বুধবার, ২৮ মে, ২০১৪

হটল্যান্ড থেকে ফ্রিজল্যান্ড ...নেদারল্যান্ড

লিখেছেন: হাসান রায়হান | এপ্রিল ২৭, ২০১১
প্রায় অর্ধযুগ হয়ে গেল বিদেশ ঘুরে আসার। কতবার ভাবছি এইটা নিয়ে লিখব কিন্তু আজ না কাল করে করে লেখা হয়ে উঠে না। দেড় মাসের জন্য হল্যান্ডের খুব খুবই ছোট এক শহরে থাকার আনন্দের স্মৃতি এতদিন না লেখার অন্যতম কারণ সেই চমৎকার সময়ের ভিজুয়াল স্মৃতি উপকরণ হারিয়ে ফেলা। সেখানে আমি আমার আশেপাশের যত ছবি তুলিছেলিাম একটা সিডিতে কপি করা ছিল। সেই সিডিটা হারিয়ে ফেলার দুঃখে লেখা আর হয়ে উঠেনা। এইবার ঠিক করেছি লিখেই ফেলব, নাহলে আর হয়ত আমার জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমনের কথা লেখা হবে না।
আমি তখন একটা ডাচ-বাংলাদেশি কোম্পানিতে কাজ করতাম। কয়েকদিন ধরে কথা হচ্ছিল আমার ও আরেকজন সিনিওর কলিগের নেদারল্যান্ড যাওয়ার। তবে যাওয়া যে হবে নিশ্চিত ছিলনা। কিন্তু যখন নিশ্চিত হল তখন হাতে সময় নাই। এক সপ্তাহের মধ্যে যেতে হবে। এবং একা। এদিকে আমার কোনো প্রস্তুতি ছিলনা। এমনকি পাসপোর্টও ছিলনা।
নেদারল্যান্ড থেকে মেইলের পর মেইল আসতে থাকল। যাওয়ার জন্য কী কী কাগজ লাগবে, ঐখানে কী কাজ করতে হবে এই সব নিয়ে। এই প্রথম আমাদের বিগ বস কোম্পানির মালিক কেইস নেবারের(Cees Nieboer) সাথে যোগাযোগ হল। তবে সেক্রেটারি ইডা চমৎকার ভাবে গুছিয়ে সহজবোধ্য মেইল করত । আমি কিন্তু ভিতরে টেনশনে অস্থির। যে কাজের জন্য আমি যাব সেইটা কখনো করি নাই। বিদেশে গিয়ে শিখে কাজ করতে হবে। পারব কীনা সেই ভয়ে ঘুম আসেনা আমার। আমি আসলে যেতেই চাই নাই। কিন্তু উপায় নাই, চাকরি করতে হলে যেতেই হবে। তাছাড়া আমি ছাড়া অন্য লোক ছিলনা তেমন।
জরুরি পাসপোর্ট করার জন্য আবেদন করলাম। পুলিশ ভেরিফিকেশনে এসে ভাব বুঝে বজ্জাত পুলিশ টাকা নিল। পাসপোর্ট যথাসময়ে পাওয়ার জন্য পরিচিত লোক ধরা হল। কিন্তু তবুও পাসপোর্ট হাতে পেয়ে এম্বেসিতে জামা দিতে গিয়ে দেখা গেল দশ মিনিট দেরী হয়ে গেছে। সেদিন আর ভিসার জন্য দাঁড়ানো যাবেনা।
ফিরে আসছি অফিস থেকে ফোন আসছে অপেক্ষা করার জন্য। কেইস এম্বেসেডরকে ফোন করেছে যেন আজ আমার এপয়নমেন্ট হয়। এমন নাছোড়বান্দা মানুষ! যদিও সেদিন হয় নাই। পরের দুই দিন বন্ধের পর অফিস ডে তে আবার গেলাম। ভিসার পাওয়া নিয়ে আমার কোনো দুশ্চিন্তা ছিলনা। না পেলেই বেঁচে যাই। অফিসার বাদামী রং এর মহিলা। কোন দেশি বুঝলামনা, ভারতীয় বা বাঙালি বা এংলো হতে পারে। তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি ও সুরে জিজ্ঞেস করল কেন যাব, কী কাজ করব ইত্যাদি। আমি তাচ্ছিল্যের ভাব নিয়া উত্তর দিলাম। আমাকে ইনভাইট করা এডোয়ার্ড বিটোফেনের লম্বা চুলের ছবি দেখে বিশ্বাস করতে চায় না সে ছেলে। যাই হোক ভিসা পাওয়া গেল। আমি পাসপোর্ট হাতে নিয়ে ভাবি ভিসা নাদিলে কেইস নিশ্চয়ই পরের ফ্লাইটে বাংলাদেশে এসে এম্বেসেডরের কলার ধরত! দেড় মাসের ভিসা সাথে শর্ত দেড় মাস পর এম্বেসিতে গিয়ে দেখা করে প্রমান দিতে হবে আমি পালায় যাই নাই হল্যান্ডে।
তারপর দুইদিন গেল টিকিট, ইনসুরেন্স, গরম কাপড় কেনা ইত্যাদি করে। খুব সকালে ফ্লাইট। ভোররাতে মা, বউ আর আড়াইমাসের রিমঝিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জীবনের প্রথম বিদেশ, প্রথম বিমানে ওঠা এবং পরবর্তীতে অজস্র প্রথমের অভিজ্ঞতা নিতে এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রা করলাম।
রাতের ফাঁকা রাস্তায় একশ কিমিতে গাড়ি চালিয়ে মাইক্রোর ড্রাইভার বিশ মিনিটেই বিমানবন্দরে পৌছে দিল। এই প্রথম বিদেশ যাত্রা, মনের ভিতর টেনশন। বোর্ডিং এ ফরম পূরণ করে লাইনে দাঁড়াতেই এক যাত্রী অনুরোধ তার ফরম লিখে দেওয়ার। এই লোককে দেখে আমার মনের ভয় সবটাই নাই হয়ে গেল, সম্পূর্ণ নিরক্ষর একজন পাঁচ বছর সৌদিতে কাজ করতে পারে, যাওয়া আশা করতে পারে তবে আমার ভয় কী?
বোর্ডিং হওয়ার পর বিমানের জন্য অপেক্ষা। ঢাকা থেকে এ্যামিরেটসে দুবাই। সেখানে বারো ঘন্টা পর কেএলেমের আমাস্টারডাম ফ্লাইট ধরতে হবে। চাঁদপুরের একজনের সাথে পরিচয় হল। সাথে লাগেজ মাত্র একটা ব্রিফকেস। শুকনা পাউরুটি পানি দিয়ে খাচ্ছিলেন। ঐদিন ছিল হরতাল তাই রাতে হোটেলে ছিলেন। হোটেল থেকে এয়ারপোর্টে চলে এসেছেন। আমাকে পাউরুটি অফার করলেন। এই দরিদ্র প্রবাসীর আন্তরিকতায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। পোষাকেই বোঝা যায় বিদেশে থেকেও উপার্জন বেশি না। মনে মনে কামনা করলাম তার যেন আরো ভালো রোজগারের সুযোগ হয়।
বিমানে শতকরা একশ ভাগ যাত্রী বাংলাদেশি। কিন্তু ভিডিও, অডিও চ্যানেল, সংবাদপত্র কোথাও বাংলাদেশি কিছু পেলামনা। হয় হিন্দি না হয় ইংরেজি। হায় কী সেলুকাস! খাবার সময় অবশ্য খিচুড়ি পাওয়া গেল। যাত্রীদের নিরানব্বই ভাগ মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিকের কাজ করে। আমার পাশের জন বয়স্ক। অবস্থা মনে হয় সাধারণ শ্রমিকদের থেকে ভালো। মুখে গাম্ভীর্য এনে শক্ত হে বসে আছে,অন্যদের সাথে কথা না বলে। অন্যরা কিন্তু গল্পগুজবে চিৎকারে বিমানকে লোকাল বাস বানিয়ে ফেলছে।
আমার সিট জানালার পাশে। বিমান যখন টেক-অফ করে উড়ে যায় নিচে সংসদ ভবন, পরিচিত সব স্থাপনা, বুড়িগঙ্গা নদী দ্রুত চোখের সামনে থেকে ছোট হতে হতে সরে যায়। অনিন্দ্য সুন্দরী ইওরোপিয়ান বিমান বালা খাবার দিয়ে যায়। পেছনের সিটে বসা যুবক বলে, মি লাভ ইউ। বিমান বালা বদমায়েশি বুঝতে পেরে বলে, স্যরি আই ডোন'ট গেট ইউ। বলে অন্যদিকে চলে যায়। এদিকে আর আসেনা।
কয়েক ঘন্টার যাত্রা বিরক্তিকর লাগে। সময় কাটাতে জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকি। দেশের সীমান্ত পার হয়ে ভারতের আকাশে বিমান। এই প্রথম অন্য দেশের উপর। রোমাঞ্চ লাগে। কোলকাতা তারপর ভুবনেশ্বর ইতা্যদি শহরের উপর দিয়ে উড়ে যায় বিমান। নাম না জানা কত জনপদ নদী বন পার হয়ে যায়। উপর থেকে নদী দেখতে সরু বাঁকা রেখার মত লাগে। একে বেকে সমূদ্রে গিয়ে মিশেছে।
দুবাইতে পৌছি সকালে, এগারোটায় মনে হয়। আমার কানেক্টিং ফ্লাইট কেএলএম বিমানের। আশা ছিল আমার সাথে কেএলএমএর আর যাত্রী থাকবে। যাদের সাথে সাথে আমি সেই ফ্লাইট ধরতে পারব। কিন্তু হায়, আমিই একমাত্র কেএলএমএর যাত্রী। কেউ দুবাইএর বেশিরভাগই সৌদি আরবের পথে অন্য বিমানে দিকে ছুটে গেল। আমার কোনো ধারণা ছিলনা কীভাবে কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে হবে। কাউন্টারে বসা আমীরাতি লোকজন জিজ্ঞেস করলে ঠিকমত উত্তর দেয়না। বলল কেএলএমএর কাউন্টারে যাও। সেই কাউন্টার খুঁজে পাই না। একবার উপরে উঠি একবার নীচে নামি বিশাল এই এয়ারপোর্টের। নিজেকে অসহায় লাগে। ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসি, তখন দেখা হয় একই বিমানে ঢাকা থেকে আসা যুবকের সঙ্গে। আমার মতই অবস্থা তার। সে যাবে এলসালভেদর। সে ধরবে এুার ফ্রান্সের ফ্লাইট। এরকম আরো চারটা কানেক্টিং ফ্লাইট ধরে যেতে হবে এলসালভেদর। জানালো পাঁচ বছর ধরে সেখানে আছে। আমি অবাক হয়ে ভাবি, বাঙালি দুনিয়ার কোনো দেশ আর বাদ রাখে নাই।
অবশেষে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া গেল। সম্ভবত জাপানি কোনো বিমানের ক্রু একজন কে জিজ্ঞেস করে সঠিক উপায় জানলাম। ভদ্রলোক জানালো ঐদিকে মারহাবার কাছে যাও সে আপনাকে সব ব্যাবস্থা করে দিবে। আমি বললাম, মারহাবাকে চিনব কীভাবে? মারহাবা কোনো লোক না, একটা প্রতিষ্ঠান। ওনাকে ধন্যবাদ দিয়ে মারহাবা খুঁজতে চললাম। পাওয়া গেল মারহাবা কাউন্টার। ওদের দায়িত্ব আমাকে হোটেলে রাখার ব্যাবস্থা করা। কাউন্টারের স্মার্ট শ্রিলংকান মেয়েটা দুবাইতে ঢোকার জন্য ভিসার ব্যাবস্থা হোটেলে ইনফর্ম করে বলে দিল কীভাবে যেতে হবে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় আমিরাতি ইমিগ্রেশনের লোক বারবার পাসপোর্ট উল্টায় দেখে, চাপ দিয়া দেখে। হয়ত দুই নম্বরি কিনা চেক করে। একসময় ছেড়ে দেয়। এয়ারপোর্টের বাইরে মারহাবা মেয়েটার কথামত এস্টোরিয়া হোটেলের নামের প্ল্যাকার্ড হাতে একজনকে পাওয়া যায়। আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। আমাকে নিয়ে হোটেলে যাওয়ার মাইক্রোতে নিয়ে উঠায়। সেখানে অপেক্ষা করছিল আরেকটা ভারতীয় দম্পত্তি। ঝকঝকে দুবাইয়ের রাস্তা দিয়ে মাইক্রো চলে। প্রথম বিদেশের মাটিতে পা রাখা।
হোটেলে রুমে গিয়েই বিছানায়। ঘুম থেকে উঠে গোসল করে থেকে বেরোই শহর দেখতে। রাস্তাঘাটে সর্বত্র সাব-কন্টিনেন্টের লোক ভরা। স্থানীয় লোকজন চোখেই পড়েনা। ফুটপাথ ধরে হোটের আশেপাশে হাটাহাটি করি। কিছু দূর গেলেই পাওয়া গেল খাবার দোকান। সবাই উপমহাদেশীয়। ফ্রাইড রাইস আর চিকেন ফ্রাই খাই। হোটেলে নানা লোকজন আসছে যাচ্ছে। টাইট টি সার্ট ও তার চেয়েও টাইট প্যান্ট পরে কয়েকজন আরবীয় মেয়ে ঘোরাফেরা করে। মুখে উৎকট সাজ। দোকানে এসে ড্রিংক কিনে খায়, দোকানদারের সাথে হাস্য মশকরা করে। আমার পাশে মলিন পোষাক পরা দুইজন নোয়াখালির ভাষায় কথা বলছে। দেশি পেয়ে আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে যাই। পাত্তা দেয় না। রাস্তায় আরেকটু হাটাহাটি করতে সন্ধ্যা হয়ে আসে। হোটেলের দিকে ফিরি, এয়ারপোর্টে যেতে হবে আমাস্টারডামের বিমান ধরতে। হোটেলের গেটের কাছাকাছি এসেছি অন্ধকারে খাওয়ার হোটলে দেখা মেয়েদের মত একজন তার ভাষায় কিছু একটা বলে। আমি স্যরি বুঝিনা বলে তাড়াতাড়ি হোটেলে ঢুকে যাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন