বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৫

মোহময়ী সিল্ক রুট

Saturday, 24 January 2015

পর্ব: ১

আমার মত ভ্রমণ প্রিয় মানুষের জন্য পর্বত অত্যন্ত কাছের মোহ। সেই পর্বত যদি হয় হিমালয় তো কথাই নেই। বার বার এর আকর্ষনে দূর দুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে এসেছে। অনেকেই চিরতরে থেকে গেছে। সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় সাদা সাদা তুলো ( সে মেঘ হোক বা বরফ ), সঙ্গে হাড় হিম করা ঠান্ডা বাতাস, মাঝে মাঝে দেখতে পাওয়া জলের স্রোত, পাঠক এ এক সর্গীয় অনুভুতি। আমার এবারের গন্তব্য পুরোনো সিল্ক রুট। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন এটি একটি ঐতিহাসিক ও প্রাচীন রাস্তা। বলা হয় এই রাস্তায় প্রাচীন কালে তাম্রলিপ্ত (অধুনা তমলুক) বন্দর থেকে রেশম পরিবহন হতো, সেই রেশম চলে যেত তিব্বত এ। পরবর্তি সময় এই রাস্তা পরিমার্জিত ও পরিবর্তিত করে ভ্রমণ প্রিয় মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয়। আমি সেই ভাগ্যবান দের মধ্যে একজন যে ওই রাস্তায় যাবার সাহস ও সুযোগ পেলাম। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি একজন অতি সাধারণ ভ্রমণ প্রিয় মানুষ। পূর্বে কোনও পর্বত অভিযান তো দূরের কথা ৮০০০ ফুট এর বেশি উচ্চতায় ওঠার অভিজ্ঞতাও এই ভ্রমণ এর আগে ছিল না। অথচ এই রাস্তায় আমরা প্রায় ১৪০০০ ফুট উচ্চতায় উঠেছিলাম। অবশ্সই গাড়িতে।
কয়েক দিন আগে সরপিল পথ ও বরফ এর সাদা চাদর দেখে আমি ঠিক করি এই পথেই অভিযানে যাবো। ফেসবুক তুতো বন্ধু জাবেদ ওই পথেই একদল লোক নিয়ে ভ্রমণ করতে বিজ্ঞাপন দেয়। আমার কাছে এটি আকর্ষণীও লাগে। শুরু হয় কথা বার্তা । এর মধ্যে আমার মনে হয় ফেসবুক গ্রুপ "টূর ও টুরিস্ট" এর তরফ


থেকে কয়েকজন এক সঙ্গে গেলে কেমন হয়? আমার সহকারী ও গ্রুপ প্রথিষ্টাকারী স্বপ্ন বাবুর সাথে একদফা আলোচনা করে ঠিক করি গ্রুপ এর একটি দল একসঙ্গে যাবো। সেই মত আমি ঘোষণা করি যে গ্রুপ থেকে একটি দল তৈরি হবে ও সেই দল জাবেদ এর সাহায্যে ওই পথে ভ্রমণ করবে। এই গ্রুপ এ ব্যাপার টা প্রথম। তাই একটা উত্তেজনা ছিলই। জাবেদ এর সঙ্গে কথা বলে 3 বার দিন খন পরিবর্তিত হয়ে শেষে ঠিক হয় 22 থেকে 29 ডিসেম্বর এই ভ্রমণ চলবে। আমি ঘোষণা করে দি যে , যে কেউ এই ভ্রমণ এ আমাদের সঙ্গী হতে পারেন। কিন্তু সর্বমোট সংখা 8-9 বা 16-17 হতে হবে। সেই মত টাকা জাবেদ কে দেবার শেষ দিন ধার্য করা হয় যাত্রা শুরুর 2 মাস আগে। কিন্তু এই রাস্তায় থাকার বাড়িগুলো তে পরিমিত ঘর না থাকায় ঠিক হয় সর্বমোট ৯ জন যাবো। জাবেদ এর প্রাথমিক সূচী তে থাকা ভ্রমণ স্থান গুলো নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। এর মধ্যে একে একে আমার দলে এসে যুক্ত হন দিব্যেন্দু, অর্নব, শুভজিত, সোমা দিদি ও মসিমা (সোমা দিদির মা, এনার বয়স আনুমানিক ৬৫), অমল দা (আমলেন্দু মিত্র), যাবো কী যাবো না করে শেষ পর্যন্ত দুর্ভাগ্য ক্রমে যেতে না পারা রণজিত বাবু। অনেক বার অনুরোধ করা হলেও প্রাথমিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে থাকা গৌতম দা ইচ্ছা সত্যেও সরে গেলেন।
প্রাথমিক ভাবে ৩০০০ টাকা করে দিয়ে দেওয়া হল জাবেদ কে।





পর্ব-২
পাঠক আজকে প্রথমেই সিল্ক রুট নিয়ে কিছু বলব। খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে মনে করা হয় ৬৫০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বনিককুল ভারতবর্ষ ও চীন থেকে রেশম পরিবহন করতেন। শুধু রেশম নয় নুন থেকে সোনা ও এই রাস্তায় পরিবাহিত হতো। এই পথে ভারতবর্ষের তমলুক (তাম্রলিপ্ত) বন্দর থেকে তিব্বত এর রাজধানী লাসা নগরী হয়ে, মধ্য এশিয়া দুর্গম পথের মধ্যমে ইউরোপ এর রোম সম্রাজ্য পর্যন্ত অতিক্রম করা যেত। উঠ ও খচ্চর এর সাহায্যে শুধু যে পন্ন তা নয়, ধর্ম, বর্ণ ও সংস্কৃতির ও আদান প্রদান ঘটে।

মনে করা হয় এই পথেই গ্রীক ভাস্কর্য ভারতে প্রবেশ করে ও ভারতের বৌদ্ধধর্ম চীন হয়ে মধ্য এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে। যদিও আমি যে পুরাতন সিল্ক রুট নিয়ে আলোচনা করছি সেটি অত্যন্ত কম পরিব্রাজক ভ্রমণ করেছেন, মনে করা হয় ১ম খ্রিস্টাব্দে এই রাস্তার আবিষ্কার হয় । ৪০০ খ্রিস্টাব্দে ফা হিয়েন এর রচনায় জানা যায় যে এই পথে তিব্বত থেকে ছামবি হয়ে ভারতবর্ষে ঢুকে তাম্রলিপ্ত বন্দরের মধ্যমে বণিক কুল পূর্বের দেশ গুলি যেমন শ্রীলঙ্কা , বালি, সুমাত্রা অবধি বাণিজ্য করতেন। তাই এই পথের গুরুত্য কোনও অংশে কম নয়। দুর্গমতার নিরিখে বেশীরভাগ সময় বরফে ঢেকে থাকা এই পথ প্রথম সারির মধ্যে পড়ে।লাসা থেকে তাম্রলিপ্ত, প্রায় ৯০০ কিলোমিটার দৃর্গম ও বিপদ সংকুল পথে চলা সেই সব পরিব্রাজক কে আমার কুর্নিশ। ভাবতেই শিহরিত লাগছিল যে আমরা তমলুক থেকে না হলেও শেয়ালদহ থেকে নথুলা বা তার


কাছাকাছি যেতে পারব। পাঠক সেই শিহরণ যে আমাদের কোন স্তরে নিয়ে যায় পরবর্তি পর্বগুলিতে পড়তে থাকুন।

আমার ঘোষণা করার পর থেকেই গ্রুপ এ সাজ সাজ রব পড়ে যায়। জাবেদ কে অনুরোধ করে ঠিক করা হয় পদমছেনএ ২ রাত্রি না থেকে আমরা জুলুক বা Dzuluk এ ২ রাত্রি থাকবো। এর ফলে সকাল সকাল সূর্য় উদয় দেখতে যেতে পারব। 
দেখতে দেখতে ২১ ডিসেম্বর চলে এল। সব থেকে কঠিন কাজের দায় নিজের কাঁধে নিলেন দিব্যেন্দু। ভারতীয় রেল এর টিকিট কাটা আমার মনে হয় এভারেস্ট জয় করার মত কঠিন কাজ। আগের দিন রাতে অনেক সময় দাঁড়িয়ে নাম লিখিয়ে তবে টিকিট পেলেও পাওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে আমাকে অঞ্জনা দি অনুরোধ করেন যদি তার জামাই বাবু কে আমরা আমাদের দলে নিতে পারি। অনেক চেষ্টা করেও ৯ জনের বেশি নিতে না পারায় ওনাকে না বলতে বাধ্য হই। রণজিত বাবুর টিকিট কাটতে হবে না। কিন্তু তাকে ধরেই আমরা সমস্থ বাবস্থা করতে থাকি। যদিও রণজিত বাবু শেষ মূহুর্তে যাবার কথা বলেছিলেন , কিন্তু আমাদের তো গাড়ি ও হোটেল এ সেই ভাবেই ধরে রাখতে হবে। 
২২ তারিখ সকাল সকাল দিব্যেন্দু ফোনে জানলেন টিকিট ডাব্লিউএল বা প্রতীক্ষায় আছে। মন খারাপ হবার আগেই বুঝতে পারলাম উনি মজা করছেন। দক্ষতার সঙ্গে দিব্যেন্দু ৮ টি টিকিট কেটে ফেলেছেন। দার্জিলিং মেল এই আমরা যাচ্ছি। আহা কী আনন্দ। রণজিত বাবু কে জানিয়ে দেওয়া হল।


কিন্তু বিপদ হল ফেরার টিকিট কাটার সময়। এর মধ্যে দিব্যেন্দু ২৭ তারিখে একটু বেশি কাজের চাপ থাকায় ২৮ তারিখে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেন। যার ফলে এবার সত্তি আর টিকিট নেই। কী করা যায়? হটাত্‍ দিব্যেন্দু ফোনে বলে নিউ বঙ্গাইগাঁও থেকে soraighat এক্সপ্রেস ট্রেন টির টিকিট পাওয়া যাবে। দাম একটু বেশি পড়লেও নিউ জলপাইগুড়ি থেকে যাত্রা করব দেখিয়ে ওই টিকিট কাটার অনুরোধ করলাম। এখানেও দিব্যেন্দু দক্ষতার সাথে একই কামরায়, পুরো একটি অঞ্চলের টিকিট কেটে নিলেন।
শুরু হয়ে গেল যাত্রার প্রস্তুতি।



পর্ব-3
একে একে বন্ধু ও শুভকাঙ্খি দের উপদেশ , সতর্কতা ও শুভেচ্ছা পেতে থাকলাম। আশায় ও নিরাশায় দেখতে দেখতে যাবার দিন এসে গেল। নিরাশা কারন দুদিন আগে ঘুরে আসা এক ভ্রমণ প্রিয় যাত্রীর কথা মত সারা রাস্তায় বরফ আর বরফ। বেশি দূর যেতে দিচ্ছিল না।
যা হয় হবে। বরফ থাকলে বরফ কেটে উঠবো। জাবেদ মনে করিয়ে দেয় ওই উচ্চতায় ঠান্ডা ও শাসকষ্ট আমাদের মনের অদম্য ইচ্ছা কে হারিয়ে দিতে পারে।
যাত্রা শুরুর এক দিন আগে রণজিত্‍ বাবু দুঃসংবাদ দিলেন। গাড়ি দুর্ঘটনা জনিত কারণে তিনি আমাদের সঙ্গী হতে পারছেন না। অঞ্জনা দির জামাই বাবু কে এই ভ্রমণের সঙ্গী করতে না পারা ও রণজিত্‍ বাবু কে শেষ মূহুর্তে ছেড়ে দিতে হওয়ার মন খারাপ কে সঙ্গী করেই সবার ব্যাগ গুছন শেষ।

উঠে পড়লাম দার্জিলিং মেল এ । ট্রেন ছাড়ার আগেই , একে একে সবাই এসে হাজির। গ্রুপ এর পতাকা টাঙ্গিয়ে (সোমাদির ভাষায় গ্রুপ এর জামা) একে একে ছবি তোলা শুরু হল। সঠিক সময় ট্রেন ছাড়ল। রাতের খাবার যে যার নিজের। আমি , দিদি ফ্রায়েড রাইস ও মাংস কিনে নিয়েছিলাম। কিছু সময় পরে খেয়ে নিলাম। এর মধ্যে অর্ণব কে নন্টে , শুভজিত কে ফন্টে ও দিব্যেন্দু কে কেল্টু দা নাম করণ করা হয়। পাশাপাশি সীট এ যে যার মত শুয়ে পরলাম। ঠান্ডা লাগছে। কিন্তু সেরকম নয়। কী করে জানব

পরের দিন ভোর বেলা আমাদের জন্য কী তৈরী করে রেখেছে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডা বাড়তে থাকে। একটা ছোট বিছানার চাদর গায়ে দিয়েছিলাম। সোয়েটার ছিল। কিন্তু ঠান্ডা যেন একটু বেশি। হটাত্‍ নন্টে চিত্‍কার করে উঠল "শীত পাচ্ছে, শীত পাচ্ছে"। ঘুম ভেঙ্গে গেল। কয়েক জন অন্য সিট থেকে উকিঝূকি দিল। আমি উঠে দরজার সামনে এলাম। প্রচণ্ড ঠান্ডা।এর মধ্যে সিট না পাওয়া দুই দুঃশাহসী যাত্রী মাঝে মধ্যেই দরজা খুলে দিচ্ছিলেন। কনকানে ঠান্ডা হওয়া ঢুকে পায়ের পাতা থেকে মাথার চুল কপিয়ে দিচ্ছিল। দার্জিলিং মেল এ এত নোংরা বাথরূম আগে দেখিনি। বর্ধিত ভাড়ার সাথে সাথে পরিষেবার মান ও ব্যাস্তানুপটিক। যাই হোক, কষ্টে শিষ্ঠে রাত কবর করা গেল। ভোরের দিকে মালদহ ও কৃষাণগঞ্জ কে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি। ঘন কুয়াশা। হেটে চললে পাল্লা দেয়াও যাবে এমন গতিবেগে বাধ্য হয়ে চলতে থাক সুপার ফাস্ট দামাল ক্রমাগত দেরির পাল্লা ভারী করছে। সঙ্গে পেটে চালু হওয়া ইদুর দৌড়। বেস খিদে পেয়েছে। জাবেদ চা খাওয়াল। যদিও তার আগেই কয়েক বার খাওয়া হয়ে গেছে।  1 ঘণ্টা 30 মিনিট দেরি করে শেষে আমরা নিউ জলপাইগুড়ি পৌছালাম। জলখাবার এখনো দেরি । শহরের বাইরে খাব। গাড়ির ড্রাইভার তপগায় লেপচা এসে গেছে। মালপত্র তোলা হলএবার শুরু হল পাহাড়ে ওঠা। সেবক এর রাস্তা থেকেই কাঞ্চন উঁকি দিল। খিদে ভুলে গেলাম বেমালুম। এসে গেল সেবক ব্রিজ। চোখের সামনে আহ সে কী দৃশ্য।








পর্ব -৪
সেবক ব্রিজ এর পাশে একটি সুন্দর খাবারের দোকানে লুচি সবজি খেতে বসলাম। কিন্তু, তার আগেই ছুট দিলাম ব্রিজ এ । দারুন দৃশ্য। আমাদের ওয়েলকাম করার জন্য হিমালয় এখানে তিস্তা কে রেখেছে, সঙ্গে রঙ্গিত। দুজনে হাত ধরা ধরি করে এবার সমতলে নামবে ও জলধারা সাগরের দিকে এগিয়ে যাবে। চটপট যত পারলাম ছবি তুলতে থাকলাম। এদিকে খাবারের ডাক পড়েছে। কালকে রাতে ভাল ঘুম হয় নি। অনেক বার চা খাবার ফলে খিদে মরে গেছে। বেস বড় বড় লুচি , অমলেট সহজগে পর পর 4 টে পেটে চালান করলাম। এক কাপ চা। বড় কাপ চা। এর মধ্যে একে একে বাড়িতে ফোনে কথা বলা শুরু। এদিকে গাড়ির ড্রাইভার এর তারা। পৌছতে দেরি হতে পারে। খাবার শেষে ব্যানার টা গাড়ির সামনে অমলদা ও জাবেদ লাগিয়ে দিল। হোটেল এ খাবারের বিল জাবেদ মিটিয়ে দিল ও সঙ্গে সঙ্গে নিজের লোকসানের খাতাও খুলে ফেলল। এত গুলো দামাল কে নিয়ে গেলে ওর যে লাভ হবে না সেতো জানাই ছিল।

গাড়িতে ব্যানার লাগানো শেষ। পাহাড়ে ওঠার যাত্রা শুরু হল। সঙ্গী তিস্তা। আমার আসন মাঝে ও বাম দিকে। চলতে থাকা তিস্তা মাঝে মাঝে আমার পাশে, মাঝে মাঝে সোমা দির দিকে । পাঁকদন্ডি বাওয়া শুরু। জলদি চলতে থাকা গাড়ির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে গ্রুপ এর জামা বিদ্রোহ করে। আবার দেরি। তবে বিরক্ত লাগছে না। এর মধ্যে বেশ কয়েক বার গৌতম বাবু আমাদের খবর নিয়েছেন। তাঁকে আনতে না পারার অক্ষমতা সঙ্গে নিয়ে , গ্রুপ এর জামা ঠিক করে শুরু হল কালিম্পং এর দিকে যাত্রা।

সামনের সীট এ জাবেদ চট পট ছবি তুলছে। বড় ট্যাব। বড় বড় ছবি। হটাত্‍ এর মধ্যে নন্তে, ফন্টে ও কেল্টু দা অদ্ভুত শব্দ শুরু করল। "কুক" । পরবর্তি কালে পাঠক এই কুক শব্দটি আমাদের ভ্রমণের সঙ্গী ও বলা যায় theme tone হয়ে যায়। উদ্যেগ, আনন্দে, দুখ্যে এই "কুক" আমাদের চাঙ্গা রেখেছিল। এদের সঙ্গে এত ঘণ্টা কাটিয়ে আমি বুঝে গেছি, যতই সামনে বিপদ আসুক, ভগবান ও হাসতে হাসতে আমাদের ছেড়ে দেবেন। হয় তো তিনি আমাদের মধ্যমে খুশি থাকতে চেয়েছিলেন।
মনে হল আমার একটা জ্যাকেট দরকার। যদি বরফ বৃষ্টি শুরু হয় তাহলে আমার সঙ্গী সোয়েটার বা ওভার কোট যেটা হাফ হাতা, হয়ত কাজে নাও আস্তে পারে। সেই মত তিস্তা বাজার পেরিয়ে, coronation ব্রিজ কে দান দিকে রেখে আমরা চললাম কালিম্পং। কালিম্পং এ দারাব। কারণ এখানে ভাল বাজার আছে। মনে করা হচ্ছে এখানে আমার জ্যাকেট পাওয়া যেতে পারে।








   


পর্ব - ৫

যত ওপরে উঠছি তত সুন্দর দৃশ্য সঙ্গে সুন্দরি তিস্তা। একটি ব্রিজ এর ওপরে উঠে গাড়ি দাড়িয়ে গেল। কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি। অমনি নেমে পড়লাম। চটপট ছবি নিতে লাগলাম। অসম্ভব সুন্দর তিস্তা, ব্রিজের ওপরে অমলদা নৃত্য ভঙ্গিমায় ছবি তুললেন। এই মানুষ টি যত কম গ্রুপ এ আসেন তত বেশী মজা করতে ওস্তাদ। একটু ধোয়া ছেড়ে আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম। আবার শুরু পাক দন্ডি। "কুক" কিন্তু তার উপস্থিতি জানিয়ে চলেছে। সংক্রামক ব্যাধির মত বাকিরাও এবার "কুক" করতে শুরু করেছে। পাঠক , এর উত্‍পত্তি কিন্তু গঙ্গার মত অজানা। হয় তো নোন্তে আলোকপাত করতে পারে। হয় তো ভাল, হয় তো খারাপ। আমরা একে ভাল ভাবেই নিয়েছি।
কালিম্পং পৌছে গেলাম। কালিম্পং বাজার। বেলা হয়ে গেছে। প্রায় আড়াইটে বাজে। তেমন কিছু ঠান্ডা লাগছে না। কালিম্পং বাজারে একদল পুলিস এর গোয়েন্দার মত আমরা প্রায় সবাই আমার জন্য জ্যাকেট কিনতে চললাম। জাবেদ একটি দোকানে নিয়ে গেল। না এখানে নেই। বেস কয়েকটি দোকান খোঁজার পর একটি দোকান আমার আয়তনের জ্যাকেট দিল। দাম চাইল দেড় হাজার টাকা। সেই মূহুর্তে দেড় হাজার টাকা খরচ করে দিলে আমার একটু সমস্যা হতো। তাই জাবেদ মনে করিয়ে দিল রঙ্গলি বাজার থেকে জ্যাকেট কিনে নিতে পারি। সেই মত জ্যাকেট কেনা স্থগিত রেখে একটু হেটে গাড়িতে উঠে বসলাম।


রামধুরা যাবার আগে আমাদের গন্তব্য ডেলো। আমার এক দিদির কাছে শোনা কালিম্পং এর ডেলো এবার আমার কাছে আস্তে চলেছে। গোর্খা টেরিটরিয়াল এর নিয়ন্ত্রনে থাকা ডেলো বাংলো ও তার পাশের পার্ক এ ঢোকার জন্য প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম।  রাস্তা বেস খাঁড়া। উঠতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে। মসিমার কোনও সমস্যা নেই। সবার আগে আগে উঠে পড়ছেন। আমার উঠতে একটু সময় লাগলো। নন্তে ফন্টে আর অমলদা চটপট উঠে বাংলো ঘুরে সোজা আর একটি টিলার ওপরে। আমি একটু বাংলো টা বাইরে থেকে ঘুরে দেখলাম। ভেতরে ঢুকি নি। একটু তাড়াহুড়ো ছিল।
টিলার ওপরে উঠলাম। কাঞ্চন এখন মেঘের পেছনে। খুব একটা ভাল দেখা যাচ্ছে না। দেখলাম আসে পাশে অনেক দেখার যায়গা আছে। আমাদের হাতে সময় নেই। নেমে এলাম।
বাইরে এসে এক কাপ কফী খেলাম। অমলদা খাওয়ালেন। খেয়ে নিয়ে আবার গাড়ি। সূর্য প্রায় বিদায় নিতে চলেছে। রঙ টক টকে লাল। এর মধ্যে ভূটিয়া হোম স্টে থেকে লেপকা ভূটিয়া আমাদের ওনার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু বেলা প্রায় শেষ। তাই পরের দিন আসব কথা দিয়ে সোজা khailang হোম স্টে দিকে এগিয়ে গেলাম। আসল রাস্তার ওপরেই বাড়িটি। প্রায় চতুর্দিকে খোলা একটা সুন্দর গ্রাম রামধুরা। নামতে
নামতে দেখি সূর্য পাহাড়ের একদম কোণে ঢলে পড়েছে। শেষ রবির স্পর্শ। ব্যাগ নামছে গাড়ি থেকে, আমি নেমে গেছি আগেই। ব্যাগ পড়ে থাক। বাম দিকে পাহাড়ের কোনই শেষ কয়েক সেকন্ড এর লাল সূর্য কে একমাত্র আমি ক্যামেরা বন্দী করতে পারলাম। সোমা দি ও খানিকটা পেরেছিল। বাকিরা ব্যাগ নামিয়ে আসার আগেই

সূর্য় ডুবে গেছে। শুধু রক্তিম আভা। এবার টের পেলাম ঠান্ডা । জল হাতে লগ মাত্র হাত কেটে যেতে থাকলো।

বাড়িটির ঘর গুলোর সামনে ছোট বারান্দাবারান্দা র সামনেই খাদ। বাম দিকে উঠান। আর একটু এগিয়ে গেলে খাবার যায়গা। এই অংশ থেকে প্রায় ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে পাহাড় দেখা যায়। আর নিচে বয়ে চলা তিস্তা। এখানে পাঠক আপনি অনেকটা তিস্তা দেখতে পাবেন। তবে তা রামধুরার সব বাড়ি থেকে দেখা যায় না।

একটু মুখ হাত ধুয়ে খেতে বসলাম। এটাই আমাদের দুপুরের খাবার। খাচ্ছি সন্ধে বেলা। সারাদিন শুধু পাহাড় আর পাহাড়। ক্লান্তি যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।







পর্ব -৬

খাবার পর একটু টয়লেট যেতে হল। ফিরে এসে খানিকক্ষণ আমাকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হল। ঠান্ডা আমার এক একটি অঙ্গ কে জমিয়ে কাঠ করে দিয়েছে। গরম জল দেবে বললেও আমার একটু তাড়া থাকায় ওস্তাদী করার ফল এই। একে একে সোয়েটার এর ওপরে মাফলার , হাফ হাতা জ্যাকেট চাপিয়ে নিলাম। রাতের কালিম্পং এখন আমাদের নিচে। টুনি দ্বারা সাজানো একটা ছোট শহর। জোনাকির আলোর মত শত শত আলো নিচের দিকটা আলোকিত করে রেখেছে। স্বর্গীয় অনুভূতি একটি নমুনা এখানে পেয়ে গেলাম। গরম গরম দুধ বিহীন চা খেয়ে নিলাম।
নাইট ভিশন না থাকায় কিছু ছবি তুললেও আমার ক্যামেরায় রাতে ছবি শুধুই অন্ধকার। তাই আমি দুঃখিত পাঠক, সেই অনাবিল সুন্দর রাতের কালিম্পং আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারলাম না। নিচে তিস্তা এখন কালো সর্পিল রেখা মাত্র।
কাজ নেই। বসে পড়লাম আড্ডা দিতে। এই প্রথম কোনও এক ট্যুর করানোর লোক যে রামধুরা পর্যন্ত আমাদের থেকে টাকা নেয় নি। এখন আমাদেরই যেচে টাকা দিতে হলো। জাবেদ খাতা খুলে বসল। প্রসঙ্গত আমাদের সর্ব মোট ৭০০০ টাকা করে জাবেদ নিয়েছিল। এছাড়া ট্রেন এর ভাড়া বাবদ ৭৮০ টাকা পড়েছিল। সবাই প্রায় ৩০০০ করে আগে দিয়ে দিয়েছিলাম। ৪৭৮০ টাকা বাকি ছিল। পুরো টাকা গুণে গুণে জাবেদ কে দিয়ে দিলাম। এক টাকাও আমাকে ছাড় দিল না। অমলদা কিন্তু কিছু ছাড় পেয়েছিলেন।


চলতে থাকলো গল্প। সঙ্গে মাঝে মধ্যে "কুক"। ওস্তাদ নন্তে যেখানে মজা সেখানে। বাইরে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডা। মাসিমা কিন্তু একদম চাঙ্গা। শরীর ওনার নিশ্চয় খারাপ হয়েছে। কিন্তু বুঝতে দেবেন না। দুটো ঘরে আমরা ছিলাম। ঘর দুটোই পাশাপাশি। এক ঘর থেকে শব্দ অন্য ঘরে শোনা যায়।
ফন্টে একটু চুপ চাপ , কিন্তু একদম বারুদে ঠাসা বন্দুক। বেশ খানিকক্ষণ গল্প চলল। এর মধ্যে এক কাপ করে কালো কফি এলো। আমরা বলেছিলাম অতিরিক্ত পয়সা দেব। অতীব অতিথি বত্‍শল রামধুরার বাসিন্দা অরুণ খালিঙ্গ বাবু , আসলে যার বাড়ি তে আমরা আছি, তিনি অতিরিক্ত পয়সা নিলেন না।
আবার পরীক্ষা । এবার রাতের খাবার তৈরি। নিয়ম অনুসারে বাইরের উঠান টপকে খাবার যায়গায় যেতে হবে। ঠান্ডা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে হিমেল হওয়া। হওয়ার হাত থেকে মুক্তি পেলেই ঠান্ডা নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে। রাতের মেনু মুরগির ঝোল, ভাত বা রুটি, সবজি। ক্ষিদে ছিল না তবুও খেয়ে নিলাম।
এবার গরম জলে হাত ধুয়ে নিলাম। এবার নিদ্রা দেবী কে স্মরণ করার পালা। আমি , দিদি, মাসিমা এক ঘরে ও বাকিরা এক ঘরে। ওই ঘরে তখন পাল্লা দিয়ে চলছে মোবাইল এ মজাদার কমিক্স। এঘর থেকে কিছু কানে আসছে। আস্তে আস্তে সুয়ে পড়লাম ও চলে গেলাম ঘুমের দেশে।

২৪ ডিসেম্বর। ভোর তখন সাড়ে চারটে। নন্তে আবার কিছু একটা চিত্‍কার করে উঠল। আমি উঠে গেলাম। আর ঘুম এলো না।

এবার সন্ধান করতে হবে কাঞ্চন। বাইরে বেরিয়ে এলাম। বারান্দায়। এর বেশি চেষ্টা করেও এগোতে পারলাম না। সেভাবে আলো ফোটে নি। অন্ধকার ই বলা যায়। অপেক্ষা করতে থাকলাম, এক এক মিনিট এক এক বছর। আর কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। মুরগির মত কোনও এক জন্তুর শব্দ পেতে থাকলাম। ঠিক মুরগি বা গরু , মিশ্রণ।
যত আলো ফুটছে তত পরিষ্কার হচ্ছে কাঞ্চন। আমার আশা ছিল হয় তো সূর্যোদয় দেখতে পাব। দেখতে দেখতে প্রথম লাল আলো কাঞ্চনের মাথায়। রাতের দিকে মন খারাপ করানো কুয়াশা এখন একদম নেই। মেঘ আছে কিন্তু খুব কম। পাঠক, আগেই বলেছি, প্রায় ১৮০ ডিগ্রী আপনি পাহাড় দেখতে পাবেন রামধুরা থেকে । প্রায় পুরো কাঞ্চনটাই আমার সামনে। সবাই কে উঠিয়ে দিলাম। নন্তে একবার কম গরম পোশাক পড়ে বেরিয়ে এসেছিল। হাজার ভোল্ট তড়িতাহিত হয়ে ঘরে ঢুকে পরে। এবার একদম জ্যাকেট পরিহিত।

"কুক"... একে একে কমলা , লাল হতে থাকলো কাঞ্চন। যেন আগ্নেয়গিরি। সদ্য অগ্নুত্পাত হয়েছে। সূর্যের দিকে মুখ রাখলে আপনার বাম দিকে। ভয় ও বিস্ময় নিয়ে ছবি আর ভিডিও করতে থাকলাম। কালকে রাতের অখ্যমতা আজকে পুষিয়ে দিল আমার ক্যামেরা। দুধ বিহীন চা হাজির। কারও নজর নেই। সবাই নতুন কাঞ্চন দেখতে ব্যস্ত। এই দৃশ্য দার্জিলিং থেকেও দেখা যায় না।
প্রকৃতির নিয়মে অবাক হওয়ার পালা ও শেষ হয়। আবার ফিরতে হবে বাস্তব জীবনে। এবার গরম জলে প্রাতকৃত্য সেরে একদম স্নান করে নিলাম। প্রাতরাশ এ আবার লুচি সবজি। এখন একটু বেশি

খেলাম। কালকের অভিজ্ঞতা বলছে আজকেও খেতে দেরি হতে পারে। আজকে যাব জুলুক। ঠান্ডা অনেক কম লাগছে। ভারী সুন্দর প্রকৃতি ও তার সঙ্গে ভারী সুন্দর একটি ভূটিয়া শিশুর ছবি তুলে ক্যামেরা ঢুকিয়ে নিলাম। হতাশ হলাম। সূর্য এখানে লাল হয়ে ওঠেন না।
গোছ গাছ শেষ। ব্যাগ গাড়িতে তোলা শুরু। হটাত্‍ ফন্টের মনিব্যাগ খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওতে ওর ছবি আছে। ছবি ও ভোটার id কার্ড এর জেরক্স ছাড়া ভারতীয় নাগরিকদের সিকিম প্রবেশ নিষেধ। ঢোকার মুখে একবার ও ওপরে উঠে রঙ্গলি তে একবার ছবি সহ লাগবে। তাহলে???
অনেক খোঁজার পরে জানা গেল ফন্টে ব্যাগ টি বাড়িতেই ফেলে এসেছে। কী বিপদ!










পর্ব -৭

মানিব্যাগ হারিয়ে গেলেও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে id কার্ড বা ছবি কোনটাই আনা অসম্ভব নয়। whatsapp নামক একটি আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বাড়ি থেকে ফন্টের ভোটের কার্ড ছবি আকারে চলে এল। ঠিক হলো পেডং বাজার থেকে ছাপিয়ে নেওয়া হবে। নন্তে তো কিছুই আনে নি। না ছবি না কার্ড। ওর শুধু "শীত পাচ্ছে"। আগের রাতে জাবেদ ইলেকট্রিক কম্বল এনেছিল। এটি কাশ্মীর থেকে বেশি দামে কেনা। সেই ইলেকট্রিক কম্বল মাসিমার জন্য আনলেও , শক লাগার ভয়ে মাসিমা ব্যবহার করেন নি। এই কম্বলটি একমাত্র নন্তে ও অমলদা কে বাঁচিয়ে রেখেছিল। ইলেকট্রিক কম্বল এখন ব্যাগে । তাই নন্তের শীত পাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।

ব্যাগ খোঁজার জন্য খানিকটা দেরি হলো। এদিকে আমাদের লেপকা ভূটিয়াজির বাড়ি যেতে হবে। বরাদ্য করা ২০ মিনিট কমে ১০ মিনিট এ নেমে আসে। গাড়ি চলতে শুরু করে। ভূটিয়াজির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গেল। ভূটিয়াজি বাড়ি নেই। কিন্তু তার দিদি আমাদের আপ্যায়িত করলেন। এনার বাড়িটি একদম রাস্তার ওপরে নয়। খানিকটা নেমে যেতে হবে। অতি মনোরম এক সুন্দর ছোট বাড়ি। রামধুরা থেকে কাঞ্চন খুব সুন্দর দেখা যায়। ভূটিয়া হোম স্টে তে জল গরম করার গিজার আছে। আর একটু আধুনিক। তবে আমার দুটো বাড়িই ভাল লেগেছে। বয়স্ক মানুষ হলে অরুণ বাবুর বাড়ি সবথেকে ভাল, অন্যথায় দুটোই থাকার জন্য অনবদ্য। রামধুরা দেখানোর জন্য জাবেদ কে আমার তরফ থেকে ধন্যবাদ।

আবার আসব বলে বিদায় নিলাম। সময় অভাবে চা খেতে পারলাম না। ধন্যবাদ লেপকাজি ও দিদি।

পেডং বাজার। গাড়ি থেমে গেল। নন্তে ফন্টের ছবি ও কার্ড ছাপানো শুরু হলো। আমি প্রথম মাছ দেখলাম পাহাড়ে ওঠার পর। অমলদা ও আমি ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। উদ্দেশ্য সেই জ্যাকেট কেনা। যদি পাওয়া যায়। এক মোটা চেহারার দোকানি কে জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, "আপনার আর আমার কথা কেউ ভাবে না দাদা, আপনার ও আমার জ্যাকেট আপনি পাবেন না।"। ভাঙ্গা মন নিয়ে ফিরে এলাম। গাড়িতে চেপে বসলাম। আমার কার্ড ও ছবি তপগায় কে দিয়ে দিয়েছিলাম। ও সবার থেকে নিয়ে নিল। শুরু হলো পথ চলা। প্রায় এক ঘণ্টা পরে সিক্কিম। রাস্তা খুব খারাপ। এই পথে চলতে চলতে পাঠক আপনি আপনার বাম দিকে সদ্য ধ্বংস হওয়া পাহাড় দেখতে পাবেন। অনেকটা পাহাড় কেটে নতুন বিমানবন্দর তৈরি হচ্ছে। ড্রাইভার সাহেবের মুখে শুনলাম এই পাহাড় কাটার ফলে অনেক স্থানীয ঘর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ্। আমার মনে হলো দার্জিলিং এ ক্রমাগত আন্দোলন ও তার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ্ সিক্কিম এর ভ্রমণ ব্যবসা। সেই জন্য সিক্কিম সরকার সরাসরি মানুষ কে নিয়ে আসতে এই বিমানবন্দর বানাচ্ছে।

একে একে রিশিখলা পেরিয়ে , খারাপ ভাল রাস্তা পেরিয়ে সিক্কিম দুয়ারে। ঢোকার মুখে ড্রাইভার সাহেব পুলিশ চৌকি তে গিয়ে আমাদের ভারতবাসী হওয়ার প্রমাণ দিয়ে এলেন। সিক্কিম পুলিশ আমাদের হাত নেড়ে টা টা

করলেন। আর ও খানিকটা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম রঙ্গলি। এখানে প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। জুলুক বা সিল্ক রুট যেতে হলে এখান থেকে নতুন করে অনুমতি নিতে হয়। আপনার গাড়ির স্থানীয ড্রাইভার সেই দায়িত্ব নেবে ও সে করে দেবে। গাড়ি পিছু ২০০ টাকা খরচ। সেই মত তপগেয় চলে গেল পুলিশ চৌকি তে। আমি চললাম জ্যাকেট কিনতে। একটা দোকানেই অনেক গুলো জ্যাকেট চেষ্টা করে শেষে প্রায় আমার আয়তনের একটি জ্যাকেট ৫৩০ টাকায় কিনতে পারলাম। প্রায় আমার আয়তনের কারণ পুরোপুরি গায়ে আসেনি। আমরা সবাই ঢুকে পড়লাম একটি দোকানে মোমো খেতে। মোমো ভাল ছিল না। তবে চা কিন্তু দারুন ছিল। নিরামিষ মোমো। এই প্রথম দার্জিলিং এর কোনও খাবার এই অঞ্চলের থেকে ভাল বলে মনে হলো। ঠান্ডা একদম নেই বললেই চলে। গায়ের সোয়েটার পর্যন্ত গাড়িতে। ফোনের টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে। বাড়িতে কথা বলে নিলাম। জাবেদ দুটি বড় বড় কেক কিনে নিল। পরের দিন যে প্রভু যীশুর জন্মদিন।

রঙ্গলি তে আমাদের দিলীপ প্রধান জি নিমন্ত্রণ করেছিলেন। চা খাবার। দিব্যেন্দু আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে অনুরোধ করে। উনি সময় মত উত্তর না দিতে পারায় আমরা যেতে পারিনি।

আবার গাড়ি চলতে শুরু করল । পথে পড়ল রঙ্গলি ড্যাম। সময় অভাবে দাঁড়াতে পারলাম না। খুব একটা আকর্ষণ করল না। রঙ্গিত নদী কিন্তু আমাদের সঙ্গী। এবার রাস্তা বেশ খাঁড়া। নন্তের মনে সংশয়। বরফ পাবে তো। আমাদের মনে কোনও সংশয় নেই, কিন্তু ওর সংশয় বাড়িয়ে বললাম নাও পেতে পারি। নন্তের মন

খারাপ। এর মধ্যে হটাত্‍ আবিষ্কার করলাম সিক্কিম পুলিশের অনুমতিপত্রে আমার বয়স ৫০। আরও অবাক কান্ড। মাসিমার বয়স ও ৫০। ড্রাইভার সাহেব তপগায় জি আমাদের দুজনকে এই বয়সি বানিয়ে দিয়েছে।

দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম কুইখোলা। এটি একটি পাহাড়ি ঝর্ণা। সুন্দর অত না হলেও মনোরম। পাহাড়ের বুক চিরে নেমে এসেছে। সশব্দে। দাঁড়িয়ে পড়লাম। শুরু হলো ফটো তোলা। এর মধ্যে অন্য একটি গাড়িতে যাওয়া আর একটি বাঙালি গ্রুপ এর এক সদস্য হটাত্‍ একটু অসতর্ক থাকায় তার চশমা জলে পরে যায়। সেই চশমা তুলতে গিয়ে ভদ্রলোক নিজেও জলে পরে গিয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ওঠেন। পাঠকগন যত ওপরে উঠছি ঠান্ডা কিন্তু বাড়ছে। এই ঠান্ডা তার মধ্যে ভিজে প্যান্ট। জানি না ভদ্রলোক কী ভাবে বাকি দিন গুলো কাটিয়েছিলেন।
চারপাশে মনোরম পরিবেশ দেখতে দেখতে প্রায় বিকেল ৩ টে (২৪ জানুয়ারী)স্নো লায়ওন গেস্ট হাউসে পৌঁছে গেলাম। এটি আপার জুলুক। ঘরের জানলা থেকে হটাত্‍ উঠে দাঁড়ানো সবুজ অরণ্যে মোরা মন ভাল করে দেওয়া একটি পর্বত শৃঙ্গ। ঠান্ডা হিমাঙ্কের নিচে। আকাশ পরিষ্কার। জানলার নিচে জমে থাকা জল খানিকটা বরফে পরিণত। নন্তে খুশি। আমি জানলাম এই হোম স্টে টে থাকার বাবস্থা দীপায়ন দে নামক আমাদের গ্রুপ এর বন্ধু , যিনি একদিকে ট্যুর নিয়ে যান, তিনি বাবস্থা করে দিয়েছেন। ধন্যবাদ দীপায়ন দা।


এবার আবার দুপুরের খাবার বিকেলে খাওয়ার পালা। আজকে বেশি ক্ষিদে পায়নি। এবার ও সেই একি মেনু। ডিমের ঝোল আর সবজি সঙ্গে আলুভাজা। সবাই মিলে খেয়ে নিলাম। আমি অতিরিক্ত ডিমের অমলেট খেলাম। এই রুম স্টে তে গিজার আছে।
নন্তে খুশিতে লাফাচ্ছে। কিন্তু মুশকিল কেল্টুদার। প্রায় কারও ফোনে টাওয়ার নেই।







পর্ব - ৮

খাওয়া শেষ হলে বাইরে ঘুরতে বেরলাম। হটাত্‍ উঠে যাওয়া ঘন অরণ্যে ঢাকা পাহাড় টি এক মোহময় বিকেল উপহার দিচ্ছে। জুলুক প্রায় ৩০০০ মিটার বা ১০০০০ ফুট উঁচু। এর আগে আমার এত ওপরে ওঠার অভিজ্ঞতা নেই। এখানে প্রচুর ফৌজী আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। ফৌজী ক্যান্টীন আছে। দারুন ক্ষমতা সম্পন্ন ফৌজী চিকিত্‍সা কেন্দ্র আছে। তাই আপনি বিপদে পড়লেই ফৌজী দের কাছে চলে যান। আমাদের ও যেতে হয়েছিল। সে গল্প পরের পর্বে শোনাবো। স্থানীয মানুষ খুব ভাল। সরল সাধাসিধে।
আমাদের চারপাশে রুখ্য পাহাড়ী আর ভীষণ খাঁড়া রাস্তা। একদম দেখতে না পাওয়া মেয়েদের চুলের ক্লিপ এর মত বাঁক। পরিবহন আইন এর সবকটি নিয়ম মেনে গাড়ি চালানো ছাড়া কোনও উপায় নেই। নন্তে, ফন্টে আর কেল্টুদা বেরিয়ে পরলো। ওরা বেশ খানিকটা ওপরে উঠে গেল। মাসিমা ও চেষ্টা করলেন। আমার আর সোমাদির বোকা খেয়ে, বেশি দূর যেতে পারেন নি। এই রাস্তায় সঠিক নিয়ম না যেনে হাঁটা বিপদজনক। যেকোনো মূহুর্তে ওপর থেকে নামা ফৌজী গাড়ি আপনাকে ধংস করে দিতে পারে। তার সঙ্গে জুরবে নিশ্বাসের অসুবিধে। একটু উঠলেই হাঁপিয়ে যাবেন। বাতাসে অক্সিজেন অনেক কম। সঙ্গে থাকবে সারাদিন পাহাড়ে ওঠার ধকল। আমি একটু উঠে একটি চৌক মত অঞ্চন দেখে দাড়িয়ে পরলাম। আমি আর দিদি। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। লাল আভা ছড়িয়ে আজকের মত বিদায় জানাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে এও জানিয়ে দিচ্ছে যে তোমাদের বেড়ানোর আর একটি দিন শেষ, একটি

দিন শেষ জীবনের খাতা থেকেও। মাসিমা ছুটলেন সূর্য ধরতে। হাতের তালুতে সূর্য পেতে চান। তার জন্য বিপদজনক রাস্তার মাঝ বরাবর দাঁরাতেও তার আপত্তি নেই। অনেক কষ্টে একটু নিরাপদ যায়গায় দাঁরকরিয়ে ছবি তুললাম। কিন্তু আগেই বলেছি, আলো একদম কমে গেলে আমার ক্যামেরা কিছু তুলতে পারে না। এখেত্রে শুধু সূর্য় উঠলেও মাসিমা প্রায় দেখাই যাচ্ছেন না। তপগেয় কে দিয়ে জাবেদ কিন্তু সূর্য ধরে ফেলেছে। তপগেয় ছবি তোলা ভালই জানে। একটি ছোটো ফৌজী বাঙ্কের পাশে জাবেদ উঠে গিয়ে আরও ভাল ছবি তুলে খুব খুশি। ওই অঞ্চল থেকে অল্প বিস্তর কিছু কিছু টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে। ভারত সঞ্চার নিগম এখানে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে হওয়া খেতে চলে যাচ্ছে। আমার মনে হল এখানে প্রযুক্তিগত ভাবেই মোবাইল ফোনের টাওয়ার ধরতে দেওয়া হয় না, নিরাপত্তার খাতিরে। ঘরে মাঝে মধ্যেই বিদ্যুত্‍ থাকছে না। এটাই এখনকার নিয়তি।


নন্তে, ফন্টের পাত্তা নেই। এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। রাস্তা আরও বিপদজনক। পরিমিত আলোর অভাব আছে। কেল্টুদা খানিক বাদে নেমে এল। মন খারাপ। বাড়িতে বা অন্য কোথাও যোগাযোগ বিশেষ হচ্ছে না। প্রসঙ্গত আমার বা কেল্টুদার (দিব্যেন্দু) দুজনেরই বাড়িতে হেড হচ্ছেন আমাদের বাবা। মাঝে মধ্যেই আমাদের এখনকার অবস্থান জানতে না পারলেই বিপদ, মা বউ চিন্তা করবে। সঙ্গে আছে আমাদের দুজনের ই


ছোটো ছোটো মেয়ে। মেয়েদের সঙ্গে কথা না বলতে পারলে মন মানে না। আমি যদিও বলে এসেছি, কয়েকদিন ফোনে হয়ত কথা হবে না। ধরে নিতে হবে আমরা মোবাইল আবিস্কারের আগের যুগে বাস করছি।
বেস কিচ্ছুখন পরে অর্ণব ও শুভজিত (নন্তে ফন্টে) নেমে এল। চিন্তা মুক্ত হলাম। জাবেদ একটি মাইল ফলকের ওপরে চেপে বসে বাবা জাবেদ দেব রূপে কিছু ছবি তুলল। কোনও ছবি ভালো ওঠে নি। পাঠক, তাপমাত্রা কিন্তু হিমাঙ্কের আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এখন বোধয় -৪ বা -৫। একটু আগে একটি ছোটো জলের স্রোত বা পরে থাকা জল যা হয় তো গাড়ি ধোয়ার ফলে সৃষ্টি হয়েছিল, এখন শক্ত হয়ে গেছে। এবার বরফ হয়ে যাবে। আমি সোয়েটার, জ্যাকেট, হাফ হাতা জ্যাকেট সব পরেও শীতে কহিল। "কুক" ও "শীত পাচ্ছে, শীত পাচ্ছে" করতে করতে ঘরে ঢুকে গেলাম। আজকে মাসিমা আর শক লাগার ভয় পাচ্ছেন না। আজকে কম্বল উনি নেবেন। জাবেদ কম্বলটি খুব সুন্দর বিছিয়ে দিয়ে এল। কিন্তু ভোল্টেজ খুব কম। সহজে গরম হচ্ছে না। আমাদের তিনটে রুম। একটায় দিদি ও মাসিমা, একটায় জাবেদ, অমলদা এক খাটে ও আমি এক খাটে, বাকি রূম কেল্টুদা দের।

জাবেদ মোমোর অর্ডার দিয়েছিলো। কিন্তু ফৌজী ভাইরাও যে মোমো এত পছন্দ করেন জানতাম না। ওরা যত বার বানায়, কোনও না কোনও ফৌজী এসে নিয়ে চলে যায়। আমাদের আর মোমো খাওয়া হয় নি। দীপায়ন দা ফোনে যোগাযোগ করে। জাবেদ কথা বলে। ল্যন্ডলাইন। আমার সাথেও কথা বলতে চান। কিন্তু জুতো পরে, জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে আস্তে আস্তে লাইন কেটে যায়।

এই হোম স্টে তে একটি ১৮০ বছরের পুরুনো বাসন আছে। তাতে তিব্বতী চা তৈরি হয়। দীপায়ন দা অনুরোধ করলেও হয়ত সময় অভাবে মোমোর মত তিব্বতী চাও আমাদের খাওয়া হয় নি।

"শীত পাচ্ছে, শীত পাচ্ছে"। ঘর গরম করার যন্ত্র দরকার। ভাড়া প্রতি রাতে ২৫০ টাকা। এই খরচ জাবেদ বহন করবে না। আমি আর অমলদা ঠিক করলাম নেব। সেই মত কম করে ৩-৪ টে যন্ত্র পরিখ্যা করার পর অবশেষে একটি ঠিক ঠাক যন্ত্র ঘরে লাগানো হল। এখন তাপমাত্রা প্রায় -৭। যদি তাপযন্ত্র খানিকটা বাড়াতে পারে।

কিচ্ছুখন গল্প চলল। পরের দিন সকাল ৪ টে উঠে সূর্য ওঠা দেখতে যাব। তাই চটপট ৯ টা নাগাদ রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। সেই একি খাবার। মুরগির ঝোল। এছাড়া খুব একটা কিছু এখানে পাওয়া যায় না।
খেয়ে নিয়ে যে যার ঘরে। মোবাইল ঘড়িতে ভোরে ওঠার ঘণ্টা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাত দুটো, ঘুম ভেঙে গেল। জাবেদএর ট্যাব সশব্দে জানান দিল যে বৌমা ওকে এতখনে যোগাযোগ করতে পেরে খবর পাঠিয়েছে। সদ্য বিবাহিত জাবেদ কিন্তু আমার ডাকেই উঠল। নিজে ওঠে নি। উঠে অনেক বিরক্তির সঙ্গে ট্যাব টি নিয়ে পড়ল। এবার জাবেদ খুশ। আমি আর ঘুমোই নি। তিনটে বাজতেই উঠে পরলাম। মুখ হাত ধুয়ে রেডি হয়ে নিলাম। একে একে সবাই রেডি। ঘড়ির কাঁটা  ৪টে

বাজার আগেই গাড়িতে। গন্তব্য লিংথুম। দুরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার । উচ্চতা প্রায় ১২০০০ ফুট। তখনকার তাপমাত্রা -১৫ ডিগ্রীর আশেপাশে। বাইরে বেরতেই কনকনে ঠান্ডা হওয়া। সমস্থ অঙ্গ জমে গেছে। "শীত পাচ্ছে" বলার মত অবস্থাও নেই। গাড়ি চলতে শুরু করল। বেশ জোরেই চলছে। অন্ধকার। কয়েকটি   মেয়েদের চুলের ক্লিপ এর মত বাঁক পেরিয়ে যেতেই পেজা তুলোর মত বরফ। জীবনে এটা আমার , নন্তের প্রথম বরফ দর্ষন। গাড়ি চলছে। কষ্ঠ ভুলে আনন্দ। এবার "কুক" ফিরে এল।

গাড়ি একটি খোলামেলা অঞ্চলে দাঁড়িয়ে গেল। পাঠক, আমার পায়ের বুড়ো আঙুল ফুলে গেছে। গরম মোজা আছে, তাও। হাতে দস্তানা থাক সত্তেও আঙুল ফুলে যেতে শুরু করেছে। গাড়ি থেকে নেমে পরলাম। ট্রাইপড দিব্যেন্দু নিয়ে গিয়েছিলো। এটা লাগানো তো হল। কিন্তু ক্যামেরা লাগিয়ে দাড়িয়ে থাকা মুশকিল। সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা হওয়া। একটু আলো ফুটতেই বুঝতে পারলাম। আমাদের পূর্বে সূর্য উঠবে, পশ্চিমে মনে ঠিক তার পেছনে লাল কাঞ্চন, আর দক্ষিণ বা দান দিকে বরফে মোরা সাদা পাহাড়। সেই পাহাড় ও একটু পরেই লাল হয়ে যাবে। মানে আমরা এখন স্বর্গে। পায়ের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে তুলোর মত বরফ। একটু আলো ফুটতেই পাসের বরফে ভেজা পাহাড়ে। সামনে লাল দিগন্ত। পেছনে কমলা হতে থাকা কাঞ্চন। কাকে দেখবো? এদিকে ঠান্ডা হওয়া। আঙুল ফুলে গেছে। মসিমা ছুটেছেন বরফে। দিদি গাড়িতে। লাল, আরও লাল হচ্ছে কাঞ্চন।




পর্ব - ৯

লিংথুম এর আকাশে এখন রঙের খেলা। যেদিকে তাকাও হয় বেগুনি নয় লাল নয় নীল। রামধনুর থেকেও উজ্জ্বল । পায়ের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বরফ। ক্রমশ লাল থেকে আরও লাল হতে থাকা কাঞ্চন। সূর্য উঠতে দেরি হচ্ছে। আমরা সবাই ধরেই নিলাম সূর্য উঠবে না। আমরা ছাড়া আর একটি গাড়ি প্রায় আমাদের সঙ্গে এসে পৌঁছেছে। ওই গাড়িতে আছেন সৌমাভো বাবুরা চারজন(সৌমাভো চট্টোরাজ, এই গ্রুপ এ পরে যোগদানকারি সদস্য)। সৌমাভোবাবু ও নন্তের মত বরফে ছুটে বেড়াচ্ছেন। আমি ভারী চেহারার জন্য ছোটাছুটি এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করি। এখনো সৌমাভো বাবুদের সঙ্গে আলাপ হয়নি।

এদিকে যত সূর্য উঠতে দেরি করছে, তত কাঞ্চন সুন্দরী হচ্ছে। যেন চোখের সামনে স্বর্গ নেমে এসেছে। পাঠক, এই সুন্দর ভোর আপনি কারো সাথে তুলনা করতে পারবেন না। এদিকে পাশের পাহাড়ে সদ্যস্নাত তৃণ গুলির ওপরে সাদা তুলোর আস্তরণ। তার ওপরে পড়েছে দিগন্তের লাল বিচ্ছুরণ। যেন এক মুঠো আবির কেউ ছিটিয়ে দিয়েছে।
গোলাপের কিন্তু কাঁটা আছে। পাঠক , প্রায় হিমাঙ্কের ১৫ ডিগ্রী নিচে, কনকনে ঠান্ডা হওয়া, এক্ষেত্রে কাঁটা। আমরা বরফ হাতে নিলাম। নন্তে ফন্টে পাশের পাহাড় চেপে ফিরে এল। মাসিমা ফিরে এসেছেন। যে যেরকম পারছে বরফ নিয়ে ছবি তুলছে। আমরা বরফে হাঁটার জন্য কোনও বুট পরে আসিনি। তবে এই বরফ

ঝুরো সোলার মত। হাতে ধরলে বা গায়ে লাগালে ভিজে যাচ্ছে না। ছোঁড়া ছুঁড়ি করি নি। হাতে নিয়ে পেছনে কাঞ্চন কে সাক্ষী রেখে ছবি তোলা হল।

এবার সূর্য উঠতে শুরু করল। দিগন্তে আভা ছড়িয়ে, কাঞ্চন কে ভুলিয়ে, একদম পরিষ্কার আকাশ সঙ্গে নিয়ে টুপ করে উঠে পড়লেন। এই দৃশ্য ভূ-ভারতে খুব কম দেখা যায়। প্রভু যীশু কে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে, হই হট্টগোল করতে করতে পাহাড়ের মাথায় সূর্য। সৌমাভো বাবুরা ছাড়াও পরে আর এক গাড়ি লোক এসেছিলেন। ব্যস। কোনও ভিড় নেই। সবাই মিলে দাঁড়িয়ে কাঞ্চন কে পেছনে রেখে ছবি তোলা হল।

এবার আবার ঘরে ফিরব। আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে এবার প্রাতঃরাশ করে আবার বেরিয়ে পরবো। সেই মত গাড়িতে উঠতে গেলাম। হটাত্‍ মাসিমা প্রায় খাদের ধারে। বিপদজনক অঞ্চলে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করছেন। সোমাদি ও আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। ৬৫ বছরের মাসিমা এখন ১৫ বছরের । কিন্তু আমার উদ্বেগ শুরু হল। আর এই ক্ষণিকের উদ্বেগেই শুরু শ্বাসকষ্ট। কপ্পুর শুঁকলাম । কোকা - ৬ খেলাম। সব শেষে দিদির আনা অদ্ভুত এক হোমিওপ্যাথি ওষুধ তুলোয় নিয়ে নাকে ধরলাম। ভোজবাজির মত নিঃশ্বাস ঠিক হয়ে গেল।

নিচে নামতে লাগলাম। ৩২ টি মেয়েদের চুলের ক্লিপের মত বাঁক পেরিয়ে উঠেছিলাম। আবার অতও গুলোই টপকে নামবো। মাঝে

থাম্বীতে দাঁড়ালাম । পাঠক এখান থেকে আপনি পুরো সর্পিল রাস্তাটাই দেখতে পাবেন। মনে হবে কোনও ভয়ানক লম্বা সর্প এখানে এঁকে বেঁকে শুয়ে আছে। মাঝে মধ্যে সদ্য জমে থাকা সাদা তুলোর মত বরফ। পাশে যথারীতি কাঞ্চন। এখন কাঞ্চন রেশমের মত মসৃণ ও সাদা। ঠান্ডা একটু কমেছে। মেঘ এখন আমাদের নিচে। দামাল জলরাশির মত একের পর এক শৈল চূড়া অতিক্রম করার দায় তার হাতে। বিমানে যে দৃশ্য দেখে আমরা পুলকিত হই, সে দৃশ্য আমার চোখের সামনে। সে আবার প্রথম সূর্য এর আলোয় স্নাত।

সৌমাভো বাবুরা গাড়িতে কফী বা চা নিয়ে গেছিলেন। আমাদের ভুল হয়েছিল। শুধু ক্যাডবেরী ছাড়া খাবার কিছু নেই। এই জিনিসটি ও শরীরের তাপমাত্রা বাড়ায়। একটু থেকে আবার নামতে থাকলাম। হোটেলে পৌঁছে গেলাম। জলখাবার তৈরি। রান্না অপূর্ব। কিন্তু সেই বড় বড় লুচি। সঙ্গে মটর। এদিকে আমাদের পরিবেশনকারি ভদ্রমহিলার সঙ্গে দিদি ভাব জমিয়ে ফেলেছে। আজকে এখানে থাকবো । তাই ব্যাগ হোটেলেই থাকলো। আমি একটি ছোট ব্যাগে ক্যামেরা, কপ্পুর, একটি ইনহেলর ও কিছু খাবার নিয়ে নিলাম। এবার আমরা যাব gnathang বা নাথঙ্গ পেরিয়ে কুপকূপ হয়ে বাবা মন্দির ও ত্‍সাঙ্গু।
গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি লিংথুম পর্যন্ত একি রাস্তায় যাবে। লিংথুম পেরিয়ে গেলাম। একটু পরেই একটি ছোট টিলা দেখে তপগায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। নন্তেরা ছটফট করছে ছবি তুলবে। জাবেদ এখন ওদের সঙ্গী। উঠে পড়েছে টিলায়। মাসিমার তো কথাই নেই। দিদি ধরে রাখতে পারে না। আমিও উঠলাম।

এই অঞ্চলে এটি সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ। নাম জানা নেই। প্রায় ১৩০০০ ফুট উঁচু। ছোট খাট পর্বত জয় বলাই যায়। বরফ পড়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বরফ। পেছনে অতুলনীয় পরিষ্কার নীল আকাশ। একদিকে আর কোনও শৃঙ্গ নেই। মেঘ অনেক নিচে। অন্যেরা খানিকটা এগিয়ে গেল। আরও ভাল ছবি চাই। তপগয়ের সঙ্গী তার সম্পর্কে শ্যালক উরঘু। বাচ্চা ছেলে কিন্তু দৌড়বিদ। ওপর থেকে গাড়ির মাথায় বরফ ফেলতে থাকলো। বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে নিচে নেমে এলাম। নামার সময় প্রথম নন্তে অমলদা কে বরফ ছুঁড়ল। গায়ে লাগেনি। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পায়ে লাগলো। তবে বেশি বরফ ছোঁড়াছুঁড়ি করা হল না। এখানেই দেখলাম একে একে অনেকগুলো ফৌজী ট্রাক চাকায় চেন লাগিয়ে চলে গেল। হাত নাড়িয়ে টা টা করলাম। প্রত্যুত্তর ও পেলাম। এই উচ্চতায় দেশ রক্ষা করতে যাওয়া সৈনিক দের আমার ও গ্রুপ এর তরফ থেকে কুর্নিশ।

এবার লক্ষ্য বাবা মন্দির। গাড়ি চলতে শুরু করল। বাবা মন্দির প্রায় ৪০০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। তবে এখন ঠান্ডা কমে গেছে। পায়ের পাতায় দুটো মোজা পরে নিয়েছি। মাঝে থামবো নাথঙ্গ। পুরো বরফে মোড়া জনপদ। নিচে নামার দরকার নেই। বরফে ঢাকা। তাই নামার চেষ্টা করেও লাভ নেই। একটু কফি খেলাম। চমরিগাই এর দুধে তৈরি কিনা জানতে উত্তর পেলাম, চমরিগাই এখন , এই সময় দুধ দেয় না। এটি প্যাকেট জাত দুধ। কফি খেয়ে আবার গাড়ি। এবার রাস্তার দুই দিকে বরফ সাদা চাদর। রাস্তায় বরফ কেটে দেওয়া



হয়েছে। গাড়ি চলাচল করতে পারছে। আকাশ পরিষ্কার থাকায় নতুন করে বরফ না পরায় এই রাস্তা চলাচলের উপযুক্ত। মাঝে হটাত্‍ অমলদার শ্বাসকষ্ট শুরু। কপ্পুর দিতেও কমছে না।




পর্ব -১০

আমি ইনহেলার রেডি করেছি। দিদি আবার সেই তুলোয় ভেজানো ওষুধ দিয়ে দিল। নাকে লাগিয়ে নিঃশ্বাস নিলেন। কিছুক্ষণ পরেই ঠিক হয়ে গেলেন। দুপাশে বরফের পাহাড় নিয়ে চলেছি। পথে দেখতে পাচ্ছি একের পর এক জলাশয় পুরো বা অর্ধেক জমে গেছে। পাকদন্ডী পথে বনবন করে পাক খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম বাবা মন্দির। মেজর হরভজন সিংহ এখানে দেবতার আকারে পূজিত হন। এই সন্ত হরভজন সিংহ কে নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। হরভজন সিংহ বর্তমান পাকিস্তান এর পাঞ্জাব প্রদেশে সদরানা মতান্তরে ভারতীয় পাঞ্জাবের ভট্টে বাহিনী গ্রামে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৫৫ সালে ডি এ ভি স্কুল , পত্তি থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করে ১৯৫৬ সালে ভারতীয় সেনবাহিনী তে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে এই সেনানীর বীরত্বে তিনি মেজর পদ মর্যাদা প্রাপ্ত করেন।

১৪৫০০ ফুট উঁচু নাথুলাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেনবাহিনীর নথি অনুসারে ইন্দো-চীনা যুদ্ধে ইনি বীরের মৃত্যু বরণ করেন। এই বীরকে ভারতীয় সরকার মহাবীর চক্র পদক দিয়ে সন্মানিত করে। কিন্তু লোকশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৬৮ সালের ভয়ানক বন্যায় সিকিম সহ উত্তর বঙ্গ নাজেহাল। সাধারণ মানুষের উদ্ধারে দিন রাত কাজ করে চলেছে সেনা। একদল খচ্চরের পিঠে খাবার নিয়ে যাওয়ার দায় ছিল মেজরের ওপরে। বিপদসংকুল দংগুছুই এর দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে তীব্র বেগে বয়ে চলা বরফ গলা জলে সৃষ্ট নালায়

পড়ে যান। ২ কিলোমিটার বয়ে চলে যান। প্রাথমিক ভাবে খুঁজে না পাওয়া গেলেও, তিন দিন পরে এক সহযোদ্ধা স্বপ্নে জানতে পারেন তিনি কোথায় আছেন। তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

এর পরে থেকে যেকোনো বিপদে সেনাবাহিনীকে মেজরের আত্মা সাহায্য করে চলেছেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী এখনো সীমান্তে কোনও সৈনিক কর্তব্য পালনে অপারগ হলে বাবা তাকে ধমক দেন এমনকি থাপ্পড় মারতেও শোনা যায়। ঘোড়ায় চড়ে এখনো সীমান্ত পাহারায় অটল। চীনা ফৌজও মেজরের উপস্থিতি শিকার করেছে। সীমান্তের যেকোনো আলোচনায় চীনা ফৌজ একটি আসন মেজর হরভজন সিংহের জন্য রেখে দেয়। এখনো তিনি ভারতীয় ফৌজের সন্মান পান বলেই শুনলাম। প্রত্যেক বছর ১১ সেপ্টেম্বর নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে মেজরের জামা কাপড় নিয়ে এক ফৌজী পৌঁছে যান। ওনার গ্রামের দিকে যাওয়া একটি ট্রেনে একটি সিট বাবার জন বরাদ্দ ।

বাবা মন্দিরে আমরাও গেলাম। বাবা একদম যে বাঙ্কার থেকে যুদ্ধ করতেন সেখানে উঠতে গেলে ৫০ টি সিঁড়ি টপকাতে হবে। এত উঁচু ও কম অক্সিজেন বহুল অঞ্চলে আমার পক্ষে ওঠা সম্ভব নয়। আমি , সোমাদি ও মাসিমা নিচে থাকলাম। বাকিরা উঠে দেখে এল। এখনো ওখানে বাবার ব্যবহার করা জিনিস পত্র রাখা আছে। পাশেই মন্দির। বাবার ছবি এখানে মূর্তি। সামনে দাঁড়ানো ফৌজী সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেই


আপনাকে হাতে প্রসাদ দিয়ে দেবে। কপালে চন্দন। এখানে প্রসাদ নকুলদানা ও কিসমিস। বাবা কে স্যালুট জানালাম। নাথুলার দিকে যাওয়া সব সৈনিক এখানে একবার দাঁড়াবেই। প্রণাম করবে। সে যে ধর্মের হোক না কেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফৌজী ভাইদের সঙ্গে আলাপ জমাতে গেলাম। চেহারা সুঠাম, লম্বা, দেখলেই ভয় করবে। শেষ পর্যন্ত এক উধমপুর থেকে আসা সেননীর সঙ্গে পরিচয় হল। নাম গোপন রাখবো। অনেক কথা হলো। কী কষ্টে এঁরা জীবনযাপন করে, শুধু মাত্র আমাদের ভাল রাখার জন্য।

বরফ পাওয়ার পর থেকে নন্তে খুব খুশি। বাবার আশ্রয়স্থলে ঘুরে এল। তপগায় ডাকছে, যেতে হবে। এখনো অনেক দূর যাব। দিদি চললো চা খেতে। ফৌজীভাইরা এখানে চায়ের ব্যবস্থা করেছেন। বিনা খরচে, সুস্বাদু। খেয়ে নিল। আবার গাড়ি চলতে শুরু করল। গন্তব্য হাতী লেক।
ঠান্ডা বেড়ে চলেছে।





 পর্ব -১১

হাতী লেক, হাতী ঝিল, যাই বলুন, এরপরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক অপরূপ সুন্দর পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট ঝিল। এই ঝিলটি এপ্রিল মাসের পরে ফুলে ফুলে ভরে যায় শুনলাম। অন্য সময় পাহাড়ে ঘেরা এই জলাশয়ে অবর্ণনীয় দূষণ মুক্ত নীল আকাশের ছায়া পরে নীল হয়ে থাকে। জল একদম টলটলে। সিকিমের আদিবাসীদের কাছে এটি একটি অতি পবিত্র স্থান। ঝিলটি হাতী আকৃতির। একটু ওপর থেকে দেখলে বোঝা যাবে । তবে দুপাশে বরফের পাহাড় নিয়ে , রাস্তার মাঝে বরফ নিয়ে আমরা যখন পৌঁছালাম তখন অনেকটাই জমে গেছে। তবুও অবশিষ্টাংশে ছোট হাতির চেহারা বজায় আছে। বাবা মন্দির থেকে একটু এগলেই কুপকূপ এর বিতান চো অঞ্চলে মাটি থেকে প্রায় ১৩৬০০ ফুট ওপরে এই হাতী লেকের অবস্থান। পৃথিবীর উঁচু ঝিল গুলির মধ্যে এটি অন্যতম। এর আশেপাশে জেলাপলা পাস (ভারত চীন সীমান্ত) ও একটি ১৮ হোলের গল্ফ ময়দান আছে। স্বাভাবিক ভাবে এটিও পৃথিবীর উচ্চতম গল্ফ ময়দান গুলির মধ্যে একটি।

গাড়ি থেকে নামতে গেলে বরফে নামতে হয়। এই বরফে জুতো ভিজবে না। নেমে ছবি তুললাম। অমলদা নিচে নেমেছিলেন। আমি দেখলাম ওপর থেকেই দেখা ভাল। একটু পরে উঠে পড়লাম গাড়িতে। এবার আমরা যাব নতুন বাবা মন্দির হয়ে ত্‍শাঙ্গু। মাঝে


চীন যাবার রাস্তা দেখতে পাব। নাথুলা যাবার অনুমতি পাইনি। চীন ফৌজের সঙ্গে দেখা হবে না।

রাস্তায় দেখলাম আর একটি ঝিল। এটি পুরো জমে গেছে। একটু এগিয়ে আইস হকি ময়দান। নামলাম না। গাড়ি থেকেই বরফের সাদা চাদর ঢাকা হকি ময়দান দেখলাম। প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি উচ্চতম ময়দান। সবাই ক্লান্ত। শেষ শক্তি জমিয়ে রাখছি ত্‍শাঙ্গু লেকের জন্য। এক নিরিবিলি স্থানে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। দুটো পাহাড়ের মাঝে মেমেঞ্চ লেক উঁকি দিচ্ছে। এই মেমেঞ্চ লেক জলঢাকা নদীর উত্‍সস্থল বলে জানি।

দেখতে দেখতে নতুন বাবা মন্দির। পাঠক , হয়তো ভাবছেন কত বাবা মন্দির। এই তো আগের পর্ব জুড়ে বাবা হরভজন সিংহের কথা পড়লাম। একটু পরিষ্কার করে বলি। এই মন্দিরটিও বাবা হরভজন সিংহকে পুজো করার জন্যই তৈরি। ফৌজী যাতায়াত বেশীরভাগ ক্ষেত্রে গোপনীয় ও মাঝে মাঝেই পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তিত পথে সেনা যাতায়াত করলে আসল বাবা মন্দির অনেক ক্ষেত্রে যাওয়া সময় সাপেক্ষে হয়ে যায়। যাতে সৈনিক বাবার আশীর্বাদ থেকে কেউ বঞ্চিত না হয় তাই বাবা মন্দিরের একদম হুবহু একটি মন্দির এখানে নির্মিত হয়। আপনি গ্যাংটক থেকে ত্‍শাঙ্গু এলে আপনার রাস্তায় প্রথমে নতুন বাবা মন্দির পরবে।
নতুন বাবা মন্দির ছাড়িয়ে চললাম ত্‍শাঙ্গু লেক। রাস্তা খুব খারাপ। সামনের সিট আঁকড়ে থাকা জাবেদ ড্রাইভার সাহেবের ঘাড়েই প্রায় শুয়ে পরে আর কী। আমি দুবার সোজা করে দিলাম। নাক

ডাকিয়ে সারা রাত ঘুমিয়ে, পেটে ক্ষিদে নিয়ে, আশেপাশে এত সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে একটি মানুষ এত কী করে ঘুমোয় কে জানে। রাস্তার দুপাশে প্রচুর বরফ। লোকজন বরফ নিয়ে খেলছে। আমরা চলেছি অভিযানে। আস্তে আস্তে ত্‍শাঙ্গু আমাদের সামনে দৃশ্যমান। এটি সিক্কিম এর অতি পবিত্র লেক। বরফ গলা জলে সৃষ্ট। জল খুব ঠান্ডা। এখনো জমেনি। উচ্চতা ১২৪০০ ফুট। এই লেকটি বিদেশীরাও যেতে পারে। তবে একসঙ্গে দুজন যেতে হবে। বিশেষ অনুমতি লাগবে। রাখী পূর্ণিমার দিন সিকিম আদিবাসীদের "ঝকরি" বলে একটি উত্‍সব হয়। এই লেকে এসে সবাই প্রার্থনা করেন।

আপনি এখানে চমরীগাই এর পিঠে চড়তে পারবেন। আমি একটি চমরীগাই এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। নন্তে , ফন্টে "কুক" করতে করতে ঘুরতে থাকলো। প্রায় দুই দিকে পাহাড়। বেশীরভাগ বরফের ছিটে নিয়ে দাঁড়িয়ে। অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। ছবি তুলতে থাকলাম। জাবেদ গাড়িতে ঘুমাবার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সুন্দর দৃশ্য দেখে নেমে এল। এই প্রথম সিকিমে নোংরা অঞ্চল দেখলাম। লেকের ধারে যথেষ্ট আবর্জনা।

এবার ক্ষিদে পেল। প্রায় দুটো বাজে। অনেক খুঁজেও খাবারের দোকান নেই।






পর্ব -১২

    ত্‍শাঙ্গু লেক নাকি তিস্তা নদীর উত্‍স। এটি তপগায় আমাকে বলেছিল। যদিও এর সমর্থনে কোনও তথ্য পেলাম না। ঝকরি উত্‍সব নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। "ঝকরি" আসলে নেপালী শব্দ। যার মানে ওঝা। ভৌতিক বিদ্যা চর্চা করেন এমন মানুষ। গুরুঙ্গ, তামাঙ্গ, শেরপা, লিমবু প্রভৃতি জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে এই বিদ্যার চল খুব বেশি। সিকিমে এই ঝকরি উত্‍সব হ্য়। দলে দলে ওঝা রাখী পূর্ণিমার দিন তন্ত্র বিদ্যা বা ঝকরি পালন করতে ত্‍শাঙ্গু লেক এ উপস্থিত হন। যেহেতু আমরা ওই সময় যাইনি, তাই বিস্তারিত জানাতে পারলাম না। পাঠক, আপনি চাইলে যেতে পারেন। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম। এবার সোজা হোটেল ফিরতে হবে। চেষ্টা করব রাস্তায় কুপকূপে কিছু খাবার খেতে। জাবেদকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সামনের সীট থেকে নামিয়ে দেওয়া হল। তপগায় ওকে পেছনে বসতে অনুরোধ করে। আমি সরাসরি ওকে ধরে পেছনে বসিয়ে দিলাম। শরীরের আয়তন অনুযায়ী নন্তে ফন্টে সামনের সীট এ। গাড়ির একটি যন্ত্রাংশ খারাপ থাকায় আমি বরাবর মাঝের সীট ও বাম দিকে একদম ফিক্সড। ফেরার পথে সবাই একটু ঝিমন্ত। নন্তে, ফন্টে জাগ্রত। গাড়ি চলতে শুরু করল। গন্তব্য জুলুকের হোম স্টে। মাঝে মাঝে ফৌজী ভাইরা গাড়ি দাঁড় করিয়ে কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞাসা করছিলেন। সাধারণত লোকে গ্যাংটক চলে যায়। কিন্তু আমরা জুলুক ফিরছি। পাশের পাহাড়ে মেঘ যেন সমুদ্র। আমাদের নিচে। আবার সেই বিমান থেকে দেখতে পাওয়া দৃশ্যের মত সুন্দর প্রকৃতি আমাদের চোখের সামনে। বিকেল

হয়ে আসছে। এখন পড়ন্ত সূর্য। আরও মোহময়। যত নিচে নামছি, দেখতে পাচ্ছি,আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করেছে। মেঘ আসছে। আমাদের ঠিক ওপরের পাহাড়ে তুষারপাত হচ্ছে। আমরা তখন নিচে। লাল আলোয় ভরে থাকা অঞ্চল সাদা হয়ে যাচ্ছে। আমরা নিচে নেমে যাওয়াতে তুষারপাতের মধ্যে পরিনি। দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য যাই বলুন, আমরা কিন্তু সর্বদা পরিষ্কার অবহাওয়া পেয়েছি। এদিকে জোর ক্ষিদে পেয়ে গেছে। দিদির চকোলেট শেষ। পেটে খিল দিয়ে চলেছি। এবার শুরু সেই পৃথিবী বিখ্যাত বাঁক। ৩২ থেকে ৩৩ টি। প্রায় ২৪ কিলোমিটার জুড়ে। তপগায় ক্ষিদের চোটে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। একটু ভয় করছে। মাঝে মাঝে সূর্য এমন রশ্মি ফেলছেন যে সামনের কাঁচে প্রতিফলিত হয়ে দৃশ্যমান শূন্য করে দিচ্ছে। সেই সময় গাড়ি আস্তে চলতে থাকে। দেখতে দেখতে জুলুক। আকাশ এখন মেঘলা । গাড়ি থামিয়ে সোজা হোটেলের খাবার টেবিল। আমরা নয় , তপগায় ও তার আত্মীয় উরঘু। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা হলেও আপনাকে স্নান করতে হবে। নাহলে শরীর খারাপ করতে পারে। আমি সকালেই গরম জলে করে গেছি। এখন একটু হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। আবার সেই দুপুরের খাবার বিকেলে। প্রায় সমমানের ও সেই ডিমের ঝোলের তরকারি। তবে সুস্বাদু।

    আজকে রাতে জাবেদ প্রভু যীশুর জন্মদিন উপলক্ষে কেক খাওয়াল। আমি ও সকলে মিলে গ্রুপের জামা টাঙ্গিয়ে কেক কাটলাম। সবাই পেট ভর্তি করে কেক খেল। বেশ হুল্লোড় হল। মাঝে একবার সেই রাতেই, হিমাঙ্কের ৪/৫ ডিগ্রী নিচে তাপমাত্রা তেই, দিব্যেন্দু ও জাবেদ একটু ওপরে , যেখানে মোবাইল টাওয়ার

খানিকটা পাওয়া যায় উঠে গেল। ফেসবুকে ছবি দেওয়া হল। আমি একটু বাড়িতে কথা বললাম। আমার ফোনে টাওয়ার নেই। জাবেদ এর ফোন থেকে যোগাযোগ করা গেল। আমাদের সঙ্গে আসা এক গুজরাটি পরিবারের দেখা হল। এনারা পরের দিন আমাদের পথে ভ্রমণ করবে। আমরা সুযোগ বুঝে উপদেশ দিলাম। ওনারা কর্পূর বা কোনও ওষুধ নিয়ে আসনে নি। আমাদের কর্পূর ওনাকে দিয়ে দিলাম। দুর্গাপুর নিবাসী। আমাদের দুর্গাপুর ভ্রমণের নিমন্ত্রণ করলেন।

    দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেল। আজকে শুয়ে পরার পরে আর মনে নেই কী হয়েছিল। একদম পরের দিন সকাল ৭ টা। উঠেই গোছগাছ শুরু। আজকে আমরা যাব আরিতর লেক হয়ে মাঙ্কিম টপ। প্রাতঃরাশ শেষ। গাড়িতে ব্যাগ উঠছে। ফন্টে গেল ঘর ফাঁকা হয়েছে কিনা দেখতে। ফেরার সময় সিঁড়িতে পতন। আবার সেই ফন্টে। এবার আরও ভয়ানক। চশমার কাঁচ ভেঙে হাত কেটে এল। গলগল করে রক্ত। কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। হোটেলের এক ভদ্রমহিলা আমাদের কাছেই আর্মি হসপিটালে নিয়ে গেলেন।





 পর্ব -১৩

আর্মি হসপিটালে ফন্টে (শুভজিত) ও অন্যদের অনেকবার বলতে হলো কী হয়েছে, কেন হয়েছে। গাড়ি তৈরি। কিন্তু আমাদের অপেক্ষা করতে হলো। অল্প কিছুক্ষণ পরে এক মহিলা ডক্টর এলেন। ওষুধ দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে দিলেন। কিছু ওষুধ দিয়ে দিলেন খাবার জন্য। ফৌজী ওষুধ ফৌজীদের মতই শক্ত পোক্ত। রক্ত পরা বন্ধ হয়ে গেল। ভালো করে বেঁধে দিলেন। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। রৌদ্র ঝলমলে দিন। কিন্তু দিনটি মোটেই আমাদের জন্য ভালো নয়। দিব্যেন্দু বা কেল্টুদার বাড়িতে বিপদ। খবর এলো। কিন্তু এই মূহুর্তে সোজা শিলিগুড়ি নামাও অসম্ভবসবথেকে বড় বিপদ এই ভীড় ট্রেনে আগে থেকে টিকিট না কনফার্ম থাকলে ফেরাও ঝক্কি পূর্ণ। তাই আপাতত আমাদের সঙ্গে থাকাই মনস্থির করল। আজকে ২৬ ডিসেম্বর। আমরা আজকে আরিতর লেক হয়ে মাঙ্কিম টপ বলে একটি অংশে থাকবো।

জুলুকের হোটেলের কম বয়সি একটি ছেলে কাজ করে। সকাল থেকেই সেও দেখছি "কুক" "কুক" করে আমাদের ডাকছে। গাড়ি চালু হওয়ার আগে অতিরিক্ত খরচের বয়ান নিয়ে এলো। আমাদের ঘরের ঘর গরম করার যন্ত্রটি ২৫০ টাকা নিলো। বাদ বাকি কিছু গরম জল, অতিরিক্ত খাবার, কফী ইত্যাদি বাবদ প্রত্তেকের ভাগে ৬৫ টাকা করে পরলো। জাবেদ পুরো টাকা দিয়ে দিলেও, সবার কাছে ৬৫ টাকা করে চাইতে লাগলো। নতুন নামকরণ হলো, জাবেদের,

মিস্টার ৬৫। এই নাম টি জাবেদের পছন্দ না হলেও এখনো ৬৫ এর তকমা ঝেড়ে ফেলতে পারে নি।
ফৌজী ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে ফন্টে ও সবাই গাড়িতে উঠল। স্নো লাইয়নের সকলকে টা টা করে আমরা নামতে লাগলাম। আমি সবাইকে বলব, জুলুক থাকতে হলে এই বাড়িতেই থাকুন। এনাদের ব্যবহার যেমন ভালো, তেমন অতিথি বত্‍শল।

যাই হোক, যত নিচে নামছি তত গরম লাগছে। প্রায় ৪০ ঘণ্টা হিমাঙ্কের এত নিচে কাটানোর ফলে শরীরে শীত সহ্য করার ক্ষমতা বেড়ে যাওয়াতে এবার গরম লাগতে লাগলো। দিব্যেন্দুর মন খারাপ। মাঝে মধ্যে আমার বা জাবেদ এর ফোনের টাওয়ার আসতেই বাড়িতে ফোনে করছে। দেখতে দেখতে আবার রঙ্গিত নদীর দেখা পেয়ে গেলাম। রঙ্গলি চলে এলাম। এখানে আবার কিছুক্ষণ দাঁড়াবো। তপগায় চলে গেল প্রয়োজনীয় কাজ করতে। আমি প্রথমে গেলাম সেই দোকানে যেখানে জাকেট কিনেছিলাম। উদ্দেশ্য বিক্রি। কিন্তু ও কিনতে চাইল না। অগত্যা আমাকে এটাকে বয়ে বেড়াতে হবে। মেয়ের জন্য একটি মোট কাপড়ের জামা কিনলাম। বেশ সস্তায়। এদিকে আজকে রাতে আমাদের মাংস পুড়িয়ে খাবার কথা। গণগনে আগুনে ঝলসে নিয়ে আদিম মানব হয়ে যাব। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো জুলুকে। কিন্তু এই ক্যাম্প ফায়ারটি মাঙ্কিমে করব ঠিক করলাম। দিব্যেন্দু জানিয়ে দিল তার আপত্তি নেই। মিস্টার ৬৫ , নন্তে চলে গেল মুরগি ও প্রয়োজনীয় জিনিস জোগাড় করতে। আমি, অমলদা, দিদি একটি দোকানে ঢুকে কফি খেলাম। যাবার দিনের দোকানি আমাদের ধুম্রপান করতে


অনুমতি না দিলেও, এই দোকানি আমাদের অনুরোধ মেনে নিল। একটু আড়াল করে আমি ও অমলদা ধুম্রপান করলাম।
ইতিমধ্যে জাবেদ ও নন্তে মুরগি তৈরি করে এনেছে। মালপত্র তৈরি। তপগায় এসে গেছে। গাড়ি চলতে শুরু করল। খানিকটা নেমেই আবার উঠা। আবার ঠান্ডা বাড়তে থাকা। মানে, সেই খুলে রাখা সোয়েটার আবার গায়ে। মাসিমা একদম সুস্থ। অন্তত মনের দিক থেকে। জাবেদের পরবর্তি ভ্রমণে যাবার ইচ্ছা খুব। ইলেকট্রিক কম্বলের খাতিরে, ৬৫ এখন মাসিমার প্রথম পছন্দের ট্যুর অপারেটর। যদিও দু'কাপ কফি খেয়ে ১৩০ টাকা দিতে হওয়াতে দিদি খুব একটা খুশি নয়।

দেখতে দেখতে আরিতর লেক পৌঁছে গেলাম। কিন্তু যথেষ্ট দুপুর হয়ে যাওয়াতে আমরা ঠিক করি পরের দিন সকালে আসব। এই বেলাতে তেমন কিছু ভালো দেখা যাবে না। সেই মত পার্কিং-এর জন্য ২০ টাকা দিয়ে আমরা মাঙ্কিমের দিকে চলতে লাগলাম। এবার রাস্তা মূলত হাঁটার জন্য। খুবই বাজে। যদিও এর থেকেও বাজে রাস্তায় পরে যেতে হয়েছিল। সে গল্প পরে। শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম মাঙ্কিম। এই অঞ্চলটি আরিতার লেকের ঠিক ওপরে। এখানে হোম স্টে গুলোতে যেতে গেলে পাহাড় চড়তেই হবে। হোটেলের দরজা অবধি গাড়ি যাবে না। প্রথমে একটি হোম স্টের সামনে গাড়ি দাঁড়ালেও , আসলে এখানেই থাকার কথা হলেও আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হলো। পাঠিয়ে দেওয়া হলো অন্য ঘরে। একটু হেঁটে প্রায় ১০০ ফুট চড়াই টপকে হোটেলে ঢুকতে হলো। তবে মালপত্র কিছু হোটেলের লোকজন বয়ে নিয়ে


গেল। এক দুবার দাঁড়িয়ে উঠে পরলাম। এখানে নিঃশ্বাসে কষ্ট হবে না।
সবুজ ঘেরা সিকিম এখন আমাদের চোখের সামনে। অদ্ভুত নীল আকাশ। কিন্তু প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছে। খেতে হবে। চটপট স্নান করে নিলাম। কিন্তু খাবার তৈরি নেই। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমাদের জন্য তৈরি ছিলেন না এনারা। সেই আবার ৪ টে?




  পর্ব - ১৪

মাঙ্কিম টপ আমার মনে হল ভ্রমণ সংস্থা গুলোর প্রদত্ত নাম। খেসেলাখা গ্রামের "মাঙ্কিম", যা নেপালী "রাই" জনজাতির আরাধ্য দেবতার মন্দির, এই অঞ্চলে অবস্থিত। দুপুরের খাবার প্রায় বিকেল ৪ টের আশেপাশে করলাম। এর আগে একটি বড় গামলায় সব মাংস ঢেলে মশলা মাখানো হলো। একটু বিশ্রাম নিয়ে চললাম "মাঙ্কিম" দেখতে। মন্দিরটি ছোট কিন্তু পরিষ্কার। দেখে মনে হলো শিব ঠাকুর। বেশ কয়েকটি সিঁড়ি টপকে উঠতে হয়। মানে আবার সেই অসম পাহাড়ী রাস্তায় ট্রেক বা হাঁটুন। দেখতে দেখতে সূর্য ডুবে গেল। সেই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করলাম। মন্দিরে খানিকটা যায়গা বানানোই হয়েছে সূর্যাস্ত ও আরিতার লেক দর্শন উপলক্ষে। ওপর থেকে এই বুট বা মোজা আকৃতির হ্রদটি দেখলে মন ভরে যাবে। সঙ্গে উপরি পাওনা উত্তর দিকে হেলিকপ্টার নামার স্থানটি।

চারপাশে ঘন অরণ্য। পাইন জাতীয় লম্বা লম্বা পাহাড়ী গাছ। অঞ্চলটি আসলে জীবজন্তুদের মুক্তাঞ্চল। যদিও আমরা কিছু দেখিনি তবে কাছেই হাতী বা ভল্লুক, নিদেন পক্ষে চিতা বাঘের উপস্থিতি একেবারেই অসম্ভব নয়। এর মধ্যে আবার দিব্যেন্দু বা কেল্টুদা গত রাতে নিতান্তই নিরীহ কুকুর কে চিতা ভেবে জুলুকে যথেষ্ট ভয় পেয়েছে। তাই দেরি না করে সন্ধ্যে নামতেই ঘরে ফিরে এলাম। জাবেদ ক্যাম্প ফায়ার করার জন্য প্রয়োজনীয়ও কাঠের দরদাম করতেই আমরা আঁতকে উঠলাম। দুই ঘণ্টা ক্যাম্প ফায়ার করতে প্রয়োজনীয় কাঠের দাম চাইল ৮০০ টাকা। এমনিতেই আমাদের

স্থান, হোটেল কোনওটাই ভাল লাগেনি। তার সঙ্গে যুক্ত হলো মালিকের ছেলের ব্যবহার। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে থাক। তপগায় বুদ্ধি দিল কালকে ফেরার পথে একটু আগে বেরিয়ে ঋষিখোলা তে রঙ্গিত নদীর পারে আগুন জালাব। কাঠের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যথেষ্ট ঠান্ডা। তাই মাংস নষ্ট হবে না।

যথারীতি আড্ডা বসল। ফন্টে একটু মুসরে পড়েছে। ঠান্ডা ওর ব্যথা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। রক্ত পড়ছে না। চশমা না থাকায় যদিও ওর খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু কড়া ব্যথার ওষুধ পরতে শরীর একটু ক্লান্ত। হোটেলের ৩ তলায় আমাদের ৩ টে ঘর। সামনে ছাদ। ছাদে বসে আড্ডা চলতে থাকলো। শুধু মাসিমা ব্যাটারি চার্জ দিচ্ছেন। মানে ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। ঠান্ডা ভালই। হিমাঙ্কের কাছাকাছি। চোখের সামনে টুনি জ্বলছে। পাহাড়ের খাঁজে তৈরি বাড়ি গুলো থেকে সেই আলোর উত্‍স। রাতের খাবার ঠিক সময় চলে এল। দল বেঁধে খেয়ে নিলাম। শুতে যাবার আগে ঠিক করলাম আজকে সব ছেলেরা এক সঙ্গে থাকবো। সেই মত কেল্টুদা ও নন্তে সবার অজান্তে একটি ঘরের খাট ধরাধরি করে অন্য ঘরে নিয়ে এল। ঘর গুলো বেশ বড়। আজকে রাতে মিস্টার ৬৫ থাকছে নন্তের সঙ্গে। অন্য খাতে অমলদা, ফন্টে, দিব্যেন্দু। দিব্যেন্দু বেশ সুন্দর ভাবে কম্বলটি একটি ছোট তাঁবুর মত বানিয়ে মোবাইল নিয়ে শুয়ে পরলো। মাঝ রাত, তখন বোধ হয় ২ টো। হটাত্‍ অমলদা চিত্কার "পরে গেলাম, পরে গেলাম"। উঠে বসলাম। না খাট থেকে কেউ পরে যায়নি। আমি শুয়ে পরলাম। খানিক বাদে আবার একই রকম চিত্কার। এবার ও উঠে বসে ভালো করে খেয়াল


করে দেখলাম অমলদা ঘুমের মধ্যে পরে যাচ্ছেন। ১৪০০০ ফুট ওপর থেকে কেউ অমলদাকে ধাক্কা দিয়েছিলো কিনা সেটা অমলদার স্বপ্নই এক মাত্র বলতে পারে।

ভালোয় ভালোয় ভোর হয়ে গেল। সকালের কাঞ্চন অল্প দৃশ্যমান। তবে গাঢ় নীল আকাশ সঙ্গে অদ্ভুত সুন্দর ফুলের বাগান আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। হাত মুখ ধুয়ে প্রাতঃরাশ সারলাম। আজকের মেনু ম্যাগী। কিছুটা হলেও আলাদা। ব্যাগ নামানো হতে লাগলো। আবার প্রায় ১০০ ফুট উতরাই টোপকে নিচে নেমে এলাম। গাড়ি রওনা হলো লামপকরির হ্রদ বা আরিতার হ্রদ এর দিকে।




পর্ব - ১৫

ইতিমধ্যে সকালে একটি বিপদ ঘটেছে। একটি পাহাড়ী জঙ্গলী বোলতা , সোমাদি কে খুব পছন্দ হয়ে যাওয়াতে, একদম সোজা হাঁটুতে কামড়ে দিয়েছে। জঙ্গলী বোলতা, বেশ বিষাক্ত। সেই যন্ত্রণা নিয়েই দিদিকে গাড়িতে উঠতে হলো। গাড়ি মালপত্র বোঝাই করে আবার নামতে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরিতার বা লেমপকরির হ্রদ। মাঙ্কিম থেকে হেঁটে আরিতার নামা যায়। জঙ্গলের মধ্যে সেই ট্রেক এক অদ্ভুত অনুভূতি। হ্রদটি মোজা বা বুট আকৃতির আগেই বলেছি। চারদিক দিয়ে ঘেরা ও প্রদক্ষিণ করার জন্য রাস্তা আছে। তাড়া থাকলেও আমরা ঠিক করলাম প্রদক্ষিণ করব। যে যার মত। সেই মত আমিও ঘুরতে লাগলাম। হ্রদের পাশেই একটি মন্দির আছে। লেখা আছে "গুরু ঋণপচে ক্ষতিক পোখড়ি"। সঠিক উচ্চারণ না করতে পারার জন্য দুঃখিত। ঘুরতে ঘুরতে মিস্টার 65 ও নন্তে , ফন্টে "কুক" করছে। ঘন জঙ্গলে তার প্রতিধ্বনি হচ্ছে। ভাল লাগলো। শুনলাম প্রতি বছর এখানে মার্চ-এপ্রিল মাসে লামপখড়ি উত্‍সব হয়। পাঠক, একবার ঘুরে যেতে পারেন। আবার একসঙ্গে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে ছবি তুললাম। গাড়িতে উঠে পড়লাম। মুরগির মাংস ডাকছে। সঙ্গে ঋষি। অনেক কিছু দেখা বাকি। যেমন বৌদ্ধ গুম্ফা, জলপ্রপাত। আমাদের অজানা থাকায় পরের বারের জন্য ফেলে আস্তে হল।
ফেরার সময় আবার একটি স্থানীয হোমস্টে থেকে চা খাবার নিমন্ত্রণ পেলাম। শ্রদ্ধা হোম স্টে। এক কথায় দারুণ। আরিতর

হ্রদের কাছেই। এই ঘরে প্রথম টেলিভিশন দেখলাম। এখানেই পরিচয় হলো সৌমাভ বাবুর সঙ্গে। ভ্রমণ পাগল এই মানুষটি প্রচুর কাজের মধ্যে সময় পেলেই বেরিয়ে পড়েন। আমাদের উনি লিংটামে দেখেছেন। খানিকক্ষণ গল্প হলো। উনি বর্তমানে আমাদের গ্রুপের সদস্য।

এর মধ্যে অমলদা নন্তেকে নিজের ভাই পাতিয়েছে। উদ্দেশ্য কিছু কাজ করিয়ে নেওয়া। ফন্টে আজকে সুস্থ। হাতে ব্যথা অনেক কমে গেছে। ছবি তুলতে তুলতে ঋষিখোলা পৌঁছে গেলাম। পাঠক, ঋষিখোলা যেতে গেলে কিন্তু ৬০০ ফুট ট্রেক করতে হবে। গাড়িতে মালপত্র রেখে পাহাড়ী রাস্তায় নামতে লাগলাম। আগুন ধড়ানোর জন্য কেরোসিন নেওয়া হল। আমাদের উদ্দেশ্য নিচে নেমে মাংস পুড়িয়ে খাব। "হালাল" করা মাংস। প্রসঙ্গত , সারা রাস্তা, প্রথম দিন থেকে জাবেদ মুরগি খায়নি। মুসলিম ধর্মীয় মতে, ভীষণ ভাবে হিন্দু বা বৌদ্ধ প্রধান সিকিমে মাংস প্রস্তুত করাও প্রায় অসম্ভব। জাবেদ অনেক কষ্টে নিজেই ব্যবস্থা করে। আমাদের কোনও আপত্তি ছিল না। স্বাদ তো একই।
ঋষিখোলা তে নামার সময় লক্ষ্য করি দিদির হালকা জ্বর এসেছে। কিন্তু সেই সব পাত্তা না দিয়ে দিদিও নেমে গেল। যেমন মা তেমন ছা। একটি বাঁশের সাঁকো পেরতে হল। নদীর পারে এখন আমরা। একটু ওপরেই জঙ্গল। অপূর্ব রূপের ডালি নিয়ে রঙ্গিত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। পাথুরে অঞ্চল। পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে নেমে চলছে। আহা কী আনন্দ। জাবেদ, তপগেয় , নন্তে চলে গেল জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে । একটু


পরেই গোছা গোছা পরে থাকা কাঠ নিয়ে এল। কোনও রকম জঙ্গল নষ্ট না করেই। দুটি পাথর একসঙ্গে করে রাখা হল। ওপরে মাংস দেওয়া হল লোহার রডে গুজে। এর পর আগুন ধরিয়ে খাওয়া শুরু হলো।
প্রথম কয়েকটি ধাপে মাংস একটু কাঁচা ছিলো। কিন্তু সুস্বাদু। নন্তে, দিদি, ৬৫ ও তপগায় রাঁধুনির কাজ করতে লাগলো। আবার গ্রুপের জামা পরিয়ে ছবি তোলা হলো। উরঘু নদীতে নেমে গেল। কয়েকদিন পর স্নান করছে। যদিও ওর ইচ্ছা ছিলো শিলিগুড়ি নেমে স্নান করা।
অমলদা ও ফন্টে মাঝে হটাত্‍ উধাও। ডাকাডাকি করার বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবুরা এলেন। ওরা একটু এগিয়ে স্থানীয় কিছু হোম স্টে দেখে এসেছেন। আমার উপদেশ হলো আপনি এই রাস্তায় গেলে অন্তত একদিন এখানে থাকুন। রঙ্গিত নদীকে উপভোগ করুন।

এখানের পাঠ মিটে গেলে এবার চড়াই টপকানো। ৬০০ ফুট নিচে নামা সহজ। তবে ওঠা একটু কঠিন। হাঁপিয়ে হলেও , একদম বিশ্রাম না নিয়ে সোজা উঠে এলাম।




পর্ব - ১৬

গাড়ি চলছে , এবার যাব সিলেরীগাঁ আজকে ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫। একই পথে উঠতে নামতে, পাহাড় কে আবার আসব জানিয়ে পেদঙ্গ কে পেছনে ফেলে সোজা সিলেরী যাওয়ার রাস্তার মুখে। তপগায় সতর্ক করে দিল। এটা নাকি "ডান্সিং রোড"। সাড়ে চার কিলোমিটার এর বিস্তৃতি। বলেই যেখানে গাড়ি তুলল সেটা কে রাস্তা না বলাই ভালো। ওর মুখে শুনলাম বনদপ্তর অনুমতি না দেওয়ায় এই রাস্তা ঠিক হচ্ছে না। দু দিকে ঘন অরণ্য। মাঝে একটি "প্রায়" রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি চলেছে। উরঘু গাড়ি থেকে নেমে গেছে। আগেই বলেছি ছেলেটি খুব ভালো দৌড়ায়। রাস্তার কল্যাণে ও উরঘুর দৌড়ের ক্ষমতায়, ও আমাদের কম করে ২০০ মিটার পেছনে ফেলে দিল নিমেষে। ঝাকুনির চোটে সদ্য ভোজন করা মুরগির মাংস মুখে উঠে আস্তে লাগলো। জানি না এই রাস্তায় চলা গাড়ির আয়ু কত দিন। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে নাচতে নাচতে পৌঁছে গেলাম সিলেরীগাঁ। বীরু তামাঙ্গ এর বাড়ি। ভদ্রলোকের মেয়ে আমাদের স্বাগতম জানালো।

বেশ সুন্দর দুই তলা ছোট্ট "সিলেরীগাঁ রিট্রীট"। আজকেও দুপুরের খাবার বিকেলে খেতে হবে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই বাড়িটি আমাদের বন্ধু সৌরভ মুখার্জী ভাড়া নিয়েছেন। উনি ও ওনার বন্ধু অভিজিত মিলে। দেখলাম তাম্বু খাটিয়ে থাকার বন্দোবস্ত আছে। লোক জন পিলপিল করছে। এই প্রথম এত লোক পেলাম কোনও

এক যায়গায়। এই বাড়িতে মাত্র ২ টো ঘর থেকে আপনি কাঞ্চন দেখতে পাবেন। কিন্তু, এই হোটেলে যে আমরা উঠেছি সেটা সৌরভের অজানা, জাবেদ এর ও। আগে জানলে বন্ধু সৌরভ নিশ্চই আমাদের খরচ কমিয়ে দিত। হয় তো বিনাপয়সায় ক্যাম্প ফায়ার করতে পারতাম। একটু পরেই দেখলাম ফোনে ফোনে একটা আলোড়ন পড়ে গেল। কেউ কেউ আমাকে খোঁজ করতে লাগলেন। সৌরভের ফোনের কল্যাণে হোক বা বীরু বাবুর অতিথি বত্সলতায় হোক, এই প্রথম আমাদের মেনু খিচুড়ী আর ডিম ভাজা। ঠান্ডা বেশ জমিয়ে পড়েছে। মাখন দিয়ে খিচুড়ী ও সঙ্গে ডিম ভাজা , পাঠক আপনার ও লোভ হতে বাধ্য। বিশেষ করে যখন আপনি বিগত কয়েকদিন ধরে শুধু সকালে ডিমের ঝোল আর রাতে মুরগির ২ পিস মাংস খাচ্ছেন।
এদিকে রাতে এক একটি খাটে এক একটি কম্বল। মহা বিপদ। অভিজিত বাবুকে অনুরোধ করে আরও একটি পাওয়া গেল। আজকেই শেষ রাত। কালকে রাতে ট্রেন। তাই ঠিক করলাম আবার সব ছেলেরা এক সঙ্গে থাকবো। এর মধ্যে বীরু বাবুকে অনুরোধ করাতে রাতের মুরগির ঝোলটি পরিবর্তিত হয়ে চিলি চিকেন করা হলো। রাঁধুনি কেল্টুদা। আমরা গপ্পো করতে থাকলাম। এদিকে নিচে দুই ভ্রমণ দলের মধ্যে কী গণ্ডগোল। বেশ তর্কাতর্কি লেগে গেল। দুই দলই বাঙালি। দুই দলই পরের দিন জুলুক যাবে। কিন্তু কী নিয়ে গণ্ডগোল বুঝতে আমাদের বেশ কিছু সময় লাগলো। কলকাতার গরমে মাথা গরম করে থাকা বাঙালি যে হিমাঙ্কের কাছাকাছি উষ্ণতাতেও মাথা গরম ও ঝগড়ায় সেরা আমি নিজে বাঙালি হয়েও জানতাম না। আমরা কিন্তু বেশ মজা পেলাম। দিব্যেন্দু চলে গেল রান্না ঘরে। আজকে শেষ দিন। আমার জরুরী


অবস্থার জন্য তৈরি রাখা ব্যাগ থেকে কাজু বাদাম বেরিয়ে এল। দিদির কাছে থাকা বাদাম ও বেরিয়ে এল। চলতে থাকলো আড্ডা।

রাতে আজকে একটু দেরিতেই খেলাম। আগে সবাইকে খাইয়ে ঝামেলা মিটিয়ে বীরু বাবু আমাদের ডাকলেন। ইতিমধ্যে ব্যাগ গোছানো শেষ। হটাত্‍ হটাত্‍ বেপত্তা হয়ে যাওয়া জাবেদ বা ৬৫ ও ফিরে এসেছে। বেশ ঝাল দিয়ে তৈরি চিলি চিকেন সহযোগে রাতের খাবার শেষ হলো। ৪ জনের খাটে ৬ জন শুয়ে পড়লাম। এর কিছুক্ষণ আগে কেল্টুদা মজা করে সৌরভকে ফোনে যোগাযোগ করে। নাম বলে "অয়ন মণ্ডল" । এই বাড়িতে থাকার ভাড়া জানতে চায়। সৌরভ ভালই ভাড়া বলে। প্রতি দিন থাকা খাওয়া নিয়ে ৯০০ ভারতীয় টাকা প্রতিজন।





পর্ব -১৭ ও শেষ
----------
রাতে শোবার আগে ঠিক হয় আজকে অমলদা যদি "পরে গেলাম" বলে চিত্কার করেন তো সত্যি ফেলে দেব। তবে রাতে একটু জাবেদের ট্যাব ছাড়া কেউ বিরক্ত করেনি।
পরের দিন , ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪, একটু সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। আজকে ১২ টায় নতুন ড্রাইভার আসবে। তপগেয়কে আবার সিল্ক রুট যেতে হবে। তাই এবার নতুন গাড়ি আসবে। কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে গাড়ি ভাড়া নিলে এই বিপদ থাকবেই। ফেরার পথে ওনারা অন্য গাড়ির ব্যাবস্তা করে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেন। ভোর বেলা আমাদের জন্য কাঞ্চন শেষ বারের মত হাজির। সঙ্গে মত্‍সপুচরে। প্রত্যেক দিনের মত আজকেও একদম পরিষ্কার আকাশ। চোখ ভরে এই ট্যুরের শেষ বারের মত কুর্নিশ জানালাম। একটু সকাল সকাল প্রাতঃরাশ শেষ হল। আমাদের পরিকল্পনা ছিল রামতে যাবার। কিন্তু ঠিক ঠাক রাস্তা চেনা না থাকায় ও কোনও স্থানীয় লোক না থাকায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবে সফল হয় নি। তার পরিবর্তে স্থানীয় কিছু অঞ্চল পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করা হয়।
সিলেরী পাহাড়ের কোলে এক সুন্দর গ্রাম। ঘন জঙ্গলে ঘেরা। এখানে চিতা, ভল্লুক ইত্যাদির অবাধ বিচরণ। এমন কী হোম স্টে তে থাকা অভিজিৎ এর মুখে শুনলাম কিছুদিন আগে এই হোমস্টের নিচে চিতা বাঘ এসেছিল। সঙ্গে শাবক।


এই সিলেরী থেকে জঙ্গল পথে রামধুরা যাওয়া যায়, অবশই পায়ে হেঁটে।

স্নান করে নিলাম। হালকা গরম জলে। এদিকে অমলদা তো নন্তেকে নিজের ভাই পাতিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য কিছু কায়িক পরিশ্রম করিয়ে নেওয়া। কিন্তু গরম জল আনার হুকুম তামিল না করে প্রথম নন্তে সেই সম্পর্কে ছেদ টেনে দেয়। নতুন ভাবে বলতে শুরু করে "কুলাঙ্গার ভাই"।

জাবেদের কথা মত ১২ টায় আমরা মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য চললাম অন্য এক হোটেলে। এখানেও ট্রেক করতে হলো। কিছুটা পাহাড়ী রাস্তা উঠে তবেই হোটেলটি। গিয়ে বসে আছি তো বসেই আছি। যে গাড়িটি আমাদের নিয়ে নিচে নামবে তার অনেক দেরি। কী বিপদ! এটা হয় আমি জানতাম। যে ভদ্রলোক ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি এবার বিকল্প ব্যবস্থা করার চেষ্টা করলেন। প্রথমে আমাদের কালিম্পং হয়ে গাড়ি বদলিয়ে যাবার কথা বললেও জাবেদ আপত্তি করায় সরাসরি শিলিগুড়ি যাবার গাড়ি বাবস্থা করতে বাধ্য হন।


সেই নতুন গাড়ি যত দেরি করছে আমাদের উত্তেজনা বাড়ছে। এদিকে নিউ জলপাইগুড়িতে কিন্তু আমাদের ট্রেন একদম সঠিক সময়ে আসবে। এক এক মিনিট এক এক ঘণ্টা। শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩ টে গাড়ি ছাড়ল। আবার কালিম্পং পেরতেই আমাদের হাত ধরে

তিস্তা। নতুন গাড়ি ভাল নয়। সেদিকে খুব একটা নজর নেই। শুধুই তিস্তাকে টা টা করে এগিয়ে চলেছি। বাড়ি ফেরার আনন্দ সঙ্গে সঙ্গীদের থেকে আবার দূরে চলে যাওয়ার দুঃখ।

তিস্তা বাজারে হটাত্‍ নতুন ড্রাইভার সাহেবের পেতে ব্যথা হওয়াতে অতি জরুরী কাজের জন্য গাড়ি থামাতে হলো। আমাদের ও ভালো হলো। একটু চা খেয়ে নিলাম। সঙ্গে খুব অল্প হলেও কমলালেবু। কিছুক্ষণ পরে আবার গাড়ি নামতে থাকলো। শুকনা পেরিয়ে সোজা শিলিগুড়ি।
শিলিগুড়ি শহর আমার বেশ ভালো লাগে। পাহাড় থেকে নেমেই কলকাতা আসার আগে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য উত্তম। কিন্তু এখন বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারব না। হিকেন মত ট্রেন প্রায় এক ঘণ্টা দেরিতে চললেও আমাদের হাতে মাত্র ১ ঘণ্টাই আছে। চটপট একটি অঞ্চলে দাঁড়িয়ে কিছু খেয়ে নিলাম। দিব্যেন্দু গেছিল হংকং মার্কেট। দিদি একটা ওষুধের দোকান থেকে বোলতা কামরের জন্য গা হাত পা ফুলে যাবার ওষুধ কিনলো। এরপর সোজা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। রাতের খাবারের জন্য সবাই মিলে রুটি তড়কা কিনে নিলাম। রাতের এনজেপি স্টেশন মোহময়। আমাদের সিল্ক রুট অভিযান ও প্রায় শেষের দিকে।
ধৈর্য পরিখ্যা শেষ। প্রায় 2 ঘণ্টা লেট করে সরাই ঘাট এসে পৌঁছাল । উঠে পরলাম। এবার পুরো একটা কূপ আমাদের। বেস কিছু লোকজন বসে ছিল। তাদের সরিয়ে আমরা বসলাম। বসেই শুনলাম আমাদের দিকের টয়লেট জল বিহীন। এবার আমি একদম নিশ্চিন্ত হলাম যে বর্ধিত ভাড়ার সঙ্গে পরিষেবাও বিপরীত ধর্মী।

এদিকে জাবেদ ক্ষিদে পেয়ে যাওয়াতে নিজে কিছু কিনে আনলো। আমরা হামলে পরলাম। বেচারা রুটি সোজা মাটিতে। অল্প কিছু বেঁচে যাওয়াতে সেটাই খেল। একটু পরেই ঘুম। এবার নিচের সীটে জাবেদ। গায়ে চাদর ছাড়াই শুয়ে পরলো। রাত বাড়তেই ঠান্ডা বাড়ছে। এদিকে আমাদের হাত মুখ ধুতেও অন্য দিকে যেতে হচ্ছে। যাই হোক ভালই কাটলো রাতটা। বেশ খানিকটা ঘুমিয়ে নিলাম। প্রচণ্ড জোরে চলা ট্রেনটি সোজা হাওড়া ঢুকিয়ে দিল 6 টার একটু পরে। গোছ গাছ করে যে যার বাড়ি।




--------------------------------------------------------------------------------------

কয়েকটি কথা:
1সিল্ক রুট - সিকিমে রাস্তা কিন্তু যথেষ্ট খাঁড়া কয়েকটি যায়গায়। তাই যদি আপনি মনে করেন একদম না হেঁটে ঘুরবেন সেটা সম্ভব নাও হতে পারে।
2যেখানে মনে হবে যেতে পারবেন না যাবেন না। অতিরিক্ত উত্সাহ নিয়ে গেলেই বিপদ।
3ড্রাইভার ও স্থানিয়দের উপদেশ মেনে চলবেন।
4যেখানে যাচ্ছেন, পরিবেশ পরিষ্কার রাখুন
5নাথুলা বা বাবা মন্দিরে গেলে সঙ্গে কিছু ওষুধ রাখুন। ডাক্তার এর পরামর্শ নিন। পারলে ছোট অক্সিজেন নিয়ে যান।
6কোনও হ্রদে জল জমে বরফ হয়ে গেলে তাতে উঠবেন না।
7যদি মদ্য পান করেন তো একদম রাতের খাবারের পরে করবেন।
8হোম স্টে গুলো একেই অনেক কষ্টে আপনাকে থাকতে ও খেতে সহায়তা করে। আপনিও ওদের সাথে থাকুন। বেশি কিছু না চাওয়াই ভালো।

1 টি মন্তব্য:

  1. হোমিওপ্যাথি যে ওষুধ তুলোয় করে নাকে দিয়েছিলেন তার নামটা যদি বলেন তালে খুব ভাল হয়

    উত্তরমুছুন