বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০১৪

মালয়েশিয়ায় নয় দিন (পার্ট-তিন)

পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারঃ
সময়ের অভাবে দুবাইতে বুর্জ খলিফাতে উঠতে পারি নাই জন্যে মনের মধ্যে একটা আফসোস ছিলো। এই আফসোস যেন দ্বিতীয়বারের মতন সঙ্গী না হতে পারে, সেজন্যে সবাইকে সাতসকালে উঠিয়ে, নাস্তা না করেই পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের পথে যাত্রা করলাম। আমরা ধীর গতিতে হেটে অফিসগামী যাত্রীদের সাথে মোটামুটি আধা-ঘন্টার মধ্যে পৌছে গেলাম টুইন টাওয়ারে। টাওয়ারের গায়ে ঠিকরে পরা সকালের সূর্যালোক এক অদ্ভুত সৌন্দর্য্য তৈরী করেছিলো। সকাল সকাল এখানে চলে আসার কারণ ছিলো কাজিনের দেয়া এক তথ্য। ও বলেছিলো যে, এখানে সকাল সাড়ে আটটা থেকে প্রথম একহাজার জনকে ফ্রী-টিকেট দেয়া হয়। আমরা দুই টাওয়ারের মাঝামাঝি অংশে যেখানে সুরিয়া শপিং মল, সেখান দিয়ে দ্রুত ভিতরে প্রবেশ করলাম। তারপরে বিভিন্ন জায়গায় টিকেট কাউন্টারের দিকে যাওয়ার নির্দেশনা দেখে খুব সহজেই টিকেট কাউন্টার খুঁজে পেলাম। এটা ছিলো আন্ডারগ্রাউন্ডে। সিড়ি দিয়ে নেমেই নিচের ফ্লোরের ঝকঝকে চকচকে অন্দরমহলের বামদিকের এক জায়গায় মেঝেতে একটা কালো লাইন আঁকাবাঁকা করে আঁকা, আর লেখা “লাইন স্টার্টস হিয়ার”। আর একপাশে টুইন-টাওয়ারের একটা চমৎকার মিনি মডেল। তারপাশেই ছিলো একটা চেম্বার, যেখানে সামনের বিশাল স্ক্রীনে আপনি নিজের চেহারা দেখতে পাবেন ক্যামেরার কল্যাণে। আরও ছিলো কিছু টাচস্ক্রীন যেখান থেকে আপনি টুইন টাওয়ারের তাবত ইতিহাস জেনে নিতে পারবেন। আমরা অন্যান্য পাবলিকের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এতো সকালেও আমাদের সামনে মোটামুটি অনেক লোক লাইনে দাঁড়ানো ছিলো। একটু পরেই দেখি জ্যাকি-চ্যান মুভির টাক্সিডো পরিহিত এক সুদর্শন ভিলেইন আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। ব্যাটা এসে আমরা কয়জন অ্যাডাল্ট, আমাদের ন্যাশনালিটি কি, কয়টা টিকেট লাগবে এসব একটা কুপনে টুকে সেটা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলো। সেই সাথে টিকেটের মূল্যও! আমরা কিছুটা হতচকিত হয়ে ব্যাটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাই, আমরাতো হুনছিলাম যে, প্রথম হাজারজনরে ফ্রী টিকেট দেন আপনেরা?” এটা শুনে টাক্সিডো পরিহিত সুদর্শন জিঙ্গালুর-জংলা ভয়ংকরভাবে হু-হা হা হা শব্দে না হেসেই বললো, “ইয়েস, দ্যাট ওয়াজ কারেক্ট। বাট ফর দ্যা লাস্ট থ্রি-ইয়ারস উই আর তেকিং টিকেট প্রাইস। নট ফ্রী এনিমোর।” লে ঠ্যালা! ভেবেছিলাম এটাতে ফ্রী চড়ে কে.এল টাওয়ারে ৩৫ রিঙ্গিতে উঠে বান্দরের মতন ঝুলাঝুলি করে আসবো। এখন এটাতেই জনপ্রতি খরচ হলো ৮০ রিঙ্গিত করে। অবশ্য আপনি যদি মালয় হন, তাহলে খরচ মাত্র ৩৫ রিঙ্গিত। তবে সে ক্ষেত্রে আপনাকে আপনার মালয় পাসপোর্ট বা আইডি কাউন্টারে দেখাতে হবে।







সকালবেলা তাড়াহুড়ো করে বের হওয়ায় টন্ডাস করা হয়নি। হঠাতই আসা প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে টিকেট কাউন্টারের ফ্লোরেই জরুরী ভিত্তিতে টান্ডাস খুঁজে বের করলাম। সেই সকালবেলা টান্ডাস পুরোপুরি ফাঁকা। প্রেসার রিলিজ করতে যেই না টয়লেটে ঢুকেছি, কমোডের হাল দেখে অটোমেটিক প্রেসার গায়েব হয়ে গেলো। টয়লেটে কোন হ্যান্ডগান নেই! তার বদলে কমোডের ভিতরে উপরের দিকে পানি বের হওয়ার নল রয়েছে, যেটা কিছুটা উপরে-নিচে সরিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় কমোডের ঠিক পাশে থাকা সুইচ দিয়ে! এসব কাহিনী দেখে বের হয়ে আসলাম। সবাই নাস্তা না করায় ক্ষুদার্থ। ভবনের ভিতরের খাবারের দোকানে গলা কাটার চাইতে বাইরে বেরিয়ে খাওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে হলো। আমরা বের হয়ে টুইন টাওয়ারের ঠিক উল্টো দিকে, রাস্তার অন্যপাশের ফুটপাতের উপরের আল-ছালাদিয়া মাল্লু দোকান থেকে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। সেই সকালবেলাতেও আমরা টিকেট পেয়েছিলাম দুপুর বারোটার। তখন ঘড়িতে বাজে মাত্র নয়টা পনেরো! এতক্ষণ কি করবো? উদ্ধারকর্তী হয়ে এগিয়ে এলো আমার টোকাই বৌ। ওর টোকানো একটা লিফলেটে দেখলাম পেট্রোনাসের সুরিয়া মলের চারতলায় আছে পেট্রোসেইন্স (পেট্রোসায়েন্স) এবং ঐ লিফলেট দেখালে জনপ্রতি ২৫ রিঙ্গিতে খরচের সাথে আরেকটি টিকেট কিনলে তার মূল্য অর্ধেক! আমরা দুইজনই সেখানে যেতে আগ্রহী হলাম। কিন্তু সেতু ভাই আর সুমি আপুর কি হবে? ওনাদের এইসব বিজ্ঞানের আতলামী ভালো নাও লাগতে পারে। এবারও আমার বৌ টু দি রেসকিউ। ও দেখি সুমি আপুকে, কেন আমাদের এটাতে যাওয়া উচিত, কেন এটা ওয়ান্স এ লাইফটাইম অপরচুনিটি, এসব বুঝিয়ে রাজি করিয়ে ফেললো।

পেট্রোসায়েন্সে এসে দেখি সেখানে একটা সায়েন্স ফেয়ারও চলছে। আমরা টিকেট কেটে ঢোকার আগে আমাদের ব্যাগগুলো লকারে ঢুকিয়ে রাখলাম। এজন্য আলাদা কোন চার্জ দিতে হয়না। মনে রাখার সুবিধার জন্যে স্ত্রীকে একটা সহজ নাম্বার দিলেও, সে কথা না শুনে আরও সহজ একটা নাম্বার (তার দাবী অনুযায়ী) দিয়ে লকার লক করে দিলো। প্রথমের ভিতরে একটা অন্ধকার টানেলের সামনে থেকে ডিম্বাকৃতির ক্যাপসুলে চেপে বসলাম। সেই টানেলের ভিতর দিয়ে সেটা চলা শুরু করলো। প্রথমে জঙ্গল জাতীয় লতাপাতা এলাকার ভিতর দিয়ে চলতে থাকলো। তারপরে একেকবার টানেলের একেকপাশে প্রজেকশনের মাধ্যমে দেখাতে থাকলো কিভাবে মানুষ আবির্ভাবের পর থেকে আস্তে আস্তে সভ্যতার আধুনিকতার দিকে ধাবিত হতে থাকে। পিছনে ধারাবিবরণী চলছিলো। এভাবে কিছুদুর গিয়ে একটা প্ল্যাটফর্মে এসে থামলো। সেখান থেকে শুরু হলো বিভিন্ন ধরনের সায়েন্স প্রজেক্ট দেখা। প্রথমেই দেখলাম গ্লাসের ভিতরে আটকানো চার্জড প্লাজমা, যেগুলো গ্লাসের বাইরে হাত রাখলে স্পর্শকৃত আঙ্গুলের মাথা পর্যন্ত অদ্ভুত ধরনের রঙয়ের টেউ তৈরী করে উঠে আসছিলো। তারপরে দেখলাম একটা ফোনবুথ। উপরে লেখা “ফিল দ্যা হারিকেন”। সেখানে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেই সর্বোচ্চ ১৩০ কিমি/ঘন্টা বেগে বাতাস এসে আছড়ে পরে শরীরের উপরে। সবাই সেটার মজা নিলো। সবার চুল এলোমেলো হয়ে একাকার অবস্থা। আমিও খুব উৎসাহ নিয়ে ঢুকলাম। এবারেও আমাকে হতাশ করে চুল ডিফারেন্সিয়াল-এক্স পরিমাণই নড়লো।


গ্লাস টিউবের ভিতরে প্লাজমা

প্রিজমের সাহায্যে তৈরী দৃষ্টিভ্রম

আমরা ছাড়া পেট্রোসায়েন্সে তেমন কোন পর্যটক ছিলো না। সব ছিলো স্থানীয় বিভিন্ন স্কুলের শিশুকিশোররা। সায়েন্স ফেয়ারে অংশ নিতে ছিলো অনেক ভলান্টিয়ার। তারাও মনেহয় স্থানীয় কলেজ বা স্কুল থেকে এসেছিলো। এরকমই এক ছেলে টেবিলে তলাবিহীন কাপ নিয়ে বসে আছে। সামনে গেলে আমাকে বললো যে, এই তলাবিহীন কাপটা দিয়ে তুমি সামনে রাখা বলটা কি পরের তিনটা কাপে নিয়ে যেতে পারবে? আমি বললাম, “হ্যাঁ পারবো। পারলে কি কোন গিফট দিবা?” ছেলেটাকে একটু হতচকায় দিতে কথাটি বলেছিলাম। কিন্তু ছেলে বহুত স্মার্ট নিকলা। বললো, “ইয়েস, দ্যান আই উইল গিভ ইউ আ গিফট অফ ইনফরমেশন।” যাই হোক, কাপের নিচের অংশে বলটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তুলে পরের কাপে ফেললাম। কেন্দ্রমুখী বলের কারণে যে এটা হয় সেটাও বললাম। ছেলেটা তারপরেও আরও সুন্দর করে ক্লাসিকাল ফিজিক্সের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললো। এডিকারেন্ট এফেক্টের কারণে কিভাবে একটা তামার তৈরী ফাপা সিলিন্ডার দন্ডের ভিতর দিয়ে একটা ভারী চুম্বক একটা হালকা বস্তুর চাইতেও আস্তে আস্তে পড়ে সেটা ডেমনস্ট্রেট করে দেখালো আরেকজন। সেন্টার-অফ-গ্র্যাভিটি ঠিক করার জন্যে যে কোন বস্তু একটা ঢালের উপরের দিকেও উঠে যেতে পারে সেটাও দেখলাম এক জায়গায়। রোবটের সাহায্যে ফুটবল খেললাম স্ত্রীর সাথে। খেলা ২-২ গোলে ড্র। মজার জিনিস হচ্ছে প্রতিটা গোলের পরে ছোট রোবটগুলো বনবন করে ঘুরে সেলিব্রেট করে! আরেক জায়গায় স্ট্যান্ডে লাগানো প্লেনের ডেমো মডেল উড়ালাম। এরপরে ৩ রিঙ্গিত করে টিকেট করে ৫-৬ মিনিটের একটা ভার্চুয়াল রোলার-কোস্টার রাইড নিলাম। চোখের সমস্যা থাকলে স্ক্রীনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। সহজ সমাধান। কিছুক্ষণ পরপর চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম।


টর্চারিং সেল (ভার্চুয়াল রোলার কোস্টার)

দেখতে দেখতে কখন যে দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেলো বুঝতেই পারি নাই। আমাদের টুইন টাওয়ার ট্যুরের সময় হয়ে গেলো। পেট্রোসায়েন্সওয়ালাদের এ কথা জানালে ওরা আমাদেরকে ওদের ব্যবহৃত একটা এক্সিট দিয়ে বাইরে বের করে দিলো, আর হাতে পরিয়ে দিলো একটা ব্যান্ড। বলে দিলো যে, আমরা ফেরত এসে আবার ভিতরে ঢুকতে পারবো ওটা দেখালে। বেশ ভালো ব্যবস্থা। আমরা দৌড়ায় দৌড়ায় একদম গ্রাউন্ডফ্লোরে নেমে আসলাম। হেভী-ডিউটি চেকিং শেষে আমাদেরকে উপরে ওঠার লিফটের সামনে নিয়ে আসা হলো। লিফটে ওঠার আগে ওদের ক্যামেরাম্যান আমাদের যুগল ছবি তুলে নিলো। ঠিক লিফটের সামনে অন্যান্য পর্যটকদের সাথে আমরা জড়ো হলাম। সেখানে একটা হলোগ্রাফিক ইমেজে আমাদের পেট্রোনাস স্কাই-ব্রীজ ও টাওয়ার সম্পর্কে ব্রিফ করা হচ্ছিলো। খুব অবাক হলাম হলোগ্রাম দেখে। কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করে ফাঁকিবাজিটা ধরে ফেললাম। পিছনে থেকে একটা প্রজেক্টর থেকে লাইট প্রজেকশন হচ্ছিলো কিছু নল থেকে বের হওয়া ধোঁয়ার উপরে। ধোঁয়ায় বাধা পেয়ে বাতাসের মধ্যে হলোগ্রাফিক ইমেজের মতন ইমেজ তৈরী হচ্ছিলো। আপনি যদি ধোঁয়া ফু দিয়ে এলোমেলো করে দেন, তাহলে ইমেজও এলোমেলো হয়ে যাবে। কনসেপ্টটা সিম্পল, কিন্তু চমৎকার।


হলোগ্রাফিক ইমেজ

আমরা প্রথমে লিফটে করে গেলাম ৪১ তলায়। এখানে দুই টাওয়ারকে সংযোগকারী বিখ্যাত স্কাইব্রিজ অবস্থিত। মূলত স্কাইব্রীজটি দোতলা। ৪১ এবং ৪২ দুই তলা মিলিয়ে স্কাইব্রীজ। কিন্তু উপরের তলাটি অফিসকর্মীরা ব্যবহার করে। নিচেরটি শুধুমাত্র পর্যটকদের জন্যে উন্মুক্ত। ভূমিকম্প আর বাতাসের ধাক্কা সামলানোর জন্যে প্রতিটি প্রান্তে স্কাইবীজের সাথে মূল বিল্ডিং এর দেয়ালের দিকে মাঝে কিছুটা দূরত্ব রাখা হয়েছে। উপর থেকে বেশ কিছু ছবি উঠালাম দুই পাশের। এর মধ্যে হঠাত এক পাশের একটা বিল্ডিং দেখে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। পূবালী ব্যাংক কুয়ালালামপুরে!? পরে ভালোমতন দেখি যে, ওটা আসলে পাবলিক ব্যাংক। দ্রুততার সাথে পড়তে গিয়ে পূবালী ব্যাংক দেখেছি। এই স্কাইব্রীজ থেকেই এক পাশে দূরে কিছু বস্তির ছবি তুললাম। ফ্রী-টিকেটের বদলে ৮০ রিঙ্গিতের ব্যাম্বু দিয়েছিলো জন্যে মেজাজ খারাপ করে ব্যাটাদের বদনাম করার জন্যে কাজটা করেছিলাম। স্কাইব্রীজ দেখা শেষ হলে আরেকটা লিফটে করে আমরা আরও উপরে উঠলাম। কত তলায় থেমেছিলাম মনে নেই। তবে সেখান থেকে একটা করিডোর পার হয়ে আরেকটা ছোট লিফটে উঠে পৌছে গেলাম একেবারে উপরের তলায়, অর্থাৎ ৮৭ তলায়। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু টুইন টাওয়ারের একটির সর্বোচ্চ তলায় আমি। ভাবতেই দারুণ লাগছিলো। অনেকের হাইট ফোবিয়া আছে। আবার অনেকের হাইট সিকনেস আছে। যেমন সুমি আপুর উপরে ওঠার পরে কান বন্ধ হয়ে মাথা ব্যাথা করা শুরু করলো। বেচারী এখানে ওঠা খুব একটা উপভোগ করতে পারেনি।

 
 

স্কাইব্রীজ থেকে তোলা দূরের বস্তি এলাকা

একদম উপরের তলা অর্থাৎ ৮৭তম তলাটা খুব সুন্দর করে সাজানো। একপাশে টুইন টাওয়ারের ব্যাপারে বেশ কিছু ইনফো দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক জায়গায় টাওয়ারের চমৎকার একটা মিনি মডেল রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে পুরো কুয়ালালামপুর শহরের একটা মডেল। বাইরের দিকে জানালার পাশে বেশ কয়েকটি বসার সোফার পাশাপাশি কিছু বায়নোকুলার লাগানো, যেগুলো দিয়ে আপনি কুয়ালামপুর শহরের অনেকদুর অংশ একদম চোখের সামনে এনে দেখতে পাবেন। প্রায় নয় বছর সময় নিয়ে বানানো এই স্কাইস্ক্র্যাপার দুটি উদ্বোধন করা হয় ১৯৯৯ সালে। একদিকে দেখলাম মাহাথির মোহাম্মাদ সাহেবের ছবি এবং বাণী ওয়ালে টাঙ্গানো। আরেকটা মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, কিছু মনিটর দেয়ালে ঝুলানো, যেগুলোর সামনে গিয়ে একটা বিশেষ এঙ্গেলে কাগজের টিকেট টা ধরলে মনিটরের মধ্যে নিজের হাতের উপরে টুইন টাওয়ারের ইমেজটা নিয়ে আসা যায়। টিকেটের বারকোডের মধ্যেই ওরা ইমেজ ইমপ্রিন্ট করে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে! ওঠার সময় এবং নামার সময় আরও একটা জিনিস খেয়াল করলাম, প্রতিবার লিফটে ঢোকার সময় টি টি করে হালকা একটা বিপের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো। লিফটে সবাই উঠে পড়লেই আওয়াজ বন্ধ। এটার কারণ খুব সম্ভবত কাগজের টিকেটের বারকোড ডিটেক্ট করে মাথা কাউন্ট করার ব্যবস্থা লিফটে করা ছিলো!


সাউথ টাওয়ার

পুরো কুয়ালামপুর শহরের মডেল

মনিটরে টিকেটের বারকোডে ইম্প্রিন্টেড ইমেজের প্রদর্শন

নিচে নেমে বের হয়ে আসার সময় ঢোকার সময়কার তোলা ছবি ফ্রেমে বাধাই করে সামনে তুলে ধরছিলো সেখানকার কর্মীরা। সেতু ভাইদেরটা বের করে যখন সেটার জন্যে ১০০ রিঙ্গিত চাইলো, তখন আমি আর কিছু না দেখে সিধা হাটা ধরলাম। ওরাও আমার ভাবভঙ্গি দেখে ডাক দিয়ে আমাদের ছবিটা দেখানোর কষ্ট করলো না। আমরা বের হয়ে আবার পেট্রোসায়েন্সে ফিরে গেলাম। আমাদের হাতে বাঁধা ব্যান্ড দেখে ওরা আমাদেরকে আবার বিশেষ পথ দিয়ে নিয়ে গেলো ভিতরে। যেখানে শেষ করেছিলাম, সেখান থেকে আবার দেখা শুরু করলাম। তেল কিভাবে তোলা হয় তার বিভিন্ন অংশের যন্ত্রাংশগুলোর কর্মপদ্ধতি দেখলাম। দেখলাম শ্যাডো ডিটেক্টরের মাধ্যমে কিভাবে স্ক্রীনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শয়তানী করা যায়। আরও দেখলাম দূর থেকে পেইন্ট গানের মাধ্যমে কিভাবে বড় স্ক্রীনের উপরে ইচ্ছেমতন পেইন্ট করা যায়। সবই রিমোট ইমেজিং। এক জায়গায় টাচ স্ক্রীনের উপরে নিচের নামের বাটিক বানালাম। এর মধ্যে একটা মিনি ডায়নোসর ওয়ার্ল্ডও ঘোরা হলো। এখান থেকে বের হয়েই পেলাম একটা লেগো-কার শপ। বিভিন্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট লেগোর যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে আপনি নিজের গাড়ি ডিজাইন করে ফেলতে পারবেন এখানে। আরেক জায়গায় বিভিন্ন শেপের পাখা বানিয়ে তা ঘুরিয়ে কারেন্ট জেনারেট করলাম। বস্তার ভিতরে শরীরের নিচের অর্ধাংশ ঢুকিয়ে একটা টানেলে ঢুকলাম। টানেলটার নাম হচ্ছে ডার্ক টানেল উইথ মেনি পসিবিলিটিজ। সেটার ঢাল বেয়ে যখন নিচে পড়বেন তখন কখনো স্লো যাবেন বা কখনো ফাস্ট, আর কখনো এমন একটা বাঁকে মোচড় খাবে শরীর যা হয়তো আপনি কল্পনাতেও আনেননি। এর মধ্যে এক জায়গায় একটু গলফ খেললাম। প্রথম শটেই বল জায়গামতন ফেলতে পারলাম। সেখানে থাকা কর্মীর চেহারা দেখে মনে হলো যেন বোঝাতে চাইছে যে, ঝড়ে বক মরে। লোকটার দৃষ্টি দেখে মনে মনে বার্নি স্টিনসেনের মতন চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড করে ফেললাম। লোকটাকে বললাম, “দ্যাট ওয়াজ নট আ ফ্লুক। আই উইল ডু দ্যাট এগেইন।” লোকটা হাসলো। আমি দ্বিতীয়বার শট নিলাম। এবারও বুলজ আই। লোকটার দিকে তাকিয়ে একটা তৃপ্তির ভিলেন মার্কা হাসি দিয়ে সরে আসলাম। কিভাবে যে হয়েছিলো আল্লাহই জানে! মাঝে এক জায়গায় বিভিন্ন মলিউকুলার স্ট্রাকচারের ঝুলানো বিশাল বিশাল অ্যাটম পার হলাম। ক্যামেস্ট্রি বলে তেমন একটা মাথা ঘামাইনি বোঝার জন্যে। কিন্তু আমার স্ত্রী দেখলাম বিশাল উৎসাহ নিয়ে তা দেখছে। তবে এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিসটা দেখলাম তার পরেই।

 
শ্যাডো ডিটেক্টরের কারিকুরী
একটা টেবিল। তার দুইপ্রান্তে দুইটি চেয়ার রাখা বসার জন্যে। টেবিলের উপরে একটা গ্লাস প্যানেল যেটার ভিতরে একটা লোহার বল রাখা। টেবিলের দুই প্রান্ত থেকে বের হয়ে ছিলো দুইটি বেল্ট যা মাথায় বেঁধে নিতে হয়। খেলার নাম মাইন্ড-বল। আপনি যদি বলের দিকে বেশি মনযোগ দেন, তাহলে বল আপনার প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের দিকে যাবে । ব্যাপারটা ভাইসভার্সা। কি দুর্দান্ত! আমরা যাবার পরে লক্ষ্য করলাম যে, যারাই টেবিলের বাম দিকে বসছে তারাই জিতছে। আমিও বাম দিকে বসলাম। প্রতিপক্ষ ছিলেন সেতু ভাই। একটু সময় লাগলেও হারিয়ে দিলাম। আশেপাশের উর্মিলা-উর্বশীদের ছলনাও মনযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে পারলো না। এরপরে সুমি আপুকে হারিয়ে দিলো আমার বৌ। সেও ছিলো বামদিকে বসা। শেষে জিনিসটা ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করার জন্যে আমি ডানদিকে বসলাম। আধা মিনিটও মনে হয় লাগেনি ওকে হারাতে। বুঝলাম যে, যন্ত্র ঠিকই আছে। যন্ত্র কিভাবে কাজ করে সেটা বলার মতন কেউ সেখানে ছিলো না বা লেখাও ছিলো না। তাই জানতে পারি নাই। তবে যন্ত্রটার উপরে ওঠা প্লেয়ারদের কনসেন্ট্রেশন গ্রাফ দেখে আমার ধারণা, যন্ত্রটা আমাদের ইলেকট্রো-এনসেফালোগ্রাম করে এবং সেখান থেকে যে ইলেকট্রিক্যাল সিগনাল পায় সেটার ইকুইভ্যালেন্ট ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরী করে বলকে আকর্ষণ করে। শুনে অবিশ্বাস্য সাইফাইয়ের কাহিনী মনে হতে পারে। কিন্তু পেট্রোসায়েন্স এ জিনিসগুলো চোখের সামনে এনে সফলই বলা যায়।

একেবারে শেষে আমরা আবারও চেপে বসলাম ডিম্বাকৃতির ক্যাপসুলে। অন্ধকার টানেলে আমরা কিভাবে মালয়রা তেল বেইচা বিল্ডিং বানায় ফেলাইলো তা দেইখা আমাদের জার্নি শেষ করলাম। লকার থেকে ব্যাগ নিতে গিয়ে কিছুতেই আর লক খোলা যাচ্ছিলো না। আমি আমার বৌকে আফসোস করে বললাম, “এক্সম্যানের টাকলু বুড়া আসলে তারেও তোমার হাজবেন্ড মাইন্ড-বলে হারায় দিবে। আর সেই স্বামীর কথা না শুনে তুমি মাতবরী করে অন্য কোড দিলা বৌ? আফসোস! গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না।” বৌ কিছু বলতেও পারেনা, সইতেও পারেনা। যাইহোক, পরে মাস্টার-কি আনিয়ে লকার খুলে রক্ষা পেলাম। পেট্রোনাসে গেলে বেশিরভাগ পর্যটকই শুধুমাত্র টুইন-টাওয়ার দেখে চলে আসেন। পেট্রোসায়েন্স বলে যে একটা জিনিস আছে তাই জানেন না। এখানে পর্যটকদের স্বল্পতাই তার প্রমাণ। আমার মনেহয়, সবারই একটু ঢু মেরে আসা উচিত এ জায়গায়। খারাপ লাগবেনা। বের হবার পরে মন খারাপ লাগছিলো, নিজের ছোটবেলার আর দেশের স্কুল পড়ুয়া ছোট ছেলেমেয়েগুলোর কথা চিন্তা করে। বিজ্ঞানের ছোট ছোট জিনিসগুলোকে কতই না আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা যায়। অথচ আমরা এগুলোর কিছুই দেখতে পাই নাই। বর্তমান আর ভবিষ্যত প্রজন্ম কবে যে দেশের মাটিতেই আখাম্বা শপিং মলের বদলে এ ধরনের জিনিস দেখতে পাবে তা সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
সানওয়ে পিরামিড আর পূত্রাজায়াঃ
পেট্রোসায়েন্স দেখা শেষে আমরা হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারপর বের হলাম সানওয়ে পিরামিড দেখার জন্যে। এটা মালয়েশিয়ার অন্যতম প্রধান শপিং মল এবং কুয়ালার পাশেই পেটালিংজায়া সেলাঙ্গর নামক জায়গায় অবস্থিত। ট্যাক্সিতে কুয়ালালামপুর থেকে যেতে ঘন্টা আধার মতন লাগে। সমস্যা হচ্ছে ভাড়া নিয়ে। ২০ রিঙ্গিতের ভাড়ার জায়গায় ব্যাটারা চায় ৪০ রিঙ্গিত। এর নিচে কিছুতেই যাবেনা। বেশ কয়েকটা ট্যাক্সি ছেড়ে দেবার পরে শেষ পর্যন্ত এক চাইনীজ ক্যাব ড্রাইভার রাজি হলো ৩৬ রিঙ্গিতে যাবার জন্যে। সেতু ভাই আর সুমি আপু ট্যাক্সি ক্যাবওয়ালার সাথে খাতির জমিয়ে ফেললো। ব্যাটা আমাদের বললো যে, আসার সময় নাকি ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। রাস্তায় মোটামুটি ভালোই জ্যাম ছিলো। তবে আমরা সর্ব বামের ফাঁকা লেন দিয়ে টেনে অন্য গাড়িগুলোর চাইতে সামনে চলে গিয়েছিলাম। খেয়াল করে দেখলাম যে, অন্যান্য লেনের গাড়িতে মাত্র একজন করে যাত্রী। শুধুমাত্র আমাদের লেনের গাড়িগুলোতেই একের অধিক যাত্রী ছিলো। যাই হোক, আমরা সানওয়েতে পৌছানোর পরে ক্যাবওয়ালা আমাদের জন্যে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে রাজি হলো। আমরা ব্যাটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

সানওয়ে পিরামিড মল চোখ ধাঁধানো সুন্দর। দিনে কেমন লাগে কে জানে, কিন্তু রাতের বেলায় এর সোনালী রঙের রূপ সত্যিই দারুণ। বিশাল বড় বড় সিংহর মূর্তি বসানো ছাদওয়ালা গেটের সামনে দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম ঝা চকচকে মার্কেটের ভিতরে। চারতলা উঁচু বিস্তৃত ভবনটার ভিতরে খুবই দ্রুততার সাথে চক্কর মারলাম। ভিতরে বড় বড় সব ব্র্যান্ডের দোকানই আছে মোটামুটি। এক জায়গায় এসে দেখলাম বিল্ডিং এর ভিতরে আস্তো একটা নাগরদোলা! পোলাপানের বিনোদনের জন্যে তৈরী। তারপরে ঘুরতে ঘুরতেই এক জায়গায় এসে চক্ষু চড়কগাছ! নিচের তলার একটা বড় অংশ জুড়ে একটা আইসরিঙ্ক! যখন প্রথমবার দেখলাম, তখন একটা গাড়ি চালিয়ে একজন কর্মী আইসের পলিশিং করছিলো। আর বের হবার সময় দেখলাম যে, কিছু পিচ্চি পোলাপান ট্রেইনারের সহযোগিতায় আইস স্কেটিং করা শিখছে। আর যারা পারে, তারা মনের আনন্দে স্কি করে বেড়াচ্ছে। দেখেই মনেহয়, কি আছে দুনিয়ায়? পারি আর না পারি, স্কি করতে নেমে পড়ি।

 
 

ফেরার তাড়ায় স্কি আর করা হলো না। তামাসা দেখা বাদ দিয়ে আমরা পিরামিডের ভিতর থেকে বের হলাম। বের হয়ে চিংচুং চাইনীজ ক্যাবওয়ালাকে আর খুঁজে পেলাম না। তবে রাত নয়টার সময়ও মলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ক্যাব দেখে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের টিকেট কাউন্টারে খোজ নিলাম। ওরা বললো যে, ওখান থেকে কুপন কিনে ক্যাব নেয়া যাবে মিটারে এবং রাত সাড়ে দশটা-এগারোটা পর্যন্ত ক্যাব মোটামুটি অ্যাভেইলেবেল! শালার জ্যাকি চ্যানের ভাই নতুন দেইখা আমাদের টুপি পড়ানোর চেষ্টা করেছিলো তার মিঠা মিঠা চাপাবাজি দিয়া। যাই হোক, খোঁজ নিয়ে বের হয়ে সামনের দিকে আসতেই সেই চাইনীজ ক্যাবওয়ালা যেন মাটি ফুঁড়ে আমাদের সামনে বের হলো। তারপরেতো বিশাল ভ্যাজাল। “না, তোমাদের যাওয়া লাগবো। আমি এতক্ষণ ওয়েট করসি।” ইত্যাদি ইত্যাদি। সুমি আপু টু দি রেসকিউ। বললো, “আমার হাসব্যান্ড আরও ঘন্টা দুয়েক থাকবে। সরি।” চাইনিজ চিটার ক্যাবি ধরা খেয়ে গজর গজর করতে করতে প্রস্থাণ করলো। মফিজ বাঙ্গালীদের জিত হলো। ফেরার সময় মিটারে বিল এসেছিলো ২৫ রিঙ্গিতের মতন। ক্যাবে ওঠার আগে শপিং মলের ছাদে সিংহর পাশাপাশি পিরামিডের আকৃতি আবিষ্কার করে বুঝতে পারলাম পিরামিড নামকরণের মাজেজা।


এর পরের দিন সকালবেলা কাটলো আগডূম-বাগডুম শপিঙয়ে। এজন্যে বেছে নেয়া হলো সস্তা চায়না টাউন। দুপুরের পরে বিকালের দিকে আমি আর আমার স্ত্রী বের হলাম পূত্রাজায়া দেখার উদ্দেশ্যে। সুমি আপুরা আগেই এ জায়গায় যাওয়ায় ওনারা আবারও শপিঙয়ে বের হলেন! আমরা দুজন কে.এল.সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে কে.এল.ট্রানজিট নামক ট্রেনে চেপে বসলাম। স্টেশন থেকে এবারে আমাদের মনোরেলের প্লাস্টিকের কয়েনের বদলে ম্যাগনেটিক কার্ডের টিকেট দিলো। দাম নিয়েছিলো জনপ্রতি সাড়ে নয় রিঙ্গিতের মতন। আমরা ট্রেনে উঠেছিলাম বিকেল পাঁচ ঘটিকায়। আর মাত্র আধা ঘন্টা পরে গেলে অফপিক আওয়ার ধরতে পারতাম। টিকেটের দামও কম লাগতো। পূত্রাজায়া পৌছাতে সময় লাগলো পনের-বিশ মিনিটের মতন। সুমি আপুরা আগের দিন বাসে গিয়েছিলেন। সময় লেগেছিলো ঘন্টাখানেকের মতন। তবে টিকেটের দামও ছিলো ট্রেনের অর্ধেক।



ট্রেনগুলো বেশ দ্রুতগতির। গতি এবং ট্র্যাকের পাশের গাছপালার জন্যে বাইরের সিনারী তেমন একটা ভালোমতন দেখা যায় না। ট্রেনে ফ্রী ওয়াইফাই সুবিধা আছে। ট্রেনে বসা যাত্রীর পাশাপাশি অনেক দাঁড়ানো যাত্রীও ছিলো। আমরা ট্রেনে যেতে যেতেই দেখলাম, যেদিকে যাচ্ছি সেদিকের আকাশ কুচকুচে কালো মেঘে ভরে আছে। অদ্ভুত রকমের ভয়াবহ সুন্দর দৃশ্য! আমরা পূত্রাজায়া স্টেশনে পৌছানোর কিছু আগেই বৃষ্টি শুরু হলো। বলা ভালো যে, আমরা প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। পূত্রা সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমে একটু হালকা-পাতলা খাওয়া দাওয়া করলাম। তারপরে বৃষ্টির মধ্যেই নিচে নেমে চলে গেলাম ট্যাক্সি স্টেশনে। সেখান থেকে কুপন কিনলাম। দুই ঘন্টার ট্যুরের খরচ পড়লো ৭৫ রিঙ্গিত। আমরা কুপন দিলাম সামনে দাঁড়ানো ক্যাবিদের হাতে। দুইজন এই প্রচন্ড বর্ষনের মধ্যে যেতে রাজি হলো না। তৃতীয় জন রাজি হলো। মিষ্টভাষী বুড়ো মালয় ক্যাব ড্রাইভার। যদিও আমাদেরকে ক্যাবে উঠানোর আগে বললো, “আর ইউ সিওর ইউ ওয়ান্ট টু গো ইন দিস রেইন। ইউ ওন্ট বি এবল টু সি এনিথিং!” বললাম যে, কিছু করার নেই। কাল যেহেতু চলে যাবো, তাই এটাই আমাদের লাস্ট চান্স।

ক্যাবওয়ালা আমাদেরকে প্রশাসনিক শহর পূত্রাজায়ার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো। সব রাস্তাঘাট একেকপাশে নূণ্যতম তিন লেন করে। পুরো শহরটাকে বিশাল এক লেক দুইভাগে ভাগ করেছে। এই লেকের শুরু আর শেষ কোথায় খোদাই জানে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, লেকটা কৃত্তিম! বুড়ো ক্যাবি আমাদেরকে সবকিছুর বর্ণণা বলে বলে নিয়ে যাচ্ছিলো। সাধ্যমতন চেষ্টা করছিলো দেখানোর। বিভিন্ন মন্ত্রনালয় ঘুরিয়ে নিয়ে গেলো পূত্রার সেন্ট্রাল কনফারেন্স হলে। এর মধ্যে লেকের ধারের একটা অ্যামিউজমেন্ট এরিনায় আমরা নামলাম। মোবাইলের গরীব ক্যামেরায় সেখান থেকে পিছনের লেক আর সেতুর কিছু ছবি তুললাম। সেতুটা দেখতে আমাদের খানজাহান আলীর সেতুর মতন। ক্যাবির কাছ থেকে জানা গেলো যে, এখানে নাকি বলিউড থেকে প্রায়শই লোকজন এসে ফিল্মের শুটিং করে। পূত্রায় দুইটা বড় বড় মসজিদ দেখলাম। এর মধ্যে যেটা বেশি বড় এবং পুরানো সেটা লেকের ধারে। এখানে মাগরীবের ওয়াক্ত হয়ে গেলো। ক্যাবি আমাদেরকে মসজিদে নামিয়ে চলে গেলো নামাজ পড়তে। তখনও মুশোলধারে বৃষ্টি পড়ছে। আমরা মসজিদ কমপ্লেক্সের নিচে নেমে গেলাম। নিচে নেমে দেখি বেশ বড় একটা ফুডকোর্ট। সেখান থেকে লেকের কিনারায় যাওয়ার, বসার এবং খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। মসজিদ কমপ্লেক্সে হাফপ্যান্ট পড়া মওলানা না দেখলেও, বেশি অবাক হলাম হাফপ্যান্ট পড়া নারী ট্যুরিস্ট দেখে! নামাজ শেষ হলে ক্যাবি আমাদেরকে বিশাল বিশাল গম্বুজওয়ালা রাজকীয় সুপ্রীম কোর্ট আর প্রাইম-মিনিস্টারের কার্যালয় দেখালো। রাতের আলোকস্বজ্জায় সেগুলো লাগছিলো রূপকথার নগরীর কোন ভবনের মতন। আমাদের দুই ঘন্টার ট্যুর প্রায় ফুরিয়ে এলো। বুড়ো ক্যাবি আমাদেরকে আবার স্টেশনে ফেরত নিয়ে আসলো। সুপরিকল্পিত প্রশাসনিক নগর পূত্রাজায়া ছেড়ে আমরা ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম কুয়ালামপুরের উদ্দেশ্যে।

 



 


[চলবে]
বিদায় কুয়ালালামপুরঃ দেখতে দেখতে আমাদের দেশে ফেরার দিনটি প্রায় চলে এলো। ফ্লাইট ছিলো সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। পকেটের দৈন্যদশার কারণে নিজেদের এবং কাছের মানুষদের জন্যে তেমন কিছু কেনাও হয়নি। হঠাতই মাথায় একটা বুদ্ধি (পড়ুন কুবুদ্ধি) উদয় হলো। সবকিছুর দামইতো বেশি, এর চাইতে সবার জন্যে এখানকার কিছু ফলমূল নিয়ে যাই। এই উদ্দেশ্যে বের হলাম ফল কিনতে। একটু দূরে ফলের একটা মার্কেট আছে।

কিন্তু সেটাতে যেতে যে ট্যাক্সি ভাড়া গুণতে হবে, তার চাইতে পাশের চায়না টাউনের ফলের দোকান থেকে ফল কেনাই শ্রেয় মনে হলো। চাইনিজদের ব্যবহার খারাপ হলেও টেনশন নিলাম না। কারণ আমাদের সাথে ছিলো বার্গেইনিং এ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আধা-চাইনীজ ব্যাটসম্যান সুমি আপু। আমরা রাত দশটা বাজার মিনিট পনের আগে ফলের দোকানে উপস্থিত হলাম। রাত দশটার দিকে তারা দোকান বন্ধ করে। শুরু হলো দরদাম। সারাদিন দোকানদারী করে দুই বুড়ো ফলবিক্রেতারা এমনিতেই ক্লান্ত। সাথে আছে দোকান বন্ধ করার তাড়া। ইতিমধ্যে তারা ফলের দাম বেশ কমিয়েছে। তবুও সুমি আপু প্রায় পাঁচ ধরনের ফলের দাম পাঁচবার পাঁচ রকমভাবে কমাতে বলছে। ব্যাটাদের টেম্পারমেন্ট খারাপ হওয়া শুরু করলো। আমি আস্তে আস্তে আমার বৌকে বললাম, “শোনো, আস্তে আস্তে সাইডে চাপো। কখন এই চিংচুংরা আমাদের উপর কারাতে ঝেড়ে দেয় তার ঠিক নেই।” তবে কারাতের ঘা পড়ার আগেই দামাদামি শেষ হলো। ফেরত আসার সময় বুড়ো দোকানী আমাদের হাতে গোটা বিশেক চিনিচাম্পা কলা ধরিয়ে দিলো। অবাক হয়ে বললাম, “উই ডোন্ট ওয়ান্ট দিজ!” দোকানী বলে, “তেক ইত তেক ইত। ইতস ফ্রী!” বেকুবগুলা মনেহয় আমাদের মতন ফরমালিন ব্যবহার করেনা। নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে তাই আমাদেরকে দিয়ে দিচ্ছিলো। আমি যখন কলাগুলো হাতে নিয়েছি তখন শুনি সুমি আপু বলছে, “হোয়াই বানানা? গিভ আস ড্রাগন ফ্রুট ফর ফ্রী।” আবারও দর কষাকষি! আমি আর দাঁড়ালাম না। দাঁড়ালে একটা কারাতেও মাটিতে পড়তো না। ফলের গাট্টি নিয়ে ঝড়ের বেগে সেখান থেকে গায়েব হয়ে গেলাম।

 

ফল কেনা শেষে হোটেলে ফেরার আগে আমার শ্বশুর আব্বার বলা একটা কথা মনে পড়ে গেলো। “দুরিয়ান খেয়ে দেখো। অতি সুস্বাদু।” কি আর করবো? কিনে ফেললাম দুরিয়ান। দেখতে অনেকটা কাঠালের মতন। ভিতরেও অনেকটা কাঁঠালের মতন। সবই ঠিক ছিলো। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে এর তীব্র গন্ধ (নাকি দুর্গন্ধ?) নিয়ে। আমার স্ত্রী নাকি এ বস্তু লাগেজে করে দেশে নিয়ে আসবে! এ কথা শুনে আমি বললাম, “এ জিনিসের গন্ধ পেলে স্যুটকেসের সাথে সাথে আমাদেরকেও লাথি মেরে প্লেন থেকে নিচে ফেলে দিবে। নেয়ার চিন্তা বাদ দাও। এখানেই খেয়ে যেতে হবে।” হোটেলে ফিরে সারারাত দুরিয়ানের গন্ধে ঘুম হারাম হয়ে গেলো। চারটা পলিব্যাগ দিয়ে মুড়িয়ে রেখেও গন্ধ আটকানো যায়না!

পরের দিন সকালে নাস্তা খেতে বের হবার সময় সাথে দুরিয়ান নিয়ে বের হলাম। ভাবলাম যে, রেস্টুরেন্ট থেকে কাটিয়ে নিবো। কিন্তু কেউ তা কাটতে রাজি না। চেক আউট করে হোটেলের কাউন্টারে মালামাল রেখে বের হয়েছিলাম বাকি সময়টা আশেপাশের মলগুলো ঘুরতে। কাউন্টারেও দুরিয়ান রাখতে দিবেনা। পরে মাল্লু রেস্টুরেন্টের এক আরাকানি নারী কর্মী, যার সাথে আমাদের ভালো খাতির হয়ে গিয়েছিলো, সে দুরিয়ানটা কেটে বের করে দিলো। ভরপেট নাস্তা করার পরে পেটে জায়গা নেই। কি আর করবো, সেই দুরিয়ান হাতে নিয়েই প্রথমে হাটতে হাটতে গেলাম লয়াট-প্লাজা। মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় টেকনোলজী মার্কেট। চারিদিকে খালি ট্যাব আর স্মার্টফোন। যেই স্টলেই যাই, কিছুক্ষণের মধ্যেই দুরিয়ানের গন্ধে জায়গাটা ভরে ওঠে। লোকজন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকানোর আগেই সে জায়গা ছেড়ে পালাই। এর মধ্যে বাইরে শুরু হয়েছে মুশোলধারে বৃষ্টি। সেতু ভাইরা শেষ মুহূর্তের আরও কিছু কেনাকাটা করতে চলে গেলো স্থানীয় একটা বাঙালি মার্কেটে। আর আমরা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটা ক্যাব নিয়ে গেলাম পাশের বুর্জায়া টাইম স্কয়্যার মলে। এই মলটা বিশাল বড়। দশতলা! ঢোকার মুখেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভেন্ডিং মেশিনটা চোখে পড়ে। ভিতরে বড় ব্র্যান্ডের দোকানও যেমন আছে, তেমনি কিছু মোটামুটি সস্তা দোকানও আছে। অবাক হলাম পাথর বসানো গয়নাগাটির ১০ বা ১৫ রিঙ্গিতের ফ্ল্যাট রেট দেখে। একটা দোকান থেকে যখন বড় দুই ভাইয়ের জন্যে টিশার্ট কিনছিলাম, তখন হঠাত করে লক্ষ্য করলাম যে, পুরো বিল্ডিং এ হালকা ভাইব্রেশন হচ্ছে! ভাবলাম, বাইরের মনোরেলের ট্রেনের কারণে হয়তো এই ভাইব্রেশন। কিছুক্ষণ পরেই ভুল ভাংলো। আরেকটু সামনে এগোতেই মাথার উপরের আর্তচিৎকার লক্ষ্য করে তাকাতেই দেখলাম ভয়াবহ দৃশ্য। ভবনের দশতলা পর্যন্ত হলো-সেকশনের সাত তলা থেকে দশতলা উচ্চতায় রয়েছে একটা আস্তো রোলার কোস্টার ট্র্যাক! অবিশ্বাস্য!

হোটেল থেকে আমরা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম সাড়ে তিনটার দিকে। হোটেলের বাঙ্গালী ম্যানেজার একটা গাড়ি ঠিক করে দিয়েছিলো। ভাড়া লেগেছিলো ১২০ রিঙ্গিত। আসার সময়ের চাইতে ৩০ রিঙ্গিত কম!গাড়িতে ওঠার আগে হাতে থাকা স্টিংকবোম দুরিয়ান খাওয়ার পালা এলো। আমার স্ত্রী দেখলাম একটা কোয়া মুখে দিয়ে ওয়াক করে ফেলে দিলো। কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু তারপরেও বাঙ্গালীদের ইজ্জতের কথা চিন্তা করে, “রাখে আল্লাহ, মারে কে” বলে মুখে চালান করে দিলাম দুরিয়ান। উফফ! এতো উৎকট স্বাদ কোন কিছুর হতে পারে জানা ছিলো না। অনেক কষ্টে গিলে ফেললাম। রাত এগারোটার সময় যখন ঢাকায় ফিরে ভাত খাচ্ছিলাম, তখনও ঢেকুরের সাথে দুরিয়ানের গন্ধ বের হচ্ছিলো! ভেবেছিলাম বাকিটা ফেলে দিতে হবে। কিন্তু সেতু ভাই অত্যন্ত মজা করে তা খেয়ে ফেলায় খাবার নষ্ট করার মতন পাপ কাজটা আর করতে হলো না।

এয়ারপোর্টে আসার পরে প্রতিবার যা হয় তাই হলো। সফর সঙ্গীদের কাউকে না আটকালেও ফাইনাল চেকিং এর সময় আমাকে আটকালো। মহিলা সিকিউরিটি অফিসার তার ছোট ছোট চোখকে যথাসম্ভব বড় বড় করে একটা ভয়লাগানো চেহারা বের করলো, আর ব্যাগপ্যাকে থাকা বডি-স্প্রে সিজ করে ছুঁড়ে ফেলে দিলো ডাস্টবিনে। মনে মনে বলি, “লাভ নাই। দুরিয়ানের ঢেক ছেড়েই বডিস্প্রের কাজ চালিয়ে নিবো।হে হে হে।” আমাদের মালিন্ডো-এয়ার সকল যাত্রী উঠিয়ে আরও ঘন্টাখানেক টার্মিনালে দাঁড়িয়ে থাকলো। কেন জানিনা। তবে সময়কে কাজে লাগালাম। আগের বারগুলোতে অর্ধেক দেখা “জ্যাক-দ্যা জায়েন্ট স্লেয়ার” এর বাকি অর্ধেকের পুরোটাই দেখে ফেললুম। মাইরি বলছি দাদা, সেরকম গাঞ্জু ফিল্ম। আমাদের সিট পড়েছিলো একেবারে পিছনের দিকে। টয়লেট গমনেচ্ছুক যাত্রীদের লম্বা কিউয়ের ঠেস খাইতে খাইতে অস্থির হয়ে গেলাম। এ যন্ত্রণা থেকে উদ্ধারকর্তা হয়ে এলো আরেক যন্ত্রণা। হঠাত করে ক্যাপ্টেন সবাইকে সিটবেল্ট বেঁধে ফেলতে বললো, আর নির্দেশ দিলো জায়গা থেকে না উঠতে। শুরু হলো বাম্পিং। ডানে-বামে, উপরে-নিচে সবদিকেই ভয়াবহভাবে প্লেন কাঁপতে লাগলো। প্রায় আধা ঘন্টা ছিলো এরকম অবস্থা। ব্যাপক ভয় পেয়েছিলাম। ভয়ে চোখ বন্ধ করে দোয়াদরুদ পড়তে গিয়ে দেখি, মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে শেখা দোয়াদরুদের বেশিরভাগই ভুলে গেছি। যেগুলো মনে আছে, সেগুলোই মনে মনে পড়তে থাকলাম। প্লেনের এমতাবস্থায় বেশিরভাগ যাত্রীই অসুস্থ বোধ করছিলো। আমার সহযাত্রীদেরও মোটামুটি একই হাল। শুধুমাত্র সেতু ভাই ব্যতিক্রম। প্লেনে উঠে উনি যে ঘুম দিয়েছিলেন, সেটা ভেঙ্গেছিলো ঢাকায় ল্যান্ড করার পরে। প্লেনের ঝড়ের মধ্যে পড়ার কথা জিজ্ঞেস করলে উল্টো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ঝড়ে পড়সিলো নাকি? ধুর মিয়া, আমারে ডাকবানা?”।

ঝড়ঝাপটা শেষ হলে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো সামনের সিটে বসা ভদ্রলোকের অভদ্রতা দেখে। এয়ারহোস্টেজের কাছে মেনুতে থাকা খাবার পান নাই তিনি। তাই যে খাবার পেয়েছেন তা অর্ধেক খেয়ে বাকিটা মেঝেতে ফেলে দিলেন। পাশে বসে থাকা স্ত্রীকে বললেন, “ওরা এসে পরিস্কার করবে। ঠিকমতন সার্ভিস দিতে পারেনা। অন্তত এতটুকু করুক।” সঙ্গে থাকা দুইটা বাচ্চা কি শিখলো তার কাছ থেকে? এসব দেখলে লজ্জায় মাথা কাটা যায়। যা হোক, ঢাকা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার পরে সেই একই কাহিনী হলো। সবাই চলে গেলো, কাস্টমসের মামুরা আটকালো কেবল আমাকে। তেমন ঝামেলা না করে শুধু চেক করেই ছেড়ে দিলো। নয়দিনের মালয়েশিয়া সফর শেষ করে বাসায় ফেরত আসলাম। আর পরের দিন দুপুরে চলে আসলাম কর্মস্থল সিলেটে। এখানে আসার পরে মিয়াভাই ওনার গরীব ক্যামেরায় তোলা টিশার্ট পরিহিত একটা ছবি আমাকে মেসেজ করে পাঠালেন। টি-শার্টটা ওনার গায়ে ফিট করেছে এবং সুন্দর মানিয়েছে। টিশার্টের জন্যে ধন্যবাদ দিলেন আমাকে। আর মেসেজের শেষের লাইনটা ছিলো এরকম, “সবচেয়ে ভালো লাগে, যখন বিদেশ থেকে আনা উপহারে লেখা দেখি মেইড-ইন-বাংলাদেশ।”!
[সমাপ্ত]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন