শুক্রবার, ৩১ জুলাই, ২০১৫

গন্তব্য সুইডেন

ফেব্রুয়ারির কোন একদিন কীল থেকে আমার বরের এক কলিগ ফোন করে জানালো শিপে করে সুইডেন যাওয়ার এক অফার আছে। আমরা যেতে আগ্রহী নাকি ? শুনে আমাদের গিসেন ইউনিভার্সিটির অনেকেই লাফ দিয়ে রাজী হয়ে গেলো। শুরু হয়ে গেলো তোড়জোড় । কিভাবে বুকিং দেওয়া হবে? কতজন যাবে? নেটে সব ঘেঁটে বুকিং দেওয়া হোল প্রায় এক মাস আগে। আমরা গিসেন থেকে বাংলাদেশী, নেপালি, ইন্দোনেশিয়ান এবং ইথিওপিয়ান মিলে ১৭ জনের এক দল তৈরি হলাম। কীল থেকে আরও চারজন বাংলাদেশী , একজন ইরানী ও একজন কাজাখিস্তানি আমাদের দলে যোগ দিয়েছিলো। গত ৩০ শে মার্চ ছিল সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। ঠিক করা হয়েছিলো আমরা গিসেন থেকে ট্রেনে কীল পৌছাবো । সেখান থেকে আমাদের সমুদ্র যাত্রা শুরু হবে সুইডেনের উদ্দেশ্যে । সেই মোতাবেক ৩০ মার্চ ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমাদের ভ্রমণ শুরু হোল। আমরা বাসে করে ট্রেন স্টেশনে পৌছালাম । সোয়া ছয়টায় আমাদের ট্রেন ছাড়ল। বলে রাখা ভালো আমরা কীল পর্যন্ত যেতে মোট চারবার ট্রেন বদল করেছিলাম । প্রথমে যদিও শুনে খুব বিরক্তি লেগেছিল কিন্তু যাত্রা শুরু করে মনে হয়েছে এই সিদ্ধান্তই ঠিক ছিল। কেননা বাচ্চারা একটানা বেশীক্ষণ ট্রেনে থাকতে চাচ্ছিল না । কারণ আমাদের আট ঘণ্টার ট্রেন জার্নি ছিল। আর তাই এই ট্রেন বদলের মাধ্যমে তারা কিছুক্ষণ বাইরে আসতে পেরে বেশ খুশি ছিল। 

Giessen স্টেশন থেকে প্রথম ট্রেনে এক ঘণ্টার জার্নি শেষে আমরা kassel নামক স্টেশনে পৌছালাম । সেখান থেকে পরবর্তী ট্রেনে উঠে আরও এক ঘণ্টার জার্নি করলাম। যেহেতু এক ট্রেন থেকে আরেক ট্রেনে উঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছিল তাই স্টেশনগুলো দেখার বা ছবি তোলার খুব একটা সুযোগ ছিল না । তবুও দুই একটা স্টেশনে চেষ্টা করেছিলাম ছবি তুলতে। আমরা দুই বাংলাদেশী পরিবারে বাচ্চা নিয়ে মোট সাতজনের দল খুব আরামেই ট্রেন জার্নি করেছিলাম। ছুটির দিন থাকায় যাত্রী তেমন না থাকায় আমরা বগীর বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতে পেরেছিলাম । জানালা দিয়ে মনোরম সব দৃশ্য দেখতে দেখতে গল্প হাসিতে দারুণ কেটেছিল সময়। আমার মেয়েটা অসুস্থ থাকায় অবশ্য ওকে নিয়ে একটু কষ্ট হয়েছিলো। ২য় ট্রেনে এক ঘণ্টার জার্নি শেষে আমরা Göttingen স্টেশনে পৌছালাম । সেখান থেকে আরও সোয়া এক ঘণ্টার জার্নি শেষে Uelzen স্টেশনে পোঁছালাম এই স্টেশনে অল্প কিছু সময় পেয়েছিলাম বাইরে দাড়িয়ে থাকার । তাই কিছু ছবি তোলার সুযোগ হয়েছিলো। স্টেশনটি দেখতে অনেক সুন্দর ছিল। এখান থেকে আমাদের সবচেয়ে বেশি সময়ের ট্রেন জার্নি শুরু হোল।
আড়াই ঘণ্টার জার্নি শেষে আমরা ইউরোপের ২য় ব্যস্ত ট্রেন স্টেশন এবং জার্মানির সবচেয়ে ব্যস্ততম স্টেশন Hamburg এসে পৌছালাম । এত বড় স্টেশন এত মানুষের ভিড় , এত প্লাটফর্ম দেখে দিশেহারা অবস্থা হয়েছিলো। বেশ দৌড়ের উপর থাকতে হয়েছিলো পরবর্তী ট্রেন ধরার জন্য।
পরবরতি ট্রেনে উঠে আরও এক ঘণ্টার জার্নি শেষে আমরা বন্দর নগরী কীল এসে পৌছালাম ।
কীল স্টেশন থেকে বের হয়ে অল্প একটু হাঁটতেই আমরা নির্দিষ্ট জাহাজের ডকে পৌঁছে গেলাম । মনের মধ্যে অজানা এক উত্তেজনা টগবগ করছিলো জীবনের প্রথম অনেকটা সময়ের জন্য জাহাজে সমুদ্র ভ্রমণের কথা মনে করে । আমরা যে জাহাজে করে সুইডেন যাওয়ার জন্য ঠিক করেছিলাম সেই জাহাজের নাম Stena line. এটি মূলত মালবাহী এবং যাত্রীবাহী জাহাজ। Kiel থেকে ছেড়ে গিয়ে সুইডেনের Göteborg নামক বন্দর নগরীতে যায়।এটি north sea হয়ে Baltic sea এর উপর দিয়ে যায়। এছাড়াও পৃথিবীর আরও বিভিন্ন দেশে তাদের এমন সার্ভিস দিয়ে থাকে। আমরা সব রকম অফিসিয়াল চেকিং শেষ করে সন্ধ্যে ৭ টার দিকে জাহাজে উঠে পড়লাম । Stena line এর ক্রুদের আন্তরিক অভ্যর্থনার মাঝ দিয়ে জাহাজে প্রবেশ করলাম। আমাদের প্রত্যকের নামে যে কার্ড দেওয়া হয়েছিলো তাই ছিল আমাদের কেবিনের চাবি। নতুন এই বিষয়টি আমাকে বেশ মজা দিল।তো আমরা রুমে প্রবেশ আধা ঘণ্টার মধ্যে ফ্রেশ হয়ে জাহাজের ছাদে চলে গেলাম। জাহাজ ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে । জাহাজের ছাদে তুষার পড়ে বেশ ভেজা আর পিচ্ছিল ছিল। আর ছিল প্রচণ্ড বাতাস আর ঠাণ্ডা । এর মাঝেই মহা উৎসাহে অবাক হয়ে সব দেখতে লাগলাম আর ছবি তুলতে থাকলাম। ছেড়ে আসা সন্ধ্যার আলোকিত কীল শহরের দৃশ্য দারুণ লাগছিলো । প্রায় ঘণ্টা খানেক থেকে বাতাস, তুষার আর ঠাণ্ডার জন্য জাহাজের ভিতর ঢুকে গেলাম। 


এবার জাহাজটি ঘুরে দেখার চেষ্টা করলাম। জাহাজের ভিতর এতটাই জাঁকজমক মনে হচ্ছিলো কোন দামী হোটেলে আছি। আসলে এর আগে হয়তো এমন কোন জাহজে না উঠায় এরকম মনে হয়েছে । জাহাজটি ১১ তলা বিশিষ্ট । একসাথে ৩০০ গাড়ি এবং ১৩০০ জন যাত্রী ধারণ করতে সক্ষম। জাহজের আট তলায় অভ্যর্থনা লাউঞ্জ। খুব ঝলমলে সেই অংশটুকু ।আমাদের কেবিন ছিল আট তলায়। ছয় তলা পর্যন্ত এবং সাত তলার কিছু অংশ গাড়ির জন্য বরাদ্দ। এছাড়া সাত তলায় রেস্টুরেন্ট , শপিং মল আছে। আট তলায় বার, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, লাউঞ্জ, gamble খেলার ব্যবস্থা এবং যাত্রীদের কেবিন । নয়, দশ এবং এগারো তলার কিছু অংশেও কেবিন ।ছাদে হেলিকপ্টার প্যাড , সুইমিং পুল এবং বারবিকিউ করার ব্যবস্থা। ছাদে একটা অংশ উন্মুক্ত বার হিসেবে আলাদা করা আছে। এছাড়া ছাদে যাত্রীদের বসার জন্য বেঞ্চ দেওয়া আছে। বাচ্চাদের বিনোদন দেওয়ার জন্য একটা বড় পাপেট ও দেখলাম। আমরা বাংলাদেশী তিন পরিবার পাশাপাশি চারটা রুম পাওয়ায় ঐ অংশটুকু আমাদের বাসা হয়ে গেলো। রাতের খাবার শেষ করে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে আমরা তিন ভাবী মিলে সাড়ে ১১ টার দিকে আবার ছাদে গেলাম। তখন লোকজন না থাকায় খুব নীরব ছিল । আমরা ভেবেছিলাম এতক্ষণে জাহাজ সমুদ্রে প্রবেশ করেছে । কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে দেখি এখনো দূরে পাড়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে । অন্ধকারের মাঝে পাড়ে অবস্থিত বাড়িগুলোর আলো , নদীতে অন্য জাহাজের আলো , দূরে একটি বড় ব্রিজের লাইটিং দেখতে অসাধারণ লাগছিলো। কিন্তু ক্যামেরা নিয়ে না উঠায় তা ফ্রেমে বন্দী না করার আফসোস রয়ে গেলো। 

জাহাজে উঠার পর কোন রকম ভয় না কাজ করলেও রাতে ঘুমাতে গিয়ে হঠাৎ মনের মধ্যে কি এক ভয় ঢুকে গেলো। আর তাই ঘুমটা খুব একটা ভালো হয় নি । মেয়ের শরীর ভালো না থাকায় সকালে তাড়াতাড়ি উঠে সূর্যোদয় দেখার ইচ্ছে থাকলেও রুম থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেলো। সাতটার দিকে ছাদে গিয়ে দেখি চারদিকে শুধু পানি আর পানি । বুঝলাম আমরা সমুদ্রের মাঝে আছি। সকালের সূর্য তার আলো বিলিয়ে যাচ্ছে উদার ভাবে। এ এক অভাবনীয় দৃশ্য। বলে বোঝাতে পারবো না। একা একা বেশ অনেকক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে থেকে অসম্ভব ভালো লাগছিলো। এর মাঝে কিছু ছবিও তুলে নিলাম।কিন্তু সেই ঠাণ্ডা আর প্রচণ্ড বাতাস বেশিক্ষণ সইতে না পেরে নীচে চলে গেলাম। গিয়ে বরকে পাঠালাম দেখতে । 

জাহাজ সোয়া দশটার দিকে প্রায় ১৫ ঘণ্টার জার্নি শেষে সুইডেনের Göteborg এসে পৌঁছাল। আমরা রুমে আমাদের লাগেজ রেখে কিছু খাবার নিয়ে সারাদিনের জন্য জাহাজ থেকে নেমে পড়লাম । তারপর শুরু হোল আমাদের নতুন একটি দেশের নতুন একটা শহর দেখার মিশন। 
আমরা যখন জাহাজ থেকে নেমে এলাম তখন অনেককেই দেখলাম ট্রলি ভর্তি করে পানীয় নিয়ে বের হয়ে আসতে । আমাদের দলে কীলের যে ভাবী ছিলেন তিনি বললেন সুইডেনে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের পর আর মদ কেনা যায় না । কিন্তু জার্মানে এই বাঁধা নেই এবং সুইডেনের চেয়ে দাম কম বলে গটেবরগ এর অনেকেই জাহাজে করে কীল থেকে কিনে নিয়ে আসে। শুরুতেই গটেবরগ বাসীর একটা তথ্য পেলাম। দিনটি ছিল চমৎকার রোদ্রজ্জল । ঘুরতে এসে এমন আবহাওয়া না পেলে নতুন শহর দেখতে কিছুটা হলেও খারাপ লাগতো। কারণ শীতের দেশে যতক্ষণ রোদ থাকে ততক্ষণ বেশ আরাম । সূর্য আড়াল হলেই ঝপ করে আবার ঠাণ্ডা জেঁকে ধরে। জাহাজে থাকতেই কোথায় যাওয়া হবে, কতক্ষণ থাকা যাবে তা ঠিক করে নিয়েছিলো । কারণ আমরা সকাল সাড়ে ১০ টা থেকে বিকাল ৬ টা পর্যন্ত শহর দেখার সুযোগ পাবো ।

Gothenburg , জনসংখ্যার দিক দিয়ে সুইডেনের ২য় বৃহত্তম নগরী ।এর আয়তন ৪৫০ বর্গ কি মি। এর জনসংখ্যা প্রায় ৫২০,৩৭৪( ৩১ ডিসেম্বর ২০১১) ।এটি একটি বন্দর নগরী ।দুটো বিমানবন্দর আছে।এই শহরে দুটো ইউনিভার্সিটি আছে। আছে অনেক দর্শনীয় জায়গা। 
সব জায়গা তো আর দেখা সম্ভব নয় । তাই আমরা এই অল্প সময়ের মধ্যে কয়েকটা জায়গা দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। জায়গাগুলি দেখার জন্য আমরা ট্রামে উঠার সিদ্ধান্ত নিলাম।আমাদের সাথে গিসেন থেকে আসা নেপালিরা এবং মালয়েশিয়ার ছেলেটিও ছিল।ট্রামে উঠতে গিয়ে যে চিন্তা মাথায় এলো আমাদের কাছে সুইডিশ ক্রনার ছিলনা বিধায় তারা আমাদের ট্রামে টিকেট কাটতে দিবে কিনা ইউরোতে সেই নিয়ে। ট্রামে উঠে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন ইন্টারন্যাশনাল কোন ক্রেডিট কার্ড থাকলে চলবে। আমাদের গিসেনে টিকেট কাটার সিস্টেম ড্রাইভারের ওখানে থাকলেও Gothenburg এ ট্রামের দরজার কাছে মেশিন দেওয়া।সেখানেই টিকেট কাটতে হয় এবং ট্রামে উঠে সেখানেই টিকেট চেক করিয়ে নিতে হয় । না হয় জরিমানা কাটা হয় । আমি আমার জীবনে প্রথম ট্রামে চড়েছি । ট্রামে ডে টিকেট কাটা যায় না বলে পরের স্টপেজে নেমে রাস্তার পাশে ছোট একটি দোকান থেকে সবার জন্য সারাদিনের টিকেট কেটে নেয় হোল। 

এর পরের ট্রামে উঠে আমরা প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেলাম।এটি Carl Skottsbergs Gata এ অবস্থিত। ওরা বলে Botaniska tradgarden. এটি সুইডেনের বৃহত্তম বোটানিক্যাল গার্ডেন ।এর পাশেই Gothneburg university র বিল্ডিং অবস্থিত। গার্ডেনটির মোট আয়তন ১৭৫ হেক্টর এবং এতে প্রায় ১৪০০ ভিন্ন প্রজাতির গাছ, অর্কিড আছে। খুব সুন্দর একটি জায়গা। কোথাও উচু পাহাড় আবার কোথাও নিচু ঢাল গার্ডেনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছিল। শীতে ঘাস মরে হলুদ হয়েছিলো এবং গাছে পাতা না থাকায় পুরো সৌন্দর্য মিস করেছি । আমরা প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সেখানে ছিলাম । 

তারপর সেখান থেকে আমরা ট্রামে করে চলে এলাম একটা সাইন্স মিউজিয়ামের কাছে। যার নাম Universeum. এটি Södra vägen এ অবস্থিত।এটি একটি পাবলিক বিজ্ঞান কেন্দ্র যা ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । যেহেতু হাতে সময় কম ছিল তাই ভিতরে আর যাওয়া হয় নি।এর বাহিরে বিশাল ডাইনোসর দেখে বাচ্চারা বেশ খুশি হয়েছিলো। আবার এর পাশের পাহাড় থেকে একটি পাইপের মাধ্যমে পানি প্রবাহিত করে সেই পানির ধারা জমাট বরফের মত কিভাবে হয়ে আছে তা দেখে আমরাও বিস্মিত হলাম । 

সেখান থেকে ট্রামে উঠে আমরা শহরের মার্কেট এলাকায় চলে এলাম। তখন ঘড়ির কাঁটায় আড়াইটা বাজে। সবার খিধে লেগে গিয়েছিলো। একটা টার্কিশ দোকান খুজে আমরা দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। তারপর মার্কেট এর ভিতর ঘুরে দেখলাম। তারপর গেলাম Feshkekorka নামক ইনডোর ফিশ মার্কেট দেখতে।এটি Rosenlundsvägen এ অবস্থিত। কিন্তু দুর্ভাগ্য ছুটির দিন থাকায় বন্ধ ছিল। তাই কিছুটা সময় হাতে থাকায় আবার খুব বেশি হাতে না থাকায় আর কোন নতুন জায়গা দেখতে না গিয়ে ট্রামে করে কিছুক্ষণ শহর ঘোরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হোল । ট্রামে করে প্রায় ঘণ্টা খানিকের বেশি ঘুরে অনেক দূর গেলাম। মনে হয় শহর ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম। একটা জায়গায় ট্রাম লাইন পাহাড়ের ভিতর দিয়ে গিয়েছিলো। ট্রামে করে যাওয়ার সময় এক ঝলক স্টেডিয়ামের দেখা পেলাম। 

আমার এই শহর ঘুরে যেসব অনুভূতি হয়েছিলো তা সংক্ষেপে বলি। ট্রাম লাইন থাকায় কি না জানিনা শহরের রাস্তাগুলোর উপরে তারের ছড়াছড়ি ছিল। তার মাঝখানে মাঝখানে বাতি এবং আরও কি যেন ছিল যা আমার ভালো লাগেনি। কেমন জঞ্জাল মনে হয়েছিলো। এই শহরের একটা জিনিস আমার খুব চোখে লেগেছিল তা হোল রাস্তার পাশে বিল্ডিঙগুলো এমনভাবে তৈরি করা যেন দুই পাশে দেওয়াল উঠিয়ে রেখেছে । প্রায় সব বিল্ডিং একই উচ্চতার বলেই হয়তো এমন লাগছিলো। বিল্ডিংগুলো অনেক প্রাচীন বলে সেগুলোতে বিভিন্ন মূর্তি যুক্ত নকশা দেখেছিলাম। আরও একটা জিনিস খুব চোখে লেগেছিল তা হোল বেশিরভাগ ভবনের ছাদ লাল টালির যা অন্যরকম এক সৌন্দর্য এনে দিয়েছিলো। এবং এক লাইনের সব ভবন একই নকশার। সবগুলো ভবনকে একটা ভবন মনে হচ্ছিলো। কিছু আধুনিক নকশার বাড়িও দেখেছিলাম। শহরটিতে প্রচুর বড় বড় মূর্তি দেখেছি। এবং এই শহরটি পাহাড়ের উপর তৈরি। এই পাহাড়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হোল এটি পাথরের তৈরি। শহরে অনেক আফ্রিকান মুসলিম চোখে পড়েছিলো। এছাড়াও বেশ কিছু নাছোড় টাইপের ভিক্ষুক দেখলাম।আর একটা জিনিস ছিল এদের বেশির ভাগ জায়গায় wifi থাকায় সহজেই নেট ব্যবহার করা গিয়েছিলো। 

আমাদের জাহাজে পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে ছয়টা বেজে গিয়েছিলো। ততক্ষণে সূর্য তার আলো একটু একটু করে কমিয়ে আনছিল। আমরা জাহাজে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে ছাদে চলে এলাম।ছাদ থেকে চারদিকের
চমৎকার কিছু ছবি তুলে সূর্যাস্তের অপেক্ষায় রইলাম। এদিকে প্রচণ্ড বাতাসের জন্য বেশিক্ষণ থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল তাই কিছুক্ষণ ভিতরে থেকে গরম হয়ে আবার এসে অপেক্ষা করেত থাকলাম। অবশেষে সেই চমৎকার দৃশ্য দেখার সুযোগ হোল। আমার ক্যামেরার চারজ শেষ হয়ে যাওয়ায় মন মতো সেই দৃশ্য ধরে রাখতে পারিনি। এতসময় অপেক্ষার পর মনে হোল যেন টুপ করেই সূর্যটা ডুবে গেলো।আবার প্রায় ১৪ ঘণ্টার জার্নি শেষে পরদিন সকাল সাড়ে নয়টায় আমরা কীল এসে পৌঁছালাম । শেষ হোল আমাদের সমুদ্র ভ্রমণ এবং সুইডেন দেখা। আমরা সেদিন কীল দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই শহরে থেকে গেলাম।
আমরা সুইডেন ভ্রমণ শেষে কীলে আমার বরের সহকর্মী মহিউদ্দিন ভাইয়ের বাসায় বেড়ানোর প্রস্তাব পেয়ে থেকে গেলাম।জাহাজ থেকে নেমে তার বাসায় পৌঁছে আড়াই ঘণ্টার মত থেকে গোসল , নামাজ, খাওয়া দাওয়া করে আবার বেড়িয়ে পড়লাম নতুন কিছু দেখার জন্য। তার আগে কীল সম্পরকে একটু বলি। 
কীল, Schleswig-Holstein স্টেটের একটি বড় এবং জনবহুল শহর যা উত্তর জার্মানিতে অবস্থিত। এটি হামবুর্গ থেকে প্রায় ৯০ কি মি উত্তরে অবস্থিত। এর আয়তন ১১৮. ৬ বর্গ কি মি এবং জনসংখ্যা ২৪২,০৪১ ( ৩১ ডিসেম্বর ২০১১)জন। 
আমাদেরকে মহিউদ্দিন ভাই কীল শহর না ঘুরিয়ে শহর থেকে একটু দূরে নতুন এক জায়গায় নিয়ে গেলেন। যা কীল শহর থেকে ১৯ কিমি দূরে অবস্থিত। ছোট্ট সেই শহরটির নাম Laboe. এটি Plön জেলার একটি পৌরসভা এবং Baltic Sea এর উপকূলে অবস্থিত। 
তো আমরা বাসে এক ঘণ্টার জার্নি শেষে Laboe তে গিয়ে পৌঁছালাম। যাওয়ার পথে গ্রাম চোখে পড়লো। এই দেশে শহরের বাড়িগুলোর চেয়ে গ্রামের বাড়িগুলো মনে হয় বেশি সুন্দর। দেড় তলা দুই তলার বাড়ি সামনে কিছু জায়গা নিয়ে তৈরি হয়। দেখে মনে হয় ছবির মত । কিছু বাড়ির ছাদ ছন দিয়ে তৈরি দেখলাম । বাস থেকে নেমে কিছুদূর গিয়ে সুন্দর একটি বীচ দেখতে গেলাম।যদিও বীচটি কিছুটা কৃত্রিম ভাবে তৈরি। সেদিনের দিনটিও রোদে ঝলমলে ছিল । তাই প্রচুর লোকের সমাগম ছিল। বীচটিকে কেন্দ্র করে রাস্তার পাশে প্রচুর হোটেল, রেস্তোরা, ছোট খাবার দোকান এবং আইসক্রিমের দোকান গড়ে উঠেছে । রোদ উপভোগ করার জন্য দোকানগুলির বাইরেও বসার ব্যবস্থা ছিল ।চারদিকের চমৎকার প্রকৃতি দেখতে দেখতে বেশ অনেকটা পথ হেঁটে আমরা একটা সাবমেরিন দেখতে গেলাম। সেটা বীচের পাশেই। U 995 নামে সাবমেরিনটি দ্বিতীয় বিশ্বে জার্মানের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করেছিলো । এটি ১৯৪৫ সালে নরওয়ে দখল করে নেয় এবং ১৯৪৮ সালে জার্মানিকে ফেরত দিয়ে দেয় । ১৯৭২ সালে মিউজিয়াম শিপ হিসেবে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় Laboe তে । মাসুদ রানার বইতে অনেকবার সাবমেরিন নিয়ে পড়ায় এটির ভিতরে যাওয়ার জন্য আমি ও আমার বর এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম । দুইজনে ৭ ইউরো দিয়ে টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকলাম । আমি ঢুকে তো থ। এ তো লোহা লক্করের গুদাম। চারদিকে শুধু মেশিন আর মেশিন । কত টাইপের তা নিজের চোখে না দেখলে বুঝা যাবে না । আমার কল্পনার চেয়ে অনেক চাপা জায়গা । এর মধ্য দিয়ে সাবমেরিনের মানুষগুলো কিভাবে চলাচল করতো ভেবে আমি অবাক হলাম। এই সাবমেরিনটি চালাতে ৫০ জন ক্রু লাগতো। এত যন্ত্রপাতির মাঝেই রান্নার জায়গা , থাকার জায়গা , বাথরুম সবকিছুই ছিল । এত সংকীর্ণ জায়গার মধ্যে এতগুলো মানুষ কিভাবে পানির নীচে দিনের পর দিন থাকতো ভাবতে গিয়ে কেমন যেন লাগলো। তাই বেরিয়ে আসলাম । আমার বর অবশ্য খুব ধীরে সুস্থে দেখে তার অনেকদিনের কৌতূহল মেটাচ্ছিল । 
রাস্তার ওপাশে Laboe Naval Memorial মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সম্মানে তৈরি করা হয় । ১৯২৭ সালে শুরু হয়ে ১৯৩৬ সালে সম্পন্ন হয়।সেটা দেখার মত পর্যাপ্ত সময় আমাদের হাতে না থাকায় আমরা বাইরে থেকে কিছু ছবি তুলে নিলাম। এর পর আমরা হাঁটতে হাঁটতে পানির কাছে গেলাম। সেখানে বাচ্চারা বালুর মাঝে মজা করে খেলল । আমরাও কিছু ছবি তুলে ফেরার জন্য ঘুরলাম। যদিও ইচ্ছে ছিল ছোট শিপে করে কীলে যাওয়ার কিন্তু ছুটির দিন থাকায় ছয়টার মধ্যেই শিপ বন্ধ হয়ে গেলো। তাই আমরা আবার বাসে করে কীল চলে এলাম। সেদিন রাতে সেখানে থেকে পরদিন ট্রেনে করে গিসেন চলে এলাম। সবকিছু খুব সুন্দর ভাবে শেষ হলেও শেষ ট্রেন থেকে নামার সময় আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হুমায়ূন ভাই তার পিঠের ব্যাগ ভুলে ট্রেনে ফেলে চলে আসলেন। সেই ব্যাগে ছিল বেশ কিছু ইউরো, দুইটা স্মার্ট ফোন ,ক্যামেরা, পাসপোর্ট, চাবি আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজ। আমাদের সব আনন্দ মুহূর্তে পানসে হয়ে গেলো। আমার বরও ও তিনি আবার ট্রেন স্টেশনে গেলেন। ব্যাগে যে মোবাইল ছিল তাতে কল দিলে একজন জার্মানি রিসিভ করে বলল , সে ব্যাগটি পেয়েছে ।পরের দিন সকাল বেলা আসলে দিতে পারবে। তিনি পরদিন সকাল বেলা গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আসলেন । বাসায় এসে দেখেন সব আছে শুধু ক্যামেরাটি নেই। বুঝা গেলো ভদ্রলোক নিজের পুরুস্কার নিজেই পছন্দ করে নিয়ে নিলেন । 
শেষ হোল আমার সুইডেন ভ্রমণ কাহিনী ।

September 11, 2014

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন