সাবরিয়া মনিরাঃ সাইকেল চালাতে হবে শুনে আঁতকে উঠলাম। একে তো ভিনদেশ, তার ওপর
ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা নেই। আর দুই চাকার এই যান শেষ চালিয়েছি তা-ও
১৫-১৬ বছর আগে। এত দিন পর পারব তো!হাতেন হোটেলের লবিতে বসে এমন সাতপাঁচ
ভাবছি। হঠাৎ ডাক পড়ল সবার, দ্বিচক্রযান এসে গেছে। হোটেলের সামনের রাস্তায়
লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা গোটা বিশেক সাইকেল থেকে একটা বেছে নিয়ে গাইডের
পিছু নিলাম। মালাকার রাস্তা ধরে ধীরগতিতে দ্বিচক্রযান এগোচ্ছে।টুরিজম
মালয়েশিয়ার আমন্ত্রণে ঢাকা থেকে ১০ জনের একটি দল মালয়েশিয়া সফরে এসেছে। সেই
দলে আমিও আছি। কুয়ালালামপুর
বিমানবন্দরে এসে নামলাম। তারপর পুত্রাজায়া হয়ে পরের দিন ঐতিহাসিক
শহর মালাকায়। এটি মালয়েশিয়ার তৃতীয় ক্ষুদ্রতম একটি রাজ্য এবং ইউনেসকো ঘোষিত
বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি অংশ।
ঝকঝকে রাস্তার কোথাও এতটুকু
ধুলাবালু নেই। গাড়িঘোড়াও কম। এক পাশে সজ্জিত দালানকোঠা। আরেক পাশে
দিগন্তবিস্তৃত নদী। মিনিট পাঁচেক দ্বিচক্রযান চালানোর পর আমরা যে জায়গায়
গিয়ে থামলাম, সেটার নাম পোর্ট ডি সান্টিয়াগো। টিলার ওপর একটা দুর্গের
ভগ্নাবশেষ এটি। ষোড়শ শতকে পতুর্গিজরা বানিয়েছিল। আর উনিশ শতকের গোড়ার দিকে
ব্রিটিশরা ধ্বংস করেছিল। ব্রিটিশরা একসময় দুর্গটিতে গোলাবারুদ মজুত রাখত।
ভাঙাচোরা দুর্গ ফটকের দুই পাশে দুটি কামান। ফটক পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি ধরে ওপরে
উঠে আরও একটি ভগ্নাবশেষের দেখা মিলল।
টিলার ঢালে দুদিকে দুটি জাদুঘর। একটি মিউজিয়াম অব ডেমোক্রেসি, অপরটি মিউজিয়াম অব গভর্নর হাউস নামে পরিচিত। টিলার পাদদেশে মালাকা কেন্দ্রীয় পুলিশ ফাঁড়ি। ফাঁড়ি পেরিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে কয়েকখানা বেইচার দেখা মিলল। কৃত্রিম ফুল, পাখি, লতাপাতা ও কার্টুনের নানা চরিত্র দিয়ে সাজানো একধরনের রিকশাকে মালয়িরা বেইচা নামে ডাকে। আমাদের দেশের রিকশার মতোই বেইচাও প্যাডেল ঘুরিয়ে চালাতে হয়।
টিলার ঢালে দুদিকে দুটি জাদুঘর। একটি মিউজিয়াম অব ডেমোক্রেসি, অপরটি মিউজিয়াম অব গভর্নর হাউস নামে পরিচিত। টিলার পাদদেশে মালাকা কেন্দ্রীয় পুলিশ ফাঁড়ি। ফাঁড়ি পেরিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে কয়েকখানা বেইচার দেখা মিলল। কৃত্রিম ফুল, পাখি, লতাপাতা ও কার্টুনের নানা চরিত্র দিয়ে সাজানো একধরনের রিকশাকে মালয়িরা বেইচা নামে ডাকে। আমাদের দেশের রিকশার মতোই বেইচাও প্যাডেল ঘুরিয়ে চালাতে হয়।
আকাশে গনগনে সূর্যটা তখন আগুন
ঝরাচ্ছে। মালয়েশিয়ায় ঋতু বলতে গরম আর বৃষ্টি। এই প্রচণ্ড রোদ, তো পরক্ষণেই
ঝুমবৃষ্টি। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরিতে সবার গলা শুকিয়ে কাঠ। বোতলের পানিতে গলা
ভিজিয়ে ফের দ্বিচক্রযানে চেপে বসলাম। এপথ-ওপথ ঘুরে এসে দাঁড়ালাম রেড ফোর্ট
চত্বরে। ক্ষণিক বিরতি দিয়ে সোজা জঙ্কারস স্ট্রিটের দিকে রওনা হলাম। সেখানে
যেতে যেতে মালাকার আসল রূপটা দেখা গেল।রাস্তার দুই পাশে
পুরোনো আমালের দালানকোঠাগুলো গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা আমাদের
পুরান ঢাকার মতো দেখতে। ফারাক একটাই। মালাকার ভবনগুলো অনেক পরিপাটি। আর
রাস্তাগুলো ছিমছাম। দ্বিচক্রযান রেখে একটা মন্দিরে ঢুকলাম। মন্দির থেকে
বেরিয়ে পাশেই মসজিদ। খানিক দূরে একটা চীনা মন্দির। ভেতরে ঢুকতেই চীনা
স্থাপত্যের অনুপম কারুকার্য নজর কাড়ে। মন্দিরের ভেতরে আছে ছোট্ট একটি
হাসপাতাল। সেখানে আকুপাংচার পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এই রাস্তাকে স্ট্রিট অব হারমনিও বলে
অনেকে। কারণ, এখানে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র বলে আলাদা কিছু নেই। সবাই একসঙ্গে
বসবাস করে নিজ নিজ ধর্ম পালন করে। বললেন টুরিজম মালয়েশিয়ার বিপণন
ব্যবস্থাপক ও আমাদের ১০ জনের দলটির অধিনায়ক বোরহান উদ্দিন আহমেদ।
জঙ্কারস স্ট্রিট থেকে কাছেই একটা
রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার সেরে হোটেলে ফিরলাম। সন্ধ্যায় রওনা হলাম মালাকার
হাং তুয়া স্টেডিয়ামের দিকে। হারি রায়া ওপেন হাউস উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের
আয়োজন করা হয়েছে সেখানে। অনুষ্ঠানে আসবেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
স্টেডিয়ামের মূল ফটক দিয়ে ঢুকতে নিরাপত্তার কড়াকড়ি চোখে পড়ল না কোথাও। নিয়ম
রক্ষার খাতিরে জনাকয়েক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। ফটকটি নেহাত সাদামাটা। কিন্তু
১৪টি দেশের অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানো হলো লালগালিচায়। ভেতরে বড় কয়খানা
শামিয়ানা টানানো। সেখানে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। সামনে বিশাল মঞ্চ।
হারি রায়া মানে হচ্ছে ঈদের খুশি।
মুসলিমপ্রধান দেশ মালয়েশিয়ায় মাসব্যাপী ঈদের আনন্দোৎসব পালিত হয়। খানাপিনা,
নাচাগানা—সবই থাকে সেই উৎসবে। আর ওপেন হাউস মানেই সবার জন্য উন্মুক্ত।
এদিন মালয়িরা মনভরে আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে ওঠে। এবারের হারি রায়ার মূল
অনুষ্ঠান মালাকায় হয়ে গেল গত ৩০ আগস্ট। পরের দিনই ছিল মালয়েশিয়ার মারডেকা
বা স্বাধীনতা দিবস।
রাত তখন সাড়ে আটটা। টেবিলভর্তি
খাবারদাবার। শুরু হলো স্থানীয় শিল্পীদের ঐতিহ্যবাহী নাচ আর গান। খানিক পরেই
মান্যগণ্য অতিথিরা বেইচায় চড়ে আসা শুরু করলেন। এলেন প্রধানমন্ত্রী দাতুক
সেরি উতামা মোহাদ নাজিব তুন হাজি আবদুল রাজাক ও তাঁর স্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী
হারি রায়া ওপেন হাউসের উদ্বোধন ঘোষণা করলেন। মুহুর্মুহু করতালি আর আকাশে
চলে আতশবাজির খেল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে চলল অতিথিদের
বক্তৃতা। সবশেষে ভোজপর্ব। নেচে-গেয়ে, উদর পূর্তি করে খেয়ে হারি রায়া ও
মারডেকার আনন্দ উপভোগ করল সবাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন