ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সুইডেন এক আকর্ষণীয়
স্থান হতে পারে। আপনি যদি প্রকৃতিপ্রেমিক হন বা স্কেন্ডিনেভীয় ইতিহাসে
আগ্রহী হন তবে সুইডেনকে অবশ্যই আপনার ভ্রমণ তালিকায় রাখবেন। সুইডেন আয়তনের
দিক দিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে তিনগুণ বড় হলেও লোকসংখ্যা মাত্র পঁচানব্বই হাজার।
সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম। স্টকহোমকে বলা (beauty on water). কথাটি কিন্তু
অতিরঞ্জিত নয়। স্যাটেলাইট হতে তোলা ছবি দেখলে মনে হয় স্টকহোম জলের উপর
ভাসছে, বাল্টিক সাগর হতে বড় কোন ঢেউ এসে বুঝি স্টকহোমকে ডুবিয়ে দেবে।
কিন্তু আসলে তা নয়। ম্যালার দ্বীপের পাড়ে স্টকহোম অপূর্ব এক সুন্দর শহর।
সুইডেন ভ্রমণ স্টকহোম দিয়েই শুরু করা যাক। আপনি যদি সরাসরি স্টকহোম
আরলান্দা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন তা’হলে আপনার কাস্টম চেকিং সময়সাপেক্ষ
হতে পারে। আর যদি ভায়া লন্ডন কিম্বা ইউরোপীয় কোন দেশ হতে আরলান্দায় অবতরণ
করেন তা’হলে কোন প্রকার চেকিং হবেনা। চেকিং লন্ডন কিম্বা ইউরোপীয় ট্রান্জিট
দেশেই হয়ে যাবে। আরলান্দা বিমান বন্দর হতে বাস, ট্যাক্সি, লোকাল ট্রেন
কিম্বা ‘আরলান্দা এক্সপ্রেস’ ট্রেন দিয়ে সরাসরি স্টকহোম এসে পৌছাতে পারেন।
ট্যাক্সিতে ভাড়া ৪৫০, ট্রেনে ১০০ আর বাসে ৭৫ ক্রোণার লাগতে পারে, ক্রোণারকে
১০ দিয়ে গুন করলেই টাকার হিসেবটা পাওয়া যাবে।
স্টকহোম
ছোট বড় চৌদ্দটি দ্বীপ নিয়ে বৃহত্তর
স্টকহোম। দ্বীপগুলো পরস্পর সেতু দিয়ে সংযুক্ত। স্টকহোম নাম করনের পশ্চাতে
কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস আছে। ১৩শ শতকে হেলজেন্সহোলম নামক জায়গায় স্টকহোম
শহরের গোড়াপত্তন হয়। হেলজেন্সহোলম ছিল বর্তমান বৃহত্তর স্টকহোমের ছোট একটি
দ্বীপ, বর্তমানে এই দ্বীপে জাতীয় সংসদ স্থাপিত। ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধের
জন্য দুটি সেতুর মাঝে শহরটিকে সরিয়ে আনা হয় বলে শহরটির নাম হয় স্টকহোম।
সুইডেনের পার্শবর্তী দেশ এস্টোনীয়া স্টকহোম থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরে
সমৃদ্ধশালী জনপদ সিগটুনা আক্রমণ ও ধ্বংস করলে সিগটুনাবাসীরা তাঁদের
মূল্যবান সম্পদ লেক ম্যালারেনে নিক্ষেপ করে নতুন দ্বীপে চলে আসে। ‘স্টক’
শব্দের অর্থ রক্ষিত স্থান আর ‘হোলম’ শব্দের অর্থ ‘দ্বীপ’। অর্থাৎ স্টকহোম
সম্পদ রক্ষাকারী দ্বীপ। পর্যটক বা দর্শনপ্রাথীদের জন্য স্টকহোমের
‘গামলাস্তন’ বা পুরানো শহর দর্শনীয় স্থান। পর্যটকরা স্টকহোমে এসেই পুরানো
শহরে চলে আসেন। পুরানো শহরের পাশেই গড়ে উঠেছে অধুনিক নতুন শহর। স্টকহোম
সেন্ট্রাল স্টেশান হতে বের হয়েই আপনি ‘রানীর সড়ক’ বা ড্রতনিংগতান ধরে
হাঁটতে হাঁটতে ছোট সেতু পার হয়ে সংসদ ভবনের মাঝের রাস্তা ধরে পুরানো শহরে
চলে আসতে পারেন। ড্রতনিংগতানে গাড়ি-ঘোড়া চলার নিয়ম নেই। কাজেই আপনি ধীরে
ধীরে হেঁটে সময় নিয়ে আসতে পারেন। এই সড়কের দু’ধারে রয়েছে বিভিন্ন দোকান এর
মধ্যে বেশ কয়েকটি বিখ্যাত শপিং সেন্টার আর কালচারাল হাউজ। ড্রতনিংগতানের
শেষ মাথায় ছোট সেতুটি পুরানো আর নতুন শহরের সংযোগস্থল। যদি আপনার মাছ ধরার
শখ থেকে থাকে তবে সেতুর উপর দাঁড়িয়ে ছিপ দিয়ে ম্যালার লেক হতে মাছ ধরতে
পারেন। ছিপ দিয়েই মাছ ধরতে হবে, জাল ফেলার নিয়ম নেই। মাছ ধরা সুইডিশদের
বিরাট এক নেশা। এইতো দিন কয়েক আগে প্রবাসী আবিদ ভাই ভোর রাতে এই সেতুর উপর
হতেই সাড়ে চৌদ্দ কিলো এক বিশাল লাক্স (সোলমন) মাছ ধরলেন। এতো বড় মাছ এর আগে
খুব কমই ধরা পরেছে। সেতুর ওপারেই সংসদ ভবন। সংসদ ভবনের ভেতর দিয়েই পায়ে
হাঁটা পথ। পথের শেষে রাজবাড়ি। রাজা কার্লগুস্তাব এই প্রসাদেই বাস করেন।
রাজবাড়ির পাশ দিয়েই সরু পাথরের রাস্তাটি চলে গেছে পুরানো শহরে। পুরানো শহরে
ঢোকার আগে রাজপ্রসাদটি ঘুরে ফিরে দেখতে ভুলবেন না। রাজপ্রাসাদে পাহারাদার
থাকলেও আপনাকে কেউ বাঁধা দেবেনা বরং সাহায্য করবে। এক সময় প্রতিবেশী দেশ
ডেনমার্কের বেশ আধিপত্য ছিল সুইডেনের উপর। ১৫২০ সালে ডেনিস রাজা দ্বিতীয়
ক্রিশ্চিয়ানের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে স্টকহোমে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা
হয়। অনুষ্ঠানে রাজপ্রতিনিধি, আভিজাত সম্প্রদায়, বিশিষ্ট জনগণ ও নগরবাসীদের
আমন্ত্রণ জানানো হয়। দীর্ঘ তিনদিন উৎসব চলার পর অভিজাত সম্প্রদায় কথায়
কথায় প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করেন। গীর্জার প্রধান
ধর্মজাযক গুস্তাভ ট্রোল্লে তাদের অভিযুক্ত করলে আদালত দ্রুতই তাদের
মৃত্যুদণ্ড দেয়। দণ্ডাদেশের পরদিন থেকে বর্তমান পুরানো শহরের বড়বাজারে
(Stortorget) মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে থাকে এবং দুদিনেই অভিজাত সম্প্রদায়ের
১০০ জনের শিরোচ্ছেদ করা হয়। ইতিহাসে এই হত্যাকাণ্ড এক কালো অধ্যায় হিসেবে
বিবেচিত হয়ে আছে। এই হত্যাকাণ্ড ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করে ও অনেক ঘটনার
জন্ম দেয়। অবশেষে ১৫২৩ সালে গুস্তাভ ভসা স্টকহোম অবরোধ করে নিজেকে সুইডেনের
প্রথম রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন এবং রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। সুইডেনের
বর্তমান রাজা সেই রাজবংশেরই বংশধর। স্টকহোম হত্যাকাণ্ডের ৩১৩ বছর পর ১৮৩৩
সালে স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলফ্রেড নবেল। নবেল তাঁর
প্রভূত সম্পত্তির যে উইল করে যান, তার থেকে দেয়া হয় ‘নবেল পুরস্কার’।
পৃথিবীতে সম্মানজনক নবেল পুরস্কারের বিকল্প নেই। স্টকহোম পুরানো নগরীর
বড়বাজার চত্তরেই গড়ে উঠেছে ‘নবেল মিউজিয়ম’। নবেল বিজয়ীদের দুর্লভ নিদর্শন
রয়েছে এই মিউজিয়মে, রবিঠাকুরও রয়েছেন এখানে। নবেল মিউজিয়মের পাশেই
রাজপ্রাসাদ এবং আরো অনান্য পুরানো স্থাপনা। পুরানো শহরের রাস্তাগুলো সরু
পাথর বিছানো। হাঁটার সময় পায়ের শব্দ হয় তবে হেঁটে আনন্দ আছে। হেঁটে হেঁটে
ক্লান্ত হয়ে গেলে ‘শান্তি, প্রেম ও আইসক্রীম’ নামক দোকানটিতে বসে সদ্য তৈরী
আইসক্রীম ও কফি পান করে মন ও দেহ দুটোকেই চাঙা করে তুলতে পারেন। দোকানটির
নাম শুনে ভড়কে যাবেন না। সুইডিশে যে নামটি আছে তার বাংলা করলে ঐ নামই
দাঁড়ায়। পুরানো শহরেই আছে ‘রয়েল কয়েন কেবিনেট’। এই যাদুঘরে বয়েছে পৃথিবীর
সবচেয়ে পুরানো মুদ্রা, মুদ্রাটি যীশুর জন্মের ৬২৫ বছর পূর্বের আর পৃথিবীর
সবচেয়ে বড় ও ভারী মুদ্রা। মুদ্রাটি প্রায় ২০ কেজি ওজন বিশিষ্ট সুইডিশ তামা
দিয়ে তৈরী এবং পৃথিবীর প্রথম ব্যাংক নোট। অনেকের হয়তো জানা নেই যে, ১৬৬১
সালে সুইডেন প্রথম ব্যাংক নোট প্রর্বতন করে। ‘গামলাস্তন’ বা পুরানো শহরে
এলে এই তিনটি দেখতে ভুলবেন না।
হগাপার্ক
স্টকহোমের ভেতর ‘হগাপার্ক’ একটি বিশিষ্ট
স্থান। এই পার্কের ভেতর এক বিশাল প্রাসাদে বাস করেন সুইডেনের জননন্দিতা
রাজকুমারী ভিক্টোরিয়া। সবুজ গাছপালায় ঘেরা পার্কের পাশেই রয়েছে ‘প্রজাপতি
হাউজ’। ‘হগাপার্ক’ নাম উল্লেখে একটি ঘটনা সামনে এল। সুইডিশ কিছু কিছু
শব্দের বা স্থানের বানান এক রকম আর উচ্চারন অন্যরকম। দেশ ও ভাষা বিশেষে এটি
হতে পারে, হতে পারে ব্যাকরণগত ভাবেও। বেশ কিছুদিন আগে বাংলাদেশের জনৈক
পর্যটক সপ্তাহ খানেক স্টকহোমের আনাচে কানাচে ভ্রমণ করে দেশে ফিরেই ‘সুইডেন
শান্তির দেশ’ নামে বিশাল এক ভ্রমণ কাহিনী লিখে ফেললেন। এক পর্যায়ে তিনি
‘হগার্পাক’ ও দেখে গিয়েছেন। পার্কের প্রবেশ দ্বারে লিখা Haga Parken.
পর্যটক ও লেখক মহাশয় সুইডিশ উচ্চারণ সমস্যায় যাননি তবে ‘হগা’কে ‘হাগা’
বানিয়ে পাঠক পাঠিকাদের নিদারুণভাবে ভুল ম্যাসেজ দিয়েছেন- যা কোন লেখকের
উচিৎ নয়। ঐ বইটিতে সুইডেন এবং সুইডেনের প্রবাসী বাঙালি সমাজ সম্পর্কে অনেক
অমার্জনীয় ভুল তথ্য আছে। আশা করি আপনারা যারা সুইডেন ভ্রমণে আসবেন
উচ্চারণগতভাবে অতটুকু অমার্জনীয় হবেন না। স্টকহোমের ভেতর আরো কিছু দর্শনীয়
স্থান আছে যেমন সিটি হল, এখানে প্রতি বছর নবেল ডিনার হয়ে থাকে,
দিউররর্গোডেন, ভসা মিউজিয়ম, স্কানসেন, মিল্লেসগোর্ড ইত্যাদি। প্রতিটি
স্থানই আপনাকে প্রচুর আনন্দ দেবে। এছাড়া মালমো, উপসলা, গোথের্গ, লুলিও,
কিরুনা শহর গুলো দেখে আনন্দ পাবেন।
দ্বীপমালা
চৌদ্দটি দ্বীপ নিয়ে বৃহত্তর স্টকহোম গঠিত
হলেও ম্যালার হ্রদ হতে বাল্টিক সাগর পর্যন্ত দীর্ঘ জল পথে দ্বীপ রয়েছে আরো
প্রায় বারশ। এই দ্বীপগুলোর কোন কোনটি একেবারেই নির্জন জনশূন্য। তবে প্রায়
সবগুলো দ্বীপেই বোট নিয়ে যাওয়া যায়। এই বিশাল দ্বীপপুঞ্জ বা দ্বীপমালার শেষ
দ্বীপটি ‘সান্দহাম’, বাংলা প্রতিশব্দ ‘বালির বন্দর’। বালি আর পাথর দিয়ে
ঘেরা বলেই হয়তো দ্বীপটির নাম ‘সান্দহাম’ বা বালির বন্দর। স্টকহোম থেকে
সান্দহামের দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়
দ্রুতগামী বোটে। দ্বীপমালার দ্বীপগুলো পাড়ি দিয়ে জলের উপর তরঙ্গ তুলে
যাত্রী নিয়ে বোট এসে ভীড়ে সবুজ বনবিথী আর পাইনসমৃদ্ধ সান্দহামে। আকাশ পথে
হেলিকপ্টারেও আসা যায় তবে তা ব্যয় সাপেক্ষ। দ্বীপের পর দ্বীপ পেছনে ফেলে
দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা পর যখন বোট সান্দহামের কোলে এসে ভীড়ে তখন চোখ জুড়ে নামে
মনমুগ্ধকর মুগ্ধতা। সান্দহামের পর আর কোন স্থলভূমি নেই, এখান থেকেই শুরু
উত্তাল বাল্টিক সাগর। সুইডেন ভ্রমণে অবশ্যই দ্বীপ ভ্রমণ মিস করবেন না।
স্টকহোম রাজবাড়ির সম্মুখে ছোট বড় বোটের সারি। এখান থেকেই বিভিন্ন দ্বীপে
বোট যায়। বোটের ভেতর চা, কফি এমনকি মধ্যাহ্ন ভোজের ব্যবস্থা আছে তবে মূল্য
আংশিক বেশি।
গোতল্যান্ড
মূলভূমি থেকে মাত্র নব্বই কিলোমিটার দূরে
কাঁচস্বচ্ছ বালটিক সাগরে ভাসছে ৩১৪০ স্কয়্যার কিলোমিটারের মাঝারি দ্বীপ
গোতল্যান্ড। দ্বীপটি নিয়ে প্রচীনকাল থেকেই কিংবদন্তী আছে। কোন এক জাদুকরের
মন্ত্রে দ্বীপটি প্রতি সন্ধ্যায় ভেসে উঠতো আবার প্রভাতের সঙ্গে সঙ্গেই
সাগরের গভীরে তলিয়ে যেত। নবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত সুইডিশ লেখিকা সেলমা
লর্গালফের অমর চরিত্র নয় বছর বয়েসী বালক নীল্স হলর্গেসন বালুচরে একটি পয়সা
খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ করেই দ্বীপটির দেখা পেয়েছিল। সে শুধু স্বল্প সময়ের জন্য,
তারপরই দ্বীপটি চোখের নিমেষে হারিয়ে গিয়েছিল। কিংবদন্তী আছে দ্বীপের প্রথম
বাসিন্দার নাম সেলভার, যিনি দ্বীপে এসে প্রথম আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন। আগুনের
আলো পেয়ে দ্বীপটি আর অদৃশ্য হয়ে যায়নি। সেলভারের কবর এখনো আছে। দ্বীপের
পূর্ব উপকুলে বোগে নামক জায়গায় প্রাচীন কবরটি পাথর দিয়ে সীমানাবদ্ধ করে
সাজানো। কিন্তু কিংবদন্তী যাই বলুক জোয়ার ভাটার জন্যই দ্বীপটি সাগরে তলিয়ে
যেতো আবার ভেসে উঠতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গোতল্যান্ডে এসে
হুবুর্গেনে যাননি এমন ভ্রমণপিয়াসী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। হুবুর্গেন জায়গাটির
সমুদ্রতীরে প্রকৃতির তৈরী মানুষের মুখটি এক আশ্চর্য। পাহারের মাথার বিশেষ
অংশটি বিশেষ একটি কোন থেকে দেখলে মনে হয় যুগ যুগ ধরে সাগরের দিকে তাকিয়ে
আছে মাথায় কালো টুপি পড়া একটি মুখ। এই পাহাড়ের চূড়ায় সমুদ্রের দিকে পিঠ
দিয়ে দাঁড়ালে মনে হয় সাগরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি। সে এক অব্যাক্ত
অনুভূতি। গোতল্যান্ড দেখতে এসে দ্বীপটির মাথায় লেগে থাকা ছোট ভূখন্ডটিকে
অবহেলা করা যায়না। সমুদ্রে ভেসে থাকা খন্ডটির নাম ‘ফোরও’। অর্থাৎ ভেড়ার
দ্বীপ। দ্বীপে প্রচুর ভেড়া পাহাড়ের কোলে সবুজ উপত্যকায় চড়ে বেড়ায়। ভেড়ার
সংখ্যাধিক্ষেই দ্বীপটির নাম ‘ফোরও’ বা ভেড়ার দ্বীপ। অবশ্য নাম নিয়ে
মতান্তরও আছে, অনেকে বলেন ইংরেজি শব্দ ‘ফারওয়ে’ বা বহুদূর শব্দ থেকেই
‘ফোরও’ শব্দটি এসেছে। কিন্তু সুইডিশ ভাষায় ঋভ্রৎ (‘ফোর) শব্দের অর্থ ভেড়া
আর ্র (ও) শব্দের অর্থ দ্বীপ। তাই মনে হয় নামকরণের দিক থেকে দ্বিতীয়
ব্যাখ্যাটিই ঠিক। দ্বীপটির মাঝে এমনও জায়গা আছে যেখানের গাছপালা মাটি থেকে
মাত্র এক বিঘৎ উঁচু, ছোট ছোট গাছগুলো কাদাময়। দেখে মনে হয় দ্বীপের এই অংশটি
এই মাত্র সমুদ্রতল থেকে উঠে এসেছে। ফোরও’র আয়তন মাত্র ১১১.৩৫ স্ক্যয়ার
কিলোমিটার, জনসংখ্যা ছয় শতেরও কম। দ্বীপটিতে কোন ব্যাংক, পোস্টঅপিস,
মেডিক্যাল সার্ভিস বা পুলিশ স্টেশান নেই। তবে দ্বীপটির রয়েছে নিজস্ব
বাচনভঙ্গী- যা সুইডিশ ভাষায় প্রাচীনতম। ‘ফোরও’র সমুদ্র সৈকতে প্রাচীনকাল
থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাথর আর পাথর। পাথরের উপর পা ফেলে ফেলে চলে যাওয়া
যায় সমুদ্রের বেশ গভীরে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় নীল স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে বসা যায়
পাথরের উপর। হ্যাঁ, ডুবন্ত পায়ের পাতায় সাগরের ছোট ছোট মাছেরা আলতো চুমু
দিয়ে যাবে বইকি! স্টকহোম হতে গোতল্যান্ডে মাত্র দুটি পথে যাওয়া যায়।
হেলিকপ্টার অথবা বিমানে আর জাহাজে। হাতে সময় থাকলে দু’চার দিন গোতল্যান্ডে
বেড়িয়ে আসতে পারেন। সময় চোখের নিমিশে ফুরিয়ে যাবে। গোতল্যাল্ডে বেশ কিছু
ভাল হোটেল, বাড়ি ও ভান্দ্রাহেম ওয়েছে। ইন্টার নেটে আগে হতেই বুকিং দিয়ে
রাখা ভাল। website : www.gothland.net
নিশিত সূর্যের দেশ
সুইডেন কে বলা হয় ‘দি ল্যান্ড অব দ্যা
মিডনাইট সান’। মিডনাইট বা মধ্যরাতে যদি আপনি সূর্য দেখতে চান তবে অবশ্যই
আপনাকে সুইডেনে আসতে হবে। জুন-জুলাই মাসে এমনিতেই স্টকহোমে রাত দশটা সাড়ে
দশটার আগে সূর্য ডোবেনা। সূর্য ডোবার পর আঁধার নামতে না মানতেই পুব আকাশে
সূর্য এসে উদয় হয়। আর নিশুতি রাতে যদি সূর্য দেখতে চান তবে আপনাকে যেতে হবে
সুইডেনের উত্তরে । সে ক্ষেত্রে কিরুনা দর্শনীয় স্থান। স্টকহোম হতে কিরুনার
দূরত্ব ১২৬০ কিলোমিটার। আপনি ট্রেন, বাস, বিমান অথবা প্রাইভেট কার নিয়েও
যেতে পারেন। যদি লং ড্রাইভ পছন্দ করেন তবে এই পথের জুড়ি নেই। প্রশস্ত,
পাহাড়ি কংক্রিটের হাইওয়ে। গাড়ি চালিয়ে আরাম ও আনন্দ দুটিই পাবেন। কিরুনায়
অনেক হোটেল রেস্তেরা আছে, স্থানীয়রা অতিথিপরায়ণ, কিরুনাবাসীদের বলা no
problem people কাজেই নির্ভাবনায় ঘুরে ফিরে দেখতে পারেন। কিরুনার প্রায়
অর্ধেক জুড়ে আছে অভ্র খনি। বর্তমান শহরটি বলা যায় খনির উপর। তাই খনির
প্রয়োজনে রেলওয়ে, হাইওয়ে ও প্রায় ৪৫০টি পরিবারকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। ধীরে
ধীরে পুরো শহরটিকেই সরিয়ে ফেলা হবে। বিশেষ অনুমতি নিয়ে খনিটিও দেখতে পারেন।
উপরন্ত বিশাল পাহাড় শ্রেণী ‘কিবনেকায়সা’র উপর মধ্যরাতের সূর্য দেখার
প্রোগ্রামতো আছেই। কিরুনায় মে মাসের ২৮-২৯ হতে জুন মাসের ১১-১২ পর্যন্ত
মধ্যরাতের সূর্য দেখা যায়। কিরুনায় বেশ কয়েকটি ভাল হোটেল রয়েছে যেমন, হোটেল
আর্ট্রিক ইডেন, ক্যাম্প রীপন, হোটেল উইন্টার প্লেস ইত্যাদি।
আইস হোটেল
শীতকালে কিরুনায় এলে দেখতে পারেন আইস
হোটেল। এটি এক বিশাল শিল্পকর্ম। সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সীমান্ত দিয়ে বয়ে
যাওয়া থর্ন নদী থেকে নিয়ে আসা বিরাট বিরাট বরফের চাঁই কেটে তৈরী হয় বরফের
ইট। ঐ ইট দিয়ে তৈরী হয় বিশাল আইস হোটেল। প্রর্দশনী হলসহ হোটেল কক্ষগুলো
তৈরী করতে প্রয়োজন হয় দশ হাজার টন আইস ও ত্রিশ হাজার টন স্নো। আইস হোটেলে
রাত্রী যাপন করা যায় বইকি। ডবল রুমের ভাড়া জনপ্রতি প্রতিরাত চৌদ্দশ
ক্রোণার, সিঙ্গেল রুম ছাব্বিশ শ ক্রোণার। আপনি ডিলুক্স রুমেও থাকতে পারেন,
ডবল রুমের প্রতিরাতের জনপ্রতি ভাড়া তিনহাজার পাঁচশত ক্রোণার আর সিঙ্গেল রুম
সাত হাজার ক্রোণার। এক ক্রোণারকে প্রায় দশ দিয়ে গুন করলেই টাকার মান পাওয়া
যাবে। তবে অতিথিদের কিরুনা বিমানবন্দর থেকে হোটেল অবধি হোটেলের
স্নোস্কুটারে যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে, এরজন্য অবশ্য অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে
হবে। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি এক বছর আগে থেকে হোটেল বুকিং না দিয়ে থাকেন তবে
রুম পাওয়া কষ্টকর। জেমসবন্ডের ‘ডাই এনাদার ডে’ ফিল্মটা বোধ হয় অনেকেই
দেখেছেন। আইস হোটেলে চিত্রগ্রহণ করা হয়েছিল ছবিটির। আপনি কি আইস হোটেলে
একবারের জন্য হলেও আসবেন? খরচটা একটু বেশি হলেও এমন শিল্পকর্ম থেকে নিজেকে
দূরে রাখা কি ঠিক?
হোটেল
স্টকহোমের প্রায় সব স্টেশান ও সাবওয়ের
কাছাকাছি ছোট বড় মিলিয়ে অনেক হোটেল রেস্তোরা রয়েছে। আপনার বাজেটানুযায়ী
বেছে নিতে পারেন। গ্রেন্ডহোটেল, রাইভাল হোটেল, কলম্বাস হোটেল, হোটেল
হেলস্টেন, নরডিক সী হোটেল, ক্লেরিয়ন হোটেল সাইন, রেক্স হোটেল। সুইডেনের
প্রায় সব হোটেলেই সুস্বাদু সুইডিশ খাবারই পরিবেশন করা হয়। তবে আপনি যদি
দেশী মুখরোচক খাবার পছন্দ করেন তবে যে কোন বাঙালি হোটেলে আসতে পারেন।
স্টকহোমে প্রায় ৬০ হতে ৭০ টি বাঙালি হোটেল রয়েছে। হোটেলের নামগুলো ভারতীয়
হলেও মালিকানা ষোলআনা বাংলাদেশীয় বাঙালি। আগ্রা টান্দুরী, ইন্ডিয়ান
গার্ডেন, ইন্ডিয়ান কিং, ইন্ডিয়া ইন, হেপী ইন্ডিয়া, লিল্লা ইন্ডিয়া, সম্রাট
অব ইন্ডিয়া, ইন্দিরা, গান্ধী, নিরভানা, ইলোরা, বেঙ্গল। এছাড়া কিছু বাঙালি
ক্যাটারিং সার্ভিস রয়েছে যারা সুস্বাদু গরম দেশীয় খাবার ঘরে পৌঁছে দিয়ে
যায়। এদের কাছে নির্ভেজাল গরুর দুধের মিষ্টান্ন পাবেন, যে স্বাদ আপনি ঢাকার
ভেজাল মিষ্টান্নে পাবেন না। সুইডেনের যে কোন হোটেলে লাঞ্চের চেয়ে ডিনারের
মূল্য বেশী। বাঙ্গলি হোটেল কিম্বা ফুটকোর্টগুলোয় লাঞ্চ ৭০ হতে ৮০ ক্রোণারের
মধ্যেই পাওয়া যাবে।
সময়
ভ্রমণে সময় বেশ তাৎপর্য বহন করে। বিভিন্ন
দেশের ভৌগলিক অবস্থান ও আবহাওয়া অনুযায়ী ভ্রমণ সময়ের তারতম্য হতে পারে।
সুইডেন ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য সময় যে কোন বছরের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস। এই
সময়ের আবহাওয়া আমাদের দেশের শীতকালের মত। দিনের দীর্ঘতা বেশী, সূর্য আকাশে
থাকে অনেকক্ষণ। জুন-জুলাইয়ে দু’এক পশলা বৃষ্টি হতে পারে তবে তা কিছু নয়।
টিপসঃ
আপনি যদি সুইডেন তথা স্কেন্ডিনেভীয়া
ভ্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে থাকেন তবে অবশ্যই বেশ আগে হতেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা
ভালো। কারণ ভ্রমণ ভিসা পেতে সময় নিতে পারে। স্যানজেন ভিসা হলে ভাল। বৃটিশ,
আমেরিকান কিম্বা স্কেন্ডিনেভীয়ন পাসপোর্ট ধারীদের ভিসার প্রয়োজন নেই।
হোটেল বুকিং বা প্যাকেজ ট্যুর ইন্টারনেটের মাধ্যমেই করা যায়। কিম্বা সরাসরি
টেলিফোন অথবা ই-মেইলের মাধ্যমেই সেরে নিতে পারেন। আর যাত্রার আগে অবশ্যই
স্বাস্থ্যবীমা করাতে ভুলবেন না। কারণ স্কেন্ডিনেভীয়ায় ওষুধ, ডাক্তার,
হাসপাতাল এই সবের খরচ বিদেশী নাগরিকদের জন্য আকাশচুম্বী। সুইডিশ তথ্যমতে
আগামী বছর সুইডেন হবে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহৎ ভ্রমণকারী দেশ, আপনিও এই বৃহত্বে
অংশ নিতে পারেন।
লিয়াকত হোসেন, সুইডেন থেকে
I want to go to Sweden for higher studies.But the defination of these visiting place of Sweden you described so,so,so nicely that I cannot express my words how you describided beautifully about this topic..May Allah bless you..
উত্তরমুছুন