শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৫

নীল সমুদ্রের দেশ : আন্দামান

ইতিহাসে খোদাই করা সিবেনান, কনিংহোম বা সিসিফাসের অদ্ভুত জঙ্গলে পর্যন্ত, আজ অভিযাত্রীদের গ্রীষ্মকালীন ঘামের গন্ধ ম-ম করছে।  এই অজেয় পথে অভিযানের আশায় আজ ও কিছু মানুষ রাকসাক পিঠে স্পাইকি বুট পায়ে দিয়ে দুর্গেয় হিমালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কোমরে ক্লাইম্বিং রোপ বাঁধছে।  এমন দেখলে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ খাঁটি কথাটিই বলেছিলন - 
" ইহার চেয়ে হতেম যদি আবার বেদুইন
চরণ তলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন। "
কিন্তু এখন আসল কথা হল এটা আমাদের ক্ষেত্রে কতদূর সত্য ।  আমাদের ক্ষেত্রে এর উত্তর কি হবে জানি না তবে আমার ক্ষেত্রে একেবারেই মিথ্যা ।  আমি আজীবন নিরাপদ অভিযান করেছি | শুধু আমি নই আমার মত বাঙালীর সংখ্যাই বোধহয় এই বঙ্গভূমিতে বেশী যারা নিরাপদ অভিযানে বিশ্বাসী। আসলে আমি এখনো এমন জীবনের পুরোপুরি সুযোগ পাইনি। যেদিন পাব মনভরে তখন এক বিপদসঙ্কুল অভিযানের, গল্প লিখব।  তবে আজ একটা সুন্দর নিরাপদ মিষ্টি ভ্রমণের গল্প বলি যেখানে শুধু আমি নই আপনিও যেতে পারেন এবং সুস্থ্য স্বাভাবিক দেহে বাড়ি ফিরে আসতে পারেন। 
বাবা সরকারী চাকরির বিশেষ কিছু সহায়তায় কখনো কখনো ভ্রমণের সুযোগ পেতেন। এই সুযোগের জন্য বাবার থেকেও কৌতুহল বেশী থাকত আমার। ২০১৩ তে যে ভ্রমণের সুযোগটা এল তাতে পরিবারের সকলের মত নিয়েই স্থির করা হলো আন্দামান।  আমার কাছে জায়গাটি সম্পূর্ণ ভাবে অজানা নতুন |আমার ধারণা ছিল আন্দামানে সেলুলার জেল আর জারোয়া, বনজঙ্গঁল বাদে দেখার কিই বা আছে।  তবু একটা অচেনা বিশ্বাস ভেতরে ছিল দেখাই যাক না কি হয়। 
এপ্রিল মাসের ছয় তারিখের প্লেনের টিকিট বুক হলো | অন্যদিক দিয়ে বিষয়টি আরেকটু মজার কারণ এটাই আমার জীবনে প্রথম প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা | আমাদের সাথে আরো দুটি পরিবার মানে আমার বাবার কলিগ, তারাও গিয়েছিল। ছয় তারিখ সকাল সকাল একটা গাড়িতে করে সবাই মিলে সাড়ে আটটার মধ্যে দমদম এয়ারপোর্ট পৌছালাম।  সেখানে নিয়মকানুনের পর একটি রানওয়ে প্যাসেঞ্জার বাসে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ধু ধু রানওয়ের মাঝে দাঁড়ানো সাদা - নীল রঙের এক বিমানের সামনে। আমার জীবনে সেই প্রথম মাটি ছেড়ে শুন্যে আরোহনের অভিজ্ঞতা তার সাথে কোনো কিছুর তুলনাই হয় না। উপরে উঠতে উঠতে কিছুক্ষণের মধ্যে বহু নীচে ক্ষুদ্র কলকাতা শহরটিকে তখন শুধুই খেলনা নগরীর মত দেখাচ্ছিল। আরো মিনিট পাঁচেক বাদে যখন বিমান স্থলভাগ ছেড়ে বঙ্গঁপসাগরে  ঢুকছে এ যেন এক স্বর্গীয় দৃশ্য, সরু সরু খড়ি লবন নদ , বাকা তারা নালা পথ সব যেন জালের মত বঙ্গঁপসাগরে বেশ খানিকটায় কবজা বসিয়েছে। শেষে বিমান যখন অনন্ত নীলে যায় নীচে শুধুই অফুরন্ত জলরাশি | বিমানের তখন উচ্চতা প্রায় ৩৪ হাজার ফুট। বিমানের নীচে রাশি রাশি মেঘ জমা হয়, এভাবে চলতে থাকে দুঘন্টা কুড়ি মিনিট।
wellcome to Port Blair Airport . ছোট্টো একটা বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরের একটা বিশেষত্ব হল বেলা বারোটার পরে এখানে আর কোনো বাইরের বিমান অবতরণ করে না। তাই বেলা বাড়ার সাথে সাথে সামরিক বাহিনীর অধীনে চলে যায় এই বিমানবন্দর, তখন শুধুই কিছু সামরিক বিমান এবং কপ্টার ওঠানামা করে এই বন্দরে এবং তার সাথে চলে কড়া নজরদারি। সাড়ে বারোটায় মধ্যে হোটেলের ম্যানেজার বিমান বন্দর থেকে আমাদের রিসিভ করলেন, আমরা হোটেলে পৌছলাম | ছোটখাটো বেশ সাজানো ঘর, দুটো করে বিছানা, বেশ আরামদায়ক ব্যাপার |
এরপর বিকালে সেলুলার জেল দেখতে গেলাম |কোনো জেলের নিয়মকানুন এতটা ভয়ঙ্কর ও মর্মান্তিক হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না | পায়রার খোঁপের মত ছোট ছোট ঘর , অস্বস্তিকর পরিবেশ , লোহার শিকল , চাবুকের আঘাত আর চূড়ান্ত সাজায় ফাঁসি | পুতুলের কাঠামো সাজিয়ে ভারতীয় বিপ্লবীদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের নিষ্ঠুর অত্যাচারের বর্ণনা রয়েছে সেখানে | দেয়ালে টাঙানো রয়েছে শয়ে শয়ে ফাঁসিতে ঝোলানো বিপ্লবীদের মুখের ছবি এবং তার পাশে রয়েছে জীবনের অন্তিম পর্যায়ে ছাড়া পাওয়া কিছু বিপ্লবীদের ছবি | সত্যি আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা ভারতবাসীরা সারাদিনের কর্মচঞ্চলতার মাঝে একবারের জন্যও তাঁদের স্মরণ করিনা, তাঁদের বীরত্বের কথা, তাঁদের মৃত্যুতে শোক পর্যন্ত প্রকাশের সময় নেই আমাদের হাতে | যাই হোক, আমি সবথেকে বেশি বিচলিত হয়েছি সেই জায়গাটা দেখে যেখানে ফাঁসি কাঠে দাড়ানো বিপ্লবীদের শরীরটা একটা হরকা টানে মাটির নিচের এক অন্ধকার কুঠুরিতে ঝুলে পরে  দাঁপড়াতে দাঁপড়াতে স্থির হত | সেই অন্ধকার কুঠুরিতে ঢুকলে দম বন্ধ হয়ে আসে | সেলুলার জেলের সকল বিপ্লবীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক বিরাট মশাল দিনরাত ধরে জ্বলে | শুনেছি সেটাকে এভাবে জ্বালিয়ে রাখার জন্য মাসে চব্বিশটা গ্যাসের সিলিন্ডার প্রয়োজন হয় | প্রতি সন্ধায় সেলুলার জেলের ময়দান স্টেডিয়ামে একটা লাইট এন্ড সাউন্ড শো-এর আয়োজন করা হয় | অপূর্ব আলো এবং সাউন্ড-এর ব্যবহার করে পর্যটকদের মনকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় স্বাধীনতার প্রাক্কালে | ক্রমপর্যায়ে একেকটা কক্ষে আলো জ্বলে উঠে জীবিত হয়ে ওঠে বিপ্লবীদের গলা, সেই অত্যাচারী ব্রিটিশ রুলার্সদের শব্দ | আস্তে আস্তে চোখের সামনে জীবিত হয়ে ওঠে সেই বটগাছটা যেটা তখন থেকে আজ পর্যন্ত বেঁচে আছে | সেই বটগাছ বলে যায় একে একে তার অভিজ্ঞতার কথা, শোনা যায় বিনয়ক দামোদর সাভারকারের করুণ কন্ঠ, শোনা যায় গোটা সেলুলার জেলে বিপ্লব হচ্ছে, সব বিপ্লবীদের মুখে একই কথা 'জাস্ট পুট হ্যাং দ্য মিনিস্টার' |আবার সেই বিপ্লব দমন করার জন্য বেশ কয়েকজন বিপ্লবীর ফাঁসি হয় | চোখে জল চলে আসে এই সম্পূর্ণ ঘটনায় |
 
সেলুলার জেল
 
সেলুলার জেলের ভেতরের একটি অংশ 
 
সেলুলার জেলের বাইরে রাস্তার ওপাশে একটি সুন্দর পার্ক রয়েছে, 'সাভারকার পার্ক' | ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সেলুলার জেল থেকে বেরিয়ে আপনি যখন মানসিক শান্তির একটা জায়গা খুঁজবেন, শুধুমাত্র এই পার্কটিই আপনার চোখে পড়বে | সেখানে চা-কফির ষ্টল, খাওয়ারের দোকান, দেশী বিদেশী পর্যটকদের ভীড়, বেশ মনোরম জায়গা বটে | সাভারকার পার্ক থেকে বেরিয়ে সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ আমরা গেলাম রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল স্পোর্টস কমপ্লেক্স | সেটা একটা মেরিন পার্ক, বিশাল আয়তন, মেরিন বাইকে বসে সান্ধ্যকালীন সমুদ্র যাত্রার রয়েছে দারুন সুযোগ | সম্পূর্ণ পার্কে আলোর বাহারি কাজ সেটাকে আরো সুন্দর করে তুলেছে | পার্কে রয়েছে রাজীব গান্ধীর একটা বিশাল মূর্তি | রাত আটটার মধ্যে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম | কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর রাতের খাওয়ারের জন্য ডাক আসলো | বড় বড় সাইজের গলদা চিংড়ি ছিল মেনুতে | আহা! সে কি সুন্দর রান্না !
৭ই এপ্রিল সকাল সকাল লাগেজ গুছিয়ে হোটেল ছাড়লাম | হোটেলের গাড়িতে করেই জাহাজ ডিপোতে পৌছে দেওয়া হলো | এত বড় জাহাজ দেখাটাই আমার জীবনে প্রথম , ওঠা তো দূরের কথা | আমাদের যাত্রা শুরু হলো নীল আইসল্যান্ডের দিকে | মাঝ সমুদ্রে জাহাজ যাত্রায় যে মানুষ কেবিনে বসে সময় কাটায় তার মত জড়বস্তু এ দুনিয়ায় আরেকটা নেই |
 
 
 নীল আইসল্যান্ডের পথে 
 
আমরা কয়েকজন কেবিন ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে ডেকের ওপর গেলাম | যেদিকে তাকানো যায়, কোনো সীমানা নেই শুধু জল আর জল | নীল দিগন্তের সাথে নীল জল মিশে একাকার | সেদিনের প্রতিটা দোলা আজও আমার স্মৃতির অগোচর হয়নি | আড়াই ঘন্টা সমুদ্র যাত্রার শেষে পৌছলাম নীল আইসল্যান্ড | সমুদ্রের কি উচ্ছাস সেখানে ! তেপান্তরের এই মহাসমুদ্র সৈকতে জড়ো হয়েছে হাজারে হাজারে নর-নারী | দেশী বিদেশী পর্যটকের ভিড় | তাদের ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন পোশাক, ভিন্ন সংস্কৃতি | একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম সেখানে তামিল এবং বিদেশীদের সংখ্যা সবচাইতে বেশি সম্পূর্ণ আন্দামানে |
 
লাইম স্টোন এর পথের মনরম দৃশ্য 
 
লক্ষণপুর বিচ 
 
স্পিড বোটে মাঝ সমুদ্র  ভ্রমনে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা | এই বোটগুলোকে বলা হয় গ্লাসবোট | অর্থাৎ তলদেশ হয় কাঁচের | এতে বোটে বসে থাকা মানুষেরা সমুদ্রের অতল গভীরতার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন | এছাড়া রয়েছে স্কুবা ডাইভিং | ওয়াটার মাস্ক মুখে পড়ে একবুক বাতাস নিয়ে বোট থেকে ঝাঁপ দিতে হবে মাঝ সমুদ্রের অতল গহ্বরে | যেখানে অনন্ত গভীরতায় নির্ভিক মাছের ঝাঁক খেলা করছে | সব থেকে চমৎকার মনে হয় যখন সেই বাহারি রঙের মাছের ঝাঁক আমাদের মাঝে রেখে দুপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় | বিশ্বের সাতটি কোরাল আইসল্যান্ডের মধ্যে আন্দামান অন্যতম | সেই কোরাল প্রাচীরের অজস্র মণিমুক্তার ওপর দাড়িয়ে মনে হতেই পারে এটি কোনো হিরক রাজার দেশ | স্কুবা ডাইভিং-এর স্বাদ এক অন্যরকম | কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও অনেকে এই স্বাদ নিতে পারেননা শারীরিক দুর্বলতার কারণে | 
সমুদ্রে স্নান করে সকলে হোটেলের গাড়িতে করে ফিরলাম আমাদের নতুন হোটেলে | চারপাশে জঙ্গল বনের মাঝে এই হোটেলের পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্যরকম | হোটেলে বিশ্রাম সেরে বিকেল পাঁচটায় বেরোলাম আরেকটা নতুন সমুদ্র সৈকতে, নাম সীতাপুর বিচ টু | সেখানে প্রকৃতির আপন খেয়ালে পাহাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে তৈরী হয়েছে 'ন্যাচারাল বিচ', যা অপূর্ব সুন্দর | সেখান থেকে আমরা গেলাম লক্ষ্মণপুর বিচ | সূর্যাস্তের এইরূপ সৌন্দর্য আমাদের কাছে সম্পূর্ণ প্রথম | সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ঘনায়মান রাত্রির ইঙ্গিতে মহাসমুদ্রের আকাশ অন্ধকারে হারিয়ে গেল এবং তারপরে সম্পূর্ণ পরিবেশটায় যে সৌন্দর্য ফুটে উঠলো তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না | সমুদ্রের গর্জন বেড়ে দ্বিগুন হলো | এই ভয়ঙ্কর আবহাওয়াতেও বিদেশীদের সমুদ্র স্নানে একটুকুও ভাঁটার টান পড়ল না | বিদেশী বলতে মনে পড়ল, তাদের মধ্যে আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করছিলাম সেই সমুদ্র সৈকতের পেছনে জঙ্গলের কিনারে বসে কিছু বিদেশী মাছ ধরছিল | ওদের পোশাক অন্যদের মত নয় | হোটেলে ফিরে ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করতে জানতে পারলাম, জঙ্গলের ভিতরে বিদেশীদের আলাদা রিসোর্ট থাকে | কারণ কিছু মানুষ প্রকৃতির সাথে মিশে আদিম কায়দায় বাঁচতে চায় | আর খাওয়ার ব্যাপারে ওরা বড় সিম্পল | মাছটি সিলভার টেপলনে পেঁচিয়ে আগুনের ওপর বসাবে | ফ্রাই হলে টেপলন খুলে হালকা নুন আর ভিনিগার দিয়ে তারা সেটাকে আস্বাদন করবে | সন্ধ্যা সন্ধ্যা হোটেলে ফিরে গল্পগুজবের মধ্যে দিয়ে রাত কাটল | পরদিন সকালে আমরা হোটেল ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি | একজন বললেন হাঁটাপথে হোটেলের একটু দূরেই একটা পরিত্যক্ত সৈকত রয়েছে | একটু সময় চেয়ে আমি নিজেই চলে গেলাম সেখানে | পাহাড়ের ফাঁকে ছোট্ট এক সমুদ্রের অংশ যেন পাখির খাঁচার মত আটকা পড়েছে | এই জায়গায় কোনো পর্যটক ঘুরতে আসেনা | সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গভাবে এই বিশ্ব-পাহাড়-সমুদ্রের দেশে আমি একাই মুগ্ধ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম |
 
 
হ্যাবলক
 
হোটেলের গাড়িতে করে আমাদের পৌঁছে দেওয়া হলো আবার জাহাজ ডিপোতে | পুনরায় আরেকটি দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রা | আড়াই-তিন ঘন্টার পথ | আমরা যাচ্ছিলাম 'হ্যাবলক' | এই যাত্রা পথে জাহাজ সমুদ্রের যে অংশ অতিক্রম করে তা একেবারে ঘন নীল( Navy Blue) | যা না দেখলে বিশ্বাস হয়না | এই সময় আমি জাহাজের ডেকেই কাটিয়েছি | হ্যাবলক পৌঁছে দেখি জাহাজের ডিপোতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে অন্য হোটেলের গাড়ি | একে অবশ্য হোটেল বললে ভুল হবে, একটি কাঁচের তৈরী রিসোর্ট | সেখানে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাধানগর বিচে অর্থাৎ হ্যাবলক বিচে | দুপুরের লাঞ্চটা ওখানেই সারলাম | তারপর সমুদ্র সৈকতে গিয়ে দেখি প্রকৃতির কি অপার সৌন্দর্য | বিদেশীরা এই বিচকে বলে 'স্বর্গরাজ্য' | তাই এখানে তাদের ভিড় সবথেকে বেশি | জানতে পারলাম এই বিচটি বিশ্বের বুকে সপ্তম সৌন্দর্যের সমুদ্র সৈকত | ধবধবে সাদা সৈকতের বালি এবং বিশাল সবুজ বনানীতে সম্পূর্ণ হ্যাবলক আবৃত | সন্ধ্যায় বিচ থেকে রিসোর্টে ফিরে চা-কফি আর সামান্য কিছু টিফিন করলাম | এই রিসোর্টটি সমুদ্রের তীরে এবং সমুদ্রের জল রাতের দিকে উঠোনের কাছাকাছি চলে আসে |
পরদিন সকালে হোটেল ছেড়ে পৌঁছলাম আবার জাহাজ ডিপোতে | পোর্টব্লেয়ারের আগের হোটেলে ফিরলাম | প্রত্যেকেই সমুদ্র যাত্রায় খুব ক্লান্ত ছিল, তাই বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল | বিকালে হোটেলের গাড়িতে করে কিছু সাইড সিন'এ গিয়েছিলাম | প্রথমে গেলাম 'সুইসাইড পয়েন্ট' | এটা ছিল একটা পাহাড়ের খাদ | পাথরের দেয়াল ঘেঁষে আশি-নব্বই ফুট নিচে ছিল এক বিস্তীর্ণ পাথুরে চাতাল | এখানকার এরম নামকরণের কারণ হলো সেলুলার জেলের বিপ্লবীরা যদি কোনভাবে কঠোর নজরদারি পেড়িয়ে আসতে পারত তবে তারা এখানে এসে দুঃখে জ্বালায় আত্মহত্যা করত | জেলের অপমান ও দুর্বিষহ জীবনের থেকে মরণ সুখকে তারা আগলে নিতেন | তারপর গেলাম 'স্নেক আইসল্যান্ড' | কিন্তু সেখানে বিকেলে স্কু ডাইভিং-এর ব্যবস্থা না থাকায় দ্বীপের কাছে র যাওয়া হলনা | এরপর পোর্ট ব্লেয়ারের প্রধান বাজারটা ঘুরে দেখলাম | ঝিনুক, শামুক, মুক্তা, প্রবাল ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায়না | তবে ওদের একটা প্রাচীন ঐতিহ্যের মূর্তি নিয়ে এসেছিলাম যেটা হলো জারোয়ার | জারোয়া ওখানকার আদিম উপজাতির নাম | রাত আটটার মধ্যে হোটেল ফিরলাম হোটেলের একটু দুরেই একটা চার্চ রয়েছে | নাম হলো পোর্টব্লেয়ার চার্চ, খুব সুন্দর বিদেশী কাঠামোয় তৈরী |
পরদিন ভোর চারটের মধ্যে বেরিয়ে রওনা দিলাম জারোয়া ট্রাই'ভস-এর দিকে | জারোয়া অধ্যুষিত এই জঙ্গল প্রায় ৭৩ কিমি প্রসস্ত | সে জঙ্গলে মানবসমাজের আনাগোনা নেই | শুধু পর্যটন শিল্পের কারণে জঙ্গলের মাঝবরাবর এক বিশাল রাস্তা নির্মান করা হয়েছে | এই পথ দিয়ে পর্যটকদের গাড়ি লাইন দিয়ে জঙ্গলের ভেতরে এগোতে থাকে | পাশে থাকে নিরাপত্তার জন্য পুলিশের প্যাট্রোল সার্ভিস | ভোর ভোর বেরোনোর কারন হলো এই সময় জারোয়ারা শিকার করতে বেরয় এবং ওই সড়কপথে পারাপারের সময় বহুবার দেখা যায় | আরেকটা সুবিধা হলো তারাতারি পৌছলে গাড়ির লাইন-এ এগিয়ে থাকা সম্ভব হয় | জঙ্গলের ভেতর বিশাল বড় খাদ, পাহাড়, জলাশয় সব মিলিয়ে সেখানকার প্রকৃতি বেশ রোমাঞ্চকর | জারোয়ারা আগে এখানে জোটবদ্ধ অবস্থায় থাকত | কিন্তু কিছু বছর হলো এক সমীক্ষায় জানা গেছে ওই জারোয়াদের এক বিরাট অংশ ওদের রাজাকে ছেড়ে 'বারাটাং' এর এক গভীর জঙ্গলে চলে গেছে | এখন এই জঙ্গলে শুধু দেড়শ জন জারোয়ার বাস | 
এক দীর্ঘ পথ পেড়িয়ে আমরা পৌছলাম 'বারাটাং' | সেখান থেকে স্পিড বোটে করে সামুদ্রিক লতানো লবণাম্বু উদ্ভিদের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গিয়ে এক লাইম স্টোন-এর অতিপ্রাকৃতিক গুহায় | সেখানকার গুহায় দেয়াল চুনাপাথরের এবং গুহার ছাদ থেকে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে দেয়ালের উপর ক্ষয় চালিয়ে বিভিন্ন মূর্তির সৃষ্টি করেছে | কোনোটা গনেশের মত, বাঘের থাবার মত, কিংবা শংখ বা অক্টোপাসের মত | এরপর গেলাম 'মাড ভলকানো' দেখতে | প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী হওয়া মাটির আগ্নেয়গিরি, যার মুখ থেকে সবসময় গরম কাদামাটি বেরোচ্ছে | এসব দেখে হোটেল ফিরতে সন্ধা হয়ে গেল |
পরেরদিন সকালে আমরা বেরিয়ে পরলাম 'জলিবয় আইসল্যান্ড' দেখতে | প্রসঙ্গত বলে রাখি এই আইসল্যান্ডটি বর্তমানে এশিয়ার মধ্যে সৌন্দর্যের জন্য প্রথম পুরস্কার পেয়েছে এবং পরিচ্ছন্নতার দিক থেকেও প্রশংসনীয় | সূর্যের প্রথম আলোয় আইসল্যান্ডটি নীল কাঁচের মত স্বচ্ছ | এই এলাকায় বেশ কিছু অঞ্চলে চোরাবালি এবং চড়া স্রোত আছে | সবচেয়ে বেশি প্রবল প্রাচীর রয়েছে আন্দামানের এই অংশটিতেই | সমুদ্রের জল যে এত স্বচ্ছ হতে পারে, সত্যিই অবিশ্বাস্য | দুপুরের খাওয়ার সেরে গেলাম অন্ডুর পার্ক | সমুদ্রের তীর সংলগ্ন ঝাউ গাছের ছায়ার নিচে এই পার্কটি | সারাদিন ক্লান্তির পর সামান্য বিশ্রাম নিলাম এইখানে | তারপর হোটেলে ফেরা | পরদিন আমাদের গন্থব্যস্থল রস আইসল্যান্ড | চারিদিক সমুদ্রে ঘেরা এই অঞ্চলটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২০০ মিটার উঁচু | পুরনো বাড়ির ধ্বংসাবশেষ ( জাপানি উপনিবেশের প্রাক্কালে তৈরী ), গীর্জার বিক্ষিপ্ত ভাঙ্গা অংশ, যুদ্ধের জন্য নির্মিত বাঙ্কার এখানে দেখতে পাওয়া যায় যদিও সবই এখন অবলুপ্তির পথে | চারিপাশে শুধুই নারকেল গাছ এবং গাছগুলির নিচে হাজারে হাজারে নারকেল | ওপরে টহল দিচ্ছে নজরদারি হেলিকপ্টার | বিকেলে গেলাম একটা মেরিন মিউজিয়ামে, নাম 'সামুদ্রিকা' | সেখানে সামুদ্রিক প্রাণী, মাছ, প্রবল, ঝিনুক, শংখ, শামুকের যত প্রজাতি হতে পারে সেগুলোর সব নমুনা রাখা ছিল |
তারপর গেলাম 'Zonal Anthropological Museum' | জারোয়াদের ছবি, তাদের ব্যবহৃত পোশাক, কৃত্রিম উপায়ে তৈরী তাদের নির্মিত বাড়ি ঘর, অস্ত্র, বাজনা, বাসন এরকম সবকিছুরই নমুনা ছিল সেখানে | সেখানে লেখা তথ্য থেকে জানতে পারলাম, জারোয়া ছাড়া এখানে মাইচেন, নিকসের মত অন্যান্য প্রজাতিও রয়েছে | সন্ধ্যে বেলায় হোটেল ফিরে এলাম | সেদিনই আন্দামানে কাটানো শেষ রাত্রি আমাদের | 
 পরদিন সকালে এয়ারপোর্ট পৌছে সাড়ে দশটার ফ্লাইটে বে অফ বেঙ্গলের অনন্ত জলরাশির ওপর দিয়ে সোজা দমদম এয়ারপোর্ট | যে সমুদ্র, বনাঞ্চল, রঙিন মাছ, প্রাণী, জারোয়া উপজাতি এতদিন টেলিভিশনে উপভোগ করেছি আজ তারা আরো সজীব আমার চোখে | যা স্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকবে |
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন