শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

লাস্ট ডেজ অফ পম্পেই

মূল লেখার লিংক
229549_10152178204510497_443837502_n
সারি সারি পাথর বসানো রাস্তা চলে গেছে নগরীর বুক চিরে, বেশ বড় বড় পাথর, মসৃণ তার পৃষ্ঠদেশ, কয়েক জায়গায় অগভীর খাজ মত, বোঝা যাচ্ছে কোন বিশেষ বাহনের অবিরাম চলাচলের ফলে কঠিন পাথরের বুক ক্ষয়ে এই চিহ্ন তৈরি হয়েছে চাকার ঘর্ষণে। কারা টানত সেই গাড়ী? হয়ত ঘোড়া, গাধা, গরু, খচ্চর বা মানুষ, মাত্র দুই হাজার বছর আগে! জি, ঠিকই পড়েছেন ২০০০ বছর আগেই এক সমৃদ্ধ রোমান জনপদ ছিল এলাকাটি, ছিল এক রমরমা বাণিজ্যকেন্দ্র! অদূরেই ভূমধ্যসাগর, বণিকেরা ভিড় করে আসত নানা দেশ থেকে, চলত পণ্যের বিকিকিনি, সবার বিনোদনের জন্য শহরে গড়ে তোলা হল রোমান স্টেডিয়াম বা অ্যারেনা, বিশাল সব কাজকারবার।
644137_10152209995330497_1939993477_n
487580_10152182184830497_2036609527_n
শহরটির এক দিকে অল্প দূরেই যেমন সমুদ্র, তেমনি অন্যদিকে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমায় এক সবুজ পাহাড়। অরণ্য, পাহাড়, সমুদ্র মিলিয়ে অনেকটা পুরাণের স্বর্গ স্বর্গ আবহ এলাকার নিসর্গে। কিন্তু একদিন সেই সবুজ পাহাড় জেগে উঠল ভীষণ ক্রোধে, ভিতরে জমে থাকা টন টন পাথর সে উগড়ে দিল চোখের নিমিষে, নিরীহ সবুজ পাহাড় রূপান্তরিত হল ইতিহাসের কুখ্যাততম আগ্নেয়গিরিতে, এই বিশেষ শহরটিসহ পাঁচটি শহর চলে গেলে আগ্নেয়গিরি লাভা, ছাই, বর্জ্যের নিচে, মৃত্যু ঘটল ১৬,০০০ মানুষের। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অমরত্ব পেল শহর এবং সেই ফুঁসে ওঠা আগ্নেয়গিরিটি, হয়ে থাকল এক অমোচনীয় কালো অধ্যায়, যুগে যুগে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের মুখে ছড়িয়ে গেল দুর্ভাগা এই নগরীর কথা, নাম যার পম্পেই। আর আগ্নেয়গিরিটির নাম ভিসুভিয়াস।
389418_10152189632830497_1641932056_n
ইতালি কেবলমাত্র একটি দেশ নয়, ইতালি একটি আলাদা গ্রহের মত! এই দেশে দেখার বস্তু এত বেশী আছে, সে হোক প্রাকৃতিক বা ঐতিহাসিক, এত ধরনের মানুষ আছে, যে বলা যায় ইতালি ভাল মত দেখতে উপলব্ধি করতে এক মানব জীবন যথেষ্ট নয়। এত শত শত দর্শনীয় স্থানের মাঝেও কিন্তু গত বছর সবচেয়ে বেশী সংখ্যক পর্যটক কিন্তু এসেছে এই ধ্বংসনগরীতেই, ২৬ লক্ষ! চলুন, আজ ঘুরে আসি বর্তমানের পম্পেই নগরী থেকে, সাথী অক্টোবরের বৃষ্টিহীন মিষ্টি রোদ।
285630_10152238643210497_13397174_n
ন্যাপোলী মহানগরী থেকে খানিক পরপরই ট্রেন ছাড়ে যা ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায় সবগুলো শহর হয়ে যায়, তবে এদের মাঝে সবচেয়ে বেশী বিখ্যাত নিঃসন্দেহে পম্পেই, তার পরপরই এরকোলানো। আধুনিক পম্পেই নগরী আবার গড়ে উঠেছে পুরাতন শহরকে ঘিরেই, যদিও অধিবাসীরা ভুলেই থাকেন আগ্নেয়গিরির পাদদেশে বাস করার বিপদের কথা, কিন্তু মাঝে মাঝে টেলিভিশনে ভিসুভিয়াসের উপরে নির্মিত তথ্যচিত্র দেখলে তাদের মনে শঙ্কা দেখা দেয়- কী হবে যদি পাগলা আবার ক্ষেপে ওঠে? কেউ জানে না সেই প্রশ্নের উত্তর।
ট্রেন ষ্টেশন থেকে বেরোতেই প্রাচীন পম্পেই-এর দিকে যাবার দিক নির্দেশনা চোখে পড়ল, মিনিট দুয়েক হাঁটলেই তার একাধিক প্রধান ফটকগুলির একটা দেখা যায়। সেখানে দিয়ে আরও শত শত পর্যটকদের সাথে শহরপ্রাচীরের ভিতরে ঢুকতেই যেন দুইটি হাজার বছর পিছিয়ে গেলাম এক নিমিষে। সারি সারি স্তম্ভ, পলেস্তারা খসে পড়া দেয়াল, লম্বা পাথরের রাস্তা চলে গেলে শহরের আরেক মাথা পর্যন্ত, দেবদেবীর মন্দির- শুধু মানুষ নেই, মানে সেই প্রাচীন মানুষগুলো নেই, এই সময়ে ট্যুরিস্টরা অবশ্য গমগম করছে সবখানেই, তাদের জ্বালাতে বরং ফাঁকা শহরের ছবি তোলা এক বিশাল ঝক্কি হয়ে দাঁড়াল।
409368_10152245861630497_1736474666_n
প্রথমেই ফোরাম নামে ফাঁকা জায়গাটি দেখা হল যেখানে শহরের জনসাধারণের সভা বা এই ধরনের অনুষ্ঠান হত, এখন সেখানে ইতস্তত দাঁড়ানো কিছু স্তম্ভ, আর আশেপাশের ছাদ ছাড়া বাড়ী বাদে এমন কিছু নেই, আর সেখানে দাঁড়ালেই চোখে আটকায় ভীমদর্শন ভিসুভিয়াসে, আসলে কেবল ফোরাম থেকেই না, সমগ্র পম্পেইয়ের সবখান থেকেই বিভীষিকাময় আগ্নেয়গিরিটি নজরে আসে। জানায় হয়ত মানুষদের সাবধানের থাকার আহ্বান।
404157_10152183295315497_1193041911_n
পম্পেই নগরীর অধিকাংশ ঘরেই অবশ্য প্রবেশের অনুমতি নেই, যেহেতু এখনো প্রত্নতত্ত্ববিদরা খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছেন, তাই খানিকটা দূরত্ব বজায় দেখেই দেখতে হয় সবকিছু। আবার কিছু কিছু এলাকার কাজ শেষ বিধায় বেশ আরামেই আগপাশতলা ঘুরে দেখার অনুমতি আছে। এমন এক ভবনে দেখা মিলল অপূর্ব রঙে রাঙানো কিছু দেয়াল চিত্র, পাকা রঙ দেখে মনে হচ্ছে যেন গত সপ্তাহেই কেউ তুলির পরশ বুলিয়ে গেছে।
561591_10152189968975497_245669193_n
8815_10152259241060497_1632393511_n
430076_10152181227690497_1521943489_n
ঘুনাক্ষরেও বোঝার উপায় নেই যে দু হাজার বছর আগে রঙ করা এই দেয়াল কয়েক মিটার লাভা আর ছাইয়ের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে ছিল শত শত বছর! এমন ধৈর্য্যশীল কাজের জন্য প্রত্ন তাত্ত্বিকদের প্রতি মাঠ আসলেই শ্রদ্ধায় নুইয়ে যায়, কিন্তু বিপরীত চিত্রটিও আছে। জনাব টনি নামে মূর্খ অসভ্য বর্বর এক লোক এই বিশ্ব সম্পদের গায়ে নিজের নাম লিখে রেখেছে দেয়াল আঁচড়ে!
602346_10152192356565497_1900037023_n
এই ভাবে নাম লিখলে কী কেউ অমর হতে পারে? মহাকালের বুকে নিজের নামকে অক্ষয় করে রাখা কি এতই সহজ? একই সাথে ঘৃণা এবং করুণা হল টনির প্রতি। বন্ধুরা, বাংলাদেশের অনেক পুরাকীর্তিতেও একই অবস্থা চোখে পড়েছে অনেক সময়, যদি আপনার সামনে কেউ এমন ক্ষতিকর কাজ করলে বুঝিয়ে বলবেন কেন এই কাজ করা উচিত নয়, বিশেষ করে আপনার শিশুটিকে এমন কাজ যে কত বড় অন্যায় সেটা অবশ্যই শিক্ষা দেবেন।
581418_10152189968490497_964858100_n
শহরের দেবরাজ জুপিটারের মন্দিরের পরে অ্যাপোলোর মন্দিরে যাওয়া হল, অনেকটা একই ধাঁচের সবখানেই, সারিসারি স্তম্ভ, ধসে পড়া ছাদ, ফাঁকা সবুজ জমি।
602346_10152184619315497_1457672560_n
1074_10152203714720497_591297080_n
এর মধ্যে হাউস অফ দ্য ফন নামের বিখ্যাত বাড়ীটির মাঝে ঢুকতেই উদ্যানের সাথে লাগানো ছোট একটি ঝর্ণার সামনে ফনের ভাস্কর্য দেখা গেল, যদিও এককালে কোন ধনী ব্যক্তির বিশাল বাড়ীটির মূল আকর্ষণ একটি অসাদাধারন মোজাইকের কাজ যেখানে সম্রাট আলেকজান্ডারের সাথে ইরানের সম্রাট দারিউসের যুদ্ধ দেখানো হয়েছে, মেঝেতে স্থাপিত বিশাল মোজাইকটির বেশ ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু ঘোড়ার পিঠে অবস্থানরত আলেকজান্ডারের মুখাবয়ব পরিষ্কার বোঝা যায়, শুনলাম ব্যাটল অফ ইসূস নামের এই মোজাইকটি আসলে একটি গ্রীক চিত্রকর্মের নকল, যদিও এর বয়স নেহাত কম নয়!
72083_10152179854265497_1965424750_n
তেমনই হাউজ অফ দ্য ট্র্যাজিক পয়েট বাড়ীর প্রবেশ পথে যেমন মোজাইকে খোদাই করা ভীষণ দর্শন কুকুর চোখে পড়ল, তেমন ভিতরে ছিল গ্রীক পুরাণের নানা চিত্র, কিন্তু নামটা কেন হাউজ অফ দ্য ট্র্যাজিক পয়েট তার অবশ্য সঠিক ব্যাখ্যা মেলে না। ধারণা করা হয় যেহেতু শিল্পকলা, পুরাণ নিয়ে আগ্রহ ছিল তাই হয়ত বাড়ীর মালিক কবি ছিলেন, আর কবি ছিলেন মানেই তার প্রতিভা ছিল, আবেগ ছিল কিন্তু অর্থ ছিল না, তাই ট্র্যাজিক! কী ভয়াবহ ভুল ধারণা সব যুগেই করা হয় কবিদের নিয়ে।
2048_10152189968335497_1412071708_n
চমৎকার রাস্তাগুলো বৃষ্টির জল নেমে যাবার জন্য সামান্য ঢালু করে তৈরি, সাথে ফুটপাতগুলোও। কিন্তু প্রায়ই রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা বিশাল সব পাথর দেখে স্বাভাবিক ভাবেই মনে কৌতূহলের উদয় হল, এগুলো কিসের জন্য?
546830_10152229553145497_622520721_n
197430_10152203714265497_94892006_n
উত্তর পাওয়া গেল চমকপ্রদ! এগুলো রাস্তা পারাপারের জন্য ব্যবহার হত, বিশেষ করে মহিলাদের জুতা বা পরনের কাপড় যেন নষ্ট না হয় তাই তারা এই ফেলে রাখা পাথরের উপরে পা দিয়েই রাস্তা পার হতেন। বৃষ্টির দিনে জল-কাদা মিলিয়ে নিশ্চয়ই অকথ্য অবস্থা হয়ে থাকত তখন, কিন্তু মূল রহস্যের সমাধান এইখানেই নয়, আসল ব্যাপার হচ্ছে পম্পেই নগরীতে স্যুয়েজ বা বর্জ্য নিষ্কাশনের কোন সুব্যবস্থা ছিল না, তাই জনসাধারণ রাস্তার উপরেই ময়লা ফেলে রাখত, তারপর শহর থেকে নিযুক্ত কেউ এসে ময়লা সরিয়ে নিয়ে যেত, কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না ময়লা ফেলার! যে কারণে দিনের বেলা একজনের ফেলা ময়লায় বেখেয়ালে আরেকজনের বেশভূষা নষ্ট হলে জরিমানার বিধান পর্যন্ত ছিল! এই পাথরগুলোর উপর দিয়ে বেড়ালেরাও যাতায়াত করত, এবং ঐতিহাসিকরা মনে করছেন পশুটানা গাড়ীও এর ফাঁক গলে অনায়াসে চলাচল করতে পারত।
602556_10152219160475497_1449033724_n
তবে পম্পেই নগরীতে টো টো করে ঘুরে মনে হল সবচেয়ে বেশী দেখলাম রান্নার ঘর, বেশ চমৎকার মোজাইকের কাজ করা, রান্নার পাত্র রাখার জন্য গোল গোল ছিদ্র, এমন অনেকবারই চোখে পড়ল। আসলে সরগরম এলাকাতে এমনই হবার কথা।
76235_10152189632730497_1389312683_n
485141_10152275513080497_1500725366_n
কিছু দোকানের সামনে তাদের ভাষায় লেখা আছে যে সেখানে কী মিলত, কোথায় বা চিহ্ন দিয়ে বোঝানো আছে যে সেটা কুমোরের দোকান, নাকি কামারের, নাকি শুঁড়িখানা! চোখ বন্ধ করতেই যেন ফিরে গেলাম সেই সময়ে- শাদা কাপড় পড়ে শহরের শাসনকর্তা চলেছে দম্ভ ভরে রাস্তা মাড়িয়ে, পেছেন সভাসদের দল, সাধারণ জনগণ ব্যস্ত হাটবাজার নিয়ে, বণিকের দল তদারকি করছে পণ্যমুল্যের। বলা হয় পম্পেই একমাত্র জনপদ যেটা থেকে আমরা সেই সুপ্রাচীন সময়ের জীবনধারার অধিকাংশই আঁচ করতে পারি।
559440_10152229552600497_1519363863_n
254334_10152207383030497_907484386_n
576381_10152207382780497_907796281_n
183506_10152184619395497_133877447_n
এত কিছু থাকার পরও পর্যটকদের কাছে পম্পেইয়ের মূল আকর্ষণ লাভা খুঁড়ে বাহির করে একটি লুপানার বা গণিকালয়, দেয়ালে নানা কামকলার ছবিসমৃদ্ধ লুপানারটিসহ পম্পেই কামকলার বেশ কিছু ছবি একবার পোস্ট করা হয়েছে বিধায় এযাত্রা এড়িয়ে গেলাম সেই প্রসঙ্গ। দশ হাজার লোকের পম্পেইতে ৩৫টি লুপানার ছিল মানে ৭১ পুরুষ প্রতি একটি লুপানার। বিজ্ঞানীরা কেবল এটুকু জানাতে পারছেন যে যৌনতা প্রাচীন পম্পেই নগরীতে কোন ঢাকগুড়গুড় বিষয় ছিল না। ( তবে ভেবে মজাও পেলাম যে বাইবেল এবং কোরান যারা রচনা করেছে তারা যদি পম্পেই নগরীর এই কামবহুল জীবনযাত্রা এবং ভিসুভিয়াসের আগুনে তাদের ধ্বংস হয়ে যাবার কথা জানত তাহলে ওল্ড টেস্টামেন্টে যেমন সদোম এবং গোমোরাহর কথা এসেছে অবধারিত ভাবে বাইবেল ও কোরানে পম্পেইয়ের কথা আসত এবং সেখানে থাকত মানুষের অসদাচরণ ও দয়ালু ঈশ্বরের ক্রোধের কথা! )
522887_10152234406905497_1798359265_n
দুঃখজনকভাবে পম্পেই নগরীর সবচেয়ে চমৎকার ভাবে সংরক্ষিত চিত্রকর্মগুলো নেপলস পুরাতত্ত্ব জাদুঘরে আছে, তেমন ভাবে এখানে অধিবাসী মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মৃতদেহগুলোর অধিকাংশই একই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। সেখানে যাওয়া হয়েছিল পম্পেই ভ্রমণের একদিন পরেই, কিন্তু সেই সংগ্রহশালা তেই বিশাল যে তার জন্য আলাদা পোস্ট দিলেই সুবিচার করা হবে মনে হচ্ছে। যদিও এখানেই দেখা মিলল কয়েকজন দুর্ভাগা পম্পেইবাসীর, প্রায় সকলেরই মুখ এবং চোখ হাত দিয়ে ঢাকা, মনে করা হয় বিষাক্ত গ্যাসের প্রকোপ থেকে নাক এবং চোখে বাঁচাতেই তারা এই পন্থা অবলম্বন করেছিল এবং এইভাবেই ভয়াল মৃত্যুবরণ করে।
150124_10152181227390497_328559027_n
কিন্তু আধুনিক গবেষণায় মনে করা হচ্ছে আগ্নেয়গিরি লাভা, ছাই, বিষাক্ত গ্যাস এগুলো আসার অনেক অনেক আগেই উত্তাপেই এই মানুষগুলি মারা গিয়েছিল, শহরের তাপমাত্রা তখন প্রায় ৩০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড ছোঁয়ার কথা, সেই উত্তাপে মানুষের বাঁচার কথা নয়। হয়ত উত্তাপ থেকে রক্ষা পেতেই তারা চোখ-মুখ ঢাকবার চেষ্টা করেছিল। কেবল একজনের মৃতদেহ দেখলাম যার মুখমণ্ডল পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল।
421335_10152178797090497_1335069908_n
কী করুণ একটা দৃশ্য! আমার মতই একজন মানুষ, দেখে মনে হয় পাথর কুঁদে তৈরি, একটু ঘুমিয়ে পড়েছে, জীয়ন কাঠির ছোঁয়া পেলেই জেগে উঠবে, কিন্তু তার বয়স ২০০০ বছর! অত আগে কী পরিমাণ আতংক এবং আকুতি নিয়ে পরপারে চলে গেছিল বেচারা! হয়ত ঘরে ফিরে এসেছিল বৌ-বাচ্চাকে সাথে নিয়ে যেতে, হয়ত অপেক্ষারত প্রেমিকা ছিল দুয়ারে, হয়ত বা সে ছিল কোন ভিনদেশী বণিক। কোন পরিচয়ই আজ আমাদের কাছে মুখ্য নয়, সে ভিসুভিয়াসের এক নির্মম শিকার, ব্যস, এটুকু জেনেই আমরা চলে যায় পরের দর্শনীয় বস্তুর সামনে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছাই এবং লাভার স্তর থেকে মানবদেহের এক কাস্টগুলো বাহির করা হয়েছে, ধারণা করা হয় উত্তাপে মারা যাবার পর, লাভা এসে পৌঁছানোর অনেক আগেই ছাই এবং বৃষ্টির জলের বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মৃতদেহগুলো অনেকটা শিলীভূত হতে গিয়েছিল, সেখান থেকে পরে আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদরা কাস্টগুলো তৈরি করেছেন।
522956_10152189632630497_1684256476_n
পম্পেই ইট-পাথরের মৃত নগরী হলেও সেখানে কিছু সবুজের ছোঁয়া আছে সবখানেই, বিশেষ করে প্রাচীন আবহ ফিরিয়ে আনা হয়েছে উদ্যানগুলোতে সেই সময়ের গাছরোপণ করেই, এছাড়া বড় গৃহগুলোর ভিতরের এক চিলতে বাগান তো আছেই।
561853_10152189968615497_213106425_n
সুযোগে তালাবদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেনে উকিও দেওয়া হয়ে গেল। সেই সাথে জানা গেল সেই আমলের জলসরবরাহ এবং সেচ ব্যবস্থা নিয়ে। প্রথম নদী থেকে, পড়ে কুয়া খুড়ে এবং শেষের দিকে পাহাড়ি ঝরনা থেকে তারা জলসরবরাহ বজায় রাখার চেষ্টা করত, ধনীদের বাড়ীতে জলসঞ্চয়ের বাহুল্যময় ব্যবস্থা ছিল বটে, কিন্তু সাধারণ জনগণ রাস্তার মোড়ে অবস্থিত কল থেকেই পানীয় এবং ব্যবহারে জল সংগ্রহ করত। তেমন কল থেকে আমরাও তৃষ্ণা নিবারন করলাম, যদিও কলটি একেবারে আধুনিক, কিন্তু সরবরাহ ব্যবস্থা সেই দুই হাজার বছরের পুরনো!
67125_10152189631045497_397054625_n
পম্পেই নগরীর জনসংখ্যা দশ হাজার হলেও ধারণা করা হয় ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুতপাতের সময় এখানে হাজার বিশেক লোক জমায়েত হয়েছিল, কারণ রোমানদের কাছে পম্পেই অবকাশকেন্দ্র হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, গড়ে উঠেছিল রোমান অ্যারেনা, গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ভাষণ সবই চলত এইখানে।
561743_10152302462570497_1516934909_n
483528_10152302462280497_1236777433_n
২৩ আগস্ট ছিল রোমানদের অগ্নিদেবতা ভুলকানালিয়ার উৎসবের দিন, দেবতাকে নৈবদ্য দেবার একদিন পরেই আগুনের রোষেই ধ্বংস হয়ে গেছিল পম্পেই নগরী। অবিশ্বাসে কি অসহায় মানুষগুলো শাপশাপান্ত করেছিল দেবতাদের, নাকি মেনে নিয়েছিল নিয়তির অমোঘ লিখন?
525035_10152182184960497_315004921_n
পরিশেষে বলতেই হয়- পম্পেই দর্শন নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, একই সাথে বর্তমান এবং অতীতের অভিজ্ঞতা হয় এখানে গেলে। বিমুগ্ধ হতে হয় প্রাচীন কালের শিল্পকলা, কারিগরিবিদ্যা, জীবনচর্চার নিদর্শন দেখে, একই সাথে দুঃখে মন ভরে ওঠে সেই দুঃখী মানুষগুলোর স্মরণে। বিশাল শহরটির অনেক গলিঘুপচির কথা এযাত্রা বাদ পড়ে গেল, বিশেষ করে নেপলসের জাদুঘরে সংরক্ষিত সেরা শিল্পনিদর্শনগুলোর বর্ণনা অন্য পোস্টে দেবার আশা রাখি।
546886_10152183294940497_447539518_n
( পম্পেইয়ের নাম প্রথম শুনেছিলাম সেবা প্রকাশনী অনুদিত লর্ড লিটনের লাস্ট ডেজ অফ পম্পেই বই থেকে, পোস্টটির নাম সেখান থেকেই ধার নিলাম।

ছবিব্লগঃ আল্পস থেকে ভিসুভিয়াস

মূল লেখার লিংক
DSC_2713
কাস্তেল দেল ওভো, নাপোলি
১।
তুরিন যাবো। শুধু তুরিনই নয়, যাবো নাপোলি, যাবো পম্পেই। চার বছরের ইতালিবাসের পরেও এই দুটো বৃহত্তম নগরী দেখা হলনা, এই আফসোসের মাত্রা আর দীর্ঘ না করার জন্য এই পরিকল্পনা। তিনদিনের সফরে আল্পসের সাদা পর্বত চুড়া থেকে ভিসুভিয়াসের গোড়ালি পর্যন্ত ভ্রমন। সাতশো এগারো কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হবে। টিকেট কেটে রেখেছি, দ্রুতগামী ট্রেন, ঘণ্টায় তিনশো কিলোমিটার গতি। বোলোনিয়া থেকে তুরিন দুঘণ্টায় পৌঁছে যাবো আর বোলোনিয়া থেকে নাপোলি তিন ঘণ্টা। তুরিনের উদ্দেশ্যে ভোরবেলা রওনা দিয়ে রাত্রে ফিরে আসব বোলোনিয়াতে আবার পরের দিন ভোরে বোলোনিয়া থেকে নাপোলির পথে যাত্রা। ইতালিতে বড়দিনের আশেপাশে টিকেট কাটলে বেশ সস্তায় তা পাওয়া যায় কারণ কেই বা বড়দিনেও ছুটে বেড়াবে ইতালির পথে পথে পর্যটক ছাড়া! তাই ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ ভোরে বাসা থেকে ক্যামেরার ব্যাগটি ঘাড়ে ঝুলিয়ে রওনা দিলাম তুরিনের পানে আর যথারীতি বেরুনোর সময় চাবির গোছা আর ক্যামেরার মেমোরি কার্ড রেখে এলাম বাসায়। চাবি ব্যাপার না, পরে রুমমেটদের কাছে পাওয়া যাবে, কিন্তু মেমোরি কার্ড এই ভোরে পাই কই, পেলাম স্টেশনের ভেতরের একটা দোকানে, দশ ইউরো গচ্চা দিয়ে! আল্পস পর্বত দেখতে যাই, এইসব ছোটখাটো ব্যাপার ধর্তব্যের মাঝে আনা যাবেনা বিধায় হক মাওলা!
আল্পস পর্বতের কোল জুড়ে বয়ে যাওয়া পো নদীর ধারে গড়ে উঠেছে তুরিন নগরী। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে রোমানরা এখানে একটি মিলিটারি ক্যাম্প নির্মাণ করেন। তারপর ধীরে ধীরে এখানে তাঁরা গড়ে তোলেন রোমান নগরী যার ছিটেফোঁটা আজও দৃশ্যমান। ইতালি যখন ১৮৬০ সালে রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তখন ১৮৬০ থেকে ১৮৬৪ এই পাঁচ বছর তুরিন ছিল ইতালির রাজধানী। তুরিন শিল্পাঞ্চল হিসেবে প্রখ্যাত। বিশেষ করে এখানে গড়ে উঠেছে বড়ো আকারের অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি। এইজন্য এই শহরকে ইতালির ডেট্রয়েটও বলা হয়ে থাকে। ইতালির ফিয়াত, লাঞ্চিয়া এবং আলফা রোমেও গাড়ির জন্ম স্থান ছাড়াও এইসব গাড়ি নির্মাতার প্রধান কারখানা রয়েছে এখানেই।তুরিন শহরে ইতালির সবচাইতে সফল ফুটবল ক্লাব ও ওল্ড লেডি হিসেবে পরিচিত জুভেন্টাস ফুটবল ক্লাবের অবস্থান। তুরিন শহরের জাদুঘরগুলির মধ্যে সবচাইতে খ্যাতিমান হচ্ছে ইজিপ্সিয়ান জাদুঘর, যেখানে কায়রো জাদুঘরের পরে সবচাইতে অধিক সংখ্যক দুর্লভ ইজিপ্সিয়ান নিদর্শন রক্ষিত আছে।
তুরিন যখন পৌঁছুলাম, যথারীতি মন খারাপ করা কুয়াশা, ধুসর আকাশ জুটল কপালে। ডিসেম্বরে বেড়ানোর এই এক ঝক্কি, অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া, হঠাৎ হঠাৎ করে শীতের নীল আকাশ উধাও। চরম বিরক্তি সহকারে আবহাওয়াকে দুয়ো দিতে দিতে নামলাম ষ্টেশনে। তুরিনের স্টেশনটা বিশাল তবে নির্মানাধীন বিধায় খাবারের দোকান টোকান নেই। পৌঁছুলাম সকাল দশটায়, নাস্তার জন্য চোঁ চোঁ করছে পেট। অবশেষে স্টেশন থেকে পড়িমরি করে একটা ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে গিললাম ব্রিয়শ সাথে প্রিয় কাফে এসপ্রেসো। তারপর হাঁটা ধরলাম। চিনিনা যেহেতু কিছুই, আর সাথে মানচিত্রও নেই, কাজেই পথচারীকে নগর কেন্দ্রের কথা জিজ্ঞেস করতেই উনি পথ দেখিয়ে দিলেন আর বললেন, “হাঁটুন সোজা পথে এক কিলোমিটার, পৌঁছে যাবেন!” ইতালিতে দেখেছি অনেক বড় শহরেই স্টেশন থেকে একটা বিশাল আকারের সড়ক নগর কেন্দ্রে গিয়ে পৌছায়। পর্যটকদের জন্য এইটা বেশ বড় একটা সুবিধে। আর পথচারী ইতালিয়ান হলে তাঁরা সাগ্রহে পথ চিনিয়ে দেয়, এর ব্যাতিক্রম আজ পর্যন্ত ছোট কিংবা বড়ো কোনও শহরেই দেখিনি। যাই হোক, ক্যামেরা বের করে পটাপট ছবি তুলতে থাকলাম। তুরিনের বাড়িঘরগুলো কেমন অন্যরকম। ইতালির অন্য সব শহরে যেমন রঙ বেরঙের বাড়ির দেখা মেলে, এখানে তেমন দেখলাম না, বেশীরভাগ বাড়িই সাদা কিংবা অফ সাদা আর সড়কের দুই ধারে বাড়িগুলোও প্রকাণ্ড কিসিমের। প্যারিসের কথা মনে পড়ে গেল। রাস্তার দুই পাশেই অনেক কৃত্রিম ঝর্ণা দেখলাম। সিংহের, বাঘের, মানুষের মুখ দিয়ে পানি বেরুচ্ছে, স্থাপনাগুলি যারপরনাই সুন্দর। এই ঝর্ণাগুলি রাত্রে আরও ভালো লাগে, রঙ বেরঙের আভায় সজ্জিত থাকে এগুলি। যাই হোক হাঁটাপথে আধ ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম নগরকেন্দ্রে। এত বিশাল কেন্দ্র দেখে তো মাথা পুরা ঘুরতে লাগলো। মাথা বেশী ঘোরার আগেই মাথা ঠিক করার জন্যে কাছেই দেখলাম একটা তথ্য অফিস, কিন্তু প্রচণ্ড ভিড় দেখে আর ঢোকার সাহস করলাম না। কেন্দ্রে চোখ ভরে দেখতে লাগলাম পালাজ্জো মাদামে আর পালাজ্জো রেয়ালে, দুই রাজবাড়ীর অবস্থানই কাছাকাছি, দুটোই চোখ ধাঁধানো সুন্দর আবার দুটোই জাদুঘর, ঢুকতে পয়সা লাগবে বিধায় বাদ, এর চাইতে ক্যামেরার শাটার টেপা ভালো। কিন্তু ভারি আবহাওয়া বলে ছবি তোলার কাজটা সন্ধ্যের জন্য মুলতবি ঘোষণা করে চললাম মোল আন্তোনেল্লিনার কাছে।
মোল আন্তোনেল্লিনা তুরিন নগরীর শোভা। এটি তুরিনের একটি ল্যান্ডমার্ক স্থাপনা। তুরিন এবং মোল অনেকটা প্যারিস আর আইফেল টাওয়ারের মতই একে অপরের পরিপূরক। এত উঁচু টাওয়ার ইউরোপেই বিরল। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮৬৩ সালে এবং শেষ হয় ১৮৮৯ সালে। এটি নির্মাণ করেন প্রখ্যাত স্থপতি আলেজান্দ্রো আন্তোনেল্লি আর তাঁরই নামানুসারে এটির নাম রাখা হয় মোল আন্তোনেল্লিনা। কেন্দ্র থেকে কাছে হওয়ায় হেঁটেই পৌঁছে গেলাম মোলের ভেতর। ১৬৭ মিটার উঁচু মোল আন্তোনেল্লিনা এখন ইতালির জাতীয় চলচ্চিত্র জাদুঘর। কালক্রমে এই টাওয়ার এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ জাদুঘর। চলচ্চিত্র সংক্রান্ত হেন জিনিষ নেই যা এখানে নেই, শুধু মুফতে সিনেমা দেখা ছাড়া। কিন্তু এখানে সময় খরচ করা যাবেনা আর তাছাড়া প্রবেশমূল্য ছয় ইউরো হওয়ায় ওখানে ঢোকার চাইতে মোলের ভেতর লিফটে করে এর চুড়ায় পৌঁছানোটা সহজ মনে করলাম। চার ইউরো খরচ করে উঠলাম মোলের শীর্ষে। এখানে থেকে দেখলাম আল্পসের সাদা সাদা পর্বত চুড়া, দেখলাম তুরিন নগরী। কিন্তু কুয়াশা দিয়ে ঢাকা ছিল বিধায় ভালমতন কিছুই দৃশ্যমান হলনা, অগত্যা কিছু ছবি তুলে রওনা দিলাম সুপেরগার পানে।
সুপেরগা হল তুরিন নগরীর কাছেই এক পাহাড়চূড়া যেখানে একটি প্রাচীন গির্জা রয়েছে আবার একই সাথে তুরিন নগরীর অসাধারন ল্যান্ডস্কেপ নাকি সেখান থেকেই দেখা যায় ভাল। কাজেই যেতে হবে সুপেরগা। কিন্তু যাব কিভাবে? ভরসা পেলাম মোলের নিচেই থাকা আরেক তথ্য কেন্দ্রে। ওরাই বলে দিল কোন বাসে যেতে হবে সেখানে, তবে বাস যাবে পাহাড়ের নীচ পর্যন্ত তারপর টয় ট্রেনে করে সুপেরগা। তাই সই। বাসে করে সুপেরগা স্টেশনে পৌঁছে টয় ট্রেনের জন্য নয় ইউরো দিয়ে টিকেট কেটে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সময়মতন ট্রেনে চেপে বসে একটু একটু করে ওপরে ওঠার সময় তুরিন শহরের অসাধারণ দৃশ্য দেখে বুঝলাম আমি একদম ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছি। সুপেরগার গির্জাটা অপূর্ব সুন্দর, এইটা বলতেই হবে। আর এখান থেকে তুরিন নগরী সহ আল্পসের যে দৃশ্য দেখলাম তা এক কথায় অতুলনীয়। যদিও পুরো শহর ছিল কুয়াশায় ঢাকা, তারপরেও আবছা তুরিন, আবছা পো নদী, অদৃশ্যপ্রায় মোল সাথে আল্পসের সাদা চুড়াগুলো মন কেড়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। বিশালাকার গির্জার শীর্ষে ওঠা যায়, তুরিনের প্যানোরামা নাকি আরও সুন্দর সেইখানেও। তিন ইউরো খরচ করে এক সরু সিঁড়ি বেয়ে ওঠা হল গির্জার শীর্ষে। এইবার আমার বাকরুদ্ধ হবার পালা। তুরিন নগরীর এত সুন্দর শোভা আর কোনভাবে দেখা হয়তো সম্ভব ছিলনা! একদম সুর রিয়েল এক অভিজ্ঞতা!
এইবার সময় এল তুরিনের রোমান অংশ দেখার। সুপেরগা থেকে আবার নগর কেন্দ্রে পৌঁছার বাস ধরলাম। তবে এইবার কেন্দ্র চিনতে একটু বেগ পেতে হল। বাসে উঠেছিলাম তো ঠিকঠাক তবে অচেনা শহরহেতু নামলাম কেন্দ্র থেকে খানিক দূরে, তাই হাঁটতে হল বেশ খানিকটা পথ। কারন আমি মূলত দেখব পোরতা পালাতিনে। তবে হেঁটে হেঁটে পরিশ্রান্ত এই দেহমনের সকল ক্লান্তি মুছে গেল তখন যখন পালাতিনের কাছে গিয়ে পৌছুলাম। হাল্কা রোদের সন্ধান মিলল অবশেষে আর রোমান টাওয়ার থেকে শুরু করে তাদের নির্মিত সকল স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ লাল রঙের হওয়ায় দেখলাম পুরো রোমান জোন যেন এক অপূর্ব রঙ ধারণ করেছে। আমার তুরিন নগরী আসার একটা অন্যতম কারণ ছিল এই পালাতিনে টাওয়ার। কারন এটিই হল রোমানদের নির্মিত সবচেয়ে প্রাচীন রক্ষণ স্তম্ভ এবং শহরে পৌঁছানোর দুয়ার। সময়ের ব্যাবধানে আশেপাশের সকল স্থাপনা ধ্বংসাবিশেষ হিসেবে পরিণত হলেও পোরতা পালাতিনে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতির সকল বাধা তুচ্ছ করে।
পোরতা পালাতিনের পাশেই নগর কেন্দ্রের মূল গির্জা অথবা দুয়োমো, যা দেখে একটু হতাশই হয়েছিলাম কেননা অন্য সব বড় শহরের দুয়োমোগুলি হয় এক একটি প্রকাণ্ড স্থাপনা, তুরিনের দুয়োমো তুলনামুলকভাবে অনেক ছোট মনে হল। আর স্থাপনা হিসেবে এমন আহামরি কিছু মনে হলনা। যাই হোক, সন্ধ্যে হয়ে এল, এইবার কেন্দ্রে ফেরার পালা। আর কেন্দ্রে আসতেই নগরীর আলোকসজ্জা দেখে চক্ষু এক্কেবারে ছানাবড়া হবার যোগাড়। এ যেন এক বিপুল ও বিচিত্র আয়োজন, একেক রাস্তায় একেক রকমের আলোকসজ্জা। কেন্দ্রে ব্যাপক মানুষের ভিড় দেখলাম। আর মাত্র দুইদিন পরেই নাতালে অথবা বড়দিন, তাই বোধহয় কেন্দ্র লোকে লোকারণ্য হয়ে রয়েছে। তুরিন নগরীর সবকিছুই দেখলাম সাজানো গোছানো, নিয়ন্ত্রিত, শৃঙ্খলিত। পরিপাটি, নিখুঁত ও পরিচ্ছন্ন। কোথায় কোনও গ্যাঞ্জাম কিংবা তাড়াহুড়ো দেখলাম না। বাসে করে স্টেশনে যাবার আগে মনের সাধ মিটিয়ে ছবি তুললাম আর শেষ বারের মতন দেখে নিলাম অপূর্ব তুরিন নগরী।
২।
নাপোলি যাবার আগ্রহ ছিল বরাবরই ষোল আনা, যেদিন থেকে ইতালিতে পা দিয়েছি। এতদিন না যাবার একটা বড় কারণ ছিল খরচ। বোলোনিয়া থেকে ওখানে যাবার জন্য নেই কোনও রায়ান এয়ার এর মতন সাশ্রয়ী উড়োজাহাজ, অতএব ট্রেন একমাত্র ভরসা। কিন্তু ট্রেন ভাড়াও এত বেশী যে ওই ভাড়ায় একই খরচে ইউরোপের যেকোনো বড় শহরে ঘুরে আসা যায়। তবে বড়দিনের ছুটি এবং বড়দিন উপলক্ষে একটা সাশ্রয়ী ট্রেন টিকেট পেয়ে সাথে সাথে যাবার জন্যে রেডি হয়ে গেলাম।
নাপোলিতে কি আছে এই প্রশ্নটি করার আগে কি নেই তা জানতে চাওয়া ভালো। নাপোলিতে পাহাড় আছে, পর্বত আছে, জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি আছে, সাগর আছে, বন্দর আছে, পিজ্জা আছে, মজাদার সব পেস্ট্রি আছে, মানুষের ভিড় আছে, কোলাহল আছে, উদ্দামতা আছে, উল্লাস আছে, কান্না আছে, দ্বন্দ্ব আছে। ট্রেন থেকে নেমে প্রথম এই শহরে পা দিলে কেমন চেনা এক বাতাবরনের কথা মনে হয়, মনে হয় অতি চেনা একটা জায়গায় এসে পড়েছি। ট্রাফিকের কোনও নিয়ম নীতি নেই, মানুষজন দেদারসে রাস্তা পার হচ্ছে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, যে যেভাবে পারছে এগিয়ে যাচ্ছে, এই শহরে যেন নিজেকে খুঁজে পেলাম, মনে হল আমি বুঝি এখানে অনাহুত নই। এই শহরের এক অদ্ভুত নিমন্ত্রনের সুর আছে, কতশত বাঙালি মুখ ঘুরে বেড়াচ্ছে, নোংরা কাদা দিয়ে ঘেরা চারপাশ, পিজ্জার দোকান থেকে দোকানি ডাকছে, বাড়িঘরের কার্নিশ থেকে রঙ বেরঙের জামাকাপড় শুকোনোর জন্য ঝুলছে। রাস্তায় দাঁড়ালেই পাহাড়ের দেখা মিলছে, দূর থেকে স্টিমারের ধ্বনি ভেসে আসছে- এ যেন এক বিচিত্র কোলাহল মুখর জায়গা, শব্দ-রঙ-দৃশ্য সবই এখানে ভিন্ন এক চিত্রের সন্ধান দেয়। কোথায় সেই তুরিনের নিপুন শৃঙ্খলা আর কোথায় এই বিশৃঙ্খল কিন্তু প্রানবৈচিত্রে ভরপুর নাপোলি!
নাপোলিতে রাত্রে থাকার বন্দোবস্ত পাকা করে এসেছি আগেই, হোটেলে থাকব এক রাত্রি, পরের দিন রাত্রিতে বোলোনিয়া ফেরা, এর মাঝে একটি পুরো দিন রেখেছি শুধু নগর কেন্দ্রে ঘোরাফেরার জন্য আর একটি দিন পম্পেই যাব বলে। সকাল সাতটায় বোলোনিয়া থেকে রওনা দিয়ে সকাল দশটায় নাপোলি স্টেশনে নেমে এত ভীড় দেখে ভিরমি খেয়েছি ঠিকই তবে সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি পেট সকালের নাস্তার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছে। কাজেই ঢুকে গেলাম স্টেশনের কাছেই একটি ক্যাফেটেরিয়ায়। সেখানে একটা ব্রিয়শ আর কাফে খেয়ে অমৃতের স্বাদ পেলাম যেন। দামও অনেক অনেক শস্তা, উত্তরের যে কোনও শহরের চাইতে। তারপর আধ ঘণ্টা ধরে চলল হোটেল খোঁজা, অবশেষে মিলে গেল আমার হোটেল। সেখানে লাগেজ রেখে রওনা দিলাম কেন্দ্রের দিকে, ট্রাম বাসের ব্যাবস্থা বুঝতে পারলাম না বিধায় দিলাম হাঁটা যা থাকে কপালে। তবে হাঁটতে গিয়ে দেখি বিপত্তির শেষ নেই, বড়দিনের আগে পুরো শহর একেবারে মানুষে পরিপূর্ণ। একে তো হাঁটা চলা কঠিন তার ওপর ট্রাফিক আইনের কিছুই বুঝতে পারছিনা, কিন্তু হন্টন থামালাম না। এগিয়ে যেতে থাকলাম গন্তব্যের দিকে, কেন্দ্রে যেতে হবে, আজ এটাই একমাত্র কাজ।
মেজাজ যথারীতি খারাপ চরম বাজে আবহাওয়ার কারণে, সেই একই কুয়াশা, রোদের দেখা নেই। তবে তাই বলে ক্যামেরার শাটার টেপা বন্ধ নেই। পুরো সড়কের দুই ধার জুড়ে বসে গেছে অস্থায়ী স্ট্রিট মার্কেট যার বেশিরভাগ বিক্রেতা আমাদের বাংলাদেশের, তারা মূলত বিক্রি করছেন খেলনা, টুপি, হাতব্যাগ এবং সান গ্লাস। এছাড়া পিতলের নানান আইটেম সাজিয়ে রেখেছেন অনেকে, অনেকে বিক্রি করছেন স্কার্ফ। সেইসব দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। অবশেষে পৌঁছুলাম ক্যাসেল দেল নুয়োভো তে। প্রকাণ্ড এক দুর্গ, দুর্গের ভেতর প্রবেশ মূল্য ৬ ইউরো। ঢুকলাম ভেতরে, একটু হতাশই হলাম, ভেবেছিলাম হয়ত দুর্গের মাথায় উঠতে দেবে, দিলে আমি নাপোলির বন্দরের একটা ভাল দৃশ্য পাব, সেই আশায় যেহেতু গুড়েবালি কাজেই সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে এলাম আর কেন্দ্রের দিকে হাঁটতে থাকলাম, এর মাঝে দেখা মিলল নাপোলির কেন্দ্রীয় থিয়েটার। হাঁটতে হাঁটতে আরেকটি জিনিস খেয়াল করলাম যে নাপোলির এই পুরনো অংশে সবকিছুই প্রকাণ্ড, প্রবল, বিশাল। পুরনো ভবনগুলি কেমন ছাল ওঠা, ইতালির অন্য শহরের মতন হয়ত নিয়মিত যত্ন নেয়া হয়না বলেও মনে হচ্ছিল। কেন্দ্রটাও মনে হল খানিক বিমর্ষ। যদিও এটি ব্যাপক জায়গা জুড়ে বিস্তৃত তবে মিলান কিংবা ফ্লোরেন্স এমনকি বোলোনিয়ার কেন্দ্রের চাইতেও কম আকর্ষণীয় মনে হয়েছে আমার। পালাজ্জো রেয়ালে আর দুয়োমোর মাঝে অনেক স্পেস থাকার কারণেও এমনটা মনে হতে পারে অবশ্য। আর রাতের আলোকসজ্জাও অনেকখানি মলিন এখানে। কেন্দ্রের মুল গির্জা অথবা দুয়োমোর স্থাপত্য অবশ্য চোখ জুড়ানো আবার তার ঠিক পেছনেই পাহাড় দারুণ একটা কনট্রাস্ট এনে দিয়েছে। কেন্দ্র ধরে আরেকটু এগিয়ে গেলে বন্দর, বন্দরে ভেড়ানো জেটি, ছোট নৌকো, অসাধারণ সুন্দর কাস্তেল দেল ওভো এবং দৃশ্যমান ভিসুভিয়াস। শহরের ঠিক এই প্রান্তে এসে নাপোলির সত্যিকারের সৌন্দর্য চোখ ভরে উপভোগ করা গেল। সারাদিনের সকল ধকল যেন এক লহমায় দূর হয়ে গেল। ওখানে একটি দোকানে দুর্দান্ত পিজ্জা খেয়ে দীর্ঘসময় সাগরপারেই কাটিয়ে দিয়ে রাত্রে ফিরে এলাম হোটেলে, সারাদিনের অবসাদে রাজ্যের ঘুম নেমে এল চোখে।
পরেরদিন ভোরে গোসল সেরে একটু চাঙ্গা হয়ে হোটেলের ব্রেকফাস্ট সেরে পম্পেই পানে রওনা দিলাম। বড়দিনে রাস্তাঘাটে তেমন মানুষ নেই, বাস-ট্রাম বন্ধ, কিন্তু পম্পেই যাবার ট্রেন চলবে, প্রথম ট্রেনটাই ধরলাম। ধীরে ধীরে ট্রেন ছুটে চলল পম্পেই এর দিকে আর সামনে দিগন্ত জুড়ে ভিসুভিয়াস। এ দৃশ্য মন থেকে মুছে ফেলা কঠিন। বড়দিন বলে কোনও রকম ভিড় নেই আর টিকেট বিক্রেতা দেখলাম অসম্ভব বিরক্ত। বড়দিনে ছুটি মেলেনি বলে রাজ্যের বিরক্ত পারলে আমার দিকে ছুঁড়ে মারে! পম্পেই এর সব দেখলাম একে একে অনেক সময় নিয়ে, পম্পেই নগরীতেই কেটে গেল সারাদিন। ভেবেছিলাম দ্রুত ফিরে আসব, অবাক হয়ে দেখলাম যে আমার নিজেরই সেখান থেকে আসতে ইচ্ছে করছিলনা। অতীতের নিঃশ্বাস থেকে বুঝি আমিও মুক্তি পাচ্ছিলাম না। ভিসুভিয়াসের কোলে নাপোলি এবং পম্পেই দর্শন সারা জীবনের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা হয়ে রইল।
তুরিনের ছবি।
ক) তুরিন শহরের আরকেড। এই আরকেড দেখলাম পুরো নগর জুড়েই বিস্তৃত।
DSC_2262
খ) একটি বাড়ির অন্দরমহলের চিত্র
DSC_2263
গ) আরকেদের ওপর সিলিঙে নানান কারুকাজ
DSC_2278
ঘ) তুরিনের তিপিকাল ভবন
DSC_2281
ঙ) পালাজ্জো মাদামে
DSC_2282
চ) মোল আন্তনেল্লিনা থেকে দেখা তুরিন নগরী
DSC_2313
ছ) সুপেরগা চার্চ
DSC_2337
জ) সুপেরগা চার্চের ভেতরে শীর্ষে ওঠার সিঁড়ি
DSC_2346
ঝ) সুপেরগা থেকে দেখা আল্পস পর্বত, তুরিন নগরী ও পো নদী
DSC_2356
ঞ) কুয়াশার চাদরে ঢাকা তুরিনের আঁকাবাঁকা পাহাড়
DSC_2351
ট) মোল আন্তনেল্লিনা
DSC_2400
ঠ) পোরতা পালাতিনে
DSC_2423
ড) দুয়োমো, তুরিন
DSC_2428
ঢ) পোরতা পালাতিনের পাশেই এই পালাজ্জো দেখেছি, নাম মনে নেই
DSC_2430
ণ) বড়দিনের অনন্য আলোকসজ্জা
DSC_2443
ত) শহর জোড়া আলোর মেলা
DSC_2463
থ) পালাজ্জো রেয়ালে
DSC_2450
দ) পালাজ্জো মাদামের একাংশ
DSC_2462
ধ) নগর কেন্দ্রের আরেকটি বিশালাকার ভবন, দূরে মোল।
DSC_2454
ন) সাঁঝবেলার রোমান নগরী
DSC_2432
প)পালাতিনের সামনে একটি ভাস্কর্য
DSC_2420
নাপোলির ছবিসমূহ
ক) কাস্তেল দেল নুয়োভো
DSC_2500
খ) কাস্তেল দেল নুয়োভোর ভেতরে একটি ঘরের সিলিং
DSC_2521
গ) কাস্তেল দেল নুয়োভো
DSC_2527
ঘ) পালাজ্জো তিয়েত্রো, নাপোলির কেন্দ্রীয় থিয়েটার
DSC_2552
ঙ) অনন্য গালেরিয়া উম্বেরতো
DSC_2554
চ) গালেরিয়া উম্বেরতোর ভেতর
DSC_2559
ছ)কাস্তেল দেল ওভোর জানালা দিয়ে দেখা নাপোলি নগরী
DSC_2618
জ)কাস্তেল দেল ওভো
DSC_2638
ঝ) নাপোলির কেন্দ্রে পালাজ্জো রেয়ালে
DSC_2658
ঞ) বন্দর নগরে সাগরপারের ভাস্কর্য
DSC_2721
ট) নাপোলি বন্দর
DSC_2725
ঠ) দুয়োমো অফ নাপোলি
DSC_2728
ড) কাস্তেল দেল ওভো
DSC_2704
ঢ) গালফ অফ নাপোলি
DSC_2711
ণ) নাপোলি শহরে ঢোকার একটি গেট
DSC_2734
ত) নাপোলি শহর
DSC_2920
থ) রঙ চটা নাপোলির গতানুগতিক ঘরবাড়ী
DSC_2924
দ) পাখির চোখে দেখা নাপোলি
DSC_2948
ধ) পিয়াজ্জা গারিবাল্দি
DSC_2952
ন) নাম না জানা একটি চার্চের ভেতর
DSC_2668
প) পুনশ্চ কাস্তেল দেল ওভো
DSC_2710
পম্পেই চিত্র
ক) সুপ্রভাত পম্পেই
DSC_2750
খ) পম্পেই ১
DSC_2741
গ) পম্পেই ২
DSC_2763
ঘ) পম্পেই ৩
DSC_2765
ঙ) পম্পেই ৪
DSC_2773
চ) পম্পেই ৫
DSC_2813
ছ) পম্পেই ৬
DSC_2811
জ) পম্পেই ৭
DSC_2862
ঝ) পম্পেই ৮
DSC_2862
ঞ) পম্পেই ৯
DSC_2779
ট) পম্পেই ১০
DSC_2864
ঠ) পম্পেই ১১
DSC_2892
ড) পম্পেই ১২
DSC_2893
ঢ) পম্পেই ১৪
DSC_2910
ণ) পম্পেই ১৫
DSC_2779