ব্রিটেনে জানুয়ারী মাসে বরফ পড়বে এ তো স্বাভাবিক, কিন্তু মাসের ৩১
দিনের মধ্যে যে দিন ৩মাস আগে থেকে বুকিং করা, সেই দিন গুলোতেই বিনামেঘে
বরফপাত হওয়া অস্বাভাবিক নয়কি। ২০১৩ র জানুয়ারিতে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল বাথ
ভ্রমণের সময়। ‘বাথ’ – কি অদ্ভুত নাম শহরের। স্নানাগার বা স্নান – এমন নাম
কি আমরা কোনো শহরের রাখতাম কষ্মিনকালেও। অথচ ব্রিটেনের বাথ শহরটিকে UNESCO
স্বীকৃতি দিয়েছে ‘World Heritage Site’ হিসেবে কারণ এই শহর প্রায় ২০০০
বছরের প্রাচীন, এর শরীরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে রোমান সময় থেকে
ভিক্টোরিয়ান সময়ের ইতিহাস।
বরফের আস্তরণে ঢেকে আছে চারদিক। এর মধ্যে প্রায় ১০০ মাইল যাত্রা তাও
রাতের অন্ধকারে – কিন্তু ভ্রমণপ্রিয় বাঙ্গালী বলে কথা! আমরা কি ডরাই কভু
শীতল বরফে! যেই ভাবা সেই কাজ। দূর্গা নাম জপে সন্ধ্যে ৭টা নাগাদ যাত্রা
শুরু করলাম। বাথ ইংল্যন্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। আমাদের বাড়ি চেশাম
থেকে হাইউইকম্ব হয়ে মোটরওয়ে ৪০ এবং মোটরওয়ে ৪ ধরে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই
পৌঁছানো যায় বাথে যে কোনো স্বাভাবিক দিনে। সেদিন অঝোরে বরফ পড়েই চলেছে,
পশ্চিমে এগোনোর সাথে সাথে তা বৃষ্টিতে পরিণত হল। রাস্তার দৃশ্যমানতা প্রায়
নেই বললেই চলে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা খুবই কম আর সবাই অতি সাবধানে
ধীরগতিতে চলছে কারণ এরকম অবস্থায় গাড়ির ওপর চালকের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ
থাকা সম্ভব নয়। এভাবে প্রায় ২ ঘন্টা চলার পর পথে এক সার্ভিস স্টেশনের
(বিলেতের সরাইখানা) দেখা পেলাম। রাতের খাবার সেরে ফেলার আশায় তাতে ঢুকে
দেখি চারদিক খাঁ খাঁ করছে, দোকানপাট সব বন্ধ, কোনো জনমন্যিষ্যি নেই – ভৌতিক
পরিবেশ। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে দোতলায় উঠে দেখি একটা মাত্র দোকান খোলা,
তাও আবার এক সহৃদয় ভারতীয়ের। আমরা তাকে দেখে যারপরনাই খুশি হলাম, কিন্ত
তিনি ততোধিক খুশি হয়ে আমাদের অনেক খাতির যত্ন করলেন।
এর পরের পথ অত্যন্ত খারাপ। ঘন কুয়াশায় আবৃত চারদিক। রাস্তার পাশের বরফ
বাতাসে উড়ে এসে জমা হচ্ছে রাস্তায় আর তা গাড়ি চলাচলের পক্ষে ভয়ানক।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমরা এসে পৌঁছালাম বাথ এ। শহরে ঢুকে
প্রথমেই মনে হল ইতিহাসের মধ্যে এসে পড়লাম।
বাথ – ব্রিটেনের একমাত্র উষ্ণ প্রস্রবণকে ঘিরে গড়ে ওঠা শহর। এটি Aqual
Sulis বা Aqual Caldiac নামে পরিচিত ছিল যার আক্ষরিক অর্থ গরম জল।
খ্রীষ্টিয় প্রথম শতকে ব্রিটেনের দক্ষিণভাগ রোমানরা অধিকার করে নেয়। এ
অঞ্চলে তখন ‘দোবুন্নি’ আদিবাসীদের বাস, তারা উষ্ণ প্রস্রবণকে দেবতাঞ্জানে
পূজো করত। ‘দবুন্নি’দের পরাক্রান্ত করলেও রোমানরা ‘সুলিস‘ দেবীর আক্রোশে
পড়তে চায়নি। দেবীর প্রসন্নতার আশায় রোমান কারিগরী বিদ্যার সহায়তায়
প্রায় ১৫ বছরের চেষ্টায় উষ্ণপ্রস্রবণকে কেন্দ্র করে খ্রীষ্টিয় ৭৫ সালে
সুলিস মিনার্ভা দেবীর মন্দির তৈরী করে। পরবর্তীকালে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ
লুপ্ত হলেও মন্দির সংলগ্ন স্নানাগার এখনো বর্তমান তার ২০০০ বছরের স্মৃতি
নিয়ে। তারই আকর্ষণে আমরাও ছুটে এসেছি তুষারঝড় উপেক্ষা করে।
সকালে রাস্তায় বেড়িয়ে বুঝতে পারলাম গতদিনের ভয়াবহতা। প্রায় ৬ ইঞ্চি
বরফে ডুবে আছে গোটা শহর। গুটি পায়ে হাঁটা ছাড়া অন্য উপায় নেই। এগারো
বর্গমাইলের এই শহরের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত ‘এভন’ নদী। এভন নদী পেরিয়ে একটু
এগোতেই ক্যাথিড্রালের চুড়া দেখা গেল। সেই চূড়া বরাবর শহরের একেবারে
কেন্দ্রে এই ‘রোমান বাথ’ অবস্থিত। বস্তুত ‘রোমান বাথ‘কে কেন্দ্র করে এই শহর
গড়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের আনাগোনায়
সারাবছরই ব্যস্ত থাকে বাথ। রোমান সময়েও বহু দূর-দূরান্ত থেকে ১৮ মাস বয়স
থেকে শুরু করে ৮৬ বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আসত সুলিস মিনার্ভা দেবীর পীঠস্থানে
রোগমুক্তির আশায়।
রোমানদের প্রযুক্তিবিদ্যার পারদর্শিতা এই স্নানাগারের প্রতিটা কোণে
স্পষ্ট। উষ্ণপ্রস্রবণের চারদিক দস্তাপাত দিয়ে ঘিরে সেই জল সুচারু ভাবে ছোট
ছোট নালা দিয়ে স্নানাগারের বিভিন্ন ঘরে পাঠানো হত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
করে। রোমানদের সামাজিক জীবনে এই স্নানাগারের একটা বড় ভুমিকা থাকত। কারণ সে
সময়ে স্নান করা ছিল রিতীমত বিলাসিতা। এই বাথটিতে একটা ঘর ছিল স্টীম নেবার
জন্য, এখনকার সাওনা বাথ এর আদলে- যেখানে দাস-দাসী থাকত গায়ে সুগন্ধী তেল
মাখিয়ে দেবার জন্যে। এর পাশে ছোট ঘর বেশ কয়েকটি যাতে কম তাপের জল রাখা
থাকত – এখানে কিছু সময় কাটিয়ে তারপর প্রধান স্নানাগারে যাওয়া যেত যার
উষ্ণতা ৪৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। এই গ্রেট বাথটিতে গরম জল আসত সরাসরি
প্রস্রবণ থেকে। হাজার বছর আগে গ্রেট বাথটি ছিল শহরের সামাজিক খবর আদান
প্রদানের মুখ্য কেন্দ্র। এখানেই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থেকে শুরু করে
দিন মজুর অবধি সবাই জমা হত এবং কোথায় কি ঘটছে, নতুন কি আইন তৈরী হচ্ছে,
জিনিষের দাম কতটা ওঠানাম করছে – সব কিছু বিস্তারিত আলোচনা হত গ্রেট বাথে
স্নান করতে এসে। এর পরের ঘরে থাকত ঠান্ডা জল যেখানে স্নান করার পর সম্পূর্ণ
হত স্নান পর্ব।
বিষ্ময়ের ঘোরকে সঙ্গী করে সুলিস মিনার্ভা দেবীর উদ্দ্যেশ্যে প্রণাম
সেরে বেরোবার ঠিক মুখেই দেখি একটা কল থেকে অবিরত উষ্ণপ্রস্রবণের পান যোগ্য
জল বেরোচ্ছে। এই জল খেয়ে আমার ছোটবেলার কৃষ্ণনগরের বাড়ির সামনের
টিউবয়েলের জলের স্বাদ মনে পড়ে গেল। অনেকটা সেই রকম কষ্ স্বাদের যদিও এতে
বারুদের গন্ধ অত্যন্ত বেশী কারণ ৪২ রকম ধাতু সমৃদ্ধ এই জলে সালফেটের পরিমাণ
অত্যন্ত বেশী। ভৌগোলিক ভাবে এটি একটি জিওথার্মাল প্রস্রবণ। প্রায় ১০,০০০
বছর আগে বাথ অঞ্চলের দক্ষিণে অবস্থিত ‘মেন্ডিপ’ নামক চুনাপাথরের পাহাড়ে
বৃষ্টির জল চুঁইয়ে প্রায় ১৪,০০০ ফুট নীচে জমা হয় যেখানে তাপমাত্রা ৬৯
ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। সেই তাপের সংস্পর্শে এসে এবং পরবর্তি কালে ভূ-ত্বকের
ফাঁক ফোকর খুঁজে এই জমা জল বেড়িয়ে আসতে শুরু করে উষ্ণ প্রস্রবণ হিসেবে।
এখান থেকে বেড়িয়ে কয়েক পা এগোলেই বাথ আ্যবি চার্চ। বরফাবৃত চত্তরে
সেই কয়েক পা এগোতেই মানুষজনকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এক মহিলা আমাদের সামনেই
সপাটে আছাড় খেলেন, আমিও বেশ কয়েকবার হড়কেও যে কি করে শেষ অবধি সামলালাম
জানিনা। এই বাথ আ্যবিও প্রায় হাজার বছরের পুরোনো। ব্রিটেনের গথিক
আর্কিটেকচারের সুন্দর উদাহরণ স্বরূপ এই চার্চটি বহুবার আগুন ও যুদ্ধে
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অতীতে। ধর্মীয় প্রভাব ছাড়াও সামারসেট অঞ্চলের সামাজিক
জীবেনেও এই চার্চের অবদান অনস্বীকার্য।
ইংল্যন্ডের ইতিহাসে বাথ স্ব-মহিমায় মহিম। এলিজাবেথের সময়ে বাথ প্রথম
শহরের মর্যাদা পায়। ষোড়োশ শতকের মধ্যভাগে গৃহযুদ্ধের সময় প্রথম চার্লসের
প্রধান ঘাঁটি ছিল বাথ। জর্জিয়ান যুগে বাথ শহরের সম্পূর্ণ নবীকরণ করেন
স্থপতি জন উড ও তার পুত্র জুনিয়ার জন উড। রাস্তার নক্সা বদলে বেশ কয়েকটি
গোলাকৃতির প্রাসাদতুল্য বাড়ি নির্মাণ করেন যা ‘সার্কাস’ ও ‘রয়্যাল
ক্রেসেন্ট’ নামে পরিচিত।
বরফে ঢাকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বহুবার পিছ্লে, কোনোমতে সামলে শহরটা
সম্পূর্ণ ঘুরে যখন ফিরছি তখন আবার ঝিরঝির করে বরফ পড়তে শুরু করেছে, দূর
থেকে গিটারের সুর ভেসে আসছে। পরদিন চেশাম ফিরে আসার সময় বাথের এক
ওরিয়েন্টাল মিউজিয়ামের মালিকের কথা বার বার মনে পড়ছিল- সে ও তার স্ত্রী
বাথে কয়েকদিনের জন্যে বেড়াতে এসে শহরটাকে ভালোবেসে সেখানেই তাদের বাসা
বেঁধেছে। সুলিস মিনার্ভা দেবীর আকর্ষণ ক্ষমতাকে অস্বীকার করি কি করে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন