শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০১৪

বেড়াতে যেতে পারেন অপরূপ টেকনাফ

উঁচু-নিচু ছোট-বড় পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। দুপাশে সবুজের সমারোহ। রাস্তার পূর্ব পাশে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে বিভক্তকারী নাফ নদী। নদীতে সারি-সারি নৌকায় পাল তুলে জেলেরা মাছ ধরছে। হিমেল বাতাসে উড়ছে নৌকার পাল। প্রকৃতির এমন অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে যেতে হবে দেশের সর্বদক্ষিণ সীমান্ত শহর টেকনাফে।
গেম রিজার্ভ : টেকনাফ গেম রিজার্ভ বাংলাদেশের একমাত্র গেম রিজার্ভ বন। এটি ১১ হাজার ৬১৫ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। বাংলাদেশে হাতেগোনা যে কটি স্থানে বন্যহাতির দেখা মেলে তার মধ্যে এটি অন্যতম। বন্য এশীয় হাতির অভয়ারণ্য হিসেবে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গেম রিজার্ভ। এখানে উঁচু পাহাড় আর বঙ্গোপসাগরের মধ্যে রয়েছে বিশাল গর্জন বন। এছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে শোভিত হচ্ছে তৈঙ্গাচূড়া। কক্সবাজার শহর থেকে ৮৮ কিলোমিটার দক্ষিণে টেকনাফের দমদমিয়া এলাকায় মুছনী গ্রামে অবস্থিত গেম রিজার্ভ। নানা ধরনের বন্য পশুপাখি, গাছপালা, ফল-ফুলসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখানে উপভোগ করতে পারবেন।
তৈঙ্গাচূড়া : গেম রিজার্ভের অন্যতম আকর্ষণ হল তৈঙ্গাচূড়া। এ চূড়া অত্যন্ত খাড়া প্রকৃতির। এটি এক হাজার ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। এখান থেকে বঙ্গোপসাগর, নাফ নদী, মিয়ানমার সীমানার পাহাড় শ্রেণী এবং গেম রিজার্ভের চিত্র উপভোগ করা যাবে।
কুদুমগুহা : গেম রিজার্ভের অভ্যন্তরে রইক্ষ্যং এলাকায় কুদুমগুহার অবস্থান। এটি বাংলাদেশের একমাত্র বালু-মাটির গুহা। কুদুমগুহায় প্রচুর বাদুড় বাস করে। তাই এটিকে বাদুড় গুহা বলেও অভিহিত করা হয়। কুদুমগুহায় দুই প্রজাতির বাদুড় ছাড়াও ৪ প্রজাতির শামুক, তিন প্রজাতির মাকড়সাসহ বিভিন্ন ধরনের বিচিত্র প্রাণীদের বসবাস রয়েছে। দুর্গম পাহাড় অতিক্রম করে এই গুহায় যেতে হয়।
রোমাঞ্চকর এ ভ্রমণে পথ পাড়ি দিলে অবশ্যই বনপ্রহরী সঙ্গে নিতে হবে।
চাকমা গ্রাম : কুদুমগুহার পাশেই একটি গ্রামে চাকমা সমপ্রদায়ের বসবাস। উপজাতিদের জীবনবৈচিত্র্য নিজ চোখে দেখতে যেতে পারেন গ্রামটিতে। তবে এ জন্য অবশ্যই আপনাকে কোনও গাইড কিংবা কোনও চাকমা উপজাতির সহায়তা নিতে হবে।
নেচার পার্ক : নেচার পার্কের অবস্থান টেকনাফ শহর থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার উত্তরে। এই পার্কটিতে কয়েক হাজার শতবর্ষী গর্জনগাছ রয়েছে। বিশাল এই বনের ভেতর হাঁটার জন্য রয়েছে তিনটি রাস্তা। এসব রাস্তায় পর্যটকদের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য মোড়ে-মোড়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিশ্রামাগার।
এখানে টাওয়ারে বসে হাতি, হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন পশুপাখির ডাক শুনতে পারবে। পাহাড়ের চূড়ায় তৈরি করা চৌকিতে বসে পুরো বনের চিত্র, নাফ নদী ও মিয়ানমারের আরাকান সীমান্তের দৃশ্য মনভরে উপভোগ করা যাবে।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিমান অথবা বাসে যাওয়া যাবে। কক্সবাজার থেকে ননস্টপ টেকনাফগামী বাসে চড়ে যেতে পারবেন টেকনাফে।
By on

ভ্রমণ বিলাসীদের জন্য সস্তা পৃথিবীর ১০টি ভ্রমণের নগরী

তুরস্ক/তুর্কী: তুর্কী উন্নয়নশিল দেশ সমুহের অন্যতম। কিন্তু দেশটির ভিতরে খরচাপাতি এখনো পুরাতন যুগেরই রয়েগেছে। কাজেই পুরাতন খরচে নতুনের স্বাদ নিতে ভ্রমণ বিলাসীদের নিকট তুর্কী হলো ২০১৩ সালের সবচেয়ে পছন্দের দেশ। গত দশবছরে দেশটির সরকারও অতিথিদের যথেষ্ট যত্নের সাথেই আপ্যায়ন করে এর হার প্রায় ৬৭% বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। দেশের এই ট্যুরিষ্টের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সরকার গ্লোবাল বিমান পরিবহণেরও ব্যবস্থা করেছেন।

২) আমেরিকান উপসাগরীয় উপকূল:
- ভিসার ব্যবস্থা করতে পারলে কম খরচে আমেরিকার এই সমুদ্র অন্চলটি আপনি ঘুরে আসতে পারেন। এই অন্চলটিকে গাল্ফ সাউথ/ সাউথ কোস্ট অথবা থার্ড কোস্ট বলেও নাম করন করা হয়। অন্চলটি আমেরিকার টেক্সাস, লুসিয়ানা, মিসিসিপি, আলবানা এবং ফ্লোরিডাকে একত্রিত করে। এই অন্চলটিকে গাল্ফ স্টেটও বলা হয়। সমুদ্র উপকুলীয় হওয়ায় আমেরিকানরা তাদের বিভিন্ন ছুটি কাটানোর জন্য এই অন্চলে এসে ভীর জমায়। বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন ট্যুরিষ্ট স্পট এবং খাওয়া-দাওয়া, থাকা ভ্রমন খরচ অনেক সস্তা হওয়ায় এই অন্চলের ট্যুরিস্টের সংখ্যাও দিন দিন বেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৩) ইউক্রেন:
- ২০১৩ সালকে ইউক্রেনের ভাইটাল সাল হিসেবে ধরা হয়। এই বৎসর ট্যুরিষ্টের সংখ্যা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে আগামী ৪/৫ বৎসরের মধ্যে হয়তো দেশটি বিশ্বের এক নম্বর ট্যুরিষ্ট ডেস্টিনেসন হতে যাচ্ছে। দেশটি ভিজিট শেষে সবাই দেশটির উন্নত কালচার, লোকাল মানুষদের সুন্দর ব্যবহার কম খরচে থাকা খাওয়ার বেশ প্রশংসা করেছেন, ফলে দেশটিতে সামনে ভ্রমণ বিলাসীদের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাবে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। গড় হিসেবে মোটামোটি ভালভাবে চলতে সব মিলিয়ে প্রতিদিন ৩০/৩৫$ খরচ হয়।

৪) কম্বোডিয়া:
- শুধুমাত্র কম খরচের জন্য নয় বরং লোকাল জনগনের চমৎকার আতিথেয়তা, চিত্তহারী সভ্যতা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য ট্যুরিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মুখে মুখে এখন দক্ষিন এশিয়ার এই দেশটির নাম। কিন্তু সামনের কয়েকবছরে দেশটিতে খরচের পরিমান বৃদ্ধি পেতে পারে, তাই যাদের মনে এই দেশটি ভ্রমন করার সুপ্ত বাসনা আছে তাদের জন্য উত্তম হবে ২০১৪ সালেই দেশটি ভিজিট করা।

৫) দক্ষিন কোরিয়া।
- এশিয়ার এই দেশটি বিগত কয়েক বছর ধরেই ভ্রমণ বিলাসীদের নিকট প্রিয় একটি দেশ। দেশটিতে যেমন ঘুরে মজা তেমনি মজা কেনা কাটায়। ছাত্র হোস্টেলের জন্য বিখ্যাত এই দেশটিতে সস্তায় উন্নত মানের হোটেল, খাওয়া ও ট্র‌্যান্সপোর্টসেবা মেহমানদের জন্য যেন স্বর্গ। দেশটির ট্যুরিষ্ট মন্ত্রনালয় বিদেশি অতিথিদের ফ্রি ট্যুরিষ্ট গাইড, ফ্রি সিটি ট্যুর সাটাল বাস এবং ২৪ ঘন্টা ফ্রি কথা বলার মোবাইল সিমের ও ব্যবস্থা করে থাকে। তবে আর দেরি কেন, যদি ভাবছেন এশিয়ার কোন উন্নত দেশে ট্যুর করবেন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন দক্ষিন কোরিয়ার বিষয়ে।


৬) তাজমেনিয়া (অস্ট্রলিয়া)
- যারা দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান তারা যদি এখনো তাজমেনিয়া ভ্রমণ না করে থাকেন তবে আপনার এখনই আপনার পরবর্তী গন্তব্য এই তাসনামিয়া হওয়া উচিত। তাজমানিয়ার ‘হোবার্ট’ এবং ‘ওল্ড-মিটস-নিউ হাবোর”
দ্বীপ দুটি বিখ্যাত দুটি ট্রাভেলস অরগানাইজেশন এর ট্রাভেল লিস্টের প্রথমে রয়েছে। TripAdvisor’s Travelers’ ২০১২ সালে এবং বিখ্যাত Lonely Planet ২০১৩ সালের শ্রেষ্ঠ ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেসন হিসেবে ঘোষণা করে তাজমেনিয়ার এই দ্বীপ দুটির নাম।


৭) ক্রোয়েশিয়া।
- সস্তায় ঘুরে বেরানোর জন্যে ক্রোয়েশিয়াও ভ্রমণ প্রেমিদের এক প্রিয় নাম। কিন্তু হয়ত বেশিদিন এই সুযোগ থাকবে না। সম্প্রতি তাদের ইউরোপিয় অন্চলে প্রবেশ করায় দেশটির অর্থনীতিতে হয়ত বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। ফলে এই সংবাদটি ভ্রমণ বিলাসীদের জন্য খুব একটা সুখকর নয়। কাজেই কারো মনে ক্রোয়েশিয়া ভ্রমনের ইচ্ছা থেকে থাকলে তা যত দ্রুত সম্ভব পুর্ন করাই ভাল।


৮) শ্রিলন্কা:
- প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই লীলাভূমি দিন দিন আন্তর্জাতিক ভ্রমণবিলাসীদের নিকট বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে এখনো তেমনটা ভীড় হয়ে উঠে নি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যথেষ্ট যোগাযোগের অভাব এবং নিরাপত্তার ভয় যদি না থাকত তাহলে দেশটি তার সৌন্দর্য দিয়ে আরো অনেক অতিথি টানতে পারতো। তবে কম বাজেটের দর্শকদের জন্য শ্রিলন্কা হতে পারে উত্তম ডেসটিনেসন।

৯) পানামা:
- পানামা তার খালের জন্য এতটাই বিখ্যাত যে শুধু এই খাল ভ্রমনেই প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ ট্যুরিষ্ট ছুটে আসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। খালের কিছু অংশের খনন কাজ আগামী বছর শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এবং এটা শেষ হলে দেশটি আরো বেশি বেশি ক্রুজকে ওয়েলকাম করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। দেশটিতে লাক্সারি হোটেলের দৈনিক মুল্য মাত্র ১২০ ডলার যেখানে আমাদের দেশে লাক্সারি হোটেলের দৈনিক খরচ ৩০০/৪০০$।

১০) নিকারাগুয়া:
- সেন্ট্রাল আমেরিকার এই দেশটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের কারনে সেন্ট্রাল আমেরিকার পরবর্তি শ্রেষ্ঠ পর্যটন অন্চল হিসেবে পরিচয় লাভ করতে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, ঘন জঙ্গল, চোখ ধাধাঁনো সমুদ্র সৈকত এবং অতি সস্তা থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা পাল্টিয়ে দিতে যাচ্ছে দেশটির অর্থনীতি। বলা হয়ে থাকে, নিউইয়র্কের একটি সস্তা মোটেলের খরচে নিকারাগুয়াতে আপনি লাক্সারিয়াস হোটেলে রাত্রিযাপন করতে পারেন। ভ্রমণ বিলাসীদের জন্য এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা আর কি হতে পারে।

 By on

ভ্রমণ যখন দার্জিলিংয়ে

একবার ভাবুন, আপনি ছুটছেন পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে। জিপের ভেতর দাঁত কামড়ে বসে আছেন। পাল্লা দিয়ে চলছেন মেঘের সাথে। মেঘগুলো কখনো জিপের এক পাশের জানালা দিয়ে ঢুকছে। আর বের হচ্ছে অন্য পাশ দিয়ে। আপনি ছুটছেন প্রায় সাত হাজার ফুট উচ্চতার এক শহরের উদ্দেশে। বলছি দার্জিলিংয়ের কথা। হিমালয়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ছবির মতো সুন্দর স্বপ্নপুরী এই দার্জিলিং।
কিভাবে যাবেন?
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিভোর নগরী পাহাড়ে ঘেরা অপূর্ব চিরহরিৎ ভূমির দার্জিলিংয়ে স্থলপথে রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি দার্জিলিং যেতে চাইলে উত্তরবঙ্গের বুড়িমারি সীমান্ত অতিক্রম করে যাওয়াটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক। ঢাকার গাবতলী থেকে প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীবাহী বাস চলাচল করে উত্তরবঙ্গের বুড়িমারী সীমান্তের উদ্দেশে। মতিঝিল থেকে ভারতের শিলিগুঁড়ি পর্যন্ত যায় শ্যামলী পরিবহণের গাড়ি। ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস থেকে পাসপোর্টে নির্দিষ্ট সময়ের ভিসা নিয়ে রাত ১০টার সুপার সেলুন চেয়ার কোচে উঠে পড়–ন বুড়িমারী সীমান্তের উদ্দেশে। ভাড়া জনপ্রতি আর কত সামর্থের মধ্যেই। ভোর ৭টা নাগাদ আপনি অনায়াসে পৌঁছে যাবেন বুড়িমারী চেকপোস্টে। ইমিগ্রেশন অফিসের কাছেই সব বাস থামে। প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করে ইমিগ্রেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তির সাথে সম্পন্ন করে নিন ভ্রমণ কর ও কাস্টমসের সব প্রক্রিয়া। অবশ্য আপনি চাইলে ঢাকা থেকেই ভ্রমণ কর প্রদান করে যেতে পারেন সোনালী ব্যাংকের যে কোনো শাখায়। বুড়িমারী অতিক্রম করে ওপারে চ্যাংড়াবান্দা সীমান্তে পৌঁছে একইভাবে সম্পন্ন করে নিন আপনার ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের সব প্রক্রিয়া। ও ভালো কথা, আপনার বহনকৃত ইউএস ডলার চ্যাংড়াবান্দায় অবস্থিত সরকার অনুমোদিত ডিলারদের কাছ থেকেই ভারতীয় মুদ্রায় পরিবর্তন করে নেবেন। অন্যথায় পরবর্তী সময়ে টাকা ভাঙাতে আপনাকে বেশ বেগ পেতে হবে।
চ্যাংড়াবান্দা থেকে সরাসরি ময়নাগুড়র বাস ধরে দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন শীর্ষেন্দু-সমরেশের উপন্যাসখ্যাত শিলিগুড়ি জিপ স্টেশনে। ভাড়া জনপ্রতি ৭০ ভারতীয় রুপি। সেখান থেকে ঝটপট ১২০ ভারতীয় রুপির বিনিময়ে সংগ্রহ করে নিন দার্জিলিংগামী কমান্ডার জিপের টিকিট। হাতে শীতের পোশাক নিয়ে বসে পড়ুন আপনার নির্ধারিত আসনে। ব্যস, মাত্র আড়াই থেকে তিন ঘণ্টায় আপনি পৌঁছে যাবেন মেঘের দেশ স্বপ্নিল ভুবনের দার্জিলিংয়ে।
তাছাড়া কলকাতা থেকে যেতে চাইলে আপনাকে শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটের দার্জিলিং মেল ধরতে হবে। টিকিট সংগ্রহ করবেন ট্যুরিস্টদের জন্য নির্ধারিত কাউন্টার ফেয়ারলি প্যালেস থেকে। অতঃপর প্রায় ৫৭৬ কিলোমিটার অর্থাৎ ১৪ ঘণ্টার এক ট্রেন ভ্রমণ করে পরদিন সকাল ১০টা নাগাদ নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে যাবেন। স্টেশন থেকে প্রাতঃরাশ সম্পন্ন করে রিকশাযোগে চলে আসুন শিলিগুড়ি জিপ স্টেশনে। ১০-১২ রুপি ভাড়া পড়বে। সেখান থেকে ওই কমান্ডার জিপে চড়ে পৌঁছে যেতে পারেন স্বপ্নপুরী দার্জিলিংয়ে।
কোথায় থাকবেন?
পুঞ্জীভূত মেঘের কণা ভেদ করে আঁকাবাঁকা পথের ধারে পুরো দার্জিলিং শহরে রয়েছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হোটেলে প্রতিদিনের থাকা এবং খাওয়াসহ জনপ্রতি ভাড়া প্রায় ৮৫০-১২০০ রুপি করে। প্রায় প্রতিটি হোটেলেই রয়েছে দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুরে বেড়ানোর জন্য আকর্ষণীয় জিপ, সার্বক্ষণিক গরম পানির ব্যবস্থা, ঠাণ্ডা প্রতিরোধে ওষুধসহ যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো সমস্যার তাৎক্ষণিক সেবা।
খাবার-দাবার
ট্যুরিস্টদের জন্য হোটেলগুলোতে সব ধরনের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে পুষ্টিকর ও রুচিসম্মত খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অসংখ্য ট্যুরিস্টের আগমনের ফলে এখানকার হোটেল মালিকরা বাংলাদেশীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় একেবারে বাঙালি রুচিসম্মত খাবার-দাবারের জোগান দিয়ে থাকেন। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনার ছাড়াও হোটেল কর্তৃপক্ষ ভোরবেলায় বেড-টি এবং ডিনারের আগে ইভনিং-টি’র ব্যবস্থাও করে থাকেন।
কোথায় বেড়াবেন?
ছোট বড় মিলিয়ে বেড়ানোর জন্য প্রায় ১৭টি আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে দার্জিলিং জুড়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত রেলওয়ে স্টেশন ‘ঘুম’ ছাড়াও আরো যেসব দর্শনীয় স্থান দেখে আপনার আনন্দময় অভিজ্ঞতা অর্জিত হবে তা হচ্ছে;
সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে অপূর্ব সুন্দর সূর্যোদয় দেখা। পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনা-স্থান ঘুম মোনাস্ট্রি। ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ বাতাসিয়া লুপ। বিলুপ্ত-প্রায় পাহাড়ি বাঘ স্নো লুপার্ড খ্যাত দার্জিলিং চিড়িয়াখানা। পাহাড়ে অভিযান শিক্ষাকেন্দ্র ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট’। এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং-রক- এর স্মৃতিস্তম্ভ। কেবল কারে করে প্রায় ১৬ কিলোমিটার এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ভ্রমণ।
হ্যাপি ভ্যালি টি গার্ডেনে বসে তাৎণিকভাবে পৃথিবীখ্যাত ব্ল্যাক টি পানের অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থী কেন্দ্র তিব্বতিয়ান সেলফ হেলপ্ সেন্টার। সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮,০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত মনোরম খেলাধুলার স্থান দার্জিলিং গোরখা স্টেডিয়াম।
নেপালি জাতির স্বাক্ষর বহনকারী দার্জিলিং মিউজিয়াম। পৃথিবীর বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার জাপানিজ টেম্পল ব্রিটিশ আমলের সরকারি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র কাউন্সিল হাউস ‘লাল কুঠির’ অসাধারণ শৈল্পিক নিদর্শন খ্যাত ‘আভা আর্ট গ্যালারি’। শতবর্ষের প্রাচীন মন্দির ‘দিরদাহাম টেম্পল’।
এসব নিদর্শন ছাড়াও আপনার মনের চিরহরিৎ জগতকে শুধু আনন্দময় নয়, এক নতুন জীবনের যাত্রা শুরু করাতে চলে যেতে পারেন পাথর কেটে তৈরি ‘রক গার্ডেন’ এবং গঙ্গামায়া পার্কে উপরোল্লিখিত দর্শনীয় স্থানগুলো ছাড়াও আপনার হৃদয় গহিন থেকে রোমাঞ্চিত করবে মহান সৃষ্টিকর্তার বিশাল উপহার হিমালয় কন্যা ‘কাঞ্চন-জংঘা’, বিশুদ্ধ পানির অবিরাম ঝর্ণাধারা ‘ভিক্টোরিয়া ফলস্’ এবং মেঘের দেশে বসবাসরত এক সুসভ্য জাতির সংস্কৃতি।
কেনাকাটা
দার্জিলিং শহরের লাডেন-লা রোডের কোল ঘেঁষে রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় মার্কেট। দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য প্রায় সব জিনিসই আপনি পেয়ে যাবেন আপনার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। সবচেয়ে ভালো পাবেন শীতের পোশাক। হাতমোজা, কানটুপি, মাফলার, সোয়েটারসহ যে কোনো প্রকারের লেদার জ্যাকেট পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দমতো মূল্যে। তাছাড়া ১০০ থেকে ৫০০ রুপির মধ্যে পেয়ে যাবেন অসাধারণ কাজ করা নেপালি শাল এবং শাড়ি যা আপনার পছন্দ হতে বাধ্য। প্রিয়জনকে উপহার দিতে সর্বনিম্ন ২০ রুপি থেকে ২৫০ রুপির মধ্যে পেয়ে যাবেন বিভিন্ন অ্যান্টিক্স ও নানাবিধ গিফট আইটেম, যা আপনার প্রিয়জনের ভালোবাসা কেড়ে নিতে সক্ষম। তাছাড়া আকর্ষণীয় লেদার সু আর বাহারি সানগ্লাস তো আছেই। কেনাকাটা করতে গিয়ে প্রতারিত হওয়ার আশংকা একেবারেই নেই। তবে হোটেলগুলোতে কিছু নেপালি তরুণ-তরুণী ভ্রাম্যমাণ ফেরি করে শাল, শাড়ি বিক্রয় করে থাকে। তাদের কাছ থেকে না কেনাটাই উত্তম।
ঝুঁকি
মানুষের জীবনটাই একটা বড় ঝুঁকি। তার পরেও সাবধানতা অবলম্বন করে ঝুঁকি এড়িয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকার প্রয়াস পেয়েছে মানুষ দীর্ঘকাল। দার্জিলিং ভ্রমণেও ছোটখাটো কিছু ঝুঁকি রয়েছে। মাঝে-মাঝেই পাহাড়ি অঞ্চলে ছোটখাটো ধস নামে। তবে সেটা বেশি হয় বর্ষা মৌসুমে। শীত বা গরমে সে ঝুঁকিটা একেবারেই নেই। আর গরম জামাকাপড় ব্যবহারে অবহেলা না করলে ঠাণ্ডা লাগার ঝুঁকিটাও কমে যায় একেবারেই। তাছাড়া হোটেল কর্তৃপরে সঙ্গে সবরকম বিষয়ে পরামর্শ করে চলাফেরা করলে স্থানীয় দালাল বা হারিয়ে যাওয়ার আশংকা থেকেও আপনি পেয়ে যাবেন পুরোপুরি মুক্তি।
মোট খরচ
স্বল্প খরচে, অল্প আরামে মনটাকে মানিয়ে নিতে পারলে শীত মৌসুমে মাত্র ১৬,০০০ টাকার মধ্যেই আপনি সেরে নিতে পারেন স্বপ্নপুরী দার্জিলিং দেখার যাবতীয় কার্যক্রম। ভালো কথা, এ হিসাবটা শুধু বুড়িমারী সীমান্ত পথের। কলকাতার শিয়ালদহ হয়ে গেলে এ হিসাব বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ২০,০০০ টাকায়। আমাদের দেশে রয়েছে অসংখ্য ট্যুরিজম কোম্পানি, যারা দার্জিলিংসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্যাকেজ ট্যুরের আয়োজন করে থাকে।
আশপাশে
দার্জিলিং শহর থেকে কিছুটা দূরে নেপাল শহরের নিকটবর্তীতে অবস্থান করছে মিরিক লেক ও পশুপতি মার্কেট। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টার মধ্যে জনপ্রতি ৪৫০ রুপি ভাড়ার মধ্যে আকর্ষণীয় জিপে ঘুরে আসতে পারেন। সেজন্য অবশ্য আরো একটি দিন বেশি অতিবাহিত করতে হবে দার্জিলিং শহরে। তবুও যাত্রার দিন থেকে নিয়ে সর্বমোট পাঁচ দিনেই সবকিছু ঘুরে-ফিরে আসতে পারবেন আপনার প্রিয়জনদের মাঝে অপূর্ব স্বপ্নিল অভিজ্ঞতা নিয়ে।
By on  

ইন্দোনেশিয়ার বালি - অপরূপ সৌন্দর্যের দ্বীপ

পর্যটন শহর বালি দ্বীপের মানুষ পর্যটকদের স্বাগত জানাতে আন্তরিক। পর্যটন শিল্পকে প্রাধান্য দিয়েই শহরটি গড়ে উঠেছে। এই দ্বীপের যতটুকু দেখেছি, তাতেই অভিভূত হয়েছি। দ্বীপটিকে সুন্দর, পরিচ্ছন্ন রাখতে সবাই অত্যন্ত আন্তরিক। জনগণ রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের পাতা পর্যন্ত কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলেন। পর্যটকদের অগ্রাধিকার এখানে সব কিছুতে। বসবাসের হোটেল এলাকায় কোনো বাণিজ্যিক দোকান পর্যন্ত নেই। বালি দ্বীপ ভ্রমণের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত। পৃথিবীর বহু দেশ থেকে ভ্রমণপিপাসুরা আসেন বালি দ্বীপের প্রাকৃতিক রূপে নিজেদের সিক্ত করতে। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে করে আমরা প্রথমে পৌঁছলাম সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে। সেখানে বেশ কয়ক ঘণ্টা যাত্রাবিরতি ছিল। এয়ারপোর্টটি দারুণ জমকালো। তবে ক’ঘণ্টা ওখানে বসে থাকতেই আমরা বেশ বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। প্লেন পরিবর্তন করে ওই একই এয়ারওয়েজের আরেকটি ছোট প্লেনে চড়ে আমরা রওনা দিলাম বালির পথে। আমাদের প্লেন এগিয়ে চলেছে বালির দিকে আর প্লেনের জানালা দিয়ে নিচে তাকালে দেখা যাচ্ছে কেবল সমুদ্র আর সমুদ্র। বালির আয়তন ৫.৬৩২,৬ কিলোমিটার। বালি প্রদেশটি আটটি প্রশাসনিক জেলায় বিভক্ত। বালি দ্বীপটি আসলে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। বালিতে প্রধানত শুষ্ক ও আর্দ্র এই দু’টি মওসুম রয়েছে। তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে।
Pura Tanah Lot
বালি ইন্দোনেশিয়ার ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ক্ষুদ্রতম প্রদেশ, যার আয়তন মাত্র ৫ হাজার ৭৮০ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ৪২.২ লাখ। বালির রাজধানী হলো ডেনপাসার (উবহঢ়ধংধৎ)। বালির সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গা হলো সমুদ্রসৈকত। সমুদ্রসৈকতে স্পিডবোটে টেনে নেয়া প্যারাসুটে মানুষের আকাশে ওড়ার সুযোগ রয়েছে। সৈকত এলাকা খুবই পরিচ্ছন্ন। এর পাশাপাশি বালিতে রয়েছে কয়েক হাজার বছরের পুরনো হিন্দু মন্দির। তিন দশক আগেও বালি পুরোপুরি কৃষিনির্ভর ছিল। কিন্তু বর্তমানে বালির মোট অর্থনীতির ৮০ শতাংশ পর্যটন শিল্পের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং একে ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম ধনী প্রদেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মুসলিম বসবাসকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া হলেও বালির চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। বালিতে বসবাসকারীদের মধ্যে ৮৪.৫ শতাংশই হিন্দু এবং মন্দিরের আধিক্যের কারণে বালিকে বলা হয় দেবতাদের দ্বীপ, শান্তির দ্বীপ।
আমাদের প্লেন যখন বালি দ্বীপের এয়ারপোর্টের দিকে অবতরণের জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল যে, আমরা যেন সমুদ্রের মধ্যেই অবতরণ করতে যাচ্ছি। প্লেনের অনেক যাত্রী বেশ হইচই করে উঠল। কিন্তু প্লেনটি ঠিকঠাক মতোই সমুদ্রের কোল ঘেঁষা বিমানবন্দরে অবতরণ করল। ছোট্ট একটি বিমানবন্দর কিন্তু টুরিস্টদের জন্য রয়েছে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে এয়ারপোর্টের বাইরে আসার সাথে সাথে একটি বালিনিজ মেয়ে ফুল দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘ডবষপড়সব ঃড় ইধষর’। প্রত্যেক পর্যটককে বালিনিজরা এভাবেই স্বাগতম জানায়।
এর পরে একটি গাড়িতে করে আমরা পৌঁছে গেলাম হোটেল গ্র্যান্ড হায়াতে। হোটেলের রিসেপশনে সব ফরমালিটিজ শেষ করে আমরা আমাদের রুমে চলে যাই। রুমটি বেশ বড় আর ভীষণ সুন্দর করে সাজানো। সেদিন আমরা কেবল বিশ্রাম নিলাম। পরের দিন খুব সকালে উঠে ব্রেকফাস্টের জন্য হোটেলের ডাইনিং হলে গেলাম। আমি তো অবাক ব্রেকফাস্টের জন্য প্রায় পঞ্চাশ ধরনের খাবার দেখে। যা হোক খাওয়া শেষ করে আমরা হোটেলের একটি গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে আমরা গাইডের সহায়তায় বালি ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের যিনি গাইড ছিলেন তার পরনে ছিল বালির ঐতিহ্যবাহী লুঙ্গি আর ফতুয়া, মাথায় বালির বিশেষ টুপি। তার কাছ থেকে জানলাম বালির অধিবাসীদের প্রধান পেশা পর্যটন শিল্প। কোনো না কোনোভাবে তারা এই শিল্পের সাথে জড়িত। এই এলাকার মানুষের প্রথাগত জীবন ও বৈচিত্র্যময় বসবাস দেখানোর জন্য আমারা গেলাম বালির একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রামে। গ্রামে যাওয়ার পথের দু’ধারে ঠিক বাংলাদেশের মতো ফসলের ক্ষেত চোখে পড়ল। আমাদের গ্রামের যে বাড়িটিতে নিয়ে যাওয়া হলো সেটি ছিল একজন হস্তশিল্পীর বাড়ি। সেখানে দেখলাম বেশ কয়েকজন শিল্পী নানা ধরনের হস্তশিল্পের কাজ করছেন। বালি জগৎখ্যাত হস্তশিল্পের জন্য। দ্বীপবাসীর তৈরি কাঠের বা মেটালের বিভিন্ন ঘর সাজানোর দ্রব্যগুলো এক কথায় অসাধারণ। এ ছাড়াও পথে পথে স্যুভেনিয়র শপে বিক্রি হচ্ছে আকর্ষণীয় সব হস্তশিল্প। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে শিল্পীদের হাতে আঁকা তেল ও জল রঙের ছবি। আমি দু’টি ছবি খুব শখ করে কিনে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম। এখনো ছবি দু’টি আমার ঘরে অতি যতেœ শোভা পাচ্ছে। যা হোক বালির গ্রামে শিল্পীদের বাড়ি ভ্রমণ শেষে আমরা গেলাম বালির প্রথাগত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে। উপভোগ করি বালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা নৃত্যশিল্পীদের নাচ। ঠিক ইন্দোনেশিয়ার সিনেমায় যেমনটা দেখেছি তেমনই নাচ-গান নিজের চোখে দেখলাম। তারপর গাড়িতে আবার রওনা দিলাম। ইন্দোনেশিয়া মুসলমানপ্রধান দেশ হলেও বালি দ্বীপটি হিন্দুপ্রধান। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল একটি পুরনো সনাতনী মন্দির। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা এই মন্দিরে আসে পূজা করতে। মন্দিরে একটি অদ্ভুত বিষয় দেখলাম। প্রচুর বাদুড় রয়েছে মন্দিরে এবং সবাই তাদের বেশ আদর করে। ওই এলাকাটির নাম টেনগানান। সেদিনকার মতো বেড়ানো পালা শেষ করে আমরা হোটেলে ফিরলাম। সন্ধ্যার দিকে আশপাশের দোকানপাটে ঘুরতে গেলাম।
বালির সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ এলাকা কুটায় (কঁঃধ) অবস্থিত। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলের দূরত্ব সাড়ে ৩ কিলোমিটার। আমাদের ট্যাক্সি ভাড়া আসল ৮০ হাজার রুপিয়া। প্রতি ডলারের বিনিময়ে আমরা ১১ হাজার ২৫০ রুপিয়া পেয়েছিলাম। ইন্দোনেশিয়ায় সর্বোচ্চ এক লাখ রুপিয়ার নোট পাওয়া যায়। পরবর্তী তিন দিন এই লাখ লাখ রুপিয়ার হিসাব-নিকাশ করতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে।
বিকেল ৫টার দিকে সূর্যাস্ত দেখার উদ্দেশ্যে সমুদ্রসৈকতের দিকে পা বাড়ালাম। বালির বিশ্ববিখ্যাত কুটা সমুদ্রসৈকত না দেখলে বালি দেখাই বৃথা হবে। বালির কুটা সমুদ্রসৈকতের পানির রঙ গাঢ় নীল। দেখতে দেখতে মনে হলো কুটা সমুদ্র সৈকত সুন্দর হলেও আমাদের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য কোনো অংশেই এর চেয়ে কম নয়।
সাগরে নামার ব্যাপারটা সেই সময়ের জন্য স্থগিত রেখে সূর্যাস্তের পর আমরা কুটা শহর দেখার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। কুটার রাস্তা খুব বেশি প্রশস্ত নয় এবং রাস্তায় প্রচুর মোটরসাইকেল দেখতে পাওয়া যায়। এখানে আরেকটা মজার বিষয় হলো, চালকদের অনেকেই নারী।
বালিতে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ রুপিয়া হলে সারাদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। আমাদের যাত্রা শুরুর সাথে সাথে চোখে পড়ল রাস্তায় দু’ধারে বালিনিজদের অত্যন্ত দৃঢ় সংস্কৃতির ছাপ। বালিনিজরা ঐতিহ্যে খুব বিশ্বাসী। বাড়ির মূল ফটকে ওরা এমন স্থাপত্য শিল্প ব্যবহার করে যা দেখলে এক শ’ বছরের পুরনো মনে হয়। ফুল এবং বাঁশের ব্যবহার সর্বত্র চোখে পড়ার মতো। বাঁশকে নানাভাবে সাজিয়ে বিভিন্ন বাড়ি, মন্দির, দোকান ইত্যাদিতে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। রাস্তার দু’পাশে কাঠের, মাটির, পাথরের তৈরি অবাক করা বিভিন্ন কারুকাজখচিত শিল্প বারবার নজর কাড়ছিল। বালিতে তেমন কোনো সুউচ্চ ঘর-বাড়ি আমাদের চোখে পড়েনি।
শহরের কেন্দ্র ছাড়া অন্যান্য সব এলাকার প্রায় সব বাড়িঘরই ২-৩ তলার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমাদের গাড়ি ঝধৎর ফবরি নামে একটি সোনা-রুপার অলঙ্কার বানানোর কারখানা কাম শো-রুমে এসে থামল।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কুটা থেকে ৬৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বের একটি অঞ্চল যার নাম কিন্তামানি (করহঃধসধহর)। এটি একটি পাহাড়ি এলাকা এবং উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ৫০০ ফুট।
কিন্তামানি অঞ্চলের বাতুর (সড়ঁহঃ নধঃঁৎ) নামের জীবন্ত আগ্নেয়গিরি এবং সেই পাহাড় ঘেঁষা বাতুর হৃদ (ষধশব নধঃঁৎ) দেখতেই সেখানে গেলাম আমরা। গন্তব্যে পৌঁছেই আমার মনে হলো এত সুন্দর জায়গা হয়তো খুব কম আছে।
বাতুর পাহাড় ও হ্রদকে পেছনে ফেলে আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করল। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কুটা এবং কিন্তামানির মাঝামাঝি এলাকা ‘উবুদ’ (টনঁফ)। উবুদে আমাদের মূল দেখার বিষয় ছিল পাহাড়ের গায়ে জুম চাষের আকারের অপূর্ব সুন্দর ধানক্ষেত। পর্যটন বালির অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হলেও বেশিসংখ্যক মানুষ এখনো কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। বালির কৃষিকাজের বেশির ভাগ দখল করে আছে ধান চাষ। ধান চাষটা সুন্দরভাবে করায় এটাও একটা উল্লেখযোগ্য পর্যটক আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হবে যেন সৃষ্টিকর্তার নিজের হাতে সযতেœ আঁকা কোনো ছবি। ছবিসদৃশ সেই জায়গা থেকে অনেক ভালো লাগার অনুভূতি নিয়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে চললাম। তখনো সন্ধ্যা হতে কিছু সময় বাকি থাকায় হোটেলে ফেরার আগে বালির পূর্ব প্রান্তের অন্য একটি সমুদ্রসৈকতে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম।
কুটা থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে তানাহ লট (ঞধহধয খড়ঃ) নামের মন্দির। বালিতে পর্যটকদের দেখার যেসব স্থাপনা আছে তার বড় অংশজুড়ে আছে বিভিন্ন মন্দির। যেহেতু মন্দিরের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ কম তাই শুধু এই একটি মন্দিরকেই আমাদের তালিকায় রেখেছিলাম। এটি দেখতে যাওয়ার কারণ হচ্ছে এর অবস্থান। মন্দিরটি সাগরতীরে একটি বড় পাথরখণ্ডের ওপর অবস্থিত এবং জোয়ারের সময় মন্দিরটিকে একটি ছোট দ্বীপের মতোই দেখায়। প্রতিজনের জন্য ৩০ হাজার রুপিয়া দিয়ে টিকিট কেটে আমরা মন্দির এলাকায় প্রবেশ করলাম। মূল মন্দিরের ভেতরে ঢোকার অনুমতি না থাকলেও মন্দিরের স্তম্ভে¢র অর্থাৎ পাথরখণ্ডের একটি উচ্চতা পর্যন্ত ওঠা যায়। তবে পবিত্র পানি দিয়ে হাত, মুখ ধুয়ে কিছু রুপিয়া দান করার পরই সেটা সম্ভব।
পবিত্র পানি দিয়ে হাত ধোয়ার পর মন্দিরের সেবকেরা আমাদের কানে ফুল ও কপালে কয়েকটি চাল লাগিয়ে ওপরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
তানাহ লট থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণের উলুওয়াটু (টষঁধিঃঁ)। এটি বালির সর্বদক্ষিণের একটি এলাকা। আমাদের উদ্দেশ্য বিখ্যাত উলুওয়াটু সানসেট পয়েন্ট থেকে সূর্যাস্ত দেখা।
প্রতিজন ২০ হাজার রুপিয়া দিয়ে টিকিট কেটে উলুওয়াটু সানসেট পয়েন্ট এলাকায় প্রবেশ করলাম। এ এলাকায় বানরের উপদ্রব খুব বেশি। আমরা যখন ছবি তোলায় ব্যস্ত, তখন এক দুষ্টু বানর আমার সানগ্লাস কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করল। আমরা সূর্যাস্ত দেখার জন্য যেখানে এসে দাঁড়ালাম, সেটা সাগরের পাশেই অনেক উঁচু একটি পাহাড়। নিচে সাগরের পানি এসে পাথরে আছড়ে পড়ছে। ওপর থেকে নিচে তাকালে রীতিমতো ভয় লাগে। সাগর, পাহাড়, সবুজ বনানী এবং সূর্যাস্ত সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে।
উলুওয়াটুর এই জায়গাটি বালি সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্যবাহী নাচ কেকাক (কবপধশ) পরিবেশনার জন্য বিখ্যাত। সূর্যাস্তের পরপরই কেকাক এবং আগুননাচ শুরু হয়। আমরা এক লাখ রুপিয়া দিয়ে তিনটি টিকিট কেটে বালির এই ভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক নাচ উপভোগ করতে বসে গেলাম। এটি মুক্তমঞ্চে পরিবেশিত হয় এবং দর্শক গ্যালারিতে পর্যটকদের এত ভিড় যে সূচ ধারণের জায়গা নেই। কেকাকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ পরিবেশনায় কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় না।
এ সময় ৬০ জনের মতো বালিনিজ পুরুষ তাদের মুখ দিয়ে একই তালে আওয়াজ করতে থাকে। আর মঞ্চে মূলত সংলাপহীন সংক্ষিপ্ত রামায়ণ মঞ্চস্থ হয়। কেকাকের শুরুটায় একঘেয়েমি থাকলেও আস্তে আস্তে প্রাণ ফিরে এলো । এক সময় বেশ উপভোগ করলাম।
উলুওয়াটু থেকে জিমবারানের (ঔরসনধৎধহ) উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাদের এবারের উদ্দেশ্য রসনাবিলাস। সি-ফুড না খেয়ে বালি ত্যাগ করলে ভ্রমণটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যে। উলুওয়াটু থেকে কুটা আসার পথেই জিমবারান এলাকার অবস্থান এবং কুটা থেকে এর দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। সাগরতীরে সি-ফুড রেস্টুরেন্টের জন্য জিমবারান বিখ্যাত। এখানে খোলা আকাশের নিচে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
সাগরের গর্জন ও লাইভ মিউজিক শুনতে শুনতে সি-ফুড খাওয়ার মজা নেয়ার জন্য অবশ্য চড়া মূল্য দিতে হয়। ১০-১২ আইটেমের সি-ফুড খেয়ে আমাদের প্রায় ১০ লাখ রুপিয়া বিল দিতে হলো।
বালিতে কেনাকাটার জন্য কৃষ্ণা (কৎরংযহধ) নামে একটি সুপার শপে প্রবেশ করলাম। আমাদের ড্রাইভার মেডি আগেই জানিয়েছিল যে, এই সুপার শপ ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। এক দরের দোকান হওয়ায় অতিরিক্ত মূল্য দেয়ার ঝুঁকিও কম থাকে।
বালি দ্বীপটিতে পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য রয়েছে প্রচুর পাব, ডিসকো আর নাইট ক্লাব। এখানে আসা বেশির ভাগ পর্যটকই অস্ট্রেলিয়ার বলে মনে হলো। এ ছাড়াও অন্যান্য দেশের পর্যটকও নজরে পড়ল। রাতে আমরা ছোট একটি রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া করলাম। আমরা যখন খাচ্ছিলাম তখন হঠাৎই রেস্টুরেন্টটা কেঁপে উঠল। আমরা বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। ওখানকার লোকেরা বলল এই রকমের ছোটখাটো ভূমিকম্প প্রায়ই এ দ্বীপে হয়ে থাকে। রাতে হোটেল লাগোয়া সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে গেলাম। রুমে ফিরতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গেল। দ্বীপটি খুবই নিরাপদ। চুরি, ছিনতাই বা কোনো কিছু হারানোর ভয়ই নেই। পরের দিন সকালে আমরা সমুদ্রে নেমে পড়লাম। অনেক দেশের পর্যটকদের সাথে সমুদ্রে স্নান করার অভিজ্ঞতাটি দারুণ।
দুপুরের পর আমরা বেরিয়ে পড়লাম সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য। আমরা যেখানে পৌঁছলাম সেই জায়গাটি বালির শহর থেকে একটু দূরে। যাওয়ার পাহাড়ি পথে চোখে পড়ল পাহাড়ের ধাপে ধাপে ধানক্ষেত। যাই হোক সূর্য অস্ত দেখতে আমরা পৌঁছলাম সমুদ্রসৈকতে। আমার জীবনে এর আগে আমি কখনো এত সুন্দর প্রকৃতি দেখিনি। বিশাল সুনীল সমুদ্র, তার মাঝে একটা কালো পাথরকে কেটে বানানো হয়েছে বিখ্যাত তানাহ লট টেম্পল। সমুদ্রের হাঁটুজল ভেঙে সেই টেম্পলে আমরা গেলাম। ওপরে নীল আকাশটা ক্রমেই লালচে হয়ে যাচ্ছে আর সূর্যটা এক সময় চার দিককে আঁধার করে ডুবে গেল সমুদ্রের বিশালতায়। আমার মনে হয়েছিল বালি না এলে আমি বঞ্চিত থাকতাম প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্য থেকে। পরের দিন আমরা দেখতে গেলাম কিনতামানি বাতুর ভলকেনো। ইন্দোনেশিয়ার এই দ্বীপে আগে একবার এই অগ্নিগিরি থেকে অগ্নি উৎপাত হয়ে বহু মানুষ আর গ্রাম ধ্বংস হয়েছে। এখন এই আগ্নেয়গিরিটি শান্ত। আমরা পাহাড়ি পথ ধরে গেলাম আগ্নেয়গিরিটি দেখতে। বেশ দূর থেকে গিরিটি দেখলাম। দেখতে দেখতে মনে হলো এই শান্ত সুবিশাল পাহাড়ের মুখ থেকে বের হওয়া লাভা কত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে অথচ এখন এটি কত শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
বালিতে বাংলাদেশ থেকে আসা পর্যটকের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এমনকি কাজ করতে আসা কোনো বাংলাদেশীও আমি দেখতে পাইনি। এয়ারপোর্ট আনুষ্ঠানিকতার শেষ মুহূর্তে এসে জানতে পারলাম যে, প্রত্যেক পর্যটককে ভ্রমণ শেষে এক লাখ ৫০ হাজার রুপিয়া ট্যাক্স দিতে হয়। এটি ডলারেও পরিশোধ করা যাবে। বেলা সাড়ে ১২টায় আমাদের বিমান চলতে শুরু করল। সাগরকে দু’ভাগ করা রানওয়ে ধরে আমাদের বিমানের গতি বাড়তে থাকল। মনে মনে বললাম ‘বিদায় বালি’। বালির অনন্যসুন্দর মুহূর্তগুলোর
জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ।
-নাজমুল হোসেন, By on

পর্যটনে কয়েকটি সেরা শহর

পাতায়া
সমুদ্রতীরের ছিমছাম শহর পাতায়া ব্যাংকক থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে। মূলত রাতের অাঁধারে জেগে ওঠা যে কয়টি শহর রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম এটি। রাতের গভীরতা যত বাড়ে, আলোর ঝলকানিও সেই সঙ্গে পাল্লা দেয়। তালে তালে চলে সংগীতের মূর্ছনা। পর্যটকের ভিড় ঠেলা দায়। নাইট ক্লাব, রেস্তোরাঁ, সমুদ্রের তীর_ সবকিছু একাকার। এককথায় অন্য এক জগৎ। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে পাতায়া। বাসে দু-তিন ঘণ্টায় পৌঁছে যেতে পারবেন। দেড়শ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে সোয়াশ’ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলবে বাস। সমুদ্রতীরের এই ছিমছাম শহরটি যেন বিনোদনের স্বর্গরাজ্য। ডিস্কো, পাব, গোগো ক্লাবগুলো সমুদ্র তীরজুড়ে সাজানো। আমাদের কঙ্বাজারের মতো বিশাল ঢেউ না থাকলেও বড় মোহনীয়। মনে হয় তীর দিয়ে শুধু হেঁটে বেড়াই। সমুদ্রের ভিতরে আছে বিশাল বিশাল নৌযান। সেগুলোর একেকটি যেন ছোট্ট শহর।
পাতায়া থেকে সমুদ্রের ভিতরে তাকালেই দেখা যায় অসংখ্য কোরাল দ্বীপ। সেগুলোও দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজানো। সবুজের সমারোহের চারপাশে নীল জল। পাতায়া থেকে লাইট জাহাজযোগে যেতে পারেন তেমনই একটি দ্বীপ ‘কোলহার্ন’-এ। চারদিকে অসীম জলরাশির মধ্য দিয়ে ছুটে চলার রোমান্সই আলাদা। ‘কোলহার্ন’-এ কেউ কারও দিকে ফিরেও তাকায় না। কেউবা এরই মধ্যে সেরে নিচ্ছে সমুদ্রস্নান। সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসা যায় পাতায়ায়। পাতায়ায় রয়েছে অসংখ্য হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টহাউস। খাবার হোটেল নিয়েও ভাবতে হবে না। বেশ কয়েকটি বাংলা-ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। টাকিভর্তা থেকে শুরু করে নানা স্বাদের সামুদ্রিক মাছও পাওয়া যায়। আবাসিক হোটেলগুলোতে ভাড়া খুবই কম। পরিচ্ছন্ন ও ছিমছাম শহরে কটা দিন কিভাবে কেটে যাবে টেরই পাবেন না। এ ছাড়া ব্যাংকক থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি থিমপার্ক। বাঘ-সিংহ থেকে শুরু করে জিরাফ, গণ্ডার, ময়ূর, হরিণ, ভাল্লুকসহ হরেক জীবজন্তু আর পাখপাখালির যেন মেলা বসে সেখানে। ০০৭খ্যাত জেমস বন্ড সিরিজের চলচ্চিত্রের জীবন্ত প্রদর্শনী দেখা যাবে সাফারি ওয়ার্ল্ডে। সরাসরি আয়োজিত ৪৫ মিনিটের এই শো হলিউড সিনেমার নানা অ্যাকশন দৃশ্যে ভরপুর। বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের ভস্মীভূত হওয়ার দৃশ্য, আগুনে পুড়ে মানুষের কঙ্কাল হয়ে যাওয়া, সাগরের ভেতর দিয়ে দ্রুতগতিতে স্পিডবোটে হিরোইনের চলে আসা_ এ রকম অনেক আকর্ষণীয় বিষয় দিয়ে সাজানো হয়েছে সাফারি ওয়ার্ল্ড। তাই তো পাতায়াকে বলা হয় বিনোদনের স্বর্গরাজ্য।

বালি
ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম পর্যটন শহর বালি। মূলত বালি দ্বীপকে কেন্দ্র করেই এই শহরের সৃষ্টি। বালি হলো ইন্দোনেশিয়ার ৩৩তম প্রদেশ। প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অবকাশ যাপনের জন্য এই শহরে আসেন। বালির অপরূপ সৌন্দর্য মানুষকে বিমোহিত করে। তাই তো মানুষ প্রাণের টানে বারবার এখানে ফিরে আসে। এ শহর পর্যটকদের হৃদয়ের রানী বনে গেছে। আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকায় পর্যটকদের ভিড় সবসময় লেগে থাকে। এ শহরের প্রধান আকর্ষণ হলো বালি দ্বীপ এবং এর সৌন্দর্য। আয়তন প্রায় ২২ হাজার বর্গমাইল আর লোকসংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। এ দ্বীপের পূর্ব ও পশ্চিম অংশ পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। এটি মূলত হিন্দুপ্রধান প্রদেশ। হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ৯০ ভাগ। বাকিরা মুসলিম, খ্রিস্টান ও অন্য ধর্মের।
বালিতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, পাঁচতারকা হোটেল, মোটেল, ক্যাসিনো, বারসহ সবকিছু রয়েছে। তাই যে কোনো ধরনের পর্যটক এ দ্বীপ সফর করতে পারে। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক ভালো। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে বালি আবিষ্কৃত হয়। বালি মূলত ইন্ডিয়ান ও চাইনিজ কালচারে গড়ে উঠেছে। বালিকে আটটি রিজেন্সিতে ভাগ করা হয়েছে। বালিতে শহর বা সিটি আছে মাত্র একটি আর তা হলো ডেনপাসার, যা এ প্রদেশের রাজধানী। অন্য রিজেন্সি হলো জেমবারানা, টাবানা, বেডুং, জিয়ানইয়ান, কুলাংকুন, বানলি, কারানগাছেম, বুলেলেং ও ডেনপাসার। এখানকার অর্থনীতি পর্যটকের ওপর নির্ভরশীল। পর্যটক থেকেই আসে প্রায় ৮০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা। বালির প্রধান পর্যটন কেন্দ্র হলো কুতা সমুদ্রসৈকত। এখানেই প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ বেড়াতে আসে।

সিঙ্গাপুর সিটি
বিশ্বের যে কয়েকটি শহর পর্যটনশিল্পের ওপর নির্ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে সিঙ্গাপুর সিটি অন্যতম। প্রতিবছর কয়েক মিলিয়ন পর্যটক সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেন। এখানে দেখার মতো যেসব পয়েন্ট বা স্থাপনা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে নাইট সাফারি, মারলাওন পার্ক, সান্তোসা আইল্যান্ড অন্যতম। নাইট সাফারিতে গভীর রাতে জঙ্গলের ভিতরের নানান পশুপাখিদের মাঝ দিয়ে ট্রামে করে পর্যটকরা বিচরণ করেন। বাঘ, হরিণ, ভাল্লুক, হাতি, উট, কুমির এ সাফারির প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। এ সাফারিতে পশুপাখিরা উন্মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়। মারলিন বা সিংহ-মৎস্য হচ্ছে সিঙ্গাপুরীদের গর্বের প্রতীক, বীরত্বের প্রতীক। কথিত আছে বহু আগে সিঙ্গাপুর যখন তেমাসেক বা সমুদ্রনগরী নামে পরিচিত ছিল তখন প্রচণ্ড এক সামুদ্রিক ঝড় ওঠে দ্বীপে। অধিবাসীরা যখন নিজেদের সঁপে দেয় ঈশ্বরের হাতে ঠিক তখনই সমুদ্র থেকে সিংহ-মৎস্য আকৃতির এক জন্তু এসে ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঁচিয়ে দেয় অধিবাসীদের। আর সে থেকে মারলিন নামের সিংহ-মৎস্য সিঙ্গাপুরীদের গর্ব আর বীরত্বের প্রতীক। মারলিনের মূর্তি ম্যারিনা বে-এর মারলাওন পার্কে অবস্থিত। আর সান্তোসা আইল্যান্ড হলো সমুদ্রের মাঝে ছোট এক দ্বীপে গড়ে তোলা বিনোদন কেন্দ্র।

প্যারিস
শিল্প ও সাহিত্যের শহর প্যারিস। শহরের মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আইফেল টাওয়ার। মূলত এই টাওয়ারকে কেন্দ্র করেই পর্যটন ব্যবসা ঘুরপাক খাচ্ছে এ শহরের। এ ছাড়া দেখার মতো এই শহরে প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক সভ্যতার অনেক স্থাপনা রয়েছে। বিশেষ করে মধুচন্দ্রিমা উদযাপনের জন্য নবদম্পতিদের কাছে পছন্দের তালিকায় এ শহরের অবস্থান শীর্ষে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে আইফেল টাওয়ার। বিশ্বের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র এটি। আইফেল টাওয়ারটি স্থাপনা নির্মাণের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনাই বটে। ১৮৮৭ সালে ফ্রান্স সরকার যখন ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকী পালনের তোড়জোড় করছিল তখন সে ঘটনাটিকে স্মরণীয় এক নিদর্শনে ধরে রাখার জন্যই এই প্রতীক মিনারটি তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল তারা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৮৮৯ সালের ৩১ মার্চে মাত্র দুই বছর, দুই মাস, দুই দিনে টাওয়ারটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল। এত উঁচু আর এমন আকৃতির টাওয়ার বানাতে খুবই কম শ্রম ব্যয় করা হয়েছে। টাওয়ারটিতে আছে অর্ধবৃত্তাকার চারটি তোরণ। ওঠানামার জন্য আছে কয়েকটি লিফট। সাত হাজার টন ওজনের এ স্থাপনাটিতে সিঁড়ি আছে এক হাজার ৭৯২টি।

 কাঠমান্ডু
কাঠমান্ডু শহর প্রকৃতপক্ষে তিনটি শহর নিয়ে গড়ে উঠেছে। কাঠমান্ডু, ভক্তপুর ও পাটন বা ললিতপুর। ললিতপুর হলো নেপালের প্রাচীন রাজবংশের আবাসস্থল। ১২০০ শতকের রাজপ্রাসাদ ও অভিজাতদের প্রাসাদসহ পুরো এলাকাটি পর্যটকদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। এখানে কোনো আধুনিক স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ। কাঠমান্ডুতে দেখার মতো যে কটি মন্দির রয়েছে তার মধ্যে বুদ্ধনাথ বা বোধনাথ মন্দির অন্যতম। এটি কাঠমান্ডুর অন্যতম পবিত্র জায়গা। ধবধবে সাদা মূল মন্দিরটি ঘিরে অসংখ্য উপাসনালয় এবং দোকান রয়েছে। চারদিকে পায়রা দিয়ে ভরা। একসঙ্গে দল বেঁধে উড়ে বেড়ায় এবং দর্শনার্থীরা খাবার দিলে মারামারি করে খায়। অন্যদিকে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য রয়েছে বালাজি ওয়াটার গার্ডেন। রয়েছে সাউথ এশিয়ার অন্যতম বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দির শম্ভুনাথ স্তূপাতে। এটা মাংকি টেম্পল নামেও সুপরিচিত। অন্যদিকে নগরকোটের রিসোর্টে সবাই যায় শুধু সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয় দেখতে।


স্পেনস সিয়েস
স্পেনের সিয়েস দ্বীপপুঞ্জের সমাহারকে বলা হয় লাস আইসল্যান্ড সিয়েস। বিশ্বের সেরা পর্যটনকেন্দ্রের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে এই দ্বীপপুঞ্জ বা ছোট্ট এই শহর। বিনোদন, প্রমোদ ও অবকাশের সবকিছুই রয়েছে এখানে। আনন্দ উল্লাস করতে করতে কখন যে সময় দিন পার হয়ে যাবে তা টেরই পাওয়া যাবে না। স্থানীয় ভাষায় এ দ্বীপপুঞ্জকে ‘লাস আইসল্যান্ড সিয়েস’ বলা হয়। স্পেনের উত্তর-পশ্চিমে গ্যালিসিয়ায় এ দ্বীপপুঞ্জে তিনটি দ্বীপ আছে- মন্টেগিউদো, দো ফারো ও সান মার্টিনো। মন্টেগিউদোকে শার্প মাউন্ট কিংবা উত্তর দ্বীপও বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে দো ফারোকে লাইটহাউস দ্বীপ ও দক্ষিণ দ্বীপ নামেও ডাকা হয়। মন্টেগিউদো সৈকতকে ‘মোস্ট বিউটিফুল বিচ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নাম দেওয়া হয়েছিল। প্রায় ২০০ বছর আগে এসব দ্বীপে মানুষ বসবাস করত। কিন্তু কোনো একসময় দ্বীপগুলো জলদস্যুর আক্রমণে মানবশূন্য হয়ে যায়। এরপর ১৯৮০ সালে এ দ্বীপপুঞ্জ বসতিবিহীন ন্যাশনাল পার্ক নামে সংরক্ষিত প্রকৃতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সারা বছরই এখানে ঢল নামে পর্যটকের। তবে গ্রীষ্মকালে সবচেয়ে বেশি ভিড় পরিলক্ষিত হয়। ফিরোজা রঙের স্ফটিক স্বচ্ছ পানি আর ধবধবে সাদা বালুকারাশি যে কাউকে টেনে আনে এ সৈকতে। তবে ১৯৯২ সাল থেকে এ সৈকতে মাছ এবং ১৯৮৮ সাল থেকে পাখি শিকার নিষিদ্ধ করা হয়। প্রাকৃতিক এ সৈকতে প্রকৃতিগতভাবেই বেড়ে উঠেছে ঝোপঝাড়। কাঁটাওয়ালা চিরহরিৎ গুল্ম, খাড়া ডালওয়ালা গুল্মসহ বিভিন্ন লতাপাতায় ঢাকা ঝোপঝাড় এ সৈকতের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আছে ওক, ডুমুর, পাইন ও ইউক্যালিপটাস। প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক এখানে আসেন অবকাশ কাটাতে। এদের বেশির ভাগই গ্রিস, ফ্রান্স ও ইতালির। করপোরেট হাউসের বার্ষিক সভাও অনুষ্ঠিত হয় এখানে।

আগ্রা
যে কয়টি স্থাপত্যের ওপর ভারতের পর্যটনশিল্প দাঁড়িয়ে, সেগুলোর মধ্যে তাজমহল অন্যতম। আর এই তাজমহলকে ঘিরে জমজমাট হয়ে থাকে আগ্রা শহরটি। তাজমহল ছাড়া প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সভ্যতার অনেক নিদর্শন রয়েছে এই শহরে। তারপরও সবার দৃষ্টি থাকে সম্রাট শাহজাহানের তৈরি এ স্থাপত্যের দিকে। কেউ কেউ তাজমহলকে ভারতের পর্যটন শিল্পের মেরুদণ্ডও বলে থাকেন। ভারতে ঘুরতে এলে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে প্রথম পছন্দ থাকে তাজমহল। বিশেষ করে নতুন বিবাহিতদের কাছে সৌধটির আকর্ষণ অন্যরকম। এ কারণে আগ্রার সঙ্গে দেশের সব শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটানো হয়েছে। এ ছাড়া দিল্লি থেকে সড়কপথের দূরত্ব খুব একটা বেশি না হওয়ায় বাইরের পর্যটকরা আগ্রায় ভিড় করেন বেশি। অন্যদিকে তাজমহলের কাছাকাছি এলাকায় মোগল স্থাপত্য ও দুর্গ রয়েছে। রয়েছে সম্রাট আকবরের বিলাসবহুল দুর্গ। মোগল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি মমতাজ নামে পরিচিত, তার স্মৃতির উদ্দেশে এ অপূর্ব তাজমহল নির্মাণ করেন। সৌধটি নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে যার কাজ সম্পন্ন হয় প্রায় ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে। তাজমহল ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এটি তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নকশার ওপর, বিশেষ করে পারস্য ও মোগল স্থাপত্য অনুসারে। তাজমহল ঘুরতে গেলে যে বিষয়টি মনে রাখা জরুরি তা হলো- দেশীয় পর্যটক ও বিদেশি পর্যটকদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রবেশ মূল্য রাখা আছে। এ ছাড়া আগ্রার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা, যা মোগল সম্রাটদের স্থাপত্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

কক্সবাজার
কক্সবাজার। এ শহর সম্পর্কে আর নতুন করে কিছু বলার নেই। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের জন্য এর পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। কক্সবাজার নামটি এসেছে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স নামে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির এক অফিসারের নাম থেকে। কক্সবাজারের আগের নাম ছিল পালংকি। এ শহর তার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। প্রতিবছর দেশ-বিদেশের লাখ লাখ পর্যটক এ শহরে আসেন। দেখার মতো এই শহরে রয়েছে বৌদ্ধমন্দির, ইনানি বিচ, হিমছড়ি, সাফারি পার্ক ইত্যাদি। কক্সবাজার শহর থেকে নৈকট্যের কারণে লাবণী বিচ কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্রসৈকত বলে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া হিমছড়ি কক্সবাজারের ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। ভঙ্গুর পাহাড় আর ঝরনা এখানকার প্রধান আকর্ষণ। তবে পর্যটকদের কাছে সমুদ্রসৈকতের আকর্ষণ শীর্ষে। সৈকতটি কক্সবাজার শহর থেকে বদরমোকাম পর্যন্ত একটানা বিস্তৃত। পর্যটনশিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত অনেক হোটেল, বাংলাদেশ পর্যটন কেন্দ্র নির্মিত মোটেল ছাড়াও সৈকতের নিকটেই রয়েছে পাঁচতারা হোটেল।

অপরূপ সৌন্দর্য প্যারিস শহর

ফ্রান্সের প্যারিস শহরটা শুধু দেখার জন্য নয়, অনুভবের জন্য নয়। রাত যত গভীর হতে থাকে, প্যারিস তত জেগে উঠতে থাকে। নিশি সুন্দরী প্যারিসের রূপদর্শনে দলে দলে বেরিয়ে পড়েন পর্যটকরা। দিনের চেয়ে রাতের প্যারিস অনেক সৌন্দর্যমন্ডিত।
সন্ধ্যা হলেই নাইট ক্লাব, পাব, বার থেকে আইফেল টাওয়ার পর্যন্ত আলোর ঝলকানির শুরু হয়। বাঙালিরাই এক প্যারিস বলে। কিন্তু ইউরোপে শহরটির নাম পারি। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, ল্যুভর মিউজিয়াম, মেট্রো লাইন, রেস্তোরাঁ, ফ্যাশন- সব কিছুতেই অনন্য এক আর্টিস্টিক, ক্রিয়েটিভ, রোমান্টিক মনের ছাপ পাওয়া যায়।
১৮০০ শতকে শিক্ষা ও জ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এবং রাস্তায় বৈদ্যুতিক বাতি লাগানোর ক্ষেত্রে পৃথিবীর প্রথম শহর হওয়ায় প্যারিসকে বলা হয় ‘সিটি অফ লাইট। যার মানে দাঁড়ায় আলোর শহর।
ফরাসিরা শিল্প-সংস্কৃতির মহান পৃষ্ঠপোষক কবিতা ভালোবাসে, একটু ভাবুক, খামখেয়ালিও বটে। ইউরোপের সবচেয়ে বেশি মাল্টিকালচারাল শহর এটি। বহু দিন যাবৎ প্যারিসে বসবাস করে এশিয়া, আফ্রিকা ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ থেকে লোকজন। তাদের মধ্যে জাতিগত এক সুষম সংমিশ্রণ চোখে পড়ে। এশিয়া মহাদেশের লোকজনের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
প্যারিসের আইফেল টাওয়ার পৃথিবীর বিখ্যাত কাঠামোর একটি এবং ফ্রান্সের অন্যতম একটি প্রতীক। ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার গুস্তাভো আইফেলের নির্মিত ৩০০ মিটার (৯৮৬ ফুট) উচ্চতার এইটাওয়ার। ১৯৩০ সালে নিউইয়র্কে ‘ক্রাইসলার বিল্ডিং’টির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত আইফেল টাওয়ারই ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থাপনা। আইফেল, রেলের জন্য সেতু ডিজাইন করতেন- টাওয়ারটি নির্মাণে তিনি সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছিলেন। তার নামানুসারেই মিনারটির নাম রাখা হয়েছিল ‘আইফেল টাওয়ার’।
জানা গেছে, ১৮ হাজার ৩৮টি লোহার বিভিন্ন আকৃতির ছোট ছোট কাঠামো জোড়া লাগিয়ে এ টাওয়ার তৈরি করতে ৩০০ কর্মী কাজ করেছিলেন। ১৮৮৯ সালের ৩১ মার্চে মাত্র ২ বছর, ২ মাস, ২ দিনে টাওয়ারটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল। ১৯০৯ সালে এর চূড়ায়ে বসানো হয় একটি বেতার অ্যান্টেনা। ফলে এর উচ্চতা বেড়ে হয় ২০.৭৫ মিটার। সেই থেকে আইফেল টাওয়ারকে বেতার তরঙ্গ প্রেরণের জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে।
পরে আইফেল টাওয়ারে একটি টিভি অ্যান্টেনাও সংযোজন করা হয়েছে। চলতি বছর প্যারিসের আইফেল টাওয়ার পার ১২৭ বছর অতিক্রম করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আইফেল টাওয়ারের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এবং টাওয়ারই ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস নগরীর বিশেষ মর্যাদা এনে দিয়েছে।
আরো জানা যায়, প্রায় ১৪টি মেট্রো লাইনে ৩৮০টি মেট্রো স্টেশন নিয়ে প্যারিসের মেট্রো ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাবওয়ে। এটি ১০০ বছরের পুরনো। প্যারিসে বসবাসরত লোকজনের যাতায়াতের জন্য এ মেট্রো লাইনের বিকল্প নেই। এ ছাড়া যাতায়াতের জন্য রয়েছে ট্রাম, আরিয়ার ও এসএনসিএফ।
প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়াম পৃথিবীর বৃহত্তম আর্ট মিউজিয়াম। এর বিশালত্ব, দেয়ালের অলঙ্করণ, অমূল্য স্থাপত্য, ভাস্কর্য, পেন্টিংয়ের সম্ভার যে কোনো মানুষকে অবাক করবে। মিউজিয়ামের ভেতর ম্যাপ নিয়ে প্ল্যানিং করেই সবাই চলাচল করে। মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখতে তিন দিন সময় লাগে।
এ মিউজিয়ামে একটি বড় হলঘরের মাঝে বুলেট প্রুফ কাচের মধ্যে মোহিনী হাসি হাসছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ঐতিহাসিক ছবি ‘মোনালিসা’। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে এ মিউজিয়াম।
শরীয়তপুর প্রতিনিধি: ঢাকা, অক্টোবর ২৩(বিডিলাইভ২৪)

যে পাঁচ কারণে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করবেন

আসছে ঈদ। ঈদের ছুটিতে পরিবার-প্রিয়জন নিয়ে ‍অনেকে যেমন দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে প্রমোদ ভ্রমণে বের হবেন, অনেকে তেমনি বের হবেন বিদেশি মনোমুগ্ধকর পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণে। বিদেশ ভ্রমণেচ্ছুদের পছন্দের তালিকায় থাকতে পারে এশিয়ার থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার বালি, নেপাল, ভুটান এবং মালয়েশিয়া। তবে, বিশেষ পাঁচটি কারণে প্রমোদ ভ্রমণেচ্ছুদের মালয়েশিয়ার দিকে খানিকটা বেশি আগ্রহ দেখাতে হবে।

ঈদকে সামনে রেখে অপরূপ সাজ নেওয়া মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে দূরত্ব মাত্র পাঁচ ঘণ্টা। কম সময়ের মধ্যে কম খরচে ঘুরে বেড়ানোর জন্য মালয়েশিয়া যে পাঁচটি কারণে সবাইকে কাছে টানবে তা জেনে নেওয়া যাক।

*এশিয়ায় একখণ্ড ইউরোপ
ইউরোপের দেশগুলোর মতোই মালয়েশিয়ার সবকিছু বেশ সাজানো-গোছানো। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনেক উন্নত। সড়কপথ, রেলপথ, জলপথ ও আকাশপথ বেশ কার্যকর এবং আরামদায়ক। সাজানো-গোছানো দেশটিতে ভ্রমণে  যোগাযোগ সুবিধা প্রত্যাশা অনুযায়ী হওয়ায় প্রতি বছর বিভিন্ন দেশের হাজারো পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন সানন্দে। প্রধান ভাষা মালয় হলেও কম বেশি সবাই ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। তাই যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষাগত দিক থেকেও তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না এখানে।

*তিন জাতির মিলনমেলা
মালয়েশিয়ায় প্রধান জাতি মালয় হলেও আরও দু’টির প্রধান জাতির বাস এখানে; চীনা ও ভারতীয়। মালয়েশিয়া এমন একটি দেশ যেখানে অন্তত তিনটি ভাষায় কথা বলা যায়। মালয়, ইংরেজি এবং স্ব স্ব জাতির ভাষা; চীনা হলে মান্দারিন, ভারতীয় হলে তামিল বা হিন্দি। এছাড়া, সবগুলো জাতিই নিজেদের সাংস্কৃতিক উৎসব সমান গুরুত্ব সহকারে উদযাপন করে। তিনটি প্রধান জাতির মিলনমেলার এ দেশে সবসময়ই কোনো না কোনো উৎসব লেগেই থাকে। উৎসবপ্রিয়দের জন্য মালয়েশিয়ার চেয়ে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু আর কী হতে পারে?

*কম খরচে ভ্রমণ
অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে অনেক কম খরচে ভ্রমণ এবং কেনাকাটা করা যায় মালয়েশিয়ায়। এদেশের এক মুদ্রার (রিংগিত) মান বাংলাদেশি ২৪ টাকা। এখানে এক স্থান থেকে অপরস্থানে যাতায়াতের খরচ অনেক কম। শহরে ট্রেনে অথবা বাসে খরচ ১-৩ রিংগিতের মত। প্রতি বেলা খাবারে রিংগিত খরচা করতে হয় ৫-১০। এছাড়া, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে তুলনা করলে অনেক কম খরচে বেশ ভালো সার্ভিস পাওয়া যায় মালয়েশিয়ায়। 

*পুরো মালয়েশিয়াই যেন পর্যটনকেন্দ্র
মালয়েশিয়ায় ভ্রমণের জন্য রয়েছে প্রচুর স্পট। কুয়ালালামপুর, পেনাং, লংকাউই দ্বীপ, তিওমান দ্বীপ, পেরহেন্তিয়ান দীপ, ইপো, সেলাঙ্গর, মেলাকা, পেরাক ইত্যাদি এখানকার প্রধানতম দর্শনীয় স্থান। শুধু ভ্রমণই নয়, প্রতিটি স্পটেই রয়েছে উপভোগের নানা আয়োজন। এর মধ্যে-ডাইভিং, ট্র্যাকিং, ক্যাম্পিং, রাফটিং সহ অনেক অ্যাডভেঞ্চার রাইডে চড়ে ভ্রমণকে বেশ উপভোগ্য করা যেতে যেতে পারে। 

*বাহারি সব খাবারের সমাহার এবং কেনাকাটার মহাআয়োজন 
মালয়েশিয়ায় মানুষ বেশ খাবার প্রিয়। স্থানীয়দের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটকদের রসনাবিলাসের জন্য প্রায় প্রতিটি দেশের খাবার আয়োজন রয়েছে এখানে। এর মধ্যে ভারতীয়, চীনা, মালয়, থাই, আরবি, ইরানি, কোরিয়ান, জাপানিজ ও ইউরোপীয় খাবারের স্বাদ জিহ্বাকে আরও বেশি প্রলুব্ধ করবে। আর কুয়ালালামপুরকে বলা হয় চতুর্থ বৃহৎ শপিং শহর। আকর্ষণীয় সব স্থানে জমজমাট শপিং মল গড়ে উঠেছে। এছাড়া, নাইট মার্কেট তো রয়েছেই।

এ কথা বলাই বাহুল্য যে, সারাবছর পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও ঈদকে কেন্দ্র করে এখন অপরূপ সাজে ভ্রমণপ্রিয়দের টানছে সমুদ্রবুকের মালয়েশিয়া।
By on

বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০১৪

ড্রাগন জাতির দেশে

মোল্লা বাড়ির বৌ বললেন তিনি সফরে যেতে চান। যে সে সফর না, বিদেশ সফর। বিদেশ যাবার নাম শুনলেই আমার হৃদকম্প শুরু হয়। ভিসার জন্য নানা ঝামেলা, ছূটোছুটি, সময় নষ্ট। সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা থাকলে দূতাবাসের কেরানির শীতল অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দেখে নিজেকে বিন লাদেনের অনুগত অবৈধ অভিবাসন সন্ধানী বলে মনে হয়। কিন্তু বিবির আবদার বলে কথা, আমি লাচার। বললাম, তথাস্তু, তবে এমন দেশে যাব যেখানে ভিসা লাগে না। কাছে-পিঠে এমন দুটো দেশ আছে, নেপাল ও ভুটান। নেপাল আগেই ঘোরা হয়েছে, তাই ভুটান যাওয়াই সাব্যস্ত হল। ভুটানের বিমানবন্দরে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে হাজির হলেই ওরা ঢুকার অনুমতি দিয়ে দেয়। ভারত ও মালদ্বীপ ছাড়া অন্য সব দেশের নাগরিককে আগে থেকেই ভিসার ব্যবস্থা করে রাখতে হয়। পৃথিবীতে বোধ হয় ভুটানই একমাত্র দেশ যেখানে ঢুকতে বাংলাদেশী নাগরিকদের উন্নত দেশের নাগরিকদের তুলনায় ভিসার ঝামেলা কম হয়।

ঢাকা থেকে ভুটানের ড্রুক এয়ারে চেপে ভুটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পারো পর্যন্ত যাওয়া যায়। চারদিকে পাহাড়, মাঝখানে এক চিলতে রানওয়ে। পাহাড়গুলো সবই বিধ্বস্ত র‍্যাংস ভবন থেকে অনেক উঁচু। বিমান চালকদের দক্ষতার তারিফ করতে করতে সেখানে নামলাম আমরা। ছোট বন্দর, অল্প সময়ে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস পার হয়ে এলাম। থিম্পু থেকে আমাদেরকে হোটলে নেবার জন্য এক লোক গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল।


চার ধারে পাহাড়ের মাঝখানে ছোট্ট পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

মাথাপিছু জিডিপির বিচারে ভুটান আমাদের চেয়ে ধনী, প্রায় তিন গুণ। তবে ভুটান মনে করে জিডিপি বা জিএনপি না, জিএনএইচ, মানে Gross National Happiness দিয়ে একটি জাতির অবস্থা বিচার করা উচিত। ভুটানে পৌঁছানোর কিছক্ষণের মধ্যেই অবশ্য আমার বিবির happiness উধাও হয়ে গেল। আমাদের গাড়িতে বসিয়ে ড্রাইভার গেছে অন্য দু'জন বাংলাদেশী পর্যটককে নিয়ে আসার জন্য। বহুক্ষণ ধরে তাঁদের আসার নাম নেই। বিবি কী ধরনের টক-ঝাল বাক্যবাণ তাঁদের প্রতি হানা যায় সে পরিকল্পনা আঁটছেন। শেষ-মেষ যখন দু'জন এলেন, চেহারা দেখে বোঝা গেল তাঁদের happiness অধমের বিবির থেকেও নিম্নস্তরে নেমে গেছে। দু'জনের একজন দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ বেনসন সিগারেট নিয়ে এসেছিলেন, ভুটানের কাস্টমস সিগারেটের দামের তিন গুণ শুল্ক আদায় করেছে। বাক্যবাণ তুণেই রয়ে গেল। পৃথিবীতে বোধ হয় ভুটানই একমাত্র দেশ যেখানে সিগারেট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিদেশীরা আড়ালে খেতে পারেন, তবে শুল্ক দিয়ে সিগারেট আনতে হয়। দোকানে পাওয়া যায় না।

রাজধানী থিম্পুর দিকে রওনা হলাম। গাড়িতে এক ঘন্টার রাস্তা। দু'ধারে পাহাড়, খাড়ি, নদী, জঙ্গল, সুন্দর দৃশ্য। দেখতে দেখতে আমার ব্যক্তিগত happiness অনেক বেড়ে গেল। ভুটানে সমতল ভূমির বড় অভাব। বিমান বন্দরের মতই থিম্পু উপত্যকা পাহাড়ের মাঝখানে। থিম্পু শহরের কেন্দ্রে আমাদের হোটেল। সামনে এক লেনের রাস্তা। সুশৃঙ্খল্ভাবে গাড়ি চলছে। অযথা হর্ন বাজানোর প্রবণতা নেই। পৃথিবীতে বোধ হয়ে ভুটানই একমাত্র দেশ যেখানে রাজধানীর রাস্তায় ট্রাফিক বাতি নেই।

রাস্তায় আমার ধারণার চেয়েও বেশি গাড়ি দেখলাম। বেশির ভাগই (আমার ছোট জরিপে ৯৫ শতাংশই) মারুতি-সুজুকি অথবা হিউন্দাই। আমার ধারণা ছিল ভুটানের নাগরিকদের সাধারণ্যে পশ্চিমা পোশাক পরা নিষেধ। সেই ধারণাও দেখলাম ভুল।

হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে দৃশ্য দর্শনে বেরুলাম। প্রথমে একটি বৌদ্ধ স্তুপ, তারপর পাহাড় চূড়ায় বৌদ্ধ মূর্তি। ভুটানের অধিকাংশ নাগরিক মহাযান ধারার বজ্রযান তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।


রামধনুর দিকে মুখ করে থিম্পু শহরের উপর নজর রাখছেন ভগবান বুদ্ধ


বৌদ্ধ স্তুপ।
কৈফিয়তঃ ভুটান ভ্রমণের উপর পোস্ট দিয়েছিলাম অনেক দিন হয়ে গেল। অসুস্থতা এবং নানা ব্যস্ততায় পরবর্তী কিস্তি দিতে দেরি হয়ে গেল, এজন্য দুঃখিত। প্রথম পর্বে যাঁরা মন্তব্য করেছিলেন তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ, তাঁদের উপদেশ মাথায় রাখলাম। তবে লেখা খুব বড় করতে চাই না। আরো দুই কিস্তি শেষ করে রেখেছি। শেষ কিস্তি শিগগিরই দিয়ে দেব। ছবিগুলো যাচ্ছেতাই হয়েছে, ক্যামেরা একটা কিনতে হবে! চোখের পীড়ার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি]

প্রথম পর্ব

বুদ্ধ পয়েন্টের মূর্তি দেখে আমরা নীচে নেমে থিম্পু শহরে ফিরে এলাম। হস্তশিল্পসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকানে ঘুরাঘুরি করে দিনের বাকি সময় কাটল। বেশির ভাগ পণ্যই ভারত থেকে আমদানী করা, দামও খুব বেশি। এত দাম দিয়ে কিছু কেনার ইচ্ছে হল না। আমাদের সফর সঙ্গীরা খবর দিলেন তাঁরা দোকানে রুচি চানাচুর ও ড্যানিশ বিস্কিটের মত বাংলাদেশী পণ্যও দেখেছেন। তবে দাম জিজ্ঞেস করেননি। ভুটানের শিল্প বলে তেমন কিছু নেই। বাজার ছোট (লোকসংখ্যা মাত্র ৭ লাখ), ভূ-প্রকৃত্রির জন্য পরিবহন খরচ বেশি, এই কারণেই হয়ত। ভারত থেকে পাহাড়ি, সর্পিল, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পণ্য আসে তাই দাম পড়ে বেশি।

এদেশের মানুষের আয়ের মূল উৎস কৃষি থেকে। মোট জমির মাত্র ৩ শতাংশ চাষযোগ্য। কিন্তু লোকসংখ্যা কম হওয়ায় তারা মশলা ও ফল চাষ করে রফতানি করে। বাংলাদেশেও আসে। জনসংখ্যা কম হওয়ার আরেক সুবিধা বেকারত্বের হার মাত্র ৪ শতাংশ। পাহাড়ি নদীতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অবারিত সুযোগ আছে, কল-কারখানা না থাকায় চাহিদা কম, ফলে বাড়তি বিদ্যুৎ ভারতে রফতানি হয়।

ভুটানের দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়ানোর সুবিধে হল দোকানীরা বিরক্ত করে না। কোন কিছু গছানোর প্রবণতা তাঁদের নেই। একটা বইয়ের দোকানও পেয়ে গেলাম। সেখানে ইংরেজি বইয়ের যে সংগ্রহ তা বাংলাদেশের কোন দোকানে নেই। আমি যে শহর বা দেশেই যাই স্থানীয় মানচিত্র ও তথ্যমূলক বই কিনি। ভুটানের উপর কিছু বই দেখলাম, কিন্তু কেনার মত টাকা সাথে ছিল না।

ভুটানের টাকার মান ভারতের রূপির সমান। নেপালের মত এখানেও ভারতের রূপি চলে। আমাদের কাছে সামান্য কিছু ভারতীয় মুদ্রা ছিলা, তাই দিয়ে সামান্য কিছু খাদ্য দ্রব্য কিনে চেখে দেখা হল। যেহেতু এখানে কেনা-কাটা করার মত তেমন কিছু নেই, হোটেল-খাবার-পরিবহনের টাকা আগেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে, আরো সামান্য কিছু স্থানীয় বা ভারতীয় মুদ্রা হলেই আমাদের চলে। মুশকিল হল আমাদের কাছে ডলারের ছোট নোট নেই। ১০০ ডলারের নোট ভাঙ্গালে যে পরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা পাওয়া যাবে তা খরচ করা সম্ভব হবে না। অল্প কিছু স্থানীয় মুদ্রা আর বাকিটা খুচরা ডলার হিসাবে ফেরত পেলে আমাদের সুবিধা হয়। হোটেলে বলল তাঁরা প্রতি ডলারে ৫২ ভুটানি মুদ্রা (নুলত্রাম) দিবে। তারাই বলল ব্যাংকে প্রায় ৫৬ নুলত্রাম করে পাওয়া যাবে।

হোটেলের উল্টোদিকেই ড্রুক পিএনবি ব্যাংক। ব্যাংকের লোগো এবং পিএনবি দেখে বোঝা যায় এটা ভারতের পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের ভুটানি প্রতিষ্ঠান। সকালে সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম তারা ৫৫ নুলত্রাম হারে ডলার ভাঙ্গিয়ে দেবে, কিন্তু কোনে খুচরা ডলার ফেরত দেবে না। ডলার না ভাঙ্গিয়েই দ্বিতীয় দিনের দৃশ্য দর্শনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।

প্রথম গন্তব্য থিম্পু ও গান্তের মধ্যবর্তী একটি গিরিপথ। চড়াই বেয়ে উঠতে হয় ৩৫০০ মিটার (থিম্পুর উচ্চতা ২১০০ মিটার)। পথে একটি চেক পোস্ট পড়ে, সেখানে পাসপোর্ট জমা দিয়ে যেতে হয়। ফেরার পথে ফেরত দিয়ে দেয়। এখানে দর্শনীয় জিনিস দু'টো। এক হল ১০৮ বৌদ্ধ স্তুপের সমারোহ। মাঝখানের স্তুপটি বড়। তার চার পাশে ১০৭টি ছোট স্তুপ। মুসলমানরা যে রকম দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে কাবাগৃহ প্রদক্ষিণ করে, বৌদ্ধরা তেমন মন্ত্র জপতে জপতে স্তুপ প্রদক্ষিণ করে। পার্থক্য হল মুসলমানরা ঘোরে কাবাকে বাঁয়ে রেখে, আর বৌদ্ধরা চক্কর দেয় স্তুপকে ডানে রেখে।


১০৮ স্তুপের সমাহার

স্তুপরাজির বিপরীতে একটি বৌদ্ধ বিহার। জুতো খুলে ভিতরে ঢুকে দেখা গেল সেখানে তিনটি বিশাল মূর্তি। মাঝখানেরটা ভিক্ষাপাত্র হাতে ভগবান বুদ্ধের। একজন ভিক্ষু সেখানে বসে বসে জপ করছিলেন। তিনি উঠে বাতি জ্বালিয়ে দিলেন আমাদের সুবিধের জন্য। তিনি জানালেন বুদ্ধের ডান পাশে যাঁর মূর্তি, তিনি গুরু পদ্মসম্ভবের। গুরু রিনপোচে নামে তিনি ভুটানিদের কাছে পরিচিত। বর্তমানের পাকিস্তানের সোয়াত অঞ্চল থেকে এসে তিনি ভুটানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন করেন। ভুটানিরা তাঁকে বুদ্ধের অবতার হিসাবে মানে। পদ্ম ফুল থেকে জাত রিনপোচের কথা পরে আরো আসবে।

আবহাওয়া ভাল থাকলে এখান থেকে বরফ ছাওয়া হিমালয়ের গিরিশৃঙ্গ দেখা যায়। একটা ছোট তালাবদ্ধ ঘরে পর্বত চূড়া দেখার জন্য টেলিস্কোপ আছে দেখলাম। তবে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় আমরা কিছুই দেখতে পারলাম না।

হোটেলে দুপুরের খাবার সেরে ফের বের হলাম। প্রথমে আরেক পাহাড় চূড়ায় বিবিএস বা ভূটান ব্রডকাস্টিং সিস্টেমের সম্প্রচার কেন্দ্র। বিবিএস-এর দেখার কিছু নেই, তবে ঐ পাহাড় থেকে প্রাক্তন রাজার প্রাসাদ, সংসদ ভবন, থিম্পুর প্রধান জং এবং মন্ত্রীদের আবাসিক এলাকা দেখা যায়। মন্ত্রীদের বাসস্থান সুন্দর কিন্তু সাদামাটা, ভূটানের অধিকাংশ বাড়ির মত টিনের চালে ছাওয়া। রাজা-বাদশাহরা সাধারণত আলিশান সমীহ জাগানিয়া ভবনে থাকেন, তাতে তাঁদের শক্তি ও আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটে। বর্তমানকালে পৃথিবীতে ভুটানই সম্ভবত একমাত্র দেশে যেখানকার রাজা স্বেচ্ছায় নিজের ক্ষমতা খর্ব করে গণতন্ত্রের ব্যবস্থা করেছেন। এই কাজটি করেন ভুটানের চতুর্থ রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক। এরপর তিনি তাঁর ছেলের উপর দায়িত্ব দিয়ে সিংহাসন ছেড়ে দেন। ওয়াংচুকের বাড়ি গাছপালার অবগুন্ঠনে ঢাকা, সহজে চোখেই পড়ে না। পাশেই বিশাল সংসদ ভবনের সদম্ভ উপস্থিতি। সংসদ ভবনের সামনে থিম্পুর জং। এখানে রাজার দফতর, দরবার ও কিছু মন্ত্রণালয়ের দফতর অবস্থিত।

জং-এর বিষয়টা একটু বলা দরকার। ভুটানের উত্তর সীমান্তে তিব্বত। তিব্বত থেকে বিভিন্ন সময় ভিন্ন মতাবলম্বী বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা ধর্মীয় নিগ্রহের শিকার হয়ে ভুটানে আশ্রয় নিয়ে তাঁদের ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করেছেন। এঁদের কারণে তিব্বত প্রায়ই ভুটানের উপর হামলা চালিয়েছে অতীতে। এমন এক ধর্মগুরু ছিলেন শবদ্রুং নাওয়াং নামগিয়াল। তিনি শুধু ধর্মবেত্তাই ছিলেন না, সামরিক বিশষজ্ঞও ছিলেন। তিনি ভুটানের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে কিছু দুর্ভেদ্য ভবন তৈরি করেন যা একাধারে প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনের কেন্দ্র হিসাবে কাজ করত। তিব্বতীদের আক্রমণ এখান থেকেই প্রতিহত করা হত। ক্ষুদ্র ভুটান বার বার বিশাল তিব্বতের আগ্রাসন রুখে দাঁড়িয়েছে। এ দুর্গ ভবনগুলোকেই বলা হয় জং। সেই জংগুলো এখনো অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দফতর হিসাবে কাজ করছে।

বিবিএস-এর চূড়া থেকে নেমে আমরা গেলাম সেই জং-এর কাছে। যখন পৌঁছুলাম তখন দিনের শেষে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্টানের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা অবনমনের কাজ শুরু হয়ে গেছে। পতাকাকে এরা খুবই সম্মান করে। আনুষ্ঠানিকভাবে যেখানে পতাকা উড়ে সেখানে হাতকাটা জামা বা স্যান্ডেল পরে যাওয়া যায় না; ফুল হাতা জামা ও জুতো পড়া নিয়ম।


ভুটানের ফ্ল্যাগ-এ ড্রাগনের ছবি। ভুটানি ভাষায় ড্রুক মানে ড্রাগন। ড্রুকয়ুল মানে ড্রাগন জাতির দেশ, ভুটান। ভুটান শব্দটা এসেছে সংস্কৃত 'ভূ উত্থান 'থেকে।


ছবির বামদিকে মাঝামাঝি সংসদ ভবন। তার ডানে ৪র্থ রাজার প্রাসাদ। সামনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দফতর। এগুলোর বাঁ পাশে জাতীয় পতাকা উড়ছে। আমরা জং-এ পৌঁছাতেই এই পতাকা নামানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছিল।


থিম্পুর জং।


পতাকা গুটিয়ে বাদ্য সহকারে ভবনের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।


জং-এর ভেতরের আঙ্গিনা থেকে তোলা দৃশ্য।

জং-এর একাংশে দর্শনার্থীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। সেদিকটা ঘুরে দেখে আমরা ফিরে চললাম হোটেলে। পরদিন প্রাতঃরাশ সেরে যেতে হবে পারোর পথে। স্থানীয় বা ভারতীয় মুদ্রার সংস্থান হল না। হোটেলের কর্মচারীদের বখশিস দেওয়া সম্ভাব হবে না। অন্তত সেদিন সম্ভব হবে না, তবে নানা কৌশল অবলম্বন করে পারো থেকেই তাঁদের যৎকিঞ্চিৎ বখশিস দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। 
পরদিন লুচি-শব্জী দিয়ে নাস্তা সেরে গাড়িতে রওনা দিলাম পারোর পথে। আগেই বলেছি এক ঘন্টার পথ। দু’ধারে সুন্দর, প্রাকৃতিক দৃশ্য। দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। পথে একটি জায়গা আছে যাকে ইংরেজিতে Confluence বলে। ভুটানি নামটা ধরতে পারলাম না। বাংলায় ত্রিবেণীসংগম বলা যেতে পারে। এখানে পারো ও থিম্পু নদী একধারায় মিলেছে। পাহাড়ি এলাকার রাস্তাও নদীর সমান্তরালে চলে, তাই এখানে তিনটি রাস্তাও মিলেছে; একটি যায় পারোর দিকে, আরেকটি থিম্পুর দিকে আর তৃতীয়টি ভারত সীমান্তে ফুটশোলিংয়ের দিকে। ত্রিবেণীসংগম পার হয়ে বেশ কিছু দূর গেলে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে পারোর বিমানবন্দর দেখা যায়। পরদিন এখান থেকেই দেশে ফিরব।


ত্রিবেণীসংগম। বাম দিকে পারো নদী, মাঝামাঝি থিম্পু নদী, ডানে মিলিত ধারা। থিম্পু নদীর সমান্তরাল থিম্পু যাবার রাস্তা দেখা যাচ্ছে।


পাহাড়ের উপর থেকে দেখা পারো বিমানবন্দর।

পারো খুবই ছোট, ছিম ছাম শহর। আমরা যখন পৌঁছালাম তখনো হোটেলের কক্ষ প্রস্তুত হয়নি, তাই মালপত্র রেখে পারোর আশপাশ ঘুরে দেখতে বেরুলাম। শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলে, অন্তত পারো-থিম্পুর সন্নিহিত এলাকায়, ঘরে ঘরে উঠোনে মোটর গাড়ি দেখা যায়। প্রায় প্রত্যেকের একটি ছোট গাড়ি, নিদেনপক্ষে একটি স্কুটার আছে। তবে ভুটানে স্কুটার-মোটর সাইকেল খুব কম চলে, কী কারণে জানি না। পারো শহরের বাইরে দেখলাম বহু রিসোর্ট আছে। একটি ফাইভ স্টার রিসোর্টও দেখলাম।

গাড়িতে আধা ঘন্টা মত চলার পর আমরা একটি ঐতিহাসিক জংয়ের ধ্বংসাবশেষের পাদদেশে উপস্থিত হলাম। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই জং থেকে তিব্বতীদের আক্রমণ প্রতিহত করা হত। পাহাড়ের চারদিকে ভুটানের জাতীয় বৃক্ষ সেডারের বনভূমি। ভূমিকম্পের সময় প্রদীপ পরে জংটিতে একবার আগুন ধরে গিয়েছিল, অর্থাভাবে এর সংস্কার করা আর সম্ভব হয়নি। এখন পরিত্যক্ত। চড়াই ধরে কয়েক মিনিট উঠার পর একটি কৃত্রিম নালা মত চোখে পড়ল, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে গেছে। আমাদের গাইড জানাল বন্দী তিব্বতীদের হত্যা করে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এই নালা দিয়ে নীচের নদীতে ফেলে দেওয়া হত। আরো উপরে জংয়ের ভেতরে একটি খোলা চত্ত্বর, সেখানে যোদ্ধাদের ঘোড়া বেঁধে রাখা হত। দেখলাম একদল ছেলে-মেয়ে সেখানে চড়ুইভাতি করছে। একজন জানাল তাঁরা বিশ্ব বন্ধু দিবস পালন করছে।


পাহাড় চূড়ায় জং-এর ধ্বংসাবশেষ।


এই নালা দিয়ে হতভাগ্য নিহত তিব্বতী সৈন্যদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গড়িয়ে পড়ত।


জং-এর ভেতরে এখানে সৈন্যদের ঘোড়া বাঁধা থাকত।


জং-এর ভেতরে এখন ঘোড়া নেই, বেওয়ারিশ কুকুর আছে।


জং-এর একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন।

জং থেকে হোটেলে ফেরার পথে সম্ভবত ভুটানের সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য চোখে পড়ল। পাহাড়ের খাড়ির উপরে একদম কিনারে বাঘের নীড় মন্দির (Tiger’s Nest Temple)। যেমন অদ্ভূত তার নাম, তেমনি অদ্ভুত তার অবস্থান। বাঘের আবার নীড় হয় কেমন করে? সে গল্প বলি। দেব-দেবী তো বটেই, আধুনিক যান-বাহন আবিষ্কারের আগে দরবেশ-সাধুরাও বাহন হিসাবে অসাধারণ নানান জীব-জন্তুতে সওয়ার হয়ে ভ্রমণ করতেন। হযরত শাহ মখদুম কুমিরের পিঠে চড়ে রাজশাহী গিয়েছিলেন (রেফারেন্সঃ মাসিক দ্বীন দুনিয়া )। কুমারখালীর দরবেশ শাহ সোনাবন্ধু বাঘের পিঠে চলাফেরা করতেন (রেফারেন্সঃ Islam in Kumarkhali)। আগে বলেছিলাম গুরু রিনপোচে ভুটানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ঘটান। তিনি বাঘের পিঠে এখানে এসেছিলেন। তবে হযরত সোনাবন্ধুর চেয়ে গুরু রিনপোচের কুদরতি বেশি ছিল, তাঁর বাঘ পাখির মত উড়তে পারত। বাঘের পিঠে উড়েই তিনি পাহাড় চূড়ায় পৌঁছেছিলেন। সেখানে নির্মিত মন্দিরের নামকরণের সার্থকতা এখানেই।


নেট থেকে নেওয়া ব্যাঘ্র নীড় মন্দিরের ছবি। সূত্রঃ The Blog of the Long Now

দুর্ভাগ্যবশত আমার উড়ন্ত বাঘ নেই, গাড়িতেও সেখানে যাওয়া সম্ভব না। চড়াই বেয়ে হেঁটে মন্দিরে পৌঁছাতে সামর্থভেদে দুই থেকে তিন ঘন্টা লাগে। আমার বিবির হাঁটুর ব্যথা ব্যারাম আছে, অন্য দুই সফর সঙ্গী হাঁটার ব্যাপারে চরম নিরুৎসাহী। এই পথ বেয়ে উঠতে শুধু দম থাকলেই চলে না, হিম্মতও লাগে যথেষ্ট। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের হাতে অত সময় নেই। কাজেই নীচ থেকে মন্দির দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল।

মধাহ্নভোজ শেষ করে হোটেলে উঠে হেঁটে শহর দেখতে বের হলাম। পনের-বিশ মিনিট হাঁটলেই মোটামুটি পুরো শহর ঘোরা হয়ে যায়। আজ রোববার, সাপ্তাহিক ছুটি। ছোট এক চত্ত্বরে দেখলাম বহু বাঙালির সমাবেশ। সিঙ্গাপুর-মালয়শিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে নির্মাণ কাজে প্রচুর বাঙলি শ্রমিক দেখা যায়। ভুটানেও তাই। তবে এরা বাংলাদেশী না, ভারতীয়। ভুটান সংলগ্ন কুচবিহার থেকে এরা বৈধভাবেই আসে শ্রমিক হিসাবে। স্থলপথে আসা, তাই আসার খরচ প্রায় শূণ্য। বেতনও তুলনামূলকভাবে ভাল, অন্তত ওদের ভাষ্য অনুযায়ী।

দোকানে দোকানে ঘুরি। ফল ছাড়া তেমন কিছু কেনার মত নেই। কিন্তু পকেটে ভারতীয় রূপি বা ভুটানি নুলত্রাম নেই। ভুটানের উপর বই আর মানচিত্র কেনার জন্য উশখুশ করছি। এক জায়গায় একটা বড় সুসজ্জিত দোকান পেয়ে গেলাম। ভেতরে হস্তশিল্পের সমাহার। দরজায় Visa-MasterCard-এর চিহ্ন দেখে ঢুকে পড়লাম। বইও আছে পেছন দিকে। একটা বই আর একটা মানচিত্র পছন্দ করে দোকানীর সামনে এসে দাঁড়ালাম থাইল্যান্ড-ভিয়েতনামের মত এখানেও বেশিরভাগ দোকানদার মহিলা। তাঁকে বললাম, আমি বই-মানচিত্র ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কিনব, কিন্তু তুমি কি দামের অতিরিক্ত ৫০০ নুলত্রাম কেটে ঐ পরিমাণ অর্থ আমাকে নগদ দিতে পারবে? আমার সমস্যা তাঁকে বুঝালাম। সে বলল এ রকম করাটা উচিত না, তবে সে নিজেও যেহেতু বিদেশ ভ্রমণ করে, সমস্যাটা সে অনুধাবন করে এবং আমার অনুরোধ সে রাখবে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
পরদিন সকালে বিদায় লগ্নে এই টাকা দিয়েই পারোর হোটেলের দু-তিনজন কর্মচারী ও আমাদের ড্রাইভার-গাইডের বখশিস দেওয়া হল। আর ড্রাইভারের মাধ্যমে থিম্পুর হোটেলের কর্মচারীদের বখশিসও পাঠানোর ব্যবস্থা হল। এরা সবাই খুব অমায়িক, হাসি মুখে আমাদের সব আবদার মেনেছে, তাই বখশিস দিতে মোটেও দ্বিধা ছিল না।


ভুটানি নুলত্রাম।

মোটের উপর ভুটানে ভালই সময় কাটল। যাঁরা প্রকৃতির সান্নিধ্য পছন্দ করেন, বনে ছাওয়া পাহাড়ে হাঁটতে ভালবাসেন, ভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চান, দেব মূর্তি দর্শনে যাঁদের মাথার চুল খাড়া হয় না, তাঁদের বেড়ানোর আদর্শ জায়গা ভুটান। যানজট, জনযট, লোড শেডিং, বায়ু দূষণ নেই। ইংরেজি মোটামুটি চলে। ভর গ্রীষ্মকালেও আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ, কোন ভবনেই এসি নেই, বৈদ্যুতিক পাখাও দুর্লক্ষ্য। তবে ঝকঝকে আকাশ ছোঁয়া ভবন, ঝলমলে নিয়ন বাতি, আলিশান শপিং মল, রোমাঞ্চকর বিনোদন পার্ক পাবেন না। শিশুরা এখানে ঘুরতে হয়ত আগ্রহ পাবে না। ভুটানে দ্রব্য মূল্য বেশি, কিন্তু উচ্চ মূল্যের বিলাসী পণ্য দোকানে নেই।

দেখতে দেখতে তিন দিন কেটে গেল। দেশে ফেরার পথে মনে হচ্ছিল বাহনটা বিমান না হয়ে বাঘ হলে একটু ব্যাঘ্র নীড় মন্দিরটা ঘুরে আসা যেত। হয়ত পায়ে হেঁটেই উঠব ভবিষ্যতে কোন একদিন।
[শেষ]

মন্তব্য

পাহাড়ের খাড়ির উপরে একদম কিনারে বাঘের নীড় মন্দির (Tiger’s Nest Temple)। যেমন অদ্ভূত তার নাম, তেমনি অদ্ভুত তার অবস্থান। বাঘের আবার নীড় হয় কেমন করে? সে গল্প বলি। দেব-দেবী তো বটেই, আধুনিক যান-বাহন আবিষ্কারের আগে দরবেশ-সাধুরাও বাহন হিসাবে অসাধারণ নানান জীব-জন্তুতে সওয়ার হয়ে ভ্রমণ করতেন। হযরত শাহ মখদুম কুমিরের পিঠে চড়ে রাজশাহী গিয়েছিলেন (রেফারেন্সঃ মাসিক দ্বীন দুনিয়া )। কুমারখালীর দরবেশ শাহ সোনাবন্ধু বাঘের পিঠে চলাফেরা করতেন (রেফারেন্সঃ Islam in Kumarkhali)। আগে বলেছিলাম গুরু রিনপোচে ভুটানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ঘটান। তিনি বাঘের পিঠে এখানে এসেছিলেন। তবে হযরত সোনাবন্ধুর চেয়ে গুরু রিনপোচের কুদরতি বেশি ছিল, তাঁর বাঘ পাখির মত উড়তে পারত। বাঘের পিঠে উড়েই তিনি পাহাড় চূড়ায় পৌঁছেছিলেন। সেখানে নির্মিত মন্দিরের নামকরণের সার্থকতা এখানেই। 

 

দুবাইয়ের পথে, মাঠে-ঘাটে

২০ আগস্ট ২০১২। আরব আমিরাতের ঈদুল ফিতরের পরের দিন। চিরচেনা দেরা দুবাইয়ের বুক যেন আজ নতুন করে দেখা। ভোরের কুয়াশা কেটে দেশে যখন সুর্য উঠে যেমন লাগে আজ ঠিক তেমনি লাগছিলো দেরা দুবাইকে। পরদেশের সব পরবাসী সবাই ঈদের ছুটিতে। নগরে নেই ব্যস্ততা। তাই ভোরবেলা নাসির স্কয়ারের দিকে ছুটে চলা আমাদের। মশকুর, জাবেদ ও তুষার কে নিয়ে যাত্রা।

উদ্দেশ্য দুবাই নাসির স্কয়ারের ইউনিয়ন মেট্্েরা স্টেশন। মাত্র ৫ মিনিট হেঁটেই পৌঁছে গেলাম মেট্্েরা মানে ইলেক্ট্রিক ট্রেন স্টেশনে। যথারীতি ৫ মিনিট পর-ই এসে গেলো ড্রাইভারবিহীন অত্যাধুনিক দুবাই মেট্্েরা। উঠে বসাতেই চলতে শুরু করলো আমাদের লক্ষ্যেস্থল জুমেরাহ বীচের পানে। মাটির নীচে অনেকক্ষণ চলার পর আবার উপরে উঠে গেলো মেট্্েরাটি। ১০ মিনিট মেট্রোতে জার্নির পরই চলে আসলাম ইতিসালাট টাওয়ার স্টেশনে। নেমে গেলাম আমরা। আগে থেকেই আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন মায়নুর ইসলাম ও সালেহ আহাদ টিপু ভাই। মেট্টো থেকে নেমেই দেখা হলো তাদের সাথে। প্রথমে ঈদের কোলাকুলি করেই উঠে গেলাম গাড়িতে।
যাত্রা হলো শুরু...
সবে মাত্র সকাল ১০টা। দুবাইতে এত্তো গরম গাড়ির ভেতরের এসিও কাজ করছেনা। ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্র-ই মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় এমন ভাব। দুবাইতে সাধারণত ৫০ এর উপর তাপমাত্রা থাকেনা। আর ভরা গরমের দিনে ৪৫-৪৮ থাকে। নানা রকম কথা আর মধুর স্মৃতিচারণ নিয়ে আমাদের গাড়ি চলছে দুবাই শহরের অন্যতম পর্যটন স্পট জুমেরাহ’র দিকে। গাড়িতে বাজছে বাংলা গান। সেই সাথে আমাদের হৈ হুল্লুড় আর প্রাণবন্ত গপসপ নিয়ে গেছে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে। আমার জন্মভূমি, আমাদের প্রিয় দেশে। আমাদের গ্রামে। যেখানে লুকিয়ে আছে আমাদের ফেলে আসা ঈদ। প্রবাসী জীবনে ঈদগুলোও কেমন পর পর লাগে। আমাদের দেশের বাতাসগুলো ঘুম পাড়ায় আর মরুভূমির বাতাসগুলো ঘুম তাড়ায়। এমন গরম বাতাস গায়ে মেখে পৌছে গেলাম জুমেরাহ বীচে। তখন ভর দুপুর। প্রচণ্ড রোদে বীচের বালু আর পানি ঝিকমিক করছে। প্রথমেই আমাদের চোখে ধরা পড়লো কিছু আজব টাইপের বাঙালি পর্যটকদের। যাদের কাণ্ড দেখে শুধু হাসি নাই। বরং অবাকও হয়েছি। এরা এসেছেন আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবী থেকে। ৫০ সদস্যের দল। বুকে ব্যাজ ধারণ করে আছেন ‘বনভোজন’র আর এসেছেন বীচ ভোজনে। সেই সাথে এই দেশে পাবলিক প্লেস মানে খোলামেলাভাবে পান খাওয়া বলা হয় মমনু মানে নিষেধ। রয়েছে মুকালাফা বা জরিমানাও। কোনকিছুর পরোয়া না করেই মধ্যবয়সি বাঙালি ভদ্রলোক প্রকাশ্যে পান খাচ্ছেন। এটা দেখে মশকুরের মন্তব্য ছিলো এমনই-সব পর্যটন এলাকায় বাঙালিদের হেয় করে দেখার এটা অন্যতম কারণ। বাঙালিরা আইন জানেনা আর মানেনা। সবশেষে ছবি তুললাম জুমেরাহ বীচকে পিছে নিয়ে। আমরা মানলাম আইন। মূল বীচ এলাকায় ছবি তুলা নিষেধ। তাই বীচের বাইরে থেকে ছবি তুলে নিলাম। বীচে গোসলের জন্য প্রস্তুত হলাম। গোসল করতে ফর্মাল ড্রেস তথা ফুল প্যান্ট শার্ট গ্রহণযোগ্য নয়। এমন পোষাকে কাউকে দেখলে বীচ এলাকায় থাকা সিকিউরিটি বাঁশি বাজিয়ে সতর্ক করে দেয়। এতেও কেউ না মানলে জরিমানা দিতে হয়। আমরাও যথারীতি থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ও শর্ট গ্যাঞ্জি পরে নামলাম বীচের বুকে। হাজার বিদেশী মানুষের ঢল দেখে বিস্মিত সবাই। সকল দেশের সকল মানুষের আপন ভাষায় চলছে ভাষা বিনিময়। কিন্তু সকলের হাসির ভাষা একই। দুবাইয়ের যতোটা পর্যটন স্পট আছে তার বেশি জুড়ে রয়েছে জুমেরাহ। তাই বিদেশী পর্যটকদেরও জুমেরাহ’র দিকে চোখ। জুমেরাহ বিশাল বীচের নিরিবিলি পরিবেশ পর্যটকদের মন জোগায়। জুমেরাহও বিশাল বিস্তুত এলাকা নিয়ে আপন গৌরবে দাঁড়িয়ে আছে দুবাইয়ের বুকে। ১,২,৩ জুমেরাহতে রয়েছে ওপেন বীচ, ফ্যামেলী বীচ, ওয়াদি ওয়াটার পার্ক, খেজুর গাছের সারি সারি শৈল্পিক পাল্ম জুমেরাহ, এবং বিশ্বের চতুর্থ উচু হোটেল বুর্জ আল আরব। আমরা অনেকক্ষণ সমুদ্রের পানিতে অবগাহন করে উঠে এলাম তীরে। সারা শরীর যেন লবণাক্ত হয়ে গেছে। তাই উপরে রাখা শাওয়ারে গোসল সেরে উঠে গেলাম।

কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা...
গোসলের পানি ঠাণ্ডা হলেও উপরের গরম আর নীচের মরুভুমির বালু আমাদের প্রাণ যেন হাঁপিয়ে তুলছে। এবার জুমেরাহ এলাকার বুর্জ আল আরবের দিকে ছুটে গেলাম আমরা। গাড়িতে নেমেই একটা গ্র“প ছবি নিলাম। ছবিটি তুলে দিলেন ইউরোপ থেকে আসা এক বন্ধু। আমরা দেখতে লাগলাম পৃথিবীর ৪র্থ উচু হোটেল বুর্জ আল আরব। সমপূর্ণ সাগরের পানির উপর বানানো হয়েছে নান্দনিক শিল্প দিয়ে। একসময় দুবাই বলতেই বুর্জ আল আরবকে বুঝানো হতো। ৭০ তলা বিশিষ্ট সাত তারা এই হোটেলটির উচ্চতা ৩২১ মিটার। ২৮০ মিটার আর্টিফিশিয়াল বরফ দিয়ে রাখা হয়েছে হোটেলটি। সেই সাথে বীচ থেকে তীরপর্যন্ত বানানো হয়েছে একটি ব্রীজও। কৌতুহলী মানুষৈর ভীড় ঠেলে আমরাও হোটেল দর্শন শেষে এবার গেলাম আল ওয়াদি ওয়াটার পার্কে। বাচ্চা থেকে বয়স্ক সকলের বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়ে ওঠে পার্কটি। পাকের প্রবেশদ্বারে কৃত্রিম ঝর্ণাধারা সকলের দৃষ্টি কাড়ে। গরমে প্রত্যেক পর্যটক অস্বস্তি বোধ করছেন তবুও হার মানছেননা উপভোগ থেকে। ঠিক তেমনি আমরাও। এদিক ওদিক শুধু ক্যামেরার ক্লিক আর ক্লিক। আমরা গরমে কাতর হয়ে গেছি। তাই মায়নুর ভাইয়ের পরামর্শে প্রথমেই ঢুকতে চাই মল অব আমিরাতে। পরাণটা ঠাণ্ডা করতে চাই। গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা। মায়নুর ভাই ড্রাইভ করে ঢুকলেন মল অব আমিরাতের পার্কিংয়ে। আহা! এতো শান্তি লাগছে! ঠাণ্ডায় শীত শীত অনুভব হচ্ছিল। হাত মুখ ধুয়ে দেখতে লাগলাম বিশাল মল অব আমিরাতকে। আমাদের দেশের কয়েকটি মার্কেট এক করলে বোধ হয় এমন বড় হবে। নান্দনিক শিল্প কর্ম দিয়ে গড়া এখানকার সবক’টি মল। এর মধ্যে মল অব আমিরাত ও দুবাই মল উল্লেখযোগ্য। মল অব আমিরাত ২০০৫ সালে স্থাপিত হয়েছে। ২২৩,০০০ স্কয়ার মিটার নিয়ে গঠিত মলটিতে রয়েছে পাকঘরের কেনাকাটা থেকে সিনেমা হল পর্যন্ত। এক কথায় দৈননন্দিন জীবনের সব রয়েছে এখানে। অনেকক্ষণ নানারকম আইটেম দেখে আর মনমাতানো সব ছবি তুলে পেটকে শান্ত করতে ঢুকলাম কেএফসিতে। লাইনবদ্ধ মানুষের সাথে আমরাও লাইনে দাঁড়ালাম। অবশেষে কেএফসি নিয়ে বসে গেলাম আপন জায়গায়। খেয়ে দেয়ে এবার রওনা হলাম বার দুবাইস্থ আল সাফা পার্কে। বাঙালিদের ঈদ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে ওখানে। আয়োজন করেছে বড়লেখা প্রবাসী পরিষদ, দুবাই এবং মিডিয়া পার্টনার ও সার্বিক সহযোগিতায় ছিলো আমিরাত-বাংলা মাসিক পত্রিকা মুকুল। বিকেলের মিঠে রোদে শত-শত বাঙালি ব্যাচেলর ও পরিবার এসে জড়ো হলেন পার্কে। লাগছিল কোন ডাকবাংলাতে বসে আছি। খাঁটি বাংলা কথা, বাংলা খেলা, বাংলা গান। ইভেন্ট ছিলো ছেলেদের ফুটবল, হংসশিকার, রশিটান, মোরগের লড়াই এবং মেয়েদের বালিশ বদল ও চেয়ার দৌড়। খুবই ইনজয় করলাম। আয়োজকদের একজন হয়ে বেশি উপভোগ করলাম। সেইসাথে মূল পরিকল্পক কবি আব্দুল আজিজ সেলিমের প্রাণবন্ত পরিচালনা ও মহিলাদের পরিচালক লেখিকা
মোস্তাকা মৌালার পরিচালনায় মুগ্ধ সবাই।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...
পার্কের ঈদ উৎসবে রূপ নিয়েছে মিলন মেলার। হারানো বন্ধু ইকবাল, হিফজুর ও হাদিকে পেলাম এখানে। সেইসাথে পেলাম আলতাব মামা ও উনার স্ত্রীকে। এদের সাথে এখানে দেখা হবে এটা ছিলো কল্পনাতীত। তাই এটা বাড়তি পাওয়া। এছাড়া আরেকটি ব্যাপার খুবই ইনজয় করেছি। আমার অনেক ফেসবুক বন্ধু আমাকে চেনেন। আমি যাদেরকে চিনিনা। ওরা সবাই এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো- আপনি মুকুল পত্রিকার লুৎফুর ভাইনা? আমি-হ্যাঁ বলাতেই উনারা বল্লেন আমরা আপনাকে চিনি। ফেসবুকে আপনার কর্মকাণ্ড দেখি। আর এ দলে ছিলেন সালমান, খায়রুল, মুহিনসহ অনেকেই। আড্ডাতে বাংলাদেশ থেকে আসা মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখার সুজানগর ইউপি চেয়ারম্যান নসিব আলী সাহেবের গানে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন দর্শকরা। রাত বেজে যায় ১০টা। দর্শকদের একটাই আকুতি ওয়ান মোর প্লিজ। অবশেষে পার্ক কর্তৃপক্ষ গান বন্ধ করতে বলে। সাঙ্গ হয় মিলন মেলা। শেষ হয়ে যায় আমার ভ্রমণ মিশনও। অনেক আনন্দ করে আবার ফেরলাম দেরা দুবাই শহরের বুকে। উঠলাম মশকুরের বাসায়। এার আগে মায়নুর ভাই ও টিপু ভাই চলে গেলেন। আমরাও ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। অনেক ধেকার পরই আমাদের কাছে লাগছিল-দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...।

লেখক: সম্পাদক, মাসিক মুকুল, দুবাই।LINK

আসাম যাত্রা

২০০৭ সাল। সেবার ঈদ এবং পুজার জন্যে বেশ বড় রকমের একটা ছুটির ফাদে পড়েছিলো ভার্সিটি। সেটাকে কাজে লাগানোর জন্যে মনস্থির করি নানীবাড়ি যাবো। ভারতের আসাম রাজ্যে আমার নানীবাড়ি। যাওয়াটা বিশাল ঝক্কির ব্যাপার। বাসায় সবাই মিলে যাওয়ার বিল উত্থাপন করলাম। বিল আংশিকভাবে পাশ হলো। ভাইয়া-ভাবী বললো যাবে। মিয়াভাই-ভাবী বললো হয়তো যাবে। আব্বা-আম্মা যাবে না। আমি আব্বাকে বললাম যে, সবার সাথে ভিসার জন্যে লাইনে দাড়াবো নাকি একা দাড়াবো। আব্বা অন্যদের সাথে লেজ না বাধার পরামর্শ দিলেন এবং আমাকে একাই ভিসার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়তে বললেন।

ভিসা কাহিনীঃ
সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে গুলশানে ইন্ডিয়ান অ্যামবাসিতে পৌছে গেলাম। গিয়ে দেখি মোটামুটি হাজারখানেক লোকের পিছনে আমাকে দাড়াতে হবে। পূজার কারণে ভয়াবহ ধরনের রাশ। কি আর করা? দাঁড়িয়ে পড়লাম। এর মাঝে দেখি এক পাবলিক এসে বলছে,
- সামনে দাড়াবেন নাকি?”
- কত?
- ৪০০ টাকা।
- নাহ।
- আপনি জায়গা দেখেন, তারপর পছন্দ হলে টাকা দিয়েন।
- জায়গা দেখেও টাকা দিতে পারবো না। দিলে বাসায় যাওয়ার ভাড়া থাকবে না। (বাসায় যাবার সিএনজি ভাড়া থাকবে না। সেটা অবশ্য উল্লেখ করি নাই।)
- কত দিতে পারবেন?
- ২০০ টাকা ম্যাক্সিমাম।
- ৩০০ দিয়েন।
- ভাই, পারলে না করতাম না। ৩০০ কেন, ৪০০ই দিতাম।
লোকটা কিছুক্ষণ চিন্তা করে আমাকে বললো, “আসেন আমার সাথে।” আমি লাইনে আমার পিছনের লোকটাকে আমার জায়গাটা দেখতে বলে অন্য লোকটার সাথে হাটা ধরলাম। গিয়ে দেখি মোটামুটি সামনের দিকে শ-খানেক লোকের পিছনে আরেকটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটাকে দেখিয়ে প্রথম লোকটা আমাকে বললো,
- দেখেন, চলবে নাকি? এটা ছাড়া আর কোন জায়গা নাই এখন আমার কাছে।
আমি কোন কথা না বলে দুশো টাকা লোকটার হাতে গুজে দিলাম। দ্বিতীয় লোকটা লাইন থেকে বের হয়ে আমাকে জায়গা করে দিলো। আমি লোকটার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলাম। সেদিন মোটামুটি দশটার মধ্যে ভিসার কাজ শেষ করে বের হতে পেরেছিলাম অ্যামবাসী থেকে। লাকি মি। ভাইয়া-ভাবীরা পরের দিন গিয়েছিলো ভিসার জন্যে। মোটামুটি ছয় ঘন্টার মত দাঁড়িয়ে থেকেও ভিসা পায়নি। উল্টো, মিয়াভাইয়ের পাসপোর্ট আটকিয়ে রেখে খুব হ্যারাস করেছিলো।

যাত্রা হলো শুরুঃ
আমার যাত্রার ব্যাপারে নানীবাড়িতে কাউকে কিছু জানানো হয় নাই। সারপ্রাইজ ভিজিট আরকি। রাত সাড়ে নয়টার শাহআলী পরিবহনে রওনা দিলাম। গন্তব্য বুড়িমারী। ড্রাইভার ব্যাটা আস্তে ধীরে চালিয়ে সকাল আটটার দিকে বুড়িমারীতে নামিয়ে দিলো। সকাল সাড়ে আটটার দিকে বর্ডার খুলে দেয়। আমার পিঠে এক বিশাল ব্যাকপ্যাক। তাছাড়া আর কোন লাগেজ নাই। বুড়িমারী চেকপোস্টে বিডিআর কোন ঝামেলা করলো না। ভ্যাজাল বাধলো ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা ইমিগ্রেশনে। আমার সাথে যারা সেসময় ভারতে যাচ্ছিলো, সবার গন্তব্যই মোটামুটি পশ্চিমবঙ্গ অথবা মাল্টিপল-এন্ট্রি ভিসায় নেপাল। শুধুমাত্র আমারই গন্তব্য আসাম। সবই লিখে দিয়েছিলাম ফর্মে। এরপরও কোথায় যাবেন? কেন যাবেন? কার কাছে যাবেন? কিভাবে যাবেন? কি করেন? যার কাছে যাবেন সে কি করে? ব্লা ব্লা একের পর এক প্রশ্ন করেই গেলো। আমি ধৈর্য্য ধরে জবাব দিলাম সব প্রশ্নের। এর মাঝে আবার কাস্টমসে আমার লাগেজ চেক করতে চাইলে বললাম যে, আমার লাগজে কোন লক নাই। চেক করে নেন। ব্যাকপ্যাকের গিফট আইটেমসের মধ্যে অনেকগুলো শাড়ি আর সাবান ছিলো। সাবানগুলো দেখে এমন চোখ বানালো যেন আমি সাবান না, আরডিএক্স নিয়ে যাচ্ছি।

ইমিগ্রেশন থেকে ছাড়া পেয়ে মানি এক্সচেঞ্জ গিয়ে কিছু রুপি কিনলাম। তারপর এক্সচেঞ্জের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
- আচ্ছা ভাই, এখান থেকে মাথাভাঙ্গা যাবার বাস কোথা থেকে ছাড়ে?
- সামনেই একটা বাইপাস আচে। ওখান থেকে সুপার ধরে চলে যেতে পারবেন।
- আচ্ছা। বাইপাস পর্যন্ত কিভাবে যাবো? রিক্সা বা ভ্যান?
- না না, দাদা। রিক্সা-ভ্যান লাগবে না। হেটেই চলে যেতে পারবেন।
পিঠের এই বোঝা নিয়ে হাটা খুব কষ্টকর ব্যাপার। তাই দুরত্ব কম হওয়া স্বত্তেও একটা রিক্সা নিলাম। জীবনের শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তের একটা ছিলো সেটা। কারণ রিক্সাতেই প্রায় মিনিট বিশেক লেগেছিলো বাইপাস পর্যন্ত পৌছাতে। মনে মনে গালি দিয়ে ব্যাটার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করলাম।

ছুপার সার্ভিসঃ
সুপারের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে সুপার ক্ষুদা পেয়ে গেলো। মনে পড়লো যে, সকাল থেকে নাস্তাই করা হয়নি। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে লুচি আর সবজি খেয়ে নিলাম। তারপর আবারও অপেক্ষা সুপারের জন্যে। কিন্তু যে বাস আসে, সেটাই নাকি সুপার না। অপেক্ষা করতে করতেই দেখি মোবাইলে তখনও নেটওয়ার্ক আছে। আমার ডিজুস দিয়ে বাসায় ফোন দিয়ে আম্মাকে টেনশন করতে মানা করলাম। তারপর আবারও অপেক্ষা। অবশেষে সুপার এলো। সুপার দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ! মিনিবাস আর রাইডারের মাঝামাঝি এক বাহন। তারউপরে কোন সিট খালি নাই। আগত্য লাগেজ মেঝেতে রেখে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রা। কিছুক্ষণ পরে মনে হলো রেস্টুরেন্টের লোকটা আমাকে ইচ্ছে করে এই লোকাল বাসে উঠিয়ে দিয়েছে সুপার বলে। কারণ রাস্তায় যেই হাত উঠাক না কেন, সাথে সাথে ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে তাদের উঠিয়ে নিচ্ছে। এটা আর যাই হোক, কোন সুপার সার্ভিস হতে পারেনা। এভাবে চলতে চলতে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই একটু ঝিমুনী চলে এসেছিলো। হঠাত প্রচন্ড শব্দ করে সামনের গাড়ির সাথে সংঘর্ষ আর তাল সামলাতে না পেরে আমি সামনের বসে থাকা যাত্রীর কোলে ধরাশায়ী। হৈ হৈ করে উঠলো বাসের যাত্রীরা।
- সুয়োর ড্রাইভারটার কি ব্রেক নেই?
- আহা, ড্রাইভারকে দোষ দিচ্ছেন কেন দাদা? সামনের আহাম্মকটা হঠাত ব্রেক কষার কারণেইতো এটা হলো। সালার সব দোস ও ব্যাটার।
- একেতো আটআনা ভাড়া বাড়িয়েচে, তারওপর কিভাবে গাড়ি চালাচ্চে দেকেচেন দাদা? আমার নতুন সার্টটার পুরো দুটো বোতাম ছিড়ে গিয়েচে। এটার ক্ষতিপূরণ কে দিবে শুনি?
- সালাকে দুটো রামথাপ্পড় কসিয়ে দিন দাদা। কঠিন শিক্ষা হবে তাহলে।
কিছু উৎসাহী যাত্রী নেমে সামনের গাড়ির ড্রাইভারকে কঠিন শিক্ষার রামথাপ্পড় দেবার জন্যে নেমে গেলো। আমার পাচ্ছে রামকান্না। এমনিতেই সেই লেভেলের ছুপার সার্ভিস। তারউপর এভাবে মারামারি শুরু করলে আজকে আর আমার আসাম পৌছুতে হবেনা।
অবশেষে মাথাভাঙ্গাঃ

সামনের গাড়ির ড্রাইভারকে চড়-থাপ্পর মেরে দাদাদের জানে একটু শান্তি আসলো। তারা এসে আবার বাসে চেপে বসলো। বাস ছাড়লো। এবার ড্রাইভার সাহেব আর কোথাও থামলো না। মাথাভাঙ্গাতে এসে তবেই গাড়ি থামলো। আমি গাড়ি থামার সাথে সাথে ছিটকে বের হয়ে আসলাম। পাবলিককে জিজ্ঞেস করলাম কুচবিহারের গাড়ির ব্যাপারে।

পাবলিক আবারও আরেক সুপার সার্ভিসের কথা আমাকে বললো। আমি সাবধানে জিজ্ঞেস করলাম যে সুপার সার্ভিস ছাড়া অন্য কোন সার্ভিস আছে কিনা। তারা জানালো যে সুমো সার্ভিস আছে এবং সেটা রাস্তার অন্য পাশেই। এ কথা শুনে গলা শুকিয়ে গেলো। সুপার থেকে সুমো পালোয়ান! আল্লাহ জানে এবার কি অপেক্ষা করছে। রাস্তার অন্যপাড়ে গিয়ে দেখি জিপ সার্ভিস রয়েছে যেটাকে ওরা সুমো বলে জিপের ব্র্যান্ড-নেম অনুযায়ী। অপেক্ষা না করে ছাড়বো ছাড়বো করছে এমন একটা সুমোতে চেপে বসলাম আর তার আগে উপরের ক্যারিয়ারে ব্যাকপ্যাকটা ছুড়ে মারলাম। সুমোতে বসতে হলো আমাদের লেগুনার সিটগুলোর মত সাইড হয়ে। এ ধরনের সিটে বসলেই কেন জানি খুব অস্বস্তি লাগে। তারউপর সুমোর লিকলিকে শরীরের হাড়গিলে ড্রাইভারটা ড্রাইভ করা শুরু করলো লেগুনার ড্রাইভারগুলোর মতন। গা গুলায় বমি লাগা শুরু করলো। কোনমতে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকলাম, আর মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকলাম যেনো এই হরিবল জার্নিটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়।

কুচবিহারঃ
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে কুচবিহার পৌছে গেলাম। দুপুর প্রায় সোয়া দুইটা বাজে। গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালাম। গা তখনো গুলাচ্ছে। পেট খালি। এখান থেকে আমার আসামের ধুবরী জেলার বাস ধরতে হবে। কিন্তু তার আগে কিছু খাওয়া দরকার। একটা রিক্সা ডাক দিয়ে বাস টার্মিনালের আশেপাশের ভালো কোন রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে বললাম। রিক্সা চলছে। বেশ কিছুক্ষণ চলার পরে দেখি একটা বড় লনওয়ালা প্রাসাদের সামনে এসে থামলো।
- নামুন। রাজবাড়ি চলে এসেচে।
ব্যাটার কথা শুনে মেজাজটা গেলো খিচড়ে। বললাম,
- এই, তুমি ফাইজলামী করো আমার সাথে? তামাশা করো? তোমারে বললাম রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে আর তুমি নিয়ে আসছো রাজবাড়িতে!
- কি বলচেন এসব? আমি কেন আপনার সাথে ফাজলামো করবো? আপনিইতো বললেন যে রাজবাড়ি চলো।
- কানের চিকিৎসা করাও। রেস্টুরেন্ট আর রাজবাড়ি কখনোই একরকম লাগেনা শুনতে। এখন বাস টার্মিনালের পাশে কোন রেস্টুরেন্টে নিয়ে চলো। রেস্টুরেন্ট, ঢাবা, হোটেল, খাওয়ার জায়গা, ইনন, সরাইখানা। বুঝতে পারছো?
- জ্বী। প্রথমে রাজবাড়ি না বলে রেস্টুরেন্ট বললেইতো হতো।
- হ, বাপ। ভুল হইছে। এখন চল। তাড়াতাড়ি চল।
টার্মিনালের উল্টো দিকের এক রেস্টুরেন্টে আসলাম অবশেষে। ভিতরে ঢুকে ভাত, ডাল, শাক আর মাছ দিয়ে খেয়ে নিলাম কোনমতে। তারপরও দেখি কেমন জানি লাগতেছে। বুঝলাম যে বর্ডারে খাওয়া লুচি আর সবজি কোন কারণে পেটে প্রচুর গ্যাস উৎপন্ন করেছে। গ্যাস রিলিজ করার জন্যে একটা ফার্মেসীতে ঢুকলাম এন্টাসিড কেনার জন্যে।
- ভাই, এন্টাসিড হবে?
- কিসের সিড?
- এন্টাসিড।
- নাহ। হবে না।
- এটাতো খুব কমন ওষুধ। আচ্ছা, অক্সিকোন হবে?
- অক্সিজেন??!!
- (কাঁদো কাঁদো হয়ে) নারে ভাই। আপনাদের এখানে গ্যাস হলে চুষে খাওয়া ট্যাবলেটকে কি নামে ডাকে আমি জানিনা। দয়া করে সেটা দেন, প্লিজ।
- গ্যাস্টিকের ওষুধ চাচ্চেন বলবেনতো।
ওষুধ হাতে পাবার সাথে সাথে সেটা মুখে চালান করে দিয়ে লোকটাকে শুকরিয়া বলে বেরিয়ে আসলাম। মিনিট পাচেকের মধ্যে কয়েকটা বড় বড় ঢেকুর ছেড়ে দারুন স্বস্তি বোধ করলাম।

অতঃপর ধুবরীর বাসঃ
টার্মিনাল ছিলো দুটো। একটা সরকারী এবং একটা বেসরকারী। সরকারীটাতে প্রথমে গেলাম আসামের গাড়ি ধরতে। এগুলোর চেহারাসুরত ভালো না হলেও সার্ভিস দারুণ। আগে একবার অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু বিধিবাম। দিনের একমাত্র সরকারী বাসটা ছেড়ে গিয়েছে ঘন্টাখানেক আগে। বাধ্য হয়ে বেসরকারী টার্মিনাল থেকে ধুবরীর একটা বাসে চেপে বসলাম। বড় বাসটা মোটামুটি খালি। যে দুই-একজন প্যাসেঞ্জার আছে তাদের মুখে ধুবরীর আঞ্চলিক ভাষা শুনে মূহুর্তেই বিল্লী থেকে শের বনে গেলাম। পাশের সিটের লোক আমার সাথে আলাপ শুরু করলো,
- (আমার ব্যাকপ্যাক দেখিয়ে)কুটি থেকি আসছেন? দিল্লী?
- না, ঢাকা।
- তাই নাকি? কোথায় যাবেন? (ভাষা চেঞ্জ)
- আঙ্কেল মুই এটিকার ভাষা মোটামুটি কবার পাং।
- হয় নাকি? খুব ভাল লাগিল শুনিয়া। ধুবরীত কায় আছে?
- মোর মামা, খালা সব ধুবরীত।
- হয় নাকি? ধুবরীত কুটি বাড়ি?
- বিদ্যাপাড়া।
- মোর বাড়ি ঝগড়ার পাড়।
লোকটার সাথে বেশ ভালো খাতির হয়ে গেলো। মাঝখানে ইফতারীর সময় দেখি লোকটা নেমে কিছু ছোলা-মুড়ি কিনে নিয়ে আসলো। আমিও ভাগ পেয়েছিলাম। সন্ধ্যার পরে গাড়ি গোলগঞ্জ পৌছালো। এ জায়গায় মাঝে মাঝে বাংলাদেশী নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। আমি তাড়াতাড়ি ডিজুস বের করলাম। দেখি নেটওয়ার্ক পাচ্ছে। বাসায় ফোন দিয়ে আশ্বস্ত করলাম যে আমি প্রায় পৌছে গিয়েছি এবং টেনশন করে যেন মামাদের ফোন দিয়ে আমার আসার ব্যাপারে কিছু জানানো না হয়।
এর প্রায় পৌনে এক ঘন্টা পরে ধুবরীতে এসে নামলাম। একটা রিক্সা নিয়ে সোজা নানীবাড়ি। নানীবাড়ির বাইরে একটু দূরে রিক্সা থেকে নেমে দেখি, নিচে মেজো মামা আর এক কাজিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আমাকে খেয়াল করে নাই। আমি হঠাত তাদের সামনে গিয়ে বিশাল এক সালাম দিলাম। আমার কাজিন দেখি খুব বেশি অবাক হয়ে, ডাঙ্গায় তোলা কাতল মাছের মত মুখ করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। মেজো মামা কিছু বললো না। শুধু দুই হাত বাড়িয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আর বললো, “আগে থেকে বললেতো তোকে বর্ডার থেকে নিয়ে আসতে পারতাম।

সৌন্দর্যের বেলাভূমি টেকনাফ

পাহাড়ের পাদদেশে সমতল, সেই সমতলের কানায় কানায় পূর্ণ জনপদ, আর জনপদকে এক পাশ হতে এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে একটি নদী। তার এ অটুট বন্ধন কখনও ছুটে যাবার নয়। এ নদী যুগ যুগ ধরে সে সভ্যতার বিকাশে সাক্ষী হয়ে আছে।

যে নদীর কলকল জল নিয়মিতই সে জনপদের কথা বর্ণনা দেয়। মানুষের সকল হর্ষ-বিষাদ নিয়ে সে নদী প্রতি মূহূর্তে ডুব দেয় অদূরে গর্ব ভরে প্রবাহিত সাগড়ে। পাহাড়ের গায়ে আঁচর কেটে বেড়ে ওঠা এ জনপদের সকল দু:খ-বেদোনা যেন নদীটি ধুয়ে নিয়ে সাগড়ে ফেলে আসে। আর সাগড় থেকে নিয়ে আসে বেঁচে থাকার অনেক উপকরণ। নদী মাতৃক বাংলাদেশের একেবারের শেষ অঞ্চলটির বর্ণনা করলে এমন কথাই বলবেন ভাবুক মন। রুপকথার দেশের গল্প শোনালেও সত্যি সত্যি এমন ভূমি আপনাকে নেমন্তন করছে আমাদেরই দেশে। নাম তার টেকনাফ। টেকনাফ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিনের ভূমি, বাংলাদেশ যেন টেকনাফ দিয়ে নেমে যাচ্ছে বঙ্গপোসাগড়ে। দেশের আর সব স্থান হতে টেকনাফ অনেকটা আলাদা, অনেক বৈচিত্রতাপূর্ণ সে কথা আমি বৈকি অনেকেই হয়ত: জানেনা। আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল সোনালী বাংলাদেশের এ দক্ষিণা বিন্দু টেকনাফ কে। এইত গত মাসের কথা। ভ্রমন পিপাসুদের মন তৃষ্ণার্ত। কোথাও বেড়িয়ে আসার আকাঙ্খা যেন মৌলিক চাহিদায় রুপান্তরিত হয়ে থাকে। পিকনিকে যাবার অতি উত্তম সময়টুকু পার করছি। তাই আমার মন ও খাঁচা বন্দি পাখির ন্যায় ছটফট করছে। যথারীতি অফিসে এলাম। হাজিরা খাতায় সাইন করতে করতেই সুখবরটি পেলাম। মনে হল বিধাতা আমরা উড়– উড়– মনকে প্রসন্নতা দানে এ উপহার তুলে দিচ্ছেন। অফিস থেকে আগামী বৃহস্পতি বার ভ্রমনে বেরুচ্ছি আমরা। পুলকিত মন যখন জানলো ছুটি সহ মোট তিন দিনের জন্য আমরা যাচ্ছি সেন্ট মার্টিনে, তখন বাঁধভাঙ্গা হাসি আমার মুখে লেগেই আছে। চললাম আমরা দারুচিনি দ্বীপের দেশ পানে। অফিস থেকেই বাস, মাইক্রো নেয়া। তবে ঢাকা ছাড়তে একটু দেরী হয়ে গেল। তাই চট্টগ্রামে পৌঁছুতেই সকালের সোনারোদ এসে লাগল চোখে-মুখে। আমরা ক্লান্ত, তাই যাত্রা বিরতি। পেট চো চো করছে সবার। জি. ই.সি.র মোড়ে নেমে খাবার খেলাম। আর দেরী নয় আবার ৬ ঘন্টার পথ। এ জার্নি বাই বাস। তবে আমার বেলায় জার্নী বাই মাইক্রো। ঠিক বিকেলে যেয়ে পৌঁছলাম কক্সবাজারের কলাতলীতে। সবাই হোটেলে কে কোন রুমে যেয়ে ফ্রেস হবে এ নিয়ে ব্যস্ত আমি তখন বিশ্বের সর্ববৃহত সমুদ্র সৈকতে পাখা মেলে উড়ছি। দূর সমুদ্র হতে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন এর হাতছানি আমাকে ব্যকুল করছিল বারবার। রাত পোহাতেই আমরা আবার পথ চলছি। সেন্ট মার্টিন যেতে হলে টেকনাফ যেতে হবে। সেখানেই নাফ নদীতে নোঙ্গর পেতে দাড়িয়ে আছে কেয়ারী সিন্দবাদ। আমরা আবার রওনা দিলাম। যত দক্ষিণে যাওয়া যায়। এলো মেলো পাহাড়ী পথ। নাইক্ষ্যংছড়ির বন গ্রামের ভেতর পাহাড়ী আঁকা বাঁকা পথ। মনে পড়ে খবরের কাগজে পড়েছিলাম এ অঞ্চল হতে প্রায়ই পর্যটকগণ অদৃশ্য হয়ে যায়। পুরো এলাকাটি উখিয়া জেলার অর্ন্তগত। সকাল ১০টায় পৌছলাম আমরা টেকনাফে। কিন্তু ঘটল অন্য ব্যাপার। পৌঁছার আগেই জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে। পাশের কৌতুকরসে ভরপুর কলিগ আমাকে জিজ্ঞেস করল " ট্রান্সলেট কর। টেকনাফে পৌঁছার পূর্বে জাহাজ ছাড়িয়া দিল"। ট্রান্সলেট তখন মাথায় আসছে না। মনে বড় রকমের একটা শংকা উকি দিচ্ছিল বারবার। কি ছেড়া দ্বীপে যাওয়ার সুতো ছিড়ে গেল! বুক শুন্যতা হু হু করে বাড়ছিল। আমরা টেকনাফের বন্দর গন্তব্যহীনভাবে দাড়িয়ে। স্থানীয় লোকজনদেও সাথে গল্প করে সময় পার করছি। আর নাফ নদের মুগ্ধতা অবলোকন করছি। ঠিক এমন সময় স্থানীয় এক ব্যক্তির বিনয়ী কণ্ঠ আমদের "টেকনাফে আপনাদের পা ফেলে যান আজ।" যেই বলা সেই কাজ। টেকনাফ দেখব আমরা। হোটেল ভাড়া হল। নামটা চমৎকার নেটাং মাথিন। পাহাড়ের নীচে হোটেলটি। যেন পাহাড়কে ছাদ বানিয়ে তৈরি। নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলে ম্যানেজার জানালেন, "নেটাং মাথিন মানে মাথিনের পাহাড়। মাথিন সম্পর্কে চমৎকার গল্প শুনলাম।" চললাম সবাই মাথিনের কুপ দেখতে। এ যেন সত্যিকারের লাইলি মজনু কাহিনী। স্থানীয় বার্মিজ মার্কেট পেলাম। যে যা পেলাম কিনে নিলাম যা ঢাকায় মেলেনা। আমরা চললাম টেকনাফের আরেকটি দর্শনীয় স্থান শাহ পরীর দ্বীপে। পাহাড়ের পাদদেশে অতীব সৌন্দর্যময় এক চারণভূমি। গবাদি পশুর ভীড়ে গ্রাম বাংলার রুপরেখার দৃশ্যপট হৃদয়ে ভেসে উঠল। সম্রাট শাহ সুজা এর নামে নামকরণ করা এ দ্বীপটি বাংলাদশের শেষ নিরবচ্ছিন্ন স্থলভাগ। ভাবতেই ভাল লাগে এমন একটি স্থানে আমরা দাড়িয়ে। বিশেষ করে শাহ পরী হতে নাফ নদীকে এতই চমৎকার দেখায় যে পৃথিবীর আর কোন নদী হয়ত: এত সুন্দর নয়। নদীর জল সাগড়ের নীলে ছোঁয়া। নাফ এর মোহনার খুব কাছাকাছি আমরা। এর পরই বঙ্গপোসাগর। ওপারে মায়ানমারের আরাকান রাজ্য। সেখানে আকাশ ছুঁই ছূঁই পাহাড়, তার ওপর সাদা মেঘের খেলা যেন মেঘকে মাথায় নিয়ে পাহাড় গুলো নাফ নদীতে স্নান করছে। নাফ এর স্রোত সামনে বিস্তৃত সাগরে গিয়ে মিশছে। নদী যদি এত সুন্দর হয়ে থাকে তাহলে টেকনাফ বীচ হবে সুন্দরতম। আমদের ব্যকুল হৃদয় প্রকৃতির আরও সৌন্দর্য অবলোকনে টেকনাফ সৈকতে গেলাম। বিকেল হয়ে এল। সূর্য যেন ক্লান্ত। দুর হতে সমুদ্রের গর্জন শুনছি। কাছে গিয়ে আমরা সবাই অবাক। সমুদ্রে ভাসছে অর্ধবক্র চাঁদ। একটি নয় অনেকগুলো। সেই চাঁদগুলোতে কোন বুড়ি নয় সুতো টানছেন জেলেরা। আমাদের গাঁয়ের নৌকাগুলো থেকে সম্পূর্ন আলাদা এসব নৌকো দেখতে ঈদের চাঁদের মতই দেখাচ্ছে। সৈকতে যেয়ে দেখি এমন নৌকো আরও অনেক । এদের সবগুলোতেই পতাকা লাগানো ও প্রত্যেকটি বাহারী রংয়ে রাঙায়িত। সমুদ্রের বুকে বীরদর্পে ঘুড়ে বেড়ায় বলে টেকনাফের নৌকাগুলোর আকৃতি এমন। টেকনাফ সৈকত দেখে আমরা বিমুগ্ধ। জোয়ার ভাটায় সাদা ফেনা হয়ে ঢেউ মুর্হুমহু আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। বালিতে লাল কাঁকড়া ছুটোছুটি করছে। পেছনের নারিকেল গাছ, বিস্তৃত বালুচর, রুপালী ঢেউ, তার বুকে ঘুরে বেড়ানো জেলেদের চাঁদসৃদশ সাম্পান। সত্যি মন কেড়ে নিলো টেকনাফ সুমুদ্র সৈকত। নেটাং মাথিনের দেশ টেকনাফ আমাদের দারুচীনি দ্বীপে যাওয়ার ব্যর্থতা পুরোটাই মুছে দিল।

থাইল্যাণ্ডের দিনপঞ্জী

থাইল্যাণ্ডে এসেছি গত মাসের শেষের দিকে। সারাদিন ট্রেনিংয়ের শেষে সন্ধ্যা বেলায় আমরা মাঝে মাঝে ঘুরতে বের হই। গত দুই দিন ধরে চেংমাই ঘুরে দেখলাম।

আমরা মোট দশজন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়েছি এই কোর্স করতে। মজার ব্যাপার হল দশজন ছেলেমেয়ে এসেছে দশটা দেশ থেকে। তাই cross-cultural communication করতে গিয়ে ভারি মজার মজার সব ঘটনা ঘটছে। সবার যোগাযোগের কমন ভাষা ইংরেজি । তবু সবারই আগ্রহ অন্য ভাষার দু একটা শব্দ শিখে নেওয়া্র ব্যাপারে। কোন বন্ধু যেন নিজেকে দলছুট বা একা না ভাবে, সে ব্যাপারে শিক্ষকসহ সবারই সমান খেয়াল।

কিগ্যান নামে এক শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান ছেলে যেই টের পেল যে আমি রাস্তাঘাট চিনি না, অমনি সে সবাইকে ছেড়ে আমার সাথে হাটতে হাটতে চলে এল আমার সাথে। পুরোটা পথ হাটতে হাটতে আমাকে রাস্তা চেনানোর জন্য অসংখ্য চিহ্ন মুখস্থ করাল। ওর দুটো ক্যামেরা আছে বলে আমাকে একটা দিয়ে রেখেছে যাতে আমি সেটা দিয়ে ইচ্ছেমত ছবি তুলতে পারি কারণ আমার ক্যামেরাটা ডিএসএল আর নয় এবং তা দিয়ে ফুল মেনু কন্ট্রোল করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। আর যে গার্লস হোস্টেলে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সেখানকার মেয়েগুলোও ভীষণ ভাল।

এবার আসা যাক, থাইল্যাণ্ডের জীবন যাত্রা সম্পর্কে। দুই সপ্তাহয় আমি তেমন একটা ঘোরার সময় পাই নি। আমি যে এলাকাটায় থাকি সেটার নাম চেত ইয়োদ। পাশেই একটা মন্দির আছে এই নামে। সেই মন্দিরের নামেই নামকরণ। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে করে আসতে বিশ মিনিট লাগে। জায়গাটা সুপার হাইওয়ের এক পাশে।

বেশ মফ:স্বল মফ:স্বল ভাব আছে জায়গাটায়। কারণ জায়গাটা খুব ফাকা আর নিরিবিলি। বেশিরভাগ মানুষই স্বাধীনভাবে চলাচলের জন্য বাইক চালায়। যাদের বাইক নেই, তারা প্রায় ১৫ মিনিট পায়ে হেটে হার্বারে যায়। সেখান থেকে 'সং তাও' নামে এক রকমের যান পাওয়া যায়- বাহনটা আমাদের দেশের টেম্পোর থাই সংস্করণ আর কি। এছাড়াও আছে টুকটুক- বাংলাদেশের রিকশার মতই অনেকটা। তবে আমাদের রিকশার মত অত সুলভ নয় জিনিসটা। যে যানবাহনই নিতে চান না কেন, আপনাকে হার্বারে বা কোন বড় রাস্তার সামনে গিয়ে দাড়াতে হবে। আমাদের দেশে যেমন বাসার গেট খুলেই 'এই রিকশা' বলে হাক দিয়ে রিকশা দাড় করে ফেলা যায়, এখানে সে উপায় নেই।
একা চলাচলের ব্যাপারে আমার এখনো তেমন কনফিডেন্স আসে নি কারণ আমি থাই বলতে পারি না আর ওরা থাই ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। ইংরেজি বলা তো দুরের কথা, বোঝেও না। তাই দু একটা ছোটখাট কেনাকাটার জন্য আমি কয়েক পা দূরের সেভেন/ইলেভেন স্টোর ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার ঝুকি নিই না। অন্য কোথাও ঘুরতে গেলে দল বেধে যাই।
তবে থাইরা খুবই হাসিখুশি।এমনকি রাগ প্রকাশের জন্যও ওদের বিশেষ রকমের হাসি আছে। আপনাকে দেখলেই চিনুক না চিনুক, চোখাচোখি হওয়া মাত্রই 'সোওয়াদিখা/সোওয়াদিখাপ' বলে হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে স্বাগত জানাবে। মেয়েরা বলে 'সোওয়াদিখা' আর ছেলেরা বলে 'সোওয়াদিখাপ'। অচেনা মানুষকে এভাবে স্বাগত জানানোর ব্যাপারটা আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছে।

পোশাক আশাকের ব্যাপারে পশ্চিমাদের সাথে তেমন একটা পার্থক্য আমার চোখে ধরা পড়ছে না।কখনো কখনো আমার বয়সী মেয়েদের পোশাক আশঙ্কাজনক রকমের সংক্ষিপ্ত।আমার সাথে থাকা পশ্চিমা রুমমেটদেরও হার মানায়।

বার আর ক্যাফের ব্যাপারে আমি রীতিমত লা-জওয়াব। রাস্তার পাশের খাবারগুলোর স্বাদ অসাধারণ। দামেও সস্তা। একটা সসেজ কিংবা বেকড ব্যানানা কিনতে লাগছে ১০ বাথ।বেকড্ ব্যানানা! শুনতে অদ্ভূত লাগছে না? কিন্তু স্বাদটা অসাধারণ! পকেটে টাকা একটু বেশি থাকলে ঢুকে পড়া যায় কোন ক্যাফে তে। ওখানে কফির ধরণ বুঝে দাম। তবে এক কাপ ল্যাটে পাওয়া যায় ৫০-৬০ বাথের মধ্যে। দামটা আমার কাছে মোটামুটি সস্তাই মনে হল।এখনো স্টারবাক্সে যাওয়া হয় নি।আমাদের কারোরই অত ট্যাকের জোর নেই কিনা।

তবে জেনে রাখা ভাল যে, আপনি যদি রবিবারে চেংমাইয়ের ধারে কাছে থাকেন তবে নাইট বাজারটা ঘুরে আসতে পারেন। দারুণ দারুণ জিনিস পাবেন ওখানে। তবে দামাদামি করতে হবে।

অনেকক্ষণ বকবক করলাম। বিদায় নিই আপাতত। ঘড়িতে বারটা বেজে গেছে। যাওয়ার আগে বলি, কাপখুন খাআআআ (ধন্যবাদ)।
ওই যে বলে না--- দাগ থেকে যদি ভাল কিছু হয়, তবে দাগ ভাল। ঠিক সেই রকম, আমার আহাম্মকি থেকে যদি কৌতুকের জন্ম হয়, তবে আহাম্মকিই ভাল।

হেঁয়ালী না করে ব্যাপারটা খুলে বলি।কাল আমাদের সবগুলো সেশন ছিল ফাইনাল কাট প্রো-এর উপরে। দশজনের মধ্যে সাতজনেরই এডিটিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে এবং ওরা সাতজনই ঈর্ষণীয় একেকটা ম্যাক ল্যাপটপের মালিক। তো, আমরা যারা এডিটিংয়ে এক্কবারে আনাড়ি তাদেরকে ওই সাতজনের সাথে একসাথে মিশিয়ে বসানো হল। আর আমাদের- মানে যাদের ম্যাক ল্যাপটপ নেই তাদের জন্য একটা করে আইম্যাক দেওয়া হল।

আমার পাশে বসল রিচার্ড। ছেলেটা জন্মসূত্রে আমেরিকান। কিন্তু থাইল্যাণ্ডে বড় হয়েছে বলে মন মানসিকতা এবং মূল্যবোধ এশিয়ানদের মত। ও নিজেকে থাই হিসেবেই পরিচয় দেয়- যদিও থাই সরকারের চোখে সে নিছকই বিদেশী।

ওকে পাশে পেয়ে আমি খুশিই হলাম। কারণ ওর সাথে আমার খুব জমে। কিন্তু তখন কি আর জানি ও আজ আমার মান-সম্মান নিয়ে 'অপু দশ বিশ' খেলবে!

যাহোক, আমাদের কানেডিয়ান শিক্ষক বললেন, তিন চার লাইনের একটা স্ক্রিপ্ট দিয়ে ছোটখাট একটা মক শুটিং করে ফেলতে। ৩০ মিনিটের মধ্যে শুটিং শেষ করতে হবে।রব নামের এক আমেরিকান এক পায়ে খাড়া হয়ে গেল পরিচালনা করার জন্য। কিন্ত এবারই বাধল আসল বিপত্তি। শিক্ষক শর্ত জুড়ে দিলেন।বললেন-এমন দুজনকে দিয়ে অভিনয় করাতে হবে যারা ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় যোগাযোগ করতে সক্ষম। আর সেই ভাষাটা হতে হবে পরিচালকের অজানা। উনি দেখতে চান, অনুবাদকের উপর ভর করে পরিচালক Cross cultural situation মোকাবেলা করতে কতটা সক্ষম।

রব তো ভেবে পায় না, কাদের দিয়ে অভিনয় করাবে। ফস করে রিচার্ড বলে বসল, ‍"শ্যামা আর ওয়াসিম। ওয়াসিম পাকিস্তানী, ও উর্দু বলে আর শ্যামাও ভালই উর্দু বোঝে। ওরাই অভিনয় করুক।"

আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ছেলে মেয়েকে দিয়ে অভিনয় করালে নিশ্চয় রোমান্স করাবে! হ্যা, আমার আশঙ্কাই সত্যি হল। পরিচালক রব আমাকে সিন দুটো বুঝিয়ে দিল।হাত ধরাধরির কোন ব্যাপার নেই। কেবল দুই লাইন ডায়ালগ। খুবই সিম্পল। তবু আমি এদের কী করে বোঝাব, আমি প্রাণ খুলে হাসতে পারি, মজা করতে পারি। কিন্তু আমি এসব পারি না! মানুষের সামনে অভিনয় করতে গেলে আমার ভীষণ আড়ষ্ট লাগে। কিন্তু এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আপত্তি করলে ওরা সবাই হয়তো আমাকে খুব সংকীর্ণ ভাববে! আর রব এবং শিক্ষককে আমি খুব সম্মান করি।আমি ছাড়া আর কেউ তো উর্দু বা হিন্দি বুঝবে না।

চুপ করে বসে থাকলাম। সবাই মহাসমারোহে ক্যামেরা, বুম, লাইট সেট করতে শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎই রিচার্ড ভীড় ঠেলে এসে আমার পাশে বসল। ও বুঝে গেছে, খবর খারাপ! বলল, "Are you okay, Shyama?"
থমথমে মুখে বললাম, "No. I'm not."
ও কী বলবে ভেবে না পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, "I'm such an idiot!"
ওর অনুতপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ওর অনুতাপে কোন খাদ নেই। হেসে বললাম, "ইয়েস, ইউ আর।" ও হেসে উঠল। তারপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। একটু পরে রব এসে আমার সাথে কথা বলল। আমাকে জিজ্ঞেস না করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে দু:খ প্রকাশ করল।

কিন্তু প্যাচটা লাগল কাস্টিং নিয়ে। মেয়েরা কেউই উর্দু বা হিন্দি পারে না। এখন ওদেরকে ডায়ালগ মুখস্থ করাতেই সময় পার হয়ে যাবে। কিন্তু রিচার্ড চাইছে না, চাপে পড়ে আমি আর এ ব্যাপারে মাথা গলাই। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ও বলে উঠল, "আরে বাদ দাও, আমিই পারব! মাত্র তো কয়টা লাইন। আমিই হব ওয়াসিমের প্রেমিকা্।"
সবাই তো হা। কয়েকজন বলে উঠল, "তা কী করে হয়? একে তুই ছেলে, তার উপরে জীবনে কোনদিন উর্দু, হিন্দীর ধারেকাছে ছিলি না।"
ও কিন্তু সিরিয়াস। সোজা আমার পাশে এসে বসল। লাইনগুলো মুখস্থ করার চেষ্টা করল কিন্তু হিন্দী মুখস্থ করা কি চারটি খানি কথা? তাও আবার জিভ যদি হয় আমেরিকান! বুঝতেই পারছেন পাঠক, উচ্চারণের কী হাল হয়েছিল। যাই হোক, ও ঠিক করল, ডায়ালগ লেখা নোটবুকটা হাতে নিয়েই অভিনয় করবে।
শুটিংয়ের সময় সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।নিজের দাড়িওয়াআলা মুখ নিয়ে এত সুন্দর করে ও মেয়ের গলা করছে যা আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারি নি, আর অঙ্গ ভঙ্গীও ভীষণ হাস্যকর। আমি লক্ষ্য করলাম, ও অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে, মজাও পাচ্ছে, কিন্তু লজ্জায় ওর পুরো মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে প্রতিটা ডায়ালগের পর।
শুটিং শেষে পরিচালক রব বলল, " আমার জীবনে দেখা সেরা দাড়িওয়ালা নায়িকা তুমি।"
প্যাক আপ হয়ে গেলে, ও আমার কাছ থেকে কলম চেয়ে নিয়ে আমার নোটবুকে কী যেন লিখতে লাগল। ওর মুখে চাপা হাসি।
নোটবুকটা ফিরে পেয়ে দেখলাম, তাতে লেখা-- "মনে রেখো, আজ রিচার্ড তোমার জীবন বাচিয়েছে।"