শনিবার, ২৮ জুন, ২০১৪

ঘুরে আসি মুম্বাই

মুম্বাইয়ের ছত্রপতি-শিবাজী বিমানবন্দরে যখন জেটএয়ারওয়েজের ফ্লাইট ল্যাণ্ড করলো ঘড়িতে তখন স্থানীয় সময় বিকাল ৩ টা বেজে ১৫ মিনিট। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে বাইরে বের হতে হতে ৪ টা বেজে গেলো। প্রি-পেইড ট্যাক্সির জন্য ২২০ রুপি দিয়ে টোকেন নিলাম। ট্যাক্সি আমাদের নামিয়ে দিল ইস্ট গোরেগাঁও সেন্ট পায়াস কলেজ ক্যাম্পাসে। আমরা বলতে আমি এবং শাহাদাত ভাই, যিনি বাংলাদেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় এন.জি.ও তে কর্মরত আছেন। আমরা গিয়েছিলাম এ বছর জানুয়ারিতে, মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শর্ট কোর্সে অংশ নিতে।

দশদিন ব্যাপী এ কোর্সটিতে অংশ নিতে দেশ-বিদেশের অনেক অংশগ্রহণকারী এসেছিলেন। থাকা, খাওয়া, কোর্স ম্যাটেরিয়াল - এ সবকিছু আয়োজকরাই ব্যবস্থা করেছিলেন। নতুন একটা জায়গায় নতুন ব›ন্ধু পেতে বেশি সময় লাগলোনা, খাবার-দাবারও ছিল চমৎকার কিন্তু প্রতিদিনের সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত ক্লাস শিডিউল দেখে আমরা সবাই আতঙ্কিত হলাম। তারপরেও প্রতিদিন ক্লাস শেষ হওয়া মাত্রই ছুটে গিয়েছি দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্যে।

মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়

মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়

ভেবেছিলাম, এবার ইণ্ডিয়ান মোবাইল কোম্পানীগুলোর যেকোন একটির সীম কার্ড তুলবো। বিদেশী হিসেবে নিজের পাসপোর্ট ব্যবহার করে সীমকার্ড তোলাটা কষ্টকর নয়, কিন্তু সেটা হবে স্বল্প সময়ের জন্যে, অর্থাৎ, যতদিন ভারতে অবস্থান করবো, শুধুমাত্র সেই সময়টুকুর জন্যেই, লাইফটাইম নয়। ভারতের ২৮ টা স্টেট বা রাজ্যের জন্য মোবাইল কোম্পানীগুলোর নিয়ম হলো, এক রাজ্যের অধিবাসী অন্য রাজ্য থেকে সীম কার্ড তুলতে পারবেনা। এক স্টেট থেকে অন্য স্টেটে রোমিং এর জন্য আউট গোইং এর মতো ইনকামিং চার্জও প্রযোজ্য হবে। আর এক স্টেটের মোবাইল নম্বরে রুপি রিচার্জ করতে হলে রিচার্জ কার্ড চলবেনা, বরং আমাদের বাংলাদেশের মতো ফ্লেক্সি করতে হবে, যেটা ওখানে ’রিচার্জ’ নামেই পরিচিত। সাথে করে নিয়ে যাওয়া বেনসনের প্যাকেট শেষ হয়ে গেল দু’দিনের মাথাতেই। দিল্লী থেকে আসা নিখিলের দেয়া ৪০ রুপির প্যাকেট ’নেভী কাট’-ই তারপর ভরসা হলো।

প্রতিদিন যে জায়গাগুলোতে ঘুরতে গিয়েছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ট্রেনে গিয়েছি। ট্যাক্সিতে ভাড়াটা একটু বেশি, আর বিকেলে পুরো মুম্বাই যেন ঢাকা শহরের মতো জ্যামে আটকে যায়। এখানকার ট্রেন ব্যবস্থাটা অসাধারণ লেগেছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই ট্রেনে করেই চলাচল করছে। একশো সত্তুর রুপির একটি টিকিট কিনলে আপনি প্রথম শ্রেণীতে যেকোন ট্রেনে যতখুশি সারাদিন ভ্রমণ করতে পারবেন। মহিলাদের জন্য আলাদা রিজার্ভ বগি। আর বাকী বগিগুলো আপামর জনসাধারনের জন্য, যার ভাড়া একেবারেই কম। যেমন, গোরেগাঁও থেকে চার্চগেট পর্যšত ’বোরিওয়ালি’ ট্রেনে ৪০ মিনিটের যাত্রাতে ৬ রুপি ভাড়া। ট্রেনের আবার রকমফের আছে, ফাস্ট ট্রেন, স্লো ট্রেন ইত্যাদি, আপনার প্রয়োজন মতো ট্রেন ধরে নিতে পারবেন। আর বাসে যদি ভ্রমণ করতে চান, সেক্ষেত্রেও ভাড়া একেবারেই কম। বাসে আরেকটি সুবিধা হলো, মাত্র ২৫ রুপি দিয়ে সারাদিন আপনি সেই বাসের নির্ধারিত রুটে ভ্রমণ করতে পারবেন।

ট্রেন যাত্রা

ট্রেন যাত্রা

প্রথম দিন দল বেঁধে আমরা ঘুরতে গেলাম ’গেটওয়ে অব ইণ্ডিয়া’ দেখতে। ট্রেনে গোরেগাঁও থেকে চার্চগেট নেমে ট্যাক্সিতে ৩০ রুপি নিলো। গেটওয়ে অব ইণ্ডিয়া-এর পিছনেই অ্যারাবিয়ান সি, আর সামনে বিখ্যাত তাজ হোটেল। আমরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। চারিদিকে নিরাপত্তা কর্মীদের তৎপড়তায় কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলাম। কাছেই বিখ্যাত চার্চ দেখে ফিরে গেলাম গোরেগাঁও।

গেটওয়ে অব ইণ্ডিয়া

তাজ হোটেল
গেটওয়ে অব ইণ্ডিয়া

গেটওয়ে অব ইণ্ডিয়া

চার্চগেট

চার্চগেট

হোটেল তাজ

জুহু বিচের নামটা অনেক শুনেছি, যেখানে বলিউড তারকা অমিতাভ বচ্চন, শর্মিলী ঠাকুর, রাজ বব্বর সহ আরও অনেকের বাড়ি। আর বলিউড তারকা শাহরুখ খানের বাড়ি রয়েছে বান্দ্রাতে, যেখানে কেনা-কাটার জন্য প্রচুর শপিং মল-ও রয়েছে। ট্যাক্সিতে জুহু বিচে যেতে ১৫০ রুপির মতো লাগলো। তবে ট্রেনে ভিলেপার্লে স্টেশন পর্যন্ত আসলে ভালো করতাম, কারণ বিকেলের দিকে প্রচণ্ড ট্র্যাফিক জ্যাম। জুহু বিচের কাছেই প্রচুর খাবারের দোকান। পাওভাজি, ভেলপুরী খেলাম পেট ভরে।

জুহু বীচ

জুহু বীচ

জুহু বীচ

জুহু বীচের খাবারের দোকান

জুহু বীচের খাবারের দোকান

পরদিন ট্রেনে জোগেশ্বরী স্টেশনে নেমে বাসে করে গেলাম হাজী আলীর মাজার দেখতে। এখানেই ’'বোম্বে' সিনেমার কিছু অংশের শ্যুটিং হয়েছিল। সন্ধ্যার আলোক ঝলমলে হাজীআলীতে মাগরিব-এর নামাজ-এর পর লাইভ কাওয়ালী শুনলাম বেশ কিছুক্ষণ। তারপর রওনা হলাম পাশেই অবস্থিত হিন্দু ধর্মবলম্বীদের বিখ্যাত ’মহালক্ষী মন্দির’ দেখতে। ফেরার পথে হিরা-পান্না শপিং মলে একটু ঘুরে এলাম।

হাজী আলী

হাজী আলী

হাজী আলী

হাজী আলী

হাজী আলী
হাজী আলী
হাজী আলী

হাজী আলী

হাজী আলীতে সন্ধ্যার পর লাইভ কাওয়ালী

মহালক্ষীমন্দিরের বাইরের দিক

তারপরদিন বিকেলে গোরেগাঁও থেকে মেরিনলাইন্স স্টেশনে নেমে মেরিনড্রাইভ ঘুরতে গেলাম। কাছেই 'চোপাটী বীচ'। আরব সাগরের পাশে আলোক ঝলমলে মেরিনড্রাইভে এসে মনে হলো, ইউরোপের কোন দেশে চলে এসেছি।

মেরিন ড্রাইভ

মুম্বাই ঘুরে একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, একদিকে ফুটপাথে হাজার হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে, কিংবা যতদূর চোখ যায়, বস্তি আর বস্তি, আবার সেন্ট্রাল মুম্বাই, বান্দ্রা, ভিলেপার্লে এলাকায় বিশালাকায় দামী অট্টালিকা, কোটি রুপির দামী হুন্দাই, মার্সিটিজ বেঞ্জ কিংবা ফক্স ওয়াগনে দামী পোষাক পড়া মানুষ-জন চলাফেরা করছে। রাতের মুম্বাইয়ের জমকালো রেস্টুরেন্ট, নাইটক্লাব, আর মদের বার গুলো দেখলে বোঝাই যায়না যে, এখানে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষেরা কতটা কষ্টে আছে।

আলোক বর্ণিল মুম্বাই

আলোক বর্ণিল মুম্বাই

মুম্বাই-এর রাস্তায় এরকম হাজারো ভিখারী রয়েছে
--------------------
মন্তব্যঃ
বুবলা বলেছেন: ভালোই লিখেছেন। আপনি ঠিক বলেছেন মুম্বাই এ ট্রাফিক জ্যাম বরই বেদনা দায়ক। জ্যামের চোটে রাস্তা দেখতে পাবার জো নেই। সেই জন্য লোকাল ট্রেনে সফর করাই বুদ্ধিমত্তার কাজ । তবে একটা কথা আমি আপনাকে বলব যে আপনি যখন তাজ হোটেল এ কাছে গেলেন তখন ওখান থেকে ফেরি করে এলিফ্যান্টা দ্বীপটা ঘুরে আসতে পারতেন ওটা একটা দারুন সফর হয়। আর মুম্বাই এর উপর আমার একটা পোস্ট আছে
বলেছেন: ভালো লাগল। খরচাপাতির হিসাব টা জেনে নিলে আমাদের জন্য ভাল হত। 
লেখক বলেছেন:   জেট এয়ারওয়েজে ঢাকা-মুম্বাই-ঢাকা রাউণ্ড ট্রিপ প্রায় ৪৮৫ ইউ.এস.ডলার। যেতে সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘন্টা, আসতে প্রায় আড়াই ঘন্টা। অন্য এয়ারলাইন্স-এও যেতে পারেন। তবে জেট এর সার্ভিস ভাল। প্রতিদিন একটি করে ফ্লাইট ঢাকা-মুম্বাই এবং মুম্বাই-ঢাকা। বাই রোডে যেতে চাইলে: যাওয়া-আসা মিলিয়ে সর্বোচ্চ ১২-১৫০০০ হাজারে হয়ে যাবে। বাসে করে ঢাকা - বেনাপোল> বাসে বেনাপোল টু কোলকাতার হাওড়া স্টেশন> ট্রেনে মুম্বাই সেন্ট্রাল স্টেশন। সময় লাগবে প্রায় ৩ দিন এবং অনেক কষ্ট। যাবার আগে অবশ্যই ট্রেনের টিকিট ঢাকা থেকেই বুক করে যাবেন। চাইলে জাহাজেও যেতে পারেন। (তবে সিস্টেমটা ঠিক জানা নেই)
মুম্বাইতে থাকার খরচ অনেক বেশি। প্রতিরাত ৫০ ডলারের থেকে শুরু করে ২০০-৩০০ ডলারের হোটেলও আছে। তবে যাবার আগে অনলাইনে হোটেল রিজার্ভ করে গেলে অনেক টাকা বাঁচাতে পারবেন। তবে 'চিত-কাইত' টাইপ ২০০-৩০০ রুপির হোটেলও আছে।
প্রতিদিন খাবার জন্য নিম্নে ৩০০-৪০০ রুপি ধরে রাখতে পারেন। এটা আসলে নির্ভর করছে, কি ধরনের খাবার আপনি খাবেন।
যাতায়াতের জন্য অবশ্যই ট্রেন ব্যবহার করবেন। তবে ট্রেনের ক্ষেত্রে ২ টি কথা:
১. অফিস টাইমে অনেক ভীড় থাকে, সুতরাং পকেট সাবধান,
২. ট্রেনে উঠা-নামার সময় প্রতিদিন ২/৪ জন কাটা পড়ছে। সুতরাং সাবধানে চলাচল করতে হবে।
  বলেছেন: মুম্বাইয়ের ট্রেন সার্ভিসটি খুব ভালো। সরকার চাইলে আমাদের দেশেও এরকম সার্ভিস দিতে পারতো। আমি যখন গিয়েছিলাম (৫ বছর আগে) তখন ভিটি স্টেশনের কাছে ৪০০ রুপীতে হোটেলে ছিলাম। হোটেল মোটামুটি ভালো ছিল।
লেখক বলেছেন: এখনতো দেড়-দুই হাজার রুপির নিচে হোটেল পাওয়াটা টাফ। 
মূল লিংক 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন