বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০১৪

নেপালে আনন্দময় দশদিন

village-in-gandaki-annapurna-range-nepal
বিমান যখন কাঠমান্ডু ত্রিভুবন বিমান বন্দরে ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন দুপুর ১টা। নেপালে ভ্রমণ করার জন্য বাংলাদেশের মানুষকে ভিসা নিয়ে যেতে হয় না। অতি সহজে এয়ারপোর্টেই ভিসা মেলে। এ জন্য কেবল একটি ছোট্ট ফরম পূরণ করতে হয়, আর এক কপি ফটো জমা দিতে হয়।
পোর্ট ভবনে ঢুকেই মিতুল ঝটপট ফরম পূরণ করতে শুরু করে দিল। এবারের ভ্রমণে আমার পরিবারের সকল সদস্য– অর্থাৎ বেবী, কীর্তি, অর্থী আর শ্রেয়া আছে। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছে মিতুল; সে কীর্তির সূত্রে গত ডিসেম্বরে আমাদের পরিবারের সদস্যপদ পেয়েছে। তাছাড়া বন্যা, টুটুল আর জয়িতাও এসেছে। জয়িতা এই প্রথমবারের মতো মাটির মায়া কাটিয়ে আকাশে উড়ছে, প্রথম বিদেশের মাটিতে পা রাখছে। ওর চোখ একেবারেই স্বপ্নমাখা। সব কিছুই ও দেখছে অন্যভাবে। আর জয়িতার উপর একটু পািন্ডত্য খাটাবার চেষ্টা করছে অর্থী আর শ্রেয়া। কারণ ওরা আরও দু-একবার উড়োজাহাজের সিটবেল্ট পেটে বেঁধেছে।
বিমানবন্দরের আয়োজন খুব একটা জোরদার আর গোছানো নয়। বিদেশি পর্যটকদের কীভাবে সন্দেহের চোখে দেখতে হয়, তা যেন এখনও রপ্ত করে উঠতে পারেননি এখানকার লোকেরা। অন্যদের পাসপোর্টে সিল পড়ার আগে আমি আর শ্রেয়া বাইরে বের হয়ে এলাম। একটু দূরে একটা ছাউনির নিচে নেপালি টুপি পরে এক শীর্ণকায় ভদ্রলোক আমার নাম ছাপা একটা কাগজ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি তাকে ইশারা দিতেই তিনি এগিয়ে এসে বললেন, “নমস্তে।”
বিমানবন্দরের বাইরে বেশ গরম। পাহাড়ি দেশ নেপালে এতটা গরম থাকবে, এটা আমরা আশা করিনি। আমাদের সঙ্গে শীতবস্ত্রও আছে। এগুলোর যে কী গতি হবে কে জানে! আমরা বুকিং দিয়েছি পার্ক ভিলেজ হোটেলে। মূল শহর থেকে এটির দূরত্ব প্রায় ১২ কিমি। আমাদের মাইক্রোবাস শহরের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে। শহরময় নানা ধরনের নির্মাণ কাজ চলছে। ধুলোময় রাস্তাঘাট। সবকিছু পেরিয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট পর আমরা হোটেলে এসে পৌঁছুলাম।
নেপালে হোটেল আর রেস্টুরেন্টে সকল বিলের উপর ২৩% ভ্যাট আর সার্ভিস চার্জ যোগ হয়। এ হোটেলের প্রতিটি রুমের ভাড়া ১২০ থেকে ১৭০ মার্কিন ডলার। তার উপর ভ্যাট আর সার্ভিস চার্জ যোগ হবে। তবে এখানে দামাদামি করা চলে। আমরা টেলিফোনে দামাদামি করে ১৫০ ডলার মূল্যের রুম ভ্যাট-সার্ভিস চার্জসহ ৭৫ ডলারে চুক্তি করেছি। চট করে রিসেপশন কাউন্টারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা রুমের দিকে রওনা হলাম। অবশ্য তার আগে আমাদের জন্য দুপুরের খাবার তৈরি করার আদেশ দিতে ভুললাম না। কারণ আমরা সবাই ততক্ষণে বেশ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছি। হোটেলের পরিবেশটি এক কথায় চমৎকার। চারদিকে অনেক বাগান, গাছপালা; নিরিবিলি পরিবেশে পাখির কলকাকলি আমাদের মুগ্ধ করে দিচ্ছে। হোটেলটির পেছনদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। অবশ্য নেপালের সর্বত্রই পাহাড় আর পাহাড়। এখানে সূর্য ওঠে পাহাড় ডিঙিয়ে, আবার অস্ত যায় পাহাড়ের আড়ালে।
রুমে গিয়ে এর সাজগোজ দেখেও আমরা মুগ্ধ হয়েছি। চমৎকার সব আয়োজন। রাতে বাইরে বসে চাঁদের আলোতে আড্ডা দেওয়া যাবে। অবশ্য আকাশে এখন চাঁদ ওঠে কিনা, এখন পূর্ণিমার সময় কিনা কে জানে? পূর্ণিমার সময় এখানে এলে ভালো হত। তাড়াতাড়ি গোসল করে আমরা রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। বেবী চট করে নামাজ পড়ে নিচ্ছে।
সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কেবলা কোন দিকে হতে পারে?”
আমি ঘরের ভেতর কোনো নির্দেশনা আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখলাম। এর কোনো চিহ্ন পেলাম না। অগত্যা ঘরের বাইরে এসে সূর্য কোনদিকে যাচ্ছে তা পরীক্ষার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অনেকক্ষণ সূর্যদেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করেও তার গতিপথ সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারলাম না। এ সময় একজন মালিকে এদিকে আসতে দেখে এগিয়ে গিয়ে বললাম, “গুড আফটারনুন। ভাইসাহেব, বলেন তো কেবলা কোনদিকে?”
ভদ্রলোক আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী বললেন আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা ভাই, ওয়েস্ট কোনদিকে? সূর্য কোনদিকে ওঠে আর কোনদিকে ডোবে?”
ভদ্রলোক দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু একটা বললেন এবং চলে গেলেন। অগত্যা আবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে একটা দিক নির্ধারণ করলাম এবং বেবীকে সেই দিকটি দেখিয়ে দিলাম। চটপট আমরা চলে গেলাম রেস্টুরেন্টে। ইতোমধ্যে আমাদের খাবার তৈরি হয়ে গেছে। খাবারের দাম কিছুটা বেশি হলেও ভালোই লাগল। আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন রুচির পর্যটক আছে। কেউ দেশি মুরগি আর রুই মাছের চচ্চরি ছাড়া কিছুই খেতে চায় না। আবার কেউ কাঁকড়া-বিছে কড়কড়ে ভাজি পেলে খুশি হয়। তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়া শেষ করে আমরা সবাই রুমে গেলাম। উদ্দেশ্য, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া।ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আবার সবাই একত্র হয়ে গেল।
সবার বক্তব্য, এখানে তো আমরা বিশ্রাম নিতে আসিনি। এক্ষুনি বেরোতে হবে, থামেলে যেতে হবে। কাঠমান্ডু শহরের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে থামেল। আমরা সবাই রেডি হয়ে গাড়ি খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু এখান থেকে কোনো গাড়ি পাওয়া মনে হয় সৌভাগ্যের ব্যাপার। কারণ কেবল যাত্রী পেলেই ট্যাক্সিগুলো এখানে আসে। আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে দুটো ট্যাক্সি জোগাড় করলাম। প্রতিটি ট্যাক্সি ৬০০ রুপি করে মোট ১ হাজার ২০০ রুপি ভাড়া নেবে।
durbar_square_kathmandu_nepal
প্রথমে আমরা গেলাম দরবার এলাকায়। সেখানে অনেক অনেক পুরনো মন্দির আছে। কারুকার্যখচিত এসব মন্দির দেখতে দেখতে আমাদের বিকেল কাটল চমৎকারভাবে। আমি আর টুটুল দুটো নেপালি টুপি কিনে মাথায় পরে অনেক ছবি তুললাম। একটা মন্দিরে বয়েসী মানুষেরা একসঙ্গে বসে কীর্তন গাইছিলেন। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে কীর্তন শুনলাম এবং তাদের ছবি নিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আমরা আবারও ট্যাক্সি নিয়ে থামেল এলাকার দিকে রওনা হলাম। থামেল হচ্ছে কাঠমান্ডুর মূল পর্যটন কেন্দ্র।
আমরা যখন থামেলে পৌঁছলাম, তখন সবাই একবাক্যে জানাল যে তারা সবাই এখানে চলে আসতে আগ্রহী। পার্ক ভিলেজ হোটেলটি সুন্দর হলেও সেখানে কেমন যেন একা একা লাগে। ভালো লাগে না। তাই সবাই এই থামেল এলাকার যে কোনো হোটেলে থাকবে। এখানে আশপাশে শপিং সেন্টার আছে, ঘোরাফেরার জায়গা আছে। গভীর রাত পর্যন্ত এলাকাটি জেগে থাকে। আর এলাকাকে জাগিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা আমাদের পালন করতে হবে না। কিন্তু পার্ক ভিলেজ হোটেলে আমরা ঘুমিয়ে গেলে সবই শেষ।
আমরা তখন একই গ্রুপের হোটেল কাঠমান্ডু রেস্ট হাউজে গেলাম। এখানকার রুম দেখে আমাদের খুব পছন্দ হল। তবে এখানে রুমের ভাড়া ১৫০ হতে ২২০ মার্কিন ডলার; সেই সঙ্গে ভ্যাট আর সার্ভিস চার্জ মিলে আরও ২৩%। কিন্তু আমি তো ইতোমধ্যে দরকষাকষি শিখে ফেলেছি। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে বলে শেষে সবকিছুসহ ৮০ ডলারে রুম ঠিক করে ফেললাম। কাল ১১টায় ওদের গাড়ি গিয়ে আমাদের নিয়ে আসবে। আমরা আবারও কিছুক্ষণ শপিংমলে ঘোরাঘুরি করে ক্লান্তির বোঝা বাড়ালাম। তারপর পার্ক ভিলেজে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি খোঁজা শুরু করলাম। কিন্তু কোনো ট্যাক্সিই ওদিকে যেতে চায় না। তাদের একটাই কথা, ওখানে গেলে শূন্য অবস্থায় ফিরে আসতে হবে।
যাহোক, শেষ পর্যন্ত দুটো ট্যাক্সিকে রাজি করানো গেল। আমরা পার্ক ভিলেজে পৌঁছে রাতের খাবার খেয়ে যার যার ঘরে চলে গেলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, রাতে বাইরে বসে জম্পেস আড্ডা হবে। কিন্তু বাইরে ততক্ষণে শীত শুরু হয়ে গেছে। নিরিবিলি পরিবেশে শীত যেন পাহাড় থেকে উড়ে উড়ে আসছে।সকালে আমরা ঘুম থেকে উঠলাম অনেকটা বেলা করে। কারণ আজ আমাদের কোনো প্রোগ্রাম নেই। সকাল ১১টার মধ্যে রেডি হয়ে চেক আউট করে নিলেই হল। আমরা নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ পর ব্যাগ নিয়ে রিসেপশন কাউন্টারে এসে দেখি কাঠমান্ডু গেস্ট হাউজের গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা চেকআউট করে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে বসলাম।
কাঠমান্ডু গেস্ট হাউজে আমাদের দেওয়া রুমগুলো খুবই সুন্দর। জানালা দিয়ে একটা সবুজ মাঠ দেখা যায়। মাঠের পাশে ওদের নানা ঐতিহ্য লালিত সরঞ্জামাদি রাখা আছে। একপাশে একটি ছোট্ট লাইব্রেরি। এখান থেকে বই নিয়ে পাশে থাকা খোলা বিছানায় শুয়ে আরাম করে পড়া যায়। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, একটা মেয়ে সেখানে শুয়ে বই পড়ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি এই পাঠিকা হচ্ছে আমাদের অর্থী। সে বেশ পড়ুয়া। কিন্তু এ হোটেলে পৌঁছার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে লাইব্রেরি আর আয়েশি ভঙ্গিমায় পড়ার স্থানটা চিনে ফেলেছে, এটাই আশ্চর্যের বিষয়। আমি ক্যামেরা বের করে অর্থীর কটি ছবি তুলে নিলাম। দুপুরে আমরা কাঠমান্ডু গেস্ট হাউজের পাশে থার্ড আই রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। রেস্টুরেন্টটি বাইরে থেকে অনেকটা সাদামাটা মনে হলেও ভেতরটা বেশ অন্যরকম। এখানে প্রত্যেক রুমে স্তরে স্তরে উপরে-নিচে টেবিল পাতা হয়েছে। সব টেবিলের সঙ্গেই বসার জন্য তাকিয়া দেওয়া আছে। জুতো বাইরে খুলে এসে আসন পেতে বসতে হয়। আমরা একটা রুম দখল করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে গেলাম। রাজদরবারের চাপরাশিদের পোশাকে সজ্জিত বেয়ারাগণ বেশ ভাঁজ মেরে মেরে মেন্যু হাজির করলেন।
আমরা অনেক গবেষণা করে দুই ধরনের খাবারের অর্ডার দিলাম। এখানে আমাদের টেবিলে প্রাধান্য পেল সাদা ভাত আর সাধারণ তরকারি। অন্যদিকে ছোটদের টেবিলে দেখা গেল ফ্রায়েড রাইসের সঙ্গে নানা ধরনের উদ্ভট নামের কারি। খাওয়া শেষ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম শহরে ঘুরতে। অনেকক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরে আমরা চলে এলাম সিভিল মলে। এটি কাঠমান্ডুর অতি আধুনিক শপিং সেন্টার। এখানকার মডার্ণ ছেলেমেয়েদের পদচারণায় সিভিল মল তাদের আঁটোসাঁটো কোটের সঙ্গে রংবেরংয়ের টুপি পরার সংস্কৃতি ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে অনেকদূর, পশ্চিমে। তবে পুরোপুরি পশ্চিমা সংস্কৃতির ঢল এখানে এখনও নামেনি।
সিভিল মলের প্রবেশ পথের দুধারে অনেক খোলামেলা খাবারের দোকান। এগুলোর মধ্যে চটপটি, ফুচকা, আইসক্রিম, মমো ইত্যাদির দোকান উল্লেখযোগ্য। সিঁড়ি দিয়ে ওঠেই একটা কাউন্টার থেকে টাকা দিয়ে খাবারের জন্য টিকিট কিনতে হয়। তারপর নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে লাইন দিয়ে খাবার নিতে হয়। শ্রেয়া এ সিস্টেম না বুঝে ফুচকার দোকানে গিয়ে দাঁড়াতেই যে মেয়েটি ফুচকা তৈরি করে ক্রেতাদের দিচ্ছিল সে শ্রেয়াকে একটা ফুচকা দিল। শ্রেয়া সেটি খেয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও আর কোনো ফুচকা পেল না। শেষ পর্যন্ত আমি এগিয়ে গিয়ে ওকে ফুচকা দিতে বলায় সে টিকিট ঘরের দিকে দেখিয়ে দিল এবং টিকিট কিনে আনতে বলল।
আমি দেখলাম, টিকিট কেটে এনে লাইনে দাঁড়ালে ও আর সিনেমা দেখতে পারবে না। কীর্তি এরই মধ্যে ওদের জন্য সিনেমার টিকেট কেনে এনেছে। সিনেমা শুরু হতে আর মিনিট দশেক বাকি আছে। অগত্যা মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সবাই আইসক্রিম খেয়ে ওঠে পড়লাম।
এখানে টুটুল আর বন্যা একটা হিন্দি সিনেমা দেখবে। বাকিরা দেখবে থ্রি-ডি ইংলিশ কার্টুন। আমি আর বেবী সিনেমা দেখার বদলে রুমে ফিরে বিশ্রাম নেব। ওরা সিনেমা হলে ঢুকে গেলে আমি আর বেবী একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
হোটেলে ফিরে আসার পরপরই একটা টেলিফোন পেলাম। কাঠমান্ডু গেস্ট হাউজের একজন কর্মকর্তা আমাকে ফোন করে তার পরিচয় দিলেন। ভদ্রলোকের নাম সতীশ। বাংলাদেশ থেকে আসার আগে তার সঙ্গেই আমার কথা হয়েছিল। আমি তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসে ভদ্রলোকের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসলাম। কমদামে হোটেল বুক করার ব্যবস্থা করার জন্য ধন্যবাদ জানালাম। এরপর বললাম, “আমরা এ গ্রুপের হোটেলেই থাকতে চাই। আমরা যেহেতু পোখরা যাচ্ছি সেখানেও তোমাদের হোটেলেই থাকব। তবে আমাদের কাছ থেকে কম ভাড়া নিতে হবে।
বেশ দামাদামি করে এবার প্রতি রুম ৬০ ডলারে ঠিক করে ফেললাম। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে আমি আবার রুমে ফিরে এলাম। বেবী তখন একা একা শুয়ে আছে। বহুদিন পর যেন আমি ওকে একা খুব কাছে পেয়েছি। অনেকক্ষণ ধরে আমরা জম্পেস আড্ডা দিলাম। ব্যস্ততাহীন, দুঃশ্চিন্তাহীন নিখাদ এই আড্ডায় আকাশ-পাতাল অনেক কিছুই উঠে এল। আমাদের শেষ জীবন কীভাবে কাটবে তাও আলোচিত হয়ে গেল। হঠাৎ লক্ষ করলাম রাত দশটা বেজে গেছে। আশপাশের রেস্টুরেন্টগুলো কয়টা পর্যন্ত খোলা থাকে জানি না। তড়িঘড়ি করে আমরা খাবারের সন্ধানে বের হলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অনেক রেস্টুরেন্ট দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। কাঠমান্ডু গেস্ট হাউজের রেস্টুরেন্টে তো কোনো লোকই পাওয়া গেল না। থার্ড আই রেস্টুরেন্ট এইমাত্র দরজা বন্ধ করল। আমরা অনেক খুঁজে নিউ অর্লিন্স ক্যাফে নামক একটি রেস্টুরেন্ট পেলাম। এখানে বিদেশি পর্যটকদের ভিড় লেগে আছে। আমরা ভেতরে ঢুকে মেন্যু দেখলাম, খাবার পছন্দ হল না। অগত্যা আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে আরও কোনো রেস্টুরেন্ট পাওয়া যায় কি না খুঁজতে গেলাম।
ঠিক এমনি সময়ে মিতুল আর কীর্তিকে দেখি– ওরা হন্যে হয়ে রেস্টুরেন্ট খুঁজছে। এছাড়া অন্যরা কাঠমান্ডু গেস্ট হাউজের সামনের লনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। খাবার পাওয়া যাবে কি না কে জানে? ওদের বেশ উদগ্রীব দেখাচ্ছিল। আমি জানালাম যে, ওখানে একটি রেস্টুরেন্ট খোলা আছে। তবে ওটাতে রুটি আর ডাল ছাড়া আপাতত আর কিছু পাওয়া যাবে না। মিতুলের পরামর্শ অনুসারে আমরা আবার ওই রেস্টুরেন্টে ফিরে গিয়ে একই স্থানে আবার বসলাম। ভাবটা এমন, যেন আমরা ওদের আনতে গিয়েছিলাম। আমরা এখানে রুটি আর ডালের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছি। আর ওদিকে মিতুল, কীর্তি আর টুটুল হেঁটে হেঁটে দূরের একটি ফাস্ট-ফুড রেস্টুরেন্ট থেকে বার্গার খেয়ে এল।
ব্যাগ গুছিয়ে রেখে আমরা বেশ সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালেই আমাদের রওনা হতে হবে পোখরার উদ্দেশে। নেপালের অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে পোখরা অন্যতম। কাঠমান্ডু হতে পোখরার দূরত্ব ২০৮ কিমি; কিন্তু সড়কপথে সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা; কখনও কখনও তার চেয়েও বেশি। পাহাড়ি রাস্তা, পাশে নানারকম মৃত্যুখাদ। এর মধ্যেই গাড়ি চালিয়ে যেতে হয়।
সকালে ওঠে আমরা হোটেলের সৌজন্য নাশতা খেতে গিয়ে দেখি গুণে গুণে কটি পাউরুটির টুকরো, এক বাটি জেলি, আর কিছু পাহাড়ি কলা রাখা আছে। বিশ্বের অন্য কোনো হোটেলেই এর চেয়ে নিম্নমানের নাস্তা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। রেস্টুরেন্টের বেয়ারাদের আচরণও নাস্তার মানের মতোই। নাস্তা খেয়ে আমরা ব্যাগ নিয়ে এসে গাড়িতে উঠলাম। এটি ১৪ সিটের একটি মাইক্রোবাস। চাররাত আর পাঁচদিনের জন্য আমরা এটি ভাড়া করেছি ৩৫ হাজার রুপি দিয়ে। পাঁচদিনে আমরা কোথায় কোথায় যাব, তা আগেই জানিয়ে রাখা হয়েছে। গাড়িতে ওঠার পর গাড়ি বেদমগতিতে ছুটে চলছে।
কাঠমান্ডু শহর ছেড়ে আমরা শহরের উপকণ্ঠ থেকে শুরু হওয়া পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এগুচ্ছি। গাড়ির ভেতর প্রচ- গরম লাগছে। কারণ এর এসি চলছে না। গাড়িতে কেবল ড্রাইভারের পাশের জানালা খোলা যায়, অন্যগুলো আটকানো। এসির বিষয়ে ড্রাইভারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানালেন, গাড়ির এসি ভালোই আছে, তবে এসি চালু করা হবে না। কারণ গাড়ি ভাড়া করার সময় এসি চালানোর কথা বলা হয়নি। এখন এসি চালাতে হলে ২০% বেশি দিতে হবে। আমাদের তো মাথায় হাত। এসি যদি চালানো না হয় তাহলে গরমে আমরা অতীষ্ঠ হয়ে যাব। ট্যুর ম্যানেজার মিতুল তো বেশ বিব্রতই হয়ে গেল। এখন কী করা যায়! আরও ঘণ্টাদেড়েক পথ চলার পর নদীর পাড়ে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট দেখা গেল। পাশে একটা টং টাইপের মুদির দোকান। আমরা চা খাবার জন্য এখানে গাড়ি থামাতে বললাম। এরই মধ্যে সবাই গরমে অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আমরা লাফিয়ে নেমে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম।
এটি একটি খোলা রেস্টুরেন্ট। নদীর পাড়ে অনেকটা জায়গাজুড়ে টেবিল-চেয়ারগুলো ছড়ানো আছে। চারদিকে বেড়া নেই। নদীর দিক থেকে হুহু করে উত্তুরে বাতাস বইছে। মুহূর্তে যেন আমাদের শরীর জুড়িয়ে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যে আবিষ্কার করলাম, অর্থী আমাদের কাছে নেই। ও ঢালু পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে এক্কেবারে নিচে নেমে নদীর পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিচ্ছে। অর্থীকে এ অবস্থায় দেখে নিচে নামার চ্যালেঞ্জ নিল জয়িতা আর শ্রেয়া। কারণ ওরা যদি এই ঢালু রাস্তাটি বেয়ে না নামতে পারে তাহলে তাদের ইজ্জত একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। তাই ওরা অনেক কষ্টে ঢালু পথ বেয়ে বেয়ে নিচে নেমে গেল। আমরা মজা করে চা খেলাম। এখানে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় কাটালাম। টুটুল মুদি দোকান থেকে কলা কিনে আনল। আমাদের দেশে বান্দরবানে এ ধরনের কলা পাওয়া যায়। চা-কলা খাবার পর আমরা আবার গাড়িতে চড়ে পোখরার দিকে রওনা হলাম। এরমধ্যে গাড়ি বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে, সাঁ-সাঁ করে এসি চলছে। আমরা খুব আশ্চর্য হলাম। মিতুলকে জিজ্ঞেস করলাম, “বিষয় কী? ঠান্ডা আসে কোত্থেকে?”
মিতুল জানাল, তাকে ফিট করা হয়েছে। পাঁচদিনের ডিউটি শেষে একটু বখশিস দিলেই চলবে।
দুপুর দেড়টার দিকে আমরা একটি কালচার ভিলেজ রেস্টুরেন্টে থামলাম। এটি পোখরা যাওয়ার পথে তানাহুন নামক স্থানে একটি আবদ্ধ ও খোলামেলা রেস্টুরেন্ট। মানে এর একাংশ দেয়াল দিয়ে আবদ্ধ করা, আর অন্য অংশ চারদিকের দেয়ালহীন, খোলামেলা। রেস্টুরেন্টের বাইরেটা বেশ সুন্দর। আমরা খোলামেলা অংশে গিয়ে নদী আর পাহাড়ের মুখোমুখি হয়ে বসলাম।
এ রেস্টুরেন্টের মেন্যু একেবারেই বাংলাদেশি খাবারের মতো। সাদা ভাত, পাতলা ডাল থেকে শুরু করে ডিম ভাজা পর্যন্ত সবই আছে। আমরা খাবারের অর্ডার দিয়ে আড্ডাবাজিতে মেতে উঠলাম। অল্পক্ষণ পরেই খাবার আসতে লাগল। খাবার যে ভালো ছিল এর প্রমাণ হচ্ছে সব টেবিল থেকেই আবারও নতুন নতুন অর্ডার দেওয়া হল। গাড়িতে এসি দেওয়া বা না দেওয়ার মালিক ড্রাইভার সাহেবকে আমরা যা ইচ্ছা তাই দিয়ে পেট ভরে খাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালাম।
খাওয়া শেষ হওয়ার পরও আমরা এখানে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। জায়গাটা সবার কাছেই ভালো লাগছিল। তারপর এক সময় আবার আমাদের ছুটে চলা শুরু হল। আমরা পোখরা পৌঁছুলাম দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পর। আমাদের গাড়ি পোখরা শহর পেরিয়ে শহরের উল্টোদিকে এগিয়ে চলল। পাকা রাস্তা ছেড়ে শুরু হল ভাঙা রাস্তা দিয়ে যাওয়া। এবার আমার মনে ভয় ঢুকে গেল, এটাও তাহলে পার্ক ভিলেজের মতোই শহর থেকে বিচ্ছিন্ন একটা রিসোর্ট। ওখানে গেলে বাইরে আসার নিশ্চয়ই খুব অসুবিধা। গাড়ি আরও কিছুদূর এসে বামে ঘোরার পর দেখলাম, আমাদের চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে এ এলাকার সুন্দরতম রিসোর্ট ওয়াটারফ্রন্ট। সামনে বিশাল সুইমিংপুল, তারও সামনে এক টুকরো সবুজ মাঠ পেরিয়ে আবার বেশ বড় লেক। আর ওপারে বিশাল পাহাড় আকাশের অনেকটা ঢেকে রেখেছে। পাহাড়ের শীর্ষে একটা সাদা মন্দির। রিসোর্টটা দেখে কেন জানি আমাদের মনটা নেচে উঠল। আহা, তিন তিনটে দিন আমরা এই সুন্দর রিসোর্টে কাটাব। কতই না মজা হবে!
রিসেপশন কাউন্টারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা রুমে চলে গেলাম। আমাদের পাশাপাশি চারটা রুম, দক্ষিণের বারান্দায় এসে দাঁড়ালে অন্য রুমের বারান্দাগুলোও দেখা যায়। চটপট হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই আমরা কজন বেরিয়ে পড়লাম। এ দলের মধ্যে আমার সঙ্গে বেবী, বন্যা আর টুটুল আছে। বাকিরা রুমেই সিনেমা ইত্যাদি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আমরা হোটেলের সামনের লন পার হয়ে সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে ছোট্ট দরজাটি দিয়ে বাইরে চলে এলাম। এখানে চমৎকার একটি সবুজ মাঠ। আমরা মাঠটি পেরিয়ে লেকের পাশে এসে দেখি নিচে বসে অনেকেই বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। আমরা আরও একটু দূরে এসে ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসলাম।
পড়ন্ত বিকেলে পাহাড়ি ফুরফুরে বাতাস আমাদের মনকে যেন কোন সুদূরে উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমরা অনেকক্ষণ বসে গল্প করলাম, অনেকগুলো ছবি তুললাম। সন্ধ্যার আগে আগে হঠাৎ ঝপ করে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল আর বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল। আমরা দৌড়ে হোটেলে চলে এলাম। হোটেলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি থেমে গেল।
আমরা রুমে আসার পর অর্থী আর জয়িতা এসে জানাল যে ওদের ক্ষিধে পেয়েছে। আমি নিচে ওদের রেস্টুরেন্টে গিয়ে মেন্যু দেখতে দেখতে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। প্রতিটি জিনিসের দামই আকাশছোঁয়া। ওরা নিশ্চয়ই দাম বেশি রেখে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের একটা কৌশল নিয়েছে। কারণ এখান থেকে শহরে খেতে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এখান থেকে ট্যাক্সি জোগাড় করা সম্ভব নয় বললেই চলে। আমাদের বিষয়টা অবশ্য অন্যরকম। কারণ আমরা পাঁচদিনের জন্য গাড়ি নিয়েই এসেছি।
আমি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে পাশের গ্রামের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। পাহাড়ের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা এঁকেবেঁকে গ্রামের দিকে এগিয়ে গেছে। এদিকটায় লোক চলাচল খুব কম, গাড়ি-ঘোড়া একদম নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে দু-একটা মোটর সাইকেল এ পথে চলে। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা দোতলা পাকাবাড়িতে ‘হোটেল ও রেস্টুরেন্ট’ লেখা সাইনবোর্ড দেখে এগিয়ে গেলাম। নিচে একটা রুমে একটা কম্পিউটার সামনে নিয়ে একটা মেয়ে বসে কাজ করছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে রেস্টুরেন্টটি কোথায়?”
সে আমাকে সিঁড়ি দেখিয়ে বলে দিল, “দোতলায়।”
আমি দোতলায় গিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই। একটা রুমে গোটাতিনেক টেবিল আর তার সঙ্গে বেশ কটি চেয়ার রাখা আছে। বাইরের খোলা ছাদেও একটি টেবিল আর চারটি চেয়ার পাতা। আমি জোরে জোরে ডাকলাম, “এখানে কেউ আছেন?”
পাশের একটি রুম থেকে দরজা ঠেলে একটি মেয়ে আমার সামনে এসে হাসিমুখে দাঁড়াল। তার পরনে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট ও নীল টি-শার্ট। বিনয়ের সঙ্গে কুর্নিশ করে মেয়েটি বলল, “নমস্তে।”
আমি ধন্যবাদ দিয়ে বললাম “তুমি কি এই রেস্টুরেন্টে কাজ কর?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার নাম কী?”
“কুসুম।”
“কুসুম মানে কী?”
“আমি জানি না।”
“আমাদের দেশে কুসুম মানে ফুল।”
কুসুম আমাকে একটা ছাপানো মেন্যু এনে দিল।
তাদের মেন্যু দেখে আমি খুবই খুশি হলাম। এখানে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই থেকে শুরু করে সকল ফার্স্ট ফুড, ভাত, পোলাও এবং ডাল পর্যন্ত আছে। আর এগুলোর দাম অবিশ্বাস্য রকম কম। রেস্টুরেন্টটি ওদের পারিবারিক এবং খুব পরিচ্ছন্ন। ওর বাবা একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকুরি করেন। কুসুমের মা আর ওদের দুবোন মিলে এই পারিবারিক ব্যবসা চালায়। বাড়ির দোতলায় রেস্টুরেন্ট আর তাদের থাকার ঘর। অন্যদিকে নিচতলায় রয়েছে হোটেল, অর্থাৎ ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা। এখানে প্রধানত রাশিয়া বা অন্যান্য দেশের পর্যটকরা অতি অল্প ভাড়ায় থাকেন। আমি কুসুমের রেস্টুরেন্টে অনেক ধরনের ফার্স্ট ফুডজাতীয় খাবারের অর্ডার দিলাম। এর মধ্যে ফ্র্যাঞ্চ ফ্রাই, মুরগি ভাজি, সব্জি ভাজি, কপি ভাজি ইত্যাদি আছে। আমার খাবার বানাতে কিছুটা সময় লাগবে বলে কুসুম আমাকে একটা চা দিয়ে গেল। এরই মাঝে ওর মা চলে এসেছেন। তিনিও খাবার বানাবার কাজে হাত লাগালেন। আমি যাতে একা বসে বসে অস্থির না হয়ে পড়ি সে জন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওরা মা-মেয়ে পর্যায়ক্রমে রান্নাঘর থেকে বাইরে আসছে আর দু-একটা কথা বলে চমৎকার একটা করে হাসি উপহার দিয়ে আবার রান্নাঘরে ঢুকে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর কুসুমের মা আমার হাতে খাবারের প্যাকেটটি তুলে দিলেন। খাবারের প্যাকেট দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। খাবার যাতে ঠান্ডা না হয়ে যায় সে জন্য সেগুলো ফয়েল পেপার দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে মুড়িয়ে দিয়েছেন ভদ্রমহিলা। দাম চুকিয়ে দিয়ে হোটেলে এসে সবার সামনে আমি খাবার খুলতে লাগলাম। এ সময় সবাই এগিয়ে এসে আমাকে সাহায্য করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এতগুলো খাবার হাওয়া হয়ে গেল। আমার খুব ভালো লাগল এই খাবারগুলো সবাই পছন্দ করেছে বলে।
রাতে আমরা গাড়ি নিয়ে শহরে খেতে গেলাম। প্রথমে সবাই দোকানপাটে ঘুরে বেড়াল। টুকটাক নেপালি জিনিসপত্র কেনাও হল। ভারতীয় সিনেমা দেখে দেখে জয়িতা কিছু কিছু হিন্দি বলা শিখেছে। ওর নিজের কাছে কিছু টাকাও আছে। ও যা দেখছে, তাই কিনে ফেলতে চাইছে। দোকানদারের সঙ্গে হিন্দি ভাষায় কথা বলছে সে। দামাদামি করছে।
শহরের শেষ দিকে একটা রেষ্টুরেন্টে আমরা খেতে বসলাম। রেস্টুরেন্টটি মোটামুটি মানের। খাবার তেমন একটা ভালো লাগল না। রাতে আমরা যার যার বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে গভীর রাতে ঘুমালাম। সকালে ওয়াটারফ্রন্ট রেস্টুরেন্টে নাস্তা সৌজন্য হিসেবে দেওয়া হবে। আমরা একটু দেরি করে সেখানে গেলাম এবং পরিচিত নানা ধরনের খাবার দিয়ে নাস্তা করে নিলাম। এখানকার বেয়ারাগুলো খুব ভালো। তারা হাসিমুখে নানা ধরনের খাবার এনে দেয়। দুপুরের আগে আগে আমরা গাড়ি নিয়ে শহরে চলে এলাম। ঘুরে ঘুরে শহরটা দেখে নিলাম আমরা। চমৎকার ঐতিহাসিক একটি শহর। বহু পুরনো আমল হতেই এটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত। দুপুরে আমরা একটি ভেজিটারিয়ান রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। আর মিতুলের নেতৃত্বে ছোটরা গেল ইকিরি বিকিরি মার্কা কী যেন একটা রেস্টুরেন্টে। সেখানে গিয়ে তারা আজব কিছু খাবার খেয়ে খুশিতে লাফাতে লাফাতে ফিরে এল। আর আমি সেই চিরদিনের বন্ধু ডিম ভাজি দিয়ে খেয়ে নিলাম।
বিকেলটা আমাদের কাটল কাছের একটা নদীতে বোটিং করে। চমৎকার লেইক টাইপের একটা শান্ত নদী। এর দুদিকে উঁচু পাহাড় ভর্তি সবুজ গাছ। বিকেলের হালকা হিমেল বাতাস আমাদের আনন্দকে আরও সমৃদ্ধ করলো। সন্ধ্যার পর আমরা নদীর তীরে বসে আড্ডা দিলাম। রাতে শহর থেকে রাতের খাবার খেয়ে আমরা ওয়াটারফ্রন্টে ফিরলাম। আজ একটু সকাল সকাল ঘুমুতে হবে। কারণ কাল খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবাই সারাংকোট পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখতে যাবে। আমি অবশ্য ঘুমুতে যাওয়ার আগে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছি, জীবনে বহু স্থান থেকেই সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখেছি। এটা দেখার জন্য ঘুম বাদ দিয়ে শেষ রাতে পাহাড়ে চড়তে পারব না।
শেষ রাতে সকলের হৈচৈ শব্দে আমারও ঘুম ভাঙল। খুব আড়ম্বরপূর্ণ সাজুগুজু করে ওরা বেরুতে যাচ্ছে। আমার আর ঘুম হবে বলে মনে হচ্ছে না। এখন আমার ‘আবার সাধিলেই খাইব’ এমন অবস্থা। বেরুতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে বেবী কেন জানি দয়া করে বলল, “চল না, তুমিও চল। একা একা শুয়ে থাকতে তোমার ভালো লাগবে?”
এর জবাবে আমি যদি বলি, “হ্যাঁ, খুবই ভালো লাগবে।”
তাহলে একটা দাম্পত্য কলহের সূচনা হতে পারে। তাছাড়া আমারও ভালো লাগছিল না। সূর্য বেচারা তো উঠবেই, এটা তার কপালের লিখন। সে না উঠে পারবে না। আমি সূর্য দেখি বা না দেখি, সবার সঙ্গে হৈচৈ তো করতে পারব! আমি যাব বলে পাঁচ মিনিটের সময় নিয়ে মোটামুটি সাড়ে এগারো মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে ওদের সঙ্গে নেমে গেলাম। গাড়ি শহর পার হয়ে অনেক ডান-বাম করে পাহাড়ে আরোহন করার পাঁয়তারা করছে। এদিকে পুব আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। আমরা পৌঁছার আগেই সূর্য উঠে যেতে পারে এমন আশংকায় এখন সবাই কাতর। এ মুহূর্তে বন্যা আবার একটু বিটলেমি বুদ্ধি খাটিয়ে দিল।
সে বলল, “আমরা ঠিক সময়েই পৌঁছুতে পারতাম, মাহফুজ ভাই সাড়ে এগার মিনিট দেরি করায় এখন সূর্যোদয় দেখতে পাব না।”
ওর কথা শুনে সবাই এখন একটা যেন সহি কারণ পেয়ে গেল। আলোচনা শুরু হয়ে গেল আমার দেরি করা নিয়ে। আমি দেখলাম মহাবিপদ।
আমি তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, “আগামী ১৫ তারিখ নাকি হেফাজতে ইসলামির সম্মেলন, মতিঝিল শাপলা চত্বরে। আল্লাহ জানেন কী হয়।”
এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। বন্যা এবার হুজুরদের প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিল। ততক্ষণে আমরা সারাংকোটের একটি পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। ভাগ্য অতি সুপ্রসন্ন, সূর্য কেবল ভাব দেখাচ্ছে, এখনও সারিবদ্ধ পাহাড় ডিঙিয়ে উঁকি দেয়নি। আমরা তাড়াতাড়ি হেঁটে পাহাড়ের শীর্ষে চলে এলাম। এখানে ইতোমধ্যে বহু মানুষের সমাবেশ ঘটেছে। চীন, ইউরোপ, ভারতসহ অনেক দেশের মানুষের চেহারা দেখা যাচ্ছে এখানে, দেখা যাচ্ছে না শুধু সুরুজ মিয়াকে। সে কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। আর এই পাহাড়ের শীর্ষে লাল চাদর গায়ে জড়িয়ে বসে আছে বেবী, জ্যাকেট গায়ে থিরথির করে কাঁপছে বন্যা, ড্যাবড্যাবে চোখে পুবের দিকে তাকিয়ে আছে অর্থী, শ্রেয়া আর জয়িতা। ওদিকে মিতুল আর কীর্তি ছবি তোলায় ব্যস্ত। ওদের মনে প্যারাগ্লাইডিং নিয়ে বিপুল উৎসাহ। আশপাশের পাহাড় থেকে কিছু লোক প্যারাগ্লাইডিং করছে, অর্থাৎ একটা প্যারাস্যুট নিয়ে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ছে, নিচে এসে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
আজ সকাল ১০টার দিকে ওরাও প্যারাগ্লাইডিং করবে; গতকালই টিকিট কিনে এনেছে। সেই থেকে আমার মনে ভয় ঢুকে গেছে, আল্লাহ না করুক, ঠিক ওদের প্যারাস্যুটটাই যদি ফুটো হয়ে যায়!
টুটুল পাশের দোকান থেকে চার কাপ চা নিয়ে এল। এই ঠান্ডা আবহাওয়াতে গরম চা পেয়ে সবাই খুব খুশি। যারা চা পেল না তারা অন্তত দোকানের খোঁজ পেল, ওদিকে গেলে চা খাওয়া যাবে।
আমিও জ্যেষ্ঠতার সূত্রে জায়গায় বসেই আওয়াজ দিয়ে এক কাপ চা পেয়ে গেলাম। টুটুলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিলাম। এখন ধীরে ধীরে দর্শক কমতে শুরু করেছে। আরও কিছুক্ষণ পর সবাইকে হতাশ করে দিয়ে ঝপাৎ করে সূর্য অনেকটা উপরে চড়ে বসল। এটা দুপুরের সূর্যের মতোই কড়া। পাশের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে যেমন নতুন কোমলমতি বউয়ের ইমেজটা পাওয়া যায় না, তেমনি আমরা লাল আভা ছড়িয়ে সেজেগুঁজে ধীরে ধীরে প্রবীণ হওয়া সূর্যের স্বাদটা পেলাম না। অগত্যা আমাদের চলে আসতে হল।
আমরা হোটেলে ফিরে এসে নাস্তা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার মনের গহীনে একটা চাপা ভয় রয়ে গেল যে কীর্তি আর মিতুল আকাশে উড়তে যাবে। ওদের যাওয়া দেখলে আমি হয়তো আরও অশান্তিতে পড়তে পারি, এ ভয় থেকে আমি আরও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলাম। হোটেলের সামনের সুইমিং পুলে ডুবসাঁতার দেওয়ার জন্য বেবী আমাকে ডেকে উঠাল সাড়ে দশটায়। আমরা তাড়াতাড়ি সুইমিং-এর পোশাক আর হোটেলের টাওয়েল নিয়ে নিচে নেমে এলাম। আমি আর টুটুল চেঞ্জ রুমে গিয়ে হাফপ্যান্ট পরে চলে এলাম পুলসাইডে। তারপর চটপট নেমে পড়লাম চমৎকার পানিতে।
আমি তো নরসুন্দা পাড়ের ছেলে, ছোটবেলাতেই সাঁতার রপ্ত করেছি। অবলীলায় আমি সুইমিং পুলের এপাড় থেকে ওপাড়ে সাঁতার কাটতে লাগলাম। ওদিকে টুটুল ছোটবেলা থেকেই শহরে মানুষ। সে একটা গোল টিউব বুকের নিচে নিয়ে অনেক কষ্টে সাঁতার কাটতে শুরু করল। এদিকে বেবী আর বন্যা চেঞ্জ রুম থেকে মুখ আঁধার করে বেরুচ্ছে দেখে আমরা ঘাবড়ে গেলাম। হঠাৎ গৃহশান্তি বিঘ্নত হচ্ছে কেন? ওরাই তো সুইমিং পুলে নামার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিল। এখন মুখ গোমরা করে পুলসাইড চেয়ারে বসতে যাচ্ছে কেন? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
বেবী মুখটাকে একটু গাব্বু বানিয়ে বলল, “সুইমিং কস্টিউম না পরলে নামতে দেবে না। সালোয়ার কামিজে হবে না।”
“তাহলে ওদের কাছ থেকে ধার নিয়ে পরে ফেল।”
“চুপ কর। দুনিয়ার কত জায়গায় সালোয়ার কামিজ পরে সুইমিং পুলে নেমেছি। এখন নেপাল এসে এসব পরতে হবে?”
আমরা মনের আনন্দে সাঁতার কাটছি আর ওরা তীরে বসে গল্প করছে। এমন সময় মিতুল আর কীর্তি এল আমাদের মাঝে। ওরা এইমাত্র প্যারাগ্লাইডিং করে ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করেছে। আনন্দে ঝিকঝিক করছে ওরা।
ওদের আনন্দ দেখে অর্থী বায়না ধরে বসল, সেও প্যারাগ্লাইডিং করবে। ওর এই আব্দারের সঙ্গে একমত হয়ে গেল বেবী আর বন্যা। ওদের সামনে আমি তো অসহায়। অগত্যা রাজি হতে হল। ভাগ্য ভালো, সেদিন আর টিকিট পাওয়া গেল না।
আমাদের হোটেলটি এমন জায়গায় যে সারাদিন ধরে প্যারাগ্লাইডারগণ এর আশপাশে এসে ল্যান্ড করেন। দেখতে অদ্ভুত লাগে। আমরা সারাজীবন আকাশ থেকে এভাবে শকুনদের ল্যান্ড করতে দেখেছি। আর আমাদের চোখের সামনে ধুপধাপ মানুষ নেমে আসছে আকাশ থেকে। আকাশে যেন অনেকগুলো ফুল ফুটে আছে। রংবেরংয়ের প্যারাস্যুট নিয়ে আকাশে উড়ছে বহু মানুষ। দূর থেকে দেখে মনে হয় না কেউ ভয় পাচ্ছে। মনে মনে দু-একবার ভেবেছি, আহা, অর্থীকে একটিবার উড়তে দিলে ভালোই হত! ও একটু মজা করতে পারত। আবার কবে ও নেপাল আসতে পারে, কে জানে!
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে বিকেলের দিকে। আমি আর বেবী হোটেরের বারান্দায় বসে আছি। কিছুক্ষণ পর পর চিলের মতো উড়তে উড়তে প্যারাগ্লাইডারগণ আশপাশে এসে ল্যান্ড করছে। এসব দেখতে খুবই ভালো লাগছে। আগামীকাল আমাদের নাগরকোট যাওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে আমরা কোনো হোটেল বুক করিনি। সপরিবারে এ রকম একটা অনিশ্চিত স্থানে বেশ অসহায় লাগে।
মিতুল অবশ্য বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলছে, “কোনো অসুবিধা হবে না। আমরা কোনো না কোনো হোটেল পেয়ে যাব। আমি একটু ট্রাই করে দেখি– এমন ভাব নিয়ে সতীশকে একটা ফোন করলাম। তাঁর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে ওয়াটারফ্রন্ট এর মতো একটা চমৎকার হোটেলে বুকিং দিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম। তিনি খুব খুশি হলেন। এবার তাকে নাগরকোটে একটা হোটেল বুক করে দেবার জন্য অনুরোধ জানালাম। রুমের ভাড়া হিসেবে প্রতিরুম ৪০ ডলারে বেঁধে দিলাম। প্রথমে তিনি একটু আমতা আমতা করলেও শেষে আমার জন্য চেষ্টা করছেন বলে জানালেন। এরও আধা ঘণ্টা পর তিনি আমাকে বুকিং নিশ্চিত করে দিলেন। নাম ভাংগেরি হোটেল। চারটি রুমের জন্য এক রাতের ভাড়া ১৬০ ডলার। আর সকালের নাস্তা ফ্রি। আমি তাঁকে আবার ধন্যবাদ জানিয়ে মনে মনে ভাবলাম, এভাবে চালিয়ে গেলে তো আর দুই দফা পরে বিনামূল্যে রুম পাওয়া যাবে।
বিকেলে আমরা আবার মূল শহরে গিয়ে বেশকিছু শপিং করে নিলাম। শপিং এর ক্ষেত্রে জয়িতা বেশ উৎসাহ দেখাল। যেহেতু সে প্রথম বিদেশে এসেছে তাই সবাই তাকে দশটা বিশটা ডলার দিচ্ছে। এগুলো ভাঙিয়ে সে যা দেখছে তাই কিনে নিতে চাচ্ছে। আমি শ’খানেক নেপালি টুপি কিনে নিলাম সবাইকে দেব বলে। রাতে আমরা আবার সেই ভেজিটারিয়ান রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম। আর মিতুলরা আবার সেই ব্যতিক্রমী খাবার খাওয়ার জন্য কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
পরদিন সকালে নাস্তা সেরেই আমরা হোটেল ছেড়ে মাইক্রোবাসে উঠে বসলাম। আমাদের আজ অনেক দূর যেতে হবে। সেই কাঠমান্ডু পেরিয়ে ভক্তপুর ছেড়ে আমরা যাব নাগরকোট। আবার সেই পাহাড়ি রাস্তা, আবার সেই পাহাড়ি নদী, আবার সেই ঝরনাধারা।
এসব দেখতে দেখতে আমরা দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম রাস্তার পাশে একটা হোটেলে। একটা রেস্টুরেন্টের এতগুলো শাখাপ্রশাখা আমি আগে আর কোথাও দেখিনি। অনেকটা জায়গাজুড়ে ছায়া সুনিবিড় এই রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম খাবার পাওয়া যায়। সবখানেই পেটচুক্তি পদ্ধতি বা বুফে সিস্টেম। মূল হাইওয়ে থেকে উপরে উঠেই একটা ইউনিট।
এখানে ভারতীয় সাধারণ খাবার পাওয়া যায়। যেমন ভাত, পোলাও, মুরগি, মাছ, ভাজি, ডাল ইত্যাদি। আবার পাহাড়ি রাস্তা ধরে কিছুটা উপরে উঠে গেলে আবার অন্য একটি ইউনিটে নেপালি খাবার। এর বামদিকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলে সেখানে আবার চাইনিজ টাইপ খাবারের আরও একটা ইউনিট। আমরা ভারতীয় টাইপের সাধারণ খাবারের দোকানের পাশে একটি বড় বড় ঘন পাতাওয়ালা একটি গাছের নিচে রাখা টেবিল চেয়ারে বসে গেলাম। গরমের মাঝেও ঝিরিঝিরি বাতাস গায়ে একটা আরামের প্রলেপ দিয়ে যাচ্ছে যেন। আমরা কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নেওয়ার পর খাবার আনতে গেলাম। এখানে যে মানুষটি ডিউটি করছেন তিনি খুবই আন্তরিকভাবে খাবার পরিবেশন করলেন। তিনি আমাদের চাহিদা অনুসারে ভেতর থেকে সালাদ-লেবু ইত্যাদিও এনে দিলেন। আমরা খুব তৃপ্তির সঙ্গে দুপুরের খাবার শেষ করে আবার রওনা হলাম।
আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে আমরা কাঠমান্ডু পৌঁছে গেলাম। আমাদের গন্তব্য নাগরকোট। তাই আমরা কাঠমান্ডু না ঢুকে সরাসরি নাগরকোটের দিকে এগিয়ে চললাম। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমরা নাগরকোট পৌঁছে গেলাম। এখানে রাস্তাগুলো ক্রমে উপরের দিকে উঠে গেছে। পাহাড়ের চূড়াগুলোতে এক একটা হোটেল। সবগুলো হোটেলই মেঘের রাজ্যে। শহরের মাঝখানে শীর্ষ চূড়ায় উঠে একটু থামল গাড়িটা। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের হোটেলের নাম কী?”
“ভাংগেরী হোটেল।” মিতুল ওকে বলল।
“ভাংগেরী? ওকে।”
এটা শহরের শেষ হোটেল। আমাদের আরও পাঁচ কিলোমিটার যেতে হবে।
ড্রাইভার এবার গাড়িটাকে সামনের দিকে নিয়ে চলল। আমরা বেশ ক্লান্ত, কোনোমতে হোটেলে পৌঁছুতে পারলে যেন বাঁচি। আর এ রকম পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে চলতেও ভয় লাগে। গাড়ি একটু সটকে গেলে কয়েকশ’ ফুট নিচে পড়ে যেতে হবে। যাক, গাড়ি যতই এগুচ্ছে রাস্তা ততই সরু হয়ে আসছে। আর সেই সঙ্গে আমার মনের ভেতর শংকা যেন ডংকা বাজাচ্ছে। একা একা ভ্রমণ করলেও এক কথা, আমি তো সপরিবারে এসেছি। কোনোমতে এই ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা ডিঙিয়ে একবার দেশে যেতে পারলে আর জীবনে নেপাল আসব না। মাইলখানেক যাওয়ার পর ড্রাইভার গাড়িটাকে একটা পাহাড়ের পাশ দিয়ে ঢালু একটা কাঁচা রাস্তায় নামিয়ে আনল। খাড়া পাহাড়ের কিছুটা অংশ কেটে সম্প্রতি এই রাস্তা বানানো হয়েছে। এখানে উল্টোদিক থেকে একটা গাড়ি এলে ভাগ্যে কী আছে কে জানে?
এখানে দুটো গাড়ি ক্রস করতে হলে আমাদের গাড়িকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যেতে হবে। ভয়ে আমার আত্মা উড়ে গেল। আমি কেবলই আল্লাহ আল্লাহ করছি। ড্রাইভারকে সাবধানে চালাবার জন্য বলছি, আমার কথা সে শুনতে পাচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। কোন কোন স্থানে রাস্তা এতটাই সরু যে ভয়ে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, আমাদের কি নেমে বাকি রাস্তা হেঁটে যাওয়া উচিত কি না। আরও কিছুদূর গিয়ে একটা সমতল ভূমিতে আমাদের গাড়িটা থামল। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, এর উপরে অনেকদূর পর্যন্ত পাহাড়। আর পাহাড়ের উপর একটা হোটেল। আবার আমরা যেখানে গাড়ি থেকে নেমেছি তা থেকে নিচের দিকেও একটা হোটেল। নাম দেখে বুঝতে পারলাম নিচেরটাই আমাদের হোটেল। আমাদের নামতে দেখে হোটেলের কর্মচারীদের একটা দল উপরে চলে এল আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য।
তারা আমাদের মালপত্র বহন করে নিচে নিয়ে গেল। আমরাও হোটেলের লবিতে গিয়ে বসলাম। হোটেলের কর্মকর্তাগণ খুব স্মার্ট আর ভদ্র। আমরা লবিতে বসার পর একজন ভদ্রলোক এসে পরিচয় দিলেন। এ হোটেলে কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে সব বর্ণনা দিলেন। ততক্ষণে আর একজন বেয়ারা ওয়েলকাম ড্রিংকস নিয়ে এলেন। হোটেলের প্রত্যেক কর্মচারীই সুন্দর পরিপাটি পোশাকে সজ্জ্বিত এবং কাস্টমারের মন গলাতে সদাব্যস্ত। আমরা ওয়েলকাম ড্রিংকস শেষ করার আগেই ওয়েস্টার্ন পোশাকে সজ্জিত কেতাদুরস্ত প্রকৃতির একজন ভদ্রলোক এসে নিজ নাম বললেন এবং পরিচয় দিলেন যে তিনি এই হোটেলের প্রধান বাবুর্চি। তিনি খাতা-কলম নিয়েই এসেছেন। আমরা এখন বিকেলে কী খাব, রাতে কী খাব এবং কখন খাব, সকালে কী খাব ইত্যাদি তিনি নোট করে নেবেন। নিরিবিলি পাহাড়ি এলাকায় এসে পড়েছি, খাবারের দাম কত হবে কে জানে? হোটেলওয়ালাদের জন্য এটাই সুযোগ, প্রতি রুমের ভাড়া ৪০ ডলার দেওয়ার বদলা নেওয়ার। আমি মেন্যু হাতে নিয়ে দেখলাম দাম মোটামুটি কমই। তখন মনে পড়ল, বেবী ফার্মের মুরগি খায় না। থাইল্যান্ড গিয়ে সে দেশি মুরগি খাবার আগ্রহ দেখিয়েছিল। সেখানে তা পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই নেপালে তো দেশি মুরগি পেতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমি প্রধান বাবুর্চি সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, এখানে কি লোকাল চিকেন পাওয়া যাবে?”
“নিশ্চয়ই যাবে স্যার।
“কোথায় পাওয়া যাবে? বাজারে?
“জি না। এখানে কোনো বাজার নেই। আপনি চাইলে পাহাড়ের পাদদেশে ঐ যে বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে, ওখানে গিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে জোগাড় করা সম্ভব। তবে এক্ষুনি লোক পাঠাতে হবে। অন্ধকার হয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না।
“এভাবে কিনতে গেলে একটা মুরগির দাম কত হতে পারে?
“আড়াই হাজার টাকা থেকে তিন হাজার টাকা।
তিনবেলা খাবারের অর্ডার দিতে দিতে আমাদের রুম বরাদ্দ হয়ে গেল। আমরা যার যার রুমে ঢুকে গেলাম। সুসজ্জিত বড় বড় রুম। সব রুমেই পুবদিকে বড় বারান্দা। এখানে দাঁড়িয়ে সকালে সূর্যোদয় দেখার ব্যবস্থা। হোটেল কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগেই জানিয়েছে যে তারা ভোর পৌণে পাঁচটায় টেলিফোনে জাগরণি কল দেবেন।
আমরা রুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে ছোটবড় গ্রুপে ভাগ হয়ে আড্ডায় নিমগ্ন হয়ে গেলাম। আমাদের বিকেলের নাস্তা ঘরেই চলে এল। স্প্রিং রোল, ফ্র্যাঞ্চ ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই আর কফি। চমৎকার মুখরোচক নাস্তা। সারাদিনের ক্ষিধে আর ক্লান্তি যেন মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল। সন্ধ্যার পর ধীরে ধীরে শীত বাড়তে শুরু করল। আমাদের ঘরের পুবদিকের দরজায় ছোট্ট একটা ফুটো ছিল। সে ফুটো দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দে ঠান্ডা কনকনে বাতাস ঢুকতে শুরু করল। সবারই প্রথমে পা এবং ধীরে ধীরে সমস্ত শরীর কম্বলের নিচে চলে যাচ্ছে। আড্ডা তেমন জমছে না। টুটুল টেলিফোনে সবার জন্য চা আর কফির অর্ডার দিল। ঠান্ডার দৌরাত্ম্য এমন যে কফি আনতে আনতে অর্ধেক ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেই কফি খেয়ে আমরা কিছুটা গরম হলাম।
রাত নয়টা নাগাদ রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাক এল। আমরা স্যুয়েটার-টুয়েটার পরে নিচে নেমে এলাম। ডাইনিং রুমে এসে দেখি এলাহী কা-। আমাদের জন্য পৃথক একটি টেবিল সাজানো হয়েছে। খাবারগুলো এত সুন্দরভাবে সাজানো যে দেখেই আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সবাই অত্যন্ত তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারলাম। নেপালে আসার পর এই প্রথম সবাই আনন্দ নিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে খেল।
বাবুর্চি সাহেবকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি করে রুমে ঘুমাতে গেলাম। আমরা খুব দ্রুতই কম্বলের নিচে ঢুকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বলতে পারব না।
সকালে যখন ঘুম থেকে অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে জেগে উঠলাম তখন ভোর পৌণে পাঁচটা। হোটেল কর্তৃপক্ষ রুমে রুমে ফোন দিয়ে সবাইকে জাগিয়ে দিচ্ছেন সূর্যোদয় দেখার জন্য। সারাংকোটে সূর্যোদয় দেখার বিড়ম্বনা আমি এখনও ভুলিনি। এখানে আবার সূর্য দেখার জন্য ঘুম জলাঞ্জলি দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। বেবীকে আমি চোখ বন্ধ করেই বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? বেবী চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে পড়ল। দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আশপাশের সকল রুমের বারান্দা থেকেই আওয়াজ আসছে। অনেকেই ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি এদের কলকাকলিতে বেশ বিরক্ত। ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে। হঠাৎ কী জানি ঘটল, সব রুমের বারান্দা থেকে বহু লোক এক সঙ্গে চিৎকার দিয়ে উঠল।
এর মধ্যে উচ্চস্বরে কেউ বাংলায় বলছে, “মাগো, কী সুন্দর!”
আবার কেউ-বা চাইনিজ ভাষায় বলছে, “চিং মিং টিং মিং।”
এক সময় লক্ষ করলাম আমিও বারান্দায় চলে এসেছি। পুবের আকাশের দিকে চেয়ে আমি নির্বাক হয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। পৃথিবীতে এমন সুন্দর কিছুও থাকতে পারে! পাহাড়ের ভাঁজকে ভিত্তি করে ঢেউ খেলানো রংয়ের বাহার ছড়িয়ে আছে পুবদিকে। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অনেকক্ষণ ধরে। মনে হচ্ছে, আমাদের নেপাল আসা সার্থক হয়েছে। পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে এমন সুন্দর দৃশ্য কোনোদিন দেখিনি। আমি মনপ্রাণ ভরে উপভোগ করলাম এ দৃশ্য, ছবি নিলাম, ভিডিও করলাম।
পুবের আকাশ খুব দ্রুত রং বদলাচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে। সূর্য যেন লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠে আসছে। খুব স্বল্পসময়ের ব্যবধানে সূর্য পাহাড় ডিঙিয়ে উঠে এল। আকাশে রং এর খেলা কমে আসতে শুরু করল এবং এক সময় তা অতি সাধারণ দৃশ্যে পরিণত হল।
আমরা আবার ঘুমুতে গেলাম।
সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেতে গেলাম। বিশ্বের অনেক বড় বড় হোটেলেও এ রকম মজার নাস্তা পাওয়া যায় না। অথচ নেপালের এই গহিন বনে পাহাড়ের কোলে একাকী বসে থাকা ভাংগেরি হোটেলের নাস্তা দেখে আমরা খুবই আপ্লুত হয়ে গেলাম।
আমরা আমাদের পছন্দমতো খাবার বেছে নিলাম। এতেও আমাদের নিস্তার হল না। বয় থেকে শুরু করে বাবুর্চি পর্যন্ত নানা ধরনের খাবার নিয়ে আসতে শুরু করল এবং জোর করেই পাতে তুলে দিতে লাগল। এ ক্ষেত্রে যার যা পছন্দ সে রকম খাবার পরিবেশনের বিষয়েও ওরা সচেতন ছিল। আমরা তৃপ্তির সঙ্গে নাস্তা সেরে রুমে গেলাম এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই সেখান থেকে বিদায় নিয়ে ব্যাগসহ গাড়িতে এসে বসলাম।
পাহাড়ের কোলে তৈরি অতি সরু রাস্তা ধরে গাড়িটি এগিয়ে চলল। কেন জানি গতকালের চেয়ে আজ একটু কম ভয় লাগছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি বড় রাস্তায় এল এবং পাহাড়ের সুউচ্চ পিঠ থেকে ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল। আধা ঘণ্টাখানেক পর আমরা ভক্তপুর এসে পৌঁছলাম। এখানে অনেক অনেক মন্দির। চমৎকার কারুকাজখচিত মন্দিরগুলো দেখতে খুব চমৎকার। এসব মন্দিরগুলো বর্তমানে ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুযায়ী ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট।
ভক্তপুর কাঠমান্ডু শহরের পুবদিকে অবস্থিত। পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝমাঝি পর্যন্ত এটি নেপালের রাজধানী ছিল। তখন ছিল মালা বংশের রাজত্বকাল। সে আমলে ভক্তপুর ‘জো জো ধাও’ নামে এক বিশেষ ধরনের দই এর জন্য বিখ্যাত ছিল। এ ধরনের দই নেপালের অন্য কোনো এলাকায় তৈরি হত না। বর্তমান সময়েও ‘জো জো ধাও’ নেপালে একটি আকর্ষণীয় খাবার। আবার এ এলাকা দেবদেবীর নানা মুখোশ পরে করা নৃত্যের জন্যও বিখ্যাত ছিল।
এখানকার ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা, স্থাপনা, ঐতিহাসিক ভাস্কর্য ও কাঠের কাজ, কারুকার্যময় দরজা-জানালা, মৃৎপাত্র, বুনন শিল্প, সুন্দর মন্দির, রংবেরংয়ের স্থানীয় পোশাক, সংস্কৃতি, উৎসব, বাদ্য ও সংগীত– এসব জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে। আমরা এখানে ঘুরে ঘুরে স্থাপনাগুলো দেখার সুযোগ পেলাম। দরবার স্কয়ারের লায়ন গেইট, গোল্ডেন গেইট, ৫৫ জানালাবিশিষ্ট প্যালেস, পিকচার গ্যালারি, রাজা ভূপতীন্দ্র মালার ভাস্কর্য, বাতশালা মন্দির পুষ্পপতি মন্দির দেখতে মনোরম। এসব একা একা মন দিয়ে দেখা যায়। আবার একজন গাইড নিলে সেও ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে প্রতিটি স্থাপনার ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য বুঝিয়ে দিতে পারে।
ভেতরে ঢুকে আমরা মন্দিরগুলোর কারুকাজ দেখে মোহিত হয়ে গেলাম। একটা ভবনের সামনের টানা বারান্দায় অনেকগুলো শিশু আর্ট প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। আমি ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকটা শিশুর চিত্রকর্ম দেখেছি। ওরা অনেক সুন্দর করে মন্দিরগুলোর চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছে।
ভক্তপুরে আরও অনেক মন্দির আছে। এগুলোর মধ্যে ন্যাতাপোল মন্দির, ভৈরবনাথ মন্দির, দত্তত্রয়া মন্দির, চ্যাঙ্গো নারায়ণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আমরা ঘুরে ঘুরে এগুলো দেখলাম। ন্যাতাপোল মন্দির ১৭০২ সালে রাজা ভূপতীন্দ্র কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। পাঁচটি ট্যারেসের উপর নির্মিত এই মন্দিরভবনে দুজন বিখ্যাত রেসলারের ভাস্কর্য, দুটো হাতি, দুটো সিংহ, দুটো গ্লিফিনস, বাঘিনি এবং সিংহী এর পাথুরে মূর্তি আছে। বাঘ ও সিংহকে দেবতা বলে কল্পনা করা হচ্ছে।
আমরা সারাদিন ধরে প্রচ- রোদে ঘুরে ঘুরে ভক্তপুরের সকল স্থাপনাগুলো দেখলাম। দুপুরে আমরা মন্দির এলাকাতেই একটা রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিলাম। খাওয়া দাওয়া করার পর আমরা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন মন্দিরের পাদদেশে বসে বিশ্রাম নিলাম।
পড়ন্ত বিকেলে বাইরে আসার পথে একজনকে আইসক্রিম খেতে দেখে আমাদেরও আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে হল। আমরা আশপাশের দোকানগুলো খুঁজে কোথাও আইসক্রিমের সন্ধান পেলাম না। আমি তখন সবাইকে অপেক্ষা করতে বলে আবার মন্দিরের ভেতরের দিকে গিয়ে সেই লোকটাকে খুঁজে বের করলাম যিনি আইসক্রিম খাচ্ছেন। ভাগ্য ভালো, তাঁর আইসক্রিম খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। আইসক্রিমের দোকানের কথা তাঁকে জিজ্ঞেস করাতেই তিনি সানন্দে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে এসে আঙুল উঁচিয়ে আমাকে দোকানটি দেখিয়ে দিলেন।
আমরা সবাই যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি আইসক্রিমের দোকানটি তার খুব কাছে। মাঝখানে একটা ছোট্ট মন্দির ডিজাইনের স্থাপনা থাকায় আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না। এবার আমি সেখানে গিয়ে আইসক্রিম কিনে নিয়ে খেতে খেতে চলে এলাম।
আমরা যখন কাঠমান্ডু পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা উৎরে গেছে। এবার আমাদের জন্য নতুন হোটেল ঠিক করেছে মিতুল। এর নাম হোটেল একসেস। চার রুমের মধ্যে আমাদের রুমটি একেবারেই ব্যতিক্রমী এবং সুন্দর। রুমের বাইরে একটি প্রশস্ত গোলাকার বারান্দা আছে। ছাদওয়ালা এই বারান্দায় বেশ কতগুলো চেয়ার আছে। এখানে বসে সকলে মিলে জম্পেস আড্ডা দেওয়া যায়। আমাদের বারান্দা দেখে চটপট টুটুল আর বন্যা চলে এল। মিতুলসহ অন্য সকলেই ঘন ঘন বারান্দায় আসা-যাওয়া করতে লাগল। এ রকম একটি চটকদার বারান্দার মালিক হিসেবে আমরা খুব আনন্দ পেলাম।
এ এলাকাটার নাম থামেল। এটা কাঠমান্ডুর প্রাণকেন্দ্র। প্রাচীনকাল হতেই এ জায়গাটা ছিল জমজমাট। বিদেশিদের শতকরা আশি ভাগ লোকই বেড়াতে এসে এই থামেল এলাকায় থাকেন। বিভিন্ন দালানে বহু প্রাচীন ঐতিহ্যের নজির দেখা যায়। অনেক রাত পর্যন্ত এখানে দোকানপাট খোলা থাকে। পরের দুদিন আমরা পরম আনন্দে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছি আর আশপাশের রেস্টুরন্টে খেয়েছি। মেয়েরা দিনব্যাপী শপিং করেছে। আমার স্ত্রী তো শপিংঅন্তপ্রাণ। দেশের বাইরে গিয়ে পাকঘরের খুন্তি থেকে শুরু করে বেডরুমের জন্য আলমারি পর্যন্ত নিয়ে আসতে চায়। সে আর বন্যা প্রাণভরে শপিং করেছে। নব্য বিদেশ আগতা জয়িতাও পিছিয়ে থাকেনি। সেও অনেক অনেক জিনিসপত্র কিনেছে। কার কার জন্য উপঢৌকন কিনতে হবে তার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কারও নাম একজন ভুলে গেলেও অন্যজন মনে করিয়ে দিচ্ছে। আবার একজনের জন্য একটা জিনিস কিনে ফেললে সমমর্যাদা সম্পন্ন আরও পাঁচজনের নাম চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। এনার জন্য কেনা হল, তেনারা কী ভাববেন? সুতরাং তেনাদের জন্যও কেনা হোক। এভাবেই তালিকা বাড়ে।
নেপাল ভ্রমণের শেষদিন খাওয়াদাওয়ার পর হোটেলে ফিরে এসেছি। হঠাৎ বেবীর মনে হল, চায়ের সঙ্গে চিনি না মিশিয়ে আলাদা পটে টেবিলে চিনি দেওয়ার জন্য একটা স্টিলের কৌটা সে রেস্টুরেন্টগুলোতে দেখেছে। ওটা না নিতে পারলে নেপাল ভ্রমণই হবে বৃথা। এমনিতেই পৃথিবীর অনেক স্থান ঘোরা বৃথা হয়ে বসে আছে। আমি একটু দেখে আসি বলে বাইরে এলাম। রেস্টুরেন্টে এবং বিভিন্ন দোকানে জিজ্ঞেস করে করে অবশেষে এই চিনির কৌটার একটা ঠিকানা জোগাড় করতে পারলাম। একজন বলে দিলেন, “সোজা গিয়ে ডানে, আবার যেখানে চৌরাস্তা, সেখানে বামে। আবার বেশ কিছুদূর গিয়ে পাবেন দুই রাস্তা, তখন ডানে। এ রকম একটা স্থানে গিয়ে এই কৌটা পেলেও পেতে পারেন।”
আমি সোজা হাঁটা শুরু করলাম। কথামতো ডানবাম করে আমি যেখানে গিয়ে পৌঁছলাম সেখানে কৌটা পাওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। তবে চমৎকার তরতাজা সবজি আর ফলমূল দেখা গেল প্রচুর। বিদেশ বিভুঁইয়ে সবজি কিনে কোনো লাভ নেই। আর এখান থেকে সবজি কিনে বাংলাদেশে নিয়ে যেতে চাইলে আমার বউ খুশি হতে পারে বটে, তবে উড়োজাহাজ কোম্পানি খুবই অখুশি হবে।
শেষপর্যন্ত আবারও মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে এগুতে থাকলাম। কাঁচাবাজারের দোকানদারদের প্রায় সবাই ইংরেজি বুঝতে পারেন না। এখান থেকে বেছে বেছে ইংরেজি জানা মানুষ আবিষ্কার করাও কষ্টসাধ্য। এভাবে অনেক সাধনার পর সাত রাজার ধনের মতোই সেই কৌটা পাওয়া গেল। খুশির চোটে আমি দুটো কৌটা কিনে ফেললাম। ছোটবেলায় রূপকথায় পড়েছিলাম, রাক্ষসের প্রাণ ভোমরা থাকে কৌটায়। সেটাকে মেরে ফেলতে পারলেই রাক্ষসের মৃত্যু হয়। তখন রাজপুত্র আর হারিয়ে যাওয়া রাজকন্যার মুখে হাসি ফোটে। আমার মুখেও কৌটা পেয়ে হাসি ফুটল।
আমি ঝটপট কৌটা নিয়ে রওনা হলাম। কিছুটা পথ এসেছি, ঠিক এমনি সময়ে ঝপ করে নামল বৃষ্টি। আর আমিও একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম। এ ধরনের চেহারার রেস্টুরেন্ট বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জেও প্রচুর দেখা যায়। আমার চোখে পড়ল গরম গরম জিলিপি। আহা, নেপালেও তাহলে জিলিপি পাওয়া যায়! আমি বেশ কয়েক পিস জিলিপি কিনে নিলাম। এখানে প্রতি পিস পাঁচ রুপি করে জিলিপি বিক্রি হচ্ছে।
বৃষ্টি একটু কমলে আমি জোর কদম হাঁটা দিলাম এবং এক সময় লক্ষ করলাম যে, এখানকার পথঘাট আমি চিনতে পারছি না। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে আমি ঠিক উল্টোদিকে যাচ্ছি। অগত্যা আমাকে আবার ফিরতে হল।
পরদিন সকালে আমরা যখন এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হচ্ছি, তখন আমাদের খুব মায়া হচ্ছিল। মাত্র দশদিনেই আমরা নেপালের বন্ধু হয়ে গেছি। এখানকার সব কিছুর সঙ্গে আরও কিছুদিন থাকতে ইচ্ছে করছে। বিদায় নেপাল, বিদায় পোখরা, বিদায় নাগরকোট।

ভিয়েতনামে ভ্রমণ: মুনকেক

 ভিন দেশে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে কারো কারো সঙ্গে একাধিকবার দেখাসাক্ষাৎ হয়ে যায়। কোন কোন মানুষ মেহমানদারীতে অতিশয় সজ্জন। তারা মাতৃভাষার বেড়াজাল ছিন্ন করে পর্যটকদের সঙ্গে অতি সহজে কমিউনিকেট করেন। তাদের সঙ্গে পর্যটনের সময় জানপহচান অন্তরঙ্গতা হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু না। কেউ কেউ বিদেশীদের অভ্যর্থনা করতে নিজ মানসে পুষে রাখেন তুলতুলে কম্বলের মতো উষ্ণতা। মি. উত্রান ও তার পরিবারকে এ পর্যায়েই ফেলা যায়। তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় অতি স্বল্পক্ষণের। হো চি মিন সিটিতে প্রথমবারে আসার দিনে আমরা মি. উত্রানের সঙ্গে হ্যানয় বিমানবন্দর থেকে একই ফ্লাইটে উড়ে আসি। আমাদের প্লেনখানা অতি বিলম্বে মাঝরাতে এসে হো চি মিন সিটিতে ল্যান্ড করে। সে রাতে গড়পড়তা সহযাত্রীদের মতো মি. উত্রান হাত মিলিয়ে বাই বাই করে অচেনা অন্ধকারে মিলিয়ে যাননি। তিনি নিজ উদ্যোগে আমাদের তার গাড়িতে করে পৌঁছে দেন প্যালেস হোটেলে। আমি ও হলেণ আমাদের প্রায় ছয় বছরের কন্যা কাজরিকে নিয়ে সে রাতে কোন প্রকার বালা-মুসিবতে না পড়ে হোটেলে আসতে পেরে উত্রান পরিবারের প্রতি দারুণ কৃতজ্ঞতাবোধ করি। আমাদের সম্পর্ক কিন্তু বিপরীতগামী দু’টি ট্রেনের মতো এখানেই কাটা পড়ে না। পরদিন উত্রান সপরিবারে এসে আমাদের নিয়ে চলেন হো চি মিন সিটির প্রধান দ্রষ্টব্য সাবেক রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ পরিদর্শনে।
ভিয়েতনামের শৈল শহর দালাত ও অতীত দিনের সম্রাটের নিজস্ব নগর হোয়েতে সপ্তাহ দুই কাটিয়ে আমরা যখন আবার ফিরে যাওয়ার পথে হো চি মিন সিটিতে রাত্রি দুয়েকের জন্য যাত্রা বিরতি করলাম, তো মনে হলো উত্রান পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা বিশেষ জরুরি। আমাদের মাঝে হলেণ তুলনামূলকভাবে করিৎকর্মা। সে দ্রুত ব্যাগ স্যুটকেস হাতড়িয়ে বের করে তাদের টেলিফোন নাম্বার। ফোন করে তাদের ক্রীড়া সামগ্রীর দোকানে মিসেস উত্রানকে পাওয়া গেলো। হলেণ তাদের পরিবারের সকলকে প্যালেস হোটেলের লাগোয়া রেস্তোরাঁয় আমন্ত্রণ জানায়। মিসেস সোৎসাহে তা গ্রহণ করে আসার প্রতিশ্রুতি দেন।
সেই দুপুর বারোটা থেকে হোটেলের লবিতে বসে উত্রান পরিবারের জন্য ইনতেজারি করছি। এখন প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। তারা আর আজ আসবে বলে মনে হয় না। হলেণ বার কয়েক উঠে গিয়ে আবার তাদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওপাশে কেবলই রিং হয়, কেউ রিসিভার ওঠায় না। উত্রান পরিবারের সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজনের সম্ভাব্যতার কথা ভেবে তো আর কাজরিকে উপোস রাখা যায় না। তাই এক সময় হলেণ উঠে গিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে নিয়ে আসে চিকেন স্যান্ডউইচ ও ইয়োগার্ট। আমরা ভাবি ভিয়েতনামে মধ্যাহ্ন ভোজন বোধ করি বিকেলের দিকে সারা হয়। হয়তো উত্রানরা অপরাহ্ন চারটা নাগাদ এসে হাজির হবেন। তাই আমরা কিছুক্ষণ ভেতরে ক্ষিধা পুষে রাখি।
অবশেষে অভিজ্ঞতা অসহনীয় হলে শুকনো মুখে কাজু বাদাম, বিস্কিট ও আপেলের টুকরা চিবাই। এক পর্যায়ে আমি ও হলেণ মৃদু তর্কে লিপ্ত হই। আমি জানতে চাই— মিসেস উত্রান লাঞ্চে রাজি হয়েছেন, বিষয়টি কি ঠিক্ ঠিক্ সে টেলিফোনে শুনতে পেয়েছে? মিসেসের ইংরেজি ততোটা সাবলীল নয়, তাই হলেণ আদা বললে তিনি যে কাঁচকলা বুঝবেন তাতে আর বিচিত্র কী? হলেণ আমার তীর্যক মন্তব্যের জবাব না দিয়ে টিপয় থেকে ফ্যাশন ম্যাগাজিন তুলে তা দেখতে শুরু করে। লবিতে বসে বসে উত্রান পরিবারের জন্য ঘোরতর ইন্তেজারীতে আমাদের সময় কিন্তু মন্দ কাটে না। কাজরি টিভি সেটের সামনে বসে এক নাগাড়ে কার্টুন নেট্ওয়ার্ক দেখে চলছে। সে যে রাত্রিবেলা কার্টুন চরিত্রটির মতো আচরণ করবে না, তা নিয়ে আমি খানিক ভাবিত হই। লবির একপাশে সারসের গলার মতো পিতলের নক্সা করা মস্ত বাতিদানের নীচে ঠিক মেঝের উপর আসন বিছিয়ে বসে এক বিভ্রান্ত টুরিস্ট। পর্যটকটির প্যান্ট ও স্পোর্ট-গেঞ্জি দুই-ই ধূলিমলিন ও স্থানে স্থানে ছিন্ন, সুতা ঝুলানো। মানুষটি বোধ করি নানাদেশ ঘুরে শ্রান্ত। তাই থেকে থেকে হাই তোলে সে প্রকাণ্ড এক মানচিত্রের নানা স্থানে কলম দিয়ে দাগ কাটে। তারপর সে ছাদের দিকে মুহূর্ত কয়েক নির্ণিমেষ তাকিয়ে আড়মোড়া ভেঙে পকেট থেকে বের করে ক্যালকুলেটর । এবার বোধ করি সে হিসাব কষছে কোথায় যেতে কতটা কড়ি লাগবে?
লবির দেয়াল ঘড়িতে পাঁচটা বাজার সংকেত হয়। কোথাও উত্রান পরিবারের আসার কোন আলামত দেখা যায় না। আমার উল্টো দিকের কাউচে বেশ কিছুক্ষণ হলো এসে বসেছেন বৃদ্ধ এক দম্পতি। পুরুষটির চামড়ার কুঁচকানো ভাঁজ দেখে মনে হয় মানুষটি রীতিমতো বুড়ো হয়েছেন। তার সঙ্গিনীর মাথায় এক রাশ রূপালি চুল, তবে নিভাঁজ ত্বক ও চোখ মুখের উজ্জ্বলতা দেখে মনে হয় বৃদ্ধাটি এখনো সতেজ আছেন। কিন্তু মিনিট কয়েকের মাঝে আমার অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়। বৃদ্ধ চাবি হাতড়িয়ে প্রকাণ্ড ব্রিফকেস থেকে বের করেন বিশাল প্রেসার মাপার মেশিন। তিনি সঙ্গিনীর পৃথুল বাহুতে কাপড়ের পুরু ফিতা জড়িয়ে পাম্প করে দক্ষ হাতে রক্তচাপ মাপেন। তার কুঁচকানো কপালে উদ্বেগ ফুটে। খানিক পর তিনি লাঠি ঠুক্ ঠুক্ করে রেস্তোরাঁ থেকে নিয়ে আসেন জল। এবার তিনি বৃদ্ধাকে অতি যত্নে খাইয়ে দিচ্ছেন একটি পিল। আমি ভাবি এদের লবিতে বসিয়ে রাখার কোন মানে হয় না। হোটেল কর্তৃপক্ষের উচিত এখনই এদের কামরায় পৌঁছে দেয়া।
যেন টিকেট ছাড়া রঙ্গ মঞ্চে ঢুকে পড়েছে— এরকম অনিশ্চিত পদক্ষেপে লবিতে এসে এদিক-ওদিক তাকায় গাঢ় নীল বর্ণের উপজাতীয় পোষাক পরা অল্প বয়সের একটি মেয়ে। মেয়েটি তার নিজস্ব উপস্থিতিতে বোধ করি বিপন্ন বোধ করে। সে লবির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থেকে কেবলই এদিক ওদিক তাকায়। তার গ্রীবার হেলনে লালচে পশমের ঝালর দেয়া শিরোভূষণে গাঁথা রূপালি কাঁটার প্রান্তে দোলে গোলাপি বর্ণের ঝুলন্ত পোশাক। এবার সে সাহস করে কাউন্টারে গিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করে। তার চোখমুখ দেখে মনে হয় না ট্রাইভাল তরুণীটি আশানুরূপ জবাব পেয়েছে। সে ক্ষুন্ন মুখে আড়ষ্ট হয়ে সোফায় বসে যেন আকাশ পাতাল ভাবে। মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে সে পা নাড়ে, সুডৌল বাহু লতিয়ে কপাল থেকে সরায় ঝুঁকে পড়া গুচ্ছ গুচ্ছ চুল। তার হাত ও পায়ে পরা রূপার ভারী বলয় থেকে অতি মৃদু ধাতব ধ্বনি বাজে। মেয়েটি মনে হয় কারো জন্য তীব্র প্রতীক্ষায় আছে। তার গণ্ডদেশ ভোরের সূর্যালোকের মতো রাঙা হয়ে ওঠে।
উপজাতীয় মেয়েটি কেবলই উসখুস করে বার বার পাশ ফিরে বসে। আমার চোখ দু’টি যেন প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হয়। আমি আরেকবার গাঢ়ভাবে তাকে দেখি। সবুজ বুনো ফলের অভ্যন্তরে অরুণ বর্ণ সুস্বাদু শাসের মতো নীল রঙের পাহাড়ী ভূষণে তার তীব্র দেহরেখা নারীত্বের সর্বাত্মক বঙ্কিমতা নিয়ে ফুটে ওঠে। আমি দৃষ্টিকে শাসন করে অনিচ্ছায় অন্যদিকে তাকাই। লবির একপাশের দেয়াল সম্পূর্ণ কাঁচের তৈরি। তাই ওদিক দিয়ে হো চি মিন সিটির ফুটপাতের চলমান চালচিত্র দিব্যি দেখা যায়। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ ক’জন ফেরিওয়ালা অ্যাকুইরিয়ামে যেরকম রঙিন মাছ দেখা যায়, সেরকম তারা তারকা চিহ্নিত হোটেলের কাচঘরে বসা বিবিধ বর্ণ ও মাপের মানুষ দেখে। কাচের ওপাশ থেকে এক ফেরিওয়ালার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মানুষটি তার হাতের পণ্য সম্ভার কালচে সোনালি ল্যাকারে রাঙানো তিরলে তুলে ধরে ইশারায় আমাকে আকৃষ্ট করে। আমি ফেরিওয়ালার সঙ্গে আই কন্টাক্ট ধরে রেখেছি দেখে উৎসাহিত হয়ে এক অন্ধ ফেরিওয়ালি কাচের দেয়ালে গ্রাহাম গ্রিনের ভিয়েতনামের উপর লেখা বই ঘষতে শুরু করে। ইতিমধ্যে টেলিভিশনে কার্টুন নেটওয়ার্ক সমাপ্ত হয়েছে। তাই কাজরি এসে কাঁচের ওপাশে ফুটপাতের রঙ্গমঞ্চের দিকে তাকায়। সে দেয়ালে টোকা দিয়ে ওপাশের কানা ফেরিওয়ালির সঙ্গে কমিউনিকেট করতে চেষ্টা করে। কানা মেয়ের মুখের হাসিটি মধুর। সে হেসে হাতছানি দিয়ে কাজরিকে ডাকে। বংশীবাদকের পেছনে ধাবমান ইঁদুর ছানার মতো আমাদের মেয়েটি তড়িৎ গতিতে লবি অতিক্রম করে দুয়ার ঠেলে চলে যায় বাইরে।
আমি কাজরিকে সামলাতে ফুটপাতে নেমে আসি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বানরকে দেখার জন্য পথচারীরা যেমন গোল হয়ে দাঁড়ায় তেমনি আমাদের মেয়েটিকে ঘিরে ফেরিওয়ালারা বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে রঙ্গ রস্ করছে। একখানা পাজেরো ভ্যান এসে থামে। গাড়ি থেকে হাসি মুখে নেমে আসেন গল্ফ সার্ট পরা ঋজু দেহী মি. উত্রান। হোটেলের দোর ঠেলে হলেণও বেরিয়ে আসে। আমরা মি. উত্রানের সঙ্গে সম্ভাষণ বিনিময় করি। মনে মনে প্রত্যাশা করি তিনি হয়তো দেরিতে আসার জন্য ক্ষমা চাইবেন। কিন্তু উত্রান ওসবের ধার মাড়েন না। তিনি আমাদের গাড়িতে উঠতে তাড়া দেন। ততক্ষণে তার পুত্রটি লাফ দিয়ে নেমে এসেছে ফুটপাতের উপর। ছোট্ট এ ছেলেটির পরনে আজ নৌসেনাদের মতো নিভাঁজ সাদা পোষাক। তার কৌণিক টুপিতে ঝলমল করছে টিনে তৈরি রূপালি জাহাজের নকশা। ছেলেটি করিৎকর্মা। সে দ্রুত ফেরিওয়ালাদের ব্যুহ ভেদ করে কাজরিকে উদ্ধার করে এনে গাড়িতে উঠায়। কি আর করা— আমরা গন্তব্য না জেনেই পাজেরোতে এসে উঠি। পেছনের সীট থেকে মধুর করে হেসে মিসেস উত্রান আমাদের স্বাগত জানান। মি. উত্রান বেলা শেষের ট্রাফিককে সমীহ করে সাবধানে পথঘাট দেখে গাড়ি চালাচ্ছেন। আমি মনে মনে ভাবি তিনি হয়তো তার পছন্দ মতো কোন রেস্তোরাঁয় আমাদের নিয়ে চলেছেন। না, মি. উত্রান বেশ খানিক গাড়ি চালিয়ে চলে আসেন শহরের এক প্রান্তে অত্যন্ত নিরিবিলি একটি অঞ্চলে। তিনি এতো ধীরে গাড়ি চালান যে মনেই হয় না তার কোথাও যাওয়ার কোন তাড়া আছে। মনে হয় তিনি একটি গাছপালায় ছাওয়া পার্কের ভেতর দিয়ে দিয়ে এগুচ্ছেন। বোধ করি তারা পার্কে পিকনিকের আয়োজন করেছেন। গাড়ি মুদিত শাপলায় সজল হয়ে আসা একটি হৃদের তীরে এসে থামে। আমাদের ছেলেমেয়ে দু’টি গাড়ি থেকে লম্ফ দিয়ে নেমে খোয়াড় খোলা জোড়া মোরগের মতো ছুটে যায় ঘাসের উপর দিয়ে। আমরা কিছুক্ষণ হৃদের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। দু’পাশ থেকে জলের উপর ঝুঁকে আছে বেশ ক’টি দৃষ্টিনন্দন তরু। ঝিরিঝিরি হাওয়ায় এক জোড়া নির্জন নৌকা আস্তে ধীরে দুলে। শান্ত জলে মাছের মৃদু ঘাইয়ে ভাঙে নীল আকাশের প্রতিফলন। এ স্থানের নিরিবিলি মায়া আমাদের কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারি না— এখানে আমাদের নিয়ে আসার কারণ কি? খানিক নীরবে হাঁটাহাঁটির পর আমরা আবার গাড়িতে উঠি।
আমরা আবার শহরের ভেতর দিয়ে ছুটি। এক পর্যায়ে পাজেরোখানা পার্ক করে রেখে উত্রান দম্পতি আমাদের যে স্কোয়ারটিতে নিয়ে আসেন সেখানে রীতিমত রঙের মেলা বসেছে। যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে বর্ণিল আওডাই পরা ভিয়েতনামিজ্ তরুণীর দল। প্রচুর ছেলেমেয়ে পিতা-মাতার আগমন ঘটেছে। দলে দলে দোকানিরা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বিক্রি করছে রঙিন ফানুস বা বিবিধ আকৃতির নানা বর্ণের কাগজে তৈরি ভিয়েতনামিজ্ লণ্ঠন। দর কষাকষি চলছে প্রবল বেগে। আমরা পর পর বেশ ক’টি মুখোশের দোকান অতিক্রম করে ভিড় ঠেলে মেলার কেন্দ্রস্থলে চলে আসি। এখানে ছেলে-মেয়ে কিশোর কিশোরীদের অনেকেই মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে আমাদের পাশ দিয়ে ঢিমেতালে মুখোশ নৃত্য করে চলে যায় ক’টি তরুণী। নাচিয়ে মেয়েগুলোর মুখ গোলাকার বিচিত্র নকশা আঁকা বেতের মুখোশে আবৃত। কিন্তু এতে তাদের নাচের লাস্যে কমতি কিছু হয় না। আমরা— পথচারীরা মুগ্ধ হয়ে তাদের দোলায়িত দেহ ভঙ্গিমার দিকে তাকাই। এলোপাথাড়ি ভেঁপুর শব্দ ও থেকে থেকে পটকার বিষ্ফোরণে স্থানটি এমন গুলজার হয়ে আছে যে একে সাইক্লোনের কেন্দ্রস্থিত ঘূর্ণয়মান প্রাকৃতিক চোখের মতোই অস্থির মনে হয়। আমি কৌতূহল চাপতে না পেরে মি. উত্রানকে— মেলাটি কিসের তা ব্যাখ্যা করতে অনুরোধ করি। জবাবে উত্রান বলেন, এটি ‘টেট্ ট্রুং থু’ বা মধ্য শরতের চান্দ্র উৎসব। বিষয়টি ভালো করে বুঝার আগেই তার মোবাইল টেলিফোন বেজে ওঠে। উত্রান আমাদের হাতের ইশারায় মেলায় থাকতে বলে শান্তিতে ফোনে কথা বলার সুবিধার জন্য ফাঁকা জায়গার দিকে ছুটেন।
মিসেস উত্রানের সাথে হেঁটে হেঁটে আমরা মুখোশ পট্টিটি ঘুরে ফিরে দেখি। কাজরি ও উত্রান পুত্র মুখোশ কিনতে চায়। আমরা বেছে বেছে এক মধ্যবয়সী নারী দোকানীর মেলে রাখা পণ্য সম্ভারের সামনে এসে দাঁড়াই। মহিলা মনযোগ দিয়ে সরার মতো দেখতে গোলাকার বেতের মুখোশের উপর তুলি দিয়ে হাসি মুখ, চোখ ও ভুরু আঁকছেন। কাজরি ও উত্রান পুত্র দোকানীর কল্যাণে মুখোশ পরা দু’টি ছেলে মেয়েতে রূপান্তরিত হয়। মুখোশওয়ালীর পাশেই ফুটপাতে হাতের ছাপচিত্র সাজিয়ে বসেছেন ভিয়েতনামিজ হস্ততত্ত্ববিদ। নারীটির মুখ ও কপালে রঙিন খড়ি দিয়ে অপেরা শিল্পিদের মতো নকশা আঁকা। আমার সাথে তার চোখাচোখি হতেই তিনি হাতছানি দিয়ে ডাকেন। তারপর আকাশের দিকে ইশারা দিয়ে বোধ করি জানাতে চান যে— তার শরণাপন্ন হলে ভবিষ্যৎটি দিব্যি দেখা যাবে। আমাদের মুখোশ পরা ছেলে মেয়ে দু’টি অন্যদিকে ছুটছে দেখে আমি আর এ যাত্রায় ভাগ্য পরীক্ষা করার অবকাশ পাই না।
উত্রান পুত্র আমাদের মেয়েকে নিয়ে আরেকটি দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এ দোকানের পণ্য সম্ভার বিচিত্র। ওখানে সাজানো নারকেলের মতো গোলাকার মাটির সব ভাণ্ড। তাতে গাঢ় রঙে লাল সবুজ ও হলদে নকশা আঁকা। দোকানী ডিসপ্লের জন্য একটি ভাণ্ডের মুখ খোলে। তার ভেতরে কাগজ কেটে তৈরি অরিগামী বলে এক ধরনের কৃত্তিম সারস। আমাদের ছেলেমেয়ে দু’টি মিনিয়েচার সারসকে চিমটি দিয়ে ধরে শূন্যে ছুড়ে উড়াতে শুরু করলে মিসেস উত্রান তাদের জন্য দরাজ হাতে খরিদ করেন দু’টি বর্ণাঢ্য ভাণ্ড।
আমরা এবার চলে আসি ফানুস বা রঙিন লণ্ঠনের পট্টিতে। মি. উত্রান হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসে এখানে আমাদের সাথে যোগ দেন। সন্ধ্যা হয়ে এলো বলে দোকানীদের কেউ কেউ এখন ফানুশের ভেতরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নির্মেঘ আকাশে একটি দু’টি করে তারা ফোটার মতো জ্বলে ওঠে বেশ ক’টি রঙিন লণ্ঠন। লণ্ঠনগুলোর আকৃতিও বিচিত্র। কাজরি পুতুলের মতো দেখতে একটি ফানুস কিনতে চায়। তাকে কাঙ্ক্ষিত লণ্ঠন কিনে দিয়ে আমি উত্রান পুত্রের দিকে ফিরি। উড়ন্ত ড্রাগনের দেহের মতো লণ্ঠনটি পেয়ে সে স্পষ্টত খুশি হয়। বাচ্চা দু’টি এখন পরষ্পরকে তাদের নিজস্ব লণ্ঠন দেখাচ্ছে। মি. উত্রান আমাদের জন্য লণ্ঠন কিনতে চান। আমি খরগোস ও হলেন মাছাকৃতির লণ্ঠন দু’টি পছন্দ করি। উত্রান দম্পতি নিজেদের লণ্ঠন বাছাইয়ে প্রচুর সময় নেন। তাদের শলাপরামর্শ থেকে মনে হয় তারা লণ্ঠন নির্বাচনে সাংস্কৃতিক কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। অবশেষে মিসেস ফড়িং আকৃতির এবং মিস্টার মোরগাকৃতির ফানুস দু’টি পছন্দ করলে হলেন কানের কাছে ফিস্ ফিস্ করে বলে, ‘দম্পতি তাদের নিজস্ব রাশিচক্রের সাথে সংগতি রেখে লণ্ঠনগুলোর আকৃতি নির্বাচন করেছেন।’ আমাদের লণ্ঠন কেনার পালা শেষ হয়ে আসে। মনে মনে ভাবি ফানুসগুলোর আকৃতি যা বিচিত্র— হলেনের আন্দাজ সত্যি হলেও হতে পারে।
মুখোশ, লণ্ঠন সবই কেনা হয়ে গেছে— তারপরও মেলা থেকে সহজে নিস্তার পাওয়া যায় না। উত্রান দম্পতি আমাদের টেনে হিচড়ে নিয়ে চলেন তুলনামূলকভাবে কম ভীড় ত্রিপলের মণ্ডপ-বাঁধা একটি এলাকার দিকে। মণ্ডপের নিচে সারি দিয়ে রাখা মুনকেক বা চন্দ্রাকৃতির প্রকাণ্ড সব পিঠা। দোকানের কেকগুলো সবই বৃত্তাকৃতির, এতে কিস্মিস্, বাদাম ও আখরোট গেঁথে নানা রকমের নকশাকাটা। এখানকার দোকানীদের সকলেই বোধ করি যুবতী বয়সের। তাদের রেশমী ভূষণে সদ্যজ্বলা ফানুসের আলো পড়ে। এদের জনা তিনেক আমাদের দেখে খিল খিল করে একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়ে। একটি মেয়ে মুখোশ খুলে আমাদের তড়িতে দেখে নিয়ে চলে যায় আবার মুখোশের অন্তরালে। আমি চারদিক থেকে ধেয়ে আসা নারী দৃষ্টির মধ্যখানে পড়ে অপ্রস্তুত বোধ করি। মিসেস উত্রান এতক্ষণে তার পছন্দসই দু’টি কেক নির্বাচন করেছেন। হলেন সৌজন্যবশত কেক্ দু’টোর দাম দিতে গেলে দু’টি ভিনদেশি মহিলার মাঝে রীতিমত কুস্তি বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হয়। মিসেস উত্রানের হাতে এক গাদা ভিয়েতনামিজ্ টাকা ডং। হলেন ডলার হাতে পরাজয় বরণ করে পিছিয়ে যায়। চকিতে একটু আগে দেখা মেয়েটি আবার মুখোশ খুলে তার বা’চোখে আমার দিকে তাকিয়ে লাস্যময় ইঙ্গিত করে। আমি মনে মনে দ্রুত ইশারাটির তর্জমা করি। অনুমান হয় যে— সে আমাকে তার কাছ থেকে কেক্ কিনতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আমি আবার তার দিকে তাকাই। তার চক্ষু পল্লবে রহস্যময় কৌতুক খেলা করে। আমি ভেতরে ভেতরে তার চাঙ্গারির কেক ফেক্ সমস্ত কিছু কিনে ফেলার উদ্যোম অনুভব করি। কিন্তু বাস্তবে কিছুই করি না। অতি সংযত মুখে মিসেস উত্রান ও হলেনের পেছন পেছন মুখচোরা বিলাইয়ের মতো হাঁটতে শুরু করি। আশে পাশে আরো ক’টি কেক্ বিক্রেতা তরুণী খিল খিল করে হেসে ওঠে। আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকাই। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে চকিতে মুখ ভ্যংচিয়ে চলে যায় মুখোশের অন্তরালে।
উত্থান পরিবারের ফ্ল্যাট বাড়িটি তিন তলায়। আমরা প্রশস্ত ড্রইং রুমে এসে বসলে— পরিচারিকা এসে টেবিলের উপর সবুজ চায়ের টিপট ও পেয়ালা রেখে যায়। আমরা তিতকুটে স্বাদের চা পান করতে করতে কামরাটি দেখি। এক কোণে টাইগার উড্ নামক এক থাই আমেরিকান গল্ফ খেলোয়াড়ের সম্পূর্ণ কাটআউট দেখে মি. উত্রানের খেলোয়াড়ি মনোভাবকে আর অবজ্ঞা করা যায় না। তিনি আমার সাথে ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ঢিমেতালে গল্পগাছা শুরু করেন। কিচেন থেকে খাবারের সৌরভ ভেসে আসলে আমার মন খুশি হয়ে ওঠে। মি. উত্রান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খেলার সামগ্রী রফতানির কথা বলেন। বৈদেশিক ইনভেস্টমেন্টের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তার সাথে আমার একটি দু’টি খুচরো কথাবার্তা হয়। তিনি ভিয়েতনামে বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগের পক্ষপাতি। সহসা তার মোবাইল ফোন বেজে উঠলে তিনি তাতে সাড়া দেন। হলেন উঠে মিসেস উত্রানের সন্ধানে ফ্ল্যাটের ভেতরবাগে যায়। কাজরি অনেকক্ষণ হলো উত্রান পুত্রের সাথে লাপাত্তা। আমি একাকী বসে বসে ড্রয়িংরুমের কেবিনেটে রাখা এক সারি রূপালি কাপ ও শিল্ড দেখি। অতি দামী ইলেকট্রনিক্সগুলোও আমার মনযোগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মনে মনে ভাবি হোচিমিন সিটিতে সমাজতন্ত্রের জ্বর নেমে যেতেই সকলে এবার পাতে পুঁজিবাদের পথ্য তুলতে উঠেপড়ে লেগেছে।
হঠাৎ করে আমার দিকে উড়ে আসে দু’টি অরিগামি সারস। তার পেছন পেছন বেরিয়ে আসে মুখোশ পরা আমাদের মেয়ে কাজরি। তাকে অস্থির দেখায়। সে আমার দিকে চেয়ে বলে, ‘গিভ মি ইয়োর ক্যামেরা। কুইক প্লিজ্। আই ওয়ান্ট টু টেউক এ পিকচার অব্ দিস বয়। হি লুক্ হ্যান্ডসাম।’ কাজরির হাতে ক্যামেরা দিয়ে আমি তার সাথে সাথে চলি। পাশের কামরায় উত্রান পুত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। বাচ্চা ছেলেটি কাপড় পাল্টিয়ে টি-শার্ট পরেছে। সে অরিগামির একটি মিনিয়েচার সারস উড়াতে গেলে কাজরি ফ্লাশ ঝলকিয়ে তার ছবি তুলে।
মি. উত্রানের টেলিফোনিক সংলাপ শেষ হতেই মিসেস আমাদের সকলকে তাড়া দিয়ে ছাদে পাঠান। ছাদে জলপূর্ণ চৌবাচ্চার পাশে নিচু টেবিল ও খান-কতক টুল পাতা হয়েছে। এখানে আসতেই সন্ধ্যে বেলার স্নিগ্ধ হাওয়ায় শরীর জুড়ায়। চৌবাচ্চাটির জলে দু’টি মুদিত শাপলা ফুল। আকাশ জুড়ে চাঁদের তীব্র আলো। রুপালি কিরণ জল ছুঁয়ে যায়। মি. উত্রান চান্দ্র উৎসবটি সম্পর্কে কিছু কথা বলেন। তার বাচনিকে জানা যায় মধ্য শরতের এই রাতে চন্দ্রকলায় আসে পূর্ণতা। উজ্জ্বল কিরণের প্রশস্তিস্বরূপ ভিয়েতনামিজরা এই রাতে চান্দ্র বন্দনায় মেতে উঠে। তার কথা শেষ হতে না হতেই মিসেস ও পরিচারিকা নিচ থেকে সবগুলো কাগজের লণ্ঠন হাতে উপরে উঠে আসেন। তাদের পেছন পেছন হুড়মুড় করে এসে হাজির হয় কাজরি ও উত্রান পুত্র। আমরা লণ্ঠনগুলোর ভেতর মোম জ্বেলে তা ছাদের কাপড় মেলার দড়িতে ঝুলিয়ে দেই।
ছাদের স্নিগ্ধ হাওয়ায় উৎসব রাতের আহার দিব্যি জমে ওঠে। আমরা স্যুপ শেষ করে সেস্মি তেলের ফোড়ন দেয়া চিকেন নোডুলস্ খাই। শেষের দিকে পরিবেশিত হয় নারকেলের দুধ মাখা স্টিকি রাইস, সাথে ফালি ফালি করে কাটা মিষ্টি আম। এত কিছুর পরও আবার পরিবেশিত হয় সবুজ চায়ের-সাথে টুকরো করে কাটা মুনকেক্। আমরা চায়ের পেয়ালা হাতে চৌবাচ্চার পাশে এসে দাঁড়াই। জলে এখন পূর্ণ চাঁদ প্রতিফলিত হচ্ছে। মৃদু হাওয়ায় খরগোস, ফড়িং, ড্রাগন, মাছ, মোরগ ও পরীর আকৃতির লণ্ঠনগুলো দোলে। কাজরি আমার হাত ধরে টেনে ছাদের এক কোণে নিয়ে যায় প্রাইভেট কিছু কথা বলার জন্য। সে ফিস ফিস করে বলে, ‘ক্যান্ আই মেরি দিস্ বয় হোয়েন হি ইজ্ গ্রোউন আপ্?’ তার প্রশ্নে আমি থতমত খেয়ে যাই। তারপর সামলে নিয়ে বলি, ‘প্রথমে বড় হও, তারপর বিয়ে ইত্যাদির কথা ভাবা যাবে।’ উত্রান পুত্রটি কাজরির খোঁজে এদিকে এসে পড়ে। তার হাতে চকচকে রুপালি কাগজে তৈরি দু’টি বড়সড় নৌকা। সে নৌকাগুলো দেখিয়ে বারবার ভিয়েতনামিজ্ ভাষায় কিছু একটা বলে। কিন্তু ভাষাটি না জানার কারণে তার বক্তব্য আমাদের বোধগম্য হয় না। মিসেস উত্রান এসে আমাদের উদ্ধার করেন। তার তর্জমায় জানা যায়— তাদের পুত্র আমাদের কন্যাকে নিয়ে হ্রদে নাও ভাসাতে যেতে চায়। মি. উত্রান আমাদের বুঝিয়ে বলেন— হৃদটি কিন্তু বেশি দূরে না। চাইলে আমরা পাজেরোতে করে এক টানে ওখানে নাও ভাসানো দেখতে যেতে পারি। তারপর ঘাসে উপর একটু হাঁটাহাঁটিও করা যেতে পারে। ভুঁড়ি-ভোজনের পর হাঁটার সম্ভাবনায় আমরা খুশি হই।
হৃদের পাড়ে বিজলি বাতি ফাতি কিছু নেই বলে চাঁদের কিরণে জলরাশি রুপালি হয়ে আছে। আমরা ঘাস ছাওয়া পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চাঁদের প্রতিচ্ছায়া দেখি। হৃদের আশে পাশে মা বাপের সাথে আরো বেশ কিছু শিশু নাও ভাসাতে এসেছে। এক সময় কাজরি ও উত্রান পুত্র তাদের নৌকা দু’টি ভাসায়। জলতলে চাঁদের আলো অজস্র রুপালি বলয়ে বিবর্তিত হচ্ছে। আমাদের পুত্র কন্যার নাও দু’টি কিরণ বলয় ভেঙে ভেঙে দুলে দুলে এগিয়ে যায়। আমরা হৃদের পাড়ে চন্দ্রাহত হয়ে বসে থাকি। খানিক দূর থেকে ভেসে আসে তারের যন্ত্রের বিষণ্ন সুরেলা ধ্বনি। ঝংকারটি ক্রমশ নিকটবর্তী হতে থাকে। মনে হয় পৃথিবীর মানব মানবীরা আজ চাঁদের আলোয় নাও বেয়ে পরস্পরের কাছে চলে আসছে। তারের যন্ত্র বাজিয়ে এক বৃদ্ধ ছোট্ট বালিকার হাত ধরে ধীর লয়ে হেঁটে আমাদের পাশ দিয়ে চলে যান। মি. উত্রান স্বগতোক্তির মতো বলেন, ‘সেই ছোট বেলা থেকে দেখছি এই অন্ধ বাদক চান্দ্র উৎসবের রাতে ভোডিকাম যন্ত্র বাজিয়ে লেকের পাড় ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। তখনকার দিনে তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যেত তার মেয়ে। এখন বোধ করি বুড়ো বাদক নাতনির হাত ধরে হাঁটেন।’ মি. উত্রানের কথা শেষ হতেই আবার সুরধ্বনি এসে আমাদের কানে লাগে। মনে হয় নাওগুলো দাঁড় বেয়ে চলে যাচ্ছে চাঁদের দেশে।
ঘুমন্ত বাচ্চা দু’টিকে কাঁধে নিয়ে আমরা যখন ধীর গতিতে পাজেরোর দিকে যাচ্ছি মিসেস হলেনের হাতে গুঁজে দেন আস্ত একটি মুনকেক। গাড়িতে বসে হোটেলের দিকে ফিরতে ফিরতে ভাবি আগামী কাল আমাদের ভিয়েতনাম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা আছে। মনে হয় ভবিষ্যতে যেখানেই থাকি না কেন পূর্ণিমা রাতে হয়তো উত্রান পরিবারের কথা মনে পড়বে। কাজরিও হয়তো মাঝে মধ্যে ছেলেটির কথা ভেবে আনমনা হবে— নাকি সে তাকে একেবারেই ভুলে যাবে?

স্বপ্নরাজ্যের সন্ধানে - চীন

Li river
শুনেছি চিন দেশের লি নদীর জলে নাকি চাঁদনি রাতে পরীরা এসে সময় কাটায়! পৃথিবীতে সত্যি-ই তা হলে এত সুন্দর জায়গা আছে, যেখানে পরীরা তাদের জগত্ ছেড়ে ঘুরতে আসে! উত্তর জানতে চিনের ভিসা নিয়ে ক’দিনের ছুটিতে শুভ্রনীলের সঙ্গে গেলাম সেই স্বপ্নরাজ্যে। নাম তার ইয়াংশু। স্বপ্নই বটে! ঘন সবুজ কার্স্ট মাউন্টেনের জালে বাধা পড়া এক ফালি জায়গা, আর তার বুক চিরে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জলের ধারা— লি নদী।
শুভ্রনীল আর আমি কাজের সূত্রে ছিলাম হং কং-এ। অনেক দিন ধরেই ইচ্ছে গুইলিন যাওয়ার। চিনারা একে বলেন ‘হেভেন আন্ডার দ্য স্কাই’। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলাম, পর্যটকদের ভিড়ে গুইলিন অনেক বেশি বাণিজ্যিক। তবে এখান থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের এক পাহাড়ি শহর ইয়াংশু-তে নাকি স্বর্গের খোঁজ মিলতে পারে!
আমরা আগে থেকে চিনা রেলের সফট স্লিপারের টিকিট বুক করে রেখেছিলাম। ট্রেনের পাশাপাশি বহু স্লিপার বাসও আছে, যেগুলো সরাসরি ইয়াংশু যায়। গুইলিনে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আছে। হং কং থেকে মেট্রো রেলে চিন লাগোয়া সীমান্ত শহর শেনঝেন-এ পৌঁছলাম। সেখান থেকে সন্ধে পৌনে ছ’টায় ছাড়ল গুইলিনের ট্রেন। পর দিন ভোরে ঘুম জড়ানো চোখে দেখি ট্রেন ছুটছে সবুজের হাত ছুঁয়ে। মাথার উপরে নীল আকাশ নিয়ে দূরে গম্বুজের মতো ছোটবড় সব পাহাড়ের সারি। দৃশ্যপট বদলে গেল একটু পরেই। আকাশের নীল রঙে সোনালি আলোর খেলা। কোথাও চাষিরা মাথায় তালপাতার মস্ত বড় টুপি পরে খেতে কাজে নেমে পড়েছে। কোথাও বা আবার চারদিক একেবারে ফুলে ফুলে রঙিন। এ সবের মাঝেই ট্রেন থামল গুইলিনে। চকচকে পরিষ্কার স্টেশন চত্বর পেরিয়ে বাইরে এসে ইয়াংশু-র বাস ধরলাম।
Li-jiang-Mountain-Yangshuo-Guangxi-China
বাস ছুটছে। এই মেঘ, এই রোদ্দুর, তো এই কুয়াশা। কখনও শরতের মিষ্টি রোদ্দুর স্নান করছে লি নদীতে। কখনও বা মেঘেরা লুকোচুরি খেলছে পাহাড়ের সঙ্গে। পর মুহূর্তেই কুয়াশা ঢেকে দিল পাহাড়কে। প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ চলা শেষে পৌঁছলাম স্বপ্নের সেই পাহাড়ি দেশে। পুরো শহরটাই পর্যটন শিল্পের কথা ভেবে যেন বানানো হয়েছে! তাই বোধহয় একে বলা হয় ‘ফরেনার্স ভিলেজ’। বাস স্ট্যান্ডে নেমে দেখি, চার দিকে প্রচুর পর্যটক আর গাইড। স্ট্যান্ডের ঠিক উল্টো দিকে বেশ বড় একটা পার্ক। সেখানে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক গাড়ি — দেখতে অনেকটা অটো রিকশার মতো। তবে আকারে একটু বড়। তারই একটিতে চেপে বসলাম। চালক জানালেন, ২০ ইউয়ান-এর নোটে (চিনা টাকা) যে ছবি ব্যবহার করা হয়, সেটি এই ইয়াংশু-র লি নদীর ছবি।
হোটেলের ঠিক উল্টো দিকে বইছে লি। নদীর ও পারে সবুজ কার্স্ট মাউন্টেনের সারি। নদীতে নামার জন্য খুব সুন্দর সিঁড়ি রয়েছে। ইচ্ছে হলেই তার ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকা যায়। হোটেলের ডান দিকের ছোট ছোট দোকানে পসরা সাজিয়ে এ দেশের মেয়ে-বৌ-রা বিক্রি করছেন পশমিনা শাল, চিনা হ্যান্ড ব্যাগ, সোয়েটার, সিল্ক স্কার্ফ, সিল্ক টাই, চিনা ছাপার ছোট বড় হাত পাখা, যা গরমের দিনে ব্যবহারের পাশাপাশি দেওয়ালে টাঙিয়ে ঘর সাজানো যায়। এ ছাড়াও বিক্রি হচ্ছে হাতের কাজের বিভিন্ন জিনিস। যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ড্রাগন আর ফেঙ শ্যুই।
west street
দোকান দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। পড়লাম ‘ওয়েস্ট স্ট্রিট’-এ। এখানেও পর্যটকদের মনকাড়া বিভিন্ন জিনিসের দোকান রয়েছে। ওয়েস্ট স্ট্রিটের একদম প্রান্তে পৌঁছলাম। এ রাস্তার নাম ‘হান্ড্রেড ফুড স্ট্রিট’। ভোজনরসিকদের তৃপ্তির জন্য একশোরও বেশি রেস্তোরাঁ। তার মধ্যে ভারতীয় রেস্তোরাঁ রয়েছে। চলছেও রমরমিয়ে। তবে এ সবের পাশাপাশি রীতিমতো ঠেলাগাড়িতেও বিক্রি হচ্ছে সস্তার জনপ্রিয় খাবার। বিকেল থেকে রাত অবধি লি নদীর পাড়ে ফুটপাথে ঠেলাগাড়ি করে বিক্রি হয় স্পাইসি তোফু ফ্রাই (মশলাদার পনির ফ্রাই)। সুস্বাদু এই ফ্রাই না খেলে এখানে আসাটাই যেন বৃথা। এ ছাড়া, দুপুরবেলা গলা ভেজাতে ঠান্ডা আখের রস আর সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে আড্ডা জমাতে চিকেন বা ফিস বার-বি-কিউ-এর কোনও জুড়ি নেই। মশলা মাখিয়ে রাখা চিকেন বা ফিসের ছোট ছোট টুকরো একটি কাঠির মধ্যে গেঁথে আগুনে ফেলে ঝলসানো, তার উপর লেবু, ধনেপাতা কুচি আর অন্য মশলা ছড়ানো— জিভে জল অবধারিত। চারপাশ ঘুরে হোটেলে ফিরে এসে দুপুরের খাওয়া সারতেই বেলা গড়িয়ে গেল। বিকেল থেকে সন্ধে অবধি বিভিন্ন দোকান ঘুরে, জমিয়ে কেনাকাটা করে কাটিয়ে দিলাম। কলকাতার মেয়ে বলে দর কষাকষি বেশ ভালই হল!
পর দিন খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল। ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে জলের ঝমঝম শব্দ। বারান্দায় এসে সামনে তাকাতেই দেখলাম হোটেলের ঠিক উল্টো দিকে একটু নীচে ছোট্ট এক জলপ্রপাত। সে কলকল শব্দে নেমে এসে মিশে গিয়েছে লি-র শান্ত স্রোতে। কাল এত ঘোরাঘুরির মধ্যে এটা লক্ষই করিনি! স্বপ্নটা যেন ঠিকঠাক পূর্ণ হল— নদী, ঝরনার মুক্তধারা, সবুজ পাহাড়, রঙিন ফুলের বাগিচা, শরতের রোদ্দুরমাখা নীল আকাশ, ভোরের আলোয় ভেজা গহিন অরণ্য— সব মিলিয়ে এক ছোট্ট স্বর্গরাজ্য।
8152989222_f770232575_b
শহরটা খুব একটা বড় নয়। আগ্রহ থাকলে পায়ে হেঁটেও ঘোরা যায়। তা ছাড়া, প্রচুর গাড়ি ও ছোট বাস আছে। মন চাইলে সাইকেল অথবা বাইক ভাড়া নিয়েও পাহাড়ের পথে বেড়ানো যায়। অথবা ব্যাম্বু বোটে চড়ে নদীর বুকে ভেসে যাওয়া যায় ইচ্ছেমতো। যে হেতু রূপকথার দেশ, তাই এখানকার গাড়িগুলো যেন একই রকমের গোলাপি জামা পরেছে। আসলে গাড়িগুলি মিষ্টি গোলাপি রঙের। ইয়াংশু থেকে ঠিক ছয় কিলোমিটার দূরে রয়েছে এক বিশাল বটগাছ। বহু সিনেমারও শ্যুটিংও হয়েছে এই ‘বিগ বানিয়ান ট্রি’র ছায়ায়। এখান থেকে আট কিলোমিটার দূরে রয়েছে ‘মুন হিল’। এমন নামের কারণ, এই পাহাড়ের মাঝখানে ঠিক পূর্ণিমার চাঁদের মতো একটা বিরাট গর্ত রয়েছে। চার দিকের পরিবেশ মনমাতানো সৌন্দর্যে ভরপুর। ‘বিগ বানিয়ান ট্রি’ এবং ‘মুন হিল’-এর মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে ‘অ্যাসেম্বল্ড ড্রাগন কেভ’। চুনাপাথরের তৈরি এই গুহার ভেতর আলো-অন্ধকারে মেশানো পরিবেশ। কানে ভেসে আসে মিষ্টিমধুর এক গানের কলি। গানের সঙ্গে রঙিন নিয়ন আলোর খেলা— সব মিলিয়ে এ যেন এক মায়াবি রাজ্য।
Shelter Bridge
দুপুরে খেতে গেলাম ভারতীয় রেস্তোরাঁ ‘কালি মির্চ’-এ। আলাপ হল হোটেল মালিকের সঙ্গে। তিনি দার্জিলিং থেকে সাত বছর আগে এখানে এসেছিলেন গাইড হিসেবে। বেশ কিছু বছর পর তাঁর হবু গৃহিণীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে খুলেছেন এই রেস্তোরাঁ। বান্ধবীটি চিনা নাগরিক। কীসের টানে এই ভিন্ দেশে পড়ে আছেন? শুধুই ব্যবসা না বিদেশিনি বধূ? নাকি এই মায়াবি প্রকৃতির জাল কাটিয়ে আর ফিরতে ইচ্ছে করেনি? উত্তরে তিনি শুধু হাসলেন। আলাপ হল আরও তিন রাঁধুনির সঙ্গে, এঁরা প্রত্যেকেই দার্জিলিং থেকে এসেছেন। দেশের মানুষজন, সুস্বাদু খাবার— মাটন কষা, নান, মাটন বিরিয়ানি, মিষ্টি— প্রাণ ভরে গল্প করতেই বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল।
পাহাড়ি মানুষদের সহজ সরল জীবনধারা ও আন্তরিকতার কথা উল্লেখ না করলে রূপকথার এই গল্পটা সম্পূর্ণ হবে না। এঁদের উদার ব্যবহার আমাদের প্রতি মুহূর্তকে আরও রঙিন করে তুলেছিল। ফিরে এসে হোটেলের বারান্দায় বসে কফিতে চুমুক দিয়ে লি নদীর ও পারে সূর্যাস্ত দেখার ফাঁকে কখন যে সন্ধে পেরিয়ে রাত নামল, বুঝতেই পারিনি! সে দিন ছিল পূর্ণিমা। চিনে এই সময়ে এক সপ্তাহ ধরে ‘অটাম ফেস্টিভ্যাল’-এর ছুটি। এখানকার রীতি মেনে সেই রাতে ‘মুন কেক’ কিনলাম। শরতের আকাশে সহস্র তারাদের ঝিকিমিকি আর চাঁদের আলো নদীর জলে ভেসে রয়েছে। পাড়ে তখনও দু’এক জন মাঝি সওয়ার নিয়ে যাওয়ার আশায় নৌকায় টিমটিমে আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে। দূরের অন্ধকার পাহাড়ে জ্বলে উঠেছে হাজার আলোর মালা। সহস্র জোনাকি যেন একসঙ্গে তাদের সব রোশনাই উজাড় করে সাজিয়েছে শরত্-পূর্ণিমার রাতটিকে।
Li-River
তৃতীয় দিন সকালে ‘ক্রুজ’ সফরে গেলাম। লি-র পাড়ে বাঁশের তৈরি ছোট ছোট নৌকা আমাদের নদীর বুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। একটার পর একটা ব্যাম্বু স্টিক পাশাপাশি বসিয়ে তৈরি হয়েছে এই ভেলা। ইদানীং বেশির ভাগ ভেলাই বাঁশের মতো দেখতে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে তৈরি। ভেলার উপর বসার জায়গা আর মাঝির হাতের দাঁড় কিন্তু বাঁশের তৈরি। ভেসে চলেছি। মাথার উপর নীল আকাশ। নদীর পাড় ঘেঁষে উঠে গিয়েছে পাহাড়। ‘মাঝিভাই’য়ের সঙ্গে গল্প করার ফাঁকেই লক্ষ করছি দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। নদীর পাড়ে অনেক ছেলেমেয়ে আপন মনে পেন্টিং-এ ব্যস্ত। ছবি আঁকার এ এক অনবদ্য জায়গা। ঠান্ডা হাওয়া যেন ঘুমপাড়ানি গান গাইছে! এত নির্জন সুন্দর জায়গা আগে কোথাও দেখেছি কি না মনে পড়ছে না। সারি সারি পাহাড়ের এক একটি যেন এক এক আকারের। হঠাত্ একটি পাহাড় চোখে পড়ল, দেখতে একেবারে মানুষের বুড়ো আঙুলের মতো। ঈশ্বরের কী অপূর্ব সৃষ্টি!
নৌকাবিহার শেষে হোটেলে ফেরার পথে দোকানপাট ছাড়িয়ে আরও খানিকটা হেঁটে পৌঁছলাম এক মনাস্ট্রিতে। গেট বন্ধ থাকায় ভিতরে ঢুকতে পারলাম না। নদীর পাড়ে দেখি, এক আদিবাসী বৃদ্ধ একটি বাঁশের উপর দু’টি বুনো জংলি হাঁস নিয়ে বসে আছেন। বাকি দিনটা এ দিক ও দিক ঘুরে, খাওয়াদাওয়া ও কেনাকাটা করে কেটে গেল।
স্বপ্নরাজ্যে তো আর চিরকাল থাকা যায় না! তবে তাকে মনের মণিকোঠায় বন্দি করা যায়। ইয়াংশু ছেড়ে চতুর্থ দিন সকালে রওনা হলাম গুইলিনের উদ্দেশে। তার আগে মায়াবি সবুজ অরণ্যের বুনো গন্ধ প্রাণ ভরে গায়ে মেখে নিলাম। মায়া কাটিয়ে চলে যেতে মন চাইছে না। গাড়িতে মালপত্তর চাপিয়ে উঠে বসলাম। রোদ্দুরে চিকচিক করছে লি-র জল। আগের দিন দেখা সেই ঝরনাটি সূর্যের আলোয় স্নান করে তার জলধারা নিয়ে আমাদের আবার আসার নিমন্ত্রণ জানাল। বাস ছেড়ে দিল। পিছনে পড়ে রইল আমার সবুজ পাহাড়ি মিষ্টি স্বপ্নের দেশ — ইয়াংশু।

অচিনপুরের পথে

গুপি-বাঘার মতো হাততালি দিয়ে হঠাত্ আমরা এমন এক অচিনপুরে পৌঁছলাম, যেখানে কেউ ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না। সুন্দর সে দেশে অগত্যা তাই হাত-পা ছুঁড়ে অভিনয় দক্ষতার কেরামতি দেখিয়ে অন্যকে নিজের কথা বোঝানো ছাড়া উপায় নেই! চিন যাওয়ার আগে খুব সামান্য কিছু ধারণা ছিল সে দেশ সম্পর্কে। তবে এটুকু জানতাম, প্রতিবেশী রাষ্ট্র চিনের হাতেই পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি। ভারতের থেকে হয়তো একটু বেশিই উন্নত হবে; এমন একটা অগভীর ভাবনা নিয়ে চিন পৌঁছলাম।
কিন্তু প্রথম দর্শনেই ভাষা বিভ্রাটে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। ইন্টারনেটের কল্যাণে আমরা এই ভাষা সমস্যার একটা আভাস আগেই পেয়েছি। তাই সাত দিনের এই পারিবারিক ভ্রমণে ইংরেজি বলতে পারা ট্যুর গাইডের বন্দোবস্ত করেছিলাম। তা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় কথার বাইরে কিছু বলতে গেলেই ঠোক্কর খেতে হয়। অচেনা দেশ, তাই উত্তেজনা ভরা মনে অনেক প্রশ্ন জমা হচ্ছে। তবু, ঝাঁ চকচকে বেজিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পর থেকে হোটেলের পথটুকু মুখ বুজেই বসে থাকতে হল। দু’পাশের পরিষ্কার রাস্তাঘাট, ঝকঝকে ও অত্যাধুনিক বাড়ি দেখে চোখ ভরে যায়। কিন্তু মন ভরে না। দু’টো কথা না বলতে পারলে যেন শান্তি নেই!
4758237090_7edb437a30_z
পৃথিবীর সব থেকে জনবহুল এবং আয়তনের দিক থেকে এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্র চিন। দেশের উত্তরপ্রান্তে রাজধানী শহর বেজিং, পুরনো নাম পিকিং। বেজিং-এ অনেক দর্শনীয় জায়গা রয়েছে। ঐতিহাসিক ও আধুনিক— দু’ ধরনের জায়গাই রয়েছে সে তালিকায়। শৃঙ্খলা এবং পরিশ্রম একটা দেশকে যে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে, ভেবে অবাক লাগে! নিজেদের ঐতিহ্য এবং ভাষা ধরে রাখার প্রচেষ্টা এ দেশের সর্বত্রই চোখে পড়ে। পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে মহিলারাও সমস্ত রকম কাজে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন। আমাদের তিন দিনের বেজিং বেড়ানোর সঙ্গী হিসেবে মহিলা এবং পুরুষ গাইড পেয়েছি।
প্রথম দিন দেখতে গেলাম বিশ্বখ্যাত চিনের প্রাচীর। প্রায় ১৩ হাজার মাইল দীর্ঘ এই প্রাচীর মূলত চিনের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য তৈরি করা হয়। পাহাড়ের উপর এঁকেবেঁকে অজগর সাপের মতো চিনের প্রাচীরের বিস্তার। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্য। ইউনেস্কো ১৯৮৭ সালে এই ‘গ্রেট ওয়াল’কে পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য স্থাপত্যের শিরোপা দেয়। পুরো প্রাচীরটাই পাথরের সিঁড়ি ভেঙে ঘোরা যায়।
আমরাও প্রাচীন এই প্রাচীরের সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা হাঁটলাম। জনশ্রুতি বলে, পাথরের এই সিঁড়ির নীচে পাওয়া গিয়েছে মানুষের হাড়। বিশালাকার এই প্রাচীর নির্মাণের পিছনে হাজার হাজার মানুষের আত্মবলিদানের গল্প সেখানে লুকিয়ে আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ভ্রমণোন্মুখ মানুষে ছেয়ে গিয়েছে পুরো প্রাচীর। তাঁদের মধ্যে ভারতীয় তো বটেই কয়েক জন বাঙালির সঙ্গেও পরিচয় হল। খুব ছোট বয়স থেকে ইতিহাস বইয়ে যে চিনের প্রাচীরের ছবি দেখে এসেছি, মেঘলা দিনে সেই ছবিই হাতের মুঠোয় পাওয়ার পাশাপাশি সেখানে বাঙালির দেখা পেয়ে আমরা তো আনন্দে আত্মহারা!
এর পরের গন্তব্য ‘সামার প্যালেস’। বেজিং শহরের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে ছোট একটি পাহাড়ের উপর কুনমিং হ্রদের ধারের এই গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ চিনের অন্যতম এক জনপ্রিয় জায়গা। ১৭৫০ সালে রাজপরিবারের গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল হিসেবে এই প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এখন জনসাধারণের প্রমোদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে গেলাম ‘পাখির বাসা’ বা বেজিং ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে। স্থাপত্য শিল্পের অত্যাধুনিক নমুনা এই অলিম্পিক স্টেডিয়াম। ২০০৮ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের সময় স্টেডিয়ামটির উদ্বোধন হয়।
     
লামা টেম্পল
টেম্পল অফ হেভেন
পুরনো বেজিং-এর রাস্তা
বেজিং শহরের রাস্তায় প্রচুর গাড়ি এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রয়েছে যানজট। গাইড ভদ্রলোক জানালেন, যানজট নিয়ন্ত্রণে কোন গাড়ি কবে রাস্তায় বেরোবে তার নির্দিষ্ট সময় ও দিন ঠিক করে দেয় সরকার। শুনলাম, সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণেই গুগল ও ফেসবুক-এর মতো জনপ্রিয় ওয়েবসাইট খোলার অনুমতি পায়নি এ দেশে।
চিন ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন আমরা গেলাম নিষিদ্ধ শহর বা ফরবিডেন সিটি লাসায়। মিং সাম্রাজ্য থেকে কিউং সাম্রাজ্য পর্যন্ত সম্রাটদের বাসস্থান ছিল এই শহর। প্রবেশপথেই পড়ে তিয়ান মেন স্কোয়্যার। ইতিহাসের বইয়ের পাতা থেকে উঠে এল অনেক স্মৃতি। এর পর আমরা গেলাম ‘লামা টেম্পল’-এ। এটি চিনের অন্যতম বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ মঠ। অপূর্বসুন্দর এই মঠে রয়েছে ব্রোঞ্জের তৈরি বিরাট এক বুদ্ধমূর্তি। এ ছাড়া এই মন্দিরে রয়েছে আরও তিনটি বুদ্ধমূর্তি। যার মধ্যে প্রায় ২৬ মিটার লম্বা, বিশালাকার একটিমাত্র চন্দনকাঠে নির্মিত বুদ্ধ মূর্তিও রয়েছে। ১৯৯৩ সালে গিনেস বুক এফ রেকর্ড-এ এই মূর্তিটি অন্তর্ভুক্ত হয়।
এ বার পেট পুজোর পালা। এ দেশের মানুষের খাদ্যাভাসের বৈচিত্র পৃথিবীর অন্য যে কোনও দেশকে পেছনে ফেলে দিতে পারে। বিভিন্ন রেস্তোরাঁতে চিনা এবং আমেরিকান— দু’ ধরনের খাবারই পাওয়া যায়। চিনা মেনুতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, পৃথিবীর কোনও প্রাণী শরীরের কোনও অংশই চিনারা ফেলে দেন না। আরশোলা, বিছে, মাকড়শা ভাজা থেকে শুরু করে হাঙরের জিভ, লেজ, যকৃত— সবই পরম তৃপ্তির সঙ্গে খান এঁরা। চিনা নাগরিকদের খাদ্য-বৈচিত্র দেখলে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ’। এর সঙ্গে অবশ্য বিভিন্ন নিরামিষ খাবারের ব্যবস্থাও আছে। এ ছাড়া, চিনের বিভিন্ন রকম চা— লিচু থেকে লেবু, কত রকম স্বাদের যে চা মেলে এখানে! সে স্বাদ যেন মুখে লেগে আছে। চা-রসিক বাঙালিদের কাছে এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
তৃতীয় দিন গেলাম ‘টেম্পল এফ হেভেন’-এ। বেজিং-এর অন্যতম ধর্মীয় আকর্ষণ। চিনের সম্রাটরা প্রতি বছর নবান্নের সময় প্রার্থনা করতে এই মন্দিরে আসতেন। ১৯৮৮ সালে এই মন্দির সংলগ্ন একটি উদ্যান জনসাধারণের প্রমোদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। মন্দির সংলগ্ন সেই পার্কে অনেককেই তাস, ক্যারাম, ব্যাডমিন্টন-সহ অন্যান্য খেলায় ব্যস্ত থাকতে দেখলাম।
আমাদের বেজিং সফরের শেষ দিনে এক বার ঢুঁ মেরে এলাম, পুরনো বেজিং-এ। সেখানে তেমন আধুনিকতার ছোঁয়া নেই, অনেকটা আমাদের পুরনো কলকাতার মতো। কলকাতার স্মৃতি আরও জাগিয়ে তুলল ওখানকার ‘হাটং রাইড’ বা রিকশা। চড়তে খুব মজা!
   
বুলেট বা হাই স্পিড ট্রেন
সাংহাইয়ের নজরকাড়া স্থাপত্য
তিন দিন বেজিং ঘোরার পর গেলাম ১৩০০ কিলোমিটার দূরের সাংহাই শহরের দিকে। বেজিং থেকে সাংহাই বুলেট বা হাই স্পিড ট্রেনে করে গিয়েছিলাম। এই ট্রেনের গতি ঘণ্টায় প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। তাই মাত্র সাড়ে ৫ ঘণ্টায় সাংহাই পৌঁছে গেলাম। গতি ছাড়াও বুলেট ট্রেনের অভ্যন্তরীন সাজসজ্জা খুবই চমকপ্রদ। বসা, খাওয়া ও শোওয়ার ব্যবস্থা দেখার মতো! এমন সুন্দর ভাবে এই জনবহুল ট্রেনকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে রাখা হয়েছে, প্রশংসার যোগ্য। খুব স্বাভাবিক ভাবেই নতুন বা ভাল কিছু দেখলেই মনে হয়, ইস্, আমাদের দেশে যদি এমন হত! তবে এটা ঠিক, রেল পরিষেবায় চিন পেছনে ফেলে দিয়েছে আমেরিকাকেও।
বাণিজ্য শহর সাংহাই চিনের সবচেয়ে বড় শহর। পূর্ব চিনের ইয়াংসি নদীর ধারের এই শহরের জনসংখ্যা প্রায় ২৩ মিলিয়ন। আকাশছোঁয়া বাড়ি আর তার নজরকাড়া স্থাপত্য চোখের পলক ফেলতে দেয় না! চিনের অর্থনৈতিক উন্নতির নমুনা পাওয়া যায় এই শহরে এলে। আমাদের ট্যুর বাস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষে ভর্তি। সবাই এসেছেন তাঁদের কোম্পানির ব্যবসায়িক কাজে। তার ফাঁকেই চলছে শহর দেখা। বেজিং শহরের আনাচে কানাচে শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসের যে গল্প ও ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ছড়াছড়ি তার অভাব বোধ করলাম সাংহাইতে।

অরুণাচলের তাওয়াং, মেঘের শহর

91-IMG_7953
অরুণাচলের আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ। হেলিকপ্টার থেকে তোলা ছবি।
উত্তর-পূর্ব ভারতের নাম আগেই শুনেছি কিন্তু এত কিছু জানা ছিল না। অরুণাচল, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ এই ৯ রাজ্য নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারত। বাংলাদেশের সীমানা পেরুলে উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যগুলি আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। অন্য দেশের সীমান্তবর্তী রাজ্য হওয়ায় এবং নানা রাজনৈতিক ও নৃ-তাত্ত্বিক কারণে এক সময় এই রাজ্যগুলিতে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত ছিলো। এখন সিকিম ছাড়া সবগুলি রাজ্যে ভ্রমণ করা যায়।
অরুণাচলের তিন পাশে ভুটান, মায়ানমার আর চীন। সবুজ বনরাজি নিয়ে উঁচু উঁচু পাহাড় ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। হাজার বছর ধরে এখানে বাস করছে অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী।
অরুণাচল সম্পর্কে চটজলদি কিছু তথ্য
বলা হয় ভারতে প্রথম সূর্য উদয় হয় অরুণাচল প্রদেশে। যেহেতু অরুণাচল ভারতের সবচেয়ে পুবের রাজ্য সেহেতু এটি একটি ভৌগলিক সত্য।
তাওয়াং হেলিপ্যাডে লেখক। মাত্র পৌঁছেছেন।  পেছনে রুশ হেলিকপ্টার-এমআই ৭৭।
তাওয়াং হেলিপ্যাডে লেখক। মাত্র পৌঁছেছেন। পেছনে রুশ হেলিকপ্টার-এমআই ৭৭।
আয়তনে প্রায় ৮৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের অর্ধেকের চেয়ে কিছুটা বেশি। এর শতকরা ৮২ ভাগ এলাকা চিরহরিৎ বনে ঢাকা। অনেক বৃষ্টিপাত হয়। বছরে গড়ে তিন হাজার মিলিমিটারেরও বেশি। আবহাওয়া সমতলে মৌসুমি হলেও যত উত্তরের দিকে গেছে ততই আলপাইন হয়ে উঠেছে অর্থাৎ পাহাড়ি ঠাণ্ডা। পাহাড়ি এলাকাই বেশি। উঁচু উঁচু। সোজা মেঘের ওপর উঠে গেছে পাহাড়ের চূড়া।
শীত বাড়লে চূড়াগুলি ঢেকে যায় সাদা সাদা বরফের আস্তরে। বিশেষ করে সেলাপাস অঞ্চল। ১৭টি জেলা নিয়ে অরুণাচল। ২০১১ সালের জরিপে জনসংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। ২৬টি প্রধান গোত্র আর শতাধিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি। জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৩১ ভাগ এই সব বিবিধ ধর্মের মানুষ ছাড়াও অরুণাচলে বাসকারীদের প্রায় ৩৫ ভাগ হিন্দু, ১৯ ভাগ খ্রিষ্টান আর ১৩ ভাগ বৌদ্ধ। শিক্ষিতের হার শতকরা ৬৭ ভাগ।
রাজধানী ইটানগর। অবশ্য ভ্রমণের গল্প অরুণাচলের ১৭ জেলার সবচেয়ে সুন্দর জেলা-শহর, তাওয়াং নিয়ে। সমুদ্রসীমা থেকে যার উচ্চতা প্রায় ১৩ হাজার ফুট। মেঘের দেশের এক অনিন্দ্য সুন্দর শহর তাওয়াং।
যেভাবে ভ্রমণের শুরু
ভারত ভ্রমণের কথা মাথায় এলে বাংলাদেশী হিসেবে প্রথমেই কোলকাতা তারপর একে একে দার্জিলিং, দিল্লী, আগ্রা, আজমির শরিফ এই নামগুলি তালিকায় উঠে আসতে থাকে। ভারত সরকারের পর্যটন বিভাগের নিমন্ত্রণপত্র হাতে না পাওয়া পর্যন্ত ‘তাওয়াং’ বলে যে কোন জায়গা আছে তা জানা ছিল না।
‘তাওয়াং’ অরুণাচল প্রদেশের একটি শহরের নাম। একদিন সকালে পর্যটন প্রতিষ্ঠান জার্নি প্লাস-এর প্রধান নির্বাহী তৌফিক ভাইয়ের ফোন পেলাম, “আখতার, আপনি কোথায়?”
'বাংলাদেশ ডেলিগেট টিম। বা দিক থেকে, যুগান্তরের রবিউল ভাই, পর্যটন বিচিত্রার সম্পাদক মহিউদ্দিন হেলাল ভাই, বিশ্বভ্রমণকারী বাংলাদেশের সেরা সাইক্লিস্ট আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল ভাই, আমি, ফোর হুইলস্ ট্যুরিজমের প্রধান নির্বাহী কাজী জিয়াউদ্দীন বাপ্পী ভাই, এটিএস নিউজের বার্তা সম্পাদক প্রণবদা।' - লেখক
‘বাংলাদেশ ডেলিগেট টিম। বা দিক থেকে, যুগান্তরের রবিউল ভাই, পর্যটন বিচিত্রার সম্পাদক মহিউদ্দিন হেলাল ভাই, বিশ্বভ্রমণকারী বাংলাদেশের সেরা সাইক্লিস্ট আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল ভাই, আমি, ফোর হুইলস্ ট্যুরিজমের প্রধান নির্বাহী কাজী জিয়াউদ্দীন বাপ্পী ভাই, এটিএস নিউজের বার্তা সম্পাদক প্রণবদা।’ – লেখক
বিছানায় শুয়ে ফোন ধরলাম। গায়ে ভীষণ জ্বর।
“বাসায়। আপনি কেমন আছেন?”
“শরীর খারাপ নাকি? কণ্ঠ যেন কেমন লাগছে?”
“না, সব ঠিকঠাক। বলেন।” অসুখের ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গেলাম।
তৌফিক ভাইয়ের কণ্ঠে তাড়া, “শোনেন, দাওয়াত আসছে। তাওয়াং ঘুরতে যাবেন?”
“তাওয়াং? সেটা আবার কোথায়?” আমি অজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।
“অরুণাচলের একটি শহর, ভারতে। ৪ দিনের প্রোগ্রাম। সাথে আরো দিন তিনেকের ফ্যাম ট্রিপ। দিন সাতেক ম্যানেজ করতে পারবেন না? নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, আসাম যা খুশি বেছে নিতে পারেন। যাবেন?”
“অবশ্যই যাবো। তার আগে একটু পুরো বিষয়টা খুলে বলেন না!”
তৌফিক ভাই ভারতীয় হাইকমিশন থেকে আসা এই নিমন্ত্রণের ব্যাপারে বিস্তারিত জানালেন। নতুন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার নেশায় অসুখের কথা যদিও চেপে গেলাম, তবুও দুশ্চিন্তা একটু রয়েই গেলো।
তাওয়াং মনাস্ট্রির ঠিক সামনে স্থানীয় অলংকার বিক্রি করছেন একজন মনপা।
তাওয়াং মনাস্ট্রির ঠিক সামনে স্থানীয় অলংকার বিক্রি করছেন একজন মনপা।
মনে মনে ভাবলাম, দিন তারিখ হিসাবে রওয়ানা হতে তখনো দিন সাতেক বাকি। সুতরাং আশা রাখি, এর মধ্যে সুস্থ্য হয়ে যাবো। কিন্তু আমার কপাল খারাপ। ডাক্তারি অনুসন্ধানে টাইফয়েড, সাথে ডেঙ্গু ধরা পড়ল। মরার ওপর খাড়ার ঘা। ডাক্তার ঠাণ্ডা চোখে বললেন, আপনার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত।
আমি রাজি হলাম না। আমার হাসপাতালে ভর্তির খবর জানাজানি হলে ভ্রমণ বাতিল হয়ে যাবে। চিকিৎসা ব্যবস্থা বাসায় নেয়ার ব্যবস্থা করলাম। দিনে দুটো করে ১৪টি অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন নিতে হবে। লোক ঠিক করলাম, যে বাসায় এসে ইনজেকশন দিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ থেকে দুজন সাংবাদিকসহ আমরা পর্যটন-সংশ্লিষ্ট চার জন। মোট ছয় জনের বাংলাদেশ টিম ভ্রমণের জন্য তৈরি। তাদের বিবরণ একটু পরে দিচ্ছি।
কিছু জটিলতা সত্ত্বেও ভিসা শেষ পর্যন্ত ঠিক মতোই পেয়ে গেলাম। ৬ মাসের মাল্টিপল ভিসা, তার ওপর বাস, ট্রেন, আকাশ তিন পথেই যাতায়াত করতে পারবো। খুবই ব্যাতিক্রমী ঘটনা। কিন্তু অসুস্থতার ক্ষেত্রে আমার শেষরক্ষা হলো না। আমি চিকিৎসা সম্পূর্ণ করতে পারলাম না। রওনা হওয়ার তারিখ এসে গেল।
১৭ অক্টোবর (২০১৩) দশম ইনজেকশনটা নেয়ার আধা ঘণ্টা পরেই এয়ারপোর্টে রওনা হতে হলো। টুনি গাড়ি ড্রাইভ করলো। টুনি আমার স্ত্রী। যানজটের কোন বিড়ম্বনা ছাড়াই সবার আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। আমরা সঙ্গীরা তখনও অন দ্য ওয়ে। তবে বেশি দেরি হলো না। একে একে সবাই এসে গেলো। সঙ্গীদের হাতে আমাকে সঁপে দিয়ে টুনি বিদায় নিলো।
দলের মধ্যে একটা ছোট্ট ইনফর্মাল মিটিং হয়ে গেলো। প্রথমে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে কোলকাতা যাওয়া। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন সংস্থা কর্তৃপক্ষ আমাদের স্বাগত জানাবেন। তারপর ভোর পাঁচটার কানেক্টিং ফ্লাইটে গৌহাটি পৌঁছব। মোট সাত দিনের সফর।
১৭ অক্টোবর, ২০১৩
সিকিউরিটি চেকিং, ইমিগ্রেশন সব শেষ হয়ে গেলো নির্বিঘ্নে। আমরা সবাই যে যার মতো চুপচাপ বসে রইলাম এয়ার ইন্ডিয়ার বোর্ডিং লাউঞ্জে। যাত্রী খুব বেশি মনে হলো না।
ঢাকা থেকে রাত সোয়া নয়টায় বিমান আকাশে উড়লো। আপাত গন্তব্য কোলকাতা হলেও আমরা চলেছি অরুণাচলের জেলা শহর তাওয়াং-এর উদ্দেশ্যে।
বিমান, সড়ক বা রেল যে পথেই হোক না কেন তাওয়াং যেতে হলে আপনাকে আসামের রাজধানী গৌহাটি আসতেই হবে। গৌহাটিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের গেটওয়ে বলা হয়। কারণ উত্তর-ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে যেতে হলে গৌহাটি হয়ে যেতে হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা এভাবেই সাজানো। ঢাকা থেকে সড়ক পথে তামাবিল বা আখাউড়া সীমান্ত থেকে শিলং হয়ে গৌহাটি যাওয়া যায়। কিন্তু হয়ত সময়, শ্রম আর সম্মান এই তিনের বিবেচনায় ভারত সরকার আমাদের কোলকাতা হয়ে প্লেনে গৌহাটি পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঢাকা থেকে কোলকাতা এয়ার ইন্ডিয়ায় এবং কোলকাতা থেকে গৌহাটি স্পাইস জেট-এ।
তাওয়াং মনাস্ট্রির প্রধান ফটক পেরিয়ে মন্দিরের চত্বরে পৌঁছার সিঁড়িপথ
তাওয়াং মনাস্ট্রির প্রধান ফটক পেরিয়ে মন্দিরের চত্বরে পৌঁছার সিঁড়িপথ
পয়ত্রিশ মিনিট পর আমরা কোলকাতায় ল্যান্ড করলাম। এয়ারপোর্টের ফরমালিটিজ আর লাগেজ কালেকশন করতে করতে আরো চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লেগে গেলো। ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন সংস্থার কর্মকর্তারা যারপরনাই আতিথেয়তায় আমাদের গ্রহণ করলেন। রাত তখন প্রায় ১১টা। আমাদের রাতের থাকা ও ডিনারের ব্যবস্থা হলো মনোটেল হোটেলে। হোটেলে থাকা বলতে ঘণ্টা দুয়েকের বিশ্রাম। কারণ রাত সাড়ে তিনটায় আবার ছুটতে হবে কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে। স্পাইস জেট-এর এক ঘণ্টা দশ মিনিটের ফ্লাইট আমাদের পৌঁছে দেবে গৌহাটি এয়ারপোর্টে।
সকালের উদ্ভাসিত সোনালি আলোয় সমস্ত চরাচর মোহময় হয়ে উঠেছিলো। সকাল সাতটা নাগাদ আমরা গৌহাটি এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলাম। আমাদের উত্তরীয় পরিয়ে, মালা পরিয়ে বরণ করা হলো। সৌজন্য বিনিময় হলো। সবাই একসাথে ছবি তুললাম।
ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম এয়ারপোর্টে। এবার তাওয়াং-এ পৌঁছার জন্য হেলিকপ্টারে সোয়া এক ঘণ্টার যাত্রা। নটা নাগাদ হেলিকপ্টার উড়বে। এই প্রথম হেলিকপ্টারে চড়ব। গতরাতে কোন ঘুম হয়নি। শরীর পুরোপুরি সুস্থ নয়। ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে আছি। সবাই নিজেদের মধ্যেও কম কথা বলছি। সবাই-ই বেশ ক্লান্ত মনে হলো।
খবর এলো তাওয়াং-এর আবহাওয়া খুব স্থিতিশীল নয়। সুতরাং দেরি হবে। দশটা নাগাদ রওনা হওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বুঝে নিলাম হেলিকপ্টারকে প্রতিনিয়ত বাতাসের অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়। গন্তব্য থেকে সবুজ সংকেত না পেলে তার উড়ান নাই।
পবন হান্স হেলিকপ্টার সার্ভিস সংস্থা গৌহাটি থেকে নানা গন্তব্যে এই হেলিকপ্টার সার্ভিস দিয়ে থাকে। খরচও খুব বেশি নয়। গৌহাটি থেকে তাওয়াং জনপ্রতি সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার রুপি মাত্র। দুই তিন রকমের হেলিকপ্টার আছে। ৩ আসনের হেলিকপ্টারের সংখ্যাই বেশি। এছাড়া ১৬ এবং ২৩ আসনের হেলিকপ্টারও আছে। আমার উচ্চতাভীতি আছে। আকাশে উঠলেই মনে হয় সবকিছু নিয়ে এই বুঝি ভেঙে পড়ল। আর ভ্রমণে ঠাসাঠাসি পছন্দ করি না। তিন আসনের ফড়িং-এর মতো হেলিকপ্টার দেখেই ভয় হলো, তাই কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করতে আমাকে একটা বড়সর রাশান এমআই ৭৭ হেলিকপ্টারে চড়ানোর ব্যবস্থা করা হলো। ২৩ আসন বিশিষ্ট হেলিকপ্টার হলেও যেহেতু এটি তাওয়াং যাবে এবং বারো হাজার ফুট উপর থেকে উড়বে তাই এতে ১৬ জনের বেশি উঠতে পারবে না। ভালোই হলো। ভেতরে অনেক সিট খালি ছিলো, ফাঁকা ফাঁকা। সমস্যা শুধু একটাই হলো আমি দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
27-IMG_5882
সকালের তাওয়াং শহর। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মাত্র সূর্য উঠেছে।
হেলিকপ্টার আকাশে উঠলো। প্লেনের মতো কোন দৌড়াদৌড়ির বালাই নেই। সোজা উপরে ওঠা, তারপর নাকটা নিচের দিকে রেখে সোজা চলতে থাকা। সারাটা পথ জুড়ে নিচে তাকিয়ে দেখলাম শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। বাড়ি-ঘর, স্কুল, মন্দির, বাজার-ঘাট আরো কত কী! বিস্তর মেঘ ছোটাছুটি করছে। ঘড়ির কাঁটার সাথে মিল রেখে ঠিক সোয়া এক ঘণ্টা পর হেলিকপ্টার তাওয়াং-এর মাটি স্পর্শ করলো।
পাহাড়ের ওপর খোলা চত্বরে আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলার জন্য তৈরি করা অস্থায়ী অডিটোরিয়াম। হেলিকপ্টারের দরজা খোলামাত্র বাতাস এসে সোজা হাড়ের মধ্যে ঢুকে গেলো। ভাবতেই পারিনি এই একটু আগের গরম আবহাওয়ার পর এত ঠাণ্ডা সইতে হবে। হাতের কাছে জ্যাকেট ছিলো। কিন্তু জ্যাকেট-মাফলার কোন কিছুকেই তখন আর যথেষ্ট মনে হচ্ছিল না। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলাম। তাপমাত্রা মনে হল শূন্যে নেমে গেছে।
অরুণাচল পর্যটন কর্তৃপক্ষ আমাকে স্বাগত জানালেন। এগিয়ে এসে পরিচয় দিয়ে হাত মেলালেন, গাইড লবসং টাসি। আবার সেই উত্তরীয় গলায় জড়িয়ে দিলেন। আসামের উত্তরীয় আর অরুণাচলের উত্তরীয়ের তফাত নজরে এলো। সাথে পরিবেশন করলেন উত্তপ্ত এক কাপ রাইস ওয়াইন। এক চুমুক রাইস ওয়াইন গলা দিয়ে নামিয়ে দিতেই পানীয় পানের রহস্য চোখের সামনে পানির মতো সরল হয়ে গেল। শরীরের প্রতিটি শিরায় কে যেন আগুনের শিখা প্রবাহিত করে দিলো। ভেল্কিবাজির মতো নিমেষে শীত উধাও। সারা শরীরে নেমে এলো ওমের উত্তাপ। বুঝলাম, কতটা জরুরী ছিলো এই পানীয়টুকু।
"অভিনেতা বিবেক ওবেরয়কে নিয়ে মঞ্চে এন্তার মাতামাতি। আদিবাসী নৃত্যশিল্পী, সরকারি কর্মকর্তা, বিদেশী অতিথি সব এক মঞ্চে।" - লেখক
“অভিনেতা বিবেক ওবেরয়কে নিয়ে মঞ্চে এন্তার মাতামাতি। আদিবাসী নৃত্যশিল্পী, সরকারি কর্মকর্তা, বিদেশী অতিথি সব এক মঞ্চে।” – লেখক
বলে রাখা ভালো, আমার ছবি তোলার বাতিক আছে। ঘোরাঘুরি আর ছবি তোলা আমার পেশার একটা বড় অংশ। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য যে অংশটুকু দখল করেছে তার পরিমাণ মামুলি। সুতরাং তাওয়াং নেমেই ক্যানন সিক্সটি ডি ক্যামেরার ৫০ মিলিমিটার প্রাইম লেন্স পাল্টে ১৮-১৩৫ মিলিমিটার জুম লেন্স লাগিয়ে নিলাম। বেশ কিছু ল্যান্ডস্কেপ তুললাম। হেলিকপ্টার আর মানুষের মুখ বাদ গেল না। একটা ফোর হুইলার স্করপিয়ন গাড়ি তৈরি ছিলো। দ্রুত গাড়িতে উঠলাম। আমার একার জন্যেই অপেক্ষা। অন্যদের গাড়ি আলাদা। গাড়ি রওয়ানা হলো হোটেলের উদ্দেশ্যে। মনের মধ্যে হাজার হাজার প্রশ্নের মাছ ভেসে উঠছে, সাঁতার কাটছে, ডুব দিচ্ছে আবার ভেসে উঠছে।
টাসির কাছে জানতে চাইলাম, আজকের তাপমাত্রা কতো?
টাসির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সুঠাম দেহ, হাস্যোজ্জ্বল। কিছুক্ষণ পরপর ঘড়ি দেখছে টাসি। “৭/৮ ডিগ্রী হবে। ডিসেম্বরে মাইনাসে নেমে যাবে।” বলেই পাহাড়ের চূড়ায় জমাট বাঁধা মেঘের কুণ্ডলীর দিকে চোখ ফেরালো।
“তাওয়াং পৌঁছতে দেরি করে ফেললাম। সরি। ছোট হেলিকপ্টারে চড়তে ভয় করে। আর ঠাসাঠাসি হলে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।” নিজের সমস্যাগুলির কথা গাইডকে জানিয়ে রাখা ভাল। আর আমার কারণে আসলেই দেরি হয়ে গেছে।
টাসি শব্দ করে হেসে উঠলো, “নো, ইউ আর অন টাইম। তবে বিশ্রামের জন্য সময় পাবে না। হোটেলে চেক ইন করেই লাঞ্চের জন্য বেরুতে হবে। তোমার বন্ধুরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা ধরে নিয়েছিলো, তুমি হয়ত আসতে পারবে না।”
আমি আগের প্রসঙ্গেই রয়ে গেলাম, “এখানে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা হয়?”
“নাহ! কখনো হয়নি। আবহাওয়া খারাপ থাকলে হেলিকপ্টার সার্ভিস বন্ধ থাকে। নো রিস্ক! তোমার কি কোন রকম শরীর খারাপ লাগছে?”
“কই না তো? কেন?” একটু বিস্মিত হলাম।
অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আর বিবেক ওবেরয়।
অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আর বিবেক ওবেরয়।
“উচ্চতাজনিত কারণে হয়ত একটু খারাপ লাগতে পারে। বাট ডোন্ট ওরি। ঠিক হয়ে যাবে। হাঁটার সময় আস্তে আস্তে হাঁটবে। মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই একটু একটু করে গরম পানি খেয়ে নেবে। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নেবে। বমি আসলে চেপে রাখার দরকার নেই। আমাকে বলবে।” কথাগুলো মুখস্ত। গড়গড় করে বলে গেল টাসি।
জানতে চাইলাম, তাওয়াং কত ফুট উঁচুতে?
“তাওয়াং-এ সব জায়গা এক রকম নয়।” টাসির চোখেমুখে রহস্যের হাসি। “মূল শহরের উচ্চতা সাড়ে দশ থেকে এগারো হাজার ফুট হবে। তবে ওই যে পাহাড়গুলি দেখতে পাচ্ছো, সেগুলি তের হাজার ফুট উপরে চলে গেছে। জাং ফলস্ দেখতে যাওয়ার সময় আমরা ওখানে উঠবো।”
টাসির কথায় আমি ক্লান্তির ভেতরেও ভ্রমণের আনন্দে উত্তেজিত বোধ করতে লাগলাম। দলের অন্যরা আগেই পৌঁছে গেছে। হোটেলে পৌঁছতে ৩০ মিনিটের মতো সময় লাগলো। রাস্তার দুপাশে বিশালাকৃতির সারি সারি গগনচুম্বী সবুজ পাইন গাছের নিস্তব্ধ বনানী চোখে পড়লো।
জ্যাক্স হোটেলে চেক ইন করে লাগেজগুলি রুমে রেখে সবার সাথে বেরিয়ে পড়লাম।
স্থানীয় এক রেস্টেুরেন্টে লাঞ্চ করবো সবাই। বাইরে তাপমাত্রা ৬/৭ ডিগ্রীর বেশি মনে হলো না। পথের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তাওয়াং-এ কোন উৎসবের আয়োজন হয়েছে আর সেজেগুঁজে সবাই সেই উৎসবে যোগ দিতে রওয়ানা হয়েছে। আসলেই তো উৎসব। ভারতের এই অঞ্চলের ট্যুরিজম সম্ভাবনাকে তুলে ধরার জন্য পৃথিবীর বহু দেশের অতিথিকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ট্রাভেল মার্ট, আইটিমএম ২০১৩।
স্থানীয় অধিবাসী তরুণীদল
স্থানীয় অধিবাসী তরুণীদল
অনেক বিদেশীর আনাগোনা চোখে পড়লো। তবে স্থানীয়রা পোশাকের কারণে আলাদা করে নজরে পড়ছিল। সকলের গায়ে শীতপোশাক। কিছুটা তিব্বতি স্টাইল। পরে অবশ্য জেনেছিলাম তাওয়াংয়ের কাছেই তিব্বত বর্ডার। এক সময় তাওয়াং তিব্বতেরই অংশ ছিল। আর নজড়ে পড়ল প্রচুর আর্মি অফিসার ও সৈন্য। ভারতীয় উপমহাদেশের সব পাহাড়ি এলাকার মতো পাহাড় আর সমতলের দ্বন্দ্ব এখানেও আছে অনুমান করলাম। এই ধরনের আন্তর্জাতিক আয়োজনে নিরাপত্তা সব সময়ই একটা বড় বিষয়।
পর্যটন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে প্রত্যেক গাড়ির সাথে একজন করে অফিসার দেয়া হলো। যারা ভ্রমণ পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের সাথে সার্বক্ষণিক ছিলেন। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের ডিনার শেষ করা পর্যন্ত, হেলিপ্যাডে গ্রহণ করা থেকে শুরু করে ৪ দিন পর আবার বিদায় জানানো পর্যন্ত তারা আমাদের সাথে সাথেই ছিলেন।
আমাদের গাড়ির সাথে যে অফিসার ছিলেন তার নাম আগেই বলেছি লবসং টাসি। পরবর্তীতে তাওয়াং-এ এই একই নামে আরো জনাপাঁচেকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। ‘টাসি’ হয়ত তাওয়াং-এর কমন নাম। ইন্দোনেশিয়ায় এই রকম আরেকটা কমন নাম পেয়েছিলাম – আদে। জাকার্তা, বালি, লম্বক যেখানেই যাই, নাম জিজ্ঞেস করলেই বলে, আদে। ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে শুরু করে প্লেনের ক্রু, সবার নাম আদে। অদ্ভুত ব্যাপার!
স্থানীয় অধিবাসী তরুণীদল
স্থানীয় অধিবাসী তরুণীদল
আমরা প্রথম দিনের লাঞ্চে স্থানীয় খাবারের দিকে গেলাম না। স্যুপ, সালাদ, ফ্রাইড রাইস, এসব খেয়েই তৃপ্ত থাকলাম। খাওয়া শেষে রওয়ানা হলাম তাওয়াংয়ের বিখ্যাত বুড্ডিস্ট মনাস্ট্রি দেখতে। গাড়ি থেকে নেমে আর গাড়িতে ওঠার আগে অল্প কিছু পথ হাঁটতে হচ্ছিল আর এতেই আমরা ভীষণ হাঁপিয়ে উঠছিলাম। এত উচ্চতায় অক্সিজেনের স্তর তুলনামূলক পাতলা বলে হঠাৎ করে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। মাঝে মাঝে বমি পাচ্ছিল, মাথা ঝিম ঝিম করছিল। টাসির নির্দেশনা মনে রেখে চলার চেষ্টা করছিলাম। সাধারণ পানি অর্থাৎ রেস্টেুরেন্টের পানি বা মিনারাল ওয়াটারের বোতলের পানি এতই ঠাণ্ডা যে প্রাণভরে তৃষ্ণা মেটানো যাচ্ছিল না। শুধু চুমুক দেয়া আর দু’এক ঢোক গেলা।
অক্সিজেনজনিত এই সমস্যা কাটানোর একটা বড় উপায় ঘন ঘন পানি খাওয়া আর আরো একটু বেশি উচ্চতায় উঠে কিছুক্ষণ থেকে আবার নেমে আসা। পর্বতারোহীদের ভাষায় ‘এক্লাইমেটাইজেশন’।
কোথাও কোথাও আমাদের জন্য গরম পানির ব্যবস্থা ছিল। এসব ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলাম। গৌহাটি থেকে হেলিকপ্টারে ওঠার আগে পবন হান্সের কর্মকর্তারাও সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তাওয়াং পৌঁছার পরে একটু শ্বাসকষ্ট হতে পারে। বমি বমি বা মাথা ঝিমঝিম করতে পারে। খাপ খাওয়াতে একটু সময় লাগবে। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই তাওয়াং মনাস্ট্রি এলাকায় পৌঁছে গেলাম। সেখানে আমাদের জন্য যে ভিআইপি আয়োজন অপেক্ষা করছিলো কে জানত! কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই টাসি মুখ খুললো, “তাওয়াং মনাস্ট্রি ৪০০ বছরের পুরানো। আর এই তাওয়াং মনাস্ট্রি ভারতের সবচেয়ে বড় এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বুড্ডিস্ট মনাস্ট্রি । যেহেতু এটি ভারতের সবচেয়ে বড়, তাই ভারতে বসবাসকারী বৌদ্ধদের কাছে এই মনাস্ট্রি তীর্থস্থান হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।”
“অন্যান্য দেশের বৌদ্ধরা এখানে আসে?” জানতে চাইলাম।
“পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল আর ভুটান থেকেও প্রচুর বৌদ্ধরা এখানে আসেন। তবে ২০০৯ সালে যখন দালাই লামা এখানে পরিদর্শনে এলেন তখন তার ধর্মীয় প্রার্থনায় প্রায় ৩০ হাজার বৌদ্ধ অংশ নিয়েছিল। তাই এই মনাস্ট্রি কী করে, কবে, কে তৈরি করলো সে কাহিনি বেশ পরিচিত এবং ভক্তদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
বিশাল আকৃতির শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে, কাশার বাদ্যযন্ত্রে ঝংকার তুলে মন্দিরে চলছে প্রার্থনা।

বিশাল আকৃতির শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে, কাশার বাদ্যযন্ত্রে ঝংকার তুলে মন্দিরে চলছে প্রার্থনা।
নানা আলোচলনার প্রসঙ্গে এক সময় টাসি বলল, বৌদ্ধদের প্রধান পুরোহিতকে দালাই লামা বলা হয়। ততক্ষণে আমাদের গল্পে আরো কয়েকজন গাইড জড়ো হয়েছে। কেউ শুনছে, কেউ দু’এক লাইন যোগ করছে। আমি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি টুকে নিচ্ছি। একজন বললেন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস দালাই লামা একজনই, যিনি বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চেহারায় পুনর্জন্ম নেন। তাই প্রধান পুরোহিতের নাম সব সময় দালাই লামা। আর সময় হিসেব অনুসারে তাদেরকে দালাই লামা ১, ২, ৩ এভাবে সম্বোধন করা হয়। বর্তমানে দালাই লামা ১৪-এর সময় চলছে।
এই মনাস্ট্রি তৈরির ইতিহাস বলতে গিয়ে একজন গাইড বললেন, দালাই লামা পঞ্চম ‘নাগওয়াং লোবসাং গায়াতসো’-এর ইচ্ছা অনুযায়ী ১৬৮০-৮১ সালে তাওয়াং মনাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মেরাগ লামা লোতে গায়াতসো’।
প্রচলিত আছে, এই মনাস্ট্রি প্রতিষ্ঠার জন্য স্থান নির্বাচন করতে গিয়ে মেরাগ লামা তার ঘোড়া ছেড়ে দেন। ঘোড়া যে স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে স্থান মনাস্ট্রি প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচিত হয়। হয়ত সে কারণেই এই স্থানের নামকরণও করা হয়েছে ‘তাওয়াং’ – যার অর্থ হচ্ছে ‘চুজেন হর্স বা পছন্দের ঘোড়া’।
"নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো।" - লেখক
“নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো।” – লেখক
প্রধান গেট দিয়ে ঢোকার পর কিছুটা পাহাড়ি রাস্তা হেঁটে আমরা মনাস্ট্রি চত্ত্বরে প্রবেশ করতেই আমাদের অভ্যর্থনা জানানো হলো। নিয়ে যাওয়া হলো মন্দিরের ভেতরে। মন্দিরের ভেতরে তখন প্রায় শ’তিনেক সন্ন্যাসী একসাথে মন্ত্র পাঠ করে প্রার্থনা শুরু করলেন। আমরা বিদেশী দর্শনার্থীও প্রায় শ দেড়েক উপস্থিত ছিলাম। মন্দিরের ফ্লোর মজবুত কাঠের তৈরি। সবাই কাঠের পাটাতনের ওপর আসন গেড়ে সারিবদ্ধ হয়ে বসলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক প্রার্থনা চলল। তারপর মন্দিরের ভেতর থেকে সবাই বেরিয়ে এলাম মন্দির চত্বরে।
চত্বর বলতে বিশাল উঠানের মতো খোলা জায়গা। চারপাশ দিয়ে সব দর্শনার্থীরা গোল হয়ে দাঁড়ালো আর মাঝখানের খোলা জায়গায় শুরু হলো একে একে নৃত্য পরিবেশন।
বিচিত্র পোশাক পরা নৃত্যশিল্পীদের থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না। বারান্দার এক পাশে লম্বা শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে চলেছেন দুই সন্ন্যাসী। বাজছে ঢাক। ঘুঙুর পায়ে শিল্পীরা তালে তালে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে লাফিয়ে লাফিয়ে নানা ভঙ্গিমায় নেচে চলেছেন। পাহাড়ের চূড়ায় শেষ সূর্যের আলো চোখে পড়ল। দ্রুত অন্ধকার নেমে এলো। নৃত্যের উদ্দাম ছন্দ যেন রক্তে ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হল তিন লক্ষ বছর আগের কোন বিলুপ্ত সভ্যতার পূর্ণিমা-বরণ আসরে এসে পড়েছি। আকাশের গায়ে লটকে থাকা ভয়ঙ্কর পাহাড়গুলোর অন্ধকার পাইন জঙ্গলের ভেতর আরো লুকিয়ে আছে কতো ইতিহাস! কত অন্ধকার গুহার গায়ে কত সুখ, কত দুখ আর কত কত শিকারের গল্প! কত শিশুর হাতের আঙুল গাছের শেকড়ের মতো মাটি আকড়ে আকড়ে বেড়ে উঠেছে মেঘের দেশে, এই উপত্যকার গাঢ় সবুজ ছায়ায়। কত অজানা জাতি গোষ্ঠির কত অব্যক্ত গল্প ঐসব ঝর্ণার ¯্রােতে ¯œাত সাদা সাদা পাথরের গায়ে খোদাই হয়ে আছে। সে এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা! আমার কী সাধ্য যে ভাষায় প্রকাশ করি! এক সময় আসর ভাঙলো। অন্ধকার পুরোপুরি আমাদের ঢেকে ফেলেছে। আমরা নৈশভোজের জন্য তৈরি হতে হোটেলে চলে এলাম।
হোটেলে এসে দ্রুত পোশাক পাল্টে তৈরি হয়ে নিলাম। পাহাড়ি রাস্তায় আলো অন্ধকারের এক অদ্ভুত পরিবেশ। রাস্তার ওপর জমে থাকা ঘন মেঘের ভেতর থেকে হেডলাইটের আলো জ্বালিয়ে গাড়ি চলল সরকারি নৈশভোজের আয়োজনে। সাথে আছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পাহাড়ি সংস্কৃতির প্রদর্শন হবে বিশ্বের কাছে।
তাওয়াং এ প্যারাগ্লাইডিং
তাওয়াং এ প্যারাগ্লাইডিং
গাড়ি থেকে নামলাম পাহাড়ের ওপরের এক খোলা চাতালে। ডানে তাকাতেই বিশাল আকারের অস্থায়ী অডিটোরিয়াম চোখে পড়ল। স্টিলের ফ্রেম জোড়া লাগিয়ে আর সাদা সামিয়ানা দিয়ে ঢেকে বানানো হয়েছে বিশালাকৃতির অডিটোরিয়াম। সামনে দাঁড় করানো সারি সারি পতাকা। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে পত্পত্ করে উড়ছে।
ঢোকার মুখে লম্বা রেড কার্পেট। গেটের কাছে আসতেই অপূর্ব সাজে সজ্জিত তরুণী দল স্থানীয় পানীয় সহযোগে স্বাগত জানালো। রাজকীয় অভ্যর্থনা! এক তাঁবুর মধ্যে সব মিলিয়ে অন্তত পাঁচশ লোকের আয়োজন। এক হাজারেরও বেশি নৃত্যশিল্পী আর কলাকুশলী এসেছেন পুরো উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে। চার দিনের প্রত্যেক রাতে চলবে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নৃত্য, সংগীত। উত্তর-পূর্ব ভারতের পর্যটনের নানা দিক বিশ্বের কাছে তুলে ধরাই এ আয়োজনের উদ্দেশ্য। পৃথিবীর ৬০টি দেশ থেকে এসেছেন অতিথিরা। মুম্বাই থেকে এসেছেন বিবেক ওবেরয়। রাতে দারুণ পার্টি হলো। কৃষ থ্রি মুক্তি পাওয়ার পর বিবেকের ক্রেজ আরো এক ধাপ বেড়ে গেছে বলেই মনে হলো।
মঞ্চে পাহাড়ি শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনা চলছে। বাংলাদেশ থেকে আসা আমাদের ৬ জনের জন্য আলাদা একটা টেবিল দেয়া হলো। আমরা আসন গ্রহণ করতেই নানা রকম খাবার আর পানীয় আসতে লাগলো।
নৈশভোজে পরিচয় হলো নানা দেশের মানুষের সাথে। গল্প হলো ঢের। রাত বেড়ে চলল। বাইরে বেরিয়ে দেখি আকাশে বিশাল একটা চাঁদ। থমকে দাঁড়িয়ে আছে সাদা সাদা মেঘ। অডিটোরিয়ামের ভেতর থেকে অনুষ্ঠানের আওয়াজ ভেসে আসছে। দরাজ গলার গান আর বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছণায় সবকিছু অপার্থিব লাগতে শুরু করলো।
মাথা ঝিমঝিম করাটা কমে গেছে। স্থানীয় পানীয়ের নামটা জানা হলো না। মারাত্মক তার ক্ষমতা। টাসি সবাইকে হোটেলে ফেরার সময় স্মরণ করিয়ে দিলো। ফুরফুরে মেজাজে সবাই হোটেলে ফিরে এলাম। যে যার রুমে ঢুকে গেলাম। পরদিন সকালে সেমিনার আছে। এই অঞ্চলের পর্যটনের নানা দিক তুলে ধরা হবে সে সেমিনারে।
তাওয়াং শহর।
তাওয়াং শহর।
আমার তখনই শুতে ইচ্ছে হলো না। আমি ক্যামেরা নিয়ে উঠে আসলাম হোটেলের ছাদে। হু হু করা বাতাস আর হিম শীতল ঠাণ্ডায় লং এক্সপোযারে অপূর্ব তাওয়াং শহরের রাতের ছবি তুলতে থাকি। ঘণ্টা খানেক পর রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
তাওয়াং সম্পর্কে চট করে কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি। ২ হাজার বর্গকিলোমিটারের তাওয়াং জেলায় জনসংখ্যা হাজার পঞ্চাশেকের মতো। মনপা জনগোষ্ঠির মানুষরাই এখানকার প্রধান অধিবাসী। এই মনপাদের মধ্যেও আছে ৬টি শ্রেনী – তাওয়াং মনপা, দিরাং মনপা, লীশ মনপা, ভাট মনপা, কালাকতাং মনপা এবং পানচেন মনপা। শিক্ষিতের হার শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য তাওয়াং ভ্রমণবিলাসীদের কাছে খুবই প্রিয়।
১৯ অক্টোবর, ২০১৩
আগেই বলেছি, তাওয়াং-এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্য। তের হাজার ফুট উচুঁতে এই শহর। রাস্তায় রাস্তায় মেঘ ঘুরে বেড়ায়। যে দিকে তাকাবেন চিরহরিৎ বনাঞ্চল ঢাকা পাহাড়ের সারি। সকালের সোনারঙা সূর্যের আলো পাহাড়ের চূড়ায় পড়েছে। বেশ কিছু ছবি তুললাম। ম্যাজিক লাইটের বদৌলতে সকাল আর সন্ধ্যায় ল্যান্ডস্কেপ ছবি দারুণ হয়। আমাদের দলের সবাই তৈরি। একসাথে চললাম নাস্তা করতে। হোটেলের তিন তলায় রেস্টুরেন্টে। গাড়ি এসে গেছে আগেই।
বিকেল পর্যন্ত সভা সেমিনার চলল। সন্ধ্যা নামার ঘণ্টা তিনেক আগে আমরা তাওয়াং শহরটা ঘুরতে বেরুলাম। কেউ কেউ কিছু শীতবস্ত্র কিনলো। আমি কিছু ওষুধ কিনলাম, তাওয়াং-এর স্থানীয় গানের একটা সিডি কিনলাম। সবাই মিলে নাম না জানা কিছু স্ট্রিট ফুড কিনে খেলাম। পাহাড়ের ওপারে সূর্য হারিয়ে যেতেই শহরে ঝুপ করে নেমে এলো অন্ধকার।
শহর ছড়িয়ে আছে পাহাড়ের ঢালে। আঁকাবাঁকা রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে। কোন পাহাড়ের চূড়ায় স্কুল, কোন পাহাড়ের চূড়ায় মন্দির, কোথায় ঢালের গা কেটে তৈরি করা হয়েছে আধুনিক মার্কেট, শপিংমল, কুটিরশিল্পের প্রদর্শনী কেন্দ্র।
হেলিকপ্টার থেকে তোলা তাওয়াং শহর।
হেলিকপ্টার থেকে তোলা তাওয়াং শহর।
অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে সন্ধ্যা হতেই নক্ষত্রের মতো জ্বলে ওঠে বৈদ্যুতিক বাতি। শহরের হোটেলগুলি পর্যটকে ভরা। রাত বাড়তে থাকে শীতেরও প্রকোপ বাড়ে। রাতে আবার সেই নৈশভোজ। আমরা ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে এলাম। সবাই একরুমে জড়ো হয়ে অনেক গল্প হলো। মাঝরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর যে যার রুমে ফিরে এলাম। আজকে অনেক ক্লান্ত লাগছে। রুম হিটার জ্বলছে। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। হোটেলের জানালার গায়ে অস্বচ্ছ জমাট কুয়াশা।
২০ অক্টোবর, ২০১৩
আজকে তাওয়াং-এ দুইদিনব্যাপী এক দারুণ উৎসব শুরু হতে যাচ্ছে। সকালে অফিসিয়াল কিছু কাজকর্ম সেরে দুপুরের পরপর আমরা মেলা প্রাঙ্গনে পৌঁছে গেলাম।
সব মিলিয়ে হাজার খানেক মানুষের আয়োজন। উৎসবে প্রায় অর্ধশতাধিক স্টল আছে। এই স্টলগুলিতে তাওয়াং-এর শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষি, কুটির শিল্প, জীবন-যাপনের বৈচিত্র্য তুলে ধরা হলো। কিছু কিছু কটেজ ছিলো যেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মানুষরা কীভাবে বসবাস করে তা তুলে ধরা হয়েছে।
তাদের পোশাক, রান্নাঘর, অতিথিশালা, ব্যবহার্য নানা দ্রব্যাদি সাজানো, তৈরি করা হচ্ছে নানা খাবার। মাঝখানে গনগনে আগুনের চুল্লী, চারপাশে উৎসুক দর্শনার্থীরা বসে গরম গরম তৈরি করা খাবার কিনে খাচ্ছে। ছবি তুলছে, ফেসবুকে আপডেট করছে।
মেলা প্রাঙ্গণের চারপাশ উঁচু উঁচু পাহাড় ঘেরা। বিকাল হতেই পাহাড়ের চূড়া থেকে শুরু হলো প্যারাগ্লাইডিং। একে একে প্যারাগ্লাইডাররা নেমে আসছিলো মেলার খোলা চত্ত্বরে। এক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। চারপাশে আলোর মশাল জ্বলে উঠলো। মনে হচ্ছিল হাজার বছর আগের কোন জনপদের বাসিন্দা হয়ে আছি।
তাওয়াং-এর পাহাড়ি পথ।
তাওয়াং-এর পাহাড়ি পথ।
চাঁদের ভৌতিক আলোয় তাদেরই একজন হয়ে এই উপত্যকার আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অধিবাসীদের রঙবেরঙের নানা ডিজাইনের বিচিত্র পোশাক। তাদের ঘিরে ছবি তোলার হিড়িক। আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে। চারপাশের স্টলের মাঝখানের খোলা জায়গায় স্টেজ বানানো হয়েছে। সেখানে চলছে নাচ-গান, উপস্থাপকের মজার মজার উপস্থাপনা আর দর্শকদের হৈ-হল্লা। রাত বেড়ে চলল। আমরা বিদেশী ডেলিগেটরা এক ফাঁকে নৈশভোজ সেরে নিলাম। তারপর আরো গান, আরো নৃত্য, আরো পানাহার, আরো ছবি তোলা, আরো হারিয়ে যাওয়ার গল্প। হোটেলে ফিরে এসেও এই আনন্দ শেষ হয় না।
আমাদের হোটেলে আরো অনেক দেশের ডেলিগেটরা থাকছেন। গত দুদিনে তাদের সাথেও একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অনেক রাত পর্যন্ত তাদের সাথেও আড্ডা দেয়া হলো। হলো অনেক মত বিনিময়। তাদের পর্যটন, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, চলচ্চিত্র, ফটোগ্রাফি কিছুই বাদ গেল না। আমাদের আসরে সবচেয়ে বেশি হলো জোকস। পরিব্রাজক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বলের ভাণ্ডার যেন অফুরন্ত। পর্যটন বিচিত্রার সম্পাদক মহিউদ্দিন হেলালেরও গল্পের রসদ সমৃদ্ধ। এটিএন নিউজের প্রণবদা প্রসঙ্গক্রমে রাজনীতি আর ইতিহাস তুলে ধরে আমাদের সমৃদ্ধ করে চলেছেন। ফোর হুইলস ট্যুরিজম-এর বাপ্পী ভাই নিপাট ভদ্রলোক। সাতেপাঁচে নাই। আমার ভালোমন্দে তার কড়া নজর, যেন অভিভাবক। দৈনিক যুগান্তর-এর রাকিব ভাই চুপচাপ মানুষ। আমি সব সময়ই ভালো শ্রোতা। ছবি তুলেই সময় কাটাই বেশি।
শুকরের মাংস পোড়াতে দিচ্ছেন শেফ হংসং টাসি।  
শুকরের মাংস পোড়াতে দিচ্ছেন শেফ হংসং টাসি।
২১ অক্টোবর, ২০১৩
আজকে আমরা তাওয়াং শহর থেকে বাইরে বেড়াতে যাব। দুটি জায়গা দেখার আছে। একটি হচ্ছে মাধুরী লেক। যার আসল নাম শাংগেতসার লেক। রাকেশ রোশন পরিচালিত কোয়েলা ছায়াছবির ‘তানহাই তানহাই তানহাই… দোনোকো পাস লে আই…’ গানটির শুটিং এই লেকে হয়েছিলো। এরপর থেকেই লেকটির আসল নাম হারিয়ে ধীরে ধীরে মাধুরী লেক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
ভূমি জরিপ অনুসারে ১৯৫০ সালে এক ভূমিকম্পের ফলে উদ্ভূত বন্যা থেকে এই লেকের উৎপত্তি। এই লেক দেখার জন্য আপনার তাওয়াং আসার দরকার নেই হয়ত কিন্তু আপনি তাওয়াং এলে শাংগেতসার লেকটিকে এক নজর দেখে যাবেন।
তাওয়াং শহর থেকে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। লেকটি যেমন সুন্দর দেখতে যাওয়ার পথটিও তেমন সুন্দর। আমরা চললাম আরো দূরের পথে। জাং ফলস দেখতে। জাং জলপ্রপাতের আসল নাম ছিলো নুরানাং ফলস। এখন জাং ফলস নামেই পরিচিত। অপূর্ব সুন্দর এই জলপ্রপাত। পাহাড়ের গা বেয়ে, এঁকেবেঁকে চলা পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা যখন জাং ফলসের কাছে পৌঁছলাম তখন যেন ভাষা হারিয়ে ফেললাম। এত সুন্দর ঝর্না এর আগে কোথায় দেখেছি মনে পড়ে না। প্রায় ঘণ্টা খানেক সময় কাটালাম সেখানে।
কত রকম ছবিই না তুললাম। এই ঝর্নার কাছেই একটি রিসোর্ট আছে। পাহাড়ের চূড়ায়। সে রিসোর্টের বারান্দা থেকে পুরো ঝর্না আর খরস্রোতা ঝিরি নজরে আসে। অপূর্ব! এই বারান্দায় বসে আমরা সবাই কফি খেলাম। কিছুটা সময় জিরিয়ে ভ্রমণের ক্লান্তি একটু দূর হতেই ফেরার পথ ধরলাম।
পথে স্থানীয় এক রেস্টেুরেন্ট থেকে ভর্তা, সবজি, পাহাড়ি মুরগীর মাংস দিয়ে দুপুরের আহার করে নিলাম। আহা কী তার স্বাদ! তাওয়াং-এ ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। তবুও কিছুটা সময় চাইলে তখনও বেড়ানো যায়।
সবাই হোটেলে ঢুকে গেলো। টাসি বলল, চলুন আপনাকে তাওয়াং-এর ওয়ার মেমোরিয়ালটা দেখিয়ে আনি। বেশ, তাই চলুন। গিয়ে বুঝলাম, এই ওয়ার মেমোরিয়াল না দেখলে আমার একটা বড় অতৃপ্তি থেকে যেত। সুবেদার জুগেন্দার সিং-এর নাম যারা জানেন তারা ইতিমধ্যেই বুঝে গেছেন আমার বক্তব্য। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে সুবেদার জুগেন্দার সিং এক পাহাড়ের উপত্যকায় মাত্র ১৩ জন সৈন্য নিয়ে প্রায় ৬০০ জন চীনা সৈন্যকে আটকে রেখেছিলেন। জুগেন্দার সিং প্রথম দিনেই গুলিবিদ্ধ হন। এবং সেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। টানা তিনদিন যুদ্ধ চলার পর পুরো ১৩ জনের দলটিই শহীদ হন এবং তারপর চীনা সৈন্যরা সেই উপত্যকা অতিক্রম করে ভারতের আরো ভেতরে প্রবেশ করে।
পাহাড়ের ওপর খোলা চত্ত্বরে আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলার জন্য তৈরি করা অস্থায়ী অডিটোরিয়াম।
পাহাড়ের ওপর খোলা চত্ত্বরে আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলার জন্য তৈরি করা অস্থায়ী অডিটোরিয়াম।

এই যুদ্ধকাহিনী দেশের জন্য আত্মত্যাগের নিদর্শন হিসেবে ভারতের ইতিহাসে খোদাই হয়ে গেছে। সুবেদার জুগিন্দার সিংকে ইন্ডিয়ান আর্মির সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘পরম বীরচক্র’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। এই ওয়ার মেমোরিয়ালে যুদ্ধে শহীদ হওয়া আরো সকল সৈন্যদের নাম লেখা আছে। স্থাপত্য শৈলীর বিবেচনায়ও ওয়ার মেমোরিয়ালটি অন্যন্য। একজন আর্মি অফিসার পরম যত্নে আর শ্রদ্ধায় মেমোরিয়ালটি ঘুরিয়ে দেখালেন।
অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলাম। হোটেলে ছাদে দাঁড়িয়ে শেষ বারের মতো রাতের তাওয়াং শহর দেখে নিলাম। পরদিন সকালেই আমরা তাওয়াং ছেড়ে যাচ্ছি। ৪টি দিন স্বপ্নের মতো কেটে গেল। সকাল ৯টায় আমাদের হেলিকপ্টার। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেই লাগেজ গুছিয়ে নিলাম।
২২ অক্টোবর, ২০১৩
ঘুম ভাঙলো দরজায় লবসং টাসির টোকা শুনে। দ্রুত নাস্তা সেরে নিলাম। গাড়ি তৈরি। সবাই অন্যান্যদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। হেলিপ্যাডে পৌঁছে গেলাম নির্ধারিত সময়ের আগেই। বিদায় ভারাক্রান্ত চোখে আরো অনেকের সাথে হেলিপ্যাডে দেখা হলো। তারপর একসময় বিশাল হেলিকপটারটি আমাদের নিয়ে উড়াল দিলো। তাওয়াং শহরের ছোট ছোট বাড়িগুলি আরো ছোট হতে থাকলো। বিখ্যাত সেলা পাসের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ে চললো গৌহাটি এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। পেছনে পরে রইলো হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার এক অজানা উপাখ্যান।
মেঘের মধ্যে ডুবে আছে রাতের তাওয়াং। হালকা বাতাস আর হাড় জমাট করা কনকনে ঠাণ্ডা।
মেঘের মধ্যে ডুবে আছে রাতের তাওয়াং। হালকা বাতাস আর হাড় জমাট করা কনকনে ঠাণ্ডা।
তাওয়াং-এ যা যা দেখার
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছেই। এছাড়া দেখতে পারেন তাওয়াং মনাস্ট্রি, তাওয়াং শহর, মাধুরী লেক (শাংগেতসার লেক), জাং বা নুরানাং ফলস, ওয়ার মেমোরিয়াল, স্থানীয় হস্তশিল্প প্রদর্শনী ইত্যাদি।
যেভাবে যাবেন
নানা পথ আছে। বেছে নিন আপনার পছন্দ মতো একটি।
এক. ঢাকা-কোলকাতা-গৌহাটি-তাওয়াং
আপনি বাসে (১৪/১৫ ঘণ্টা) ১৫০০ টাকায়, ট্রেনে (১২/১৩ ঘণ্টা) ন্যূনতম ৯৬০ টাকায় বা বিমানে (৪০ মিনিট) আনুমানিক ৬ হাজার টাকায় ঢাকা থেকে কোলকাতা যেতে পারেন।
কোলকাতা থেকে গৌহাটি যেতেও বাস (২০/২২ ঘণ্টা), ট্রেন (২২/২৩ ঘণ্টা) এবং বিমান (সোয়া ১ ঘণ্টা) আছে। এসি বাসে ১ হাজার টাকা, ট্রেনে ৮শ টাকা, বিমানে আনুমানিক ১০ হাজার টাকা খরচ হবে।
ঢাকা থেকে গৌহাটি সরাসরি কোন ফ্লাইট নেই। জেট এয়ারের কানেক্টিং ফ্লাইটে যেতে পারেন। রিটার্ন টিকেটে খরচ পড়বে আনুমানিক ২১ হাজার টাকা। গৌহাটি থেকে বমডিলা হয়ে বাসে (প্রায় ২ দিন) বা হেলিকপ্টারে (সোয়া ১ ঘণ্টায়) তাওয়াং পৌঁছা যায়।
বাসা ভাড়া আনুমানিক ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা। হেলিকপ্টার ভাড়া জনপ্রতি সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা।
দুই. ঢাকা-তামাবিল-শিলং-গৌহাটি-তাওয়াং
ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে তামাবিল যেতে ৬শ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। তামাবিল থেকে বর্ডার পেরিয়ে বাস বা জিপ পাওয়া যায়। শিলং হয়ে গৌহাটি যেতে খরচ পরবে জনপ্রতি দেড় থেকে ২ হাজার টাকা। গৌহাটি থেকে তাওয়াং যাওয়ার খরচ আগেই বলেছি।
যেখানে থাকবেন
আপনার যাত্রাপথের ওপর নির্ভর করে আপনাকে তাওয়াং যাওয়ার পথে কোলকাতা,শিলং বা গৌহাটিতে রাত্রি যাপন করতে হতে পারে। অনলাইনে অনেক হোটেলের তথ্য পাবেন। তবে কয়েকটি হোটেলে নাম বলে রাখি। বাজেট অনুযায়ী হোটেল বেছে নিতে পারবেন।
আসামের রাজধানী গৌহাটি এয়ারপোর্ট। হেলিকপ্টারের জানালা থেকে তোলা।
আসামের রাজধানী গৌহাটি এয়ারপোর্ট। হেলিকপ্টারের জানালা থেকে তোলা।
কোলকাতায় গ্র্যান্ড হায়াত, পিয়ারলেস ইন, মনোটেল, কর্পোরেট, ডি. কে. ইন্টারন্যাশনাল, গোল্ডেন অ্যাপল, আফরিন ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি।
গৌহাটিতে হোটেল ব্রহ্মপুত্র অশোক, গেটওয়ে, ডাইনেস্টি, রেইনস ইন এগুলোও ভালো মানের হোটেল।
শিলং-এ থাকতে পারেন সেন্টার পয়েন্ট, পোলো টাওয়ার, অ্যালপাইন কন্টিনেন্টাল, মি কাসা, পাইনউড, পেগাসাস ক্রাউন, এসেম্বলি ইত্যাদি হোটেলে।
তাওয়াং-এ থাকতে পারেন সংগার লজ, তাওয়াং লজ, তাওয়াং ইন, জ্যাক্স ইত্যাদি হোটেলে। মাঝারি মানের হোটেলে থাকলে রাতপ্রতি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা খরচ পড়বে।
খরচ
যদি ৪জন বা ৮জন বা ১২ জনের গ্রুপ হয় তাহলে ভ্রমণে সবচেয়ে কম খরচ পড়বে। থাকা, খাওয়া এবং যাতায়াতে ন্যূনতম আনুমানিক ২০ হাজার টাকা বাজেট ধরলে আপনি তাওয়াং ভ্রমণ করে আসতে পারবেন। কোন ট্যুর অপারেটরের সাহায্য নিলে সবচেয়ে ভালো করবেন।