সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০১৪

নেপালের পথে পথে

কাঠমুন্ডু টু পোকারা

২৬ নভেম্বর, ২০১৩ তারিখ। কাঠমুন্ডু শহরের জরাজীর্ণ কাঠিন্যতা পেছন ফেলে আমার বাস এগিয়ে চলছে পোকারার দিকে। একটু এগোতেই চারপাশে সীমাহীন সবুজের দেখা পেলাম আমি। সূর্য তখন উঠি উঠি করছে। একপাশে সুউচ্চ পাহাড়ের সারি, অন্যপাশে গভীর খাদ, পাহাড়ী ঘুরপথে এগিয়ে চলছে বাস। আমি তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম বাইরে, উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। দেখলাম কোথাও কোথাও রাস্তা থেকে অনেক নীচূ ভূমিতে মানুষ চাষ-আবাদ করে বসতি গড়েছে। আবার কোথাও বা কুলুকুলু স্রোতে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ পানির ধারা। আবার কোথাওবা পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের আলোর স্পর্শে কেটে যেতে শুরু করেছে ঘন জমাট কুয়াশা। কত দেখব আমি ! এখানে সুন্দরের শেষ নেই।

কাঠমুন্ডু টু পোকারা দীর্ঘ ছয় ঘন্টার বাস ভ্রমণ, প্রায় পুরোটা জুড়েই এমন পাহাড়ী প্রকৃতির সুন্দরের জাল বিছানো। সেই সাথে ঘন কুয়াশার সাথে নরম সোনালী সূর্যালোকের লুকোচুরি খেলা। কোথাও পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের আলো হুটোপুটিতে চারপাশ উদ্ভাসিত হয়ে আছে, কোথাওবা জমাট কুয়াশার আড়ালে সূর্য নিজেই ঢাকা পড়ে আছে। বাস এগোচ্ছে, ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। আবার কিছুক্ষণ পরই অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোর হাতছানি যেন আমাদেরকে কাছে ডাকছে। এভাবে পাহাড়ের গা ঘেঁসে এগিয়ে চলছে আমাদের বাস। আর আমার মনে হচ্ছে ইস্একটিবার যদি হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারতাম নীরব অভিমানে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজের চাদর গায়ে ঐ পাহাড়কে।

এর কিছুক্ষণ পরই বাস থেমে গেল এক জায়গায়। হেলপার জানাল আধা ঘন্টা সময় দেয়া হলো সবাইকে প্রাতঃক্রিযা সারার জন্য। ততক্ষণে আরও অনেক ট্যুরিষ্ট বাস সেখানে যাত্রা বিরতি করেছে। জায়গাটা মূল রাস্তা ছেড়ে একটু ডানদিকের সমতলে। আমি নেমে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাতেই দৃষ্টি আটকে গেল আমার। বিস্ময়ে হতবাক হবার জোগাড় আমার। প্রকৃতি যেন এখানে নিপুণ কারিগর। তার ঠাস বুননে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পাহাড়। সবগুলো পাহাড়ের চূড়া ঢেকে আছে শুভ্র ঘন কুয়াশায়। সত্যি এমন সুন্দরের তুলনা মেলেনা সহসা। আমি একটি লোকের হাতে আমার ক্যামেরাটি দিয়ে অনুরোধ করলাম আমার কিছু ছবি তুলে দিতে। ততক্ষণে সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। লোকটি সানন্দে আমার কয়েকটা ছবি তুলে দিল। কিন্তু প্রকৃতির এমন সুন্দরের আবাহনকে ক্যামেরায় কতটুকুই বা ধরে রাখা সম্ভব?

আবার চলতে শুরু করল বাস। আমি টের পেলাম আমার মনে কবিতার খেলা শুরু হয়ে গেছে। দূরে ঐ আকাশনীলে/পাহাড় ডাকে ঝরণাতলে/কানে কানে কথা কয় দু’জনে মিলে। ওদের কথা বলার মাঝে আবার আমাদের যাত্রা বিরতি নাস্তার জন্য। সেই একই সৌন্দর্যের জাল বিছানো চারপাশ। তবে এবার তার সাথে যোগ হয়েছে সূর্যের আলো। অর্থাৎ এই জায়গাটা সূর্যের আলোয় পুরোপুরি উদ্ভাসিত। সবার সাথে বাস থেকে নেমে আমি শুধু এক কাপ লাল চা খেলাম ৫০ রূপীতে। ভাবলাম এতে যদি গলার একটু উপকার হয়। সারা বাসজুড়ে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে খুক খুক করে কাশছি।

চা খাওয়া শেষ করে অন্যদের নাস্তা খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি হাঁটাহাঁটি করে দেখলাম চারপাশটা। সবাই উঠে এলে আমিও উঠে বসলাম বাসে। চলতে শুরু করল বাস। এবার বাসে বসেই আমি ঘুমের কোলে আশ্রয় নিলাম। যখন জাগলাম দেখি বাস এক জায়গায় থামছে। মানুষের কোলাহলে মুখর হয়ে উঠেছে জায়গাটা। তার কারণ অনেকগুলো ট্যুরিষ্ট বাস এসে থেমেছে সেখানে। কেউ খাচ্ছে, কেউ লাঞ্চ বক্স সাথে নিয়ে বাসে উঠছে। আমি নেমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। এখানেও পাহাড় আছে বটে, কিন্তু পাহাড়-মাটি আর জলস্রোত মিলে প্রকৃতির যে নিসর্গ সৌন্দর্য তা যেন ক্রমশ কেটে যাচ্ছে। তার বদলে অন্য রকম কিছুর হাতছানি। মানুষের মাঝে নাগরিক ব্যস্ততার ছোঁয়া এই প্রথম দেখতে পেলাম। টের পেলাম আমাদের গন্তব্য আর বেশীদূর নয়। একজনের কাছে জানতে পারলাম আর এক ঘন্টা লাগবে পোকারা পৌঁছুতে। যেহেতু একটায় বাসটি পৌঁছার কথা তাই আমি এখান থেকে কোন খাবার নিলাম না। তাছাড়া দুপুরের খাবার খাওয়ার মতো ক্ষুধাও লাগেনি। হোটেলে পৌঁছে যা হোক একটা কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করে নেয়া যাবে।

আবার ছেড়ে দিল বাস। আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম। চারপাশের আবহ ক্রমশঃ পাল্টে যেতে শুরু করেছে। একপাশে পাহাড়ের সারি আছে বটে, অন্যপাশে রাস্তার কোল ঘেঁষে ছোট ছোট বাড়ি। সুন্দর ছিমছাম বাড়িগুলো, বাইরের দিকের প্লাস্টারে নান্দনিক সৌন্দর্য যে কারও দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম। আমি বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে গেলাম অন্য এক ভূবনে। এর আগে জাপানে এমন নান্দনিক প্যাটার্ণের বাড়ি দেখেছি আমি। তবে এগুলোর সৌন্দর্য সম্পূর্ণ আলাদা। কোন বাড়িতে কোন বাউন্ডারি দেয়াল নেই, কলাপসিবল গেটও নেই। বারান্দায় আমাদের দেশের মতো লোহার ব্যারিকেডও নেই। আমাদের দেশের বাড়িগেুলোর বারান্দায় যে লোহার গ্রীল দেয়া হয় নিরাপত্তার স্বার্থে সেগুলোকে আমি লোহার বেড়া বা ব্যারিকেড বলতে বেশী পছন্দ করি। কারণ, আমি যখন আমার বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়াই তখন মনে হয় একটা জেলখানায় আছি আমি, ইচ্ছে করলই এখান থেকে সামনের দিকে এগোতে পারবনা আমি। অন্যদিকে পোকারা শহরের এই বাড়িগুলো যেন মুক্ত বিহঙ্গ, আকাশপাণে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি বাড়ির চারপাশ খোলা, বারান্দা খোলা, বাইরের দিকের দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কারুকার্যময় সৌন্দর্য। আমার কাছে মনে হলো এই বাড়িগুলো পোকারা শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি অনিবার্য উপকরণ। এরা প্রকৃতির বন্ধু বটে !



বাস যতই এগোচ্ছে ততই পোকারা শহরের ছিমছাম নাগরিক সৌন্দর্য আমাকে মোহিত করছে। এখন আর প্রকৃতির নিসর্গ সুন্দরের জন্য পিছুটান অনুভব হচ্ছেনা আমার। এমন সময় বাস থামল এক জায়গায়। কিছু লোক নেমে গেল। ড্রাইভার আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কোন হোটেলে যাব। আমি মাউন্ট কৈলাস রিসোর্ট এর নাম বললাম। ড্রাইভার আমাকে বসে থাকতে বলল। বুঝলাম বাস আরও সামনের দিকে যাবে। আমি বসে রইলাম। বাস এগোতে লাগল মূল রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকের একটি ছিমছাম রাস্তা ধরে। রাস্তার মাঝখানের আইল্যান্ডে সারি সারি নারকেল গাছ। দু’পাশে হোটেল আর রিসোর্ট। নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ। কোথাও ট্রাফিক জ্যাম নেই, নেই কোন ট্রাফিকও। এর আগে এমন সুন্দর রাস্তার দেখা পেয়েছিলাম আমি ভারতের গোয়া শহরে। গোয়াকে মনে হয়েছিল নাগরিক কাঠিন্যতা বা কৃত্রিমতা থেকে দূরে স্বর্গীয় এক শহর। আজ পোকারাকেও আমার কাছে অনেকটা সেরকম মনে হচ্ছে।

বাস এসে সর্বশেষ স্টপেজে থামল। দেখলাম নানা হোটেলের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার আমার হোটেলের নাম ধরে ডাকতে লাগল। এক লোক এগিয়ে এলো ড্রাইভারের ডাকে। দেখলাম ওর হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে আমার নাম লেখা রযেছে। আমি বাস থেকে নেমে ওর পিছু পিছু গিয়ে গাড়িতে বসলাম। এগিয়ে চলল গাড়ি। সেই সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ চারপাশে। দশ মিনিটও বোধহয় লাগেনি আমি এসে পৌঁছে গেলাম মাউন্ট কৈলাস রিসোর্টে। কিন্তু প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতে গিয়ে আবারও স্তম্ভিত হলাম আমি সুন্দরের আবাহন দেখে। হোটেলের এপাশ-ওপাশ মিলিয়ে দুটি ভবন। মাঝখানে অনেকটা জায়গাজুড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রাকৃতিক সুন্দরের আবাহন। ইয়া বড় বড় গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকা ফুল বাতাসে দুলে দুলে যেন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে আগত অতিথিদের। আছে আরও নানা জাতের ফুল। গাঁদা ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে চারপাশ। এখানেই শেষ নয়। এদেরকে পরম আদরে আগলে রেখেছে একটি স্বচ্ছ জলাধার। এর পানির উৎস হচ্ছে একটি কৃত্রিম ঝরণা। জলাধারটা একেবেঁকে পুরো বাগানটাকে ঘিরে রেখেছে। এপাড় থেকে ওপাড়ে যাবার জন্য এর উপর রয়েছ দুটি ছোট্ট পুল। সব মিলিয়ে অবাক করা সুন্দরের সমাহার ঘটানো হয়েছে রিসোর্টের খোলা প্রান্তরে।

হোটেলের গেট সংলগ্ন মূল রাস্তার অপর পাড়েই লেক, এর পাশ ঘেঁষেই সারি সারি পাহাড়। জানিনা এজন্য কি-না, জায়গাটির নাম লেক সাইড। গেট পেরিয়ে হাতের বাঁদিকে প্রথম ভবনটিতেই রিসেপশন। আমি ভিতরে ঢুকে প্রয়োজনীয় কাজ সারলাম। রিসিপশনের কর্মকর্তা মেয়েটি আমার পাসপোর্টটি হাতে নিয়ে একটু অবাক হলো তিনটি পাসপোর্ট একসাথে দেখে। আমি অনেকগুলো দেশ ভ্রমণ করেছি দেখে সে খুব খুশী হলো। আমার হাতে চাবি দিল, বি ব্লকের ৫০৩ নম্বর কক্ষ আমার জন্য বরাদ্দ হলো। এটা পাশের ভবনে। হোটেল স্টাফ আমার লাগেজ নিয়ে আমার সাথে সাথে এলো। আমি রুমে ঢুকেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কাঠমুন্ডুর মতো একই ভাড়া অর্থাৎ প্রতিদিন ৮০ মার্কিন ডলার করে। অথচ এখানকার ব্যবস্থা কত উন্নত। এর আগে আরও অনেক দেশে ফাইভ স্টার হোটেলে থেকেছি আমি। দেখলাম এই রুমের ব্যবস্থাপনা প্রায় সেগুলোর কাছাকাছি। রুমের সামনের ভারী পর্দা তখন গুছানো। তাই বাইরের আলো অতি সহজেই সাদা রং এর স্বচ্ছ পর্দা ভেদ করে রুমে ঢুকে পড়েছে। আমি স্বচ্ছ পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম। সামনে কৃত্রিম ঝরণা, সুইমিং পুল, সারি সারি গাঁদা ফুল। এগুলোর ওপাশেই হোটেলের আরেকটি ভবন। সব দেখে আমি ভাবলাম আজকের বিকেলটা এখানে কাটানোই উত্তম হবে।

বিকেলটা আশেপাশে ঘুরে কাটিয়ে দিলাম। রাতে বিছানায় শুয়ে আগামী দিনের কথা ভাবলাম। পোকারা আসার মূল কারণই তো এটা। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘু ম ভাঙল রাত ৩টা ২০ মিনিটে। আর ঘুমানোর চেষ্টা করলাম না আমি। তার বদলে এই লেখাটা এগিয়ে নিলাম। সাড়ে চারটার দিকে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আবার লিখতে শুরু করলাম। পাঁচটায় রিসিপশন থেকে ফোন পেলাম। আমি জানালাম তৈরী হচ্ছি। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। কাজেই সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হয়েছে আমাকে। রিসিপশনে যেতেই একটি ছেলে গাড়ি দেখিয়ে দিল। আমি গাড়িতে উঠে বলসলাম। অন্ধকারের বুক ছিঁড়ে এগিয়ে চলল আমার গাড়ি। দেখলাম অসংখ্য গাড়ি ও ট্যুরিষ্ট বাস একইভাবে ছুটে চলছে। উদ্দেশ্য সবার এক, গন্তব্যও এক।
আধা ঘন্টার মধ্যে আমার এসে পৌঁছে গেলাম কাংখিত গন্তব্যে। গাড়ি পার্কিং এ দিতে হলো ৩০ রুপী। ড্রাইভার আমাকে নামিয়ে দিয়ে বলল সে এখানেই অপেক্ষা করবে। আমি যেন গাড়ির নাম্বার দেখে চলে আসি। গাড়ির নাম্বার হচ্ছে ৩৬১। তাছাড়া গাড়ির গায়ে মাউন্ট কৈলাস রিসোর্ট লেখা রয়েছে। আমি উঠে গেলাম অসংখ্য পর্যটকদের সাথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে। পাহাড়ের উপরে সমতল জায়গাটা তখন অসংখ্য পর্যটকের ভীড়ে কোলাহল মুখর। অথচ কেউ কারও মুখ দেখছে না বা দেখতে পাচ্ছেনা। সেদিকে দৃষ্টিও নেই কারও। সবার অপেক্ষা কাংখিত সূর্যোদয়ের জন্য। যে কারণে আমার মতো নিজ দেশের ভৌগলিক সীমারেখাকে পেছনে ফেলে এতদূর ছুটে এসেছে সবাই।

আকাশে তখনও চাঁদ শোভা পাচ্ছে। চাঁদের আলোতে দূরে পোকারা শহরের অস্তিত্ব বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে চাঁদের আলো উপভোগের তৃষ্ণা কারও নেই। বরং চাঁদের বিদায় যত তাড়াতাড়ি হয় সেটাই সবার কাম্য। আমি এই প্রথম এটা টের পেলাম। সমতল ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে সামনের বিস্তীর্ণ পাহাড়ভূমে চাঁদের উদ্ভাসিত আলোকে উপভোগের পরিবর্তে কারও নিকট অকাম্য হতে পারে। এতেই বুঝা যায় হিমালয়ের পাদদেশে সূর্যোদয়ের যে দৃশ্য দেখার জন্য আমি এখানে ছুটে এসেছি সেটা কত উপভোগ্য ! কত গরিমাময় !
যাই হোক। ভূমি থেকে এখন আমি কতটা উপরে উঠে এসেছি সেটা ঠিক পরিমাপ করে বলতে পারবনা। তবে উঠে এসেছি অনেক উপরে এটা নিশ্চিত। কারণ, প্রথমে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে গাড়িগুলো অনেক উপরে উঠে এসেছে। তারপর যেখানে আমাদেরকে নামিয়ে দিয়েছে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বেশ কয়েকটা ঘুরানো-প্যাঁচানো অমসৃণ সিঁড়ি বেয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা সবাই। উঠার সময় খেয়াল করলাম এই রাতের বেলাতেও সিঁড়ির ধাপে ধাপে দুই পাশে নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানীরা। এসব জিনিসের মধ্যে শাল এবং হাতে তৈরী বিভিন্ন সামগ্রী এবং ধাতব মূর্তিই বেশী।



তখনও পূব আকাশে আলোর রেখা ফুটেনি। সূয্যি মামার দেখা পাওয়া তো দূরের কথা। কেবল পূব দিগন্তে রক্তিম আভার দেখা মিলছে। এতেই চোখে পড়ছে সারি সারি পাহাড়ের অস্তিত্ব। এতক্ষণ অন্ধকারে কোনটা পাহাড়, কোনটা গহবর ঠিক বুঝা যাচ্ছিল না। এখন পূব আকাশে আলোর রেখা যত ষ্পষ্ট হচ্ছে ততই পাহাড় আর খাদের অস্তিত্ব পরিস্কার হচ্ছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার ঠিক সামনেই গভীর একটা খাদ, তারপর সারি সারি পাহাড়। আমরা দাঁড়িয়েছি পূব দিকে মুখ করে। সারি সারি পাহাড়ের মায়াজাল ভেদ করে সূর্য উঠার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে সেদিকে। আর আমাদের হাতের বাঁদিকে অর্থাৎ উত্তর দিকে বিস্তীর্ণ পাহাড়রাশির ওপাড়ে সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়া ক্রমশ শুভ্র সতেজ আলোয় নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। অবাক হবার মতো ব্যাপার। সূর্যের দেখা তখনও মেলেনি। অথচ পাহাড়ের চূড়াটি ক্রমশঃ শুভ্র থেকে শুভ্রতর হয়ে বড় আকার ধারণ করছে। এখান থেকে দেখা যায় বরফে ঢাকা গ্রেট হিমালয়ের অন্নপূর্ণা ও ধূলগিরি চূড়া। কি অদ্ভূত মিতালী সূর্যের সাথে বরফাচ্ছিত এই পাহাড় চূড়ার ! হিমালয় যেন নিজ থেকে সূর্যের সাথে এই মিতালী স্থাপন করেছে নিজের অস্তিত্বকে আরও বেশী জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলার জন্য। সময়ের প্রতিটি পলক এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সময় যতই এগোচ্ছে গ্রেট হিমালয় তার মহামহিম শুভ্রতার অবগুন্ঠনে নিজকে প্রকাশ করছে বিস্তৃত আকারে।

অবশেষে পূব আকাশে পাহাড়ের অপর পাশে সূর্যের মুখ দেখতে পেলাম আমরা। লাল টকটকে সূর্যরাজ ক্রমেই নিজের সম্পূর্ণ অস্তিত্ব ঘোষণা করতে লাগল। এ যেন আকাশে সূর্য উঠা নয়, সূর্য উঠছে পাহাড়রাশির আদুরে বন্ধন ছুঁয়ে ওপাড় থেকে। সবার ক্যামেরা সচল হয়ে গেছে অনেক আগেই। একবার পূব আকাশের সূর্যের ছবি তুলছি আমরা, তার পর মুহূর্তেই উত্তর দিকে বরফাচ্ছাদিত হিমালয়ের চোখ ধাঁধানো রূপের। কোনটা ছেড়ে কোনটার ছবি তুলব ! আমি এসেছি একা। একে-তাকে অনুরোধ করে নিজের ছবি তুলতে হচ্ছে। এক সময় সূর্যের দিক থেকে সবার মনযোগ গিয়ে নিবিষ্ট হলো শুভ্র গরিমায় প্রস্ফুটিত গ্রেট হিমালয়ের উপর। তখন সাদা বরফের উপর সূর্যের আলো পূর্ণরূপে পড়ছে। প্রেমিকের অপেক্ষায় থাকা প্রেমিকার মতো হিমালয় বুঝি রূপকা রানী সেজে এতক্ষণ এর অপেক্ষাতেই ছিল। তাই সূর্যের আলোর পরিপূর্ণ অবয়বে নিজকে ঢেকে সে প্রকাশ করছে তার মোহময়ী রূপের সবটুকু। সত্যি এ সৌন্দর্যের তুলনা মেলেনা পৃথিবীর কোথাও ! কোন ভাষার কোন সমৃদ্ধ অভিধানেও বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবেনা এই সৌন্দর্যকে উপযুক্তরূপে বর্ণনা করার মতো কোন শব্দ। পৃথিবী বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের কল্পনা বিলাসও বোধহয় এখানে এসে হার মানতে বাধ্য হবে। আমি শুধু ভাবছি মানুষের মনকে মোহিত করার জন্য বিধাতার সে কি অপরূপ সৃষ্টি ! প্রকৃতিকে সাজিয়ে রেখেছে সৌন্দর্যের সবটুকু নির্যাস দিয়ে। একমাত্র চোখে দেখে হৃদয়ে ধারণ করা ছাড়া কার সাধ্য আছে ভাষার ফ্রেমে সুন্দরের এই আবাহনকে প্রকাশ করতে পারে ?



ততক্ষণে সূর্যের আলোয় চারপাশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। মহামতি হিমালয়ের রূপে ভুলে গিয়ে এতক্ষণ ঠান্ডার অস্তিত্ব যেন ভুলেই গিয়েছিলাম। মোহাচ্ছন্ন ভাব একটু শিথিল হতেই টের পাচ্ছি কনকনে ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে গায়ে। অনেকে ফেরার পথ ধরেছে। কেউ কেউ ছবি তুলছে তখনও। আমিও তাদের মধ্যে রয়েছি। ঐতিহাসিক এই সময়কে যতক্ষণ পারা যায় উপভোগ করার জন্য। এমন সময় পরিচয় হলো এক বাংলাদেশী দম্পতির সাথে। তাদের বাসা তেজগাঁও এ, সাত রাস্তার মোড়ে ওয়াপদা কলোনীতে। এবার আমার ছবি তোলার সুবিধা হলো। আমার অনুরোধে ভদ্রলোক আমার ছবি তুলে দিলেন। উনার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর সাথেও ছবি তুললাম আমি। তারপর উনাদের যুগল ছবি তুলে দিলাম। এরপর আলাপচারিতার মাধ্যমে জানতে পারলাম যে উনারা গতকালও এখানে এসেছিলেন। কিন্তু দেখতে পারেননি কিছুই। কারণ, গতকাল এই সময়ে আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন, হিমালয় ছিল মেঘে ঢাকা। একথা শুনে আমি মনে মনে খোদাকে ধন্যবাদ জানালাম আজকে অমনটি না করার জন্য। কারণ, আমার হাতে সময় শুধু আজকের দিনটিই। আজকে মিস হলে এযাত্রা আর দেখার সুযোগ হতনা হিমালয়ের এই অনিন্দ সুন্দর রূপ ! আগামীকাল সকালেই আমাকে চলে যেতে হবে, টিকেট ওভাবেই কাটা আছে।

যাক্। কথা বলতে বলতে নেমে এলাম আমরা গাড়ি পার্কিং এ। এরপর সেই আঁকাবাঁকা পথ বেযে রিসোর্টে ফেরা। আসার পথে বেশ কিছুক্ষণ চোখে পড়ছিল শুভ্র সোন্দর্যমন্ডিত হিমালয়ের চূড়াটি। তারপর এক সময় সে হারিয়ে গেল আমার দৃষ্টির সম্মুখ থেকে। ঠিক তখনি আমি আমার মধ্যে এখানকার প্রকৃতির মায়াবী হাতছানি টের পেলাম। সেই হাতছানি যতটা না এখানকার আকাশ কিংবা সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির, তারচেযে বেশী হিমালয়ের। সবকিছু মিলিয়ে বুকের ভিতর একটা সূক্ষ্ণ পিছুটান টের পেলাম।

কাঠমুন্ডু টু নগরকোর্ট 


অস্তগামী সূর্যের রংএ সজ্জিত হিমালয়ের চূড়া।

কাঠমুন্ডু থেকে মাত্র বত্রিশ কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত নগরকোর্ট শহরটির অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার একশত পঁচাত্তর মিটার। হিমালয়ের বুকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য উপভোগের জন্য মূলতঃ এই শহরটি বিখ্যাত। শহরটি একটি আকর্ষণীয় পিকনিক ষ্পটও বটে। এখানে সবুজের ঠাস বুননে ঢাকা সারি সারি পাহাড়ের জড়াজড়ি অবস্থান প্রকৃতি প্রেমিক যে কাউকে বিমোহিত না করে পারেনা। হোটেল ও মোটেলগুলো মূলতঃ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থিত। হিমালয়ের মায়াবি রূপ বিশেষ করে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য যাতে পর্যটকরা পরিপূর্ণরূপে উপভোগ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এমন লোকেশান বেছে নেয়া হয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য।


আমি পোকারা থেকে কাঠমুন্ডু এসে সেখান থেকে যাচ্ছি নগরকোর্টে। গাড়ি এগিয়ে যেতে যেতে কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের কাঠিন্যতার জাল ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি। এখানে প্রকৃতি যেন ডানা মেলা বিহঙ্গ। অবারিত তার চলার ছন্দ। কিন্তু তাই বলে এটাকে আমি আমার দেশের দুচোখ জুড়ানো সবুজে-শ্যামলে মায়াময় প্রকৃতির সাথে তুলনা করতে পারলাম না। কিন্তু বেশীক্ষণ নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আমার কাংখিত শ্যামল প্রকৃতির দেখা পেলাম, প্রবেশ করলাম সবুজের ঠাস বুননে। এরপর শুধু আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে ক্রমেই উপরে উঠার পালা। ড্রাইভার এমন উচ্চ গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল যে আমি ঠিকভাবে গাড়িতে বসে থাকতে পারছিলাম না। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি পাহাড়, যতদূর দৃষ্টি যায় শুধূ পাহাড়ের বুকে সবুজের ঠাস বুনন, এসবের কোলে অস্তাচলগামী সূর্যের রক্তিম আভা। কোথাও বা নরম সোনালী সেই আলো লম্বালম্বিভাবে বিচ্ছুরিত হচ্ছে গাছের মগডালে। সেই নরম সোনালী আভা ঢেকে দিয়েছে হিমালয়ের সুউচ্চ চূড়াকে। যে শ্বেত-শুভ্র হিমালয়কে আমি দেখে এসেছি পোকারার সারাংগট থেকে, এ যেন সেই হিমালয় নয়।বিদায়ী সূযের রক্তিম আভায় স্বর্ণখচিত অত্যুজ্জল এক আলোক বর্তিকা। অস্তগামী সূর্যের সবটুকু রং কেড়ে নিয়ে নিজকে রাঙিয়ে তুলেছে সোনার আলোয়। সবকিছু মিলিয়ে নেশা জাগানিয়া মোহময় রূপ।



সূর্য অস্ত যাচ্ছে।

কিন্তু এই সৌন্দর্যকে নিবিষ্টমনে উপভোগ করব সেই উপায় কোথায় ? গাড়ির ভিতর নিজকে স্থির রাখতেই হিমশিম খাচ্ছি আমি। অগত্যা ড্রাইভারকে বললাম গাড়ির গতি একটু কমাতে। কিন্তু কোন লাভ হলনা। বরং মনে হলো গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ড্রাইভার। শেষে জিজ্ঞেস করলাম সে ইংরেজী বুঝে কি-না। প্রথমে ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু ড্রাইভার কোন উত্তর দিচ্ছেনা দেখে ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে আবার জিজ্ঞেস করলাম। কারণ, নেপালে হিন্দীর ভাষার প্রচলন প্রায় সর্বত্র। যাই হোক, এবার কাজ হলো, ড্রাইভার বুঝল আমার প্রশ্ন। উত্তর দিল, সে ইংরেজী বুঝেনা। এবার তো আমার আক্কেল গুড়–ম অবস্থা ! কি করে ওকে বুঝাব যে, ও যেভাবে গাড়ি চালাচ্ছে তাতে আমার খুব অসুবিধা হচ্ছে। এ তো গেল অসুবিধার একটিমাত্র দিক। অন্যদিকে আমার মনের মধ্যে ভয় ভয় করতে শুরু করেছে ওর কথা শুনে।
তখন অস্তাচলগামী সূর্যের নরম সোনালী আলো অন্ধকারের দিকে রূপ পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। সারি সারি পাহাড়ের বেষ্টনি আর ঘন গাছপালার জড়াজড়ি অবস্থান ভেদ করে শ্বেত-শুভ্র হিমালয়ের চূড়াও ততটা প্রকট নয়। কিন্তু আমরা যে রাস্তা বেয়ে ক্রমশঃ উপরে উঠছি তার চারপাশটা ততক্ষণে অন্ধকারে ঢেকে গেছে। গন্তব্যের কতদূর এসেছি, আর কতদূর যেতে হবে, সময়ই বা কতক্ষণ লাগবে- এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পারলে হয়তো একটু স্বস্তি পেতাম। কিন্তু ড্রাইবার তো আমার প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারছেনা। কারণ, সে প্রশ্নই বুঝতে পারছেনা। তাছাড়া আমিও হিন্দী ভাষায় এতটা পারদর্শী নই যে তাকে এই প্রশ্নগুলো বুঝিয়ে করতে পারব। সে একমনে এমনভাবে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে যেন সে গাড়ি চালানোর প্রতিযোগীতায় নেমেছে। ভয়ের কারণ আরও একটা আছে। এতক্ষণ এই পাহাড়ী পথ বেয়ে যতটা উপরে উঠে এসেছি সে পর্যন্ত আমার গাড়ির সামনে- পেছনে কোন একটিও গাড়ির দেখা পাইনি। কেবল বিপরীত দিক থেকে আসা দুই/একটা গাড়ির দেখা পেয়েছি আমি। তাছাড়া রাস্তার কোন পাশে কোন জনবসতি কিংবা দোকানপাটও নেই। এমন অবস্থায় আমি সারিনার উপর মনে মনে একটু বিরক্ত হলাম। রাফ ড্রাইভিং করে এমন একটা ড্রাইভারকে সে কেন আমার জন্য ঠিক করে দিল ? তার উপর ইংরেজী বুঝেনা !



এমন অবস্থায় অন্য কেউ হলে কি করত আমি জানিনা। কিন্তু আমি সাহস হারাইনি একটুও। এর একমাত্র কারণ হলো সর্বাবস্থায় আমি সেই পরম শক্তিমানের উপর নির্ভর করে থাকি। আজও তাই করলাম। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করলাম আমি অন্তরের গভীর বিশ্বাস থেকে। বললাম, আমার একা একা বাংলাদেশ থেকে নেপালে আসা, নিঃশঙ্কচিত্তে ঘুরে বেড়ানো - সব তোমার ইচ্ছেতেই হচ্ছে। কাজেই এখন যদি আমার জীবনে কোন দুর্ঘটনা ঘটে সেও তোমার ইচ্ছেতেই হবে। তোমার ইচ্ছের নাটাই ছিঁড়ে বেরিয়ে আসব এমন ক্ষমতা আমার নেই। তবে আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে আমার অমঙ্গল হবে, ক্ষতি হবে - এমন কোন ঘটনা তুমি ঘটাবেনা। মনে মনে আল্লাহর দরবারে এমন প্রার্থনা জানানোর পর মনের ভিতর একটু স্বস্তি অনুভব করলাম আমি। সাথে সাথে একটা বুদ্ধি এলো মাথায়। আমি যে হোটেলে যাচ্ছি সেটার নাম বললাম। জিজ্ঞেস করলাম ক্লাব হিমালয়া আর কত দূর ? জানি ড্রাইভার ইংরেজী বুঝবেনা। কিন্তু ক্লাব হিমালয়া নামটা তো ওর পরিচিত। কিছু একটা উত্তর তো দিবে। আমি বাংলাদেশে থাকতেই সারিনা আমাকে জানিয়েছিল যে নগরকোর্টে ক্লাব হিমালয় তে আমার বুকিং কনফার্ম করা হয়েছে এক রাতের জন্য ১১০ ডলারের বিনিময়ে। ড্রাইভার আমার প্রশ্নের কি বুঝল জানিনা। কিছুটা হিন্দী কিছুটা নেপালী ভাষার মিশেলে জানাল যে আমরা যাচ্ছি দি ফোর্ট এ।

আমি অবাক হলাম। সাথে সাথে মনের ভিতর আবারও ভয় ভাব জেগে উঠল। এমনিতেই সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে নির্জন পাহাড়ী রাস্তায় এক গাড়িতে আমি একা যাত্রী। তার উপর ড্রাইভার এখন বলছে অন্য হোটেলের কথা। স্বাভাবিকভাবে মনটা অন্য আশংকায় দুলে উঠল। আমি সাথে সাথে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা দি ফোর্টে যাব কেন ? আমার বুকিং তো ক্লাব হিমালয়াতে কমফার্ম করা। ড্রাইভার কি বুঝল জানিনা। জানাল তাকে ওখানে যাওয়ার কথা বলে দেয়া হয়েছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। ভুলটা কার কোথায় হয়েছে সেটা খুঁজে বের করা কিংবা শুধরানোর সময় এখন নয়। আগে একটি ঠিকানায় পৌঁছানো দরকার। আমি দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত নিলাম। ড্রাইভারকে বললাম, আমাকে ক্লাব হিমালয়াতে নিয়ে চলো। ড্রাইভার তাতে রাজী হলো।
ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে নেমে এসেছে চারপাশে। ড্রাইভার আরও দ্রুত গাড়ি চালাতে লাগল। কিন্তু এখানে বেশ কিছুটা রাস্তা অমসৃণ, ভাঙা-চূড়া। উপরে উঠতে গিয়ে রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছে। গাড়ির ভিতর স্থির হয়ে বসা তো দূরের কথা। আমি একবার গাড়ির এপাশে, আরেকবার ওপাশে ছিটকে পড়তে লাগলাম। এভাবে কিছুদূর উপরে উঠার পর কয়েকটি দোকান-পাট দেখতে পেলাম। মনের ভিতর একটু সাহস ফিরে এলো। কিন্তু আমার মাগরেবের নামাজ পড়া হয়নি। কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এমন সময় ড্রাইভার গাড়ি থামাল ক্লাব হিমালয়ার সামনে। এতক্ষণ গাড়ির ভিতর বসে থেকে মোটেও আন্দাজ করতে পারিনি যে চারপাশে হাড় কাঁপানো শীতের তান্ডবে টিকে থাকা দায়। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমেই সেটা টের পেলাম। তাড়াতাড়ি গায়ে শাল জড়িয়ে নিয়ে চারপাশে ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম। আরও অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়ানো, আমার মতো পর্যটক নিয়ে এসেছে হয়তো। হোটেলের স্টাফ ও গাড়ির ড্রাইভার মিলিয়ে জনা বিশেক লোকও আছে সেখানে। জায়গাটা পাহাড়ের একদম উঁচুতে সমতল ভূমি। পুরো জায়গা জুড়ে অসংখ্য গাছপালা। নিয়ন বাতির আলোতে আমার কাছে মনে হলো জায়গাটা একটা রহস্যময় পুরী। এর বাইরে দূরের কিছু এই মুহূর্তে দেখার উপায় নেই। কারণ, অন্ধকার তখন চারপাশের প্রকৃতিকে ঢেকে ফেলেছে পুরোপুরিভাবে।


চাদের আলোয় হিমালয়ের এই রূপ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি।

আমি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ানোমাত্র একজন বেয়ারা দৌড়ে এসে আমার লাগেজটা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। আমি ওর পেছন পেছন গিয়ে ঢুকলাম ক্লাব হিমালয়ার ভিতরে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকার সাথে সাথে একপ্রস্থ স্বস্তি নেমে এলো আমার মনে। দরজার ওপাড়েই একাধিক ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে। বাইরের কনকনে ঠান্ডা এখানে পরাভূত। বেশ কয়েকজন পর্যটক চেক ইন এর অপেক্ষায় বসে আছেন। তাদের লাগেজে ওয়েটিং প্লেসটাকে মনে হচ্ছে কোন রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুম। আমি গিয়ে সোফায় বসতেই ছোট্ট ট্রেতে করে এক কাপ গরম চা নিয়ে এলো একজন বেয়ারা। এসময় এই চা’টার মূল্য যে কত তা বলে বুঝানো যাবেনা। আমি ওকে ধন্যবাদ দিয়ে ট্রে থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে একটা চুমুক দিলাম। মনে হলো যেন আমার সারাদিনের ক্লান্তির উপর এক পশলা ভাল লাগার আমেজ ছড়িয়ে পড়ল। আমি চা শেষ করে কাউন্টারে গেলাম। ভদ্রলোক অনেক খোঁজাখুজি করেও আমার নামে কোন বুকিং পেলেন না। চা খেয়ে যতটুকুই বা চাঙ্গা হয়েছিল সারাদিনের ভ্রমণ বিধ্বস্ত শরীর, মুহূর্তেই সেটা আবার দ্বিগুণ আকার ধারণ করল। আমার তখন আর এক মুহূর্ত সময়ও কাটছিল না। কখন বিছানায় শরীরটা একটু এলিয়ে দিব সেই অপেক্ষায় যখন উন্মুখ তখনই এমন একটা খবর। আমার নামে এখানে কোন বুকিং নেই। এর চেয়ে বড় বিড়ম্বনা আর কাকে বলে ?




আমার তখন মনে পড়ে গেল যে ড্রাইভার আমাকে ক্লাব দি ফোর্টে নিয়ে যেতে চাইছিল। হয়তো ড্রাইবারই ঠিক ছিল। সারিনা কি তাহলে শেষ মুহূর্তে আমার বুকিং পাল্টিয়েছে , যা আমাকে বলতে ভুলে গেছে ? কার্যত হয়েছেও তাই। আমি তৎক্ষণাত ভদ্রলোককে সারিনার ফোন নম্বর দিয়ে কথা বলতে বললাম। সারিনার সাথে কথা বলে ভদ্রলোক আমাকে জানালেন যে, আমার বুকিং এখানেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পর্যটকদের অতিরিক্ত চাপের কারণে তারা শেষ পর্যন্ত কুলিয়ে উঠতে পারেনি। তাই আমার বুকিংটা দি ফোর্ট এ কনফার্ম করা হয়েছে। আমি সময় নষ্ট করার জন্য ভদ্রলোককে সরি বলে উঠে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোক একজন বেয়ারাকে ডেকে বলে দিলেন আমার লাগেজটা গাড়িতে উঠিয়ে দিতে এবং ড্রাইভারকে ডেকে দিতে। আমি বেয়ারার পিছু পিছু এসে গাড়িতে উঠে বসলাম। এবার ঘুটঘুটে অন্ধকার, পাহাড়ী পথ। বুকটা আমার দুরু দুরু করতে লাগল। কিন্তু রক্ষে এই যে, বেশীক্ষণ সময় লাগল না ক্লাব দি ফোর্টে পৌঁছুতে। মাত্র দশ মিনিটের মাথায় প্রচন্ড রকম অমসৃণ রাস্তা পেরিয়ে আমার গাড়ি এসে থামল দি ফোর্টের সামনে।


কিন্তু আজ যেন বিরুদ্ধ স্রোতই আমার সঙ্গী। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে একটা ধাক্কা খেলাম। একে তো প্রাকৃতিক অন্ধকার, তার উপর বৈদ্যুতিক বিপর্যয়। কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছেনা। আমার ড্রাইভার গেটে আমার পরিচয় দেয়ার পর দারোয়ান গেট খুলে দিল। কিন্তু নিমেষ কারো আঁধারে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। এগোব কি করে ? এমন সময় একজন একটি মোমবাতি হাতে এগিয়ে এলো। দারোয়ান আর মোমবাতি ওয়ালার পেছন পেছন হেঁটে আমি ভিতরে ঢুকে আলোর দেখা পেলাম। রঙিন শেডের নিচে ছোট ছোট প্রদীপ জ্বলছে। হয়তো এগুলো মোমবাতিই হবে। কারণ, পরে জেনেছিলাম যে এখানে জেনারেটর এর কোন ব্যবস্থা নেই।



সূর্যালোকে উদ্ভাসিত হিমালয়ের চূড়া।

যাই হোক। আমি কাউন্টারে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারলাম। কাউন্টার থেকে আমাকে জানানো হলো যে, আমার জন্য এখানেই রাতের ডিনারের ব্যবস্থা আছে। অবশ্য এই তথ্যটা সারিনা আমাকে আগেই জানিয়েছিল। তখন অবশ্য বুঝিনি যে এটা একটা বড় ধরনের পাওয়া আমার জন্য। কারণ, ডিনারের ব্যবস্থা না থাকলে রাতে আমাকে না খেয়ে থাকতে হতো। পোকারার মতো এখানে বাইরে গিয়ে ডিনার করে আসব এমনটা ভাবাও অনুচিত। একে তো নির্জন পাহাড়ী এলাকা, তার উপর বাইরেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর কনকনে হিমেল ঠান্ডা তো আছেই। তাছাড়া এ পর্যন্ত আসার পথে আশেপাশে কোন হোটেল বা রেস্টুরেন্টও চোখে পড়েনি। কোন পুরুষ মানুষও বোধহয় রাতে এখান থেকে বেরিয়ে বাইরে গিয়ে ডিনার সারার কথা চিন্তা করবেনা। আর আমি একা মহিলা। এতদূর চলে এসেছি তাতে নিজের প্রতিই এখন বিস্ময় জাগছে। কাজেই এখানেই রাতে ডিনারের ব্যবস্থাটা আমার জন্য বড় একটা সুবিধা।


আমি কাউন্টারে কর্তব্যরত ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানালাম। বেয়ারা এসে এক হাতে মোমবাতি আর এক হাতে আমার লাগেজটি নিয়ে তার পিছু পিছু যেতে বলল। ওর কথামতো একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠে একটা দরজা পাওয়া গেল। দরজা খুলতেই একটা প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগল। যদিও অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছেনা তবু আমি আন্দাজ করতে পারলাম যে এটা একটা খোলা জায়গা। আমি ভাল করে সামনে তাকালাম। ঘন কুয়াশায় ফিকে হয়ে পড়া চাঁদের আলোয় আবছা কিছু যেন দেখা যাচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে সামনেই সারি সারি পাহাড়। আর বাকী সবকিছু জমাট কুয়াশায় ঢাকা। যাই হোক। এমন ঠান্ডা হাওয়ায় বেশীদূর এগোতে হলনা আমাকে। যে দরজাটা পেরিয়ে এসেছি এর থেকে বিশ/পঁচিশ কদম হাঁটতেই বাদিকে একটা রুমের দরজা খোলে দিল বেয়ারা। লাগেজটা সেখানে রেখে সে চলে গেল। বলে গেল আমি যেন দরজার ছিটকিনি ভাল করে লাগিয়ে রাখি। আর ম্যাচ ও মোম দেখিয়ে দিয়ে গেল।


বেয়ারা চলে যাবার পর ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে আমি নিজের কাছেই নিজের বিস্ময় প্রকাশ করলাম। বলে উঠলাম, হায় ! হায়! এখানে থাকব কি করে ? পাহাড়ের উপর এমন খোলা জায়গা ! তাছাড়া রুমের সামনের অংশে পুরোটা কাঁচের দেয়াল, যদিও ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা। আমার মনে হলো রাতে যদি কোন বন্য জন্তু কাঁচের দেয়াল ভেঙে ভিতরে ঢুকে আক্রমণ চালায় তাহলে কে বাঁচাবে আমাকে ? কথাটা মনে হতেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল আমার। মনে মনে আল্লাহ্কে ডাকলাম। বললাম, ইয়া আল্লাহ্্, তুমি দেখো। এমন সময় বিদ্যুৎ চলে আসায় আমার ভয় একটু দূরীভূত হলো। আমি পরনের কাপড় পাল্টিয়ে ওজু করে প্রথমে মাগরেবের নামাজ পড়লাম। তবে ওজু করতে গিয়ে শীতের প্রচন্ডতা আর এক দফা টের পেলাম। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আর ওজু করবনা। এই ওজুতেই এশার নামাজ পড়ব। পায়ে মোজা পরে সুয়েটার-শাল গায়ে দিয়ে বিছানায় কম্বলের নিচে শরীরটা ঢুকিয়ে দিলাম। কিন্তু পুরোপুরি শুলাম না। কারণ শুইলেই ঘুমিয়ে পড়ব। তাহলে এশার নামাজের আগে আবার ওজু করতে হবে।


আটটায় ডিনার শুরু। তাই সাড়ে সাতটায় এশার নামাজ পড়ে ডিনার খেতে গেলাম। রুম থেকে বের হতেই শীতের প্রচন্ড ধাক্কায় কেঁপে উঠলাম আমি। রুমের দরজা বাইরে থেকে লক করে এবার চারপাশটা ভাল করে দেখলাম আমি। এখানে এক লাইনে চারটি রুম। সামনে খোলা ছাদ। এরপরই দেখা যাচ্ছে সারি সারি পাহাড়ের চূড়া। হোটেল আর পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গাটা একটা ঘন অরণ্য বলে মনে হলো আমার কাছে। জায়গাটা সত্যি ভয় পাবার মতো। তবে প্রকৃতি প্রেমিক কিংবা ভাবুক মাত্রই জায়গাটা পছন্দ করবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। মাথার উপর খোলা আকাশ, সামনে বিস্তৃত খোলা প্রাঙ্গণ- যেখানে পাহাড়ের গায়ে সবুজ বনারণ্য কানে কানে কথা বলছে প্রকৃতির উদার বুকে মাথা রেখে -- আমাদের কংক্রীটের শহুরে জীবন থেকে বেরিয়ে এমন একটা ভাল লাগার প্রতিচ্ছবি কে না পছন্দ করবে ?


এরপরও ভয় যেন কিছুতেই কাটতে চায় না মন থেকে। এমন সুন্দর খোলা পাহাড়ী জায়গা ! দরজার বাইরে এসে তালা লাগাতে লাগাতে মনে হচ্ছিল এই বুঝি কিছু হলো ! দ্রুত হাতে দরজা লক করে দুই পা সামনে এগোতেই পাশের রুম থেকে দুই জন ভদ্রলোক বের হয়ে এলো। আমি একটু সাহস খুঁজে পেলাম যেন, এতক্ষণের ভয় ভয় ভাবটা কেটে গেল। যেদিকেই যাই না কেন, এখান থেকে যাওয়ার রাস্তা একটাই, সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠে একটা দরজা পেরিয়ে যেদিক দিয়ে এসেছিলাম। আমি ওদের সাথে সেই দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলাম রিসিপশনে। পাশেই ডিনারের ব্যবস্থা। এরমধ্যে অনেকেই এসে ডিনার শুরু করে দিয়েছে। আমি একটা প্লেট হাতে নিয়ে খাবার নিতে যাব এমন সময় কাউন্টার থেকে একটি ছেলে আমার কাছে এগিয়ে এসে দেখিয়ে দিল কোনটা পর্ক বা শূয়োর এর মাংস। ছেলেটির দায়িত্বজ্ঞান দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেটা প্রকাশ করলাম। যদিও আমার বেলায় ওর এই দায়িত্ব পালন না করলেও চলত। কারণ, এসব দেশে শূয়োরের মাংস খাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই আমি সব সময় দেখে-শুনে লেখা পড়ে খাবার বাছাই করি। এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতাও নেহায়েত কম নয়। তবু স্বীকার করতে হয় এই যে এই ধরনের কর্মতৎপরতা আমি খুব বেশী দেখিনি। আমার মনে হলো, আমি যে মুসলিম সেটা ওরা বুঝতে পেরেছে আমার মাথার ঘোমটা দেখে। এবং তারা এটাও জানে যে, মুসলিমরা শূয়োর খায়না বা তাদের জন্য শূয়োর খাওয়া নিষিদ্ধ। আমার ধর্মের প্রতি তাদের এই সচেতনতার বিষয়টি এখানে উল্লেখ না করে পারলাম না। যাই হোক, আমি ভাতের সাথে একটুখানি সবজি ও দুই টুকরো চিকেন নিয়ে রাতের খাবার সারলাম। সাথে আর একটা জিনিসও খেয়েছিলাম সেরাতে। সেটা হলো কাঁচা মরিচ। নিয়ে এসেছিলাম পোকারা থেকে। সেখানে যে ভারতীয় ঘরোয়া একটি রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলাম দুই রাত, সেখান থেকে দুটো কাঁচা মরিচ চেয়ে নিয়েছিলাম। একটা খেয়ে আর একটা সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম কখন দরকার পড়ে সেটা ভেবে। এই প্রসংগটা এখানে বলার তেমন প্রয়োজন হতনা। তবু কেন বললাম সেকথাটা একটু বলি।


আমি খাবারের সাথে কাঁচামরিচ কামড়ে কামড়ে খাচ্ছিলাম মুখে একটু বাড়তি রুচির জন্য এবং সেটা পেয়েছিলামও। তাই কোনদিক না তাকিয়ে আমি ভাত খাচ্ছিলাম বলা যায় অনেকটা তৃপ্তি সহকারে এবং এক মনে। আমার এই মরিচ খাওয়ার দৃশ্যটা কাউন্টারের লোকজন এবং আরও অনেকে বিশেষ দৃশ্য হিসেবে তাকিয়ে দেখছিল সেটা আমি খেয়াল করিনি প্রথমদিকে। ওদের দিকে দৃষ্টি পড়তেই ওরা একটু যেন তথমতো খেয়ে গেল। আমি ব্যাপারটাকে সহজ করার জন্য মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললাম যে, আই হেভ টেকেন ইট ফ্রম পোকারা। ওরা কিছু না বলে দৃষ্টি সরিয়ে নিল আমার দিক থেকে।


যাই হোক। খেতে খেতেই আমি টের পাচ্ছিলাম যে, আমার আজ সারাদিনের বিরামহীন ছুটে চলার প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে শরীর। যেন এখানেই শুয়ে পড়তে পারলে বেঁচে যাই। খাওয়া শেষ করে কোনমতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে রুমে ঢুকলাম। ঠিক তখনি আবার বিদ্যুৎ চলে গেল। আমি তাড়াতাড়ি মোম জ্বালিয়ে দরজার লক ঠিকমতো লাগানো হয়েছে কি-না পরীক্ষা করে দেখলাম। জায়গাটাকে যতটা রোমান্টিক আর কাব্যিক বলে চালাতে চেষ্টা করলাম আমি, কিন্তু বিদ্যুৎ চলে যাবার সাথে সাথে আবার ভয় এসে আমাকে ঝাঁকিয়ে ধরল। কেন জানি আমার মনে হতে লাগল যে এই অন্ধকার রাতে পাহাড়ী জঙ্গল থেকে কোন বন্য প্রাণী বেরিয়ে অনায়াসে আক্রমণ করতে পারবে আমাকে। এমনটা ঘটলে এখান থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই আমার। গলা ফাটিয়ে শত চীৎকার করলেও রাতের বেলা কেউ শুনবে কি-না সন্দেহ আছে। আমার পরিবারের কেউ হয়তো জানতেও পারবেনা আমি কোথায় কিভাবে মারা গেলাম।


কথাটা মনে আসার সাথে আমার বাসায় ফোন করার কথা মনে পড়ে গেল। অন্তত সবার জানা থাকা দরকার যে আমি আজকের রাতে কোথায়, কিভাবে আছি ! যদিও আমার ভ্রমণসূচী সবাই জানে এবং এটাও জানে যে, আজ আমি নগরকোর্টে থাকব এবং আগামীকাল দেশে ফিরে যাব। বাসায় আছে আমার হাজব্যান্ড আর আমার বোনের মেয়ে লিলি এবং ওর মেয়ে শশী অর্থাৎ আমার নাতনী। আর আছে কাজের মেয়েটা। আমি প্রথমে আমার হাজব্যান্ডকে ফোন করলাম। কিন্তু অনেকক্ষণ রিং হলেও রিসিভ করেনি। হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত। তাই আমি লিলিকে ফোন করলাম। লিলি ফোন রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করল, খালাম্মা কোথায় আছেন ? আমি জানালাম, নগরকোর্টে আছি, সন্ধ্যায় এসে পৌঁছেছি। তারপর আমার স্বাভাবিক বলার ভংগীতে চারপাশের পরিবেশের একটা বর্ণনা দিলাম লিলিকে। বললাম, হায়, হায় ! লিলি, এ কোথায় এলাম ? পাহাড়ের চূড়ায় একটি রুম, সামনে খোলা ছাদ, এরপরই অনেকটা জুড়ে পাহাড় আর গাছপালা। আল্লাহ্্ই জানে কোন বন্য জন্তু এসে রাতে হামলা করে কি-না। লিলি বলল, জন্তু থাকলে এমন খোলা জায়গায় রুম বানাত না-কি ? তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনার শরীর ঠিক আছে তো ? আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি একদম ঠিক আছি। লিলি আশ্বস্ত হয়ে বলল, ঠিক আছে। ভালভাবে ফিরে আসেন।

লিলির সাথে কথা বলার পর মনে হলো আমার মন থেকে ভাবনার জমাট অনুভূতি অনেকটা সরে গেছে। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। তারপর দু’টা কম্বল মুড়ি দিয়ে আল্লাহ্্র নাম নিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। ভাবলাম, এমন একটা ভীতিকর পরিবেশে কি জানি ঘুম আসবে কি-না। মনে মনে দোয়া পড়তে লাগলাম সব সময় যেরকম করে থাকি। এমন সময় বেয়ারা এসে দরজায় নক করল। আমি জানতে চাইলাম, কি ব্যাপার ? ও জানাল হট ওয়াটার ব্যাগ নিয়ে এসেছে। আমি দরজা খোলে দিলে বেয়ারা রুমে ঢুকে বলল, রাতের বেলা ঠান্ডা আরও বাড়বে। এই হট ওয়াটার ব্যাগটা বিছানায় কম্বলের নিচে নিয়ে শুইলে বিছানা গরম থাকবে। তারপর সে রুম হিটার চালিয়ে দিয়ে প্রয়োজনে কিভাবে বন্ধ করতে হয় সেটা দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি বিছানায় পায়ের নিচে হট ওয়াটার ব্যাগটা নিয়ে শুয়ে পড়লাম। এবার দেখলাম বেশ ওম ওম লাগছে। তারপর চোখ বুজে দোয়া পড়তে লাগলাম।
কিন্তু ঘুম আসার আগ পর্যন্ত একটা চিন্তা কিছুতেই মাথা থেকে সরছিলনা। সেটা হলো রুমে কোন ইন্টারকম ফোন নেই। রাতের বেলা কোন প্রয়োজনে যে কারও সাহায্য চাইব সেই উপায় একেবারে বন্ধ। কারণ, দরজা খোলে বাইরে গিয়ে কাউকে ডাকব সেই সাহস আমার নেই। শুধু তাই নয় আরও একটা দুশ্চিন্তা মনের ভিতর খচ খচ করতে লাগল। সেটার কারন হলো রুম হিটার। এই জিনিসটা ব্যবহার করতে আমার সব সময় ভয় ভয় লাগে। আামর ছোট ভাইয়ের অফিসের বস একবার আমেরিকায় গিয়ে একা রুমে রুম হিটার জ্বালিয়ে ঘুমিয়েছিল। রাতের বেলা সেটা ব্রাস্ট হয়ে রুমে আগুন ধরে যায়। কয়দিন পর সেই ভদ্রলোকের অঙ্গার হয়ে যাওয়া মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। জানি এর সবটাই ভাগ্যের খেলা। কিন্তু সেই থেকে রুম হিটারের যে আতঙ্ক আমার মনে চেপে বসে আছে তা আর দূর হয়নি। আজ এখানে তো এমনিতেই মনের ভিতর আতঙ্কের শেষ নেই। তার উপর আবার রুম হিটার। শীত যতই লাগুক, এটাকে মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। উঠে গিয়ে রুম হিটারটা বন্ধ করে দিয়ে আবার এসে শুয়ে পড়লাম। তারপর মনে মনে আল্লাহ্কে ডাকতে লাগলাম ভালয় ভালয় যেন আজকের রাতটা কেটে যায়। এবং এক সময় নিরিবিলি এক পাহাড়ের চূড়ায় খোলা প্রাঙ্গণের একটি কক্ষে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। এ যেন প্রকৃতির খোলে সুখের নিদ্রা ! এই নিদ্রাই আমাকে ২৮ নভেম্বর, ২০১৩ এর ভ্রমণক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেল পরের দিনের সূর্যোদয় পর্যন্ত।

ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। অবশ্য ভোর বললে ভুল বলা হবে। তখনও ভোর হয়নি। বাংলাদেশ সময় তখন পৌণে পাঁচটা, নেপালে পাঁচটা। আমি আরও কিছুক্ষণ সজাগ শুয়ে থেকে সোয়া পাঁচটার দিকে বিছানা ছাড়লাম। ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে ফজরের নামাজ পড়লাম। ভোরবেলা ঠান্ডার প্রকোপ বেশী থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এতটা ! এই এতটা যে কতটা তা প্রায় জমে যাওয়া পানিতে হাত না দিলে আমিও বুঝতে পারতাম না। এমন ঠান্ডার সময় এই ধরনের হোটেলগুলোতে ওয়াশরুমে গরম পানির ব্যবস্থা থাকে এমনটাই সব সময় দেখে এসেছি। কিন্তু এখানে সেই ব্যবস্থা নেই। অবাক হবার মতো ব্যাপার হলেও এখন আর ততটা অবাক হলাম না। কারণ, এখানে ঢুকার পর থেকে তো অনেক প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে আসছি, যা ট্যুরিষ্ট প্রধান কোন অঞ্চলের এই ধরনের হোটেল-মোটেলগুলোতে থাকার কথা নয়। এই যেমন বারবার বিদ্যুৎ যাচ্ছে কিন্তু জেনারেটরের ব্যবস্থা নেই। লিফট নেই, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। রুমে ইন্টারকম নেই, গেষ্টরা প্রয়োজনে কাউকে ডাকতে হলে রিসিপশনে গিয়ে ডেকে আনতে হয়। আমার রুমে দেখলাম অতি সাধারণ মানের একটি কার্পেট বিছানো। একটা ভাল ড্রেসিং টেবিল কিংবা জিনিসপত্র রাখার জন্য কোন ক্যাবিনেটও নেই। এরকম আরও কত কিছুর ঘাটতি আছে এখানে কে জানে ?

নামাজ পড়ার পর প্রতিদিনের অভ্যাসমতো কিছুক্ষণ কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করলাম আমি। কিন্তু এখানেও বিড়ম্বনা। কুরআন তেলাওয়াত শুরু করতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। গতরাতেও এমনটা হয়েছিল। তখন বেয়ারা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তাই মোমবাতির অস্তিত্ব আমার জানা এবং বিদ্যুৎ চলে যাওয়ামাত্র আলো জ্বালাতে আমার সমস্যা হলনা। আমি মোমবাতির আলোতে পবিত্র কুরআন শরীফ পড়া শেষ করে বাইরে তাকালাম। ঘন কুয়াশার ফাঁক গলিয়ে একটু একটু আলো ফুটছে তখন। আমি বিছানায় এসে কম্বলের নিচে শরীর ঢুকিয়ে দিয়ে তছবিহ পড়তে শুরু করলাম। তছবিহ পড়া শেষ করে আবার বাইরে তাকিয়ে দেখি আকাশে আলোর রেখা ফুটে উঠেছে। গতরাতই আমাকে বলা হয়েছিল যে, সানরাইজ ভিউ দেখার জন্য জায়গাটা উত্তম। তবে প্রচন্ড ঠান্ডা। কাজেই সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রুম থেকে বের হতে হবে।



এমন সময় বাইরে একাধিক মানুষের গলার আওয়াজ পেলাম আমি। সাথে সাথে রুমের সামনের ভারী পর্দা একপাশে একটু সরালাম। চোখে পড়ল আকাশ সেজে ঠেছে সূর্য উঠার পূর্ব মুহূর্তের সাজে। আমি ঘরের পর্দা পুরোটা একপাশে সরিয়ে নিলাম। অমনি চোখে পড়ল আমার রুম বরাবর পাহাড়ের সাদা চূড়ায় সূর্য উঠার পূর্ব মুহূর্তের ঝলকানি। এই সেই গ্রেট হিমালয় পর্বতমালা। পাহাড়ের ওপাশে হিমালয়ের চূড়ায় ভোরের আলোর প্রস্ফুটিত রূপ। এই রূপ উপভোগ করার জন্যই এত ভোরে আমার পাশের রুমের অতিথিরা বেরিয়ে এসেছে। আমি কাপড় চেঞ্জ করে ক্যামেরা লোড করে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। আমার রুম বরাবর সামনের খোলা ছাদে তিনজন মহিলা ও দুইজন পুরুষ অনবরত ছবি তুলছে। এরাই আমার গত রাতের প্রতিবেশী। আমি এগিয়ে গিয়ে গুড মর্নিং বলতেই ওরা সহাস্যে আমাকে ওদের সঙ্গী করে নিল। আমি ওদের সাথে দাঁড়িয়ে হিমালয়ের বুকে একটি ভোরের সূর্যোদয়ের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম, যেমনটা করেছিলাম পোকারায় হিমালয়ের অন্নপূর্ণা পিকে সূর্যোদয়ের সময়। সত্যি এমন দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়, কেবল হৃদয়-মন দিয়ে উপভোগ করা ছাড়া।


আমরা যেদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি তার ডানদিকে রক্তিম আলোর পসরা সাজিয়ে সূর্য উঠছে। আর বাঁদিকে সাদা বরফে ঢাকা হিমালয়ের চূড়ায় সূর্যের সেই কিরণ আছড়ে পড়ে এক রহস্যময় সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে হিমালয় যেন পরম আদরে ভালবাসার মায়াজালে টেনে নিচ্ছে সূর্যরশ্মিকে তার গভীর সান্নিধ্যে। আর এদের মাঝখানে পাহাড়ের বুকে সবুজের ঘন অরণ্য নিরব সাক্ষী হয়ে দেখছে সবকিছু। আমরা সবাই একের পর এক ছবি তুলছি। কিন্তু কোনদিক রেখে কোনদিকের ছবি তুলব ? একদিকে হিমালয়কে নিজের রংএ রাঙিয়ে দিয়ে সূর্য তার আপন গরিমায় উদ্ভাসিত। অন্যদিকে নিজের দুগ্ধ-ধবল বরফাচ্ছিত শান্ত-সৌম্য রূপের সাথে সূর্যের রক্তাভ আভাকে ধারণ করে আপন মহিমায় উজ্জল হিমালয়। মাঝখানে প্রকৃতির বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা সবুজ পাহাড়রাশি যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা পটভূমি। ছবি তোলার পাশাপাশি আমি এপাশ-ওপাশ ঘুরে মোবাইলে ভিডিও করলাম এই অনিন্দ সুন্দর দৃশ্যপট।

আমার ভিতরের প্রথমবারের উন্মাদনা একটু স্থিত হয়ে আসার পর আমি কথা বললাম সেখানে থাকা পর্যটকদের সাথে। ওরা অইরিশ, একই পরিবারের সদস্য। আমি একা এসেছি জানতে পেরে খুব অবাক হলো ওরা। বাংলাদেশের মেয়েরা একা বিদেশে ভ্রমণ করতে পারে এটা নাকি ওরা এই প্রথম দেখল। ওদের সাথে আরও কথা বলার পর আমার ধারণা হলো যে বাংলাদেশ সম্পর্কে ওদের কিছু ধারণা আছে। তবে কোনটাই স্বচ্ছ নয়।

সূর্য তখন বেশ খানিকটা উপরে উঠে গেছে। এর আলোতে এভারেস্ট পর্বতমালা, অন্নপূর্ণা ও ধুলাগিরি শৃঙ্গ এখন আমাদের সামনে সম্পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত। চোখ জুড়ানো এমন দৃশ্য কোনদিন দেখতে পাব আগে ভাবিনি। মনে মনে বিধাতাকে ধন্যবাদ দিলাম প্রকৃতির এমন মহিমাময় রূপ-সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য আমাকে দেয়ার জন্য। আমি জানিনা মানুষ কখন কোন পরিস্থিতিতে তার মানব জনমকে সার্থক মনে করে ? মানুষভেদে এই উপলব্ধি ভিন্নতর হতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে সময়ের যে সন্ধিক্ষণে আমি দাঁড়িয়ে আছি তাতে এমন অভিব্যক্তি মনের গহীন কোণ থেকে এমনিতেই বেরিয়ে এসেছে। আমি মনে মনে বললাম, সার্থক জনম আমার দেখেছি হিমালয়কে প্রকৃতির আনন্দ প্লাবিত কোলে। পাণ করেছি এর রূপের সূধা মহাকালের কোন এক আনন্দযজ্ঞের মাঝে দাঁড়িয়ে। মহামহিম হিমালয় তার চারপাশের প্রকৃতিকে আপন রূপের ঝলকে যেভাবে রাঙিয়ে তুলেছে সৌন্দর্য পিয়াসী সামনে, তাদের মধ্যে আমি একজন। ভাবতেই নিজের অস্তিত্বকে একটি অনন্য প্রেক্ষাপটে আবিস্কার করলাম আমি।


এতক্ষণ পর আমার সুযোগ হলো হিমালয় থেকে দৃষ্টি সরানোর। আমি ছাদের নিচের চারপাশটা ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম। সেখানেও দৃষ্টি আটকে যাবার মতো সুন্দরের সমারোহ। সবকিছু ছিমছাম, ঝকঝকে-তকতকে, সুন্দর করে সাজানো। জায়গাটা পাহাড়ের উপর অনেকটা সমতলে। সেখানে অসংখ্য চেনা-অচেনা গাছ। দেখেই বুঝা যায় লাগানো হয়েছে অত্যন্ত পরিকল্পনা করে হোটেলের সৌন্দর্য বর্ধনের দিকে লক্ষ্য রেখে। প্রকৃতির কোলে সাজানো এমন নিটোল সুন্দর পরিবেশ হাতের কাছে পেয়ে কার না ইচ্ছে করে একটু ঘুরে বেড়াতে ? তার উপর সময়টা যদি হয় মনের সাজানো বাগানে উড়ে বেড়ানো পোষা পাখিটির মতো। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে এক ফ্লোর নিচে নামলেই এরকম আরও একটি ছাদ। তবে সেটাকে ছাদ না বলে ফুলের বাগান বলাই ভাল। থরে থরে ফুটে রয়েছে নানা জাতের ফুল। কোনটা চিনি, কোনটা বা চিনিনা, আগে কখনও দেখিনি। ফুলের গাছের ফাঁকে ফাঁকে এখানে-সেখানে সিমেন্টের আসন বসানো। ছাদের চারপাশে নিচ থেকে উঠে আসা নানা ধরনের গাছ ডাল-পালা বিছিয়ে যেন আমাকেই কাছে ডাকছে। প্রকৃতির এমন উদাত্ত-লোভনীয় আহবানকে পাশ কাটিয়ে চলে যাব কিংবা উপেক্ষা করব এমন মনের জোড় আমার নেই, কোনকালেও ছিলনা। আমি ধীর পায়ে নেমে গেলাম নিচের ছাদে। এখান থেকে হিমালয়কে পরিপূর্ণ অবয়বে দেখা যায়না ঠিকই, তবে এই ছাদ নিজে যে সুন্দরের মেলা বসিয়েছে সেটাও কোন অংশে কম নয়। আমি ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখছি আর মুগ্ধতার মোহময় আবেষ্টনীতে ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছি। মনে মনে বলি, যদি অনন্তকাল এখানে, এই প্রকৃতির ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে সময় কাটানো যেত তাহলে বলতাম দ্বিতীয়বারের মতো আমার মানব জনম সার্থক হয়েছে।

প্রথমবার তো হিমালয়কে দেখে পরিপূর্ণতা পেয়েছে আমার মানব জনম। সময় আর প্রকৃতির এমন মনকাড়া আয়োজন থেকে আমি অতিথি খালি হাতে ফিরতে পারবনা। হৃদয়ের গভীরতম উপলব্ধিতে যা ধারণ করেছি তার প্রকাশ ঘটালাম গুটিকয়েক ছবি তুলে। তারপর গিয়ে বসলাম ব্রেকফাস্ট টেবিলে। খাওয়া শেষ করে দ্রুত রুমে ফিরে গেলাম আমি। ইতোমধ্যে নয়টা বেজে গেছে। সাড়ে দশটায় আমাকে রওনা দিতে হবে। গুছগাছেরও একটা ব্যাপার আছে। যদিও ফ্লাইটের সময় অনেক পরে, তিনটা দশে। দুপুর দেড়টায় গিয়ে পৌঁছুতে পারলেই হলো। তার আগে নগরকোর্টের একটা দর্শনীয় স্থান দেখার বাকী রয়েছে আমার। সেটা হলো বখ্তপুর দরবার স্কোয়ার। এরপর হাতে সময় থাকলে কোন একটা শপিং মলে ঢুকব আমি। হাতে অনেকগুলো নেপালী রুপী রয়ে গেছে। কেনাকাটাও তেমন করা হয়নি। তাই যদি কিছু কেনাকাটা করা যায় সেই চেষ্টা একটু করে দেখব।

কিন্তু আমি আমার রুমের সামনে গিয়ে ভিতরে ঢুকার কথা ভুলে গেলাম। এ যেন হিমালয়ের মাদকতার টান। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম হিমালয়ের দিকে। সূর্যের আলো যত তেজ ছড়াচ্ছে ততই হিমালয়ের জৌলুস দীপ্তমান হচ্ছে। আমার প্রতিবেশী আইরিশ মহিলাও তখন তার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে রৌদ্রকরোজ্জল হিমালয়ের তেজোদীপ্ত রূপ দেখছে। আমি তাকে অনুরোধ করলাম আমার কিছু তুলে দিতে। ভদ্রমহিলা সানন্দে রাজী হলো। ছবি তোলা শেষ করে আমি রুমে গিয়ে বিছানায় শরীরটা একটু এলিয়ে দিলাম। এখান থেকেও হিমালয় পূর্ণ অবয়বে দৃশ্যমান। এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য যে বিছানায় শুয়ে আমি হিমালয় দেখব। এমন অবস্থায় মনের ভাবাবেগকে দমিয়ে রাখা সত্যিই কঠিন। তাই উঠে বসে কাগজের বুকে কলমের আছড়ে সেটা প্রকাশ করলাম আমি। কথার ফুলঝুরি হোক, আর যা-ই হোক। আমি মনে করি সেই মুহূর্তে আমি যে কথাগুলো লিখেছি তা আমার মনের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ, জীবন্ত আগ্নেয়গীরির মতো। সেই ভাবাবগকে এখন আবার নতুন করে লিখতে গেলে সেটা যে তার মৌলিকত্ব হারাবেনা এমন নিশ্চয়তা আমি দিতে পাচ্ছিনা। তাই সেই লেখাটা হুবহু তুলে ধরলাম এখানে।


“ একি ভাবার কথা ! নাকি কখনও ভেবেছি আমি ? আমার রুম থেকে বিছানায় বসে হিমালয়ের রৌদ্রকরোজ্জল আলোকিত রূপ দেখছি আমি। বাস্তবকে ডিঙিয়ে মানুষের কল্পনা অনেকদূর যেতে পারে এটা আমি জানি। কিন্তু তাই বলে এতদূর ! আমার একা একা নেপালে আসার বিষয়টিকে বাস্তবতার নিরিখে যদিও গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়, কিন্তু তাই বলে এতটা ! নগরকোর্টের ফোর্ট রিসোর্টের ৩০১ নম্বর কক্ষটি আমার নামে বরাদ্দ পাওয়ার ঘটনাকে আজ ভোর হবার আগ পর্যন্ত স্বাচ্ছন্দে গ্রহণ করতে পারিনি আমি। কারণ, গতকাল সন্ধ্যার পর রুমে ঢুকার সময় থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত যা যা প্রতিকূলতা আমার সামনে এসেছে সেগুলো পরোক্ষভাবে আমার মনে ভয়ের ঘন্টা বাজিয়েছে একাাধিকবার। কিন্তু ক্লান্ত শরীরে ঝাঁকিয়ে ধরা ঘুমের কাছে সবকিছু হার মানতে বাধ্য হয়।

অথচ সকালটা আমার কাছে হাজির হয়েছে আমার এ যাবৎকালে সেরা অর্জনকে সাথে নিয়ে। আজকের সূর্যোদয় আমাকে উপহার দিয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্টতম স্মরণীয় মুহূর্ত। আমি স্বচক্ষে হিমালয়ের সূর্য উদয়কালীন সৌন্দর্য, যার তুলনা মেলেনা পৃথিবীর কোন কিছুর সাথে। আর এখন আমি নিজ রুমে বসে বিছানায় শুয়ে দেখছি রৌদ্রালোকিত হিমালয়ের তেজোদীপ্ত রূপকে। আমার চিন্তা-চেতনা-অনুভূতি সবকিছু দিক হারিয়ে ফেলেছে। তাই নিজকে নিয়ে এখন আমি কি করব ভেবে পাচ্ছি না। ইচ্ছে করছে দেশ থেকে সমস্ত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজন সবাইকে ডেকে নিয়ে এসে দেখাই আমার আজকের এই অবস্থানকে। বলি, দেখো, আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। মহাকাল আমার কাছে আজ সকালে সুন্দরের ঢালি হাতে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষের আবহমান কালের চিন্তা-চেতনার সব বন্ধন ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়ে আজকের এই সকাল আমার কাছে স্মরণকালের শ্রেষ্ট সময় হিসেবে বেঁচে থাকবে।
আমরা সবাই একের পর এক ছবি তুলছি। জানিনা কিভাবে তুললে, কত ছবি তুললে গ্রেট হিমালয়কে আমি জীবন্ত হিসেবে তুলে ধরতে পারব সবার কাছে। আর এখন এই মুহূর্তে সকাল নয়টার মতো বাজে। আর এক ঘন্টা পর চলে যাব আমি। এই মুহূর্তে আমি আমার বিছানায় বসে এই লেখা লিখছি আমি। আমার চোখের সামনে শুভ্র বরফের চাদর গায়ে হিমালয় দাঁড়িয়ে তার মহিমাময় রূপ নিয়ে। এখন বুঝতে পাচ্ছি রুমের সামনের অংশে কাঁচের দরজা বা দেয়াল দেয়ার মূল কারণটা এই। ঘরে বসে বিছানায় শুয়েও উপভোগ করা যাবে হিমালয়ের নান্দনিক সৌন্দর্য। সত্যি অবিশ্বাস্য ! প্রথমেই বলেছিলাম কথাটি। আবারও বলছি। এই মুহূর্তে আমার অস্তিত্ব আমার কাছে অবিশ্বাস্য। সেই ছোটকালে হিমালয় নিয়ে কত পড়া পড়তে হয়েছে। কিন্তু একবারের জন্যও মনে হয়নি যে আমি কোনদিন স্বচক্ষে হিমালয়কে দেখতে পাব। অথচ আজ এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় সত্য যে, আমি নেপালের নগরকোর্ট শহরের ক্লাব দি ফোর্ট রিসোর্টের ৩০১ নম্বর কক্ষের বিছানার উপর বসে এই লেখা লিখছি আর বারবার চোখ তুলে তাকিয়ে হিমালয়কে দেখছি। সূর্যের আলো যত প্রকট হচ্ছে, ততই উদ্ভাসিত হচ্ছে হিমালয়ের রূপ। এই যে বছরের পর বছর ধরে হিমালয়ের চূড়ায় আরোহণের জন্য মানুষের মধ্যে অদম্য চেষ্টা তা কেবল অভিযাত্রী হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখাবার জন্য নয়। হিমালয়ের এই যে মায়াবী সৌন্দর্য সেটাও এর একটা কারণ।”

কিন্তু আমি এই মুহূর্তে সময়ের ফ্রেমে কঠিনভাবে আবদ্ধ। একটুও নড়চড় করার উপায় নেই। এতক্ষণ ধরে হিমালয় আমার মনে যে কাব্যিক ভাবাবেগের জন্ম দিয়েছে তাতে করে হাতে সময় থাকলে নিঃসন্দেহে একটি মহাকাব্য না হোক, হিমালয়ের স্তূতিকাব্য লিখে ফেলতে পারতাম। কিন্তু উপায় নেই। তাই লেখার খায়েস অসম্পূর্ণ রেখেই উঠতে হলো আমাকে। জিনিসপত্র তেমন বের করা হয়নি, কেবল অতি প্রয়োজনীয় কিছু ছাড়া। তাই খুব তাড়াতাড়ি লাগেজ গুছিয়ে নিতে সমস্যা হলনা। ঘড়েিত তখন দশটার একটু বেশী বাজে। আমি রুম থেকে বের হয়ে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলাম হিমালয়ের দিকে। প্রচন্ড এক পিছুটান যেন আমাকে ডাকছে। মনের ভিতর বিচ্ছেদের সুর বেজে উঠল। সেটাকে শক্তিতে রূপান্তর করে সেই পিছুটানকে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। যেতে যেতে মনে মনে বললাম, আর কি দেখা হবে কখনও এই মহিমাময় সুন্দরের সাথে ? একমাত্র বিধাতাই জানেন। সব পারেন তিনি। তিনি ইচ্ছে করলেই আবার আমার দেখা হতে পারে হিমালয়ের এই রূপের সাথে।কাউন্টারে চাবি জমা দিয়ে বেরিযে এলাম। গাড়ি তৈরী ছিল। আমি উঠে বসতেই ছেড়ে দিল। মনে মনে বললাম, আবার হবে তো দেখা/এই দেখাই শেষ দেখা নয় তো ? যেন পরম প্রিয়জনকে ছেড়ে যাওয়া মনের অভিব্যক্তি !

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন