আরাফ ইসগল। আরাফ হেড্ডেলু। রাস্তার দুধারে এ ধরণের লেখা দেখে হঠাৎ
মনে হতে পারে ইংল্যন্ডের সুদৃশ্য রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে এ কোথায় চলে
এলাম! আসলে ততক্ষণে যে সিমরু অর্থাৎ ওয়েলশ্ এ ঢুকে পড়েছি ইংল্যন্ডের
সীমানা ছাড়িয়ে। ধঁাধার মত শোনালেও ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত ওয়েলশ
এক দ্বি-ভাষিক দেশ। ইংল্যন্ডের পশ্চিমে অবস্থিত এই ওয়েলশ এ আমরা চলেছি
স্নোডোন পর্ব্বত অভিযানে।
স্নোডোন – স্থানীয় ভাষায় Yr Wyddha হল ইংল্যন্ড ও ওয়েলশের সর্ব্বোচ্চ পর্ব্বত শৃঙ্গ। ১০৮৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট স্নোডোন ভৌগোলিক সংঞ্জা মেনে একটি ক্ষয়জাত পর্ব্বত যা প্রায় ৫০০ মিলিয়ান বছরের ইতিহাস বহন করছে নিজের শরীরে। বেশ কয়েকটি ক্ষয়চক্রের সাক্ষী এই পর্ব্বতে তাই পাললিক শিলার ভঁাজ থেকে শুরু করে আগ্নেয়গিরির বৈশিষ্ট্য এমনকি হিমবাহ সৃষ্ট ভূমিরূপ সবই বর্তমান। আর ৫০০ মিলিয়ান বছর তো আর খেলা কথা নয়, তার মধ্যে যে কতবার এই অঞ্চল সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েছে আবার পাশের পাতের ধাক্কাতে জেগে উঠেছে তার কি কোনো ঠিক আছে! ভূত্ত্বের তাত্ত্বিক বৈশিষ্টের মতই এখানকার আবহাওয়াও বড়ই অদ্ভুত। সেপ্টেম্বর থেকে জুন মাস অবধি যে কোনো সময় বরফ পড়তে পারে। সূর্য্যদেবের দেখা পাওয়া ভার। মেঘ কারণে অকারণে এসে ভিজিয়ে দেবে স্বেচ্ছায়। ঝোড়ো হাওয়া তার সঙ্গী হলে সব মিলিয়ে পথযাত্রীদের হয়রানির একশেষ। সেই কারণে স্নোডোন যাত্রা শুরু হওয়ার আগে সর্বত্র সাবধান বাণী থাকে – আবহাওয়া খারাপ হলে সেই মুহুর্তে যাত্রা বাতিল করে ফিরে আসতে। তা সত্ত্বেও সারা বছরই স্নোডোনের অভিযাত্রীদের উদ্ধার করতে হয় হেলিকাপটারের সাহায্যে। বছর চারেক আগে আমাদের স্নোডোন অভিযান যে মাঝ পথে থামিয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল, তার মূলেও ছিল এক ভয়ানক কালো মেঘ। সেদিন আমাদের মত আরও অনেকেই বিফল মনোরথে ফেরার পথ ধরেছিল।
স্নোডোন – স্থানীয় ভাষায় Yr Wyddha হল ইংল্যন্ড ও ওয়েলশের সর্ব্বোচ্চ পর্ব্বত শৃঙ্গ। ১০৮৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট স্নোডোন ভৌগোলিক সংঞ্জা মেনে একটি ক্ষয়জাত পর্ব্বত যা প্রায় ৫০০ মিলিয়ান বছরের ইতিহাস বহন করছে নিজের শরীরে। বেশ কয়েকটি ক্ষয়চক্রের সাক্ষী এই পর্ব্বতে তাই পাললিক শিলার ভঁাজ থেকে শুরু করে আগ্নেয়গিরির বৈশিষ্ট্য এমনকি হিমবাহ সৃষ্ট ভূমিরূপ সবই বর্তমান। আর ৫০০ মিলিয়ান বছর তো আর খেলা কথা নয়, তার মধ্যে যে কতবার এই অঞ্চল সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েছে আবার পাশের পাতের ধাক্কাতে জেগে উঠেছে তার কি কোনো ঠিক আছে! ভূত্ত্বের তাত্ত্বিক বৈশিষ্টের মতই এখানকার আবহাওয়াও বড়ই অদ্ভুত। সেপ্টেম্বর থেকে জুন মাস অবধি যে কোনো সময় বরফ পড়তে পারে। সূর্য্যদেবের দেখা পাওয়া ভার। মেঘ কারণে অকারণে এসে ভিজিয়ে দেবে স্বেচ্ছায়। ঝোড়ো হাওয়া তার সঙ্গী হলে সব মিলিয়ে পথযাত্রীদের হয়রানির একশেষ। সেই কারণে স্নোডোন যাত্রা শুরু হওয়ার আগে সর্বত্র সাবধান বাণী থাকে – আবহাওয়া খারাপ হলে সেই মুহুর্তে যাত্রা বাতিল করে ফিরে আসতে। তা সত্ত্বেও সারা বছরই স্নোডোনের অভিযাত্রীদের উদ্ধার করতে হয় হেলিকাপটারের সাহায্যে। বছর চারেক আগে আমাদের স্নোডোন অভিযান যে মাঝ পথে থামিয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল, তার মূলেও ছিল এক ভয়ানক কালো মেঘ। সেদিন আমাদের মত আরও অনেকেই বিফল মনোরথে ফেরার পথ ধরেছিল।
এবার যথেষ্ট খোঁজ খবর নিয়ে রিতীমত কোমর বেঁধে পথে নেমেছি। তাই এ
যাত্রায় আমাদের সাময়িক বাসস্থান ল্যানবেরিস গ্রাম। এই গ্রাম শুধু যে
স্নোডোনের পাদদেশে অবস্থিত তাই নয়, স্নোডোন আরোহণের ৬টি রাস্তার মধ্যে
অপেক্ষাকৃত সহজ রাস্তার শুরু এই গ্রাম থেকে।
স্নোডোন জাতীয় উদ্দ্যানের মধ্যমণি স্নোডোন পর্ব্বত। এই পর্ব্বত শৃঙ্গে
পৌঁছাবার যে ছটা পথ রয়েছে তাদের ৈদর্ঘ্য এবং বন্ধুরতা ভিন্ন।
পর্ব্বতারোহীরা তাদের দক্ষতা ও ক্ষমতার উপর নির্ভর করে ল্যানবেরিস পথ,
মাইনারস পথ, ওয়াটকিন পথ, রেঞ্জার পথ, পিগ পথ অথবা রিড-ডু পথ বেছে নেয়।
এদের মধ্যে সবথেকে সুদৃশ্য পথ মাইনারস পথ, হয়ত সেই জন্যেই স্থানীয় লোকেরা
সব সময় উৎসাহ দেয় এই রাস্তা অনুসরণ করতে। কিন্তু আমাদের পূর্ব অভিঞ্জতা
বলে অসামান্য সুন্দর এই পথের শেষ কয়েক মাইল এতই খাড়া ঢাল যে রাস্তা সে
অর্থে নেই বললেই চলে। যে যেমন ভাবে পাহাড়ের ঢাল আঁকড়ে ধরে এগোতে পারবে
সেটাই তার পথ। কাজেই এবারও যখন প্রাতরাশের টেবিলে আমাদের ‘বেড আ্যান্ড
ব্রেকফাস্ট’ এর মালিক উপদেশ দিল মাইনারস পথ ধরার তখন যারপরনাই অবাক হলাম।
যে গ্রাম থেকে সহজতম পথের শুরু সেখানকার বাসিন্দা কিনা বলে ‘শেরপা’ বাস ধরে
আরও ৮ কিলেমিটার দূরে গিয়ে যাত্রা শুরু করতে! রহস্যটা কি!কিন্তু আমার
নিজের ফিল্ড ওয়ার্কের পারদর্শিতার ওপর অগাধ আস্থা। তাই এসব উপদেশ নস্যাৎ
করে বীরাঙ্গণার মত রওনা দিলাম ল্যানবেরিস পথের উদ্দ্যেশ্যে। পথে একটা ম্যাপ
সংগ্রহ করলাম। ভূ-পর্যটকের কি মানচিত্র না হলে চলে!
নির্দেশিকা অনুযায়ী রেলস্টশনের কয়েকশো গজ দক্ষিণে ভিক্টোরিয়া স্টেপস্
দিয়ে ল্যানবেরিস পথের শুরু। এখানে বলে রাখি ওয়েলশ ভাষায় ‘লাথ’ অর্থ গজ।
অত্যন্ত চড়াই পথ হলেও পিচ বাঁধানো রাস্তা দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠল।মনে
মনে তুলনা করে নিলাম মাইনারস পথের সাথে। আহা! এমন রাস্তা দিয়ে সোজা
স্নোডোনের মাথায় পৌঁছোতে কত আর সময় লাগবে! মাত্র মিনিট কুড়ি যাবার পরই
নির্দেশ বঁা দিকের পশুচারণ জমিতে ঢোকার। ব্যাস্, ছেড়ে দিলাম সাধের রাস্তা –
শুরু করলাম সাধ্যের রাস্তা ধরে হাঁটা। এখান থেকে বাঁ দিকে পড়ে ‘ইলিডির
ফয়ার’ পাহাড়ের ঢালে পরিত্যক্ত স্লেট খনি আর তার পাদদেশে ‘লিন পেরিস’
হ্রদ। এই হ্রদের জল কে ব্যবহার করে ‘ডিনোরিগ’ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে
এবং এটি ইউরোপের সর্ব্ববৃহৎ।
পথ চলেছে রেললাইনের সমান্তরালে। ১৮৯৬ সাল থেকে এক কামরার ছোট্ট ট্রেন
উৎসাহী পথিক কে পৌঁছে দেয় স্নোডোন পর্ব্বতের একেবারে মাথায়। অল্প কিছুদূর
পথ পাড়ি দেবার পর একটা বাঁকে প্রথমবার রেল ব্রীজ পেরোনোর পরই সামনের
হিমবাহ অধ্যুষিত উপত্যকা যেন নিজেকে মেলে ধরল। অদ্ভুত নামের সব পাহাড় –
ফোয়েল গছ্, মোয়েল এলিও, আসলে এগুলো সবই হিমবাহের প্রবল ক্ষয়ের ফলে তৈরী
হয়েছে। মূল উপত্যকাটি একটি চওড়া U আকৃতির উপত্যকা, একটা শীর্ণ নদী তার
মধ্যে বয়ে চলেছে তিরতির করে আর এই উপ্যকার সাথে এসে জুড়েছে অসংখ্য ঝুলন্ত
উপত্যকা। প্রায় প্রতিটা ঢালের উপরদিকে ইজিচেয়ারের মত ‘করি’ এখনও
প্রতীয়মান যা কিনা হিমবাহের উর্দ্ধপ্রবাহের ক্ষয়ের সাক্ষী। মাত্র ১৮,০০০
বছর আগে শেষ হওয়া হিমযুগ এসবের কারিগর।
স্নোডোন আক্ষরিক অর্থে ভূ-তত্ব বিদ্যার জীবন্ত মিউজিয়াম। প্রিকেম্ব্রিয়ান যুগ থেকে সিলুরিয়ান যুগ অবধি ভঙ্গিল পর্ব্বত গঠন, তার ক্ষয়, সমুদ্রতলে নিমজ্জিত থেকে আগ্নেয়গিরি হিসেবে জেগে ওঠা – এরকম কত যে অজস্র ঘটনার সাক্ষী, সেই তুলনায় শেষের হিমযুগের হিমবাহের কার্যকলাপ একেবারেই হালের ঘটনা।
স্নোডোন আক্ষরিক অর্থে ভূ-তত্ব বিদ্যার জীবন্ত মিউজিয়াম। প্রিকেম্ব্রিয়ান যুগ থেকে সিলুরিয়ান যুগ অবধি ভঙ্গিল পর্ব্বত গঠন, তার ক্ষয়, সমুদ্রতলে নিমজ্জিত থেকে আগ্নেয়গিরি হিসেবে জেগে ওঠা – এরকম কত যে অজস্র ঘটনার সাক্ষী, সেই তুলনায় শেষের হিমযুগের হিমবাহের কার্যকলাপ একেবারেই হালের ঘটনা।
চলতে চলতে খেয়াল করিনি কখন সূর্য্য মধ্যগগনে পৌঁছেছেন আর আমাদের পথও
ক্রমশ খাড়া হতে সুরু করেছে। প্রবল ক্ষিদে আর ক্লান্তি প্রায় জোর করেই মনে
করিয়ে দিল আমরা চলেছি এক পর্ব্বতারোহণে – যে সে রাস্তা তো নয় যে গল্প
করতে করতে ফুরিয়ে যাবে! ততক্ষণে দূরে দেখা যাচ্ছে ‘হাফ ওয়ে হাউস’ কফির
দোকান অর্থাৎ স্নোডোন পর্ব্বত শৃঙ্গের ঠিক অর্ধেক উচ্চতা আমরা প্রায়
পেরিয়ে এসেছি। এই জনহীন পাহাড়ে ‘হাফ ওয়ে হাউস’ এ ক্লান্ত পথিকরা দু-দন্ড
জিরিয়ে নেবার সাথে বাকি পথের রসদও জোগাড় করে নেয়। এক কাপ চা খেয়ে আবার
হাঁটতে শুরু করলাম।
এখান থেকে দূরের রাস্তা দেখা যাচ্ছে এঁকে বেঁকে পাহাড়ের গা দিয়ে যেন
শূণ্যে মিশেছে। চলমান সারিবদ্ধ কিছু মাথা শুধু দৃশ্যমান। রাস্তার ডানদিকে
এক পাহাড়ের চূড়া, একটু আগেও মেঘে ঢাকা ছিল, মেঘ সরতেই তার রূপ স্পষ্ট হল –
এটি আসলে বহু বহু বছর আগের ভঙ্গিল পর্ব্বতের অধভঙ্গ বা সিনক্লাইন অংশ। যার
থাকার কথা উপত্যকা অঞ্চলে – প্রকৃতির খেলায় তার স্থান হয়েছে পাহাড়ের
মাথায়। হিমবাহের ক্ষয়ের ফলে এই পাহাড়ের ঢালে সবুজ জলের লিন ডু আরডু হ্রদ
সৃষ্টি হয়েছে। সবুজ হ্রদের মুগ্ধতা নিয়ে আবার রেলব্রীজ পেরোলাম। সাথে
সাথেই যেন দৃশ্যান্তর হল কোন এক অদৃশ্য পর্দা সরিয়ে। এখানে পথ অত্যন্ত
সংকীর্ণ, অতি সন্তর্পণে পা ফেলতে হয়। অামাদের পথটুকু যেন আটকে দিয়েছে ঢেউ
খেলানো উপত্যকাকে। অসামান্য সুন্দর এই পার্ব্বত্যাঞ্চলের একখন্ড প্রতীক এই
উপত্যকা। সবুজ পাহাড়ের প্রায় প্রতিটা বাঁকে ঘন নীল হ্রদ। তার পাড় দিয়ে
পায়ে চলা পথ। ক্ষণিকের মধ্যেই সব আচ্ছন্ন করে ধেয়ে এল মেঘ। একেতেই খাড়া
শৈলশিরার মাথার উপর দিয়ে চলেছি, তাতে চারদিক অন্ধকার, বৃষ্টিতে পথ আরও
পিচ্ছিল। পাথরে পা সমানে পিছলে যাচ্ছে। স্নোডোনের কঠিন রূপ না দেখে বোধহয়
কারোর যাত্রা সম্পুর্ণ হয়না!
একটু পরে বৃষ্টি থামলেও রাস্তা ক্রমশ প্রায় ৭০ ডিগ্রী ঢালে সোজা উপরে
উঠে গেছে। এক পা করে এগোলেও দম ফুরিয়ে যাচ্ছে অচিরেই। ল্যানবেরিস পথের
সবথেকে কঠিন অংশ এটি। স্নোডোন শৃঙ্গ প্রায় হাতের মুঠোয়, তবু এই পথটুকু
অনন্ত। এভাবে ৪০মিনিট শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে চলার পর হঠাৎ করেই যেন সমতলে
এসে পরলাম। রোদ্দুরও যেন হেসে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। সামনে একটা পাথরের
স্তম্ভে লেখা ‘কোপা’ অর্থাৎ সামিট। একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল অজান্তেই।
এখান থেকে চারপাশের অন্তত গোটা ১২ শৃঙ্গ, ১৮ টা হ্রদ দেখা যায়। হঠাৎ তাতাই
দেখাল অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে আটলান্টিক সমুদ্র তটরেখা। অপুর্ব সে দৃশ্য যা
ভাষায় প্রকাশে আমি অপারক।কিছু ক্ষণ এভাবে সম্মোহিত থেকে যতটা সম্ভব মনের
ক্যামেরায় বন্দী করে প্রকৃতির এই অনবদ্য সৃষ্টিকে প্রণাম জানিয়ে ফেরার পথ
ধরলাম।


সর্পিল পথ ধরে পাথরের পর পাথর ডিঙিয়ে যখন ল্যানবেরিস গ্রামের মধ্যে এসে পৌঁছোলাম তখন প্রায় সন্ধ্যে নামছে। অসম্ভব ক্লান্ত শরীর কিন্তু মনের মধ্যে একটা অপার তৃপ্তি স্নোডোন জয়ের। প্রকৃতিকে জয় করা হয়ত সম্ভব নয়, তবু তাকে স্পর্শ করার আকর্ষণ অমোঘ। তাই ওয়েলশ থেকে ফিরে এসেছি ঠিকই কিন্তু আবার কখন যে ছুটে যাব স্নোডোনের টানে, হয়ত বা অন্য কোনো পথের সন্ধানে, তা কে জানে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন