বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০১৪

আগ্রার তাজমহল

থাপত্য সৌন্দর্য আগ্রার তাজমহল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি। এই মনোহর স্থাপত্য সৌন্দর্য হলো এক জৌলুসপূর্ণ সমাধিগৃহ যা সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের সমাধি ধারণ করে আছে। মোঘল স্থাপত্যের এই অনন্যশৈলীর মাধ্যমে মানব হৃদয়ের ভালবাসার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা সত্যিই প্রশংশনীয়। অনেকেই তাজমহলকে ‘‘মার্বলের শোকগাথা’’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন আবার কেউ বলেন ‘‘স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ’’

তাজমহল

তাজমহল তৈরির সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ

তাজমহল তৈরি করেন মোঘল সম্রাট আকবরের দৌহিত্র সম্রাট শাহজাহান, তাঁর প্রিয়তম স্ত্রী মমতাজ মহলের (মুল নামঃ আরজুমান্দ বানু বেগম) স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে। মমতাজ মহল ছিলেন শাহজাহানের তৃতীয় স্ত্রী। মমতাজ মহল ১৬৩১ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে বুরহানপরে ১৪তম সন্তান গৌহর বেগমের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। স্ত্রী হারানোর শোকে মুহ্যমান শাহজাহান তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর স্মৃতির জন্য নির্মাণ করেন ভালবাসার এই অপরূপ নিদর্শন।
সম্রাট শাহজাহান, তাঁর প্রিয়তম স্ত্রী মমতাজ
সম্রাট শাহজাহান ও  তাঁর প্রিয়তম স্ত্রী মমতাজ
তাজমহলের নির্মাণ কাজ শেষ হতে না হতেই শাহ জাহান তাঁর পুত্র আওরঙ্গজেব দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত ও আগ্রার কেল্লায় গৃহবন্দী হন। কথিত আছে, জীবনের বাকী সময়টুকু শাহ জাহান আগ্রার কেল্লার জানালা দিয়ে তাজমহলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই কাটিয়েছিলেন। শাহ জাহানের মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেব তাঁকে তাজমহলে তাঁর স্ত্রীর পাশে সমাহিত করেন।

তাজমহলের নামকরনঃ  
সম্রাট শহজাহান তার প্রিয়তম স্ত্রী মমতাজ মহলের নামের , মমতাজ থেকে “মম” বাদ দিয়ে এই বিস্ময়কর স্থাপনাটির নামরাখেন “তাজ মহল”।

Taj_Mahal_sideview

তাজমহলের নির্মানকাল ও খরচঃ
তাজমহলের নির্মান শুরু হয় ১৬৩২ সালে; মমতাজের মৃত্যুর এক বছর পর। ২০ হাজারের বেশি শ্রমিকের প্রচেষ্টায় ১৬৪৮ সালে, মমতাজের মৃত্যুর ১৭ বছর পর গম্বুজ গুলোর নির্মান কাজ শেষ হয়; যদিও পুরো কাজ শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। শুধু মানুষ নয়; এ মহান কীর্তির ভাগিদার ১০০০ হাতী, যারা নির্মাণের জন্য মার্বেল পাথর পরিবহনে নিয়োজিত ছিল। এছাড়াও অসংখ্য  গাধা এবং ষাঁড়ের দল কপিকল নাড়াতে শক্তির যোগান দিতো। অসাধারণ এই তাজমহলের নির্মান কাজ শেষ হতে প্রায় বাইশ বছর সময় লেগেছিল এবং বিশ হাজার কর্মী এই নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ছিল।
 Taj-Mahal (1)
তৎকালীন নির্মাণ খরচ অনুমান করা কঠিন ও কিছু সমস্যার কারণে তাজমহল নির্মাণে কত খরচ হয়েছিল তার হিসাবে কিছুটা হেরফের দেখা যায়। তাজমহল নির্মাণে তৎকালীন আনুমানিক ৩২মিলিয়ন রুপি খরচ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু শ্রমিকের খরচ, নির্মাণে যে সময় লেগেছে এবং ভিন্ন অর্থনৈতিক যুগের কারণে এর মূল্য অনেক, একে অমূল্য বলা হয়।

তাজমহলের স্থাপত্যশৈলীঃ


পুরো তাজমহল ১৮০ ফুট উঁচু যার প্রধান গম্বুজটি ২১৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট চওড়া এবং এর চারপাশে চারটি মিনার আছে যার প্রতিটির উচ্চতা ১৬২.৫ ফুট। পুরো কমপ্লেক্সটির আকার ১৯০২X১০০২ ফুট। শুধু তাজমহলটি ১৮৬X১৮৬ ফুট মার্বেল পাথরের উপর নির্মিত। এর প্রধান প্রবেশদ্বার ১৫১X১১৭ ফুট চওড়া এবং ১০০ ফুট উঁচু।
Inside-the-Taj-Mahal1
তাজমহল তৈরি হয়েছে সাড়া এশিয়া এবং ভারত থেকে আনা বিভিন্ন উপাদান সামগ্রী দিয়ে। নির্মাণ কাজের সময় ১,০০০ এরও বেশি হাতি ব্যবহার করা হয়েছিল নির্মাণ সামগ্রী বহন করে আনার জন্য। আলো-প্রবাহী অস্বচ্ছ সাদা মার্বেল পাথর আনা হয়েছিল রাজস্থান থেকে, ইয়াশ্‌ব্‌- লাল, হলুদ বা বাদামী রঙের মধ্যম মানের পাথর আনা হয়েছেল পাঞ্জাব থেকে।
taj-mahal-interior2

চীন থেকে আনা হয়েছিল ইয়াশ্‌ম্‌- কঠিন, সাধা, সবুজ পাথর, স্ফটিক টুকরা। তিব্বত থেকে বৈদূর্য সবুজ-নীলাভ (ফিরোজা) রঙের রত্ন এবং আফগানিস্তান থেকে নীলকান্তমণি আনা হয়েছিল। নীলমণি- উজ্জ্বল নীল রত্ন এসেছিল শ্রীলঙ্কা এবং রক্তিমাভাব, খয়েরি বা সাদা রঙের মূল্যবান পাথর এসেছিল আরব থেকে। এ আটাশ ধরনের মহামূল্যবান পাথর সাদা মার্বেল পাথরেরে উপর বসানো রয়েছে।

তাজমহলের গম্বুজগুলোর সৌন্দর্যঃ

তাজমহলের গম্বুজগুলো হল অন্যতম মনোমুগ্ধকর বস্তু। সমাধির উপরের মার্বেল পাথরের গম্বুজই সমাধির সবচেয়ে আকর্ষনীয় বৈশিষ্ট। এর আকার প্রায় ইমারতের ভিত্তির আকারের সমান, যা প্রায় ৩৫ মিটার। এর উচ্চতা হওয়ার কারণ গম্বুজটি একটি ৭ মিটার উচ্চতার সিলিন্ডার আকৃতির ড্রাম এর উপরে বসানো।
taj_dome

এর আকৃতির কারণে, এই গম্বুজকে কখনো পেয়াজ গম্বুজ অথবা পেয়ারা গম্বুজ বলেও ডাকা হয়। গম্বুজের উপরের দিক সাজানো হয়েছে একটি পদ্মফুল দিয়ে, যা তার উচ্চতাকে আরও দৃষ্টি গোচড় করে। গম্বুজের উপরে একটি পুরনো সম্ভবত তামা বা কাসার দণ্ড রয়েছে যাতে পারস্যদেশীয় ও হিন্দু ঐতিহ্যবাহী অলঙ্করণ রয়েছে।

বড় গম্বুজটির গুরুত্বের কারণ এর চার কোণায় আরও চারটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। ছোট গম্বুজগুলোও দেখতে বড় গম্বুজটির মতই। এদের স্তম্ভগুলো সমাধির ভিত্তি থেকে ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। ছোট গম্বুজগুলোতেও কাসা বা তামার পুরনো দণ্ড আছে।

taj_mahal_sunset
গম্বুজের সাদা মার্বেল গুলো সূযোর্দয়ের সময় গোলাপি আভা ছড়ায়। গোধুলিতে অপসৃয়মান সূর্যের বিভিন্ন রঙের আলো প্রতিফলন করে। আর রাতের বেলা পূর্ণিমার আলোয় গম্বুজগুলো যেন মুক্তোর মত চকচক করে।

ভরা পূর্ণিমার ভালবাসার এ মহাস্থাপনা সোনালি আর নীল আলোয় লুকোচুরি খেলে। আর কুয়াশা মাখা দিনে ভালবাসার এ স্তম্ভ যেন মেঘের গায়ে ভেসে বেড়ায়। প্রচলিত আছে, গম্বুজগুলো থেকে যে রঙ-বেরঙের আলোর ছটা বিচ্ছুরিত হয় তা নারীর আবেগ ও অনুভুতিকেই প্রকাশ করে।

সমাধিস্থলঃ 
তাজমহলের মূলে হল তার সাদা মার্বেল পাথরের সমাধি। যা অন্যান্য মুঘল সমাধির মত মূলতঃ পারস্যদেশীয় বৈশিষ্ট, যেমন আইওয়ানসহ প্রতিসম ইমারত, একটি ধনুক আকৃতির দরজা, উপরে বড় গম্বুজ রয়েছে। সমাধিটি একটি বর্গাকার বেদিকার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভিত্তি কাঠামোটি বিশাল এবং কয়েক কক্ষবিশিষ্ট। প্রধান কক্ষটিতে মুমতাজ মহল ও শাহজাহানের স্মৃতিফলক বসানো হয়েছে, তাদের কবর রয়েছে এক স্তর নিচে।
12
 মুমতাজ ও  সম্রাট শাহজাহানের কবর
মুমতাজ ও সম্রাট শাহজাহানের কবর


মমতাজ মহল মারা যাওয়ার পর প্রথম তাঁকে সমাহিত করা হয় জয়নাবাদ বাগানে। ৬ মাস পর তাঁকে পুনরায় সমাহিত করা হয় আগ্রার তাজমহলে (তখনও তাজমহল নির্মিত হয়নি); মমতাজ মহলের সমাধিস্থলে আল্লাহতায়ালার ৯৯ নাম খোদাই করা আছে।  সম্রাট শাহজানের সমাধিতে খোদাই করা তাঁর মৃত্যু দিবস– ২৬ শে রজব দিবাগত রাত্রি, ১০৭৬ হিজরি।

তাজমহলের স্থপতিঃ
তাজমহল কোন একজন ব্যক্তির দ্বারা নকশা করা নয়। এ ধরনের প্রকল্পে অনেক প্রতিভাধর লোকের প্রয়োজন। বিভিন্ন উৎস থেকে তাজমহল নির্মাণ কাজে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। নিম্নে তাদের নাম উল্লেখ করা হল……
  •  তাজমহলের প্রধান ডিজিইনার হলেন ইরানের বিখ্যাত স্থপতি ওস্তাদ মুহাম্মদ আফেনদি।
  •  দিল্লির চিরঞ্জীলাল হলের প্রধান ভাস্কর
  •  ইরানের আমানত খান হলেন খোদাই শিল্পী
  • গম্বুজগুলো ডিজাইন করেন ইসমাইল আফেনদি
  •  লাহোরের কাজিম খান ছিলেন প্রধান স্বর্ণকারক
 taj_mahal_mosque_interior_hall

তাজমহলের অন্যান্য ইমারতসমূহ

তাজমহলের প্রধান ফটক
তাজমহলের প্রধান ফটক

তাজমহলের মসজিদ............
তাজমহলের মসজিদ…………
তাজমহলের বাগানের একাংশ
তাজমহলের বাগানের একাংশ… 

তাজমহল সম্পর্কে একটি প্রচলিত মিথঃ
অনেকেই জানেন, তাজমহল নির্মান শেষে সম্রাট শাহজাহান নির্মান শ্রমিকদের হাতের কব্জি কেটে দিয়েছিলেন! অন্য কোন জায়গায় যেন শ্রমিকেরা এই রকম ইমারাত তৈরি না করতে পারে!!”
এটি আসলে একটি মিথ। (এই মিথ আমি নিজেও কিছুদিন আগে সত্যি বলে জানতাম!)
সত্যটা হচ্ছে, তাজমহলের নির্মান শ্রমিকদের এতো বেশী টাকা পয়সা , সোনা দেওয়া হয়েছিল, তারা ঐ টাকা দিয়ে সারাজীবন বেকার খাওয়ার মত অর্থ ছিল। এই প্রচুর অর্থ দেওয়াকে রূপক অর্থে কব্জি কেটে নেওয়া নামে প্রচলিত হতে থাকে”
আমি তাজমহল নিয়ে মোটামুটি অনেক ঘাটাঘাটি করেছি, কোথাও কব্জিকাটা সম্পর্কে কোন প্রমানাদি পাই নি, আর তা ছাড়া তাজমহলের মুল্যবান দলিলপত্রেও এই বিষয়ে কিছু স্পষ্ট নেই।
 SOURCE LINK: Mehedi44

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন