মূল লেখার লিংক

অনেক দিন পর, আবার ঘোরাঘুরি নিয়ে পোস্ট। এবার ছুটিতে একটু লম্বা উইক এন্ড পেয়ে সবাই এদিক সেদিক যাবার জন্য গোছগাছ শুরু করল। কেউ পাহাড়ে যায়, কেউ সাগরে, কেউ আবার জঙ্গলের ডাকে সাড়া দেবার জন্য প্রস্তুত (কলিজায় যাদের সাউন্ড হয়)। তখন, গবর্নমেন্ট শাটডাউন হয়ে থাকায় কাছের জঙ্গলে গিয়ে জ্বিন-ভুতের খাবার হবার ঝুঁকি নিলাম না। আমি আর আমার আদারহাফ জলপ্রপাত (এই নিকে অনেক আগে একটা লেখা পোস্ট হয়েছিল সচলে) ঠিক করলাম, কোন শহর-টহর দেখে আসি। আমরা থাকি বেশ গ্রাম গ্রাম টাইপের জায়গায়। দশতলা একটা স্টুডেন্ট হোস্টেল আছে আমাদের শহরে, যেটা আমদের এখানে সবচেয়ে উচু বিল্ডিং এর পরের সর্বোচ্চটা ৪ তলা।১২-১৩ তলা বিল্ডিংও কোন শহরে দেখলেই আমরা চোখ ট্যারা বানিয়ে তাকিয়ে থাকি। দূরে গেলে বড় শহর আটলান্টা বেশি গ্যাঞ্জাম, সেটা বাদ। এরপর, লুইজিয়ানার নিউ অর্লিন্স যাওয়া যায়, সেটা আরও অনেক বেশি দূর। মাঝারি আকারের একটা শহর আর দেখার মত কিছু টুকটাক আছে এমন একটা জায়গার খোঁজাখুজি করে জলপ্রপাত বের করে ফেলল টেনেসি রাজ্যের চ্যাটানুগা’র (Chattanooga) নাম। নামটা নিয়ে আমার নিজেরই সমস্যা বেঁধে গেল, অনেকটা চাটগাঁর মত নাম। তার উপর, এর উচ্চারণ চাট্টানুগা, না চাত্তানুগা, এটা নিয়ে কনফিউজড। যাই হোক, আপাতত, চ্যাটানুগা চলুক। চ্যাটানুগার আশে পাশের লুক আউট মাউন্টেনের রুবি ফল, হেলানো রেললাইন আর রক সিটিকে সিলবাসে ভরে নিলাম।
সময় মত বোঁচকা বুঁচকি বেঁধে ভাড়া গাড়ি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ঠিক করলাম, পথে যেখানেই সুন্দর কিছু চোখে পড়বে, সেখানেই থামার চেষ্টা করব। হাইওয়ের বদলে চিপাচুপা জঙ্গলের মধ্য দিয়েই যাবার চেষ্টা করলাম এবার যাওয়ার পথে যাই্-ই দেখি, মনে হয়, ইস! আর একটু আগে জানলে কোন চিপায় গাড়ি রেখে এখানে হেঁটে আসতাম।
পরে একটা লেক পার হবার পর একটা চিপা রাস্তায় গাড়ি রেখে হেঁটে আসলাম।

আবার, কতদূর যাবার পর আরেক টুকরা জলরাশি দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম, পানির আওয়াজে বুঝতে পারছিলাম যে কাছাকাছি কোথায় ঝর্ণা আছে।

হাঁটা শুরু করলাম আওয়াজ লক্ষ্য করে, সামনেই একজোড়া বুড়োবুড়ি হাত ধরে হাঁটছে -দেখতে ভালোই লাগছিল। এরপর, বুড়ো সিগারেট ধরাল, তাতে দুটো টান দিয়ে দিল বুড়ির হাতে, বুড়ি দু’একটা টান দিয়ে আবার বুড়োর হাতে। এদের ভালোবাসা আমৃত্যু অটুট থাকুক!

একটু হাঁটতেই পেয়ে গেলাম জায়গাটা যেখান থেকে পানির আওয়াজ আসছিল। উচ্চতা খুব বেশি না, তবে প্রস্থে বেশ বড় আর পানির প্রবাহও বেশ।

অবশ্য এটা প্রাকৃতিক না, হাইড্রোইলেট্রিসিটি বানানোর জন্য লেকের একটা ওভার ফ্লো এটা। কিছুক্ষণ পরেই পানি শুকিয়ে গেল!

এরপর, যখন চ্যাটানুগা পৌঁছালাম, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। কাছাকাছি চ্যাটানুগা নদীর পাশের পার্কে যাওয়ার মত সময় আছে কোনমতে। এই নদীতে ভাসমান একটা আবাসিক হোটেল আছে, আরও আছে টুকটাক রিভার ক্রুজের ব্যবস্থা।

একটু পরেই খুব দ্রুত সন্ধ্যা নেমে এল। নদীর ওপারের চ্যাটানুগা অ্যাকুউরিয়াম, এপার থেকেই দেখে নিলাম।

পরের দিন সকাল বেলা বের হলাম রুবি ফলসের উদ্দেশ্য। এটা একটা প্রাইভেট প্রপার্টি, প্রবেশ মূল্যও বেশ চড়া। তবুও, সরকারি জায়গাগুলো বন্ধ থাকার কারণে ভীড় মনে হল অনেক বেশি। তবে, সব যায়গার টিকেট একসাথে কিনলে, সামান্য মূল্যছাড় আছে।

রুবি ফল আসলে মাটির নিচে, ভূ-পৃষ্ঠের ১১২০ ফিট গভীরে। কাজেই লিফটে নেমে, গুহার ভেতর দিয়ে হেঁটে পৌছাতে হয়। লিফটের লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়া শুরু করলাম আশে পাশের সব লেখাজোখা।
সেসবের অনুবাদ করলে এমন দাঁড়ায় যে, লুক আউট মাউন্টেনে প্রচুর গুহা-টুহা ছিল, আমেরিকার সিভিল ওয়ারের সময় এই সব গুহায় সৈন্যদের জন্য অস্থায়ী হাসপাতালও খোলা হয়েছিল। ১৯০৫ সালে রেললাইন বানানোর জন্য আরেকটা টানেল বানানো হয় এবং সব গুহা-টুহা বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯২৩ সালে লিও ল্যাম্বার্ট নামে একজন গুহোৎসাহী (Cave Enthusiast=গুহা + উৎসাহী ) ভদ্রলোক ভাবলেন এই সব গুহা বেশ মজার জিনিস ছিল (সে নিজে ছোটবেলায় এগুলো চষে বেরিয়েছে বলে ধারণা করা হয়।) এগুলোকে ঠিকঠাক করে টিকিট বিক্রি করলে কেমন হয়// (কী বুদ্ধি! কী বুদ্ধি!) তো, সুবিধাজনক দিক থেকে লোকজন ওঠা নামা করানোর জন্য ল্যম্বার্ট সাহেব লিফট বসানোর পরিকল্পনা করলেন, এবং চারজন শ্রমিক লাগিয়ে দিলেন পাথর সরানোর কাজে। তারা একদিনে ৬ ফিট করে আগাতে পারত। হঠাৎ, একদিন ইউরেকা! ইউরেকা! নিচ থেকে ঠান্ডা বাতাসের আভাস পাওয়া গেল আর সাথে ১৮ ইঞ্চি উচ্চতার একটা ফাঁকাপথ। গুহোৎসাহী জনাব ল্যাম্বার্ট তার এক জানি দোস্তকে নিয়ে ঢুকে পড়লেন সেই ফাঁকা যায়গার ভেতরে হামাগুড়ি দিতে দিতে। তারপর ১৭ ঘন্টা তাদের কোন খবর নেই। পরে, যখন তারা বের হয়ে আসলেন, তখন তারা জানালেন যে তারা অনেক চমৎকার একটা গুহার সন্ধান পেয়েছেন, আর এর শেষে একটা জলপ্রপাতও আছে। দুর্ভাগ্যবশত, অনেকে তাদের কথা বিশ্বাস করল না প্রথমে, ভাবল হয়ত ভিতরে ঢুকে চোখে ভুল-ভাল দেখেছে এরা। পরে, অবশ্য আরেকবার আরও কিছু লোক সাথে করে নিয়ে গিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, গুহার শেষে সত্যিই একটা জলপ্রপাত আছে। ল্যাম্বার্ট সাহেব তার স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে এর নাম রেখে দিলেন, রুবি ফলস।

পরবর্তীতে, ল্যাম্বার্ট সাহেবের পরিকল্পনামত দর্শনীর বিনিময়ে গুহা পরিদর্শনের সুযোগ মেলে জনসাধারণের। সেইযুগে গুহা দেখিয়ে টাকা কামাই করার চিন্তাও বের করতে পারত ক’জন ?

আমাদের ট্যুর গাইড হিসেবে যে মেয়েটা ছিল, সে তার নাম বলল, “কেলডা”। তার মায়ের নাম কেলি আর বাবার নাম ডোনাল্ড মিলিয়ে নাকি তার এই নাম রাখা হয়েছিল।

এরপর লিফটে করে পাতালে নামানো হল সবাইকে। নামার আগে অবশ্য পইপই করে বেল দেয়া হল ভেতরে কোন ত্যাগ করার ব্যবস্থা নেই, কাজেই লেফটে ওঠার আগেই সবার কাজ সেরে নিতে হবে। গুহোৎসাহী ল্যাম্বার্ট সাহেবের মত আমাদের হামাগুড়ি দিতে হবে না, মানুষের আসা-যাওয়ার জন্য সুরঙ্গ প্রশস্ত করা হয়েছে, বসানো হয়েছে বিদ্যুতের তার, তথ্যচিত্র প্রদর্শনের জন্য ডিসপ্লে। গুহার শুরুতের আমদের ছবি তুলে রাখা হল, যদি চাই কিছু পয়সার বিনিময়ে এই ছবি মিলবে। শুরুতেই একটা জায়গায় ছোটখাট হলঘরের মত বানানো, সেখানে সবাইকে দাঁড় করিয়ে একটা ভিডিও দেখাল আর নিয়মকানুন বলে দিল কেলডা। প্রথম নিয়ম হল, সুড়ঙ্গের বেশিরভাগ জায়গাই বেশ সংকীর্ণ। আর অনেকগুলো দল এই মুহূর্তে ভেতরে আছে। একদল যখন বের হয়ে আসবে, আমরা তখন, সুরঙ্গের ডানদিকের দেয়ালে চ্যাপ্টা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। যারা বের হয়ে যেতে থাকবে তাদের সবগুলো দলের জন্যই এই অগ্রাধিকার। আর, আমরা যখন বের হয়ে আসতে থাকব, তখন অন্য দলগুলো আমাদের পথ ছেড়ে দেবে।
এরপর, শুরু হল হাঁটা, কখন ভেজা, কখনও শুকনো আবার কখনো কয়েক ধাপ সিঁড়ি। মাঝখানে থেমে থেমে কিছু স্ফটিক দেখানো হল যার কয়েকটা নাকি দেখতে মাছের মত, কোনটা নাকি হাতির পায়ের মত, কোনটা নাকি ড্রাগনের মত, কোনটা নাকি অস্তগামী সূর্যের মত (প্রত্যেকের গায়ে এরা আবার সাইনবোর্ড সেঁটে দিয়ে গিয়েছে!)। আমরা অবশ্য এটা বুঝতে পারছিলাম, যে এর অনেকগুলো দিয়েই যা ইচ্ছে তা কল্পনা করে নেয়া যায়।

আর চলতে চলতে কয়েকবারই কয়েকটা ফিরতি দলকে জায়গা দেবার জন্য দেয়াল সেঁটে দাঁড়াতে হল। অবশ্য, খুব স্বাস্থ্যবান কয়েকজন এরকম কসরতে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিল না।
রুবি যেহেতু মাটির অনেক অনেক নিচে, এখানে বাইরে থেকে আলো আসার কোন উপায় নেই, কাজেই বৈদ্যুতিক বাতিও ভরসা। আর, এই রুবি’র মালিকরা ভেবেছে, বাতি যাখন জ্বালাতেই হবে তাহলে বাতির রাজা ফিলিপস , মানে রং বেরংয়ের যত বাতি আছে সব লাগিয়ে ফেলি! অনেকটা হাঁটার পর যখন খুব ক্লান্ত লাগছিল, ঠিক এরকম একটা সময়ে সেই রুবির দেখা মিলল। নানান রংয়ের বর্ণচ্ছটায় অসাধারণ লাগছিল জলের এই ধারা।

তবে, সবচেয়ে সুন্দর লাগছিল সাদা রংয়েই।

কিছুক্ষণ খালি চোখে দেখার পর ট্রাইপড বসিয়ে কয়েকটা ছবি তুলতে না তুলতেই জানানো হল এবার ফিরতে হবে। মানে! ২৫ মিনিট হাঁটিয়ে এনে রুবির সাথে মাত্র ৫ মিনিট থাকতে দেবে! কয়েক মুহূর্তের মাঝেই আলো বন্ধ করে কেবল বের হয়ে যাবার জায়গাটায় আলো জ্বেলে রাখা হল -এ যেন একরকম জোর করে তড়িয়ে বের করে দেয়া!
যাই হোক, বের হবার সাথে সাথেই কেলডা বলল, বেরিয়ে যাবার এই অংশটুকুতে প্রচুর বাদুড় আছে, একটু আওয়াজ করলেই বাদুর ওড়া উড়ি শুরু করবে, মাথায় বাথরুম করে দেয়াটাও বিচিত্র না! দলের মেয়েরা বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেল। তবে, কিছুক্ষণ পর কেলডা তার ঝকঝকে সাদা দাঁত কেলিয়ে বলল, সে আমাদের সাথে মশকরা করেছে। টিকিট না কেটে কোন বাদুরকেও গুহার দারোয়ান কম্পানি ঢুকতেই দেবে না। পরে বুঝলাম, এটা বেশ ভালো একটা ট্রিক; অল্প সময় থাকতে দেবার কারণে মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে সুকৌশলে চিন্তা অন্য খাতে পাঠিয়ে দিয়েছে কেলডা।
বের হয়ে আসাটা তেমন কোন ঘটনাবহুল কিছু নয়। কেবল, ভিভিআইপির মত সম্মানটুকু বাদে। এবার আমাদের জন্য অন্য দলগুলো সরে গিয়ে পথ করে দিচ্ছিল। এরপর, আবার লিফটে করে ভুপৃষ্ঠে পুনরাগমন। এক জায়গায় দেখলাম লেখা: “আমাদের গুহা কর্তৃপক্ষ ট্যুর গাইডকে বখশিস প্রদানে কোন বাধা দেয় না, বরং উৎসাহিত করে”
বের হয়ে, আরও কয়েকটা ছবিটবি তুলে পরের ঠিকানায় যাত্রা করলাম। আজ দিনের মধ্যেই হেলানো রেললাইন আর রক সিটি গার্ডেন দেখে শেষ করতে হবে। সেটা নিয়ে আরেকদিন আসব না হয়।
সবাইকে শুভেচ্ছা
[মেঘলা মানুষ]
ভ্রমণের সময়কাল: অক্টোবরের প্রথমার্ধ, ২০১৩
পুনশ্চ:
১। রুবি ফলসের সুরঙ্গের আরও একটা অংশ আছে যেটা মানুষের মাঝে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি, সেই ট্যুর ১৯৩৫ থেকে বন্ধ।
২। খুব খেয়াল করে দেখলে রুবি ফলসের উপরের দিকে কিছু দড়ি ঝুলতে দেখা যায়। এগুলো দিয়ে উপরে উঠে নাকি পানির প্রবাহের আরও খানিকটা ভেতেরে যাবার চেষ্টা করা হয়েছিল। তেমন একটা অগ্রগতি হয়নি তাতে।
৩। রুবি ফলসের পানি প্রাকৃতিকভাবেই পরিষ্কার। তবে, ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হবার কারণে এটা একই সাথে প্রাকৃতিক জোলাপ (Laxative?) হিসেবেও কাজ করে।
তথ্যসূত্র:
১। কেলডা’র বক্তৃতা।
২। জায়গায় জায়গায় বাজানো রেকর্ডেড কথা বার্তা।
৩। উইকি
৪। রুবি ফলসের ওয়েবসাইট

অনেক দিন পর, আবার ঘোরাঘুরি নিয়ে পোস্ট। এবার ছুটিতে একটু লম্বা উইক এন্ড পেয়ে সবাই এদিক সেদিক যাবার জন্য গোছগাছ শুরু করল। কেউ পাহাড়ে যায়, কেউ সাগরে, কেউ আবার জঙ্গলের ডাকে সাড়া দেবার জন্য প্রস্তুত (কলিজায় যাদের সাউন্ড হয়)। তখন, গবর্নমেন্ট শাটডাউন হয়ে থাকায় কাছের জঙ্গলে গিয়ে জ্বিন-ভুতের খাবার হবার ঝুঁকি নিলাম না। আমি আর আমার আদারহাফ জলপ্রপাত (এই নিকে অনেক আগে একটা লেখা পোস্ট হয়েছিল সচলে) ঠিক করলাম, কোন শহর-টহর দেখে আসি। আমরা থাকি বেশ গ্রাম গ্রাম টাইপের জায়গায়। দশতলা একটা স্টুডেন্ট হোস্টেল আছে আমাদের শহরে, যেটা আমদের এখানে সবচেয়ে উচু বিল্ডিং এর পরের সর্বোচ্চটা ৪ তলা।১২-১৩ তলা বিল্ডিংও কোন শহরে দেখলেই আমরা চোখ ট্যারা বানিয়ে তাকিয়ে থাকি। দূরে গেলে বড় শহর আটলান্টা বেশি গ্যাঞ্জাম, সেটা বাদ। এরপর, লুইজিয়ানার নিউ অর্লিন্স যাওয়া যায়, সেটা আরও অনেক বেশি দূর। মাঝারি আকারের একটা শহর আর দেখার মত কিছু টুকটাক আছে এমন একটা জায়গার খোঁজাখুজি করে জলপ্রপাত বের করে ফেলল টেনেসি রাজ্যের চ্যাটানুগা’র (Chattanooga) নাম। নামটা নিয়ে আমার নিজেরই সমস্যা বেঁধে গেল, অনেকটা চাটগাঁর মত নাম। তার উপর, এর উচ্চারণ চাট্টানুগা, না চাত্তানুগা, এটা নিয়ে কনফিউজড। যাই হোক, আপাতত, চ্যাটানুগা চলুক। চ্যাটানুগার আশে পাশের লুক আউট মাউন্টেনের রুবি ফল, হেলানো রেললাইন আর রক সিটিকে সিলবাসে ভরে নিলাম।
সময় মত বোঁচকা বুঁচকি বেঁধে ভাড়া গাড়ি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ঠিক করলাম, পথে যেখানেই সুন্দর কিছু চোখে পড়বে, সেখানেই থামার চেষ্টা করব। হাইওয়ের বদলে চিপাচুপা জঙ্গলের মধ্য দিয়েই যাবার চেষ্টা করলাম এবার যাওয়ার পথে যাই্-ই দেখি, মনে হয়, ইস! আর একটু আগে জানলে কোন চিপায় গাড়ি রেখে এখানে হেঁটে আসতাম।
পরে একটা লেক পার হবার পর একটা চিপা রাস্তায় গাড়ি রেখে হেঁটে আসলাম।

আবার, কতদূর যাবার পর আরেক টুকরা জলরাশি দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম, পানির আওয়াজে বুঝতে পারছিলাম যে কাছাকাছি কোথায় ঝর্ণা আছে।

হাঁটা শুরু করলাম আওয়াজ লক্ষ্য করে, সামনেই একজোড়া বুড়োবুড়ি হাত ধরে হাঁটছে -দেখতে ভালোই লাগছিল। এরপর, বুড়ো সিগারেট ধরাল, তাতে দুটো টান দিয়ে দিল বুড়ির হাতে, বুড়ি দু’একটা টান দিয়ে আবার বুড়োর হাতে। এদের ভালোবাসা আমৃত্যু অটুট থাকুক!

একটু হাঁটতেই পেয়ে গেলাম জায়গাটা যেখান থেকে পানির আওয়াজ আসছিল। উচ্চতা খুব বেশি না, তবে প্রস্থে বেশ বড় আর পানির প্রবাহও বেশ।

অবশ্য এটা প্রাকৃতিক না, হাইড্রোইলেট্রিসিটি বানানোর জন্য লেকের একটা ওভার ফ্লো এটা। কিছুক্ষণ পরেই পানি শুকিয়ে গেল!

এরপর, যখন চ্যাটানুগা পৌঁছালাম, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। কাছাকাছি চ্যাটানুগা নদীর পাশের পার্কে যাওয়ার মত সময় আছে কোনমতে। এই নদীতে ভাসমান একটা আবাসিক হোটেল আছে, আরও আছে টুকটাক রিভার ক্রুজের ব্যবস্থা।

একটু পরেই খুব দ্রুত সন্ধ্যা নেমে এল। নদীর ওপারের চ্যাটানুগা অ্যাকুউরিয়াম, এপার থেকেই দেখে নিলাম।

পরের দিন সকাল বেলা বের হলাম রুবি ফলসের উদ্দেশ্য। এটা একটা প্রাইভেট প্রপার্টি, প্রবেশ মূল্যও বেশ চড়া। তবুও, সরকারি জায়গাগুলো বন্ধ থাকার কারণে ভীড় মনে হল অনেক বেশি। তবে, সব যায়গার টিকেট একসাথে কিনলে, সামান্য মূল্যছাড় আছে।

রুবি ফল আসলে মাটির নিচে, ভূ-পৃষ্ঠের ১১২০ ফিট গভীরে। কাজেই লিফটে নেমে, গুহার ভেতর দিয়ে হেঁটে পৌছাতে হয়। লিফটের লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়া শুরু করলাম আশে পাশের সব লেখাজোখা।
সেসবের অনুবাদ করলে এমন দাঁড়ায় যে, লুক আউট মাউন্টেনে প্রচুর গুহা-টুহা ছিল, আমেরিকার সিভিল ওয়ারের সময় এই সব গুহায় সৈন্যদের জন্য অস্থায়ী হাসপাতালও খোলা হয়েছিল। ১৯০৫ সালে রেললাইন বানানোর জন্য আরেকটা টানেল বানানো হয় এবং সব গুহা-টুহা বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯২৩ সালে লিও ল্যাম্বার্ট নামে একজন গুহোৎসাহী (Cave Enthusiast=গুহা + উৎসাহী ) ভদ্রলোক ভাবলেন এই সব গুহা বেশ মজার জিনিস ছিল (সে নিজে ছোটবেলায় এগুলো চষে বেরিয়েছে বলে ধারণা করা হয়।) এগুলোকে ঠিকঠাক করে টিকিট বিক্রি করলে কেমন হয়// (কী বুদ্ধি! কী বুদ্ধি!) তো, সুবিধাজনক দিক থেকে লোকজন ওঠা নামা করানোর জন্য ল্যম্বার্ট সাহেব লিফট বসানোর পরিকল্পনা করলেন, এবং চারজন শ্রমিক লাগিয়ে দিলেন পাথর সরানোর কাজে। তারা একদিনে ৬ ফিট করে আগাতে পারত। হঠাৎ, একদিন ইউরেকা! ইউরেকা! নিচ থেকে ঠান্ডা বাতাসের আভাস পাওয়া গেল আর সাথে ১৮ ইঞ্চি উচ্চতার একটা ফাঁকাপথ। গুহোৎসাহী জনাব ল্যাম্বার্ট তার এক জানি দোস্তকে নিয়ে ঢুকে পড়লেন সেই ফাঁকা যায়গার ভেতরে হামাগুড়ি দিতে দিতে। তারপর ১৭ ঘন্টা তাদের কোন খবর নেই। পরে, যখন তারা বের হয়ে আসলেন, তখন তারা জানালেন যে তারা অনেক চমৎকার একটা গুহার সন্ধান পেয়েছেন, আর এর শেষে একটা জলপ্রপাতও আছে। দুর্ভাগ্যবশত, অনেকে তাদের কথা বিশ্বাস করল না প্রথমে, ভাবল হয়ত ভিতরে ঢুকে চোখে ভুল-ভাল দেখেছে এরা। পরে, অবশ্য আরেকবার আরও কিছু লোক সাথে করে নিয়ে গিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, গুহার শেষে সত্যিই একটা জলপ্রপাত আছে। ল্যাম্বার্ট সাহেব তার স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে এর নাম রেখে দিলেন, রুবি ফলস।

পরবর্তীতে, ল্যাম্বার্ট সাহেবের পরিকল্পনামত দর্শনীর বিনিময়ে গুহা পরিদর্শনের সুযোগ মেলে জনসাধারণের। সেইযুগে গুহা দেখিয়ে টাকা কামাই করার চিন্তাও বের করতে পারত ক’জন ?

আমাদের ট্যুর গাইড হিসেবে যে মেয়েটা ছিল, সে তার নাম বলল, “কেলডা”। তার মায়ের নাম কেলি আর বাবার নাম ডোনাল্ড মিলিয়ে নাকি তার এই নাম রাখা হয়েছিল।

এরপর লিফটে করে পাতালে নামানো হল সবাইকে। নামার আগে অবশ্য পইপই করে বেল দেয়া হল ভেতরে কোন ত্যাগ করার ব্যবস্থা নেই, কাজেই লেফটে ওঠার আগেই সবার কাজ সেরে নিতে হবে। গুহোৎসাহী ল্যাম্বার্ট সাহেবের মত আমাদের হামাগুড়ি দিতে হবে না, মানুষের আসা-যাওয়ার জন্য সুরঙ্গ প্রশস্ত করা হয়েছে, বসানো হয়েছে বিদ্যুতের তার, তথ্যচিত্র প্রদর্শনের জন্য ডিসপ্লে। গুহার শুরুতের আমদের ছবি তুলে রাখা হল, যদি চাই কিছু পয়সার বিনিময়ে এই ছবি মিলবে। শুরুতেই একটা জায়গায় ছোটখাট হলঘরের মত বানানো, সেখানে সবাইকে দাঁড় করিয়ে একটা ভিডিও দেখাল আর নিয়মকানুন বলে দিল কেলডা। প্রথম নিয়ম হল, সুড়ঙ্গের বেশিরভাগ জায়গাই বেশ সংকীর্ণ। আর অনেকগুলো দল এই মুহূর্তে ভেতরে আছে। একদল যখন বের হয়ে আসবে, আমরা তখন, সুরঙ্গের ডানদিকের দেয়ালে চ্যাপ্টা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। যারা বের হয়ে যেতে থাকবে তাদের সবগুলো দলের জন্যই এই অগ্রাধিকার। আর, আমরা যখন বের হয়ে আসতে থাকব, তখন অন্য দলগুলো আমাদের পথ ছেড়ে দেবে।
এরপর, শুরু হল হাঁটা, কখন ভেজা, কখনও শুকনো আবার কখনো কয়েক ধাপ সিঁড়ি। মাঝখানে থেমে থেমে কিছু স্ফটিক দেখানো হল যার কয়েকটা নাকি দেখতে মাছের মত, কোনটা নাকি হাতির পায়ের মত, কোনটা নাকি ড্রাগনের মত, কোনটা নাকি অস্তগামী সূর্যের মত (প্রত্যেকের গায়ে এরা আবার সাইনবোর্ড সেঁটে দিয়ে গিয়েছে!)। আমরা অবশ্য এটা বুঝতে পারছিলাম, যে এর অনেকগুলো দিয়েই যা ইচ্ছে তা কল্পনা করে নেয়া যায়।

আর চলতে চলতে কয়েকবারই কয়েকটা ফিরতি দলকে জায়গা দেবার জন্য দেয়াল সেঁটে দাঁড়াতে হল। অবশ্য, খুব স্বাস্থ্যবান কয়েকজন এরকম কসরতে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিল না।
রুবি যেহেতু মাটির অনেক অনেক নিচে, এখানে বাইরে থেকে আলো আসার কোন উপায় নেই, কাজেই বৈদ্যুতিক বাতিও ভরসা। আর, এই রুবি’র মালিকরা ভেবেছে, বাতি যাখন জ্বালাতেই হবে তাহলে বাতির রাজা ফিলিপস , মানে রং বেরংয়ের যত বাতি আছে সব লাগিয়ে ফেলি! অনেকটা হাঁটার পর যখন খুব ক্লান্ত লাগছিল, ঠিক এরকম একটা সময়ে সেই রুবির দেখা মিলল। নানান রংয়ের বর্ণচ্ছটায় অসাধারণ লাগছিল জলের এই ধারা।

তবে, সবচেয়ে সুন্দর লাগছিল সাদা রংয়েই।

কিছুক্ষণ খালি চোখে দেখার পর ট্রাইপড বসিয়ে কয়েকটা ছবি তুলতে না তুলতেই জানানো হল এবার ফিরতে হবে। মানে! ২৫ মিনিট হাঁটিয়ে এনে রুবির সাথে মাত্র ৫ মিনিট থাকতে দেবে! কয়েক মুহূর্তের মাঝেই আলো বন্ধ করে কেবল বের হয়ে যাবার জায়গাটায় আলো জ্বেলে রাখা হল -এ যেন একরকম জোর করে তড়িয়ে বের করে দেয়া!
যাই হোক, বের হবার সাথে সাথেই কেলডা বলল, বেরিয়ে যাবার এই অংশটুকুতে প্রচুর বাদুড় আছে, একটু আওয়াজ করলেই বাদুর ওড়া উড়ি শুরু করবে, মাথায় বাথরুম করে দেয়াটাও বিচিত্র না! দলের মেয়েরা বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেল। তবে, কিছুক্ষণ পর কেলডা তার ঝকঝকে সাদা দাঁত কেলিয়ে বলল, সে আমাদের সাথে মশকরা করেছে। টিকিট না কেটে কোন বাদুরকেও গুহার দারোয়ান কম্পানি ঢুকতেই দেবে না। পরে বুঝলাম, এটা বেশ ভালো একটা ট্রিক; অল্প সময় থাকতে দেবার কারণে মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে সুকৌশলে চিন্তা অন্য খাতে পাঠিয়ে দিয়েছে কেলডা।
বের হয়ে আসাটা তেমন কোন ঘটনাবহুল কিছু নয়। কেবল, ভিভিআইপির মত সম্মানটুকু বাদে। এবার আমাদের জন্য অন্য দলগুলো সরে গিয়ে পথ করে দিচ্ছিল। এরপর, আবার লিফটে করে ভুপৃষ্ঠে পুনরাগমন। এক জায়গায় দেখলাম লেখা: “আমাদের গুহা কর্তৃপক্ষ ট্যুর গাইডকে বখশিস প্রদানে কোন বাধা দেয় না, বরং উৎসাহিত করে”
বের হয়ে, আরও কয়েকটা ছবিটবি তুলে পরের ঠিকানায় যাত্রা করলাম। আজ দিনের মধ্যেই হেলানো রেললাইন আর রক সিটি গার্ডেন দেখে শেষ করতে হবে। সেটা নিয়ে আরেকদিন আসব না হয়।
সবাইকে শুভেচ্ছা

[মেঘলা মানুষ]
ভ্রমণের সময়কাল: অক্টোবরের প্রথমার্ধ, ২০১৩
পুনশ্চ:
১। রুবি ফলসের সুরঙ্গের আরও একটা অংশ আছে যেটা মানুষের মাঝে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি, সেই ট্যুর ১৯৩৫ থেকে বন্ধ।
২। খুব খেয়াল করে দেখলে রুবি ফলসের উপরের দিকে কিছু দড়ি ঝুলতে দেখা যায়। এগুলো দিয়ে উপরে উঠে নাকি পানির প্রবাহের আরও খানিকটা ভেতেরে যাবার চেষ্টা করা হয়েছিল। তেমন একটা অগ্রগতি হয়নি তাতে।
৩। রুবি ফলসের পানি প্রাকৃতিকভাবেই পরিষ্কার। তবে, ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হবার কারণে এটা একই সাথে প্রাকৃতিক জোলাপ (Laxative?) হিসেবেও কাজ করে।

তথ্যসূত্র:
১। কেলডা’র বক্তৃতা।
২। জায়গায় জায়গায় বাজানো রেকর্ডেড কথা বার্তা।
৩। উইকি
৪। রুবি ফলসের ওয়েবসাইট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন