শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সাদা মানুষের দেশে

মূল লেখার লিংক
ক্যাক ক্যাক শব্দ করে কনভেয়ার বেল্ট চালু হলো। একে একে নানান রকম ব্যাগ আসছে। কিন্তু আমারটার হদিশ নেই। এর আগেও এমন হয়েছে, আমি পৌছে গেছি এক দেশে। আর আমার তল্পি-তল্পা আরেক দেশে। সেইসব স্মৃতি আর সম্ভাব্য দুর্ভোগের আশঙ্কায় বেশ টেনশিত বোধ করছি। আর তখনই খেয়াল করলাম, এই কনভেয়ারবেল্টটা অদ্ভুত। ঢাকার শাহজালাল, বা সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টের বেল্টগুলো ছোটো ছোটো রবারের ফালি দিয়ে তৈরি। এখানে, টরোন্টোতে, রবারের বদেল স্টেইনলেস স্টিল। অল্পকিছু ব্যাগ আসলেই বেল্ট ভরে যায়। তখন থামিয়ে দেয়। একটু ফাঁকা হলে নতুন ব্যাচের ব্যাগগুলো আসে। তখনই চিন্তাটা মাথায় এলো। সম্ভবত এই বেল্টটা এদেশেই বানানো। এদেরই কারো ডিজান করা। তাই অন্যরকম।দেশে হয়তো লিফ্টে উঠছি, এস্কেলেটর এ চাপছি, চালাচ্ছি কম্পিউটার অথবা চড়ছি সিএনজি। সব সময়ই মনে হয় জিনিসটা অন্যকেউ বানিয়েছে। আমরা কিনে এনেছি। একবার একটা ধান মাড়াইয়ের মেশিন দেখলাম। পা দিয়ে প্যাডেল করতে হয়। কে যেন বললো, এইটা আমাদের দেশেই উদ্ভাবিত। তারপর থেকেই যন্ত্রটা দেখলেই প্রাণটা ভর যেত। সেই উদ্ভাবককে চেনা হলো না, বলে আফসোস আছে আজো। রাস্তায়, নসিমন, ময়ুরী চলতে দেখে বা ইট ভাঙ্গার মেশিনের ঘড়ঘড় শুনে মাঝে মাঝে ভাবি, ভালোই তো বানিয়েছে রে! যদিও, এসব যন্ত্রে সেফটির বালাই নেই। আর ইঞ্জিনটা তো সেই বাইরে থেকেই কিনে আনা। যে সভ্যতায় বাস করি। তাতে কত কম অবদান আমাদের! মাঝে মধ্যে ভাবি, যদি কখনো জাতিসংঘ ট্রেডব্যান করে দেয়। তখন কী হবে? মধ্যযুগে ফিরে যাবো কি আবার? নবজাতকের ছয়টি রোগের টিকা কি আমরা বানাতে পারি? বা তা বানানোর সরঞ্জাম? যাক গিয়ে, মূল গল্পে ফিরি।
প্রথমবার কানাডা আসার কথা মনে আছে। একটা কনফারেন্সে অংশ নিতে যাচ্ছি। আমাদের ইন্স্টিটিউট থেকে যাচ্ছে আরো ছয়-সাত জন। সিংগাপুর থেকে সবাই একসাথে চেক ইন করছি। একে একে সবাই পার হয়ে গেল। আর আমার পাসপোর্টটা ফিরিয়ে দিয়ে কাউন্টারের মেয়েটা বললো, তোমার যাওয়া হবে না। সমস্যা আছে! আমি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এ দেখি, দুস্বপ্ন হলো সত্যি! খোঁজ নিতে জানা গেল। আমার ফ্লাইট যাবে হংকং হয়ে। কিন্তু, ওরা বাংলাদেশীদের পুরোপুরি মানুষ গণ্য করে না। কোনো প্লেনে যদি বাংলাদেশী কেউ থাকে তাহলে ঐ দেশে সেই প্লেন ল্যান্ড করাই নিষেধ। স্রেফ ট্রানজিট করতেও দেবে না। বাংলাদেশের ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট হোল্ডারদেরও নাকি হংকংএ ঢুকতে ভিসা/অনুমতি নেওয়া লাগে। আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছি। সঙ্গীদের বললাম তোরা না হয় যা। ওদের একজন গিয়ে, ততক্ষণে ম্যানেজার গোছের কারো সাথে কথা বলছে। আমি কানাডা যাচ্ছি শুনে সে বললো দেখি কী করা যায়। নথিপত্র ঘেটে বের করলো, যে কানাডা বা ইউএসএর ভ্যালিড ভিসা থাকলে বিশেষ ব্যবস্থায় নাকি ট্রান্সিট করা যেতে পারে। কারণ ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে। কানাডা বা আমেরিকার ভদ্রপল্লীতে।
তারপর সে নানান রকম হ্যাপা করে এক ব্যবস্থা করলো। বলে, হংকং এ নামার পরে আমাদের একজন তোমাকে নিয়ে নেক্সট প্লেনে বোর্ড করে দেবে। কিন্তু পুরোটা সময় তোমাকে এই ব্যাজটা পরে থাকতে হবে। একটা সবুজ রঙের ব্যজ ধরিয়ে দিলো হাতে। যাচ্ছিলাম, ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াটারলুর ইন্স্টিটিউট ফর কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এ। এই ফিল্ডের সবচেয়ে বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান। কত বিজ্ঞাণীর সাথে পরিচয় হবে, কাজ করার সুযোগ হবে আর পাশে আছে নায়াগ্রা জলপ্রপাত। এইসব নিয়ে জল্প্না কল্পনা ছাপিয়ে, লজ্জা অপমান আর হতাশার একটা মিশ্র অনুভূতি হতে লাগলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, নৎসী জার্মানি সহ ইউরোপের অনেক অংশে, ইহুদীদের মানুষ গন্য করতো না। বাইরে পাবলিক প্লেসে চলাফেরা করার জন্য তাদেরকে একটা ব্যাজ পরে ঘোরা লাগতো। যাকে বলা হতো ইয়োলো ব্যাজ। আমার ব্যাজটা অবশ্য হলুদ না, সবুজাভ। তারকাকার না, গোল চাকতির মত, তাতে লেখা MAAS। হংকং এ পৌছে সবাই নেমে গেল একদিক দিয়ে। আর আমাকে একজন কেবিন ক্রু, এক পিছনের দরজা দিয়ে, গলি-তস্যগলি ঘুরিয়ে নেক্সট প্লেনের বোর্ডিং রুমে ঢুকিয়ে দিলো।
সেবার নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখা হলো। মন্ট্রিয়ল ঘোরা হলো। IQC তে গিয়ে বিশ্বের সেরা সব পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করার সুযোগ হলো। কত অদ্ভুত যন্ত্রপাতি দেখলাম। শিখলাম। কিন্তু ঐ ব্যাজের ব্যাপারটা মাথা থেকে গেল না। নিজেকে এতটা ছোট হতে দিলাম… আজ ব্যাজ পরালো। কাল হলোকাস্ট শুরু করলেও ঠেকাতে পারবো কি?
এবার আসার সময় তাই হংকং হয়ে আসিনি। এলাম দক্ষিণ কোরিয়া হয়ে। কোনো সমস্যা হয়নি। স্রেফ দ্বিতীয়বার বোর্ডিং এর সময় সবাই যখন পাসপোর্ট আর বোর্ডিং কার্ড দেখিয়ে ঢুকে যাচ্ছে, আমার বেলায় একজন এক্সপার্টকে ডাকা হলো। এক্সপার্ট একটা বিশেষ অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে আমার পাসপোর্টে লাগানো কানাডার ভিসাটা নীরিক্ষা করলো কিছুক্ষণ। তারপর সবিনয়ে দেখিয়ে দিলো প্লেনে ওঠার পথ। স্রেফ ছোট্ট একটা পার্থক্য। শুধু আমার বেলায়। যেন পোলাইটলি বুঝিয়ে দেওয়া, “তুমি আর সবার সমান নও”।
এই লেখার শিরোনামটা দেখে হয়তো অনেকেরই ভ্রুকুঞ্চিত হয়েছে। আমি-ই তো বিরক্ত হতাম। মানুষের আবার সাদা-কালো কী? কিছু সাইন্সফিকশন গল্পে প্রথম মাত্রার অঞ্চল, দ্বিতীয় মাত্রার অঞ্চল, তৃতীয়, চতুর্থ… এমন অঞ্চলভাগ থাকে। দ্বিতীয় রা প্রথম অঞ্চলে যেতে পারে না। বা অনুন্নত তৃতীয় রা পারে না দ্বিতীয় অঞ্চলে যেতে। গল্পের খাতিরে অবশ্য, দুয়েকজন মাঝে মাঝে অন্য অঞ্চলে যায়। ঠিক যেমন আমি এখানে এলাম। গল্পের খাতিরে। পৃথিবীটা এত বড়, এত সুন্দর, কিন্তু আমরা, এই কালো আর বাদামি মানুষেরা আমাদের অনাহার, অশিক্ষা, আর অসহায়ত্ব নিয়ে, একটা অদৃশ্য গণ্ডিতে আটকা পড়েছি। এখানকার কোয়ান্টাম অ্যান্ড ন্যানো টেকনল্জি সেন্টারের বিল্ডিংটা সাইন্স ফিকশন সিনেমায় দেখা যে কোনো গবেষণাগারকেই হার মানায়। হাজারো মানুষ প্রকৃতির রহস্য নিয়ে মেতে আছে দিন রাত। সভ্যতাকে এগিয়ে নিচ্ছে পরবর্তী ধাপের দিকে। ওদের সাথে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মাতি আমিও। কিন্তু মাঝে মধ্যে, কোনো এক অলস মুহূর্তে। নিজেকে খুব বহিরাগত মনে হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন