প্যারাগ্লিডিং

ছোট বেলায় স্কুল ম্যাগাজিন আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম। কবিতার প্রথম লাইন দুইটি ছিল এমন 'আমি যদি হতাম পাখি, হতাম আমি নীল আকাশের সাথী।'

পাখি হবার আজন্ম সাধ কিছুটা হলে পূর্ণতা পেল এই পাতায়া শহরে। প্যারাগ্লিডিং এর কল্যাণে ক্ষণিকের জন্য পাখির মতো উড়ার দারুন অভিজ্ঞতা হলো। মাথার উপর নীল আকাশ, পায়ের নিচে নীল জল, মাঝখানে আমি কাধে প্যারাস্যুট কাধে ঝুলিয়ে শুন্যে হাওয়ায় ভাসছি। এ এক দারুন অভিজ্ঞতা।

ও প্যারাগ্লাইডিং ব্যাপারটা কী সেইটাও তো বলা হলো না। প্যারাগ্লাইডিং হলো স্টীমারের পিছনে প্যারাস্যুট বেঁধে অভিযাত্রীকে পাখির মতো উড়তে সাহায্য করা। পাতায়া থেকে কোরাল আইল্যান্ড যাবার পথে আমাদের গাইড প্যারাগ্লাইডিং এর জন্য মাঝ সমুদ্রে আমাদের নামিয়ে দিল। পাতায়া সৈকত থেকে স্টীমারে মিনিট পাঁচেক দূরে সমু্দ্রের মাঝে প্যারাগ্লাইডিংএর আয়োজন করা হয়েছে। প্যারাগ্লাইডিং জন প্রতি পাঁচশ বাথ। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৪০০ টাকা। প্রতিজন পাঁচ থেকে সাত মিনিটের জন্য প্যারাগ্লাইডিং-এ আকাশে উড়া সুযোগ পায়। এত অল্প সময়ের জন্য এমন আকাশ ছোয়া মূল্য! কিন্তু আকাশে উড়া বলে কথা, দলে দলে ছোট বড় সব বয়সী পর্যটকই প্যারাগ্লাইডিং-এর রোমাঞ্চ লুফে নিতে সারিবদ্ধ লাইনে দাড়িয়েছে।

প্যারাগ্লাইডিং থেকে অপেক্ষায় যেন রোমাঞ্চ বেশি। সেফ জ্যাকেট পরে প্রায় আধাঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে আছি। আর দেখছি, প্যারাগ্লাইডিং সম্পন্নদের উচ্ছ্বাস। প্যারাগ্লাইডিং করা একেকজনের চোখে মুখে যে আনন্দের হল্কা দেখা যায় তাতেই অপেক্ষমানদের রোমাঞ্চ বাড়িয়ে দেয়। নিঃসন্দেহে প্যারাগ্লাইডিং-এ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা, যা সচারচর পাওয়া যায় না।

দেখতে দেখতে আমার টার্নও এলো। আমার সেফ জ্যাকেটের সাথে প্যারাস্যুটা বিশেষ হুকের মাধ্যমে আটকে দেওয়া হলো, আমি হাত পা সবই যেমন খুশি তেমন নাড়াতে পারবো কিন্তু নিচে পড়ে যাবো না। পিঠে প্যারাস্যুট বাঁধা শেষে প্যারাস্যুটের সাথে বাঁধা স্টীমার যেই ছুটলো ওমনি আমি এক পলকে আকাশে। আহা কী আনন্দ! দুই হাত প্রসারিত করলাম। পাখিরা কেমনে হাওয়ায় ভাসে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম। আকাশে উঠে নিজেকে কেমন হালকা হালকা লাগছে। উপস্থিত সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে বেশ লাগছে। সারাটা দিন যদি এমনি আকাশে ভেসে থাকা যেন! সেটা তো সম্ভব না। তাই মনে মনে প্রার্থনা করলাম ইস যদি প্যারাস্যুটটা ছিড়ে যায়! তাহলে মাঝ সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া অভিজ্ঞতাও হয়ে যাবে। আমি জানি যথেষ্ট নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া আছে, তাই মাঝ সমুদ্রে পড়ে অন্তত ডুবে মরবো না এইটা নিশ্চিন্ত। অতএব প্যারাস্যুট ছিড়ে নিচে পড়ার প্রার্থনা করা যেতেই পারে। এখানে ব্যতিক্রম কিছু ঘটুক। কিন্তু প্রার্থনা কবুল হলো না আর সবার মতো নির্দিষ্ট সময় পর আমাকেও নিচে নামিয়ে দেওয়া হলো।

প্যারাগ্লাইডিং শেষ হলেও এর রেস অনেকক্ষণ রয়ে যায়। সবচেয়ে অবাক হলাম যখন দেখলাম আমার অজান্তেই ওরা আমার প্যারাগ্লাইডিং এর মুহুর্তটা ওরা ফ্রেমবন্দি করে রেখেছে। ফ্রেমেবাধা ছবিটা এতটাই লোভনীয় যে ওদের কাছ থেকে না কিনে পারা গেল না। সামান্য প্লাস্টিকের ফ্রেমে একটা ছবি, ১০০ বাথ। নো বার্গেনিং। প্রতি মিনিটেই একজন করে প্যারাগ্লাইডিং করছে। তাদেরকে সনাক্ত করে ঠিক তাদের কাছেই নির্দিষ্ট সময় পরে ছবি পৌছে প্রমাণ করলো থাইবাসী বিপনণটা ভালোই রপ্ত করেছে। প্যারাগ্লাইডিং-এর ঘন্টা চারেক পরে আমরা যখন কোরাল আইল্যান্ড ঘুরে পাতায়া সৈকতে নামলাম তখন দেখি একজন আমাদের দলের সবার ছবি নিয়ে দাড়িয়ে আছে।

আমরা সবাই একের পর এক প্যারাগ্লাইডিং করেছি এমন নয়। দেখা গেছে আমি করেছি আমার পিছে অপরিচিত একজন সামনে অপরিচিত একজন। এর মাঝেই ঠিকই ওরা ঠিকই আমাকে আলাদা করে রেখেছে। তাই সবাই যখন নিজের প্যারাগ্লাইডিং এর আকর্ষণীয় ছবি ফ্রেমে বাঁধা অবস্থায় পেলাম। তখন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। ১০০ বাথ তো ব্যাপারই না। পাতায়া শহরে এমন অনেক কিছুই আছে, কেউ আপনাকে জোর করবে না কিন্তু এমনভাবে ওরা উপস্থাপন করবে যে আপনার পকেট থেকে বাথ এমনি এমনিই বের হয়ে যাবে। থাইবাসী টাকা কামানো ফন্দী ভালই রপ্ত করেছে।
মাসাআজ
রাত এগারটায় সিদ্ধান্ত নিলাম ফুট মাসাআজ করাতে হবে। সারাদিন এতোবেশি হাটাচলা করতে হয়েছে যে এখন শরীর মন বলছে, মাসআজ, মাসআজ। মাসআজ না করলে আমি বোধহয় আর হাটতে চলতে পারবো না! থাইল্যান্ডে এলাম আর মাসাআজ করালাম না তা হয় নাকি? তো কোথায় মাসাআজ করা যায়? পাতায়া শহরে আমরা উঠেছি ওয়েলকাম হোটেল-এ। এই হোটেল থেকে বের হতেই রাস্তার পাশে সারি সারি মাসাআজ পার্লার । সুদর্শন থাইনারীরা মাসাআজ পার্লারের সামনে বসে সুর করে মাসআআজ মাসআআজ গীত গেয়ে ভোক্তাদের আকর্ষণ করছে। সারাদিন মাসআআজ মাসআআজ শুনতে শুনতে এখন মাসাআজটা অস্তিমজ্জায় ঢুকে গেছে। তাই রাত এগারটায় হোটেল থেকে বের হলাম মাসাআজ করাতে।
পাতায়া আর ব্যাংকক থাইল্যান্ডের এই দুই শহরে আমাদের ঘোরার সুযোগ হয়েছে এবং শহর দুইটার সর্বত্রই মাসাআজ পার্লার চোখে পড়ে। বিশেষ করে পর্যটনবেষ্টিত হোটেলগুলোর পাশে এই মাসাআজ পার্লারের আধিক্য অনেক বেশি। থাই মাসাআজ, ফুট মাসাআজ, অয়েল মাসাআজ আরও হরেক রকমের মাসাআজ আর আছে রকমারী স্পা। থাইল্যান্ডের এই মাসাআজকে এরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
ব্যাংককের তুলনায় পাতায়ায় মাসাআজ খরচ তুলনামূলক কম। পাতায়ার পরিবেশনাটাও যথেষ্ট ভালো। প্রত্যেক মাসাআজ পার্লারের সবাই নির্দিষ্ট পোশাক পরা। পার্লারের ভিতরের রুমসজ্জাও দারুন। ব্যাংককের মাসাআজ পার্লারে যৌনতাকে প্রশ্রয় দেয়। পাতায়ার মাসাআজ পার্লার সেইদিক থেকে মুক্ত।
তো যাই হোক রাত এগারটায় পাতায়ার এক মাসাআজ পার্লারের দরজায় কড়া নাড়লাম। সুদর্শন এক থাই নারী অভ্যর্থনা জানালো। যখন হোটেল রুম থেকে বের হয়েছিলাম তখন চিন্তা ছিল ফুট মাসাআজ করাবো। সারাদিন হাটতে হাটতে পা দু'টা বড্ড ক্লান্ত। পা দু'টার একটু আরাম দরকার। আগে যেহেতু এখানে আসা হয় নি তাই কেমন কী খরচ তার একটা ধারণা নিলাম। যখন শুনলাম ফুট মাসাআজ ২০০ বাথ, থাই মাসাআজও ২০০ বাথ; তখন দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই থাই মাসাআজ নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। থাই মাসাআজ মানে সারা শরীর মাসাআজ। একই খরচে কেন শুধু পা মাসাআজ করাবো?
থাই মাসাআজের জন্য আমাকে তিনতলার একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ঘরটায় নীল রঙের পর্দা দিয়ে ঢাকা। আমাকে মাসাআজ করানোর জন্য যেই মেয়েটি আমার সামনে দাড়িয়ে আছে তার পরনেই নীল রঙের পোশাক। আমাকে মাসাআজ-এর বিশেষ পোশাক দেওয়া হলো। অদ্ভুত পোশাক। অনেকটা ত্রিকোয়াটার প্যান্টের মতোন। প্যান্টের কোমরের সাইজ হবে পঞ্চাশ। পোশাকটা কোমরে বাঁধার মতো ফিতাও নেই। এইটা কিভাবে পড়বো। আমি পোশাকটা হাতে নিয়ে বোকার মতো দাড়িয়ে আছি। মেয়েটা থাই ভাষায় অনর্গল কি সব বলছে। ওরা যেমন বাংলা-ইংরেজী জানে না, আমি তেমন থাই ভাষাও জানি না। নিজেকে বড় অসহায় লাগছে। ওর কথা, আকার-ইঙ্গিতে যেটা বুঝলাম ও বলছে আমার পরনের পোশাক সব খুলে এই মাসাআজ পোশাক পড়তে। শার্টটা না হয় খুললাম। প্যান্টটা কিভাবে খুলি যদি সামনে ষোল-সতেরও বছরের একটা মেয়ে দাড়িয়ে থাকি। আমি বাংলা-ইংরেজী মিশিয়ে যথাসাধ্য বোঝানোর চেষ্টা করছি, জানার কোন চেঞ্জ রুম আছে কিনা। ও কি বুঝছে সেই জানে, আমার সামনে দাড়িয়ে হি হি করে হাসছে। মিনিট পাঁচেক এমন ভাষা জটিলতায় যাওয়ার পর অবশেষে মনে হলো, মেয়েটি আমার অবস্থা বুঝতে পারলো। আমাকে রুমে একা রেখে চলে গেল। এই তো সুযোগ, অদ্ভুত পোশাকটা কোন রকমে আওত্তে নিয়ে মেয়েটির অপেক্ষায়..।
তার মিনিট পাঁচেক পরে নীল রঙের ষোড়শী মেয়েটি ফিরে এলো। আমাকে শুইয়ে আমার পায়ের আঙুলগুলো হাতে নিয়ে আলতো করে টান দিতে লাগলো। তারপর ধীরে ধীরে মেয়েটির নরম হাত পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিচরণ করতে থাকে। আর পরম আয়েশে আমার শরীর ঢুবতে থাকে।...... তারপর.... তারপর....
মাসাআজ-এর বিস্তারিত বর্ণনা আমি দেবো না। আগ্রহীরা থাইল্যান্ড-এ যখন যাবেন তখন থাই মাসাআজ যে নিবেন এটা আর বলার দরকার নেই। থাই মাসাআজ সম্পর্কে শুধু এটুকুই বলে রাখি, একঘন্টার থাই মাসাআজ আপনার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দেবে।
রিপলিস বিলিভ ইট অর নট

ছোট বেলায় টিভিতে রিপলিস বিলিভ অর নট এর প্রোগ্রাম দেখতাম আর অবাক হতাম সত্যি এমন হয় কি? কে জানতো আমাদের ওয়েলকাম প্লাজা হোটেল-এর পাশেই সেই বিখ্যাত রিপলিস বিলিভ ইট অর নট এর জাদুঘর। সকালে নাস্তা শেষে জাদুঘরের সামনে ঘুর ঘুর করছি। আর একটা ছবি তোলা যায় কিনা ভাবছি। ছবি তুলতে পারলে দেশে ফিরে বন্ধুদের কাছে বুক ফুলিয়ে বলা যাবে, এই দেখ রিপলিস বিলিভ ইট অর নট। জাদুঘরের সামনে দেখলাম একজন সুদর্শণ থাই নারী দাড়িয়ে আছে। পোশাক-আশাকেই বোঝা যাচ্ছে এই জাদুঘরের কর্মী। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এইখানে ছবি তোলা যাবে কিনা? সে আমার ইংরেজী কী বুঝলো সেই জানে, মিষ্টি হেসে আমাকে একটা ব্রশিয়ুর ধরিয়ে দিল। সেখানে থাই ভাষায় হিজি বিজি লেখা। কিছুই বুঝবার উপায় কী বলতে চাচ্ছে। শুধু এক যায়গায় বুঝতে পারলাম 'রিপলিস বিলিভ ইট অর নট'এর ছবির পাশে লেখা ৩৫০ বাথ। আর পাশে কয়েকটা সময় উল্লেখ করা। ভাবলাম হয়তো জাদুঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে ৩৫০ বাথ লাগবে। কিছুক্ষণের ভিতরেই যেহেতু আমাদের আগে থেকে নির্দিষ্ট স্পট ভ্রমণে বের হয়ে যাবো, সেহেতু এত অল্প সময়ের জন্য ৩৫০ বাথ খরচ করা বোকামীই হবে। আমি আমার মতো ফটাফট ছবি তুলে 'রিপলিস বিলিভ ইট অর নট' জাদুঘরের সামনে থেকে প্রস্থান করলাম। পরে দেশে আসার পর অফিসের এক সহকর্মীর মাধ্যমে জানতে পারলাম 'রিপলিস বিলিভ ইট অর নট'-এ ফোর ডি সিনেমা শো হয়। তখন একটু বুঝতেও বাকি রইল না যে জাদুঘরের সামনে মেয়েটি আমাকে যে ব্রশিয়ুর ধরিয়ে দিয়েছিল ওইটা ছিল আসলে ফোর ডি সিনেমা শো-এর সময়সূচি। এই জীবনে থ্রিডি সিনেমা দেখাই হলো না আর সেখানে ফোর ডি সিনেমা দেখার সুযোগ পেয়েও হারালাম। দেশে এসে থাই বলদদের মনে মনে গালাগাল দিলাম, তোরা থাই ভাষাকে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দিস ঠিক আছে। কিন্তু এমন মাধ্যম তো ব্যবহার করবি যাতে সবাই তথ্যটা পায়। আমি তখন যদি জানতাম 'রিপলিস বিলিভ ইট অর নট'এ ফোর ডি শো হয় তাহলে আমি নিশ্চয় শো দেখার সময় বের করে নিতাম।
ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী এবং আমাদের ব্যর্থ বিকাল

হীরা রত্ন জহরতের প্রতি আমার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। তারপরও সকলের সাথে আমিও আমাদের নির্দিষ্ট ট্যুর বাসে চড়ে বসলাম। আমাদের এই বাসটা ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীতে নিয়ে যাবে। এইটা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডায়মন্ড গ্যালারী। আমার আর আমার রুমমেট-এর পরিকল্পনা ছিল আমরা ট্যুর বাসে চেপে ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী পর্যন্ত যাবো। তারপর ঔখান থেকে নিজস্ব ব্যবস্থায় পাতায়া শহরের একদম শেষপ্রান্তে সমুদ্রের তীরঘেষে অবস্থিত স্যাঙচুরি অব ট্রুথ দেখতে যাবে। কাঠের তৈরি এই সুউচ্চ মন্দিরটি থাইশৈল্পিক স্থাপত্যের একক অনন্য সৃষ্টি। অন্তর্জাল থেকে পাওয়া তথ্য, স্যাঙচুরি অব ট্রুথে শিল্পের ছোয়ায় হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্ম, থাইল্যান্ড, চীন, কম্পোডিয়ার পুরাণকাহিনী, সেই সময়কার মানুষের দর্শণ তুলে ধরা হয়েছে।

(স্যাঙচুরি অব ট্রুথ, উৎস: অন্তর্জাল)
ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী থেকে দূরত্বটা কম হবে তাই সকলের আমরাও ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীতে হাজিরা দিই। ভেবেছিলাম বাস থেকে নেমেই দলছুট হবো। দলছুট হওয়া হলো না। বাস থেকে নামতেই কিছু বোঝার আগেই আমাদের ঠেলে ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীর ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। সবার গলায় একটা ভিজিটিং কার্ড ঝুলিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো অন্ধকার হলরুমে। সেখানে দশ মিনিটের একটা প্রামান্যচিত্র প্রদর্শিত হলো। ডায়মন্ড আহরণ থেকে শুরু করে তার বাজারজাতকরণের সমগ্র প্রক্রিয়া সুন্দরভাবে সেই প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। প্রামাণ্যচিত্র শেষ হবার সাথে সাথেই একজন চৌকস বিপনন কর্মী হাজির। সে আমাদের ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীর বিভিন্ন শিল্পকর্মের নিপুন বর্ণনা দিচ্ছে আর সেই সাথে দামটা উল্লেখ করতেও ভুল করছে না। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থীদের মধ্যে একজন দর্শনার্থীও যদি বিপননকর্মীর উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে কোন শিল্প কর্ম কেনে তাহলেই সারাদিনের ব্যবসা হয়ে যাবে। কারণ একেকটা শিল্পকর্মের দাম লাখ থেকে মিলিয়ন বাথ। সাধ্যের ভিতরেও কেনাকাটা করার ব্যবস্থাও আছে।

(রত্নসজ্জিত শিল্পের কারুকাজ)
ডায়মন্ডপ্রিয়দের জন্য এই গ্যালারীটা ভালো লাগবে আমার মতো নিরাসক্ত ব্যক্তির জন্য এইটা উপযুক্তস্থান নয়। তাই ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী থেকে বের হবার পথ খুঁজছি। কিন্তু ভিতরে এতো বেশি চোরাগলি যে ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী থেকে বের হবার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। অবশ্য প্রতিটি গলিতেই চমক আছে। এতো কাছে এতো মূল্যবান রত্নসম্ভার দেখার সুযোগ হলো। একদম কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো কিভাবে কর্মীরা ডায়মন্ড তৈরি। ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীর ভিতর থাইল্যান্ডের নিজস্ব তৈজসের একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে। কিন্তু দামটা একটু বেশি চড়া। ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীর ঠিক অপরপাশেই রুয়েন থাই ওটপ। থাইল্যান্ডের নিজস্ব পণ্যসম্ভারের অনেক বড় একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। কি নেই এখানে? আসবাবপত্র, কসমেটিক সামগ্রী, পোশাক-আশাক, চকলেট আরও বহুরকমের তৈজসপত্র। থাইল্যান্ড থেকে স্যুভেনিউর হিসেবে কেনা কাটা করার জন্য আমার মতে একটা আদর্শ দোকান। দামটাও তুলনামূলকভাবে কম।
(পাতায়া শহর)
ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীতে বের হয়ে এখানে ঘোরাঘুরি করে হাতের অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেললাম। কেনাকাটার নেশাকে রদ করে অবশেষে আমি আর আমার রুমমেট স্যাঙচুরি অব ট্রুথের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । আমাদের পরিকল্পনা ছিল ম্যাপ দেখে হাটতে হাটতে যাবো। সময় একটু বেশি লাগলেও শহরটা দেখতে দেখতে যাওয়া হবে। তাছাড়া ম্যাপ দেখে আন্দাজ করেছিলাম ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী থেকে আধাঘন্টা হাটলেই স্যাঙচুরি অব ট্রুথে পৌছে যাবো।

দেখা গেল আমাদের ধারণা ভুল। আধাঘন্টা হেটে আমরা মাত্র অর্ধেক পথ আসতে পেরেছি। রাস্তায় সব জায়গায় থাই ভাষায় লেখা। ঠিকপথে এগোচ্ছি কিনা মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু কারও কাছে যে জিজ্ঞেস করবো তার কোন উপায় নেই। কেউই থাইভাষা ছাড়া দ্বিতীয় কোন ভাষা জানে না। ম্যাপ দেখিয়ে অনেক কষ্টে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে বুঝে নিতে হচ্ছে আমরা ঠিক কোথায় আছি। আধাঘন্টা এভাবে হাটার পর সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে হবে না। দিনের আলো নিভে আসতে শুরু করেছে। স্যাঙচুরি অব ট্রুথে যেতে হলে এখনই আমাদের কোন যানবাহনে উঠতে হবে। অনেক কষ্টে এক জীপওয়ালাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম কোথায় আমরা যেতে চাচ্ছি কিন্তু সে আমাদের হতাশ করা তথ্য দিলো যে স্যাঙচুরি অব ট্রুথ ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন যাওয়া থেকে না যাওয়ায় ভালো। ব্যর্থ মনোরথের ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। তবে ফিরে আগেই আমরা অল্পসময়ের জন্য ওয়াট ফোটিস্যাম্পানে একবার ঢু মারার সুযোগ হলো। এটিও একটি কাঠের তৈরি বৌদ্ধমন্দির। এই পাতায়া শহরে এমন অসংখ্য মন্দির পাবেন। হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলে মন্দির এবং সেই সাথে থাই শিল্পের সাথেও পরিচিত হবার সুযোগ পাবেন।
বিগবুদ্ধ দর্শণ
আগামী সকালেই আমরা পাতায়া শহর ছেড়ে যাবো। এক পাতায়া শহরেই প্রচুর দর্শণীয় স্থান আছে যার অনেক কিছুই সময়ের অভাবে দেখা হয়নি। তাই আজকের রাতটা যতটুকু কাজে লাগনো যায়। ম্যাপ দেখে দ্রুত বের করলাম কোথায় যাওয়া যায়? গন্তব্য বিগ বুদ্ধ। পাতায়া শহরের সবচেয়ে উচুতে বিশাল বড় বৌদ্ধমন্দির। হোটেল থেকে স্থানীয় জিপ গাড়িতে চড়ে আমরা একটা ফ্লাইওভারের নিচে নেমে পড়লাম। বর্তমানে আমাদের দলের সদস্যসংখ্যা চার। এখন ম্যাপ দেখে পথ এগোনো। এর আগে কখনো এভাবে ম্যাপ দেখে পথ আবিস্কার অভিজ্ঞতা হয় নি। তাই বেশ একটা এ্যাডভেঞ্চার এ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছে। উচু পাহাড়ে আমরা চারজন আর কোথাও কেউ নেই। হুট করে দুএকজন স্থানীয় বাসিন্দা সামনে চলে আসছে। পাহাড়ী এই এলাকা পাতায়া থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম। নির্জন, আমার কাছে বেশ গুরগম্ভীরও মনে হলো। ক্যামন একটা গা ছমছমে ভাব আছে। হয়তো রাত এবং রাস্তার আধো আলো আধো অন্ধকারের জন্যই এমনটি মনে হচ্ছে। সবচেয়ে ঘাবড়ে গেলাম যখন একদল কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে আমাদের পথ রুদ্ধ করে দাড়ালো। আক্রোশে কুকুরগুলো গড়গড় করছে। পারলে এখনই কাঁচা খেয়ে ফেলে। কি বাবা! তোদের দেশে এসেছি বলে এই তোদের আতিথিয়তা। আমরা সামনে এগোবো কি এগোবো না বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পরে গেলাম। কুকুরগুলো যেভাবে পথ রোধ করে দাড়িয়ে আছে যে সামনে যাওয়া মুশকিল। আমাদের এই দূরাবস্থা দেখে অন্ধকার ফুরে এক স্থানীয় ভারতীয় লোক আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলো। সেই আমাদেরকে বিগবুদ্ধের মূর্তির কাছে নিয়ে গেল। এবং আবারও প্রমাণ হলো যত গর্জে তত বর্ষে না। কুকুরের ঘেউ ঘেউ আমরা সামনে যেতেই মিইয়ে গেল। বজ্জাতগুলো আস্তে করে রাস্তা ছেড়ে কু কু করছে।
বিগবুদ্ধে এসে আপসোস হচ্ছিল কেন দিনের আলো থাকতে থাকতে এখানে আসতে পারলাম না। দিনের উজ্জল আলোয় সোনালী রঙের বৌদ্ধমূর্তিগুলোর দ্যুতিময় আলোকচ্ছটা দেখা হলো না। পাতায়া শহরের একদম উচুতে বিগবুদ্ধ মুর্তি।

সম্পূর্ণ সোনালী রঙের সবচেয়ে মূর্তিটার উচ্চতা হবে আনুমানিক ২০ মিটার। স্থানীয় ভাষায় মুর্তিটার নামকরণ Khao Phra Ya)। এই Khao Phra Yai কে ঘিরেই ছোট বড় আরো সাতটা সোনালী বর্ণের বৌদ্ধ মুর্তি রয়েছে। সব ধর্মীয়স্থানের মতো এখানেও শান্তি শান্তি পরিবেশ। রাতের বেলা বলেই হয়তো মানুষের সমাগম নেই। আমরা যখন সেখানে গেলাম দেখি তিন থাইযুবতী প্রার্থণারত। বিগবুদ্ধের একদম শেষপ্রান্তে সাদাচামড়া একজোড়া যুবক-যুবতী অন্তরঙ্গভাবে বসে গিটারে টুংটাং করছে। আমাদের দেশে ধর্মীয় উপসানলয়ে সব সময় নিরবতা পালন করা হয়ে থাকে তাই বিগবুদ্ধ মন্দিরে গিটারে টুংটাং শব্দে একটু অবাকই হয়েছিলাম। ধর্মটা আসলে নিজের ভিতর। যে যেমনভাবে পারে পালন করে।

একদম শহরের মাথায় দাড়িয়ে এক পলকে রাতের লালনীল রঙিন বাতিতে উজ্জল পাতায়া শহরকে দেখার অনুভুতিটাও অন্যরকম। পায়ে হেটে পাহাড়ের মাথায় উঠতে যথেষ্ট ঘাম ছড়াতে হয়েছে। এখন এই উপরে আকাশের কাছাকাছি পৌছে সেই ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।
লেখকঃ আলোকিত পৃথিবী
ছোট বেলায় স্কুল ম্যাগাজিন আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম। কবিতার প্রথম লাইন দুইটি ছিল এমন 'আমি যদি হতাম পাখি, হতাম আমি নীল আকাশের সাথী।'
পাখি হবার আজন্ম সাধ কিছুটা হলে পূর্ণতা পেল এই পাতায়া শহরে। প্যারাগ্লিডিং এর কল্যাণে ক্ষণিকের জন্য পাখির মতো উড়ার দারুন অভিজ্ঞতা হলো। মাথার উপর নীল আকাশ, পায়ের নিচে নীল জল, মাঝখানে আমি কাধে প্যারাস্যুট কাধে ঝুলিয়ে শুন্যে হাওয়ায় ভাসছি। এ এক দারুন অভিজ্ঞতা।
ও প্যারাগ্লাইডিং ব্যাপারটা কী সেইটাও তো বলা হলো না। প্যারাগ্লাইডিং হলো স্টীমারের পিছনে প্যারাস্যুট বেঁধে অভিযাত্রীকে পাখির মতো উড়তে সাহায্য করা। পাতায়া থেকে কোরাল আইল্যান্ড যাবার পথে আমাদের গাইড প্যারাগ্লাইডিং এর জন্য মাঝ সমুদ্রে আমাদের নামিয়ে দিল। পাতায়া সৈকত থেকে স্টীমারে মিনিট পাঁচেক দূরে সমু্দ্রের মাঝে প্যারাগ্লাইডিংএর আয়োজন করা হয়েছে। প্যারাগ্লাইডিং জন প্রতি পাঁচশ বাথ। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৪০০ টাকা। প্রতিজন পাঁচ থেকে সাত মিনিটের জন্য প্যারাগ্লাইডিং-এ আকাশে উড়া সুযোগ পায়। এত অল্প সময়ের জন্য এমন আকাশ ছোয়া মূল্য! কিন্তু আকাশে উড়া বলে কথা, দলে দলে ছোট বড় সব বয়সী পর্যটকই প্যারাগ্লাইডিং-এর রোমাঞ্চ লুফে নিতে সারিবদ্ধ লাইনে দাড়িয়েছে।
প্যারাগ্লাইডিং থেকে অপেক্ষায় যেন রোমাঞ্চ বেশি। সেফ জ্যাকেট পরে প্রায় আধাঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে আছি। আর দেখছি, প্যারাগ্লাইডিং সম্পন্নদের উচ্ছ্বাস। প্যারাগ্লাইডিং করা একেকজনের চোখে মুখে যে আনন্দের হল্কা দেখা যায় তাতেই অপেক্ষমানদের রোমাঞ্চ বাড়িয়ে দেয়। নিঃসন্দেহে প্যারাগ্লাইডিং-এ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা, যা সচারচর পাওয়া যায় না।
দেখতে দেখতে আমার টার্নও এলো। আমার সেফ জ্যাকেটের সাথে প্যারাস্যুটা বিশেষ হুকের মাধ্যমে আটকে দেওয়া হলো, আমি হাত পা সবই যেমন খুশি তেমন নাড়াতে পারবো কিন্তু নিচে পড়ে যাবো না। পিঠে প্যারাস্যুট বাঁধা শেষে প্যারাস্যুটের সাথে বাঁধা স্টীমার যেই ছুটলো ওমনি আমি এক পলকে আকাশে। আহা কী আনন্দ! দুই হাত প্রসারিত করলাম। পাখিরা কেমনে হাওয়ায় ভাসে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম। আকাশে উঠে নিজেকে কেমন হালকা হালকা লাগছে। উপস্থিত সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে বেশ লাগছে। সারাটা দিন যদি এমনি আকাশে ভেসে থাকা যেন! সেটা তো সম্ভব না। তাই মনে মনে প্রার্থনা করলাম ইস যদি প্যারাস্যুটটা ছিড়ে যায়! তাহলে মাঝ সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া অভিজ্ঞতাও হয়ে যাবে। আমি জানি যথেষ্ট নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া আছে, তাই মাঝ সমুদ্রে পড়ে অন্তত ডুবে মরবো না এইটা নিশ্চিন্ত। অতএব প্যারাস্যুট ছিড়ে নিচে পড়ার প্রার্থনা করা যেতেই পারে। এখানে ব্যতিক্রম কিছু ঘটুক। কিন্তু প্রার্থনা কবুল হলো না আর সবার মতো নির্দিষ্ট সময় পর আমাকেও নিচে নামিয়ে দেওয়া হলো।
প্যারাগ্লাইডিং শেষ হলেও এর রেস অনেকক্ষণ রয়ে যায়। সবচেয়ে অবাক হলাম যখন দেখলাম আমার অজান্তেই ওরা আমার প্যারাগ্লাইডিং এর মুহুর্তটা ওরা ফ্রেমবন্দি করে রেখেছে। ফ্রেমেবাধা ছবিটা এতটাই লোভনীয় যে ওদের কাছ থেকে না কিনে পারা গেল না। সামান্য প্লাস্টিকের ফ্রেমে একটা ছবি, ১০০ বাথ। নো বার্গেনিং। প্রতি মিনিটেই একজন করে প্যারাগ্লাইডিং করছে। তাদেরকে সনাক্ত করে ঠিক তাদের কাছেই নির্দিষ্ট সময় পরে ছবি পৌছে প্রমাণ করলো থাইবাসী বিপনণটা ভালোই রপ্ত করেছে। প্যারাগ্লাইডিং-এর ঘন্টা চারেক পরে আমরা যখন কোরাল আইল্যান্ড ঘুরে পাতায়া সৈকতে নামলাম তখন দেখি একজন আমাদের দলের সবার ছবি নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
আমরা সবাই একের পর এক প্যারাগ্লাইডিং করেছি এমন নয়। দেখা গেছে আমি করেছি আমার পিছে অপরিচিত একজন সামনে অপরিচিত একজন। এর মাঝেই ঠিকই ওরা ঠিকই আমাকে আলাদা করে রেখেছে। তাই সবাই যখন নিজের প্যারাগ্লাইডিং এর আকর্ষণীয় ছবি ফ্রেমে বাঁধা অবস্থায় পেলাম। তখন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। ১০০ বাথ তো ব্যাপারই না। পাতায়া শহরে এমন অনেক কিছুই আছে, কেউ আপনাকে জোর করবে না কিন্তু এমনভাবে ওরা উপস্থাপন করবে যে আপনার পকেট থেকে বাথ এমনি এমনিই বের হয়ে যাবে। থাইবাসী টাকা কামানো ফন্দী ভালই রপ্ত করেছে।
মাসাআজ
রাত এগারটায় সিদ্ধান্ত নিলাম ফুট মাসাআজ করাতে হবে। সারাদিন এতোবেশি হাটাচলা করতে হয়েছে যে এখন শরীর মন বলছে, মাসআজ, মাসআজ। মাসআজ না করলে আমি বোধহয় আর হাটতে চলতে পারবো না! থাইল্যান্ডে এলাম আর মাসাআজ করালাম না তা হয় নাকি? তো কোথায় মাসাআজ করা যায়? পাতায়া শহরে আমরা উঠেছি ওয়েলকাম হোটেল-এ। এই হোটেল থেকে বের হতেই রাস্তার পাশে সারি সারি মাসাআজ পার্লার । সুদর্শন থাইনারীরা মাসাআজ পার্লারের সামনে বসে সুর করে মাসআআজ মাসআআজ গীত গেয়ে ভোক্তাদের আকর্ষণ করছে। সারাদিন মাসআআজ মাসআআজ শুনতে শুনতে এখন মাসাআজটা অস্তিমজ্জায় ঢুকে গেছে। তাই রাত এগারটায় হোটেল থেকে বের হলাম মাসাআজ করাতে।
পাতায়া আর ব্যাংকক থাইল্যান্ডের এই দুই শহরে আমাদের ঘোরার সুযোগ হয়েছে এবং শহর দুইটার সর্বত্রই মাসাআজ পার্লার চোখে পড়ে। বিশেষ করে পর্যটনবেষ্টিত হোটেলগুলোর পাশে এই মাসাআজ পার্লারের আধিক্য অনেক বেশি। থাই মাসাআজ, ফুট মাসাআজ, অয়েল মাসাআজ আরও হরেক রকমের মাসাআজ আর আছে রকমারী স্পা। থাইল্যান্ডের এই মাসাআজকে এরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
ব্যাংককের তুলনায় পাতায়ায় মাসাআজ খরচ তুলনামূলক কম। পাতায়ার পরিবেশনাটাও যথেষ্ট ভালো। প্রত্যেক মাসাআজ পার্লারের সবাই নির্দিষ্ট পোশাক পরা। পার্লারের ভিতরের রুমসজ্জাও দারুন। ব্যাংককের মাসাআজ পার্লারে যৌনতাকে প্রশ্রয় দেয়। পাতায়ার মাসাআজ পার্লার সেইদিক থেকে মুক্ত।
তো যাই হোক রাত এগারটায় পাতায়ার এক মাসাআজ পার্লারের দরজায় কড়া নাড়লাম। সুদর্শন এক থাই নারী অভ্যর্থনা জানালো। যখন হোটেল রুম থেকে বের হয়েছিলাম তখন চিন্তা ছিল ফুট মাসাআজ করাবো। সারাদিন হাটতে হাটতে পা দু'টা বড্ড ক্লান্ত। পা দু'টার একটু আরাম দরকার। আগে যেহেতু এখানে আসা হয় নি তাই কেমন কী খরচ তার একটা ধারণা নিলাম। যখন শুনলাম ফুট মাসাআজ ২০০ বাথ, থাই মাসাআজও ২০০ বাথ; তখন দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই থাই মাসাআজ নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। থাই মাসাআজ মানে সারা শরীর মাসাআজ। একই খরচে কেন শুধু পা মাসাআজ করাবো?
থাই মাসাআজের জন্য আমাকে তিনতলার একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ঘরটায় নীল রঙের পর্দা দিয়ে ঢাকা। আমাকে মাসাআজ করানোর জন্য যেই মেয়েটি আমার সামনে দাড়িয়ে আছে তার পরনেই নীল রঙের পোশাক। আমাকে মাসাআজ-এর বিশেষ পোশাক দেওয়া হলো। অদ্ভুত পোশাক। অনেকটা ত্রিকোয়াটার প্যান্টের মতোন। প্যান্টের কোমরের সাইজ হবে পঞ্চাশ। পোশাকটা কোমরে বাঁধার মতো ফিতাও নেই। এইটা কিভাবে পড়বো। আমি পোশাকটা হাতে নিয়ে বোকার মতো দাড়িয়ে আছি। মেয়েটা থাই ভাষায় অনর্গল কি সব বলছে। ওরা যেমন বাংলা-ইংরেজী জানে না, আমি তেমন থাই ভাষাও জানি না। নিজেকে বড় অসহায় লাগছে। ওর কথা, আকার-ইঙ্গিতে যেটা বুঝলাম ও বলছে আমার পরনের পোশাক সব খুলে এই মাসাআজ পোশাক পড়তে। শার্টটা না হয় খুললাম। প্যান্টটা কিভাবে খুলি যদি সামনে ষোল-সতেরও বছরের একটা মেয়ে দাড়িয়ে থাকি। আমি বাংলা-ইংরেজী মিশিয়ে যথাসাধ্য বোঝানোর চেষ্টা করছি, জানার কোন চেঞ্জ রুম আছে কিনা। ও কি বুঝছে সেই জানে, আমার সামনে দাড়িয়ে হি হি করে হাসছে। মিনিট পাঁচেক এমন ভাষা জটিলতায় যাওয়ার পর অবশেষে মনে হলো, মেয়েটি আমার অবস্থা বুঝতে পারলো। আমাকে রুমে একা রেখে চলে গেল। এই তো সুযোগ, অদ্ভুত পোশাকটা কোন রকমে আওত্তে নিয়ে মেয়েটির অপেক্ষায়..।
তার মিনিট পাঁচেক পরে নীল রঙের ষোড়শী মেয়েটি ফিরে এলো। আমাকে শুইয়ে আমার পায়ের আঙুলগুলো হাতে নিয়ে আলতো করে টান দিতে লাগলো। তারপর ধীরে ধীরে মেয়েটির নরম হাত পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিচরণ করতে থাকে। আর পরম আয়েশে আমার শরীর ঢুবতে থাকে।...... তারপর.... তারপর....
মাসাআজ-এর বিস্তারিত বর্ণনা আমি দেবো না। আগ্রহীরা থাইল্যান্ড-এ যখন যাবেন তখন থাই মাসাআজ যে নিবেন এটা আর বলার দরকার নেই। থাই মাসাআজ সম্পর্কে শুধু এটুকুই বলে রাখি, একঘন্টার থাই মাসাআজ আপনার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দেবে।
রিপলিস বিলিভ ইট অর নট
ছোট বেলায় টিভিতে রিপলিস বিলিভ অর নট এর প্রোগ্রাম দেখতাম আর অবাক হতাম সত্যি এমন হয় কি? কে জানতো আমাদের ওয়েলকাম প্লাজা হোটেল-এর পাশেই সেই বিখ্যাত রিপলিস বিলিভ ইট অর নট এর জাদুঘর। সকালে নাস্তা শেষে জাদুঘরের সামনে ঘুর ঘুর করছি। আর একটা ছবি তোলা যায় কিনা ভাবছি। ছবি তুলতে পারলে দেশে ফিরে বন্ধুদের কাছে বুক ফুলিয়ে বলা যাবে, এই দেখ রিপলিস বিলিভ ইট অর নট। জাদুঘরের সামনে দেখলাম একজন সুদর্শণ থাই নারী দাড়িয়ে আছে। পোশাক-আশাকেই বোঝা যাচ্ছে এই জাদুঘরের কর্মী। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এইখানে ছবি তোলা যাবে কিনা? সে আমার ইংরেজী কী বুঝলো সেই জানে, মিষ্টি হেসে আমাকে একটা ব্রশিয়ুর ধরিয়ে দিল। সেখানে থাই ভাষায় হিজি বিজি লেখা। কিছুই বুঝবার উপায় কী বলতে চাচ্ছে। শুধু এক যায়গায় বুঝতে পারলাম 'রিপলিস বিলিভ ইট অর নট'এর ছবির পাশে লেখা ৩৫০ বাথ। আর পাশে কয়েকটা সময় উল্লেখ করা। ভাবলাম হয়তো জাদুঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে ৩৫০ বাথ লাগবে। কিছুক্ষণের ভিতরেই যেহেতু আমাদের আগে থেকে নির্দিষ্ট স্পট ভ্রমণে বের হয়ে যাবো, সেহেতু এত অল্প সময়ের জন্য ৩৫০ বাথ খরচ করা বোকামীই হবে। আমি আমার মতো ফটাফট ছবি তুলে 'রিপলিস বিলিভ ইট অর নট' জাদুঘরের সামনে থেকে প্রস্থান করলাম। পরে দেশে আসার পর অফিসের এক সহকর্মীর মাধ্যমে জানতে পারলাম 'রিপলিস বিলিভ ইট অর নট'-এ ফোর ডি সিনেমা শো হয়। তখন একটু বুঝতেও বাকি রইল না যে জাদুঘরের সামনে মেয়েটি আমাকে যে ব্রশিয়ুর ধরিয়ে দিয়েছিল ওইটা ছিল আসলে ফোর ডি সিনেমা শো-এর সময়সূচি। এই জীবনে থ্রিডি সিনেমা দেখাই হলো না আর সেখানে ফোর ডি সিনেমা দেখার সুযোগ পেয়েও হারালাম। দেশে এসে থাই বলদদের মনে মনে গালাগাল দিলাম, তোরা থাই ভাষাকে সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দিস ঠিক আছে। কিন্তু এমন মাধ্যম তো ব্যবহার করবি যাতে সবাই তথ্যটা পায়। আমি তখন যদি জানতাম 'রিপলিস বিলিভ ইট অর নট'এ ফোর ডি শো হয় তাহলে আমি নিশ্চয় শো দেখার সময় বের করে নিতাম।
ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী এবং আমাদের ব্যর্থ বিকাল

হীরা রত্ন জহরতের প্রতি আমার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। তারপরও সকলের সাথে আমিও আমাদের নির্দিষ্ট ট্যুর বাসে চড়ে বসলাম। আমাদের এই বাসটা ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীতে নিয়ে যাবে। এইটা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডায়মন্ড গ্যালারী। আমার আর আমার রুমমেট-এর পরিকল্পনা ছিল আমরা ট্যুর বাসে চেপে ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী পর্যন্ত যাবো। তারপর ঔখান থেকে নিজস্ব ব্যবস্থায় পাতায়া শহরের একদম শেষপ্রান্তে সমুদ্রের তীরঘেষে অবস্থিত স্যাঙচুরি অব ট্রুথ দেখতে যাবে। কাঠের তৈরি এই সুউচ্চ মন্দিরটি থাইশৈল্পিক স্থাপত্যের একক অনন্য সৃষ্টি। অন্তর্জাল থেকে পাওয়া তথ্য, স্যাঙচুরি অব ট্রুথে শিল্পের ছোয়ায় হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্ম, থাইল্যান্ড, চীন, কম্পোডিয়ার পুরাণকাহিনী, সেই সময়কার মানুষের দর্শণ তুলে ধরা হয়েছে।

(স্যাঙচুরি অব ট্রুথ, উৎস: অন্তর্জাল)
ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী থেকে দূরত্বটা কম হবে তাই সকলের আমরাও ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীতে হাজিরা দিই। ভেবেছিলাম বাস থেকে নেমেই দলছুট হবো। দলছুট হওয়া হলো না। বাস থেকে নামতেই কিছু বোঝার আগেই আমাদের ঠেলে ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীর ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। সবার গলায় একটা ভিজিটিং কার্ড ঝুলিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো অন্ধকার হলরুমে। সেখানে দশ মিনিটের একটা প্রামান্যচিত্র প্রদর্শিত হলো। ডায়মন্ড আহরণ থেকে শুরু করে তার বাজারজাতকরণের সমগ্র প্রক্রিয়া সুন্দরভাবে সেই প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। প্রামাণ্যচিত্র শেষ হবার সাথে সাথেই একজন চৌকস বিপনন কর্মী হাজির। সে আমাদের ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীর বিভিন্ন শিল্পকর্মের নিপুন বর্ণনা দিচ্ছে আর সেই সাথে দামটা উল্লেখ করতেও ভুল করছে না। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থীদের মধ্যে একজন দর্শনার্থীও যদি বিপননকর্মীর উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে কোন শিল্প কর্ম কেনে তাহলেই সারাদিনের ব্যবসা হয়ে যাবে। কারণ একেকটা শিল্পকর্মের দাম লাখ থেকে মিলিয়ন বাথ। সাধ্যের ভিতরেও কেনাকাটা করার ব্যবস্থাও আছে।

(রত্নসজ্জিত শিল্পের কারুকাজ)
ডায়মন্ডপ্রিয়দের জন্য এই গ্যালারীটা ভালো লাগবে আমার মতো নিরাসক্ত ব্যক্তির জন্য এইটা উপযুক্তস্থান নয়। তাই ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী থেকে বের হবার পথ খুঁজছি। কিন্তু ভিতরে এতো বেশি চোরাগলি যে ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী থেকে বের হবার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। অবশ্য প্রতিটি গলিতেই চমক আছে। এতো কাছে এতো মূল্যবান রত্নসম্ভার দেখার সুযোগ হলো। একদম কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো কিভাবে কর্মীরা ডায়মন্ড তৈরি। ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীর ভিতর থাইল্যান্ডের নিজস্ব তৈজসের একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে। কিন্তু দামটা একটু বেশি চড়া। ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীর ঠিক অপরপাশেই রুয়েন থাই ওটপ। থাইল্যান্ডের নিজস্ব পণ্যসম্ভারের অনেক বড় একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। কি নেই এখানে? আসবাবপত্র, কসমেটিক সামগ্রী, পোশাক-আশাক, চকলেট আরও বহুরকমের তৈজসপত্র। থাইল্যান্ড থেকে স্যুভেনিউর হিসেবে কেনা কাটা করার জন্য আমার মতে একটা আদর্শ দোকান। দামটাও তুলনামূলকভাবে কম।

(পাতায়া শহর)
ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীতে বের হয়ে এখানে ঘোরাঘুরি করে হাতের অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেললাম। কেনাকাটার নেশাকে রদ করে অবশেষে আমি আর আমার রুমমেট স্যাঙচুরি অব ট্রুথের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । আমাদের পরিকল্পনা ছিল ম্যাপ দেখে হাটতে হাটতে যাবো। সময় একটু বেশি লাগলেও শহরটা দেখতে দেখতে যাওয়া হবে। তাছাড়া ম্যাপ দেখে আন্দাজ করেছিলাম ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী থেকে আধাঘন্টা হাটলেই স্যাঙচুরি অব ট্রুথে পৌছে যাবো।

দেখা গেল আমাদের ধারণা ভুল। আধাঘন্টা হেটে আমরা মাত্র অর্ধেক পথ আসতে পেরেছি। রাস্তায় সব জায়গায় থাই ভাষায় লেখা। ঠিকপথে এগোচ্ছি কিনা মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু কারও কাছে যে জিজ্ঞেস করবো তার কোন উপায় নেই। কেউই থাইভাষা ছাড়া দ্বিতীয় কোন ভাষা জানে না। ম্যাপ দেখিয়ে অনেক কষ্টে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে বুঝে নিতে হচ্ছে আমরা ঠিক কোথায় আছি। আধাঘন্টা এভাবে হাটার পর সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে হবে না। দিনের আলো নিভে আসতে শুরু করেছে। স্যাঙচুরি অব ট্রুথে যেতে হলে এখনই আমাদের কোন যানবাহনে উঠতে হবে। অনেক কষ্টে এক জীপওয়ালাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম কোথায় আমরা যেতে চাচ্ছি কিন্তু সে আমাদের হতাশ করা তথ্য দিলো যে স্যাঙচুরি অব ট্রুথ ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন যাওয়া থেকে না যাওয়ায় ভালো। ব্যর্থ মনোরথের ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। তবে ফিরে আগেই আমরা অল্পসময়ের জন্য ওয়াট ফোটিস্যাম্পানে একবার ঢু মারার সুযোগ হলো। এটিও একটি কাঠের তৈরি বৌদ্ধমন্দির। এই পাতায়া শহরে এমন অসংখ্য মন্দির পাবেন। হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলে মন্দির এবং সেই সাথে থাই শিল্পের সাথেও পরিচিত হবার সুযোগ পাবেন।
বিগবুদ্ধ দর্শণ
আগামী সকালেই আমরা পাতায়া শহর ছেড়ে যাবো। এক পাতায়া শহরেই প্রচুর দর্শণীয় স্থান আছে যার অনেক কিছুই সময়ের অভাবে দেখা হয়নি। তাই আজকের রাতটা যতটুকু কাজে লাগনো যায়। ম্যাপ দেখে দ্রুত বের করলাম কোথায় যাওয়া যায়? গন্তব্য বিগ বুদ্ধ। পাতায়া শহরের সবচেয়ে উচুতে বিশাল বড় বৌদ্ধমন্দির। হোটেল থেকে স্থানীয় জিপ গাড়িতে চড়ে আমরা একটা ফ্লাইওভারের নিচে নেমে পড়লাম। বর্তমানে আমাদের দলের সদস্যসংখ্যা চার। এখন ম্যাপ দেখে পথ এগোনো। এর আগে কখনো এভাবে ম্যাপ দেখে পথ আবিস্কার অভিজ্ঞতা হয় নি। তাই বেশ একটা এ্যাডভেঞ্চার এ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছে। উচু পাহাড়ে আমরা চারজন আর কোথাও কেউ নেই। হুট করে দুএকজন স্থানীয় বাসিন্দা সামনে চলে আসছে। পাহাড়ী এই এলাকা পাতায়া থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম। নির্জন, আমার কাছে বেশ গুরগম্ভীরও মনে হলো। ক্যামন একটা গা ছমছমে ভাব আছে। হয়তো রাত এবং রাস্তার আধো আলো আধো অন্ধকারের জন্যই এমনটি মনে হচ্ছে। সবচেয়ে ঘাবড়ে গেলাম যখন একদল কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে আমাদের পথ রুদ্ধ করে দাড়ালো। আক্রোশে কুকুরগুলো গড়গড় করছে। পারলে এখনই কাঁচা খেয়ে ফেলে। কি বাবা! তোদের দেশে এসেছি বলে এই তোদের আতিথিয়তা। আমরা সামনে এগোবো কি এগোবো না বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পরে গেলাম। কুকুরগুলো যেভাবে পথ রোধ করে দাড়িয়ে আছে যে সামনে যাওয়া মুশকিল। আমাদের এই দূরাবস্থা দেখে অন্ধকার ফুরে এক স্থানীয় ভারতীয় লোক আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলো। সেই আমাদেরকে বিগবুদ্ধের মূর্তির কাছে নিয়ে গেল। এবং আবারও প্রমাণ হলো যত গর্জে তত বর্ষে না। কুকুরের ঘেউ ঘেউ আমরা সামনে যেতেই মিইয়ে গেল। বজ্জাতগুলো আস্তে করে রাস্তা ছেড়ে কু কু করছে।
বিগবুদ্ধে এসে আপসোস হচ্ছিল কেন দিনের আলো থাকতে থাকতে এখানে আসতে পারলাম না। দিনের উজ্জল আলোয় সোনালী রঙের বৌদ্ধমূর্তিগুলোর দ্যুতিময় আলোকচ্ছটা দেখা হলো না। পাতায়া শহরের একদম উচুতে বিগবুদ্ধ মুর্তি।

সম্পূর্ণ সোনালী রঙের সবচেয়ে মূর্তিটার উচ্চতা হবে আনুমানিক ২০ মিটার। স্থানীয় ভাষায় মুর্তিটার নামকরণ Khao Phra Ya)। এই Khao Phra Yai কে ঘিরেই ছোট বড় আরো সাতটা সোনালী বর্ণের বৌদ্ধ মুর্তি রয়েছে। সব ধর্মীয়স্থানের মতো এখানেও শান্তি শান্তি পরিবেশ। রাতের বেলা বলেই হয়তো মানুষের সমাগম নেই। আমরা যখন সেখানে গেলাম দেখি তিন থাইযুবতী প্রার্থণারত। বিগবুদ্ধের একদম শেষপ্রান্তে সাদাচামড়া একজোড়া যুবক-যুবতী অন্তরঙ্গভাবে বসে গিটারে টুংটাং করছে। আমাদের দেশে ধর্মীয় উপসানলয়ে সব সময় নিরবতা পালন করা হয়ে থাকে তাই বিগবুদ্ধ মন্দিরে গিটারে টুংটাং শব্দে একটু অবাকই হয়েছিলাম। ধর্মটা আসলে নিজের ভিতর। যে যেমনভাবে পারে পালন করে।

একদম শহরের মাথায় দাড়িয়ে এক পলকে রাতের লালনীল রঙিন বাতিতে উজ্জল পাতায়া শহরকে দেখার অনুভুতিটাও অন্যরকম। পায়ে হেটে পাহাড়ের মাথায় উঠতে যথেষ্ট ঘাম ছড়াতে হয়েছে। এখন এই উপরে আকাশের কাছাকাছি পৌছে সেই ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।
লেখকঃ আলোকিত পৃথিবী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন