মূল লেখার লিংক

পাঠান মুলুক মানেই, আফগানিস্তান।আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল। এক সময় ‘কাবুলিওয়ালারা’ আমাদের দেশে ব্যবসা করতে আসতো। পেস্তা, বাদাম, কাজুবাদাম,কিসমিস, আখরোট, নানা রকমের রঙ্গিন মুল্যবান পাথরের। যা অলঙ্গকারে ব্যবহৃত হতো।
যুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত এই দেশটি।কখনো রাশিয়া, কখোনো আমেরিকার দখলে।খনিজ সম্পদে ভরপুর এই দেশটি। পর্যটকের ভীড় নেই বললেই চলে। বিধ্বস্ত অর্থনীতি। সেই সাথে রাজনৈতিক অবস্থাও অস্থিতিশীল।
যুদ্ধকালীন সময়ে অধিকাংশ নাগরিকই বিদেশে পাড়ি জমায়। তারা বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছে। এখন অনেকেই দেশে ফিরছে। কিছুটা স্থিতিশীল দেশটাও।
জাতিসংঘের তত্বাবধানে বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কাজ চলছে এখন। বাড়ী-ঘর, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সবই ছিল বিধ্বস্ত। জাতিসংঘের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে আমার হাসবেন্ড সাত বছর আফগানিস্তানে ছিলেন। তিনি পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনীয়ার। সেই সুবাদে আমি অতি সাহসিকতার পরিচয় দিতে এক মাসের জন্য আফগানিস্তান গিয়েছিলাম। সৌভাগ্যবশতঃ আফগানদের প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় আমার। তারই কিছু ছবি তুলেছিলাম।
সেখান থেকে কিছু ছবি শেয়ার করলাম।

প্রথম দেখা কাবুল

ছাত্রীরা স্কুলের পথে

আফগান গোত্রের সর্দারগন

অতিথীকে প্রথম আপ্যায়ন। চা, বাদাম ও কিসমিস দিয়ে।
আফগানরা অতিথী আপ্যায়নে বিশেষ এক ধরনের পাত্র ব্যবহার করে, এতে সাজানো থাকে কাঠবাদাম, পেস্তা, আখরোট, কিসমিস,চকলেট সাথে চিনি বিহীন লাল চা। চা পরিবেশনার শেষ নেই। এক কাপ শেষ হবার আগেই ঐ কাপে আবারো চা ঢেলে দেওয়া হবে।

ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন। আফগানরা এ ভাবেই মেঝেতে বসে খাবার খায়।


আফগান পরিবারের মহিলা সদস্য

বিধ্বস্ত রাজপ্রাসাদ

বিধ্বস্ত রানীমহল

মোগল সম্রাট বাবরের কবর। কাবুলের বাগ-এ-বাবর-এ অবস্থিত। বাবরের অন্তিম ইচ্ছায় তাঁকে কাবুলে সমাহিত করা হয়। তাঁর প্রথম স্ত্রী ছিলেন আফগানি।
আফগানিস্তানের প্রকৃতি

আফগান প্রকৃতি অনেকটা বৈরীই বলা যায়। পাথরের পাহাড়, মরুভুমি, ফসলী জমি সবই আছে। পাহাড়ে কোন রকমের গাছ দেখা যায় না বললেই চলে।
আফগানিস্তানের আয়তন ৬,৪৭,৫০০ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা তিন কোটি। প্রচুর খালি সমভুমি পড়ে আছে, তা রেখে কেন যে ওরা গাদাগাদি করে পাহাড়ে উপর বাস করে, তা আমার মাথায় আসে না। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন, একটার উপর আরেকটা মাচের বক্স সাজানো আছে।
আফগানদের প্রধান খাবার রুটি। সেই রুটির সাইজ মাশ আল্লাহ্ জীবনেও ভুলবো না। দৈর্ঘে তিন ফুট হবে, প্রস্থে দেড় ফুট হবে আর ঊচ্চতা এক ইঞ্চি। আমাদের দেশে তন্দুর রুটি যেমন চুলায় বানায়, চেমনি চুলায় বানানো। সাধারনতঃ সবাই ওই রুটি কিনেই খায়। যখন কিনে নিয়ে যায়, সে এক আরেক দৃশ্য- কাঁধে করে নিয়ে যেতে হয়। আমি যে গেষ্ট হাউসে ছিলাম, সেটা অফিসের গেষ্ট হাউস। দুপুরে সব অফিস স্টাফরা ওখানেই খেত। আমি এক পাঠান ড্রাইভারকে ওই রুটি দুইটা খেতে দেখছি সাথে বড় এক ডিস সবজি। যেখানে আমি দুপুরে ছয় ভাগের এক ভাগ খেতে পেরেছি। ওখানে মাছ খুব কমই পাওয়া যায়। ভেড়া, দুম্বা, গরু, খাশী সব কিছুর গোশতই পাওয়া যায়। এক কেজি গোশত প্রায় দশ লিটার পানি দিয়ে রান্না করে, মানে ঝোল রাখে। ওরা ওই তরকারীটাকে বলে “সুরুয়া।” বাটি ভর্তি সুরুয়া আর খুব বেশি হলে দু’টুকরো গোশত নিয়ে তাতে রুটি ভিজিয়ে খায়। আমিও খেয়েছি, মজাই লাগে। আফগানরা তৈলাক্ত খাবার বেশী খায়, ভীষণ পরিশ্রমী আর পাহাড় বেয়ে উঠতে হয় বলে, হয়তোবা সেটা বার্ন হয়ে যায়।আশেপাশের দেশ থেকে ভাল বাসমতি চালও আসে, ওরা বিরিয়ানীও পছন্দ করে। ভেড়া বা দুম্বার গোশতে প্রচুর চর্বি হয়, সেটা ওরা খুব পছন্দ করে খায়।
নানা রকমের ফলের চাষ হয় এখানে। অসম্ভব মিষ্টি সব ফল। আপেল বা আঙ্গুরের কথা না হয় বাদই দিলাম। খারবুজা নামে একটা ফল হয়, যা আমাদের দেশের ফুটি বা বাঙ্গির মত। প্রায় তরমুজের মতই রসালো এবং দারুন মিষ্টি। আর বাদামেরতো কথাই নেই। কত প্রজাতির বাদাম যে ওই দেশে চাষ হয় তার ইয়ত্তা নেই। সব্জিও চাষ হয়, তবে তা সীমিত।
আর চাষ হয় পপি। পপির ফল থেকে হেরোইন তৈরী হয়। কি ভাবে তা বানানো হয় সেটা আমি বলতে পারছি না। মুলতঃ তা পাচার হয় আমেরিকাতেই। আমেরিকানদের ধ্বংস করবার এটাও এক ষড়যন্ত্র।
শীতের সময় তুষারে আবৃত হয় সিংহ ভাগ অঞ্চল। মাঝে মাঝে তুষার ঝড়ও হয়। আবার মরু ঝড়ও দেখা যায়।
পাহাড় আর মরুভুমিতে ঘেরা বলেই হয়তোবা পানির অভাব ওই দেশে। পানির স্তর অনেক নিচে। তবে আল্লাহ্র রহমতে, পাহাড় বেয়ে ঝরনা নামে। সেই পানিই সুপেয়, একেবারে ডিসটিলড্ ওয়াটার। দু’একটা জায়গায় পাহাড়ী ঝরনা দেখা যায়, যার পানি রঙ্গীন। খাওয়া যায়। স্বাদ একেবারে কোমল পানীয় কোকের মত। অবিশ্বাস্য!!! সুবহান আল্লাহ্। মনে পড়ে, সূরা আর রাহ্মানের সেই ক’টা লাইন,” তোমরা বিধাতার কোন নিয়ামতকে অস্বিকার করবে।”( ফাবিয়াইয়ে আ’লা এ রব্বেকুমা তুকাজ্জেবান)।
আফগানিস্তানে এখন গাড়ী কিনতে কোন ট্যাক্স দিতে হয় না, আমেরিকা শাষিত বলেই হয়তোবা। আমাদের দেশে যেখানে ২০০%, ৩০০% ট্যাক্স দিতে হয়। বিভিন্ন ধরনের ব্র্যান্ডের গাড়ী ওখানে পাওয়া যায়। আমি দেখেছি, সাধারন টাউন সার্ভিসের গাড়ী মার্সিডিসের বাস। তারপরও পাহাড়ী অঞ্চলে এখনো চলছে ঘোড়া, গাধা। চলছে মানুষ, বইছে বোঝা। মরুভূমিতীতে চলে উট।
ওদের জাতীয় খেলার নাম,” বুচ কাশি”। খেলোয়াররা সব ঘোড়-সওয়ারী। মেশের চামড়ার ভিতর খর ঢুকিয়ে একটা আকৃতি বানায়। তারপর সেটা নিয়ে চললো খেলোয়ার, কোন একটা গোলপোষ্টে সেটা প্রবেশ করাতে হবে। এভাবেই খেলা এগিয়ে চলে। উটের যুদ্ধও ওদের একটা প্রিয় খেলা।
পাহাড়ী নদীগুলোতে যখন পানি থাকে না, তখন মনে হয় যেন পাথরের নদী। আর যখন পানি আসে, প্রবল খরোস্রোতা।
এখনো মাঝে মাঝে দেখা যায়, তালেবানদের তান্ডবের দৃশ্য। এখানে ওখানে পরিত্যক্ত পোড়া গাড়ী, বিকল ট্যাংক, দেয়ালে অজস্র বুলেটের চিহ্ন। তালেবানদের গেরিলা আক্রমন এখনও আছে। সব আমেরিকা বিরোধী। আফগানদেরও সরকারী চাকুরী করতে দেবে না তালেবানরা। আমি যখন ছিলাম, তখন একটা সিডি বেরিয়েছিল। কয়েকজন আফগান পুলিশ সদস্যকে তালেবানরা ধরে নিয়ে গেছে। তাদের সবাইকে জবাই করে, ধরের বুকের উপর মাথাটা রেখে দিয়েছে। সেই দৃশ্য ভিডিও করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। তাতে হুমকী দেয়া হয়েছে, “কেউ যদি আমেরিকার অধীনে চাকুরী করে তাদেরো এই দশা হবে”। কী হিংস্র, নরপিশাচ এরা!!! আমার হাসবেন্ড এই সিডি টা দেখেছিলেন। আমি সইতে পারব না বলে, আমাকে দেখান নি। সাধারন আফগানরা তালেবান বিরোধী। তারা শান্তি চায়।
আফগান প্রকৃতির কিছু ছবি এখানে পোষ্ট করলামঃ-

পাহাড়ী নদির ভিতরে অতিথীশালা

নদি পারাপার (রোপ ওয়ে)

পাহাড়ী নদি



পাহাড়ী নদি
দুর্গম পাহাড়

দুর্গম পাহাড়

দুর্গম পাহাড়

দুর্গম পাহাড়

বিলুপ্ত সভ্যতা

নিষিদ্ধ পপি চাষ



লড়াকু উট

লড়াকু ঘোড়া

জাতীয় খেলা – “বুচ কাশি”




দুর্গম যাত্রা



তুষারে আবৃত গোলাপ

শীতের প্রকৃতি

তুষার ঝড়





প্রাকৃতিক কোল

মরু জাহাজ




ভার বহনকারী গাধা


সবুজ আভা

সবুজ আভা

সবুজের আভা

পিপাসা নিবারন

ফুলেল স্নিগ্ধতা – (আলু বোখারা)

সূর্যস্নাত বরফ ঢাকা রাজপথ
ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ


ঐতিহাসিক ঘটনাবলিতেও আফগানিস্তানের জুরি নেই। এর আগে মোঘল সম্রাট বাবরের কবরের ছবি দিয়েছিলাম।
আজ বলছি, সাহসী যোদ্ধা রুস্তমকে নিয়ে। আমি যা জানি, তাই লিখছি। ভুল শুধরে দেবার দায়িত্ব আপনাদের। আমাদের দেশে ” রুস্তম পালোয়ান” বলে এই গল্পটি প্রচলিত আছে।
সোহরাব, রুস্তম কাহিনী একটি পারস্য উপাখ্যান। এটি একটি পিতা-পূত্রের সম্মুখ যুদ্ধের কাহিনী। রুস্তমের সন্তান সোহরাব। রুস্তম একজন সাহসী যোদ্ধা। তার পূত্র সোহরাবের যখন জন্ম হয়, তখন তিনি ছিলেন যুদ্ধের ময়দানে। তার স্ত্রী পত্র মারফত জানিয়েছিলেন, তাদের একটি কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছে। জানা যায়, কারন হিসেবে তার প্রিয়তমা স্ত্রী বলেছিলেন, তার প্রিয় জীবন সঙ্গী রুস্তমকে তিনি ছোট করে দেখতে চান না। আমি জানি না কেন তিনি এটা করেছিলেন। রুস্তমের আরেক স্ত্রী ছিলেন তাহমিনা।
এদিকে সোহরাব বড় হতে থাকে। সোহরাব জানে তার পিতা কে। পিতা পুত্রের দেখা নেই। বড় হয়ে, সে তার মাকে ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। অল্প সময়েই অধিক বীরত্ব দেখিয়ে সে অনেক সুনাম অর্জন করে এবং সেনাবাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হয়। তার বীরত্ব, তার বাবা রুস্তমকেও ছাড়িয়ে যায়। তার মৃত্যুর পুর্ব পর্যন্ত, সে ছিল পারস্য সেনাবাহিনীর মৃত্যুভয়হীন সাহসী যোদ্ধা।
সোহরাব ও রুস্তম জীবনে তিনবার মিলিত হয়েছিলেন, যুদ্ধের ময়দানে। প্রথমবার যুদ্ধে সোহরাব জয়ী হয়ে তার বাবাকে ক্ষমা করে দেন। দ্বিতীয় বারও পরাজিত বাবাকে ক্ষমা করে দেন। তৃতীয় বারে দুর্ভাগ্যবশতঃ সোহরাব মারাত্বকভাবে আহত হয়ে মারা যান। মৃতপ্রায় সোহরাব বর্ণনা করেন তার পরাজয়ের কারন, বাবা রুস্তমকে তিনি তার মায়ের দেওয়া তাবিজ দেখান। রুস্তম তারই সীলমহোর দেওয়া তাবিজ দেখে বুঝতে পারেন সোহরাব তার সন্তান, আর তিনি তার ঔরসজাত সন্তানকে হত্যা করেছেন !!তিনি গভীর শোকে, দুঃখে নিজেকে বারবার আঘাত করতে থাকেন। তার তাবু, আসবাবপত্র সব কিছু পুড়িয়ে ফেলে, তার সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে আসেন সিস্তানে !!
সেই রুস্তম পালোয়ানের বাড়ী এখনও আছে আফগানিস্তানে। কালের গহ্বরে এখন তা বিলুপ্ত প্রায়। তাহমিনার বাবার বাড়ীটিও এখন বিলুপ্তির পথে।
লাইলী-মজনুর প্রেমের কাহিনী আমরা কম-বেশী সবাই জানি। আফগানিস্তানের এক মরুভূমীতে দু’জনেরই কবর আছে। সেই মরুভূমীর নাম ” দাস্ত-এ-লাইলী “। সেই কবরের ছবি আমার তোলা ছিল, কিন্তু অতি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আমি তা যে কোথায় হারিয়েছি !!!!
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’ যারা পড়েছেন, তারা সবাই ‘কারগা’ ও ‘পাঘমান’ জায়গা দু’টির সাথে পরিচিত। কারগায় একটি লেক আছে, চারিদিকে পাহাড় ঘেরা। আফগানিস্তানে খাবার পানির অভাব, আগেও বলেছি। আফগানিস্তান যখন, রাশিয়া শাষিত ছিল, তখন এই কারগা লেক থেকে পানি সরবরাহের জন্য, লেকটিকে আধুনিকায়ন করা হয়। চারিদিকের পাহাড়ের বরফ গলে কারগা লেক-এ আসতো, সে পানি পাম্প মেশিনের মাধ্যমে কাবুল শহরে সরবরাহ করা হতো। কারগা লেক এখনও কাবুল শহরে পানি সবরাহের প্রধান উৎস।
আফগানদের যে কোন আনন্দ অনুষ্ঠানেই তারা নাচ-গান করে। পুরুষ-মহিলা পৃথক পৃথক ভাবে নাচে। মেয়েদের নাচের অনুষ্ঠানে পুরুষদের যাওয়া নিষেধ।
এ সবেরই কিছু ছবি পোষ্ট করলামঃ-

বর্ণনা-তখ্ত-ই-রুস্তম

তখ্ত-ই-রুস্তম

নিরাপত্তা পরিখা

পরিখা পারাপারের সেতু। এই বাড়ীতে রুস্তম নিরাপত্তার কারণে রাত্রি যাপন করতেন।

গুহা রাজপ্রাসাদ-তাহমিনার বাড়ী

মীনা বাজার। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই মহিলা। প্রধানতঃ তাহমিনার জন্যই প্রতিষ্ঠিত।

মীনা বাজারের দেয়ালচিত্র

পাঘমান স্কয়ার। এটা পাঘমান জেলা সদরে অবস্থিত।

পাঘমান স্কয়ার

কারগা লেক

পর্যটকদের জন্য নতুন সাজে কারগা লেক

কারগা লেক-পর্যটন কটেজ

কারগা লেক ফুলে ফুলে সজ্জিত

কারগা বাঁধ-পানি বিশুদ্ধকরন কাঠামো, বর্তমানে অকেজো


নাচ-আফগান পুরুষদের অন্যতম বিনোদন

পাঠান মুলুক মানেই, আফগানিস্তান।আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল। এক সময় ‘কাবুলিওয়ালারা’ আমাদের দেশে ব্যবসা করতে আসতো। পেস্তা, বাদাম, কাজুবাদাম,কিসমিস, আখরোট, নানা রকমের রঙ্গিন মুল্যবান পাথরের। যা অলঙ্গকারে ব্যবহৃত হতো।
যুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত এই দেশটি।কখনো রাশিয়া, কখোনো আমেরিকার দখলে।খনিজ সম্পদে ভরপুর এই দেশটি। পর্যটকের ভীড় নেই বললেই চলে। বিধ্বস্ত অর্থনীতি। সেই সাথে রাজনৈতিক অবস্থাও অস্থিতিশীল।
যুদ্ধকালীন সময়ে অধিকাংশ নাগরিকই বিদেশে পাড়ি জমায়। তারা বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছে। এখন অনেকেই দেশে ফিরছে। কিছুটা স্থিতিশীল দেশটাও।
জাতিসংঘের তত্বাবধানে বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কাজ চলছে এখন। বাড়ী-ঘর, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সবই ছিল বিধ্বস্ত। জাতিসংঘের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে আমার হাসবেন্ড সাত বছর আফগানিস্তানে ছিলেন। তিনি পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনীয়ার। সেই সুবাদে আমি অতি সাহসিকতার পরিচয় দিতে এক মাসের জন্য আফগানিস্তান গিয়েছিলাম। সৌভাগ্যবশতঃ আফগানদের প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় আমার। তারই কিছু ছবি তুলেছিলাম।
সেখান থেকে কিছু ছবি শেয়ার করলাম।

প্রথম দেখা কাবুল

ছাত্রীরা স্কুলের পথে

আফগান গোত্রের সর্দারগন

অতিথীকে প্রথম আপ্যায়ন। চা, বাদাম ও কিসমিস দিয়ে।
আফগানরা অতিথী আপ্যায়নে বিশেষ এক ধরনের পাত্র ব্যবহার করে, এতে সাজানো থাকে কাঠবাদাম, পেস্তা, আখরোট, কিসমিস,চকলেট সাথে চিনি বিহীন লাল চা। চা পরিবেশনার শেষ নেই। এক কাপ শেষ হবার আগেই ঐ কাপে আবারো চা ঢেলে দেওয়া হবে।

ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন। আফগানরা এ ভাবেই মেঝেতে বসে খাবার খায়।


আফগান পরিবারের মহিলা সদস্য

বিধ্বস্ত রাজপ্রাসাদ

বিধ্বস্ত রানীমহল

মোগল সম্রাট বাবরের কবর। কাবুলের বাগ-এ-বাবর-এ অবস্থিত। বাবরের অন্তিম ইচ্ছায় তাঁকে কাবুলে সমাহিত করা হয়। তাঁর প্রথম স্ত্রী ছিলেন আফগানি।
আফগানিস্তানের প্রকৃতি

আফগান প্রকৃতি অনেকটা বৈরীই বলা যায়। পাথরের পাহাড়, মরুভুমি, ফসলী জমি সবই আছে। পাহাড়ে কোন রকমের গাছ দেখা যায় না বললেই চলে।
আফগানিস্তানের আয়তন ৬,৪৭,৫০০ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা তিন কোটি। প্রচুর খালি সমভুমি পড়ে আছে, তা রেখে কেন যে ওরা গাদাগাদি করে পাহাড়ে উপর বাস করে, তা আমার মাথায় আসে না। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন, একটার উপর আরেকটা মাচের বক্স সাজানো আছে।
আফগানদের প্রধান খাবার রুটি। সেই রুটির সাইজ মাশ আল্লাহ্ জীবনেও ভুলবো না। দৈর্ঘে তিন ফুট হবে, প্রস্থে দেড় ফুট হবে আর ঊচ্চতা এক ইঞ্চি। আমাদের দেশে তন্দুর রুটি যেমন চুলায় বানায়, চেমনি চুলায় বানানো। সাধারনতঃ সবাই ওই রুটি কিনেই খায়। যখন কিনে নিয়ে যায়, সে এক আরেক দৃশ্য- কাঁধে করে নিয়ে যেতে হয়। আমি যে গেষ্ট হাউসে ছিলাম, সেটা অফিসের গেষ্ট হাউস। দুপুরে সব অফিস স্টাফরা ওখানেই খেত। আমি এক পাঠান ড্রাইভারকে ওই রুটি দুইটা খেতে দেখছি সাথে বড় এক ডিস সবজি। যেখানে আমি দুপুরে ছয় ভাগের এক ভাগ খেতে পেরেছি। ওখানে মাছ খুব কমই পাওয়া যায়। ভেড়া, দুম্বা, গরু, খাশী সব কিছুর গোশতই পাওয়া যায়। এক কেজি গোশত প্রায় দশ লিটার পানি দিয়ে রান্না করে, মানে ঝোল রাখে। ওরা ওই তরকারীটাকে বলে “সুরুয়া।” বাটি ভর্তি সুরুয়া আর খুব বেশি হলে দু’টুকরো গোশত নিয়ে তাতে রুটি ভিজিয়ে খায়। আমিও খেয়েছি, মজাই লাগে। আফগানরা তৈলাক্ত খাবার বেশী খায়, ভীষণ পরিশ্রমী আর পাহাড় বেয়ে উঠতে হয় বলে, হয়তোবা সেটা বার্ন হয়ে যায়।আশেপাশের দেশ থেকে ভাল বাসমতি চালও আসে, ওরা বিরিয়ানীও পছন্দ করে। ভেড়া বা দুম্বার গোশতে প্রচুর চর্বি হয়, সেটা ওরা খুব পছন্দ করে খায়।
নানা রকমের ফলের চাষ হয় এখানে। অসম্ভব মিষ্টি সব ফল। আপেল বা আঙ্গুরের কথা না হয় বাদই দিলাম। খারবুজা নামে একটা ফল হয়, যা আমাদের দেশের ফুটি বা বাঙ্গির মত। প্রায় তরমুজের মতই রসালো এবং দারুন মিষ্টি। আর বাদামেরতো কথাই নেই। কত প্রজাতির বাদাম যে ওই দেশে চাষ হয় তার ইয়ত্তা নেই। সব্জিও চাষ হয়, তবে তা সীমিত।
আর চাষ হয় পপি। পপির ফল থেকে হেরোইন তৈরী হয়। কি ভাবে তা বানানো হয় সেটা আমি বলতে পারছি না। মুলতঃ তা পাচার হয় আমেরিকাতেই। আমেরিকানদের ধ্বংস করবার এটাও এক ষড়যন্ত্র।
শীতের সময় তুষারে আবৃত হয় সিংহ ভাগ অঞ্চল। মাঝে মাঝে তুষার ঝড়ও হয়। আবার মরু ঝড়ও দেখা যায়।
পাহাড় আর মরুভুমিতে ঘেরা বলেই হয়তোবা পানির অভাব ওই দেশে। পানির স্তর অনেক নিচে। তবে আল্লাহ্র রহমতে, পাহাড় বেয়ে ঝরনা নামে। সেই পানিই সুপেয়, একেবারে ডিসটিলড্ ওয়াটার। দু’একটা জায়গায় পাহাড়ী ঝরনা দেখা যায়, যার পানি রঙ্গীন। খাওয়া যায়। স্বাদ একেবারে কোমল পানীয় কোকের মত। অবিশ্বাস্য!!! সুবহান আল্লাহ্। মনে পড়ে, সূরা আর রাহ্মানের সেই ক’টা লাইন,” তোমরা বিধাতার কোন নিয়ামতকে অস্বিকার করবে।”( ফাবিয়াইয়ে আ’লা এ রব্বেকুমা তুকাজ্জেবান)।
আফগানিস্তানে এখন গাড়ী কিনতে কোন ট্যাক্স দিতে হয় না, আমেরিকা শাষিত বলেই হয়তোবা। আমাদের দেশে যেখানে ২০০%, ৩০০% ট্যাক্স দিতে হয়। বিভিন্ন ধরনের ব্র্যান্ডের গাড়ী ওখানে পাওয়া যায়। আমি দেখেছি, সাধারন টাউন সার্ভিসের গাড়ী মার্সিডিসের বাস। তারপরও পাহাড়ী অঞ্চলে এখনো চলছে ঘোড়া, গাধা। চলছে মানুষ, বইছে বোঝা। মরুভূমিতীতে চলে উট।
ওদের জাতীয় খেলার নাম,” বুচ কাশি”। খেলোয়াররা সব ঘোড়-সওয়ারী। মেশের চামড়ার ভিতর খর ঢুকিয়ে একটা আকৃতি বানায়। তারপর সেটা নিয়ে চললো খেলোয়ার, কোন একটা গোলপোষ্টে সেটা প্রবেশ করাতে হবে। এভাবেই খেলা এগিয়ে চলে। উটের যুদ্ধও ওদের একটা প্রিয় খেলা।
পাহাড়ী নদীগুলোতে যখন পানি থাকে না, তখন মনে হয় যেন পাথরের নদী। আর যখন পানি আসে, প্রবল খরোস্রোতা।
এখনো মাঝে মাঝে দেখা যায়, তালেবানদের তান্ডবের দৃশ্য। এখানে ওখানে পরিত্যক্ত পোড়া গাড়ী, বিকল ট্যাংক, দেয়ালে অজস্র বুলেটের চিহ্ন। তালেবানদের গেরিলা আক্রমন এখনও আছে। সব আমেরিকা বিরোধী। আফগানদেরও সরকারী চাকুরী করতে দেবে না তালেবানরা। আমি যখন ছিলাম, তখন একটা সিডি বেরিয়েছিল। কয়েকজন আফগান পুলিশ সদস্যকে তালেবানরা ধরে নিয়ে গেছে। তাদের সবাইকে জবাই করে, ধরের বুকের উপর মাথাটা রেখে দিয়েছে। সেই দৃশ্য ভিডিও করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। তাতে হুমকী দেয়া হয়েছে, “কেউ যদি আমেরিকার অধীনে চাকুরী করে তাদেরো এই দশা হবে”। কী হিংস্র, নরপিশাচ এরা!!! আমার হাসবেন্ড এই সিডি টা দেখেছিলেন। আমি সইতে পারব না বলে, আমাকে দেখান নি। সাধারন আফগানরা তালেবান বিরোধী। তারা শান্তি চায়।
আফগান প্রকৃতির কিছু ছবি এখানে পোষ্ট করলামঃ-

পাহাড়ী নদির ভিতরে অতিথীশালা

নদি পারাপার (রোপ ওয়ে)

পাহাড়ী নদি



পাহাড়ী নদি

দুর্গম পাহাড়

দুর্গম পাহাড়

দুর্গম পাহাড়

দুর্গম পাহাড়

বিলুপ্ত সভ্যতা

নিষিদ্ধ পপি চাষ



লড়াকু উট

লড়াকু ঘোড়া

জাতীয় খেলা – “বুচ কাশি”




দুর্গম যাত্রা



তুষারে আবৃত গোলাপ

শীতের প্রকৃতি

তুষার ঝড়





প্রাকৃতিক কোল

মরু জাহাজ




ভার বহনকারী গাধা


সবুজ আভা

সবুজ আভা

সবুজের আভা

পিপাসা নিবারন

ফুলেল স্নিগ্ধতা – (আলু বোখারা)

সূর্যস্নাত বরফ ঢাকা রাজপথ
ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ


ঐতিহাসিক ঘটনাবলিতেও আফগানিস্তানের জুরি নেই। এর আগে মোঘল সম্রাট বাবরের কবরের ছবি দিয়েছিলাম।
আজ বলছি, সাহসী যোদ্ধা রুস্তমকে নিয়ে। আমি যা জানি, তাই লিখছি। ভুল শুধরে দেবার দায়িত্ব আপনাদের। আমাদের দেশে ” রুস্তম পালোয়ান” বলে এই গল্পটি প্রচলিত আছে।
সোহরাব, রুস্তম কাহিনী একটি পারস্য উপাখ্যান। এটি একটি পিতা-পূত্রের সম্মুখ যুদ্ধের কাহিনী। রুস্তমের সন্তান সোহরাব। রুস্তম একজন সাহসী যোদ্ধা। তার পূত্র সোহরাবের যখন জন্ম হয়, তখন তিনি ছিলেন যুদ্ধের ময়দানে। তার স্ত্রী পত্র মারফত জানিয়েছিলেন, তাদের একটি কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছে। জানা যায়, কারন হিসেবে তার প্রিয়তমা স্ত্রী বলেছিলেন, তার প্রিয় জীবন সঙ্গী রুস্তমকে তিনি ছোট করে দেখতে চান না। আমি জানি না কেন তিনি এটা করেছিলেন। রুস্তমের আরেক স্ত্রী ছিলেন তাহমিনা।
এদিকে সোহরাব বড় হতে থাকে। সোহরাব জানে তার পিতা কে। পিতা পুত্রের দেখা নেই। বড় হয়ে, সে তার মাকে ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। অল্প সময়েই অধিক বীরত্ব দেখিয়ে সে অনেক সুনাম অর্জন করে এবং সেনাবাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হয়। তার বীরত্ব, তার বাবা রুস্তমকেও ছাড়িয়ে যায়। তার মৃত্যুর পুর্ব পর্যন্ত, সে ছিল পারস্য সেনাবাহিনীর মৃত্যুভয়হীন সাহসী যোদ্ধা।
সোহরাব ও রুস্তম জীবনে তিনবার মিলিত হয়েছিলেন, যুদ্ধের ময়দানে। প্রথমবার যুদ্ধে সোহরাব জয়ী হয়ে তার বাবাকে ক্ষমা করে দেন। দ্বিতীয় বারও পরাজিত বাবাকে ক্ষমা করে দেন। তৃতীয় বারে দুর্ভাগ্যবশতঃ সোহরাব মারাত্বকভাবে আহত হয়ে মারা যান। মৃতপ্রায় সোহরাব বর্ণনা করেন তার পরাজয়ের কারন, বাবা রুস্তমকে তিনি তার মায়ের দেওয়া তাবিজ দেখান। রুস্তম তারই সীলমহোর দেওয়া তাবিজ দেখে বুঝতে পারেন সোহরাব তার সন্তান, আর তিনি তার ঔরসজাত সন্তানকে হত্যা করেছেন !!তিনি গভীর শোকে, দুঃখে নিজেকে বারবার আঘাত করতে থাকেন। তার তাবু, আসবাবপত্র সব কিছু পুড়িয়ে ফেলে, তার সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে আসেন সিস্তানে !!
সেই রুস্তম পালোয়ানের বাড়ী এখনও আছে আফগানিস্তানে। কালের গহ্বরে এখন তা বিলুপ্ত প্রায়। তাহমিনার বাবার বাড়ীটিও এখন বিলুপ্তির পথে।
লাইলী-মজনুর প্রেমের কাহিনী আমরা কম-বেশী সবাই জানি। আফগানিস্তানের এক মরুভূমীতে দু’জনেরই কবর আছে। সেই মরুভূমীর নাম ” দাস্ত-এ-লাইলী “। সেই কবরের ছবি আমার তোলা ছিল, কিন্তু অতি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আমি তা যে কোথায় হারিয়েছি !!!!
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’ যারা পড়েছেন, তারা সবাই ‘কারগা’ ও ‘পাঘমান’ জায়গা দু’টির সাথে পরিচিত। কারগায় একটি লেক আছে, চারিদিকে পাহাড় ঘেরা। আফগানিস্তানে খাবার পানির অভাব, আগেও বলেছি। আফগানিস্তান যখন, রাশিয়া শাষিত ছিল, তখন এই কারগা লেক থেকে পানি সরবরাহের জন্য, লেকটিকে আধুনিকায়ন করা হয়। চারিদিকের পাহাড়ের বরফ গলে কারগা লেক-এ আসতো, সে পানি পাম্প মেশিনের মাধ্যমে কাবুল শহরে সরবরাহ করা হতো। কারগা লেক এখনও কাবুল শহরে পানি সবরাহের প্রধান উৎস।
আফগানদের যে কোন আনন্দ অনুষ্ঠানেই তারা নাচ-গান করে। পুরুষ-মহিলা পৃথক পৃথক ভাবে নাচে। মেয়েদের নাচের অনুষ্ঠানে পুরুষদের যাওয়া নিষেধ।
এ সবেরই কিছু ছবি পোষ্ট করলামঃ-

বর্ণনা-তখ্ত-ই-রুস্তম

তখ্ত-ই-রুস্তম

নিরাপত্তা পরিখা

পরিখা পারাপারের সেতু। এই বাড়ীতে রুস্তম নিরাপত্তার কারণে রাত্রি যাপন করতেন।

গুহা রাজপ্রাসাদ-তাহমিনার বাড়ী

মীনা বাজার। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই মহিলা। প্রধানতঃ তাহমিনার জন্যই প্রতিষ্ঠিত।

মীনা বাজারের দেয়ালচিত্র

পাঘমান স্কয়ার। এটা পাঘমান জেলা সদরে অবস্থিত।

পাঘমান স্কয়ার

কারগা লেক

পর্যটকদের জন্য নতুন সাজে কারগা লেক

কারগা লেক-পর্যটন কটেজ

কারগা লেক ফুলে ফুলে সজ্জিত

কারগা বাঁধ-পানি বিশুদ্ধকরন কাঠামো, বর্তমানে অকেজো


নাচ-আফগান পুরুষদের অন্যতম বিনোদন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন