শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

আসল চাপ নাম্বার ওয়ানের দেশ উরুগুয়ে

মূল লেখার লিংক

বঙ্গদেশের ইবনে বতুতা আমাদের সবার প্রিয় তারেক অনু ভাই কাজকাম ফেলে রেখে ঘুরে বেড়ায় দেশ-বিদেশ। মজার মজার আইটেম খায় আর তার বর্ণনা লিখে লাখো বাঙালির হৃদয়ে হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। গরুর মাংস নিয়ে তো হালে শুরু করেছেন এক নতুন সিরিজ, ব্রাজিলে গিয়ে খেলেন চুরাস্কো, আর্জেন্টিনার চাপকে তো দিয়েই দিলেন নাম্বার ওয়ান সার্টিফিকেট! কথা সত্য হতেও পারে, তবে আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে যা বলার জন্যই এই পোষ্ট।
ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার মত বৃহৎ আয়তনের দুই দেশের চিপায় বিশ্ব মানচিত্রের একটু আড়ালে থাকা ছোট্ট দেশ উরুগুয়েতে গিয়েছিলাম। গর্বের সাথে এরা বলে “পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা গোমাংসের দেশ হিসেবে উরুগুয়ে আজও প্রথম স্থানে, বিফ স্টেকের লড়াইয়ে আমাদের হারাতে পারে এমন কোনও দেশ নেই” । উরুগুয়ের মানুষ আর্জেন্টিনার দাদাগিরি খুব একটা পছন্দ করেনা। অনেকটা বাংলাদেশের একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর ভারত বিরোধী মানসিকতার মতন। আর্জেন্টিনার জনগনের সাথে ভাষার মিল থাকা সত্ত্বেও আমি দেখেছি পর্তুগীজভাষী ব্রাজিলীয় পর্যটকদের প্রতি এরা বেশী বন্ধুভাবাপন্ন। বিশ্বফুটবলে যেমন আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল চরম শত্রু ঠিক তেমনি কোপা আমেরিকাতে উরুগুয়ে আর আর্জেন্টিনার শিরোপার লড়াই। গরুর মাংস নিয়েও ব্যাপারটা একই। দুই দেশই বলে আমি সেরা, একজনের আছে সারাবিশ্বে সুপরিচিতি আর অন্যজন বলে আমি ছোট দেশ হতে পারি কিন্তু আমার আছে ঐতিহ্য। উরুগুয়ের জাতীয় প্রতীক কিন্তু সেই ঐতিহ্যবাহী গরুর মাংস-শিল্পের সাক্ষ্য দেয়।

উরুগুয়েতে মানুষ আছে ৩ মিলিয়ন আর গরুর সংখ্যা ১২ মিলিয়ন। তাজ্জব ব্যাপার। দুনিয়াতে আর কোনও দেশ নেই যেখানে মাথাপিছু ৪ টি গরু আছে। ১ লক্ষ ৭৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের উরুগুয়ের ৬০% ভুমি সারাবছর পশুপালনের জন্য ব্যাবহৃত হয়। একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “ভাই এত খালি তৃণভূমি পড়ে আছে, ধান-গম কিছু ফলাও না কেন?” জবাব শুনে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ “উরুগুয়েতে যে পরিমান ধান হয় তার ২০% দিয়েই দেশের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়, এর থেকে ভালো ঘাস ফলানো আর গরু চড়ানো!” একজন তো আরও এক কাঠি সরস, নির্দ্বিধায় বলে বসল “উরুগুয়েতে প্রতিটি গরুর জন্য বরাদ্দ আছে দুইটি ফুটবল মাঠের সমপরিমান চারণভূমি”।
বেশিরভাগ গরুর ফার্ম পারিবারিক মালিকানায় চালিত। শ্রমিক সল্পতার কারণে বহুজাতিক মাংস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলি উরুগুয়েতে আসতে চায়না। একবার গিয়েছিলাম রাজধানী মন্তেভিদেওর একটু বাইরে এক ওয়াইন প্রস্তুতকারী ফার্মে। মালিকপক্ষের সাথে আলাপ করে বুঝলাম শ্রমিকপক্ষকে বেশ তোয়াজ করে চলতে হয়, একজন রাগের মাথায় চাকরী ছেড়ে দিলে বিকল্প আরেকজন পাওয়া এত সোজা না! মাত্র ৩৩ লক্ষ মানুষ দিয়ে এরা দেশ চালায় ক্যামনে?
পশুপালনের জন্য সারাবছর জুড়েই থাকে চমৎকার আবহাওয়া। খোঁয়াড় জিনিসটা কি তা জানেনা এই দেশের গরু, খোলা আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ চারণভূমিতে দিনরাত কাটিয়ে দেয়। প্রধান এবং একমাত্র খাদ্য সবুজ ঘাস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাটেল ফুড চেনেনা এরা। সারাদিন হেঁটেহেঁটে ঘাস খাওয়ার কারণে মাংসে চর্বির পরিমাণও তুলনামুলকভাবে অনেক কম। খুঁটিতে বাঁধা কোনও মহেশকে দেখিনি আমি! উরুগুয়ের আইন অনুযায়ি একটি গরুকে খেতে হবে শুধুই ঘাস, দেহবৃদ্ধির জন্য দেয়া যাবেনা কোনও হরমোন। বহুজাতিক কোম্পানিগুলি বেশ নাখোশ এই নিয়মে। পাশের দেশ আর্জেন্টিনায় কিন্তু খামারগুলি এই নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা না। তাই আর্জেন্টিনায় চুটিয়ে ব্যবসা করছে মাংস রপ্তানিকারকরা, বহুজাতিক কর্পোরেট ধান্ধায় ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ছে ছোট খামারিরা।
গড়ে মাথাপিছু বছরে ৫৮ কিলো গোমাংস ভক্ষন করে এই দেশের মানুষ! তারপরও উরুগুয়ের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস গরুর মাংস! এই দেশের জীবনযাত্রার সব কিছুতেই যেন জড়িয়ে আছে এদের গো-মাংস শিল্প। আমরা যেমনটা প্রতিদিন বলি আজ ভাতের সাথে কি খাবো? এরা জিজ্ঞেস করবে আজ মাংসের সাথে কি খাবো? আর মাংস বলতেও তো সেই গরু, দামেও বেশ সস্তা। প্রতিবছর যে ৩ মিলিয়নের কাছাকাছি পর্যটক আসে তারাও একবার হানা দিবেই রাজধানীর পোর্ট মার্কেটে। আসাদো অর্থাৎ আগুনে পোড়ানো গ্রিলড মাংসের সেরা সমাহার বসে সেই পোর্ট মার্কেটে। প্রতিদিন মধ্যাহ্নভোজে গমগম করে উঠে এর ভিতরের পরিবেশ। কি নেই তাতে? গরুর শরীরের চামড়া আর শিং বাদে এমন কোনও অংশ নেই যা গ্রিল হয়না। চুরাস্ক, চোরিসো সসেজ, ব্লাড সসেজ, বিফস্টেক আরও কত কি…… ফিক্সড রেট, যত খুশি তত খান! একটি স্মরণীয় দিন কাটিয়েছি মন্তেভিদেওর সেই পোর্ট মার্কেটে!

সেরা বিফস্টেক খেতে হলে কিন্তু যেতে হবে রাজধানীর বাইরে। হাইওয়ের পাশে থাকা খামারবাড়িতে মিলবে স্বাদে অতুলনীয় উরুগুয়ের সেরা মাংসের মেন্যু। এই খামারব্যবসায়ীদের মূল ক্রেতাই উরুগুয়ের বাইরে থেকে আসা পর্যটকেরা। নিজেদের মালিকানার বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে পালিত গরুর মাংস পরিবেশিত হয় রেড ওয়াইন সহকারে। উরুগুয়ের পূর্বপ্রান্তের কলোনিয়া দেল সান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্তের পুন্তা দেল এস্ত পর্যন্ত ঘুরে বেরিয়েছি আমি। হাইওয়ের পাশের দৃশ্য বড়ই মনোরম, মাইলের পর মাইল তৃণভূমি আর অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে গরুর পাল।

রাস্তার পাশের বিলবোর্ডে ঝলসানো আগুনে পোড়ানো চাপের ছবি দিয়ে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে খামার মালিকেরা। সারাদিন পরিবার নিয়ে কাটানোর আর সাথে ভূরিভোজনের উৎকৃষ্ট স্থান হল এই খামারবাড়ি। আমি গিয়েছিলাম লা পাতাইয়্যা নামের এক খামারবাড়িতে, সেতো মন্তেভিদেও থেকে অনেক দূর। বিফস্টেক এই জীবনে আর না খেলেও চলবে, জিভের জল এখনও শুখায়নি!


আমার যেটা মনে হয় গো-মাংসের কথা বাদ দিলেও শুধুমাত্র উরুগুয়ে নামে যে একটি দেশ আছে বা থাকলেও সেটি কোথায় তা বিশ্বের অনেকে জানেনা। আমাদের বাংলাদেশটা যেমন বিশাল দেশ ভারতের ছায়ায় লুকিয়ে থাকে বিশ্বমানচিত্রে ঠিক তেমনি উরুগুয়ে হারিয়ে যায় বৃহৎ আয়তনের দুই প্রতিবেশী ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার চিপায়। বাঙালিকে যেমন রেস্টুরেন্ট খুলে শুধুমাত্র ব্যবসার খাতিরে নাম দিতে হয় ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট তেমনি উরুগুয়ের গরুর মাংসের সুনাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পরতে পারেনা বহুজাতিক মাংস ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন