বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০১৪

গুয়াহাটীতে ( গৌহাটি ) দুই দিন

 ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটী শহরে খনি ও খনিজ শিল্প সম্পর্কিত দুই দিনের এক সম্মেলনে গেছি সম্প্রতি।আমি একে দীর্ঘদিন ধরে গৌহাটি নামে জানতাম। গিয়ে দেখি ওরা লিখছে ''গুয়াহাটী''( ইংরেজীতে লেখে Guwahati)। অবশ্য সরাসরি ''য়'' ব্যবহার করে না। ব্যবহার করে ''প'' বর্গীয় ''ব'' ছাড়া শ এর আগে যে ''ব'' আছে সেটি। এটি স্বাধীন,স্বদেশ,স্বজন ইত্যাদি লিখতে ব্যবহৃত হয়। ইংরেজীতে w, আরবীতে ''ওয়া'' এর প্রতিবর্ণীকরণেও এটি ব্যবহৃত হয়। সিলেট ও আসাম এলাকায় ''গুয়া'' অর্থ ''সুপারি''। গুয়াহাটী মানে সুপারি বাজার। সুউচ্চ পাহাড়ঘেরা বিশাল এক উপত্যকায় এই শহরের অবস্থান। এ শহরের ''দিস পুর'' এলাকাটি আসাম রাজ্যের রাজধানী। এই শহরের পাশ দিয়ে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের বিপুল সূচনাধারা বয়ে গেছে। এই শহরে বাস করেন গণসঙ্গীতের কিংবদন্তী পুরুষ (বর্তমানে বিজেপি নেতা) ড.ভূপেন হাজারিকা। কর্মব্যস্ততার জন্য শহরটি ভালো করে দেখতে পারিনি বটে কিন্তু এই দুই দিনে (৫ নভেম্বর রাত থেকে ৮ তারিখ সকাল পর্যন্ত) গুয়াহাটি শহরসহ আসাম রাজ্যের জন্য অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে।

প্রস্তুতি

যাত্রার প্রাথমিক প্রস্তুতির পর বিমানের টিকিট বুকিং দিয়ে শুরু করলাম ভিসার প্রস্তুতি। এটা আমার জীবনের এক মর্মান্তিক আর অপমানকর অভিজ্ঞতা। ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এক সহকর্মীসহ আমরা যে অপমানকর ব্যবহারের সম্মুখিন হয়েছি তাতে আমরা যে একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক, এই স্বাধীনতা যে আমরা মুফতে বা কারো দয়ায় পাইনি, ত্রিশ লক্ষ প্রাণ আর দু'লাখ মা-বোনের চরম ত্যাগের বিনিময়ে বীরবিক্রমে লড়াই করে পেয়েছি সেটা ভুলে যাবার দশা। পরদিন সকালে ফ্লাইট। তার আগের দিন সন্ধ্যা ৬টায় শেষ পর্যন্ত দয়া (!?) করে ভিসা দিলেন তাঁরা। ততক্ষণে বুকিং দেয়া টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে অন্যের কাছে। এদিকে ব্যাঙ্কের লোককে অনেক অনুরোধ করে বসিয়ে রেখেছি। কিন্তু কনফার্মড টিকিট ছাড়া স্বভাবত:ই তিনি ডলার এনডোর্স করতে পারবেন না। এখন টিকিট কোথায় পাই। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানে কোলকাতা, সেখান থেকে জেট এয়ারে গুয়াহাটী। আসা যাওয়ার সময় কোলকাতায় প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা করে বসে থাকতে হবে। অগত্যা তাই মেনে টিকিট নিলাম। সেই টিকিট নিয়ে দৌড়ে গিয়ে অনেক কষ্টে ডলার এনডোর্স করে ডলার নিলাম। ততোক্ষণে ভ্রমনের সব আনন্দ মহাবিষাদে পরিণত হয়ে গেছে। হাইকমিশনের লোকজনের দুর্ব্যবহার আর হয়রানীর কথা মনে হলে এখনো বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছি।

যাত্রারম্ভ

পরদিন (৫ নভেম্বর) বেলা ২টা ২০-এ বিমানে চড়লাম। এই প্রথম বাংলাদেশ বিমানে যাচ্ছি। ঢুকেই মন খারাপ হয়ে গেলো। জরাজীর্ন চেহারা দেখে মনে হলো এটা বিমানকূলের মুড়ির টিন সার্ভিস। আমাদের পাইলটদের দক্ষতা আর দু:সাহসকে আমি এখন ভীষণ শ্রদ্ধা করি। পৃথিবীর আর কোন দেশের পাইলটরা এই বিমান চালাতে রাজী হবেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। আমাদের বিস্মিত করে প্রায় নির্ধারিত সময়েই বিমান আকাশে উড়লো। জানালার পাশে বসে বাংলাদেশ দেখতে দেখতে যাচ্ছি। কোলকাতার কাছাকাছি আসার পর ভীষণ জোরে শব্দ হলো সাথে ভালো রকমের একটা ঝাঁকিও খেলাম। জোরে ছুটেচলা গাড়ির চাকার নীচে বিশাল সাইজের ইট পড়ার মতো শব্দ।এর আগেও অনেকবার বিমান ভ্রমন করেছি দেশে বিদেশে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা প্রথম। পাশের একজন বললেন, চাকা খোলার শব্দ। তারপর ভয়মুক্ত হলাম। শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় কোলকাতায় নেমেও পড়লাম।

প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা পর ওখানকার সময় সন্ধ্যা ৬টায় জেট এয়ারে চড়লাম। ঝকঝকে নতুন বোয়িং ৭৩৭-৯০০। মন ফুরফুরে হয়ে গেলো। কিন্তু যাত্রার শুরুর পর আরেকটা ধাক্কা খেলাম। এয়ার হোস্টেজ ছোট্ট একটা পানির বোতল দিলেন। ২০০ এমএল পানি ! এক ঘন্টা ১০ মিনিটের ফ্লাইটে এইটুকুই খেদমত। নাস্তা খেতে হলে কিনে খেতে হবে। এটাও আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। আমাদের দেশের ভেতর ৪০/৪৫ মিনিটের ফ্লাইটেও কমপক্ষে নাস্তা দেয়া হয় কোল্ডড্রিঙ্কসসহ। ভাঙ্গাচোরা বিমানের ৪০ মিনিটের ফ্লাইটেও কেক, স্যাণ্ডউইচ আর কোক দিয়েছিলো। বাঙালী ধনকূবের সুব্রত রায়ের সাহারা গ্রুপেরই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান জেট এয়ার। এরপর থেকে আমি বলি ''২০০এমএল পানি এয়ার''।

গুয়াহাটী পৌঁছে দেখি নির্ধারিত টেক্সি আসেনি। ফোনও করার উপায় নেই। উপস্থিত টেক্সিচালকরা ঘিরে আছে জোঁকের মতো। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সেই মহান টেক্সিওয়ালা হাজির হলেন। নাম কামাক্ষা নাথ। আসামের কামরূপ জেলার কামরূপ আর গুয়াহাটী শহরের কামাক্ষার জাদুবিদ্যার সুনাম শৈশব থেকে শুনে আসছি। কামাক্ষানাথের চেহারা দেখে মনে হলো কোন জাদুকরের ডেকে আনা জাদুই চরিত্র।

এয়ার পোর্ট থেকে সোজা পূর্ব নির্ধারিত হোটেল নক্ষত্রে গেলাম পার্টিতে যোগ দিতে। এখানেই আমাদের ওঠার কথা ছিলো। কিন্তু বুকিং মিললো না। পরে ঠিক হলো হোটেল নন্দনে থাকবো। যাই হোক, হোটেল নক্ষত্রে পৌঁছে দেখি পুলিশে পুলিশারণ্য ! সাথে আরো বিচিত্র পোষাকের নানা বাহিনী। সৈন্যও কিছু দেখলাম। বহু কষ্টে হোটেলে ঢুকলাম। এই হোটেলে সিট না পাওয়া আর কড়া নিরাপত্তার কারণ জানলাম, পরদিন ৬ তারিখে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট টিম উঠবে ৮ তারিখে গুয়াহাটীতে ভারত-অসি ম্যাচ খেলার জন্য।

পার্টি সেরে হোটেল নন্দনে পৌঁছাতে রাত এগারটা হয়ে গেলো। এই রাতেও রাস্তায় যে জ্যাম দেখলাম আর কামাক্ষানাথের কাছে যা শুনলাম তাতে শুরুতেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো গুয়াহাটীর যানজটের কাছে ঢাকার যানজট হেরে ভূত হয়ে যাবে।

মনিরাম দেওয়ান ট্রেড সেন্টারের সাথে বালাজী টেম্পল
Click This Link

নন্দন হোটেল

নন্দন হোটেলে এসে হোটেল কর্মীদের পেশাদারী মনোভাব ও দক্ষতা দেখে বেশ ভালো লাগলো। তিন তারকা এ হোটেলটি পল্টন বাজার এলাকায়। এখানকার এককালের সবচেয়ে ভালো হোটেল। এর চেয়ে ভালো নতুন দু'টি হোটেলে ভারতীয় আর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের অবস্থানের জন্য বুকড থাকায় এখানেই উঠতে হলো। ভেতরের সাজসজ্জায় প্রাচীনত্বের সৌন্দর্য ফুটে আছে। লিফট দুটোও এন্টিক- লোহার গ্রিলের দরজাবিশিষ্ট।

সকালে এক কপি ''টাইমস অব ইণ্ডিয়া''র সাথে ফ্রি নাস্তার কুপন। পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নাস্তার টেবিলে গিয়ে ভালো লাগলো। ব্যুফে সিস্টেম। তবে আমাদের কাছাকাছি নাস্তার ধরণ। নাস্তার মেন্যুটা আর নাস্তার মান খুব ভালো। স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। লুচি,সবজি,ডাল,টোস্টেড ব্রেড,ফ্রেন্চ ফ্রাই, টক এইসব বিচিত্র স্বাদের আয়োজন।

মণিরাম দেওয়ান ট্রেড সেন্টার

এরপর কামাক্ষানাথের গাড়ীতে তীব্র যানজট পেরিয়ে সম্মেলনস্থল মণিরাম দেওয়ান ট্রেড সেন্টারে হাজির হলাম সকাল সাড়ে নটায়। যাবার পথে শহর ঘিরে থাকা আকাশছোঁয়া পাহাড়ের সৌন্দর্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। কামাক্ষানাথ জানালেন এসব পাহাড়ে এখনো কিছু চিতাবাঘের আনাগোনা আছে। মাঝে মাঝে চিতাবাবুরা শহর পর্যটনে বেরিয়ে পড়েন। তখন বন বিভাগের লোকজনের ডাক পড়ে। তাঁরা চিতাবাবুদের ধরে আবার তাদের পাহাড়ী বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে আসেন। মাঝে মাঝে নরমাংসভোজের সাধও তারা অপূর্ণ রাখেন না। পাহাড়ে নরভোজী চিতাদের আনাগোনা আছে বলে বাঘেরবাড়া মানুষজন যে পাহাড়বিবাগী হয়ে গেছেন তা কিন্তু নয়। গাছের ফাঁকে ফাঁকে সেই ঘোর পাহাড়চূড়াতেও বহু ঘরের চাল মাথা বের করে আছে। গুয়াহাটী মেডিকেল কলেজও কম যাবে কেন ? সেটাও একটা দশাসই পাহাড়ের চূড়ায় মাথা উঁচিয়ে আছে।

সম্মেলনে যাবার আগে যেমনটা ভেবেছিলাম আয়োজন দেখলাম তার চেয়ে বড়ো। এলাহী কাণ্ডই বলা চলে। প্রধান অতিথি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের খনিজসম্পদ মন্ত্রী মি. বি.কে. হেনডিক। বিশেষ অতিথি আসামের মুখ্যমন্ত্রী মি. তরুণ গগৈ, আসামের খনিজ সম্পদ মন্ত্রী মি. খোরসিঙ এংটে ও মিজোরামের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ; শ্রম,কর্মসংস্থান ও শিল্প প্রশিক্ষণ এবং ব্যবসা ও বাণিজ্য মন্ত্রী মি. লালরিনলিয়ানা সাইলো। আরো ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের খনিজ সম্পদ সচিব শ্রীমতি শান্থা শীলা নায়ার এবং আসাম সরকারের খনিজ সম্পদ কমিশনার ও সচিব মি. রবি কাপুর।

এটা ছিলো মূলত: ইনভেস্টারস কনফারেন্স। ফলে খনিজ সেক্টরের সব মহারথীরাই হাজির ছিলেন। ফেডারেশন অব ইণ্ডিয়ান মিনারেল ইণ্ডাস্ট্রিজ অন্যতম প্রধান ভূমিকায় ছিলো। এই সংগঠনটি খুবই প্রভাবশালী। কারণ খনিজ সেক্টর হচ্ছে সব চেয়ে ব্যয়বহুল সেক্টর। এই সেক্টরের মেনিবিড়ালরাই অন্য অনেক সেক্টরের বাঘের চেয়ে বড়ো সাইজের। শতশত কোটি বা হাজার কোটিতে এদের হিসাব। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই সেক্টরের হিসাব লক্ষ কোটিতে। সেভেন সিস্টার্স ( এখন এর সাথে সিকিমকেও জুড়ে আট বোন বলা হচ্ছে ) বলে পরিচিত এই অঞ্চল খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। ( আসাম,মণিপুর,মেঘালয়,অরুণাচল প্রদেশ,মিজোরাম, নাগাল্যাণ্ড ও ত্রিপুরা )

সরকারের তরফ থেকে এই সম্মেলনে তুলে ধরা হলো গত কয়েক বছরের কিভাবে শতশত কোটি রুপি ব্যয়ে এসব রাজ্যে বিনিয়োগবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। জানানো হয়েছে চলমান উন্নয়ন পরিকল্পনায় কতো বিপুল বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবং বিনিয়োগের জন্য কী ব্যাপক ও চোখ কপালে ওঠার মতো উৎসাহপ্যাকেজ দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোর তরফ থেকে। সব কথা মনে নেই তবে এটুকু মনে আছে শতভাগ ট্যাক্স হলিডে, ক্যাপিটাল মেশিনারির ট্যাক্সের ওপর ৯০% পর্যন্ত রি-ইমবার্সমেন্ট ( এখানে অবশ্য কিছু সীমারেখা আছে)। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো ৩০% পর্যন্ত বিনিয়োগ ফেরতের ঘোষনা এবং এর কোন ঊর্ধসীমা নেই অর্থাৎ বিনিয়োগ হাজার কোটিতে হলেও তার ৩০% ফেরৎ দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। মন্ত্রী, সচিব সমস্বরে এসব জানিয়ে বিনিয়োগের আহবান জানালেন। এ সবের সাথে ভাবা হচ্ছে ''জিও ট্যুরিজম'' চালুর কথাও। আকর্ষণীয় জিওলজিক্যাল সাইটগুলো দেখানোর ব্যবস্থা থাকবে পর্যটকদের। ঘনসবুজ নিবিড় বনে ছাওয়া মন ভরিয়ে দেয়া রোমাঞ্চকর পাহাড়ী পথে ছুটে চলার বিমলানন্দতো সাথে থাকছেই।

মন্ত্রী সচিবদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সাথে বিপুলসংখ্যক কমাণ্ডোও মোতায়েন ছিলো। এর বাইরে স্থানীয় কোন নেতাকর্মী কিংবা আমলা বাহিনীর টিকির সন্ধানও পাওয়া গেলো না আসেপাশে। মন্ত্রী সচিবদের কথার ওজন, সেক্টর সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা আর কাজের গতিশীলতা দেখে টাসকি খাবার যোগাড় ! ব্যবসায়ীরা আইনগত কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুললেন। সচিব প্রতিটি সমস্যার জবাবে জানালেন নতুন তৈরি করা আইনে কী সব সংস্কার করা হচ্ছে। সাথে জানালেন লোকসভার চলতি শীতকালীন অধিবেশনেই পাশ হতে যাচ্ছে এই নতুন আইন। আর দেখলাম আইনের সর্বগামিতা। প্রতিটা বিষয়ে আইন রয়েছে। পরিবেশ আইনের কড়াকড়ি নিয়ে কথা তুলতেই সচিব জানালেন, খনি, অর্থনীতি,উন্নয়ন এসবের মতো পরিবেশও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এটা মেনেই কাজে নামতে হবে।
মণিরাম দেওয়ান ট্রেড সেন্টারটি আসাম সরকার বাণিজ্য বিকাশের জন্য তৈরী করেছে। এখনো নির্মানকাজ শেষ হয়নি। এটি ঐতিহ্যবাহী ''বালাজী টেম্পল'' সংলগ্ন। শহরের এক প্রান্তে পাহাড়ের কাছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় এলাকায় স্থাপিত।
কনফারেন্সের প্রতিটি সেশনে একাধিক পেপার উপস্থাপন করা হয়েছে খনি ও খনিজ শিল্প বিষয়ে। ভারত সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এসব উপস্থাপনা। কর্পোরেট হাউসগুলোর পক্ষ থেকেও পেপার পেশ করা হয়েছে।

এখানে এসে দেখলাম জিওলজিকাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়া ( জিএসআই ), ইণ্ডিয়ান ব্যুরো অব মাইন্স , কোল ইণ্ডিয়া লি. নিজেদের কাজে বেশ সক্রিয়।

শুরুতে বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনে ভিসা নিয়ে বিপাকে পড়লেও ভেতরে গিয়ে পেলাম সম্পূর্ন ভিন্ন চিত্র। সবাই খুব আন্তরিক ব্যবহার করলেন। খুব আগ্রহ দেখালেন বাংলাদেশ সম্পর্কে। মন্ত্রী, সচিব সবাই তাঁদের বক্তব্যে বাংলাদেশ এবং ভূটান থেকে প্রতিনিধি যোগদানের বিষয়টি উল্লেখ করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। উভয় দেশের প্রতিনিধিদের পেপার উপস্থাপনের এবং পরে প্রতিক্রিয়া জানাবার ব্যবস্থা করেছেন।

এসব আনুষ্ঠানিকতার বাইরে ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সাথে আলাপ পরিচয় হয়েছে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে বাংলাদেশ থেকে ১৯৪৭ উত্তরকালে ভারতে চলে যাওয়া মানুষদের বাংলাদেশের প্রতি প্রচণ্ড টান।

জিওলজিকাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়ার মহাপরিচালক মি. নীতিশ কুমার দত্ত মুন্সীগঞ্জের মানুষ। ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে বারবার বাংলাদেশের খবর নিয়েছেন। বাংলাদেশে বেড়াতে আসার জন্য তাঁর তীব্র আকূলতা আমার খুব ভালো লেগেছে। তাঁকে বাংলাদেশে আসার জন্য আমিও দাওয়াত করেছি। ঠিকানা বিনিময় করে বলেছি বাংলাদেশে এলে তিনি যেন আমাদের জানান । আমরা তাঁকে বাংলাদেশে এলে সম্ভাব্য সব সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।

এছাড়া বিভিন্ন কর্পোরেট হাউসে কর্মরত বরিশাল,ময়মনসিংহ, সিলেট, ফরিদপুর থেকে যাওয়া মানুষরা বাংলাদেশের জন্য পাগল। আমি নোয়াখালীর লোক হলেও তাঁরা আমার সাথে নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেছেন। আমিও বরিশাল, সিলেট প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষায় তাঁদের সাথে কথা বলেছি। সিলেট এলাকায় প্রচলিত জোক শুনিয়েছি। তাদেরকে বাংলাদেশে দাওয়াত করেছি।

কোলকাতা থেকে গিয়েছেন অনেকে। অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় এই খাতের বাণিজ্যিক দিক নিয়ে পেপার পেশ করেছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষত: অফিস আদালত, উচ্চ শিক্ষায় বাংলার ব্যবহার নিয়ে তাঁরা খুব উচ্ছ্বসিত সুনাম করলেন। জানালেন পশ্চিম বাংলায় বাংলা চর্চার দুরবস্থার কথা। সেখানে ব্যাপক হিন্দি চর্চা আর ইংরেজী না জানলে চাকরী না পাবার কথাও বললেন।

বাস্তবতা হলো বহুভাষী দেশ ভারতে ইংরেজী ছাড়া উপায় নেই। প্রত্যেকে নিজের ভাষা সম্পর্কে খুব সংবেদনশীল। নিজের ভাষা কেউ ছাড়তে চায় না। বিশেষত: দক্ষিণ ভারত হিন্দির আসেপাশেও যায়না। যে হিন্দি মুভি মধ্যপ্রাচ্য ছেয়ে আছে সেই হিন্দি মুভিও দক্ষিণে চলে না। সেদিন পেপারে দেখলাম, যে মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাইতে হিন্দি মুভির জন্ম হয় সেই মহারাষ্ট্র রাজ্য বিধান সভায় বিধায়ক আবু আজমী মারাঠীর বদলে হিন্দিতে শপথ নেয়ায় এমএনএস বিধায়কদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন।

হোটেল নক্ষত্রের বদলে প্রগতি মেনর

পরের দিনও পার্টি হবার কথা ছিলো হোটেল নক্ষত্রে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের জন্য সে পার্টি করতে হয়েছে হোটেল প্রগতি মেনরে। সে পার্টিতে যোগ দেন মিজোরামের মন্ত্রী মি. লালরিনলিয়ানা সাইলো। কতক্ষন পর দেখি বাংলাদেশ দলের লোকদের খোঁজা হচ্ছে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো মন্ত্রী সাহেবের কাছে। তিনি জানালেন, অচিরেই তিনি বাংলাদেশ সফরে আসবেন। আমরাও বললাম, তাঁকে বাংলাদেশে স্বাগত: জানাবার জন্য আমরা সানন্দে অপেক্ষা করবো।

পার্টি ভালোই জমলো। আমি যখন নানা উপাদেয় পানীয়ের বদলে কোক আর জুসের সন্ধান করলাম তখন টেবিলে যেন বাজ পড়লো। উড়িষার রাজধানী ভূবনেশ্বর ( সাবেক কটক ) থেকে আসা এক ভদ্রমহিলা পর্যন্ত অবাক হলেন। তিনি সমানে চালাচ্ছিলেন লাল পানীয়। সিলেটী ভদ্রলোক বললেন আপনিতো এখন বিদেশে, আপন মর্জিতে চলুন। আমি হেসে বললাম, আপন মর্জি মতোই তো কোক চাইছি। টেবিল জুড়ে হাসির বন্যা বয়ে গেলো।

একটু পর নিজ বাড়ী থেকে দূরে আসা একজনকে দেখা গেলো সত্যিই বেশ স্বাধীন হয়ে গেছেন। এসেছেন অরণাচল প্রদেশ থেকে। নিজেকে বিশ্বের কনিষ্ঠতম পিএইচডি ডিগ্রীধারী বলে ঘোষণা দিলেন জড়ানো কণ্ঠে। বললাম, আপনার নাম তাহলে গিনেস বুকে পাওয়া যাবে। ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ও শালারাতো হিন্দি জানে না। আবার হাসির রোল উঠলো।
ভাংলো মিলন মেলা

৭ নভেম্বর মধ্যাহ্ণ ভোজ দিয়ে শেষ হলো দু'দিনের সম্মেলন। প্রতি বছর এই সম্মেলন হবে বলে সিদ্ধান্ত হলো। আগামী বছর এটা হবে নাইজেল শহরে। সবাই সবার কাছে ঠিকানা বিনিময়ের মাধ্যমে যোগাযোগের প্রতিশ্রূতি দিলাম। বাংলাদেশে আসার জন্য দাওয়াত দিলাম। জানিনা এদের কারো সাথে আর দেখা হবে কিনা। ছোট হয়ে আসা পৃথিবীতে কারো কারো সাথে দেখা হয়েও যেতে পারে। কিন্তু সবার সাথে হবেনা এটা নিশ্চিত। কারণ পৃথিবীর কোন মিলন মেলাই আর কখনো একই লোকদের নিয়ে বসে না। কিছু মানুষ আর আসে না। নতুন কেউ সে স্থান দখল করে।

ভেবেছিলাম শহর ঘুরবো। ব্রক্ষ্মপুত্র নদ দেখবো এবং উত্তর গুয়াহাটী যাবো নদীর ওপরের সরাইঘাট ব্রিজ পার হয়ে। ওপারের আমিনগাঁওয়ে আছে ইণ্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলোজি ( আইআইটি)। এপারে আছে গুয়াহাটী বিশ্ববিদ্যালয়, কামাক্ষার বিখ্যাত মন্দিররাজি ( কামাক্ষা মন্দির,আদি মন্দির, মা কামাক্ষা মন্দির ইত্যাদি), আছে চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্ক। এর কিছুই হলো না মহাস্বাধীন ড্রাইভার কামাক্ষানাথের বদৌলতে। প্রায় ঘণ্টাখানেক বিলম্বে এলেন। এই দেরী তাঁর কাছে কোন ব্যাপারই না। সোজা জানালেন, জ্যামের জন্য দেরী হয়েছে, তার কী দোষ !? ফলে শহর ভ্রমনের প্ল্যান বাদ দিতে হলো। কারণ সূর্যাস্তের পর শহরের দূরের প্রান্তে যাওয়া সমীচীন মনে হলো না।

হোটেলে ডলার ভাঙ্গানোর কোন ব্যবস্থা নেই। ডলার ভাঙ্গানো নিয়ে এক ঝামেলায় পড়লাম। স্টেট ব্যাঙ্ক (অহমিয়া ভাষায় লেখে বেঙ্ক) অব ইণ্ডিয়ার অল্প কিছু শাখায় ভাঙ্গানো যায়। এরকম একটা ব্রাঞ্চ খুঁজে পেতে পেতে ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত হোটেলের মধ্যস্থতায় ডলার ভাঙ্গানো হলেও ডলার প্রতি ৩ রুপি কমে ভাঙ্গাতে বাধ্য হয়েছি।

বিগ বাজার

যানজট এড়িয়ে খুব বেশী কিছু করা যাবেনা বলে চেইন সুপারশপ ''বিগ বাজারে'' ঢুকলাম। কিছু শপিং করলাম। বেশ ভালো শপিংয়ের জন্য।তবে একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম জিনিসপত্রের দামে। এতোদিন শুনেছি ভারতে বিশেষত: উত্তর পূর্বাঞ্চলে বেশীরভাগ জিনিস সস্তা। কিন্তু এখন অনেক দাম। কিছু কিছু বাংলাদেশের চেয়ে দাম বেশী।

ফিরে আসা

পরদিন ৮ তারিখে ভোরে রওয়ানা দিলাম। গুয়াহাটি এয়ার পোর্টে পৌঁছার ঠিক আগে দেখি বিরাট সামিয়ানা টানিয়ে হজ্বযাত্রীদের বিমানযাত্রার প্রস্তুতি চলছে। তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা দেখে ভালো লাগলো। ভেতরে ঢুকে দেখলাম সেখানেও হজ্বযাত্রীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কর্মকর্তারা সর্বতোভাবে তাঁদের সাহায্য করছেন।

ঢোকার মুখে পুলিশ কর্মকর্তা বললেন আপনাদের ফ্লাইট নাম্বার কিন্তু মিলছে না। কাউন্টারে যোগাযোগ করুন। জেট এয়ারের টিকেট আমাদের। পরে আসতে হলো জেট লাইটে। জেট এয়ার আর জেট লাইটের যাত্রীদের একত্রে জেট লাইটে আসতে হলো।

দালাই লামা

সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিমানে আরোহনের জন্য বসে আছি। কথা বলছিলাম জিওলজিকাল সার্ভে অব ইণ্ডয়ার মহাপরিচালক নীতিশ দত্ত মহাশয়ের সাথে। তিনিও কোলকাতায় আসবেন, কারণ জিওলজিকাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়ার সদর দফতর কোলকাতায়। এমন সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিশেষ নড়াচড়া চোখে পড়লো। ইণ্ডিগো এয়ার লাইন্সের একটা বিমান আমাদের সামনে এসে টেক্সিং শেষে থামলো। দেখলাম তিব্বতের প্রধান ধর্মগুরু দালাই লামা বিমান থেকে নামলেন। সবাই দাঁড়িয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলাম। খুব কাছে থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ পেয়ে খুব ভাগ্যবান লাগলো নিজেকে। ছবিতে তাঁকে দেখতে যেমন লাগে বাস্তবে তিনি দেখতে অনেক বেশী আকর্ষণীয়। যা ভাবতাম তার চেয়ে অনেক বড়োসড়ো ও সুন্দর দেহের অধিকারী তিনি। বিমান বন্দরে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে তিনি হেলিকপ্টারে অরুণাচল প্রদেশে চলে যান। ( অরুণাচলের বিষয়টি পরে পেপারে পড়ে জেনেছি)

পাখির চোখে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ

কুয়াশার জন্য এক ঘণ্টা বিলম্বে বিমান আকাশে উড়লো। জেট লাইটের নতুন বোয়িং ৭৩৭-৯০০। চারপাশে সকালের রোদের ঝকঝকে আলো। জানালার পাশে বসে পাখির চোখে দেখলাম গুয়াহাটী শহর। ব্রক্ষপুত্র নদের সূচনা ধারাও দেখলাম। চারপাশ থেকে অনেকগুলো ঝর্ণাধারা মিশেছে। কী বিশাল সেই জলধারা ! অবিশ্বাস্য রকমের চওড়া সেখানে এই নদ। তবে শীতের সময় বলে পানির পরিমান কম। পাহাড়ের কোলে বিস্তৃত গুয়াহাটী শহরটি আসলেই খুব সুন্দর। প্রকৃতির অপরিমেয় সৌন্দর্যের এক ঈর্ষণীয় ভাণ্ডার !
কোলকাতায় ৯ ঘণ্টা

ঝকঝকে সকালের আলোয় ফুরফুরে মেজাজে উড়তে উড়তে এক ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম কোলকাতা। হাওড়ার জোড়াব্রীজ ( বৃটিশ ও আধুনিক), বিশাল রেলওয়ে স্টেশন, ইডেনের ক্রিকেট স্টেডিয়াম, সল্টলেক ফুটবল স্টেডিয়াম, গঙ্গা নদী, আকাশছোঁয়া ভবনরাজী আর বিস্তৃত কোলকাতা শহর পাখীর চোখে দেখলাম। নামার আগে খুব নীচদিয়ে উড়ছিলো বলে সবকিছু খুব স্পষ্ট দেখা গেছে। ভালোয় ভালোয় কোলকাতায় নেমে গেলাম।

কলকাতায় আদতে ৫ ঘণ্টা বসে থাকার কথা ছিলো। গুয়াহাটীতে এক ঘণ্টা দেরী হওয়ায় কলকাতায় এক ঘণ্টা কম বসতে হবে ভেবে ভালোই লাগছিলো। তাই বিধাতা বোধহয় অজ্ঞাতে হেসেছিলেন। চেক ইনের ঘোষণায় বিলম্ব দেখে অস্থির হয়ে উঠছিলাম। এই সময় এলো বজ্রাহত হবার মতো খবর ! আরো ৫ ঘণ্টা বেশী থাকতে হবে কলকাতায় ! সব মিলে প্রায় ৯ ঘণ্টার ধাক্কা। আমরা দেশ ছেড়েছি বৃহস্পতিবার। শুক্রবার থেকে নাকি বিমানের এই সময় বদল হয়েছে। টিকিট বদলে কিংফিশার বা এয়ার ইণ্ডিয়ায় আসার ব্যর্থ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম।

এর মধ্যে প্রশ্ন উঠলো আদতে ৫ ঘণ্টা বিলম্বিত বিমানেই যেতে পারবো কিনা ? কারণ পাশে বসা এক পরিবারের ৭ জনের নাকি কনফার্মড টিকেট থাকা সত্বেও তারা সিট পাচ্ছেন না। আবার বিমান অফিসে যেতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা চেক ইন আদেশ ছাড়া ও এলাকায় যেতে দিতে রাজী হলেন না। ভাগ্যিস এ সময় বিমানের এক কর্মকর্তা এলেন। তিনি পুলিশকে বলে বিমান অফিসে যাবার ব্যবস্থা করলেন।

সাদা চামড়া কালা চামড়া

বিমান অফিসে কাজ করছিলেন এক ভদ্র লোক। কথা বলে বুঝলাম কোলকাতারই লোক। বললেন, কনফার্মড টিকিট থাকলেও ৭২ ঘণ্টা আগে আবার কনফার্ম করতে হয়। তাঁকে বললাম, এর আগেই যে আমরা গুয়াহাটীতে চলে গেছি, সেখান থেকে তো আমাদের পক্ষে এটা করা সম্ভব ছিলো না। এ কথা শুনে বললেন, তাহলে বসুন। দেখছি আপনাদের ব্যাপারটা। দ্রুত হাতের কাজ সেরে কম্পিউটারের সামনে এলেন আমাকে সাথে নিয়ে। এ সময় হন্তদন্ত হয়ে এক সাদা চামড়ার বিদেশী ঢুকলেন। ঢাকায় দূতাবাসে কাজ করেন। তাঁর অনেক কাজ ঢাকায় সে জন্য টিকিট বদলাতে চান। বিমানের ওই কর্মকর্তা বললেন তাঁকে একটু অপেক্ষা করার জন্য। আমাকে দেখিয়ে বললেন, ওনার কাজটা সেরে নিই। সাদা ভদ্রলোক চাইলেন আমার কাজটা রেখে তাঁর কাজটা আগে করে দেয়া হোক। বিমান কর্মকর্তা বললেন, ''দু:খিত, আপনাকে দয়া করে অপেক্ষা করতে হবে।" এটা শুনে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে সাদা চামড়া বেরিয়ে গেলেন।

এটা দেখে সাদা চামড়াকে কোন রকম পাত্তা না দিয়ে আমাকে বললেন, আপনি বসুন তো দাদা। আপনার কাজই আমি আগে করে দোব। ও ব্যাটার দরকার হলে আবার আসবে। এই সালার ( কোলকাতার উচ্চারণ) সাদা চামড়াদের নিয়ে আর পারিনা। ব্যাটেদের ধারণা ওরা এখনো আমাদের মালিকমোক্তার রয়ে গেছে। ও রকম ডাঁট দেখাতে চায় সব সময়। সব কাজ ফেলে ওদের কাজ আগে করে দিতে হবে। ষাট বছর আগে যে ওদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেছি সেটা ভুলে গেছে। আমরা আর পাত্তা দিই না। এক সময় শাসন করেছেন, করেছেন। ওসব ভুলে যান। আর ওসব তামাদী স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।

আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনছিলাম। আসলে এ রকম আত্মমর্যাদাবোধ ছাড়া কোন স্বাধীন জাতি স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারে না। উন্নতিও করতে পারে না।

বেশ কিছু সময় পর আমাকে বললেন, ''আপনার ভাগ্য ভালো স্যার, আপনার সিট আছে। আপনাকে আরেকটা প্রিন্ট আউট দিয়ে দিচ্ছি।'' আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রিন্ট আউট নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এসময় সাদা চামড়া আবার এসে ঢুকলো। আমি মুচকি হেসে বেরিয়ে এলাম দীর্ঘ সময় বিমানের জন্য নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করার জন্য।

বহুভাষা

বসে বসে এয়ারপোর্ট দেখছি। কোলকাতার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তরাষ্ট্রীয় বিমান বন্দরের আন্তরাষ্ট্রীয় টার্মিনালটি পুরনো ভবনে। অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল এরচেয়ে বড়ো এবং সুন্দর। ব্যস্ততাও এখানে বেশী। অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীও বেশি। কলকাতা থেকে বাসে গৌহাটি যেতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা লাগে। প্লেনে লাগে মাত্র সোয়া ঘণ্টা। এদের বিমান এবং বিমানবন্দরে তিনটি ভাষা ব্যবহৃত হয়। গুয়াহাটীতে প্রথমে অহমিয়া, তারপর হিন্দি এবং সব শেষে ইংরেজী। কোলকাতায় প্রথমে বাংলা, এরপর হিন্দী, সব শেষে ইংরেজী।

আসামে প্রধানত: অহমিয়া পত্রিকা পাওয়া যায়। কিছু বাংলা কাগজ যায় কোলকাতা থেকে। আর আছে ইংরেজী কাগজ। কিছু সর্বভারতীয় ( যেমন টেলিগ্রাফ, টাইমস অব ইণ্ডিয়া। তবে সেটার আসাম সংস্করণ।) আর আছে স্থানীয় ইংরেজী কাগজও।

অহমিয়ার সাথে শুদ্ধ বাংলা, সিলেটী আঞ্চলিক, ময়মনসিংহের রংপুরের কিছু আঞ্চলিক শব্দের মিশেল থাকলেও বর্ণমালায় ভিন্নতা আছে। বোঝার সুবিধার্থে দুটো অহমিয়া দৈনিক পত্রিকার লিঙ্ক দিলাম-
http://www.assamiyakhabor.com/
http://www.ajirdainikbatori.com/
প্রথমটির নাম অহমিয়া খবর দ্বিতীয়টির নাম আজির দৈনিক বাতরী।

অবশেষে ঢাকায়

বিমানের সেই মুড়ির টিনে চড়ে রাত সোয়া ন'টায় ঢাকায় এসে নামলাম। আবারো শ্রদ্ধা বিমানের দুর্ধর্ষ সাহসী ক্রুদের । শ্রদ্ধা জানাই তাঁদের দক্ষতাকে। ঢাকা নেমে পড়লাম ইমিগ্রেশনের লম্বা লাইনের পাল্লায়। দেড় ঘণ্টা ওখানে শেষ। বাসায় আসতে আসতে রাত বারোটা। পৌনে দু'ণ্টার বিমান ভ্রমনের জন্য সবমিলে লাগলো ১৫ ঘণ্টার মতো। হাড়ে হাড়ে বুঝলাম ভ্রমন কাহাকে বলে !

সমাপনী

শুরুতেই বলেছিলাম দিন যদিও মাত্র দু'টি। গুয়াহাটী তথা আসামের জন্য বড়ো কিছু ঘটনা ঘটেছে এরই মধ্যে।

প্রথমত: আহমেদাবাদে প্রায় জিতে যাওয়া ম্যাচে ( শচীনের ১৪১ বলে ১৭৫ রানের অতিমানবিক ইনিংসের বদৌলতে) মাত্র তিন রানে হেরে গুয়াহাটী এসেছিল ভারতীয় দল সিরিজে ফেরার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু গো-হারা হেরে সব শেষ। এই ম্যাচ নিয়ে সবার খুব আশা ছিলো। আরেকটি কথা গুয়াহাটীর আকাশ বাতাস বেদনাবিদুর করে রেখেছিলো। সব পত্রিকায় বিশেষ প্রতিবেন ছাপা হয়েছে- এটাই খুব সম্ভবত: গুয়াহাটীর মাঠে লিটল মাস্টার শচীনের শেষ ম্যাচ !

দ্বিতীয়ত: আমরা যেদিন গেলাম সেদিনই ঢাকায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন উলফার দুই শীর্ষ নেতা শশধর ও চিত্রবন। রাতে তাঁরা ধরা পড়েন বিএসএফ সৈন্যদের হাতে। প্রথমে খবরে বলা হয়েছিলো তারা আত্মসমর্পন করেছেন। কিন্তু টিভির সামনে তাঁরা বললেন, তাঁরা আত্মসমর্পন করেননি। ৯ নভেম্বর তাদের মুক্তির দাবীতে আসাম বন্ধ পালন করেছে উলফা। এসব নিয়ে ব্যাপক অলোচনা সমালোচনা দেখা গেছে গুয়াহাটীতে।

তৃতীয়ত: গুয়াহাটী হয়ে অরুণাচল প্রদেশে গেছেন দালাই লামা। এটা নিয়ে চীন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রকারান্তরে ভারতকে হুমকিই দিয়ে ফেলেছে চীন। এটাও বড়ো ঘটনা পুরো ভারতের জন্যও।

চতুর্থত: আমরা যে সম্মেলনে গেলাম সেটা সফল হবে বলেই আশা করা যায়। এর সফলতা মানে সেভেন সিস্টার্সের অর্থনৈতিক অঙ্গনে বিপুল সাড়া পড়বে। এ অঞ্চলের জীবন যাত্রাও বদলে যাবে।

পঞ্চমত: আসাম এই পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে সেভেন সিস্টার্স ( এখন এইট ) এলাকার গেট-ওয়ে হয়ে উঠতে চলেছে।

মাত্র দু'দিনে কিছুই দেখা হয়নি। এমন কি গণসঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ ড. ভূপেন হাজারিকার বাড়ীটাও অন্ধকারের জন্য ঠিক মতো দেখতে পারিনি। তাই সুন্দর এই শহরের ডাক বুকের ভেতর শুনতেই থাকবো আবার তার কাছে যাবার আগ পর্যন্ত। আপনিও ইচ্ছে করলে যেতে পারেন গৌহাটি তথা গুয়াহাটী। আমি নিশ্চিত সেখানে আপনার ভালো লাগবে।

মান্না দে'র একটা গান দিয়ে শেষ করি--
'' আবার হবে গো দেখা
এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো !"
( শেষ) 
=======================
মন্তব্যঃ
১। জেট এয়ার বাজেট এয়ারলাইন্স। বাজেট এয়ারে খাবার কিনে খেতে হয় অথবা টিকেট করার সময়ই অগ্রিম পে করতে হয়। এটা সব বাজেট এয়ারের জন্যই প্রযোজ্য।
লেখক বলেছেন: খুব সুন্দর শহর। আমি আবার সুযোগ পেলে যাবো। সেক্ষেত্রে ভিসাতে ডাউকি চেকপোস্টের জন্য আবেদনে উল্লেখ করবো। এবারও ছিলো সেটা। ঢাকা থেকে জাফলং গিয়ে ডাউকি দিয়ে সড়কপথে জিপ ভাড়া করলে চার/সাড়ে চার ঘণ্টা লাগবে। পাহাড়ী পথের রোমাঞ্চকর ভ্রমন মিস করতে চাইনা। এবার ঠিকমতো জানতে পারিনি বলে, সময় কম ছিলো বলে নে পথে যাইনি।
পড়ে সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। 


SOURCE LINK

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন