শৈশবে মানচিত্র নিয়ে খুব করে ঘাঁটাঘাঁটি করতাম। তখন থেকেই পশ্চিম বাংলার শহর কুচবিহারকে ভালো লেগে গেল। দিন যায় বছর যায়। স্কুল ও কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম বিএ (অনার্স)-এ ক্লাসে। ১৯৭২ সাল সে বছরই প্রথম কুচবিহার যাওয়া। সেই স্মৃতি এখনও ভাসা ভাসা মনে পড়ে। তখন মনে হয়েছিল কিছুটা বিবর্ণ হলেও ছবির মতো সাজানো শহর কুচবিহার। ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম বলেই কুচবিহারের ইতিহাস জানতে ব্যাকুল হলাম। জেনে ছিলাম ১৫২২ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বসিংহর হাতে কুচ রাজ্যের পত্তন হলেও রায়কত শিরোপায় ভূষিত শিশু সিংহের হাতে ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে রায়কত বংশের প্রতিষ্ঠা। কুচ রাজদের করদ মিত্র স্বাধীন রাজ্য ১৯৪৯-এর ১২ সেপ্টেম্বর ভারতভুক্তি হতে কামতা বা কুচবিহার একটি জেলায় রূপ পেয়েছিল। সেই থেকে জেলার সদরও বসেছে এ কুচবিহারে । আমারই ক্লাসমেট বাবুল-ই একদিন বলল দোস্ত কুচবিহারে গেলে তো চল। দেখে আসবি পাসপোর্ট ভিসার প্রয়োজন নেই। তখন তো দেশ স্বাধীন হয়েছে সবে। সুযোগটি আর হাতছাড়া করলাম না। ঢাকা থেকে লালমনিরহাটে গিয়ে এক রাত কাটানোর পর আমরা সীমান্তের কাছাকাছি এলাম। বাবুলই সব ম্যানেজ করল। সীমান্তে শুধু এইটুকু বলেছিলাম, আমরা জয় বাংলা থেকে এসেছি। এতেই বিএসএফ খুশি। ভাসা ভাসা মনে পড়ে, দিনহাটা হয়ে আমরা কুচবিহারে গিয়েছিলাম। কুচবিহার যাওয়ার পথে বাবুল বলল, কুচবিহারেই আমার জš§। জšে§র বছর পাঁচেক পর বাবা কুচবিহার ছেড়ে এলেন লালমনিরহাটে।
প্রথমবার কুচবিহারে গিয়ে বিশাল রাজপ্রাসাদ দেখার জন্য বেরুলাম। মনে আছে প্রধান গেট থেকে ভেতরে ঢুকে বেশকিছুটা পথ এগিয়ে রাজপ্রাসাদের কাছে এলাম। বাবুল বলল, রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ কি পড়েছিস। হ্যাঁ। ও বলল, জানিস এ প্রাসাদেও ভূত পেতনী আর প্রেতাÍা ঘুরে বেড়ায়। ওর কথাগুলো শুনে ভয়ে বুকটা আঁতকে উঠল। সেই ১৯৭২ সালে কুচবিহারের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া কষ্টকর ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন একটা ভালো ছিল না।
প্রায় ৩৬ বছর পর কুচবিহারের কথা বেশ করে মনে পড়ায় কুচবিহারকে কাছ থেকে আবারও দেখব বলে বেনাপোল সীমান্ত অতিক্রম করে বনগাঁ থেকে লোকাল বাস ধরে এলাম কলকাতার ধর্মতলায়। দুপুর ২টায় বাস ছেড়ে যাচ্ছে কুচবিহারের উদ্দেশে। হাত তুলতেই বাসচালক বাস থামালেন। কন্ডাক্টরকে বললাম, কুচবিহার যাব। তিনি উঠতে বললেন। পছন্দ মতো একটি সিট বেছে নিয়ে বসতে বললেন। পরদিন সকাল দশটার দিকে বাস এসে থামল কুচবিহারে। রিকশা নিয়ে ইলোরা হোটেলের দিকে রওনা হলাম। আগে থেকেই জানতাম ইলোরা হোটেলের নাম। ইলোরা হোটেলেই লাগেজ রেখে এক ঘণ্টা রেস্ট নেয়ার পর কুচবিহার রাজপ্রাসাদ দেখার জন্য নিচে নেমে এলাম। যে দিকে তাকাই মনে হয় কত না সাজানো-গোছানো শহর। তবে কুচবিহারকে ৩৬ বছর পর দেখে মনে হল, অসম বাংলার যোগাযোগকারী পথে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে কুচবিহারের পরিচিতি থাকলেও, কুচবিহার জেলা তথা শহর পর্যটন মানচিত্রে এখনও জায়গা করে নিতে পারেনি। অথচ শৈব-শক্তি-বৈষ্ণব দেবালয়, সুরম্য রাজপ্রাসাদ, ঐতিহ্যময় বাড়িঘর, ছোট বড় দিঘি নিয়ে গড়ে ওঠা কুচবিহার শহর ঘিরে তৈরি হতে পারে নতুন একটি ভ্রমণ সার্কিট। তবে এ জেলার লোকগীতি ও লোকবাদ্যও সমীহ করার মতো। এক স্টুডিওতে ফিল্ম কিনতে গিয়ে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় হয়। তাকে জানালাম, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এ কথা শুনে উনিত বেজায় খুশি। বললেন, রাতের বেলা নিমন্ত্রণ রইল, দাদা আসবেন কিন্তু। কথায় কথায় ওই ভদ্র মহিলা জানালেন, কুচবিহার এ নামটি নিয়ে নানা মুনির নানা মত। একটি লোকের কথা অনুসারে কুচ বধুপুর ছিল শিব-পার্বতীর বিচরণস্থল। পরশুরামের ভয়ে ভীত ক্ষত্রিয়রা এসে ভগবতীর ক্রোড়ে বা কুচে আশ্রয় নেয়ার ফলে নাম হয় কুচবিহার।
কুচবিহার রাজপ্রাসাদ দেখার জন্য দুপুর ২টায় এলাম। ওখানে গিয়ে দেখলাম রাজপ্রাসাদের একতলা এবং দোতলায় কয়েকটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হয়েছে। রাজ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক সামগ্রীর অসাধারণ সংগ্রহ এখানে প্রদর্শিত হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে কুচবিহার জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত অমূল্য সব প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। ওখানেই পরিচয় হল এক গাইডের সঙ্গে। তিনিই জানালেন, মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে এ প্রাসাদের নির্মাণ কার্য শেষ হয় ১৮৮৭ সালে। সেই সময় খরচ পড়েছিল প্রায় ৯ লাখ টাকা। তার সঙ্গে এলাম বিশাল দরবার হলে। তখন শুধুই যে তাকিয়ে থাকা। একটু পর ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম। পাশেই রাজবাড়ি পার্ক সেখানে এসে বসলাম। অদূরে একটি ছেলে একাকী বসেছিল। হাত ইশারা করে ডাকতেই ও কাছে এল। জিজ্ঞেস করলাম তোমার নাম? বলল, ফিরোজ। তোমাদের বাড়ি কি কুচবিহারে? হাসতে হাসতে জানাল হ্যাঁ এখানেই তো।
পরদিন সকালে নাস্তা খেয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লাম কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বলতেই পারব না। বিকালবেলা একটু অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এবার একা একা এক ফার্মেসিতে গিয়ে চিকিৎসক আছেন কিনা জানতে চাইলাম। ফার্মেসির লোকজন বলল, তিনিতো এই মাত্র চলে গেছেন। তবু বসুন ফোন করে ওনাকে নিয়ে আসি। পনেরো মিনিটের মধ্যে চিকিৎসক এসে উপস্থিত। তার রুমে ঢুকে অসুস্থের কথা জানালাম। তিনি আমাকে বেশ ভালো করে দেখলেন। আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকে এসেছি...। এবার তিনিই বললেন, আমাদের পূর্ব পুরুষদের আদিবাড়ি কিন্তু আপনাদের বাংলাদেশের গাইবান্ধাতে। ১৯৪৭ সালের পর তারা এ কুচবিহারে চলে এলেন। চিকিৎসকের নাম হল ডা. এস পাল।
চিকিৎসাপত্রটি হাতে দিয়ে বললেন, আপনি কোথায় উঠেছেন?
বললাম, ইলোরা হোটেলে।
তিনি বললেন, রাত দশটার দিকে আপনাকে গিয়ে একবার দেখে আসব। সত্যি সত্যিই চিকিৎসক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তখন প্রশ্ন জাগল, আমাদের বাংলাদেশে এমনটি কি আশা করা যায়?
পরদিনও কুচবিহারে ছিলাম। ৮০ টাকায় রিকশা ভাড়া করে শহরের একটু দূরে তোর্মা নদীর তীরে গেলাম। তখন মনে পড়ল কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কথা। তার আসল দেশ তো এই কুচবিহারে। তিনি তো তোর্মা নদীকে নিয়ে গানও করেছেন। ওখান থেকে ফিরে এলাম শহরে। যেদিকে যাই মনে হয়, কুচবিহার শহরটি দেখতে অতি সুন্দর তো। বাহ্ এখানে আছে তরুবীথিযুক্ত প্রশস্ত রাজপথ। আহা কি-ই-না সুন্দর প্রমোদ উদ্যান। দীর্ঘ সরোবর সবই আছে। বাহ্ আরও আছে আম-কাঁঠাল-গুবাক। বৃক্ষ যেন শহরটিকে একটি সুন্দর কুশবনে পরিণত করেছে। তাই কুচবিহার ছেড়ে কিছুতেই ফিরতে ইচ্ছা করছিল না।
পরদিন দার্জিলিং যাব বলে প্রস্তুতি নিলাম এবং খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তাই-ই করলাম। চললাম দার্জিলিংয়ের দিকে...।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন