লাওসের ভিয়েনচান শহরে যাঁরা আন্তর্জাতিক সংস্থা বা দূতাবাসে কাজ করেন, তাঁদের সমাজ আকারে ছোট, এবং নানা দেশে থেকে আসা মানুষজনদের মধ্যে অন্তরঙ্গতাও নিবিড়। এঁদের মধ্যে সামাজিকতার নিরিখে মার্গারেটকে নিঃসঙ্গ বলা চলে, চালচলনে সে ব্যতিক্রমও বটে। বছর দেড়েক হলো আমেরিকার কলোরাডো থেকে মার্গারেট লাওসে এসেছে। সে সচরাচর কাউগার্লদের মতো স্কিনটাইট জিনসের সঙ্গে চামড়ার জ্যাকেট ও হাইবুট পরতে ভালোবাসে। কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলা তেমন একটা পছন্দ করে না। মাঝেমধ্যে তাকে দেখা যায় হ্যাটে কোঁকড়ানো সোনালি চুল ঢেকে তাদুয়া রোডে দ্রুত মোটরবাইক ছোটাচ্ছে। সে নিঃসন্তান, কর্মহীন গৃহিণী, কাজকর্ম খঁুজতে তাঁকে কখনো, দেখা যায়নি। শোনা যায় তাঁর স্বামী কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার বৃহৎ চাঁই। তিনি সর্বক্ষণ ফ্লাই করে বেড়ান সিউল, সিঙ্গাপুর, জাকার্তা ও বেইজিংয়ে। মার্গারেটকে আমি কখনো তার স্বামীর সঙ্গে যুগলে কোথাও যেতে দেখিনি।
এক বিকালে তাকে নামফুর ফোয়ারা চত্বরে একাকী বসে বিয়ার পান করতে দেখে ‘হাই ডিয়ার’ বলে ওর পাশে গিয়ে বসেছিলাম। সে অনুচ্চ স্বরে কান্ট্রি ওয়েস্টার্ন মিউজিকের লিরিক গাইছিল। তার কণ্ঠস্বরের সুরেলা উচ্চারণকে কেউ কিন্নরকণ্ঠি আখ্যা দিলে তা অসংগত হবে না একেবারে। হক কথা বলতে কি—আমি আলাপ জমাতে চেয়েছিলাম; এবং সে বলেছিল কলোরাডোর এক ফার্মে জননীহীন অবস্থায় একাকী বেড়ে ওঠার কথা। তার বাবা গিটারে কান্ট্রি ওয়েস্টার্ন মিউজিক বাজাতেন, আর তাদের ফার্ম হাউসে ছিল অজস্র ‘হিলিবিলি’ ‘ব্লু গ্রাস’ ইত্যাদি মার্কিন ঘরানার গানের রেকর্ড। ঘোড়া ছুটিয়ে খামারের জার্সি গরুগুলোর দেখভাল করার সময় মাঝেমধ্যে তার মগজে ঝেঁপে আসত সংগীত। আর সে প্রেইরির নিঃসঙ্গ প্রান্তরে গিটার বাজিয়ে সুরে তর্পণ করত।
মার্গারেটের সঙ্গে আরেকটু সামাজিকভাবে মেশার প্রেরণা থেকে তাকে ভিয়েনচান শহরে আমাদের কুঠিতে যে নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করা গানের কালেকশন আছে, তা জানিয়েছিলাম। উইক এন্ডের এক দুপুরে সে এসেওছিল। অর্কিডের বাগিচায় বসে অনেকক্ষণ আমরা ব্যাটারি লাগানো টেপে ভিন দেশের বিচিত্র সব গানও শুনলাম ঘণ্টা কয়েক। তারপর সে আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে ধার চাইল রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলগীতির কটি ক্যাসেট।
মাস খানেক পরে তার সঙ্গে আবার দেখা হলো অস্ট্রেলিয়ান ক্লাবে। একটি ফিরিঙ্গিপানি গাছের নিচে বিকিনি পরে সে ডেকচেয়ারে শুয়েছে। মেয়েটি নিজের শরীরের সুদৃশ্য সম্ভার সূর্যস্নাত করতে করতে তাকিয়ে ছিল মেকং নদীর দিকে। আমি কথা বলার জন্য কাছ দিয়ে হেঁটে গেলে শুনতে পাই সে অন্যমনস্কভাবে গাইছে, ‘ক্রেইজি, আইম ক্রেইজি ফর ফিলিং সো লোনলি, আইম ক্রেইজি ফর ফিলিং সো ব্লু’। তার লিরিকের নিঃসঙ্গ উচ্চারণের সঙ্গে বিষণ্নতার দহন সংক্রমিত হয়ে আমার অনভূতিতে ছড়িয়েছিল নীল বিষ। হঠাৎ গান সমাপ্ত না করে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তোমার বাংলা গানের টেপগুলো আরও মাস খানেক রাখতে পারি কি? আমি চেষ্টা করছি গিটারে সুর তোলার?’

ভিয়েনচান শহর থেকে মাইল পনেরো দূরে মেকং নদীর তীর ঘেঁষে আছে শতাধিক মূর্তিতে সাজানো বিরল একটি ভাস্কর্যের বাগিচা। বেিশর ভাগ মূর্তির গঠনশৈলীতে বৌদ্ধ ঘরানার ধর্মীয় ভাবনা প্রতিফলিত হলেও বেশ কিছু ভাস্কর্যে বিরাজ করছেন রাজা রামচন্দ্র, হনুমানজি এবং পুরাণের নানা চরিত্র—মায় রাক্ষস-খোক্কস, দৈত্যদানব ইত্যাদি। বিদেশ থেকে কোনো মেহমান এলে আমি প্রায়ই তঁাদের নিয়ে যাই মূর্তির এ মর্তলোকে। এ রকম একটি ট্রিপে দাতা সংস্থার এক সাহেবকে নিয়ে এসেছি ভাস্কর্যের বাগিচায়। সাহেব পাথরে তৈরি বিপুল আকারের শায়িত বুদ্ধমূর্তির ভিডিও করছেন। এ ফাঁকে আমি চলে আসি বাগিচার সবচেয়ে বিচিত্র এক দৈত্যের মূর্তির কাছে। আচানক এ ভাস্কর্যের অনন একাধিক, চারদিকে ছড়ানো তার অনেকগুলো হাতের তেলোতে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট পাথরের ফিগারিন। হঠাৎ দেখি, দৈত্যের গতরে হেলান দিয়ে বসে মার্গারেট। অস্তগামী সূর্যের রাশ্মি তার সোনালি চুলে ঝলসে যাচ্ছে। টেপরেকর্ডার হাতে সে শূন্যতায় এমনভাবে তাকিয়ে আছে যে মনে হয় বালিকার চীনামাটির খেলনা পুতুলটি ভেঙে গেছে। এখন তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলে সে হাত-পা ছুড়ে কেঁদে ওঠবে হু হু করে।
চোখাচোখি হতেই জিজ্ঞেস না করে পারি না, ‘হোয়াটস আপ মার্গারেট? কী হয়েছে তোমার?’ খুব কষ্টে সে যা বলে তার সারাংশ হচ্ছে, এ দৈত্যকে তুষ্ট করার জন্য কিছু মানুষ ঢোল-ডফকি-খোল-করতাল নিয়ে তুমুল স্বরে গান করছিল; মার্গারেট তাদের সংগীত রেকর্ড করতে গেলে তারা তার কাউগার্লসুলভ পোশাক-আশাক ও স্বর্ণািল চুলের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে স্রেফ ছুটে পালায়। মার্গারেট করুণ মুখে জানতে চায়, ‘টেল মি, ডু আই লুক রিয়েলি টেরিবোল? আসলেই কি আমাকে কোনো দৈত্য-দানোর কন্যার মতো দেখাচ্ছে?’
আরও মাস ছয় কিংবা আট কেটে গেছে। মার্গারেটের কাছ থেকে ক্যাসেটগুলো আমি ফেরত পাইনি। তাতে যে খুব মনঃক্ষুণ্ন হয়েছি, তা-ও না। তারপর এক উইক এন্ডে ভিয়েনচান শহর থেকে বেশ দূরে নিবিড় বনানীর এক রিসোর্ট লাও-পাকোতে এসেছি একটু রিলাক্স করতে। রিসোর্টের বাঁশ-বেত-কাঠের ছোট্ট ছোট্ট কটেজ একেবারে নদীর পাড় ঘেঁষে। কটেজের বারান্দায় ঝুলানো দড়ির হ্যামকে শুয়ে তাকিয়ে ছিলাম কচুরিপানা ভাসা নদীজলের দিকে। বিকাল দ্রুত নিভে আসছে। রিসোর্টের তত্ত্বাবধায়ক জার্মান তরুণ গুন্থার বাগদনাফ এসে বলে, ‘চিয়ার আপ ম্যান, একটু পর ক্যাম্পফায়ারে আগুন দেব, চলে আসো, আজ কিন্তু লাও-পাকোতে সেক্সি সারপ্রাইজ আছে।’
ঠিক সন্ধ্যার দিকে লাও-পাকোর লঙহাউস বা আদিবাসীদের কায়দায় তৈির দীর্ঘ বারান্দাওয়ালা ঘরের কাছাকাছি আঙিনায় ল্যান্ড করে একটি হেলিকপ্টার। তা থেকে নেমে আসেন মার্কিন রাষ্টদূত উইন্ডি চেম্বারলিন। গিটার, বঙ্গো, মারাক্কাস, ড্রাম নিয়ে তঁার পেছন পেছন নামে ভিয়েনচান শহরের এক্সপ্যাট বা আন্তর্জাতিক সমাজের বেশ কজন কেষ্টবিষ্টু। সব শেষে নামে লেদার জ্যাকেট বুটে কাউগার্লের সাজে সজ্জিত মার্গারেট।
আঁধার গাঢ় হতেই গুন্থার বাগদনাফ আগুন জ্বেলে ক্যাম্পফায়ার সাজায়। আমরা রেদা দিয়ে ঘষে-মেজে স্মুদ করা সব গাছের গুঁড়িতে বসি। আজ জার্মানদের অক্টোবর ফেস্টের পরব। তাই গুন্থার দেদার ওনিওন কেইক ও ড্রাফট বিয়ারের বন্দোবস্ত করেছে। আগুনের আঁচে কালো সফট লেদারের কেবল কাঁচুলি পরা মার্গারেটকে সত্যিই সেক্সি সারপ্রাইজের মতো দেখায়। তার পাশে বসে এ ইনফরমাল আসরেও তিন প্রস্থ স্যুট ও হ্যাট মাথায় এক প্রৌঢ় ইংরেজ। সে ছাতি দিয়ে খঁুচিয়ে খঁুচিয়ে মুড়মুড়ে সব ঝরা পাতায় ছিদ্র করছেন। তঁাকে দেখে শার্লক হোমসের গোয়েন্দা গল্পের চরিত্রের মতো মনে হয়। মার্গারেট গিটার বাজিয়ে ‘লিটল লগ কেবিন ইন দ্য লেইন’ গাইতে শুরু করলে এক্সপ্যাট সব কেষ্টবিষ্টু ড্রাম মারাক্কাস বাজিয়ে তার সঙ্গে সংগত করেন। ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝতে পারি স্যুট পরা বেজায় ফরমাল ইংরেজ জেন্টেলম্যান হচ্ছেন মার্গারেটের স্বামী। ভদ্রলোক ছোট্ট কাচের গ্লাসে ক্রমাগত ভোদকার শট নিতে নিতে সিগার হাতে তাকিয়ে থাকেন শূন্যতায়। মার্গারেট একটি দুটি পপুলার ‘হিলিবিলি’ অঙ্গের গান করে খালি খালি গিটারে সুর খেলায়। সে আজ আমার দিকে একেবারেই নজর দিচ্ছে না দেখে একটু অভিমানাহত হয়ে যেই ভাবছি আসর ছেড়ে উঠব, ঠিক তখনই সে গিটারে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’র কেবল একটি চরণ বাজিয়ে মৃদু হাসে। অবশেষে সে ‘গ্রিন গ্রিন গ্রাস অব হোম’ গাইতে শুরু করলে সমগ্র আবহে ছড়িয়ে পড়ে নস্টালজিক বিষণ্নতা। আমরা নানা দেশ থেকে আসা সব এক্সপ্যাট মানুষরা যেন মুহূর্তের জন্য স্বদেশের সবুজ নিসর্গের কথা ভাবি।
ভোদকার একাধিক শটের জন্য দ্রুত বেহেড হয়ে গেলে একপর্যায়ে মার্গারেট তার স্বামীকে কটেজে নিয়ে যায়। এ ফাঁকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত চাউর করেন যে আগামী মাসে ব্যাংকক থেকে বের হবে মার্গারেটের প্রথম সিডি। বঙ্গো ও ড্রাম বাজিয়েরা আলাপ করেন তাকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলবেন কান্ট্রি ওয়েস্টার্ন মিউজিকের ব্যান্ড। এ প্রস্তাবে মগ বটমস-আপ করে পান চলে ড্রাফ্ট বিয়ার। ব্যান্ডের নাম ‘এক্সপ্যাট’ হবে না ‘সেক্সপ্যাট’ হবে তা নিয়ে চলে খানিক তাত্ত্বিক গোছের বিতর্ক।
ঘুম আসছিল না, তাই বেশ রাতে কটেজ থেকে বেরিয়ে নদীর তীরে খোলামেলা চারচালা ডাইনিং হলে আসি। চলমান জলে ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলো। পতঙ্গের রকমারি ধ্বনিতে সমগ্র চরাচর নিবিড় হয়ে আছে। আর এ নির্জনতায় বেতের চেয়ারে একাকী বসে মার্গারেট ওয়াকম্যানে গান শুনছে। আমি কাছে আসতেই সে ইয়ারফোন আমার দিকে এগিয়ে দেয়। আশ্চর্য হয়ে শুনি, তাতে বাজছে, ‘গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়... সে কি তুমি সে কি তুমি’? আমার টেপের যে সঠিক ব্যবহার হচ্ছে, তা বুঝতে পারি, সঙ্গে সঙ্গে আন্দাজ করার চেষ্টা করি, এটি আমার হাতে আর কখনো ফিরে আসবে কি?
মে ১৬, ২০১৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন