মূল লেখার লিংক

সারি সারি পাথর বসানো রাস্তা চলে গেছে নগরীর বুক চিরে, বেশ বড় বড় পাথর, মসৃণ তার পৃষ্ঠদেশ, কয়েক জায়গায় অগভীর খাজ মত, বোঝা যাচ্ছে কোন বিশেষ বাহনের অবিরাম চলাচলের ফলে কঠিন পাথরের বুক ক্ষয়ে এই চিহ্ন তৈরি হয়েছে চাকার ঘর্ষণে। কারা টানত সেই গাড়ী? হয়ত ঘোড়া, গাধা, গরু, খচ্চর বা মানুষ, মাত্র দুই হাজার বছর আগে! জি, ঠিকই পড়েছেন ২০০০ বছর আগেই এক সমৃদ্ধ রোমান জনপদ ছিল এলাকাটি, ছিল এক রমরমা বাণিজ্যকেন্দ্র! অদূরেই ভূমধ্যসাগর, বণিকেরা ভিড় করে আসত নানা দেশ থেকে, চলত পণ্যের বিকিকিনি, সবার বিনোদনের জন্য শহরে গড়ে তোলা হল রোমান স্টেডিয়াম বা অ্যারেনা, বিশাল সব কাজকারবার।


শহরটির এক দিকে অল্প দূরেই যেমন সমুদ্র, তেমনি অন্যদিকে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমায় এক সবুজ পাহাড়। অরণ্য, পাহাড়, সমুদ্র মিলিয়ে অনেকটা পুরাণের স্বর্গ স্বর্গ আবহ এলাকার নিসর্গে। কিন্তু একদিন সেই সবুজ পাহাড় জেগে উঠল ভীষণ ক্রোধে, ভিতরে জমে থাকা টন টন পাথর সে উগড়ে দিল চোখের নিমিষে, নিরীহ সবুজ পাহাড় রূপান্তরিত হল ইতিহাসের কুখ্যাততম আগ্নেয়গিরিতে, এই বিশেষ শহরটিসহ পাঁচটি শহর চলে গেলে আগ্নেয়গিরি লাভা, ছাই, বর্জ্যের নিচে, মৃত্যু ঘটল ১৬,০০০ মানুষের। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অমরত্ব পেল শহর এবং সেই ফুঁসে ওঠা আগ্নেয়গিরিটি, হয়ে থাকল এক অমোচনীয় কালো অধ্যায়, যুগে যুগে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের মুখে ছড়িয়ে গেল দুর্ভাগা এই নগরীর কথা, নাম যার পম্পেই। আর আগ্নেয়গিরিটির নাম ভিসুভিয়াস।

ইতালি কেবলমাত্র একটি দেশ নয়, ইতালি একটি আলাদা গ্রহের মত! এই দেশে দেখার বস্তু এত বেশী আছে, সে হোক প্রাকৃতিক বা ঐতিহাসিক, এত ধরনের মানুষ আছে, যে বলা যায় ইতালি ভাল মত দেখতে উপলব্ধি করতে এক মানব জীবন যথেষ্ট নয়। এত শত শত দর্শনীয় স্থানের মাঝেও কিন্তু গত বছর সবচেয়ে বেশী সংখ্যক পর্যটক কিন্তু এসেছে এই ধ্বংসনগরীতেই, ২৬ লক্ষ! চলুন, আজ ঘুরে আসি বর্তমানের পম্পেই নগরী থেকে, সাথী অক্টোবরের বৃষ্টিহীন মিষ্টি রোদ।

ন্যাপোলী মহানগরী থেকে খানিক পরপরই ট্রেন ছাড়ে যা ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায় সবগুলো শহর হয়ে যায়, তবে এদের মাঝে সবচেয়ে বেশী বিখ্যাত নিঃসন্দেহে পম্পেই, তার পরপরই এরকোলানো। আধুনিক পম্পেই নগরী আবার গড়ে উঠেছে পুরাতন শহরকে ঘিরেই, যদিও অধিবাসীরা ভুলেই থাকেন আগ্নেয়গিরির পাদদেশে বাস করার বিপদের কথা, কিন্তু মাঝে মাঝে টেলিভিশনে ভিসুভিয়াসের উপরে নির্মিত তথ্যচিত্র দেখলে তাদের মনে শঙ্কা দেখা দেয়- কী হবে যদি পাগলা আবার ক্ষেপে ওঠে? কেউ জানে না সেই প্রশ্নের উত্তর।
ট্রেন ষ্টেশন থেকে বেরোতেই প্রাচীন পম্পেই-এর দিকে যাবার দিক নির্দেশনা চোখে পড়ল, মিনিট দুয়েক হাঁটলেই তার একাধিক প্রধান ফটকগুলির একটা দেখা যায়। সেখানে দিয়ে আরও শত শত পর্যটকদের সাথে শহরপ্রাচীরের ভিতরে ঢুকতেই যেন দুইটি হাজার বছর পিছিয়ে গেলাম এক নিমিষে। সারি সারি স্তম্ভ, পলেস্তারা খসে পড়া দেয়াল, লম্বা পাথরের রাস্তা চলে গেলে শহরের আরেক মাথা পর্যন্ত, দেবদেবীর মন্দির- শুধু মানুষ নেই, মানে সেই প্রাচীন মানুষগুলো নেই, এই সময়ে ট্যুরিস্টরা অবশ্য গমগম করছে সবখানেই, তাদের জ্বালাতে বরং ফাঁকা শহরের ছবি তোলা এক বিশাল ঝক্কি হয়ে দাঁড়াল।

প্রথমেই ফোরাম নামে ফাঁকা জায়গাটি দেখা হল যেখানে শহরের জনসাধারণের সভা বা এই ধরনের অনুষ্ঠান হত, এখন সেখানে ইতস্তত দাঁড়ানো কিছু স্তম্ভ, আর আশেপাশের ছাদ ছাড়া বাড়ী বাদে এমন কিছু নেই, আর সেখানে দাঁড়ালেই চোখে আটকায় ভীমদর্শন ভিসুভিয়াসে, আসলে কেবল ফোরাম থেকেই না, সমগ্র পম্পেইয়ের সবখান থেকেই বিভীষিকাময় আগ্নেয়গিরিটি নজরে আসে। জানায় হয়ত মানুষদের সাবধানের থাকার আহ্বান।

পম্পেই নগরীর অধিকাংশ ঘরেই অবশ্য প্রবেশের অনুমতি নেই, যেহেতু এখনো প্রত্নতত্ত্ববিদরা খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছেন, তাই খানিকটা দূরত্ব বজায় দেখেই দেখতে হয় সবকিছু। আবার কিছু কিছু এলাকার কাজ শেষ বিধায় বেশ আরামেই আগপাশতলা ঘুরে দেখার অনুমতি আছে। এমন এক ভবনে দেখা মিলল অপূর্ব রঙে রাঙানো কিছু দেয়াল চিত্র, পাকা রঙ দেখে মনে হচ্ছে যেন গত সপ্তাহেই কেউ তুলির পরশ বুলিয়ে গেছে।



ঘুনাক্ষরেও বোঝার উপায় নেই যে দু হাজার বছর আগে রঙ করা এই দেয়াল কয়েক মিটার লাভা আর ছাইয়ের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে ছিল শত শত বছর! এমন ধৈর্য্যশীল কাজের জন্য প্রত্ন তাত্ত্বিকদের প্রতি মাঠ আসলেই শ্রদ্ধায় নুইয়ে যায়, কিন্তু বিপরীত চিত্রটিও আছে। জনাব টনি নামে মূর্খ অসভ্য বর্বর এক লোক এই বিশ্ব সম্পদের গায়ে নিজের নাম লিখে রেখেছে দেয়াল আঁচড়ে!

এই ভাবে নাম লিখলে কী কেউ অমর হতে পারে? মহাকালের বুকে নিজের নামকে অক্ষয় করে রাখা কি এতই সহজ? একই সাথে ঘৃণা এবং করুণা হল টনির প্রতি। বন্ধুরা, বাংলাদেশের অনেক পুরাকীর্তিতেও একই অবস্থা চোখে পড়েছে অনেক সময়, যদি আপনার সামনে কেউ এমন ক্ষতিকর কাজ করলে বুঝিয়ে বলবেন কেন এই কাজ করা উচিত নয়, বিশেষ করে আপনার শিশুটিকে এমন কাজ যে কত বড় অন্যায় সেটা অবশ্যই শিক্ষা দেবেন।

শহরের দেবরাজ জুপিটারের মন্দিরের পরে অ্যাপোলোর মন্দিরে যাওয়া হল, অনেকটা একই ধাঁচের সবখানেই, সারিসারি স্তম্ভ, ধসে পড়া ছাদ, ফাঁকা সবুজ জমি।


এর মধ্যে হাউস অফ দ্য ফন নামের বিখ্যাত বাড়ীটির মাঝে ঢুকতেই উদ্যানের সাথে লাগানো ছোট একটি ঝর্ণার সামনে ফনের ভাস্কর্য দেখা গেল, যদিও এককালে কোন ধনী ব্যক্তির বিশাল বাড়ীটির মূল আকর্ষণ একটি অসাদাধারন মোজাইকের কাজ যেখানে সম্রাট আলেকজান্ডারের সাথে ইরানের সম্রাট দারিউসের যুদ্ধ দেখানো হয়েছে, মেঝেতে স্থাপিত বিশাল মোজাইকটির বেশ ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু ঘোড়ার পিঠে অবস্থানরত আলেকজান্ডারের মুখাবয়ব পরিষ্কার বোঝা যায়, শুনলাম ব্যাটল অফ ইসূস নামের এই মোজাইকটি আসলে একটি গ্রীক চিত্রকর্মের নকল, যদিও এর বয়স নেহাত কম নয়!

তেমনই হাউজ অফ দ্য ট্র্যাজিক পয়েট বাড়ীর প্রবেশ পথে যেমন মোজাইকে খোদাই করা ভীষণ দর্শন কুকুর চোখে পড়ল, তেমন ভিতরে ছিল গ্রীক পুরাণের নানা চিত্র, কিন্তু নামটা কেন হাউজ অফ দ্য ট্র্যাজিক পয়েট তার অবশ্য সঠিক ব্যাখ্যা মেলে না। ধারণা করা হয় যেহেতু শিল্পকলা, পুরাণ নিয়ে আগ্রহ ছিল তাই হয়ত বাড়ীর মালিক কবি ছিলেন, আর কবি ছিলেন মানেই তার প্রতিভা ছিল, আবেগ ছিল কিন্তু অর্থ ছিল না, তাই ট্র্যাজিক! কী ভয়াবহ ভুল ধারণা সব যুগেই করা হয় কবিদের নিয়ে।

চমৎকার রাস্তাগুলো বৃষ্টির জল নেমে যাবার জন্য সামান্য ঢালু করে তৈরি, সাথে ফুটপাতগুলোও। কিন্তু প্রায়ই রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা বিশাল সব পাথর দেখে স্বাভাবিক ভাবেই মনে কৌতূহলের উদয় হল, এগুলো কিসের জন্য?


উত্তর পাওয়া গেল চমকপ্রদ! এগুলো রাস্তা পারাপারের জন্য ব্যবহার হত, বিশেষ করে মহিলাদের জুতা বা পরনের কাপড় যেন নষ্ট না হয় তাই তারা এই ফেলে রাখা পাথরের উপরে পা দিয়েই রাস্তা পার হতেন। বৃষ্টির দিনে জল-কাদা মিলিয়ে নিশ্চয়ই অকথ্য অবস্থা হয়ে থাকত তখন, কিন্তু মূল রহস্যের সমাধান এইখানেই নয়, আসল ব্যাপার হচ্ছে পম্পেই নগরীতে স্যুয়েজ বা বর্জ্য নিষ্কাশনের কোন সুব্যবস্থা ছিল না, তাই জনসাধারণ রাস্তার উপরেই ময়লা ফেলে রাখত, তারপর শহর থেকে নিযুক্ত কেউ এসে ময়লা সরিয়ে নিয়ে যেত, কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না ময়লা ফেলার! যে কারণে দিনের বেলা একজনের ফেলা ময়লায় বেখেয়ালে আরেকজনের বেশভূষা নষ্ট হলে জরিমানার বিধান পর্যন্ত ছিল! এই পাথরগুলোর উপর দিয়ে বেড়ালেরাও যাতায়াত করত, এবং ঐতিহাসিকরা মনে করছেন পশুটানা গাড়ীও এর ফাঁক গলে অনায়াসে চলাচল করতে পারত।

তবে পম্পেই নগরীতে টো টো করে ঘুরে মনে হল সবচেয়ে বেশী দেখলাম রান্নার ঘর, বেশ চমৎকার মোজাইকের কাজ করা, রান্নার পাত্র রাখার জন্য গোল গোল ছিদ্র, এমন অনেকবারই চোখে পড়ল। আসলে সরগরম এলাকাতে এমনই হবার কথা।


কিছু দোকানের সামনে তাদের ভাষায় লেখা আছে যে সেখানে কী মিলত, কোথায় বা চিহ্ন দিয়ে বোঝানো আছে যে সেটা কুমোরের দোকান, নাকি কামারের, নাকি শুঁড়িখানা! চোখ বন্ধ করতেই যেন ফিরে গেলাম সেই সময়ে- শাদা কাপড় পড়ে শহরের শাসনকর্তা চলেছে দম্ভ ভরে রাস্তা মাড়িয়ে, পেছেন সভাসদের দল, সাধারণ জনগণ ব্যস্ত হাটবাজার নিয়ে, বণিকের দল তদারকি করছে পণ্যমুল্যের। বলা হয় পম্পেই একমাত্র জনপদ যেটা থেকে আমরা সেই সুপ্রাচীন সময়ের জীবনধারার অধিকাংশই আঁচ করতে পারি।




এত কিছু থাকার পরও পর্যটকদের কাছে পম্পেইয়ের মূল আকর্ষণ লাভা খুঁড়ে বাহির করে একটি লুপানার বা গণিকালয়, দেয়ালে নানা কামকলার ছবিসমৃদ্ধ লুপানারটিসহ পম্পেই কামকলার বেশ কিছু ছবি একবার পোস্ট করা হয়েছে বিধায় এযাত্রা এড়িয়ে গেলাম সেই প্রসঙ্গ। দশ হাজার লোকের পম্পেইতে ৩৫টি লুপানার ছিল মানে ৭১ পুরুষ প্রতি একটি লুপানার। বিজ্ঞানীরা কেবল এটুকু জানাতে পারছেন যে যৌনতা প্রাচীন পম্পেই নগরীতে কোন ঢাকগুড়গুড় বিষয় ছিল না। ( তবে ভেবে মজাও পেলাম যে বাইবেল এবং কোরান যারা রচনা করেছে তারা যদি পম্পেই নগরীর এই কামবহুল জীবনযাত্রা এবং ভিসুভিয়াসের আগুনে তাদের ধ্বংস হয়ে যাবার কথা জানত তাহলে ওল্ড টেস্টামেন্টে যেমন সদোম এবং গোমোরাহর কথা এসেছে অবধারিত ভাবে বাইবেল ও কোরানে পম্পেইয়ের কথা আসত এবং সেখানে থাকত মানুষের অসদাচরণ ও দয়ালু ঈশ্বরের ক্রোধের কথা! )

দুঃখজনকভাবে পম্পেই নগরীর সবচেয়ে চমৎকার ভাবে সংরক্ষিত চিত্রকর্মগুলো নেপলস পুরাতত্ত্ব জাদুঘরে আছে, তেমন ভাবে এখানে অধিবাসী মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মৃতদেহগুলোর অধিকাংশই একই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। সেখানে যাওয়া হয়েছিল পম্পেই ভ্রমণের একদিন পরেই, কিন্তু সেই সংগ্রহশালা তেই বিশাল যে তার জন্য আলাদা পোস্ট দিলেই সুবিচার করা হবে মনে হচ্ছে। যদিও এখানেই দেখা মিলল কয়েকজন দুর্ভাগা পম্পেইবাসীর, প্রায় সকলেরই মুখ এবং চোখ হাত দিয়ে ঢাকা, মনে করা হয় বিষাক্ত গ্যাসের প্রকোপ থেকে নাক এবং চোখে বাঁচাতেই তারা এই পন্থা অবলম্বন করেছিল এবং এইভাবেই ভয়াল মৃত্যুবরণ করে।

কিন্তু আধুনিক গবেষণায় মনে করা হচ্ছে আগ্নেয়গিরি লাভা, ছাই, বিষাক্ত গ্যাস এগুলো আসার অনেক অনেক আগেই উত্তাপেই এই মানুষগুলি মারা গিয়েছিল, শহরের তাপমাত্রা তখন প্রায় ৩০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড ছোঁয়ার কথা, সেই উত্তাপে মানুষের বাঁচার কথা নয়। হয়ত উত্তাপ থেকে রক্ষা পেতেই তারা চোখ-মুখ ঢাকবার চেষ্টা করেছিল। কেবল একজনের মৃতদেহ দেখলাম যার মুখমণ্ডল পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল।

কী করুণ একটা দৃশ্য! আমার মতই একজন মানুষ, দেখে মনে হয় পাথর কুঁদে তৈরি, একটু ঘুমিয়ে পড়েছে, জীয়ন কাঠির ছোঁয়া পেলেই জেগে উঠবে, কিন্তু তার বয়স ২০০০ বছর! অত আগে কী পরিমাণ আতংক এবং আকুতি নিয়ে পরপারে চলে গেছিল বেচারা! হয়ত ঘরে ফিরে এসেছিল বৌ-বাচ্চাকে সাথে নিয়ে যেতে, হয়ত অপেক্ষারত প্রেমিকা ছিল দুয়ারে, হয়ত বা সে ছিল কোন ভিনদেশী বণিক। কোন পরিচয়ই আজ আমাদের কাছে মুখ্য নয়, সে ভিসুভিয়াসের এক নির্মম শিকার, ব্যস, এটুকু জেনেই আমরা চলে যায় পরের দর্শনীয় বস্তুর সামনে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছাই এবং লাভার স্তর থেকে মানবদেহের এক কাস্টগুলো বাহির করা হয়েছে, ধারণা করা হয় উত্তাপে মারা যাবার পর, লাভা এসে পৌঁছানোর অনেক আগেই ছাই এবং বৃষ্টির জলের বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মৃতদেহগুলো অনেকটা শিলীভূত হতে গিয়েছিল, সেখান থেকে পরে আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদরা কাস্টগুলো তৈরি করেছেন।

পম্পেই ইট-পাথরের মৃত নগরী হলেও সেখানে কিছু সবুজের ছোঁয়া আছে সবখানেই, বিশেষ করে প্রাচীন আবহ ফিরিয়ে আনা হয়েছে উদ্যানগুলোতে সেই সময়ের গাছরোপণ করেই, এছাড়া বড় গৃহগুলোর ভিতরের এক চিলতে বাগান তো আছেই।

সুযোগে তালাবদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেনে উকিও দেওয়া হয়ে গেল। সেই সাথে জানা গেল সেই আমলের জলসরবরাহ এবং সেচ ব্যবস্থা নিয়ে। প্রথম নদী থেকে, পড়ে কুয়া খুড়ে এবং শেষের দিকে পাহাড়ি ঝরনা থেকে তারা জলসরবরাহ বজায় রাখার চেষ্টা করত, ধনীদের বাড়ীতে জলসঞ্চয়ের বাহুল্যময় ব্যবস্থা ছিল বটে, কিন্তু সাধারণ জনগণ রাস্তার মোড়ে অবস্থিত কল থেকেই পানীয় এবং ব্যবহারে জল সংগ্রহ করত। তেমন কল থেকে আমরাও তৃষ্ণা নিবারন করলাম, যদিও কলটি একেবারে আধুনিক, কিন্তু সরবরাহ ব্যবস্থা সেই দুই হাজার বছরের পুরনো!

পম্পেই নগরীর জনসংখ্যা দশ হাজার হলেও ধারণা করা হয় ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুতপাতের সময় এখানে হাজার বিশেক লোক জমায়েত হয়েছিল, কারণ রোমানদের কাছে পম্পেই অবকাশকেন্দ্র হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, গড়ে উঠেছিল রোমান অ্যারেনা, গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ভাষণ সবই চলত এইখানে।


২৩ আগস্ট ছিল রোমানদের অগ্নিদেবতা ভুলকানালিয়ার উৎসবের দিন, দেবতাকে নৈবদ্য দেবার একদিন পরেই আগুনের রোষেই ধ্বংস হয়ে গেছিল পম্পেই নগরী। অবিশ্বাসে কি অসহায় মানুষগুলো শাপশাপান্ত করেছিল দেবতাদের, নাকি মেনে নিয়েছিল নিয়তির অমোঘ লিখন?

পরিশেষে বলতেই হয়- পম্পেই দর্শন নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, একই সাথে বর্তমান এবং অতীতের অভিজ্ঞতা হয় এখানে গেলে। বিমুগ্ধ হতে হয় প্রাচীন কালের শিল্পকলা, কারিগরিবিদ্যা, জীবনচর্চার নিদর্শন দেখে, একই সাথে দুঃখে মন ভরে ওঠে সেই দুঃখী মানুষগুলোর স্মরণে। বিশাল শহরটির অনেক গলিঘুপচির কথা এযাত্রা বাদ পড়ে গেল, বিশেষ করে নেপলসের জাদুঘরে সংরক্ষিত সেরা শিল্পনিদর্শনগুলোর বর্ণনা অন্য পোস্টে দেবার আশা রাখি।

( পম্পেইয়ের নাম প্রথম শুনেছিলাম সেবা প্রকাশনী অনুদিত লর্ড লিটনের লাস্ট ডেজ অফ পম্পেই বই থেকে, পোস্টটির নাম সেখান থেকেই ধার নিলাম।

সারি সারি পাথর বসানো রাস্তা চলে গেছে নগরীর বুক চিরে, বেশ বড় বড় পাথর, মসৃণ তার পৃষ্ঠদেশ, কয়েক জায়গায় অগভীর খাজ মত, বোঝা যাচ্ছে কোন বিশেষ বাহনের অবিরাম চলাচলের ফলে কঠিন পাথরের বুক ক্ষয়ে এই চিহ্ন তৈরি হয়েছে চাকার ঘর্ষণে। কারা টানত সেই গাড়ী? হয়ত ঘোড়া, গাধা, গরু, খচ্চর বা মানুষ, মাত্র দুই হাজার বছর আগে! জি, ঠিকই পড়েছেন ২০০০ বছর আগেই এক সমৃদ্ধ রোমান জনপদ ছিল এলাকাটি, ছিল এক রমরমা বাণিজ্যকেন্দ্র! অদূরেই ভূমধ্যসাগর, বণিকেরা ভিড় করে আসত নানা দেশ থেকে, চলত পণ্যের বিকিকিনি, সবার বিনোদনের জন্য শহরে গড়ে তোলা হল রোমান স্টেডিয়াম বা অ্যারেনা, বিশাল সব কাজকারবার।


শহরটির এক দিকে অল্প দূরেই যেমন সমুদ্র, তেমনি অন্যদিকে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমায় এক সবুজ পাহাড়। অরণ্য, পাহাড়, সমুদ্র মিলিয়ে অনেকটা পুরাণের স্বর্গ স্বর্গ আবহ এলাকার নিসর্গে। কিন্তু একদিন সেই সবুজ পাহাড় জেগে উঠল ভীষণ ক্রোধে, ভিতরে জমে থাকা টন টন পাথর সে উগড়ে দিল চোখের নিমিষে, নিরীহ সবুজ পাহাড় রূপান্তরিত হল ইতিহাসের কুখ্যাততম আগ্নেয়গিরিতে, এই বিশেষ শহরটিসহ পাঁচটি শহর চলে গেলে আগ্নেয়গিরি লাভা, ছাই, বর্জ্যের নিচে, মৃত্যু ঘটল ১৬,০০০ মানুষের। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অমরত্ব পেল শহর এবং সেই ফুঁসে ওঠা আগ্নেয়গিরিটি, হয়ে থাকল এক অমোচনীয় কালো অধ্যায়, যুগে যুগে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের মুখে ছড়িয়ে গেল দুর্ভাগা এই নগরীর কথা, নাম যার পম্পেই। আর আগ্নেয়গিরিটির নাম ভিসুভিয়াস।

ইতালি কেবলমাত্র একটি দেশ নয়, ইতালি একটি আলাদা গ্রহের মত! এই দেশে দেখার বস্তু এত বেশী আছে, সে হোক প্রাকৃতিক বা ঐতিহাসিক, এত ধরনের মানুষ আছে, যে বলা যায় ইতালি ভাল মত দেখতে উপলব্ধি করতে এক মানব জীবন যথেষ্ট নয়। এত শত শত দর্শনীয় স্থানের মাঝেও কিন্তু গত বছর সবচেয়ে বেশী সংখ্যক পর্যটক কিন্তু এসেছে এই ধ্বংসনগরীতেই, ২৬ লক্ষ! চলুন, আজ ঘুরে আসি বর্তমানের পম্পেই নগরী থেকে, সাথী অক্টোবরের বৃষ্টিহীন মিষ্টি রোদ।

ন্যাপোলী মহানগরী থেকে খানিক পরপরই ট্রেন ছাড়ে যা ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায় সবগুলো শহর হয়ে যায়, তবে এদের মাঝে সবচেয়ে বেশী বিখ্যাত নিঃসন্দেহে পম্পেই, তার পরপরই এরকোলানো। আধুনিক পম্পেই নগরী আবার গড়ে উঠেছে পুরাতন শহরকে ঘিরেই, যদিও অধিবাসীরা ভুলেই থাকেন আগ্নেয়গিরির পাদদেশে বাস করার বিপদের কথা, কিন্তু মাঝে মাঝে টেলিভিশনে ভিসুভিয়াসের উপরে নির্মিত তথ্যচিত্র দেখলে তাদের মনে শঙ্কা দেখা দেয়- কী হবে যদি পাগলা আবার ক্ষেপে ওঠে? কেউ জানে না সেই প্রশ্নের উত্তর।
ট্রেন ষ্টেশন থেকে বেরোতেই প্রাচীন পম্পেই-এর দিকে যাবার দিক নির্দেশনা চোখে পড়ল, মিনিট দুয়েক হাঁটলেই তার একাধিক প্রধান ফটকগুলির একটা দেখা যায়। সেখানে দিয়ে আরও শত শত পর্যটকদের সাথে শহরপ্রাচীরের ভিতরে ঢুকতেই যেন দুইটি হাজার বছর পিছিয়ে গেলাম এক নিমিষে। সারি সারি স্তম্ভ, পলেস্তারা খসে পড়া দেয়াল, লম্বা পাথরের রাস্তা চলে গেলে শহরের আরেক মাথা পর্যন্ত, দেবদেবীর মন্দির- শুধু মানুষ নেই, মানে সেই প্রাচীন মানুষগুলো নেই, এই সময়ে ট্যুরিস্টরা অবশ্য গমগম করছে সবখানেই, তাদের জ্বালাতে বরং ফাঁকা শহরের ছবি তোলা এক বিশাল ঝক্কি হয়ে দাঁড়াল।

প্রথমেই ফোরাম নামে ফাঁকা জায়গাটি দেখা হল যেখানে শহরের জনসাধারণের সভা বা এই ধরনের অনুষ্ঠান হত, এখন সেখানে ইতস্তত দাঁড়ানো কিছু স্তম্ভ, আর আশেপাশের ছাদ ছাড়া বাড়ী বাদে এমন কিছু নেই, আর সেখানে দাঁড়ালেই চোখে আটকায় ভীমদর্শন ভিসুভিয়াসে, আসলে কেবল ফোরাম থেকেই না, সমগ্র পম্পেইয়ের সবখান থেকেই বিভীষিকাময় আগ্নেয়গিরিটি নজরে আসে। জানায় হয়ত মানুষদের সাবধানের থাকার আহ্বান।

পম্পেই নগরীর অধিকাংশ ঘরেই অবশ্য প্রবেশের অনুমতি নেই, যেহেতু এখনো প্রত্নতত্ত্ববিদরা খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছেন, তাই খানিকটা দূরত্ব বজায় দেখেই দেখতে হয় সবকিছু। আবার কিছু কিছু এলাকার কাজ শেষ বিধায় বেশ আরামেই আগপাশতলা ঘুরে দেখার অনুমতি আছে। এমন এক ভবনে দেখা মিলল অপূর্ব রঙে রাঙানো কিছু দেয়াল চিত্র, পাকা রঙ দেখে মনে হচ্ছে যেন গত সপ্তাহেই কেউ তুলির পরশ বুলিয়ে গেছে।



ঘুনাক্ষরেও বোঝার উপায় নেই যে দু হাজার বছর আগে রঙ করা এই দেয়াল কয়েক মিটার লাভা আর ছাইয়ের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে ছিল শত শত বছর! এমন ধৈর্য্যশীল কাজের জন্য প্রত্ন তাত্ত্বিকদের প্রতি মাঠ আসলেই শ্রদ্ধায় নুইয়ে যায়, কিন্তু বিপরীত চিত্রটিও আছে। জনাব টনি নামে মূর্খ অসভ্য বর্বর এক লোক এই বিশ্ব সম্পদের গায়ে নিজের নাম লিখে রেখেছে দেয়াল আঁচড়ে!

এই ভাবে নাম লিখলে কী কেউ অমর হতে পারে? মহাকালের বুকে নিজের নামকে অক্ষয় করে রাখা কি এতই সহজ? একই সাথে ঘৃণা এবং করুণা হল টনির প্রতি। বন্ধুরা, বাংলাদেশের অনেক পুরাকীর্তিতেও একই অবস্থা চোখে পড়েছে অনেক সময়, যদি আপনার সামনে কেউ এমন ক্ষতিকর কাজ করলে বুঝিয়ে বলবেন কেন এই কাজ করা উচিত নয়, বিশেষ করে আপনার শিশুটিকে এমন কাজ যে কত বড় অন্যায় সেটা অবশ্যই শিক্ষা দেবেন।

শহরের দেবরাজ জুপিটারের মন্দিরের পরে অ্যাপোলোর মন্দিরে যাওয়া হল, অনেকটা একই ধাঁচের সবখানেই, সারিসারি স্তম্ভ, ধসে পড়া ছাদ, ফাঁকা সবুজ জমি।


এর মধ্যে হাউস অফ দ্য ফন নামের বিখ্যাত বাড়ীটির মাঝে ঢুকতেই উদ্যানের সাথে লাগানো ছোট একটি ঝর্ণার সামনে ফনের ভাস্কর্য দেখা গেল, যদিও এককালে কোন ধনী ব্যক্তির বিশাল বাড়ীটির মূল আকর্ষণ একটি অসাদাধারন মোজাইকের কাজ যেখানে সম্রাট আলেকজান্ডারের সাথে ইরানের সম্রাট দারিউসের যুদ্ধ দেখানো হয়েছে, মেঝেতে স্থাপিত বিশাল মোজাইকটির বেশ ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু ঘোড়ার পিঠে অবস্থানরত আলেকজান্ডারের মুখাবয়ব পরিষ্কার বোঝা যায়, শুনলাম ব্যাটল অফ ইসূস নামের এই মোজাইকটি আসলে একটি গ্রীক চিত্রকর্মের নকল, যদিও এর বয়স নেহাত কম নয়!

তেমনই হাউজ অফ দ্য ট্র্যাজিক পয়েট বাড়ীর প্রবেশ পথে যেমন মোজাইকে খোদাই করা ভীষণ দর্শন কুকুর চোখে পড়ল, তেমন ভিতরে ছিল গ্রীক পুরাণের নানা চিত্র, কিন্তু নামটা কেন হাউজ অফ দ্য ট্র্যাজিক পয়েট তার অবশ্য সঠিক ব্যাখ্যা মেলে না। ধারণা করা হয় যেহেতু শিল্পকলা, পুরাণ নিয়ে আগ্রহ ছিল তাই হয়ত বাড়ীর মালিক কবি ছিলেন, আর কবি ছিলেন মানেই তার প্রতিভা ছিল, আবেগ ছিল কিন্তু অর্থ ছিল না, তাই ট্র্যাজিক! কী ভয়াবহ ভুল ধারণা সব যুগেই করা হয় কবিদের নিয়ে।

চমৎকার রাস্তাগুলো বৃষ্টির জল নেমে যাবার জন্য সামান্য ঢালু করে তৈরি, সাথে ফুটপাতগুলোও। কিন্তু প্রায়ই রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা বিশাল সব পাথর দেখে স্বাভাবিক ভাবেই মনে কৌতূহলের উদয় হল, এগুলো কিসের জন্য?


উত্তর পাওয়া গেল চমকপ্রদ! এগুলো রাস্তা পারাপারের জন্য ব্যবহার হত, বিশেষ করে মহিলাদের জুতা বা পরনের কাপড় যেন নষ্ট না হয় তাই তারা এই ফেলে রাখা পাথরের উপরে পা দিয়েই রাস্তা পার হতেন। বৃষ্টির দিনে জল-কাদা মিলিয়ে নিশ্চয়ই অকথ্য অবস্থা হয়ে থাকত তখন, কিন্তু মূল রহস্যের সমাধান এইখানেই নয়, আসল ব্যাপার হচ্ছে পম্পেই নগরীতে স্যুয়েজ বা বর্জ্য নিষ্কাশনের কোন সুব্যবস্থা ছিল না, তাই জনসাধারণ রাস্তার উপরেই ময়লা ফেলে রাখত, তারপর শহর থেকে নিযুক্ত কেউ এসে ময়লা সরিয়ে নিয়ে যেত, কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না ময়লা ফেলার! যে কারণে দিনের বেলা একজনের ফেলা ময়লায় বেখেয়ালে আরেকজনের বেশভূষা নষ্ট হলে জরিমানার বিধান পর্যন্ত ছিল! এই পাথরগুলোর উপর দিয়ে বেড়ালেরাও যাতায়াত করত, এবং ঐতিহাসিকরা মনে করছেন পশুটানা গাড়ীও এর ফাঁক গলে অনায়াসে চলাচল করতে পারত।

তবে পম্পেই নগরীতে টো টো করে ঘুরে মনে হল সবচেয়ে বেশী দেখলাম রান্নার ঘর, বেশ চমৎকার মোজাইকের কাজ করা, রান্নার পাত্র রাখার জন্য গোল গোল ছিদ্র, এমন অনেকবারই চোখে পড়ল। আসলে সরগরম এলাকাতে এমনই হবার কথা।


কিছু দোকানের সামনে তাদের ভাষায় লেখা আছে যে সেখানে কী মিলত, কোথায় বা চিহ্ন দিয়ে বোঝানো আছে যে সেটা কুমোরের দোকান, নাকি কামারের, নাকি শুঁড়িখানা! চোখ বন্ধ করতেই যেন ফিরে গেলাম সেই সময়ে- শাদা কাপড় পড়ে শহরের শাসনকর্তা চলেছে দম্ভ ভরে রাস্তা মাড়িয়ে, পেছেন সভাসদের দল, সাধারণ জনগণ ব্যস্ত হাটবাজার নিয়ে, বণিকের দল তদারকি করছে পণ্যমুল্যের। বলা হয় পম্পেই একমাত্র জনপদ যেটা থেকে আমরা সেই সুপ্রাচীন সময়ের জীবনধারার অধিকাংশই আঁচ করতে পারি।




এত কিছু থাকার পরও পর্যটকদের কাছে পম্পেইয়ের মূল আকর্ষণ লাভা খুঁড়ে বাহির করে একটি লুপানার বা গণিকালয়, দেয়ালে নানা কামকলার ছবিসমৃদ্ধ লুপানারটিসহ পম্পেই কামকলার বেশ কিছু ছবি একবার পোস্ট করা হয়েছে বিধায় এযাত্রা এড়িয়ে গেলাম সেই প্রসঙ্গ। দশ হাজার লোকের পম্পেইতে ৩৫টি লুপানার ছিল মানে ৭১ পুরুষ প্রতি একটি লুপানার। বিজ্ঞানীরা কেবল এটুকু জানাতে পারছেন যে যৌনতা প্রাচীন পম্পেই নগরীতে কোন ঢাকগুড়গুড় বিষয় ছিল না। ( তবে ভেবে মজাও পেলাম যে বাইবেল এবং কোরান যারা রচনা করেছে তারা যদি পম্পেই নগরীর এই কামবহুল জীবনযাত্রা এবং ভিসুভিয়াসের আগুনে তাদের ধ্বংস হয়ে যাবার কথা জানত তাহলে ওল্ড টেস্টামেন্টে যেমন সদোম এবং গোমোরাহর কথা এসেছে অবধারিত ভাবে বাইবেল ও কোরানে পম্পেইয়ের কথা আসত এবং সেখানে থাকত মানুষের অসদাচরণ ও দয়ালু ঈশ্বরের ক্রোধের কথা! )

দুঃখজনকভাবে পম্পেই নগরীর সবচেয়ে চমৎকার ভাবে সংরক্ষিত চিত্রকর্মগুলো নেপলস পুরাতত্ত্ব জাদুঘরে আছে, তেমন ভাবে এখানে অধিবাসী মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মৃতদেহগুলোর অধিকাংশই একই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। সেখানে যাওয়া হয়েছিল পম্পেই ভ্রমণের একদিন পরেই, কিন্তু সেই সংগ্রহশালা তেই বিশাল যে তার জন্য আলাদা পোস্ট দিলেই সুবিচার করা হবে মনে হচ্ছে। যদিও এখানেই দেখা মিলল কয়েকজন দুর্ভাগা পম্পেইবাসীর, প্রায় সকলেরই মুখ এবং চোখ হাত দিয়ে ঢাকা, মনে করা হয় বিষাক্ত গ্যাসের প্রকোপ থেকে নাক এবং চোখে বাঁচাতেই তারা এই পন্থা অবলম্বন করেছিল এবং এইভাবেই ভয়াল মৃত্যুবরণ করে।

কিন্তু আধুনিক গবেষণায় মনে করা হচ্ছে আগ্নেয়গিরি লাভা, ছাই, বিষাক্ত গ্যাস এগুলো আসার অনেক অনেক আগেই উত্তাপেই এই মানুষগুলি মারা গিয়েছিল, শহরের তাপমাত্রা তখন প্রায় ৩০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড ছোঁয়ার কথা, সেই উত্তাপে মানুষের বাঁচার কথা নয়। হয়ত উত্তাপ থেকে রক্ষা পেতেই তারা চোখ-মুখ ঢাকবার চেষ্টা করেছিল। কেবল একজনের মৃতদেহ দেখলাম যার মুখমণ্ডল পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল।

কী করুণ একটা দৃশ্য! আমার মতই একজন মানুষ, দেখে মনে হয় পাথর কুঁদে তৈরি, একটু ঘুমিয়ে পড়েছে, জীয়ন কাঠির ছোঁয়া পেলেই জেগে উঠবে, কিন্তু তার বয়স ২০০০ বছর! অত আগে কী পরিমাণ আতংক এবং আকুতি নিয়ে পরপারে চলে গেছিল বেচারা! হয়ত ঘরে ফিরে এসেছিল বৌ-বাচ্চাকে সাথে নিয়ে যেতে, হয়ত অপেক্ষারত প্রেমিকা ছিল দুয়ারে, হয়ত বা সে ছিল কোন ভিনদেশী বণিক। কোন পরিচয়ই আজ আমাদের কাছে মুখ্য নয়, সে ভিসুভিয়াসের এক নির্মম শিকার, ব্যস, এটুকু জেনেই আমরা চলে যায় পরের দর্শনীয় বস্তুর সামনে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছাই এবং লাভার স্তর থেকে মানবদেহের এক কাস্টগুলো বাহির করা হয়েছে, ধারণা করা হয় উত্তাপে মারা যাবার পর, লাভা এসে পৌঁছানোর অনেক আগেই ছাই এবং বৃষ্টির জলের বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মৃতদেহগুলো অনেকটা শিলীভূত হতে গিয়েছিল, সেখান থেকে পরে আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদরা কাস্টগুলো তৈরি করেছেন।

পম্পেই ইট-পাথরের মৃত নগরী হলেও সেখানে কিছু সবুজের ছোঁয়া আছে সবখানেই, বিশেষ করে প্রাচীন আবহ ফিরিয়ে আনা হয়েছে উদ্যানগুলোতে সেই সময়ের গাছরোপণ করেই, এছাড়া বড় গৃহগুলোর ভিতরের এক চিলতে বাগান তো আছেই।

সুযোগে তালাবদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেনে উকিও দেওয়া হয়ে গেল। সেই সাথে জানা গেল সেই আমলের জলসরবরাহ এবং সেচ ব্যবস্থা নিয়ে। প্রথম নদী থেকে, পড়ে কুয়া খুড়ে এবং শেষের দিকে পাহাড়ি ঝরনা থেকে তারা জলসরবরাহ বজায় রাখার চেষ্টা করত, ধনীদের বাড়ীতে জলসঞ্চয়ের বাহুল্যময় ব্যবস্থা ছিল বটে, কিন্তু সাধারণ জনগণ রাস্তার মোড়ে অবস্থিত কল থেকেই পানীয় এবং ব্যবহারে জল সংগ্রহ করত। তেমন কল থেকে আমরাও তৃষ্ণা নিবারন করলাম, যদিও কলটি একেবারে আধুনিক, কিন্তু সরবরাহ ব্যবস্থা সেই দুই হাজার বছরের পুরনো!

পম্পেই নগরীর জনসংখ্যা দশ হাজার হলেও ধারণা করা হয় ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুতপাতের সময় এখানে হাজার বিশেক লোক জমায়েত হয়েছিল, কারণ রোমানদের কাছে পম্পেই অবকাশকেন্দ্র হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, গড়ে উঠেছিল রোমান অ্যারেনা, গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ভাষণ সবই চলত এইখানে।


২৩ আগস্ট ছিল রোমানদের অগ্নিদেবতা ভুলকানালিয়ার উৎসবের দিন, দেবতাকে নৈবদ্য দেবার একদিন পরেই আগুনের রোষেই ধ্বংস হয়ে গেছিল পম্পেই নগরী। অবিশ্বাসে কি অসহায় মানুষগুলো শাপশাপান্ত করেছিল দেবতাদের, নাকি মেনে নিয়েছিল নিয়তির অমোঘ লিখন?

পরিশেষে বলতেই হয়- পম্পেই দর্শন নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, একই সাথে বর্তমান এবং অতীতের অভিজ্ঞতা হয় এখানে গেলে। বিমুগ্ধ হতে হয় প্রাচীন কালের শিল্পকলা, কারিগরিবিদ্যা, জীবনচর্চার নিদর্শন দেখে, একই সাথে দুঃখে মন ভরে ওঠে সেই দুঃখী মানুষগুলোর স্মরণে। বিশাল শহরটির অনেক গলিঘুপচির কথা এযাত্রা বাদ পড়ে গেল, বিশেষ করে নেপলসের জাদুঘরে সংরক্ষিত সেরা শিল্পনিদর্শনগুলোর বর্ণনা অন্য পোস্টে দেবার আশা রাখি।

( পম্পেইয়ের নাম প্রথম শুনেছিলাম সেবা প্রকাশনী অনুদিত লর্ড লিটনের লাস্ট ডেজ অফ পম্পেই বই থেকে, পোস্টটির নাম সেখান থেকেই ধার নিলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন