মেঠোপথে বেলে মাটির সাথে গেঁথে আছে লোহিত বর্ণের নুড়িপাথর। তীব্র সূর্যালোকে পায়ে চলা পথের পাশের ঘাস বিবর্ণ হরিৎ। আমি ও মিস্ ফুয়াং একটি মেয়েলি ছাতার নীচে আমাদের মাথা দু’টি রোদ বাঁচিয়ে হাঁটি। আমাদের দৃষ্টিসীমায় বেশ ক’টি আকার আকৃতিহীন জলাশয়। ছোট্ট এ ঝিলগুলোর কালচে সবুজ পানিতে সূর্যালোক রূপালি হয়ে ছলকায়। এ তীব্র দাবদাহেও ঝিলে বেশ ক’টি ডোঙ্গা জাতীয় নৌকা। ছোট্ট এ নাওগুলোতে মাথাইল পরে মাঝ বয়সী মহিলারা দূর্বাদাম কেটে ধীর লয়ে বৈঠা বায়। আলোর তীব্রতায় আমাদের চোখে যেন ধাঁধা লাগে। ঠিক বোঝা যায় না মাঝিরা মাছ ধরছে না কলমি শাক্ তুলছে। মিস্ ফুয়াং এর চলার গতি দ্রুত হয়। যেহেতু আমি উচ্চতায় দীর্ঘকায় তাই আমাকে মেয়েলি ছাতা উঁচিয়ে তার মাথায় ছায়া দিতে হয়। ফুয়াং থেকে থেকে হ্যাট্ পরা মাথা বাঁকিয়ে রোদচশমায় ঢাকা চোখে তাকিয়ে বোধ করি আন্দাজ করতে চেষ্টা করে আমি তার সাথে তাল মেলাতে পারছি কি না। চলাচলের দ্রুততার জন্য আমাদের মাঝে কথাবার্তা কিছু হয় না। আমাদের পাশ দিয়ে দু’জন মাঝ বয়সী ভিয়েতনামিজ্ মহিলা খালুই ভর্তি ছোট মাছ ও জলজ লতাগুল্ম শাক নিয়ে উল্টো দিকে চলে গেলে ফুয়াং রোদচশমা খুলে তাদের সাথে সম্ভাষণ বিনিময় করে। আচরণে মনে হয় মহিলারা ফুয়াংকে বেশ ভালো ভাবে চেনেন। কিন্তু তাদের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেমে বাক্যালাপ কিছু হয় না। আমরা পথের বাঁক অতিক্রম করি। এখানে বেশ ক’টি গাছপালা। তাদের ছায়ায় কর্দমাক্ত জলভরা খাদ। খাদে কাদা মেখে গড়াচ্ছে গোটা পাঁচেক রক্ত চক্ষু মহিষ। মহিষগুলোর কারো কারো শিং এ বসা শালিক পাখি।
রওয়ানা হওয়ার সময় ফুয়াং ভূমিকা স্বরূপ বলেছিল- সে আমাকে একটি গ্রামের গরিবী দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। তার মন্তব্যে আমি অলক্ষ্যে হেসে মনে মনে বলেছিলাম বাংলাদেশের শ্রীহট্ট অঞ্চলে আমার জ›ম, রাতের সাথে অন্ধকার যেরকম মিশে থাকে সেরকম দারিদ্রের সাথে আমাদের নিত্য দিনের সম্পর্ক। তারপরও গ্রামটির উপকণ্ঠে এসে মনে হলো- ফুয়াং অসত্য কিছু বলেনি। এ গ্রামের অবস্থা সত্যি সত্যিই করুণ। এখানকার কমিউনের ঘর- যেখানে গ্রাম কমিটির বসে শলা পরামর্শ করার কথা, মনে হয় ক্রমশঃ দরোজা জানালা খুইয়ে, চাল ভেঙ্গে ঝুরে ঝুরে পড়ছে। পতাকা দন্ডটি মনে হয় ঝড়ের চাপে সেই যে নুয়ে ছিল তা আর কেউ সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয়নি। আমাদের আশে পাশে একজন দু’জন করে শীর্ণ দেহের মানুষ জন হেঁটে যায়। ফুয়াং তাদের যথারীতি সম্ভাষণ করে। তাদের জবাবে কিন্তু উৎসাহ ব্যঞ্জক সাড়া কিছু পাওয়া যায় না। এখানকার ঘর দুয়ারের দিকে তাকালে মনে হয় বছর কয়েক আগেও এ গাঁয়ে সুসময় ছিল। বেশ ক’টি গৃহের কাঠামো ইট ও কাঠে গড়া, ছাদে কালচে হয়ে আসা টালি। অনেকগুলো বাড়ীর সামনে দু’টি করে বর্গাকৃতির পুকুর। একটু খেয়াল করে তাকালেই মনে হয় জলে সবুজ শর জমে আছে। পুকুরগুলো পাড় যেন চারদিক থেকে ক্রমে ক্রমে ভেঙ্গে পড়ছে। একটি ঘরের টালির ছাদ দুমড়ে মুচড়ে ঝুলে আছে। চালের এখানে সেখানে গর্ত ও ফোঁকর। আমি হাঁটতে হাঁটতে ভাবি গাঁয়ের মানুষ জন কি ঘর দুয়ার মেরামতের কথা একেবারে ভুলে বসেছে?
কিছুক্ষণের মধ্যেই কামরাটি ভরে যায় বেশ কয়েকজন মহিলা ও তরুণী বয়সের নারীতে। তাদের কেউ কেউ উদাসীন চোখে আমাকে তাকিয়ে দেখে। ফুয়াং এর কথাবার্তায় বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে দেখে আমি অনুমান করি- সে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এতে নারীদের মাঝে তেমন কিছু ভাবান্তর দেখা যায় না। দুটি নারী জোরে শোরে কিছু একটা বর্ণনা দেয়। ফুয়াং মুখ তুলে আমাকে বলে, ‘এদের অনেকেই ঋণ ফেরত দিতে পারছে না। বাচ্চাদের অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। এক মহিলার স্বামী সেই যে ঋণের টাকা নিয়ে শহরে কাজ করতে গেছে তার আর ফেরার নাম নেই। বাংলাদেশেতো গ্রামীন ব্যাংক সাক্সেস্ফুল প্রোগ্রাম করছে, ঋণ খেলাফী সমস্যার সমাধান তারা কি ভাবে করে?’ আমি জন সমক্ষে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে চাই না। তাই ফুয়াংকে বলি- পরে এক সময় এ নিয়ে কথা বলা যাবে। একটি তরুণী তার বাচ্চা মেয়ের পিটে ছোট্ট গামছা দিয়ে প্লাষ্টিকের সস্তা পুতুল বেঁধে দেয়। শিশুটি এখন পিটে খেলনা শিশু বয়ে মিনিয়েচার মা হয়ে সংকীর্ণ কক্ষে হাঁটাহাঁটি করে। দুয়ার দিয়ে সাবধানে উঁকি দিয়ে ফতুয়া পরা এক বৃদ্ধ এসে কামরায় ঢুকেন। বৃদ্ধের কপালে পাখির ডিমের মতো মাংশের গোলক। তিনি এগিয়ে এসে মৃদু হেসে আমার সাথে হাত মেলান। তার চোখে মুখে কৌতূহল। তিনি জানতে চান আমাদের দেশটি কি রাজা দ্বারা শাসিত? তার পরবর্তী প্রশ্ন হয়- আমার স্বদেশে দুর্ভিক্ষ হলে সরকার ফ্রি চাল দেয় কিনা? ফুয়াং যতেœ আমার জবাবের অনুবাদ করে। আমি এবার বৃদ্ধের কাছে জানতে চাই, ‘অতীত দিনে গ্রামবাসীদের পেশা কি ছিল?’ বৃদ্ধ তার কপালের গোলাকার ডিম চুলকিয়ে বলেন, ‘পাশের জলাভূমিতে সকলে এক সময় পাট চাষ করতো। দেশে সমাজতন্ত্র এলে সরকারী লোক এসে সকলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাটের কার্পেট তৈরী করতে শেখায়। তারপর দেখতে দেখতে একদিন পাট চাষ উঠে যায়। আজকাল কেউ আর জুট কার্পেট তৈরী করে না।’ বুড়োর কথা শেষ হলে আমি উৎসুক্য নিয়ে ফুয়াং এর দিকে তাকাই। সে ব্যাখ্যা করে বলে, ‘এই বছর দশেক আগেও এ গ্রামের অনেক জুট কার্পেট সরকার ইস্ট ইউরোপের বুলগেরিয়া, হ্যাংগেরী প্রভৃতি দেশে রপ্তানী করতো। সোভিয়েত ইউনিওনের সাথে সাথে ইস্ট ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ব্লক্ সহসা কলাপস্ করলে এখান থেকে পাট চাষ তামাদি হয়ে যায়।’ আমি ফুয়াং এর অনুবাদে আমাদের দেশের পাট-চাষীদের দুর্দশার কথা বলি। আমার বক্তব্যে এক ধরণের প্রতিক্রিয়া হয়। মনে হয় মহিলাদের অনেকেই অন্যদের সাথে উত্তেজিত স্বরে কিছু বল্ছে। আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে, তাই বোধ করি ফুয়াং আর সমস্ত কিছু অনুবাদ করে না। চৌকি থেকে উঠার মুখে দেখি টলোমলো পায়ে ছোট্ট বাচ্চাটি আমার হাঁটুর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে মুখে সাহসী কৌতূহল। সে আংগুল বাড়িয়ে আমার অনামিকায় পরা নীলা পাথরটি খুঁটতে শুরু করে। বুড়ো কাছে এসে জানতে চান- আমার শুঁটকি মাছে রুচি হয় কি না? আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি এক তরুণীকে ইশারা দেন। মেয়েটি দ্রুত উঠে গিয়ে আমার জন্য উপহার স্বরূপ নিয়ে আসে পলিথিনের ব্যাগ ভর্তি শুকনো মাছ।
এ গ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে আমি ও ফুয়াং ছাতা মাথায় ঘন্টা খানেক হাঁটি। এবারকার পথটি দীর্ঘ গাছপালা ও বাঁশঝাড়ে ছায়াছন্ন। তারপরও হাঁটতে গিয়ে আমাদের দারুণ ক্লান্ত লাগে। ফুয়াং বোধ করি খুব করে ঘামছে। সে পরে আছে অনেকটা আমাদের শেলওয়ার কামিজের মত্ োঢিলেঢালা সাদা আওডাই। তার জামার কিছু কিছু আংশ ভিজে উঠছে এবং শরীর থেকে ভাজা মৌরির মতো এক ধরণের ঘ্রাণ ভেসে আসে। এক পর্যায়ে আমি রীতিমত লবেজান বোধ করলে সে থেমে কাঁধে ঝুলানো প্রকান্ড পার্স থেকে বের করে দু’টি স্প্রাইটের ক্যান্। আমি বাঁশ ঝাড়ের ছায়াতলে ঘাসের উপর সটান বসে স্প্রাইট্ পান করি। পানীয়টি খরদাহে রক্তের মতোই উষ্ণ। কিন্তু তাতে তৃষ্ণা মেটে। আমার মাথায় এখন ছাতা নেই বলে স¤মুখের পাহাড় শ্রেণী স্পষ্ট দেখতে পাই। রোদ যেন পাহাড়ের চূনা পাথরের কালচে খয়েরি দেহে প্রতিফলিত হয়ে শূন্যতায় ছড়াচ্ছে রূপালি ধোঁয়া। একটি পাহাড়ের গ্রীবায় সাদা হাঁসের পালকের মতো তুলতুলে মেঘের ক্রমশঃ ভাসমান গহনা। আমার এখানে বসে- থেকে থেকে মেঘের ক্রমাগত উড়ে যাওয়া দেখতে ইচ্ছে হয়। ফুয়াং ঘড়ির দিকে তাকায় তারপর ভ্রকুটি করে আমাকে সচল হতে নির্দেশ দেয়। হাঁটতে শুরু করতেই কোথা থেকে আলুথালু শীতল হাওয়া আমাদের মুহূর্তের জন্য ছুঁয়ে যায়। আমাদের পাশ দিয়ে মহিষের পিটে বসে বাঁশি বাজাতে বাজাতে দিগন্তের দিকে চলে যায় একটি রাখাল বালক । আমরা বাকি পথটুকু চট্ জলদি অতিক্রমের জন্য দ্রুত হাঁটি।
হাঁটতে হাঁটতে এদিকে দহের থির জল ক্রমশ চলমান হয়ে উঠে। মৃদু স্রোতে ভাসে থোকা থোকা কচুরিপানা। দেখতে দেখতে দহের বিস্তার বিবর্তিত হয় নদীতে; তাতে ভাসছে নোঙর করা বেশ কতগুলো বৃহৎ আকারের নৌকা। নদীর এক পাশে সবুজ ঘাসের বিশাল প্রান্তর। মাঠের শেষ সীমায় তীব্র রোদে দাঁড়িয়ে ত্রিভূজাকৃতির ক’টি পাহাড়। অন্য পাশে ঘন হয়ে আসা শ্যামল বনানীর উপর দিয়ে চূনা পাথরের কালচে ধূসর শৈল শিখর। নদীতে স্রোত মৃদু মন্দ। নৌকাগুলোর শরীর ঘেষে কালচে সবুজাভ্ জলরাশি ধীর লয়ে বয়ে চলে। আমরা আলগা তক্তার উপর দিয়ে হেঁটে বড়সড় নৌকাটিতে উঠতে উঠতে ফুয়াং আমাকে জানায়, ‘এ নাওগুলোর বাসিন্দারা সকলেই ভাসমান জলবেদে। নৌকায়ই তাদের ঘর দুয়ার, জীবন যাপন ও বসবাস। এরা সকলে কাঠের বাক্সের মতো খাঁচায় মাছ পালন করে।’ ফুয়াং এ পর্যন্ত জানাতেই আমরা নায়ের পাটাতনে এসে উঠি। ঠোঁটের উপর উঁচু হয়ে বেরিয়ে আসা দু’টি বাঁকানো দাঁতের এক প্রৌঢ় মতো লোক এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। আমি অনুমান করি এই জলবেদেদের নিয়ে ফুয়াং তার ঋণ ও সঞ্চয় কর্মসূচী করে যাচ্ছে। এত পথ হেঁটে আসাতে আমার ক্লান্তি লাগে বলে আমি পাটাতনের উপর বসে পড়ি। ফুয়াং প্রৌঢ় লোকটির সাথে খুচরা কিছু কথাবার্তা বলে তাকে নিয়ে লাফ দিয়ে অন্য একটি নৌকায় চলে যায়। আমি মনে মনে ভাবি এত পথ হেঁটে আসার পরও মেয়েটির দেহে জোর কিছু কম নেই।
আমি বসে বসে নাও এর ভেতরটুকু দেখি। কাঠের চৌকির উপর পারিপাটি করে পাতা বিছানা। দেয়ালের হুকে ঝুলছে- হাড়ি, পাতিল, হ্যারিকেন, ছাতা ও সংসারের টুকিটাকি। খানিক অবাক হয়ে দেখি একপাশে টুলের উপর রাখা ব্যাটারি চালিত ছোট্ট এক টেলিভিশন। বিছানার ওপাশটুকু বেতের চৌখুপ্পি বেড়ায় আড়াল করা। আবডাল থেকে চশমা চোখে টুক্টুক করে এক বৃদ্ধা বেরিয়ে আসেন। আমি বুড়িকে ভিয়েতনামিজ্ কেতায় সম্ভাষণ করি। বুড়ো মানুষটি ফোকলা দাঁতে হেসে পাটাতনে বসে কুলায় করে আনা চাউল বাছতে শুরু করেন। কুলা থেকে সর সর করে অনেকগুলো পায়ে হেঁটে শুঁড় নাড়িয়ে পাটাতনের উপর দিয়ে ছুটে যায় দু’টি তেলাপোকা। বুড়ি চাউল বাছতে বাছতে কেবলই আড় চোখে আমার দিকে তাকান। এক পর্যায়ে উঠে গিয়ে নিয়ে আসেন এক ঘটি জল। আমি ঘর্মাক্ত হয়ে আছি বলে বোধ করি আমাকে ইশারায় হাতে মুখে ও মাথায় জল দিতে বলেন। আমি তার কথা মতো নৌকার প্রান্তে গিয়ে হাত মুখ ধুই। নদীর অতি মৃদু ধীর লয়ের স্রোতে ওপারের শৈল শ্রেণীর ছায়া স্পষ্ট দেখা যায়। অন্য নায়ের গলুই থেকে বেরিয়ে এসে ফুয়াং আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। সে ইশারায় আমাকে জলপান করতে নিষেধ করে। তার রোদচশমাটি এখন চুলের উপর তোলা। কাঁধ থেকে ¯ট্রাপে ঝুলে তার ফুল তোলা হ্যাট্। ফুয়াং এবার সার্কাসের এক্রোবেট মেয়েদের মতো তার স্থিতিস্থাপক পদযুগলে বিচিত্র কোণ সৃষ্টি করে লাগোয়া অন্য একটি নৌকায় চলে যায়। মুহূর্তে নদী জলে শৈল শিখরের প্রতিবিম্বে তার দেহরেখাটির ছায়া স্টিকারের মতো লেগে যায়। আমি তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্য নৌকাগুলোকে দেখি। বিকাল হয়ে আসছে। কোন কোন নাও থেকে অল্প বিস—র ধোঁয়া উড়ে। বাতাসে মাছ রাঁধার গন্ধ ভাসে। বেশ দূরে একটি নাও এর গলুইয়ে বসে একটি কিশোরী মেয়ে। মেয়েটি মনে হয় ধ্যান ধরে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। তার আংগুলগুলো চোখ ও মুখের উপর থেকে থেকে ঘুরে যায়। দূরত্বের জন্য সে ঠিক কি করছে তা পরিষ্কার দেখা যায় না। আমি কল্পনা করি- বালিকাটি জলের আরশিতে মুখ দেখে তার চোখে কাজল বোলাচ্ছে।
দাঁত উঁচু প্রৌঢ়ের পেছন পেছন ফুয়াং লাফ দিয়ে এসে আমাদের পাটাতনের উপর দাঁড়ায়। দু’টি নাও এর মধ্যভাগ অতিক্রমের দৈহিক পদ্ধতিতে তার বুক থেকে যেন দু’টি অর্ধগোলক শূণ্যে লাফিয়ে উঠে। তার চোখে মুখের সাবলিলতা দেখে মনে হয় প্রজেক্ট পরিদর্শনের ফলাফল মোটামুটি ভালোই। প্রৌঢ় লোকটি খাঁচায় করে মাছ পালন সম্পর্কে আমাকে বুঝাতে শুরু করে। ফুয়াং বিরস মুখে তা অনুবাদ করে যায়। এক পর্যায়ে প্রৌঢ়টি নৌকার পাশে গিয়ে বিস্তর কসরতে তোলে আনেন মাছ ভর্তি খাঁচা। খাঁচার ভেতর মাছগুলো রূপালি পালক ঝালকিয়ে খলবল করে ওঠে। সাথে সাথে আকাশে সারস জাতীয় দু’টি পাখি উড়ে আসে। প্রৌঢ় খাঁচা আবার জলে চুবিয়ে দেন। পাখি দু’টি কিছুক্ষণ চক্রাকারে উড়ে।
বৃদ্ধা কিছুতেই আমাদের না খেয়ে ফিরতে দেবেন না। তিনি ছই এর ভেতর পাটাতনে চাদর পেতে আমাদের খেতে ডাকেন। প্রৌঢ় চুল আচড়িয়ে গায়ে হোচিমিন জ্যাকেট চড়িয়ে চাদরে জানু পেড়ে বসেছেন। তিনি তার ঠোঁটের উপর উঁচু হয়ে থাকা দাঁতে মিষ্টি হেসে আমাদের খেতে ডাকেন। অগত্যা আমি ও ফুয়াং তাদের সাথে আহারে যোগ দেই। ভাতের সাথে আমরা চপ¯িটক দিয়ে ভাজা মাছ খাই। বাটিতে করে দেয়া হয় শামুক বা গুগলি জাতীয় কিছুর ঘন স্যুপ্। দিব্যি ক্ষিধা পেয়েছিল তাই জলের দেবতা খিজির খোয়াজের নাম করে স্যুপটি চাখি। খেতে খেতে বুড়ি ফুয়াং এর দিকে তাকিয়ে কিছু বলেন। বুড়ো মানুষটির মুখে উদ্বেগ ফুটে ওঠে। তিনি এবার জোরে শোরে তাকে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করছেন। ফুয়াং মাথা ঝাঁকায়। বুড়ি যেন রেগে যান। আমি কৌতূহলি হয়ে ফুয়াংকে বিষয়টি কি তা তর্জমা করতে বলি। ফুয়াং ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকায়। কিন্তু সে তর্জমার ধার দিয়েও যায় না। এবার প্রৌঢ় তার জীর্ণ জ্যাকেটে গাঁথা কাস্তে হাতুড়ি আঁকা ব্যাজ দেখিয়ে কিছু বলেন। ফুয়াং হাসি মুখে তার বক্তব্যটি অনুবাদ করলে আমি জানতে পারি- প্রৌঢ় ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। পিতৃভূমির প্রতি তার অবদানের জন্য তাকে সম্মানজনক ব্যাজ্ দেয়া হয়। একটু থেমে তিনি আবার যোগ করেন যে- টেলিভিশনে তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের নানাকিছু দেখেছেন। দেশটির নিসর্গ শোভা তার ভালো লেগেছে।
জেলার গেষ্টহাউসটি ব্যরাকের মতো। প্রতিটি কামরায় চার কিংবা পাঁচটি করে বিছানা পাতা। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তাই আমি পাজামা পরে উৎকট গরমে বিছানার উপর বসে হাসফাস করি। আমার মাথার উপর অতি মৃদু আলোর বৈদ্যুতিক বালভ্। বিদ্যুতের অপচয় যাতে না হয়- এজন্য এত কম আলো দেয়া হয়েছে- এ দিয়ে পত্র পত্রিকা কিছু পড়ার উপায় নেই। গেষ্টহাউসের এদিকে কোন ঘর-বাড়ী নেই বলে স্থানটি ভীষণ রকম নিরব হয়ে আছে। পাশের কামরায় ফুয়াং। আমি একা একা মশার গুঞ্জন শুনতে শুনতে ভাবি- মেয়েটি কি ঘুমিয়ে পড়েছে? কিছুক্ষণের মধ্যেই দরোজায় টোকা দিয়ে ফুয়াং চৌকাঠে এসে দাঁড়ায়। সে খানিক ইতস্তত করে বলে, ‘মিঃ সুলতান, তুমি যদি একটু বারান্দায় এসে বসো, আমি গেষ্টহাউসের পেছন দিকে চাপকলে গোসল সেরে নিতে পারি।’ তার অনুরোধ মোতাবেক আমি বারান্দায় এসে সিমেন্টের সিঁড়ির ধাপের উপর বসি। ফুয়াং টুথ্পে¯ট ও তোয়ালে হাতে গেষ্টহাউসের পেছন দিকে চলে যায়। আমি বসে বসে মশার কামড়ে বিরক্ত হই। বারান্দার ক্ষীণ শক্তি হলুদাভ্ বালভের আলোয় সমস্ত কিছু ঝাপসা ও ভৌতিক দেখায়। গেষ্টহাউসের পেছন থেকে চাপকলে বিস্তর কসরৎ করার আওয়াজ পাওয়া যায়। ইচ্ছে হয় এগিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে পানি তুলতে সাহায্য করি। কিন্তু মনে হয় উদ্যোগটি শোভন হবে না। বিমর্ষ হয়ে বসে বসে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদের বেরিয়ে আসা দেখি। একটু পর ফুয়াং বুকে তোয়ালে চেপে ভিজে কাপড়ে ত্রস্ত পদক্ষেপে আমার দিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তার কামরায় চলে যায়।
খানিক পর ফুয়াং আবার বারান্দায় ফিরে আসে। এখন তার পরনে বাসন্তী বর্ণের সিল্কের নরোম নাইটি। সে উল্টো দিকের সিঁড়ির ধাপে বসে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় মশক নিবারণী ওয়েন্টমেন্ট। মশার ঔষধটি পেয়ে আমি তার প্রতি যার পর নাই কৃতজ্ঞতা বোধ করি। সে এখন চিরুনী দিয়ে চুল আচড়াচ্ছে। তার অনাবৃত কাঁধ ও গলায় চাঁদের আলো এসে পড়ে। সে দু’বাহু উর্দ্ধে তুলে ব্যান্ড দিয়ে চুল বাঁধতে গেলে তার স্তন যুগলের উর্দ্ধভাগ দৃষ্ট হয়। আমি ইচ্ছে করে খানিক তফাতে আঙ্গিনার দিকে তাকাই। মেঘ সরে যাচ্ছে তাই চাঁদের আলোয় সন্ধ্যামালতী জাতীয় কিছু ফুল ফুটে উঠতে দেখা যায়। ফুয়াং এখন তার নিরাভরণ বাহুতে অয়েন্টমেন্ট মাখাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ আমরা চুপচাপ বসে থাকি। হঠাৎ করে সে মৃদু স্বরে বলে, ‘মিঃ সুলতান, আমি নৌকার বুড়ির কথা অনুবাদ করিনি বলে দুঃখিত।’ আমি এবার কৌতূহল নিয়ে তার দিকে তাকাই। সে একই স্বরে আবার বলে, ‘বুড়ি বলছিল কিছু দিন আগে এ এলাকা থেকে দু’টি যুবতী মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। সে আমাকে একা একা ঘুরে বেড়াতে মানা করছিল। আজকাল কিডন্যাপ খুব বেড়েছে। চীনে নারী শিশুর জ›ম রোধ করা হচ্ছে বলে- সমাজে মেয়েদের অভাব। কিডন্যাপ করে মেয়েদের চীন সীমান্তের ওপারে পাচার করে দেয়া হচ্ছে।’ আমি তরুণীটির নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে বিষণœ হয়ে ম্লান চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন