বিটিভিতে যখন সোর্ড অব টিপু সুলতান দেখানো হতো, আমি ছিলাম মুগ্ধ দর্শক।
মহীশুরের রাজপ্রাসাদ দেখে ভেবেছি কবে যাবো সেখানে! ছোট ছিলাম তখন, তাই
ভাবনা শধুমাত্র স্বপ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তারপর একদিন সুযোগ হলো আমার
স্বপ্নটাকে বাস্তব করার।
সময়টা ২০০৪ সালের জানুয়ারী মাস। ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানী
ব্যাঙ্গালোর শহরে ব্যক্তিগত কাজে প্রায় এক মাস থাকা হয়। ঠিক সেই
সময়টাতেই একদিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো মহীশুর ঘুরতে যাওয়ার। এক শুক্রবার
খুব সকালে মাইক্রোবাস ভাড়া করে ব্যাঙ্গালোর থেকে মহীশুরের উদ্দেশ্যে
যাত্রা শুরু করলাম।
মহীশুর হচ্ছে কর্ণাটকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, ব্যাঙ্গালোর থেকে প্রায়
১৫০ কিলোমিটার দক্ষিন-পশ্চিমে চামুন্দী পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। সকাল
দশটার ভিতর মহীশুর শহরে পৌঁছে গেলাম। এই শহরকে সাধারণত ‘প্রাসাদের শহর’ বলা
হয়ে থাকে। তাই প্রথমেই গেলাম মহীশুরের রাজ প্রাসাদে।
এই রাজপ্রাসাদের আরেকটি নাম আছে- আমবা ভিলাস প্রাসাদ (Amba Villas
Palace)। এই প্রাসাদটি হচ্ছে মহীশুরের রাজকীয় ওদিয়ার পরিবারের বাসস্থান।
ওদিয়ার বংশ ১৩৯৯ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মহীশুর রাজ্য শাসন করেছিলো।
যাহোক, মহীশুর রাজপ্রাসাদ ভারতের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান এবং
দর্শনার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় তাজমহলের পরেই এর অবস্থান।
ইন্দো-সারাসেনিক স্টাইলে নির্মিত এই রাজপ্রাসাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,
এতে হিন্দু, মুসলিম, রাজপুত এবং গথিক স্থাপত্য শৈলীর অপূর্ব সংমিশ্রণ আছে।
তিন তলা এই প্রাসাদটি পুরোটাই ঘিয়া রংয়ের গ্রানাইট পাথরে নির্মিত এবং এর
গম্বুজগুলো নির্মিত গাড় গোলাপী রংয়ের মার্বেল পাথরে, সাথে আছে ১৪৫ ফুট
উঁচু পাঁচ তলার সমান একটি টাওয়ার। আর আছে প্রাসাদের চারপাশে নয়ন জুড়ানো
বাগান। এর নকশায় ছিলেন ব্রিটিশ স্থাপত্যবিদ হেনরি আরউইন।

প্রাসাদের মূল প্রবেশ পথেই একজন গাইড পেলাম। একজন
বিদেশী হিসেবে ২০০ রুপী দিয়ে টিকেট কেটে প্রাসাদের ভিতরে যখন ঢুকতে যাবো,
শুনলাম ভিতরে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া যাবে না! হা হুতোম্মি! ঘুরবো, দেখবো
অথচ ছবি তুলতে পারবো না! যখন গিয়েছিলাম, প্রাসাদের এক অংশে সংস্কার কাজ
চলছিলো। আর পুরো প্রাসাদটিও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা ছিলো না।
শুধুমাত্র চারটি বিশেষ রুম দেখতে পেয়েছিলাম। আজ এতো বছর পর সবকিছু ঠিকমতো
মনে নেই, তবে বিশাল দরবার হলের কথা ভালোই মনে আছে। দরবার হলের বিশালতায়
নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। প্রতিটি পিলারের কারুকাজ দেখে যেনো মোহিত
হচ্ছিলাম। দরবার হলের সাথেই বিশাল ব্যালকনি, যেখানে এসে সামনের দিকে
তাকিয়ে স্তব্ধ হওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিলো না! আমি যে পুরো
চামুন্দী পাহাড়ের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি!
বারোটার মধ্যেই রাজপ্রাসাদ দেখা শেষ করে রওয়ানা দিলাম শ্রীরঙ্গাপাটনার
দিকে। এই সেই শ্রীরঙ্গাপাটনা, মহীশুর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের যে
ছোট্ট শহরটি হঠাৎ করেই আঠারশ শতাব্দীর দিকে বিখ্যাত হয়ে উঠে, শের-ই-মহীশুর
টিপু সুলতানের রাজধানী হওয়ার কারণে। শহরটির চারপাশ দিয়ে কাবেরী নদী
প্রবাহিত হওয়ায় এটি আসলে একটি দ্বীপ! প্রথমেই শহরটির একেবারে মাঝে
অবস্থিত শ্রীরঙ্গনাথস্বামী মন্দিরে গেলাম। গ্রানাইট পাথরে তৈরী ভারতের
অন্যতম প্রাচীন এই মন্দিরটির বিশালতা উপলদ্ধি করতে না করতেই সময়ের সাথে
পাল্লা দিয়ে দৌড় লাগালাম দরিয়া দৌলাত বাগের দিকে- টিপু সুলতানের বাগান
প্রাসাদ। দরিয়া দৌলাত বাগ অর্থ হচ্ছে ‘সমুদ্রের সম্পদ’। ১৭৮৪ সালে প্রধানত
সেগুন কাঠ দিয়ে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত সবুজ রংয়ের
প্রাসাদের চারপাশের বাগানে যেনো টিপু সুলতানের ছোঁয়া অনুভব করতে পারছিলাম।
কৈশোরের হিরোর বাগান বাড়ি বা গ্রীস্মকালীন বাড়িটি দেখে চোখের জল আর বাঁধ
মানছিলো না! এখানে টিপু সুলতানের সময়কালের সমরাস্ত্র, পেইন্টিং এবং
মুদ্রা দেখতে দেখতে একটি তৈলচিত্রের দিকে চোখ আটকে গেলো। স্যার রবার্ট কার
পর্টারের আঁকা “শ্রীরঙ্গপাটনামের ঝড়” (Storming of Srirangapattanam) –এ
১৭৯৯ সালের ৪ঠা মে ব্রিটিশদের কাছে টিপু সুলতানের চূড়ান্ত পরাজয়টা যেনো
জীবন্ত হয়ে উঠেছে! বাগান বাড়ি থেকে শ্রীরঙ্গপাটনা ছেড়ে চলে যাবার পথে
থামলাম- টিপু সুলতানের সমাধিক্ষেত্রে। শহরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত এই
সমাধিক্ষেত্রটি টিপু সুলতান নিজেই নির্মান করেছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের শেষ
ঠিকানা হিসেবে। ইংরেজদের কাছে টিপু সুলতানের পতন হলে ১৭৯৯ সালের ৫ই মে
তাঁকে এখানে সমাধিস্থ করা হয়। চারকোণা এই সমাধিক্ষেত্রের উপরে উঠে গেছে ইট
দিয়ে তৈরী গম্বুজ। চারপাশের খোলা করিডোরগুলো তৈরী করা হয়েছে কালো পাথরের
পিলার দিয়ে। এই সমাধিক্ষেত্র কমপ্লেক্সের ভিতরে একটি মসজিদও আছে, যাতে
মোঘল স্থাপত্যশৈলীর ছাপ পাওয়া যায়। ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে
যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ টিপু সুলতানের সমাধিক্ষেত্র থেকে আবার চলে এলাম মহীশুর
শহরে। বেলা তখন প্রায় তিনটা।




দ্রুত মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ করে দেখতে গেলাম মহীশুর চিড়িয়াখানা। এতোকিছু
থাকতে চিড়িয়াখানায় কেনো? মহীশুর চিড়িয়াখানার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য
আছে। সরকারীভাবে এর নাম শ্রী চামারাজেন্দ্র জু’লজিকাল গার্ডেন। ১৮৯২ সালে
মহীশুরের মহারাজা শ্রী চামারাজ ওয়াদিয়ার এই চিড়িয়াখানার পত্তন করেন এবং
এভাবেই এটি হয়ে উঠে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন চিড়িয়াখানা। এর আরেকটি
বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – এখানেই ভারতের যে কোনো চিড়িয়াখানা থেকে সবচেয়ে বেশি
হাতি আছে। চিড়িয়াখানা দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। এই সময়ই
রওয়ানা দিলাম খুবই আকর্ষনীয় এক জিনিস দেখতে!
মহীশুর শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তর- পশ্চিমে কাবেরীসহ আরো দুটি
নদীর মিলিত স্থানে নির্মিত কৃষ্ণরাজ সাগর বাঁধের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যা ছয়টার
দিকে রওয়ানা দেবার মূল কারণটা হচ্ছে বৃন্দাবন গার্ডেনের আলো ঝলমলে নৃত্যরত
ঝর্না (Dancing Fountain) দেখা! ভারতের সবচেয়ে পুরাতন সেচ বাঁধের নিচেই
তৈরী করা হয়েছে বৃন্দাবন গার্ডেন। কাশ্মিরের শালিমার গার্ডেনের অনুকরণে
নির্মান করা এই গার্ডেনে আছে প্রচুর প্রজাতির বৃক্ষ এবং পুষ্প। তবে এর
সবচেয়ে আকর্ষনীয় দিক হচ্ছে, যেটার কারণেই দর্শনার্থীরা এখানে আসেন, সেটি
হচ্ছে নৃত্যরত ঝরণা। মিউজিকের তালে তালে ঝরনা থেকে পানি বেরিয়ে আসে
সিনক্রোনাইজড ভঙ্গিতে। এবং এই নৃত্য শুরু করা হয় সন্ধ্যা সাতটা থেকে, চলে
এক ঘন্টা। রক্তিম সন্ধ্যার আলোতে এই আলোকজ্জ্বল ঝরনার মিউজিকের তালে
নাচাটা- এক মোহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি করে। পুরো একটি ঘন্টা শুধু মিউজিকই
শুনলাম আর ঝর্নার নাচই দেখলাম। সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি যেনো এই এক ঘন্টায়
ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেলো।

নির্মল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে সাড়ে আটটার দিকে বাঁধ
থেকে যখন ব্যাঙ্গালোরের দিকে রওয়ানা দিলাম, তখন মন থেকে মহীশুরের রাজ বংশ
উধাও, টিপু সুলতান উধাও, সেখানে শুধু বিরাজ করছিলো এক অপার্থিব মুগ্ধ
মৌনতা! তাই ঘড়ির হিসেবে পরের দিন (রাত বারোটার পর) যখন ব্যাঙ্গালোরে এসে
পৌঁছালাম, তখন ক্লান্তির জায়গায় ভর করেছিলো জীবনের অসম্ভব প্রিয় কিছু
মুহূর্ত, প্রিয় কিছু স্মৃতি জমা হওয়ার আনন্দ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন