“অ্যামাজন ডট কম নামটা বেশ মজার, বোকা বোকাও বলতে পারেন। আপনার কি
মনে হয়?” শুধোলেন আমাদের গাইড। তাঁর অবিরাম বাক্যস্রোতে বেশ দিশাহারা বোধ
করছিলাম, আকস্মিক এহেন প্রশ্নে থতমত খেয়ে বললাম, “কই না তো, সেরকম কিছু মনে
হয় নি কখনো।” বলেই বুঝলাম এসব হল টোপ প্রশ্ন, কিন্তু ততক্ষণে ভদ্রলোক
বঁড়শিতে খপাত করে গেঁথে ফেলেছেন। বেশ আত্মপ্রসাদী একটা হাসি হেসে বললেন
“আপনার দোষ নেই, ওটার জন্য একটু ইতিহাস জানতে হবে।” শুনে একটু রাগ হল, যতই
হোক ইতিহাস একমাত্র বিষয় যে পরীক্ষার খাতায় জীবনে আমাকে নিরাশ করেনি (যদিও
সাল-তারিখ টারিখ বিশেষ মনে থাকে না, তাই ক্লাস টেনের টেস্টে প্রবালবাবু
লিখে দিয়েছিলেন “আই ওয়ন্ট হিস্ট্রি, নট লিটারেচার”)। তেতো মুখ করে বলতে হল,
“তাই নাকি? কিরকম?” বাকি সব শ্রোতার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন
“অ্যামাজন কথাটার মানে হল উইদাউট এ ব্রেস্ট, একটি স্তনবিহীন মহিলা। নিশ্চয়
ভাবছেন এরকম উদ্ভট মানে কেন?” বেঁচে থাকুক ভারতীয় ক্যুইজ ক্লাব, এবার আমার
আপারহ্যান্ড নেওয়ার পালা “ওহ, তাই বলুন! আরে এ তো সেই দুর্ধর্ষ মহিলা
যোদ্ধাজাত অ্যামাজনিয়ানদের নামে। যাঁরা তাঁদের তীরের নিশানা অভ্রান্ত করার
জন্য একটি স্তন কেটে ফেলতেন, যাতে ধনুকের ছিলা টানার সময় হাত বুকের ওপর
দিয়ে পিছলে চলে না যায়।” গাইড মোটেও প্রসন্ন হলেন না, “ও, জানেন তাহলে।
কিন্তু এটা কি জানেন যে অ্যামাজনিয়ানরা মোটেও অ্যামাজন নদীর ধারেকাছে
থাকতেন না, তাঁরা থাকতেন ব্ল্যাক সীর কাছে? আর তাঁদেরই গড়ে তোলা প্রথম
উপনিবেশ দেখতে চলেছেন আপনারা, এফেসাস। তাহলে সুদূর দক্ষিণ আমেরিকায় নামটা
গেল কি করে?” চিত্রালী পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল, “হল এবার শান্তি? মিছিমিছি
তুর্কীদের সঙ্গে টক্কর দিতে যাওয়া কেন বাপু?” বলতেই হল সে ব্যাপারে সম্যক
ধারণা নেই। “শুনুন তাহলে – অন্ধ কবি হোমার জন্মেছিলেন শহর ইজমিরে, যেখান
থেকে আপনারা রওনা দিলেন। এখন সেটা টার্কির মধ্যে হলেও বহু বহু বছর ধরে
গ্রীক সাম্রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ শহর বলে পরিগণিত হত। এখানেই লিখেছিলেন
(আক্ষরিক অর্থে অবশ্য হোমার লেখালেখির কাজটা করতে পারতেন না, অন্য কেউ সেটা
করেছিল নিশ্চয়) ইলিয়াড আর ওডিসি। আর এই ইলিয়াডেই হোমার উল্লেখ করেছিলেন
লেজেন্ডারি অ্যামাজনিয়ানদের, লিখেছিলেন সমুদ্রের কাছেই গভীর জঙ্গলে ঢাকা
পাহাড়ে কিভাবে তারা দিন গুজরান করতেন। স্প্যানিশ নাবিকরা যখন দক্ষিণ
আমেরিকা অভিযানে বেরোন, তখন জাহাজে সময় কাটানোর জন্য তাদের পড়তে দেওয়া
হয়েছিল হোমারের ইলিয়াড। অ্যামাজনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের মনে হয় আরে,
এরকম জায়গাতেই তো অ্যামাজনিয়ানরা থাকত। সদ্য পড়ে উঠেছে ইলিয়াড, অ্যামাজন
নদের নাম আর কিই বা রাখতে পারত তারা?”
মানতে হল জেফ বেজোস একটা ‘ ফ পা‘ করে ফেলছেন। কিন্তু তাতেই কি আর রেহাই মিলল? ভদ্রলোক মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললেন “আপনি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন বললেন না? বলুন তো পৃথিবীতে সবথেকে লাভজনক কাজ কোনটা?” আবারো পরাজয় স্বীকার করতে হল। গাড়ীর জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন “কি দেখছেন?” “কেন, অলিভ গাছ।” “এই অলিভ চাষীরা বছর কতদিন কাজ করে জানেন? স্রেফ এক থেকে দু’মাস। আর অলিভের পৃথিবীজোড়া চাহিদার কথা নিশ্চয় জানেন, তার সঙ্গে জেনে রাখুন টার্কি প্রথম তিনটে অলিভ উৎপাদনকারী দেশের অন্যতম। ফলে এই ক্ষেতখামারির মধ্যে হামেশাই বি-এম-ডব্লিউ, মার্সিডিজ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন।” আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরে সত্যিই দরকার নেই তাও না জিজ্ঞাসা করে পারলাম না ” আর বছরের বাকি দশ মাস কি করেন ওঁরা?” ভদ্রলোক ব্যাজার মুখ করে বললেন “আর বলবেন না। এরা সবাই বংশানুক্রমে সুফী, দশ মাস ধরে ভালো ভালো কবিতা পড়ে; সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার মশাই। কে শুনেছে দশ মাস ধরে কাজ না করে কবিতা পড়া হচ্ছে?” আমিও শুনিনি কোনদিন, কিন্তু যারপরনাই চমৎকৃত হলাম। অলিভ চাষীদের সৌভাগ্যের কথা ভাবতে ভাবতে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলাম, সেটা কাটল পাশের সুইস মহিলার “মা, মাগো” আর্তস্বর শুনে। চোখ খুলে দেখি এফেসাসে ঢোকার ঠিক আগে আমরা উপস্থিত হয়েছি পাহাড়ের ওপর ভার্জিন মেরীর মন্দিরে।

ক্যাথলিক জনশ্রুতি অনুযায়ী যীশু ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর ইওহান (সেন্ট জন) মেরীকে নিয়ে আসেন করেসস পাহাড়ে এবং পাহাড়ের ওপর এক পাথুরে ঘরে মেরী আমৃত্যু থেকে যান। বুঝতেই পারছেন ‘আমৃত্যু’ ক্যাথলিকদের কাছে উপযুক্ত শব্দ নয়, তাঁদের কাছে এর নাম ‘Assumption‘। মেরীর ঘর বলে কথা, অলৌকিক কাহিনী এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। ছোট্ট পাথুরে ঘরের অনেকটা জুড়ে এক প্রার্থনা গৃহ (আপনি ধর্মবিশ্বাসী হোন বা না হোন, যে কোনো চার্চে গেলেই যেরকম একটা প্রাণ জূড়নো শান্তি খুঁজে পান, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি), আর তার বাইরে বেশ যত্ন করে সাজিয়ে রাখা আছে অগুন্তি ক্রাচ। মেরীর আশীর্বাদে যেসব প্রতিবন্ধীদের আর ক্রাচের দরকার পড়েনি, তাঁরা সেগুলো এখানে দিয়ে গেছেন – শেষটি নাকি জমা পড়েছে এই ২০০৬-এ। এমত অবস্থায় “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু” বলে ঘুরে দেখে নেওয়াটাই স্বাভাবিক; যুক্তিবাদী মন যাই বলুক না কেন নিজের ইচ্ছেয় যখন ঘুরতে এসেছি তখন অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নগুলো ওখানে দাঁড়িয়ে তোলার সত্যিই কোনো অর্থ হয় না। বিশ্বাসের ব্যাপারটা আরোই জোরদার হয়ে দেখা দিল ‘উইশিং ওয়াল’ দেখে – কতশত মানুষ তাঁদের ইচ্ছাপূরণের জন্য চিলতে খানেক কাগজে কয়েক লাইন লিখে সেটা আটকে দিয়ে গেছেন এই দেওয়ালে। ছবি তুলতে গিয়ে খানিকটা আচম্বিতেই চোখে পড়ল কিছু আকুতি, প্রিয়জনের দুরারোগ্য ব্যাধিযন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন কেউ কেউ।

উইশিং ওয়ালটা সহযাত্রীদের সবাই দেখেছেন, ফলত মুডটা একটু গ্লুমি। সেটা আন্দাজ করেই গাইড ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন “মনে করুন খ্রিষ্টপূর্বাব্দ দশম শতকে আপনি গ্রীক শহর এফেসাসে বসবাস করছেন। আপনার অবস্থাপত্র ভালোই, আপনাকে সেবা করার জন্য একজন ভৃত্য রয়েছে। বেজায় ঠান্ডার দিন, আপনার চাকরকে দিয়ে কোন কাজটা প্রথমে করাবেন আপনি?” কেউ বললেন সুপ বানাতে বলবেন, কেউ চাইলেন জল গরম করতে; কলম্বিয়ান এক মহিলা বললেন “তখনকার দিনে ডু নট ডিস্টার্ব বোর্ড ছিল? তাহলে ওটাই বেডরুমের দরজায় লাগিয়ে দিতে বলব।” গাইড বললেন “করতে পারেন এসব, তবে আদি অকৃত্রিম গ্রীকদের চাকরদের থেকে একটি বিশেষ সার্ভিসের দরকার ছিল। মনে রাখা ভালো শীত হোক কি গ্রীষ্ম, গ্রীকরা মার্কেটপ্লেসে সময় কাটাতে বড্ড ভালোবাসতেন। তাই বাজারের লাগোয়া ছিল পাবলিক টয়লেট, সারি সারি সিট এবং পাশাপাশি। কিন্তু শীতকালে মারবল পাথর পশ্চাৎদেশে ভালোই ছ্যাঁকা দেয়। সুতরাং, কি করণীয়?” হতভম্ব মুখগুলো দেখে নিজেই উত্তর দিলেন “চাকরদের আদেশ দেওয়া হত মনিবরা যাওয়ার আগে সিটে বসে সিট গরম করে দিতে হবে।” সারা গাড়ী জুড়ে রাম-রাম আর তওবা-তওবা। তারই মধ্যে আরো জানা গেল শৌখিন গ্রীকদের জন্য সেখানে মজুত থাকতেন মিউজিসিয়ানরা, উল্টোদিকে মুখ করে তারা বাজিয়ে চলতেন সুরেলা সব গত। ভেতরে থাকত লম্বা লম্বা থাম, আর থামের ওপরে থাকত লতিয়ে ওঠা সুগন্ধী সব ফুল। প্রাতঃকৃত্যতেও যে বেশ কিছু ইন্দ্রিয়ের আরাম দরকার সেটা বলাই বাহুল্য, এবং গ্রীকরা বেশ বুঝেছিলেন সে কথা!
গ্রীকদের আদিখ্যেতা নিয়ে সাতকাহনের মধ্যেই পৌঁছে গেছি এফেসাস। যত সহজে লিখে ফেললাম ব্যাপারটা, তত সহজেও কিন্তু হৃদয়ঙ্গম হয়নি এফেসাসেস সামনে দাঁড়িয়ে, সত্যি পৌঁছলাম? সত্যিই দেখছি? সুমেরিয়ান, লিডিয়ান, পারসিয়ান, ভূকম্প সব সহ্য করে প্রায় তেরশ বছর ধরে ইতিহাসে ইতিহাসে সমৃদ্ধ হয়েছে এই শহর, শেষমেশ ২৬২ খ্রীষ্টাব্দে গথদের আক্রমণে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। বাইজান্টাইন এবং অটোমান রাজত্বের সময়েও এ শহরকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্ট হয়েছে কিন্তু আলেকজান্ডারের সোনার এফেসাসকে আর ফিরে পাওয়া যায়নি। পনেরশ শতক থেকে সেইসব প্রচেষ্টাও থেমে যায়। প্রত্নতাত্বিকরা নতুন করে একে খুঁজে পান আঠারশ শতকের শেষে। কাজ এখনো চলছে, পুরো এফেসাসেস দশ শতাংশ-ও ট্যুরিস্টদের আওতার বাইরে। এফেসাসেস রুক্ষ চালচিত্র দূর থেকে দেখেই মনে হল রাস্তার শুরুতেই একাকী গাছটার নিচে একটিবারের জন্য দাঁড়িয়ে নি। জানা গেল গাছটা মালবেরি, অনাদিকাল ধরে স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে রেশমের গুটি চাষ উপলক্ষ্যে। আমার অবশ্য শুধুই মনে পড়ল মণীন্দ্র গুপ্তের অবিস্মরণীয় স্মৃতিকথা ‘অক্ষয় মালবেরি’। পাঠক, যদি বাংলা ভাষা আপনি ভালোবাসেন এ বই আপনাকে পড়তেই হবে। মণীন্দ্র গুপ্ত কবি, তিনি এ বইয়ে গদ্য লিখলেও আদতে বুনেছেন কবিতার জাল, এঁকেছেন হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার মিঠে ছবি। কিন্তু অক্ষয় মালবেরি নিয়ে বিশদে যেতে পারলাম না এখন, কারণ মালবেরির নিচে দাঁড়াতেই চোখে পড়েছে গ্রীক অগোরা – কয়েকশ বছর ধরে ধার্মিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যা-সুরাহায় গ্রীকরা মিলিত হতেন এখানে।

সেই গ্রীক অগোরা – ডেমোক্র্যাসির আঁতুড়ঘর।
পাথরে খোদাই চক্র দেখেই গাইডের মুখ বেশ গম্ভীর হয়ে গেল। বারকতক বিড়বিড় করে কিসব বললেন, হাবেভাবে বুঝলাম ‘অকালকুষ্মান্ড’ ধরণের কিছু বলছেন, কাকে বলছেন সেটাই এখন প্রশ্ন। ভদ্রলোক আরকিওলজিতে দস্তুরমতন পি-এইচ-ডি করেছেন, তার পরেও পেটের দায়ে ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্টে একটা ডিগ্রী নিতে হয়েছে। সেই কারণেই কিনা কে জানে, সামান্য রগচটা আছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “বুঝলেন তো, গ্রীকরা আমার কাছে ধাঁধা বিশেষ।” স্টেটমেন্টটা নিজেই আমার কাছে একটা ধাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল কিন্তু ততক্ষণে দেখি ক্যাথলিক সহযাত্রীরা ভারী চঞ্চল হয়ে পড়েছেন। বাক্যবাগীশ গাইডের সামনে এতক্ষণ মুখ খোলার কেউ সাহস দেখান নি, এখন হঠাৎ চতুর্দিক থেকে জার্মান, স্প্যানিশে প্রচুর কিচিরমিচির। নেটিভ ইংলিশ স্পীকার কেউই নন, তবুও ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংলিশ থেকে বুঝলাম ক্রসের আগে খৃষ্টধর্মের প্রতীক ছিল মাছ; পাথরের ওপর মাছ দেখতে পেয়ে সবাই ভারী আহ্লাদিত। তার মধ্যেই গাইড বজ্রনিনাদে হাঁক ছাড়লেন “খামোশ”; সবাই তাকাতে প্রায় দাঁত খিঁচিয়ে বললেন “অত্ত মাছ মাছ করে লাফাবেন না, গ্রীক জেলেগুলোর ফাঁদা জালে পা দিলেই সর্বনাশ ।” “ভালো করে দেখুন, চক্রের মধ্যে পাঁচ খানা গ্রীক অক্ষর খুঁজে পাবেন - আয়োটা, কাই, থীটা, উপ্সাইলন আর সিগমা। প্রশ্নটা হচ্ছে হঠাৎ এই পাঁচটা অক্ষরকে নিয়ে কেন মাথা ঘামাব? কারণ, এগুলো একসঙ্গে একটা অ্যাক্রোনিম বিশেষ, পুরো কথাটা হল “Iesous Xristos Theou Yios Sotare” যার মানে ঈশ্বরের পুত্র যীশু খৃষ্ট রক্ষাকর্তা। এদিকে ΙΧΘΥΣ নিজে একটা শব্দ-ও বটে, ইকথাস – যার মানে মাছ। ব্যাস, বোকা গ্রীকগুলো যীশুর প্রশস্তিকে ভেবে নিল মাছের মেটাফর, সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে।” সব্বাই গপ্পো শুনে মুগ্ধ, দলে ইস্ট এশিয়ান কেউ না থাকলেও ভারী হুড়োহুড়ি পড়ে গেল গাইডের সঙ্গে ছবি তোলার। তিনি অবশ্য এসব বালখিল্যতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে পা বাড়িয়েছেন বুলুটেরিয়নের দিকে – যেখানে বসত এফেসাস কাউন্সিলের মীটিং, গানবাজনার আসর এবং সময় সময় নানা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই সেখানে মাথা উঁচিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তিন পিলার – গ্রীক, রোমান এবং বাইজ্যান্টাইন সাম্রাজ্যের তিন প্রতিভূ।

এর মধ্যেই দেখি সামনে এক খোদাই করা নারীমূর্তি , ঠিক যেন টেক-অফের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আর কয়েক সেকন্ডের মধ্যেই উড়ে যাবেন। নিশ্চয় ভাবছেন যে ইনি কোনো গ্রীক দেবী? ঠিকই ধরেছেন তবে নামটা শুনলে একটু চমকাতে পারেন। এনার নাম নাইকি! হ্যাঁ, এনার নামেই সেই বিখ্যাত জুতোর ব্র্যান্ড, যাকে ড্যান ওয়েইডেন (এবং অফ কোর্স মাইকেল জর্ডন) বিশ্ব জুড়ে চিনিয়েছেন ‘জাস্ট ডু ইট’ বলে। নাইকি কিন্তু শুরু হয়েছিল ‘ব্লু রিবন স্পোর্টস’ নাম দিয়ে; সত্তর সালে এক জুতসই ব্র্যান্ডনেম খুঁজতে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, কোনো প্রত্নতত্ত্বের ছাত্রের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে এবং জয়ের দেবী নাইকির নামে রাখা হয় ব্র্যান্ডের নাম। নাইকি হাঁটেন না, উড়েও বেড়ান না; জিরো গ্র্যাভিটিতে লাফিয়ে চললে যেরকম দাঁড়াবে, খানিকটা সেই ভঙ্গীতে মাটি ছুঁয়েই আবার সুপারম্যানের মতন শাঁ করে বেরিয়ে যান। মারভেল কি ডিসি কমিকস যদি একটা গপ্পো খাড়া করতে পারে, হলিউডের নজর এদিকে পড়তে বেশী দেরি হবে না। অ্যাডেড অ্যাডভান্টেজ, নাইকি প্রডিউসার-ও হয়ে যেতে পারে!

এর পরেই অবশ্য যাঁকে দেখলাম, তিনি বহুপরিচিত হলেও আরাধ্য দেবী হয়ে কোনোকালে বিরাজ করতেন একথা কস্মিনকালেও মনে হয়নি। আরাধনা বলতে চিরাচরিত অর্থে যা বুঝি তা না হলেও, যদি দেখেন যে সম্রাট হেড্রিয়ানের সম্মানে তৈরী মন্দিরের মূল তোরণে নানারকম ফুল এবং অ্যাকান্থাস লতার মধ্যে এনার মুখটি ফুটে আছে তবে আপনিও নিয্যস চমকাবেন। দূর থেকে হয়তো বুঝতেও পারবেন না, তারপর ক্যামেরার লেন্সে ফোকাস রেখে জুম করতে গিয়ে চমকে উঠবেন – আরে, চুলগুলো কিরকম যেন কিলবিলিয়ে নেমেছে! এনার চুল অবশ্য সর্বদা কিলবিলিয়ে নামত না, রেগে গেলে তবেই মাত্র।

মেডুসার রাগী মুখ তন্ময় হয়ে দেখতে গিয়ে ইঁটের পাঁজার ওপর একটু বেশীই ভর দিয়ে ফেলেছিলাম বোধহয়, বিজাতীয় ভাষায় প্রতিবাদ শুনে মাথা ঘুরিয়েই চক্ষুস্থির! তুর্কীর সর্বত্রবিরাজমান বেড়ালদের গল্প এই ব্লগেই আগে করেছি, কিন্তু তা বলে তাঁদের ঐতিহাসিক শহর এফেসাসেও খুঁজে পাব এতটা ভেবে উঠতে পারিনি। এলই বা কোত্থেকে, কিই বা খায় সে সব প্রশ্ন অবশ্যই মাথায় এল কিন্তু সবার আগে যেটা চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে তাদের রাজকীয় মেজাজ, এফেসাসেস সার্বিক ভাবগম্ভীর পরিবেশে দিব্যি খাপ পেয়ে গেছে।

বেড়ালদের ছবি তুলতে গিয়ে একটু দেরি হচ্ছিল বোধহয়, গাইড দৌড়ে এলেন “চলুন চলুন, আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে ওদিকে।” ভারী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম “কারা?” কারণ গাইডের আঙ্গুল যে দিকে দেখাচ্ছে, আমার সহযাত্রীরা তার ঠিক উল্টোদিকে রীতিমতন পোজ দিয়ে ছবি তুলছেন। গাইড হাসলেন, ভারী রহস্যময় হাসি “সেই তারা, যারা প্রত্যেকে আপনার জন্য হৃদয়ে ঠিক এক চিলতে জায়গা রেখে দিয়েছে। শুধু ওয়ালেটটা আনতে ভুলবেন না।”
এসেছি ঘুমিয়ে পড়া গ্রীক ভিলেজ আলতেনকমে, বহু প্রাচীন অ্যাপোলো মন্দিরের কাছেই। পশ্চিম তুরস্কের এক প্রান্তে, গ্রীস-তুরস্কের সীমানার কাছেই এই গ্রাম। ইংরেজী কায়দায় হয়ত লোকে বলবে ‘টাউন’ কিন্তু সেকথা ধরবেন না। লোকে এখানে আসে সমুদ্র দেখতে, টারকোয়েজ রঙ্গীন জল আর সোনালী হলুদ বালির জন্য। দুপুরের খামোখা খেয়ালে মনে হল গ্রামটা ঘুরে দেখি। একজন পর্যটককেও চোখে পড়ল না, কিন্তু ভারী অবাক হয়ে দেখলাম সারা রাস্তা জুড়ে স্থানীয় লোকজনদেরও দেখা যাচ্ছে না। সমুদ্রের দিকটা কয়েকটা ছোট্ট জেলে-বোট জেটিতে আটকে থেকে অলস হাওয়ায় দুলছে। একটার মাস্তুলে দুখানা সী-গাল চুপটি করে বসে শুধু জল দেখছে, ভাবটা খানিক টুরিস্ট সুলভ-ই। দোষ দেওয়া যায় না, ভারী মিঠে একটা রোদের সঙ্গে সমুদ্রের হাওয়ার এমন মজলিশি যুগলবন্দী তৈরী হয়েছে, মনে হবে এই শেষ স্টপ, সব ভুলে থেকে যাই। তবে দু’পেয়েদের কথা আলাদা, তারা একটু এবড়োখেবড়ো বীচের ওপরেই পিচ ঢালা মসৃণ রাস্তা ধরে হাঁটতেই থাকবে, হাঁটতেই থাকবে। আর কখনো সমুদ্রের দিক থেকে চোখ সরিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে গ্রীক ভিলাগুলোর দিকে তাকালে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠতে পারে, কাশফুল। তখন হয়ত কিছুক্ষণের জন্য মনটা একটু আকুলিবিকুলি করতে পারে, চার’হাজার মাইল দূরের কোনো জনাকীর্ণ শহরে একবারের জন্য হলেও ছুটে যেতে, বারো বছর ধরে সে শহরে যাওয়া হয়নি এ মরশুমে।

আর তক্ষুনি চোখ পড়বে কাগজফুল হয়ে ফুটে থাকা গল্পদের ওপর আর চিনচিনে ব্যথাটাও কোথায় হারিয়ে যাবে। বুগেনভিলিয়া এ শহরের প্রিয় ফুল, প্রত্যেকটা ভিলার সামনে-পিছনে কোথাও না কোথাও ঈষৎ গোলাপি আভা নিয়ে তারা ঝেঁপে এসেছে। পাঁচিল মানেই তো একটা অধিকারের প্রতীক, একটু দূরত্ব গড়ে দেওয়ার অদম্য চেষ্টা, একটা বিভাজন দাখিল করার অবিনম্র প্রয়াস। এই মানুষী ট্রেটগুলোকে ভুলিয়ে দিতে, বিত্তজনিত মালিকানাকে ক্যামোফ্লাজ করতে আপনার বেস্ট বেট ওই বুগেনভিলিয়া। বিশ্বাস করুন, সত্যি কাজ দেয়। তাই যে দু’পেয়ে সবজে নীল জলের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল আদেখলের মতন, সেও গুটি গুটি পায়ে রাস্তা ক্রস করে চলল তার গল্পদের কাছে। এক গল্প নিয়ে যায় আরেক গল্পের কাছে; এক গল্প দূরে দেখায় স্তব্ধ দুপুরে ইস্তানবুল থেকে ছুটি কাটাতে আসা দুই কিশোরী তাদের সামার রিসর্টের সামনে দোলনা বানিয়ে দুলছে। কিশোরী সুলভ বেণী মোটেই নেই, কিন্তু তাদের থেকে থেকে অযথা হাসি চিরকালীন। ক্ষণিকের আগন্তুককে দেখে তারা থমকায়, তারপর মোটেই পাত্তা না দিয়ে শুরু হয় কথা চালাচালি, কত্ত কত্ত কথা – সব রাখা ছিল ছুটির দিনের এই নিশ্চুপ দুপুরের জন্য। আরেক গল্প ভালোবাসে একটু সাসপেন্স তৈরী করতে, পাতা ঝরঝরিয়ে বলল বাড়ির পেছনের চড়াই-উতরাই এর দিকে যেতে, ব্যাস শুধু ওইটুকুই। হাঁটতে হাঁটতে এল এক ঝুরঝুরে বাড়ী, তার ঘুলঘুলি দেখলেই বোঝা যায় এ গ্রামের প্রাচীনতমদের মধ্যে পড়ে সে, হাল ফ্যাশনের লাল টালিওলা ভিলারাও জানে তার কথা। উঠোনের দু’দিকে তার দুই দেওয়াল, একটা জালি জালি ফ্রেম আটকে রয়েছে দুই দেওয়ালের মধ্যে। আর তাতে লতিয়ে লতিয়ে উঠেছে আঙ্গুর গাছ, থোকা থোকা কালো আঙুর। কৌতূহলী চোখ দেখে প্রাচীন বাড়ীর প্রাচীনা মালকিন বেরিয়ে এসেছিলেন। চুপ দুপুরের মায়াবী রূপকথা সত্যি করে তিনি সেই দেশী ঠাকুমা, সেই অজস্র বলিরেখা, সেই ফোকলা হাসি, আর সেই প্রশ্রয়দাত্রী চাউনি। আমি চিনি সেই চাউনি, গলা ব্যথা ব্যথা হওয়ার আগেই তাই ঢালু রাস্তা দিয়ে নেমে গেলাম। রাস্তা দিয়ে নামতে নামতে শুনি আবার কিসের ফিসফাস, ঝেঁপে ওঠা কাগজফুলদের গল্প ফুরনোর নয় । চোখে পড়ল বাতাসবাড়ির গম্বুজ।

সেই নাম না জানা কোন কালে তৈরী হয়েছিল এ গম্বুজ, মান্ধাতার আমলের স্পিনিং হুইলে বয়ে যেত মৃদুমন্দ হাওয়া। এখন আর কোন কাজে লাগে তাকে? শুধোলাম, কোনো উত্তর এল না। পাতা ঝরার বেলায় মনে হল কাগজফুলদের গল্প বলা শেষ হয়েছে। একটু বিসদৃশ ঠেকল, কিন্তু কি আর করা। বাতাসবাড়ির গম্বুজকিনারে এসে বুঝলাম ভুল হয়েছে, দোষ আমার। বাতাসবাড়ির সত্যিই কোনো কাজ নেই, এখন-ও নেই, তখন-ও ছিল না। কিন্তু সব স্থাপত্য কি কাজ মাপার জন্য হয়? পাহাড়চূড়ায় লম্বা লম্বা গাছেদের মধ্যে বাতাসবাড়ি রয়ে গেছে শুধু রোমান্সের জন্য। কবি, ভাবুক, ক্ষণিকের অতিথিদের মনগড়া রোমান্স নয়, এ আক্ষরিক, খাঁটি রোমান্স। তরুণীর একঢাল পিঠখোলা চুল রেড ফ্ল্যাগ তুলে রেখেছে, তাই জন্যই তার পিঠ আমার দিকে; তার সঙ্গী কি করছে সে কথা আমার জানার নয়, কারোরই জানার নয় – এ দুপুরটা শুধুই তাদের। ঘুমিয়ে থাকা আলতেনকমে তারা পড়ে পাওয়া সুযোগ নেয় না, তাদের গন্তব্য অন্যত্র।
কাগজফুলের শহর অপেক্ষা করে আছে এখনো, চলে যান। অন্তত একটা দুপুরের জন্য হলেও, তাড়াতাড়িই – কে জানে কখন কর্মব্যস্ত পৃথিবীর খেয়ালে আরেকটা গ্লোবালাইজড টুরিস্ট স্পটের আইডিয়া ভেসে আসে টারকোয়েজ জল ধরে সোনালী বালির তীরে।
মানতে হল জেফ বেজোস একটা ‘ ফ পা‘ করে ফেলছেন। কিন্তু তাতেই কি আর রেহাই মিলল? ভদ্রলোক মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললেন “আপনি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন বললেন না? বলুন তো পৃথিবীতে সবথেকে লাভজনক কাজ কোনটা?” আবারো পরাজয় স্বীকার করতে হল। গাড়ীর জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন “কি দেখছেন?” “কেন, অলিভ গাছ।” “এই অলিভ চাষীরা বছর কতদিন কাজ করে জানেন? স্রেফ এক থেকে দু’মাস। আর অলিভের পৃথিবীজোড়া চাহিদার কথা নিশ্চয় জানেন, তার সঙ্গে জেনে রাখুন টার্কি প্রথম তিনটে অলিভ উৎপাদনকারী দেশের অন্যতম। ফলে এই ক্ষেতখামারির মধ্যে হামেশাই বি-এম-ডব্লিউ, মার্সিডিজ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন।” আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরে সত্যিই দরকার নেই তাও না জিজ্ঞাসা করে পারলাম না ” আর বছরের বাকি দশ মাস কি করেন ওঁরা?” ভদ্রলোক ব্যাজার মুখ করে বললেন “আর বলবেন না। এরা সবাই বংশানুক্রমে সুফী, দশ মাস ধরে ভালো ভালো কবিতা পড়ে; সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার মশাই। কে শুনেছে দশ মাস ধরে কাজ না করে কবিতা পড়া হচ্ছে?” আমিও শুনিনি কোনদিন, কিন্তু যারপরনাই চমৎকৃত হলাম। অলিভ চাষীদের সৌভাগ্যের কথা ভাবতে ভাবতে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলাম, সেটা কাটল পাশের সুইস মহিলার “মা, মাগো” আর্তস্বর শুনে। চোখ খুলে দেখি এফেসাসে ঢোকার ঠিক আগে আমরা উপস্থিত হয়েছি পাহাড়ের ওপর ভার্জিন মেরীর মন্দিরে।

ক্যাথলিক জনশ্রুতি অনুযায়ী যীশু ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর ইওহান (সেন্ট জন) মেরীকে নিয়ে আসেন করেসস পাহাড়ে এবং পাহাড়ের ওপর এক পাথুরে ঘরে মেরী আমৃত্যু থেকে যান। বুঝতেই পারছেন ‘আমৃত্যু’ ক্যাথলিকদের কাছে উপযুক্ত শব্দ নয়, তাঁদের কাছে এর নাম ‘Assumption‘। মেরীর ঘর বলে কথা, অলৌকিক কাহিনী এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। ছোট্ট পাথুরে ঘরের অনেকটা জুড়ে এক প্রার্থনা গৃহ (আপনি ধর্মবিশ্বাসী হোন বা না হোন, যে কোনো চার্চে গেলেই যেরকম একটা প্রাণ জূড়নো শান্তি খুঁজে পান, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি), আর তার বাইরে বেশ যত্ন করে সাজিয়ে রাখা আছে অগুন্তি ক্রাচ। মেরীর আশীর্বাদে যেসব প্রতিবন্ধীদের আর ক্রাচের দরকার পড়েনি, তাঁরা সেগুলো এখানে দিয়ে গেছেন – শেষটি নাকি জমা পড়েছে এই ২০০৬-এ। এমত অবস্থায় “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু” বলে ঘুরে দেখে নেওয়াটাই স্বাভাবিক; যুক্তিবাদী মন যাই বলুক না কেন নিজের ইচ্ছেয় যখন ঘুরতে এসেছি তখন অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নগুলো ওখানে দাঁড়িয়ে তোলার সত্যিই কোনো অর্থ হয় না। বিশ্বাসের ব্যাপারটা আরোই জোরদার হয়ে দেখা দিল ‘উইশিং ওয়াল’ দেখে – কতশত মানুষ তাঁদের ইচ্ছাপূরণের জন্য চিলতে খানেক কাগজে কয়েক লাইন লিখে সেটা আটকে দিয়ে গেছেন এই দেওয়ালে। ছবি তুলতে গিয়ে খানিকটা আচম্বিতেই চোখে পড়ল কিছু আকুতি, প্রিয়জনের দুরারোগ্য ব্যাধিযন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন কেউ কেউ।

উইশিং ওয়ালটা সহযাত্রীদের সবাই দেখেছেন, ফলত মুডটা একটু গ্লুমি। সেটা আন্দাজ করেই গাইড ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন “মনে করুন খ্রিষ্টপূর্বাব্দ দশম শতকে আপনি গ্রীক শহর এফেসাসে বসবাস করছেন। আপনার অবস্থাপত্র ভালোই, আপনাকে সেবা করার জন্য একজন ভৃত্য রয়েছে। বেজায় ঠান্ডার দিন, আপনার চাকরকে দিয়ে কোন কাজটা প্রথমে করাবেন আপনি?” কেউ বললেন সুপ বানাতে বলবেন, কেউ চাইলেন জল গরম করতে; কলম্বিয়ান এক মহিলা বললেন “তখনকার দিনে ডু নট ডিস্টার্ব বোর্ড ছিল? তাহলে ওটাই বেডরুমের দরজায় লাগিয়ে দিতে বলব।” গাইড বললেন “করতে পারেন এসব, তবে আদি অকৃত্রিম গ্রীকদের চাকরদের থেকে একটি বিশেষ সার্ভিসের দরকার ছিল। মনে রাখা ভালো শীত হোক কি গ্রীষ্ম, গ্রীকরা মার্কেটপ্লেসে সময় কাটাতে বড্ড ভালোবাসতেন। তাই বাজারের লাগোয়া ছিল পাবলিক টয়লেট, সারি সারি সিট এবং পাশাপাশি। কিন্তু শীতকালে মারবল পাথর পশ্চাৎদেশে ভালোই ছ্যাঁকা দেয়। সুতরাং, কি করণীয়?” হতভম্ব মুখগুলো দেখে নিজেই উত্তর দিলেন “চাকরদের আদেশ দেওয়া হত মনিবরা যাওয়ার আগে সিটে বসে সিট গরম করে দিতে হবে।” সারা গাড়ী জুড়ে রাম-রাম আর তওবা-তওবা। তারই মধ্যে আরো জানা গেল শৌখিন গ্রীকদের জন্য সেখানে মজুত থাকতেন মিউজিসিয়ানরা, উল্টোদিকে মুখ করে তারা বাজিয়ে চলতেন সুরেলা সব গত। ভেতরে থাকত লম্বা লম্বা থাম, আর থামের ওপরে থাকত লতিয়ে ওঠা সুগন্ধী সব ফুল। প্রাতঃকৃত্যতেও যে বেশ কিছু ইন্দ্রিয়ের আরাম দরকার সেটা বলাই বাহুল্য, এবং গ্রীকরা বেশ বুঝেছিলেন সে কথা!
গ্রীকদের আদিখ্যেতা নিয়ে সাতকাহনের মধ্যেই পৌঁছে গেছি এফেসাস। যত সহজে লিখে ফেললাম ব্যাপারটা, তত সহজেও কিন্তু হৃদয়ঙ্গম হয়নি এফেসাসেস সামনে দাঁড়িয়ে, সত্যি পৌঁছলাম? সত্যিই দেখছি? সুমেরিয়ান, লিডিয়ান, পারসিয়ান, ভূকম্প সব সহ্য করে প্রায় তেরশ বছর ধরে ইতিহাসে ইতিহাসে সমৃদ্ধ হয়েছে এই শহর, শেষমেশ ২৬২ খ্রীষ্টাব্দে গথদের আক্রমণে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। বাইজান্টাইন এবং অটোমান রাজত্বের সময়েও এ শহরকে নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্ট হয়েছে কিন্তু আলেকজান্ডারের সোনার এফেসাসকে আর ফিরে পাওয়া যায়নি। পনেরশ শতক থেকে সেইসব প্রচেষ্টাও থেমে যায়। প্রত্নতাত্বিকরা নতুন করে একে খুঁজে পান আঠারশ শতকের শেষে। কাজ এখনো চলছে, পুরো এফেসাসেস দশ শতাংশ-ও ট্যুরিস্টদের আওতার বাইরে। এফেসাসেস রুক্ষ চালচিত্র দূর থেকে দেখেই মনে হল রাস্তার শুরুতেই একাকী গাছটার নিচে একটিবারের জন্য দাঁড়িয়ে নি। জানা গেল গাছটা মালবেরি, অনাদিকাল ধরে স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে রেশমের গুটি চাষ উপলক্ষ্যে। আমার অবশ্য শুধুই মনে পড়ল মণীন্দ্র গুপ্তের অবিস্মরণীয় স্মৃতিকথা ‘অক্ষয় মালবেরি’। পাঠক, যদি বাংলা ভাষা আপনি ভালোবাসেন এ বই আপনাকে পড়তেই হবে। মণীন্দ্র গুপ্ত কবি, তিনি এ বইয়ে গদ্য লিখলেও আদতে বুনেছেন কবিতার জাল, এঁকেছেন হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার মিঠে ছবি। কিন্তু অক্ষয় মালবেরি নিয়ে বিশদে যেতে পারলাম না এখন, কারণ মালবেরির নিচে দাঁড়াতেই চোখে পড়েছে গ্রীক অগোরা – কয়েকশ বছর ধরে ধার্মিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যা-সুরাহায় গ্রীকরা মিলিত হতেন এখানে।

সেই গ্রীক অগোরা – ডেমোক্র্যাসির আঁতুড়ঘর।
পাথরে খোদাই চক্র দেখেই গাইডের মুখ বেশ গম্ভীর হয়ে গেল। বারকতক বিড়বিড় করে কিসব বললেন, হাবেভাবে বুঝলাম ‘অকালকুষ্মান্ড’ ধরণের কিছু বলছেন, কাকে বলছেন সেটাই এখন প্রশ্ন। ভদ্রলোক আরকিওলজিতে দস্তুরমতন পি-এইচ-ডি করেছেন, তার পরেও পেটের দায়ে ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্টে একটা ডিগ্রী নিতে হয়েছে। সেই কারণেই কিনা কে জানে, সামান্য রগচটা আছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “বুঝলেন তো, গ্রীকরা আমার কাছে ধাঁধা বিশেষ।” স্টেটমেন্টটা নিজেই আমার কাছে একটা ধাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল কিন্তু ততক্ষণে দেখি ক্যাথলিক সহযাত্রীরা ভারী চঞ্চল হয়ে পড়েছেন। বাক্যবাগীশ গাইডের সামনে এতক্ষণ মুখ খোলার কেউ সাহস দেখান নি, এখন হঠাৎ চতুর্দিক থেকে জার্মান, স্প্যানিশে প্রচুর কিচিরমিচির। নেটিভ ইংলিশ স্পীকার কেউই নন, তবুও ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংলিশ থেকে বুঝলাম ক্রসের আগে খৃষ্টধর্মের প্রতীক ছিল মাছ; পাথরের ওপর মাছ দেখতে পেয়ে সবাই ভারী আহ্লাদিত। তার মধ্যেই গাইড বজ্রনিনাদে হাঁক ছাড়লেন “খামোশ”; সবাই তাকাতে প্রায় দাঁত খিঁচিয়ে বললেন “অত্ত মাছ মাছ করে লাফাবেন না, গ্রীক জেলেগুলোর ফাঁদা জালে পা দিলেই সর্বনাশ ।” “ভালো করে দেখুন, চক্রের মধ্যে পাঁচ খানা গ্রীক অক্ষর খুঁজে পাবেন - আয়োটা, কাই, থীটা, উপ্সাইলন আর সিগমা। প্রশ্নটা হচ্ছে হঠাৎ এই পাঁচটা অক্ষরকে নিয়ে কেন মাথা ঘামাব? কারণ, এগুলো একসঙ্গে একটা অ্যাক্রোনিম বিশেষ, পুরো কথাটা হল “Iesous Xristos Theou Yios Sotare” যার মানে ঈশ্বরের পুত্র যীশু খৃষ্ট রক্ষাকর্তা। এদিকে ΙΧΘΥΣ নিজে একটা শব্দ-ও বটে, ইকথাস – যার মানে মাছ। ব্যাস, বোকা গ্রীকগুলো যীশুর প্রশস্তিকে ভেবে নিল মাছের মেটাফর, সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে।” সব্বাই গপ্পো শুনে মুগ্ধ, দলে ইস্ট এশিয়ান কেউ না থাকলেও ভারী হুড়োহুড়ি পড়ে গেল গাইডের সঙ্গে ছবি তোলার। তিনি অবশ্য এসব বালখিল্যতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে পা বাড়িয়েছেন বুলুটেরিয়নের দিকে – যেখানে বসত এফেসাস কাউন্সিলের মীটিং, গানবাজনার আসর এবং সময় সময় নানা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই সেখানে মাথা উঁচিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তিন পিলার – গ্রীক, রোমান এবং বাইজ্যান্টাইন সাম্রাজ্যের তিন প্রতিভূ।

এর মধ্যেই দেখি সামনে এক খোদাই করা নারীমূর্তি , ঠিক যেন টেক-অফের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আর কয়েক সেকন্ডের মধ্যেই উড়ে যাবেন। নিশ্চয় ভাবছেন যে ইনি কোনো গ্রীক দেবী? ঠিকই ধরেছেন তবে নামটা শুনলে একটু চমকাতে পারেন। এনার নাম নাইকি! হ্যাঁ, এনার নামেই সেই বিখ্যাত জুতোর ব্র্যান্ড, যাকে ড্যান ওয়েইডেন (এবং অফ কোর্স মাইকেল জর্ডন) বিশ্ব জুড়ে চিনিয়েছেন ‘জাস্ট ডু ইট’ বলে। নাইকি কিন্তু শুরু হয়েছিল ‘ব্লু রিবন স্পোর্টস’ নাম দিয়ে; সত্তর সালে এক জুতসই ব্র্যান্ডনেম খুঁজতে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, কোনো প্রত্নতত্ত্বের ছাত্রের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে এবং জয়ের দেবী নাইকির নামে রাখা হয় ব্র্যান্ডের নাম। নাইকি হাঁটেন না, উড়েও বেড়ান না; জিরো গ্র্যাভিটিতে লাফিয়ে চললে যেরকম দাঁড়াবে, খানিকটা সেই ভঙ্গীতে মাটি ছুঁয়েই আবার সুপারম্যানের মতন শাঁ করে বেরিয়ে যান। মারভেল কি ডিসি কমিকস যদি একটা গপ্পো খাড়া করতে পারে, হলিউডের নজর এদিকে পড়তে বেশী দেরি হবে না। অ্যাডেড অ্যাডভান্টেজ, নাইকি প্রডিউসার-ও হয়ে যেতে পারে!

এর পরেই অবশ্য যাঁকে দেখলাম, তিনি বহুপরিচিত হলেও আরাধ্য দেবী হয়ে কোনোকালে বিরাজ করতেন একথা কস্মিনকালেও মনে হয়নি। আরাধনা বলতে চিরাচরিত অর্থে যা বুঝি তা না হলেও, যদি দেখেন যে সম্রাট হেড্রিয়ানের সম্মানে তৈরী মন্দিরের মূল তোরণে নানারকম ফুল এবং অ্যাকান্থাস লতার মধ্যে এনার মুখটি ফুটে আছে তবে আপনিও নিয্যস চমকাবেন। দূর থেকে হয়তো বুঝতেও পারবেন না, তারপর ক্যামেরার লেন্সে ফোকাস রেখে জুম করতে গিয়ে চমকে উঠবেন – আরে, চুলগুলো কিরকম যেন কিলবিলিয়ে নেমেছে! এনার চুল অবশ্য সর্বদা কিলবিলিয়ে নামত না, রেগে গেলে তবেই মাত্র।

মেডুসার রাগী মুখ তন্ময় হয়ে দেখতে গিয়ে ইঁটের পাঁজার ওপর একটু বেশীই ভর দিয়ে ফেলেছিলাম বোধহয়, বিজাতীয় ভাষায় প্রতিবাদ শুনে মাথা ঘুরিয়েই চক্ষুস্থির! তুর্কীর সর্বত্রবিরাজমান বেড়ালদের গল্প এই ব্লগেই আগে করেছি, কিন্তু তা বলে তাঁদের ঐতিহাসিক শহর এফেসাসেও খুঁজে পাব এতটা ভেবে উঠতে পারিনি। এলই বা কোত্থেকে, কিই বা খায় সে সব প্রশ্ন অবশ্যই মাথায় এল কিন্তু সবার আগে যেটা চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে তাদের রাজকীয় মেজাজ, এফেসাসেস সার্বিক ভাবগম্ভীর পরিবেশে দিব্যি খাপ পেয়ে গেছে।

বেড়ালদের ছবি তুলতে গিয়ে একটু দেরি হচ্ছিল বোধহয়, গাইড দৌড়ে এলেন “চলুন চলুন, আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে ওদিকে।” ভারী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম “কারা?” কারণ গাইডের আঙ্গুল যে দিকে দেখাচ্ছে, আমার সহযাত্রীরা তার ঠিক উল্টোদিকে রীতিমতন পোজ দিয়ে ছবি তুলছেন। গাইড হাসলেন, ভারী রহস্যময় হাসি “সেই তারা, যারা প্রত্যেকে আপনার জন্য হৃদয়ে ঠিক এক চিলতে জায়গা রেখে দিয়েছে। শুধু ওয়ালেটটা আনতে ভুলবেন না।”
এসেছি ঘুমিয়ে পড়া গ্রীক ভিলেজ আলতেনকমে, বহু প্রাচীন অ্যাপোলো মন্দিরের কাছেই। পশ্চিম তুরস্কের এক প্রান্তে, গ্রীস-তুরস্কের সীমানার কাছেই এই গ্রাম। ইংরেজী কায়দায় হয়ত লোকে বলবে ‘টাউন’ কিন্তু সেকথা ধরবেন না। লোকে এখানে আসে সমুদ্র দেখতে, টারকোয়েজ রঙ্গীন জল আর সোনালী হলুদ বালির জন্য। দুপুরের খামোখা খেয়ালে মনে হল গ্রামটা ঘুরে দেখি। একজন পর্যটককেও চোখে পড়ল না, কিন্তু ভারী অবাক হয়ে দেখলাম সারা রাস্তা জুড়ে স্থানীয় লোকজনদেরও দেখা যাচ্ছে না। সমুদ্রের দিকটা কয়েকটা ছোট্ট জেলে-বোট জেটিতে আটকে থেকে অলস হাওয়ায় দুলছে। একটার মাস্তুলে দুখানা সী-গাল চুপটি করে বসে শুধু জল দেখছে, ভাবটা খানিক টুরিস্ট সুলভ-ই। দোষ দেওয়া যায় না, ভারী মিঠে একটা রোদের সঙ্গে সমুদ্রের হাওয়ার এমন মজলিশি যুগলবন্দী তৈরী হয়েছে, মনে হবে এই শেষ স্টপ, সব ভুলে থেকে যাই। তবে দু’পেয়েদের কথা আলাদা, তারা একটু এবড়োখেবড়ো বীচের ওপরেই পিচ ঢালা মসৃণ রাস্তা ধরে হাঁটতেই থাকবে, হাঁটতেই থাকবে। আর কখনো সমুদ্রের দিক থেকে চোখ সরিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে গ্রীক ভিলাগুলোর দিকে তাকালে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠতে পারে, কাশফুল। তখন হয়ত কিছুক্ষণের জন্য মনটা একটু আকুলিবিকুলি করতে পারে, চার’হাজার মাইল দূরের কোনো জনাকীর্ণ শহরে একবারের জন্য হলেও ছুটে যেতে, বারো বছর ধরে সে শহরে যাওয়া হয়নি এ মরশুমে।

আর তক্ষুনি চোখ পড়বে কাগজফুল হয়ে ফুটে থাকা গল্পদের ওপর আর চিনচিনে ব্যথাটাও কোথায় হারিয়ে যাবে। বুগেনভিলিয়া এ শহরের প্রিয় ফুল, প্রত্যেকটা ভিলার সামনে-পিছনে কোথাও না কোথাও ঈষৎ গোলাপি আভা নিয়ে তারা ঝেঁপে এসেছে। পাঁচিল মানেই তো একটা অধিকারের প্রতীক, একটু দূরত্ব গড়ে দেওয়ার অদম্য চেষ্টা, একটা বিভাজন দাখিল করার অবিনম্র প্রয়াস। এই মানুষী ট্রেটগুলোকে ভুলিয়ে দিতে, বিত্তজনিত মালিকানাকে ক্যামোফ্লাজ করতে আপনার বেস্ট বেট ওই বুগেনভিলিয়া। বিশ্বাস করুন, সত্যি কাজ দেয়। তাই যে দু’পেয়ে সবজে নীল জলের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল আদেখলের মতন, সেও গুটি গুটি পায়ে রাস্তা ক্রস করে চলল তার গল্পদের কাছে। এক গল্প নিয়ে যায় আরেক গল্পের কাছে; এক গল্প দূরে দেখায় স্তব্ধ দুপুরে ইস্তানবুল থেকে ছুটি কাটাতে আসা দুই কিশোরী তাদের সামার রিসর্টের সামনে দোলনা বানিয়ে দুলছে। কিশোরী সুলভ বেণী মোটেই নেই, কিন্তু তাদের থেকে থেকে অযথা হাসি চিরকালীন। ক্ষণিকের আগন্তুককে দেখে তারা থমকায়, তারপর মোটেই পাত্তা না দিয়ে শুরু হয় কথা চালাচালি, কত্ত কত্ত কথা – সব রাখা ছিল ছুটির দিনের এই নিশ্চুপ দুপুরের জন্য। আরেক গল্প ভালোবাসে একটু সাসপেন্স তৈরী করতে, পাতা ঝরঝরিয়ে বলল বাড়ির পেছনের চড়াই-উতরাই এর দিকে যেতে, ব্যাস শুধু ওইটুকুই। হাঁটতে হাঁটতে এল এক ঝুরঝুরে বাড়ী, তার ঘুলঘুলি দেখলেই বোঝা যায় এ গ্রামের প্রাচীনতমদের মধ্যে পড়ে সে, হাল ফ্যাশনের লাল টালিওলা ভিলারাও জানে তার কথা। উঠোনের দু’দিকে তার দুই দেওয়াল, একটা জালি জালি ফ্রেম আটকে রয়েছে দুই দেওয়ালের মধ্যে। আর তাতে লতিয়ে লতিয়ে উঠেছে আঙ্গুর গাছ, থোকা থোকা কালো আঙুর। কৌতূহলী চোখ দেখে প্রাচীন বাড়ীর প্রাচীনা মালকিন বেরিয়ে এসেছিলেন। চুপ দুপুরের মায়াবী রূপকথা সত্যি করে তিনি সেই দেশী ঠাকুমা, সেই অজস্র বলিরেখা, সেই ফোকলা হাসি, আর সেই প্রশ্রয়দাত্রী চাউনি। আমি চিনি সেই চাউনি, গলা ব্যথা ব্যথা হওয়ার আগেই তাই ঢালু রাস্তা দিয়ে নেমে গেলাম। রাস্তা দিয়ে নামতে নামতে শুনি আবার কিসের ফিসফাস, ঝেঁপে ওঠা কাগজফুলদের গল্প ফুরনোর নয় । চোখে পড়ল বাতাসবাড়ির গম্বুজ।

সেই নাম না জানা কোন কালে তৈরী হয়েছিল এ গম্বুজ, মান্ধাতার আমলের স্পিনিং হুইলে বয়ে যেত মৃদুমন্দ হাওয়া। এখন আর কোন কাজে লাগে তাকে? শুধোলাম, কোনো উত্তর এল না। পাতা ঝরার বেলায় মনে হল কাগজফুলদের গল্প বলা শেষ হয়েছে। একটু বিসদৃশ ঠেকল, কিন্তু কি আর করা। বাতাসবাড়ির গম্বুজকিনারে এসে বুঝলাম ভুল হয়েছে, দোষ আমার। বাতাসবাড়ির সত্যিই কোনো কাজ নেই, এখন-ও নেই, তখন-ও ছিল না। কিন্তু সব স্থাপত্য কি কাজ মাপার জন্য হয়? পাহাড়চূড়ায় লম্বা লম্বা গাছেদের মধ্যে বাতাসবাড়ি রয়ে গেছে শুধু রোমান্সের জন্য। কবি, ভাবুক, ক্ষণিকের অতিথিদের মনগড়া রোমান্স নয়, এ আক্ষরিক, খাঁটি রোমান্স। তরুণীর একঢাল পিঠখোলা চুল রেড ফ্ল্যাগ তুলে রেখেছে, তাই জন্যই তার পিঠ আমার দিকে; তার সঙ্গী কি করছে সে কথা আমার জানার নয়, কারোরই জানার নয় – এ দুপুরটা শুধুই তাদের। ঘুমিয়ে থাকা আলতেনকমে তারা পড়ে পাওয়া সুযোগ নেয় না, তাদের গন্তব্য অন্যত্র।
কাগজফুলের শহর অপেক্ষা করে আছে এখনো, চলে যান। অন্তত একটা দুপুরের জন্য হলেও, তাড়াতাড়িই – কে জানে কখন কর্মব্যস্ত পৃথিবীর খেয়ালে আরেকটা গ্লোবালাইজড টুরিস্ট স্পটের আইডিয়া ভেসে আসে টারকোয়েজ জল ধরে সোনালী বালির তীরে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন