সোমবার, ১২ মে, ২০১৪

রূপে ঝলমল নিঝুম দ্বীপ

নোয়াখালীর উপকূলে গভীর সমুদ্রে জেগে উঠা এক রহস্যময়ী দ্বীপ 'নিঝুমদ্বীপ'। সাগরের উত্তাল ফেনিল তরঙ্গ, নীল আকাশ আর ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘেরা সেখানে নিত্য মাতামাতি করে। নীরবে নিভৃতে সাগরের গর্ভ থেকে ধীরে ধীরে এ দ্বীপটি জেগে উঠেছে। এখন সে পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত সবুজ অরণ্যের নেকাবে ঘেরা লাস্যময়ী সাগর দূহিতা। তার শান্ত স্নিগ্ধ রূপ ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে। দেশ বিদেশের মানুষ কৌতুহলী হয়ে উঠছে এ দ্বীপকে ঘিরে।

নিঝুম দ্বীপের জন্ম
নোয়াখালী দক্ষিণে সাগর বেষ্টিত হাতিয়া দ্বীপ। তারও দক্ষিণে অথই নীল সমুদ্র। শত শত বছর ধরে হাতিয়া দ্বীপ এক সমৃদ্ধশালী জনপদে পরিনত হয়। এখানের অনেকেই বংশ পরম্পরায় অবস্থাপন্ন কৃষক ও মত্স্যজীবি। অনেকে ছিলেন বনেদী ব্যাবসায়ী। উত্তাল সাগরের সাথে হেসে খেলে এদের বেড়ে উঠা। সাম্পান আর বড় বড় বজরা নিয়ে এরা যুগ যুগ ধরে সাগরে মাছ ধরতে যেতেন। পঞ্চাশের দশকের দিকে হাতিয়ার জেলেরা দক্ষিণে দূর সমুদ্রে দেখতে পেলেন সাগরের মধ্যখানে একটি বিশাল ভূখন্ড জেগে উঠছে। তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তারা দেখে আসছেন সমুদ্রের এসব অঞ্চলে মাঝে মাঝে এরকম ভাসমান দ্বীপ ভেসে উঠে আবার তীব্র স্রোতে হারিয়েও যায়। তারা ভেবেছিলেন এরকমই হয়তো কোন দ্বীপ এটি। কিন্তু দেখা গেলো ধীরে ধীরে সে ভূখন্ড চিক চিক করে আরো বেশী দৃশ্যমান হচ্ছে দিন দিন। এক সময় সত্যিই সেটি একটি রুপময় দ্বীপে রুপ নিলো। এ দ্বীপের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এ দ্বীপের মাটি চিকচিকে বালুকাময়। জেলেরা নাম দিলেন 'বাল্লারচর' বা বালুর চর। জেলেরা দূর সমুদ্রে যাবার পথে একটি বিশ্রাম আর আশ্রয়ের জায়গাও খুঁজে পেলেন। শুকনো মৌসুমে তাঁরা সে বালুর মধ্যে মাছ শুকানোর কাজও শুরু করলেন। ধীরে ধীরে সে চরে নল খগড়া উরি আর বুনো ঘাস জমাতে লাগলো। হাতিয়ার মহিষের বাথানিয়ারাও যাওয়া আসা শুরু করলেন সে দ্বীপে। ওসমান মিয়া নামে এক বাথানিয়াও তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সাগর ডিঙ্গিয়ে তার বাথানের শত শত মহিষগুলো নিয়ে গেলেন সে দ্বীপে। তার নামেই সে দ্বীপের নাম হয় চর ওসমান। সরকারী দলিল দস্তাবেজে চর ওসমান হিসাবে এটি এখন লিপিবদ্ধ আছে। ধীরে ধীরে দ্বীপাটির আয়তন বাড়তে থাকে। কিছু কিছু গাছ গাছালী জন্ম নিলো। ফুটে উঠলো তার শান্ত স্নিগ্ধ রূপ। দ্বীপের পরিবেশ হলো নীরব নিঝুম তার চতুর্দিকে ফেনীল সাগরের ছন্দময় খেলা।

নিঝুম দ্বীপের নাম করণঃ
সত্তর দশকে হাতিয়ার সংসদ সদস্য ছিলেন আমিরুল ইসলাম কালাম। তিনি দেশী-বিদেশী পর্যটকদের নিয়ে গেলেন সে দ্বীপে। অবাক বিষ্ময়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সবাই অবলোকন করলেন এর শান্ত স্নিগ্ধ রূপ। তিনি এ দ্বীপের নাম দিলেন
নিঝুম দ্বীপ। সে থেকে নিঝুম দ্বীপ হিসেবেই এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কিছু জেলে আর বাথানিয়া সেখানে অস্থায়ীভাবে আবাস গড়ে তুলেছিলেন। ৭০ এর ১২ নভেম্বর প্রলয়কারী ঘূর্ণিতে সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বিরান হয়ে যায় সে জনপদ। স্বাধীনতা পর বন বিভাগ এর দায়িত্ব নেয়। শুরু করে বনায়ন।
এক সময়ের নিঝুম নীরব নিথর জনপদ মানুষের পদচারনায় এখন ধীরে মুখরিত হয়ে উঠছে। গড়ে উঠছে জনবসতি। গাবাদি পশুর খামার। দ্বীপ সংলগ্ন চতুর্দিকে বিপুল মত্স্য ভান্ডার আর দুলর্ভ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ নিঝুম দ্বীপ সম্ভাবনার এর উজ্জল দিগন্ত উম্মোচিত করছে।

জনবসতিঃ
১৭৯৪ সনের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরো কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী তখন এর জনসংখ্যা ছিলো ৪৫জন। পুরুষ ২৩ জন ও মহিলা ২২জন। স্বার ছিলো ৭জন। এরা সবাই বিভিন্ন যায়গা থেকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ভোলা, মনপুরা, রামগতি থেকেও অনেকে এখানে চলে আসেন। ১৯৮৮ সনে সরকারি ভাবে ৯টি গুচ্ছগ্রাম সৃষ্টিকরে ৫শ ৪৬টি পরিবারকে বসতির ব্যাবস্থা করা হয়। এই গুচ্ছগ্রাম গুলো হলো, বসুন্ধরা, বাতায়ন, আনন্দ, আগমনি, ছায়াবীথি, ধানসিঁড়ি, যুগান্তর, সূর্যদয় ও পূর্বাচল। এখানে প্রতিটি পরিবারকে দেয়া হয় দুই একর করে জমি। যাতে রয়েছে, বাড়ী ৮ ডিসিমেল ও কৃষি জমি ১ একর ৯২ ডিসিমেল করে। একটি বড় দীঘির চতুর্দিকে বাড়ী গুলো করা হয়েছে। এছাড়াও এ দ্বীপে বর্তমানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার অধিবাসী বসবাস করছে। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।

জীবিকাঃ
এ অঞ্চলে মানুষদের প্রধান জীবিকা সমুদ্রে মত্স্য আহরণ ও কৃষি। নিঝুম দ্বীপে একটি ছোট্ট পরিসরের বাজার রয়েছে। এ দ্বীপে আগে কখনো কোন পোষ্ট অফিস ছিলো না, অতিস¤প্রতি বাজারের মধ্যে একটি পোষ্ট অফিস চালু হয়েছে। তবে এখনও ব্যবসা বাণিজ্য বা যোগাযোগের জন্য এখানে অধিবাসীদের অসুবিধা রয়ে গেছে। এ দ্বীপে শুটকীর ব্যবসার সঙ্গে অনেকেই জড়িত। শুকনো মৌসুমে এখানে শত শত মন মাছ শুটকী করা হয়। এখানে রয়েছে অনেক গুলো মাহিষের বাথান। পর্যাপ্ত দুধ পাওয়া যায় সেখান থেকে। সে দুধ থেকে তৈরী হয় উত্কৃষ্ট মানের দই। চট্টগ্রাম মাইজদীতে মহিষের দই-এর বিপুল চাহিদা রয়েছে।

শিক্ষা:
নিঝুম দ্বীপে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। একটি নিঝুম দ্বীপ বিদ্যানিকেতন অপরটি নিঝুম দ্বীপ শতফুল স্কুল। স্কুল দুটি দুই সাইক্লোন সেন্টারে গড়ে উঠেছে। প্রায় ১ হাজার ২শ ছাত্র-ছাত্রী এখানে পড়া শুনা করে। হাতিয়া দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এ এলাকার জনগণের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানান উন্নয়ন কর্মের সহযোগীতা করে আসছে। এদের মধ্যে আক্ষরিক শিক্ষা না থাকলেও সামাজিক শিক্ষায় অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। দ্বীপের জনগণ বেশ ভদ্র বন্ধুবত্সল ও কর্মঠ।

নিঝুম দ্বীপের আয়তন:
নিঝুম দ্বীপের বর্তমান আয়তন প্রায় ৪৪ বর্গ কিলোমিটার এর উত্তর অংশে রয়েছে বন্দরটিলা। বনের মাঝা-মাঝি একটি সরু ছরা বা খাল দ্বীপকে দুভাগ করছে। এর উত্তর অংশ বন্দরটিলা ও হাতিয়া দক্ষাণ অংশ মোক্তারিয়ার সঙ্গে দুরত্ব কমে আসছে। এখানে মাঝখান বরাবর সাগরের গভীরতাও কমে আসছে। এর উপর দিয়ে একটি বাঁধ কিংবা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। তাহলে হাতিয়া থেকে সরাসরি সড়ক পথে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যাবে। দ্বীপের পূর্ব ও দক্ষিণে সাগর থেকে জেগে উঠছে আরো নতুন নতুন ভুখন্ড। এত দিন নিঝুম দ্বীপটি ছিলো হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড। বর্তমানে নিঝুম দ্বীপকে ইউনিয়নে উন্নিত করা হয়েছে। । বন বিভাগের সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে মনোমালিন্য ছাড়া আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি অত্যন্ত শান্ত। এ দ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিম কোনে ইতিমধ্যে একটি বড় দ্বীপ জেগে উঠেছে। ঢাল চর হিসাবে এটি এখন চিহ্নিত হয়েছে। দ্বীপের আশ-পাশে ছোট বড় কয়টি দ্বীপ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে চর কালাম, রৌশনীচর, দমারচর প্রভৃতি অন্যতম। বিশেষজ্ঞদের ধারনা নদী বাহিত পলি মাটি জমে জমে বেড়ে যাচ্ছে নিঝুম দ্বীপের আয়নত।

অভ্যন্তরিন যোগাযোগঃ
এ দ্বীপের অভ্যন্তরিন যোগাযোগ এখানো তেমন উন্নত নয়। এখানে কয়টি মাটির রাস্তা রয়েছে। সমগ্র দ্বীপে কোন যাত্রীবাহি যানবাহন নেই। কোন রিক্সাও নেই। এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে হেঁটেই যেতে হয়। স¤প্রতি এখানে একটি পোষ্টঅফিস স্থাপিত হয়েছে। রেড ক্রিসেন্টের ওয়ারলেসের মাধ্যমে জরুরী সংবাদ আদান প্রদান হতো। দূর্যোগের সময় এই ওয়ারলেস সেইটিই ছিলো একমাত্র আবলম্বন। স¤প্রতি গ্রামীণ ফোনের টাওয়ার বসানো হয়েছে। এখন মোবাইলেও যোগাযোগ করা যায।

অর্থনীতিঃ
নিঝুম দ্বীপে প্রচুর পরিমাণ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ রয়েছে বলে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার জরিপে ও বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। এখানে রয়েছে মহিষের বড় বড় বাথান। সবগুলোই স্থানীয় বাথানিয়াদের নিজস্ব উদ্যোগে গড়া। এখান থেকে উত্পন্ন দুধ থেকে তৈরী হয় বিখ্যাত দই। অথচ প্রক্রিয়াজাত করার কোন ব্যবস্থা নেই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দুগ্ধ খাতে বিপুল অর্থনৈতিক সুফল পাওয়া যাবে। এ ছাড়াও নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন চর কমলা, চর রোশনী, চর রোহানীরা, চর নুরুল ইসলাম, চর পিয়া, ঢালচর, মৌলভী চর, চর গিয়াস উদ্দিন, তেলিয়ার চর, চর রশিদ, চর আজমন, চর আমানত, সাগরদী প্রভৃতি দ্বীপে চারণ ক্ষেত্র করা যেতে যারে। নিঝুম দ্বীপ ঘিরে রয়েছে বিপুল মত্স্য ভান্ডার। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক চিংড়ি জোন। সুস্বাধু ইলিশের চারণ ক্ষেত্র এই জলসীমানা। সুন্দর সুষ্ঠু প্রকৃতি নির্ভর পরিকল্পনা নিলে দেশের অর্থনীতির বিপুল উন্নতি সাধিত হবে বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন।

বনায়নঃ
নিঝুম দ্বীপের অন্যতম আকর্ষনীয় দিক হলো এর বিশাল শান্ত স্নিগ্ধ গভীর ঘন বন। নিঝুম দ্বীপের আয়তন ৪৪ বর্গকিলোমিটারের প্রায় তিন চতুর্থাংশই গভীর ঘন বনে আবৃত। স্বাধীনতার পর থেকে বন বিভাগ এখানে বন সৃজন করে আসছে। তবে গভীর সমুদ্রের আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নতুন মাটিতে বাইন ও কেওড়া গাছ লাগানো হয়েছে। নতুন মাটিতে নতুন চরে এ গাছগুলো বেশ কার্যকর। আবার নতুন মাটি পোক্ত ও শক্ত করার জন্য এ গাছ গুলো বেশ উপযোগী বলে বন বিভাগ জানিয়েছে। এ বনের মধ্যে আছে বানর, উদবিড়াল, গুঁই সাপ, নানান জাতের পাখি, বন মোরগ, কাঠরিড়ালী, বিভিন্ন ধরনের সাপ, কাছিম, প্রভৃতি। আর আছে হাজার হাজার মায়াবি হরিণ। লাখ লাখ অতিথি পাখির জন্য এ দ্বীপ এক বিরাট আকর্ষন। প্রচন্ড শীতে খাদ্যের অন্বেষণে এসব পাখিরা উড়ে আসে এ দ্বীপে। এ সময় পাখিদের অপূর্ব মোহনীয় কূজন শুনে মনে হয় কোন এক রূপকথার পঙ্খীরাজ্য। তবে শিকারীদের জন্য দুঃসংবাদ হলো এ রাজ্যে শিকার নিষিদ্ধ। এ দ্বীপের ভিতর আছে মানুষে প্রাণীতে এক নিবিড় সংখ্যতা। ঘন বনের মধ্যে উত্পন্ন হয় উত্কৃষ্ট মধু। প্রতি বছর আহরিত হয় শত শত লিটার মধু।

আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্রঃ
একটি আকর্ষণীয় লাভজনক পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে নিঝুম দ্বীপ এক স্বর্গভূমিতে পরিনত হতে পারে। দ্বীপের দক্ষিণ বৃত্তাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে সী-বীচ। চিকচিকে মোটা বালুকারময় এ সৈকত ঢালু হয়ে চলে গেছে সমুদ্রের অভ্যন্তরে। ভাটায় জেগে উঠে দীর্ঘ বেলাভূমি। সে বেলাভূমিতে সাগরের ফেনীল উর্মীমালা আছড়ে পড়ার অপূর্ব দৃশ্য কাউকে আলোড়িত না করে পারে না। চন্দ্রালোকে জোয়ার ভাটায় এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এক স্বর্গীয় অনুভূতি সৃষ্টি করে। জোত্স্নার আলোয় ফেনিল উর্মীমালার শীর্ষে শীর্ষে যেন এক একটি মনি মুক্তা জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকে। দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়।

নিঝুম দ্বীপকে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছিলো। ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এ দ্বীপকে একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেদ্র করার পদপে নিয়েছিলো। বর্তমানে এ দ্বীপকে পর্যটন দ্বীপ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সরকারী ব্যাপক পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বর্তমানে সেখানে কয়টি সরকারি বেসরকারি রেষ্ট হাউজ করা হয়েছে। একটি বেসরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠান সেখানে পর্যটকদের জন্য হাতি ঘোড়া ইত্যাদির ব্যাবস্থা করেছে। অনেকের ধারনা এ দ্বীপের বালুকাবেলায় কোন অবকাঠামো গড়ে তুললে সমুদ্রের জোয়ারে তা ভেঙ্গে পড়তে পারে। তবে বিকল্প ব্যবস্থায় পি-ফেব্রিকেটেড কটেজ নির্মাণ করে পর্যটন মৌসুমে এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বন বিভাগে একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে চিহ্নিত করে অভয়ারন্য হিসাবে ঘোষণা করে এর ভিতর ছোট ছোট চ্যানেলে পর্যটকদের জন্য দৃশ্য অবলোকনের ব্যবস্থা করতে পারে। যেভাবে দেশী বিদেশী বিভিন্ন পর্যটক এ দ্বীপের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে, এ আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে এখানে গড়ে উঠতে পারে অত্যন্ত আকর্ষণীয় পর্যটন জোন। এ থেকেও আমাদের দেশ উপার্জন করতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্র।

প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য নিবাসঃ
ইতিমধ্যে নিঝুম দ্বীপটি হয়ে উঠেছে একটি চমত্কার স্বাস্থ্য নিবাস। যে কেই এখানে এসে সুন্দর সূর্যস্নাত দিনে সমুদ্র অবগাহনে হবেন পুলকিত। বছরের ঝূঁকিপূর্ণ ঝড় ঝঞ্ঝার দিনগুলো বাদে বিশেষ করে শীত-হেমন্তে ভ্রমন বেশ জমে উঠে। এখানে শহরের মত গাড়ীর ধোঁয়া নেই। ধুলি বালির আধিক্য নেই। কান ফাটা গাড়ীর হর্ন নেই। কেবল সমুদ্রের নির্মল বায়ু শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ, বায়ু পরিবর্তনকারীদের জন্য এ দ্বীপটি এক স্বর্গরাজ্য। মাত্র কয়েক ঘন্টার অবস্থানেই শরীর ও মন হয়ে উঠবে ঝরঝরে তাজা।

মত্স্য ভান্ডারঃ
নিঝুম দ্বীপের চতুর্দিকে আছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশাল মত্স্য ভান্ডার। বৈশাখ থেকে আষাঢ় শ্রাবণ পর্যন্ত এখানে সবচেয়ে বেশী মাছ ধরা পড়ে। এ সময় সবচেয়ে বেশী ধরা পড়ে ইলিশ। ইলিশ ছাড়াও নানান জাতের মাছ সারা বছরই এখানে পাওয়া যায়। খুলনা, বরিশাল, চাঁদপুর, চট্টগ্রামের শত শত মাছ ধরার ট্রলার এ সময় এ অঞ্চলে এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। এ সময় নিঝুম দ্বীপের চতুর্দিকে হাজার হাজার জেলেদের পাল তোলা নৌকা মাছ ধরার উত্সবে মেতে উঠে। নানা রঙের নানা আকারের পালের নৌকার সাগরের মধ্যে এক রঙ্গিন ফুলের মালায় পরিনত হয়। সে দৃশ্য স্বচে না দেখলে কল্পনা করাও অসম্ভব।


সমুদ্রের কলতান, মায়াবী হাতছানীঃ
সমুদ্রের ডাক শুনতে সবাই ছুটে যায় কক্সবাজার। সমুদ্র সৈকত বলতে বুঝায় কক্সবাজার টেকনাফ এবং স¤প্রতিক কুয়াকাটা। অথচ নিঝুম দ্বীপের বিস্তীর্ণ সমুদ্রতট ও তার মায়াবী হাতছানী এখনো অনেকের আড়ালে রয়ে গেছে। অদ্ভুত এক নির্জনতা নিঝুম দ্বীপকে ঘিরে রেখেছে এর সৈকতে দাঁড়ালে গভীর সমুদ্র থেকে তরঙ্গে ভেসে আসে সমুদ্রের মায়াবী আহ্বান। হৃদয়ে বেজে উঠে অপূর্ণ সুরের মুর্ছনা। তনুমন তখন তন্ময় হয়ে হারিয়ে যায় সুদূর দিগন্তে। যেন সাগরের নীলে দাঁড়িয়ে আকাশের নীলকে ছুঁয়ে দেখা। সমুদ্রের হৃদপিন্ডে বসে সমুদ্রের শব্দ শোনা। আর মনের সাধ মিটিয়ে বেড়াতে চাইলে নিঝুম দ্বীপ হচ্ছে আদর্শ স্থান। সমুদ্রের গানের সাথে নিজ হৃদয়ের সুর মিলিয়ে একাকার হয়ে যাওয়া, দূরনীলিমায় আকাশ রাঙানো দিগন্তের ফুলসজ্জায় সূর্য আর সাগরের অপূর্ব মৈথুন উপভোগ করা। পরক্ষনেই উর্মিল সাগরের জলদ শরীরে লাল সূর্যের হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে যে কারো রোমান্টিক হৃদয়কেও নিরুদ্দেশ করে দেবে।

যেভাবে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যাবেঃ
ঢাকা থেকে খুব সহজেই নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যায়। ঢাকার সদরঘাট থেকে একটি স্টিমার সপ্তাহে দুদিন হাতিয়ায় চলাচল করে। হাতিয়া থেকে ট্রলারে যেতে হয় নিঝুম দ্বীপ। ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত পর্যন্ত অনেকগুলো চেয়ারকোচ সরাসরি নোয়াখালীতে যাতায়ত করে। চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টায় এগুলো সরাসরি মাইজদী সোনাপুর এসে পৌঁছে। চেয়ার কোচের ভাড়া দুইশ' টাকা । সকাল সাতটায় কমলাপুর থেকে ছাড়ে উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেন । এছাড়া ঢাকা সাঈদাবাদ থেকে আধা ঘন্টা পর পর যাত্রীসেবা বাস গুলো ছাড়ে নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে, ভাড়া ১শ ২০ টাকা। নোয়াখালী সোনাপুর পৌঁছে সেখান থেকে যেতে হবে স্টিমার ঘাট। বাস টেম্পো বা বেবীতে সরাসরি পাকা মশ্রিণ পথ ধরে ৪০ কিঃমিঃ দক্ষিণে সুধারামের শেষ প্রান্তে চর মজিদ স্টিমার ঘাট। তার পরেই হাতিয়া যাবার চেয়ারম্যান ঘাট। পাকা রাস্তা একেবারে ঘাট পর্যন্ত এসে মিশেছে। সোনাপুর থেকে একটি বেবী রিজার্ভ নিলে ২৫০টাকা থেকে ৩০০ টাকা অথবা জনপ্রতি ৫০টাকা দিয়ে যাওয়া যায়। টেম্পো, বাসে জনপ্রতি ভাড়া আরো কম। চর মজিদ ঘাট থেকে ট্রলার কিংবা সী-ট্রাকে করে হাতিয়া চ্যানেল পার হয়ে যেতে হবে হাতিয়া নলচিরা ঘাটে। সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। । নলচিরা বাজার থেকে যেতে হবে হাতিয়ার দক্ষিণে জাহাজমারা। সময় নেবে আধা ঘন্টা। জাহাজমারা থেকে ট্রলারে সরাসরি নিঝুম দ্বীপ। সময় নেবে ৪০/৫০মিনিট। তবে দলবেঁধে গেলে ট্রলার রিজার্ভ করে সরাসরি নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যায়। ঘাট থেকে নদীপথে হাতিয়া অথবা নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে জোয়ারের জন্য। কারণ জোয়ার না থাকলে ঘাটে ট্রলার ভিড়ানো যায় না। আবার ভাটার সময় নদীতে অসংখ্যা ডুবা চরে ট্রলার আটকে যাবার সম্ভাবনা থাকে। জোয়ারের সঠিক সময় জেনে ঢাকা থেকে ভোরে রওনা হলে বিকালের মধ্যে নিঝুম দ্বীপে পৌছানো যায়। নিজস্ব গাড়ী নিয়ে আসলে ঢাকা থেকে মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টায় সহজেই স্টিমার ঘাটে পৌঁছা যাবে। পথিমধ্যে যোগাযোগের এই সামান্য অসুবিধা ছাড়া এত অল্প সময় ও অল্প খরচে সমুদ্রের কাছে যাওয়ার আর কোন সহজ উপায় নেই।


থাকার ব্যবস্থাঃ
নিঝুম দ্বীপে অতি স¤প্রতি একটি ভালোমানের হোটেল বাণিজ্যিক ভাবে চালু হয়েছে। এখানকার স্থানীয় বাজারে খুব সস্তায় অল্প দামে চার পাঁচটি আবাসিক বোডিং আছে। তাছাড়া বন বিভাগের একটি চমত্কার বাংলো আছে। পাশেই আছে জেলা প্রশাসকের ডাক বাংলো। এগুলোতে আগে ভাগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায়। তাছাড়া রেড-ক্রিসেন্ট ইউনিট ও সাইক্লোন সেন্টারেও থাকার ব্যবস্থা করা যায়। এ দ্বীপে অনেকেই আছেন খুব বন্ধু বত্সল। পর্যটকদের এরা খুব সম্মানের চোখে দেখেন। যেকোন অসুবিধা দুর করতে আগ্রহ করে তারা নিজেরাই এগিয়ে আসেন। নোয়াখালী শহরে থাকতে চাইলে এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভাল ভাল আবাসিক হোটেল। প্রধান সড়কের পাশেই এই হোটেল গুলো রয়েছে। তাছাড়া বিআরডিবি রেস্ট হাউস, সড়ক বিভাগ, জনস্বাস্থ্য বিভাগের আধুনিক ডাক বাংলো রয়েছে। সরকারী অনুমতি নিয়ে সার্কিট হাউসেও যে কেউ থাকতে পারেন। সময় করে মাইজদীতে একদিন থেকে এর শান্তরূপ উপভোগ করা হবে ভ্রমনের একটি বাড়তি পাওনা। পথে পড়বে বিখ্যাত মোঘল স্থাপত্যের নান্দনিক সৌন্দর্যের বজরা মসজিদ। আর একটু সময় নিলে দেখে আসা যাবে অহিংস ভাবাদর্শের নানান ঘটনা বিজড়িত উপ মহাদেশ খ্যাত গান্ধি আশ্রম।

নিঝুম দ্বীপের রোমাঞ্চঃ
যারা উচ্ছাস উচ্ছলতা আর রোমাঞ্চে জীবনকে অর্থবহ করতে চান তারা নিঝুম দ্বীপকে ঘিরে, সে আশা ষোল কলাপূর্ণ করতে পারেন। শীত মৌসুমে সাগর শান্ত থাকলেও বছরের যেকোন সময় এখানে আসা যায় এপ্রিল থেকে সাগর ধীরে ধীরে অশান্ত বা গরম হতে থাকে। তখন ঢেউয়ের উচ্চতাও বৃদ্ধি পায়। ট্রলারে সে তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সাগর পাড়ি দিতে প্রয়োজন পড়ে সাহসের। সে সময় এক রোমাঞ্চ অভিজ্ঞতায় দুধর্ষ অভিযাত্রীর মত মনে হবে নিজেকে। উদ্দাম ঢেউয়ে ছিটকে আসা সমুদ্রের লোনা জল পুলকিত হবে হৃদয়। এ সময় সমুদ্র পাড়ি হবে জীবনের রোমাঞ্চাকর হৃদ-কাঁপানো অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতার ভান্ড ভারী হলে জীবনও হবে সমৃদ্ধশালী।

TRAIN SCHEDULE OF DHAKA-NOAKHALI-DHAKA

Intercity Trains From Dhaka:
Train No
Name
Off Day
From
Departure
To
Arrival
712
Upakul Express
Wednesday
Dhaka
7:00:00 AM
Noakhali
1:05:00 PM

Mail/Express Trains From Dhaka :
Train No
Name
Off Day
From
Departure
To
Arrival
12
Noakhali Express
No
Dhaka
8:10:00 PM
Noakhali
4:40:00 AM


Intercity Trains From Noakhali :

Train No
Name
Off Day
From
Departure
To
Arrival
711
Upakul Express
Wednesday
Noakhali
2:30:00 PM
Dhaka
8:25:00 PM


Mail/Express Trains From Noakhali :

Train No
Name
Off Day
From
Departure
To
Arrival
11
Dhaka Express
No
Noakhali
8:30:00 PM
Dhaka
5:55:00 AM

নিঝুম দ্বীপ
নোয়াখালী জেলার দক্ষিণে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত হাতিয়া উপজেলার সর্বদক্ষিণে নিঝুমদ্বীপের অবস্থান। ১৯৪০ এর দশকে এই দ্বীপটি বঙ্গোপসাগর হতে জেগে উঠা শুরু করে। চর গঠনের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে ৪০ এর দশকের শেষদিকে নিঝুমদ্বীপ তৃণচর বা গোচারণের উপযুক্ত হয়ে উঠে। মাছ ধরতে গিয়ে হাতিয়ার জেলেরা নিঝুমদ্বীপ আবিস্কার করে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নিঝুমদ্বীপে জনবসতি শুরু হয়। মূলত হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়ন হতে কিছু জেলে পরিবার প্রথম নিঝুমদ্বীপে আসে। নিঝুমদ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ইছা মাছ (চিংড়ি মাছ) ধরা পড়তো বিধায় জেলেরা এই দ্বীপের নাম দেয় ‘‘ইছামতির দ্বীপ’’। এই দ্বীপটিতে মাঝে মাঝে বালির ঢিবি বা টিলার মত ছিল বিধায় স্থানীয় লোকজন এই দ্বীপকে বাইল্যার ডেইল বলেও ডাকতো। কালক্রমে ইছামতি দ্বীপ নামটি হারিয়ে গেলেও স্থানীয় লোকেরা এখনো এই দ্বীপকে বাইল্যার ডেইল বলেই সম্বোধন করে। নিঝুম দ্বীপ বা বাইল্যার ডেইল যে নামই হোক না কেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের দিয়ারা জরিপ বিভাগ এই দ্বীপের জমি চর ওসমান মৌজা হিসেবে জরিপ করে। কথিত আছে সর্দার ওসমান নামের এক সাহসী বাথানিয়া ১০০ মহিষ নিয়ে প্রমত্তা মেঘনা পাড়ি দিয়ে প্রথম এই দ্বীপে অসে এবং দিয়ারা জরিপ কর্মচারীদেরকে জরিপ কাজে প্রভূত সহায়তা করে বিধায় তার নামে অনুসারে নিঝুম দ্বীপে মৌজার সরকারী নাম হয় ‘চর ওসমান’। সমগ্র নিঝুম দ্বীপের প্রায় ৩০০০.০০ একরে মানুষের বসতি রয়েছে এবং অবশিষ্ট অংশে ম্যানগ্রোভ বনায়ন রয়েছে।ইছামতির দ্বীপ, বাইল্যার চর বা চর ওসমান যে নামেই স্থানীয় ভাবে প্রচলিত হোক না কেন ৮০ এর দশকের শুরুহতে এই দ্বীপটি বাংলাদেশের জনগণের নিকট নিঝুম দ্বীপ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা: নোয়াখালী জেলা সদর মাইজদী হতে প্রথমে সোনাপুর বাসস্ট্যান্ড যেতে হবে। সেখান থেকে চেয়ারম্যান ঘাট গামী যেকোন লোকাল বাস সার্ভিস/ সিএনজি অটোরিক্সা যোগে চেয়ারম্যান ঘাটে নামতে হবে। অতঃপর সীট্রাক/লঞ্চ সার্ভিসে নলচিরা ঘাটে নেমে সিএনজি অটোরিক্সা যোগে জাহাজমারা ঘাটে গিয়ে নৌকাযোগে জাহাজমারা চ্যানেল পার হয়ে নিঝুম দ্বীপ পৌঁছা যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন