মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৪

ভারতের ট্রেনের টিকেট বুকিং

ভারতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য খুবই আরামদায়ক এবং নির্ভরযোগ্য বাহন হলো ট্রেন। কোলকাতা থেকে দিল্লী অথবা চেন্নাই কিংবা শিলিগুড়ি, প্রায় সব গন্তব্যেই আপনি ৩-৪ ধরণের ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারেন। আমরা বাংলাদেশীরা সাধারণত কোলকাতা থেকেই বিভিন্ন গন্তব্যের ট্রেনে যাতায়ত করি। কিন্তু ট্রেনের টিকেট কাটা একটা বেশ ঝামেলার কারণ হয়ে দেখা দেয়, কারণ ভারতে ট্রেনে খুব জলদি বুকিং শেষ হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে আপনি দু’টো কাজ করতে পারেন।
১. ফরেন কোটাঃ ধরুন আপনি কোলকাতা থেকে দিল্লী যাবেন। রাজধানী এক্সপ্রেসের সাধারণ টিকেট দু’তিন দিন আগে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু দু’দিন আগে ফরেন কোটায় টিকেট পেতে আপনাকে খুব একটা ঝামেলা হবে না। কোলকাতায় যে কোন ট্রাভেল অপারেটরের কাছে টিকেট কাটবার সময় ফরেন কোটার কথা উল্লেখ করুন এবং অবশ্যই সাথে আপনার পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন। ফরেন কোটার টিকেটের দাম সাধারণ টিকেটের সমান।
২. ততকালঃ ততকাল হলো শেষ সময়ের টিকেট। যদি ফরেন কোটাতেও টিকেট না পাওয়া যায় তাহলে একমাত্র ততকালই ভরসা। ততকালের টিকেট ছাড়া হয় ট্রেনের যাত্রা শুরু হবার একদিন আগে। তাই কোলকাতা গিয়েই ট্রাভেল এজেন্সিগুলোকে আগে-ভাগে আপনার সকল তথ্য দিয়ে দিন। তাহলে তারা টিকেট ছাড়ার পরপরই আপনার জন্য টিকেট করে রাখবে। তবে এক্ষেত্রে আপনার প্রায় ৩০০-৫০০ রুপি বেশি লাগবে, ট্রাভেল এজেন্সির কমিশন সহ।
যদি আপনি মাসখানেক আগে থেকেই ভারত ভ্রমনের প্ল্যান করে রাখেন, তাহলে আপনি বাংলাদেশে বসেও ইচ্ছে করলে ভারতের ট্রেনের টিকেট কাটতে পারেন। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের অপরদিকে, নিকেতনে ঢোকার মুখে দু’তিনটি ট্রাভেল এজেন্সি এই বুকিংগুলো দিয়ে থাকে।
ভারতের আভ্যন্তরীন ট্রেনের সময়সূচি জানার জন্য লগ ইন করতে পারেন এই সাইটটিতে।
www.erail.in
আপনার ভ্রমণ হোক সম্পূর্ণ ঝামেলা মুক্ত।

ট্রিক মাস্টার

তালে তালে.. নৈনিতালে!

আমাদের চার বন্ধুর মাথায় মাঝে মাঝেই সিনেমা দেখার ভুত চাপে। একবার ‘কোয়ি মিল গ্যায়া’ নামন হিন্দী সিনেমাটি দেখার পর সিনেমার লোকেশন টা খুব পছন্দ হয়ে গেলো। পরে ‘স্যার গুগল’-এর কাছ থেকে জানতে পারলাম যে জায়গাটির নাম ‘নৈনিতাল’। ব্যাস আর কি? পরদিন থেকে শুরু হলো নেট ঘাটা এবং বড় ভাইদের পেছনে লেগে থাকা সব খোঁজখবর নেবার জন্য ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এ সবের ফলাফল অনুযায়ী মাস খানেক পর পকেটে হাজার দশেক টাকা নিয়ে উঠে পড়লাম কলতাকার বাসে।
ঝামেলা হলো শুরু
এখন উপরের সিম্পল বর্ননা শুনে যদি মনে হয় যে নৈনিতাল যাওয়াটা আজিমপুর যাবার মতোই সোজা, তাইলে আগেই বলি স্যরি। কারণ নৈনিতাল যাওয়াটা বেশ ভালোই ঝক্কির। শুরুতেই আমরা হোঁচট খেলাম ফোরস এর একজনের অনুপস্থিতিতে। তারপর বাজেট সংকট এবং সবচেয়ে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা। (২০০৫ সালে ভারতের ভিসা করার জন্য সত্যি সত্যিই সারা রাত লাইনে দাঁড়াতে হতো!) কোনমতে পৌছালাম কোলকাতা সস্তায় সস্তায় এবং এক বড় ভাইয়ের (আমাদের প্রিয় জানের টুকরা ফসু ভাই!) বুক করা হোটেল রুমে উঠে পরলাম পয়সা বাঁচাতে। তারপর শুরু হলো ‘কালকা মেইল’ এ দিল্লীর উদ্দেশ্যে যাত্রা। ইয়া আল্লাহ - সাধে লোকে বলেনা দিল্লী দুরস্ত! পাক্কা ৩৬ ঘন্টা পর নামলাম দিল্লীতে। দিল্লীতে নামার পর শুরু হলো কাঁপাকাঁপি, কি যে ঠান্ডা! তারপর সারাদিন রেস্ট নিয়ে আবারও ট্রেন জার্নি, এবার দিল্লী টু কাঠগোদাম। এটা বেশিক্ষণ না, মাত্র ১৪ ঘন্টা!
কাঠগোদাম টু নৈনিতাল
কাঠগোদাম স্টেশনটায় নামার সাথে সাথে পুরো ভ্রমণের যত ধকল ছিলো সব সাথে সাথে কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেলো। এটা আমার দেখা ভারতের সবচেয়ে সুন্দর স্টেশন। স্টেশনটা যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয়েছে বিশাল পাহাড়ের সারি। মনে হয় সামনে যেন কতই না অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে। কাঠগোদাম থেকে ট্যাক্সিতে নৈনিতাল পৌঁছাতে সময় লাগে দুই ঘন্টার মতো। আমরা জানুয়ারী মাসে গিয়েছিলাম তাই পুরো পাহাড়ী রাস্তাটায় সবুজ ঘাসের উপর তাজা বরফ পরে আছে - কি যে সুন্দর! পুরো জার্নিটা করতে আমাদের সময় লাগে দুই গুন বেশি কারণ পুরো রাস্তায় এত সুন্দর সুুন্দর স্পট যে কোনটা ছেড়ে কোনটায় দাড়াবো বুঝেই পাওয়া যায় না। পুরো জার্নিটা এক কথায় অসাধারণ।

ছবিঃ কাঠগোদাম স্টেশন
“তাল্লিতাল.. মাল্লিতাল.. বিচমে হ্যায়.. নৈনিতাল!”
‘নৈনিতাল’ বা ‘নৈনাঝিল’ হলো ভারতের অন্যতম বৃহত লেক সিটি। দার্জিলিং এর মিরিক লেক থেকে এটা প্রায় ৪/৫ গুন বড়। আবার শ্রীনরের ডাল লেকের মতো এতটা বিস্তৃতও না। খুব সুন্দর ‘কলকা’ শেপের এই লেকটির চারদিক পাহাড় ঘেরা। টলটলে স্বচ্ছ পানি (বরফের মত ঠান্ডা!), ঝকঝকে নীল আকাশ আর সাদা তুষারে মোড়ানো সবুজ পাহাড় -প্রকৃতির এক অপূর্ব চারনভুমি এই নৈনিতাল। আর পুরো লেকের চারপাশে গড়ে উঠেছে নৈনিতাল শহড়। লেকের নিচের দিক টার নাম ‘তাল্লিতাল’ আর উপরের দিকটার নাম ‘মাল্লিতাল’। তাল্লিতালের তুলনায় মাল্লিতাল বেশ সভ্রান্ত। দোকানপাট গুলোও বেশ ঝকঝকে আর দারুন দারুন সব বাংলো বাড়ি। আমরা যেদিন নৈনিতাল পৌছাই ঠিক তার আগের দিন এখানে স্নো -ফল হয়, তাই প্রতিটি বাড়ির কার্নিশে আর টালির ছাদে ছিলো সাদা বরফের আস্তর। কিন্তু মেঘ কেটে যাওয়াও পুরো পরিবেশটা ছিলো দারুন ঝকঝকে। নৈনিতালের অসাধারণ পরিবেশের কারণে এখানে গড়ে উঠেছে ভারতের নাম করা সব বোর্ডিং স্কুল। একটা পাগল খানাও আছে, আমার ধারণা রোগীরা এখানকার সৌন্দর্য দেখে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়!

ছবিঃ নৈনিতাল
নৈনিতালের কাছাকাছি
উপরের কথাগুলো আমাদের তিনজনের জন্য একেবারে মিথ্যা। কারণ ধবধবে সাদা মিহি তুষার পেয়ে আমরা এমন পাগলামিতে মেতেছিলাম যে আশ-পাশের মানুষ আমাদের নিঃসন্দেহে পাগল ভাবছিলো। আসলে নতুন তুষারের মজাই আলাদা। আমাদের দেশে এই জিনিষটা বড্ড মিস করি। আর তুষারের বল বানিয়ে বরফের বল ফাইটিং খেলার তো তুলনাই হয় না।

ছবিঃ বরফে পাগলামি
আমরা এই বরফের সাম্রাজ্য পেয়েছিলাম মাল্লিতাল থেকে একটু উপরে একটি পাহাড়ী পার্কে। রোপ ওয়ে (কেবল কার) দিয়ে আপনাকে সেখানে পৌঁছাতে হবে। পাহাড়টি থেকে আপনি পুরো নৈনিতালের দারুন ভিউ পাবেন। এখানে একটা ছোট মার্কেটও আছে যেখানে আপনি নৈনিতালের ট্রাডিশনাল পোষাক পরে ছবি তুলতে পারেন।
তাল্লিতালে, লেকটার কিনারায় আছে দারুন একটা মসজিদ। খুব সুন্দর সাদা কারুকাজে ভরপুর মসজিদটা গড়ে উঠেছে একটা স্টেডিয়ামের পাশে। স্টেডিয়ামটা একটু অদ্ভুত, পুরো মাঠটিই সিমেন্টের তৈরি, এরা যে কিভাবে খেলে আল্লাই জানে। স্টেডিয়ামটির আশেপাশে গড়ে উঠেছে ছোট মেলার মতো মার্কেট। মার্কেটটা বেশ সস্তা, বিশেষ করে শীতের পোষাক আর মোমবাতি এখানে খুবই সস্তায় পাবেন।
বোটিং
নৈনিতালে আসবেন আর বোটিং করবেন না, তা’তো হয় না। এখানে খুব সস্তায় নৌকা ভাড়া পাওয়া যায় ঘন্টা হিসেবে। আমি ভারতের অনেক লেকে বোটিং করেছি, তবে এতটা স্থির পানির লেক আর দেখিনি। লেকটির মাঝখানে নৌকা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকুন, খুব ভালো লাগবে। ২০০-৩০০ রুপির মধ্যেই আপনি ঘন্টা হিসেবে নৌকা ভাড়া পেয়ে যাবেন। আর মনে রাখবেন, পানি কিন্তু বীভৎস রকমের ঠান্ডা!

ছবিঃ নৈনিতালে বোটিং
নৈনিতাল থেকে একটু দুরে
নৈনিতাল পৌছানোর পরদিন আমরা ঘুরতে বের হই এর আশপাশটা দেখবার জন্য । সারাদিনের জন্য একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পরি। মাল্লিতাল থেকে ৫-৭ কিলোমিটার পরেই শুরু হয়ে যায় ঘন পাহাড়ী বন। এই জঙ্গল বিখ্যাত হয়েছে জিম করবেটের শিকারের চারনভুমি হিসেবে। উচু উচু পাইন গাছের মধ্যে দিয়ে আপনি পাগাড়ী ট্রেইল ধরে হর্স রাইড করতে পারেন। এই জঙ্গলটি ঘুরে দেখবার জন্য ঘোড়াই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি। কারন মাটির পাহাড়ি রাস্তায় বরফ পরে অসম্ভব পিচ্ছিল হয়ে থাকে। উঁচু উঁচু গাছগুলোর মাথায় সাদা বরফ জমে থাকে, খুব সুন্দর একটি দৃশ্য। এখানেই কোই মিল গ্যায়া সিনেমার পিচ্চি এলিয়েনটা ল্যান্ড করেছিলো।

ছবিঃ করবেটের জঙ্গলে
এরপর আমরা যাই সুইসাইড করতে। মানে সুইসাইড পয়েন্ট দেখতে। খোদাই জানে কেন এর নাম সুইসাইড পয়েন্ট কারণ পাহাড়ী এই ভ্যালিটি দেখবে খুবই সুন্দর। ভ্যালিটিতে ছোট কিন্তু খুব সুন্দর আরেকটি লেক আছে, এটার নাম সুখা তাল। নামকরণেই কারণেই হয়তো জায়গাটিতে গেলে বেশ গা ছমছম করে।

ছবিঃ সুইসাইড পয়েন্ট
আমাদের পরের গন্তব্য ছিলো কেভ গার্ডেন। এখানে বেশ কিছু গায়ে গা লাগা পাহাড়েরর ভেতর দিয়ে বড় একটা সুরঙ্গ হয়ে আছে। সুরঙ্গটা আমাদের খাগড়াছরির আলুটিলার মতোই তবে আরেকটু এক্সাইটিং। আপনি সুরঙ্গের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যেতে পারবেন মশাল হাতে নিয়ে। তবে আমার মত মোটাসোটা হলে বিপদ আছে। কখনো বসে, কখনো ক্রল করে আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে।
‘তাল’ শব্দটির অর্থ লেক। আর এখানে তালের অভাব নেই। প্রতিটি পাহাড়ের কোনায় কোনায় খালি তাল আর তাল। ভীম তাল, নাগা তাল, সুখা তাল - নৈনিতাল ছাড়াও আরো একগাদা তাল আছে। সবগুলো তালই খুব সুন্দর কিন্তু সত্যি কথা বলতে নৈনিতালের কাছে বাকিগুলো কিছুই না! তাই বোটিং করতে চাইলে নৈনিতালেই করুন।
উপরের জায়গাগুলো হলো তথাকথিত টুরিস্ট স্পট। তবে এই ছোট্ট ছবির মতো শহড়ে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। তাই পায়ে হেঁটে বা রিক্সায় চড়ে ঘুরে বেড়ান শহড়টি, অসাধারণ লাগবে। সন্ধ্যার দিকে লেকটার পাশের বেঞ্চিগুলোতো লাইন দিয়ে বসে থাকে কাপল রা। আমরা তিন বন্ধুই তখন ছিলাম ব্যাচেলার, তাই বড্ড হতাশ লাগছিলো। তখনই প্রমিস করেছিলাম যে একবার বৌ নিয়ে এখানে আসতেই হবে! আপনাদেরও বলি, কাপল ডেস্টিনেশন হিসেবে নৈনিতালের জুড়ি নেই।

ছবিঃ তিন বন্ধু পাহাড়ি ভ্যালিতে
কিভাবে যাবেন
আমি একজন বাজেট ট্রাভেলার, তাই সেই হিসেবেই আপনাদেরকে বাজেট দিচ্ছি। এই পুরো ট্রিপটি আপনি অনেক লাক্সারিয়াস ভাবেও করতে পারেন।
ঢাকা থেকে কোলকাতা চলে যান যে কোন বাসে। শ্যামলী, গ্রিন লাইন বা সোহাগ -সবগুলোর সার্ভিসই প্রায় এক ধরণের। কোলাকাতা গিয়ে সেদিন দিল্লী যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। পরের দিন রাজধানী অথবা দুরন্ত এক্সপ্রেস ধরে চলে যান দিল্লী। খরচ পরবে ১৮০০ রুপির মতো আর সময় লাগবে ১৬ ঘন্টা। (টিকেট কাটা সংক্রান্ত জটিলতা হলে এই লেখাটি পড়তে পারেন - train tickets booking) এরপর দিল্লী থেকে কাটুন কাঠগোদামের টিকেট। দিল্লি টু কাঠগোদাম বেশ কিছু অপশন আছে, রাতের ট্রেনটাই ভালো কারণ এই জার্নিটা প্রায় ১২-১৪ ঘন্টার। আপনি ইচ্ছা করলে জেএসবিটি থেকে নৈনিতাল যাবার বাসও ধরতে পারেন কিন্তু রেকমেন্ড করবো না। আমরা ফিরেছিলাম বাসে, অনেকটা জান হাতে নিয়ে! কাঠগোদাম থেকে একটা ট্যাক্সি বুক করে নিন অথবা শেয়ারে টাটা সুমো পেয়ে যাবেন।
কোথায় থাকবেন
পুরো লেকটার ধার ঘেষে গড়ে উঠেছে অনেক হোটেল । মাল্লিতালের হোটেলগুলো একটু এক্সপেনসিভ। তাল্লিতালে আপনি ৮০০-১০০০ এর মধ্যে মোটামুটি মানের ভালো হোটেল পেয়ে যাবেন। হোটেল আগে থেকে বুক করার কোন প্রয়োজন নেই, ওখানে প্রচুর অপশন পাবেন।
মনে রাখবেন
  • শীতকালে ভয়াবহ স্নো ফল হয়। তাই গরম কাপড় বেশি করে নিয়ে যান। শীতকালটাই বেড়ানোর জন্য সেরা সময়।
  • প্রধান ভাষা হিন্দী, ইংরেজিটা এরা খুব একটা বোঝে না।
  • কোন প্যাকেজ ট্যুর না নিয়ে নিজেরাই ট্যাক্সি ভাড়া করে নিন, অনেক ভালোমতো ঘুরতে পারবেন।
  • খাবার দাবার নিয়ে কোন টেনশন করবেন না, প্রচুর রেস্টুরেন্টের অপশন আছে। আর পাহাড়ী খাবারের স্বাদই আলাদা।
সিমলা, মানালী তো অনেক গিয়েছেন। একবার নৈনিতাল থেকেও ঘুরে আসুন। ঠকবেন না, এতটুকু আমার গ্যারান্টি!
হ্যাপি ট্রাভেলিং। দাই ফু!

হাসিব হাসান চৌধুরী

ঘুরে এলাম মায়ানমার ---

অনেক দেশ ঘোরার স্বপ্ন থাকলেও মায়ানমার যাব ঘুরতে তা কখনও ভাবিনি। আমার হাসব্যান্ড তসলিমের চাকরীর কারণে শেষ পর্যন্ত ঘুরে এলাম আমাদের পাশের দেশ মায়ানমার। ১৯ দিনের আমার এই সফরে আমি ঘুরে দেখেছি বেশ কিছু সুন্দর জায়গা, যার বর্ণনা আমি আমার এই লেখায় দিব। আর হ্যা, মায়ানমার দেশটি ঘুরে আমি তৃপ্ত।
বাগান- দ্যা সিটি অফ প্যাগোডাঃ
প্রথমেই যে জায়গার কথা বলব তা হল বাগান। কারণ মায়ানমার পৌঁছে পরদিন ই আমি চলে গেছি এই বাগানে। মায়ানমার এর প্রথম রাজধানী এটি। জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসী এই জাতি জ্যোতিষীর কথা মত এই নিয়ে ৪ বার তাদের রাজধানী বদল করেছে।
ইয়াঙ্গুন থেকে বাগানে বিলাসবহুল বাস চলাচল করে প্রতিদিন। ৪০০মাইলের এই পথ পেরোতে ৮ ঘণ্টার মত সময় লাগে। বাস ভাড়া ১৫০০-২০০০ টাকা জন প্রতি। চমৎকার হাইওয়ে দিয়ে এই ৮ ঘণ্টার জার্নি মোটেও কষ্টকর মনে হয় না। এয়ার হোস্টেসদের মত এই সব বাসে রয়েছে বাস হোস্টেস। আমরা সন্ধ্যা ৭:৩০ এ রওনা দিয়ে পরদিন ভোর রাতে এসে পৌছাই বাগানে। বাগান নাম শুনলেই মনে হতে পারে ফুলের শহর হয়ত এই বাগান।কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। বাগান হল প্যাগোডার শহর। যেখানেই চোখ যায়, শুধু প্যাগোডাই চোখে পড়ে। ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৪৪০০ টি প্যাগোডা আছে এই শহরে।

তৎকালীন শাসকেরা নাকি কোন পাপকর্ম করলে, পাপমোচনের জন্য তৈরি করে ফেলতেন একটি প্যাগোডা। আর তাই, প্যাগোডার অভাব নেই এখানে। ছিমছাম ছবির মত গোছানো এক শহর এই বাগান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক আসে এই শহর দেখতে। বাগানে আসার আগেই শুনেছি সূর্যোদয় দেখার জন্য এই বাগান সেরা। বিভিন্ন প্যাগোডার ছাদে বসে পর্যটকেরা উপভোগ করেন এই সূর্যোদয়। ঘোড়ার গাড়ি করে এলাম এক প্যাগোডায় সূর্যোদয় দেখতে। আমাদের আগেই পৌঁছে গেছে আরও অনেক দেশী বিদেশী পর্যটক। কি যে সুন্দর এই সূর্যোদয়ের দৃশ্য। অন্ধকার আকাশের বুক চিড়ে উঁকি দিল সূর্য। আর সূর্যোদয় হওয়া মাত্রই হঠাৎ দেখা গেলো একটু দূরে আলোর ঝলকানি। দুরের এক বিল্ডিং এর মাথায় জড়ো হতে লাগলো বেশ কিছু বিশাল আকৃতির বেলুন। এরপরই, আকাশের বুকে উড়তে শুরু করল হট এয়ার বেলুনগুলো। দেখেই মনটা নেচে উঠলো খুশিতে।

নিজেও এই হট এয়ার বেলুন রাইড নিতে চাইলাম। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না। কমপক্ষে ৭ দিন আগে বুক না করলে সিট মিলে না এই বেলুনে ওঠার। বিদেশী পর্যটকদের জন্য জন প্রতি খরচ ও কম না। ৩২০ ডলার। বেলুনে না ওঠার এই দুঃখ আমার এখনো রয়ে গেছে।
মায়ানমার একটি নিরাপদ দেশ। তাই ঘুরে বেড়াতে কোন দুশ্চিন্তা করতে হয় না পর্যটকদের। বিভিন্ন পর্যটক নিজেরা সাইকেল চালিয়েই ঘুরে বেড়ায় এই বাগানে। এছাড়া রয়েছে ঘোড়ার গাড়ি। বিভিন্ন প্যাগোডা ঘুরে বেড়ালাম একটা ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে। প্যাগোডাতে খালি পায়ে প্রবেশ করতে হয়। শুধু তাই নয়, স্বল্প পোশাকে এই সব প্যাগোডায় ঢোকা নিষেধ। বেশি-র ভাগ প্যাগোডায় ঢুকতে কোন প্রবেশ মূল্য লাগে না। কয়েকটি প্যাগোডায় ঢুকতে ১৫ ডলার প্রবেশ মূল্য দিতে হয়। তবে যেকোনো একটি প্যাগোডায় ১৫ ডলার দিলেই হবে। আপনাকে ধরিয়ে দিবে একটি কার্ড, যা দিয়ে এরপরের ৭ দিন যে কোন প্যাগোডা আপনি ভ্রমন করতে পারবেন। সূর্যোদয়ের মত সূর্যাস্ত দেখতেও অনেকে ভীড় করে বিভিন্ন প্যাগোডায়। আমরাও ইরাবতী নদীর তীরে অবস্থিত বু প্যাগোডায় গেলাম সূর্যাস্ত দেখতে। মন মুগ্ধকর ছিল সেই সূর্যাস্তের দৃশ্য।
পোপা মাউন্টেইনঃ
বাগান থেকে আমরা গেলাম পোপা মাউন্টেন। বাগান থেকে ১.৫ ঘণ্টার পথ। গাড়ি ভাড়া নিয়েই যাওয়া যায়। এখানে রয়েছে ৭৯৮ মিটার ওপরে একটি অদ্ভুত সুন্দর রিসোর্ট। নাম পোপা মাউন্টেইন রিসোর্ট। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য । এত উঁচুতে পাহাড়ের বুকে এই রিসোর্টের নির্মাণ শৈলী মুগ্ধ করার মত। পুরোটাই যেন কাঠ দিয়ে তৈরি। সবুজের মাঝে চোখে পরে সুন্দর করে তৈরি বেশ কিছু ভিলা। অসংখ্য বিদেশী পর্যটক এর দেখা মিলল এখানে। চারপাশের দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ এবং পাহাড়প্রেমী মানুষের জন্য এর চেয়ে সুন্দর জায়গা খুব কমই আছে বলে আমার ধারনা।

শুধু তাই না, এখানে আছে চমৎকার একটি সুইমিংপুল, যেখান থেকে খুব সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায় টঙ কেলাট এর। পোপা মাউন্টেইন রিসোর্ট এর অন্যতম আকর্ষণ এই প্যাগোডাটি।

৭৭৭ টি সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে হয় এই প্যাগোডায়। কথিত আছে, এই প্যাগোডায় দোয়া করলে তা পুরন হয়। কাজেই ধার্মিক মানুষের ভিড় অনেক। ছোট ছোট বাচ্চা নিয়েও মানুষ এই ৭৭৭ টি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। আর বিদেশী পর্যটকরা তো আছেনই। বেশ কিছু দুষ্টু বানর এর দেখাও মিলবে এই টঙ কেলাট এ।

এই রিসোর্ট এর পাশেই রয়েছে একটি হর্স রাইডিং জোন। চাইলে কোন ঘোড়া ভাড়া করে ঘুরে দেখতে পারেন এই রিসোর্ট এর চারপাশ। রিসোর্ট এ আমরা যে রুমে ছিলাম, তার বেলকনি দিয়েও দেখা যেত এই টঙ কেলাট। দুপুরে রাতে খেতে হবে এই রিসোর্ট এই। আসে পাশে তেমন ভালো কোন রেস্টুরেন্ট নেই তাই। বলে রাখা ভালো যে, এই রিসোর্টটি বেশ এক্সপেন্সিভ। আমরা যে ভিলাতে ছিলাম তার ভাড়া ছিল ১৫০ ডলার এবং খাবারের বিল ও ডলারেই দিতে হয়েছে। কিন্তু এত সুন্দর পরিবেশে একদিন থাকতে পেরেই আমি মহাখুশি।
নুই সং সী বিচঃ
মায়ানমার এ বেশ কিছু সুন্দর সমুদ্র সৈকত আছে। সব চেয়ে সুন্দর সৈকত এর নাম না পলি। এটা ইয়াঙ্গুন থেকে অনেক দূরে এবং বিদেশী পর্যটক দের জন্য খুব একটা নিরাপদ না কারণ, মুসলিমদের সাথে দাঙ্গা হয়েছে যে রাখাইন পল্লী তে তা, এই না পলি-র পাশেই।
তাই আমরা বেছে নিলাম নুই সং সমুদ্র সৈকতকে।
ইয়াঙ্গুন থেকে প্রতি সকালে বাস ছাড়ে, নুই সং এর উদ্দেশ্যে। বাঙালি কমিউনিটি থেকে নুই সং যাওয়ার একটা প্ল্যান করা হল। তাই আমাদের আর বাসে যেতে হয় নাই। এক ভাই এর গাড়িতে করেই গেলাম। সময় লাগলো ৫ ঘণ্টা। নুই সং পৌঁছেই খুশিতে মনটা নেচে উঠলো। এত সুন্দর সমুদ্র চোখের সামনে। পানি অসম্ভব সুন্দর নীল।

আমরা যে রিসোর্ট এ উঠলাম তার নাম বে অফ বেঙ্গল। সমুদ্র ঘেঁষেই তৈরি এই বিলাসবহুল রিসোর্টটি। পানি দেখে নিজেকে আটকে রাখা খুব কঠিন। রুমে যেয়ে একটু ফ্রেশ হয়েই চলে গেলাম বিচে। অদ্ভুত সুন্দর। আমার এই জীবনে আমি বেশ কিছু সী বিচ দেখেছি, কিন্তু এত সুন্দর, শান্ত এবং নীল পানি-র বিচ দেখি নাই। এই সী বিচ, বিদেশী পর্যটক দের জন্যই মূলত। স্থানীয় মানুষ এর ভিড় নেই। নেই প্যারা সেইলিং, স্নরকেলিং এর ব্যবস্থা। আর এই কারণেই পানি এত সুন্দর। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, এই সবের ব্যবস্থা আছে, আর এর জন্য আপনাকে ট্রলারে করে আর একটু দূরে যেতে হবে। আমাদের এইই সবের ইচ্ছা ছিল না। সমুদ্র দেখেই তৃপ্ত ছিলাম। বাইক ভাড়া করে ঘুরে বেড়ালাম সী বিচ এর পাশ দিয়ে।

এখানে রয়েছে একটা লাভারস আইল্যান্ড, যেখানে রয়েছে একটা মারমেইড এর মূর্তি। জোয়ারের সময় এখানে যেতে হয় ট্রলারে, কিন্তু ভাটার সময় হেটেই চলে যাওয়া যায়। আমরা বাইক নিয়ে যেয়ে এই লাভারস আইল্যান্ড ঘুরে দেখলাম। এর সামনেই দেখলাম বিভিন্ন দেশের পর্যটকেরা বালি দিয়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য বানাচ্ছে। কোনটা দেখার মত হচ্ছে, কোনটা দেখে হাসি পেল।
এই নুই সং এর পানি-র রঙ সকাল, দুপুর, বিকালে বিভিন্ন রঙ ধারন করে। সকালে পানির রঙ খুব গাঢ় নীল, দুপুরের দিকে কিছুটা হাল্কা, আর বিকালে পানি তে হাল্কা নীল আভা দেখা যায়।
আমাদের রিসোর্ট এর সুইমিংপুল ও সমুদ্রমুখী। সুইমিংপুলে ভিজে ভিজে জুস খেতে খেতে সমুদ্র দেখতে যে কত টা ভালো লাগে, তা এবার বুঝলাম।

আমাদের রিসোর্ট এর পাশেই ওয়েস্টার্ন পয়েন্ট, সামুদ্রিক খাবারের দোকান। অসম্ভব মজার খাবার পাওয়া যায় এখানে। সমুদ্র থেকে ধরা মাছ ভেসে বেড়ায় এই রেস্টুরেন্ট এর চৌবাচ্চায়। আপনি যেটাকে পছন্দ করে দিবেন, সেটাই আপনার মন মত রেধে পাঠিয়ে দেয়া হবে আপনার টেবিল এ।
আপনাদের জন্য একটা তথ্য। নুই সাং এর পেঁপে অনেক মজার। গেলে খেতে ভুলবেন না।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে এসে বসলাম সমুদ্র তীরে রাখা রিলাক্সিং চেয়ারগুলোতে। আসে পাশে কেও নাই। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। সাথে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। সামনে বিশাল সমুদ্র। মনে হচ্ছে আমার জন্যই রিসার্ভ করে রাখা পুরো বিচ টা। এ যেন ছিল এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
ইয়াঙ্গুনঃ
২ দিন নুই সাং এ কাটিয়ে ফিরে এলাম ইয়াঙ্গুন। অনেকেই আমরা ভাবি, এটাই মায়ানমার এর রাজধানী। কিন্তু তা নয়। মায়ানমার এর রাজধানী নেই পি ডো। খুব গোছানো ছিমছাম শহর এই ইয়াঙ্গুন। রাস্তা ঘাট চকচকে। উঁচু বহুতল ভবন খুব একটা নেই। দামি দামি গাড়ি হাঁকিয়ে মানুষ ছুটে চলে। ৫ তারকা হোটেল ও আছে বেশ কিছু। এই শহরে কিংবা এই দেশে সাধারণত ২ শ্রেণীর মানুষ আছে। উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত। মধ্যবিত্ত নাই বললেই চলে। আমি আমার সফরের অধিকাংশ সময় এই ইয়াঙ্গুনেই থেকেছি কারণ আমার হাসব্যান্ড এর অফিস এখানেই।

ইয়াঙ্গুন শহরের প্রধান আকর্ষণ শুয়ে ডাগন প্যাগোডা। স্বর্ণ এবং হীরকখচিত এই প্যাগোডা দেখতে দেশ বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসে ইয়াঙ্গুনে। শহরের যে কোন প্রান্ত থেকে দেখা যায় এই প্যাগোডার চূড়া। বিদেশী পর্যটক হওয়ার কারণে জনপ্রতি ৮ ডলার প্রবেশ মূল্য দিয়ে ঢুকতে হল আমাদের। ধর্মভীরু হাজার হাজার মানুষ এখানে এসে প্রার্থনা করে সুতায় ঝুলিয়ে রেখে যায় তাদের ব্যবহৃত দামি দামি অলংকার। পূর্ণিমার রাতে এই প্যাগোডার সৌন্দর্য আরও ভালো ভাবে নাকি বোঝা যায়।

এর পর ইয়াঙ্গুন এসে যেটা না দেখলেই না, সেটা হল পানিতে ভাসমান এক জোড়া ড্রাগনমুখী রেস্টুরেন্ট। নাম কারায়ুই প্যালেস। খুব ই নামকরা এই রেস্টুরেন্ট এ ৩দিন আগে থেকে বুকিং না দিলে নাকি সিট পাওয়া যায় না। এই রেস্টুরেন্ট টি যে লেকে অবস্থিত, তার নাম কানুজি লেক। এই লেকের চারপাশে রয়েছে ছোট বড় আর ও কিছু রেস্টুরেন্ট, যেগুলোতে অগ্রিম বুকিং এর প্রয়োজন নেই।

শহরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে ইনায়া লেক। অং সাং সূচির বাসায় ও এই লেক এর পাশেই। এখানে রয়েছে একটি মেরি গো রাউন্ড, যেটিতে চড়ে পুরো শহরটাকে এক নজর দেখে ফেলা যায়। 
খাওয়া দাওয়ার জন্য বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট আছে এই শহরে। বলে রাখা ভালো, খুবই এক্সপেন্সিভ দেশ এই মায়ানমার। রেস্টুরেন্ট এ খাবার খরচ এবং হোটেল এ থাকার খরচ অনেক বেশি। আমার ভাগ্য ভালো যে তসলিমের বাসাতেই ছিলাম,নিজেই রান্না বান্না করে খেয়েছি, বিভিন্ন বাঙালি ভাই,ভাবিরা দাওয়াত করে খাইয়েছেন। আর ইয়াঙ্গুনে আমার প্রিয় রেস্টুরেন্ট ছিল মেরি ব্রাউন। মালয়শিয়ান চেইন রেস্টুরেন্ট।
বেশ কিছু ভারতীয় রেস্টুরেন্ট এও খেয়েছি। খেয়েছি চায়না টাউনে। তবে দুঃখ লেগেছে এটা ভেবে যে নামী দামী কোন ইন্টারন্যাশনাল চেইন রেস্টুরেন্ট এখানে নেই। জানি না কেন?
আপনাদের যদি বিভিন্ন জেমস/ স্টোন এর প্রতি আকর্ষণ থাকে, তবে অবশ্যই চলে আসবেন এই ইয়াঙ্গুনে। রুবি, পান্না, সাফায়ার, ডায়মন্ড কি নেই এখানে? শপিং এর জন্য রয়েছে বোজও মার্কেট, অং সাং সূচির বাবার নামে এই মার্কেট। আর স্বর্ণের দাম ও বাংলাদেশের তুলনায় বেশ কম এখানে। ভরি তে হাজার ১০ কম তো হবেই। তবে স্বর্ণের ক্রেতাদের খুব একটা পাত্তা দিবে না এরা। আমাদের দেশের স্বর্ণের দোকানদার দের মত কোমল পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করা দূর এর কথা।

দেখতে দেখতেই যেন পার হয়ে গেল আমার ১৯ দিন এর এই সফর। ফিরে আসতে হল নিজ দেশে। কিন্তু মনের মাঝে রয়ে গেছে মায়ানমার ভ্রমনের সুন্দর স্মৃতিগুলো।
ভ্রমনের পূর্বে যে বিষয়গুলো লক্ষণীয়ঃ
* ৮ বছর বন্ধ থাকার পর চালু হয়েছে ঢাকা -ইয়াঙ্গুন- ঢাকা বিমানের ফ্লাইট। প্রতি সোম এবং বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকা থেকে ছেড়ে যায় বিমান ইয়াঙ্গুন এর পথে। ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট সময় লাগে। ভাড়া ৩৮৫ ডলার ( রিটার্ন সহ)।
* মায়ানমার যেতে ভিসা লাগে এবং ৩ কর্ম দিবস লাগে ভিসা পেতে। টুরিস্ট ভিসা ফী ২০০০ টাকা। মনে রাখবেন, মায়ানমার এম্বাসীর বাঙালি লোকগুলো কিন্তু টাকা ছাড়া কাজ করতেই চায় না। কাজেই ওদের টাকা না দিতে চাইলে হাতে সময় নিয়ে ভিসার জন্য দাড়াবেন।
* মায়ানমারে খরচ তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি। যদিও ১ ডলার ভাঙিয়ে ওদের দেশে প্রায় ৯৯০ চাট ( মায়ানমার এর মুদ্রা) পাবেন আর আমাদের ১ টাকা সমান ওদের ১২ চাট প্রায়। উদাহরণস্বরূপ ট্যাক্সিতে ওঠা মাত্রই আপনাকে বাংলাদেশী টাকার প্রায় ২০০ টাকা দিতে হবে। এর নিচে যেন ভাড়াই নেই। তবে ট্যাক্সির জন্য আপনাকে কখনই অপেক্ষা করতে হবে না। প্রচুর ট্যাক্সি আছে রাস্তায়।
** চলাফেরা করতে ওখানে কোন সমস্যা নেই। চোর ডাকাত এর ভয় নেই। খুব সিকিউরড দেশ মায়ানমার।
* এদের ইংলিশ এর ওপর খুব একটা দখল নেই। কাজেই কিছুটা সমস্যায় পরতে পারেন।
তবে তারা ইংলিশ জানুক আর না জানুক, আপনি দেখা মাত্রই কোন বার্মিজকে বলুন মিংলাবা। এটা তাদের সম্ভাষণ। তারা খুশি হয়ে যাবে।


মাদিহা খান জিতা LINK

বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৪

ইয়েলোষ্টোন পার্ক ভ্রমন

লিখেছেন: আদিল মাহমুদ


বিশ্বের সর্বপ্রথম এবং এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক পার্ক হিসেবে আমেরিকার ইয়েলোষ্টোন ন্যাশনাল পার্ক সুপরিচিত। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে এই ইয়েলোষ্টোন পার্কে ৪ দিনের ভ্রমনে গিয়েছিলাম। সে ভ্রমন ছিল পরিনত বয়সে আমার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সেরা ভ্রমন। সেই মুগ্ধতার কোন তূলনা নেই, ৪ বছরেও তার রেশ তেমন কমেনি, বরং বেড়েছেই বলা যায়। আবার কবে যেতে পারব সে আশায় দিন গুনি। তাই মনে হল আপনাদেরও এর কিছুটা স্বাদ দেই। যারা এখনো সেখানে যাননি তারা হয়ত কিছুটা আবেশ পাবেন। যদিও দুধের স্বাদ ঘোলে কোনদিনই মেটে না বলাই বাহুল্য।
প্রায় সাড়ে তিন হাজার বর্গমাইল বিশিষ্ট ইয়েলোষ্টোন পার্কটি আমেরিকার মিডওয়েষ্টে ওয়াইওমিং, মন্টানা, ও আইডাহো এই তিনটি রাজ্যের মাঝে পড়েছে। বেশীরভাগ অংশই পড়েছে আমেরিকার সবচেয়ে জনবিরল ওয়াইওমিং রাজ্যে। যারা বিদেশের এ জাতীয় প্রাকৃতিক পার্ক সম্পর্কে জানেন না তারা হয়ত পার্কের আকার দেখে বুঝতে পারছেন না যে পার্ক কিভাবে এত বড় হয়। বিদেশে এ জাতীয় প্রাকৃতিক পার্কগু্লি কোন দেওয়াল বা সীমানা ঘেরা থাকে না। আদতে এগুলি রমনা পার্ক বা সোরওয়ার্দী উদ্যান বলতে আমাদের চোখে যা ভেসে ওঠে মোটেও তেমন কিছু নয়। এই প্রাকৃতিক পার্কগুলিকে পার্ক না বলে সংরক্ষিত এলাকা বললে বোঝা যায় ভাল। বন, পাহাড়, হ্রদ ওয়ালা কিছু বিস্তীর্ন এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষনা করে এ জাতীয় প্রাকৃতিক পার্ক বানানো হয়। এ জাতীয় পার্কের ভেতর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে যথা সম্ভব কম আলোড়ন তুলে ভ্রমনকারিদের জন্য নগর জীবনের বেশীরভাগ সুবিধে যেমন হোটেল, রেস্তোরা, এসব গড়ে তোলা যেতে পারে। আবার কিছু কিছু পার্কে শুধুমাত্র বনের মাঝে ক্যাম্পিং এর ব্যাবস্থা থাকে। এ ধরনের ব্যাবস্থায় সাধারনত পানি ছাড়া আর তেমন কোন নাগরিক সুবিধে থাকে না; মোটামুটি আদম হাওয়ার জীবন। বস্তার মত স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে চেইন টেনে ঘুমাতে হবে, রাতের বেলায় হয়ত ভালুকে এসে তাবুর পাশে ঘুরে বেড়াবে। ভাল মুডে থাকলে হয়ত তাবুর ভেতরেও উকি দেবে।
ইয়েলোষ্টোন পার্ক যে তিনটি রাজ্যে পড়ছে সেই তিনটি রাজ্যই বেশ জনবিরল। পার্কের একটি গেটের কাছাকাছি ওয়াইওমিং এর জ্যাকসন নামের একটি ছোট শহরে এয়ারপোর্ট থাকলেও বিমান ভাড়া বেশী পড়ে, কারন ছোট এয়ারপোর্ট বলে ফ্লাইট কম। তাই আমরা প্রথম কলোরাডোর ডেনভার শহরে নামি। এই ডেনভার শহরেই আমি আমেরিকায় প্রথম নামি, তাই আমার কাছে এর কদর একটু বেশী। তাছাড়াও সেখানে ছাত্র জীবনের এক ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল, সেও বহুদিন ধরে বলছিল যেতে। ডেনভার নিউইয়র্ক বা শিকাগোর মত মাল্টি মেগা সিটি না হলেও আকারে বেশ বড়, এবং পুরো শহরটাই পাহাড় এবং লেকের অপূর্ব বিন্যাসে ঘেরা। শুধু ডেনভার শহর আর এর আশে পাশের এলাকায়ই মনে হয় বেশ কদিন ঘোরা যায়। আমেরিকার মিড ওয়েষ্ট অঞ্চলটা বরাবরই আমার খুব প্রিয়। পূর্ব বা পশ্চীম উপকুলের জনারন্যের বাইরে এ অঞ্চলের প্রকৃতির অবারিত বিস্তার আমাকে সবসময়ই মুগ্ধ করে। লোকজনের মধ্যেও আন্তরিকতা অনেক বেশী মনে হয়। বন্ধুর উষ্ম আতিথিয়েতায় দুদিন ডেনভার এবং তার আশেপাশের নানান এলাকা দেখে অবশেষে গাড়ি ভাড়া নিয়ে রওনা দিলাম ইয়েলোষ্টোন পার্কের দিকে।
বলে রাখা ভাল যে ডেনভার শহর থেকে ইয়েলোষ্টন পার্ক প্রায় ৬০০ মাইলের কাছাকাছি। আমেরিকায় এই দুরত্ব এমন কিছু ব্যাপার না হলেও খুব কমও নয়। এই দীর্ঘ পথে বেছে নেবার আরেকটি কারন আমি আমেরিকায় যে শহরে প্রথম ছাত্রজীবন কাটাই সেই ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াইওমিং ও আমার প্রিয় ল্যারামী শহর এক নজর দেখা ও আমার স্ত্রীকে দেখানো। বিদেশে মনে হয় সবার মাঝেই এই বোধটা কম বেশী কাজ করে। নিজে প্রথম যে শহরে থাকে সেই শহরের প্রতি আলাদা মমত্বমোধ জন্মে। নইলে ২৬ হাজার লোকের একটা শহর ভাল লাগার তেমন কিছু নেই। আমার স্ত্রী আমার সেই অতি প্রিয় শহর যা তাকে দেখাতে এত লম্বা পথ ড্রাইভ করার সাহস করেছি দেখে চরমভাবে হতাশ, এবং আমার রুচি এবং লাইফ ষ্টাইল সম্পর্কে তার চিরন্তন চিন্তাধারার পূনরায় প্রকাশ ঘটালো যেগুলি যথেষ্ট আপত্তিকর ও ছাপার অযোগ্য। তাকে শহর দেখাই আর বলি এটা এই এটা সেই, সে আরো বিস্মিত হয়ে বলে এখানে কিভাবে এতদিন থাকলে? তবে ল্যারামি শহর থেকে আধা ঘন্টা দূরে ভিদাবু (আদিবাসী নাম) নামের একটা পাথুরে পাহাড়ের পার্ক দেখার পর সে কিছুটা খুশী হয়। এই পার্কের অনন্য বৈশিষ্ট্য হল এর পাহাড় বিশাল বিশাল বেশ কিছু পাথর খন্ডের উপর তৈরী। তাতে তেমন অবাক হবার কিছু নেই। তবে সেই দানবীয় খন্ডগুলি একটা আর একটার উপর যেভাবে হাজার হাজার বছর ধরে বসে আছে তাতে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। কোন কোন পাথর একটা আর একটার হয়ত মাত্র আধ হাত যায়গা জুড়ে মাত্র লেগে আছে, বাকি অংশ শূন্যের উপর। পাহাড়গুলির চূড়ায় তাকালেই মনে হয় এই বুঝি ওয়েষ্টার্ন ছবির মত এক এক করে রণসাজে সজ্জিত আদিবাসী ইন্ডিয়ান দেখা দেবে।
আমার প্রিয় ল্যারামির কিছু পুরনো স্মৃতি চারনার পর দুপুর বেলা আবার রওনা হলাম। এবার আসল লক্ষ্য, ইয়েলোষ্টোন পার্ক, যেতে হবে উত্তর-পশ্চীমে। ল্যারামি থেকে ৩০ মাইল দূরে অবস্থিত স্নোয়ি রেঞ্জ নামের আরেকটা পার্কের ভেতর দিয়ে যাব, তাতে কিছুটা সময় বাড়বে। ল্যারামি থেকে স্নোয়ি রেঞ্জ যাবার হাইওয়ে ১৩০ পথটা আমেরিকার ন্যাশনাল সিনিক ওয়ে এর অন্তর্ভুক্ত। এই রাস্তার প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার লোভ সামলানো খুব কঠিন। পুরো পথটা ধীরে ধীরে পাহাড়ের উপর উঠতে থাকে, দুদিকে বিস্তীর্ন পান্ডব বিবর্জিত তৃণভূমি। পাহাড়ের চূড়ায় বারো মাসই বরফ থাকে। আশেপাশে তাকালে মনে হয় খালি চোখেই ৫০ মাইল দেখা যায়। মাঝে মাঝে হ্রদ এবং বনভূমি। সেই সৌন্দর্য বর্ননা করার মত উপযুক্ত ভাষা আমার নেই, বিভূতিভূষন হয়ত পারতেন। পাহাড়ের চূড়ায় সেন্টিনেল নামের ১০ বর্গমাইলের একটা ছোট শহর, যার জনসংখ্যা ১৯০। ১৯০ জনসংখ্যা শুনে অবাক হবেন না, পথে আরেকটি শহর ছিল যার জনসংখ্যা ৪। শহর বলতে দুয়েকটি বাড়ি, আর একটি গ্যাস ষ্টেশন; গ্যাস ষ্টেশনের মালিকই হলেন শহরের মহামান্য মেয়র বা নগর পিতা। ওয়াইমিং রাজ্যে ৫০/১০০ জনের শহর অনেক আছে। আমার ছাত্রাবস্থায় এসব ছোট শহরের ছেলেমেয়েদের অনেককেই ২৬ হাজার লোকের ল্যারামি শহরের “নাগরিক জীবনের বিড়ম্বনায়” বিরক্ত হতে দেখেছি। এত বড় শহর তাদের ভাল লাগে না। যদিও এ শহরে দরজা খোলা রেখেও রাতে ঘুমাতে পারেন, দিনে ক্লাসেও চলে যেতে পারেন, রাস্তায় হাটতে দেখলে গাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে।
স্নোয়ি রেঞ্জ থেকে বের হয়ে ইয়েলোষ্টোন যাবার মূল পথ আই-৮০ তে উঠলাম। দ্রুত সবুজ গায়েব হয়ে যেতে শুরু করল, পথ হয়ে উঠতে লাগল কিছুটা বোরিং। শুধু মাঝে মাঝে হরিনের পাল আর অন্য কিছু বন্যপ্রানী ছাড়া তেমন কিছুই দেখার নেই। বেশ কয়েক পাল বুনো ঘোড়া দেখলাম। আমার স্ত্রীর ধারনা ছিল বুনো ঘোড়া মানেই দিবারাত্র অহঃনিশি দৌড়ের উপর থাকবে। দূঃখজনকভাবে কার্যত কোন ঘোড়ার পালকেই সেরকম ব্যাতিব্যাস্ত দেখা গেল না। সবকটা এক যায়গায় ঘাড় নীচু করে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে, দেখলে কেমন যেন বেকুব বেকুব লাগে, যদিও ঘোড়া খুবই বুদ্ধিমান প্রানী। এভাবে ক’ঘণ্টা একঘেয়ে পথ চলার পর রাত নামল।
রাতটা রক স্প্রীং নামের আরেকটি ছোট শহরের একটি মোটেলে কাটিয়ে দিয়ে সকাল বেলা আবার যাত্রা শুরু। এ শহরে রাতে খাবার জন্য একটা চীনে দোকানে ঢোকার পর একজন আমেরিকান আমাদের দিকে কিছুক্ষন কৌতূহলের চোখে তাকানোর পর এক পর্যায়ে ভদ্রভাবে অনুমতি নিয়ে আমাদের টেবিলে কিছুক্ষন বসলেন। যথারীতি আমেরিকান কায়দায় কিছু সৌজন্য মূলক কথাবার্তার পর তার আগ্রহের কারন ভেঙ্গে বললেন। আমাদের দেখে তার ধারনা হয়েছিল যে আমরা ভারতীয়। তার দাদী ছিলেন একজন পাঞ্জাবী ভারতীয় মহিলা। যদিও তিনি কখনো ভারত যানি, দাদীকেও কখনো দেখেননি, তবে ভারতীয় দেখলে আগ্রহ বোধ করেন। তিনি অবশ্য পাঞ্জাব উচ্চারন করতে পারেন না, বলেন পুঞ্জাব। ভদ্রলোক মার্কিন নৌবাহিনীতে বেশ কিছুদিন ছিলেন। আমাকেও, মনে হয় আমার লম্বা চওড়া দেহ দেখেই নৌবাহিনী বা সেনাবাহিনীতে ঢোকার সুপরামর্শ দিলেন। সেখানের চাকরির কি কি সুবিধা, রিটায়ার করলেও কত সুবিধে এসব বোঝালেন। আমিও বেশী ঝামেলা না করে একমত হলাম। এ কথা সেকথার পর তিনি তার টেবিলে চলে গেলেন। এখন তার নিয়মিত কিডনী ডায়ালাইসিস করতে হয়। যদিও খাবার সময় আড়চোখে তার প্লেট দেখে তেমন কোন আলামত চোখে পড়েনি। যে হারে তিনি চিংড়ী ভাজা সাঁটাচ্ছিলেন তাতে তার কোন গুরুতর রোগ আছে বিশ্বেস করা বেশ শক্ত।
ওয়াইওমিং অত্যন্ত জনবিরল আগেই বলেছি। রাজ্যে আধুনিক শিল্প কারখানা বলতে আক্ষরিক অর্থেই কিছু নেই। আমাদের ইউনিভার্সিটির ৭ তলা ছাত্রাবাস হল রাজ্যের সবচেয়ে উঁচূ বিল্ডিং। মাইলকে মাইল ধুধু আধা মরুময় তৃণভূমি, মাঝে মাঝে দুয়েকটা র‌্যাঞ্চ, সেখানে গরু, ছাগল, ঘোড়া পালন করা হয়। ছোট ছোট শহরগুলিতে ঢুকলে হঠাৎ মনে হয় ওয়াইল্ড ওয়েষ্টের যুগে চলে এসেছি। বাড়িঘর, দোকান পাট বেশীরভাগই পুরনো আমলের কাঠের লগ কেবিন ষ্টাইলের, পুরো পরিবেশের মাঝেই পুরনো দিনের প্রচ্ছন্ন ছাপ পাওয়া যায়। পুরনো দিনের ওয়েষ্টার্ন ছবিতে যেমন ব্যাট উইং ডোর ওয়ালা সেলুন, সেই ব্যাট উইং ওয়ালা দোকান পাটও আছে। লোকজনের বেশ ভূষাও অনেকটা তেমন; টাইট জীন্স, হাঁটু পর্যন্ত উঁচু বুট, মাথায় হ্যাট, ঘন ঝোলা দাঁড়ি গোফ। শুধু ঘোড়ার পিঠে না চড়ে চালাছে গাড়ি। স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের ট্র্যাডিশন ও প্রকৃতি ধরে রাখার পক্ষে এখন পর্যন্ত খুবই কট্টর, তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে তেমন জোর দেয় না। বড় কোম্পানীগুলি তাই এ রাজ্যে এখনো ঢুকতে পারেনি।
ইয়েলোষ্টোন পার্কে ঢোকার মোট ৪টি গেট আছে। আমরা দক্ষিনের দিক থেকে ইয়েলোষ্টোনে যাই। পার্কের দক্ষিন গেট ঘেষে জ্যাকসন নামের একটি ছোট শহর আছে। অপূর্ব সুন্দর একটি ট্যূরিষ্ট শহর। এ শহরের এক প্রান্তে একটা বিশাল মাঠ আছে। এই মাঠে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে হরিনের দল এসে তাদের মাথার শিং ফেলে যায়। সে সময় পুরো মাঠময় শুধু হাজারে হাজারে শিং দেখা যায়, সে নাকি এক আজব দৃশ্য। শহরের ভেতর একটি গেট বানানো আছে হরিনদের ফেলে যাওয়া এসব শিং দিয়ে। আমেরিকার সব পার্কের প্রবেশ মুখেই একটি করে বিনে পয়সার নয়নাভিরাম ভিজিটর সেন্টার থাকে। এসব যায়গায় পার্ক সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্যাবলী তথ্যাবলী চমতকারভাবে দেওয়া থাকে। জ্যাকসন শহরের এই সেন্টারটি আরো কয়েক কাঠি বাড়া। এখানে ইয়েলোষ্টোন পার্কের ইতিহাস, ভূপ্রকৃতি, আদিবাসীদের ঐতিহ্য, প্রায় সব প্রানীদের লাইভ সাইজের ষ্টাফিং কৃত্রিম জংগল সৃষ্টি করে রাখা আছে। এই সেন্টারটাই শুধু সারাদিন ঘোরা যায়।
আগেই বলেছি এসব পার্ক কোন দেওয়াল বা বেড়া ঘেরা নয়। তবে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে প্রবেশমূল্য নেওয়া হয়, তারজন্যই গেটের ব্যাবস্থা। আমাদের পার্কের ভেতরে থাকার রিজার্ভেশন ছিল, তাই প্রবেশমূল্য লাগল না। পার্কের ম্যাপ ধরিয়ে কিছু গতবাধা কথাবার্তা শুনিয়ে দিল। শুরু হল জংগলের ভেতর দিয়ে পথ চলা। তবে ভরা ট্যুরিষ্ট মওসুম হওয়ায় গাড়ির ভীড় যথেষ্ট। এর মাঝেই রাস্তায় বেধে গেল বিরাট জাম। কারন সামনে দূর্ঘটনা ঘটেছে। এই কারনে বেশ কিছুক্ষন দেরী হল। অবশেষে বিকেলের দিকে পৌছালাম আমাদের প্রথম রাত কাটাবার স্থান লেক ইয়েলোষ্টোন সাইটে।
ইয়েলোষ্টোন পার্কের ভেতর দর্শনার্থীদের সুবিধের জন্য ছোট ছোট ৪ টি কেন্দ্র তৈরী করা হয়েছে যেগুলিতে আধুনিক কায়দায় থাকা খাওয়া, বাজার, গাড়ির ওয়ার্কশপ সবই আছে। এ ছাড়াও পুরো পার্ক জুড়েই জংগলের ভেতর অসংখ্য ক্যাম্প সাইট আছে। পুরো পার্ক অনেক বড় হওয়াতে ভাল বুদ্ধি হল একাধিক যায়গায় রাত কাটানো। আমরা প্রথম দুরাত রাত কাটাই লেক ইয়েলষ্টোনের ধারের একটি কেবিনে। এই কেন্দ্রটিতে বেশ কয়েকটি কেবিন এবং ৩০০ রুমের অত্যাধুনিক একটি হোটেলও রয়েছে। পান্ডব বিবর্জিত ঘোর জংগলের মাঝে এই এলাহি কারবার দেখলে অবাকই হতে হয়। এই পুরো এলাকাটি লেক ইয়েলোষ্টোন নামের বিশাল এক নীল পানির হ্রদের পাড়ে, বহুদুরে অপর পাড় দেখা যায়, তাতে সুউচ্চ পর্বত শ্রেনী। লেকের ধারেই অদ্ভূত নির্জনতার মাঝে একটি চমতকার সন্ধ্যা কাটিয়ে দিলাম।

পরদিন শুরু হল আসল পার্ক সফর। ইয়েলোষ্টোন পার্ক আসলে এত বিশাল আর দেখার এত কিছু আছে (অবশ্যই ব্যাক্তিগত পছন্দ অপছনের ব্যাপার আছে) যে অনায়াসে আমরা ৪ মাস কাটিয়ে দিতে পারি। পার্ক ঘোরার পদ্ধুতি খুবই সহজ। গেট থেকেই পুরো পার্কের ম্যাপ দিয়ে দেয়। সেই ম্যাপ ভেতরেও বহু যায়গায় থাকে। ম্যাপের ভেতরেই অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাবে দেখানো থাকে কোন কোন যায়গায় কি কি আছে, কিভাবে যেতে হয়। যেমন, পার্কে বনের ভেতর অসংখ্য পায়ে হাঁটার হাইকিং ট্রেইল আছে। ম্যাপে দেখানো থাকে সেসব ট্রেইলের অবস্থান এবং তার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য, গাড়ি পার্ক করার যায়গা, কোন যায়গায় রেষ্টুরেন্ট আছে এর সবকিছুই। কোন যায়গায় কি কি আকর্ষনীয় বিষয় আছে সব মার্ক করা থাকে। এখন আপনার কাজ কেবল আপনার পছন্দ অনুযায়ী যায়গা নির্বাচন করে সারাদিনের প্ল্যান ঠিক করে বেরিয়ে পড়া। ইয়েলোষ্টোনের বনভূমির গাছগুলি বেশীরভাগই শীত প্রধান দেশের কনিফার জাতীয় যা বারো মাসই সবুজ থাকে, সাথে আছে বিস্তীর্ন তৃনভূমি আর অসংখ্য ছোট বড় হ্রদ। বনের ভেতর প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবজন্তু পাখি দেখা প্রধান আকর্ষন, তবে এ ছাড়াও প্রকৃতি ও নির্জনতারও তূলনা মেলা ভার। আর আছে বেশ কিছু ইন্টারেষ্টিং জিওলোজিক্যাল ফিচার ও আকর্ষন যা পরে বলব।
ইয়েলোষ্টোন পার্কের অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে অবাধে বিচরন করা বন্যপ্রানী দর্শন হল একটি অন্যতম প্রধান আকর্ষন। হরিন ও বাইসনের পাল দেখা যায় অহরহ, কোন রকমের অপেক্ষা ছাড়াই। তবে ভালুক, নেকড়ে, বীভার, কয়োট এদের দেখাটা কিছুটা ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। রাস্তার ধারের নির্দিষ্ট পার্কিং ছাড়া অন্য কোথাও হঠাত গাড়ির জটলা দেখলে বুঝে নিতে হবে যে দ্বিতীয় গ্রুপের কোন প্রানী দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় বাকিরাও দ্রুত গাড়ি কোনমতে রেখে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
আমরা সকালে রাস্তায় নামার মিনিট খানেকের মাঝেই একটা ঝোপের আড়ালে দেখি বিরাট এক বাইসন। তখনো জানি না যে এই বাইসনের পাল এখানে আমাদের দেশের কাকের মতই সহজলভ্য। তাই নগর জীবনে অভ্যস্ত আমি ক্যামেরা নিয়ে আধা উন্মাদের মত দৌড় দিলাম, পাছে এই অনন্য সুযোগ আবার না হাতছাড়া হয়ে যায়! আপনারা যারা সেবা প্রকাশনীর ওয়েষ্টার্নের ভক্ত বা আগে পড়তেন তারা হয়ত এই প্রানীর কথা অনেক পড়েছেন। বাইসন প্রানীটা হল অনেকটা আমাদের দেশের মহিষের মত, এরা আমেরিকান বাফেলো নামেও পরিচিত। আরেকটু বড় হবে মনে হয় সাইজে। প্রচন্ড শক্তিশালী, তবে খুবই নিরীহ। এককালে এরা সারা আমেরিকাময়ই গিজ গিজ করত। আজকের দিনে স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যায় কমে গেছে। তবে এখনো বহাল তবিয়তেই অনেক আছে।
গাড়ি আবার রাস্তায় তুলতেই বিরল বাইসন দর্শনের অপার আনন্দ নিমেষেই উবে গিয়ে বুক শুকিয়ে গেল। কারন এবার দেখি পুরো এক পাল বাইসন রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি পানে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তাদের চেহারা সূরত দেখে মোটেও বন্ধুসূলভ মনে তো হয়ই না, উল্টাটাই মনে হয়। আগে যেটাকে দেখেছিলাম সে এই পালেরই অন্তর্ভুক্ত। তাকেও দেখি জাবর কাটতে কাটতে গদাই লষ্করি চালে ঢাল বেয়ে নেমে আসছে। আমার মাথায় তখন হিসেব খেলা করছে ভাড়ার গাড়ি ভাংচুর হলে কি গতি হবে। গাড়ির ভেতর আমাদের কি হবে সেই চিন্তা কেন যেন আসেনি। ধরেই নিয়েছি যে এই পাল নিশ্চিত গাড়িতে চড়াও হবে। গাড়ি বাঁয়ে ঘুরিয়ে পাল এড়ানোর চেষ্টা করলাম। তাতে ফল হল যে বাইসনেররা ভয় পেয়ে রাস্তা ছেড়ে বনের মাঝে ঢুকে গেল। সাধারন নিয়ম আসলে বন্যপ্রানী রাস্তায় দেখলে গাড়ি থামিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করা। বন্যপ্রানীর সাথে বাড়ি লেগে প্রতি বছরই অনেক দূর্ঘটনা ঘটে থাকে।
নদীর ধার ধরে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছি আর প্রকৃতির শোভা উপভোগ করছি। এই ইয়েলোষ্টোন নদী আমাদের পদ্মা মেঘনার তূলনায় নস্যি হলেও যথেষ্ট চওড়া, দক্ষিন দিকে লেক ইয়েলোষ্টনে পড়েছে। দুধারেই ঘন বন। চলতে চলতেই দেখি রাস্তার এক পাশে বড় ধরনের জটলা। নদী এখানে রাস্তা থেকে অনেকটাই নীচে, ঘন ঝোপের জন্য পুরো দেখা যায় না। বুঝলাম যে নদীতে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি গাড়ি রাস্তার ধারে থামিয়ে দুজনে দৌড় দিলাম। ঘটনাস্থলে পৌছে দেখলাম অভাবনীয় দৃশ্য। নদীর প্রায় মাঝ বরাবর একটি হরিনের মৃতদেহ। দেখেই বোঝা যায় বেশ কদিনের পুরনো। সেটা লক্ষ্য করে একটি ভালুক নদীর মাঝ বরাবর ধীরে ধীরে হেটে এগুচ্ছে। তারা হাঁটার ভংগীতে বেশ বৈচিত্র আছে। সাধারনত চার পায়েই হাঁটে, তবে মাঝে মাঝে দুপায়ে দাঁড়িয়ে আশে পাশে তাকিয়ে দেখে। আশে পাশের বিশেষজ্ঞদের কথায় বুঝলাম যে এটা সাধারন কালো ভালুক নয়, গ্রিজলী ভালুক।
নদীর অপর পাড়ে বনের ভেতর আরেকটি কয়োটকেও দেখা যাচ্ছে অসীম ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে। এদের বলা যায় চান্স মোহাম্মদ। এরা নেকড়ে জাতীয় প্রানী হলেও আকারে অনেক ছোট, কিছুটা শেয়াল এবং আমাদের দেশীয় কুকুরের মাঝামাঝি। এরা তালে থাকে ভালুক বা নেকড়ে যখন শিকার ধরে খায় তার ছিটে ফোটা বা উচ্ছিষ্ট কপালে জোটে কিনা এই অপেক্ষায়। তবে বাগে পেলে এরাও হরিন শাবক বা ছোট প্রানীর উপর হামলা করে ভক্ষন করে। দর্শকরা পার্কের নিয়ম নীতি মেনে প্রায় সবাই নীরব ছিলেন। তারপরেও ক্যামেরার সামান্য শব্দ হচ্ছিল। তাই মনে হয় ভালুক বাবাজীর জন্য যথেষ্ট। উনি তাতে যথেষ্ট বিরক্তি বোধ করলেন, এমনকি লোভনীয় কদিনের পঁচা হরিনের মাংসের মায়া ত্যাগ করে ধীরে ধীরে গদাই লষ্করি চালে বনের ভেতর ঢুকে গেলেন।
ভালুক আর সব হিংস্র বন্যপ্রানীর মতই মানব সংসর্গ একেবারেই পছন্দ করে না। এদের ঘ্রান শক্তি অকল্পনীয়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে পুলিশের বিশেষ ট্রেনিং পাওয়া গন্ধ শোকার কুকুর থেকে ভালুকের ঘ্রানশক্তি ২৫ গুন পর্যন্ত বেশী হতে পারে। মানুষ এড়িয়ে চললেও প্রতি বছরই পার্কে দু একটি দূর্ঘটনা ঘটে যায়। নির্জন ট্রেইলে ভালুকের সাথে অপ্রত্যাশিত মোলাকাতে প্রানহানীর ঘটনাও মাঝে মাঝে ঘটে। পার্কে এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতামূলক বেশ কিছু নির্দেশনা আছে। যেসব অঞ্চল ভালুকের বিশেষ প্রিয় সেসব যায়গার ট্রেইলে হাইক করার সময় অনবরত কথা বলা বা কিছুর আওয়াজ করা সাধারন নিয়ম। ভালুক শব্দে বিরক্ত হয়ে দূরে চলে যায়। আমরা বনের মাঝে বেশ কিছু ট্রেইলে হাঁটার সময় গাছের গুড়িতে ভালুকের থাবার তাজা আঁচড়ের দাগ দেখেছি। পার্কের সাধারন নিয়ম কানুনের মাঝে ভালুক আক্রমন করলে কি করতে হয় তার নিয়মও জানানো হয়। নিয়ম অনেকটা সেই ছেলেবেলায় শোনা “ভল্লুক তোমার কানে কানে কি বলিল” গল্পের মত। নিজেকে বলের মত বানিয়ে মরার ভান ধরে মটকা মেরে পড়ে থাকা আর কি। ভালুক দর্শনের সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য অবশ্য এ যাত্রা পার্কে আর হয়নি।
এবার জীব জানোয়ারের জগত থেকে একটু প্রকৃতির দিকে নজর ফেরাই। পার্কের বৈচিত্রময় প্রকৃতি হতে পারে যেকোন প্রকৃতি প্রেমিকের বহুদিন উপভোগ করার মত খোরাক। হীরক রাজার ষ্টাইলেই বলতে হয় সাপ ব্যাং শকুনের ঠ্যাং কি নাই সেখানে? অবারিত সবুজ তৃণভূমি, ছোট বড় লেক, বিস্তীর্ন বনাঞ্চল, সুউচ্চ পর্বতমালা, বেশ কটি নয়নাভিরাম জলপ্রপাত, প্রকৃতির বিস্ময় বেশ কিছু বিরল জিওলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য…সব লিখতে গেলে আক্ষরিক অর্থেই মহাভারত রচনা করতে হবে। ভালুক দর্শনের পর দুপুরের লাঞ্চের পর রওনা দিলাম গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন অফ ইয়েলোষ্টোন দেখতে। এটা এরিজোনার বিশ্বখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মত অতটা গভীর না হলেও আমেজটা পাওয়া যায়। দিগন্ত বিস্তৃত দুই উঁচু লালচে পাথুরে পাহাড়ের মাঝে গভীর খাদ, বহু নীচে রুপালী ফিতের মত বয়ে চলা খরস্রোতা নদী। খাদের সর্বোচ্চ গভীরতা ১২০০ ফুট, কিছু কিছু যায়গায় ৪০০০ ফুট চওড়া। গাড়ি পার্ক করার যায়গা থেকে পাহাড়ের কিনারা ঘেষে কিছুটা গেলে দর্শকদের জন্য ভিউ পয়েন্ট আছে যেখান থেকে এর বিস্তৃতি সময় নিয়ে উপভোগ করা যায়। এখান থেকেই দেখা যায় আপার ফলস এবং লোয়ার ফলস নামের দুই জলপ্রপাত। পাহাড়ি চিকন আঁকা বাঁকা পথ ধরে জলপ্রপাতের একেবারে কাছেও চলে যাওয়া যায়। সেও এক দারুন অভিজ্ঞতা।