মূল লেখার লিংক

আমাদের এক সহকর্মী গিয়ে উপস্থিত হলেন রাশিয়ায়। তার রাশিয়ান উচ্চারণ থেকে শুরু করে গায়ের রঙ, বেশভূষা দেখে বোঝার উপায়টুকু নেই তিনি রাশিয়ান না-কি অন্যদেশীয়। কিন্তু, সবকিছু উলোটপালোট হয়ে গেল পানীয়ের দোকানে হাসিমুখে সামান্য ভদ্কার অর্ডার করতে গিয়ে। ভদ্কার গ্লাস এগিয়ে দেয়ার সাথে সাথে দোকানী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন দেশ থেকে বেড়াতে এসেছো?” তিনি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি করে বুঝলে আমি অন্যদেশ থেকে এসেছি? কি করে নিশ্চিত হলে আমি রাশিয়ান নয়।” দোকানীর সোজাসাপ্টা উত্তর, “খুব সহজ, রাশিয়ানরা কখনো হাসিমুখে ভদ্কা অর্ডার করে না”।
আহ্! রাশিয়া! মাদার রাশিয়া। কত গল্প, কত মুভ্যি, কত গোয়েন্দাবৃত্তির কাহিনীই না শুনেছি এই দেশটাকে নিয়ে। নীলক্ষেতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কত বইয়ের প্রচ্ছদেই না দেখেছি রাশভারী রাশিয়ান লেখকের ছবি। নিকোলাই গোগলের ‘তারাস বুলবা’ কিংবা টলস্টয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস্’। তার উপর ‘রাদুগা’ প্রকাশনীতো আছেই। শৈশব কৈশরের স্মৃতি হোক আর হলিউডের মুভ্যিতে রাশিয়ান সাবমেরিনের বিধ্বংসী কার্যকলাপের জন্যই হোক, রাশিয়ান শহর সেইন্ট পিটার্সবার্গের পুলকভ বিমানবন্দরে নেমেই সমস্ত দেহ মন রোমাঞ্চে ভরে গেল।
ইমিগ্রেশান লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম খুব দ্রুত কাগজপত্রে সই করে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে যাত্রীদের। বেশিরভাগ যত্রীই আশপাশের ইউরোপিয় দেশগুলো থেকে এসেছেন। আমারো কম সময় লাগবে এই ভেবে খুশি হয়ে উপস্থিত হলাম অফিসারের সামনে। লেডি অফিসার। আরেকটু যুতসই করে বলি- রাশিয়ান লেডি অফিসার। গুডমর্নিং কিংবা ইভিনিংয়ের কোনো কারবারই নাই। বাজখাই কণ্ঠে সরাসরি বলে, “পাসপোর্ট”। পাসপোর্ট দিলাম। আমার দিকে না তাকিয়েই, টেলিফোনে ডায়াল করতে শুরু করলো। আমার আগের কারো ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। বুঝলাম ঘটনা খারাপ। তার রাশিয়ান ভাষার এক বিন্দুও বুঝতে পারলাম না, কিন্তু মুখভঙ্গি দেখে আন্দাজ করলাম, সে তার বসকে বলছে, “বদমাইশটাকে হাতে নাতে ধরে ফেলেছি স্যার”। কথা বলছেতো বলছেই, মাঝে মাঝে পাসপোর্ট দেখে কি সব নাম্বার বলছে। শুধু মাঝখান থেকে শুনতে পারলাম, “আমেরিকা”। আমার আর বুঝতে বাকী থাকলো না, বেটি বসকে জানাচ্ছে, “হালায় একটা আমেরিকান স্পাই স্যার, শক্ত কইরা দড়ি দিয়ে বাইন্দা রাখি”। নাহ, যা ভেবছি তা না। কিছুক্ষণ পর ফোন রেখে, কি সব সাইন টাইন করে হেডমাস্টার স্যারদের সমান গম্ভীর মুখ করে বলে, “গো”।
যতই গম্ভীর মুখে বলুক না কেন, সে যাত্রা বেঁচে গেলাম। বিমানবন্দর থেকে বের হতেই দেখি সাদা কাগজে বড় বড় করে Mainul Raju লিখে দাঁড়িয়ে আছে একজন। ইমিগ্রেশান অফিসার যদি হেডমাস্টার হয়, তাহলে এই লোক ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপাল। দেখেই মনে হয়, ভাবের ভারে কথাই বলতে পারবে না। গিয়ে বললাম, আমি মইনুল রাজু। তারপর, কোনো কথা না বলে সোজা হাঁটা শুরু করলো। আমিও পিছন পিছন হাঁটা শুরু করলাম। হোটেল থেকে গাড়ি নিয়ে এসেছেন। আমাকে অবশ্য আগে থেকেই আমেরিকান বন্ধুরা সতর্ক করে বলেছিলো, “রাশিয়ানরা কিন্তু বেশী কথাবার্তা বলে না”। এয়ারপোর্ট থেকে একটা লোক কয়কে মাইল পাড়ি দিয়ে আমাকে হোটেলে নিয়ে গেলো, একটা কথাও বললো না। আমি বলতে চেষ্টা করেও, দুই একটা ‘হু’ ‘হা’ ছাড়া আর বেশি সুবিধা করতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম, ইংলিশ ভালোভাবে পারেন না বলে হয়তো। কিন্তু, আমাদের দেশে যারা ক্যাব চালান, তারাওতো ততটা ইংলিশ বলতে পারার কথা না। তাই বলে তারা কি বিভিন্ন ধরণের মুখভঙ্গি করেন না! তারা কি হাসি দিয়ে অতিথিকে বুঝানোর চেষ্টা করেন না, ইংলিশ না জানার কারণে আমি কিছু বলতে পারছি না, কিন্তু, আমার দেশে তোমাকে অন্তর থেকে স্বাগতম, হে অতিথি। যাই হোক, হোটেলে গিয়ে চাবি বুঝে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম।

ছবিঃ দ্যা চার্চ অন স্পিল ব্লাড। যে জায়গাটাতে রাশিয়ান জার আলেকজান্ডার (২) ১৮৮১ সালে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিলেন সেই জায়গাটাতে এই চার্চটি নির্মাণ করা হয়।

ছবিঃ সেইন্ট নিকোলাস চার্চ সেইন্ট পিটার্সাবার্গ

ছবিঃ নেভা নদীর তোর ঘেঁষে গড়ে উঠা শহর সেইন্ট পিটার্সাবার্গ

ছবিঃ নেভা নদীর তোর ঘেঁষে গড়ে উঠা শহর সেইন্ট পিটার্সাবার্গ

ছবিঃ নেভা নদীর তোর ঘেঁষে গড়ে উঠা শহর সেইন্ট পিটার্সাবার্গ

ছবিঃ শহরের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া ক্যনাল

ছবিঃ সেইন্ট আইজ্যাক ক্যাথেড্রাল
কিছুটা বিশ্রাম সেরে বিকেল বেলা বের হলাম শহর দেখতে। প্রথম পদচিহ্ন রাখলাম সেইন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায়। রাস্তায় নেমে বুঝতে পারলাম, একি! এ কি দেখছি আমি! শহরের প্রতিটা গলিতে গলিতে আনন্দ। কি অনায়াসে হেসেখেলে একে অপরের কাঁধে হাত রেখে হেঁটে চলছে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপন মনে রঙ-তুলিতে ছবি আঁকছেন শিল্পী। গিটার নিয়ে কেউ মনের সুখে বাজিয়ে যাচ্ছে গান। একেবারেই হাসিখুশিতে ভরপুর জমজমাট একটা শহর। তাহলে, কি শুনে এসেছি এতদিন! একজন দুজনকে দিয়ে কখনোই একটা শহরকে কিংবা একটা জাতিকে বিচার করা যায় না। রাশিয়ার সব মানুষই কেজিবির এজেন্ট নয়; সবাই বাসার ছাদে নিউক্লিয়ার বোম্ব সেট করে আমেরিকার দিকে তাক করে বসে নেই। এখানেও শিল্পী আছে, গায়ক আছে, উচ্ছ্বল টিনেজার তরুণ-তরুণী আছে; আমার মত, আমাদের মত, সুখে উদ্বেলিত, দুঃখে জর্জরিত হাজার হাজার সাধারণ মানুষ আছে।








বুঝতে পারলাম, শুধু পূর্ব একটা ধারণা মনের ভেতর আঁকড়ে রাখার কারণে ইমিগ্রেশান অফিসার কিংবা ড্রাইভারের আচরণ আমার কাছে গুরুগম্ভীর মনে হয়েছিলো। আসলে অন্য সব জায়গাতেও একই জিনিস হয়। পার্থক্য শুধু একটা “গুড মর্নিং” কিংবা “গুড ইভনিং” বলার। কি জানি, রাশিয়ান ভাষায় তারা হয়তো কোনো সম্ভাষণ করেছেও, আমিই হয়তো বুঝতে পারিনি। কি জানি, হয়তো আমাদের আমেরিকান বন্ধু ভদ্কার দোকানে গিয়ে অস্বাভাবিক হাসি দেয়ার কারণেই দোকানী বুঝেছিলো, সে রাশিয়ার কেউ নয়। অন্য কারো কথা জানি না, বছরের পর বছর ধরে হলিউডের সিনেমা আমার মনের মানসপটে যে রাশিয়ার ছবি এঁকে দিয়েছে, এই রাশিয়া সেই রাশিয়া নয়। এই রাশিয়া নাচে-গানে-আনন্দে মাতোয়ারা, উৎফুল্ল এক প্রফুল্ল রাশিয়া। তবে একটা কথা বলে রাখা ভালো, মস্কোর পর রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহর একটু অন্য ধরণের। রাশিয়ায় পশ্চিমা সংস্কৃতির সবচেয়ে বেশি প্রসার দেখা যায় এই পিটার্সবার্গ শহরেই। যতটুকু জানি, মস্কো কিংবা অন্য ছোট শহরের রূপ কিছুটা আলাদা।



এমন এক শহর, এমন এক জাতি, যাদের বর্ণমালার একটা বর্ণও আমার চেনা নেই, যাদের ভাষার এক বিন্দু-বিসর্গ বোঝার ক্ষমতাও আমার নেই, সেখানে কেমন করে আমি চলবো ফিরবো, সেটা নিয়েই ভাবছিলাম। কিন্তু, সমাধানটা হয়ে গেলো খুব সহজে। কপালগুণে ব্লগিংটা শুরু করেছিলাম। শহরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরে নিজের সগৌরব উপস্থিতির কথা জানান দিলো সহব্লগার তাওসীফ হামীম; মীম নামেই সুপরিচিত। আগে কোনোদিন দেখা হয়নি, কথা হয়নি, তবু দেখা হবার পর মনে হলো আমরা যেন সাত জনমের পরিচিত। দেরী না করে ফেইসবুকে ছবি উঠিয়ে দেয় মীম। সেটা দেখে একজন আবার কমেন্ট করলো- “ দুইটা দামড়া ছেলে খাটে মুখামুখি বসে আছে! ছি ছি ছি”। মীম যে রকম বাংলা বলে, রাশিয়ান তার থেকে কোনো অংশে কম বলে না। তার কল্যাণে যতদূর সম্ভব শহরের সব তথ্য জানাতো হলোই, সাথে সাথে সে স্টুডেন্ট হবার বদৌলতে বহু মিউজিয়াম কিংবা দর্শনীয় স্থানে নামমাত্র মূল্যে মিলে গেল টিকিট। ওদিকে, কোন কোন রাশিয়ান খাবার না খেয়ে ফিরে যাওয়া উচিত হবে না, তার তালিকাটাও পাওয়া গেল তার কাছ থেকেই। শহর থেকে ফিরে আসার আগ দিন পর্যন্ত, যে পরিমাণ আন্তরিকতা একজন সহব্লগার এর কাছ থেকে পেয়েছি, সেটা কখনো ভুলবার নয়।






গোটা সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরে ঘুরে বেড়ালে দেখা যায়, প্রাসাদের ছড়াছড়ি। মানুষের পরিশ্রমকে পুঁজি করে গড়ে তোলা এইসব বৃহদাকার আর সুরম্য প্রাসাদ দেখলেই বুঝা যায়, একদা কত নির্যাতন, দুঃশাসন আর অনাচারের বদৌলতে নির্মিত হয়েছে এইসব অট্টালিকা, কি নির্মমভাবেই না করা হয়েছে সম্পদের যথেচ্ছ অপব্যবহার।

ছবিঃ হেরমিটেজ মিউজিয়ামের ভিতর থেকে তোলা, ১৭৬৪ সালে নির্মিত হওয়া হেরমিটেজ মিউজিয়াম বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন ও বড় মিউজয়ামগুলোর মধ্যে একটি।

ছবিঃ হেরমিটেজ মিউজিয়ামের বাইরে থেকে তোলা।

ছবিঃ সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরের একমাত্র মসজিদ।
প্রাসাদ আছে, অথচ প্রাসাদ ষড়যন্ত্র থাকবে না, তা কি করে হয়। তাই প্রতিটা প্রাসাদের ঘটনা পরিক্রমায় যুক্ত হয়ে আছে কাকে কিভাবে ষড়যন্ত্র করে কখন হত্যা করা হয়েছে সেই ইতিহাস। কিন্তু, সাধারণ মানুষ চিরকাল ধরে প্রাসাদের বাইরের মানুষ, হয়তো তাই তারা সহজে ভুলে যেতে পারে মর্মান্তিক আর নিকৃষ্ট সব প্রাসাদীয় রাজনীতি। আর, সেই বিস্মৃতির পথে ধরে এগিয়ে চলেই সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরের গলিতে গলিতে এখন বিউগলের করুণ সুর নয়, বেজে চলে রোমাঞ্চের রঙিন বাদ্য।
ছবিঃ রোমান্সের শহরে স্বাগতম।


ছবিঃ নিশ্চয়ই রাশিয়ান কুতকুত খেলা।

ছবিঃ মাত্রিওসকা পুতুল, একান্তই রাশিয়ান এই পুতুল।
খুব অল্প কিছু বাংলাদেশী মানুষ আছেন এই শহরে। তাদের একটা সংগঠনও আছে। মীমের কল্যাণে আমার শহরে আসার কথা জানতে পেরেছেন তারা। ঠিকই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট একবেলা খাওয়ার জন্য ফোন করে অনুরোধ করলেন। সময়ের অভাবে সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু, কৃতজ্ঞতা উনার প্রতি, উনাদের প্রতি। কারণ, যত যাই বলি না কেন, ভিনদেশে এই সামান্য বাঙালিপণাটুকু ভালো লাগে। এই জিনিসগুলো আরো বেশি করে স্মরণ করিয়ে দেয় শিকড়ের কথা, আমার যে নিজের একটা দেশ আছে সেই কথা।

ছবিঃ মেট্রো রেইলে চড়ার টানেল।
গোটা শহরে একজন সামান্যতম পরিচিত রাশিয়ানও আমার ছিলো না। ছোটোবেলায় শেখা বাল্যশিক্ষার মত করে রাশিয়ান বর্ণমালা পড়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু, তাই বলে রাশিয়ান ভাষা বলার বিন্দুমাত্র সাহসটুকু ভুলেও কখনো করিনি। সেইন্ট পিটার্সবার্গের ভুগর্ভস্থ ট্রেইন এত বেশি মাটির নীচে যে, স্বয়ংক্রিয় সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই বেশ কয়েক মিনিট লেগে যায়। সত্যি বলতে, সেই টানেলের পথ ধরে নামতে নামতে, চলতি পথে অপরিচিত কারো সাথে পরিচয় পর্ব শেষে, ঢং করে খানিকক্ষণ কথা বলার সুযোগটুকুও মিলে যায়। সেই সুবাদে দেখা হয়েছিলো রাশিয়ান এক তরুণীর সাথে। পরের দিন দেখি সে একই তরুণী, রাস্তায় দেখে খানিকটা চিৎকার করেই এগিয়ে আসলো। নিজের অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো “প্রিভিয়েত”। রাশিয়ায় “প্রিভিয়েত” মানে হলো “হাই” বা “হ্যালো”। কখন যে সে সম্বোধনটুকু শিখে ফেলেছি, সেটা নিজেই টের পাইনি। আসলেই, মনের ভাব প্রকাশের জন্যই তো ভাষা; সেই ভাব প্রকাশের প্রয়োজন পড়লে ভাষা আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে, সেটাইতো সমস্ত ভাষার ইতিহাস।
অনেক কথার ভীড়ে শহরের রূপসী রুপকথাগুলোই যে বলা হলো না। সে না হয় থাক আজ, অন্য আরেকদিন হবে সে গল্প। নীচে সে গল্পের ভুমিকাটুকু শুধু দিয়ে গেলাম আজ।

আমাদের এক সহকর্মী গিয়ে উপস্থিত হলেন রাশিয়ায়। তার রাশিয়ান উচ্চারণ থেকে শুরু করে গায়ের রঙ, বেশভূষা দেখে বোঝার উপায়টুকু নেই তিনি রাশিয়ান না-কি অন্যদেশীয়। কিন্তু, সবকিছু উলোটপালোট হয়ে গেল পানীয়ের দোকানে হাসিমুখে সামান্য ভদ্কার অর্ডার করতে গিয়ে। ভদ্কার গ্লাস এগিয়ে দেয়ার সাথে সাথে দোকানী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন দেশ থেকে বেড়াতে এসেছো?” তিনি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি করে বুঝলে আমি অন্যদেশ থেকে এসেছি? কি করে নিশ্চিত হলে আমি রাশিয়ান নয়।” দোকানীর সোজাসাপ্টা উত্তর, “খুব সহজ, রাশিয়ানরা কখনো হাসিমুখে ভদ্কা অর্ডার করে না”।
আহ্! রাশিয়া! মাদার রাশিয়া। কত গল্প, কত মুভ্যি, কত গোয়েন্দাবৃত্তির কাহিনীই না শুনেছি এই দেশটাকে নিয়ে। নীলক্ষেতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কত বইয়ের প্রচ্ছদেই না দেখেছি রাশভারী রাশিয়ান লেখকের ছবি। নিকোলাই গোগলের ‘তারাস বুলবা’ কিংবা টলস্টয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস্’। তার উপর ‘রাদুগা’ প্রকাশনীতো আছেই। শৈশব কৈশরের স্মৃতি হোক আর হলিউডের মুভ্যিতে রাশিয়ান সাবমেরিনের বিধ্বংসী কার্যকলাপের জন্যই হোক, রাশিয়ান শহর সেইন্ট পিটার্সবার্গের পুলকভ বিমানবন্দরে নেমেই সমস্ত দেহ মন রোমাঞ্চে ভরে গেল।
ইমিগ্রেশান লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম খুব দ্রুত কাগজপত্রে সই করে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে যাত্রীদের। বেশিরভাগ যত্রীই আশপাশের ইউরোপিয় দেশগুলো থেকে এসেছেন। আমারো কম সময় লাগবে এই ভেবে খুশি হয়ে উপস্থিত হলাম অফিসারের সামনে। লেডি অফিসার। আরেকটু যুতসই করে বলি- রাশিয়ান লেডি অফিসার। গুডমর্নিং কিংবা ইভিনিংয়ের কোনো কারবারই নাই। বাজখাই কণ্ঠে সরাসরি বলে, “পাসপোর্ট”। পাসপোর্ট দিলাম। আমার দিকে না তাকিয়েই, টেলিফোনে ডায়াল করতে শুরু করলো। আমার আগের কারো ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। বুঝলাম ঘটনা খারাপ। তার রাশিয়ান ভাষার এক বিন্দুও বুঝতে পারলাম না, কিন্তু মুখভঙ্গি দেখে আন্দাজ করলাম, সে তার বসকে বলছে, “বদমাইশটাকে হাতে নাতে ধরে ফেলেছি স্যার”। কথা বলছেতো বলছেই, মাঝে মাঝে পাসপোর্ট দেখে কি সব নাম্বার বলছে। শুধু মাঝখান থেকে শুনতে পারলাম, “আমেরিকা”। আমার আর বুঝতে বাকী থাকলো না, বেটি বসকে জানাচ্ছে, “হালায় একটা আমেরিকান স্পাই স্যার, শক্ত কইরা দড়ি দিয়ে বাইন্দা রাখি”। নাহ, যা ভেবছি তা না। কিছুক্ষণ পর ফোন রেখে, কি সব সাইন টাইন করে হেডমাস্টার স্যারদের সমান গম্ভীর মুখ করে বলে, “গো”।
যতই গম্ভীর মুখে বলুক না কেন, সে যাত্রা বেঁচে গেলাম। বিমানবন্দর থেকে বের হতেই দেখি সাদা কাগজে বড় বড় করে Mainul Raju লিখে দাঁড়িয়ে আছে একজন। ইমিগ্রেশান অফিসার যদি হেডমাস্টার হয়, তাহলে এই লোক ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপাল। দেখেই মনে হয়, ভাবের ভারে কথাই বলতে পারবে না। গিয়ে বললাম, আমি মইনুল রাজু। তারপর, কোনো কথা না বলে সোজা হাঁটা শুরু করলো। আমিও পিছন পিছন হাঁটা শুরু করলাম। হোটেল থেকে গাড়ি নিয়ে এসেছেন। আমাকে অবশ্য আগে থেকেই আমেরিকান বন্ধুরা সতর্ক করে বলেছিলো, “রাশিয়ানরা কিন্তু বেশী কথাবার্তা বলে না”। এয়ারপোর্ট থেকে একটা লোক কয়কে মাইল পাড়ি দিয়ে আমাকে হোটেলে নিয়ে গেলো, একটা কথাও বললো না। আমি বলতে চেষ্টা করেও, দুই একটা ‘হু’ ‘হা’ ছাড়া আর বেশি সুবিধা করতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম, ইংলিশ ভালোভাবে পারেন না বলে হয়তো। কিন্তু, আমাদের দেশে যারা ক্যাব চালান, তারাওতো ততটা ইংলিশ বলতে পারার কথা না। তাই বলে তারা কি বিভিন্ন ধরণের মুখভঙ্গি করেন না! তারা কি হাসি দিয়ে অতিথিকে বুঝানোর চেষ্টা করেন না, ইংলিশ না জানার কারণে আমি কিছু বলতে পারছি না, কিন্তু, আমার দেশে তোমাকে অন্তর থেকে স্বাগতম, হে অতিথি। যাই হোক, হোটেলে গিয়ে চাবি বুঝে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম।

ছবিঃ দ্যা চার্চ অন স্পিল ব্লাড। যে জায়গাটাতে রাশিয়ান জার আলেকজান্ডার (২) ১৮৮১ সালে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিলেন সেই জায়গাটাতে এই চার্চটি নির্মাণ করা হয়।

ছবিঃ সেইন্ট নিকোলাস চার্চ সেইন্ট পিটার্সাবার্গ

ছবিঃ নেভা নদীর তোর ঘেঁষে গড়ে উঠা শহর সেইন্ট পিটার্সাবার্গ

ছবিঃ নেভা নদীর তোর ঘেঁষে গড়ে উঠা শহর সেইন্ট পিটার্সাবার্গ

ছবিঃ নেভা নদীর তোর ঘেঁষে গড়ে উঠা শহর সেইন্ট পিটার্সাবার্গ

ছবিঃ শহরের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া ক্যনাল

ছবিঃ সেইন্ট আইজ্যাক ক্যাথেড্রাল
কিছুটা বিশ্রাম সেরে বিকেল বেলা বের হলাম শহর দেখতে। প্রথম পদচিহ্ন রাখলাম সেইন্ট পিটার্সবার্গের রাস্তায়। রাস্তায় নেমে বুঝতে পারলাম, একি! এ কি দেখছি আমি! শহরের প্রতিটা গলিতে গলিতে আনন্দ। কি অনায়াসে হেসেখেলে একে অপরের কাঁধে হাত রেখে হেঁটে চলছে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপন মনে রঙ-তুলিতে ছবি আঁকছেন শিল্পী। গিটার নিয়ে কেউ মনের সুখে বাজিয়ে যাচ্ছে গান। একেবারেই হাসিখুশিতে ভরপুর জমজমাট একটা শহর। তাহলে, কি শুনে এসেছি এতদিন! একজন দুজনকে দিয়ে কখনোই একটা শহরকে কিংবা একটা জাতিকে বিচার করা যায় না। রাশিয়ার সব মানুষই কেজিবির এজেন্ট নয়; সবাই বাসার ছাদে নিউক্লিয়ার বোম্ব সেট করে আমেরিকার দিকে তাক করে বসে নেই। এখানেও শিল্পী আছে, গায়ক আছে, উচ্ছ্বল টিনেজার তরুণ-তরুণী আছে; আমার মত, আমাদের মত, সুখে উদ্বেলিত, দুঃখে জর্জরিত হাজার হাজার সাধারণ মানুষ আছে।







বুঝতে পারলাম, শুধু পূর্ব একটা ধারণা মনের ভেতর আঁকড়ে রাখার কারণে ইমিগ্রেশান অফিসার কিংবা ড্রাইভারের আচরণ আমার কাছে গুরুগম্ভীর মনে হয়েছিলো। আসলে অন্য সব জায়গাতেও একই জিনিস হয়। পার্থক্য শুধু একটা “গুড মর্নিং” কিংবা “গুড ইভনিং” বলার। কি জানি, রাশিয়ান ভাষায় তারা হয়তো কোনো সম্ভাষণ করেছেও, আমিই হয়তো বুঝতে পারিনি। কি জানি, হয়তো আমাদের আমেরিকান বন্ধু ভদ্কার দোকানে গিয়ে অস্বাভাবিক হাসি দেয়ার কারণেই দোকানী বুঝেছিলো, সে রাশিয়ার কেউ নয়। অন্য কারো কথা জানি না, বছরের পর বছর ধরে হলিউডের সিনেমা আমার মনের মানসপটে যে রাশিয়ার ছবি এঁকে দিয়েছে, এই রাশিয়া সেই রাশিয়া নয়। এই রাশিয়া নাচে-গানে-আনন্দে মাতোয়ারা, উৎফুল্ল এক প্রফুল্ল রাশিয়া। তবে একটা কথা বলে রাখা ভালো, মস্কোর পর রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহর একটু অন্য ধরণের। রাশিয়ায় পশ্চিমা সংস্কৃতির সবচেয়ে বেশি প্রসার দেখা যায় এই পিটার্সবার্গ শহরেই। যতটুকু জানি, মস্কো কিংবা অন্য ছোট শহরের রূপ কিছুটা আলাদা।



এমন এক শহর, এমন এক জাতি, যাদের বর্ণমালার একটা বর্ণও আমার চেনা নেই, যাদের ভাষার এক বিন্দু-বিসর্গ বোঝার ক্ষমতাও আমার নেই, সেখানে কেমন করে আমি চলবো ফিরবো, সেটা নিয়েই ভাবছিলাম। কিন্তু, সমাধানটা হয়ে গেলো খুব সহজে। কপালগুণে ব্লগিংটা শুরু করেছিলাম। শহরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরে নিজের সগৌরব উপস্থিতির কথা জানান দিলো সহব্লগার তাওসীফ হামীম; মীম নামেই সুপরিচিত। আগে কোনোদিন দেখা হয়নি, কথা হয়নি, তবু দেখা হবার পর মনে হলো আমরা যেন সাত জনমের পরিচিত। দেরী না করে ফেইসবুকে ছবি উঠিয়ে দেয় মীম। সেটা দেখে একজন আবার কমেন্ট করলো- “ দুইটা দামড়া ছেলে খাটে মুখামুখি বসে আছে! ছি ছি ছি”। মীম যে রকম বাংলা বলে, রাশিয়ান তার থেকে কোনো অংশে কম বলে না। তার কল্যাণে যতদূর সম্ভব শহরের সব তথ্য জানাতো হলোই, সাথে সাথে সে স্টুডেন্ট হবার বদৌলতে বহু মিউজিয়াম কিংবা দর্শনীয় স্থানে নামমাত্র মূল্যে মিলে গেল টিকিট। ওদিকে, কোন কোন রাশিয়ান খাবার না খেয়ে ফিরে যাওয়া উচিত হবে না, তার তালিকাটাও পাওয়া গেল তার কাছ থেকেই। শহর থেকে ফিরে আসার আগ দিন পর্যন্ত, যে পরিমাণ আন্তরিকতা একজন সহব্লগার এর কাছ থেকে পেয়েছি, সেটা কখনো ভুলবার নয়।






গোটা সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরে ঘুরে বেড়ালে দেখা যায়, প্রাসাদের ছড়াছড়ি। মানুষের পরিশ্রমকে পুঁজি করে গড়ে তোলা এইসব বৃহদাকার আর সুরম্য প্রাসাদ দেখলেই বুঝা যায়, একদা কত নির্যাতন, দুঃশাসন আর অনাচারের বদৌলতে নির্মিত হয়েছে এইসব অট্টালিকা, কি নির্মমভাবেই না করা হয়েছে সম্পদের যথেচ্ছ অপব্যবহার।

ছবিঃ হেরমিটেজ মিউজিয়ামের ভিতর থেকে তোলা, ১৭৬৪ সালে নির্মিত হওয়া হেরমিটেজ মিউজিয়াম বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন ও বড় মিউজয়ামগুলোর মধ্যে একটি।
ছবিঃ হেরমিটেজ মিউজিয়ামের বাইরে থেকে তোলা।

ছবিঃ সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরের একমাত্র মসজিদ।
প্রাসাদ আছে, অথচ প্রাসাদ ষড়যন্ত্র থাকবে না, তা কি করে হয়। তাই প্রতিটা প্রাসাদের ঘটনা পরিক্রমায় যুক্ত হয়ে আছে কাকে কিভাবে ষড়যন্ত্র করে কখন হত্যা করা হয়েছে সেই ইতিহাস। কিন্তু, সাধারণ মানুষ চিরকাল ধরে প্রাসাদের বাইরের মানুষ, হয়তো তাই তারা সহজে ভুলে যেতে পারে মর্মান্তিক আর নিকৃষ্ট সব প্রাসাদীয় রাজনীতি। আর, সেই বিস্মৃতির পথে ধরে এগিয়ে চলেই সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরের গলিতে গলিতে এখন বিউগলের করুণ সুর নয়, বেজে চলে রোমাঞ্চের রঙিন বাদ্য।
ছবিঃ রোমান্সের শহরে স্বাগতম।


ছবিঃ নিশ্চয়ই রাশিয়ান কুতকুত খেলা।

ছবিঃ মাত্রিওসকা পুতুল, একান্তই রাশিয়ান এই পুতুল।
খুব অল্প কিছু বাংলাদেশী মানুষ আছেন এই শহরে। তাদের একটা সংগঠনও আছে। মীমের কল্যাণে আমার শহরে আসার কথা জানতে পেরেছেন তারা। ঠিকই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট একবেলা খাওয়ার জন্য ফোন করে অনুরোধ করলেন। সময়ের অভাবে সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু, কৃতজ্ঞতা উনার প্রতি, উনাদের প্রতি। কারণ, যত যাই বলি না কেন, ভিনদেশে এই সামান্য বাঙালিপণাটুকু ভালো লাগে। এই জিনিসগুলো আরো বেশি করে স্মরণ করিয়ে দেয় শিকড়ের কথা, আমার যে নিজের একটা দেশ আছে সেই কথা।

ছবিঃ মেট্রো রেইলে চড়ার টানেল।
গোটা শহরে একজন সামান্যতম পরিচিত রাশিয়ানও আমার ছিলো না। ছোটোবেলায় শেখা বাল্যশিক্ষার মত করে রাশিয়ান বর্ণমালা পড়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু, তাই বলে রাশিয়ান ভাষা বলার বিন্দুমাত্র সাহসটুকু ভুলেও কখনো করিনি। সেইন্ট পিটার্সবার্গের ভুগর্ভস্থ ট্রেইন এত বেশি মাটির নীচে যে, স্বয়ংক্রিয় সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই বেশ কয়েক মিনিট লেগে যায়। সত্যি বলতে, সেই টানেলের পথ ধরে নামতে নামতে, চলতি পথে অপরিচিত কারো সাথে পরিচয় পর্ব শেষে, ঢং করে খানিকক্ষণ কথা বলার সুযোগটুকুও মিলে যায়। সেই সুবাদে দেখা হয়েছিলো রাশিয়ান এক তরুণীর সাথে। পরের দিন দেখি সে একই তরুণী, রাস্তায় দেখে খানিকটা চিৎকার করেই এগিয়ে আসলো। নিজের অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো “প্রিভিয়েত”। রাশিয়ায় “প্রিভিয়েত” মানে হলো “হাই” বা “হ্যালো”। কখন যে সে সম্বোধনটুকু শিখে ফেলেছি, সেটা নিজেই টের পাইনি। আসলেই, মনের ভাব প্রকাশের জন্যই তো ভাষা; সেই ভাব প্রকাশের প্রয়োজন পড়লে ভাষা আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে, সেটাইতো সমস্ত ভাষার ইতিহাস।
অনেক কথার ভীড়ে শহরের রূপসী রুপকথাগুলোই যে বলা হলো না। সে না হয় থাক আজ, অন্য আরেকদিন হবে সে গল্প। নীচে সে গল্পের ভুমিকাটুকু শুধু দিয়ে গেলাম আজ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন