শনিবার, ১৭ মে, ২০১৪

তুরস্কের এফেসাস- সাতটি তারার এক তিমির!


বিজয়দেবী নাইক (Nike)
আমাদের গাইড এক তুর্কী মহিলা। নাম হানিফা। জন্ম এফেসাসের কাছাকাছি সেলচুক শহরে। বাবা মায়ের সাথে দেশ ছেড়ে পড়াশোনা করেছেন ও বড়ো হয়েছেন জার্মানিতে। পরে আবার আত্মার টানেই আবার ফিরে এসেছেন নিজের দেশ তুরস্কে। সদালাপি ও আন্তরিক হানিফা যদিও আট বছর বয়েসের এক সন্তানের মা, বয়েস তার চুয়ান্ন।

আমাদের গাইড হানিফা
টিকিট কেটে এফিসাসের সীমানায় ঢুকেই একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে প্রাথমিক বর্ণনা শুরু করলেন। “নানির সাথে এসে এই গাছের নিচেই ছোটবেলায় খেলা করতাম। চারপাশের খোড়াখুড়ি দেখে নানি বলতো, এদের কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই?”
সবাই হেসে উঠলাম শুনে।

খনন কাজের শুরু

এফেসাসের রাজপথে পাথরস্তম্ভ
পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যগুলোর মাঝে একটি, প্রাচীন সভ্যতা ও জীবনযাত্রায় জীবন্ত ছবি তুলে ধরার প্রশ্নে এফেসাসের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রায় দুইশো বছর ধরে বিভিন্ন আর্কিওলজিস্ট স্তরের পর স্তর খনন করে এই কীর্তি তুলে ধরেছেন আধুনিক বিশ্বের সামনে। তাদের মাঝে সবার আগে রয়েছেন অষ্ট্রিয়া ও বৃটেনের বোদ্ধারা। মেয়ান্দা নদীর সাথে বয়ে আসা পলিমাটির স্তর আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বংস এফেসাস ধীরে ধীরে মাটির নীচে তলিয়ে যায়। বহু বছর মাটির নীচে থাকার পর খনন শুরু করে এক একটি করে ছোটবড়ো টুকরো নানাভাবে পরীক্ষা করে মিলিয়ে মিলিয়ে যত্নের সাথে সে শহরকে আবার সাজিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সা্জানোর নকশা খুঁজতে গিয়ে এর ইতিহাস, রাজনীতি, জীবনযাত্রা নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে তাদের। ধ্বংসাবশেষ অনেকটাই খুঁজে পাওয়াও যায়নি কারণ আশেপাশের অধিবাসীদের বাড়িঘর গড়ার কাঁচামাল হিসেবে ব্যাবহৃত হয়েছে এসব পাথর অনেকদিন ধরেই।

সিনেট সদস্যদের বসার জায়গা

লাইব্রেরী
কী ছিল না এই শহরে! ২৫০০ বসার জায়গা সহ থিয়েটার, বিশাল লাইব্রেরি, সময় আর আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জন্য রেখে বাড়িঘর, পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের পাইপ, জামজমকপূর্ণ গোসলের জায়গা, সবই সে উন্নত সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঐতিহাসিকদের মতে প্রায় একহাজার বছর ধরে এই শহরের নানা সুবিধাদি ভোগ করতে পরে শহরের দুই লাখ বাসিন্দা।

ক্ষমতাশীনদের বাসস্থান এলাকার তোরণ

শহরবাসীদের সম্পত্তির হিসেব লেখা পাথরখণ্ড
পাশাপাশি ছিল নানা ধরণের আমোদ প্রমোদের সমস্ত উপকরণ। রোমান সময়ে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ হোতারা কাজের শেষে তাদের ক্লান্তি কাটাতেন হাম্মামে। আরাম আয়েশের পাশপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনা ও রাষ্টতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ছক কাটা হতো সেখানে। এমন কি প্রাকৃতিক কর্ম সারার সময়েও এই আলোচনায় কোনো রকম ছেদ পড়ার সুযোগ ছিল না। পাশাপাশি বসে সেখানেও কথাবার্তা চলতো। পাশেই ছিল গণিকালয়। একটি কর্মব্যাস্ত দিনের এর চাইতে সুখময় সমাপ্তি আর কী হতে পারে!

রাজপথ, ডানে আমোদ প্রমোদ, বামে প্রজাদের বাসস্থান

গণপায়খানা ও রাজ্যশাসন!
এফেসাসের ইতিহাস ঘা্টতে গেলে অনেক পেছনে ফিরে যেতে হয়। খ্রীষ্টপূর্ব ১১০০ শতাব্দীতে গ্রীক আয়োনিয়ানদের হাতে গোড়াপত্তন হয় এফেসুসের। তাদেরই কোনো এক রাজপুত্র তার বিলাসভবন স্থাপনের জায়গা খুঁজতে গিয়ে কেনো এক ধর্মগুরুর পরামর্শে এজিয়ান সাগরের পাড়ের এই স্থানটিকেই বেছে নেয়। এরপর ইতিহাসের বিবর্তনকে আকড়ে ধরে গ্রীসের বিভিন্ন শক্তির হাত ঘুরে খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পারসীদের হাতে পড়ে এফেসাস। খ্রীষ্টপূর্ব ৩৩৩ সালে তাদেরকে বিতাড়িত আলেকজান্ডার দি গ্রেট দখল করেন শহরটি। এরপর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন জাতি এফেসাসের দখল নেয়। অবশেষে খ্রীষ্টপূর্ব ১৮৯ শতাবদীতে রোমানদের হাতে পড়ে কলেবরে আরও বর্ধিত হয়। উন্নত নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা, শাসনতান্ত্রিক সুযোগ সুবিধা আর ভোগবিলাসের কেন্দ্র হয়ে উঠে স্থানটি। রোমান প্রদেশ “ছোটো এশিয়ার” এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসাকেন্দ্রে পরিণত হয় এফেসাস। ৬১৪ খ্রীষ্টাব্দে এক ভুমিকম্পে শহরের অনেকটাই ধ্বংস হয়ে যায় । তারপরও ১০০০ ও ১১০০ খ্রীষ্টাব্দে আবারও বিত্তশালী এক শহরে পরিণত হয়। কিন্তু ১৪০০ সালে এখানকার সমূদ্রবন্দর অন্য এক শহরে সরিয়ে নেবার পর গূরুত্বহীন হয়ে ধীরে ধীরে ধ্বংসপ্রাপ্ত, পরিত্যাক্ত এক শহরে পরিণত হয় এফেসাস। মেয়ান্দা নদীর পলিমাটির নীচে তলিয়ে যায় ধীরে ধীরে। এর পর ইতিহাস বোদ্ধাদের চেষ্টায় ১৮৩৩ সালে এর উদ্ধারকার্য শুরু করা হয়। আজ অবধি চলছে খননের কাজ।

থিয়েটার, আসনসংখ্যা ২৫০০

রাজপথ
তুর্কী বীর কামাল পাশা শুধুমাত্র আধুনিক তুরস্কের জন্মদাতা নন, গ্রীসের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ী হয়ে সার্বভৌমিক তুনস্কের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। আধুনিক চিন্তায় যারা বিশ্বাসী ও দেশের ইউরোপিয়ান অংশে তাঁর এই অবদানকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া হলেও রক্ষনশীল মুসলিম সমাজ ধীরে ধীরে অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। তবে তুরস্কের এই অংশের অধিবাসীরা প্রগতিশীল ও কামাল পাশার চিন্তারধারা অনুসারী। তাই এখানে এখনও বিভিন্ন ধর্ম ও ঐতিহ্যের শান্তিপূর্ণ পাশাপাশি অবস্থান। ব্যাক্তিগতভাবেও তুর্কিদের সাথে বিভিন্ন আলোচনা হয়েছে আমার। ইউরোপীয়ান প্রভাবের এত কাছাকাছি হয়েও মুসলিম হিসেবে তাদের গর্ববোধের কমতি চোখে পড়ে নি। যারা সত্যিকারের ইতিহাস সচেতন, তার ধর্মের চশমা পড়ে ইতিহাস বিচার করে না। এখানকার তুর্কিদেরও সেরকমই মনে হলো। ধর্মের লেবাস পড়ে ইতিহাস সাজানোর প্রচেষ্টা করতে কাউকেই দেখলাম না।

দোকানপাটের সাইনবোর্ড
তবে এর পাশাপাশি আরেকটি দিকও ভাবতে হয়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সংকটের কারণে সেখানকার ট্যুরিষ্টদের নজরের কেন্দবিন্দুতে এখন তুরস্ক। ইতালি, গ্রীস ও স্পেন ট্যুরিষ্টদের পছন্দের জায়গা হলেও ইওরোভুক্ত দেশ হিসেবে এসব দেশে বেড়ানো খুব ব্যায়সঙ্কুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে সুযোগটি লুফে নিয়ে ট্যুরিষ্টব্যাবসায় এখন অনেক এগিয়ে তুরস্ক। সেজন্যে বাইরের লেবাস পাল্টাতে হয় বৈকি! আমাদের মতো ট্যুরিষ্টদের দৃষ্টি সে লেবাস পেরিয়ে কতটুকুই বা ঢোকে গভীরে!
এফেসাসের পর হানিফা আমাদেরকে সেলচুক শহরের একটি মসজিদ দেখালেন। সচেতন, শিক্ষিতা হানিফা যতটা সন্মান ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে মসজিদ ও ইসলামী ধর্মকর্মের টুকিটাকি বর্ণনা দিলেন অতিথিদের, তাতে এই ধর্মের তাঁর নিজস্ব সম্পৃক্ততার বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠলো।

ফেরারপথে টায়ার সংকট!
সেলচুকের একটি রেষ্টুরেন্টে আদানা কাবাব ও আনুষাঙ্গিক খাবার দাবার বেশ উপভোগ্য লাগল। ফেরার পথটি রাতের অন্ধকারে আরও বেশী একঘেয়ে হতো, যদি না একটি দূর্ঘটনা না ঘটতো। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ওঠার সময় বাসের টায়ার পাটে হঠাৎ। গতি কম থাকায় ভয়ঙ্কর কোনো বিপদ ঘটার আগেই থামান যায় বাস। সবাই মিলে হাত লাগানোর কারণে গাড়ির চালক সহজেই সেটি পাল্টাতে পারলেন।
মূল লেখার লিংক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন