, এমএন রায়ের রেডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে নেতাজী সুভাষ বোসের ‘ফরওয়ার্ড ব্লকে’।
যুগান্তর গোষ্ঠীতে বহু বিখ্যাত বিপ্লবীদের সমাবেশ ঘটে। যার মধ্যে ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, বাঘা যতিন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দার, বসন্ত কুমার বিশ্বাস, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী, কল্পনা দত্ত জোশিসহ আরও অনেকে। যুগান্তরের অন্যতম বিখ্যাত বিপ্লবী ছিলেন খুদিরাম বসু। অপরদিকে ঢাকার ‘অনুশীলন সমিতির’ বিপ্লবীদের মধ্যে ছিলেন মাখন লাল সেন, যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, অতি বিখ্যাত বিপ্লবী পুলিন দাশ, শিবদাস ঘোষ এবং নিহার মুখার্জি প্রমুখ। যতিম চন্দ্র বাসু ছিলেন অনুশীলন সমিতির স্থপতি। ১৯০২ সালে অনুশীলন সমিতির জন্ম হয়েছিল। আজ হয়তো এদের কথা কেউ স্মরণ করেন না।
এই জেলে অন্তরীণ ছিলেন ভিনায়ক সাভারকারের আরেক ভাই বাবারাও সাভারকার যার সম্পূর্ণ নাম ছিল গনেশ দামোদর সাভারকার। ছিলেন মৌলানা আহমেদ উল্লাহ, আব্দুর রহিম সাদিকপুরী, ফজলে হক খায়েরাবাদী এবং আরও পরে ভাগাত সিং-এর অন্যতম সহচর বটেকেস্বর দত্ত। ফজলে হক খায়েরাবাদী ছিলেন লক্ষ্মৌয়ের বাসিন্দা; যিনি ১৮৫৭ সালের অভ্যুত্থানের আদর্শিক গুরু ছিলেন। ১৮৬১ সালে এখানেই ফাঁসি হয় ফজলে হক খায়েরাবাদীর। তিনি একাধারে ছিলেন চিন্তাবিদ, উর্দু-ফারসি ভাষার কবি এবং ধর্মীয় গুরু। তিনি ছিলেন সুফিবাদী কবি। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে মুসলমানদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করতে ফতোয়া দিয়েছিলেন। ওউধের বাসিন্দা বেগম হযরত মহলের সমর্থক ছিলন। হালের কবি জ্ঞানেসার আখতার ছিলেন তার পোতা। বর্তমানে ভারতের বিখ্যাত কবি জাভেদ আখতার, সালমান আকতার এবং ফারহান আখতার তারই সরাসরি বংশধর।
প্রায় এক ঘণ্টা সেলুলার জেলে কাটিয়ে আস্তে আস্তে বের হওয়ার পথ ধরলাম। সেলুলার জেলের তিন তলার শেষের মাথায় অনেক দর্শনার্থী সাভারকারের কথিত বিশেষভাবে সংরক্ষিত সেলের সামনে দাঁড়ানো। ভিনায়ক দামোদর সাভারকার যিনি ছিলেন একাধারে কবি, রাজনীতিবিদ এবং কট্টর হিন্দুবাদী বিপ্লবী নেতা। মহারাষ্ট্রের এই নেতা উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনিই ভারতের রাজনীতিতে হিন্দুত্বের অন্যতম প্রবক্তা। তিনি বৃটেনে ছাত্র হিসাবে স্থাপন করেন ‘অভিনব ভারত সোসাইটি’ এবং ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটি’। সাভারকার শুধু হিন্দুত্ব তত্ত্বের প্রবক্তাই ছিলেন না ছিলেন চরম কম্যুনাল নেতা। তার মতাদর্শ ছিল ‘ভারত হিন্দুদের আদীস্থান অন্য ধর্মালম্বীদের জায়গা নেই। তাদের ফিরতে হবে হিন্দুত্বতে।’ অনেকটা আজকের ‘ঘর ওয়াশমি’-এর মতাদর্শের মতো। তার লেখায় ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবের তত্ত্বে ছিল ভরপুর। সাভারকারকে বিপ্লবী চেতনার প্রচারের জন্য ১৯১০ সালে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দুই প্রস্ত যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করে পশ্চাশ বছরের শাস্তি দেয়া হয়। পাঠানো হয় সেলুলার জেলে। পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতের সৈনিকদের অংশগ্রহণ ও সমর্থনের শর্ত হিসেবে যে সাধারণ ক্ষমতা ঘোষণা করা হয় তারই প্রেক্ষাপটে ১৯২১ সালে অনেকের সঙ্গে তাকেও মুক্ত করা হয়। জেলে থাকাকালেই হিন্দুত্ব এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদ নিয়ে প্রচুর লেখার মাধ্যমে তার এই তত্ত্ব সমগ্র ভারতে প্রচারিত হয়। তার এই তত্ত্বের কারণে কংগ্রেস এবং গান্ধী-নেহেরুর সঙ্গে মতের অমিল ঘটে ক্রমেই তিনিও হয়ে ওঠেন কংগ্রেস বিরোধী।
andaman2
এ পর্বে সেলুলার জেল দেখা আপাতত শেষ হলেও ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’-এর মাধ্যমে আরও বিস্তারিত জানা যাবে ভেবে জেল চত্বর হতে বের হলাম। সেলুলার জেলের ইতিহাস যাই থাকুক এখানে যারা অন্তরীণ ছিলেন তাদের প্রত্যেকের জীবন কাহিনীর সঙ্গে সংগ্রাম আর ভারতের ইতিহাস জড়িত। অনেকেই অতি পরিচিত অনেক আলোচিত মানুষেরা অন্তরীণ জীবন কাটিয়েছেন এখানে।
যে পথে প্রবেশ করেছিলাম সে পথ দিয়েই বের হলাম। এবার আমাদের গন্তব্য পোর্ট ব্লেয়ারের সমুদ্র সৈকত সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার ফিরবো এখানে। গাড়ি প্রবেশ পথের উল্টো দিকের ছোট সবুজ পার্কের পাশে থাকবার কথা তাই সামনের চত্বর পার হলাম। ছোট পার্ক। সামনে বাদামওয়ালার ঠেলাগাড়ি। চা বিক্রেতা ফ্লাস্কে চা বিক্রিতে ব্যস্ত। পার্কে ঢুকলাম। গেটের গোড়া হতেই এক সারিতে সোনালি রঙের তৈরি প্রমাণ সাইজ কয়েকজনের প্রতিকৃতি স্থাপিত যার প্রথমটাই সাভারকারের। একটু দূরে বাকিগুলো। এরা সবাই স্বনামধ্য বিপ্লবী যাদের বেশিরভাগ মারা গিয়েছিল বন্দিদশায়। এদের অনেকে হাঙ্গার স্ট্রাইকে ছিলেন। কর্তৃপক্ষ জোর খাটিয়ে এদের অনশন ভাঙতে যে অমানবিক প্রয়াস তাতে অনেক বিপ্লবী মৃত্যুবরণ করেন। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে প্রত্যেকের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত পড়লাম।
যদিও এই জেলে ১৮৫৭ সাল হতে বহু স্বনামধন্য জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীরা জীবন কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন অত্যাচারে অত্যাচারিত হয়েছেন কিন্তু গোটা আন্দামানে উপস্থিতি রয়েছে ভিনায়ক দামোদর সাভারকারের। সাভারকারের উপস্থিতি গত দুই দশকে বেড়েছে বলে তথ্যে প্রকাশ। কোনভাবেই সাভারকারকে সেলুলার জেল হতে বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি পণ্ডিত নেহেরু ও তার পরবর্তী প্রজন্মের কংগ্রেস নেতারা।
১৯২১ সালে জেল হতে মুক্তি পেয়ে দামোদার সাভারকার আরএসএস (জঝঝ)-এর পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেন। তিনি গান্ধীর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন না। তার তত্ত্ব ছিল ‘ভারত ছাড় কিন্তু ব্রিটিশ আর্মি রেখে যাও’। ভারত বিভক্তির ঘোরবিরোধী ছিলেন ‘হিন্দু মহাসভার’ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। গান্ধী নেহেরু বিরোধিতা তাকে আরও কম্যুনাল করে তোলে। ক্রমেই পুনরায় ব্রাহ্মণদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়তে থাকে। গান্ধীর হত্যাকারী ‘গডসে‘ পরিবারের সঙ্গে নৈকট্যের কারণে গান্ধীর হত্যায় সাভারকারের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। পরে অবশ্য অকাট্য প্রমাণাদির অভাবে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সাভারকারকে গ্রহণ করতে পারেনি। শুধু নেহেরুই নয় ওই বি চাভান মোরাজি দেশাইও আন্দামান সাভারকারের জেলকক্ষে প্রবেশ করেননি। পণ্ডিত নেহেরু তো সমগ্র সেলুলার জেল ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন। এমনকি ১৯৫৭ সালে ‘সিপাহী বিদ্রোহী’ শতবছর পূর্তিতে নেহেরু সাভারকারের সঙ্গে অনুষ্ঠানের এক মঞ্চে বসতেও রাজি হননি।
ভিনায়ক দামোদর সাভারকার ১৯৬৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি সাভারকারের গুণগ্রাহী। ভারতের পার্লামেন্ট হাউসে সাভারকারকে স্থাপন করা হয় আরও পরে ২০০৩ সালে।
যদিও বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ভারতের মূল ভূ-খণ্ডে সেলুলার জেল নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। আরও পরে বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সেলুলার জেলের বিপ্লবীদের ফিরিয়ে আনবার বিষয়টি স্বাধিকার আন্দোলনের দাবিতে পরিণত হয়। অবশেষে মহাত্মা গান্ধী এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সক্রিয় ভূমিকার কারণে বৃটিশ সরকার ১৯৩৭-৩৮ সালের মধ্যে সকল বিপ্লবী কারাবন্দিদের ফিরিয়ে আনে। জেল প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আন্দামান জাপানিদের হাতে পড়ে। এখানে স্থাপিত হয় ‘আজাদ হিন্দ’-এর সদর। ওই সময় ব্রিটিশ ভারতের যুদ্ধবন্দিদের রাখা হয় এই জেলে। আজাদ হিন্দু ফৌজের সর্বাধিনায়ক নেতাজী সুভাষ বোস ওই সময়ে পরিদর্শন করেন এই সেলুলার জেল। এখানে কয়েক বছর প্রতিষ্ঠিত ছিল ‘অস্থায়ী আজাদ হিন্দ’ সদর। পরে ব্রিটিশ প্রতি আক্রমণে জাপানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে শেষ হয় ‘আজাদ হিন্দ’-এর কর্তৃত্ব। ভেঙে যায় সুভাস বোসের নেতৃত্বে ‘আজাদ হিন্দু’-এর স্বপ্ন। আমরা পোর্ট ব্লেয়ারের সমুদ্র সৈকতে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য ডুবেছে মাত্র। খুব বেশি বড় নয় সৈকতটি। ২০১০ সালের সুনামি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল এখানকার সব স্থাপনা তথাপি নারকেল গাছের সারি এখনও দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ বসে ঝালমুড়ি আর চা খেলাম। এসব বিক্রেতারাই বাংলা ভাষাভাষি।
প্রায় আধাঘণ্টা পোর্ট ব্লেয়ারের সৈকতে কাটিয়ে যখন লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখতে ফিরলাম সেলুলার জেলের প্রবেশ পথে তখন জানতে পারলাম যে কারিগরি ত্রুটির কারণে বাতিল করা হয়েছে এই শো। ট্যুর অপারেটর আমাদেরকে আশ্বাস দিলেন যে আমাদের ভ্রমণের শেষ দিনের বিকালে এখানে পুনরায় শো দেখাবার ব্যবস্থা করবেন। আমরাও নাছোড় বান্দা। জানালাম শো না দেখে আমরা আন্দামান ছাড়ছি না। তরুণ ট্যুর অপারেটরের গাইড মুচকি হাসি দিলেন। অগত্য ফিরে আসলাম হোটেলে। আমাদের প্যাকেজে প্রাতরাশ আর ডিনার ধার্য ছিল, সে কারণে রাতে খাবার হোটেলে সারতে বেগ পেতে হয়নি।
পরের দিন সকালে আমাদের গ্রুপ আন্দামান ওয়াটার কমপ্লেক্স ঘাট হয়ে অপর পাড়ের রস আইল্যান্ডে পৌঁছলাম। এখানে ছোট ফেরিতে চড়ে প্রায় পনের মিনিট সমুদ্রের নীলপানি পার হয়ে রস আইল্যান্ডে পৌঁছলাম। ছোট দ্বীপ সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে প্রায় পঞ্চাশ হতে একশত ফুট উপরে। এখানেও সুনামি আঘাত করেছিল। এক সময়ে আন্দামানের ব্রিটিশ সদর ছিল এই দ্বীপে। ১৯৪১ সালের ভূমিকম্পের পর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে সদর সরিয়ে নেয়া হয়। বর্তমানে দ্বীপটি ভারতীয় নৌবাহিনীর ঘাঁটি ‘আইএনএম জরওয়া’। ফেরি হতে নেমে হেঁটে প্রবেশ করবার মুখে জেটিতে ভারতীয় পতাকা আর নৌবাহিনীর জেটি ছাড়া কোন জলযান চোখে পড়েনি।
andaman3
দ্বীপটির মাঝখানে উঁচু ছোট উপত্যকার মতো যেখানে ব্রিটিশ সময়ের অফিসার মেস, ছোট একটি জেল, অফিসারদের বাসস্থান, সৈনিক ব্যারাক, ক্লাব হাউজ এবং টেনিস কোর্ট রয়েছে। এগুলো এখন পরিত্যক্ত, অনেকটা ভগ্নস্তূপের মতো। কিছু দূরে ছোট একতলা একটি লাল দালান চোখে পড়লো প্রচলিত ব্রিটিশ ভারতীয় স্থাপত্যের নিদর্শন। উপরে দোচালা টালির ছাদ। এই স্থাপনাটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। এটি এ অঞ্চলে এক সময়ের বিখ্যাত বেকারি ছিল। তথ্যে প্রকাশ এখান হতে শুধু আন্দামানেই নয় সমগ্র বৃটিশ ভারতীয় নেভিকে রুটি, কেক ইত্যাদি সরবরাহ করা হতো। বেকারির পেছনেই পরিত্যক্ত পানি পরিশোধনাগার আর বিদ্যুতের জেনারেটর ঘর। পরিত্যক্ত সুইমিংপুল। সামান্য দূরে ছোট টিলার উপরে ব্রিটিশ বাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টারের বাসস্থানের ভগ্নাংশ। আরও ভেতরে অন্যান্য স্থাপনাগুলো। জঙ্গলাবৃত্ত ছোট কোরাল দ্বীপ এই রস আইল্যান্ড। এখান হতেই পরিচালিত হতো আন্দামানের সেলুলার জেল। ১৯৪২ সাল হতে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এখানেই ছিল জাপানি সামরিক সদর। ১৯৪৫ সালে পুনরায় ব্রিটিশ বাহিনী আন্দামান দখলের সঙ্গে সঙ্গে জাপানি বাহিনী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ এখানেই আত্মসমর্পণ করে। দ্বীপজুড়ে প্রচুর নারকেল গাছ। রয়েছে পুরাতন বট আর পাকুর বৃক্ষ। এই দ্বীপেই ১৯৪৩ সালে নেতাজী সুভাষ বোস একরাত কাটিয়ে ‘আজাদ হিন্দু’-এর পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। বর্তমানে এখানে ভারতীয় নেভির একটি অতিথিশালা এবং ছোট একটি জাদুঘর ছাড়া তেমন কোন স্থাপনা নেই।
আমরা যে ঘাটে নেমেছিলাম তার ব্রিটিশ নাম এখনও বলবৎ রয়েছে। ‘আবারডি’ ঘাট। ঘাটের দুপাশে জাপানি বাহিনীর দুটি বাঙ্কার এবং মেশিনগান এখনও স্থাপিত রয়েছে। রয়েছে একটি ক্লক টাওয়ার যার নিচে জাপানি বাহিনী যুদ্ধবন্দি ব্রিটিশ প্রধান কমিশনার ওয়াটার ফল-এর ডেপুটি মেজর বার্ড-এর শিরঃñেদ করেছিল। এসব তথ্যেই সাঁটানো রয়েছে পর্যটকদের জ্ঞাতার্থে। এই দ্বীপের নামকরণ করা হয় ব্রিটিশ মেরিন সার্ভেয়ার স্যার ড্যানিয়েল রস-এর নামে। এ নাম আর পরিবর্তন হয়নি। এখানেও প্রবেশমূল্য রয়েছে তবে ট্যুর প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণে আমাদেরকে কোথাও টিকিট ক্রয় করার বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি।
দুপুরের তাতানো সূর্য তবুও গাছের ছায়ায় সমুদ্রের বাতাস বয়ে আনে একপশলা শান্তি। আমরা বেশ কিছু সময় গাছের ছায়ায় বসে সমুদ্রের পানির রং দেখছিলাম। মনে হলো সমুদ্রের পানি বেশি কিছু দূরে রঙ বদলিয়েছে। কাছের পানির গাঢ় নীল আর কিছু দূরে রঙ কালচে। হবেই কারণ কালাপানি বলতে আন্দামানকেই তো বুঝায়।
আমরা রস দ্বীপ হতে ফিরতি পথে শহরের এক ছোট রেস্তোরায় দুপুরের খাবার খেয়ে যখন হোটেলে ফিরলাম তখন পড়ন্ত বেলা। হোটেল রুমের পেছন দিক থেকে ছোট বারান্দা। গতকাল সময় পাইনি ওদিকে তাকাবার। পর্দা সরাতেই নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়লো। একটু দূরেই আন্দামান সাগরের নীলপানি। অদূরে আরেকটি ছোট দ্বীপ। নীলপানির বুক চিরে চলছে হাইস্পিড জলযানগুলো। বেশিরভাগই বিভিন্ন দ্বীপের সাথে যোগাযোগের একমাত্র ব্যবস্থা- যাত্রীবাহী ফেরি। আগেই বলেছি আন্দামান অবশ্যই ভারতের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। এসব ফেরি সার্ভিসগুলো মূলত পর্যটক এবং বিভিন্ন দ্বীপে মালামাল বহন করে।
সন্ধ্যায় হোটেলের ছাদে আমাদের ট্যুর অপারেটর অভ্যর্থনা রেখেছিল। সন্ধ্যার পর ছাদে উঠে দেখলাম আরেক অপূর্ব দৃশ্য। দূরের দ্বীপগুলোর ঝলমলে বাতি। এখানে এখন পর্যন্ত একবারও বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখিনি। যেসব দ্বীপে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে সেখানে স্থানীয়ভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তদুপরি হোটেল আর মোটেলগুলোর রয়েছে নিজস্ব জেনারেটর।
পরের দিন সকালে নাস্তা সেরে হোটেল ছাড়লাম দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম দ্বীপ হ্যাভলকের উদ্দেশে। পোর্ট ব্লেয়ার হতে হ্যাভলকের দূরত্ব প্রায় ৬০ কি.মি.। সম্পূর্ণটাই সমুদ্রপথের যাত্রা। এসব দ্বীপে পর্যটকদের যাতায়াতের জন্যে রয়েছে ব্যক্তিমালিকানাধীন বিলাশবহুল জলযান। হ্যাভলক পর্যটকদের জন্যেই নয় নব্যবিবাহিতদের জন্যে নিরিবিলি স্থানে মধুচন্দ্রিমা যাপনের উপযুক্ত স্থান। রয়েছে জলক্রীড়ার একাধিক উপাদান, দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সমুদ্রের তলদেল পদভ্রমণ। আমরা অন্যতম বিলাশ তরী মারত্রুজ নামক জলযানে প্রায় দুই ঘণ্টায় হ্যাভলক দ্বীপে পৌঁছলাম। সমগ্র সমুদ্র পথের পানি এত স্বচ্ছ ছিল যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। দুই হালের বিশেষ এই যান অতিদ্রুত গতিসম্পন্ন ছিল। পর্যটকে ভর্তি ছিল যানটি।
andaman4
এই দ্বীপের নামটি ব্রিটিশদের দেয়া। নামকরণ করা হয়েছিল জেনারেল হেনরি হ্যাভলকের নামে এবং এ দ্বীপ আন্দামানের অন্যতম বৃহৎতম দ্বীপ।
হেনরি হ্যাভলক ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জেনারেল। হ্যাভলক ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময় কানপুরের নানা সাহেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং বিদ্রোহী সিপাহীদের যে নির্যাতন করে হত্যা করেন তা ইতিহাসের সবচাইতে কালো অধ্যায় বলে বিবেচিত। যে ধরনের অমানবিক অত্যাচার হ্যাভলক করেছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণ ওই সময়ের ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা তুলে ধরেছিলেন। কানপুরে এখনও বিদ্যমান রয়েছে ওইসব স্থান যেখানে হ্যাভলক গড়ে তুলেছিলেন টর্চার চেম্বার অথচ হ্যাভলক আন্দামান দ্বীপে এখনও জীবিত। হ্যাভলক ১৮৫৮ সালে লক্ষেèৗতে কথিত পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণ করেন।
হ্যাভলক আন্দামানের রিচি দ্বীপপুঞ্জের বৃহৎতম দ্বীপ যার আয়তন প্রায় ১১৪ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। প্রায় ৯৫ ভাগ বাংলা ভাষাভাষি এবং সিংহভাগ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশী মূলের বাঙালি। এখানকার বাসিন্দারা ছোটখাট ব্যবসা ও কৃষিকাজে নিয়োজিত এবং পর্যটন এনে দেয় অর্থ।
আমরা সি-সেল হোটেলে কটেজে দুই রাত কাটাবো। কটেজগুলো অর্ধাচন্দ্রাকারে সমুদ্রের ধারে। প্রতিটি ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর সাদৃশ্য রুমগুলো নারিকেল বাগানে সজ্জিত। প্রকৃতির সঙ্গে যেন মিশে আছে এই কটেজ। এ দ্বীপে বেশ কিছু বড় বড় কটেজ রয়েছে। বছরের কয়েক মাস ছাড়া সমগ্র সময়েই পর্যটকদের ভিড় থাকে হ্যাভলকে। দেখে অবাক হলাম সে আধুনিক জীবনের সব ধরনের সুবিধা রয়েছে এসব কটেছে। মুগ্ধ করার মতো মনোরম পরিবেশে তৈরি এসব কটেজগুলো।
বিকালে দেখতে গেলাম রাধানগর সমুদ্র সৈকত। খুব একটা বড় সৈকত নয় তবে কোরাল দ্বীপ বলে কথা। অতি স্বচ্ছ টলটলে পরিষ্কার সমুদ্রের পানি। পানির বর্ণের কথা না বললেই নয়, গাঢ় নীল তার মধ্যে ছোট ছোট চিকচিকে ঢেউ। পরের দিন স্পিড বোটে এলিকেপ্ট সৈকতে গেলাম সেখাকে সমুদ্রের তলদেশে হাঁটা হতে সব ধরনের ওয়াটার স্পোর্ট-এর ব্যবস্থা রয়েছে। বয়সে তরুণরা সমুদ্রের তিরিশ ফুট নিচে ‘সি ওয়াক’ করে তাদের অনুভূতি সিডিতে ধারণ করে নিয়ে আসে। এ এক অবর্ণনীয় দারুণ অভিজ্ঞতা।
আমরা এই সবুজ গহীন বনবেষ্টিত হ্যাভলক দ্বীপে দুই রাত কাটিয়ে পুনরায় সমুদ্র পথে নেইলদ্বীপে আসলাম। এখানকার কটেজগুলো আরও চমকপ্রদ। আমরা যে কটেজগুলোতে ছিলাম আলাদা আলাদাভাবে তাঁবু দ্বারা নির্মিত রুমগুলো। হ্যাভলকের মতো নারিকেল বাগানের মধ্যে কটেজগুলো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। রয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা। এই দ্বীপটি হ্যাভলক হতে আকারে ছোট। সবুজের সমারোহ। জনসংখ্যা মাত্র তিন হাজার এবং শতভাগ বাংলা ভাষাভাষি। আয়তনে ১৮ বর্গকিলোমিটার এই কোরাল দ্বীপটি। সবুজ। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য। এখানে একাধিক কটেজ রয়েছে আর সবগুলোই সমুদ্র সংলগ্ন স্থানে নির্মিত।
andaman5
এই দ্বীপটি জর্জ জেমস স্মিথ নেইল নামক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক সাধারণ সৈনিকের নামে রাখা হয়েছে। জেমস নেইল ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহ দমনে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন বলে তাকে ইতিহাসে স্মরণীয় করতেই এই নামকরণ করা। লক্ষণীয় বিষয় যে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের বেশিরভাগ দ্বীপের নাম রাখা হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এমন ব্যক্তিদের নামে যারা ১৮৫৭ সালের উপমহাদেশের ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’কে পরাহত করতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। স্বাধীন ভারতে অপরিবর্তিত রয়েছে এসব নাম।
নেইল দ্বীপে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক কোলাম সৈকত। ছোট ছোট সমুদ্র সৈকত কিন্তু পর্যটকদের জন্য সম্ভব সব উপকরণই রয়েছে। আমরা এক রাত্র কাটিয়ে ফিরে আসলাম পোর্ট ব্লেয়ারে। ওই দিন সন্ধ্যায় পৌঁছলাম সেলুলার জেলে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখতে যা আমরা প্রথম বিকালে দেখতে পারিনি। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শো শুরু হলো। সমস্ত চেয়ারগুলো দর্শনার্থীতে ভরে গেল। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে শুরু হলো রঙিন আলোর ছটা আর সাউন্ডসহ ধারা বিবরণী। পুরাতন বটগাছকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের অধ্যায় তুলে ধরা হলো। তুলে ধরলো বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিপ্লবীদের ওপর অত্যাচারের চিত্র আর ফাঁসির মঞ্চের জয়গান একই সাথে জেলের সেলগুলো হতে পাগলা ঘণ্টার সঙ্গে সঙ্গে ‘ইনকেলাব জিন্দাবাদের’ গগণবিদারী ধ্বনি। যার ওপরে পূর্ণচন্দ্রের কোমল আলো আর সামনে রঙিন আলো আর আঁধারে ইতিহাসের বর্ণনা। এতগুলো মানুষ কারও মুখে কোন রা নেই। উপস্থিত দর্শকরা যে বিমোহিত যেন নতুন করে ইতিহাসের পাতায় বিচরণ করছেন মুখোমুখি হয়েছেন সব বিপ্লবীদের, যারা এই সুদূর কালাপানিতে জীবনের বহু অংশ কাটিয়েছেন অথবা কাটাতে পারেনি। ধারাভাষ্যকারের বর্ণনায় একে একে উঠে আসল উনবিংশ শতাব্দীতে এই দ্বীপে কালে মা নামে এক ব্রিটিশ বিরোধী বন্দির হাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নরের হত্যা, পরবর্তীতে জেল তৈরির ইতিহাস, বটেকেশ্বর দত্তের অনশনে কাহিনী, ভগৎ সিং-এর অন্যান্য সহযোগীদের আমরণ অনশন আর জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জোর করে অনশন ভাঙবার প্রচেষ্টায় অনেকেরই মৃত্যুর কাহিনী। আরও পরে ভিনায়ক সাভারকারের কাহিনী।
প্রায় শেষ সময়ে আলো-আঁধারের আর শব্দের সমন্বয়ে বেজে উঠলো আজাদ হিন্দু ‘ফৌজের’ রণসংগীত। কদম কদম বাড়ায়ে যা আর দৃপ্তপদে সেলুলার জেলে নেতাজী সুভাষ বোসের আগমন। প্রায় দেড় ঘণ্টার এই শো জীবিত করে তুললো প্রায় একশত দশ বছরের পুরাতন সেলুলার জেলের ইতিহাস।
প্রায় দেড় ঘণ্টা নিশ্চুপে বসে দেখলাম আর শুনলাম। ভেসে গিয়েছিলাম ‘কালাপানি’তে। শো শেষ হলো ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যদিয়ে। বেজে উঠল ‘বন্দে মাতারাম’ আর ‘ইনকেলাব জিন্দাবাদের’ ধ্বনি। শো শেষে নিশ্চুপে বের হয়ে আসলাম।
পরের দিন ভোরে আন্দামান, কালাপানি ত্যাগ করলাম। আকাশে ডানা মেললো আমাদের বহনকারী বিমান। নিচে তাকিয়ে দেখলাম অপশৃয়মান ‘সেলুলার জেল’। ক্রমেই আমরা আন্দামান সাগরের পানির রং কালচে দেখতে শুরু করলাম। নিচে সাগরের অথৈ পানি দেখছিলাম। দেখছিলাম ছোট ছোট জলযানের আনাগোনা। কানে তখনও বাজছিল ‘ইনকেলাব জিন্দাবাদ’-এর ধ্বনি।
(লেখকের আগামী ভ্রমণ কাহিনী ‘কালাপানি হতে আদ্রিমাতিকের তীরে’ নামক বইয়ের এক অধ্যায় হতে) লেখক : সাবেক নির্বাচন কমিশনার, সৌজন্যে: মানবজমিন।

সোমবার, ৯ মে, ২০১৬

ঢাকা-শিলং-ঢাকা বাসের টিকেট কিনলে ভিসা করিয়ে দেবে শ্যামলী পরিবহন

1
শ্যামলী ও বিআরটিসি’র যৌথ উদ্যেগে ঢাকা থেকে ভারতের মেঘালয়ের রাজধানী শিলং পর্যন্ত বাস সার্ভিস রয়েছে। এই সার্ভিসের মাধ্যমে আপনি ৪৫০০ টাকায় ঢাকা-শিলং-ঢাকা বাসের টিকেট কিনলে সেই সাথে শুধু ভারতীয় ভিসা ফি দিলে ভারতীয় ভিসা করিয়ে দিবে তারাই। ভিসা সেন্টারে আপনাকে যেতে হবে না। পাসপোর্ট, টাকা ও অন্যন্য কাগজপত্র তাদের নিকট জমা দিতে হবে।
যাত্রার সময়কাল

ঢাকা থেকে বৃহস্পতিবার রাতে রওনা দিবে, শিলং থেকে সোমবার ভোরে রওনা দিবে। এই ডেটেই আপনাকে যেতে-আসতে হবে।
বিঃদ্রঃ শুক্রবার হাফ ডে, শনি ও রবিবার ফুল ডে সময় পাবেন সেখানে।
ভিসা তথ্য
সাধারন ভিসার মতোই ৬ মাসের ভিসা দিবে। এন্ট্রি পোর্ট হবে “ডাইকি” (ভারতের ইমিগ্রেশন ‘ডাউকি’ আমাদের ইমিগ্রেশন ‘তামাবিল’)। আপনি ৬ মাসের মধ্যে যতবার খুশি ততবার যেতে আসতে পারবেন এবং ভারতে বাংলাদেশীদের যেতে বাধা নেই এমন সকল স্থানে যেতে পারবেন।
খরচ
ভিসা, ও বাসের টিকেট বাবদ ৫১০০ টাকা নিবে। (বাসের টিকেট ৪৫০০+ভিসা ৬০০) ট্রাভেল ট্যাক্স বাবদ অতিরিক্ত ৫০০ টাকা লাগবে (চাইলে ঢাকা থেকেও ট্রাভেল ট্যাক্স পরিশোধ করে যেতে পারে তাহলে সেখানে জামেলা কম হয়)
যোগাযোগ
রিয়াজ ভাই – ০১৭৩৩৫২৪৩৮৬ (দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা : ঢাকা-শিলং বাস সার্ভিস) অফিস : ০২ ৯৩৫৩৮৮২ কমলাপুর শ্যামলী-বি.আর.টি.সি. কাউন্টার।
যে যে কাগজপত্র লাগবে
* অরিজিনাল পাসপোর্ট * আপনার পাসপোর্টের ফটোকপি * জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি (যদি না থাকে তাহলে জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি এবং চেয়ারম্যান বা কমিশনার কতৃক নাগরিকত্ব সনদ) * একটি বিদ্যুৎ/পানি/টেলিফোন বিলের ফটোকপি (নিকটস্ত মাসের এবং বিল দেওয়া হয়েছে) * নূন্যতম ৬ মাসের ব্যাংক ষ্ট্যাটমেন্ট অথবা কোন ব্যাংক কতৃক নুন্যতম ১৫০ ডলার এনড্রোসমেন্ট স্লিপ ও পাসপোর্ট সিল সহ।
ছাড়া কর্মক্ষেত্রের প্রমান স্বরূপ আপনি :
# ছাত্র হলে :
* ছাত্র পরিচয়পত্রের ফটোকপি
# ব্যাবসাযী হলে :
* চলতি ট্রেড লাইসেন্সের ফটোকপি (অবশ্যই আপনার নামে)
* ভিজিটিং কার্ড
# চাকুরীজীবি হলে :
* চাকুরির পরিচয়পত্রের ফটোকপি
* অফিসিয়াল প্যাডে অফিস কতৃক ছুটির মঞ্জুরীপত্র
* ভিজিটিং কার্ড

ঘুরতে গিয়েছিলাম টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ এবং মিয়ানমারের মংডু

১
টেকনাফ মোড়ে।
২
টেকনাফের রসালো টাম ফল।

22
টেকনাফের শিশুদের সাথে দুই বোন- সায়মা আনসারী ও সানজিদা আনসারী
৩
টেকনাফের এই জায়গাটিতে লবণ চাষ হয়।
৫
চাষকৃত লবণ সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।

৬
ট্রাকে লবণ তোলা হচ্ছে। পোজ দিয়েছেন জিনিয়া ম্যাডাম।
12
শাহপরীর দ্বীপে নাফ নদীর উপর জেটিতে দাঁড়িয়ে।

৭
শাহপরীর দ্বীপে সাগর পাড়ে সুন্দর সুন্দর নৌকা সারি করে সাজানো।
টু দ্যা পয়েন্টে ফকিরেপুল পৌঁছে বাস ধরলাম। নারী-পুরুষের স্বস্তিদা্য়ক অনুপাতে (আমি বাদে সমান সমান) প্রিত হলাম এই ভেবে যে, তাতে অন্তত অহেতুক ফ্রয়ডীয় ঈর্ষা থেকে অনেকে মুক্তি পাবে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। না হোক, সেও তো আরেক মজা।
টেকনাফ পৌঁছলাম সকাল আটটা নাগাদ। হোটেলে উঠে প্রাতঃকর্ম সেরে চলে গেলাম দলবলে শাহপরীর দ্বীপ। এটি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত। মূল ভূখণ্ড বলতে সাগর না পেরিয়ে শাহপরীর দ্বীপ যাওয়া যায়। তবে একদম সাগড় পাড়ে। প্রাকৃতিক, মনোরম এক সমুদ্র সৈকত। দ্বীপের বাম পাশে নাফ নদী। নদীর ঐ পারে বার্মা বা মায়ানমার সীমান্ত।
এই দ্বীপের নামকরণ নিয়ে কিছু মিথ প্রচলিত আছে।এর নামকরন সম্পর্কে কেউ বলেন সম্রাট শাহ সুজার ‘শাহ’ আর তাঁর স্ত্রী পরীবানুর ‘পরী’ মিলিয়ে নামকরণ হয়েছিল এই দ্বীপের, কারো মতে ‘শাহ ফরিদ’ আউলিয়ার নামে দ্বীপের নাম করণ হয়েছে। অপরদিকে অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি সা’বারিদ খাঁ’র ‘হানিফা ও কয়রাপরী’ কাব্য গ্রন্থের অন্যতম চরিত্র ‘শাহপরী’। রোখাম রাজ্যের রাণী কয়রাপরীর মেয়ে শাহপরীর নামেই দ্বীপের নামকরণ হয়েছে বলেও অনেকে বলেন।
একসময় এই দ্বীপটি আয়তনে অনেক বড় থাকলেও বর্তমানে ছোট হতে হতে অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে। স্বাধীনতার আগে শাহপরীর দ্বীপের আয়তন ছিল দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১০ কিলোমিটার। বর্তমানে তা ছোট হয়ে দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার ও প্রস্থ ৩ কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে এবং ভাঙন অব্যাহত আছে।
টেকনাফ থেকে সড়ক পথে শাহপরীর দ্বীপের দুরত্ব ১৩ কিলোমিটার। সড়ক পথ হলেও মাঝখানে পথ ভাঙা থাকার কারণে কিছুটা পথ ইঞ্জিন চালিত নৌকায় পার হতে হয়।
শাহপরীর দ্বীপে গিয়ে প্রথমে আমরা গিয়েছিলাম নাফ নদীর উপর নির্মিত জেটিতে। সেটি মূলত একটি সীমানা চৌকি। ওখানে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি বালক বশি দিয়ে এক কোরাল মাছ উঠিয়ে আনল। সাথে আরো কিছু মাছ দেখলাম। চমৎকার তাজা মাছ। তবে বালকটি সে মাছের মালিক নয়। মাছ কিনতে চাইলাম। মালিক নাই বলে আর মাছ কেনা হল না। অগত্যা মাছের সাথে সবাই ছবি তুললাম।
1
2
এরপর গেলামে একদম সমুদ্র ঘেষে অবস্থিত বাগারপাড়ায় (নামটি ভুল হতে পারে)। প্রথমে সমুদ্রে গিয়ে দাপাদাপি করলাম। বিশাল
বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল তীর ঘেষে। কক্সবাজারে এত বড় ঢেউ দেখা যায় না। আমরা নেমেও গেলাম অনেকদূর। ফিরতে কষ্ট হচ্ছিল, জোয়ার ছিল বলে বেঁচে গেছি।
03
দূরে দু’জনকে দেখা যাচ্ছে।
বাগারপাড়ায় এসে ডাব খেলাম। ওদের সাথে কথা বললাম, ছবি তুললাম। মনে হল- পরিবারগুলো একেবারে সমুদ্রের সাথে মিশে আছে নির্ভয়ে।
শাহপরীর দ্বীপ থেকে ফিরে টেকনাথে গ্রিন গার্ডেন নাম একটি হোটেলে রাত কাটালাম। সকালে রওনা হলাম মিয়ানমারের মংডুর উদ্দেশ্যে। মংডু হচ্ছে নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের একটি ছোট শহর। টেকনাফের মতই। তবে কালচার একেবারে ভিন্ন।
19
ওখানে যাওয়ার কিছু হ্যাপা আছে। ইমিগ্রেশন থেকে একটি টেমপরারি পাসপোর্ট নিতে হয়। পাসপোর্ট নিতে দুই কপি ছবি এবং ভোটার আইডি কাডের ফটোকপি লাগে। ইমিগ্রেশন ফি লাগে। এরপর ট্রলার পেরিয়ে যাওয়া যায় মিয়ানমারের মংডু। মোবাইল, ক্যামেরা ইত্যাদি কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস নেওয়া যায় না। একটি মোবাইল নিতে হলে মিয়ানমার কাস্টমসকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। ট্রলারভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা।
মংডুতে থাকার কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। দেখতে না জানলে দেখারও তেমন কিছু নেই। তবে একটু গ্রামে ঢুকতে পারলে নতুনত্ব আছে।
আমরা ছিলাম কেন্নাই গেস্ট হাউজে। এটি বাইরে থেকে দেখতে যত ভালো দেখা যাচ্ছে আসলে ভেতরটা অত ভালো নয়। ওখানে আরেকটা সংকট হচ্ছে- ইলেকট্রিসিটি। রাতে সরকারি বিদ্যুত থাকে না। বিকল্প হচ্ছে জেনারেটর বা সোলার।
28
দেখার মধ্যে দেখলাম রাখাইনদের চালচলন এবং খাদ্যাভাস। অন্যরা তো আমাদের এ পাশের মতই। পার্থক্য বলতে কাপড়টা ওরা বেশিরভাগ মিয়ানমারের কালচার মেনে পরে। অর্থাৎ লুঙ্গি ইন করে পরলে যেমন হয়।
4
রাখইন শিশু।
16
স্থানীয় পানীয় বিক্রি হচ্ছে, সাথে চালের পিঠা।
17
শুকরের মাংস বিশেষ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধ করে বিক্রী করা হচ্ছে।
1
ট্রাভেলার নয়ন খাই খাই করেও শেষ পর্যন্ত খাইল না।
১৬
সকালে খাইলাম ফ্রাইড রাইচ ডিম দিয়ে, সাথে কাচকি শুটকি ভাজি।
1
মংডুতে নাস্তার টেবেল ট্রাভেলার নয়ন এবং মি. কবির।
রাতটুকু থেকে সকালে দল ছেড়ে একটু ভেতরে গেলাম। দেখলাম সুন্দর ছিমছাম গ্রাম। ধনী না হলেও তারা খুব সাজিয়ে থাকে। ওখানে আছে হিন্দু পাড়া এবং মুসলিম পাড়া। অদূরে আছে রাখাইন পাড়া।
সব মিলিয়ে চব্বিশ-পঁচিশ ঘণ্টা আমরা ওখানে ছিলাম। ঘর হতে দু’পা র বেশি ফেলার সুযোগ ছিল না, অনুমতি ছিল তিন কিলোমিটার। যাওয়া হয়ত যায় চোখ এড়িয়ে আরো খানিকদূর। তবে যেহেতু দলটি নারী-পুরুষ মিলিয়ে দশজনের তাই একমত হতে হতেই সময় চলে যায় অনেক। দলটির সবার মধ্যে যে জানাশোনা খুব বেশি তাও আসলে নয়।
অবশ্য দল থেকে উপদল হয়ে কেউ কেউ যে বাড়তি কিছু দেখেছে তার নজির তো নিচের ছবিগুলো, আমরা যেহেতু সেখানে সদলবলে যাইনি। যােইহোক আমরা ছবি তো অন্তত দেখছি!
৯
১০
১২
তারপরেও হয়েছে তো অনেক কিছুই। নতুন স্থান দেখা হয়েছে, নতুন সংস্কৃতির সাথে সংযোগ সাধন হয়েছে, নিজেদেরকেও জানাশোনা হয়েছে।
তবে কিছু বিষয় মাথায় রাখলে এ ধরনের ট্যুর আরো উপভোগ্য হতে পারে। যেমন-
১। ছোট দলে যাওয়া ভালো, তাতে বোঝাপড়া সহজ হয়, অবশ্য দলটা খুব বেশি বড় ছিল না, তবে বোঝাপড়ায় ঘাটতি ছিল;
২। গ্রুপের মধ্যে উপগ্রুপ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরী;
৩। একজনকে দায়িত্ব না দিয়ে, কমপক্ষে দুইজনকে ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব দেওয়া উচিৎ;
৪। শার্প টাইমলিমিট না থাকাই ভালো। একদুই দিন হাতে নিয়ে গেলে সুবিধে হয়;
৫। প্রত্যেকের খরচ বাঁচিয়ে চলার মানুসিকতা থাকা দরকার। একটু সতর্ক হলেই অনেক খরচ বাঁচানো যায়। খাওয়ার আগে অবশ্যই দাম জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিৎ। যানবাহন রিজার্ভ করলে সবদিক চুকিয়ে নেওয়া উচিৎ;
৬। ট্যুরে একান্ত আপনজন নিয়ে গেলে কোনো দায়িত্ব আপনি নিতে যাবেন না, তাতে হযবরল হয়। অন্যদের কাছে বিষয়টি বিরক্তিকর হতে পারে।
খুব বড় কোনো লক্ষ্য থাকলে ছোট ছোট কারণে আপনি উচ্ছ্বসিত হতে পারবেন না। ভালোলাগা পর্যন্তই তা সীমাবদ্ধ থাকবে। এমনিতেই আমি দলবদ্ধ অানন্দে খুব একটা দক্ষতা দেখাতে পারিনে, তার উপর বিভিন্ন পারিবারিক দায়িত্বের কারণে মনের অবস্থা খুব একটা খোলামেলা থাকেও না।
এবার ইচ্ছে ছিল সময়টা ঝাঁপিয়ে-দাপিয়ে কাটিয়ে দেওয়ার। খুব একটা তা হয়নি, আবার একেবারে যে হয়নি তাও নয়।
প্রত্যেকটা নতুন জায়গায় দেখার-বোঝার থাকে অনেক কিছু, তবে সেজন্য সময় দিতে হয়, চোখ ঘুরিয়ে চলে আসলে অনেক সময় শুধু ক্লান্তিই বাড়ে। তাই ট্যুরের ব্যাপারে আমার নিজস্ব একটি দর্শন আছে- সময় নির্দিষ্ট করে যেতে আমি রাজি নই। জায়গাটিকে একজস্ট করে আসতে যত সময় লাগার লাগবে, নট লুক এট অনলি, আই লাইক টু লুক ইনটু।
টাইম বাজেট করে গেলে সে জিনিসটা হয় না, গ্রুপে গেলে আরো কিছু সমস্যা থাকে, সবার মতামত এক করা, সবাইকে এক পালে রাখা -এগুলো বিগ চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া পরিবেশ এবং প্রাকটিসের কারণে আমরা খুব বেশি এডভেঞ্চার-প্রিয় নই, যার কারণে গাছের আম তলায় না পড়লে বা কেউ না পেড়ে দিলে আমাদের খাওয়ার জো নেই।
তাই খুব বেশি প্রত্যাশা এ ট্যুর থেকে আমার ছিল না। তাতে কিছু যায় আসে না, চোখ খোলা থাকলেই আমার মন ভরে যায়। হয়েছেও তাই।
MAIN LINK

স্থলপথে মিয়ানমার যাবেন যেভাবে

1
আপনি যদি ঢাকা থেকে যাতে চান তাহলে বাস এ টেকনাফ যাবেন, টেকনাফ বন্দর এর কয়েক কি মি আগেই রয়েছে ইমিগ্রেশন অফিস, আপনি বাস থেকে সরাসরি ইমিগ্রেশন অফিস এ নেমে যেতে পারেন অথবা টেকনাফ বন্দর এ নেমে আপনাকে সি এন জ়ী নিয়ে আসতে হবে ( সময় লাগবে ১০ মিনিট)। মায়ানমার যাওইয়ার জন্য আপনাকে এন্ট্রি পারমিট নিতে হবে এই ইমিগ্রেসন থেকেই, এবং এই ইমিগ্রেশন জেটীতেই  আপনার কাক্ষিত মায়ানমার এ আসা-যাও্য়ার  বোট পাও্য়া যাবে
এন্ট্রি পারমিট আপনি স্পটেই নিতে পারবেন এবং এজন্য আপনার দুইটা জিনিস অবশই লাগবে, তা হচ্ছে ০১। জতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি এবং ০২। স্টাম্প ও পাসপোরট সাইজ ছবি। কোন দালাল বা অন্য কাউকে ধরার দরকার নাই , ইমিগ্রেশন এ দুইটা ভাগ , পুলিশ এবং ইমিগ্রেশন, আপনি প্রথমে পুলিশ অংশে যাবেন ( অই অংশে মুলত এন্ট্রি পারমিট ইসু করে ) ওখানের ফরমালিটিজ শেষ হলে ওরাই আপনাকে দেখিয়ে দেবে পরবরতী অংশ ( সীমান্ত পার হও্য়ার অনুমতি, ভিসা আর কি ) , এন্ট্রি পারমিট নিয়ে দিনে দিনেই যেতে চাইলে আপনাকে সকাল ৮ঃ ৩০ মিনিট এ উপ্সথিত থাকতে হবে। এন্ট্রি পারমিট এবং আসা-যাও্য়া বোট ভাডা মিলিয়ে জন প্রতি ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা খরচ পডবে।

কখন যাবেন: আপনি বছরের যেকোন সময় যেতে পারেন তবে শীত কাল সব চেয়ে ভাল হবে, আপনার যদি সেইন্ট মারটিন সহ ঘুরে আসার পরিকল্পনা থাকে তাহলে শীতের সময়ই সবচেয়ে ভাল।

কোথায় থাকবেনঃ থাকার জন্য বেশ কয়েক টি হোটেল রয়েছে মংডু তে, আপনি অনায়াসে মোটামুটি ভাডায় থাকতে পারবেন।

কোথায় খাবেনঃ বাংলা খাবারের হোটেল রয়েছে বেশ কিছু। মুসলিম হোটেল ও রয়েছে।

আশেপাশের দর্শনিয় স্থানঃ দর্শনিয় স্থান এর চেয়ে মিয়ানমারের মানুষ, সামাজিক রীতিনীতি, জীবন ধারা আপনাকে নতুন ধারনা এনে দেবে দেশ টি সম্পরকে, তবে বোদ্ধ মন্দির সহ বেশ কিছু দর্শনিয় স্থান রয়েছে।
বিশেষ পরামর্শ: মোবাইল, ক্যামেরা ইত্যাদি ইলেকট্রন্কিস দ্রব্য নেওয়া যাবে না। টাকা নেওয়া যাবে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার।
MAIN LINK

শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৫

ঈদে মালয়েশিয়া ভ্রমণের সাতসতেরো

ফেরদৌস জামান
দেশের বাইরে কাছেপিঠে কোথাও যেতে চাইলে সবার আগে মনে পড়ে ভারতের কথা, তারপরই মালয়েশিয়া। অথচ মাত্র চার দশক আগের কথা, সে সময় বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা প্রায় সমান ছিল। উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে তারা আজ পৌঁছে গেছে অনেক উপরে। এতটাই উপরে যে, তারা নিজেদের দেশকে আজ ইউরোপের কোনো দেশের সমতুল্য মনে করে! অন্যান্য বিভাগ তো বটেই তারা দেশের পর্যটন শিল্পকেও সমান তালে এগিয়ে নিয়েছে। কী এমন আকর্ষণ রয়েছে যে, পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ পর্যটক আজ মালয়েশিয়াকে অন্যতম ভ্রমণ  উপযোগী দেশ বলে মনে করছে? আমরা যারা ছুটিছাটা পেলেই দেশে অথবা দেশের বাইরে কোথাও বেড়াতে যাই দুটো দিন নির্ঝঞ্ঝাট আরাম করে কাটানোর জন্য, তাদের জন্য আজকের লেখায় থাকছে মালয়েশিয়া ভ্রমণের বৃত্তান্ত। কারণ সামনে ঈদ। আর ঈদের ছুটিতে পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে আপনিও নিশ্চয়ই  কোথাও যাবেন বলে ভেবে রেখেছেন। এবার চলুন মালয়েশিয়া গিয়ে কী দেখা যেতে পারে জেনে নেই।

ক্যামেরুন হাইল্যান্ড :  বৃটিশ কর্তৃক নির্মিত বৃহৎ পাহাড়ি ঘাঁটি এটি। বর্তমানে এখানকার লোক সংখ্যা ৩০ হাজারের উপর। যার মধ্যে মালয়, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান ও অন্যান্য এ্যাথনিক গোষ্ঠীর কিছু মানুষ বসবাস করে। হাইল্যান্ডটি ট্রেইলের জন্য বিখ্যাত। যেতে হয় ট্রেইল ধরে।  চলতি পথের প্রধান আকর্ষণ সবুজ বন ও ঝরনা। জঙ্গল পথে হাঁটা ছাড়াও অভয়ারণ্যটি আরও এক কারণে বিশ্বের পর্যটকদের নিকট পরিচিত, তা হলো চা বাগান। চাইলেই ঘুরে ঘুরে দেখে নেয়া যেতে পারে বিস্তীর্ণ বাগানগুলো।

জর্জ ইনার সিটি :  বৃটিশ রাজা তৃতীয় জর্জ এর নামানুসারে জায়গাটির নামকরণ করা হয়। এর অবস্থান উত্তর পানাং আইল্যান্ডে। শহরের বেশিরভাগ অধিবাসী  চাইনিজ। ঔপনিবেশিক আমলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আজও আকার্ষণ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিশেষত স্থাপত্য নিদর্শনের অনুপম শৈলী ও গঠনের জন্য জর্জ টাউন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অদ্বিতীয়। এই শহরের যৌবন জেগে ওঠে সন্ধ্যায়। যখন রাস্তায় রাস্তায় স্থানীয়রা স্ট্রিট ফুড ও ড্রিঙ্কস সংগ্রহ করতে জড়ো হয়।

তামান নেগার : তামান নেগার অর্থ জাতীয় উদ্যান। পৃথিবীর প্রাচীনতম উদ্যানগুলোর মধ্যে একটি। বৃক্ষের পাশাপাশি এখানে রয়েছে অনেক ঝরনা। রয়েছে জঙ্গলের মনোরম পরিবেশের মাঝে ট্রেকিংয়ের সুব্যবস্থা। আরও রয়েছে চাঁদোয়া দীপ্তিতে ঢাকা পৃথিবীর দীর্ঘতম পায়ে হাঁটার উপযোগী পথ। তামান নেগারকে স্বর্গ বলা হয় সেই সমস্ত প্রাণীর জন্য, যারা এশিয়ার বুক থেকে বিলুপ্ত প্রায়। এদের মধ্যে এশিয়ান হাতি, বাঘ, গন্ডার এবং চিতা উল্লেখযোগ্য। সংখ্যায় কম তাই এদের সচরাচর দেখা যায় না। তবে নিশ্চিতভাবে আপনি বহু প্রজাতীর পখি দেখতে পাবেন সেখানে।
লঙ্কাবির আকর্ষণ কেবল কার

পুলাউ তিওমান :  ১৯৭০ সালে টাইম ম্যাগাজিনে নির্বাচিত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দ্বীপগুলোর মধ্যে এটি স্থান করে নিয়েছিল। এর অবস্থান দেশটির পূর্ব উপকূলের কাছে। পর্যটকরা স্বর্গসম সৌন্দর্য উপভোগের উদ্দেশে এখানে গিয়ে থাকে। সম্পূর্ণ দ্বীপ প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা। স্কুবা ডাইভারদের জন্য দ্বীপটি সাক্ষাত স্বর্গ।

পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার :  ২০০৪ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বোচ্চ টাওয়ার এটিকেই বলা হতো। এই যমজ দালানের নির্মাণশৈলীর মাঝে ইসলামিক স্থানীয় সংস্কৃতির এক নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। দুই টাওয়ারের মাঝের ব্রিজকে বলা হয় স্কাই ব্রিজ। ৫০ রিঙ্গিত বা ১২শ` টাকার নিময়ে দর্শনার্থীরা উঠতে পারবেন এই স্কাইব্রিজে।

লঙ্কাবি :  মালয়েশিয়ার বহুল প্রচলিত পর্যটন কেন্দ্র লঙ্কাবি। ৯৯টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এই দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান আন্দামান সাগরে। এখানে সর্বাপেক্ষা নয়নাভিরাম সমুদ্র সৈকত রয়েছে। অধিকন্তু উৎকৃষ্ট মানের রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁ রয়েছে। আসলে কি নেই এখানে, কেবল কার, ঝরনা, সমুদ্রের নিচ দিয়ে রাস্তা, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আরও কত কি! একটু ভিন্ন স্বাদের জন্য একটি নৌকা ভাড়া করে চলে যেতে পারেন ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের ভেতর। সেখানেও আছে বাদুরের গুহা, ঈগলের গুহা ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান।

এই ক্রিস্টাল মসজিদটির কিছু অংশ সমুদ্রে আর কিছু অংশ স্থলে
পারহেন্টিয়ান আইল্যান্ড :  দেশটির অন্যান্য দ্বীপের মধ্যে পর্যটক আকর্ষণের দিক থেকে এই দ্বীপের অবস্থান শীর্ষে। সুন্দরতম দ্বীপটির সৈকতে সস্তায় থাকা ও খাওয়ার সুবন্দবস্ত রয়েছে।

মুলু কেভস :  এটি একটি গুহা। এটি দেশের বিখ্যাত গুনুং মুলু জাতীয় উদ্যানে অবস্থিত। উদ্যানটি অবিশ্বাস্যভাবে এই গুহা দ্বারা ঘেরা। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গুহাপ্রকোষ্ঠ আবিষ্কৃত হয়েছে এই গুহাভ্যন্তরে। উল্লেখ রয়েছে প্রকোষ্ঠের আকার এতই বড় যে, তার ভেতরে অনায়াসে চল্লিশখানা বোইং-৭৪৭ উড়োজাহাজ এটে যেতে পারে।
আর মালয়েশিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে চলে যেতে পারেন মালাক্কা সিটি। কেনাকাটার জন্য যেতে পারেন প্যাভিলিয়ন, টাইমস স্কয়ার, বিবি প্লাজা, সানওয়ে পিরামিড মার্কেট ইত্যাদি শপিং মলগুলোতে। পৃথিবীর সবগুলো ব্র্যান্ডের পণ্যই পাবেন এই মার্কেটগুলোয়। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার স্থানীয় পণ্যগুলোও গুণগত মানসম্পন্ন, দামও ক্রয়সীমার মধ্যেই। আর ইলেক্ট্রনিকস পণ্য কিনতে চাইলে অবশ্যই যেতে হবে ল-ইয়েট প্লাজা।
লঙ্কাবি সৈকতে প্রবাল

দেশের বিভিন্ন টুর অপারেটর কোম্পানি আপনার আনন্দময় ভ্রমণের জন্য মালয়েশিয়াকে ঘিরে সাজিয়েছে চমৎকার সব ভ্রমণ প্যাকেজ। তাদের মধ্যে থেকে পছন্দ মত নির্ভরযোগ্য যে কোনো অপারেটরের অফার আপনি গ্রহণ করতে পারেন। রেইনবো হলিডেজ ৩ দিন ২ রাতের মালয়েশিয়া ভ্রমণ প্যাকেজের মূল্য রেখেছে ৩৮,৭০০ টাকা। প্যাকেজে আপনি পাবেন তিন তারকা মানের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা, দৈনিক সকালের নাস্তা, পুত্রজায়া ভ্রমণ, আধাবেলা কুয়ালালামপুর সিটি ভ্রমণ, এয়ারপোর্ট-হোটেল-এয়ারপোর্ট  রিটার্ন যাতায়াত সুবিধা এবং সঙ্গে থাকবে ইংরেজিতে পারদর্শী দোভাষী। বিস্তারিত জানতে ০১৭৮১৯০৬২০৪ এই নাম্বারে ফোন করতে পারেন।

ক্যাপ্টেন হলিডেজ-এর প্যাকেজ মূল্য ৩৮,৫০০ টাকা। ভ্রমণের সময় ৪ দিন ৩ রাত। তারা আপনাকে যে সুযোগ-সুবিধা দেবে সেগুলো হলো : ফিরতি বিমান টিকিট, ভ্রমণে নিজস্ব পরিবহণ সুবিধা, ২ রাত কুয়ালালামপুর, ১ রাত জেন্টিং ভ্রমণ, থামেল পার্ক ভ্রমণ, কেবল কার (ওয়ান ওয়ে), আধাবেলা সিটি ভ্রমণ, দৈনিক সকালের নাস্তা এবং ভিসা সহযোগিতা। ফোন-০১৯৭৭০৫৮৪৫২।

এ ছাড়াও সাউথ এশিয়ান টুরিজম (০১৭১৬-৪৬৬০৪৭), এভারেস্ট হলিডেজ (০১৯৫৬-২৯৯৬৮৯) সহ দেশের অনেক টুর অপারেটর কোম্পানি ঈদ উপলক্ষে মালয়েশিয়ায় ভ্রমণ প্যাকেজ অফার করেছে। মনে রাখা দরকার সকলের প্যাকেজ মূল্য প্রায় সমান। তবে এ ক্ষেত্রে আপনাকে একটু সাবধানী হতে হবে। ভালো করে জেনে, বুঝে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পাহাড়ে দেবতার মূর্তি
ভিসা প্রসেসিং : গ্রাহক চাইলে টুর কোম্পানিগুলো ভিসা প্রসেস করে দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ভিসা ফি ও অন্যান্য খরচ বাবদ গুনতে হবে প্রায় ৩৫০০-৫০০০ টাকা। এ জন্য প্রয়োজন হবে : ছয় মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও সলভেন্সি সার্টিফিকেট, সাদা ব্যাকগ্রাউন্ড ছবি, চাকুরিজীবী হলে এনওসি.(নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) এবং প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্সের নোটারাইজড্ ফটোকপি, ব্যবসায়ী হলে ট্রেড লাইসেন্সের নোটারাইজড্ ফটোকপি, বিজনেস কার্ড বা ভিজিটিং কার্ড। যদি আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা নিজেই সাজিয়ে থাকেন, অর্থাৎ কোনো টুর অপারেটরের সহযোগিতা নিতে না চান তাহলে যাওয়ার আগে থাকার জায়গা আগে থেকেই নিশ্চিত করে নিতে হবে।