সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০১৪

আমার কুয়েত ভ্রমন

হাজার বছর ধরে ভাবছি নিজের ভ্রমন কাহিনীগুলো নিয়ে কিছু লেখব। ধীরে ধীরে স্মৃতিগুলোও ধুসর হয়ে আসছে। কারন সে প্রায় ১৬-১৭ বছর আগেকার কথা। লেখি লেখি করেও আর লেখা হয়নি। তো আজ ভাবলাম - লেখা শুরু করি, দেখি কতদূর যাওয়া যায়। লেখার ও ছবির মান দুটোই নিম্নমানের হবে। ছবির মান খারাপ কারন যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমার কাছে কোন উন্নত ক্যামেরা ছিলনা। আর লেখার মান খারাপ, কারন এখনও আমার মাঝে উন্নত মানের লেখনীশক্তি তৈরী হয়নি। লেখনীশক্তি তৈরি হওয়ার অপেক্ষায় আছি।



'৯৬ সালের প্রথমকার কথা। এসএসসি পরীক্ষা সামনে। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের ব্যাচেই প্রথম বই বদলে দেয়া হয়। সবাই চিন্তিত। আগের বছরের সাজেশন বলে কিছু আর নাই - আগের বই আর এবারের বইয়ে তো কোন মিল নাই, তো পুরানো সাজেশন দিয়ে হবেটা কি! সবার মাথায় হাত। আমার মাথায় হাতের সাথে সাথে পা! কারন পড়াশোনায় আমি বরাবরই ইসমার্ট। পড়ার কথা শুনলেই ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। এই কাজ, ঐ কাজ - নাই কাজ তো খই ভাজ - কত ব্যস্ততা আমার! পড়ার টেবিলে বসে বসে সারাদিন শুধু ক্রিকেটের দল ঠিক করতাম। কাকে আগে ব্যাটিং-এ নামাবো, কে হবে ওপেনিং বোলার, আরো কত কি! আমি আবার জোর করে দলের ক্যাপ্টেন হইতাম তো
পরীক্ষার আগে আগে যা হয় সবসময়, আমার আব্বুর মনে হলো, আমাকে শক্তহাতে "টাইট" দেয়া দরকার। আমার ধারনা এর পেছনে আম্মুর উসকানি আছে। তো আব্বু দেখি খালি আমার পড়াশোনার খবর রাখে, কোচিং কেমন চলছে, কোন স্যার কেমন, আর কোন বই লাগবে কি না - দিনে দুইবার করে এই জেরা শুরু হলো। আমি সামনের এসএসসি পরীক্ষার কথা ভেবে প্রমাদ গুনলাম। তখন তো সবে জেরা করা হচ্ছিল, যদি রেজাল্ট খারাপ হয় তাহলে আমাকে যে রিমান্ডে নেয়া হবে - সেটা বুঝতে আর বাকী থাকল না
রিমান্ডের ভয়ে হোক আর নিজের ভবিষ্যৎের কথা ভেবেই কিনা জানি না, আমি পড়াশোনা করতে করতে ঝড় তুলে ফেলি। মনে হচ্ছিল পড়তে পড়তে সব উড়ায়ে ফেলব। রাস্তা দিয়ে কেউ হেটে গেল, ওকেও ধরে এনে পড়াটা ঝালাই করব - বুঝতেই পারছেন অবস্থা। তো এই রকম মারকাট পড়াশোনার মাঝে হঠাৎ জানতে পারলাম - আমার আব্বুর বিদেশ গমনের খবর। আসলে উনার বিদেশে যাবার কথা আরো আগেই। কিন্তু এটা তো বাংলাদেশ, এখানে তো কোথাওই সিরিয়াল মানা হয় না - সবার আগে সুযোগ পায় তারা, যারা কানেক্টেড। আব্বুর যেহেতু তেমন কোন কানেকশন নাই, তাই তাকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। পরে জেনেছি - প্রতি বছরই সিলেক্শন কমিটিতে তার নাম আসছিল, কিন্তু কোন এক অদ্ভূত কারনে তাকে কোনবারই সিলেক্ট করা হচ্ছিল না। আব্বু বয়স ও পদবী দুক্ষেত্রেই জৈষ্ঠ্য হবার পরও তাকে বাদ দেয়া হচ্ছিল।
সেবছর কমিটিতে উনার নাম ডাকা হয় এবং তাকে দলে নেয়া হয়, হয়ত তারা ভেবেছিলেন "এই লোক কে অনেক বছর আটকানো হয়েছে, এবার তাকে ছাড়ি"। যাই হোক উনি বিদেশ যাচ্ছেন ১মাসের মাঝেই। অনেকে হয়ত ভাবছেন উনার এই বিদেশ যাবার খবরে আমি খুশিতে লাফ দিয়ে ছাদে টক্কর খেয়ে মাথা ফুলিয়েছে - কিন্তু না আমি ঠিক খুশি হইনি। মানে আমি আব্বুর জন্য খুশি ছিলাম, কিন্তু কিছুটা ভয়ও কাজ করছিল - কিভাবে আমরা, ছোট ভাই, আম্মাকে নিয়ে চলব। আব্বু যাচ্ছেন কুয়েত। খুব তাড়াহুড়া করে সব কিছু তৈরি করা হলো, ভিসা, মেডিকেল, তার অনূপস্থিতে ব্যাংকের কাগজপত্র - হাবিজাবি সব কিছু। তারপর তার যাবার দিন চলে এল। এয়্যারপোর্টে গেলাম সবাই। আব্বু সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন, আমার কাছে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন - কিন্তু কিছু বলেননা। তারপর হুট করে ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে হনহন করে ইমিগ্রেশনের দিকে হাটা দিলেন। বিমান বাংলাদেশের একটি প্লেন তাকে নিয়ে কুয়েতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল। উনি চলে যাওয়ার পরপরই মনে হলো, কারো হাত মাথার উপর থেকে সরে গেছে। নিজেকে অনেক একা লাগছিল
তখনও অবশ্য জানিনা কিছুদিনের মধ্যেই আমাকেও প্লেনে চড়ে বসতে হবে।
 ...সে প্রায় ১৬-১৭ বছর আগেকার কথা। লেখি লেখি করেও আর লেখা হয়নি। তো আজ ভাবলাম - লেখা শুরু করি, দেখি কতদূর যাওয়া যায়...

বাবা হুট করে কুয়েত চলে গেলেন। ২ বছরের কন্ট্রাক্ট কাজ। সেখানে কুয়েত প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাথে কাজ করবেন। একা একা ছোট একটি ফ্লাট নিয়ে থাকেন। আর প্রতিদিন একবার ফোন দেন। তখন তো আর স্কাইপ, ভাইবার - ছিল না। ফোন কার্ড কিনে কিনে কথা বলতেন। নতুন দেশ, নতুন মানুষজন, নতুন চাকুরী - তারপর দেশটা হলো মরুভূমি, যেদিকে উনি তাকান বালু আর পাথরের রাজ্য।

এদিকে আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। খুব একটা খারাপ হয়নি, বায়োলজি নিয়ে যদিও ভয় ছিল, আমি আবার ভালো বায়োলজি বুঝতাম তো তাই! তো পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই বাবা একদিন বললেন "আমি তোমার মামার সাথে কথা বলেছি, টিকেট পাঠাচ্ছি কিছুদিনের মধ্যে"। পাসপোর্ট করানো ছিল সবার। কিছুদিন পর ভিসাও হয়ে গেল। দেখতে দেখতে একদিন বিমানে উঠার দিন চলে এল।

যেদিন ফ্লাইট তার আগের রাতে, সবাই চলে এলাম নানুবাড়ী। রাতে সব খালাতো ভাইবোনরা মিলে গল্প আর আড্ডা। সবাই দেখলাম আমার থেকেও উত্তেজিত - যেন আমার লটারী লেগে গেছে। আমিও একসময় খুব উত্তেজিত ছিলাম, কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত ;) যাই হোক প্রায় ভোর ৪টার দিকে ২/৩ টা গাড়ীতে করে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিলাম। দেশী সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্য আমরা ছিলাম যাত্রী ৩ জন, কিন্তু বিদায় দিতে এসেছে ১১-১২ জন :P

এয়ারপোর্টের বাইরে অনেক মানুষের ভিড়, ভেতরে দেখি মানুষের সংখ্যা অনেক কম। কারন সবাই আমাদের মতো - যাত্রী কম, শুভাকাংখী বেশী। এটাই তো হবার কথা। যাই হোক ইমিগ্রেশন শেষে, মামা বললেন "চলো আমার একজন বন্ধু এখানে কাজ করেন, ওর সাথে দেখা করে আসি"। গেলাম ঐ বন্ধুর সাথে দেখা করতে। কুশল বিনিময়ের পর উনি বললেন "সকালে তো নাস্তা করা হয়নি তোমাদের?", আমি মাথা নাড়লাম। এরপর উনি আমাদের নিয়ে গেলেন এয়ারপোর্টের দুইতলায় - লাউন্জে। সেখানে গিয়ে দেখি বিশাল ব্যাপার। টেবিল পর টেবিল খাওয়া-দাওয়ায় সাজানো। ফল-মূল, পাউরুটি, জেলী, মাখন, চা, কফি - কি ছিল না সেখানে। আমাদের বলা একদিক থেকে শুরু করতে - কিন্তু আমি আর আমার ভাই কিছুই খাইনি। কারন প্রথমত আমরা বাংগালীরা অনেক মুখচোরা। দ্বিতীয়ত দেশের বাইরে যাচ্ছিলাম, কিছুটা নার্ভাস ছিলাম, ক্ষুধা-টুধা সব গায়েব হয়ে গেছে। কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করে নিচে চলে এলাম।

সময় মতো গেট খুলে দেয়া হলে, আমরা প্লেনের উদ্দেশ্যে হাটা দিলাম। আমি কিছুটা মনক্ষুন্ন ছিলাম - আমার ইচ্ছা ছিল পুরানো দিনের মতো খোলা আকাশের নিচ দিয়ে হেটে হেটে প্লেন গিয়ে উঠব - কিন্তু এখন তো আর তেমনটি নেই। আমাদের একটি টানেলের মধ্যে দিয়ে হাটিয়ে নেয়া হলো।

ভেতরে খুব ছিমছাম। সমস্ত প্লেন জুড়ে "বিদেশ-বিদেশ গন্ধ" (যখন কেউ বিদেশ থেকে আসে, তখন তাদের লাগেজ খুললে একটা সুন্দর গন্ধ পাওয়া যায় - আমি এটা নাম দিয়েছি "বিদেশ-বিদেশ গন্ধ" :D ) । প্লেনের ভেতর এসি চলছিল পুরোদমে। আমাদের টিকেট ইকোনমি ক্লাসের। কিন্তু এরপরও বসতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। আর সিটগুলো ছিল একদম সামনের দিকে - তো পা রাখারও কোন সমস্যা ছিল না। প্লেন ছাড়ার আরো ৩০ মিনিট বাকী, কিন্তু সাবধানের মার নাই তাই আমি সিটবেল্ট বেধেই বসে পড়লাম :P

প্লেন ছাড়ার ১৫-২০ মিনিট আগে দেখি মামার সেই বন্ধু এসে উপস্থিত! ঘটনা কি? উনিও কি আমাদের সাথে কুয়েত যাবেন নাকি :P ! উনি এসে সব ঠিকঠাক আছে নাকি জানতে চাইলেন, তারপর বললেন "সামনে অনেকগুলো সিটে খালি আছে, আপনারা সামনে এসে বসেন"। আমরা ৩ জন সামনে গিয়ে বসলাম। গিয়ে দেখি আরেক এলাহী কারবার - বিজনেস ক্লাসে আপগ্রড করায়ে দিয়েছেন। বিশাল চেয়ার, রীতিমত পা উঠায়ে বসা যাবে। বিজনেস ক্লাস বলতে গেলে পুরোটাই ফাকা। সিট ছিল ১৮-২০ টা, আমরা মানুষ বড়জোড় ৬-৭ জন। আমার ছোট ভাইতো উঠে গিয়ে জানালার পাশে বসল। ৫ মিনিট পর দেখি উঠে গিয়ে অপর পাশের জানালায় বসে - বুঝলাম সে এই কাজ পুরো রাস্তাতেই করবে।

একটু পর পাইলটের কন্ঠ শুনলাম। শুনে মনে হলো, যেন কুয়েত চলে আসছি অলরেডী :D । তার প্রায় ১০ মিনিট প্লেন নড়া শুরু করল। কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে যাচ্ছিলাম বসে থাকতে থাকতে। এয়ার হোস্টেসরা খালি একবার এদিকে যায়, আবার ওদিকে যায়। তারপর রানওয়েতে গিয়েও আবার অপেক্ষা। ঠায় দাড়িয়ে আছে প্লেন - নড়েও না আর চড়বেতো নাইই! বোর হতে হতে শেষ হব হব - তখন দেখি প্লেন চলা শুরু করল। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম - খুব খুব আস্তে আস্তে দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। মনে হচ্ছে রিকশায় উঠেছি :P


তারপর প্লেনের গতি আরো একটু বেড়ে গেল, আমি ভাবলাম ব্যাপার না, যেন জীবনে আরো কতবার প্লেন চড়েছি :D শয়তান ছোট ভাইয়ের জন্য ঠিক মতো জানালা দিয়ে কিছু দেখতেও পারছিলাম না, সামনের দিকে হেলে হেলে দেখতে হচ্ছিল। হঠাৎ করে প্লেনের গতি পুরোপুরি বেড়ে গেল - আমি ঝপাৎ করে চেয়ারে মাঝে ঢুকে গেলাম। চেষ্টা করেও সামনের দিকে আসতে পারছিলাম না। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি দুনিয়া ছোট হয়ে আসছে। যেন লেগো দিয়ে বানানো খেলাঘর।
প্লেন তখন রানওয়ে দিয়ে ছোটা শেষে মেঘ চিড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে যা দেখলাম তাতে মনে হলো সমস্ত ঢাকা শহরটাই যেন বন্যায় ডুবে আছে, যদিও তখন বর্ষাকাল ছিল না। চেনা ঢাকা শহরটাকে ওপর থেকে এতটাই অচেনা মনে হয়, কি আর বলব! যেন এই প্রথম শহরটাকে দেখছি। ছোট ছোট বাড়িঘর, রাস্তা - কে বলবে জীবনের সব ক'টি বছর ঐসব রাস্তা দিয়ে চলাচল করেই কেটেছে। দেখে মনে হয় মাইলের পর মাইল শুধু ধানক্ষেত আর মাঠ, আমাদের দেশে জায়গা নিয়ে এতটা সমস্যা - উপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের সব নাগরিকরাই যেন ১০ বিঘা জমির মালিক!

যারাই প্লেনে চড়েছেন তারা জানেন (যারা চড়বেন তারা ভবিষ্যৎে জানবেন) - বিমান ভ্রমন ভয়ংকর রকম সাদামাটা একটা ভ্রমন। বাস, ট্রেন, স্টীমার - সবখানেই মুক্ত বাতাস আর চলাচলের জায়গা থাকে। কিন্তু বিমানের ভেতর একেবারেই উল্টো। সিটগুলো ছোট ছোট, বেশি লম্বা হলে হাটু সামনের সিটের সাথে বারবার ধাক্কা খাবে, পাশের লোক ঘাড় ত্যাড়া হলে আপনার হ্যান্ডরেস্ট দখল করে নিবে, পিছনে কোন ত্যাদড় বসলে একটু পরপর পিছন থেকে আপনার সিটে লাথি মারতেই থাকবে - এসব কিছু ঘটতে থাকবে আর আপনি বসে থাকবেন একটি পুরোপরি বন্ধ, সীল্ড একটি ধাতব যানের মাঝে - এবং আপনি যদি সৌভাগ্যবান হন, তাহলে এইসব অত্যাচার সহ্য করতে হবে কয়েক ঘন্টার জন্য - আর যদি কপাল খারাপ থাকে, তাহলে হয়ত ১৫-২০ ঘন্টা!

আমরা যাচ্ছিলাম কুয়েতের উদ্দেশ্য, তো যাত্রাকালে লাগবে ৫-৬ ঘন্টার মতো। খারাপ না, তার উপর এক মামার বদৌলতে বিজনেস ক্লাসে বসে আরামেই যাচ্ছি। সত্যিকার অর্থে সেটি ছিল আমার প্রথম বিমান ভ্রমন, তাই বিজনেস-ইকোনমী এসবের তফাৎ খুব একটা বুঝিনি।

একটু পরই দেখলাম বিমানবালাদের ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। দেখে মনে হলো যেন কোথাও আগুন লেগে গেছে, আর উনারা পানি খুজে পাচ্ছেন না। একবার এদিক যায়, দু'মিনিট পর আবার ওদিক। উনাদের দৌড়াদৌড়ি দেখে মনে হচ্ছিল, সব জিনিসপত্তর এক জায়গায় রাখলেই তো হয় - তাহলেই তো বারবার এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে হয় না :P

যাইহোক অল্প কিছুক্ষন পরই, একজন বিমানবালা একটি ছোট ট্রলিতে করে চা-কফি নিয়ে আসলেন। আমার কাছে এসে খুব স্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করলেন "চা য়ে?" - আমি তো থতমত খেয়ে গেলাম - 'চা য়ে' মানে কি? উনি কি বাংলা বলছেন নাকি হিন্দী? উনি যে চা সাধছেন সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু শুধু 'চা' না বলে 'চা য়ে' বলছেন কেন? শেষে 'য়ে' টা কেন লাগালেন?

যাই হোক আমি গম্ভীরভাবে বললাম "কফি"। ইসমার্ট মানুষ তো তাই, আর তাছাড়া প্রথমবার প্লেন চড়ছি কফি খেয়ে একটু ভাব দেখানো দরকার! যাই হোক, উনি খুব ছোট একটা ট্রেতে এক কাপ ব্ল্যাক কফি ঢেলে সাথে ২ প্যাকেট ক্রিম/চিনি দিয়ে ট্রে টা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমিও ভ্দ্র ছেলের মতো ট্রে টা নিতে গেলাম। ওমা!!! মহিলা দেখি ট্রে ছাড়ে না। আমি ট্রে টানি, উনি ট্রে ধরে ঠায় দাড়িয়ে আছেন। কিরে বেটি কফি সাধলি, এখন আবার দিচ্ছিস না কেন? :-* এটা কেমুন ব্যবহার? উনি দেখি এদিক ওদিক মাথা নাড়ছেন - আমি তো পুরোই বেকুব - তখন আমার সামনের সিটের দিকে তাক করলেন, আর আমি দেখলাম সামনের সিটের পেছনের দিকেই একটি ট্রে আছে, যা খোলা যায়, আবার খাবার পরে উঠিয়ে রাখা যায়। আমি দেখেছিলাম ঐ ট্রেটা আগেই, কিন্তু ওটাই যে এখন ব্যবহার করতে হবে, আমি কি করে জানব :P আমি একটু লাজুক হাসি দিয়ে উনার কাছ থেকে শুধুমাত্র কফির কাপটা নিলাম। আমার হাসিতে উনার মন গলেছিল বলে মনে হয় নি।

এদিকে আমার ছোটভাই সমানে প্রশ্ন করে যাচ্ছে, হাজার হাজার সব প্রশ্ন। আর আমি মনিটরে খালি দেখছি কোন দেশের উপর দিয়ে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে যখন পাকিস্তান পেরিয়ে আসলাম, তখন নদীনালা, গাছপালা সব উধাও হয়ে গেল - শুরু হলো বিস্তীর্ণ পাহাড়ের সারি। মেঘ আছে তবে অতটা না। একসময় পাহাড়ের চুড়াতে তুষাড়ে ছাপ দেখতে শুরু করলাম, সম্ভবত আফগানিস্তান এলাকার সীমানা, মনে নেই ঠিকঠাক। সে এক অপূর্ব দৃশ্য - সবুজের কোন ছিটেফোটাও নেই কোথাও, সব রূক্ষ পাথরের পাহাড় অথচ পাহাড়ের চূড়াটা শুভ্রশ্বেতকায়। কোন জনবসতি চোখে পড়ছিলনা। আর থাকলেও সেটা এত উপর থেকে চোখে পড়ার কথাও নয়।



একসময় দুপুরের খাবার সময় এলো। আমি তো মনে হয়, শুধু এর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম :P আমাদের ভেজিটারিয়ান/চিকেন অফার করা হলো, চিকেন নিলাম, প্লেনে উঠে শুধু সবজি খাব নাকি? যাই হোক খাওয়া খুব একটা খারাপ ছিলনা। চিকেন, ম্যাশড পটেটো (আলুর ভর্তা মাখনসহ), রুটি, বিস্কুট, মাখন, জেলী, কমলার রস (ভয়ংকর তেতো), পেস্ট্রী - আমার মা দেখি শুধু রুটিটা মুখে দিয়ে বললেন "এই এসব সরা আমার সামনে থেকে, কি বাজে গন্ধ এসব খাওয়াতে" - আমি বললাম "এক কাজ কর তুমি আমার রুটিটা খাও, আর আমি না হয় তোমার পুরো খাবারটাই..............." :P



যাই হোক, সিনেমা চলছিল মনিটরে। সিনেমা দেখতে দেখতে খাওয়া শেষ করলাম। ব্যাটারা দেখি একই সিনেমা বারবার দেখাচ্ছে। কিছুক্ষন সিনেমা বাদ দিয়ে হেডফোনে গান শুনলাম। গানের চ্যানেল বদলাতে বদলাতে হঠাৎ করে কানে লাগল একটা গান। তখন অবশ্য জানি না, কিন্তু ওটা ছিল আরব রাজ্যের তৎকালীন সুপারহিট একটি গান। গানের কথা গুলো আমার কানে এইরকম লাগছিল:

"আম্মা লে এএএএএএএএ, আম্মা লে এএএএএএএএ
আম্মা লে এএএ, আম্মাআআআআ লে এএএএএএএএ।
আম্মা লে এএ, হালাতামা
হিছালা সাইআ লে এএএএএএএ!" :D

গানের কথায় তো আমি কাইৎ!!! একি কিম্ভূৎকিমাকার টাইপ গান!

আম্মা নিব কেন? আপনার আম্মা আপনে রাখেন!!! কিন্তু গানের তালটা ভালই। গানটা এতটাই ভাল লেগেছিল, যে এখনও মনে আছে। পরে অনেক কষ্টে গানটা খুজে বের করেছিলাম, এবং দেখলাম গানের কথাটা "আম্মা লে এএ" না.... হবে "আম্মা নে এএ" :D !



গায়িকা: ডায়ানা হাদ্দাদ
গানটির ইউটিউব লিংক: Diana Haddad - "Ammanih"

এর মাঝে আবার কফি ও বিস্কটু দেয়া হলো। ধীরে প্লেন নামার সময় হলো। কুয়েতের উপরে এসে দেখি প্লেন আর নামে না, খালি ঘুরছে, আর ঘুরছে। পরে জেনেছি বিমানবন্দর থেকে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত বিমান মাটিতে অবতরন করে না।

কিছুক্ষন পর প্লেন নিচে নামা শুরু করল। জানালা দিয়ে দেখি অদ্ভূত এক দেশ। যতদুর চোখ যায়, শুধু বালি আর পাথর, এরই মাঝে আলোর ছড়াছড়ি। সবকিছু সাজানো, যেন মনে হয় এই মাত্র কেউ ধুয়ে মুছে রঙ করে গেছে। রাস্তায় কোন জ্যাম নেই, বাড়ীগুলো সব একই রকম, হাইওয়ে গুলো মাইলের পর মাইল চলে গেছে - যেন কেউ নিখুত কোন পরিকল্পনায় সাজিয়েছে আর এই সাজানো খেলাঘর সাজানোই থেকে যাবে যুগের পর যুগ। কিন্তু সব কেমন যেন ধুসর! একটা দম বন্দ্ধ - বন্দ্ধ ভাব।

প্লেন টেক অফের সময় যতটা ধরা খেয়েছিলাম, ল্যান্ডিং-এ তেমন কিছু টের পেলাম না। খুব মৃদু একটি ঝাকুনি লাগল, রিকশায় চড়ার সময় এর চেয়ে বেশীই লাগে। ধীরে ধীরে প্লেন থামল, আমরা সব নেমে যাবার জন্য রেডী, কিন্তু দরজা খোলা আর হয় না। অধৈর্য্য হয়ে গেলাম, আর কতক্ষন আটকে থাকব, এতটুকু বাতাসের জন্য বুকটা হাসফাস করছিল! অবশেষে দরজা খোলা হলো আর কুয়েতের আবহাওয়ার উষ্ম অভ্যর্থনা জানাল। মনে হচ্ছিল চুলার সামনে এসে দাড়িয়েছি। অথচ আমরা কিন্তু টানেলের মাঝ দিয়েই হেটে যাচ্ছিলাম। আর ওটা নাকি কোন গরমই না! সরাসরি রোদের মাঝে দাড়ালে না জানি কি হতো!



টানেল পেরিয়ে এসে ঢুকলাম বিমানবন্দরে। কয়েক ঘন্টা আগে ছেড়ে এসেছি আমাদের বিমানবন্দর, আর এখন দেখছি কুয়েতের বিমানবন্দর - কত পার্থক্য, কত তফাৎ! যেদিকেই তাকাই সবকিছু আলোতে ঝলসে যাচ্ছে। দুনিয়ার সব ব্রান্ডের দোকান দেখা যাচ্ছে, একই সাথে তারা আপনার পকেট খালি করে দিবে, আবার আপনার হাতে তুলে দেবে প্রথম শ্রেনীর কোন বস্তু। অর্থাৎ আপনার পয়সা খরচ হবে ঠিকই, কিন্তু এর বিনিময়ে কোন নকল বা দুনম্বরী কিছু পাবেন না। আমার ভাই কিছু চকলেটের দিকে ইশারা করল, আমি বললাম "মাইর দিব"।







মৃদু এয়ারকন্ডিশনে মনে হচ্ছিল চেয়ারে একটু গা এলিয়ে দেই। কিন্তু বিশ্রাম নেবার সময় তো তখন নেই। যেদিক তাকাই সব আরবী, ইংরেজীও আছে, কিন্তু খুব কম। চারদিকে বোরখা পড়া মহিলা, আবার একই সাথে শার্ট-প্যান্ট পড়াও মহিলাও দেখলাম। জগাখিচুড়ী অবস্থা। এদের মাঝে মা আর ভাই কে নিয়ে ইমিগ্রেশনের দিকে চললাম।
কুয়েতে এয়ারপোর্টে প্লেন ল্যান্ড করল দুপুরের একটু পরে। হাতে একগাদা চটের বস্তা টাইপ ব্যাগ। কুয়েতে আসছিলাম ১ মাসের জন্য। এই অল্প কদিনের জন্য এত কেজি কেজি জিনিসপত্তর আনার মানে কি? নিজেদের জিনিসতো আছেই, মানুষের জন্যও আনা হয়েছে। যেই শুনেছে যাচ্ছি, কিছু না কিছু গছিয়ে দিয়ে গেছে - "আমার ভাই থাকে ওর জন্য সামান্য কিছু জামা কাপড় দিব, আর কিছু না" - প্লেন ওঠার আগের রাত্রে এসে কাঠাল সাইজের এক পোটলা নিয়ে হাজির, কম করে হলেও পাচ কেজি হবে। তখন তো আর এসব লাগেজে ঢোকানা যাচ্ছেনা। ফলাফল সব হাতে বহন করতে হলো আমাকে।



যাই হোক দুই হাতে দুই পাটের ব্যাগ নিয়ে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার মা মহা বিরক্ত, তার মতে বিদেশ আসার মতো জঘন্য কাজ আর নেই। আমার ছোট ভাই দুইহাত কচলাতে কচলাতে আগাচ্ছে, যেন ভাবছে "এইবার আইসা পড়ছি - সব চকলেট খেয়ে শেষ করে ফেলব"।

খুব একটা বড় বিমানবন্দর না, তাও খুব হিমশিম খাচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত একটা জায়গায় এসে দাড়ালাম (আমাদের যেমন ইমিগ্রেশন গেট আছে) - কাচ দিয়ে ঢাকা, ওপাশে অনেক মানুষ হাটাহাটি করছে। হঠাৎ দেখি ভিড়ের মাঝে আব্বু হাত নাড়ল। আমি শান্তি পেলাম, যাক ঠিক জায়গা মতো এসে দাড়িয়েছি।

এরপর ইমিগ্রেশন লাইনে দাড়ালাম। একে একে আম্মুর, আমার ভাইয়ের পাসপোর্ট চেক করে সিল মারল। আমার পাসপোর্ট দেখল, ভালো করে দেখল, তারপর বলে "ইউ ওয়েত"। আমি ভাবি 'একি'! ওদের ছেড়ে দিয়ে, আমাকে আটকায় কেন! আর আমারও কপাল সবজায়গায় খাই ধরা :P ইমিগ্রেশন অফিসার একবার পাসপোর্ট দেখে, একবার কম্পিউটার স্ক্রিন। একবার ভিসা চেক করে, একবার আমার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকায় যেন আমি কোন ক্রিমীনাল। তারপর আমাকে দাড় করিয়ে রেখে সে আমার পাসপোর্ট নিয়ে ভিতরের একটি রুমে চলে গেলেন। আমার বাবা কাচের দেয়ালের ওপাশ থেকে আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন। এদিকে আমার মা জননী দেখি ঠায় হয়ে দাড়িয়ে আছেন, যেন আমি কুয়েতে না ঢুকতে পারলে, পরের বাসে করে আমার সাথে উনিও ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবেন।

একটু পর দেখি সেই অফিসার বের হয়ে এল, এসে আরাম মতো বসে আমার ভিসার ওপর একটা নম্বর লেখল। আর তার কিছুক্ষন পর আমাকে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে চিৎকার করে বলল "নেক্সট"!

পরিবারের সবার সাথে এয়্যারপোর্ট হতে বের হয়ে আসলাম। সব চক চক করছে, যেন প্রতি ক্ষনে ক্ষনে কেউ এসে ন্যাকড়া দিয়ে মুছে দিয়ে যায়। আপনারা যখন যাবেন, তখন দেখবেন এই ব্যাপারটা সবার আগে চোখে পড়বে। হয়ত আমরা চারদিকে ময়লা-আবর্জনা দেখতে দেখতে এতটাই অভ্যস্থ আর তাই পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা আমাদের চোখে ধরা পড়ে সবার আগে।

যাই হোক বের হয়ে দেখি চমৎকার একটা লাল জীপ। আমার ভাই তো খুশিতে বলে উঠল "এটা আমাদের গাড়ী?"। কুয়েত সরকারের গাড়ী এত খুশী হয়ে লাভ নাই :P এমন গাড়ীতে আগে কখনও ওঠা হয়নি যদিও। গাড়ীতে ওঠে ফুল স্পীডে এসি ছেড়ে দিয়ে রওনা হলাম।



আর গাড়ীর গতি দেখি বাড়ছে তো বাড়ছেই আর মাথার ওপর দিয়ে ব্রীজ-ওভারব্রীজ সব সাই সাই করে পেছনে ছুটে যাচ্ছিল, কোনদিক কি হচ্ছিল কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি, শুধু এতটুকু বুঝেছিলাম চারদিকে শুধু পাথর আর ধুলার রাজ্য। এর মাঝে কার্পেটের মতো বিছানো রাস্তা।



কিছুদুর পরপরই চোখে পরছিল ব্যাঙের ছাতার মতো কিছু ইমারত - পানির ট্যাংকি! এই জিনিসগুলো কিছুক্ষন পরপরই দেখতে পাচ্ছিলাম। আমাদের পানি নিয়ে এত সমস্যা তারপরও আমরা পানি নিয়ে এত পাগলামি করি না, ওরা যতটুকু করে। কারন হতে পারে, আমরা পানিকে অধিকার মনে করি, আর ওরা মনে করে প্রাচুর্য্য।



রাস্তার মাঝে খেজুুরের গাছ। প্রতিটা গাছের গোড়াতেই পাইপ দেখা যাচ্ছে। মনে হলো "ব্যাটারা পাগল নাকি? তাদের দেশের প্রতিটা গাছের নিচেই কি পাইপ দিয়ে পানি দেয়া সম্ভব?"। পরে জেনেছি সেটাই তারা করেছে। ওদের ওখানে গাছের খামার আছে। যেখানে একটি গাছকে পরিচর্যা করে বড় করে তোলা হয়, তারপর সেটাকে তুলো এনে শহরের বিভিন্ন স্থানে রোপন করা হয়। যেহেতু গাছগুলোকে একবার মাটি থেকে তোলা হয়েছে, খুবই নিবিড় পরিচর্যা ছাড়া এইগাছগুলো বেচে থাকবেনা। তাই বলতে গেলে সব গাছের আশেপাশেই পাইপ দিয়ে পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।



সব রাস্তা দেখতে একই রকম। সব গাছপালা, সব বাড়ী ঘর দেখতে একই রকম। হঠাৎ দেখলে মনে হয় কোন ধাধার মাঝে পড়ে গেছি। রাস্তাতো আর কিছু চিনি না তখন, এদিক ওদিক করে শেষ পর্যন্ত গাড়ী এসে দাড়াল একটা এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর সামনে। দোতলা তে ছিল আমাদের বাসা। বাসায় ঢুকে দেখি খাবার টেবিলে কম করে হলেও ৫০ টা স্নিকারস আর কিটক্যাট পড়ে আছে। আমি আর আমার ভাই পারলে তখনই গাপগাপ করে সব গিলে ফেলি :P নাহ গিলি নাই, ভদ্র ছেলে তো।



একটু ফ্রেশ হয়ে টিভি ছাড়লাম দেখি সব "আওলা হাওলা ইয়া গাওলা" চলতেছে, আর ফুটবল। কয়েক চ্যানেল পরপরই ফুটবল। বিভিন্ন দেশের, ওদের নিজেদের ক্লাব ফুটবল, আর ধারা ভাষ্যকার দের চিরচেনা চিৎকার "গোওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওওললল"। যারা শুনছেন তারাই বুঝবেন আমি কোন চিৎকারটার কথা বলতেছি
রাতে ছিল আব্বু এক কলিগের বাসায় দাওয়াত। শুরু হইসে, কুয়েতে আমি যে ৩০ দিন ছিলাম, তার মাঝে বাসায় খাওয়া হয়েছিল মনে হয় ৭ দিন। আর বাকী সব দিনই ছিল কারো না কারো বাসায় অথবা রেস্তোরাতে খাওয়া-দাওয়া। দাওয়াতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছি তো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। আসলেই শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল - তাপমাত্রা নেমে গেছে। একি কান্ড কয়েক ঘন্টা আগেও তো উনুনের তাপ ছিল, আর এখন ফ্রিজের বাতাস বইছে। কি আর করা গাড়ীতে চেপে রাতের কুয়েত দেখতে দেখতে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
 কুয়েত কেন জীবনে কোনদিন বাংলাদেশের বাইরে কোথাও পা দেয়া হয়নি। তাই প্রথমবার দেশের বাইরে দেশ - ব্যাপারটা খুব অদ্ভূত লাগছিল। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আমি আর আমার ছোট ভাই বিল্ডিং-এর সামনে সিড়িতে বসে রাস্তার গাড়ী চলাচল করা দেখছিলাম। দুপুরের দিকে রোদে মনে হচ্ছিল গা পুড়ে যাবে, কিন্তু সন্ধার পর তাপমাত্রা দেখলাম অনেক কমে এসেছে।

বাসার পাশেই একটা রেস্তোরা। খুব জমকালো কিছু না, আমাদের স্টার কাবাব বা কস্তুরীর মতো। জীবনে প্রথম শর্মা খেলাম - মনে হয় যেন এখনও সেরকম মজার শর্মা আর খাইনি। সেখানে আপনি পাবেন চিকেন শর্মা আর দুম্বার (ভেড়া) শর্মা। ওরা দুম্বা অনেক পছন্দ করে, কিন্তু দুম্বা তে এত গন্ধ! এক কামড়ের পর আপনার ক্ষিদে গায়েব হয়ে যাবে!

শর্মার দাম রাখল ২৫০ পয়সা। ওখানে ১০০০ পয়সা = ১ টাকা। আমাদের যেমন ১০০ পয়সায় ১ টাকা হয়। ওখানের পয়সাকে বলে 'ফিলস'। টাকাকে বলে কে.ডি. (কুয়েতী দিনার)। তো ১০০০ ফিলস = ১ কেডি। আর ১ কেডি = ১৬৫ টাকা। এখন সেটা বেড়ে দাড়িয়েছে ১ কেডি = ২৭৫ টাকা। তাহলে বুঝতেই পারছেন কারো পকেটে কুয়েতী ৫০ টাকা থাকা মানে বাংলাদেশী প্রায় ১৪০০০ টাকা! সেইরকম পার্থক্য।



আমাকে একটা নতুন মানিব্যাগ দেয়া হলো, আর তাতে চকচকে ১০কেডি, সেটা দেখে আমার চোখও চকচকে - এই ১০ কেডি দিয়ে কি কি করতে পারতাম - ১০০০ টা পেপসি কিনতে পারব। অর্থাৎ ২ টা বিয়ের মানুষ খাওয়ানোর কোক-পেপসি-স্প্রাইট কিনতে পারব :P । অথবা প্রায় ২০০ টা রুটি কিনতে পারব। বুঝতেই পারছেন - একজন মানুষ যতই দরিদ্র হোক না কেন, সে কখনও ক্ষিদে নিয়ে ঘুমাতে যাবে না, কারন খাওয়া দাওয়ার মূল্য তার হাতের নাগালেই আছে।

ওখানে সবাই একটি বিশেষ রুটি খায় এটাকে বলে 'খুবজ'। নান রুটির মতো, কিন্তু এত নরম নয়। এই রুটি ২টার বেশি খাওয়া অসম্ভব, ৪টা রুটির প্যাকেট পাওয়া যেত, ২০০ ফিলসে। সাথে কিছুর ঝোল হলেই পেটপুরে খাওয়া শেষ।



আরো দেখলাম মিস্টি বলে কিছু নাই। আমরা যেমন রসে ভেজানো মিস্টি খাই - ওখানে সবাই শুকনো একটা মিস্টি খায়, যেটা আমার কাছে খুব একটা সুবিধার মনে হয়নি।



চকলেট/আইসক্রিম/জুস/পেপসি/কোক - এসবের দাম ছিল সবচেয়ে কম, তো আমাদের জন্য কুয়েত ছিল স্বর্গের মতো। সারাদিন খালি চকলেট পেপসি খেতাম, আর দোকানে যাবার প্রয়োজন কম ছিল, কারন ওখানে সবাই বাল্কে (পাইকারী স্টাইলে) জিনিস কিনে। আমি নিজেও বোকা হয় গেছিলাম প্রথম প্রথম! বাবা বললেন "জুসের প্যাকেট একটা নিয়ে নাও", আমি নিলাম, উনি বললবেন "না না, পুরোটাই" মানে পুরো কার্টন - ২৪টাই। পুরো মাসের জুস একদিনেই কেনা। চকলেটের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আর আমি যেহেতু প্রথম গিয়েছিলাম, এসবের দিকেই আমার নজর ছিল বেশী। :)

খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে তারা যে দিলদরিয়া, সেটা তাদের কেএফসি, পিজ্জাহাট-এ গিয়ে বুঝতে পারলাম। কোক একবার কিনবেন এরপর ফ্রি। তাও মানুষের সুবিধার জন্য কোকের ফাউন্টেন (যেখান থেকে আপনার গ্লাসে কোক ভরবেন) কাউন্টার থেকে দূরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আপনি কোক খেতে চাইলে বারবার কাউন্টারে যেতে হবে না। ফাউন্টেনের বোতামে চাপ দিয়ে নিজে নিজের গ্লাস ভরে নেবেন।

মানুষজন সব আলখাল্লা পড়েই ঘুরাঘুরি করত। মহিলারা দেখলাম কিছু বোরখা পরিহিত, কিছু ছোট স্কার্ট পড়া। মানে দেশটিতে দুইরকম সংস্কৃতির পরিচয় চোখে পড়ে। আর মহিলারা সেইরকম মেকআপ দিয়ে রাখত, সেই তুলনায় পুরুষদের অনেকটাই মার্জিত মনে হতো।

একটা মজার ব্যাপার দেখলাম - সবার গাড়ী আছে! মানে সবার! একদিন এক গাড়ী এসে বাসার সামনে থামল (আমি বাসার সামনে সিড়িতে বসে অনেক সময় পার করতাম)। তো গাড়ি থেকে এক লোক বার হয়েই আমার সামনে হাত পাতল - তারমানে ভিক্ষা করতে গাড়ী চালিয়ে এসেছে। এ কেমন দেশরে বাবা - ভয়ানক অবস্থা! তাকে আমি ২৫০ ফিলস দিয়েছিলাম, আমার শর্মা খাওয়ার পয়সা। সে খুব খুশি হয়ে কিসব বলল (গালি দিল কিনা সেটা সেমূহুর্ত বা এইমূহুর্ত - কোন মূহুর্তেই বোঝা গেলনা) - তারপর অন্য বাসা গুলোতে বেল বাজিয়ে ভিক্ষা শুরু করল!

ওখানে আরো মজার একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম সেটা হলো পুরোনো জিনিস ফেলে দেয়া। আপনি হয়ত কাজ শেষে বাড়ী ফিরছেন, হঠাৎ দেখবেন রাস্তার পাশে পড়ে আছে, ২৫ইন্চি এক টিভি সেট অথবা বিশাল বড় এক সোফা। কাছে গিয়ে পরীক্ষা করলেই দেখবেন সেগুলো বলতে গেলে নতুনই। আমরা যখন চলে আসি, আমরাও তখন কালো লেদারের একটি সোফা, ড্রেসিং টেবল, খাট রেখে আসি - যার প্রয়োজন সে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। আবার সেখানে "ফ্রাই-ডে মার্কেট" বলে একটা বাজার বসে। আপনি এই রকম সেকেন্ড হ্যান্ড বিভিন্ন জিনিস সেখানে পাবেন। বিশাল বড় এলাকা নিয়ে এই ফ্রাই-ডে মার্কেট বসত, দিন দুনিয়ার যা আছে সব পাবেন, তবে সেকেন্ড হ্যান্ড অথবা একটু অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের।



কুয়েতে যাবার আগে থেকেই জানতাম, ওখানে বাংলাদেশীরা খুব একটা ভালো নেই। ওখানে যেয়ে কিছু কিছু চোখেও পড়ল। একদিন খুব ভোরে ঘুম ভেংগে যাওয়ায় বারান্দায় দাড়িয়ে আছি, ভোর হবে হবে, এরপরও ভীষন গরম, সূর্য তখনও ওঠেনি। হঠাৎ দেখি একজন মানুষ রাস্তা দিয়ে আপন মনে হেটে আসছে, গায়ে খুব উজ্জল হলুদ/কমলা ইউনিফর্ম পড়া। তার হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। উনি মাটির দিকে তাকিয়ে হাটছিলেন আর রাস্তা থেকে কাগজ, পেপসি ক্যান -এসব উঠিয়ে উঠিয়ে ব্যাগে ভরছিলেন। তার চেহারা স্পষ্টভাবে দেখিনি, তবে আমাদের দেশী হবার সম্ভাবনাই বেশি। শরীর ও গায়ের রং তো আমার মতোই ছিল। এতদূর দেশে এসে সকাল হতে না হতেই তাকে রাস্তায় নেমে যেতে হচ্ছে, ঘন্টার পর ঘন্টা এই গরমে সে হেটে বেড়াবে, আর ময়লা কুড়াবে, যাতে আমরা পরিস্কার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারি। অথচ আমরা ময়লা ঠিক জায়গায় ফেললেই কিন্তু ঐ মানুষটার কষ্ট ৭০% কমে যাবে - কিন্তু না, আমরা আয়েশী মানুষ! আয়েশ করে এখানে-সেখানে ময়লা ফেলব, পরিস্কার করার জন্য তো এরা আছেই, ওর কষ্ট কমানোর জন্য আমরা আয়েশ করা ছাড়ব কেন???
সোর্স লিঙ্কঃ কেএসরথি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন