বুধবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ

ফয়সাল আহম্মেদঃ প্রতিবছরের মতো এবারও যখন আমাদের ভ্রমণপিয়াসী দলটি হাতড়ে বেড়াচ্ছে সীমিত টাকায় কোথায় কোথায় যাওয়া যায়, চীনের প্রাচীর থেকে হো চি মিন সিটি—কিছুই বাদ গেল না আলোচনায়। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো সিংহল দ্বীপ বা শ্রীলঙ্কা। যা ভেবেছিলাম, তার চেয়েও অনেক সুন্দর দেশটি। সেখানকার মানুষের মিষ্টি ব্যবহার, ঝকঝকে-তকতকে রাস্তাঘাট, জিবে জল আনা সব খাবারদাবার ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য—সবই আমাদের অভিভূত করেছে। আর সবচেয়ে অবাক হয়েছি বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের হাসিমুখ দেখে। আমি চ্যালেঞ্জ করতে পারি, কেউ আর
কোনো দেশে এটা দেখেননি।
কলম্বো: শুরুতেই রাজধানী
ছয় দিনের একটি বেড়ানোর প্রোগ্রাম নিয়ে আমাদের আটজনের দলটি রওনা দিলাম মিহির লঙ্কা ফ্লাইটে। রাজধানী কলম্বোর বন্দরনায়েকে বিমানবন্দরের বাইরে এসেই বুঝলাম, আমাদের স্থান বাছাই চমৎকার হয়েছে। শহরের কিছু যানজট পেরিয়ে চারদিক দেখতে দেখতে যখন গাড়িটি এসে পৌঁছাল শহরের শেষ প্রান্তে লাভিনিয়ার সাগরসৈকতের হোটেল বারজায়ায়, তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। অবশ্য পথেই দাঁড়িয়েছিলাম একটি খাবারের দোকানে। সেখানে অনেক খাবারের ভিড়ে এক কোনায় বিক্রি হচ্ছিল আমাদের চিতই পিঠার মতো একটি জিনিস, ওপরে ডিমপোচ দিয়ে। তা দেখেই রাফফাত হইচই করে উঠল, উহ্, এইটা তো ট্র্যাভেল অ্যান্ড লিভিংয়ে পিটার কুরুবেদার ‘মাই শ্রীলঙ্কা’-তে দেখেছি। এর নামই ‘ওপাস ওপাস’। আরে এই তো দেখা যাচ্ছে ‘মালু পান’, (ত্রিকোনাকার রুটি) এগুলো কিন্তু খেতেই হবে।
রাতের খাওয়া হলো সমুদ্রসৈকতের একটি রেস্তোরাঁয়। মিটিমিটি মোমের আলোয় সাগরের গর্জন, সেই সঙ্গে ভেসে আসা স্প্যানিস আর ইংরেজি গান—সব মিলে অপূর্ব এক পরিবেশে ডিনার সারলাম। খাওয়া আর আড্ডা দিতে দিতে অনেক রাত হয়ে গেল। পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম কলম্বো দেখতে।
শহরজুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ডাচ, পর্তুগিজ ও ব্রিটিশদের তৈরি নানা কীর্তি ও স্থাপত্য। কলম্বোতে আপনি দেখতে পারেন সেন্ট অ্যান্থনি’স চার্চ, অল সেইন্টস চার্চ, উলভেনডাল চার্চ, সীমা মালাকা মন্দির; রয়েছে অনেক বৌদ্ধমন্দির, পুরোনো পার্লামেন্ট ভবন, প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম, পুরোনো টাউন হল। সময় হাতে থাকলে আরও দেখে নিতে পারেন জাদুঘর এবং প্রাচীনতম ও বৃহত্তম হিন্দুমন্দির বৈলাশানাথন স্বামীমন্দির।
শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার সাঙ্গাকারা আমাদের কাছে খুব জনপ্রিয় একজন। কাজেই দলের ভেতর থেকে দাবি উঠল, সাঙ্গাকারার রেস্তোরাঁ ‘মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাবে’ যেতেই হবে। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্র, অর্থাৎ মূল বাণিজ্যিক এলাকায় একটি ওপেন মলে এটির অবস্থান।
বলে রাখা ভালো, কেউ যদি শ্রীলঙ্কায় গিয়ে কিছু কেনাকাটা করতে চান, তাহলে তা কলম্বোতেই সেরে নিতে হবে। ওডেল, কটন কালেকশনসহ বেশ কয়েকটি বড় দোকান রয়েছে। শ্রীলঙ্কা থেকে কিনতে পারেন চা-পাতা, ভেষজ কসমেটিকস, বিভিন্ন ধরনের পাথর, সুতির কাপড়ের তৈরি পোশাক ও মসলা।
ক্যান্ডি
দুই দিন কলম্বোতে ঘোরাঘুরি করে আমরা রওনা দিলাম শৈল শহর ক্যান্ডির দিকে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পবিত্র ভূমিও এই ক্যান্ডি। এখানে যাওয়ার পথে আমরা গেলাম ‘এলিফ্যান্ট অরফানেজ’ বা হাতিদের আশ্রয়কেন্দ্র দেখতে। ১৯৭৫ সালে পিনাওয়ালাতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় আহত ও অনাথ বাচ্চা হাতিদের রাখার জন্য। আমরা যখন পৌঁছালাম, ওদের তখন গোসল করার জন্য নদীতে নেওয়া হয়েছে। অপূর্ব সুন্দর একটি পাহাড়ি নদী, যেখানে গোসল করছে ২৫ থেকে ৩০টি ছোট-বড় হাতি। দুপুরে হাতির দল ফিরে গেল তাদের থাকার জায়গায়, সেখানে তাদের খাওয়ানো হলো।
ক্রমেই পথ হয়ে উঠল পাহাড়ি। পাহাড় বেয়ে গাড়ির পাশাপাশি ট্রেনও ছুটে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে চোখে পড়ল চা-বাগান, মাটি ও বাঁশ-বেতের তৈরি জিনিসের ওপর। ক্যান্ডি শহরটা একটা লেক ঘিরে। আর উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় বসে যিনি এখানে শান্তির পরশ বুলিয়ে যাচ্ছেন, তিনি গৌতম বুদ্ধ। বহিরাভোকান্ডা বৌদ্ধবিহারে শ্বেতপাথরে নির্মিত গৌতম বুদ্ধের এই মূর্তি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। শহরের সব জায়গা থেকেই এটি চোখে পড়ে।
গলে
ক্যান্ডি থেকে গেলাম সাগরে ঘেরা শহর গলেতে। সবাই যাওয়ার যে পথ, অর্থাৎ যে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি চালাল, তা দেখে আবার আমরা অভিভূত। গাড়ির গতি ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার, কিন্তু একটুও ঝাঁকুনি খেতে হচ্ছে না। চলতে চলতেই আমরা স্বপ্ন দেখলাম, এ রকম চারটি রাস্তা আমরা তৈরি করব বাংলাদেশে। শুধু ওই বড় রাস্তাই নয়, এদের সব পথই পরিষ্কার ও মসৃণ। গলেতে ঢোকার মুখে প্রথমেই চোখে পড়ল ভারত মহাসাগর। সাগরের পাড় ঘেঁষেই শহরের রাস্তা। কিন্তু শহরটা কোথায়? এখানে তো সবটাই সাগর। উত্তাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে চারপাশে।
পর্তুগিজ ও ডাচ স্থাপনার অনেক নির্দেশন দেখতে পাওয়া যায় গলেতে। এ কারণেই এটিও বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। পণ্ডিতেরা মনে করেন, ওল্ড টেস্টামেন্টে ‘তারনিস’ বলে যে জায়গার কথা উল্লেখ আছে, গলে আসলে সেই জায়গা, যেখানে বাদশা সোলায়মান তাঁর বাণিজ্যতরি পাঠিয়েছিলেন।
গলেতে সবচেয়ে সুন্দর দেখার জায়গা ডাচদের পুরোনো নগর এবং এর পুরোনো লাইটহাউস। পুরোনো জিনিস ও মুখোশের বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে এখানে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে গেলে তিমি দেখতে সাগরে যাওয়া যায়। এ ছাড়া সময় থাকলে দেখে আসা যায় রেইন ফরেস্ট, কচ্ছপের হ্যাচারি ও ডাচ মিউজিয়াম।
যেভাবে যাবেন
শ্রীলঙ্কার ভিসা পাওয়া যায় কলম্বো বিমানবন্দরে পৌঁছে। নিজেও যেতে পারেন, ট্র্যাভেল এজেন্টও নিয়ে যায়। খরচ প্রতিজন ৭৫ থেকে ৮৫ হাজার টাকা।
ফয়সাল আহম্মেদ
দৈনিক সুন্দরবন বাংলাদেশ

1 টি মন্তব্য: