শনিবার, ১৭ মে, ২০১৪

টার্কিশ কোলাজ

বেলা দশটার দিকে রোদ যখন বেশ ঝলমলিয়ে ওঠে, তখন অফিসের জানলা দিয়ে দূরে ‘সী অফ মারমারা‘ বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। বেশ মজাই লাগে; এই এতক্ষণ ধরে মনে হচ্ছিল দূরে শুধুই আকাশ আর তার মাঝে একটা ফুটকির মতন কালো মেঘ আর সূয্যিমামা দেখা দিলেই বোঝা যায় দিকচক্রবাল ভারী ঠকাচ্ছিল, আকাশের অনেকটাই আদতে জল আর কালো ফুটকিটা ছোট্ট একটা দ্বীপ বোধহয়। মারমারা কথাটা শুনে ইস্তক মনটা কি যেন হাতড়াচ্ছিল, কি যে সেটাই ঠাহর হচ্ছিল না। তারপর যেই উইকিদেবতা জানালেন কথাটা আদতে এসেছে গ্রীক শব্দ মারমারন থেকে, তক্ষুনি বুঝলাম রহস্যটা কি। মারমারন বলুন কি মারমারা, সবই বোঝায় মার্বল (যা নাকি ওখানকার দ্বীপে প্রচুর পরিমাণেই পাওয়া যেত এককালে); আর মার্বলের শুদ্ধ বাংলা বা সংস্কৃত? ভাবুন, ভাবুন! অ্যাই তো, এতক্ষণে ঠিক মনে পড়েছে - মর্ম্মর! অ্যামেচার এটিমোলজিস্টরা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন উত্তেজনার যথেষ্ট কারণ আছে। এটা দেখেই আমার এক টার্কিশ কলীগের সঙ্গে বসে গেলাম  দু’ভাষাতে কমন শব্দর একটা লিস্টি বানাতে (ওকে অবশ্য বলিনি যে আদতে বাংলা ভাষাই ঋণী) – আদালত, দুনিয়া, আয়না, দোস্ত আরো কত শত শব্দ যে বেরোল। আগের উইকএন্ডে যে  ইস্তানবুলের রাস্তায় ‘পেয়খানা’র-ও দেখা পেয়েছি, সেটা অবশ্য বেমালুম চেপে গেলাম।
বেশ কিছু পাকিস্তানি এম-বি-এ ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আলাপ হল। প্রতি বছরেই তিন-চার জন করে আসে , এবারে একসঙ্গে সাতজন পড়তে এসেছে। কয়েকজন এসেছে লাহোর ইউনিভার্সিটি  অফ ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স থেকে, বাকিরা লাহোরেরই ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স থেকে। নাম প্রায় এক হলেও দুয়ের মধ্যে বিস্তর রেষারেষি। ভারতীয় অধ্যাপক শুনেই সব বিস্তর চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিল, “এই ব্ল্যান্ড তুর্কী রান্না খাচ্ছেন কি করে?”,  “কবে বিরিয়ানি রেঁধে খাওয়াবেন আগে বলুন?”, “তাকসিম স্ক্যোয়ারের কাছে শুনেছি একটা ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ আছে, ট্রাই করেছেন?” ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা জিনিস বোঝা গেল যে এরা সবাই বিরিয়ানি জিনিসটা ভারী মিস করছে। পাকিস্তানীদের বিরিয়ানি রেঁধে খাওয়াব অত সাহস এখনো আসেনি, তাই বাড়িতে নেমন্তন্ন তৎক্ষণাৎ না করতে পারলেও কথা দিলাম ‘সোয়াদ’-এ গিয়ে একবার সবাই মিলে খেয়ে আসব। আমার কিন্তু টার্কিশ রান্না দিব্যি লেগেছে, ইউনিভার্সিটি  কাফেটেরিয়াতে অলমোস্ট বাড়ির স্টাইলে রান্না করে। যদিও ‘কেবাব নেশন’ হিসাবেই এ দেশ পরিচিত, এরা কিন্তু রান্নায় প্রচুর পরিমাণে দেশী বেগুন, বিলিতি বেগুন আর ইয়োগার্ট ব্যবহার করে। সুস্বাদু খাবারকে কেন ব্ল্যান্ড বলছে ভাবতে গিয়ে খেয়াল পড়ল বহুদিন আগে পড়া এই সত্যি ঘটনাটা -
বাজপেয়ী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন ইসলামাবাদ ( এদিকে মুশারফের চ্যালাচামুন্ডারা উল্টোদিকের বাসে করে কার্গিল যাচ্ছিল , বাজপেয়ী সেটা টের পান নি), সঙ্গে গেছেন বেশ কিছু ভারতীয় সাংবাদিক। দুপুরের খাবার খুঁজতে বেরিয়ে ঢুকেছেন রাস্তার পাশের এক দোকানে। মুঘলাই রান্নার বেজায় খোশগন্ধ বেরোচ্ছে, বাঙ্গালী এবং উত্তর ভারতীয়দের জিভ দিয়ে জল পড়ে আর কি। বাধ সাধলেন দক্ষিণী সাংবাদিকরা, ভেজ ডিশ পাওয়া যায় কিনা সেটা আগে কনফার্ম করতে হবে। ইতিমধ্যে বিশালদেহী পাঠান মালিক চলে এসেছেন, ভারতীয় পত্রকার শুনে বিশেষ সমাদরে তাঁদেরকে ভেতরে নিয়ে যেতে তৈরী। দক্ষিণী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানালেন আলবত ভেজ ডিশ পাওয়া যাবে! বেফিকর তসরিফ রাখার অনুরোধ জানিয়ে কথা দিলেন কোনো সমস্যা হবে না। তা কিছুক্ষণের মধ্যেই গরম গরম নন-ভেজ ডিশ চলে এল, কিন্তু ভেজ প্রিপারেশনের আর দেখা মেলে না।বাঙ্গালী জিভ প্রায় জলশূন্য হয়ে যায়, কিন্তু ভদ্রতা বলেও একটা ব্যাপার আছে। আরো বোধহয় মিনিট চল্লিশ  পর অবশেষে ভেজ ডিশের আগমন – বিশাল বাটি ভর্তি বড় বড় মাংসের টুকরোর চোখ জুড়িয়ে দেওয়া, মন উদাস করে দেওয়া ঝোল। আর অবশ্যই সঙ্গে কিছু সব্জীর টুকরো। তাই টমেটো, বেগুন আর ইয়োগার্টের মধ্যে মাংস ঠেসে দিলেও ব্ল্যান্ড যে লাগবে, তা বলা বাহুল্য!
ইউনিভার্সিটি থেকে প্রত্যেক ফ্যাকাল্টি মেম্বার-ই একটি করে ল্যাপটপ পান, আমিও পেলাম। পেয়েই চক্ষু চড়কগাছ, কীবোর্ডটি টার্কিশ ভাষীদের জন্য বানানো।তবে যতটা রিঅ্যাক্ট করলাম ব্যাপারটা আদতে অতটাও খারাপ নয়।     শ্রীল শ্রীযুক্ত আতাতুর্ক মহোদয়ের দৌলতে টার্কিশ অ্যালফাবেট-ও মূলত ল্যাটিন, সাতটি অক্ষর খালি উচ্চারণের সুবিধার্থে মূল ল্যাটিন অক্ষরের ওপর একটু কারিকুরি করে গড়ে তোলা হয়েছে। একদিকে যেমন কিউ, ডবলিউ এবং এক্স  টার্কিশ অ্যালফাবেটের মধ্যে পড়ে না, উল্টোদিকে আবার ল্যাজওলা সি, ল্যাজওলা এস, লোয়ারকেসে ফুটকিবিহীন আই বা দু’দুটো ফুটকিওলা ও কে পেয়ে যাবেন। মুশকিলটা মূলত হচ্ছে এই ফুটকিবিহীন আই কে নিয়ে। ইনি বসে আছেন আমাদের ইউসুয়াল কীবোর্ডে ফুটকিওলা আইয়ের জায়গায়। তাই শেষ ক’দিন ধরে ভারত, আমেরিকা এবং পৃথিবীর অন্য যেসব জায়গায় অফিসিয়াল ই-মেল ছাড়তে হয়েছে, তাতে আই বাবাজীবন ‘বিন্দু’বিসর্গ জানাচ্ছেন না। মজাটা হল অন্য দেশের লোকেরা এটা বোধহয় লক্ষ্যও করেন নি কিন্তু তুর্কী কলীগরা একটু কনফিউসড। হয়েছে কি, ফুটকিবিহীন আই-এর উচ্চারণটা খানিকটা অ্যা এবং খানিকটা ই-র ওয়েটেড কম্বিনেশন বিশেষ। তাই Prabirendra না লিখে Prabırendra লিখলে প্রব্যারেন্দ্র এবং প্রবেরেন্দ্রর মাঝামাঝি কিছু শোনাবে। তাই ওনারা একটু চিন্তায় পড়েছেন, ব্যাটা সাতদিন যেতে না যেতেই কি অ্যাক্সেন্ট মারছে দেখো! গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে ল্যাজওলা সি’র প্রতি আমার নিখাদ প্রেম। সি’র ল্যাজ গজালেই আপনাকে ‘zi’ বলতে হবে। পরশুরাম বেঁচে থাকলে গিয়ে বলে আসতাম ” শেষমেষ ‘z’ান্তি পেরেছি স্যর”! তো ভালোবাসায় দিগ্বিদিক ভুলে  ‘জী, জী’ করে যাচ্ছি, c/si/j/z কেউ ছাড় পাচ্ছে না।
সবে সপ্তাহখানেক হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়েছি কিন্তু তাতেই ওজন এবং আকৃতি নিয়ে ব্রেন বড় ঝামেলায় পড়েছে। সবই বেজায় ছোটো ছোটো লাগছে। মানুষজনের কথা ছেড়েই দিলাম, আলুর সাইজ দেখে ভাবছি সেপ্টেম্বরেই বাজারে নতুন আলু উঠে এসেছে? তাড়াহুড়োতে এয়ারপোর্টে চশমাটা হারিয়ে এসেছি তাই কাক এবং পায়রা চোখে পড়লেই মনে হচ্ছে নতুন চশমা বানানোটা নিতান্তই দরকার। এমনকি ক্যাম্পাসের চেরি ফলের গাছ দেখে ভাবছিলাম নতুন কোনো বেরি বোধহয়। মোদ্দা কথা হল, দৈত্যাকৃতি আমেরিকান পশু-পাখী, গাছপালা এবং জড়পদার্থ না দেখতে পেয়ে চমকে চমকে উঠছি আর স্বপ্নে গার্জিয়ান এঞ্জেল এসে বলে যাচ্ছেন “এটাই বাস্তব, ওটা জেনেটিক এঞ্জিনীয়ারিং-এর কেরামতি।” কালকে একটু তো তো করে বলেই ফেললাম “যাই বলুন, ও দেশে কিন্তু একটা আপেল টেবলের ওপর রেখে দিলে একটুও না টসকিয়ে মাস তিনেক থেকে যেত।” উলুবনে আর কত মুক্তো ছড়ানো যায় বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন। বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম  ল্যাজ, শিং নিয়ে টকটকে লাল রঙের শয়তান-ও দেখা দিয়ে যাচ্ছেন;  বেশি বিরক্ত করছেন না, খালি বলছেন “পাইরেট বে“।
জীবজন্তুর কথা প্রসঙ্গে বলি ইস্তানবুলের বেড়ালরা প্রায় বিশ্ববিখ্যাত। তাদের ক্যামেরাবন্দী করার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে লোকেরা আসেন। অতি সম্প্রতি টাম্বলারেও তুর্কী মার্জারকুলের দেখা পাওয়া যাচ্ছে । ইস্তানবুলের রাস্তায় মেলা বেড়াল দেখতে পাবেন –  সিংহের মতন কেশর নিয়ে পার্সিয়ান বেড়াল, ‘মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা’র কভার থেকে উঠে আসা কালো কুচকুচে বেড়াল,  ইনসাইড-আউট ক্যাট এবং আর যা যা চাই। ক্যাম্পাসে অত বৈচিত্র্য নেই বটে, কিন্তু তেনারা সর্বত্র বিরাজমান। ক্যাফেটেরিয়া, লাইব্রেরী, ডরমিটরি তে তো বটেই কালকে দেখলাম এক দুধে-আলতা রূপসী সেমিনার রুমেও ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রথম দিন পৌঁছনোর পর সর্বপ্রথম অভ্যর্থনা জানাতেও এঁদেরই একজন উপস্থিত ছিলেন। বিদেশী বলে ভ্রূক্ষেপ অবধি না করে পায়ে মাথা ঘষতে শুরু করেছিলেন তারপর অবশ্য সেই কাজটাই সুটকেসের সঙ্গে করতে গিয়ে দু’জনেই সশব্দে পপাত চ । তাতে অবশ্য একটা কাজের কাজ হল, আমার পড়শীরা টের পেলেন “ভুবন ভ্রমিয়া শেষে…” ইত্যাদি ইত্যাদি। ফ্যাকাল্টি হাউসিং-এ যাতে ঢুকে না পড়েন, সেটা এনসিওর করতে গিয়ে চার রাউন্ড চু-কিতকিত খেলে জিততে হল কিন্তু এ শুনে পরাভূতকে অবহেলা করবেন না। কাঁচের দরজার এদিক থেকে দেখি রণে ভঙ্গ না দিয়ে তিনি পেছনের দু পায়ে দাঁড়িয়ে সামনের দু’পা দিয়ে দরজার হাতল ঘোরাচ্ছেন। বিশ্বাস করুন, টানছেন না,  ঘোরাচ্ছেন – দেখে চক্ষু স্থির এবং সার্থক দুটোই হল।
ইস্তানবুল ২০২০-র অলিম্পিকস আয়োজন করার ভার পায়নি। আমারই যা একটু খারাপ লাগছিল (সদ্য-আগতর আদিখ্যেতা?), তুর্কী বন্ধু এবং ছাত্রছাত্রীরা দেখলাম বিশেষ বিচলিত নন। অলিম্পিকস আয়োজন করে এথেন্স তথা গ্রীস এবং ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করে দক্ষিণ আফ্রিকার যা হাঁড়ির হাল হয়েছে, সেসব দেখেশুনেই বোধহয় লোকজন অস্ফুটে বলছেন “বাঁচা গেল, বাবা।” ব্রেজিলেও ২০১৪ এবং ২০১৬ নিয়ে যা তুলকালাম চলছে, এখানকার লোকজন ভাবছেন ফাঁড়া কাটল। গতকাল রাস্তায় বেরিয়ে মনে হল, সিরিয়ার যুদ্ধ-টোকিওর বেটার ইনফ্রাস্ট্রাকচার – তাকসিম স্কোয়্যারে বিক্ষোভ এসব কোনোটাই ইস্তানবুলের অলিম্পিকসের দায়িত্ব না পাওয়ার কারণ নয়। অলিম্পিকস কমিটির সদস্যরা মোস্ট প্রব্যাবলি হিসেব করে দেখেছেন স্টেডিয়ামে ভরবে না। হাঁ হাঁ করে ওঠার আগে কারণটা বলতে দিন প্লীজ! আমার ইউনিভার্সিটি থেকে তাকসিম স্কোয়ারের (শহরের প্রাণকেন্দ্র) দূরত্ব বোধহয় চল্লিশ কিলোমিটারের আশেপাশে হবে। দিন ভালো থাকলে, অল্পস্বল্প ট্রাফিক জ্যাম পেয়েও মোটামুটি ৪৫-৫০ মিনিটে চলে যাওয়া যায়। গতকাল ছিল শনিবার এবং লাগল ঝাড়া আড়াই ঘন্টা। ইস্তানবুলের ট্র্যাফিক জ্যামকে টেক্কা দিতে পারে এরকম শহর বোধহয় পৃথিবীতে নেই, অ্যাপারেন্টলি জাকার্তা ছাড়া। এবং যতটা সময় লাগতে পারে তার থেকে ঘন্টা খানেক, ঘন্টা দেড়েক দেরি হওয়াটা রীতিমতন দস্তুর আর কি! এবার ভাবুন, উসেইন বোল্ট ১০০ মিটার দৌড়তে চলেছেন (যদিও ঘোষণা করেছেন যে ২০১৬-র সোনার মেডেলগুলো পেয়েই জুতোজোড়া তুলে রাখবেন), এরকম বিশ্বের বিস্ময় চাক্ষুষ করতে কতক্ষণ সময় আছে আপনার কাছে? সাড়ে ন’সেকন্ড মতন। ইস্তানবুলে বসে সাড়ে ন’সেকন্ড, ইয়ার্কি? গাড়ির টায়ার এক ইঞ্চি গড়াতে লেগে যাচ্ছে সাড়ে ন’মিনিট।  ১৭ তারিখে  রিয়াল মাদ্রিদ আসছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির গ্রুপ ম্যাচে  এখানকার সেরা দল গালাতাসারায়ের সঙ্গে খেলতে। এক তুর্কী ছাত্র দেখলাম হিসেব কষছে “অ্যাকাউন্টিং এর পরীক্ষা শেষ বিকেল সাড়ে চারটে। তারপর দৌড়ে হস্টেলে ফিরে গাড়ি নিয়ে (হ্যাঁ, হস্টেলে থাকলেও গাড়ি আছে, অবাক হবেন না) বেরোতে বেরোতে ৪-৪৫। মেন গেটে চেকফেক করে বেরোতে বেরোতে তার মানে প্রায় পাঁচটা। ইরি ত্-তারা, ম্যাচ তো রাত নটা পঁয়তাল্লিশে শুরু, হল না বোধহয়।” বন্ধুবান্ধবরা দেখলাম আশ্বাস দিচ্ছে আর দূরে গিয়ে বেজায় মাথা নাড়ছে। আরে ম্যাচ দেখবি তো পরীক্ষ দিস না। চল্লিশ কিলোমিটার যাওয়ার জন্য নাকি বাবু হাতে রেখেছেন মাত্র চার ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট, বেয়াকুব আর কাকে বলে!
পাকিস্তানি ছাত্রী মারিয়া লন্ডন ফেরত, এবং এথনিক ফুড বেজায় ভালোবাসে। অন্য পাকিস্তানীদের মতন সারাক্ষণ বিরিয়ানি মিস করে না, তার প্রাণ কাঁদে থাই এবং চাইনিজ খাদ্যবস্তুর জন্য। দু’দিন আগে ক্যাম্পাসের সেরা রেস্তোরাঁয় বেজায় লেকচার দিয়ে এসেছে অথেনটিক থাই কারিতে কতটা নারকেল দুধ পড়বে সেই নিয়ে। এমন ঝড়ের বেগে ইংলিশে ধাতানি দিয়েছে যে টার্কিশ ভাষী শেফের জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে শোনা ছাড়া কোনো অপশন ছিল না। আজকে দেখি কন্যার মুখে একগাল হাসি, বলল “সেদিনকার ব্লিৎসক্রিগে কাজ দিয়েছে! আজকে যা চমৎকার চাইনীজ বানিয়েছে না, আহা! প্লীজ, খেয়ে আসুন।” প্রতিবেশী দেশের চাইনীজ প্রেম নিয়ে একটু সন্দেহ সব সময়েই আছে আমার, তবে কিনা সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। গেলাম, অর্ডার করলাম এবং অর্ডার করার মিনিট চল্লিশ পরে খানা হাতে পেলাম। চল্লিশ মিনিট ধরে ক্ষুৎপিপাসায় কাতর থেকেও সাবকন্টিনেন্টাল টাচে বানানো চাইনীজের লোভে  আর ওয়েটারদের ব্যাস্তসমস্ত করে তুলিনি। প্রথম গ্রাস, এবং জিভ পুড়ে ছারখার। না, গরমে নয়, নুনে। শেফ ভদ্রলোক নিজে মনে হয় কোনোদিন চাইনীজ খাননি, এমনকি রান্না করতে করতে চাখেন-ও নি। সুতরাং, সয়া সসে যে কতটা নুন থাকতে পারে সে নিয়ে তাঁর সিমপ্লি কোনো আইডিয়া নেই, শুধু জানেন যে চাইনীজ খাবারে সয়া সস দিতে হয়। তাই সয়া সসের ঝোলে নুডলস চুবিয়েও তিনি ভরপুর নুন দিয়েছেন, মানে হাতে করে কাঁচা কাঁচা নুন। কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়, এর একটা টার্কিশ উপসংহার আছে। টার্কিশ কাবাব ইস্কান্দার (এর গল্প অন্য  আরেকদিন) খাওয়ার সময় এরা কাবাবের ওপর বাটার সস ঢেলে দিয়ে যায়। বাটার সস মানে গলানো বাটার, আপনার কোলেস্টরল লেভেল যাই হোক না কেন, ওই বাটার সস ছাড়া ইস্কান্দার খাওয়া মানে একটা ব্ল্যাসফেমি করে বসলেন। এই তুর্কী কুক দেশপ্রেমের জন্যই হোক, বা ইম্প্রোভাইজ করতে গিয়েই হোক সেই বাটার সস এখানেও ঢেলেছেন। আর বাটার সসের দুটোই ইনগ্রেডিয়েন্ট – বাটার এবং নুন, অতএব য পলায়তি স জীবতি। পালাতে পালাতে মনে পড়ল, মারিয়া এই খেয়েই বেজায় আহ্লাদিত – তার মানে পাকিস্তানি চাইনীজের স্বাদ-ও সমতুল্য। চাইনীজ প্রিমিয়ারের কানে একবার তুললে হয়, এই যে পাকিস্তান পাকিস্তান করে হেদিয়ে যাচ্ছেন, একবার-ও আপনাদের দেশের খাবারটা ওদেশে গিয়ে চেখেছেন? আমার দৃঢ় ধারণা পাকিস্তানী চাইনীজ যদি তুর্কী চাইনীজের পঞ্চাশ শতাংশ-ও নিয়ে আসতে পারে, পরের পঞ্চাশ বছরের জন্য চীন পাকিস্তানকে রসদ যোগানো বন্ধ করে দেবে। মুশকিল একটাই, এসব আইডিয়া দেওয়ার জন্য দিল্লী যাওয়ার টাইম নেই, আর এ বিদেশে ক্রিকেট-বলিউড-বিরিয়ানি নিয়ে আলোচনার জন্য আছে তো ওই পাকিস্তানীরাই। সুতরাং,  নেক্সট কিছু বছরের জন্য সাধু সাবধান; ইস্তানবুল হোক কি লাহোর, চাইনীজ খেতে চাইলে পকেটে গোটা আলু নিয়ে ঘুরবেন। নুনকে জব্দ করতে আলু হল যাকে বলে ব্রহ্মাস্ত্র; এক গ্রাস করে চাইনীজ খাবেন আর এক কামড় করে কাঁচা আলু। Bon appétit!
ইস্তিকলাল অ্যাভেনিউ-এ দুপুর সাড়ে বারোটার সময় যা ভিড় দেখলাম, তা সত্যি সত্যি-ই কলকাতার পুজোর ভিড়ের সঙ্গে তুলনীয় – অন্তত ম্যাডক্স স্ক্যোয়ারে ষষ্ঠীর সন্ধ্যাবেলায় এত লোক দেখতাম নব্বইয়ের শেষে। এখন কি অবস্থা অবশ্য জানি না, কলকাতার পুজো শেষ দেখেছি ২০০১-এ। কাগজে এখন যেরকম ঘড়ি ধরে বিন্দুতে সিন্ধু মাপার প্রয়াস চালায়, দেখে গতিক সুবিধের ঠেকে না। সে যাই হোক, জনস্রোতে ভাসার একটা মজা আছে, স্পেশ্যালি আপনার হাতে যদি সময়-ই সময় আর উদ্দেশ্য বলে সত্যিই কিছু না থেকে থাকে। প্রথমত, এগিয়ে চলার জন্য আপনাকে বিন্দুমাত্র এফার্ট দিতে হবে না, মনে হবে যেন এসকেলাটরে চড়ে এগিয়ে চলেছেন। দ্বিতীয়ত, এই যে কত মুলুকের লোক, কাঁহা কাঁহা থেকে এসে কত কিসিমের জিনিসপত্র কিনে পেপার ব্যাগ, ব্যাকপ্যাক, আমেরিকান ট্রাভেলারের সুটকেস ভর্তি করে নিয়ে চলেছে, এ দেখেও  মজা। তো সেই নির্মল আনন্দ-ই নিচ্ছিলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কিছুক্ষণ পর কানের কাছে বড় প্যাঁ-পোঁ আরম্ভ হতে খেয়াল হল  সেই লাল রঙের কাঠের তৈরি ট্রামগুলোর একটা এসে অনুরোধ করছে ট্রাম লাইন ছেড়ে দেওয়ার জন্য। তুর্কী সরকার এই বিশাল রাস্তাটায় সমস্ত রকম যানবাহনের চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন, রয়েছে কেবল হিস্টোরিক্যাল চার্ম বাড়ানোর অভিপ্রায়ে এই ট্রামগুলো। সারা রাস্তাই যেহেতু জনগণের কব্জায়, বিনীত অনুরোধ না করে উপায় কি? জীবনানন্দ স্মরণে বালিগঞ্জের মুখটায় অন্তত এরকম কিছু করলে মন্দ হয় না; অবশ্য শেষবার গড়িয়াহাটে দেখলাম ট্রাম কন্ডাকটর বিস্তর মুখ খারাপ করে করে হেদিয়ে গেলেন, দুদিক থেকে লোকজন রাস্তা পেরিয়েই চলেছেন; লাল সবুজ হল, সবুজ হলুদ হল, হলুদ আবার লাল হল, কন্ডাকটরের মুখের বেগুনী আভা আর নেভে না।
istanbul_Tram
তো রাস্তা ছেড়ে যেই সাইড হয়েছি, দেখি চোখের সামনে ম্যাজেস্টিক সিনেমা। বেজায় চমকালাম, না ম্যাজেস্টিক এর ‘পপার’ সুলভ দুর্দশা দেখে নয়, স্পষ্ট চোখের সামনে দেখলাম “with English subtitles in Present Tense”। প্রেজেন্ট টেন্সেই সাবটাইটল কেন লেখা হল, এ প্রশ্ন কাকে না ভাবাবে বলুন? দেন অ্যান্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, এ সিনেমা দেখতেই হবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সিনেমা শুরু হতে কুড়ি মিনিট। এদিকে আরো দশ মিনিট দূরেই রয়েছে ‘রবিন্সন ক্রুসো’ বইয়ের দোকান, ইস্তানবুলের বিখ্যাত ইন্ডি বুকস্টোর। আর্থিক অনটনে উঠে যাব যাব করছে, সেখানে গিয়ে দু’একটা বই না কিনলেই নয়। তো দৌড়ে দৌড়ে গেলাম, হাঁফাতে হাঁফাতে ঝপাঝপ Buket Uzuner এর ‘Istanbullu’ আর Barrie Kerper সম্পাদিত “Istanbul :The Collected Traveler” ঝোলায় ফেলে, “গেঁড়ে বসে থাকুন, ওঠার নামটিও করবেন না” বলে সহমর্মিতা প্রকাশ করে ফির সে দে দৌড়। ম্যাজেস্টিকের সেলোন নাম্বার চারে ঢুকে খেয়াল পড়ল প্রেজেন্ট টেন্সে সাবটাইটল দেখার আশায় লাঞ্চ অবধি করতে ভুলে গেছি। চোখ গোলগোল করে দেখছি (একেই চশমাটা সিয়াটল এয়ারপোর্টে হারিয়ে এসেছি), পনের মিনিটের মাথায় ফের টের পেলাম কেউ কথা রাখে না। সিনেমার প্রোটাগনিস্ট আগে ফরচুন-টেলারের কাজ করেছে কিনা, এ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যান দিচ্ছে আর তলায় সাবটাইটল ভেসে উঠছে, এবং দিব্যি পাস্ট টেন্স দেখা যাচ্ছে। রাগের চোটে তালটাই কেটে গেল, সিনেমাটা যদিও দিব্যি বানিয়েছে। শেষ হল, ভাবছি কাউন্টারে গিয়ে অভিযোগ জানাব কিনা, এমন সময় দেখি পর্দায় ফুটে উঠল  ‘Simdiki Zaman‘ অর্থাৎ কিনা চলচ্চিত্রের নাম, আর তার নিচে ক্ষুদি ক্ষুদি অক্ষরে ‘Present Tense’, বুঝলেন তো? হুঁ, গুগল ট্রান্সলেটর-ও কনফার্ম করেছে।
পরমা তখনো প্রথমা হয়নি – বৈশাখী সংখ্যায় বিস্তর অচেনা খাবারদাবারের রেসিপি দিয়ে ভারী ভালো লাগিয়ে তুলেছিল। নামগুলোও জবরদস্ত -  মাছের ডুবলি, ডিমের তুরফি, চামলাই শাকপাক, সরষে শাপলা, কমলালেবুর কালিয়া, করলার তিতরায়তা, সাপটার টক, শর্করপারা, টিকরশাহি ইত্যাদি ইত্যাদি।  অনেক কিছুই খাইনি এর মধ্যে, ইনক্লুডিং শর্করপারা। পরে অবশ্য খেয়াল পড়ল উত্তর ভারতেও একটা স্ন্যাক আছে, শক্কর পারা নামে। কয়েকদিন আগে  ইউনিভার্সিটি ক্যাফেটেরিয়ায় একটা অতি সুস্বাদু ডেসার্ট দিল,  চমৎকার মুচমুচে পেস্ট্রি তার ওপরে আবার মুক্তোর দানার মতন এক ফোঁটা অ্যামন্ড।  খাওয়ার পর দেখি মেনুতে লেখা  Şekerpare! ব্যাস আর যায় কোথায়, দু’য়ে দু’য়ে চার। এই হল গিয়ে গ্লোবালাইজেশন, পরমার সনাতনী বাংলা খাবার না খেতে পেয়ে হা-হুতাশ করছিলেন, পেয়ে গেলেন ইস্তানবুলে।
sekerpare
পরের দিনই আবার ছোটো ছোটো রসের মিষ্টি খেয়ে ভারি পান্তুয়ার কথা মনে পড়ছিল, তফাতের মধ্যে এটায় চিনচিনে মিষ্টি ভাবটা নেই আর পেস্তার গুঁড়ো দিয়ে সুন্দর ডেকরেট করা। যতবার বাজখাঁই ‘কেমালপাশা ত্যাতলাজি’ নামটা দেখছি ততবারই মনে হচ্ছে যাই বলো বাপু, একটা নাড়ির টান দিব্যি টের পাচ্ছি। শেষে আর থাকতে না পেরে বিস্তর রিসার্চ করে, পেজ কে পেজ গুগল ট্রান্সলেট করে দেখি ওমা, আমাদের গুলাবজামুন-ই হল গিয়ে তুরস্কের ‘কেমালপাশা ত্যাতলাজি’। বলছিলাম কি, হুঁ হুঁ।
kemalpasa
তবে কিনা,  কবি বলেছেন “যত হাসি তত কান্না, বলে গেছেন রাম শন্না “(আই মীন রাম শর্মা)। গ্রসারি স্টোরে গিয়ে দেখি সারি সারি ‘Peynir’। এটিমোলজিস্টকে আর পায় কে! লাফাতে লাফাতে নিয়ে এলাম, তখনো মাছ কিনে ওঠা হয়নি। কাঁহাতক আর মাংস খাওয়া যায়, পনির মশালাই হোক রাত্রে। মশলা-টশলা রেডি, কিউব কিউব করে কাটাও হয়ে গেছে; এবার তেল গরম করে ভাজার পালা। যেই না গরম তেলে ঢালা, কি বলব, চোখের সামনে মাখনের সমুদ্র তৈরি হল। আমি আবার একটু ভেবড়ে গিয়ে তার মধ্যেই ইন্টারনেট খুলে বসলাম, বং মম থেকে তরলা দালাল, সবাই দিব্যি গেলে বলেছেন পনির ভাজাটা আবশ্যক। ততক্ষণে অবশ্য পনির নয়, পেইনির তার লিকুইডিফায়েড ফর্মে কড়াই উপছে রীতিমতন ধাওয়া করতে শুরু করেছে। ঝাড়ু হাতে সম্মুখসমরে যাওয়ার আগে আরো একটা আপ্তবাক্য মনে পড়ল, অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী!
বসন্তের শুরুই বলা যায়, ইরাণীরা যাকে বলে বাহার। গালাতা টাওয়ারের ওপরে একটা কালো চিল চক্কর কেটেই চলেছে, শহরের  দেড় কোটি লোক বহাল তবিয়তে আছে কিনা সেটা জানতেএকটা বার্ডস-আই ভিউ থেকে কড়া নজর রাখছে। ওই জায়গায় পৌঁছনোর উপায় থাকলে দেখা যেত ত্রিভুজাকৃতি শহরটার পূবের দিকের বাহুটি হঠাৎ যেন সমতল থেকে একটু উঁচিয়ে উঠে গন্ডারের শিঙ -এর মতন একটা আকার ধারণ করেছে, আর সেই শিঙ এর দু পাশে সমুদ্র। উত্তর দিকে বসফরাসের একটা শাখা ঢুকে এসেছে, দক্ষিণে মর্ম্মর  সাগর – সারাক্ষণ একটা অনর্থক ভরসা যুগিয়ে চলেছে এ শহরের মানুষদের, মাভৈঃ, কেউ আসবে না উৎপাত করতে, আঁচড়টুকু পড়বে না এ শহরের গায়ে। সেই অলীক ভরসাতেই বোধহয় মানুষজন দিব্যি খোশমেজাজেই আছে অথচ শেষ তিনশ বছরে তেইশবার শত্রুপক্ষ এ শহরকে আক্রমণ করেছে, যদিও কব্জা করতে পেরেছে একবারই – পরাক্রমী আরবরা নয়, দুর্দান্ত ভবঘুরে জাত বুলগাররা-ও নয়, শেষবার এ শহরের পতন হয়েছিল চতুর্থ ক্রুসেডের নাইটদের হাতে। মার্চ মাসের শুরুতে, যখন শীত তার শেষ কামড় দিয়ে সদ্য বিদায় নিয়েছে এসব পুরনো কথা ভেবে কেউই মন ভারী করতে চান না, গুপ্তচররাও উৎকণ্ঠায় পড়ার মতন কোনো খবর আনছে না তাই সম্রাট প্যালিওলোগোস খোশমেজাজেই আছেন। কিন্তু রজার ক্রাউলের মনে কু ডেকেছে ওই কালো চিল!
কালো চিলের তাৎপর্য কি সেটা ভালো করে বোঝার আগেই কানের কাছে বেশ হেঁড়ে গলায় কেউ ‘ইয়াসিম’ বলে ডাক ছাড়লেন। দেখি এক স্বর্ণকেশী যুবা তাঁর বান্ধবীকে প্রায় দৌড়ে আসতে বলছেন কারণ সাতটা বিশাল হল ঘুরে শেষমেশ নপুংসক গোয়েন্দা ইয়াসিমের দেখা পেয়েছেন ‘ইনসান কিতাপ’ এর স্টলে। ব্যাপারস্যাপার আরো গুলিয়ে যাওয়ার আগে বলে নি, এসেছিলাম ইস্তানবুলের আন্তর্জাতিক বইমেলায় ঘুরতে। আমার অবস্থা সেই নর্ডিক দেবতার (লোকি বোধহয়) মতন যাকে বাকি দেবতারা হাত-পা বেঁধে পাতালে ফেলে রেখেছিলেন, আর শাপ দিয়েছিলেন জল খেতে গেলেই মুখের সামনে থেকে জল সরে যাবে। চতুর্দিকে থরে থরে বই সাজানো, যেমনি ঝকঝক করছে প্রচ্ছদ তেমনি খোশবাই ছড়াচ্ছে নতুন পাতার গন্ধ কিন্তু বিধি বাম, সাত খানা হলের সর্বত্রই শুধু তুর্কী বই। ইংলিশ বই স্রেফ নেই, ঘন্টা দেড়েক খুঁজে খুঁজে বার করেছিলাম একটিমাত্র স্টল যেখানে সর্বসাকুল্যে দশ থেকে বারোটি ইংলিশ বই বিক্রি হচ্ছে। তারই একটি হল রজার ক্রাউলের “কনস্ট্যান্টিনোপল, দ্য লাস্ট গ্রেট সিইজ” – ১৪৫৩ সালের আঠাশে আর ঊনত্রিশে মে, এই দু’দিনে কিভাবে বাইজ্যান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করে নেন অটোমান সম্রাট দ্বিতীয় মেহমেদ, তারই ইতিবৃত্ত। তার পাশেই সার দিয়ে দাঁড় করানো অরহান পামুকের ইংলিশে অনূদিত সব কটি বই – ‘স্নো’, ‘ব্ল্যাক বুক’, ‘রেড’, ‘মিউজিউয়াম অফ ইনোসেন্স’ ইত্যাদি। ব্রিটিশ যুগল যে বইটি দেখে আহ্লাদিত হয়ে পড়েছিলেন সেটিরও আন্তর্জাতিক বাজারে রীতিমতন ভালো কাটতি -  জেসন গুডউইনের একমেবাদ্বিতীয়ম নপুংসক গোয়েন্দা ইয়াসিম প্রথম আবির্ভাবেই জিতে নিয়েছিল গোয়েন্দা সাহিত্যের শ্রেষ্ট পুরস্কার ‘এডগার অ্যাওয়ার্ড’; ঊনবিংশ শতকের ইস্তানবুলে সুলতানের রাজপ্রাসাদে আচম্বিতে খুন হয়ে যান এক হারেমসুন্দরী, প্রায় একই সময়ে উধাও হন একাধিক রাজ-অফিসার। সুলতানের হুকুমে রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব পড়ে ইয়াসিমের ওপর, সাধারণ খুনের মামলা কিভাবে যোগসূত্র হয়ে দাঁড়ায় একাধিক ষড়যন্ত্রের মধ্যে তাই নিয়ে বেশ টানটান একটা উপন্যাস লিখেছেন জেসন। কিন্তু এডগার পুরস্কার পাওয়া বইয়ে খুন আর ষড়যন্ত্রের বাইরেও কিছু থাকতে হবে, আর সেই কারণেই পুরনো ইস্তানবুলের গলি, বাজার, প্রাসাদ, মসজিদকে চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে উঠতে দেখাটা একটা উপরি পাওনা। কিন্তু রহস্যকাহিনীর ভক্তদের কাছে জেসন গুডউইন চেনা নাম, আমাকে টানল এমন একটা সিরিজ যেটা টার্কি না এলে জানা যেত না। আহমেত উমিতকে বলা যায় তুরস্কের উম্বেরতো একো। অবশ্যই আসল উম্বেরতো একজনই, ‘নেম অফ দ্য রোজ’ লেখা একজনের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু আহমত উমিত-ও হেলাফেলা করার মতন লেখক নন। আজ অবধি খান কুড়ি বই লিখেছেন, সবগুলোই প্রায় সুপারহিট! ইতিহাসের পাতা থেকে রহস্য খুঁজে বার করতে (এবং সমাধান করতেও) এনার জুড়ি নেই। ইংলিশে সর্বসাকুল্যে খান তিনেক বই বেরিয়েছে। তারই একটা হল ‘দ্য দরবিশ গেট’ – পটভূমিকা জুড়ে রয়েছেন জালালউদ্দিন রুমি এবং রুমির স্পিরিচুয়াল গুরু শামস তাব্রিজি । আজ থেকে সাতশ বছর আগে  ইরাণের তাব্রিজ শহর থেকে হঠাৎ একদিন হারিয়ে যান শামস। বহু লোকের বিশ্বাস রুমি এবং শামসের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক সহ্য না করতে পেরে রুমিরই কাছের লোকেরা গুমখুন করেন শামসকে, কিন্তু প্রামাণ্য ইতিহাস কিছুই নেই (পড়তে গিয়ে শ্রীচৈতন্যর অন্তর্ধান রহস্য মনে পড়ছিল); এই বই সেই রহস্য নিয়েই। রহস্যের আনাচেকানাচে চমৎকার ভাবে সুফিসাধনার ইতিহাসকে নিয়ে এসেছেন, সিরিয়াস বিবলিওফাইলদের জন্য রেখে গেছেন প্রাচীন সব বইয়ের সূত্র ধরে জাল গোটানোর ইঙ্গিত – আর কি চাই!
jt-dg
ক্লাসে ঢুকেছি, উল্টোদিকে থেকে অ্যাকিলে প্রায় হাঁইমাই করে উঠলো “খাতা, খাতা”। অ্যাকিলে মানে অ্যাকিলিস আর কি, ইটালির ছেলে – ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইংলিশ, স্প্যানিশ এর পরেও আরো খান  দুয়েক ভাষা জানে। কিন্তু ওর ধারণা গ্রীক বীরের গোড়ালির মতনই তুর্কী হচ্ছে ওর প্রাণঘাতী জায়গা। এক্সপেকটেশন্স ছিল মাস দুয়েকের মধ্যে কথ্য তুর্কীতে রীতিমতন সড়গড় হয়ে যাবে  – আমি অবশ্য এহেন এক্সপেকটেশন্স শুনে হাঁ, তারপর হরিনাথ দে বা নরসিমহা রাও সুলভ জিনের কথা ভেবে চুপ করে গেছিলাম, কিন্তু সে আর হচ্ছে কই?  তারমধ্যে বান্ধবীকে ইস্তানবুল ঘোরাতে গিয়ে আগের ক্লাস মিস হয়েছে। সুতরাং, খাতা খুলে বোঝাতে হল রবিবারের নাম পাজার (রবিবার বোধহয় ছিল এদের হাটবার), রবিবারের পরেই সোমবার আসে বলে সেটা পাজারতেসি, মঙ্গলবার সালে , এই অবধি বেশ তুর্কী নাচন চলছিল। বেমক্কা বুধ আর বৃহস্পতিবারে ফারসি চলে এসেছে – চারসাম্বা আর পারসাম্বে। শুক্রবার অবশ্য ইউনিভার্সাল জুমা, শুক্রের পরেই শনি বলে সেটা দাঁড়াল জুমারতেসি। “গ্রাতসিয়ে, গ্রাতসিয়ে” বলে চলে গেল যদিও ক্লাসের নিয়ম অনুযায়ী বলার কথা তেশেক্কুরলার, কিন্তু বান্ধবীকে সদ্য এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে এসেছে, তাই আর উদব্যস্ত করলাম না। তুর্কী ভাষী শিক্ষিকার আর মিনিট দশেকের মধ্যেই ক্লাসে ঢুকে যাওয়ার কথা এবং শুরুতেই ক্যুইজ, তাই খাতায় চোখ বোলাচ্ছিলাম হঠাৎ কানের কাছে ভারী সুরেলা কন্ঠে কেউ ‘পারদন’ বলে উঠল। এখানে বলে রাখা ভালো আতাতুর্ক তুর্কী ভাষাকে আধুনিক রূপ দেওয়ার জন্য বহু বিশেষজ্ঞকে সংস্কৃতির পীঠস্থান  ফ্রান্সে পাঠিয়েছিলেন, লাটিন আলফ্যাবেট এবং বহু ফ্রেঞ্চ শব্দ তারই ফলশ্রুতি।
ঘুরে দেখি একটি মেয়ে ভারী কুন্ঠিত হেসে খাতাটি চাইছে, অ্যাকিলের মতন সেও ক্লাস মিস করেছে আগের সপ্তাহে। এ অবশ্য দেখলাম তুর্কী ভাষায় ওস্তাদ, সপ্তাহের বিভিন্ন দিনের নামগুলো আগেই জানে, খাতা দেখে একবার চেক করে নিল ঠিক জানে কিনা। তারপর ভারী মোলায়েম হেসে বলল “এক থেকে নয় অবধি মুখস্থ করেছি, ধরবে্ন প্লীজ?” ধরলাম, আট’কে ঠিকঠাক বলল সেকিজ, দশ আর নয় দিয়ে ঊনিশ হয় বলে দিব্যি বলে দিল ওন-দোকুজ, দেড় মানে যে বের বুচুক সেও চকিতে বলে দিল।  আমি এহেন পারদর্শিনী (এবং পারদর্শী) দের ভারী ডরাই, তাই তাড়াতাড়ি অজুহাত দেখিয়ে  খাতায় মুখ গোঁজার আগেই দেখি ফস করে ক্রিয়াপদ নিয়ে প্রশ্ন করছে, আফটার অল আমাকেও ক্যুইজ দিতে হবে কিনা। ওড়া আর জল খাওয়া এক করে দিলাম, গাড়ী চালানোকে বলে দিলাম ব্রেকফাস্ট করছি, জেগে উঠতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম – সে এক নাজেহাল কান্ড। আমার আসন্ন সর্বনাশে তার মুখে ছায়া ঘনাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি প্রশ্ন ঘোরাতে হল – “তুমি কি ফ্রেশম্যান নাকি সফোমোর?” প্রশ্ন শুনে কুটিপাটি অবস্থা , বলল “ঈশ্বর মঙ্গল করুন তোমার, আমি পি-এইচ-ডি’র ছাত্রী।” জানতাম প্রতিপ্রশ্ন আসবেই, অ্যাকিলে যাকে বলে ‘পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন’, “তুমি কি সিনিয়র ইয়ার?” বলতে বলতেই বোধহয় চোখ গেছে খোঁচা খোঁচা হয়ে থাকা দুইখান সাদা দাড়ির ওপর “নাকি মাস্টার্স?” তাতেও নিরুত্তর দেখে চোখ আরো বড় “ওঃ, আপনিও পি-এইচ-ডি?” এইবার বলতেই হল “নাহ, আমি হলাম গিয়ে পাজারলামা হোজা।” পাঠক, ঘাবড়াবেন না -  পাজার মানে তো বুঝতেই পারছেন আর হোজাও চেনা শব্দ, সেই যে হোজা নাসিরুদ্দীন যাকে সত্যজিৎ মোল্লা বলে পরিচয় করিয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে – অর্থাৎ কিনা, মার্কেটিং এর প্রফেসর। ‘লামা’টাও বুঝে ফেলেছেন নিশ্চয়, হ্যাঁ ‘বাবরনামা’ কি ‘বাঙ্গালনামা’ র নামা, মানে বিষয়।
সে বেচারি দেখি ভারী কাঁচুমাচু হয়ে পড়েছে, প্রফেসরকে ক্রিয়াপদ জিজ্ঞাসা করার মতন ঘোরতর অপরাধ খুব কমই আছে। মাফটাফ চেয়ে বলল “আমি কিন্তু হিন্দী সিনেমা ভয়ঙ্কর ভালোবাসি, শাহরুখের কোনো সিনেমাই ছাড়ি না।” আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম “নাহ, আমি ওকে টলারেট করতে পারি না।” ভারী অবাক হচ্ছিল কিন্তু হোজার ব্যাপারটা খেয়াল ছিল তাই একটু চুপ করে থেকে বলল “মিস্টার রওশনকেও আমার বেশ লাগে”। বুঝলাম হৃত্বিকের কথা হচ্ছে, আমি তাতেও ঘাড়া নাড়াতে এবার সূচীভেদ্য স্তব্ধতা – বোধহয় ভাবছে কি কুক্ষণে সিনেমার কথা আরম্ভ করেছিলাম। আমার এবার মায়া হল, বললাম “আ্মার ভালো লাগে আমিরকে”। চোখ পুরো জ্বলজ্বলিয়ে উঠল “তাই বলুন। অফ কোর্স, আমিরকে কার না ভালো লাগে। আমার তো ওকে মিস মুখার্জ্জীর কাজিনের সঙ্গে সিনেমাটাতে দারুণ লেগেছিল।” পাঠক, আমার এতক্ষণে খেয়াল পড়ল মেয়েটি ভারতীয় নয়, পাকিস্তানী-ও না। মিস মুখার্জ্জীর কাজিন শুনে এত অবাক হলাম বোধহয় পাক্কা মিনিট খানেক বাদে প্রশ্নটা বেরোল, “এক্সকিউজ মী, তুমি কোন দেশের?” ভারী সপ্রতিভ হেসে বলল “আমি ফারাহ, তেহরানে বাড়ি – আঃ, এতক্ষণে নামটা মনে পড়েছে, কাজল, কাজল।” আমি এত ইম্প্রেসড কি বলব, নিজের স্টুডেন্ট হলে এক্সট্রা ক্রেডিট দিয়ে দিতাম! ওকে আর বললাম না, ‘ফনা’ খুব একটা সুবিধের লাগেনি, ততক্ষণে কানে আসছে “আর রনবীর সিং কে আজকাল আমার দারুণ লাগছে, সোনাক্ষী কি লুটেরা-তে ওজন একটু কমাল?”
থ্যাঙ্ক ইউ বলিউড, অগুন্তিবারের সঙ্গে আরো একবার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন