মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

একটুখানি হাঁটাহাঁটি ... ভুটানের পথে পথে...

এই লেখাটা লিখতে লিখতেই দেখলাম এর মধ্যেই ভুটান নিয়ে দুইটা লেখা হয়ে গিয়েছে। তারপরও অভিজ্ঞতা শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলামনা। গত মাসে আপুনি হঠাৎ একদিন ফোন দিয়ে বলল, “১ ঘন্টার মধ্যে ডিসিশন নাও, ভুটান যাব, তুমি যাবা কিনা।” আমি ব্যাপক দোনোমনায় পড়ে গেলাম। আপুনিকে বললাম, আমার টাকা নাই। যাই হোক, আমার ঘুরাঘুরির পাগলা মনের সাথে পারলামনা। রাজি হয়ে গেলাম। যাওয়ার আগের দিন সকাল পর্যন্ত আমাদের টিকেট কনফার্ম হয়নি। আগের দিন দুপুর ২টায় টিকেট কনফার্ম হল। সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ সকাল ১০টায় আমি, আমার আপুনি, মুঈদ ভাইয়া আর অপু সহ ড্রুক রয়্যাল এয়ারওয়েজে রওনা দিলাম ভুটান। তখনও জানিনা পরবর্তী ৬ দিন কী কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য! ভুটানে বাংলাদেশীদের প্রবেশের জন্য পোর্ট এন্ট্রি ভিসা, তাই বিমানে যাবার সময় ভিসা করাবার প্রয়োজন নেই।
এয়ারপোর্টে নামার আগ পর্যন্ত আমরা জানতামনা ভুটানে তামাক জাতীয় জিনিস বহন করা এবং রাস্তাঘাটে খাওয়া নিষিদ্ধ। নেমেই সিগারেট বহন করার জন্য মুঈদ ভাইয়া আর অপুকে কাস্টমসে প্রায় ১২০০ নুল্ট্রাম (Ngultrum) ট্যাক্স দিতে হল। সেইসাথে ওদেরকে একটা সার্টিফিকেট দেয়া হল যেটা দেখিয়ে ওরা ভুটানের যে কোন দোকান থেকে লিগ্যালি সিগারেট কিনতে পারবে। পুরো ট্যুরের পরের সময়গুলোতে এরা স্মোক করার সময় এই মূল্যবান সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে খুশিমনে স্মোক করত। আমরা কোন ট্র্যাভেল এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করে যাইনি বলে আগে থেকে হোটেল ঠিক করা ছিলনা। এয়ারপোর্টে নেমে সিঙ্গাজি নামের ক্যাব চালকের সাথে আমরা রওনা দিলাম থিম্পুর পথে। এই সিঙ্গাজি পরের কয়টাদিন আমাদের জীবনটা ভাজা ভাজা করে দিয়েছে...সে গল্পে পরে আসছি। আমাদের প্ল্যান ছিল থিম্পু গিয়ে সেখান থেকে পারমিট নিয়ে সোজা পুনাখা চলে যাব। প্ল্যান অনুযায়ী থিম্পু গেলাম। দিনটা ছিল রবিবার। আমাদের কারোরই মাথায় ছিলনা ব্যাপারটা। যথারীতি সব অফিস বন্ধ। সো, ঐদিনের জন্য নো পারমিট, নো ডলার ভাঙ্গাভাঙ্গি। মোটামুটি ধরনের একটা হোটেলে উঠলাম ঐদিনের জন্য। দুপুরের পর সবাই বের হলাম হেঁটে হেঁটে থিম্পু শহর ঘুরে দেখতে। আসলে পুরো শহররের প্রতিটা জায়গাই ছবির মত সুন্দর। শহরে ঢোকার মুখেই চোখে পড়েছিল বিশালাকৃতির বুদ্ধাকে, যিনি ঐ উঁচু থেকে শহরের সবকিছু আর সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছেন প্রতিমুহূর্তে। ঠিক হল হেঁটে হেঁটে আশপাশ দেখতে দেখতে আমরা বুদ্ধা পয়েন্ট যাব। হোটেল এর ম্যানেজারকে হেঁটে যেতে কতক্ষণ লাগবে জিজ্ঞেস করায় উনি বললেন, “এইতো কাছেই, চলে যান”। সেই ভরসায় হাঁটা দিলাম। কাছেইতো, এই ভেবে হাঁটি আর ছবি তুলি আশপাশের। মোটামুটি ঘণ্টাখানেক হাঁটার পরও দেখি লোকজন বলে এইতো কাছেই, আরেকটু! এর মধ্যে Dechen নাম্নী এক ভুটানি কন্যাও আমাদের সঙ্গী হল। সে তখন সারাদিনের ঘুম শেষে উঠে হাঁটতে বেরিয়েছে। আমরা ৫ জনের ছোট্ট দল হাঁটতে থাকি। থিম্পুর উঁচু ভ্যালি থেকে চারপাশের পাহাড়, পাহাড়ের বুকে ছোট ছোট বাড়ি আর পাহাড় চূড়ায় মেঘ...এত অদ্ভুত সুন্দর, যেন দেখে শেষ হচ্ছিলনা।

ছবিঃ বুদ্ধা পয়েন্টের পথে
এদিকে পথও আর শেষ হয়না! কিন্তু দিনের আলো ঠিকই শেষ হয়ে আসতে থাকে। প্রায় ঘন্টা তিনেক হাঁটার পর তেনার (বুদ্ধা) দেখা পেলাম। সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে ১৬৭ ফিট এর বিশালাকৃতি বুদ্ধাকে দেখে নিজেকে তুচ্ছ মনে হচ্ছিল তখন। পুরো শহরটাকে চোখে পড়ে এখান থেকে। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম এখানে। এবার ফেরার পালা। কোন গাড়ি, ক্যাব কিচ্ছু নাই। আবার হাঁটা শুরু করলাম ৫ জন। মিনিট ১৫ হাঁটার পর একটা পিকআপ থামিয়ে তার পেছনে চড়ে চলে আসলাম রাতের থিম্পু শহরে। পৃথিবীতে একমাত্র এ শহরেই কোন ট্র্যাফিক লাইট নেই।

ছবিঃ বুদ্ধা পয়েন্ট
দ্বিতীয় দিনের গন্তব্য পুনাখা। নাস্তা খেতে নেমেই দেখি আমাদের আগের দিনের সেই সিঙ্গাজি এসে হাজির! ট্রেকিং পারমিট নিয়ে, ডলার ভাঙ্গিয়ে ১১টায় রওনা দিলাম থিম্পু থেকে পুনাখার পথে। ঘণ্টাখানেক পরেই আমাদের গাড়ি থামে দোচুলা পাসে। মেঘের ভিতর নেমে পড়ি আমরা। আমাদের চারপাশে মেঘ আর বাকি সব অস্পষ্ট। খুব আস্তে আস্তে মেঘ সরতে থাকে। ১০৮ chorten এর Druk Wangyal Chortens আমাদের সামনে। স্থানীয়দয়ের কাছে এ জায়গা আরও জনপ্রিয় The Druk Wangyal Lhakhang (temple) এর জন্য। মন্দিরের পুরোহিত কার্মা জানাল, চতুর্থ Druk Gyalpo, Jigme Singye Wangchuck এর সম্মানে ২০০৩ সালে এটা তৈরী হয়। বছরে অন্তত একবার রাজা এখানে ঘুরতে আসেন। মন্দিরের ভিতর-বাহিরের দেওয়াল জুড়ে বৌদ্ধ দেবতাদের ঐতিহাসিক কাহিনী ছবির মাধ্যমে বর্ণনা করা।

ছবিঃ The Druk Wangyal Lhakhang (temple)
প্রবল কুয়াশা আর বৃষ্টির জন্য দোচুলা ক্যাফের উপর থেকে হিমালয় দর্শন করতে না পারার কিঞ্চিত দুঃখ নিয়ে কেবল কফির স্বাদ নিয়েই আমাদের চলে আসতে হয়েছে। আরও ঘণ্টা দুয়েক পরে পৌঁছে যাই ভুটানের পুরনো রাজধানী পুনাখায়। আমাদের গাড়িটা যেখানে গিয়ে থামে, সেখানে নেমে বুকে ধাক্কার মত লাগল! চারপাশ পুরা দম বন্ধ করা সুন্দর...সবুজ পাহাড়, সবুজ গাছ, ছিমছাম রাস্তা-ঘাট, ছোট্ট শহর। হোটেল আর পরের দিনের ট্রেকিং এর জন্য গাইড ঠিক করে, রওনা দিলাম পুনাখা জং এর উদ্দেশ্য। সূর্য ডোবার আগেই পচু আর মচু নদীর সঙ্গম দেখার ইচ্ছা সবার। পচু (ছেলে নদী) আর মচু (মেয়ে নদী) নদীর ঠিক মাঝখানেই এই বিশাল সুদৃশ্য পুনাখা জং, শহরের মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উপাসনালয় আর প্রশাসনিক কাজের কেন্দ্র।

ছবিঃ পুনাখা জং
এই দুই নদীর ভিন্ন দুই স্রোত মিশে সৃষ্টি পুনাসাংচু নদীর। নদী আর জং ঘুরে রাতে পুনাখা শহরে ফিরে এসে পরের দুদিনের ট্রেকিং এর জন্য কেনাকাটা করলাম।
গাইড শ্রীং, পোর্টার গাসাজি সহ আমাদের ৬ জনের দল তৃতীয় দিন সকালে পুনাখা থেকে ট্রেকিং শুরু করলাম। গন্তব্য লিম্বুখা হয়ে সামতেঙ্গাং পর্যন্ত যাব। পুরো পাহাড়ী পথে আমরা এক এক করে ছোট ছোট গ্রাম, ধানক্ষেত, ওক আর পাইনের বন, সারি সারি রডোডেন্ড্রন এর ঝাড় পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম। অনেকদিনের অনভ্যাসে যদিও প্রথম দিকে পাহাড়ে উঠতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল।

ছবিঃ ট্রেকিং
দুপুরে পথেই গ্রামের একটা বাসায় থেমে সাথে নেয়া ম্যাগী নুডুলস দিয়ে লাঞ্চ সেরে আবার রওনা দিলাম। মজার বিষয় হল হাঁটা শুরু করার কিছুক্ষণ পরেই আমরা টের পেয়েছিলাম যে আমদের গাইড শ্রীং আর পোর্টার গাসাজি দু’জনেই এই পথটা কিছুটা কম চিনে। তারা অনেক আগে এই রাস্তায় গিয়েছিল। আমরা এই ঘটনা টের পেয়ে গেছি বোঝার পর শ্রীং অবশ্য অভয় দিয়ে বলল, যে কোন সমস্যা নাই, তারা আমাদের ঠিকমত পৌঁছায় দিবে। যাই হোক, মোটামুটি এই তাপশিল্লা পাহাড়ের ভিতরের দিকে ঢোকার পর শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। একেতো উপরের দিকে ওঠা, তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত যুক্ত হল কাদা আর স্লিপি রাস্তা, সেইসাথে বৃষ্টির জন্য শুরু হল জোঁকের উপদ্রব। এর মাঝে আমি ২ বার আছাড়ও খেয়ে ফেললাম।

ছবিঃ যে ভ্যালি দিয়ে ট্রেকিং করে এসেছি (পাহাড়ের উপর থেকে তোলা ছবি)

ছবিঃ ট্রেকিং এর পথে দেখা ধানক্ষেত
বৃষ্টির জন্য বিরক্তিও লাগছিল, কিন্তু বৃষ্টির কারণে পুরো জঙ্গল ঘন সবুজ হয়েছিল দেখে মনটাও ভরে যাচ্ছিল। বিকাল ৪:৩০টার দিকে শ্রীং যখন বলল “আমরা এখন পাহাড়ের একদম চূড়ায়। নিচের দিকে দেখিয়ে বলল তোমরা মেইন ল্যান্ড থেকে প্রায় ৭,৫০০ ফিট উপরে”, তখন নিজের কাছেই বিশ্বাস হচ্ছিলনা যে দুইবারের ভাঙ্গা পা নিয়ে এতখানি উঠে আসছি! এরপর আমরা পাহাড় থেকে নিচের দিকে নামা শুরু করলাম। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই এই জঙ্গল থেকে বের হতে হবে এই পরিকল্পনা নিয়ে। কারন। পুরো হাঁটার সময়টাতে আমরা কোন পাখির ডাক শুনিনি। শ্রীং ব্যাপক চিন্তিত! ঘণ্টা দেড়েকের মাঝেই আমরা জঙ্গল ছেড়ে খোলা জায়গায় বের হয়ে আসলাম। তখনও জানতামনা যে সামনে আরও একটা জঙ্গল আমাদের জন্য আপেক্ষা করে আছে! ওই খোলা জায়গা থেকেই শ্রীং হাত দিয়ে দূরে দেখিয়ে বলল, “ঐ বড় গাছওয়ালা বাসাটায় আমরা রাতে থাকব। ঠিক ১ ঘণ্টার মাঝে পৌঁছে যাব।” গ্রামের নাম Kajhi। শ্রীংই ওদের সাথে কথা বলে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। আবার হাঁটতে শুরু করলাম। যতই হাঁটি মনে হচ্ছিল বাসাটা আরও দূরে সরে যাচ্ছে। একটু পরেই বুঝলাম যে শ্রীং এবং গাসাজি আবার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে! চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার, নিচে প্যাচপ্যাচে কাদায় পা মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে, আশপাশে বন্য শূকরের শব্দ, সব ছেলেগুলোর হাতে সিগারেট, মোবাইলে ভুটানি গান বাজছে, আর ওয়াটার চ্যানেলের পাশ দিয়ে যাওয়া চিকন রাস্তায় আমরা ৬ জন লাইন ধরে হাঁটছি। সবাই খুব টেন্সড। বন্য কোন প্রাণী আশপাশে থাকলে যেন টের পাওয়া যায় তাই গাসাজি আর শ্রীং একটু পরপর মুখ দিয়ে আওয়াজ করছে। এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা আর ঝোপঝাড়ের মাঝখান দিয়ে ডালপালা সরিয়ে সরিয়ে আমরা হাঁটছি আর হাঁটছি। একটু পরপর কেউ না কেউ উঁচু নিচু পাথরে উশটা খাচ্ছি। একটা সময় ব্যথা, ক্লান্তি কোন অনুভূতিই আর কাজ করছিলনা। কেউ কারও সাথে কোন কথা পর্যন্ত বলছিলামনা। ঐ বাসায় পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে জিজ্ঞেস করলেই শ্রীং বলছে, “এইতো আর ১ ঘণ্টা!” অবশেষে পথ হারিয়ে আবার খুঁজে খুঁজে প্রায় ৪ ঘণ্টার মাথায় যখন আমরা খান্দু ইয়াঙ্কার বাসায় পৌঁছলাম ঘড়িতে তখন রাত পৌনে দশটা। সবাই বিধ্বস্ত। গোসল সেরে রাতে যখন ডিম ভর্তা আর এমাদাতশি [ভুটানের জাতীয় খাবার। মরিচ (এমা) আর স্থানীয় পনির (দাতশি) দিয়ে মাখানো ভর্তা] দিয়ে লাল মোটা চালের ভাত খেলাম, মনে হচ্ছিল স্বর্গীয় খাবার খাচ্ছি। রাতে সবাই গল্প করতে বসে সারাদিন ধরে চেপে রাখা সব তথ্য একে একে বের হতে লাগল। প্রথম জঙ্গলে যখন কোন পাখির ডাক শুনতে পায়নি, তখনই শ্রীং আর গাসাজির সন্দেহ হয় যে এখানে বাঘ থাকতে পারে। জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসার পর স্থানীয় একজন বলে, এলাকায় যে অল্প কিছু ঘর সেগুলোর লোক বেশিরভাগই বাঘের ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। দ্বিতীয় জঙ্গলটায় হাঁটার সময় আমি ছাড়া বাকি সবাই এক মুহূর্তের জন্য অন্ধকারে এক জোড়া চোখ দেখতে পেয়েছে। ঐ সময় বাকিরা ভয় পাবে ভেবে কেউ কারো সাথে এ কথা শেয়ার করেনি। প্রত্যেকে যার যার মত করে ইনিশিয়েটিভ নিয়েছে। শ্রীং, মুঈদ ভাইয়া আর অপু আগুন জ্বালিয়ে রাখার জন্য ক্রমাগত সিগারেট খেয়েছে, আওয়াজ হলে বন্য প্রাণীরা দূরে থাকে এজন্য মোবাইলে গান বাজিয়েছে। হিংস্র প্রাণী আক্রমণ করলে দলের মধ্যে ছোটখাটো আর দুর্বল মানুষকে আগে ধরে, তাই সেভ করার জন্য আমাকে সামনের দিক থেকে মাঝখানে নিয়ে আসা হয়েছিল (যদিও এটা তখন আমি বুঝতে পারিনি)! বিশাল দুইটা ছুরি হাতে গাসাজি আমাদের সবার সামনে আর শ্রীং সবার পেছনে প্রহরীর মত নিরাপত্তা দিয়ে গিয়েছে। আমরা যেই ওয়াটার চ্যানেলের পাশ ধরে হেঁটেছিলাম সন্ধ্যার পর থেকে বন্য প্রাণীরা এখানে পানি খেতে আসে। শ্রীং আর গাসাজি বলে যে, গন্ধ শুকেই উনারা মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল... কিছু ঘটলেই আগে আমাদের সেভ করার চেষ্টা করবে। এই ছিল মোটামুটি আমাদের দ্বিতীয় দিনের অভিজ্ঞতা!

ছবিঃ প্রেয়ার হুইল
ট্রেকিং শুরু করার একদম শুরুতেই আমরা একটা প্রেয়ার হুইল ক্রস করি। শ্রীং এর কথামত সবাই ওটার চারপাশে ৩ বার চক্কর দেই। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করে, প্রেয়ার হুইলকে ঘিরে ৩ বার চক্কর দিয়ে অথবা প্রেয়ার হুইল ৩ বার ঘুরিয়ে কিছু চাইলে সেই ইচ্ছা পূরণ হয়। শ্রীং এর অবশ্য ধারণা তখন ও চেয়েছিল আমাদের যেন ঠিকমত পৌঁছে দিতে পারে, এজন্যই আমরা বিপদ মাথায় নিয়েও সুস্থভাবে পৌঁছাতে পেরেছি!

ছবিঃ সকালের Kajhi গ্রাম
আগের দিনের ক্লান্তির কারণে চতুর্থ দিন একটু আয়েশ করে ঘুমিয়ে বেলা করে উঠে আবার হাঁটা শুরু করি সামতেঙ্গাং এর উদ্দেশ্যে। গিল্লেখা গ্রামের মাঝ দিয়ে আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাই সামতেঙ্গাং লেকের পাশে। সামতেঙ্গাং অংদি জেলার ছোট্ট একটা গ্রাম। পুরোটা হেঁটেই ঘুরে ফেলা যায়। গ্রামের রাস্তার দুইপাশে শান্ত, ঘন পাইন বন। এখানে আমরা সেগেই এর বাসায় উঠি রাত কাটানোর জন্য। আগেরবারের মতই শ্রীং ওদের সাথে কথা বলে এই ব্যাবস্থা করে নেয়। সামতেঙ্গাং এর আরেকটা দেখার মত জায়গা হল ওদের মিডল সেকেন্ডারি স্কুল। পুরাই একটা ফাইভ স্টার স্কুল। মনে হল এত সুন্দর, পরিষ্কার, শান্ত, স্নিগ্ধ স্কুল হলে জগতের সব বাচ্চা-কাচ্চা প্রতিদিন স্কুলেই আসতে চাইবে, থাকতেও চাইবে।

ছবিঃ সামতেঙ্গাং এর পাইনবন
পঞ্চম দিন সকাল নাস্তা খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম আমরা চুযমসা (অংদির ছোট্ট একটা শহর) এর পথে। এবার পুরোটা ছিল পাহাড় থেকে নামার রাস্তা। যথারীতি হাঁটার শুরুতেই শ্রীং বলল মাত্র আধা ঘণ্টার মাঝেই চুযমসা পৌঁছে যাব। সেখানে সিঙ্গাজী (ইনি সেই সিঙ্গাজী যিনি ভুটানে নামার পর থেকে আমাদের পিছু কোন ভাবেই ছাড়েনি। আমরা তাকে খসানোর অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে ফোন দিয়ে নানাভাবে আমাদের ধরে ফেলেছে) অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য। যাই হোক, ঘটনা একটু পরেই বোঝা গেল, তারা দুইজন আবার রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে! পাইনের বনের মাঝ দিয়ে, ঝোপঝাড় সরিয়ে অবশেষে আড়াই ঘণ্টা পর আমরা দাংচু নদীর পাড়ের চুযমসায় পৌঁছলাম। এটাই ছিল আমাদের ট্রেকিং এর শেষ পয়েন্ট।

ছবিঃ দাংচু নদী, চুযমসা, অংদি
এই দুই দিনে আমরা প্রায় ৫০ কিলোমিটার রাস্তা খালি হেঁটেছিই। ঐদিনই অংদি থেকে ট্যাক্সি করে সরাসরি চলে আসলাম পারো। পারো পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। জানালা দিয়ে পারো নদী দেখা যায় এমন হোটেল ঠিক করেই বের হয়ে পরলাম রাতের পারো শহর হেঁটে হেঁটে ঘুরতে।
ষষ্ঠ দিন সকালে সবাই এত্ত ক্লান্ত যে আর হাঁটাহাঁটির শক্তি নাই। যাই হোক তবুও গেলাম বিখ্যাত টাইগার্স নেস্ট (Taktsang monastery) দেখতে। ভুটানিদের মতে, বৌদ্ধ গুরু রিনপোচে তিব্বত থেকে বাঘের পিঠে চড়ে এই পাহাড়ের চূড়ায় আসে। তার নামেই এই নামকরণ। এখানে যেতে হলে ঠিক কতদূর হাঁটতে হয় এ ব্যাপারে আমাদের কারোরই আগে থেকে কোন ধারনা ছিলনা। আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল ১ ঘণ্টা লাগবে উঠতে। হাঁটতে শুরু করে দেখি পথ আর শেষ হয়না! আপুনি এক সময় ঘোষণা দিল সে আর হাঁটতে পারবেনা, যাবেওনা ঐখানে। যাইহোক ঘণ্টা তিনেক হেঁটে গিয়ে monastery দেখে সব ক্লান্তি চলে গেল। পারো ভ্যালি থেকে ৩,০০০ ফিট উপরে অবস্থিত এই monastery ভুটানিদের কাছে অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। টাইগার্স নেস্ট এ ওঠার পথেই পাহাড়ের খাঁজে একটা ছোটখাট ধরনের লায়ন্স কেভও আছে। এটা তেমনভাবে চোখে পরেনা বললেই চলে।

ছবিঃ টাইগার্স নেস্ট

ছবিঃ লায়ন্স কেভ
সন্ধ্যায় ওখান থেকে নেমে আবার শেষবারের মত পারো শহর হেঁটে হেঁটে ঘুরে নিলাম। পরের দিন সকালে ফিরতি পথ ধরে চলে আসি আমার দেশে। ও আচ্ছা, এয়ারপোর্ট আসার পথে র্যা ন্ডমলি একটা ট্যাক্সি দেখে থামার জন্য হাত দেখাই। থামতেই দেখি সেই সিঙ্গাজী আবার!
খরচাপাতিঃ
প্লেন ফেয়ার রাউন্ড ট্রিপঃ জনপ্রতি ২২০০০ টাকা। ৬ দিন ঘোরাঘুরি, খাওয়া, ট্যাক্সি ভাড়া, হোটেলের রুম ভাড়া, গাইড, কেনাকাটা সবসহ জন প্রতি ২০০ ডলার।
শেষ কথাঃ
• যদিও আমাদের গাইড আর পোর্টার রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছিল, তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি এরা দুইজনই খুবই ভালো ধরনের, কেয়ারিং আর দায়িত্বশীল টাইপ মানুষ ছিল।
• কোন মানুষকে রাস্তা পার হতে দেখলে এখানকার রাস্তায় গাড়ি নিজে থেকেই গতি কমিয়ে ফেলে।
• হাঁটার সময় রাস্তা...সে শহর, গ্রাম বা জঙ্গল যাই হোকনা কেন কোনভাবেই নোংরা করা যাবেনা।
• ভুটানিরা ক্ষুদ্র জোঁক থেকে শুরু করে কুকুর যে কোন প্রাণীই না মারার চেষ্টা করে। কারণ ওরা মনে করে জীব হত্যা পাপ।
• ওদের ভাষায় “কুসুজাংপো” মানে হ্যালো; আর “কাদিনচে” মানে ধন্যবাদ। Smile
Bonne Voyagelink

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন