বুধবার, ২৮ মে, ২০১৪

কলকাতা টু সারপ্রাইজ অঞ্চল ভায়া দিল্লী, কাশ্মীরে

ঢাকা থেকে বেনাপোল:
আগস্টের শুরুর দিকে। টান টান উত্তেজনা ঘরময়। পরিবারের প্রবীণ সদস্য হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমাদের ঠিক সেই সময়ই অন্তত দশ-বারোদিনের জন্য দেশ ছাড়ার ইচ্ছে। আর যাই হোক, কাউকে অসুস্থ রেখে তো যাওয়া যায় না। বর বেচারা মুখ হাড়ি করে ঘুরছে। কারণ একবার বাসের টিকেট হাতছাড়া হয়ে গেলে আর পাওয়া রীতিমতো অসম্ভব। তাও নয় আগস্টের তারিখের টিকেটটা হাতছাড়া হয়ে গেল। রইলো হাতে ৮ তারিখের টিকেটের অপশন। মেডিকেল রিপোর্ট হাতে আসবে ৭ তারিখে। ঐ রিপোর্টের উপরই সব নির্ভর করছে তখনও। ওদিকে আমাদের এবার ইচ্ছে ছিল ঈদের আগের দিন বাড়ি ফিরে ঈদটা করবো। অর্থ্যাৎ শ্যামবাবুকে বশ করা সাথে কূলও রক্ষা আর কী! অবশেষে ৭ তারিখে অফিস থেকে বরকে ফোন দিলাম। আমি কিছু বলার আগেই সে বললো, "৮ তারিখে যাচ্ছি.. ব্যাগ গোছানো শুরু করো।" লাফনো মন নিয়ে বাড়ি ফিরে প্যাকিং শুরু করলাম।
এবারকার প্যাকিংটা বেশ অন্যরকম। সবসময় কলিকাতা যাই দুইসেট কাপড় আর প্রায় শূণ্য সুটকেস নিয়ে। এবার তো আর কলিকাতা নয় সাথে দিল্লী আর বরের এক সারপ্রাইজ (সেই সারপ্রাইজের উদঘাটন হবে পরের পর্বে)। ফলে ব্যাগ এবার ঢাকা থেকেই বেশ বোঝ-বোঝাই। ৮ তারিখে তড়িঘড়ি করে অফিস থেকে ফিরে প্রায় তৈরি হয়ে আছি মাগার আমার বরের দেখা নাই। তেনার কি অফিসের মিটিং পড়েছে -এই সেই। এবার আমি মুখ হাড়ির মতো করে বসে রইলাম। তিনি ফিরলেন রাত দশটায়! বাস ১০.৩০-এর। এবং এই সময় মেসবাহ ভাইয়ের সময় নয়!! সত্যি সত্যি ১০.৩০!! কোনমতে বের হয়ে রিকশা নিলাম, জ্যামে পড়লাম। যখন বাস স্টপেজে পৌঁছালাম তখন বাজে ১০.৪৫। দেখলাম, বাসও জ্যামে। আসেনি তখনও। বাসে চাপলাম ১১টায়। সেই বাস সাভার ত্যাগ করলো রাত্রী ১.৩০টা নাগাদ!! এরপর যা হলো তা ইতিহাস। বাস-ওয়ালা কি খেয়েছিল আল্লাহ মালুম। পাখির মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল বেনাপোলে বাসটাকে অতি অল্প সময়ে। আর আমি বেচারা সব সময়ই চাকা ঘুড়ার আগেই যেখােন ঘুমিয়ে যাই, সেখানে সারা রাত কেন যেন উল্লুক হয়ে রইলাম!! তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সেই ইতিহাস। অত:পর ঝামেলা ছাড়া বর্ডার পার। ভারতবর্ষে পদচারণের সূচণা।
পার হয়ে বর্ডার-এ কেমন অর্ডার!
ভালোয় ভালোয় বর্ডার পার করে বাসে উঠে বসলাম। বেনাপোল কাস্টমস অফিস এমনিতে বড়ই বিরক্তিকর। এটা এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। এর আগে আমাকে বলেছিল- আমি নাকী আমি নই..!! কি যে আজব প্রানী এরা! সে আরেক বিশাল ইতিহাস। বর্ডার থেকে আমাদের সাথে নিজের দেশে এলো ১৪ জন বিভিন্ন মেডিকেল পড়ুয়া কাশ্মিরী ছাত্রী। তারা বেশ "হইসে"- "গেছে" রপ্ত করে ফেলেছে।
যাই হোক বাসে উঠার পর যে ব্যাটা সুপার ভাইজার সে ফোনে আলাপ শুরু করলো। একটু পরপর বাস থামায় আর সবাইকে জিজ্ঞস করছে কে কত ডলার ভাঙিয়েছে। খামাখা দেরী হচ্ছে বলে সবাই বিরক্ত! কিন্তু দাদা শুনে কার কথা!! আমাদের গাধা বানিয়ে ৫ মিনিট পর পর বাস থামিয়ে সে তার কাজ করছে। অবশেষে জানা গেল কোন একজনের ডলার নাকী জাল। ব্যাটা দাদা ঘোষণা দিল বর্ডারের মান এক্সচেঞ্জ থেকে লাক না আসা পর্যন্ত বাস ছাড়বে না! বাপের রাজ্য আর কি। পরে সবার তোপের মুখে এক পরিবারকে নামিয়ে রেখে বাস নিয়ে চলে এলাম। সেই পরিবার থেকেই নাকী জাল নোট এক্সচেঞ্জড হয়েছে। শত শত লোকের ভীড়ে কি করে তাকে ম্যানেজার ব্যাটা ধরতে পারলো বুঝলাম না!! তার দাদাগিরির ফলে কলকাতায় আসতেই বেশ ক্ষাণিকটা দেরী হলো।
(যদি আল্লাহ না করুক এমন কোন কেউ পরিস্থিতে পড়েন চোখমুখ শক্ত করে বসে থাকবেন। কারণ নোট জাল হলে বুথ থেকে তৎক্ষণাৎ সেটা ধরা পড়ার কথা- আধাঘণ্টা পরে নয়। এটা কোন ফাঁদ হতেই পারে)
মার্কুইস স্ট্রীটের হত্যা রহস্য!!
বরাবরের মতো যে হোটেলে থেকে আমরা অভ্যস্ত সেই হোটেল শুধুই হতাশা হয়ে রইলো। কোন সিট নেই। সব নাকী বাংলাদেশিতেই ঠাসা!! কথা আসলেই সত্য। নিউমার্কেট এলাকাটায় এক চক্কড় দিলে ছুটির সময় পরিচিত দলের সাথে যোগাযোগ হবেই হবে। এবারও জানি অনেকেই যাচ্ছে। দেখা হবে- এই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে উঠে পড়লাম আরেক হোটেলে। আগেই বলে নেই। ভ্রমণকারী হিসেবে আমাদের জুটিটা অতটা বিলাসী-প্রিয় নই। যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই আমরা ব্যয় করি। আর মনভরে খাওয়া-দাওয়া করি, প্রাণ ভরে সিনেমা দেখি। হোটেলে ফিরে হাতমুখ ধুয়েই বেরিয়ে পড়লাম সবসময়ের মতো। কলকাতা গেলে আমরা দুই জনই কিছু না কিছু সারাক্ষণ খেতে থাকি। এবার তার ব্যতিক্রম হবে কেন? শুরু হলো প্রিয় ম্যাঙ্গো লাচ্ছি দিয়ে। ৩০ রূপি দিয়ে এতো বড় গ্লাসের লাচ্ছি- কি দারুণ কি দারুণ!! এরপর মারিয়ার চিকেন চাওমিন আর মোমো। পেট ঢোল করে চলে গেলাম ফোরামে। উদ্দেশ্য ব্যাটম্যান দেখবো। গিয়েই দেখা হলো আরেক বন্ধু দম্পতির সাথে। যদিও কেনাকাটা করবোই না- তারপরও টুকটাক কিনছি তখন থেকেই। সিনেমার অনেক বাকী। পাপড়ি চাট, পানি-পুড়ি, চা খেয়ে বেশ সময় যাচ্ছে। বর-মশাই আসছে পুজার আনন্দমেলা কিনে িনল। আশেপাশের মার্কেটে ঘুরাঘুরি করে শো-এর আগে ফিরে অসাধারণ মুভিটা দেখা হলো। ফিরলাম চারজন একসাথে। পরদিন রাতের আহার একসাথে করবো বলে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরে আনন্দমেলাতে চোখ বুলাতেই দেখলাম সূচীপত্রে লেখা, "মার্কুইস স্ট্রীটে হত্যা-রহস্য"। আমি চোখ গোল গোল করে বরকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা যেখানে আছি, সেটা মার্কুইস স্ট্রীট না? সে বললো- হ্যা। এরপর দুইজন মিলে কত রহস্য কল্পনা করে ফেললাম!! না করে উপায়ই বা কি?? চারটি ঘিঞ্জি বাড়ি যুক্ত করে একটি রিসিপশন বানিয়ে হোটেল! কত যে চিপাচাপা! এখানে অনেক রহস্যই থাকতে পারে! আমরাও গল্পের কল্পে জিনিষপত্তর ভালোভাবো গুছিয়ে রাখলাম..আর আশেপাশে রহস্য খুঁজতে লাগলাম।..
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া..
যেহেতু একটা পর্যায়ে ভ্রমণ প্রায় অনিশ্চিত ছিল, বর বেচারা আর কোন কানেকটিং ফ্লাইট বা রেলের টিকেট কাটেনি। ভাগ্যক্রমে যে হোটেলে উঠেছিলাম আফরিনের ছ্যাকা খেয়ে- সৌভাগ্যক্রমে দেখি ঐ হোটেলের নীেচই একটি দোকান আছে যেখান থেকে দিব্যি টিকেট বুক করে ফেলা যায়। সেখান থেকে কলকাতা থেকে দিল্লী আর দিল্লী থেকে "সারপ্রাইজ" অঞ্চলের টিকেট কাটা হলো। যেহেতু সারপ্রাইজ- আমি বাইরে হাটাহাটি করছি। টিকেট প্রসেস করতে করতে মাগরিবের আজান দিয়ে দিল। দোকানের সবাই মুসলিম বলে তখনকার মতো কাজ বন্ধ করে দিলেন বটে.. কিন্তু টিকেটের ব্যাপারে আশ্বস্ত করলো। আমরা বের হয়ে চা খেলাম। ঐ অতটুকু মাটির পাত্রর চা খেয়ে আমার মন ভর না। দু-তিনবার খেতে হয়। প্রতিবারই পাত্র গুলো ফেলে দেয়। ভাবলাম, আমাদের দেশে ধর্ম নিয়ে মানুষের কত চিন্তা! অমুকে নামাজ পড়ে ক্যান! তমুকে হিজাব নেয় ক্যান!- কত শত প্রশ্ন। অথচ পাশের দেশেই ছূ্ৎ-অচ্ছুৎ, যে যার ধর্ম নিজেদের মতো পালন করছে। কেউ কোন মন্তব্য করছে না। ওখানে কোন আমাদের মুল্লুকের "অসাম্প্রদায়িক" বলুক দেখি, একই পাত্রে চা খাওয়ার জন্য! আই বেট। বিদেশ গেলে দেশি ভাইরা সব নিয়ম মানে.. দেশেই কেবল মানতে নারাজ।
মমতার মমতা:
কলিকাতা নিয়ে লেখার আসলে কিছু নাই কমবেশি সবাই সব কিছু জানেন। তাই ঐ পথ মাড়ালাম না। বরং মমতা দিদির কিছু কাজ দেখলাম। যেমন কলকাতার বিভিন্ন স্ট্রীটগুলো সবুজ বোর্ডে নতুন করে জ্বল জ্বল করছে। কীড স্ট্রীট, টর্টি লেন, কেমাক- কোনটাতেই এখন হারানোর উপায় নেই। রাস্তায় রাস্তায় তিন বাতির একটি করে লাইটপোস্ট একটু পরপর। পুরো কলকাতা ঝলমল করছে রাতের বেলায়। ট্রাফিক আইন হয়েছে আরো কড়া। দিদি যতই বেশি কথা বলুক না কেন- নিয়মনীতিতে মাৎ দিচ্ছেন বলে মনে হলো। সকালে বরাবরের মতো ব্লু -স্কাইতে নাশতা করে সারাদিন এই মার্কেট সেই মার্কেট আর রাতের বেলা বন্ধু দম্পতির সাথে খেয়ে দেয়ে দিনটা চমৎকার কাটলো। পরদিন আবার রাজধানী ট্রেন। আমি প্রথমবারের মতো দিল্লী যাচ্ছি, মনের ভিতর ভুটুর ভুটুর করে লাড্ডু পরস্ফুটিত হচ্ছে..কিন্তু এ আবার কি?? পেট কেন গড়বড় করছে.. চিন্তার বিষয় বটে!
পর দিন বিকেল ৪.৩০ পর্যন্ত ব্যাপক খাওয়া আর ঘুরার পর জ্যামের কথা মাথায় রেখে আগেই রওনা দিলাম হাওড়ার উদ্দেশ্যে। যদিও "জিসম টু" না দেখতে পারার বেদনায় জ্বলছি..তারপরও এখনও তো পথ বাকী!
রইলাম দিদির অঞ্চল থেকে দিলওয়ালাদের অঞ্চলে যাওয়ার অপেক্ষায়..

# রাজধানী ট্রেনে-যা এলাম জেনে
ট্রেন ছিল বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ। বৃষ্টিস্নাত কোলকাতায় ঘুরে ভরপুর খেয়ে ঘুরাঘুরি শেষে হাওড়ার উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। হাতে অনেকক্ষাণী সময়। কারণ হাওড়াতে গিয়ে প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পেতে কতক্ষণ লাগবে আদৌ জানি না। যথা সময়ে স্টেশন পৌঁছে জানা গেল প্ল্যাটফর্ম ১১তে গেলে ঠিকঠাকভাবে উঠে যেতে পারবো। গোছানো স্টেশন! ট্রেনও এলো যথাসময়ে। যথাসময় মানে একদমই যথা সময়। বগির বাইরে নাম দেখলাম। নাহ লিস্ট ঠিকই আছে। উঠেই দেখলাম দুই জন ইতিমধ্যে আছেন। আমরা দুইজন। আরো দুইজনের অপেক্ষা।আমাদের দুইজনের সিট হলো মিডল আর লোয়ার ব্যাঙ্কার। উপর তলায় কারা থাকবেন- আমার মনের মধ্যে তখন বিশাল তুফান এটা নিয়ে। ঠিক চারটে ছত্রিশ মিনিটে ট্রেন ছেড়ে দিল। ভাবছি আমাদের "কাদের সাহেব" একবার এসে এখানে ঘুরে গেলেই বুঝতেন সার্ভিস কাকে বলে! থাপড়ানো-চটকানো বাদে নিয়মটাকে অশীথিল করলেই ল্যাঠা চুকে যায়।
ট্রেনে উঠেই মনটা ভরে গেল। সুন্দর সিট। চমৎকার সেন্ট্রাল এসি। সবাই ট্রেনে সিট পেয়ে রীতিমতো ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেললো। জুতামোজা খুলে ঘুমিয়েই পড়ে আরকী। (অবশ্য ভয় লাগছিল মোজার গন্ধের জন্য)। আমরাও মোটামুটি গুছিয়ে নিলাম। স্বস্তি- বাকী দুজন নেই। চারজন মিলে ছয় জনের সিটে আয়েশ করে বসতেই খানা-পিনা শুরু। লাড্ডু-সিঙ্গারা-জুস-চা-স্যান্ডউইচ সহ বিশাল এক একটা নাশতার প্লেট ধরিয়ে দিল। অবাক হলাম সিঙ্গারাটা গরম দেখে।
বাইরে তখনও আলো। তাকিয়ে দেখছি ট্রেনের মেকানিজম। কিছুদিন আগে পেপারে পড়ছিলাম, বিদ্যুতের কারণে ট্রেনের একটা দুঘর্টনা হয়েছিল। বিষয়টা পরিষ্কার ছিল না আমার কাছে। ট্রেনে উঠে বুঝলাম ঘটনা। ট্রেন গুলোর বগির উপরে নির্দিষ্ট দুরত্ব পরপর আছে একেকটা স্ট্যান্ড-এর মতো যা ট্রেন লাইন জুড়ে লম্বা হয়ে টানা বিদ্যুতের তারের সাথে ঘষর্ণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করে। আর ট্রেন ছুটে যায় তীরের বেগে। বিষয়টা নিজের চোখে দেখে মনে মনে ভাবলাম, ইনশাল্লাহ একদিন বাংলাদেশেও এমন দিন আসবে যেদিন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ থাকবে আর বিদ্যুৎবেগে ছুটবে এসময়ের "কালোবিড়াল" ভরা ট্রেন ঘোড়া হয়ে..
জ্ঞান আহোরণের পরপরই আরেকদফা খানা চলে এলো। এলাহী কাণ্ডে ভরা খানা। ততক্ষণে আলো তো নিভে গেছেই। আমাদের দুই প্রতিবেশি ঘুমানোর প্রস্তুতিও নিয়ে নিয়েছে। কেনই বা নিবে না, পরিষ্কার বালিশ, একটা চাদর, একটা কম্বল, আরামদায়ক বাঙ্কার সব মিলিয়ে ঠিকঠাক ব্যবস্থা। খাওয়ার পর আমি আর আমার বর বেশ প্রশংসা-প্রশংসা ভাবে কথা বলছি, ওমনি সামনের দাদা বলে উঠলো, আগে কত ভালো ছিল দাদা..এখন দেখেচেন? চিকেনের পিসগুলো কত ছোট! ডাল দিয়েচে এক রত্তি!! আইসক্রিমও গলে গেচে..- বলতে বলতেচাদর টেনে শুয়ে পড়লো..আমি হেসে বরকে বললাম- আমাদের কালো বিড়ালের থলিতে দাদা একদিন চড়লে এটাকে বেহেশত বলবে যে..
# পাহাড়গঞ্জের আবুলরাজ্য
ট্রেন থামলো এক্কেবারে সঠিক সময়ে। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি নাশতা রেডি। ততক্ষণে ট্রেনের টয়লেট আর বেসিনের সামনে মনে হচ্ছে গলির লাইন। দাড়ি কাটছে, ব্রাশ করছে, টাওয়েল গামছা নিয়ে যে যার মতো কাজ করছে, মনে হচ্ছে যেন অফিসের জন্য প্রস্তুত! আমরা যেহেতু সোজা হোটেলে উঠবো তাই লাইন না ধরে ট্রেন থেকে নামলাম। ট্রেনের গেটেই কুলি, দুটো শুকনো পটকা সুটকেস দেখে দাম চাইলো ৮০০ রূপি। আমার বর হেসে বললো, আপনি চলে যান, আমরা দুজনেই নিতে পারবো। দিল্লির এই প্রথম আবুল দ্যা ঠগবাজের সাথে দেখা হলো এভাবেই। ট্রেনের গেট থেকে নামতে না নামতেই ঠিক টেনিদার মতো একজন হাজির। ঠগবাজ পার্ট টু। সে আমাদের এই দিকে নিতে চায় তো সে দিকে। বর আমাকে আগে থেকেই সতর্ক করে রেখেছিল, টেনদাকে বিন্দু মাত্র পাত্তা না দিয়ে যেতে থাকলাম স্টেশনের বাইরে। টেনিদা তো ছাড়েই না। এরপর আবারো মুগ্ধ হলাম স্টেশনের বাইরের স্বাগতম বিভাগের কাজে।তিনি এসে অ্যায়সা ঝাড়ি দিল টেনি টুনটুন করে পাশে সরে গেল। পিছু ছাড়লো না। আমরা বের হয়ে সরকারি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে বসে দরকারি কাজ করতে করতে দেখলাম রাস্তার ওপারে টেনি আমাদের উপর নজর রাখছে..কি বিপদ!! ওদিকে এজেন্সির যে আমাদের কাজ সমাধা করছে সেও দেখতে টেনির মতোই!! এদের পূর্বপুরুষের কর্মকাণ্ড নিয়ে ভাবতে ভাবতে চলে এলো আমাদের ট্যাক্সি। পাঞ্জাবী ড্রাইভার। দুই টেনিকে পিছে ফেলে চললাম কেরোলবাগ, হোটেলের উদ্দেশ্য..
# লেনা কম্পলসারি নেহি হ্যায়- দ্যা সানি দেওল টোন
চমৎকার হোটেল। আমরা খুশি। যেহেতু ট্রেনে ভাল ঘুম হয়েছে, তাই ভাবলাম সেদিনই কুতুব মিনার, প্রেসিডেন্ট ভবন, ইন্ডিয়া গেট ঘুরে আসবে..মানে যতদূর দেখা যায়। আমার প্রথম দিল্লী ভ্রমণ বলে কথা। ট্যাক্সি নীচে স্ট্যান্ডবাই। ফ্রেশ হয়ে নামতেই ড্রাইভার পাপাজির প্যাচাল শুরু। বুঝতে কষ্ট হলো না যে এই লোক বড়ই চতুর, যেখানে যেতে সুবিধা সেখানেই যাবে। আর যাবে কিছু অবধারিত স্টলে। যে স্টলগুলোতে কাস্টমার নিয়ে গেলে তারা কমিশন পায়। আমাদের ছলাকলা বোঝাতে বারবার সে বলে গেল, "লেনা কাম্পলসারি নেহি হ্যায়, মাগার বিশ সে পচিশ মিনিট রুখ যাও।" কি বিপদ! দিল্লী কি দোকান দেখতে এসেছি? তাও গেলাম। কি আর করা। কলার খোসার শাড়ি! ভুট্টা বিচি দিয়ে বোতাম!! মনে মনে বলছি, আয় আমাদের দেশে, দেখবি খোসা থেকে শুরু করো পাতা পর্যন্ত সবকিছু আমরা ব্যবহার করি- এমন কি খেয়েও ফেলি। ..
আর এই পাপাজির কণ্ঠের টোনটা এমনই যেন মনে হচ্ছে ধর্মেন্দ-পুত্র সানি দেওল গাড়ি চালাচ্ছে..পাপাজির পকড়পকড়ে এতোই বিরক্ত হয়েছিলাম যে শেষদিন আমরা ট্যাক্সিকে বিদায় করে দিল্রী মেট্রোতে ঘুরেছি। বিশ্বাস করুন সেটাই স্বস্তির। আমরাও ঠিক করেছি, কোলকাতার মতো দিল্লীতেও এরপর থেকে নো ট্যাক্সি- পাবলিক ট্রান্সপোর্টই যথেষ্ট।
প্রেসিডেন্ট ভবন দর্শন:
দোকান-ফোকান তো ছাড়! প্রেসিডেন্ট ভবন দেখে মন ভালো হয়ে গেল ইয়া ক্যাসলের মতন বড়। দেখলেই ভালো লাগে।অসম্ভব সিকিউরিটি। খুব কম সময় থাকলাম। প্রেসিডেন্ট ভবনের গেট থেকে বেশ ক্ষাণিক দূরেই ইন্ডিয়াগেট। ওদের স্বাধীনতা দিবসে যে প্যারেডটা হয় সেটা হয় প্রেসিডেন্ট ভবনের মূল ফটক থেকে ইন্ডিয়াগেট পর্যন্ত। আমরা যখন গেলাম তখন এই প্যারেডের সেরকম প্রস্তুতি চলছে.. তাই আরো বেশি কড়াকড়ি..
Kashmir_003.jpg
# কুতুব মিনার সের- আলাই হতো সোয়া সের
প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে এবার যাবো কুতুব মিনার। আমি আর আমার বর মাত্র দশ রূপি দিয়ে প্রবেশ করলাম। ওদিকে গেটের বাইরে দেখলাম কেরালার এক পরিবার বলাবলি করছে, এ আর দেখে কি হবে.. মনে মনে কইলাম, হ মক্কার মানুষই হ্বজ্জ্ব পায় না।
কুতুব মিনার এক কথায় আমার কাছে অসাধারণ লাগলো।কুতুব মিনারের গায়ে খোদাইকৃত কাজ আর কোরআনের আয়াত দেখে। কি সুন্দর মোটিফ আর আর্ট ওয়ার্ক! সবমিলিয়ে বড্ড প্রশান্তির জায়গা।বিশাল বড় এলাকা জুড়ে থাকা কুতুব মিনার অঞ্চলে মাজার আছে, স্তম্ভ আছে, কবর আছে, রহস্যময় লৌহদণ্ড আছে..আর আছে সুকারুকাজে ঠাসা দেয়াল। অল্প দুরত্বে আছে আলাইমিনার। সে আবার কি? কুতুব মিনারে মতো অসাধারণ স্থাপত্যের পর পরবর্তি শাসক মনে করলো এরচেয়ে বড় একটা কিছু না বানালেই নয়!! তখন, আরেক পক্ষ তার চেয়ে বড় "আলাই মিনার" তৈরিতে হাত দিয়েছিল, যেটা আর শেষ হয়নি আদৌ। হলে কুতুব মিনারের চেয়ে আড়াই গুণ বড় হতো.. সেটা কুতুব মিনারে প্রবেশের গেটে রাখা মানচিত্র বেশ বোঝা যাচ্ছিল। আমাদের দেশে অবশ্য এমন কিছু করতে চাইলে আগে পুরোনটা ভাঙ্গা হতো আর নতুন করে বাজেট পাশ হতো এবং আলটিমেটমেটলি যেটা হতোই না..জাতি খালি ইতিহাসরে কচলায়..ইতিহাস থেকে কিছুই শিখলো না..
Kashmir_008.jpg
কুতুবমিনার
Kashmir_019.jpg
অসাধারণ কাজ
Kashmir_020.jpg
আলাই মিনার
আসলেই গ্রেট- ইন্ডিয়া গেট
পাপাজির দোকান ভ্রমণ করতে করতে অবশেষে এলাম ইন্ডিয়া গেটে। ইয়াব্বড়।আর স্বাধীনতাদিবস নিয়ে বেশ হুলস্থুলও সেখানে। আরেক আবুলের সাথে দেখা। আনমনে ইন্ডিয়া গেট দেখার ফাঁকে কাগজের ভারতীয় পতাকা জামায় সেঁটে বলে ২০০ রূপি দাও। দিলাম ১০ রূপি। দিদি কিন্তু তাতেও খুশি.. Tongue
Kashmir_024.jpg
# আবুল চারিধার- পালিকাবাজার
পালিকা বাজার নামে যে বাজার সেটা মোটামুটি বিরাট মার্কেট। সব কিছু পাওয়া যায়। অনেক দাম চায় তার ছয়ভাগের একভাগে বিক্রি করে টাইপ অবস্থা্। অস্বস্তির কারণ ছিল টানা হ্যাচড়া করার বিষয়টা। ধরেন এক দোকানে দাঁড়িয়ে কিছু দেখছি, হাত ধরে টেনেটুনে অন্য দোকানে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম।আবুলে -আবুলে সয়লাব। তারপরও, বিখ্যাত মার্কেট না এলেই নয়। কিনলামও টুকটাক জিনিষ। তবে হাপ ছেড়ে বাঁচলাম বের হয়ে.. এরপর দিল্লী এলেও পালিকা বাজারে আর নয় বাপু! এই লাড্ডু ঢের খেয়েছি এবার!!
# দিল্লী হাট- বাজার ঘাট
ঢাকা শহরে কত গুলো বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার আছে বলুন তো? দিল্লীতে তেমনই দিল্লি হাটও আছে অসংখ্য। আমরা সবগুলোতেই গেলাম। অসম্ভবদাম সবকিছুর। বাপরে বাপ। আসল দিল্লী হাটে খেলাম "রাজস্থানী থাল" ..আমাদের বাঙ্গালদের মুখে রুচলো না সেই খাবার। ক্ষাণিকবাদেই আবার খেলাম প্রিয় চাওমিন। আহা..
রাজস্থানী থাল-এর চেহারাও দেখুন না...বুঝবেন..
DSC02430_1.jpg
রাজস্থানী থাল
#দিল্লী বিল্লি
আমি যাবই যাবো দিল্লীর বিরিয়ানি খেতে। বের হলাম। গেলাম দিল্লিসিক্স। আমাদের পুরানো ঢাকার চেয়েও ঘিঞ্জি এলাকা। আর যেকোনা এলাকার চেয়ে আন-হাইজেনিক। জামে মসজিদ আর লালকিলা দেখে ফেরার পথে করিম'স এ বিরিয়ানি খাওয়ার বড্ড ইচ্ছা ছিল। কিন্তু গন্ধ আর মাছি-পোকার উৎপাতে সেই আশা বিসর্জন দিলাম। আবার না দিল্লী বিল্লি হয়ে যায় এই ভয়ে..তবে লাড্ডু, মিষ্টি আর সমুসা খেলাম বটে।
না বললেই নয়, জামে মসজিদ এতটা বড় যে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। বিশাল মিনার, বিশাল প্রান্তর ..তার মাঝে অসংখ্য পর্যটক। আমরা দুজন চুপচাপ সিড়িতেই বসে ছিলাম কিছুক্ষণ..
এরপর রিকশা করে ঘুরলাম..সিটি ওয়াক মলে গেলাম মেট্রোতে করে..খুব সুন্দর মল..বিশাল বড়..থিয়েটার আছে .. বর্ন লিগেসিটা দেখে আসলাম..আর খাওয়া দাওয়া কেরোলবাগেই..চমৎকার বিরিয়ানি আর আফগানী কাবাব। আর লাছ্ছি লা-জওয়াব এক কথায়।.. যতদিন ছিলাম এক বেলা অন্তত বিরিয়ানি খেয়েছিই..
Kashmir_031.jpg
..
দিল্লী হইতে কাশ্মীর- সারপ্রাইজ হইলো চৌচিড়:
দিল্লী থেকে কাশ্মীরের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরুর আগে একটু ফ্ল্যাশব্যাক না বললেই নয়। ভ্রমণের শুরু থেকেই বর বেচারা আমাকে সিমলা- মানালির গল্প বলে আসছে। কিন্তু সে ঠিক করেছে কাশ্মীর ভ্রমণ। সারপ্রাইজ দিবে বলে কিছুই বলেনি। কিন্তু ফাঁপড়ের ফেসবুক কি আর প্রেম বোঝে! একদিন ইনবক্সে দেখলাম মেসেজ এসেছে, তোমরা নাকী কাশ্মীর যাও? আমরাও যাচ্ছি..
বলা বাহুল্য যে বন্ধু দম্পতির সাথে কলিকাতায় আহার সাড়লাম, তাদেরই একজন। কোন সন্দেহ নাই মেসেজ পেয়ে মনে একসাথে হাফডজন লাড্ডু ফুটলো..রিপ্লাই দিলাম, "সারপ্রাইজ খোলাশা করার জন্য ধন্যবাদ".. বন্ধুটি চম্পট..আমিও মুখে তালা দিলাম..
দুইদিন পর অফিসে গেলাম। এক সহকর্মী ভরা মজলিশে ঘোষণা দিলেন, এই তোরা নাকী কাশ্মীর যাস..! কোনমতে পালালাম.. বেচারা বর এতো কষ্ট করছে সারপ্রাইজ দেয়ার.তাকে অন্তত নিজে থেকে বলার সুযোগ দিতে চুপ রইলাম.. দিল্লীতে পৌঁছানোর পর সে না বলা পর্যন্ত কিছুই বললাম না।..
এবার ফিরে আসি ভ্রমণে..
দিল্লীর শেষ দিন- কাশ্মীরের পথে ধিনাক ধিনাক ধিন..
দিল্লীর শেষ দিন বলতে শহরটা দেখা। কিন্তু গরমে ভর্তা হয়ে শেষ পযর্ন্ত চলে গেলাম সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা থিয়েটার। সিনেমার নাম, গ্যাংজ অফ ওয়সিপুর.. বাজী রেখে বলতে পারি, তাপদাহ না থাকলে জীবনেও এই সিনেমা দেখা হতো না। যতরকমের গালি আছে হিন্দী ভাষায় সব শেখার জন্য এই একটা সিনেমাই যথেষ্ট। তবে, শেষ পর্যন্ত সিনেমা সম্বন্ধে বলবো, ইন্টরেস্টিং..
দিল্লী শহর ছেড়ে যাচ্ছি..বিরাট হনুমানজিকে টাটা দিলাম। শহরের মোড়েই ঠায় দাঁড়িয়ে হনুমানজি। দুই হাত বুকের কাছে ধরা। প্রতি বৃহস্পতিবার হনুমানজির হাত খুলে যায়, ভিতর থেকে প্রতিয়মান হয় রাম-সীতার উজ্জ্বল মূর্তী..
আবারো দিলাম টা টা.. এলাম পাহারগঞ্জ। যথাসময়ে ট্রেনে চেপে বসলাম। রাজধানী ট্রেন। দেখা হলো সোনালি আর আকাশের সাথে। ওরা যাবে জম্মু পর্যন্ত। ট্রেনও জম্মু পর্যন্তই। স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে যাবো কাশ্মীর-এই হলো প্ল্যান। যেতে যেতে অনেক কথা হলো অন্য দুই বাসিন্দার সাথে। ওখানকার কিছু কথা আগেই দিয়েছি..
তারপরও না বললে নয়, ওরা থাকাতে ট্রেন ভ্রমণটা খুব বেশি ভালো হয়েছে..
জম্মু টু কাশ্মীরের পথে- রনজিতের রথে
ভোরবেলা ট্রেন এসে থামলো জম্মু স্টেশনে। কথা ছিল স্টেশনে নেমেই ট্যাক্সি পাবো..কিন্তু রনজিৎ নামের ড্রাইভারটি ফোনে জানালো, তার একটু দেরি হবে। সেই "একটু" আমাদের জন্য প্রহসন হয়ে রইল। স্টেশনটি ভয়ঙ্কর নোংড়া। কোন মানুষ মনে হয় দেয়ালেঘেরা টয়লেট ব্যবহার করে না। সবাই রাস্তায়!!.. স্টেশনের পাশেই "মল" নিষ্কাশনের খাল...মাছিরা উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে এদিক সেদিক যায়। আমরা ভয়ে দাঁড়াচ্ছি না। নড়াচড়ার উপর আছি..একটা মশা গায়ে পড়লেই কম্মকাবার..
ওদিকে রনজিৎ সাহেবের দেখা নাই..ফোন করছি- কিন্তু অন্যের ফোন থেকে। কারণ জম্মু -কাশ্মীরে অন্য অঞ্চলের সিম চলবে না। নতুন সিম নেয়া আরেক বিশাল হ্যাপা..অতএব এর ওর কাছ থেকে ফোন নিয়ে ফোন করছি.. সেই কাকডাকা ভোরে যে দুই তিনটা লোক ওই এলাকায় এসেছিল, সেটাই বাঁচোয়া..
অবশেষে রনজিত এলো..আল্লাহ সহায় কোন সানি দেওলের ক্লোন আসেনি।
ঝটপট উঠে রওনা দিলাম কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে। ট্রেনে আসতে লেগেছে নয় ঘণ্টা। বাকি পথ যেতে ট্যাক্সিতেও লাগবে নয় ঘণ্টা। তাও ভালো.. চলি তো..
মেঘের ডানায় চড়ে- যাচ্ছি জম্মু ছেড়ে..
পুরোটা রাস্তা এক কথায় অসাধারণ। খালি আমরা উপরের দিকে উঠলাম। পাহাড় ঘিরে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে লাগোয়া পাহাড়ে। মাঝে মাঝেই পথ আগলে বেড়াচ্ছে টুকরো টুকরো মেঘ। আমার আবার বিশেষ মেঘ প্রীতি আছে। চিৎকার দিয়ে উঠছি খুশিতেই। আবার ভয়ও লাগে রনজিৎ সাহেব না আবার ভড়কে যায়। তবে বলতেই হয়, ড্রাইভার সাহেব চালায় দুর্দান্ত। সারাটা রাস্তা চালালো মনযোগ দিয়ে। পথিমধ্যে থামলো এক জায়গায় চা খাওয়ার জন্য।ছুপড়ি এলাকা। চা খেয়েই আবার পথচলা শুরু। যাত্রাপথে রনজিত শুধু বিভিন্ন ফটোসেশনের স্পট নিয়ে কথা বললো..কোন বাড়তি কথা নেই পাপাজির মতো।
DSC02471_1.jpg
আরো উপরে একদম মেঘের কোলে এসে গাড়ি ভিড়লো আরেকটি চা খাওয়ার পয়েন্টে। নাম টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট। চা টা খুবই মজার। কলকাতার মতো এদ্দুড়ো দেয়না। অনেকক্ষাণী দেয়। আর ঠাণ্ডার মধ্যে অমন উপাদেয় চা ঠিক বেহেস্তি নেয়ামতের মতোন।
DSC02478_1.jpg
আবার যাত্রা শুরু..
পথিমধ্যে পাহাড়ের চিপায়চাপায় বহু লোভণীয় কটেজ- বাংলো..নিশ্চয়ই হোমড়াচোমড়ারা থাকেন।
উন্নয়নের কাজ চলছে ব্যাপকহারে। সাইনবোর্ড দেখে বোঝা যায়, ভূস্বর্গ শুধারানোর দ্বায়িত্ব পড়েছে বীকন নামের প্রতিষ্ঠানের হাতে..ভালো লাগলো কাজের তোড়জোড় দেখে..
পাহাড় চিড়ে টানেল দেখ; জম্মু-কাশ্মীর করলো এক:..
অবশেষে এলো সেই বিশাল টানেল। প্রায় ২.৫ কিমি লম্বা এই টানেলে ঢুকতেই হিমভাব অনভূত হয়। আঁধার আর আঁধার। এত বড় পাহাড় ভেদি টানেল করাই তো বড় ব্যাপার। তার উপর এমন এলাকায় যেখানে ঠুশঠাশ-ধুশধাশ নিত্ত দিনের ব্যাপার। তবে বুঝতে দেরি হলোনা জম্মু-কাশ্মীরকে যতই এক করা হোক না কেন, শিল্প-সংস্কৃতি-আচার-আচারণে তাদের বেশ ভিন্নতা আছে..এমনও জম্মুবাসী আছে যারা পাহাড় পেড়িয়ে কাশ্মীরে আসেনি..
টানেল ছেড়ে- এবার কাশ্মীরে..
টানেল ছাড়াতেই দৃশ্যপটের বদল। পাহাড়ি এলাকা কমে গিয়ে বেশি দেখা যায় সমতল ভূমি.. সবুজ..স্বচ্ছ..ঠিক যেন রোদ-পরী। এক জায়গায় নাশতা খেতে নেমে সামনে তাকাতেই বোঝা গেল একে ভূস্বর্গ বলার কারণ.. আহা মেঘ- পাহাড়- সবুজের রহস্যমাখা অভিমানী এলাকাটা..
এমনকী পোশাকটাও অন্যরকম সবার.. বর বললো, পাকিস্তানবাসীর পোশাক একদমই এমন..এমনকী আচরণও। একটু রুক্ষ। ভাষাও উর্দূ..যেকোন সাইনবোর্ড উর্দূতেই লেখা..আর আচরণে বলে দেয় তারা সুবিধাবঞ্চিতদের দলে..অথবা হয়তো সুবিধা নিতেও নারাজ..
ঝিলের শহর- নৌকার বহর
দীর্ঘ ৯ ঘণ্টার ট্যাক্সিভ্রমণ শেষে এসে পৌঁছালাম ডাললেক...মনের মাঝে কিছু ছবি আছে আঁকা সেই কবে থেকে। গোলাপী রঙের বাড়ি... নৌকা-বাড়ির সারি...টলটলে জল... ফুল বোঝাই শিকারা আরো কত কি! ডাললেকে পৌঁছানোর সাথে সাথে ক্লান্তি ভাব চলে গেল নিমেষে। তখন উৎকণ্ঠা আর কৌতূহল ভর করেছে আমাদের দুজনের মনের উপর। ভাবছি, কি করে পৌছাবো আমাদের নির্ধারিত হাউজবোটে।এখানে এসে কিভাবে কি করবো- এই চিন্তা যেন দুশ্চিন্তায় পরিণত না হয় একারণে আমরা দিল্লী থেকেই হাউজবোট ঠিক করে এসেছি। কারণ মনে আছে তো, কাশ্মীরে নো ফোন- নো সহজ কমিউনিকেশন..!!
অবশেষে রনজিতের ফোন থেকে কল করে আশ্বস্ত হলাম যে আমাদের হাউজবোটে পৌঁছে দেয়ার জন্য নির্ধারিত শিকারা আসছে। তার আগেই আমাদের লাগেজ নিয়ে ঘাটের অন্যান্য শিকারার মাঝিরা টানা হেচড়া শুরু করে দিয়েছে। তারা হাতি ঘোড়া দেখানো শুরু করলো যে, তোমাদের নিতে আসবেনা কেউ। মাত্র ২০০ রূপী (মাত্র!) দিলে তোমাদের দিয়ে আসবো। আমরা হয়তো রাজিও হয়ে যেতাম। কিন্তু রনজিত জানালো, হাউজবোট ভাড়া নিলে রাত্র নয়টা পর্যন্ত ঘাট থেকে আসা-যাওয়া করার শিকারা ওরাই দেয়..আমাদের ভাড়া করার দরকার নেই। তখন বুঝলাম ডাল লেক এড়িয়ায় ”ডাল মে কালা নেহি কালে মে ডাল” আছে!! এখানকার লোক গুলো ট্যুরিস্টদের খসানোর পায়তাড়া করতে তাড়া করে সর্বাত্মক।
অবশেষে আমাদের শিকারা এলো। হাউজবোটের ছেলেটাকে দেখে চমকে উঠলাম..আরে এ দেখি সেই রিয়েলিটি শো-এর কাজী তৌকির!! আসলে কাজী তৌকীর না, এদের অনেকের চেহারাই একরকম। একশব্দে বলা যায়, সুন্দর। শিকারাও কম সুন্দর নয়। মখমলের কাপড়ে মোড়া আসন- রাজা রাজা ভাব। আমরা উঠেই হেলান দিলাম। রওনা দিলাম হাউজবোটের উদ্দেশ্যে। হাউজবোটের নামগুলো বেশ মজার, ”হনলুলু”, ”শিকাগো”, ”বোম্বে”- বিভিন্ন জায়গার নামে। ডাললেকের প্রায় ৬০% জায়গা দখল করে নিয়েছে হাউজবোট। ডাললেকের পানির নীচে জমে থাকা লতা-গুল্ম আর অসংখ্য রঙীন পাখি দেখতে দেখতে চলে আসলাম আমাদের হাউজবোটে।
Kashmir_033.jpg
সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি হাউজবোট গুলোতে আছে খোদাই করা সুক্ষ্ম কারুকাজ। অসাধারণ।
Kashmir_103.jpg
একেকটি হাউজবোটে কমপক্ষে ৪টা করে রুম। এর মধ্যে একটি আবার ”হানিমুন-কক্ষ”। আমাদের রুমটা অবশ্য সাধারণ একটা ছিল। রুমের সাথে লাগোয়া বাথরুম, গরম-ঠাণ্ডা পানির সুব্যবস্থা সহ। আর ডায়নিং স্পেস-টিভিরুম- ড্রয়িংরুম হচ্ছে একটি। হাউজবোটের সামনে আছে বসার জন্য সোফার ব্যবস্থা। ছোট্ট একটু খোলা ডেক এবং খোলা ছাতি। তবে.. হমম এখানে একটু ”তবে” আছে। বাংলাদেশি বলে তারা আমাদের ওয়াইফাই ব্যবহার করতে দেয়নি, যা প্রথমেই আমাদের মেজাজ খারাপ করে দেয়। আর রাত্রী নয়টার পর কিছু করার নেই ভাবতেই আরো বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছিলাম প্রায়। কিন্তু সেই ভাবনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে ঝটপট তৈরি হয়ে গেলাম শিকারা ভ্রমণের জন্য।
মজার ব্যাপার হলো, যাতায়াতের শিকারা ফ্রি হলেও, এই শিকারাভ্রমণ কিন্তু ফ্রি নয়। গুণতে হয় অনেকক্ষাণী টাকা থুক্কু রূপী। আর এগুলো যে ফ্রি নয়- এটা কিন্তু ওরা আগে থেকে বলবেও না। আমরা আঁচ করতে পেরেছিলাম বলে বেচে গেছি। এবং প্রস্তুতও ছিলাম।
এদের যাবতীয় চতুর কৌশল থেকে কি করে বাঁচা যায় ভাবতে ভাবতে চড়লাম শিকারাতে। বলতেই হয়- কি যে সুন্দর-!কি যে সুন্দর!! বলে বোঝানো মুশকিল। আসলেই ভূস্বর্গ।
DSC02483_1.jpg
এই শিকারা নিয়ে গেল লেকের নানা দিকে। যাচ্ছি আর ভাবছি, আর মুগ্ধ হচ্ছি। ওয়াটার গার্ডেন দেখে ভিড়লাম একটু দ্বীপের মতো স্থানে। ওখানে রেস্টুরেন্ট আছে। দুপুরের খাবারটা খেলাম সেখানেই। হাউজবোটে রাতের আর সকালের খাবার নিশ্চিত। তাই কোন খাবার সাথে নিলাম না আর।
আবার শিকারাতে উঠতেই বিপদ! এও ”পাপাজি” দ্যা গ্রেটের মতো ফ্লোটিং মার্কেটে নিয়ে গেল। যেতেই হবে। দেখতেই হবে। না হলে আসছো কোন - টাইপ অবস্থা। দেখলাম। মুখ কালো করে। দোকান দর্শন শেষে শিকারাতে উঠতেই আরো বিপত্তি। দুপাশ থেকে দুই নৌকা দোকান হাজির রকমারি পসরা নিয়ে। ”কিনো” ”কিনো” শুনতে শুনতে মেজার খারাপ হবার উপক্রম। আর সেকি দাম। ঢাকায় যে কানের দুলের দাম ১০০ টাকা সেটা চায় ৩০০০ রূপী!! আমরা মন এবং মুখশ্রী শক্ত করে ফিরে এলাম হাউজবোটে। ইন্টারনেট ব্যবহার করতেনা পারায় ”পাজী” তৌকীরদের ২৮ গুষ্ঠি উদ্ধার করে পরদিনের ভ্রমণের জন্য তৈরি হয়ে ঘুমাতে গেলাম। তার আগে ডিনারের কথা না বললেই নয়। ব্যবহার যতই বাজে হোক, খাবার কিন্তু ফ্রেশ আর উপাদেয় ছিল অবশ্যই।... হয়তো এজন্য ঘুমটাও ফাটাফাটি হলো।
সোনমার্গ - ঘোড়াওয়ালার রাগ- আমাদের দেমাগ
পরদিন বেশ সকালে রওনা দিলাম সোনমার্গের উদ্দেশ্যে। রনজিত আগে থেকেই ঘাটে আমাদের জন্য তৈরি। আমরাও হাউজবোট থেকে নানা রঙা পাখি দেখতে দেখতে ঘাটে এসেই রনজিতকে দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। এমনিতে শ্রীনগরের ডাললেকের আশেপাশের আবহাওয়া বেশ গরম। কিন্তু সোনমার্গে যাওয়ার পথে রীতিমত হিম করা আবহাওয়া টের পেলাম। পাহাড়ি ক্ষরস্রোতা নদীর ধার ঘেষে রাস্তা যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। মাঝে ফটোসেশনের জন্য থামলাম।
মিলিটারি ঘেরা জায়গাটা বেশ সুন্দর।গরম গরম চা হাতে নিতে না নিতেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল। চা খেয়েই আবার রনজিতের রথে চড়ে রওনা হলাম..
ঘণ্টা চারেক বাদে এলাম সোনমার্গ। সোনায় সোহাগা সোনমার্গ বললে ভুল হবে না। ঠাণ্ডা হিম আবহাওয়া। পাহাড়-ভ্যালী। আবার বরফও আছে..মনটা ভালো হয়ে গেল গাড়ি থেকে নেমে।
Kashmir_059.jpg
বুক ভরে নির্মল বাতাসটা নিলাম। ঢাকায় যেটার বড্ড অভাব।
কিন্তু হা- চাঁদেরও কলঙ্ক আছে, সোনমার্গে আছে ঘোড়া ওয়ালা!!
মানে?
মানে হলো, গাড়ি থেকে নামতেই ঝাঁকে ঝাঁকে ঘোড়াওয়ালা এসে ঘিরে ধরলে আমাদের। বরফ পর্যন্ত নিয়ে যাবে- দুই ঘোড়াতে নিবে মাত্র(!) ৪০০০ রূপী! পথে ৭টা স্পট দেখাবে। শুনে আক্কেল গুঢ়ুম। জানতে চাইলাম- 'বরফ কই"..অনন্তের দিকে আঙুল তুলে বললো 'ঐ দিকে'...আমরা ভাবলাম, একটু বুঝে শুনে নেই।..হাটা শুরু করলাম। হ্যামিলনের বাঁশীওয়ালার মতন পিছে আসতে থাকলো ঘোড়া ওয়ালারা। এরপর দলে যোগ দিল টাটা সুমোওয়ালা। দুজনকে বরফ নাগাদ পৌঁছে দিবে মাত্র (!) ৩০০০রূপীতে। এতোই বিরক্ত করলো যে আমরা পারলে দৌড় দেই। আমার বর একটু পর বলে উঠলো, আমরা ঘোড়ায় চড়ি আর না চড়ি- ঘোড়াওয়ালারা তো ঠিকই হেঁটে যাচ্ছে রাশ টেনে। তারমানে যেখানে বরফ সেখানে হেঁটে যাওয়া যায়!!.. অতএব হেঁটে রওনা দিলাম। পাশে তখনও ঘোড়া ওয়ালারা ফুসলে যাচ্ছে- বলে যাচ্ছে,যেতে পারবে না..অনেকদূর..-এই সেই। কিন্তু আমরা চললাম।
DSC02531_1.jpg
এতো সুন্দর পাহাড় বেয়ে হেটে যেতেই ভালো লাগছিল। একটা পার হলাম..দুইটা...পাশে দিয়ে ঘোড়াওয়ালারা যেতে যেতে টিটকারি দিচ্ছে!..আমরা পাত্তাই দিলাম না।
আরেকটা বাঁক পার হতেই দেখলাম,সেই নদীটা...খরস্রোতা...এখানে একদম পাশ ঘেষে যাচ্ছে... যেখানে বরফ আছে, সেই বরফ গলেই এই নদী। এজন্য এত্তো ঠাণ্ডা!
আরো কিছুক্ষণ পরে এসে পৌছুলাম নদীর ধারে। একটা ছুপরি। অসাধারণ মজার ডিমভাজা-টোস্ট খেয়ে নদীতে পা ভিজাতে গেলাম। বর দেখি মিটিমিটি হাসে..হাসার কারণ বুঝলাম পানিতে পা দিতেই .. লম্ফ দিয়ে জম্ফ দিলাম জিরো ডিগ্রি পানির ধাক্কায়..
কোনমতে পানি থেকে উঠে ঝুপড়িওয়ালাকে জানতে চাইলাম বরফ কতদূর...একমাত্র এই লোকটাই পথের আসল দিশা দিলো..বললো- হেটেই যাওয়া যাবে..
মনে বল পেলাম..হাটা শুরু করলাম..
অবশেষে ঘোড়াওয়ালার "অভিশাপ" পেতে পেতে এলাম বরফের কাছে..নিজের চোখে দেখলাম বরফ ভেঙে নদী হওয়ার রহস্যময় দৃশ্য...এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে!
Kashmir_076_1.jpg
আর হ্যা..যাওয়া আসা মিলে মোট ১৭কিমি (৮.৫+৮.৫) হেটেছি আমরা এই কলেবর নিয়ে..দুজন দুজনের পিঠ চাপড়ে রওনা দিলাম ডাললেকের দিকে..
গুলমার্গ যেন হিমাগার- বোনাস বরফঢাকা সেই পাহাড়!!
পরদিন গুলমার্গ... সকালবেলাতেই রওনা দিলাম। রনজিতের পাঞ্জাবী গান শুনতে শুনতে মুখস্ত হবার যোগাড়!! গতদিনের হাটার রেকর্ডে আমরা আজকেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ- নো ঘোড়া। গাড়ি থেকে নামতে ভূস্বর্গের দস্যুরা এসে হাজির..মানে ঘোড়া ওয়ালারা। ওদের পাত্তা না দিয়ে জায়াগাটার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম প্রাণ ভরে। জানলাম, শীতে ভ্যালী ভরে বরফ জমে থাকে..এখনও আছে...তবে গন্ডোলা করে যেতে হবে পাহাড়ের চূড়ায়..দুদফার গন্ডোলা ভ্রমণ শেষে যে পাহাড়ের চূড়া সেখানেই আমার প্রিয় বরফের আস্তরণ। হাটা দিলাম..আবার টিটকারি- যেতে পারবে না। অনেক দূর..বলুন তো কতদূর? মাত্র দশ মিনিটের হাটা..এরা তো পারলে শ্বাস নেয়ারও টাকা চার্জ করে.. তাই খুব সাবধানে টিকিট কাটলাম-দুই নম্বর-তিন নম্বর মানুষ এড়িয়ে..মজার কথা হলো, সবকিছুরই নির্দেশনা কিন্তু দেয়া আছে..তাও মানুষ দুই নম্বারী করতে গিয়ে শয়ে শয়ে রূপী গচ্চা দেয়..
আমরা গচ্চা দিলাম না ..প্রথম গন্ডোলা করে যে পাহাড়ে নামলাম, সেই পাহাড়ে মেঘ আর মেঘের ছড়াছড়ি..পরেরটায় ফকাফকা সূর্য্য..কারণ এখন আমরা মেঘেরও উপরে যে!!.. আর পাশেই বরফের স্লিপার টাইপ অংশ...প্রায় ৫০মিটারের মতো বেয়ে উঠলাম বরফের মাঝপথ পর্যন্ত..দুই হাতে খাবলে ধরলাম সফেদ তুলোর মতো বরফগুলোকে...মনে হলো আমি একজন পাঁচ বছরের শিশু.
DSC02565_1.jpg
বরফে লুটোপুটি করে নেমে এলাম নীচে..ভারতবর্ষের শেষ দোকানে চা খেয়ে নিলাম। কারণ পাশের পাহাড়ই পাকিস্তান যে...
IMG_7225_1.jpg
কিছুক্ষণ বসে রইলাম চুপচাপ। এতো সুন্দর জায়গা। হয়তো সারাদিনই এভাবে কাটিয়ে দেয়া যায়।
কিছুক্ষণ বাদে রওনা দিলাম পরের পাহাড়ে...সেখান থেকে ট্যাক্সিস্ট্যান্ড...হালকা পাতলা খাবার..শ্রীনগরে ফিরে আসা। এরপর শ্রীনগরে বেশ রাত পর্যন্ত ঘুরাঘুরি...পরদিন আকবরের কাণ্ড দেখে কলকাতায় ফিরবো বলে ঘুম দিলাম আয়েশ করে।
দুষ্টু আকবরের আকবরী কাণ্ড!
পরদিন প্লেন অনেক পরে।তাই রনজিত নিজে থেকেই বললো, টিউলিপ গার্ডেন, মোঘল গার্ডেন, শ্রী আচার্য মন্দির, পরী মহল দেখাবে...
প্রথমেই মন্দির দেখলাম সেই কোন চূড়ায় উঠে...তারপর টিউলিপ গার্ডেন..এতো সুন্দর ফুল..আর এতো্ই বড় যে আমার চারটা মুখের সমান!
IMG_7324_1.jpg
সেখান থেকে মোঘল গার্ডেন..আকবরের রুচীর প্রশংসা না করলেই নয়..সেই আমলে পাহাড়ের চূড়ায় সাজানো বাগান করা চাট্টিখানি কথা নয়। ম্যানুয়াল ফোয়ারা, কৃত্রিম ঝরনা..পাখি, ফুল কি নেই!!..
আর তার চেয়েও উপরে পরীমহল..আকবর সাহেব আসলেই রসিক ছিলেন বটেক..কাশ্মীরের পাহাড়ের চূড়ায় পাহাড়, তারও আরোওওও উপরে পরী-মহল..বুঝেছেন..Laughing out loud মহলের তাৎপর্য??
DSC02605_1.jpg
সেখন থেকে আকবর ফোর্ট তো দেখা যায়ই, পুরো শ্রীনগর দেখা যায় একবারে...আকবরের তারিফ করতে করতে এবার সোজা এয়ারপোর্ট..অসাধারণ জায়গা আর মনকাড়া খাবার পিছনে ফেলে রনজিত ছুটলো আমাদের নিয়ে..অবশেষে ছয় স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনি পেড়িয়ে বসে রইলাম প্লেনের অপেক্ষায়..
শেষ হইয়া্ও হইলো না শেষ-
বলা হয়নি তাইনা।কাশ্মীরের শ্রীনগরে রমজানে কিন্তু সিনেমা থিয়েটার বন্ধ থাকে..তাই..বসে ছিলাম কলকাতা ফিরে এক থা টাইগার দেখবো..কিন্তু কেমনে? প্লেন কলকাতা নামবে রাত ১০টায় আর শেষ শো রাত ১১.১৫! দিল্লী নেমে সেই বন্ধু দম্পতিকে টিকেট কাটতে বলে দিলাম কানেকটিং ফ্লাইট ধরার ফাঁকে..প্লেন কলকাতায় নামলো ৯.৫০...হোটেল ফিরলাম ১০.৪০...লাগেজ রেখে বন্ধু দম্পতির কাছ থেকে টিকিট নিয়ে সোজা এলগিন রোড..ফোরাম..১১.১৫ তে হলে প্রবেশ- সালমান দ্যা গ্রেটের এক থা টাইগার... আহ শান্তি...!
হোটেল ফিরতে ফিরতে ২টা...ভোর ৫.১৫ তে দেশের বাস...
আহ এই না হলে ভ্রমণ..৩০ রোজা বলে নো যানজট- নো লেট..এককথায় গ্রেট আলহামদুলিল্লাহ..বাসায় ফিরে ইফতার করেই চানরাতের শপিং করতে বের হলাম...আর কাশ্মীরের গল্প বলা শুরু করলাম...
তা কেমন লাগলো??
 ----------------
প্রিয়জনেষ,
আমি ও আমার এক বন্ধু চট্টগ্রাম থেকে ২৬ তারিখ রওনা হচ্ছি কাশ্মিরের উদ্দেশ্যে। আমাদের ভ্রমন সূচি নিচে দিলাম। আপনার গুরুত্বপূনর্র মন্তব্য আশা করছি। সাথে শ্রীনগরে হোটেল ভাড়া ও আনুমানিক ফুডিং কস্ট জানালে উপকৃত হতাম। শ্রীনগর থেকে সোনমার্গ, গুলমার্গ,পহেলগাও এর গাড়ী ভাড়া কি ধরনের? আমরা ৪ জন এডাল্ট ও আমাদের তিন মেয়ে যাচ্ছি। অগ্রিম ধন্যবাদ রইল।
জম্মু – কাশ্মীর ভ্রমন’২০১৩
২৬/০৯/২০১৩ (বৃহস্পতিবার) : সন্ধ্যা ৫.৩০ টায় : চট্রগ্রাম থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা।
২৭/০৯/২০১৩ (শুক্রবার) : আনুমানিক দুপুর ৩ টায়: কলকাতা পৌঁছানো।
২৮/০৯/২০১৩(শনিবার) : রাত ১১.৫৫ টায়: কলকাতা থেকে কাশ্মিরের উদ্দেশ্যে রওনা।
৩০/০৯/২০১৩ (সোমবার) : দুপুর ১২.৩০ টায়: জম্মু পৌঁছানো।
: দুপুর ২.০০ টায়: জম্মু থেকে শ্রীনগরের (২৯৩ কি:মি:)উদ্দেশ্যে রওনা।
: রাত ৯.০০ টায়: শ্রীনগর পৌঁছানো। রাত্রিবাস-শ্রীনগরে।
০১/১০/২০১৩ (মঙ্গলবার) : সকাল ৭.০০ টায়: ডাললেক ফ্লোটিং মার্কেট, ডাললেক ও নাগিন লেকের
মাঝে গার্ডেন, হজরতবাল মসজিদ, মুগলগার্ডেন, শঙ্করচার্য মন্দির প্রভৃতি ভ্রমন।
দুপুর ২.৩০ টায়: যুসমার্গ (৪৭ কি:মি) ভ্রমন। রাত্রিবাস-শ্রীনগরে।
০২/১০/২০১৩ (বুধবার) : সকাল ৭.০০ টায়: শ্রীনগর থেকে গুলমারগ (৪৬ কি:মি) যাত্রা ও
রোপওয়ে চড়ে খিলানমার্গ বেড়ানো। শ্রীনগরে-রাত্রিবাস।
০৩/১০/২০১৩ (বৃহস্পতিবার) : সকাল ৭.০০ টায়: শ্রীনগর থেকে সোনমার্গ (৫১ কি:মি)
যাত্রা ও বেড়ানো। দুপুর ৩.০০ টায়: শ্রীনগর ফিরে ডাললেকে
শিকারা ভ্রমন। শ্রীনগরে-রাত্রিবাস।
০৪/১০/২০১৩ (শুক্রবার) : সকাল ৭.০০ টায়: শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁও (৯০ কি:মি:)যাত্রা। রাত্রিবাস।
০৫/১০/২০১৩ (শনিবার) : আরুভ্যালি, বেতাবভ্যালি, বেইশরন দর্শন।রাত্রিবাস-পহেলগাঁওয়ে।
০৬/১০/২০১৩ (রবিবার) : চন্দনবাড়ি (১৬ কি:মি:)দর্শন। রাত্রিবাস-পহেলগাঁওয়ে।
০৭/১০/২০১৩ (সোমবার) : সকাল ১০ টায়: পহেলগাঁও থেকে জম্মুর উদ্দেশ্যে রওনা।
সন্ধ্যা ৭.২০ টায়: জম্মু থেকে নিউ দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা।
০৮/১০/২০১৩ (মঙ্গলবার) : আনুমানিক সকাল ৪.৩০ টায়: নিউ দিল্লি পৌঁছানো।
: নিউ দিল্লি থেকে দুপুর ১ টায় কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা।
০৯/১০/২০১৩ (বুধবার) : সকাল ৬.১০ টায়: কলকাতা পৌঁছানো।
: সকাল ১০ টায়: কলকাতা থেকে চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা।
১০/১০/২০১৩ (বৃহস্পতিবার) : আনুমানিক সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম পৌঁছানো।
roopkotha'এর ব্লগ

২টি মন্তব্য:

  1. দারুন লাগল। একটু নিটপিক করছি - কলকাতার ফোরাম মল এলগিন রোডে (এলিগ্যান্ট রোডে নয়)।

    উত্তরমুছুন
  2. ধন্যবাদ @Sarthak, আপনার নিটপিক এক্সেপ্টেড...এডিট করে দিলাম!!!!

    উত্তরমুছুন