আমাদের চার বন্ধুর মাথায় মাঝে মাঝেই সিনেমা দেখার ভুত চাপে। একবার
‘কোয়ি মিল গ্যায়া’ নামন হিন্দী সিনেমাটি দেখার পর সিনেমার লোকেশন টা খুব
পছন্দ হয়ে গেলো। পরে ‘স্যার গুগল’-এর কাছ থেকে জানতে পারলাম যে জায়গাটির
নাম ‘নৈনিতাল’। ব্যাস আর কি? পরদিন থেকে শুরু হলো নেট ঘাটা এবং বড় ভাইদের
পেছনে লেগে থাকা সব খোঁজখবর নেবার জন্য ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এ সবের ফলাফল
অনুযায়ী মাস খানেক পর পকেটে হাজার দশেক টাকা নিয়ে উঠে পড়লাম কলতাকার
বাসে।
ঝামেলা হলো শুরু
এখন উপরের সিম্পল বর্ননা শুনে যদি মনে হয় যে নৈনিতাল যাওয়াটা আজিমপুর যাবার মতোই সোজা, তাইলে আগেই বলি স্যরি। কারণ নৈনিতাল যাওয়াটা বেশ ভালোই ঝক্কির। শুরুতেই আমরা হোঁচট খেলাম ফোরস এর একজনের অনুপস্থিতিতে। তারপর বাজেট সংকট এবং সবচেয়ে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা। (২০০৫ সালে ভারতের ভিসা করার জন্য সত্যি সত্যিই সারা রাত লাইনে দাঁড়াতে হতো!) কোনমতে পৌছালাম কোলকাতা সস্তায় সস্তায় এবং এক বড় ভাইয়ের (আমাদের প্রিয় জানের টুকরা ফসু ভাই!) বুক করা হোটেল রুমে উঠে পরলাম পয়সা বাঁচাতে। তারপর শুরু হলো ‘কালকা মেইল’ এ দিল্লীর উদ্দেশ্যে যাত্রা। ইয়া আল্লাহ - সাধে লোকে বলেনা দিল্লী দুরস্ত! পাক্কা ৩৬ ঘন্টা পর নামলাম দিল্লীতে। দিল্লীতে নামার পর শুরু হলো কাঁপাকাঁপি, কি যে ঠান্ডা! তারপর সারাদিন রেস্ট নিয়ে আবারও ট্রেন জার্নি, এবার দিল্লী টু কাঠগোদাম। এটা বেশিক্ষণ না, মাত্র ১৪ ঘন্টা!
কাঠগোদাম টু নৈনিতাল
কাঠগোদাম স্টেশনটায় নামার সাথে সাথে পুরো ভ্রমণের যত ধকল ছিলো সব সাথে সাথে কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেলো। এটা আমার দেখা ভারতের সবচেয়ে সুন্দর স্টেশন। স্টেশনটা যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয়েছে বিশাল পাহাড়ের সারি। মনে হয় সামনে যেন কতই না অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে। কাঠগোদাম থেকে ট্যাক্সিতে নৈনিতাল পৌঁছাতে সময় লাগে দুই ঘন্টার মতো। আমরা জানুয়ারী মাসে গিয়েছিলাম তাই পুরো পাহাড়ী রাস্তাটায় সবুজ ঘাসের উপর তাজা বরফ পরে আছে - কি যে সুন্দর! পুরো জার্নিটা করতে আমাদের সময় লাগে দুই গুন বেশি কারণ পুরো রাস্তায় এত সুন্দর সুুন্দর স্পট যে কোনটা ছেড়ে কোনটায় দাড়াবো বুঝেই পাওয়া যায় না। পুরো জার্নিটা এক কথায় অসাধারণ।

ছবিঃ কাঠগোদাম স্টেশন
“তাল্লিতাল.. মাল্লিতাল.. বিচমে হ্যায়.. নৈনিতাল!”
‘নৈনিতাল’ বা ‘নৈনাঝিল’ হলো ভারতের অন্যতম বৃহত লেক সিটি। দার্জিলিং এর মিরিক লেক থেকে এটা প্রায় ৪/৫ গুন বড়। আবার শ্রীনরের ডাল লেকের মতো এতটা বিস্তৃতও না। খুব সুন্দর ‘কলকা’ শেপের এই লেকটির চারদিক পাহাড় ঘেরা। টলটলে স্বচ্ছ পানি (বরফের মত ঠান্ডা!), ঝকঝকে নীল আকাশ আর সাদা তুষারে মোড়ানো সবুজ পাহাড় -প্রকৃতির এক অপূর্ব চারনভুমি এই নৈনিতাল। আর পুরো লেকের চারপাশে গড়ে উঠেছে নৈনিতাল শহড়। লেকের নিচের দিক টার নাম ‘তাল্লিতাল’ আর উপরের দিকটার নাম ‘মাল্লিতাল’। তাল্লিতালের তুলনায় মাল্লিতাল বেশ সভ্রান্ত। দোকানপাট গুলোও বেশ ঝকঝকে আর দারুন দারুন সব বাংলো বাড়ি। আমরা যেদিন নৈনিতাল পৌছাই ঠিক তার আগের দিন এখানে স্নো -ফল হয়, তাই প্রতিটি বাড়ির কার্নিশে আর টালির ছাদে ছিলো সাদা বরফের আস্তর। কিন্তু মেঘ কেটে যাওয়াও পুরো পরিবেশটা ছিলো দারুন ঝকঝকে। নৈনিতালের অসাধারণ পরিবেশের কারণে এখানে গড়ে উঠেছে ভারতের নাম করা সব বোর্ডিং স্কুল। একটা পাগল খানাও আছে, আমার ধারণা রোগীরা এখানকার সৌন্দর্য দেখে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়!

ছবিঃ নৈনিতাল
নৈনিতালের কাছাকাছি
উপরের কথাগুলো আমাদের তিনজনের জন্য একেবারে মিথ্যা। কারণ ধবধবে সাদা মিহি তুষার পেয়ে আমরা এমন পাগলামিতে মেতেছিলাম যে আশ-পাশের মানুষ আমাদের নিঃসন্দেহে পাগল ভাবছিলো। আসলে নতুন তুষারের মজাই আলাদা। আমাদের দেশে এই জিনিষটা বড্ড মিস করি। আর তুষারের বল বানিয়ে বরফের বল ফাইটিং খেলার তো তুলনাই হয় না।

ছবিঃ বরফে পাগলামি
আমরা এই বরফের সাম্রাজ্য পেয়েছিলাম মাল্লিতাল থেকে একটু উপরে একটি পাহাড়ী পার্কে। রোপ ওয়ে (কেবল কার) দিয়ে আপনাকে সেখানে পৌঁছাতে হবে। পাহাড়টি থেকে আপনি পুরো নৈনিতালের দারুন ভিউ পাবেন। এখানে একটা ছোট মার্কেটও আছে যেখানে আপনি নৈনিতালের ট্রাডিশনাল পোষাক পরে ছবি তুলতে পারেন।
তাল্লিতালে, লেকটার কিনারায় আছে দারুন একটা মসজিদ। খুব সুন্দর সাদা কারুকাজে ভরপুর মসজিদটা গড়ে উঠেছে একটা স্টেডিয়ামের পাশে। স্টেডিয়ামটা একটু অদ্ভুত, পুরো মাঠটিই সিমেন্টের তৈরি, এরা যে কিভাবে খেলে আল্লাই জানে। স্টেডিয়ামটির আশেপাশে গড়ে উঠেছে ছোট মেলার মতো মার্কেট। মার্কেটটা বেশ সস্তা, বিশেষ করে শীতের পোষাক আর মোমবাতি এখানে খুবই সস্তায় পাবেন।
বোটিং
নৈনিতালে আসবেন আর বোটিং করবেন না, তা’তো হয় না। এখানে খুব সস্তায় নৌকা ভাড়া পাওয়া যায় ঘন্টা হিসেবে। আমি ভারতের অনেক লেকে বোটিং করেছি, তবে এতটা স্থির পানির লেক আর দেখিনি। লেকটির মাঝখানে নৌকা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকুন, খুব ভালো লাগবে। ২০০-৩০০ রুপির মধ্যেই আপনি ঘন্টা হিসেবে নৌকা ভাড়া পেয়ে যাবেন। আর মনে রাখবেন, পানি কিন্তু বীভৎস রকমের ঠান্ডা!

ছবিঃ নৈনিতালে বোটিং
নৈনিতাল থেকে একটু দুরে
নৈনিতাল পৌছানোর পরদিন আমরা ঘুরতে বের হই এর আশপাশটা দেখবার জন্য । সারাদিনের জন্য একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পরি। মাল্লিতাল থেকে ৫-৭ কিলোমিটার পরেই শুরু হয়ে যায় ঘন পাহাড়ী বন। এই জঙ্গল বিখ্যাত হয়েছে জিম করবেটের শিকারের চারনভুমি হিসেবে। উচু উচু পাইন গাছের মধ্যে দিয়ে আপনি পাগাড়ী ট্রেইল ধরে হর্স রাইড করতে পারেন। এই জঙ্গলটি ঘুরে দেখবার জন্য ঘোড়াই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি। কারন মাটির পাহাড়ি রাস্তায় বরফ পরে অসম্ভব পিচ্ছিল হয়ে থাকে। উঁচু উঁচু গাছগুলোর মাথায় সাদা বরফ জমে থাকে, খুব সুন্দর একটি দৃশ্য। এখানেই কোই মিল গ্যায়া সিনেমার পিচ্চি এলিয়েনটা ল্যান্ড করেছিলো।

ছবিঃ করবেটের জঙ্গলে
এরপর আমরা যাই সুইসাইড করতে। মানে সুইসাইড পয়েন্ট দেখতে। খোদাই জানে কেন এর নাম সুইসাইড পয়েন্ট কারণ পাহাড়ী এই ভ্যালিটি দেখবে খুবই সুন্দর। ভ্যালিটিতে ছোট কিন্তু খুব সুন্দর আরেকটি লেক আছে, এটার নাম সুখা তাল। নামকরণেই কারণেই হয়তো জায়গাটিতে গেলে বেশ গা ছমছম করে।

ছবিঃ সুইসাইড পয়েন্ট
আমাদের পরের গন্তব্য ছিলো কেভ গার্ডেন। এখানে বেশ কিছু গায়ে গা লাগা পাহাড়েরর ভেতর দিয়ে বড় একটা সুরঙ্গ হয়ে আছে। সুরঙ্গটা আমাদের খাগড়াছরির আলুটিলার মতোই তবে আরেকটু এক্সাইটিং। আপনি সুরঙ্গের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যেতে পারবেন মশাল হাতে নিয়ে। তবে আমার মত মোটাসোটা হলে বিপদ আছে। কখনো বসে, কখনো ক্রল করে আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে।
‘তাল’ শব্দটির অর্থ লেক। আর এখানে তালের অভাব নেই। প্রতিটি পাহাড়ের কোনায় কোনায় খালি তাল আর তাল। ভীম তাল, নাগা তাল, সুখা তাল - নৈনিতাল ছাড়াও আরো একগাদা তাল আছে। সবগুলো তালই খুব সুন্দর কিন্তু সত্যি কথা বলতে নৈনিতালের কাছে বাকিগুলো কিছুই না! তাই বোটিং করতে চাইলে নৈনিতালেই করুন।
উপরের জায়গাগুলো হলো তথাকথিত টুরিস্ট স্পট। তবে এই ছোট্ট ছবির মতো শহড়ে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। তাই পায়ে হেঁটে বা রিক্সায় চড়ে ঘুরে বেড়ান শহড়টি, অসাধারণ লাগবে। সন্ধ্যার দিকে লেকটার পাশের বেঞ্চিগুলোতো লাইন দিয়ে বসে থাকে কাপল রা। আমরা তিন বন্ধুই তখন ছিলাম ব্যাচেলার, তাই বড্ড হতাশ লাগছিলো। তখনই প্রমিস করেছিলাম যে একবার বৌ নিয়ে এখানে আসতেই হবে! আপনাদেরও বলি, কাপল ডেস্টিনেশন হিসেবে নৈনিতালের জুড়ি নেই।

ছবিঃ তিন বন্ধু পাহাড়ি ভ্যালিতে
কিভাবে যাবেন
আমি একজন বাজেট ট্রাভেলার, তাই সেই হিসেবেই আপনাদেরকে বাজেট দিচ্ছি। এই পুরো ট্রিপটি আপনি অনেক লাক্সারিয়াস ভাবেও করতে পারেন।
ঢাকা থেকে কোলকাতা চলে যান যে কোন বাসে। শ্যামলী, গ্রিন লাইন বা সোহাগ -সবগুলোর সার্ভিসই প্রায় এক ধরণের। কোলাকাতা গিয়ে সেদিন দিল্লী যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। পরের দিন রাজধানী অথবা দুরন্ত এক্সপ্রেস ধরে চলে যান দিল্লী। খরচ পরবে ১৮০০ রুপির মতো আর সময় লাগবে ১৬ ঘন্টা। (টিকেট কাটা সংক্রান্ত জটিলতা হলে এই লেখাটি পড়তে পারেন - train tickets booking) এরপর দিল্লী থেকে কাটুন কাঠগোদামের টিকেট। দিল্লি টু কাঠগোদাম বেশ কিছু অপশন আছে, রাতের ট্রেনটাই ভালো কারণ এই জার্নিটা প্রায় ১২-১৪ ঘন্টার। আপনি ইচ্ছা করলে জেএসবিটি থেকে নৈনিতাল যাবার বাসও ধরতে পারেন কিন্তু রেকমেন্ড করবো না। আমরা ফিরেছিলাম বাসে, অনেকটা জান হাতে নিয়ে! কাঠগোদাম থেকে একটা ট্যাক্সি বুক করে নিন অথবা শেয়ারে টাটা সুমো পেয়ে যাবেন।
কোথায় থাকবেন
পুরো লেকটার ধার ঘেষে গড়ে উঠেছে অনেক হোটেল । মাল্লিতালের হোটেলগুলো একটু এক্সপেনসিভ। তাল্লিতালে আপনি ৮০০-১০০০ এর মধ্যে মোটামুটি মানের ভালো হোটেল পেয়ে যাবেন। হোটেল আগে থেকে বুক করার কোন প্রয়োজন নেই, ওখানে প্রচুর অপশন পাবেন।
মনে রাখবেন
হ্যাপি ট্রাভেলিং। দাই ফু!
হাসিব হাসান চৌধুরী
ঝামেলা হলো শুরু
এখন উপরের সিম্পল বর্ননা শুনে যদি মনে হয় যে নৈনিতাল যাওয়াটা আজিমপুর যাবার মতোই সোজা, তাইলে আগেই বলি স্যরি। কারণ নৈনিতাল যাওয়াটা বেশ ভালোই ঝক্কির। শুরুতেই আমরা হোঁচট খেলাম ফোরস এর একজনের অনুপস্থিতিতে। তারপর বাজেট সংকট এবং সবচেয়ে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা। (২০০৫ সালে ভারতের ভিসা করার জন্য সত্যি সত্যিই সারা রাত লাইনে দাঁড়াতে হতো!) কোনমতে পৌছালাম কোলকাতা সস্তায় সস্তায় এবং এক বড় ভাইয়ের (আমাদের প্রিয় জানের টুকরা ফসু ভাই!) বুক করা হোটেল রুমে উঠে পরলাম পয়সা বাঁচাতে। তারপর শুরু হলো ‘কালকা মেইল’ এ দিল্লীর উদ্দেশ্যে যাত্রা। ইয়া আল্লাহ - সাধে লোকে বলেনা দিল্লী দুরস্ত! পাক্কা ৩৬ ঘন্টা পর নামলাম দিল্লীতে। দিল্লীতে নামার পর শুরু হলো কাঁপাকাঁপি, কি যে ঠান্ডা! তারপর সারাদিন রেস্ট নিয়ে আবারও ট্রেন জার্নি, এবার দিল্লী টু কাঠগোদাম। এটা বেশিক্ষণ না, মাত্র ১৪ ঘন্টা!
কাঠগোদাম টু নৈনিতাল
কাঠগোদাম স্টেশনটায় নামার সাথে সাথে পুরো ভ্রমণের যত ধকল ছিলো সব সাথে সাথে কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেলো। এটা আমার দেখা ভারতের সবচেয়ে সুন্দর স্টেশন। স্টেশনটা যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয়েছে বিশাল পাহাড়ের সারি। মনে হয় সামনে যেন কতই না অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে। কাঠগোদাম থেকে ট্যাক্সিতে নৈনিতাল পৌঁছাতে সময় লাগে দুই ঘন্টার মতো। আমরা জানুয়ারী মাসে গিয়েছিলাম তাই পুরো পাহাড়ী রাস্তাটায় সবুজ ঘাসের উপর তাজা বরফ পরে আছে - কি যে সুন্দর! পুরো জার্নিটা করতে আমাদের সময় লাগে দুই গুন বেশি কারণ পুরো রাস্তায় এত সুন্দর সুুন্দর স্পট যে কোনটা ছেড়ে কোনটায় দাড়াবো বুঝেই পাওয়া যায় না। পুরো জার্নিটা এক কথায় অসাধারণ।

ছবিঃ কাঠগোদাম স্টেশন
“তাল্লিতাল.. মাল্লিতাল.. বিচমে হ্যায়.. নৈনিতাল!”
‘নৈনিতাল’ বা ‘নৈনাঝিল’ হলো ভারতের অন্যতম বৃহত লেক সিটি। দার্জিলিং এর মিরিক লেক থেকে এটা প্রায় ৪/৫ গুন বড়। আবার শ্রীনরের ডাল লেকের মতো এতটা বিস্তৃতও না। খুব সুন্দর ‘কলকা’ শেপের এই লেকটির চারদিক পাহাড় ঘেরা। টলটলে স্বচ্ছ পানি (বরফের মত ঠান্ডা!), ঝকঝকে নীল আকাশ আর সাদা তুষারে মোড়ানো সবুজ পাহাড় -প্রকৃতির এক অপূর্ব চারনভুমি এই নৈনিতাল। আর পুরো লেকের চারপাশে গড়ে উঠেছে নৈনিতাল শহড়। লেকের নিচের দিক টার নাম ‘তাল্লিতাল’ আর উপরের দিকটার নাম ‘মাল্লিতাল’। তাল্লিতালের তুলনায় মাল্লিতাল বেশ সভ্রান্ত। দোকানপাট গুলোও বেশ ঝকঝকে আর দারুন দারুন সব বাংলো বাড়ি। আমরা যেদিন নৈনিতাল পৌছাই ঠিক তার আগের দিন এখানে স্নো -ফল হয়, তাই প্রতিটি বাড়ির কার্নিশে আর টালির ছাদে ছিলো সাদা বরফের আস্তর। কিন্তু মেঘ কেটে যাওয়াও পুরো পরিবেশটা ছিলো দারুন ঝকঝকে। নৈনিতালের অসাধারণ পরিবেশের কারণে এখানে গড়ে উঠেছে ভারতের নাম করা সব বোর্ডিং স্কুল। একটা পাগল খানাও আছে, আমার ধারণা রোগীরা এখানকার সৌন্দর্য দেখে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়!

ছবিঃ নৈনিতাল
নৈনিতালের কাছাকাছি
উপরের কথাগুলো আমাদের তিনজনের জন্য একেবারে মিথ্যা। কারণ ধবধবে সাদা মিহি তুষার পেয়ে আমরা এমন পাগলামিতে মেতেছিলাম যে আশ-পাশের মানুষ আমাদের নিঃসন্দেহে পাগল ভাবছিলো। আসলে নতুন তুষারের মজাই আলাদা। আমাদের দেশে এই জিনিষটা বড্ড মিস করি। আর তুষারের বল বানিয়ে বরফের বল ফাইটিং খেলার তো তুলনাই হয় না।

ছবিঃ বরফে পাগলামি
আমরা এই বরফের সাম্রাজ্য পেয়েছিলাম মাল্লিতাল থেকে একটু উপরে একটি পাহাড়ী পার্কে। রোপ ওয়ে (কেবল কার) দিয়ে আপনাকে সেখানে পৌঁছাতে হবে। পাহাড়টি থেকে আপনি পুরো নৈনিতালের দারুন ভিউ পাবেন। এখানে একটা ছোট মার্কেটও আছে যেখানে আপনি নৈনিতালের ট্রাডিশনাল পোষাক পরে ছবি তুলতে পারেন।
তাল্লিতালে, লেকটার কিনারায় আছে দারুন একটা মসজিদ। খুব সুন্দর সাদা কারুকাজে ভরপুর মসজিদটা গড়ে উঠেছে একটা স্টেডিয়ামের পাশে। স্টেডিয়ামটা একটু অদ্ভুত, পুরো মাঠটিই সিমেন্টের তৈরি, এরা যে কিভাবে খেলে আল্লাই জানে। স্টেডিয়ামটির আশেপাশে গড়ে উঠেছে ছোট মেলার মতো মার্কেট। মার্কেটটা বেশ সস্তা, বিশেষ করে শীতের পোষাক আর মোমবাতি এখানে খুবই সস্তায় পাবেন।
বোটিং
নৈনিতালে আসবেন আর বোটিং করবেন না, তা’তো হয় না। এখানে খুব সস্তায় নৌকা ভাড়া পাওয়া যায় ঘন্টা হিসেবে। আমি ভারতের অনেক লেকে বোটিং করেছি, তবে এতটা স্থির পানির লেক আর দেখিনি। লেকটির মাঝখানে নৌকা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকুন, খুব ভালো লাগবে। ২০০-৩০০ রুপির মধ্যেই আপনি ঘন্টা হিসেবে নৌকা ভাড়া পেয়ে যাবেন। আর মনে রাখবেন, পানি কিন্তু বীভৎস রকমের ঠান্ডা!

ছবিঃ নৈনিতালে বোটিং
নৈনিতাল থেকে একটু দুরে
নৈনিতাল পৌছানোর পরদিন আমরা ঘুরতে বের হই এর আশপাশটা দেখবার জন্য । সারাদিনের জন্য একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পরি। মাল্লিতাল থেকে ৫-৭ কিলোমিটার পরেই শুরু হয়ে যায় ঘন পাহাড়ী বন। এই জঙ্গল বিখ্যাত হয়েছে জিম করবেটের শিকারের চারনভুমি হিসেবে। উচু উচু পাইন গাছের মধ্যে দিয়ে আপনি পাগাড়ী ট্রেইল ধরে হর্স রাইড করতে পারেন। এই জঙ্গলটি ঘুরে দেখবার জন্য ঘোড়াই সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি। কারন মাটির পাহাড়ি রাস্তায় বরফ পরে অসম্ভব পিচ্ছিল হয়ে থাকে। উঁচু উঁচু গাছগুলোর মাথায় সাদা বরফ জমে থাকে, খুব সুন্দর একটি দৃশ্য। এখানেই কোই মিল গ্যায়া সিনেমার পিচ্চি এলিয়েনটা ল্যান্ড করেছিলো।

ছবিঃ করবেটের জঙ্গলে
এরপর আমরা যাই সুইসাইড করতে। মানে সুইসাইড পয়েন্ট দেখতে। খোদাই জানে কেন এর নাম সুইসাইড পয়েন্ট কারণ পাহাড়ী এই ভ্যালিটি দেখবে খুবই সুন্দর। ভ্যালিটিতে ছোট কিন্তু খুব সুন্দর আরেকটি লেক আছে, এটার নাম সুখা তাল। নামকরণেই কারণেই হয়তো জায়গাটিতে গেলে বেশ গা ছমছম করে।

ছবিঃ সুইসাইড পয়েন্ট
আমাদের পরের গন্তব্য ছিলো কেভ গার্ডেন। এখানে বেশ কিছু গায়ে গা লাগা পাহাড়েরর ভেতর দিয়ে বড় একটা সুরঙ্গ হয়ে আছে। সুরঙ্গটা আমাদের খাগড়াছরির আলুটিলার মতোই তবে আরেকটু এক্সাইটিং। আপনি সুরঙ্গের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যেতে পারবেন মশাল হাতে নিয়ে। তবে আমার মত মোটাসোটা হলে বিপদ আছে। কখনো বসে, কখনো ক্রল করে আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে।
‘তাল’ শব্দটির অর্থ লেক। আর এখানে তালের অভাব নেই। প্রতিটি পাহাড়ের কোনায় কোনায় খালি তাল আর তাল। ভীম তাল, নাগা তাল, সুখা তাল - নৈনিতাল ছাড়াও আরো একগাদা তাল আছে। সবগুলো তালই খুব সুন্দর কিন্তু সত্যি কথা বলতে নৈনিতালের কাছে বাকিগুলো কিছুই না! তাই বোটিং করতে চাইলে নৈনিতালেই করুন।
উপরের জায়গাগুলো হলো তথাকথিত টুরিস্ট স্পট। তবে এই ছোট্ট ছবির মতো শহড়ে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। তাই পায়ে হেঁটে বা রিক্সায় চড়ে ঘুরে বেড়ান শহড়টি, অসাধারণ লাগবে। সন্ধ্যার দিকে লেকটার পাশের বেঞ্চিগুলোতো লাইন দিয়ে বসে থাকে কাপল রা। আমরা তিন বন্ধুই তখন ছিলাম ব্যাচেলার, তাই বড্ড হতাশ লাগছিলো। তখনই প্রমিস করেছিলাম যে একবার বৌ নিয়ে এখানে আসতেই হবে! আপনাদেরও বলি, কাপল ডেস্টিনেশন হিসেবে নৈনিতালের জুড়ি নেই।

ছবিঃ তিন বন্ধু পাহাড়ি ভ্যালিতে
কিভাবে যাবেন
আমি একজন বাজেট ট্রাভেলার, তাই সেই হিসেবেই আপনাদেরকে বাজেট দিচ্ছি। এই পুরো ট্রিপটি আপনি অনেক লাক্সারিয়াস ভাবেও করতে পারেন।
ঢাকা থেকে কোলকাতা চলে যান যে কোন বাসে। শ্যামলী, গ্রিন লাইন বা সোহাগ -সবগুলোর সার্ভিসই প্রায় এক ধরণের। কোলাকাতা গিয়ে সেদিন দিল্লী যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। পরের দিন রাজধানী অথবা দুরন্ত এক্সপ্রেস ধরে চলে যান দিল্লী। খরচ পরবে ১৮০০ রুপির মতো আর সময় লাগবে ১৬ ঘন্টা। (টিকেট কাটা সংক্রান্ত জটিলতা হলে এই লেখাটি পড়তে পারেন - train tickets booking) এরপর দিল্লী থেকে কাটুন কাঠগোদামের টিকেট। দিল্লি টু কাঠগোদাম বেশ কিছু অপশন আছে, রাতের ট্রেনটাই ভালো কারণ এই জার্নিটা প্রায় ১২-১৪ ঘন্টার। আপনি ইচ্ছা করলে জেএসবিটি থেকে নৈনিতাল যাবার বাসও ধরতে পারেন কিন্তু রেকমেন্ড করবো না। আমরা ফিরেছিলাম বাসে, অনেকটা জান হাতে নিয়ে! কাঠগোদাম থেকে একটা ট্যাক্সি বুক করে নিন অথবা শেয়ারে টাটা সুমো পেয়ে যাবেন।
কোথায় থাকবেন
পুরো লেকটার ধার ঘেষে গড়ে উঠেছে অনেক হোটেল । মাল্লিতালের হোটেলগুলো একটু এক্সপেনসিভ। তাল্লিতালে আপনি ৮০০-১০০০ এর মধ্যে মোটামুটি মানের ভালো হোটেল পেয়ে যাবেন। হোটেল আগে থেকে বুক করার কোন প্রয়োজন নেই, ওখানে প্রচুর অপশন পাবেন।
মনে রাখবেন
- শীতকালে ভয়াবহ স্নো ফল হয়। তাই গরম কাপড় বেশি করে নিয়ে যান। শীতকালটাই বেড়ানোর জন্য সেরা সময়।
- প্রধান ভাষা হিন্দী, ইংরেজিটা এরা খুব একটা বোঝে না।
- কোন প্যাকেজ ট্যুর না নিয়ে নিজেরাই ট্যাক্সি ভাড়া করে নিন, অনেক ভালোমতো ঘুরতে পারবেন।
- খাবার দাবার নিয়ে কোন টেনশন করবেন না, প্রচুর রেস্টুরেন্টের অপশন আছে। আর পাহাড়ী খাবারের স্বাদই আলাদা।
হ্যাপি ট্রাভেলিং। দাই ফু!
হাসিব হাসান চৌধুরী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন