রবিবার, ৩১ মে, ২০১৫

ভারত বেড়াতে যেতে পারেন তমলুক



ভ্রমণ করে না অথবা করতে চায় না এমন মানুষ এই দুনিয়ায় পাওয়া বড় মুশকিল। একজন পর্যটক হিসেবে আপনি ঘুরে আসতে পারেন গোটা বিশ্ব। দেশের বাইরে ঘুরে আসতে চান? তবে স্বদেশ মূল্যে ঘুরে আসতে পারেন বিদেশ। আর এই বিদেশ অন্য কোন দেশ নয়। আমাদেরই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। যে দেশের মধ্যে রয়েছে একদিকে মরুভূমি, অন্যদিকে বরফ আচ্ছাদিত পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, জঙ্গল, স্থাপত্য, পুরাকৃর্তি ইত্যাদি। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য রয়েছে সব ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত সম্ভার। প্রবাদ আছে, ‘সমগ্র ভারত ভ্রমণ করলে পৃথিবীর অর্ধেক দেখা হয়ে যায়’। আর আপনি যদি একজন পর্যটক হিসেবে ভারতে ভ্রমণ করতে চান, তবে তার গোড়াপত্তন ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা উচিত। ভারত ঘুরে এসে ভ্রমণ পিপাসু পাঠকদের উদ্দেশ্যে পর্যটন বোর্ড ও ভারতীয় ভ্রমণ সঙ্গী গাইডের অবলম্বনে লিখেছেন রোটা. মো: রিয়াজ উদ্দিন (পূর্ব প্রকাশের পর) প্রাচীন বাংলার রাজধানী তথা খ্রিপূ কালের বন্দরনগরী তাম্রলিপ্ত-আজকের তমলুকও বেড়িয়ে নিতে পারেন চলার পথে। এই তমলুকই ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শহীদ হন মাতঙ্গিনী হাজরা। নানান কিংবদন্তিতে ঘেরাওড়িশি শৈলীতে বৌদ্ধরীতিতে মাকড়া পাথরে গড়া তমলুকের বর্গভীমা মন্দিরে প্রাচীন তারামূর্তি রয়েছে। ব্যাঘৃচর্ম পরিহিত চতুর্ভুজ দেবী শবের উপর আসীন। পৌষ সংক্রান্তিতে বারুণীর মেলা মন্দিরের আর্কষণীয় উৎসব। এছাড়াও মন্দির রয়েছে আরও নানান। রাজবাড়িটিও আজ হেরিটেজ তালিকাভুক্ত। আর আছে শুঙ্গ, মৌর্য, কুষাণ, গুপ্ত, পাল ও মধ্যযুগের পুরাকীর্তির নানান কিছু সম্ভারে সমৃদ্ধ তাম্রলিপ্ত মিউজিয়ম, শহীদ স্মৃতি ভবন ও শ্রীরামকৃষ্ণ মিশণ তমলুকে। থাকারও হোটেল আছে পৌরভবনের কাছে শ্রীনিকেতন, হাসপাতালের কাছে ক্লাসিক লজ ও রূপনারায়ণের কাছে গ্রিণভ্যালী হোটেল ও রির্সোট। মুহুর্মহু বাস যাচ্ছে ১৬ কিমি দূরের মহিয়াদল, আরও ৮ কিমি যেতে গেঁওখালি। লঞ্চে হুগলি নদী পেরিয়ে নুরপুর হয়েও ফেরা যেতে পরে গৃহপানে। দীঘায়-মেচেদা বাসও যাচ্ছে তমলুক হয়ে। তেমনিই তমলুকের ১৬ কিমি দূরে পরিখায় ঘেরা দ্বীপ অতীতের ময়নাগড়-ও বেড়িয়ে নেওয়া যায়। পুব ও উত্তর জুড়ে কংসাবতী, দক্ষিণে কেলেঘাই আর পশ্চিমে চন্ডিয়া নদী। পরিখায় ঘেরা বৌদ্ধ নরপতি মহাবীর লাউসেনের রাজধানী ময়নাগড়ে বৌদ্ধ সঙ্ঘারামও গড়ে ওঠে সেকালে। তবে, অতীত লুপ্ত হয়ে আজকের ময়নাগড় খ্যাত রাসমেলার জন্য। রাসপূর্ণিমার প্রতি রাতে (৭দিন ব্যাপী) শ্যামসুন্দর জিউ আসেন আলোয় ঝলমল সুসজ্জিত নৌকায় চড়ে গড় থেকে রাসমঞ্চে। যাত্রীও আসেন দূর-দূরান্ত থেকে শ্যামসুন্দরের শোভাযাত্রার সাথে অতীত রোমন্থন করতে। থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই ময়নাগড়ে-নিকটতম হোটেল তমলুকে মেলে। সরাসরি যাত্রায় হওড়া থেকে ট্রেনে মেচেদা (৫৯ কিমি) পৌঁছে বাসে শ্রীরামপুর থেকে (২৬ কিমি) হয়ে চলায় দূরত্ব কশে। শ্রীরামপুর থেকে ১ কিমি দূরে ময়নাগড়। হাওড়া রেল স্টেশন থেকে বাসও যাচ্ছে ৯২ কিমি দূরের শ্রীরামপুরে। ঘন্টা তিনেকের পথ। দিনে ফেরাও যায় ময়নাগড় বেড়িয়ে কলকাতায়। ঝাড়গ্রাম/ কাঁকড়াঝোড় হাওড়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব রেলে ট্রেন যাচ্ছে আড়াই ঘন্টায় ১৫৫ কিমি দূরের ঝাড়গ্রাম। ৫-৬ ৫য় ইস্পাত এক্স, শালিমার থেকে ১৫-০০টায় লোকমান্য তিলক এক্স, হাওড়া থেকে ১৭-৩০এ স্টিল এক্স, ২১-৩৫এ হাওড়া-কোরাপুট, ২২-২০এ হাতিয়া এক্স যাচ্ছে হাওড়া থেকে খড়গপুর/ঝাড়গ্রাম/ঘাটশিলা হয়ে টাটা। আর যাচ্ছে ২-২৫ থেকে ২৩-৫০এ নানান লোকাল ট্রেন হাওড়া থেকে খড়গপুর/মেদিনীপুর। লোকাল ট্রেনে আড়াই ঘন্টায় খড়গপুর পৌঁছে ৫-৩৫, ৯-১৫, ১৫-১৫, ১৮-২০, ২১-০০টায় খড়গপুর-টাটা/ঘাটশিলা মেমু প্যা ট্রেনে ৩/৪ ঘন্টায় ঝাড়গ্রাম চলা যেতে পারে। এক্স ট্রেন থেকে সময়ে আধিক্য লাগলেও ভাড়ায় সাশ্রয় মেলে। ঈঝঞঈ-র বাসও যাচ্ছে ৮ ঘন্টায় কলকাতার শহীদ মিনার থেকে ১২-০০টায় ছেড়ে কলকাতা-মুম্বাই ঘঐ-৬ ধরে ২৪৬ কিমি দূরে লোধাশুলি থেকে ডানহাতি পথে গড় শালবনী হয়ে ১৪ কিমি গিয়ে ঝাড়গ্রামে। কলকাতায় ফেরে ঝাড়গ্রাম থেকে ৫-০০টায়। আর প্রাইভেট বাস যাচ্ছে হাওড়া স্টেশন থেকে ৫-৩০ থেকে ১৫-২০এ। প্রাইভেট বাস ফেরে৫-৩০এ প্রথম ছেড়ে ১৩-১৫য় শেষ। এছাড়াও বাস যাচ্ছে দীঘা, মেদিনীপুর, খড়গপুর, মুকুটমণিপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বেলপাহাড়ি, তামাজুড়ি ছাড়াও মেদিনীপুর জেলার দিকে দিকে ঝাড়গ্রাম থেকে। শাল, পিয়াল, শিমুল, জারুল, মহুয়ায় সাজানো প্রকৃতির সাজঘর ঝাড়গ্রাম। রুখু মাটি শাল-পিয়াল-আকাশমণি-সোনাঝুরির গা বাঁচিয়ে লাল কাঁকুরে পথঘাটে। বসতিও শাল-পিয়ালের ফাঁকে ফাঁকে চলতে ফিরতে পথেঘাটে। জলবায়ু স্বাস্থ্যপ্রদ। ঝাড়গ্রামের জল উদরঘটিত ব্যাধিতে মহৌষধির কাজ করে। ঋতুভেদে বদলও ঘটে প্রকৃতিতে। গ্রীষ্মের দিনগুলিতে মহুয়ার মৌতাত বাতাসকে ভারী করে তোলে। বর্ষায় মঞ্জরী ধরে শালের শাখে শাখে। ঝরঝর মুখর বাদল দিরে রিমঝিম তান- সেও যেন মৌতাত ধরায় ঝাড়গ্রামের মাধুর্যে। চাঁদনী রাতে মাধুর্য বাড়ে আরও বেশি। প্রকৃতিই মুখ্য দ্রষ্টব্য ঝাড়গ্রামে। তবে, উচিত হবে ঝাড়গ্রামের সঙ্গে জুড়ে দিনভর প্রোগ্রামে জিপ বা গাড়িতে ১০০০-১২৫০ টাকায় জঙ্গলমহল-জামবনি-চিল্কীগড়-গিধনি-বেলপাহাড়ি-কাঁকড়াঝোড়-ঘাঘরা-তারাফেনি ব্যারেজ বেড়িয়ে নেওয়া। রেল স্টেশন থেকে ৩ কিমি দূরে শহরের উপকন্ঠে ঝাড়গ্রাম প্যালেস অর্থাৎ চক মিলানো রাজার বাড়ি। হোটেল বসেছে একতলায়। বিশেষ অনুমতিতে রাজবাড়ি দেখার ব্যবস্থা মেলে। আর আছে চতুর্মুখ শিব, লোকেশ্বর বিষ্ণু, মনসা দেবীর মন্দির। স্বল্পদূরে কিংবদন্তি খ্যাত সবিতার দাসী সাবিত্রী মন্দির। অতীতে মন্দির ছিল পাথরের, বর্তমান মন্দিরটি ১৯২০এ তৈরী। পেটিকায় মানবী দেবী সবিতার কেশও খড়গ পূজিত হচ্ছে আজও। বিগ্রহ হয়েছে চন্দন ও সিন্দুরে। প্রতিদিন ৯-৩০, ১২-৩০ ও সূর্যাস্ত থেকে ২ ঘন্টা খোলা থাকে মন্দির। আর আছে শহর থেকে ৩ কিমি দূরে কৃষ্ণনগরে ১৯৮৩-তে গড়া ৩৪.৫ হেক্টর ব্যাপ্ত ঝাড়গ্রাম ডিয়ার পার্ক তথা মিনি চিড়িয়াখানা। বিশাল এক দিঘীকে ভর করে মনোরম পরিবেশে রূপ পেয়েছে। টিকিট ৪্। আর আছে রঘুনাথপুরের আদিবাসী সংস্কৃতি পরিষদ। ঝাড়গ্রামের বিক্রমজিৎ মল্ল উগাল দেব বাহাদুরের খনন করা রাধানগরে ১০০ একর ব্যাপ্ত বিশাল দিঘী অর্থাৎ কেচেন্দা বাঁধ বা রাজবাঁধ, এরই সামনে মনোরম পরিবেশে সেবায়তন আশ্রম। অতিথিশালাও হয়েছে আশ্র্রমে। চলার পথে আর এক দিঘী মেলাবাঁধ। রিকশায় একে একে দেখে নেওয়া যায় ৫০ টাকায়। রেল স্টেশন থেকে ১০, লোধাশুলির ৫ কিমি দূরে কলকাতার আড়িয়াদহর অজয় ঘোষাল মহাশয়ের শখ ও স্বল্প রূপ পেয়েছে ২০ বিঘা ব্যাপ্ত জঙ্গলমহল, হর্টিকালচার তথা বটানিক্যাল গার্ডেন। রংবেরঙের শতাধিক ধর্মী গোলাপের বাগিচায় নানান বর্ণের গোলাপের সাথে ব্ল্যাক প্রিন্স অর্থাৎ কালো গোলাপ, ক্যাকটাস, অর্কিড, জীবজন্তু, ফুলফল গাছগাছালির জঙ্গলমহল আজ ঝাড়গ্রামে অন্যতম দ্রষ্টব্য। থাকারও ব্যবস্থা মেলে ঔঁহমষব গধযধষ জ ঐ, উ ২০০-৩০০। রেশন নিজস্ব ব্যবস্থায় সঙ্গে নিতে হয়। সিটি বাস যাচ্ছে শহর থেকে। অটোও মেলে, যাতায়াত ১২৫। আর পথেই পড়ে বাস রোডে পাশাপাশি মহারাজ উদ্যান বাটী। মল্ল রাজাদের খাস মহলে ৪০ বিঘা ব্যাপ্ত উদ্যানে জঙ্গলের আদিমতাকে অক্ষুন্ন রেখে প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্য মহুয়া ও কাজু বাগানে ঝষনড়হর জবঃৎবধঃ হয়েছে। টেলিস্কোপও বসেছে। আহারেও অভিজাত ও আন্তরিক বাঙালিয়ানা বর্তমান। জঙ্গলমহল থেকে সরাসরি বাসের অমিল হলেও ঝাড়গ্রাম থেকে চিল্কীগড়/গিধনিমুখী বাসে জঙ্গলমহলের পথে ২ কিমি এসে ডানহাতি ১১ কিমি যেতে জামবনি পেরিয়ে আরও ৫ কিমি গিয়ে চিল্কীগড়। রজক অর্থাৎ ধবরদের হারিয়ে উপাধিধারী ধলভূম রাজদের রাজবাড়ি ডুলুং নদী পেরিয়ে চিল্কীগড়ে। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রথম গণবিদ্রোহ চুয়াড় বিদ্রোহে শামিল হন রাজা। দেবতাও রয়েছেন নানান রাজবাড়ি চত্বরে। চিল্কীগড়ের প্রশস্তি গড় বা জঙ্গলমহল দুর্গ ও মন্দিরের জন্য। পথ থেকে সরে প্রকৃতির যাদুঘরে অতীতের পঞ্চরতœ মন্দিরটি পরিত্যক্ত হতে ১৩৪৮এ গড় জঙ্গলের মাঝে পিঢ় রীতিতে নতুন করে মন্দির হয়েছে অশ্বারূঢ়া, ত্রিনয়না, চতুর্ভুজা, অষ্টধাতুর জাগ্রতা শাক্তদেবী কনকদুর্গার। দীর্ঘ অতীতে কনক অর্থাৎ সোনার দেবীকেও লুঠ করে ভাস্কর পন্ডিত। স্বপ্নাদিষ্টা ৩০০ বছরের প্রাচীন দেবীও রয়েছেন বেদিতে। অতীতে প্রতি অমাবস্যায় নরবলির প্রথা ছিল। আর আজ ছাগ ও মহিষ বলি হচ্ছে নবমীর রাতে কনকদুর্গা সকাশে। অরণ্য চিরে নিচু দিয়ে বয়ে চলেছে ডুলুং নদী চড়–ইভাতির আদর্শ পরিবেশ চিল্কীগড়। থাকারও ব্যবস্থা মেলে মন্দিরের যাত্রী আবাসে। যাতায়াতের পথে জামবনির সন্নিকটে শীতের দিনে কেন্দুয়া গ্রামে (যতীন মাহাতোর বাড়ী) পরিযায়ী পাখির রোজনামচা দেখে নেওয়া যায়। মন্দির রেখে রাজবাড়ি দেখে ৬ কিমি যেতে গিধনি। রেলও আসছে ঝাড়গ্রাম থেকে পরের স্টেশন গিধনি (১৫ কিমি)। হাওড়া থেকে ১৭০ কিমি দূরে পশ্চিমবাংলার প্রান্তভূমি গিধনি। আকাশ জুড়ে ঝাড়খন্ডের বাতাস। শালবন চিরে পথ চলে ডুলুং নদী। অনুকুল ঠাকুরের শিষ্যদের উদ্যোগে আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। রাঙাপথের বাঁকে বাঁকে ছোট ছোট গ্রাম, মেটে বাড়িঘর। পুটুশ, বনতুলসী, কুসুম, মহুয়া বনে মুন্ডা, সাঁওতাল, মহালি, শবরদের বাস। ১৯৫৫র ১লা এপ্রিল ২২ হেক্টর বনভূমি ৩ বিটে ভাগ হয়ে নাম হয়েছে তার আমতোলিয়া, কানাইসোল আর গদরাসোল। গিধনি থেকে ১কিমি দূরে নীল আকাশের গায়ে সারস, টিয়া, শালিকের কোলাজ কানাইসোল। কানাইসোল বাংলোর অদূরে একদিকে পরিহাটি অপরদিকে চিল্কীগড়। অদূরে দলমা পাহাড়- ভালুক, হাতি, হায়নারা অভিসারে নামে পাহাড়ে থেকে। এ পথে আরও যেতে বেলপাহাড়ি। সরাসরি বাসও পাওয়া যায়। ঝাড়গ্রাম/মেদিনীপুর ছাড়াও দিগি¦দিক থেকে বেলপাহাড়ি, তামাজুড়ি/ঝিলিমিলির। ঝাড়গ্রাম থেকে ৪৫ কিমি দূরে শালে ছাওয়া টিলা টিলা সুন্দর পাহাড়ি। ঝাউ, মহুয়া, পিয়াল, ইউক্যালিপটাস, সোনাঝুরি, আর শিরীষও ছাতা ধরেছে বেলপাহাড়ির শিরে। সুন্দর নৈসর্গিক শোভার মাঝে সহজ সরল মানুষজন। চোখে পড়ে কনাইসোল পাহাড়ের ভালে টিকলি হয়ে পূর্ণিমার চাঁদ। পাহাড়তলিও ঠিকরে পড়া আলোয় উদ্ভাসিত। মকর সংক্রান্তিতে এলাকা জুড়ে টুসুর উৎসব চলে। দোকানপাট, খাবার হোটেল আছে। সপ্তাহান্তিক ছুটি কাটাবার মনোরম পরিবেশ।বেলপাহাড়ি থেকে লাল সুরকির পথে ৯ কিমি দূরে আর এক স্বপ্নপুরী ঘাঘরা। বাসের চল নেই- জিপ যাচ্ছে। আবার পায়ে পায়ে ট্রেক করেও মিনিট চল্লিশে চলা যায় ঘাঘরায়।

ভাদ্র ১৪২১, সেপ্টেম্বর , ২০১৪

ডুয়ার্সের জঙ্গলে কয়েকদিন

১) যাত্রারম্ভ -- শিলিগুড়ি
বাগডোগরায় উড়ে গিয়ে ডুয়ার্স ভ্রমণ শুরু করার বাসনা আমার মনে আদপেই ছিল না। বরং ইচ্ছে ছিল রাত্তিরে দার্জিলিং মেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যাবার, যাতে করে ভোরবেলা হাতমুখ ধুয়ে ফিটফাট হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামতে পারি। কিন্তু বিধি বাদ সাধলেন। যাবার দিনে কোনো রাতের ট্রেনেই রিজার্ভেশন পাওয়া গেল না। দার্জিলিং মেলের বাতানুকুল দ্বিতীয় শ্রেণীর শায়নযানে দেখি সাতচল্লিশজনের নাম রয়েছে প্রতীক্ষারতদের তালিকায়। প্রথম শ্রেণীতেও দশজনের বেশী “ওয়েট লিস্টে”। অগত্যা উড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিতেই বাধ্য হলাম।
বাগডোগরা বিমানবন্দর দেখে ভালো লাগলো – ছোটো হলেও বেশ ছিমছাম ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। টারমাকে ভারতবর্ষের প্রায় সবকটি অন্তর্দেশীয় বিমানসংস্থার প্লেন দাঁড়িয়ে আছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাবার জন্য। কিন্তু বেরুতে গিয়ে এক অপ্রত্যাশিত বাধার সম্মুখীন হলাম। পার্কিং লটে আমাদের গাড়ী আটকে দেওয়া হোলো, কারণ ওই সময় পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা ব্যানার্জি সদলবলে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা ফিরছিলেন “উত্তরবঙ্গ উৎসব” উদ্ধোধন কোরে। আমি বুঝতেই পারিনি যে সম্পূর্ণ অজান্তে আমার সফর আর উত্তরবঙ্গ উৎসব একই সঙ্গে পড়ে গেছে। এই উৎসব একটি প্রায় সপ্তাহব্যাপী বাৎসরিক অনুষ্ঠান যেটি উত্তরবঙ্গের একাধিক শহরে একই সময় উদযাপিত হয় শিল্পী এবং প্রোগ্রাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ও ভাগাভাগি করে। এ লেখার শেষে আমি আবার উত্তরবঙ্গ উৎসবে ফিরে আসবো।
বাগডোগরা থেকে শিলিগুড়ি যাবার পথে স্বভাবতঃই ছিল গাড়ীর ভীড়, ট্র্যাফিক জ্যাম ও পুলিশের ছড়াছড়ি। এই আমার দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পরে শিলিগুড়িতে আসা, তাই বহির্দৃশ্য যথাসাধ্য উপভোগের চেষ্টা করলাম। গাড়ী গেল নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটির প্রধান দরজার পাশ দিয়ে – এটা পঞ্চাশ বছর আগে ছিল না। তবু বলব যতটা শুনেছিলাম শিলিগুড়ি ঠিক ততটা ইঁট আর কংক্রীটের বিশাল শহরে পর্যবসিত হয় নি। কিছু উঁচু উঁচু বাড়ি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু গ্রাম বাংলার মিষ্টি ছাপ এখনো যথেষ্ট রয়েছে।
আমার প্রথম গন্তব্যস্থল ছিল একটি চার-তারকার নিরামিষ হোটেল। (এহেন ব্যাজস্তুতি কি একমাত্র ভারতবর্ষেই সম্ভব?) জায়গাটির সন্ধান দিয়েছিল আমার এক ভ্রমণে অভিজ্ঞ শ্যালক – বলেছিল যাত্রারম্ভে সমীচীন হবে। কথাটা মন্দ বলেনি। হাজার হোক চার তারকা তো পেয়েছে! দেখলাম ঘরগুলি সুন্দর, কল খুললে ঠাণ্ডা এবং গরম দুরকম জলই পড়ে, ডিনারে মেলে সুস্বাদু নিরামিষ খানা, ও রাত্রে “বার”টি ঠাসা থাকে বিদেশী মাদকদ্রব্যের দামী বোতলে। কিন্তু “সিণ্ড্রেলা” নামটিতে খটকা লাগলো – সিণ্ডারেলা নয় কেন? হোটেলের মালিককে সে প্রশ্ন করায় তিনি লজ্জিত মুখে স্বীকার করলেন যে সেটি তারই ভুল; উচ্চারণটি চারিপাশে ওইরকম শুনে শুনে বানানটি ভুল করে বসেছেন। এটি হোটেলটির একটি অতিরিক্ত বিশেষত্ব বলা চলতে পারে।
হোটেলের মালিকের সাথে দেখা করেছিলাম কারণ সে এবং তার পরিচিত ট্রাভেল এজেন্ট আমার ডুয়ার্স সফরের সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। কথায় কথায় জানলাম ভদ্রলোকের আদিপুরুষ এসেছিল বিকানীর থেকে। তার প্রপিতামহ এসে পত্তন গাড়ে আসামের তেজপুর শহরে এবং সেখানে ব্যবসা করে বেশ বিত্তশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু ঊনিশশো বাষট্টির চীন যুদ্ধের পরে তার পিতৃপিতামহ সপরিবার উত্তর বাংলায় চলে আসে। তার অধুনা বিস্তৃত পরিধির ব্যবসার মধ্যে রয়েছে হোটেল ছাড়াও একটি হিন্দী ভাষার দৈনিক সংবাদপত্র। শিলিগুড়ি থেকে প্রকাশিত হয় অনেক ভাষার দৈনিক পত্রিকা, যেটা অবশ্যই ওই অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষাভাষী বাসিন্দাদের প্রতিফলনমাত্র।
২) জলদাপাড়া – বন্যপ্রাণীদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা
ডুয়ার্স নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ দ্বার থেকে। ডূয়ার্স বলতে বোঝায় পূর্ব হিমালায়ের পাদদেশের সমতল ও পাহাড়ের নদীবারি সিঞ্চিত বন্যাপ্রবণ জায়গা, যেটা সিকিম ও ভুটানের পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের সমতলভূমিতে নামার দ্বারস্থান বিশেষ। নেপালের দিকে এই একই জায়গার নামকরণ হয় তরাই। ডুয়ার্সে ভারতের অধিকাংশ প্রান্ত থেকে আসতে হয় নেপাল ও বাংলাদেশ দিয়ে চাপা এক অতি সরু “করিডোর” দিয়ে, যার মাঝে রয়েছে অতি গুরুত্বপূর্ণ সেই শিলিগুড়ি শহর আর জংশন স্টেশন।
সিণ্ড্রেলা হোটেলে এক রাত কাটিয়ে আমি এবং আমার স্ত্রী পরের দিন রওনা দিলাম ভাড়া করা ভ্যানে চেপে জলদাপাড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল উদ্দেশে। শিলিগুড়ি থেকে রাস্তায় ডুয়ার্স যেতে গেলে তিস্তা নদী পার হতে হয় “করোনেশন ব্রিজ” দিয়ে। এই ব্রিজটা জল থেকে অনেক উঁচুতে দুটো পাহাড়কে সংযোজন করে; নীচে গভীর খাদের মধ্যে দেখা যায় জলধারা। সে এক অতি মনোরম দৃশ্য (প্রথম ছবিটি দেখুন)। ব্রিজটির নামকরণের কারণ এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দে সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের রাজসিংহাসন আরোহণের সময়। ব্রিজটির নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয় ১৯৪১ সালে। এটিকে অনেক সময় “সেবক ব্রিজ”ও বলা হয় তৈরীর সময়কার তত্বাবধনকারী ব্রিটিশ আর্মি এঞ্জিনীয়ার সেবক সাহেবের নাম স্মরণ করে।

প্রথম ছবি - করোনেশন ব্রিজ থেকে তিস্তার বঙ্কিম দৃশ্য
জলদাপাড়া পৌঁছাতে দিনের বেশীরভাগটাই কেটে গেল। রাস্তাটি নামে জাতীয় সড়ক হলেও কার্যতঃ অনেক জায়গাতেই তার বেশ অবহেলিত ভাঙচুড় অবস্থা। গিয়েছে কখনো বনের ভেতর দিয়ে, কখনো ফাঁকা সমতলভূমি কেটে, কখনো বা শীতে প্রায় জলশূন্য নদীর উপর ব্রিজ ধরে। রাস্তার ধারে প্রত্যক্ষদৃশ্য বনজ সম্পদ – শাল, সেগুন, খয়ের, অর্জুন প্রভৃতি দামী কাঠের গাছ। কিন্তু যেটা আমাদের সবচেয়ে চোখে পড়ল ও আকৃষ্ট করল সেটা হল রাস্তার ধারে সারি সারি সুদৃশ্য চা-বাগান। চা গাছগুলো ওপর থেকে এমন নিপুণভাবে ছাঁটা যে দেখে মনে হয় দিগন্তবিস্তৃত সবুজ গালিচা কেউ পেতে দিয়েছে। শুধু মাঝে মাঝে গালিচা ফুঁড়ে উঠেছে ছত্রছায়াধারী কিছু গাছ। আমাদের সঙ্গের নেপালী ড্রাইভারটি স্বচ্ছন্দে বাংলায় কথা বলছিল; জানালো যে তার এক বড় ভাই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে কার্গিল যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। আমার উত্তর বঙ্গ ভ্রমণের একটি ফলশ্রুতি হোলো এই যে আমি ওই অঞ্চলের বাসিন্দা বিভিন্ন জাতি-উপজাতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। আর সেই সঙ্গে বুঝতে পারলাম ওই নানা সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া সর্বসম্মতিক্রমে মেটানোর সমস্যাটা কত দুঃসাধ্য।
সন্ধ্যাবেলা পৌঁছে গেলাম পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালিত জলদাপাড়া ট্যুরিষ্ট লজে। সুন্দর ছিমছাম পরিষ্কার এই অতিথিশালা ও তার সঙ্গে খাবার ব্যবস্থা। কাঠের দোতলা মজবুত বাড়ী তৈরী করা হয়েছে বনের ভেতরে একটু ফাঁকা জায়গায়। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট পাহাড়ী ঝরণা, ওপরে সাঁকো। (শীতকালে অবশ্যই শুকনো, জলবিহীন)। ট্যুরিষ্ট লজের এক দিকে রয়েছে কেয়ারি করা ফুলের বাগান, আর মাঝখানে আছে সযত্নে পরিচর্যিত মাঠ ও মিনিয়েচার পাহাড় ও নালার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা স্থানীয় পশু ও প্রাণীদের খোদাই করা মূর্তি। সেখানে দেখতে পাবেন প্রমাণ সাইজের হাতী, গণ্ডার, চিতা, নানারকমের হরিণ ও পাখী, এমনকি বিবিধ সাপ এবং বিছেও। শুধু তাই নয়, রাত্রে মূর্তিগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে শব্দ-ও-আলোর (“সন এ লুমিয়্যারের”) খেলায়। তখন বিভিন্ন প্রাণীর ওপরে আলো পড়ে আর নেপথ্যে শোনা যায় তাদের প্রকৃতি ও স্বভাবগত তথ্য। এই নেপথ্যবাণীতে পুরুষের কণ্ঠস্বর দিয়েছেন প্রখ্যাত অভিনেতা এবং প্রকৃতিপ্রেমী সব্যসাচী চক্রবর্তি।
ভারতবর্ষে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে তিন শ্রেণীর। “বন্যপ্রাণীর নিরাপদাশ্রয়” (“Wildlife Sanctuary”) হোলো এমন এক জায়গা যেখানে বন্যপ্রণীরা অবাধে বিচরণ করতে পারে মানুষের খুব একটা সংশ্রবে না এসে। “জাতীয় উদ্যান” (“National Park”) সংরক্ষিত এই অর্থে যে সেখানে গাছ কাটা নিষিদ্ধ। কিন্তু স্থানীয় লোকেরা সেখানে পোষ্যপ্রাণী (যেমন গরু, মোষ) চড়াতে পারে ও প্রান্তিক এলাকায় কিছু চাষ-আবাদও করতে পারে। আর “জাতীয় বন” (“National Forest”) সংরক্ষিত হলেও সেখানে গভর্মেন্টের তত্ত্বাবধানে কাঠুরিয়াদের গাছ কাটতে দেওয়া হয়; তবে গাছ কাটা হলে সেই জায়গায় গভর্মেন্ট আবার নতুন করে গাছ লাগায়।
পরদিন খুব ভোরে আমরা অন্যান্য অভিযাত্রীদের সঙ্গে রওনা হয়ে গেলাম জলদাপাড়ার মাঝখানে হোলং নামে একটা জায়গার উদ্দেশে। মুখ্য উদ্দেশ্য হাতীর পিঠে চড়ে খোলা জঙ্গলে বুনো পশু দেখতে যাওয়া। হোলঙে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বড়কর্তাদের জন্য তৈরী একটি সুন্দর বাংলো আছে। বাংলোটিকে বন থেকে তফাৎ করেছে তোর্সা-গামী একটি পাহাড়ী উপনদী। আসলে জলদাপাড়ার বনকে নানাস্থানে কেটে কেটে তোর্সার বেশ কয়েকটি উপনদী বয়ে গেছে। বাংলোর সামনে যে চওড়া নালাটা আছে, তার উলটো দিকে বনের সামনে কিছুটা জায়গা সাফ করা। সেখানে বন-বিভাগের কর্মচারীরা কয়েকটি নুনের ঢিপি চৈরী করে রাখে, যাতে করে বন্য প্রাণীরা (লবণের প্রয়োজনে) সেটা চেটে নালায় জল খেতে আসতে পারে। আমাদের ভাগ্য ছিল প্রসন্ন; পৌঁছানোমাত্রই দেখলাম সকালের কুয়াশা ভেদ করে একটি গণ্ডার ধীরে-সুস্থে, হেলতে দুলতে এগিয়ে আসছে নুনের ঢিপি চাটবার জন্যে (দ্বিতীয় ছবিটি দেখুন)।
দ্বিতীয় ছবি -- গণ্ডার এগোচ্ছে নুনের ঢিপির দিকে (হোলং, জলদাপাড়া)
আমাদের দল ছিল সকালের “সাফারি”র দু নম্বর গ্রুপ। প্রথম গ্রুপের হাতী ও আরোহীদের জন্য আপেক্ষা করতে করতে আমার কিছু জ্ঞানার্জন হল। যথা, প্রতি হাতীর পিঠে চারজন সওয়াড়ি বসতে পারে। তারা বসে হাতীর পিঠে বাঁধা একটা কাঠের বোর্ডের ওপর, যেটার চারিদিক দিয়ে সুরক্ষার কারণে “গার্ড রেল” দেওয়া থাকে। যাত্রীরা বসে একদিকে দুজন ও অন্যদিকে দুজন; সীটে বসে ধরে থাকে গার্ড রেল আর পা গলিয়ে দেয় রেলের তলা দিয়ে হাতীর পিঠের ধারে। সবচেয়ে মজার কথা, এই সাফারিতে যান হিসেবে কেবলমাত্র মেয়ে হাতী ব্যবহার করা হয়, কারণ তাদের পিঠ চওড়া ও চারটি যাত্রী নিতে সক্ষম। পুরুষ হাতীরা বেশী উঁচু এবং তাদের পিঠের গড়নটা ঢালু। সেখানে কাঠের বোর্ড দিয়ে চারজনের বসা সম্ভব নয়।
হাতীর পিঠে চড়তে হয় সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা কংক্রীটের প্ল্যাটফর্ম থেকে। আমার উঠে গিয়ে ঠিক জায়গায় বসতে বিশেষ অসুবিধে হোলো না। একটু চাপাচাপি ছিল অবশ্যই, কিন্তু হাতী চলাকালে কোনো অস্বস্তি বা কষ্ট হয় নি। আমাদের মা-হাতীটার সঙ্গে তার আবার একটা বাচ্চাও ছিল; সুযোগ পেলেই সে শুঁড় দিয়ে একটু একটু দুধ চুষে নিচ্ছিল। অল্প পরেই আমরা দেখতে পেলাম জঙ্গলে উঁচু ঘাসের মধ্যে আধখানা ঢাকা আরেকটা গণ্ডার। জলদাপাড়া বনের প্রকৃতি অন্ততঃ তিন রকমের – কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাও অনেকখানি জায়গা জুড়ে শুঘু উঁচু ঘাস, আর কোথাও বা মাঠের মাঝে হঠাৎ করে কতিপয় বড় গাছের সমষ্টি। আমরা যেতে যেতে প্রায়শঃই তোর্সার উপনদীগুলো পার হচ্ছিলাম (তৃতীয় ছবিটি দেখুন) আর হঠেৎ হঠাৎ করে দেখতে পেলাম (বাহারি শিংসহ) সম্বর হরিণ, গাউর (অথবা ভারতীয় বাইসন), ছোট সাইজের “বার্কিং ডিয়ার” ও নানা জাতের রঙ-বেরঙের পাখী। আমাদের সামনের হাতীর যাত্রীরা নাকি নিমেষের জন্য চিতাবাঘ দেখতে পেয়েছিল; আমরা পাই নি। বুনো হাতীও দেখিনি – ভাগ্য ভাল বলে কি? – আর মনে হয়না ওই বনে আসল বাঘ এখন আর আছে। যাই হোক, সব মিলিয়ে সাফারিটা হল এক আসাধারণ ও অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
তৃতীয় ছবি - হাতীর পিঠে চেপে জলদাপাড়ায় ছোট নদী অতক্রম
৩) চিলাপাতা ও গরুমারা
জলদাপাড়ায় সাফারি করে বিকেলে আমরা গেলাম চিলাপাতা জাতীয় বন দেখতে। আর পরের দুদিন ঘুরলাম গরুমারা জাতীয় উদ্যানের ভেতরে ও চারিপাশের অঞ্চলে। হাতীর পিঠে চেপে বেড়াবার মত মজা অবশ্য আর কোথাও করা যায় নি। পশুপাখীও জলদাপাড়ায় যা দেখেছি অন্য দু জায়গায় সেরকমটিই দেখলাম। তবে দু-একটা উল্লেখযোগ্য নতুন জিনিস দেখা গেলো।
প্রথমতঃ চিলাপাতার জঙ্গলের মাঝখানে গাইড আমাদের নিয়ে গিয়ে দেখাল “নল রাজার গড়ে”র ধ্বংসাবশেষ। সেখানে যাবার আগে কেউ একজন আমায় বলেছিল যে ওই নল রাজা আর মহাভারাতের নল ও দময়ন্তী উপাখ্যানের নায়ক একই। আমাদের গাইড সে প্রসঙ্গকে উড়িয়েই দিল অবাস্তব ও অনৈতিহাসিক বলে। আমাদের গাইডটি ছিল একটি অল্পবয়সী অত্যুৎসাহী ছেলে; বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসে তার বিরাট আস্থা। তার মতে চিলাপাতার নল রাজা ছিলেন স্থানীয় কোনো ছোটখাট অঞ্চলের অধিকর্তা। গড় বা দুর্গ বানিয়েছিলেন প্রজাদের উত্তর (সম্ভবতঃ ভুটান) থেকে আগত হানাদারদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করতে। দুঃখের কথা দুর্গের এখন চরম দুর্গতি – ভাঙ্গা ইঁটের দেয়াল আর তোরণের অবক্ষয় ছাড়া বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই। সেগুলোও আবার গাছ ও আগাছায় অনেকাংশে ঢেকে গেছে। সাপ ও বিছের ভয়ে আমি গড়ের ভগ্নদ্বার অতিক্রম করার চেষ্টা করিনি।
দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য জিনিস গরুমারা জাতীয় উদ্যানের “যাত্রাপ্রসাদ” দর্শনস্তম্ভ বা ওয়াচটাওয়ার। গরুমারাতে কোনো হাতীর পিঠে চড়ে সফরের ব্যবস্থা নেই। তার পরিবর্তে আছে বেশ কয়েকটি পশুপাখী দেখার পক্ষে উপযুক্ত বাঁধানো উঁচু জায়গা। সেসব ওয়াচটাওয়ার থেকে বন্যপ্রাণীরা নুন চাটতে বা জলপান করতে আসলে তাদের দেখতে পাওয়া যায়। “যাত্রাপ্রসাদ” নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অভিনব গল্প। নামটি আসলে ছিল একটি পোষা পুরুষ হাতীর, যেটি গ্রামবাসী থেকে বনবিভাগের কর্মচারী সকলেরই খুব প্রিয় ছিল। কারণ সে একাধারে মানুষ থেকে শুরু করে শস্যক্ষেত্র রক্ষা করত বুনো বা পাগলা হাতীর কবল থেকে। হাতীটি মারা গেলে তার নামে তৈরী করা হয় সবচেয়ে আকর্ষণীয় দর্শনস্তম্ভ। আমরা “যাত্রাপ্রসাদ” থেকে দেখতে পেলাম আরো কিছু গণ্ডার, গাউর (ভারতীয় বাইসন) ও এক দল গায়ে গোলগোল ছাপওয়ালা চিতল হরিণ (চতুর্থ ছবিটি দেখুন)।


চতুর্থ ছবি – গরুমারার যাত্রাপ্রসাদ থেকে তোলা চিতল হরিণের দৃশ্য
গরুমারায় এসে আমার স্থানীয় আদিবাসী এবং উপজাতি সম্বন্ধে ধারণাটা আরো স্পষ্ট হোলো। উত্তর বাংলার আদিবাসীরা এক প্রজাতির নয়। এদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন উপজাতি – যেমন সাঁওতাল, ওড়িয়া, রাজবংশী, ইত্যাদি। গরুমারায় আমরা একটি ওড়িয়া উপজাতির গাইড পেয়েছিলাম। “যাত্রাপ্রসাদ” থেকে ফেরার পথে সে আমাদের মানে যাত্রীর দলকে নিয়ে গেল একটা পাথরের বেঞ্চি দিয়ে গোল করে ঘেরা সুন্দর মাঠে। সেখানে একদল আদিবাসী তরুণী তাদের নিজস্ব চিত্তাকর্ষক গ্রুপ নাচ (“লাইন ড্যান্স”) করে আমাদের দেখাল। পরে গরুমারার কাছে অনেক দোকানে দেখলাম যে আদিবাসী গহনা ও হস্তশিল্প বিক্রী হচ্ছে। আগেই শিলিগুড়িতে নেপালী ড্রাইভার ছাড়াও অনেক গুর্খা দেখেছিলাম। গরুমারায় এসে বুঝলাম যে উত্তর বঙ্গের রাজনৈতিকি ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এবং সর্বজনগ্রাহ্যা শাসন ব্যবস্থা নির্ণায়নে গুর্খারা ছাড়াও বিভিন্ন আদিবাসী উপজাতিদেরও বড় ভূমিকা থাকতে বাধ্য।
৪) পারিপার্শ্বিক যাত্রা – ভুটান (ফুন্টশোলিঙ) ও সুন্তালিখোলা
ভারত-ভুটান সীমানার একদিকে আছে পশ্চিম বাংলার শশব্যস্ত শহর জয়গাঁও আর অন্যদিকে শান্ত ছবির মতো ভুটানের শহর ফুন্টশোলিঙ। ভারতীয়দের ভুটানে (বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলে) ঢুকতে কোনো নিষেধ নেই; দু-দেশের সীমান্তরক্ষীরাই পাহাড়া দেয় বেশ ঢিলেঢালা ভাবে। আমি সেই ঢিলেঢালামি ও নিজের চেহারার সুযোগ নিয়ে গাড়ীতে করে দিব্যি ভুটানে ঢুকে পড়লাম সরকারী কাগজ-পত্র ছাড়াই। ঢুকে অল্প উঁচুতে একটি বৌদ্ধবিহার দেখতে গেলাম। বৌদ্ধবিহারটি তৈরী হয়েছে একেবারে পাহাড়ের গায়ে; সেখান থেকে নীচে শহরের ও অল্প দূরে খাড়া পাহাড়ের কোলে প্রবহমান তোর্সা নদীর এক অতি মনোরম দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় (পঞ্চম ছবিটি দেখুন)।


পঞ্চম ছবি – বৌদ্ধবিহার থেকে তোলা ফুন্টশোলিঙ এবং তোর্সা নদীর দৃশ্য
ফুন্টশোলিঙ ছাড়াও গরুমারা থেকে আমি আরেকটা সাইড ট্রিপ নিয়েছিলাম দার্জিলিঙ জেলার সুন্তালিখোলা নামে সাতশ মিটার উচ্চতার একটি ছোট পাহাড়ী শহরে। যাত্রাপথে পড়ল গুডরিক কোম্পানীর বিখ্যাত চালসা চা-বাগান। তবে সাত্যি কথা বলতে কি সুন্তালিখোলা শহরটিতে বিশেষ কিছু দ্রষ্টব্য দেখতে পেলাম না। শহরের মাঝখানে কয়েকটি দোকান ও চায়ের স্টল ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়ল না। এটা অবশ্য বলতেই হবে যে একটু নীচে নেমে একটা রাজ্যসরকার পরিচালিত সুদৃশ্য “ট্যুরিষ্ট কটেজ” রয়েছে, আর তার কাছেই রয়েছে খাড়া পাহাড়ের মাঝখানে একটি ঝর্ণার ওপরে ঝুলন্ত সাঁকো। দুঃখের কথা শীতকালে ঝর্ণায় জলের তুলনায় উপলখণ্ডের আধিক্য ছিল। মনে মনে কল্পনা করে নিলাম বর্ষাকালে সরু নদীটি কেমন স্রোতস্বিনী হয়ে উঠবে। ফেরার পথে আরেকটি দ্রষ্টব্য জায়গা ছিল “সিনক্লেয়ার্স রিট্রিট” হোটেলের সামনের পার্কটি। এখান থেকে পাওয়া যায় গরুমারা জাতীয় উদ্যান ও বনের এক পূর্ণাঙ্গের অসাঘারণ দৃশ্য।
৫) উপসংহার – জাতি, উপজাতি ও তিস্তাপারের রাজনীতি
ডুয়ার্স ভ্রমণ আমার অনেক কারণেই মনে থাকবে। একদিকে দেখলাম নানান জায়গার অতি মনোরম দৃশ্য; অন্যদিকে জানলাম স্থানীয় জন্তু-জানোয়ার ও গাছ-পালা সম্পর্কে অনেক তথ্য। কিন্তু যে বিষয়ে আমার অপ্রত্যাশিত জ্ঞানলাভ হোলো তা হচ্ছে কী ধরণের লোক উত্তর বঙ্গে বসবাস করে, এবং সেই বিভিন্ন উপজাতির সহাবস্থানের প্রতিফলন কীভাবে ভবিষ্যতের রাজনীতির ওপরে পড়তে পারে।
বলতে পারেন এটা আমার অজ্ঞতা, কিন্তু আমি শিলিগুড়িতে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে আমি একটি নিছক বাঙালী শহর দেখবো। ওখানে গিয়ে বুঝলাম যে ব্যাপারটা অতটা সহজ নয়। শিলিগুড়ির অধিবাসীদের মধ্যে রয়েছে বাঙালী ছাড়াও নেপালী, আদিবাসী ও ভারতবর্ষের নানা জায়গার মানুষের সংমিশ্রন। ফলতঃ সেখানে দেখা যায় নানা ভাষার দৈনিক পত্রিকা – বাংলা, হিন্দী, নেপালী, ইংরেজি – যাদের বেশীরভাগই শিলিগুড়ি থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। শিলিগুড়ি থেকে আমরা যত পূর্বদিকে (অর্থাৎ ডুয়ার্স অভিমুখে) যেতে থাকলাম, তত দেখতে পেলাম যে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে গুর্খার সংখ্যা কমছে ও আদিবাসীদের সংখ্যা বাড়ছে। এদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তফাৎও যে আছে তা বুঝলাম যখন লক্ষ্য করলাম ডুয়ার্সের গ্রামে গ্রামে রয়েছে ছোট ছোট গীর্জার সমারোহ। আর একটি জিনিস আমার বিশেষ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ভুটান সীমান্তে ফুন্টশোলিঙের উলটো দিকে পশ্চিম বাংলার জয়গাঁও নামে যে শহরটি রয়েছে, সেখানে আমি মাত্র দুটি সাইনবোর্ডে বাংলা হরফে লেখা দেখতে পেলাম। এবং সে দুটি লেখাও হচ্ছে সরকারী দপ্তরের সুবাদে – যেমন ধরুণ পুলিশ স্টেশন। অথচ হিন্দী ও ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড দোকানে দোকানে অজস্র – এমনকি বাঙালী মালিকানার গয়নার দোকানেও। হঠাৎ আমার সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠল পশ্চিম বঙ্গকে বিভাজন করে গুর্খাল্যাণ্ড, কামতাপুর ইত্যাদি তৈরীর তাগিদা ও উৎসাহ কোনখান থেকে আসছে। আর এটাও বুঝলাম উত্তর বঙ্গে গুর্খা ও আদিবাসীদের ক্ষমতার লড়াইয়ের উৎস কোথায়, যে কারণে প্রস্তাবিত “গুর্খাল্যাণ্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে”র সীমারেখা নির্ধারণে ও শাসনক্ষমতা বন্টনে এত অসুবিধে হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ উত্তর বঙ্গকে কোন দিকে নিয়ে যাবে তা আন্দাজ করা শক্ত, কিন্তু এ কথা স্বচ্ছন্দে বলা যায় যে আগামী বেশ কয়েক বছর ধরে এর সমস্যা বাংলার রাজধানী কলকাতাকে বেগ দেবে। আসাম, উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশের ইতিহাস ভাবলে আমার মনে হয় যে পশ্চিম বঙ্গের পার্বত্যাঞ্চল ভেঙ্গে আলাদা একটা রাজ্য বানানোর সম্ভাবনা বেশ প্রবল। এই ভাঙ্গনের প্রভাব কাটানোর একটা উপায় হতেই পারে বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও কৃষ্টির গৌরবময় ঐতিহ্যকে সামনে রেখে ও তার ওপর নির্ভর করে প্রদেশের সমস্ত বাসিন্দাদের ঐক্যবধ্য করা। কেন জানিনা আমার (স্বাভাবকুটিল?) মনে ধারণা হোলো “উত্তর বঙ্গ উৎসবের” পেছনে এমন একটা গূঢ় অভিসন্ধি উদ্যোক্তাদের অবচেতন মনে রয়েছে। আমি যখন গরুমারা জাতীয় উদ্যানের পাশের শহর লাটাগুড়িতে থাকছিলাম, তখন ওই বহুপ্রতীক্ষিত বাৎসরিক উৎসবের একটি অংশ ওখানে মঞ্চস্থ করা হচ্ছিল। একটি বিশাল প্যাণ্ডেল খাটানো হয়েছিল আমার হোটেলের সামনের রাস্তার ঠিক উল্টো দিকে। লাউড স্পীকারের সঠিক অবস্থানের কল্যাণে এক রাতে “সহজ মা”র গানের প্রোগ্রাম ঘর থেকে পুরোই শোনা গেল। পরদিন সন্ধ্যেবেলা আমি ও আমার স্ত্রী হেঁটে গেলাম কী প্রোগ্রাম তা অনুসন্ধান করতে। প্রায় সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দিনে ছিল নানান ধরণের গান (আধুনিক, রবীন্দ্রসঙ্গীত) ও অন্যান্য বিনোদনের ব্যবস্থা। আমরা যেদিন গেলাম, সেদিনের বড় আকর্ষণ ছিল উদ্ভট নামের বাংলা যাত্রা – “সিঁদুর কৌটোয় কাঁকড়াবিছে”। গিয়ে দেখি জায়গাটা লোকে লোকারণ্য; টারপলিনে ঢাকা প্যাণ্ডেল উপচে পড়ে জনতা বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। ভীড়ের একটা বড় অংশ মনে হল আদিবাসী মহিলাদের দল। দূরে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ যাত্রা দেখে বেরিয়ে আসলাম। আর মনে মনে ভাবলাম দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ রোধে বাংলা যাত্রা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কি কার্যকরী হবে?
শেষ করার আগে আরেকটা কথা না বলে পারছি না। উত্তর বাংলায় ঘুরতে ঘুরতে আমার অনেক সময়েই মনে হচ্ছিল দেবেশ রায়ের “তিস্তা পারের বৃত্তান্ত”র কথা। আমি ঠিক বাঘারুর মত চা-বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে গরুমারা জঙ্গলে মোষের বাথানে অবশ্যই যাইনি। কিন্তু চা-বাগানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বা গরুমারা জঙ্গলের প্রান্তে পোষ্যপ্রাণী চড়তে দেখে তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্তর কথা অনেক সময়েই মনে পড়েছে। ভেবেছি ও তারিফ করেছি দেবেশ রায়ের অসাধারণ খুঁটিনাটি দেখার ও বর্ণনা করার ক্ষমতা। এমন কি লাটাগুড়িতে উত্তর বঙ্গ উৎসবে যাত্রা দেখতে গিয়ে মনে পড়ে গেছে অতীতে একই উপলক্ষে দেবেশ রায়ের শ্রীদেবীর নাচের বর্ণনা। শীতকালে তিস্তা বা তোর্সার সেরকম জলের স্রোত দেখিনি – বন্যায় গ্রামকে গ্রাম ডুবে যাওয়া তো দূরের কথা। দেবেশ বাবুর নভেল শেষ হয়েছে তিস্তার ব্যারেজের বর্ণনা দিয়ে, যার লক্ষ্য জলপাইগুড়ি অঞ্চলকে গত ষাট বা সত্তর দশকের মহাপ্লাবনের পুনরাবৃত্তি থেকে বাঁচানো। সেটা কতদূর কার্যকর হয়েছে জানার জন্য বর্ষাকালে আবার উত্তর বঙ্গে ফিরে যাবার ইচ্ছে রইলো।

দীঘা ডাকছে হাতছানি দিয়ে



অতি সম্প্রতি ‘হুদহুদ’ আঘাত হানার দিন(১২-১০-১৪) আমার সিডিউল ছিল পশ্চিমবঙ্গের পুর্ব মেদিনীপুর জেলার দীঘা সমুদ্রতটে কিছু সময় কাটানো।জরুরী বার্তায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় যাত্রা একদিন পিছিয়ে দিলাম।দার্জিলিং যেমন পাহাড় পর্বত, চা-বাগান আর পাহাড়ি দৃশ্য তেমনি পশ্চিমবাংলার ঠিক বিপরীত প্রান্তে দীঘা হচ্ছে সমুদ্র সৈ্কত ও সমুদ্রতটের নৈসর্গিক দৃশ্য।

দীঘা হচ্ছে ভারতের অন্যতম স্বাস্থ্যকর ও সমুদ্রসৈ্কত।পশ্চিমবাংলার শ্রেষ্ঠতম সমুদ্র সৈকত। বড় বড় ঢেউ আর প্রচন্ড গর্জন মনকে করে দোলায়িত। আর সুর্যাস্তের অপুর্ব দৃশ্য! মনে থাকবে অনেকদিন।সমুদ্র সৈকত বরাবর ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলা ও সাগরের আছড়ে পড়া ঢেউ’র জলকণায় আপনাকে ভিজিয়ে দেবে।দারুণ রোমান্স সৃষ্টি হবে মনে!দীঘা’কে দু’টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি ‘ওল্ড’ দীঘা। এখানে সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ ও গর্জন অনেক বেশি। এটাই আসল দীঘা। এখানে গোসলের অনুমতি দেওয়া হয় না। অপেক্ষাকৃ্ত শান্ত হচ্ছে ‘নিউ দীঘা’। এখানে মাঝে মধ্যে গোসলের অনুমতি দেওয়া হয়।সাগরজলে গোসল করে অন্যরকম অনুভূতি জাগবে আপনার।

সৈকত বরাবর সারি সারি আবাসিক হোটেল পরিবেশ নষ্ট করলেও এসব হোটেল থেকে সমুদ্রের অপুর্ব দৃশ্য উপভোগ করা যায়।হোটেলের পরিমান এতো বেশি যে ভরা মৌসুমেও আবাসিক সংকট দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। দীঘা’র পাশেই মন্দারমণি সমুদ্র সৈকত। তার পাশেই তাজপুর, জুনপুট, উদয়পুর,শংকরপুর সৈকত।আরো আছে দীঘা-ওড়িশ্যা বর্ডার পেরিয়ে তালসারি সৈ্কত। এ সমুদ্র সৈ্কতগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, যে কোন এক সৈ্কতে অবস্থান করে(রাত যাপন) সবগুলো সৈকত উপভগ করা যায়।ভাড়া ট্যাক্সি পাওয়া যায় প্রচুর।

ওল্ড দীঘা’র মেরিন অ্যাকোয়ারিয়ামে জীবন্ত সাগর প্রাণী’র জগত।নিউ দীঘা’র সায়েন্স সেন্টারে সব শ্রেণি’র মানুষের বিজ্ঞান চর্চার উপকরন, তারামন্ডল। আছে অমরাবতী’র পার্ক ও তার পিছনের রাস্তায় নবনির্মিত টয় ট্রেনসহ ডিজনি পার্ক।‘অমরাবতী’র পার্কে বোটিং করা যায়।

নিউ দীঘা’র শেষ প্রান্তে উদয়পুর বিচের পাশেই বিরাট লজ ও ফুল বাগান দিয়ে সদ্য গড়ে উঠা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পর্যটন দপ্তরের টেন্টে রাত্রি যাপনের সুবর্ণ সুযোগ।তাঁবু প্রতি ভাড়া ৮০০/-।তাছাড়া সমগ্র দীঘায় বিভিন্ন মান ও দামের আবাসিক হোটেল রয়েছে।দীঘা স্টেশনের ‘রিটায়ারিং’ রুমে টিকেট দেখানো সাপেক্ষে অল্প খরচে রাত যাপন করতে পারেন।

হাওড়া থেকে এক্সপ্রেস ট্রেনে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘন্টা সময় লাগে।এছাড়া হাওড়া বা ধর্মতলা থেকে সড়কপথে বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী এসি/ভলবো/সাধারন বাস সার্বক্ষনিক চলাচল করছে। সড়কপথে কোলকাতা থেকে দীঘা পৌঁছাতে সময় লাগে ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘন্টা।

বিস্তীর্ন ঝাউবন, ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, ক্যাকটাস আর কাজুবাগানের আড়ালে উঁকি মারে সমুদ্র। মন্দারমনি আর তাজপুরের জলদা খালের মোহনা। দ’জায়গা থেকেই এই সুন্দর সঙ্গম দেখতে ভালো লাগে। নৌকায় চড়ে এপার-ওপার করা যায়।উপভোগ করা যায় লাল কাঁকড়াদের কর্মকান্ড।অতএব যাদের সময় আছে-চলুন না একটু দীঘা ও এর আশপাশের সমুদ্রটত থেকে!

আবু আফজাল মোহাঃ সালেহ
উপজেলা পল্লী উন্নয়ন অফিসার, উপজেলা পরিষদ চত্ত্বর, জীবননগর,চুয়াডাঙ্গা।
গ্রামঃ- মদনা, ডাকঘরঃ- দর্শনা, উপজেলাঃ-দামুরহুদা, জেলাঃ- চুয়াডাঙ্গা।
মোবাইল নঃ- ০১৯১৫৯৪৮৬২৩, ই-মেইলঃ-abuafzalsaleh@gmail.com

কোনার্কের সূর্যমন্দির



প্রধান সড়ক থেকে সূর্যমন্দিরে হাঁটার পথ। ৩০০ গজ হবে। মন্দিরের গেটে গিয়ে থামতে হল। টিকিট কাটতে হবে। জগদীশ দা টিকিট কাটলেন। মন্দিরে ঢুকতে চওড়া সড়ক। সড়কের দুই পাশে সবুজ পরিপাটি বাগান। এরপর মন্দিরে ঢোকার প্রধান গেট। সূর্যমন্দির। একসময় মন্দিরটি সমুদ্রের পাড়ে অবস্থিত ছিল। কথিত আছে, শ্রীকৃষ্ণর ছেলে শাম্ব এখানে সূর্য উপাসনা করে কুষ্ঠ রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এ জন্যই এটির নাম সূর্যমন্দির। মন্দিরটি আন্তর্জাতিক বিশ্ব ঐতিহ্য প্রকল্প কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ও ইউনেস্কো নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পূর্ব গঙ্গা রাজবংশের (১০৭৮-১৪৩৪) রাজা প্রথম নরসিংহদেব (১২৩৮-১২৬৪) দ্বারা নির্মিত। এক হাজার ২০০ শিল্পী ১২ বছরে এটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। পুরো মন্দিরটি পাথরের খাঁজ কেটে তৈরি করা হয়েছে। কারুশিল্পের চমৎকার নিদর্শন এই মন্দির। না দেখলে বোঝার উপায় নেই কারুকার্যের নিদর্শন এরূপ হতে পারে। মন্দিরটির উচ্চতা ২২৮ ফুট। মন্দিরের কারুকার্যে তিন রকমের সূর্যদেবতা রয়েছে। দক্ষিণ পাশের সূর্যদেবতাকে ‘উদিত সূর্য’, যার উচ্চতা ৮.৩ ফুট, পশ্চিম দিকের সূর্যদেবকে ‘মধ্যাহ্ন সূর্য’, যার উচ্চতা ৯.৬ ফুট এবং উত্তর দিকের সূর্যদেবকে ‘অস্ত সূর্য’, যার উচ্চতা ১১.৫ ফুট, আখ্যায়িত করা হয়েছে।
পুরো সুর্যমন্দিরটি একটি রথের মতো। এটি তৈরি করা হয়েছিল সূর্যদেবের পুজোর জন্য। মন্দিরে আছে ২৪টি চাকা। প্রতি চাকায় আটটি খাডি। একেকটি চাকার ব্যাস ৯.৯ ফুট।
মন্দিরের দক্ষিণ দিকের কারুকার্যে খচিত রয়েছে দুটি যোদ্ধা ঘোড়া। প্রতিটি দৈর্ঘ্যে ১০ ফুট ও প্রস্থে ৭ ফুট। পূর্ব দিকে মন্দিরে প্রবেশের মুখে দুই পাশে দুটি ঐশ্বর্যপূর্ণ সিংহ দুটি হাতির ওপর চেপে আছে। প্রতিটি সিংহ ও হাতির মূর্তি একটি পাথরের তৈরি। এটি দৈর্ঘ্যে ৮.৪, প্রস্থে ৪.৯ এবং উচ্চতায় ৯.২ ফুট। প্রতিটি সিংহ  ও হাতির ওজন ২৭.৪৮ টন। এটি মন্দিরের প্রধান গেট। এ ছাড়া মন্দিদের গায়ে অসংখ্য দেবদেবীর কারুকার্য শোভিত। প্রত্যেক দেবদেবীর রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস। তবে অধিকাংশ দেবদেবীর ক্ষয়িষ্ণু অবয়ব। আগের সেই দেহবল্লরি যেমন শোভা পাচ্ছে না, তেমনি হাত-পা ভেঙে মন্দিরটি প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্যের ক্ষয়িষ্ণু নির্মাণ দর্শন করছে পর্যটকরা। যা হোক, মন্দির পরিদর্শন শেষে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে করে না। বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। মন্দিরের শিল্পকর্ম নিয়ে যে কোন শিল্পপ্রেমীর মন ভাবনার অতলে ডুবে যাবে বারবার। তবুও সূর্যমন্দির থেকে একসময় বেরিয়ে আসতে হল। 

মোগল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র সুবাদার শাহ সুজার আমলের হোসেনী দালান

তপু রায়হান

হোসনী দালান পুরানো ঢাকায় অবস্থিত শিয়া সম্প্রদায়ের একটি ইমারত। বাংলায় নির্মিত মোগল শাসনামলের দর্শনীয় স্থাপনার মধ্যে ঢাকার হোসেনী দালান একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য নিয়ে আজও টিকে রয়েছে। দালানটি মূলত একটি স্মৃতিসৌধ। হজরত ইমাম হোসেন (রা.) এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এটি নির্মিত হওয়ার কারণে এর নামকরণও হয়েছে তারই নামানুসারে অর্থাৎ হোসেনী দালান। হোসেনী দালানটি নির্মিত হয় মোগল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র বাংলার সুবাদার শাহ সুজার আমলে। শাহ সুজা ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী শাসক। তিনি যখন সুবাদার হয়ে বাংলায় আগমন করেন, তখন তার সঙ্গে করে তিন শতাধিক শিয়া অনুচর ও তাদের পরিবার এদেশে নিয়ে আসেন। শাহ সুজার নৌবাহিনী প্রধান-শিয়া মতাবলম্বী অনুচর সৈয়দ মীর মুরাদ এই হোসেনী দালান তৈরি করেন।
কথিত রয়েছে, সৈয়দ মীর মুরাদ এক রাতে স্বপ্নে দেখতে পান, কারবালার যুদ্ধের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করছেন এবং স্বপ্নে মীর মুরাদকেও অনুরূপ একটি দালান নির্মাণের নির্দেশ দিচ্ছেন। স্বপ্নে নির্দেশ লাভ করে মীর মুরাদ ১৬৪২ খিস্ট্রাব্দ নাগাদ হোসেনী দালানটি নির্মাণ করেন। বাংলায় মোগল নির্মিত অন্য সব স্থাপনার মতো এটিও মোগল স্থাপত্য রীতি-নীতি অনুসারে নির্মিত হয়। ঢাকার নায়েব নাজিমগণ শিয়া মতাবলম্বী হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন তারাই হোসেনী দালানটির মুতাওয়াল্লী ছিলেন।
দালানের দুই দিকে রয়েছে দুইটি মিনার, দক্ষিণ দিক ঘেঁষে বিশাল পুকুর আর উত্তর দিকে প্রশস্ত মাঠের পর বিশাল গেটওয়ে। ভবনটি দ্বিতল আকৃতি বিশিষ্ট। নিচে রয়েছে কবরখানা। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে জরিখানা, হুক্কাখানা, নিশিত খাঁ নামের তিনটি কক্ষ। হোসেনী দালানটি নির্মাণের পর এখান থেকে বিভিন্ন উৎসবে জাঁকজমকপূর্ণ ও সজ্জিত মিছিল বের হতো। এছাড়া রয়েছে নহবতখানা, যেখানে প্রতিটি চাঁদ দেখার রাত থেকেই শুরু হতো নহবত বাজানো।

ত্রিপুরা


সুদীপ্ত দাস
ত্রিপুরায় বেড়াতে গেলে খুঁজে পাবেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস। ত্রিপুরার বিভিন্ন জায়গাতেই গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ছিল মেলাঘরে।
তবে শুধু ইতিহাস অনুসন্ধান নয়, ত্রিপুরার সৌন্দর্যও পর্যটকদের কাছে টানে। ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা। পরিবেশ-প্রকৃতি বাংলাদেশের সমতলভূমির মতোই, তবে আরেকটু ভেতরে ঢুকলেই গহিন অরণ্য। আছে ছোট ছোট পাহাড়, বিচিত্র জীবনধারার পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। গহিন বনে তৈরি হয়েছে ইকোপার্ক। রাজধানীর কাছেই আছে লেকের মাঝখানে মহারাজাদের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ। আরেকটু দূরে গেলে দেখা যাবে পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে তৈরি করা দেবীমূর্তি। ‘চির বসন্তকাল’ পাওয়া যাবে আরও দূরের জাম্পুই পাহাড়ে।
ঢাকা থেকে আগরতলার দূরত্ব মাত্র ৯০ কিলোমিটার। যাতায়াতও খুব সহজ এবং সস্তা। ট্রেনে বা বাসে চেপে প্রথমে আখাউড়া যেতে হবে।  আখাউড়া নেমে স্কুটার বা রিকশা নিয়ে চলে যাবেন আখাউড়া স্থলবন্দর। ইমিগ্রেশন-কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা সেরে আবারও রিকশা নিয়ে মাত্র ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরেই আগরতলা। ঢাকা থেকে আগরতলা সরাসরি বিআরটিসির বাসও চলে, তবে তা প্রায়ই বন্ধ থাকে। সব মিলিয়ে সকাল ৭টায় রওনা দিলে সকাল ১১টার মধ্যেই আগরতলা পৌঁছে যাবেন।
হোটেলে উঠে দুপুরের খাবার আর কিছুক্ষণ দিবানিদ্রার পর বিকেলে বের হয়ে পড়ুন আগরতলা শহর দেখতে। অবশ্যই দেখতে যাবেন অতীতের মহারাজাদের উজ্জয়নী প্রাসাদ, যা এখন বিধানসভা ভবন। শহরের উত্তরে নেহরু পার্কে কাটিয়ে আসতে পারেন কিছুক্ষণ। আবার দক্ষিণে ফুল আর সবুজে ছাওয়া রবীন্দ্র কাননে গিয়ে দেখে আসতে পারেন পুতুলনাচ।
পরদিন সকালে শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে রুদ্রসাগর লেকে নীরমহল প্রাসাদ দেখার পালা। শহর থেকে বাসেই যেতে পারবেন। নৌকায় লেক পাড়ি দিয়ে মাঝখানের প্রাসাদে যেতে হবে। মুঘল আর হিন্দু স্থাপত্যকলায় নির্মিত এক অনুপম সুন্দর এই প্রাসাদ। নীরমহল প্রাসাদ দেখে চলে যাবেন সেখান থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরের মেলাঘরে।
মেলাঘর থেকে ফিরে এসে সেদিনকার বিকেলটাও আগরতলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে কাটিয়ে দিন। পরদিন সকালে চলে যাবেন ‘চির বসন্তকালের জাম্পুই পাহাড়ে। জায়গাটা আগরতলা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে, মিজোরাম সীমান্তের কাছে। মেঘের সঙ্গে কোলাকুলি করতে করতে পৌঁছে যাবেন প্রায় ৩ হাজার ফুট উঁচু এই পাহাড়ে। পথে চারদিকে পড়বে কমলালেবুর গাছ।
জাম্পুই পাহাড়ের বৈশিষ্ট্য এর আবহাওয়া। সারা বছরই প্রায় বসন্তকালীন তাপমাত্রা, শীত-গ্রীষ্মের পার্থক্য খুব বেশি নয়। গ্রীষ্মে শুধু বৃষ্টি আর মেঘ। এই পাহাড়ে মূলত লুসাই উপজাতির বাস। জাম্পুই পাহাড়ে রাত কাটিয়ে আসতে পারেন, সেখানে আছে সরকারি মোটেল। স্থানীয় লুসাইদের কারও বাসাতেও থাকতে পারবেন ‘পেয়িং গেস্ট’ হয়ে।
আবারও আগরতলায় ফিরে এসে পরদিন প্রায় পৌনে দুইশ কিলোমিটার দূরের ঊনকুটি দেখতে যেতে পারেন। ট্রেনে বা বাসে কাইলাশহর জেলা সদর, সেখান থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের গায়ে পাথর খোদাই করে বানানো এই মন্দির। আগরতলা থেকে বেশি দূরে যেতে না চাইলে ২৫ কিলোমিটার দূরের সিপাহিজালা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম দেখে আসতে পারেন। আরেকটু দূরে গোমতী অভয়ারণ্য। আর তৃষ্ণা অভয়ারণ্যের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার।
ফেরার পথে আগরতলা থেকে সকালে রওনা দিলে দুপুরেই পৌঁছে যাবেন ঢাকা। 

দার্জিলিং যাবেন কিভাবে? কোনপথে?


এম খোরশেদ আলম
দেশ দেখে বেড়ানোটা আনন্দের। কিন্তু সেটা যদি হয় আর্থিক সঙ্গতির মধ্যে, তবেই তা সম্ভব। বিভিন্ন মানুষের দেশ দেখে বেড়ানো বিভিন্ন রকম। বিলাসবহুল জীবনযাপন যারা করেন তারা একটু আভিজাত্যের ছাপ রেখেই দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে বেড়ান। কিন্তু সবার সঙ্গতি তো আর সমান নয়। আর সমান নয় বলেই কি দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করা যাবে না?
যাবে। অবশ্যই যাবে। চারদিক থেকে নিজের আভিজাত্যকে একটু কাটছাঁট করে নিলেই তা সম্ভব। স্বল্প খরচে, অল্প আরামে মনটাকে মানিয়ে নিতে পারলেই আমাদের চোখের সামনে খুলে যাবে সৃষ্টির অনেক অজানা দুয়ার। আর সেই দুয়ার খুলেই চলুন চট করে বেড়িয়ে আসা যাক, হিমালয়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ছবির মতো সুন্দর স্বপ্নপুরী দার্জিলিং থেকে।
কিভাবে যাবেন?
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিভোর নগরী পাহাড়ে ঘেরা অপূর্ব চিরহরিৎ ভূমির দার্জিলিংয়ে স্থলপথে রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি দার্জিলিং যেতে চাইলে উত্তরবঙ্গের বুড়িমারি সীমান্ত অতিক্রম করে যাওয়াটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক। ঢাকার গাবতলী থেকে প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীবাহী বাস চলাচল করে উত্তরবঙ্গের বুড়িমারী সীমান্তের উদ্দেশে। ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস থেকে পাসপোর্টে নির্দিষ্ট সময়ের ভিসা নিয়ে রাত ১০টার সুপার সেলুন চেয়ার কোচে উঠে পড়–ন বুড়িমারী সীমান্তের উদ্দেশে। ভাড়া জনপ্রতি আর কত সামর্থের মধ্যেই। ভোর ৭টা নাগাদ আপনি অনায়াসে পৌঁছে যাবেন বুড়িমারী চেকপোস্টে। ইমিগ্রেশন অফিসের কাছেই সব বাস থামে। প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করে ইমিগ্রেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পন্ন করে নিন ভ্রমণ কর ও কাস্টমসের সব প্রক্রিয়া। অবশ্য আপনি চাইলে ঢাকা থেকেই ভ্রমণ কর প্রদান করে যেতে পারেন সোনালী ব্যাংকের যে কোন শাখায়। বুড়িমারী অতিক্রম করে ওপারে চ্যাংড়াবান্দা সীমান্তে পৌঁছে একইভাবে সম্পন্ন করে নিন আপনার ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের সব প্রক্রিয়া। ও ভালো কথা, আপনার বহনকৃত ইউএস ডলার চ্যাংড়াবান্দায় অবস্থিত সরকার অনুমোদিত ডিলারদের কাছ থেকেই ভারতীয় মুদ্রায় পরিবর্তন করে নেবেন। অন্যথায় পরবর্তী সময়ে টাকা ভাঙাতে আপনাকে বেশ বেগ পেতে হবে।
চ্যাংড়াবান্দা থেকে সরাসরি ময়নাগুড়ির বাস ধরে দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন শীর্ষেন্দু-সমরেশের উপন্যাসখ্যাত শিলিগুড়ি জিপ স্টেশনে। ভাড়া জনপ্রতি ৭০ ভারতীয় রুপি। সেখান থেকে ঝটপট ১২০ ভারতীয় রুপির বিনিময়ে সংগ্রহ করে নিন দার্জিলিংগামী কমান্ডার জিপের টিকিট। হাতে শীতের পোশাক নিয়ে বসে পড়–ন আপনার নির্ধারিত আসনে। ব্যস, মাত্র আড়াই ঘণ্টায় আপনি পৌঁছে যাবেন মেঘের দেশ স্বপ্নিল ভুবনের দার্জিলিংয়ে।
তাছাড়া কলকাতা থেকে যেতে চাইলে আপনাকে শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটের দার্জিলিং মেল ধরতে হবে। টিকিট সংগ্রহ করবেন ট্যুরিস্টদের জন্য নির্ধারিত কাউন্টার ফেয়ারলি প্যালেস থেকে। অতঃপর প্রায় ৫৭৬ কিলোমিটার অর্থাৎ ১৪ ঘণ্টার এক ট্রেন ভ্রমণ করে পরদিন সকাল ১০টা নাগাদ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে যাবেন। স্টেশন থেকে প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করে রিকশাযোগে চলে আসুন শিলিগুড়ি জিপ স্টেশনে। ১০-১২ রুপি ভাড়া পড়বে।  সেখান থেকে ওই কমান্ডার জিপে চড়ে পৌঁছে যেতে পারেন স্বপ্নপুরী দার্জিলিংয়ে।

কোথায় থাকবেন?
পুঞ্জীভূত মেঘের কণা ভেদ করে আঁকাবাঁকা পথের ধারে পুরো দার্জিলিং শহরে রয়েছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোটেলে প্রতিদিনের থাকা এবং খাওয়াসহ জনপ্রতি ভাড়া প্রায় ৮৫০-১২০০ রুপি করে। প্রায় প্রতিটি হোটেলেই রয়েছে দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুরে বেড়ানোর জন্য আকর্ষণীয় জিপ, সার্বক্ষণিক গরম পানির ব্যবস্থা, ঠাণ্ডা প্রতিরোধে ওষুধসহ যে কোন মুহূর্তে যে কোন সমস্যার তাৎক্ষণিক সেবা।
খাবার-দাবার
ট্যুরিস্টদের জন্য হোটেলগুলোতে সব ধরনের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে পুষ্টিকর ও রুচিসম্মত খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য ট্যুরিস্টের আগমনের ফলে এখানকার হোটেল মালিকরা বাংলাদেশীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় একেবারে বাঙালি রুচিসম্মত খাবার-দাবারের জোগান দিয়ে থাকেন। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনার ছাড়াও হোটেল কর্তৃপক্ষ ভোরবেলায় বেড-টি এবং ডিনারের আগে ইভনিং-টি’র ব্যবস্থাও করে থাকেন।
কোথায় বেড়াবেন?
ছোট বড় মিলিয়ে বেড়ানোর জন্য প্রায় ১৭টি আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে দার্জিলিং জুড়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত রেলওয়ে স্টেশন ‘ঘুম’ ছাড়াও আরও যেসব দর্শনীয় স্থান দেখে আপনার আনন্দময় অভিজ্ঞতা অর্জিত হবে তা হচ্ছে;
সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে অপূর্ব  সুন্দর সূর্যোদয় দেখা। পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনা-স্থান ঘুম মোনাস্ট্রি। ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ বাতাসিয়া লুপ বিলুপ্ত-প্রায় পাহাড়ি বাঘ Snow Lupard খ্যাত দার্জিলিং চিড়িয়াখানা। পাহাড়ে অভিযান শিক্ষাকেন্দ্র  ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট’।
সর্বপ্রথম এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং-রক- এর স্মৃতিস্তম্ভ। কেবল কারে করে প্রায় ১৬ কিলোমিটার এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ভ্রমণ।
হ্যাপি ভ্যালি টি গার্ডেনে বসে তাৎক্ষণিকভাবে পৃথিবীখ্যাত ব্ল্যাক টি পানের অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থী কেন্দ্র  তিব্বতিয়ান সেলফ হেলপ্ সেন্টার। সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে প্রায়  ৮,০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত মনোরম খেলাধুলার স্থান দার্জিলিং গোরখা স্টেডিয়াম।
নেপালি জাতির স্বাক্ষর বহনকারী দার্জিলিং মিউজিয়াম। পৃথিবীর বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার জাপানিজ টেম্পল ব্রিটিশ আমলের সরকারি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র  কাউন্সিল হাউস ‘লাল কুঠির’ অসাধারণ শৈল্পিক নিদর্শন খ্যাত ‘আভা আর্ট গ্যালারি’। শতবর্ষের প্রাচীন মন্দির ‘দিরদাহাম টেম্পল’। এসব নিদর্শন ছাড়াও আপনার মনের চিরহরিৎ জগতকে শুধু আনন্দময় নয়, এক নতুন জীবনের যাত্রা শুরু করাতে চলে যেতে পারেন পাথর কেটে তৈরি ‘রক গার্ডেন’ এবং গঙ্গামায়া পার্কে উপরোল্লিখিত দর্শনীয় স্থানগুলো ছাড়াও আপনার হদয় গহিন থেকে রোমাঞ্চিত করবে মহান সৃষ্টিকর্তার বিশাল উপহার হিমালয় কন্যা ‘কাঞ্চন-জংঘা’, বিশুদ্ধ পানির অবিরাম ঝর্ণাধারা ‘ভিক্টোরিয়া ফলস্’ এবং মেঘের দেশে বসবাসরত এক সুসভ্য জাতির সংস্কৃতি।
কেনাকাটা
দার্জিলিং শহরের লাডেন-লা রোডের কোল ঘেঁষে রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় মার্কেট। দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য প্রায় সব জিনিসই আপনি পেয়ে যাবেন আপনার ক্রয়- ক্ষমতার মধ্যে। সবচেয়ে ভালো পাবেন শীতের পোশাক। হাতমোজা, কানটুপি, মাফলার, সোয়েটারসহ যে কোন প্রকারের লেদার জ্যাকেট পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দমতো মূল্যে। তাছাড়া ১০০ থেকে ৫০০ রুপির মধ্যে পেয়ে যাবেন অসাধারণ কাজ করা নেপালি শাল এবং শাড়ি যা আপনার পছন্দ হতে বাধ্য। প্রিয়জনকে উপহার দিতে সর্বনিু ২০ রুপি থেকে ২৫০ রুপির মধ্যে পেয়ে যাবেন বিভিন্ন অ্যান্টিক্স ও নানাবিধ গিফট আইটেম, যা আপনার প্রিয়জনের ভালোবাসা কেড়ে নিতে সক্ষম। তাছাড়া আকর্ষণীয় লেদার সু আর বাহারি সানগ্লাস তো আছেই। কেনাকাটা করতে গিয়ে প্রতারিত হওয়ার আশংকা একেবারেই নেই। তবে হোটেলগুলোতে কিছু নেপালি তরুণ-তরুণী ভ্রাম্যমাণ ফেরি করে শাল, শাড়ি বিক্রয় করে থাকে। তাদের কাছ থেকে না কেনাটাই উত্তম।
ঝুঁকি
মানুষের জীবনটাই একটা বড় ঝুঁকি। তার পরেও সাবধানতা অবলম্বন করে ঝুঁকি এড়িয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকার প্রয়াস পেয়েছে মানুষ দীর্ঘকাল। দার্জিলিং ভ্রমণেও ছোটখাটো কিছু ঝুঁকি রয়েছে। মাঝে-মাঝেই পাহাড়ি অঞ্চলে  ছোটখাটো ধস নামে। তবে সেটা বেশি হয় বর্ষা মৌসুমে। শীত বা গরমে সে ঝুঁকিটা একেবারেই নেই। আর গরম জামাকাপড় ব্যবহারে অবহেলা না করলে ঠাণ্ডা লাগার ঝুঁকিটাও কমে যায় একেবারেই। তাছাড়া হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সবরকম বিষয়ে পরামর্শ করে চলাফেরা করলে স্থানীয় দালাল বা হারিয়ে যাওয়ার আশংকা থেকেও আপনি পেয়ে যাবেন পুরোপুরি মুক্তি।
মোট খরচ
স্বল্প খরচে, অল্প আরামে মনটাকে মানিয়ে নিতে পারলে শীত মৌসুমে মাত্র ১০,০০০ টাকার মধ্যেই আপনি সেরে নিতে পারেন স্বপ্নপুরী দার্জিলিং দেখার যাবতীয় কার্যক্রম। ভালো কথা, এ হিসাবটা শুধু  বুড়িমারী সীমান্ত পথের। কলকাতার শিয়ালদহ হয়ে গেলে এ হিসাব বেড়ে দাঁড়াবে সর্বসাকুল্যে ১৫০০০ টাকায়। আমাদের দেশে রয়েছে অসংখ্য ট্যুরিজম কোম্পানি, যারা দার্জিলিংসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্যাকেজ ট্যুরের আয়োজন করে থাকে।
আশপাশে
দার্জিলিং শহর থেকে কিছুটা দূরে নেপাল শহরের নিকটবর্তীতে অবস্থান করছে মিরিক লেক ও পশুপতি মার্কেট। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টার মধ্যে জনপ্রতি ৪৫০ রুপি ভাড়ার মধ্যে আকর্ষণীয় জিপে ঘুরে আসতে পারেন। সেজন্য অবশ্য আরও একটি দিন বেশি অতিবাহিত করতে হবে দার্জিলিং শহরে। তবুও যাত্রার দিন থেকে নিয়ে সর্বমোট ৫ দিনেই সবকিছু ঘুরে-ফিরে আসতে পারবেন আপনার প্রিয়জনদের মাঝে অপূর্ব স্বপ্নিল অভিজ্ঞতা নিয়ে।
MAIN LINK

দ্রুক অথবা থান্ডার ড্রাগনের দেশে


ইশতিয়াক আহমেদ
গত বছরের আগের বছর নেপাল ট্যুরে বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হওয়ার পর গত বছর বিমান ভ্রমণের আনন্দ প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। ভাবখানা এমন বিমানে চড়তে আর ভাল্লাগেনা।
আচ্ছা, ভুটানে কী রিকশায় চড়ে যাওয়া যাবে না?
ছয় সদস্যের হারাধনের পুত্রসম দল নিয়ে এয়ারপোর্টে যখন বোর্ডিং পাস নিতে এসেছি তখন আমার এক আÍীয়কে অকৃতকার্য ঘোষণা করে দিল বিমান কর্তৃপক্ষ। তিনি যেতে পারবে না। তার পাসপোর্টের মেয়াদ পর্যাপ্ত নেই। দ্রুক এয়ারের কবীর ভাই অনেক চেষ্টা করেছেন কিছু একটা করার জন্য। কিন্তু যে বিপদে আমরা আটকে ছিলাম তা কাটিয়ে দেয়ার ক্ষমতাটা তার হাতে ছিল না। তাকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
এমন একটা সময়ে ঘটনা ঘটল যখন মন খারাপ করার মতো পর্যাপ্ত সময়ও আমাদের হাতে ছিল না।
এক প্রকার অমীংমাসিত বিদায় আমাদের মধ্যে হল। আমি পাসপোর্ট আগে খেয়াল করিনি। হারাধনের একজন কমে যাওয়ার পর বাকিরাই বিষন্নতা নিয়ে বিমানে গিয়ে উঠলাম।
বিমানে ওঠার পর থেকে মন খারাপের সূচনা হল এবং দীর্ঘক্ষণ অবস্থান নিল। সবারই মন খারাপ।
আমার মন খারাপটা কিছুক্ষণের মধ্যে মেজাজ খারাপে রূপ নিল। কারণ আমার পাশে থাকা দুই বিদেশী। এশিয়ার অনেকগুলো দেশের চক্ষু মোবারক দৃশ্যমানের চেয়ে বেশি ছোট হওয়ায় ঠিক আন্দাজ করা যায় না তারা কোন দেশের? এমনকি এটা আন্দাজ করা যায় না কে কোনটা?
তাদের ব্যাপারে ধারণার ওপর চলতে হয়। আমিও করলাম। যেহেতু এরা ট্রানজিট যাত্রী ব্যাংকক থেকে এসেছে তাই ধরে নিলাম তারা থাই স্যুপের দেশ থাইল্যান্ডের অধিবাসী।
থাই স্যুপ যত প্রিয় এরা ততই বিরক্তিকর ছিল। কিছুক্ষণ পর পর দাঁত কেলিয়ে হাসে আর ভাষার সুবিধা নিয়ে কি যেন বলে। আমি বুঝি না বলেই বোধহয় বেশি কথা বলে।
আমি তাদের হাসাহাসির ক্রসফায়ার থেকে বাঁচতে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিতেই জানলাম আমরা এসে গেছি।
মাত্র ৫০ মিনিটেই ভুটান। কিংডম অব রয়েল ভুটান।
২.
আমরা দ্রুক এয়ারওয়েজের একটি বিমানে করে নামলাম পারো এয়ারপোর্টে। পারো তাদের একটি শহরের নাম। জানা মতে, এটা পৃথিবীর ছোট এয়ারপোর্টগুলোর অন্যতম। এখানে রানওয়ের  দৈর্ঘ্য অনেক কম। বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত বৈমানিকরাই এই বিমানে চাকরি করেন। যাই হোক প্রতিদিনের মতো তাদের কারসাজিতে এবার আমরাও নিরাপদে নামলাম।
নেমেই চারদিকে তাকাতে যে শব্দ মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, অসাধারণ।
মনে হল ধনীর বাড়ির গোছানো ড্রইংরুম। যার উপরের দিকে আকাশের একটা অসামান্য চিত্রকর্ম ঝুলছে। আকাশ এত যে সুন্দর হতে পারে তা এই প্রথম জানা হল। আমাদের শরতের আকাশ দেখে আমরা এত মুগ্ধতায় আবিষ্ট যে থাকি তার চেয়ে কয়েকগুণ অসাধারণ আকাশ সেটা বলতে দ্বিধা নেই।
প্রকৃতির যতœ নিলে প্রকৃতি যে তার নিজের ভালো চেহারাটাই দেখায় ভুটান তার বড় প্রমাণ।
আমরা বিমানবন্দরে নেমেই দেখলাম রাজারা দাঁড়িয়ে। পুরুষানুক্রমে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে বাস্তবে নয় বিলবোর্ডে। এরা হচ্ছেন, উগিয়েন ওয়াংচুক, জিগমে ওয়াংচুক, জিগমে দর্জি ওয়াংচুক, জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক শেষ জন বর্তমান ক্ষমতায় থাকা এবং সম্প্রতি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া রাজা জিগমে খেচার নাগেয়াল ওয়াংচুক। বিগত ১০৪ বছর  ধরে যারা এই দেশকে ক্রমে শান্তির দেশে পরিণত করে গেছেন।
তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা প্রদর্শনপূর্বক আমরা ইমিগ্রেশনে ঢুকলাম।
ভুটানের প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে একটা বিষয় বারবার দৃষ্টিতে চলে আসছিল তাদের পোশাক। সবাই একই পোশাক পরে ঘুরছে। কে পুলিশ, কে কাস্টমকর্মকর্তা, কে কুলি,  কে মজুর কিছুই বুঝি না। সব এক পোশাক। যে কারণে কুলিকে পুলিশ ভেবে ভুল করে ফেলার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম একবার।
যাই হোক আমরা বিমানবন্দরে সব চেকআপ সেরে মূল ভুটানে পা রাখার জন্য ক্রমশ ব্যাকুল হয়ে উঠছিলাম।
৩.
আমি সাধারনত কেনা জামাকাপড়ই পরি। বানানো পড়ি কম। তাই দেশে খুব একটা পরিচিত দর্জি আমার নেই। বিদেশেও ছিল না। ভুটান যাওয়ার আগ পর্যন্ত। ভুটানের মূল মাটিতে পা রাখতেই এক দর্জির সঙ্গে পরিচয় হয়। নাম, সেতেন দর্জি। অসম্ভব বিনয়ী নম্র-ভদ্র এক চরিত্র। যার সঙ্গেই পরের কয়েকদিন আমার গড়ে ওঠেছিল অসম্ভব সখ্য। সে আমাদের গাইড। ট্যুর অপারেটর।
দর্জির সঙ্গে নিয়ে আসা গাড়িতে করে আমরা প্রথমেই হোটেলে যেতে পারলাম না। আমাদের আজকের হোটেল এই পারো শহরে নেই। আমাদের হোটেল বুক করা থিম্পুতে। পারোতে আমাদের দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে এখানে দেখে যেতে হবে তাদের ন্যাশনাল মিউজিয়াম।
প্রথমে আমরা খেতে গেলাম। পারোর একটা হোটেলে আমাদের খাবার ব্যবস্থা। খাবার ইন্ডিয়ান ঘরানার। খাবার-দাবার নিয়ে আমার সমস্যা পুরনো। খেতে পারি না। তাই কোন মতে মাছের জায়গায় আলু, ঝোলের জায়গায় ঢাল দিয়ে খাওয়া সারলাম। বাইরে গেলে মাংস খেতে সবচেয়ে সমস্যা হয়। তাই মাংস অধরাই রয়ে গেল।
খাওয়া-দাওয়া শেষে আমরা গেলাম ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। যাওয়ার যে পথ, তা সুন্দর কোন কবিতার মতো। যেখানে যেমন হওয়ার কথা তেমনই। পুরোটাই পাহাড়ি পথ। উঁচু-নিচু। হঠাৎ বাঁক। আর পথের পাশজুড়ে ছোট নদী। ভুটানজুড়েই নদী। দর্জি এই নদী নিয়ে বেশ বাহাদুরি ঝাড়তে চেয়েছিল। বলল, ভুটানজুড়ে প্রায় শতাধিক নদী আছে।
আমি দর্জির অহংকারকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ফেলে দিলাম। বললাম, আমাদের দেশে হাজার বারোশ’ নদী। এবং একেকটা সমুদ্রের মতো বিশাল।
দর্জি চুপশে গেল। আমিও ভয়েছিলাম, ভাবছিলাম দর্জি যদি জিজ্ঞাসা করে বসে তোমাদের নদীর পানি কী এতইটাই স্বচ্ছ?
আমি কী করে অস্বীকার করতাম যে আমাদের কালো পানি না।
আমরা নদীর স্রোতের মতোই গাড়িতে ভেসে ভেসে চলে এলাম ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। ছোট্ট একটা মিউজিয়াম। পুরোটাই ঠাসা তাদের কৃষ্টি আর ঐতিহ্যের দ্রব্য সামগ্রীতে। দেখে দেখে কোথাও অবাক। কোথাও মুগ্ধও হলাম। জানলাম তাদের পোশাকের রহস্য। রাজা থেকে পিয়ন পর্যন্ত একই ড্রেস পরলেও পার্থক্য তাদের কাপড়ের রঙে।
সব দেখে এবার রওনা হলাম থিম্পুর দিকে। ঘণ্টা তিনেকের পথ। পুরো ভুটানটাই পাহাড়ের মাঝে। আমাদের হোটেল অপেক্ষা করছে সেখানে। আবার আমরা গাড়িতে। পাশাপাশি দুটো মাইক্রোবাস দর্জির তত্ত্বাবধানে চলছে একই সঙ্গে। মসৃণ রাস্তায় গাড়িগুলো থেকে তেমন কোন ইঞ্জিনের শব্দ না এলেও কিছুক্ষণ পর শুধু শব্দ আসছিল, বাহ বাহ।
বুঝলাম, ভুটানে মুগ্ধ বাঙালি সমাজ।
৪.
হোটেলে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ভাবলাম ঘুম দিতে হবে। কিন্তু মজার বিষয় সে খাতা শূন্য। এত সুন্দর নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ক্লান্তির রেশও নেই শরীরে। বিকেলটা কাটল কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে থিম্পু দেখে, বাকিটা দর্জির সঙ্গে আড্ডা দিয়ে। দর্জির কাছে জানলাম তাদের ভুটান সম্পর্কে। রাজার প্রতি নিগূঢ় আনুগত্য এবং অগাধ দেশপ্রেম যাদের প্রায় স্বর্গে রেখেছে। অপরাধের বালাই নেই। ক্রাইম রেট জিরো পার্সেন্ট। সে কথার প্রাথমিক সত্যতা পেলাম ঘরবাড়ির দিকে খেয়াল করে, কোন ঘরে এমনকি কোন হোটেলেও দরজা নেই। ভয় নেই চোর-ডাকাতের। কারণ সেসব তাদের দেশে নেই।
পরদিন আমরা গেলাম, এক স্তুপাতে। নাম, দচুলা পাস।  ১০৮টি স্তুপার সমন্বয়ে তৈরি। ১০৮ কে এখানে সৌভাগ্যের নম্বর ধরা হয়। নির্মাণশৈলীর কারণে এই স্তুপা দেখার মতো। দেখার মতো অনেক উঁচুতে স্তুপার নিচে মেঘের খেলা। অন্ধকার বানিয়ে দিয়েছিল স্তুপার চারপাশ। অনেককে ট্রাই করতে দেখলাম মেঘ ধরার। এক দম্পতির দিকে তাকিয়ে দেখলাম স্বামী হাতে করে মেঘ এনে দিচ্ছে স্ত্রীকে। ভেতরে কিছু না থাকলেও স্ত্রী স্বামীর মেঘকে কার্যকর প্রমাণ করতে সে মেঘ মুখে মাখার অভিনয় করল। আমার মতো পাশ থেকে আরেক বাঙালি লক্ষ্য করছিল বিষয়টা। তিনি বলে উঠলেন, হুদাই।

স্তুপা থেকে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে আমরা গেলাম একটা ক্যাফেটেরিয়ায়। অনেক দামে বিক্রি হয় সব। ভুটানে সব কিছুরই দাম মূলত বেশি। তাদের টাকার মান ইন্ডিয়ার মতো হওয়ায় খরচটা আরেকটু বেশি গায়ে লাগল। ক্যাফেটেরিয়া থেকে আমরা গেলাম বৃহত্তম বৌদ্ধ মূর্তি দেখতে। পথিমধ্যে সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া  ভুটানের সর্ব বৃহৎ মর্কেটে কেনাকাটা করতে।
কেনাকাটা শেষ করে গেলাম বিশালায়তন গৌতমের মূর্তির কাছে। এত বড় মূর্তি! চোখ ছানাবড়া অবস্থা। এত বড় মূর্তি হয় নাকি? সম্পূর্ণ ব্রোঞ্জে নির্মিত এই গৌতম বৌদ্ধকে থিম্পু শহরের সব প্রান্ত থেকে দেখা যায়। বুদ্ধকে দেখা শেষে আমাদের গন্তব্য ভুটানের জাতীয় প্রাণী টাকিন দেখার জন্য। মিশ্র গড়নের এই প্রাণী দেখার আগ্রহ ছিল সবারই। কারণ এর মুখটা ছাগলের মতো এবং দেহ গরুর মতো।
টাকিনের পর আমরা চলে গেলাম সর্ববৃহৎ কাঁচাবাজার দেখতে। সেখানে কাঁচাবাজার দেখার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা বোনাস পেলাম। সেখানে পেলাম রিয়েলিটি শো দ্রুক সুপারস্টার বিজয়ী, উলাপ লেকি। দর্জি আমাকে দেখালেন।
বাজারের একপাশে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানেই গাড়ি পার্ক করালেন দ্রুক সুপারস্টার। আগ বাড়িয়ে ডাক দিলাম। অত্যন্ত ভদ্রলোক। এগিয়ে এলেন। তিনি উপভোগ করছেন, তার প্রতি মানুষের আকর্ষণ। মেয়েরা তাকাচ্ছে। আশপাশের মানুষও দেখছে। আমার সঙ্গে মিনিট তিনেক কথা বলে চলে গেলেন উলাপ। উলাপ যাওয়ার পর দর্জিকে জিজ্ঞাসা করলাম এত মানুষ এখানে তাকে দেখলো কেউ কাছে এলো না কেন?
দর্জি জানাল, এখানে সবাই সমান। সেলিব্রেটিকে তার সম্মান দেয়া হয়। কিন্তু তাকে নিয়ে হৈচৈ করা হয় না। রাস্তায় তাকে নিয়ে এমন কিছু করা হয় না যাতে অন্যদের সমস্যা তৈরি হয়।
আমি শুনে বোকা বনে গেলাম। হাতে থাকা চকোলেটের প্যাকেটটা আনমনে ফেলে দিয়ে দর্জির দিকে তাকিয়ে রইলাম। এতক্ষণ চুপ থাকা দর্জি কেন হঠাৎ হেসে উঠল। তার হাসির রহস্য বুঝলাম না। হঠাৎ দেখলাম সে নিচু হয়ে আমার ফেলে দেয়া চকোলেটের কাগজটা তুলল। এবং জানালো, আমাদের দেশে এগুলোও হয় না।
আমি আগের ঘটনায় অবাক হলেও এবার লজ্জা পেলাম।
থিম্পু ঘুরে আরেকটা যে জিনিস খুব চোখে পড়ল ভুটান সাজছে। দর্জিকে জিজ্ঞাসা করতেই জানাল রাজার বিয়ে।
জানাল বিয়ের পরদিন তিনি আমাদের সকার গ্রাউন্ডে আসবেন। মানুষের শুভেচ্ছা নিতে।
আমি দর্জির কাছ থেকে একটি দাওয়াত চেয়ে নিয়েছিলাম। তাদের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুকের বিয়েতে আমি আসব। অক্টোবরের ১৫ তারিখ। সেদিন থিম্পুর ফুটবল স্টেডিয়ামে জনগণের সামনে আসবেন রাজা এবং তার নবপরিণীতা বধূ জেটসান পেমা।
দর্জি আমাকে সেই স্টেডিয়াম এবং সেখানে অনুষ্ঠিত হবে এমন সম্ভাব্য সব বিষয়-আশয় জানিয়েছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আমরা ১৫ তারিখ আগে আগে ঢুকে স্টেডিয়ামের কোনদিকে বসব এবং কোথা থেকে ভালোভাবে দেখা যাবে সব ঠিক করে রেখেছিলাম।
কিন্তু আর যওয়া হয়নি। তবে দোয়া ছিল এই গণমানুষের রাজার প্রতি।
আমি গাড়িতে উঠলাম হোটেলে যাব। কাল সকালে আমাদের যেতে হবে পারোতে।
৫.
আবার সেই পুরনো মুগ্ধ পথ বেয়ে সকালেই চলে এলাম পারোতে। এখানে থাকব একদিন। কাল চলে যাব। পারোটা খুব সুন্দর একটা শহর। ভুটানের মুখ। থিম্পসু নদীর পাশ ঘেঁষে আমরা চলে এসেছি এখানে। এখানে আমাদের একাধিক জিনিস দেখতে যেতে হবে। টাইগার নেস্ট। ফস্ট্রেচ অব ভিক্টরি। এবং ভুটানের সবচেয় বড় বৌদ্ধ মন্দির। সবগুলোই একে একে দেখতে হল। টাইগার নেস্ট অনেক দূর থেকে দেখতে হল কারণ এটা উঠতে লাগে তিন ঘণ্টা। নামতে দুই। শেষ রাত তাহলে ওখানেই কাটাতে হতো। যাই হোক ঘুরে-ফিরে ভুটানের দিনগুলো শেষদিকে চলে এলো। রাতে দীর্ঘক্ষণ দর্জির সঙ্গে আড্ডা মেরে ঘুমাতে গেলাম, মনটা কেন জানি বিষন্ন হয়ে উঠছে।
এই ভালো মানুষের দেশ ছেড়ে যেতে হবে। ৭ লাখ মানুষের দেশ। কি গোছানো। কী সুন্দর মানসিকতায়পূর্ণ। এক দর্জিই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। অভাব হয়তো আছে তাদের। কিন্তু অভিযোগ নেই। নিজের প্রেমিকার মতো ভালোবাসে তাদের রাজাকে। নিরীহ আর শান্ত  মেজাজের এই মানুষগুলোর প্রতি একধরনের শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এলো।
আর সারা দিনের  ক্লান্তিতে নত হয়ে এলো চোখ।
৬.
পারো এয়ারপোর্টে এসে শেষবারের মতো দর্জির সঙ্গে কথা বললাম। বিদায় জানালাম দর্জিকে। ভুটানকে। অবাক করা নীতির এক দেশকে। যাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চেয়ে জাতীয় সুখই মূল বিষয়।
এই তিন-চারদিনের সুখ শেষে আবারও বিমানে উঠলাম। বিমান যতই ভুটানের সীমানা ছাড় ছিল আমার ভেতর থেকে কী যেন ততই কমে যাচ্ছিল। কি সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
না বুঝলেও অনুমান করলাম, হয়তো সুখ। 

মোহময়ী পিরামিড


রফিকুল ইসলাম
ধু ধু মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। পথিক পথ চলে আর ভাবে কারা নির্মাণ করেছিল এই অট্টালিকা! কীভাবে নির্মাণ করেছিল! এটি কি মানুষের তৈরি নাকি অন্য কোন গ্রহ-নক্ষত্রের বুদ্ধিমান প্রাণী নির্মাণ করেছে এ পরম রহস্যময় কীর্তি! এ প্রশ্নের কোন শেষ খুঁজে পায়নি পথিক।
যা নিয়ে কালে কালে রচিত হয়েছে অজস  কথা উপকথা। অবাক কৌতূহল নিয়ে মানুষ বারে বারে ছুটে গেছে তার পানে, তার নির্মাণ কাঠামো আর বিশালত্বের কাছে মাথা নুইয়ে এসেছে। তবুও বিস্ময়ের শেষ হয়নি। এটি আর অন্য কিছু নয় মিসরের পিরামিড। পিরামিড এমন এক স্থাপনা যার বিস্ময়ের বুঝি শেষ নেই।
পিরামিড শব্দটি প্রাচীন গ্রিকদের দেয়া নাম। গ্রিক ভাষায় পিরামিড শব্দের অর্থ হল খুব উঁচু। পিরামিড হল পাথরের তৈরি বিশাল সমাধি সৌধ। এ পর্যন্ত মিসরের প্রায় ৮০টি পিরামিড বা তার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং প্রায় ৭০টি কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। মিসরের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও আকর্ষণীয় পিরামিডগুলোর মধ্যে হচ্ছে ফারাও খুফুর পিরামিড, চেপরেনের পিরামিড, খাপরার পিরামিড, মেন কাউরার পিরামিড, তুতেন খামেনের পিরামিড। এসব বিখ্যাত পিরামিড মিসরের প্রাচীন রাজবংশের আমলে খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ থেকে ২৫০০ অব্দের মধ্যে স্থাপিত।
পিরামিডগুলোর মধ্যে যেটি সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে উঁচু সেটি মিসরের প্রাচীন রাজবংশের আমলে তৈরি হয়েছিল। এটি বর্তমান কায়রো শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে মরুময় গিজা অঞ্চলে অবস্থিত, বিখ্যাত ফারাও খুফুর পিরামিড নামে পরিচিত। ফারাও খুফুর পিরামিডটি নির্মাণ করেছিল বলে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হল কীভাবে নির্মাণ কাজ সমাধা করা হয়েছিল। কত লোক লেগেছিল! তারা কত বছরের পরিশ্রমে এরকম একটি স্থাপত্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল!
গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাস মনে করেন, এ কাজে বিপুল সংখ্যক দাসকে নিয়োগ করেছিল ফারাওরা। তিনি এ সংখ্যাকে ১ লাখ বলে উল্লেখ করেন। আর ১ লাখ লোকের বিশ বছর লেগেছিল। মিসর বিষয়ক অধিকাংশ গবেষক হেরোডোটাসের বক্তব্য গ্রহণ করেছেন। তবে, পোলিশ আর্কিটেকচার ওয়েলসলো কোজিনাছকির ধারণা আরও বেশি। পিরামিডের মূল ক্ষেত্রে লোক লেগেছিল প্রায় ৩ লাখ। অফ সাইডে আরও ৬০ হাজার লোকের দরকার পড়েছিল। আবার গণিতবিদ মেন্ডেলসনের ধারণা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার লোকের ১০ বছর লেগেছিল পিরামিড তৈরির কাজে। কীভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল গ্রেট পিরামিড বা খুফুর পিরামিড এ ব্যাপারে বিভিন্নজন বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। মিসর বিষয়ক গবেষক বারবারা মটের্জের ধারণা খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮৭-২৬৬৭ সালে খুফুর পিরামিড নির্মাণ করা হয়। পিরামিড নির্মাণের জন্য বিপুল সংখ্যক পাথরের দরকার পড়েছিল। এক গ্রেট পিরামিড (সর্ববৃহৎ) তৈরির জন্য ২-২৮ মিলিয়ন ব্লক তৈরি করা হয়েছিল। কোন কোন পাথরের ওজন ছিল কয়েক টন পর্যন্ত। এত ভারি ভারি পাথর কীভাবে এত উপরে উঠানো হয়েছিল ভাবলে বিস্ময় লাগে। এক্ষেত্রে নানা মুনি নানামত দিয়েছেন।
বেশির ভাগ লোকের ধারণা ব্লকগুলো টেনে তুলে পিরামিড নির্মাণ কাজ হয়েছিল। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোসের মন্তব্য হচ্ছে, পিরামিড নির্মাণ করা হয়েছিল সিঁড়ির মতো। স্টেডিয়ামের সিঁড়ির মতো ক্রমশ উঁচু সমান্তরালভাবে, প্রথম ধাপ সমাপ্ত হওয়ার পর শ্রমিকরা পাথর ও অন্যান্য উপাদান টেনে উপরে তুলত। যখন প্রথম ধাপের উপর বিভিন্ন উপকরণ তোলা শেষ হতো, তার পরের ধাপ নির্মাণ কাজে হাত দিত। এভাবে পর্যায়ক্রমে এক একটা ধাপ শেষে নির্মাণ হয়েছিল পিরামিড। এদিকে আরেক ইতিহাসবিদ ডায়াডোরাস সেকুলাসের মতে, সিঁডি নয় বরং ডালু পথে যাবতীয় উপকরণ টেনে তোলা হয়েছিল। আর এ কাজে ব্যবহারের পাথর টেনে তোলা হতো ৫০০ কিলোমিটার দূর থেকে। ডায়াডোরাস নিজেও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এত বড় বড় পাথর কীভাবে টেনে তোলা হতো। কারণ এ যুগের মতো তখনও টেনে তোলার মতো কোন মেশিন ছিল না। আরেক বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এত বড় বড় স্থাপত্য দাঁড়িয়ে আছে বালির উপরে। হেরোডোটাস এবং ডায়াডোরাসের মতামতকে অবশ্য আধুনিক মিসর গবেষকরা খারিজ করে দিয়েছেন। বিশেষ করে ডায়াডোরাসের আরব থেকে পাথর নিয়ে আসার তত্ত্ব। যদিও তারা সিঁড়ির পর সিঁড়ি তৈরি করে তার উপরে পাথর তোলার তত্ত্ব বাতিল করে দিতে পারেননি।
পিরামিড নির্মাণে শক্ত পাথরের পাশাপাশি প্রচুর নরম চুনাপাথরের প্রয়োজন পড়েছিল। আর এজন্য পিরামিডের দূরেই স্থাপন করা হয়েছিল চুনাপাথর তরল করার ব্যবস্থা। পাথর গুঁড়ো করে তাতে জল মেশানো হতো। পানি নিয়ে আসা হতো নীল নদ হতে সরু নালা খনন করে। তরল চুনাপাথরের সঙ্গে এরপর মেশানো হতো নাইট্রান লবণ। আর এ লবণ পাওয়া যেত পাশের মরুভূমিতে। এরপর এর সঙ্গে চুন মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করা হতো যা ছিল পিরামিড তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এরপর সঙ্গে কষ্টিক সোডা, সিমেন্ট তৈরি করে রোদে শুকানো হতো। আর এভাবে তৈরি করা হতো চুনাপাথরের ব্লক। এই ব্লক সিঁড়ি কিংবা সিঁড়ির বিকল্প পথে টেনে তোলে সঠিক স্থানে বসানে হতো আর এভাবেই চুনাপাথরের ব্লক ও পাথর উপরে টেনে তুলে নির্মাণ হয়েছে অপর বিস্ময় পিরামিড।
আসলে পিরামিড কারা তৈরি করেছিল তা নিয়ে বহু মিথ প্রচলিত রয়েছে। তবে এ কথা সত্য যে মিসরের গ্রেট পিরামিড বা খুফুর পিরামিড নির্মাণ করেছিল ফারাও খুফুর। তবে সময়ের ব্যাপারটাও রহস্যাবৃত বলেই মনে হয়। খেয়ালি ফারাও সত্যি এটা নির্মাণ করেছিলেন কিনা তাতে সন্দেহ আছে অনেকেরই। হিসাব করে দেখা গেছে, পাহাড় থেকে কেটে চেঁছে একটার ওপর একটা পাথর এরূপ ২৩ লাখ পাথর দিয়ে পিরামিডটি নির্মাণ করতে সময় লাগবে ২ লাখ ৬০ হাজার দিন। তবে ফারাও কি ততদিন বেঁচেছিলেন। প্রশ্ন থেকেই যায়। এমনও তো হতে পারে খুফুর আগেই কেউ পিরামিডটির নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল। সে নিজের কীর্তির কথা ঘোষণা করেনি। প্রাচীন মিসরের একটি পুঁথি আছে অক্সফোর্ডের কেডলেয়ার লাইব্রেরিতে। পুঁথির এক জায়গায় লেখা আছে, গ্রেট পিরামিডের নির্মাতা রাজা সুরিদ। পিরামিডটি নির্মাণ করে, পুরোহিতদের দিয়ে নিজ শাসন আমলে অনেক তথ্য তা নাকি পিরামিডের ভেতরে লুকিয়ে রেখে গেছে রাজা সুরিদ। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল রাজা সুরিদের শাসনকাল ছিল মহাপ্লাবনেরও অনেক আগে। সুতরাং এর যথার্থতার প্রশ্নটি প্রচলিত মিথগুলোকে আরও পাকাপোক্ত করে দানা বাঁধতে সাহায্য করে।
অনেকেই আবার প্রশ্ন করে প্রাচীনকালে বৈজ্ঞানিক কাঠামোতে গড়া সুবিশাল পিরামিড তৈরি করা মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। এই পরম কীর্তি নির্মাণ করেছে অন্য কোন গ্রহ বা নক্ষত্রের জীবেরা প্রাচীন মিসরের পুঁথিগুলোতে এ প্রমাণ মেলে। মিসরীয়রা সূর্য দেবতার পূজা করত। সূর্য বা নক্ষত্র থেকে দেবতারা এসে মানুষকে শিখিয়ে দিয়েছিল পিরামিড তৈরির কৌশল, এমন মিথ ও প্রচলিত আছে যে, আসলে দেবতা-টেবতা নয়। তারা ছিল বহির্জাগতিক বুদ্ধিমান কিছু প্রাণী যারা প্রাচীন পৃথিবীতে এসেছিল আর নিজেদের সভ্যতার কিছু নিদর্শন পৃথিবীতে রেখে গেছে।
প্রাচীন মিসরীয়রা বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর দেবতা আবার তাদের জাগ্রত করবে। তাই তাদের মৃতদেহকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করার প্রয়োজন অনুভব করে। আর তাই নির্মাণ করে পিরামিড। রাজা খুফুও তার দেহ রক্ষার জন্য নির্মাণ করে বিশাল পিরামিড। প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো গ্রেট পিরামিড বা খুফুর পিরামিডের উচ্চতা ছিল ৪৫০ ফুট, প্রতি সাইডে দৈর্ঘ্য ৭৭৬ ফুট।
খুফুর পিরামিডে অনেক কক্ষ বা চেম্বার রয়েছে। রাজা যেখানে অতিথিদের বসাতেন সেই কক্ষ বা গ্রান্ড গ্যালারির দৈর্ঘ্য ৮.৮৪ মিটার।  গ্রান্ড গ্যালারির পাশেই ছিল কিংস চেম্বার যেখানে রাজা খুফুর মৃতদেহ মমি করে রাখা হয় এবং পাশে ছিল কুইন্স চেম্বার।
প্রাচীন মিসরীয়রা প্রথাগতভাবে সমাধি সৌধের ভেতরে মৃতদেহ মমি করে রাখার সময় প্রচুর ধন-সম্পদ সঙ্গে দিত। তাদের বিশ্বাস ছিল পরকালে এই ঐশ্বর্যের প্রয়োজন পড়বে। এ ধন-ঐশ্বর্য আহরণের জন্যই হয়তোবা আরবের বাদশা হারুর-অর-রশিদ ৮২০ খ্রিস্টাব্দে খুফুর পিরামিডের অনুসন্ধান চালায়। মাটি খুঁড়ে ভেতরে প্রবেশ করার পর কিছুই খুঁজে পায়নি, এমনকি খুফুর মমিও না। তবে কোথায় গেল ফারাও খুফুর মমি? আর কোথাইবা গেল তার ঐশ্বর্য-ধনসম্পদ। আধুনিক মিসর বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রাচীনকালেই চোরেরা সব লুট করে নিয়ে গেছে। তবে প্রশ্ন হল কিভাবে চোরেরা প্রবেশ করল এই সমাধি সৌধে? এ প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে কি খুফুর প্রাচীন চোরদের ও আধুনিক প্রতœতাত্ত্বিকদের মনে ব্যথা দিয়ে গেছেন তার নির্মিত পিরামিড পরম আশ্চর্যের কীর্তি হয়ে পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য। এ কথা শুধু ফারাও খুফুর আর ঈশ্বরই জানেন।   

রাজপ্রাসাদের শহর কুচবিহার


লিয়াকত হোসেন খোকন
শৈশবে মানচিত্র নিয়ে খুব করে ঘাঁটাঘাঁটি করতাম। তখন থেকেই পশ্চিম বাংলার শহর কুচবিহারকে ভালো লেগে গেল। দিন যায় বছর যায়। স্কুল ও কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম বিএ (অনার্স)-এ ক্লাসে। ১৯৭২ সাল সে বছরই প্রথম কুচবিহার যাওয়া। সেই স্মৃতি এখনও ভাসা ভাসা মনে পড়ে। তখন মনে হয়েছিল কিছুটা বিবর্ণ হলেও ছবির মতো সাজানো শহর কুচবিহার। ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম বলেই কুচবিহারের ইতিহাস জানতে ব্যাকুল হলাম। জেনে ছিলাম ১৫২২ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বসিংহর হাতে কুচ রাজ্যের পত্তন হলেও রায়কত শিরোপায় ভূষিত শিশু সিংহের হাতে ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে রায়কত বংশের প্রতিষ্ঠা। কুচ রাজদের করদ মিত্র স্বাধীন রাজ্য ১৯৪৯-এর ১২ সেপ্টেম্বর ভারতভুক্তি হতে কামতা বা কুচবিহার একটি জেলায় রূপ পেয়েছিল। সেই থেকে জেলার সদরও বসেছে এ কুচবিহারে । আমারই ক্লাসমেট বাবুল-ই একদিন বলল দোস্ত কুচবিহারে গেলে তো চল। দেখে আসবি পাসপোর্ট ভিসার প্রয়োজন নেই। তখন তো দেশ স্বাধীন হয়েছে সবে। সুযোগটি আর হাতছাড়া করলাম না। ঢাকা থেকে লালমনিরহাটে গিয়ে এক রাত কাটানোর পর আমরা সীমান্তের কাছাকাছি এলাম। বাবুলই সব ম্যানেজ করল। সীমান্তে শুধু এইটুকু বলেছিলাম, আমরা জয় বাংলা থেকে এসেছি। এতেই বিএসএফ খুশি। ভাসা ভাসা মনে পড়ে, দিনহাটা হয়ে আমরা কুচবিহারে গিয়েছিলাম। কুচবিহার যাওয়ার পথে বাবুল বলল, কুচবিহারেই আমার জš§। জšে§র বছর পাঁচেক পর বাবা কুচবিহার ছেড়ে এলেন লালমনিরহাটে।
প্রথমবার কুচবিহারে গিয়ে বিশাল রাজপ্রাসাদ দেখার জন্য বেরুলাম। মনে আছে প্রধান গেট থেকে ভেতরে ঢুকে বেশকিছুটা পথ এগিয়ে রাজপ্রাসাদের কাছে এলাম। বাবুল বলল, রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ কি পড়েছিস। হ্যাঁ। ও বলল, জানিস এ প্রাসাদেও ভূত পেতনী আর প্রেতাÍা ঘুরে বেড়ায়। ওর কথাগুলো শুনে ভয়ে বুকটা আঁতকে উঠল। সেই ১৯৭২ সালে কুচবিহারের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া কষ্টকর ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন একটা ভালো ছিল না।
প্রায় ৩৬ বছর পর কুচবিহারের কথা বেশ করে মনে পড়ায় কুচবিহারকে কাছ থেকে আবারও দেখব বলে বেনাপোল সীমান্ত অতিক্রম করে বনগাঁ থেকে লোকাল বাস ধরে এলাম কলকাতার ধর্মতলায়। দুপুর ২টায় বাস ছেড়ে যাচ্ছে কুচবিহারের উদ্দেশে। হাত তুলতেই বাসচালক বাস থামালেন। কন্ডাক্টরকে বললাম, কুচবিহার যাব। তিনি উঠতে বললেন। পছন্দ মতো একটি সিট বেছে নিয়ে বসতে বললেন। পরদিন সকাল দশটার দিকে বাস এসে থামল কুচবিহারে। রিকশা নিয়ে ইলোরা হোটেলের দিকে রওনা হলাম। আগে থেকেই জানতাম ইলোরা হোটেলের নাম। ইলোরা হোটেলেই লাগেজ রেখে এক ঘণ্টা রেস্ট নেয়ার পর কুচবিহার রাজপ্রাসাদ দেখার জন্য নিচে নেমে এলাম। যে দিকে তাকাই মনে হয় কত না সাজানো-গোছানো শহর। তবে কুচবিহারকে ৩৬ বছর পর দেখে মনে হল, অসম বাংলার যোগাযোগকারী পথে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে কুচবিহারের পরিচিতি থাকলেও, কুচবিহার জেলা তথা শহর পর্যটন মানচিত্রে এখনও জায়গা করে নিতে পারেনি। অথচ শৈব-শক্তি-বৈষ্ণব দেবালয়, সুরম্য রাজপ্রাসাদ, ঐতিহ্যময় বাড়িঘর, ছোট বড় দিঘি নিয়ে গড়ে ওঠা কুচবিহার শহর ঘিরে তৈরি হতে পারে নতুন একটি ভ্রমণ সার্কিট। তবে এ জেলার লোকগীতি ও লোকবাদ্যও সমীহ করার মতো। এক স্টুডিওতে ফিল্ম কিনতে গিয়ে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় হয়। তাকে জানালাম, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এ কথা শুনে উনিত বেজায় খুশি। বললেন, রাতের বেলা নিমন্ত্রণ রইল, দাদা আসবেন কিন্তু। কথায় কথায় ওই ভদ্র মহিলা জানালেন, কুচবিহার এ নামটি নিয়ে নানা মুনির নানা মত। একটি লোকের কথা অনুসারে কুচ বধুপুর ছিল শিব-পার্বতীর বিচরণস্থল। পরশুরামের ভয়ে ভীত ক্ষত্রিয়রা এসে ভগবতীর ক্রোড়ে বা কুচে আশ্রয় নেয়ার ফলে নাম হয় কুচবিহার।
কুচবিহার রাজপ্রাসাদ দেখার জন্য দুপুর ২টায় এলাম। ওখানে গিয়ে দেখলাম রাজপ্রাসাদের একতলা এবং দোতলায় কয়েকটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হয়েছে। রাজ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক সামগ্রীর অসাধারণ সংগ্রহ এখানে প্রদর্শিত হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে কুচবিহার জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত অমূল্য সব প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। ওখানেই পরিচয় হল এক গাইডের সঙ্গে। তিনিই জানালেন, মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে এ প্রাসাদের নির্মাণ কার্য শেষ হয় ১৮৮৭ সালে। সেই সময় খরচ পড়েছিল প্রায় ৯ লাখ টাকা। তার সঙ্গে এলাম বিশাল দরবার হলে। তখন শুধুই যে তাকিয়ে থাকা। একটু পর ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম। পাশেই রাজবাড়ি পার্ক সেখানে এসে বসলাম। অদূরে একটি ছেলে একাকী বসেছিল। হাত ইশারা করে ডাকতেই ও কাছে এল। জিজ্ঞেস করলাম তোমার নাম? বলল, ফিরোজ। তোমাদের বাড়ি কি কুচবিহারে? হাসতে হাসতে জানাল হ্যাঁ এখানেই তো।

ছেলেটি জানতে চাইল, আপনি কি কলকাতা থেকে এসেছেন? বললাম না। বাংলাদেশ থেকে এসেছি। ফিরোজকে বললাম, বিকালে ইলোরা হোটেলে এস। তোমাকে নিয়ে মদন মোহন ঠাকুরবাড়ি যাব। হোটেলে ফিরে গিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে টেলিভিশন ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বিকাল ৫টায় ফিরোজ এল। বললাম, চল কোথাও গিয়ে বিকালের নাস্তাটা খেয়ে নেই। ইলোরা হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে স্যান্ডুইচ ও কোল্ড ড্রিংক্স নিলাম। ফিরোজ বলল, মদন মোহন মন্দির দেখা শেষ করেই কিন্তু বারে গিয়ে হার্ড ড্রিংক্স করব। ওর কথা শুনে হ্যাঁ তাই হবে। ফিরোজের বয়স আঠারো কি উনিশ তখন। বেশ খোলামেলা কথা বলতে বড় পছন্দ করে, তাই ওকে আমার ভীষণ ভালো লেগে গেল। রিকশায় উঠে দু’জনে এবার মদন মোহন মন্দির দেখার জন্য চললাম। মদন মোহন ঠাকুরবাড়ি নামে খ্যাত মন্দিরটি শহরের মাঝখানে। ১৮৮৫ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ এ মন্দিরটি স্থাপন করেন এ কথা রিকশায় বসে ফিরোজ বলেছিল। উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা বিস্তৃত মন্দির প্রাঙ্গণে এসেই প্রবেশদ্বারের ওপর প্রাচীন নহবতখানা দেখলাম। এখানে মূল দেবতা মদন মোহনের ঘরের ওপর একটি গম্বুজ দেখতে পেলাম। সন্ধ্যা তখনও হয়নি। এক পূজারীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল। তিনি বললেন, সন্ধ্যার পরে আসুন। বেশ আনন্দ পাবেন। কি আর করা, আমরা ঘুরে ফিরে সন্ধ্যার পর সিদ্ধান্ত নিলাম। এদিকে ফিরোজের মোবাইল বেজে উঠল। কথা শেষ করে বলল, আংকেল আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। ফিরোজ চলে গেল। আমি মন্দিরের আশপাশে রয়ে গেলাম। সন্ধ্যার পর মন্দির প্রাঙ্গণে এসে পনেরো বছর বয়সী ‘জীবন’ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। সে আমাকে বলল, আমিই আপনাকে মন্দির দর্শন করাব। তখন মন্দিরের দিকে তাকাতেই মনে হল, মন্দির যেন সম্পূর্ণ আলোকিত। এদিকে আরতির ধূপ-ধূনো সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে মোহময় আবেশ। সেই ক্ষণে জীবন ও আমি মন্দিরের ভেতর ঢুকলাম। এখানে মদন মোহনের ডান পাশের ঘরে মহাকাল মূর্তির ওপর কষ্টিপাথরের কালীমূর্তি, বাঁ দিকের ঘরে দেখলাম অষ্টধাতুর জয়তারা, অন্নপূর্ণা, কাত্যায়নী ও মঙ্গলচণ্ডীর মূর্তি। দেব-দেবীর মূর্তি দেখতে দেখতে কেমন যেন একটু ভয় ভয় লাগল। জীবনের হাত শক্তভাবে ধরে এবার মন্দির থেকে বেরুলাম। হোটেল ইলোরায় ফিরে এলাম রাত ৯টায়। দরজা বন্ধ করতেই মনে হল, এখানে বুঝি প্রেতাÍা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি আর করা, সারারাত লাইট জ্বালিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেছি। ঠিকভাবে ঘুমই হল না।
পরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লাম কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বলতেই পারব না। বিকালবেলা একটু অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এবার একা একা এক ফার্মেসিতে গিয়ে চিকিৎসক আছেন কিনা জানতে চাইলাম। ফার্মেসির লোকজন বলল, তিনিতো এই মাত্র চলে গেছেন। তবু বসুন ফোন করে ওনাকে নিয়ে আসি। পনেরো মিনিটের মধ্যে চিকিৎসক এসে উপস্থিত। তার রুমে ঢুকে অসুস্থের কথা জানালাম। তিনি আমাকে বেশ ভালো করে দেখলেন। আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকে এসেছি...। এবার তিনিই বললেন, আমাদের পূর্ব পুরুষদের আদিবাড়ি কিন্তু আপনাদের বাংলাদেশের গাইবান্ধাতে। ১৯৪৭ সালের পর তারা এ কুচবিহারে চলে এলেন। চিকিৎসকের নাম হল ডা. এস পাল।
চিকিৎসাপত্রটি হাতে দিয়ে বললেন, আপনি কোথায় উঠেছেন?
বললাম, ইলোরা হোটেলে।
তিনি বললেন, রাত দশটার দিকে আপনাকে গিয়ে একবার দেখে আসব। সত্যি সত্যিই চিকিৎসক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তখন প্রশ্ন জাগল, আমাদের বাংলাদেশে এমনটি কি আশা করা যায়?
পরদিনও কুচবিহারে ছিলাম। ৮০ টাকায় রিকশা ভাড়া করে শহরের একটু দূরে তোর্মা নদীর তীরে গেলাম। তখন মনে পড়ল কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কথা। তার আসল দেশ তো এই কুচবিহারে। তিনি তো তোর্মা নদীকে নিয়ে গানও করেছেন। ওখান থেকে ফিরে এলাম শহরে। যেদিকে যাই মনে হয়, কুচবিহার শহরটি দেখতে অতি সুন্দর তো। বাহ্ এখানে আছে তরুবীথিযুক্ত প্রশস্ত রাজপথ। আহা কি-ই-না সুন্দর প্রমোদ উদ্যান। দীর্ঘ সরোবর সবই আছে। বাহ্ আরও আছে আম-কাঁঠাল-গুবাক। বৃক্ষ যেন শহরটিকে একটি সুন্দর কুশবনে পরিণত করেছে। তাই কুচবিহার ছেড়ে কিছুতেই ফিরতে ইচ্ছা করছিল না।
পরদিন দার্জিলিং যাব বলে প্রস্তুতি নিলাম এবং খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তাই-ই করলাম। চললাম দার্জিলিংয়ের দিকে...। 

ভিয়েতনামে ভ্রমণ


মঈনুস সুলতান
মেঠোপথে বেলে মাটির সাথে গেঁথে আছে লোহিত বর্ণের নুড়িপাথর। তীব্র সূর্যালোকে পায়ে চলা পথের পাশের ঘাস বিবর্ণ হরিৎ। আমি ও মিস্ ফুয়াং একটি মেয়েলি ছাতার নীচে আমাদের মাথা দু’টি রোদ বাঁচিয়ে হাঁটি। আমাদের দৃষ্টিসীমায় বেশ ক’টি আকার আকৃতিহীন জলাশয়। ছোট্ট এ ঝিলগুলোর কালচে সবুজ পানিতে সূর্যালোক রূপালি হয়ে ছলকায়। এ তীব্র দাবদাহেও ঝিলে বেশ ক’টি ডোঙ্গা জাতীয় নৌকা। ছোট্ট এ নাওগুলোতে মাথাইল পরে মাঝ বয়সী মহিলারা দূর্বাদাম কেটে ধীর লয়ে বৈঠা বায়। আলোর তীব্রতায় আমাদের চোখে যেন ধাঁধা লাগে। ঠিক বোঝা যায় না মাঝিরা মাছ ধরছে না কলমি শাক্ তুলছে। মিস্ ফুয়াং এর চলার গতি দ্রুত হয়। যেহেতু আমি উচ্চতায় দীর্ঘকায় তাই আমাকে মেয়েলি ছাতা উঁচিয়ে তার মাথায় ছায়া দিতে হয়। ফুয়াং থেকে থেকে হ্যাট্ পরা মাথা বাঁকিয়ে রোদচশমায় ঢাকা চোখে তাকিয়ে বোধ করি আন্দাজ করতে চেষ্টা করে আমি তার সাথে তাল মেলাতে পারছি কি না। চলাচলের দ্রুততার জন্য আমাদের মাঝে কথাবার্তা কিছু হয় না। আমাদের পাশ দিয়ে দু’জন মাঝ বয়সী ভিয়েতনামিজ্ মহিলা খালুই ভর্তি ছোট মাছ ও জলজ লতাগুল্ম শাক নিয়ে উল্টো দিকে চলে গেলে ফুয়াং রোদচশমা খুলে তাদের সাথে সম্ভাষণ বিনিময় করে। আচরণে মনে হয় মহিলারা ফুয়াংকে বেশ ভালো ভাবে চেনেন। কিন্তু তাদের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেমে বাক্যালাপ কিছু হয় না। আমরা পথের বাঁক অতিক্রম করি। এখানে বেশ ক’টি গাছপালা। তাদের ছায়ায় কর্দমাক্ত জলভরা খাদ। খাদে কাদা মেখে গড়াচ্ছে গোটা পাঁচেক রক্ত চক্ষু মহিষ। মহিষগুলোর কারো কারো শিং এ বসা শালিক পাখি।

রওয়ানা হওয়ার সময় ফুয়াং ভূমিকা স্বরূপ বলেছিল- সে আমাকে একটি গ্রামের গরিবী দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। তার মন্তব্যে আমি অলক্ষ্যে হেসে মনে মনে বলেছিলাম বাংলাদেশের শ্রীহট্ট অঞ্চলে আমার জ›ম, রাতের সাথে অন্ধকার যেরকম মিশে থাকে সেরকম দারিদ্রের সাথে আমাদের নিত্য দিনের সম্পর্ক। তারপরও গ্রামটির উপকণ্ঠে এসে মনে হলো- ফুয়াং অসত্য কিছু বলেনি। এ গ্রামের অবস্থা সত্যি সত্যিই করুণ। এখানকার কমিউনের ঘর- যেখানে গ্রাম কমিটির বসে শলা পরামর্শ করার কথা, মনে হয় ক্রমশঃ দরোজা জানালা খুইয়ে, চাল ভেঙ্গে ঝুরে ঝুরে পড়ছে। পতাকা দন্ডটি মনে হয় ঝড়ের চাপে সেই যে নুয়ে ছিল তা আর কেউ সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয়নি। আমাদের আশে পাশে একজন দু’জন করে শীর্ণ দেহের মানুষ জন হেঁটে যায়। ফুয়াং তাদের যথারীতি সম্ভাষণ করে। তাদের জবাবে কিন্তু উৎসাহ ব্যঞ্জক সাড়া কিছু পাওয়া যায় না। এখানকার ঘর দুয়ারের দিকে তাকালে মনে হয় বছর কয়েক আগেও এ গাঁয়ে সুসময় ছিল। বেশ ক’টি গৃহের কাঠামো ইট ও কাঠে গড়া, ছাদে কালচে হয়ে আসা টালি। অনেকগুলো বাড়ীর সামনে দু’টি করে বর্গাকৃতির পুকুর। একটু খেয়াল করে তাকালেই মনে হয় জলে সবুজ শর জমে আছে। পুকুরগুলো পাড় যেন চারদিক থেকে ক্রমে ক্রমে ভেঙ্গে পড়ছে। একটি ঘরের টালির ছাদ দুমড়ে মুচড়ে ঝুলে আছে। চালের এখানে সেখানে গর্ত ও ফোঁকর। আমি হাঁটতে হাঁটতে ভাবি গাঁয়ের মানুষ জন কি ঘর দুয়ার মেরামতের কথা একেবারে ভুলে বসেছে?

সেচের পানির প্যাচপ্যাচে কাদায় একজন চাষী হ্যাট পরে মহিষ দিয়ে হাল বাইছেন। তিনি ফুয়াংকে হ্যাট নাড়িয়ে সম্ভাষণ করেন। গাঁয়ের এদিকে ক’খানা টিনের চারচালা ঘর। ঘরগুলো জীর্ণ হতে হতে এমন ঝুরঝুরে হয়ে আছে যে মনে হয় ঝড় তুফান আসলেই তা ভেঙ্গেচুরে মুখ থুবড়ে পড়বে। উঠানে চাটাই পেতে অনেকে ছোট মাছ শুকাচ্ছে। শুঁটকি মাছের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। আমরা তীব্র রোদে অনেকক্ষণ হেঁটে রীতিমত হাসফাস করি। ফুয়াং একটি ঘরের আঙ্গিনার সামনে দাঁড়িয়ে শুঁটকি মাছের চাঙারিগুলো পরীক্ষা করে দেখে। ঘর থেকে বাচ্চা কোলে বিষণœ মুখের এক মহিলা বেরিয়ে আসতেই সে হ্যাট্ ও রোদচশমা খুলে হুট্ করে ঘরে ঢুকে যায়। আমি মেয়েলি ছাতা হাতে উঠানে কিছুক্ষণ খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থেকে কি করবো তা ভাবি। ফুয়াং ঘুনে ধরা জানালা দিয়ে আমাকে ভেতরে আসতে ডাকে। ঘরের ভেতর এসে আমি পায়া ভাঙ্গা চৌকিতে বসি। খাটটি নড়বড়ে, এর পায়াহীন অংশে গোটা আষ্টেক ইট দিয়ে ঢিকে দেয়া। প্রায় অন্ধকার কক্ষে আমার চোখ সয়ে আসলে আমি ঘরের এদিক ওদিক তাকাই। এক কোণে রাখা বাতাসহীন টায়ারওয়ালা জং ধরা একটি সাইকেল। সাইকেলের হেন্ডোল থেকে ঝুল্ছে নীল বর্ণের প্ল­াষ্টিকের সস্তা ট্রান্জিস্টার রেডিও। দু’টি বাচ্চা ছেলে পরষ্পরের সাথে হাতাহাতি করতে করতে তারস্বরে চিৎকার দিয়ে এসে ঘরে ঢুকে। বাচ্চা কোলে মা’টি তাদের সামাল দিতে গেলে গোলযোগ তীব্র হয়। এ ধুন্ধুমারে আমার পেছন দিকে আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একটি মুরগি কক্ কক্ করে ওঠে। ফুয়াং এসে মুরগিটিকে শান্ত করে বেতের ঝুড়িতে বসিয়ে দেয়। বিছানার এক কোণে যে ডিমের উপর মুরগী বসে আছে তা আমি এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। মা দ্বন্ধরত ছেলে দু’টিকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। ফুয়াং বিছানায় আমার পাশে বসে মেলে ধরে হিসাব কিতাবের খাতা। সে কলম দিয়ে খাতার এন্ট্রিগুলো পরীক্ষা করতে করতে বলে, ‘এ গ্রামে বছর খানেক হতে চললো মহিলাদের নিয়ে ঋণ ও সঞ্চয় সমিতি গঠন করা হয়েছে।’ মা’য়ের কোল ছাড়া হয়ে ছোট্ট বাচ্চাটি টলোমলো পয়ে কক্ষে ফিরে আসে। সে অবাক হয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ফুয়াং এর হাঁটুর উপর রাখা কাপড়ের লাল ফুল গাঁথা হ্যাটটি দেখে। আস্তে আস্তে বাচ্চাটি সাহস সঞ্চয় করে- এখন সে অতি সাবধানে নখ দিয়ে ফুল খুঁটছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কামরাটি ভরে যায় বেশ কয়েকজন মহিলা ও তরুণী বয়সের নারীতে। তাদের কেউ কেউ উদাসীন চোখে আমাকে তাকিয়ে দেখে। ফুয়াং এর কথাবার্তায় বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে দেখে আমি অনুমান করি- সে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এতে নারীদের মাঝে তেমন কিছু ভাবান্তর দেখা যায় না। দুটি নারী জোরে শোরে কিছু একটা বর্ণনা দেয়। ফুয়াং মুখ তুলে আমাকে বলে, ‘এদের অনেকেই ঋণ ফেরত দিতে পারছে না। বাচ্চাদের অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। এক মহিলার স্বামী সেই যে ঋণের টাকা নিয়ে শহরে কাজ করতে গেছে তার আর ফেরার নাম নেই। বাংলাদেশেতো গ্রামীন ব্যাংক সাক্সেস্ফুল প্রোগ্রাম করছে, ঋণ খেলাফী সমস্যার সমাধান তারা কি ভাবে করে?’ আমি জন সমক্ষে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে চাই না। তাই ফুয়াংকে বলি- পরে এক সময় এ নিয়ে কথা বলা যাবে। একটি তরুণী তার বাচ্চা মেয়ের পিটে ছোট্ট গামছা দিয়ে        প্ল­া­ষ্টিকের সস্তা পুতুল বেঁধে দেয়। শিশুটি এখন পিটে খেলনা শিশু বয়ে মিনিয়েচার মা হয়ে সংকীর্ণ কক্ষে হাঁটাহাঁটি করে। দুয়ার দিয়ে সাবধানে উঁকি দিয়ে ফতুয়া পরা এক বৃদ্ধ এসে কামরায় ঢুকেন। বৃদ্ধের কপালে পাখির ডিমের মতো মাংশের গোলক। তিনি এগিয়ে এসে মৃদু হেসে আমার সাথে হাত মেলান। তার চোখে মুখে কৌতূহল। তিনি জানতে চান আমাদের দেশটি কি রাজা দ্বারা শাসিত? তার পরবর্তী প্রশ্ন হয়- আমার স্বদেশে দুর্ভিক্ষ হলে সরকার ফ্রি চাল দেয় কিনা? ফুয়াং যতেœ আমার জবাবের অনুবাদ করে। আমি এবার বৃদ্ধের কাছে জানতে চাই, ‘অতীত দিনে গ্রামবাসীদের পেশা কি ছিল?’ বৃদ্ধ তার কপালের গোলাকার ডিম চুলকিয়ে বলেন,  ‘পাশের জলাভূমিতে সকলে এক সময় পাট চাষ করতো। দেশে সমাজতন্ত্র এলে সরকারী লোক এসে সকলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাটের কার্পেট তৈরী করতে শেখায়। তারপর দেখতে দেখতে একদিন পাট চাষ উঠে যায়। আজকাল কেউ আর জুট কার্পেট তৈরী করে না।’ বুড়োর কথা শেষ হলে আমি উৎসুক্য নিয়ে ফুয়াং এর দিকে তাকাই। সে ব্যাখ্যা করে বলে, ‘এই বছর দশেক আগেও এ গ্রামের অনেক জুট কার্পেট সরকার ইস্ট ইউরোপের বুলগেরিয়া, হ্যাংগেরী প্রভৃতি দেশে রপ্তানী করতো। সোভিয়েত ইউনিওনের সাথে সাথে ইস্ট ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ব্ল­­ক্ সহসা কলাপস্ করলে এখান থেকে পাট চাষ তামাদি হয়ে যায়।’ আমি ফুয়াং এর অনুবাদে আমাদের দেশের পাট-চাষীদের দুর্দশার কথা বলি। আমার বক্তব্যে এক ধরণের প্রতিক্রিয়া হয়। মনে হয় মহিলাদের অনেকেই অন্যদের সাথে উত্তেজিত স্বরে কিছু বল্ছে। আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে, তাই বোধ করি ফুয়াং আর সমস্ত কিছু অনুবাদ করে না। চৌকি থেকে উঠার মুখে দেখি টলোমলো পায়ে ছোট্ট বাচ্চাটি আমার হাঁটুর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে মুখে সাহসী কৌতূহল। সে আংগুল বাড়িয়ে আমার অনামিকায় পরা নীলা পাথরটি খুঁটতে শুরু করে। বুড়ো কাছে এসে জানতে চান- আমার শুঁটকি মাছে রুচি হয় কি না? আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি এক তরুণীকে ইশারা দেন। মেয়েটি দ্রুত উঠে গিয়ে আমার জন্য উপহার স্বরূপ নিয়ে আসে পলিথিনের ব্যাগ ভর্তি শুকনো মাছ।

এ গ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে আমি ও ফুয়াং ছাতা মাথায় ঘন্টা খানেক হাঁটি। এবারকার পথটি দীর্ঘ গাছপালা ও বাঁশঝাড়ে ছায়াছন্ন। তারপরও হাঁটতে গিয়ে আমাদের দারুণ ক্লান্ত লাগে। ফুয়াং বোধ করি খুব করে ঘামছে। সে পরে আছে অনেকটা আমাদের শেলওয়ার কামিজের মত্ োঢিলেঢালা সাদা আওডাই। তার জামার কিছু কিছু আংশ ভিজে উঠছে এবং শরীর থেকে ভাজা মৌরির মতো এক ধরণের ঘ্রাণ ভেসে আসে। এক পর্যায়ে আমি রীতিমত লবেজান বোধ করলে সে থেমে কাঁধে ঝুলানো প্রকান্ড পার্স থেকে বের করে দু’টি স্প্রাইটের ক্যান্। আমি বাঁশ ঝাড়ের ছায়াতলে ঘাসের উপর সটান বসে স্প্রাইট্ পান করি। পানীয়টি খরদাহে রক্তের মতোই উষ্ণ। কিন্তু তাতে তৃষ্ণা মেটে। আমার মাথায় এখন ছাতা নেই বলে স¤মুখের পাহাড় শ্রেণী স্পষ্ট দেখতে পাই। রোদ যেন পাহাড়ের চূনা পাথরের কালচে খয়েরি দেহে প্রতিফলিত হয়ে শূন্যতায় ছড়াচ্ছে রূপালি ধোঁয়া। একটি পাহাড়ের গ্রীবায় সাদা হাঁসের পালকের মতো তুলতুলে মেঘের ক্রমশঃ ভাসমান গহনা। আমার এখানে বসে- থেকে থেকে মেঘের ক্রমাগত উড়ে যাওয়া দেখতে ইচ্ছে হয়। ফুয়াং ঘড়ির দিকে তাকায় তারপর ভ্রকুটি করে আমাকে সচল হতে নির্দেশ দেয়। হাঁটতে শুরু করতেই কোথা থেকে আলুথালু শীতল হাওয়া আমাদের মুহূর্তের জন্য ছুঁয়ে যায়। আমাদের পাশ দিয়ে মহিষের পিটে বসে বাঁশি বাজাতে বাজাতে দিগন্তের দিকে চলে যায় একটি রাখাল বালক । আমরা বাকি পথটুকু চট্ জলদি অতিক্রমের জন্য দ্রুত হাঁটি।

প্রায় আধঘন্টা পঁয়তাল্লি­­শ মিনিটের মাঝে আমরা এক জলাভূমির তীরে এসে পৌঁছি। ভিয়েতনামের শানলা প্রদেশের এ অঞ্চলটা প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিক থেকে সত্যি সত্যিই দৃষ্টি নন্দন। আমাদের সামনে কালচে চুনাপাথরের গোলাকার খাঁজ কাটা সব সবুজ পাহাড়। ঘাসে কাদায় মাখামাখি জলে পাহাড়ী নারীরা টুকরিতে করে কিছু ধওয়া পাকলা করছে।  তারা আমাদের দিকে উৎসুক হয়ে তাকায়, তাকিয়ে খালি খালি হাসাহাসি করে ফিরে যায় ধওয়াধয়িতে।  ফুয়াং তাদের দিকে চেয়ে হাত নাড়ে বটে, কিন্তু পাহাড়ীদের ভাষা ভিন্ন বলে তাদের মাঝে কথাবার্তা কিছু হয় না। আমরা কাদা বাঁচিয়ে সাবধানে আলপখে হাঁটি। এদিকে দীর্ঘ ঘাসের ছায়ায় ভাসে জলজ গুল্ম। আলপথের শেষে বাঁশের লম্বা হিলহিলে সাঁকো। ফুয়াং তরতর করে সাঁকোতে উঠে সামনে বাড়ে। আনেকদিন হয় এ ধরনের সাঁকোতে আমি চড়িনি, তাই দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করি। মাঝ অব্দি গিয়ে ফুয়াং দাঁড়িয়ে পড়ে পিছু ফিরে হ্যাট ঝাঁকিয়ে আমাকে সাঁকোতে উঠতে উৎসাহিত করে। নড়বড়ে সাঁকো পাড়ি দিয়ে আমরা স্যাতসেতে বদ্বীপের মতো ডাঙ্গায় আসি। আমাদের সামনে একটি নাম না জানা নদী হাঁসের গ্রীবার মতো বেঁকে গিয়ে দহের সৃষ্টি করেছে। তাতে ভাসে জলবেদেদের একটি নৌকা; তার পাটাতনে ছনের দোচালাঘর। নাও থেকে একটি আধ ন্যাংটা শিশু হাতছানি দিয়ে আমাদের ডাকে। আমরা দহের পাড় ধরে দীর্ঘ ঘাস মাড়িয়ে দ্রুত হাঁটি। দহের জল এখানে থির হয়ে আছে, তাতে ভাসে জলগুল্মের শ্যাওলাময় ছায়া। ঠিক পাড়ের কাছে বাঁধা আরেকটি নাও। মনে হয় এ নায়েও বাস করছে আরেকটি পরিবার। নৌকাটিতে স্তূপ করে রাখা কাটা ডাবের খোসা। জানালা ধরে তাকিয়ে থাকা একটি ছোট্ট মেয়ে ফিক্ করে হাসে।

হাঁটতে হাঁটতে এদিকে দহের থির জল ক্রমশ চলমান হয়ে উঠে। মৃদু স্রোতে ভাসে থোকা থোকা কচুরিপানা। দেখতে দেখতে দহের বিস্তার বিবর্তিত হয় নদীতে; তাতে ভাসছে নোঙর করা বেশ কতগুলো বৃহৎ আকারের নৌকা। নদীর এক পাশে সবুজ ঘাসের বিশাল প্রান্তর। মাঠের শেষ সীমায় তীব্র রোদে দাঁড়িয়ে ত্রিভূজাকৃতির ক’টি পাহাড়। অন্য পাশে ঘন হয়ে আসা শ্যামল বনানীর উপর দিয়ে চূনা পাথরের কালচে ধূসর শৈল শিখর। নদীতে স্রোত মৃদু মন্দ। নৌকাগুলোর শরীর ঘেষে কালচে সবুজাভ্ জলরাশি ধীর লয়ে বয়ে চলে। আমরা আলগা তক্তার উপর দিয়ে হেঁটে বড়সড় নৌকাটিতে উঠতে উঠতে ফুয়াং আমাকে জানায়, ‘এ নাওগুলোর বাসিন্দারা সকলেই ভাসমান জলবেদে। নৌকায়ই তাদের ঘর দুয়ার, জীবন যাপন ও বসবাস। এরা সকলে কাঠের বাক্সের মতো খাঁচায় মাছ পালন করে।’ ফুয়াং এ পর্যন্ত জানাতেই আমরা নায়ের পাটাতনে এসে উঠি। ঠোঁটের উপর উঁচু হয়ে বেরিয়ে আসা দু’টি বাঁকানো দাঁতের এক প্রৌঢ় মতো লোক এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। আমি অনুমান করি এই            জলবেদেদের নিয়ে ফুয়াং তার ঋণ ও সঞ্চয় কর্মসূচী করে যাচ্ছে। এত পথ হেঁটে আসাতে আমার ক্লান্তি লাগে বলে আমি পাটাতনের উপর বসে পড়ি। ফুয়াং প্রৌঢ় লোকটির সাথে খুচরা কিছু কথাবার্তা বলে তাকে নিয়ে লাফ দিয়ে অন্য একটি নৌকায় চলে যায়। আমি মনে মনে ভাবি এত পথ হেঁটে আসার পরও মেয়েটির দেহে জোর কিছু কম নেই।

আমি বসে বসে নাও এর ভেতরটুকু দেখি। কাঠের চৌকির উপর পারিপাটি করে পাতা বিছানা। দেয়ালের হুকে ঝুলছে- হাড়ি, পাতিল, হ্যারিকেন, ছাতা ও সংসারের টুকিটাকি। খানিক অবাক হয়ে দেখি একপাশে টুলের উপর রাখা ব্যাটারি চালিত ছোট্ট এক টেলিভিশন। বিছানার ওপাশটুকু বেতের চৌখুপ্পি বেড়ায় আড়াল করা। আবডাল থেকে চশমা চোখে টুক্টুক করে এক বৃদ্ধা বেরিয়ে আসেন। আমি বুড়িকে ভিয়েতনামিজ্ কেতায় সম্ভাষণ করি। বুড়ো মানুষটি ফোকলা দাঁতে হেসে পাটাতনে বসে কুলায় করে আনা চাউল বাছতে শুরু করেন। কুলা থেকে সর সর করে অনেকগুলো পায়ে হেঁটে শুঁড় নাড়িয়ে পাটাতনের উপর দিয়ে ছুটে যায় দু’টি তেলাপোকা। বুড়ি চাউল বাছতে বাছতে কেবলই আড় চোখে আমার দিকে তাকান। এক পর্যায়ে উঠে গিয়ে নিয়ে আসেন এক ঘটি জল। আমি ঘর্মাক্ত হয়ে আছি বলে বোধ করি আমাকে ইশারায় হাতে মুখে ও মাথায় জল দিতে বলেন। আমি তার কথা মতো নৌকার প্রান্তে গিয়ে হাত মুখ ধুই। নদীর অতি মৃদু ধীর লয়ের স্রোতে ওপারের শৈল শ্রেণীর ছায়া স্পষ্ট দেখা যায়। অন্য নায়ের গলুই থেকে বেরিয়ে এসে ফুয়াং আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। সে ইশারায় আমাকে জলপান করতে নিষেধ করে। তার রোদচশমাটি এখন চুলের উপর তোলা। কাঁধ থেকে ¯ট্রাপে ঝুলে তার ফুল তোলা হ্যাট্। ফুয়াং এবার সার্কাসের এক্রোবেট মেয়েদের মতো তার স্থিতিস্থাপক পদযুগলে বিচিত্র কোণ সৃষ্টি করে লাগোয়া অন্য একটি নৌকায় চলে যায়। মুহূর্তে নদী জলে শৈল শিখরের প্রতিবিম্বে তার দেহরেখাটির ছায়া স্টিকারের মতো লেগে যায়। আমি তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্য নৌকাগুলোকে দেখি। বিকাল হয়ে আসছে। কোন কোন নাও থেকে অল্প বিস—র ধোঁয়া উড়ে। বাতাসে মাছ রাঁধার গন্ধ ভাসে। বেশ দূরে একটি নাও এর গলুইয়ে বসে একটি কিশোরী মেয়ে। মেয়েটি মনে হয় ধ্যান ধরে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। তার আংগুলগুলো চোখ ও মুখের উপর থেকে থেকে ঘুরে যায়। দূরত্বের জন্য সে ঠিক কি করছে তা পরিষ্কার দেখা যায় না। আমি কল্পনা করি- বালিকাটি জলের আরশিতে মুখ দেখে তার চোখে কাজল বোলাচ্ছে।

দাঁত উঁচু প্রৌঢ়ের পেছন পেছন ফুয়াং লাফ দিয়ে এসে আমাদের পাটাতনের উপর দাঁড়ায়। দু’টি নাও এর মধ্যভাগ অতিক্রমের দৈহিক পদ্ধতিতে তার বুক থেকে যেন দু’টি অর্ধগোলক শূণ্যে লাফিয়ে উঠে। তার চোখে মুখের সাবলিলতা দেখে মনে হয় প্রজেক্ট পরিদর্শনের ফলাফল মোটামুটি ভালোই। প্রৌঢ় লোকটি খাঁচায় করে মাছ পালন সম্পর্কে আমাকে বুঝাতে শুরু করে। ফুয়াং বিরস মুখে তা অনুবাদ করে যায়। এক পর্যায়ে প্রৌঢ়টি নৌকার পাশে গিয়ে বিস্তর কসরতে তোলে আনেন মাছ ভর্তি খাঁচা। খাঁচার ভেতর মাছগুলো রূপালি পালক ঝালকিয়ে খলবল করে ওঠে। সাথে সাথে আকাশে সারস জাতীয় দু’টি পাখি উড়ে আসে। প্রৌঢ় খাঁচা আবার জলে চুবিয়ে দেন। পাখি দু’টি কিছুক্ষণ চক্রাকারে উড়ে।

বৃদ্ধা কিছুতেই আমাদের না খেয়ে ফিরতে দেবেন না। তিনি ছই এর ভেতর পাটাতনে চাদর পেতে আমাদের খেতে ডাকেন। প্রৌঢ় চুল আচড়িয়ে গায়ে হোচিমিন জ্যাকেট চড়িয়ে চাদরে জানু পেড়ে বসেছেন। তিনি তার ঠোঁটের উপর উঁচু হয়ে থাকা দাঁতে মিষ্টি হেসে আমাদের খেতে ডাকেন। অগত্যা আমি ও ফুয়াং তাদের সাথে আহারে যোগ দেই। ভাতের সাথে আমরা চপ¯িটক দিয়ে ভাজা মাছ খাই। বাটিতে করে দেয়া হয় শামুক বা গুগলি জাতীয় কিছুর ঘন স্যুপ্। দিব্যি ক্ষিধা পেয়েছিল তাই জলের দেবতা খিজির খোয়াজের নাম করে স্যুপটি চাখি। খেতে খেতে বুড়ি ফুয়াং এর দিকে তাকিয়ে কিছু বলেন। বুড়ো মানুষটির মুখে উদ্বেগ ফুটে ওঠে। তিনি এবার জোরে শোরে তাকে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করছেন। ফুয়াং মাথা ঝাঁকায়। বুড়ি যেন রেগে যান। আমি কৌতূহলি হয়ে ফুয়াংকে বিষয়টি কি তা তর্জমা করতে বলি। ফুয়াং ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকায়। কিন্তু সে তর্জমার ধার দিয়েও যায় না। এবার প্রৌঢ় তার জীর্ণ জ্যাকেটে গাঁথা কাস্তে হাতুড়ি আঁকা ব্যাজ দেখিয়ে কিছু বলেন। ফুয়াং হাসি মুখে তার বক্তব্যটি অনুবাদ করলে আমি জানতে পারি- প্রৌঢ় ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। পিতৃভূমির প্রতি তার অবদানের জন্য তাকে সম্মানজনক ব্যাজ্ দেয়া হয়। একটু থেমে তিনি আবার যোগ করেন যে- টেলিভিশনে তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের নানাকিছু দেখেছেন। দেশটির নিসর্গ শোভা তার ভালো লেগেছে।

খাওয়া শেষে আমরা বিদায় নিয়ে নদীর পাড় ধরে উজানের দিকে হাঁটি। প্রৌঢ় কথা বলতে বলতে আমাদের সাথে চলেন। ফুয়াং আমাকে জানায় যে- তিনি কখনো সখনো ট্রাকটরের ড্রাইভার হিসাবে কাজ করেন। আজ তিনি আমাদের তার বাহনে করে জেলা সদরে পৌঁছে দিতে রাজী হয়েছেন। মিনিট তিরিশেক হেঁটে আমরা খেয়াঘাটে পৌঁছাই। তার ট্রাকটার নামক পাওয়ার টিলারটিকে পাওয়া যায় একটি বাজপড়া বৃক্ষতলে দাঁড়ানো। খেয়াঘাটের জোড় নৌকায় চেপে আমরা সকলে ওপারে আসি। পাওয়ার টিলারটির ড্রাইভারের আসনের দু’পাশে ঝালা করে লাগানো দু’খন্ড প্রশস্ত লোহার পাত্। আমি ও ফুয়াং পা ঝুলিয়ে পাত্ দু’টির উপর বসে যাত্রারম্ভ করি। দু’পাশের পাহাড় সারির মাঝ দিয়ে ধূলো উড়িয়ে থেকে থেকে ঝাঁকি দিয়ে টিলারখানা চলে। মাঝে মধ্যে ঝাঁকুনি তীব্র হলে আমি ও ফুয়াং পরষ্পরের হাত চেপে ধরি- আবেগবশতঃ নয় নিতান্ত আত্মরক্ষার তাগিদে। অবশেষে জেলা সদরে পৌঁছতে আমাদের ঘন্টা দেড়েকের মতো লাগে।

জেলার গেষ্টহাউসটি ব্যরাকের মতো। প্রতিটি কামরায় চার কিংবা পাঁচটি করে বিছানা পাতা। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তাই আমি পাজামা পরে উৎকট গরমে বিছানার উপর বসে হাসফাস করি। আমার মাথার উপর অতি মৃদু আলোর বৈদ্যুতিক বালভ্। বিদ্যুতের অপচয় যাতে না হয়- এজন্য এত কম আলো দেয়া হয়েছে- এ দিয়ে পত্র পত্রিকা কিছু পড়ার উপায় নেই। গেষ্টহাউসের এদিকে কোন ঘর-বাড়ী নেই বলে স্থানটি ভীষণ রকম নিরব হয়ে আছে। পাশের কামরায় ফুয়াং। আমি একা একা মশার গুঞ্জন শুনতে শুনতে ভাবি- মেয়েটি কি ঘুমিয়ে পড়েছে? কিছুক্ষণের মধ্যেই দরোজায় টোকা দিয়ে ফুয়াং চৌকাঠে এসে দাঁড়ায়। সে খানিক ইতস্তত করে বলে, ‘মিঃ সুলতান, তুমি যদি একটু বারান্দায় এসে বসো, আমি গেষ্টহাউসের পেছন দিকে চাপকলে গোসল সেরে নিতে পারি।’ তার অনুরোধ মোতাবেক আমি বারান্দায় এসে সিমেন্টের সিঁড়ির ধাপের উপর বসি। ফুয়াং টুথ্পে¯ট ও তোয়ালে হাতে গেষ্টহাউসের পেছন দিকে চলে যায়। আমি বসে বসে মশার কামড়ে বিরক্ত হই। বারান্দার ক্ষীণ শক্তি হলুদাভ্ বালভের আলোয় সমস্ত কিছু ঝাপসা ও ভৌতিক দেখায়। গেষ্টহাউসের পেছন থেকে চাপকলে বিস্তর কসরৎ করার আওয়াজ পাওয়া যায়। ইচ্ছে হয় এগিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে পানি তুলতে সাহায্য করি। কিন্তু মনে হয় উদ্যোগটি শোভন হবে না। বিমর্ষ হয়ে বসে বসে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদের বেরিয়ে আসা দেখি। একটু পর ফুয়াং বুকে তোয়ালে চেপে ভিজে কাপড়ে ত্রস্ত পদক্ষেপে আমার দিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তার কামরায় চলে যায়।
খানিক পর ফুয়াং আবার বারান্দায় ফিরে আসে। এখন তার পরনে বাসন্তী বর্ণের সিল্কের নরোম নাইটি। সে উল্টো দিকের সিঁড়ির ধাপে বসে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় মশক নিবারণী ওয়েন্টমেন্ট। মশার ঔষধটি পেয়ে আমি তার প্রতি যার পর নাই কৃতজ্ঞতা বোধ করি। সে এখন চিরুনী দিয়ে চুল আচড়াচ্ছে। তার অনাবৃত কাঁধ ও গলায় চাঁদের আলো এসে পড়ে। সে দু’বাহু উর্দ্ধে তুলে ব্যান্ড দিয়ে চুল বাঁধতে গেলে তার স্তন যুগলের উর্দ্ধভাগ দৃষ্ট হয়। আমি ইচ্ছে করে খানিক তফাতে আঙ্গিনার দিকে তাকাই। মেঘ সরে যাচ্ছে তাই চাঁদের আলোয় সন্ধ্যামালতী জাতীয় কিছু ফুল ফুটে উঠতে দেখা যায়। ফুয়াং এখন তার নিরাভরণ বাহুতে অয়েন্টমেন্ট মাখাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ আমরা চুপচাপ বসে থাকি। হঠাৎ করে সে মৃদু স্বরে বলে, ‘মিঃ সুলতান, আমি নৌকার বুড়ির কথা অনুবাদ করিনি বলে দুঃখিত।’ আমি এবার কৌতূহল নিয়ে তার দিকে তাকাই। সে একই স্বরে আবার বলে, ‘বুড়ি বলছিল কিছু দিন আগে এ এলাকা থেকে দু’টি যুবতী মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। সে আমাকে একা একা ঘুরে বেড়াতে মানা করছিল। আজকাল কিডন্যাপ খুব বেড়েছে। চীনে নারী শিশুর জ›ম রোধ করা হচ্ছে বলে- সমাজে মেয়েদের অভাব। কিডন্যাপ করে মেয়েদের চীন সীমান্তের ওপারে পাচার করে দেয়া হচ্ছে।’ আমি তরুণীটির নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে বিষণœ হয়ে ম্লান চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি।