
মেঘের সাদা পালক ভেদ করে যখন মাটি ছুঁই ছুঁই করছিলাম তখনই ভাবছিলাম কী এক বিষ্ময়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। আকাশ থেকেই কৌতুহলী চোখ যখন মাও সেতুং এর দেশ খুঁজে পেলো, তখন এক অজানা উচ্ছ্বাস বেরিয়ে আসছিল। দক্ষিণ চীনের কুনমিং থেকে আকাশ পথে আমরা যাচ্ছিলাম শিল্প শহর চুংকিং। চীনারা অবশ্য একে চোংচিং বলে। সাংহাই বা বেইজিং এর মতো বিশালতা না থাকলেও, একদিকে চুংকিং এর আছে তিন হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অন্যদিকে আধুনিক নগরকেন্দ্র। প্রদেশের বাইরে চীনে যে চারটি স্বশাসিত মিউনিসিপালিটি আছে চুংকিং তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। ১৯৪৫ এ জাপানের আত্মসমর্পণের পর মাও সেতুং আর চিয়াঙ কাই সেক-এর মধ্যে চুক্তি হয় চুংকিং শহরে। লম্বাটে আয়তনের একফালি শহরকে এফোঁড়-ওফোড় করেছে চীনের দুঃখ ইয়াং সি কিয়াং। যতদূর মনে পড়ে চীনের দীর্ঘতম এ নদীর কথা আমরা ছোটবেলায় স্কুলের বইয়ে পড়েছিলাম। আমাদের চেয়া ইয়াং সি কিয়াং চীনাদের কাছে ইয়াংজি। যাবো জেনেই এক ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি ছিলই। এবার সৌভাগ্য হলো দুঃখ নদী ইয়াংজির বুকে ঘুরে বেড়ানোর। এক সময়ের দুঃখ নদী ইয়াংজিকে কীভাবে তারা সম্ভাবনার নদীতে রূপ দিয়েছে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। কেবল ইয়াংজি নয়, চুংকিংকে জড়িয়ে আছে তিন উপনদী উজিয়াং ফুজিয়াং আর কিজিয়াং।
ইয়াংজিকে কেউ আর দুঃখ নদী বলে না- এখন এর নাম সোনালী নদী। সোনা রঙ বালির কারণে ইয়াংজির পানি সত্যিই কিছুটা চকচকে হলুদ বা সোনালী। নদীর বাঁকে ধাপে ধাপে সাজানো চুংকিং বন্দরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল ব্যবসা কেন্দ্র। দক্ষিণ চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৯০ ভাগই হয় এ বন্দর থেকে। গত পাঁচ বছরে এই বন্দরের প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৭০ ভাগের মতো। অথচ মাত্র পঞ্চাশ বছর আগেও এখানে নাকি ছিল নিবিড় বন। ছিল কেবল নদীর ধারে গড়ে ওঠা ছোট্ট এক জনপদ। নদীর বাঁকে গড়ে ওঠা বাড়িঘরগুলো এখনও সে সাক্ষ্য বহন করে। চুংকিং-এ একদিকে অরণ্যে মোড়ানো সারি সারি পাহাড়, আঁকা হাইওয়েতে কারণে অকারণে তৈরি অসংখ্য ফ্লাইওভার আর নিয়ন সাইন। পশ্চিম দিকে পাহাড়ে গা বেয়ে পুরোনো নস্টালজিক নগরী। সুনসান রিবতায় দাঁড়িয়ে থাকা আঁকা ছবির মতো। পাহাড়ের গায়ে ঢুকে থাকা ছোট্ট সব কটেজ, মাথায় টুপি লাগানো চিম্নি, সামনে বাগান সব মিলে মধ্যযুগের স্থাপত্য শৈলীর এক চমৎকার দৃষ্টান্ত যেন। চুংকিং এর গ্রেট হল যেন আর এক বিস্ময়। বয়সে নতুন হলেও এর নির্মাণ শৈলীতে আছে ভাং সাম্রাজ্যের ধ্র“পদী ভাব।
অন্যদিকে নদী পেরিয়ে সমতল উপত্যকায় গড়ে ওঠা নতুন নগরী। পাশ্চাত্যের অনুকরণে যেন এখানকার সবকিছু। ১৯ শতকের স্মৃতি স্মারক ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে ছোট্ট একটি নিউইয়র্ক। আকারে আকৃতিতে এখানকার আধুনিক সব স্থাপত্য ভুলিয়ে দেয় চুংকিং এর ঐতিহ্যকে। স্থাপত্য যেন এখানকার সংস্কৃতিকে বদলে দিয়েছে। অথবা বদলে যাওয়া সংস্কৃতির জাদুতেই হয়তো এখানকার এই নতুন করে জেগে ওঠা। ওয়ালমার্ট কেয়ার ফোরের মতো চেইন সুপার মার্কেট এখানে সেখানে ছড়ানো। যার একেকটিতে আমাদের দশ-বিশটা সুপার শপ্ আস্ত ঢুকিয়ে দেয়া যাবে অনায়াসে। শহরের একদিকে আবহমান চীনা পরম্পরার দোকান-বাজার আর একদিকে দিক হারানো চোখ ধাঁধানো বাণিজ্যিক নগর সভ্যতা। একদিকে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে চীনারা অন্যদিকে ঐতিহ্য ভাঙার রীতি। স্বল্প বসন নারী পুরুষ।
চীনের এক মহাবিস্ময় যদি প্রাচীর হয়, আমার মনে হয়েছে আর এক মহাবিস্ময় ভাষা। ব্যবসা বাণিজ্য আর অর্থনীতিতে বিশ্ব শাসন করতে যাওয়া এই দেশটির মানুষের মধ্যে অসম্ভব দেশপ্রেম যে কাউকে মুগ্ধ করবে। চীনা ভাষার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা থেকে যে দু’ একটা শব্দ পড়তে শিখেছিলাম, উচ্চারণে গিয়ে পড়তে হয়েছে মহা মুস্কিলে। বলে রাখা ভালো আমাদের সাথে একজন ইন্টারপ্রেটর কাজ করতো তার কাছেই কিছুটা তালিম নেয়া।

নিজেদের ভাষার প্রতি ওদের প্রচ- ভালোবাসার কারণেই হয়তো ইংরেজি চর্চা তেমন একটা নেই। এটা অবশ্য সারা চীনেই। আর আমাদের সাথে থাকা ইন্টারপ্রেটর ইউনা তো আমাদের ইংরেজি শুনেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শুনে আমরা কিছুটা লজ্জাই পেয়েছি। বরং ইউনাকেই আমাদের ইংরেজি শেখাতে হয়েছে। একই সাথে চান্স পেয়ে শিখিয়ে দিয়েছি বাংলা কথাও। এমনকি এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে এসে শেষ পর্যন্ত তার মুখে বাংলায় বিদায় সম্ভাষণ শুনেছি। সপ্তাখানেকের মধ্যে নিজে থেকেই বেশকিছু বাংলা শব্দ বলতো সে। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে বাংলা শুনতে ভালই লাগতো।
চীনের বিস্ময়ের আর এক নাম খাবার। আর চুংকিং এর রসনায় আছে আলাদা এক ঐতিহ্য। সেখানে গেলে হটপটের স্বাদ নিয়ে না এলে চীনাদের অতিথি সেবাই যেন বৃথা যায়। ঝটপট জেনে নিন হটপটের রেসিপি। একই সাথে মাছ মাংস সবজি দই আর নানা রকম মসলার এই মেনু খেয়ে গলায় ঝাল স্বাদ লেগে থাকবে দেশে ফেরার পরও কয়েকদিন। খাবার টেবিলে বসে মনে হলো পৃথিবীর এমন কিছু নেই যা তারা খায়না। ছোটবেলা থেকে তারা দুটো জিনিসই শেখে কাজ আর খাওয়া। খাওয়া তাদের কাছে এক শিল্প বিশেষ।
নিতান্ত গরীব ঘরে হলেও একবেলায় মেনুতে অন্তত গোটা বিশেষ আইটেম তো থাকেই। বেশিও থাকে। আর আতিথেয়তার বিষয় থাকলে তো কথাই নাই। দুই আঙুলের চাপে ধরা কাঠিতে কি ওঠেনা পারলে পানিও খায় তারা। একসাথে বসে খাওয়ার পারিবারিক ঐতিহ্য ভোলে না চীনারা। ঘুরতে থাকা টেবিলে একের পর এক গোল করে সাজানো থাকে খাবার। যার যার রুচিমতো খায় তারা। কোন ব্যাকরণ নেই। আইটেম বিশ তিরিশ যাই হোক পরিমাণ কিন্তু কমই খায় তারা। আর কাঁচা মাছ, শাক সবজি, শামুক ঝিনুক কেঁচো বা সাপ। সাথে মোটামুটি তিন চার হাত লম্বা মোটা নুডুলস। ঐতিহ্যবাহী খাবার একটু বেশি মশলাদার। নাচ গান বা বাদ্য বাজনাও চলে রান্নার অংশ হিসেবে। সন্ধ্যার আলো ফোটার আগেই রাতের খাবারে বসে তারা। চলে ঘণ্টা দুয়েক।
সূর্য আর চীনাদের ঘুম ভাঙার প্রতিযোগিতা হয় প্রতিদিন। সকাল ৭টার মধ্যে আমরা যখন ঘুমের ঘোর কাটাতে ব্যস্ত তখন ওদের কাজে যাওয়ার কথা কেউ বলেনা। সকাল ৮টার পর রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। কাজের বেলায় ছেলে মেয়ে কোন পার্থক্য নেই। আমরা গিয়েছিলাম দক্ষিণ চীনের সবচেয়ে ব্যস্ত অটোমোবাইল শিল্প কারখানা ইউটোং-এ। সেখানে কম্পিউটার ল্যাবে অত্যাধুনিক হাইটেক ডিজাইনিং থেকে শুরু করে স্টিল কাটিং বডি তৈরির মতো ভারি কাজে মেয়েদের দক্ষতা নিয়ে কেউ ভাবেনা। পাবলিক বাসের ড্রাইভিং এ একটা বড় অংশই মেয়ে। নিরাপত্তা কাজে সশস্ত্র নারীরা অনেক সাবলীল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে কারখানার কোথাও একটু কাজে ব্যত্যয় দেখলাম না। কখনো শৃঙ্খলা ভাঙার কথা ভাবেনা কেউই। আর এ জন্যই বোধহয় উৎপাদনে বিশ্বসেরা হয়ে উঠছে চীন। অটোমোবাইল, স্টিল, কেমিক্যাল এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পে কত কম সময়ে সেরাদের সেরা হয়ে উঠেছে চুংকিং ভাবলে অবাক হতে হয়।
নিয়ম ভাঙা কাকে বলে জানেনা চীনারা। একবার গভীর রাতে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। সান্ধ্যভোজের পর পরই চীনারা ঘুমায়, তবে ইয়াংজির বুকে অসংখ্য নিয়ন রেস্তোরা সারারাত জেগে থাকে। জেগে থাকে পর্যটকরা। রাত সাড়ে তিনটা চারটাতেও সেবা দিতে দাড়িয়ে থাকে ট্যাক্সি। ওঠার সাথে সাথে ইশারায় বলে দেয় সিট বেল্ট বেধে নিতে। জরিমানার ভয় নেই, নিয়ম মানার তাগিদ। বিশাল চওড়া রাস্তায় ট্রাফিক সিগনালে একা। সিগনাল শেষের জন্য মিনিটের পর মিনিট অপেক্ষায় থাকে ড্রাইভার। ইশারায় ভাড়া চাইতে হয়না, মিটার থেকে বেরিয়ে আসা বিলই কথা বলে। ক্যাব ড্রাইভাররা শেষে বিদায় জানায় খুব আন্তরিকভাবেই। রাত দুপুর যখনই হোক বলে ওঠে সি সিয়ে। চীনে ১০ দিনে অন্তত কয়েকশো বার সি সিয়ে শুনতে হয়েছে। হোটেল, দোকান, বাজার, বাস স্টপ যেখানে সেখানে অসংখ্য বার। ওদের সৌজন্যবোধ দেখেই মুগ্ধ হতে হয়। হঠাৎ খেয়াল না করলে মনে হবে সি সিয়ে যেন ওদের প্রত্যেকের মুদ্রা দোষে পরিণত হয়েছে। শেষ কথায় বলতেই হয় সি সিয়ে মানে চীনা ভাষায় ধন্যবাদ। SOURCE LINK
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন