প্রিন্স হাওলাদারঃ ইমিগ্রেশন
পেরিয়েই কে আমাকে নিতে এসেছে, খুঁজতে লাগলাম। বুকে ‘রুদেএন’ লাগানো এক
দশাসই প্রবীণকে দেখে রুশে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার জন্য এসেছেন?’ শুনে তাঁর
উত্তর, ‘চোর্ত ইভো জ্নায়েত! (আমি কোত্থেকে জানব)!’ আর তাতেই বুঝে গেলাম,
হ্যাঁ, রাশিয়ার মাটিতেই ‘ল্যান্ড’ করেছে আমার পা দুটো।ব্যাখ্যা করলেন
ভদ্রলোক, ‘আমি ট্যাক্সি ড্রাইভার। আমাকে বলেছে, ইস্তাম্বুল থেকে কেউ একজন
আসবে। তুমি যদি সে লোক হয়ে থাকো, তাহলে অকারণে সময় নষ্ট না করে চলো বেরিয়ে
পড়ি।’
১৭ বছর পর আবার মস্কো! ভ্নুকোভা এয়ারপোর্ট
থেকে বিশাল কালো মার্সিডিজ এগিয়ে চলেছে রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ
ইউনিভার্সিটির (রুদেএন) দিকে। এখানেই ১২ নম্বর ব্লকের হোটেলে থাকা ও
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম তলায় সেমিনার। সারা বিশ্ব থেকে রুশ ভাষার শিক্ষকদের
আনা হয়েছে রুশ ভাষার নতুন যেসব দিক উন্মোচিত হয়েছে, তার সঙ্গে পরিচিত করার
জন্য।
১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সময়টা কাটিয়েছি
রাশিয়ার ক্রাসনাদার শহরে। আসা-যাওয়ার পথে মস্কো। একবার ইংল্যান্ডে যাওয়ার
সময় মাস দেড়েক একনাগাড়ে থাকতে হয়েছিল মস্কোয়।
১৭ বছর আগের মস্কোর রাজপথের সঙ্গে এখনকার
পথের কোনো মিল নেই। সন্ধ্যার নিয়নের আলোয় ধাবমান যে গাড়িগুলোর দিকে চোখ
গেল, তাতে আমি স্তম্ভিত। বিশাল এই গাড়িরাজ্যে রুশ প্রতিনিধিত্ব নেই।
রাজ্যের দামি দামি সেরা মডেলের গাড়ির এক উন্মুক্ত প্রদর্শনী যেন রাস্তায়।
আর আশপাশে যে প্রান্তর ছিল, তা প্রাসাদোপম অফিসবাড়িতে বদলে গেছে। গাড়ির
চালককেই মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাশিয়ায় তৈরি গাড়ি...’
মুখের কথা মুখেই থাকল। গাড়ির গতিতেই মুখ
চলল তাঁর, ‘রাশিয়ার গাড়ি তুমি মস্কোতে দেখবে কীভাবে? মস্কোতে কি এখন আর
গরিব লোক আছে নাকি? হাতে টাকা থাকলেই বিদেশি গাড়ি কিনে ফেলে। রাশিয়ায় তৈরি
গাড়ি দেখতে পাবে শুধু মফস্বলে গেলে।’ কথাটা কতটা সত্যি, তার পরিচয় মিলবে
আমার সাত দিনের মস্কো সফরে গুনে গুনে তিনটি রুশ গাড়ির দেখা পাওয়ার মধ্যে।
দীর্ঘদিন মস্কোয় চাকরি করছেন আবদুর রোকন।
ক্রাসনাদারেই পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মস্কোর পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি
থেকে পিএইচডি করে মস্কোতেই স্থিত হয়েছেন। আমার আসার সংবাদ পেয়ে বিএমডব্লিউ
গাড়ি চালিয়ে তিনি হাজির। বললেন, শনিবার এক ফাঁকে মস্কো শহরটি ঘুরে দেখাবেন।
মিকলুকা-মাখলায়া সড়কের ছাত্রপাড়াটি দূর
থেকে দেখে মনে হয় আগের মতোই। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই পরিবর্তনটা টের পাওয়া
যায়। হোস্টেলগুলোর চারপাশে গোটা বারো ক্যাফে। দীনহীন স্তালোবায়া (ছাত্রদের
ক্যানটিন) এখন আর নেই। কিছু কিয়স্ক গড়ে উঠেছে, যেখানে মুখরোচক খাদ্যসম্ভার।
সসেজ-রুটি, শরমা ধরনের খাবার, যা ক্লাসে যাওয়ার আগে চট করে কিনে খেতে খেতে
পথ চলা যায়। পুরো ছাত্রপাড়ায় সিগারেট নিষিদ্ধ। কারও যদি ধূমপানের ইচ্ছে
জাগে, তাহলে অবশ্যই বাইরে রাস্তায় এসে নির্দিষ্ট স্থানে তা করতে হবে।
ট্রাফিক আইন না মানলে বিশাল অর্থদণ্ড।
কিন্তু যেখানে অবারিত রাস্তা, সেখানে চালকেরা যে গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন, তা
বিস্ময়কর। তবে, আইন ভাঙার প্রবণতা নেই বললেই চলে। কর্মদিবসগুলোতে বাস,
ট্রলিবাসের জন্য ডানের লেন নির্ধারিত। সে লেনে গাড়ি ঢুকলেই সর্বনাশ—বিশাল
অঙ্কের অর্থদণ্ড। রাস্তায় রাস্তায় লুকানো সিসিটিভি। আইন ভেঙে ভাবছেন পার
পেয়ে যাবেন—উঁহু।
মস্কোয় চলাচলের জন্য এখনো সেরা বাহন
মেট্রো। দ্রুতগতিসম্পন্ন এই যানে চলাচল আরামদায়ক। মেট্রো এখন পরিচ্ছন্ন।
স্টেশনগুলোও সব সময় ঝকঝকে তকতকে রাখার চেষ্টা করা হয়। আগের ঢিলেঢালা সরকারি
সেবার বদলে ত্বরিতগতির পরিচ্ছন্নতা অভিযান স্টেশনগুলোতে আবর্জনা জমতে দেয়
না। তবে সেই পাঁচ কোপেকের দিন শেষ। এখন মেট্রোর ভাড়া ২৮ রুবল। ভালো লাগল,
ট্যাব, মোবাইলে ডুবে থাকা মানুষের পাশাপাশি মেট্রোতে বই হাতে মানুষের
সংখ্যা কমেনি দেখে।
ব্যাংক এবং মানি এক্সচেঞ্জ সর্বত্রই। যে
কেউ ইচ্ছেমতো ডলার, পাউন্ড, ইউরো কিনতে পারে, ভাঙাতেও পারে সেখানে। এক
ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যায় ৩২ রুবল থেকে শুরু করে ৩৩ রুবল পর্যন্ত।
সরকারি দোকান বলে কিছু চোখে পড়ল না। আগে
‘উনিভেরসাম’ নামে তরিতরকারি-মাছ-মাংসের দোকান ছিল সবখানেই। সেগুলো দেখিনি।
তার স্থান নিয়েছে বিশাল বিশাল সব সুপারমার্কেট। বিদেশি পুঁজিও খাটছে
সেখানে। বড় বড় ব্র্যান্ডের উপস্থিতি সবখানেই। কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডস,
জাপানের সুশির দোকান যেমন আছে, তেমনি বিশেষ রুশ খাবারও রয়েছে। নিজের দিকে
ক্রেতা টানার জন্য ওয়েটাররা মিউজিক বাজিয়ে একপাক নেচেও নিচ্ছেন।
শিক্ষকেরা কেমন আছেন, প্রশ্ন রেখেছিলাম
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষকদের কাছে। ভ্লাদিমির পুতিন বেতন বাড়ানোর কথা
বলেছেন ঠিকই, কিন্তু এখনো তা কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। নতুন একজন শিক্ষক ৩০
হাজার রুবল মতো পান, যা দিয়ে মস্কোর মতো শহরে টিকে থাকা মুশকিল। তাই
অধিকাংশ তরুণ শিক্ষক চাকরির বাইরেও কিছু না কিছু করে থাকেন। একটা তুলনামূলক
ছবি তুলে ধরলেই বোঝা যাবে সমস্যাটা। একজন নবীন মেট্রোচালকের শুরুর বেতনই
৬০ হাজার রুবল। সেটা বেড়ে ৮৫ হাজার হয়। শিক্ষকদের অবস্থা এ থেকেই বোঝা যায়।
তবে অধ্যাপকদের বেতন অনেক। আগে পুরো শিক্ষক সমাজই যে অর্থনৈতিক চাপে থাকত,
সেটা এখন আর নেই।
সংস্কৃতিজগতের পরিবর্তনটা চোখে পড়ে। সেটাকে ইতিবাচক না বলার কোনো কারণ নেই। মস্কোর বিখ্যাত সার্কাস দেখলাম। বিশাল এরেনায় একদিকে ধ্রুপদি সংগীত, অন্যদিকে রকসংগীতের সরঞ্জাম। এক ঘণ্টার পুরো অনুষ্ঠানে কারও মুখে কোনো কথা নেই। আগে দেখেছি, ক্লাউনরা কথা বলে মানুষ হাসায়, এবার দেখলাম, মৌনতা আর মূকাভিনয়ই তাদের সঙ্গী। তন্ময় হয়ে তা উপভোগ করা ছাড়া উপায় নেই।
কেমন নাটক হচ্ছে, সে সংবাদও নেওয়া হলো। একটি অডিটরিয়ামে শুধু আমাদের জন্যই পরিবেশন করা হলো নাটক। মাত্র চারজন অভিনয় করলেন ১৪টি চরিত্রে। লোকজ ধারায় (বাবা ইয়াগার কথা মনে পড়ে?) নির্মিত এই নাটকে মুহূর্তের মধ্যেই একেকজন একেক চরিত্র হয়ে যাচ্ছেন, যা দেখে বিস্ময় জাগে মনে। রূপকথা দিয়েই ব্যঙ্গ করা হয়েছে শাসন-শোষণের। রাশিয়ায় নাটক মরে যায়নি।
সংস্কৃতিজগতের পরিবর্তনটা চোখে পড়ে। সেটাকে ইতিবাচক না বলার কোনো কারণ নেই। মস্কোর বিখ্যাত সার্কাস দেখলাম। বিশাল এরেনায় একদিকে ধ্রুপদি সংগীত, অন্যদিকে রকসংগীতের সরঞ্জাম। এক ঘণ্টার পুরো অনুষ্ঠানে কারও মুখে কোনো কথা নেই। আগে দেখেছি, ক্লাউনরা কথা বলে মানুষ হাসায়, এবার দেখলাম, মৌনতা আর মূকাভিনয়ই তাদের সঙ্গী। তন্ময় হয়ে তা উপভোগ করা ছাড়া উপায় নেই।
কেমন নাটক হচ্ছে, সে সংবাদও নেওয়া হলো। একটি অডিটরিয়ামে শুধু আমাদের জন্যই পরিবেশন করা হলো নাটক। মাত্র চারজন অভিনয় করলেন ১৪টি চরিত্রে। লোকজ ধারায় (বাবা ইয়াগার কথা মনে পড়ে?) নির্মিত এই নাটকে মুহূর্তের মধ্যেই একেকজন একেক চরিত্র হয়ে যাচ্ছেন, যা দেখে বিস্ময় জাগে মনে। রূপকথা দিয়েই ব্যঙ্গ করা হয়েছে শাসন-শোষণের। রাশিয়ায় নাটক মরে যায়নি।
লেনিন লাইব্রেরির পাশে চাইকোভস্কির নামে
যে কনসারভেটরিটি আছে, সেখানে মোৎসার্ট, বিটোফেন এবং নতুন রুশ কম্পোজিটারদের
রচনা থেকে বাদন শোনার অভিজ্ঞতা হলো। পিয়ানো আর বেহালা যে কীভাবে আকৃষ্ট
করতে পারে, তা এখানে উপস্থিত না থাকলে বুঝতে পারতাম না। একেবারে নিচু থেকে
ধীর লয় কখন যে দ্রুত লয় হয়ে শব্দ বাড়িয়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে মিলনায়তন, তা মুগ্ধ
বিস্ময় নিয়ে দেখলাম।
মস্কো ভ্রমণে ক্রেমলিন, বালশোই থিয়েটার,
মসফিল্ম, মস্কো নদী, নোভাদেভিচি কবরস্থানসহ কত জায়গায়ই তো বুড়ি ছোঁয়ার মতো
ছুঁয়েছি। মস্কো এখন জৌলুশের শহর। তার পরও মনে হয়, এখানেই একদিন সব মানুষকে
সমান দেখার স্বপ্ন বুনেছিল মানুষ! এখন এখানে সব আছে, আরও বেশি বেশি করে
আছে; শুধু সেই স্বপ্নীল আবেশটি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
প্রিন্স হাওলাদার
দৈনিক সুন্দরবন বাংলাদেশ
দৈনিক সুন্দরবন বাংলাদেশ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন