‘প্যারিস’ নামের মধ্যেই একটা যাদু আছে। স্বপ্নের শহর, ভালোবাসার শহর,
ফ্যাসানের শহর, ফরাসী বিপ্লবের শহর প্যারিস। সেই শহরে আমি যে কোনদিন সত্যি
পৌঁছে যাব এ আমার কল্পনার অতীত। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা বাস্তিল
দূর্গ, মেরী আঁতিনয়েত, চতুর্দশ লুই, মোনালিসা, দা ভিঞ্চি, লুভরে, সীন নদী,
আইফেল টাওয়ার – একের পর এক নামের আনাগোনা কল্পনার দৃশ্যপটে শুধুমাত্র
প্যারিস শব্দটার মধ্যেই। এই কল্পনাই বাস্তবে পরিণত হল ২০১৩ র ইস্টার এর
ছুটিতে।
আমাদের যাত্রা শুরু হল হাইউইকম্ব শহর থেকে। হাইউইকম্ব আমাদের বাড়ি থেকে আধঘন্টার রাস্তা। সেখান থেকে হলিডে কোম্পানীর বাস আমাদের পৌঁছে দেবে ইংলিশ চ্যানেলের ধারের বন্দর শহর ডোভারে। ২বছর আগে পোর্টসমাথ শহরে ইংলিশ চ্যানেলের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় আমার। তার নীল জলে মুগ্ধ আমি ভেবেছিলাম ইংলিশ চ্যানেল যদি কখনো পার হই তবে জাহাজে করে এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে পার হব। চ্যানেলের পেটের মধ্যের টানেল দিয়ে বাস বা ট্রেনে করে নয়, প্লেনে টপকে তো নয়ই, সে তো কয়েক মিনিটেই পেরিয়ে যাবে এই অপার সন্দৌর্য্যকে। দুপুর দেড়টা নাগাদ পৌঁছোলাম ডোভার এ। ইংলিশ চ্যানেলের দূরত্ব সবথেকে কম ফ্রান্সের ক্যালাই আর ইংল্যান্ডের ডোভার এর মধ্যে। মাত্র ৪২ কিমি। আমাদের গন্তব্য আপাতত এই ক্যালাই তারপর সেখান থেকে ২৩৬ কিমি দূরের ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস। কিন্তু এখান থেকে সবাই যে ক্যালাই হয়ে প্যারিস বা ফ্রান্সের অন্যত্র যাচ্ছে তা কিন্তু মোটেও নয়, সেদিক থেকে বলতে গেলে ক্যালাই হল জাহাজে করে ইংল্যন্ড থেকে ইউরোপ যাবার প্রবেশদ্বার। সেখান থেকে ইটালী, স্পেন, জার্মানী, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া সর্বত্র আনাগোনা পর্যটকদের। তাই বাসযাত্রীরা ডোভার থেকেই তাদের নির্দিষ্ট গন্ত্যব্যের বাসে উঠে জাহাজের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বছর খানেক আগে ডোভার বেড়াতে এসে আমার বিস্ময়ের শেষ ছিলনা। শ’য়ে শ’য়ে গাড়ি, বাস, ট্রাক সব লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেই মাত্র একটা জাহাজ আসছে অমনি তার পেটের মধ্যে সারিবদ্ধ ভাবে ঢুকে যাচ্ছে গাড়িগুলো। সেই দৃশ্য মনে রেখে আমিও বাস সহ ঢুকলাম পি এন্ড ও ফেরি তে। বাস থেকে নেমে জাহাজের দোতলায় গিয়ে দেখি এ তো পুরো সপিং মল! কি নেই সেখানে, কাফে, রেস্তোরা থেকে শুরু করে গয়নাগাটির দোকান অবধি! সে সব প্রলোভোন এড়িয়ে একটা জানলার ধারে বসে জাহাজের মৃদুমন্দ দুলুনিতে বুঝতে পারলাম আমরা ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে শুরু করেছি। যতদুর চোখ যায় শুধু জল আর জল। মাঝে মধ্যে দিগন্তে সাদা পালতোলা নৌকোর মত জাহাজের আনাগোনা। সমুদ্র তেমন উত্তাল নয় তা সত্ত্বেও আমি কিছুতেই কল্পনায় আনতে পারছিলামনা যে কি অসাধারণ মানসিক জোর থাকলে কোন মানুষ এই অপার জলরাশি সাঁতরে পাড় হবার কথা কল্পনায় আনতে পারে। বাস্তবে পরিণত করা তো দূরের কথা! মনে মনে অসংখ্য কুর্ণিশ জানালাম বঙ্গ সন্তান আরতি সাহা থেকে শুরু করে নাম না জানা সাঁতারুদের।
কোথা দিয়ে যে ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেল বুঝতে পারার আগেই দূর থেকে ফ্রান্সের তীর দেখা গেল, কিন্তু সেই তীরে পৌঁছতে লাগল আরও প্রায় আধ ঘন্টা। তারপর আবার সারিবদ্ধ ভাবে সব যানবাহন লাইন দিয়ে বেরিয়ে নিমেষে ফাঁকা করে দিল জাহাজ। এভাবেই ইউরোপের মূল ভূ-খন্ডে আমাদের যাত্রা শুরু হল। যেহেতু ফ্রান্সের সময় এক ঘন্টা এগিয়ে ইংল্যান্ডের থেকে তাই সাড়ে চারটে এক লহমায় সাড়ে পাঁচটা হয়ে গেল। এরপরের কাজ পাসপোর্ট, ভিসা পরীক্ষা নীরিক্ষা করানো। আমরাও প্রস্তুত সব কড়া কড়া প্রশ্নের সম্মুখীন হবার জন্যে। ও মা! কোথায় কি! গাইড জলি জানালো ইমিগ্রেশান আধিকারিকরা বৈকালিক চা পানে ব্যস্ত।
আশ্চর্য্য!! এই ভিসা পাবার জন্যে ভোর ৬টায় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ফেব্রুয়ারীর শীত উপেক্ষা করে ফরাসী দূতাবাসের সামনে ১ ঘন্টা অপেক্ষার কোনো মানেই রইলনা! কিঞ্চিত মনক্ষুন্ন হলেও ফ্রান্সের অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে কখন যে চোখ জুড়ে ঘুম এসেছে বুঝতেও পারিনি। তাতাই এর ডাকে যখন চোখ খুললাম তখন বাস আমাদের নিয়ে রুইল মালমাইসঁ তে ঢুকে পড়েছে। এখানেই আমাদের সাময়িক বাসস্থান প্লেস রিচেল্যু তে অবস্থিত একটি হোটেলে। এ জায়গাটা প্যারিস শহরের উপকন্ঠে অবস্থিত।
পরদিন সকালে ৮টার মধ্যে আমরা সকলে প্রস্তুত হয়ে বাসের অপেক্ষায় রইলাম। সবার মনে একই উত্তেজনা – প্যারিস কে সচক্ষে দেখার। এখানে বলে রাখি ইংল্যন্ডে ভারতের মতই ডানহাতি ড্রাইভ অর্থাৎ ড্রাইভার বসে গাড়ির ডানদিকে এবং বাসের দরজা বাঁদিকে বা বাস স্ট্যান্ড সেই মত। কিন্তু সমস্ত ইউরোপ এর উল্টো। তাই যে সব বাস এভাবে ইউরোপ – ইংল্যান্ড সারাক্ষণ যাতায়াত করে, তাদের দুটো দরজা দুদিকে। আমাদের কাছে এটা সম্পূর্ণ নতুন নিয়ম তাই যথেষ্ট সমস্যায় পড়তে হয়েছে মাঝে মাঝে।
প্যারিসকে যে কেন শিল্পের শহর আখ্যা দেওয়া হয়েছে তা পথে যেতে যেতে বুঝতে পারলাম। শহরের আনাচে কানাচে প্রাচীন স্থাপত্য থেকে শুরু করে বর্তমানের সময়ের শিল্পীদের সৃষ্টি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এমনকি বহুতল বাড়িগুলোর রং ও অবাক করা। তাদের শিল্পী সত্তার তারিফ করার ফাঁকেই দেখতে পেলাম এক ঝলক আইফেল টাওয়ার কে। মনের চাপা উত্তেজনাকে প্রশমিত করার আগেই সীন নদী পেরোতেই দেখা দিল আকাশচুম্বি আইফেল টাওয়ার। এখানেই আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম। কারণ আমরা নিজেদের মত করে প্যারিসকে চিনব ঠিক করেছি আর তার শুরু আইফেল টাওয়ার ছাড়া আর কোথায় বা হোতে পারে! এত সকালে চারদিক শুনশান, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ আইফেল টাওয়ার। মানুষের প্রযুক্তবিদ্যার দম্ভস্বরূপ সে যেন তার অস্তিত্ব জাহির করে চলেছে শতাধিক বছর ধরে। ১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবর্ষ পালনের উদ্দেশ্যে প্যারিসে বিশ্ব মেলা বসেছিল। এই মেলার প্রবেশ তোরণ নির্মাণের দায়িত্ব পরে গুস্তভ আইফেল নামে সেই সময়ের বিখ্যাত ফরসী ইঞ্জিনীয়ারের ওপর। মাত্র ২ বছরের চেষ্টায় ৩০০ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই আইফেল টাওয়ার নির্মিত হয়। এই ১২৪ বছরে ২কোটি ৫০ লক্ষ লোকের পদধুলি পড়েছে এই লৌহ মানবীর শরীরে। কত যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে আমাদের মত আরও কত শত মানুষের বিষ্ময়ের উদ্রেক ঘটাবে বলে।
আইফেল টাওয়ারের সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে সবুজ জলের সীন নদী, তার অপর পাড়ে বিশাল প্রাসাদ টোকাডরো। টোকাডরো পেরিয়ে চলতে থাকলাম শাঁ-জে-লিজে র দিকে। এই শাঁ-জে-লিজে হল প্যারিসের বিখ্যাত রাজপথ। যার একদিকে আর্ক দ্য ট্রোঁয়া আর অপর দিকে বিশ্ববিখ্যাত লুভরে মিউজিয়াম। ম্যাপ থেকে খুঁজে দিয়েনা এভিন্যু দিয়ে কিছুদূর যেতেই পৌঁছালাম নেপোলিয়ানের বিজয় স্তম্ভ আর্ক দ্য ট্রোঁয়া (Arch of Triumph)। বিশাল চওড়া রাজপথের ঠিক মধ্যিখানে এই বিজয় তোরণ। চারদিক থেকে অসংখ্য রাস্তা এসে মিশছে রাজপথে। ১৮০৫ এ অস্ট্রিয়া বিজয়ের পর প্রায় অধিকাংশ ইউরোপ নেপোলিয়ানের তথা ফ্রান্সের অধীনে চলে আসে। তাঁর সৈন্য বাহিনীর কৃতিত্ব কে স্মরণ করে রাখার জন্যে নেপোলিয়ান ১৮০৬ সালে এই তোরণ নির্মাণের নির্দেশ দেন যেখানে ১২৮ টি যুদ্ধ এবং তার জেনারেলদের নাম খোদিত থাকবে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নেপোলিয়ান তাঁর বিজয় তোরণ দেখে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর ১৫ বছর পর ১৮৩৬ সালে এর নির্মাণ শেষ হয় এবং এটি তৈরিতে খরচ হয় ৯.৩ মিলিয়ন ফা্রঁ। ইতিহাসের পরিহাসে এই তোরণের নীচ দিয়ে বহু বিজয়ী ফ্রান্সকে পরাজিত করে তাদের সেনবাহিনীর বিজয় পতাকা উড়িয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকরা সগৌরবে এই তোরণ এর মধ্যে দিয়ে কুচকাওয়াজ করেছে। আর্ক দ্য ট্রোঁয়ার বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে দেশ-কাল এর গন্ডির সীমা পেরিয়ে সৈনিক সমুদয় এর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হবেই। আর সেখানেই নেপোলিয়ানের জিত।

প্যারিসের বিখ্যাত এই রাজপথ শাঁ- জে- লিজে। কিন্তু ইংরাজি বানান অনুযায়ী এর উচ্চারণ হওয়ার কথা চ্যাম্প – এ লিজ (Champ elysees)। সে কথা বলার উপায় নেই আমাদের দুই পুত্রের সামনে, তাহলেই শুরু হয়ে যাবে পাক্কা আধঘন্টার ফ্রেঞ্চ ক্লাস। ১.৯০ কিমি পথের পশ্চিম প্রান্তে আর্ক দ্য ট্রোঁয়া আর পূর্ব প্রান্তে রয়েছে কনকর্ড স্কোয়ার, তুলারিস বাগিচা ও ল্যুভরে মিউজিয়াম। ফরাসী বিপ্লবের সময় এই কনকর্ড স্কোয়ারই বিপ্লবের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় যেখানে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয় গিলোটিনে। সীন নদীর ডানদিকে দেশের প্রধান বিচারালয় আর বাঁ দিকে কনকর্ড স্কোয়ার। মানসচক্ষে কল্পনা করার চেষ্টা করলাম ফরাসী বিপ্লবের সেই উত্তপ্ত দিনগুলো যখন কোর্ট থেকে আনা হচ্ছে মেরী আঁতিনয়েত কে সাধারণ মানুষের সামনে গিলোটিনে হত্যার জন্যে। কি ভয়ানক ছিল সেই সব মুহূর্ত!
শাঁ- জে- লিজের পশ্চিম প্রান্তের চার্লস দ্য গল এটোলে স্টেশন থেকে হলুদ লাইন ধরে ঠিক পাঁচটা স্টেশন পরে ল্যুভরে মিউজিয়াম। স্টশনে ঢুকে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল চারিদিকে সাবধান বাণী পকেটমার থেকে বাঁচার জন্যে, সমানে ঘোষণাও চলছে। এমন কিছু ভীড় ও নেই। সহজেই ট্রেনের কামরায় উঠলাম সাথে এক দল অল্প বয়সী মেয়েও উঠল। তাদের অকারণ ঠেলায় আমার ৬ জন দুভাগে ভাগ হয়ে গেলাম কামরার দু দিকে। এক স্টেশন পরেই খেয়াল করলাম বাবুজির ব্যাগ সামান্য খোলা এবং তার মধ্যের টাকার ব্যাগ উধাও! ল্যুভরে স্টশনে নেমে জানলাম ঐ মেয়ের দল মণিশের মাণিব্যাগ সুক্ষহস্তে হস্তান্তরিত করেছিল, কিন্তু ওর তাৎক্ষণিক তৎপরতায় এবং এক সহযাত্রীর সাহায্যে ব্যাগ ফেরত পায়। বুঝলাম শিল্পের শহর প্যারিসে পকেটমারদের শৈল্পিক হাত থেকে পর্যটকদের রক্ষা পাওয়া বেশ কঠিন।
এর পরের অভিঞ্জতাও সুখকর হলনা আমাদের। মিউজিয়ামের টিকিট বহু আগেই কাটা ছিল ইন্টারনেটে, শুধু তা সংগ্রহ করা বাকি, তাই কলকাতার পূজো প্যান্ডেলের মত বিশাল লাইন দেখেও কোন পরোয়া না করে আমরা চললাম সগর্বে। ঘড়িতে তখন একটা বাজে অর্থাৎ পাঁচ ঘন্টা নিশ্চিন্তে কাটাতে পারব পৃথিবী বিখ্যাত এই মিউজিয়ামে। টিকিট বুকিং আধিকারিকদের ইন্টারনেটের কাগজ দেখাতে তারা জানাল টিকিট সংগ্রহ করতে হবে শাঁ- জে- লিজের পাশের এক দোকান থেকে! প্রায় দু ঘন্টা অপেক্ষার পর মণিশ এসে জানাল শনিবার বলে সে দোকান বন্ধ আর সেটাও মোটেই ধারে কাছে নয়। বুঝলাম ভাষা বিভ্রাটে আমাদের এই হয়রানি। হতোদ্যম না হয়ে বিশাল সর্পিল লাইন পেরিয়ে প্রথম দরজা পেরিয়ে আরও অবাক হবার পালা। চারদিকে সব নির্দেশ ফরাসী তে লেখা। প্রায় আধঘন্টার চেষ্টায় অবশেষে টিকিট কেটে, মনের মধ্যে তরতরিয়ে গজিয়ে ওঠা রাগকে কোনরকমে দমন করে হাতে থাকা মাত্র ২ ঘন্টার সদ্ব্যবহারের আশায় এগোতে থাকলাম।
ল্যুভরে মিউজিয়ামটি ৩ ভাগে বিভক্ত। রিচ্যেলু, স্যুলি এবং ডেনন। প্রতিটি ভাগ দ্বিতল আর প্রতি তলায় প্রায় ১০০টা ঘর! পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬০,৬০০ বর্গ মিটারের এই বাড়িটিতে প্রায় ৩৫,০০০ দ্রষ্টব্য রয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন থেকে গ্রীক স্থাপত্য, নেপোলিয়ানের শয়নকক্ষ, বিংশ শতকের শিল্পীর চিত্র কি নেই সেখানে। কিন্তু এত অল্প সময়ে কি দেখব আর কি ছাড়ব, তাই প্রথমেই মোনালিসা দেখার নির্দশ অনুসরণ করে ডেনন এ প্রবেশ করলাম। মুহুর্তের মধ্যে স্থান-কাল সব পাল্টে গিয়ে এসে পড়লাম ২০০০ বছর আগের রোমান সাম্রাজ্যে। এখানে গ্রীক ও রোমান শাসকদের পাথরের মূর্তি , তাদের ব্যবহৃত জিনিষ রাখা। রোমান শাসকরা ঠিক যেন আ্যসটরিক্সের বই থেকে উঠে আসা চরিত্র, চোখে মুখে সেই ঊদ্ধত্য, স্বল্প বেশভুষা কিন্তু শরীরে দৃপ্ত পৌরুষ। তাদের পেরিয়ে দোতলায় ওঠার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন দ্য উইংড ভিক্টরি ওফ সামথরেস (The winged victory of Samothrace)। ২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে তৈরী মার্বেলের ৮ ফুট দৈর্ঘের এই মূর্তি গ্রীক বিজয়ের দেবী সামথরেস এর। দেবী যেন সমুদ্রের ঝোড়ো হাওয়া কে অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে আছেন নৌকার পুরোভাগে, হাওয়াতে ও জলের ঝাপটায় আভরণ অসংলগ্ন।

ডানদিকে ঘুরে প্রথম ঘরে ঢুকেই চারদিক ফাঁকা কিন্তু সবার চোখ ছাদের দিকে। সত্যি, কি যে অপূর্ব চিত্রিত ছাদ, কোন অকল্পনীয় ধৈর্য্য আর দক্ষতা থাকলো তবেই কোন মানুষ এরকম নিপুণ ভাবে সাজিয়ে তুলতে পারে একটা সাধারণ ছাদকে। এরকম ৩টে বড় ঘর পেরোনোর পর শুরু হল প্রাক শিল্পবিপ্লবের যুগের শিল্পীদের আঁকা একের পর এক অসাধারণ সব সৃস্টি। মাইকেল এঞ্জেলো আর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এই দুটো নামেই পরিচিত আমি। এখানে এসে মনে হল আমার এই অঞ্জানতা তৈরী হয়েছে শুধু মাত্র ইতিহাস বই এর পাতা মুখস্ত করার দৌলতে। আমার নাম না জানা শিল্পীরাও যে কি অনবদ্য সব শিল্পকর্ম সৃস্টি করেছেন যা তাদের অমর করে রেখেছে প্রায় সাতশ – আটশ বছর পরেও। এভাবে মুগ্ধ হতে হতেই এক সময় মোনালিসার সামনে এসে পড়লাম। তিনি তাঁর বিখ্যাত মুচকি হাসি দিয়ে যথারিতী বহু গুণমুগ্ধ ভক্তকে আকর্ষণ করে ভীড় জমিয়ে নিয়েছেন। মোনালিসার ঠিক বিপরীত দেওয়ালে রাখা একটা ছবি থেকে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারলামনা। এটি ইটালীয়ান শিল্পী পাওলো ভেরোনীস এর আঁকা ‘ওয়েডিং ফিস্ট এট কানা’ (wedding feast at Cana)। ৬৬৬ x ৯৯০ সেমি আয়তনের এই চিত্রটি ল্যুভরে মিউজিয়ামের সংগ্রহের সবচেয়ে বড় ছবি। কোন এক বিবাহবাসরে মদ ফুরিয়ে যাবার পর যিশু পানীয় জলকে সুরায় পরিণত করেন, সেইগল্প অবলম্বনে ভেরোনীসের সৃস্ট এই ছবিটি যাতে প্রায় ১৩০ টি মানব মুর্তি আছে, যদিও তারা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু দেখছে কিন্তু কেউ কথা বলছেনা এবং এক মাত্র যিশু ছাড়া কেউ দর্শকদের মুখোমুখি তাকিয়ে নেই। ভেনিসের চার্চের জন্যে ১৫৬৩ সালে অঙ্কিত এই অতিমানবীয় সৃস্টির সামনে দাঁড়িয়ে স্রস্টা কুর্ণিশ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।

এদিকে ঘড়ির কাঁটা যেন অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কখন যে ৬টা বাজল তা বুঝতে পারলাম ওখানকার কর্মচারীদের তৎপরতায়। কিছুই দেখা হলনা, কত আশা নিয়ে এসেছিলাম নেপোলিয়ানের ঘর, মাইকেল এঞ্জেলোর ‘ক্যাপটিভ’, ভারমীরের আঁকা চিত্র- সব অদেখা থেকে গেল।
ল্যুভরে থেকে বেড়িয়ে শাঁ- জে- লিজে ধরে হাঁটতে থাকলাম মেট্রোস্টেশন এর খোঁজে, ফিরতে হবে ল্যুই মালমাইসন। প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পর, এক ইংরাজী ভাষী যুবকের সাহায্যে যদিও বা কনকর্ড স্টেশন খুঁজে পেলাম, কিন্তু তাতে টিকিট কাটার কোন ব্যবস্থা নেই। আমাদের অপেক্ষা করতে বলে মণিশ ছুটল অপর প্রান্তে টিকিট কাটতে। অনেকেই আমাদের পাঁচ জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিঞ্জাসুদৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্লাটফর্মে অন্তর্হিত হচ্ছে। এক দশাশয়ী মহিলা হঠাৎ কি মনে করে আমাদের উদ্দ্যেশ্যে কিছু একটা বললেন ফরাসীতে আর তার প্রতু্যতরে অনি যা বলল তাতে মহিলা রেগে যারপরনাই বিরক্ত হয়ে প্লাটফর্মের গন্ডী ডিঙ্গিয়ে চলে গেলেন তরতরিয়ে। সেই মুহুর্তে তাতাই হাসিতে প্রায় ফেটে পড়ল। পরে বুঝলাম ও উদ্ধার করেছে যে ভদ্রোমহিলা অনি কে জিঞ্জেস করেছেন অমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা, আমরা কেন দাঁড়িয়ে আছি। তার উত্তরে অনি বলেছে- আমি ফরাসী পছন্দ করিনা, আমাদের বিরক্ত করোনা। তাই শুনে ও নিজেও অবাক। ৩ বছরের চর্চার অভাবে ওর বক্তব্য ‘আমরা ঠিক আছি,আমি ভালো ফরাসী জানিনা’ যে এই রকম বিস্ফোরক উক্তিতে পরিণত হবে তা বেচারা নিজেও বুঝতে পারেনি।
সেই মুহূর্তে অনি ঠিক করল ফ্রান্সে থাকাকালীন কিছুতেই আর ফরাসী বলবেনা।
রাত দশটা নাগাদ লুই মালমাইসঁ স্টেশনে এসে পৌঁছোলাম। সেখান থেকে বাসে করে যেতে হবে প্লেস রিচেল্যু। বাসের ড্রাইভার কে আমাদের গন্তব্য বলল মণিশ আর সাথে জিঞ্জেস করল ভাড়া কত। তার উত্তরে বাস ড্রাইভার ভাঙা ইংরাজিতে বলল ‘স্টেশন যাবে, এই তো সামনেই স্টেশন’। মণিশ যত বলে রিচ্যেলু সে তত স্টেশন দেখায়। কি বিপদে পড়া গেল। আর অনি তো ঠিকই করেছে আর বলবেনা কিছু ফরাসীতে। তাতাই ও নির্বাক। সেই মুহূর্তে চটজলদি বুদ্ধিতে মণিশ ওর আইপ্যাডে রাখা হোটেলের ম্যাপটা দেখাল। সেটা দেখতেই ড্রাইভার এক গাল হেসে বলল ‘ও রিচেল্যু, উঠে পড়, আমি নামিয়ে দেব’। এমনকি সহৃদয় বাস ড্রাইভার আমাদের টিকিটের পয়সা অবধি নিলনা। কিন্তু ওর বলা রিচেল্যু শুনতে আর যাই হোক রিচেল্যু শব্দের ধারে কাছে নয় এটা হলফ করে বলতে পারি।
আমাদের যাত্রা শুরু হল হাইউইকম্ব শহর থেকে। হাইউইকম্ব আমাদের বাড়ি থেকে আধঘন্টার রাস্তা। সেখান থেকে হলিডে কোম্পানীর বাস আমাদের পৌঁছে দেবে ইংলিশ চ্যানেলের ধারের বন্দর শহর ডোভারে। ২বছর আগে পোর্টসমাথ শহরে ইংলিশ চ্যানেলের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় আমার। তার নীল জলে মুগ্ধ আমি ভেবেছিলাম ইংলিশ চ্যানেল যদি কখনো পার হই তবে জাহাজে করে এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে পার হব। চ্যানেলের পেটের মধ্যের টানেল দিয়ে বাস বা ট্রেনে করে নয়, প্লেনে টপকে তো নয়ই, সে তো কয়েক মিনিটেই পেরিয়ে যাবে এই অপার সন্দৌর্য্যকে। দুপুর দেড়টা নাগাদ পৌঁছোলাম ডোভার এ। ইংলিশ চ্যানেলের দূরত্ব সবথেকে কম ফ্রান্সের ক্যালাই আর ইংল্যান্ডের ডোভার এর মধ্যে। মাত্র ৪২ কিমি। আমাদের গন্তব্য আপাতত এই ক্যালাই তারপর সেখান থেকে ২৩৬ কিমি দূরের ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস। কিন্তু এখান থেকে সবাই যে ক্যালাই হয়ে প্যারিস বা ফ্রান্সের অন্যত্র যাচ্ছে তা কিন্তু মোটেও নয়, সেদিক থেকে বলতে গেলে ক্যালাই হল জাহাজে করে ইংল্যন্ড থেকে ইউরোপ যাবার প্রবেশদ্বার। সেখান থেকে ইটালী, স্পেন, জার্মানী, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া সর্বত্র আনাগোনা পর্যটকদের। তাই বাসযাত্রীরা ডোভার থেকেই তাদের নির্দিষ্ট গন্ত্যব্যের বাসে উঠে জাহাজের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বছর খানেক আগে ডোভার বেড়াতে এসে আমার বিস্ময়ের শেষ ছিলনা। শ’য়ে শ’য়ে গাড়ি, বাস, ট্রাক সব লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেই মাত্র একটা জাহাজ আসছে অমনি তার পেটের মধ্যে সারিবদ্ধ ভাবে ঢুকে যাচ্ছে গাড়িগুলো। সেই দৃশ্য মনে রেখে আমিও বাস সহ ঢুকলাম পি এন্ড ও ফেরি তে। বাস থেকে নেমে জাহাজের দোতলায় গিয়ে দেখি এ তো পুরো সপিং মল! কি নেই সেখানে, কাফে, রেস্তোরা থেকে শুরু করে গয়নাগাটির দোকান অবধি! সে সব প্রলোভোন এড়িয়ে একটা জানলার ধারে বসে জাহাজের মৃদুমন্দ দুলুনিতে বুঝতে পারলাম আমরা ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে শুরু করেছি। যতদুর চোখ যায় শুধু জল আর জল। মাঝে মধ্যে দিগন্তে সাদা পালতোলা নৌকোর মত জাহাজের আনাগোনা। সমুদ্র তেমন উত্তাল নয় তা সত্ত্বেও আমি কিছুতেই কল্পনায় আনতে পারছিলামনা যে কি অসাধারণ মানসিক জোর থাকলে কোন মানুষ এই অপার জলরাশি সাঁতরে পাড় হবার কথা কল্পনায় আনতে পারে। বাস্তবে পরিণত করা তো দূরের কথা! মনে মনে অসংখ্য কুর্ণিশ জানালাম বঙ্গ সন্তান আরতি সাহা থেকে শুরু করে নাম না জানা সাঁতারুদের।
কোথা দিয়ে যে ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেল বুঝতে পারার আগেই দূর থেকে ফ্রান্সের তীর দেখা গেল, কিন্তু সেই তীরে পৌঁছতে লাগল আরও প্রায় আধ ঘন্টা। তারপর আবার সারিবদ্ধ ভাবে সব যানবাহন লাইন দিয়ে বেরিয়ে নিমেষে ফাঁকা করে দিল জাহাজ। এভাবেই ইউরোপের মূল ভূ-খন্ডে আমাদের যাত্রা শুরু হল। যেহেতু ফ্রান্সের সময় এক ঘন্টা এগিয়ে ইংল্যান্ডের থেকে তাই সাড়ে চারটে এক লহমায় সাড়ে পাঁচটা হয়ে গেল। এরপরের কাজ পাসপোর্ট, ভিসা পরীক্ষা নীরিক্ষা করানো। আমরাও প্রস্তুত সব কড়া কড়া প্রশ্নের সম্মুখীন হবার জন্যে। ও মা! কোথায় কি! গাইড জলি জানালো ইমিগ্রেশান আধিকারিকরা বৈকালিক চা পানে ব্যস্ত।
আশ্চর্য্য!! এই ভিসা পাবার জন্যে ভোর ৬টায় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ফেব্রুয়ারীর শীত উপেক্ষা করে ফরাসী দূতাবাসের সামনে ১ ঘন্টা অপেক্ষার কোনো মানেই রইলনা! কিঞ্চিত মনক্ষুন্ন হলেও ফ্রান্সের অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে কখন যে চোখ জুড়ে ঘুম এসেছে বুঝতেও পারিনি। তাতাই এর ডাকে যখন চোখ খুললাম তখন বাস আমাদের নিয়ে রুইল মালমাইসঁ তে ঢুকে পড়েছে। এখানেই আমাদের সাময়িক বাসস্থান প্লেস রিচেল্যু তে অবস্থিত একটি হোটেলে। এ জায়গাটা প্যারিস শহরের উপকন্ঠে অবস্থিত।
পরদিন সকালে ৮টার মধ্যে আমরা সকলে প্রস্তুত হয়ে বাসের অপেক্ষায় রইলাম। সবার মনে একই উত্তেজনা – প্যারিস কে সচক্ষে দেখার। এখানে বলে রাখি ইংল্যন্ডে ভারতের মতই ডানহাতি ড্রাইভ অর্থাৎ ড্রাইভার বসে গাড়ির ডানদিকে এবং বাসের দরজা বাঁদিকে বা বাস স্ট্যান্ড সেই মত। কিন্তু সমস্ত ইউরোপ এর উল্টো। তাই যে সব বাস এভাবে ইউরোপ – ইংল্যান্ড সারাক্ষণ যাতায়াত করে, তাদের দুটো দরজা দুদিকে। আমাদের কাছে এটা সম্পূর্ণ নতুন নিয়ম তাই যথেষ্ট সমস্যায় পড়তে হয়েছে মাঝে মাঝে।
প্যারিসকে যে কেন শিল্পের শহর আখ্যা দেওয়া হয়েছে তা পথে যেতে যেতে বুঝতে পারলাম। শহরের আনাচে কানাচে প্রাচীন স্থাপত্য থেকে শুরু করে বর্তমানের সময়ের শিল্পীদের সৃষ্টি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এমনকি বহুতল বাড়িগুলোর রং ও অবাক করা। তাদের শিল্পী সত্তার তারিফ করার ফাঁকেই দেখতে পেলাম এক ঝলক আইফেল টাওয়ার কে। মনের চাপা উত্তেজনাকে প্রশমিত করার আগেই সীন নদী পেরোতেই দেখা দিল আকাশচুম্বি আইফেল টাওয়ার। এখানেই আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম। কারণ আমরা নিজেদের মত করে প্যারিসকে চিনব ঠিক করেছি আর তার শুরু আইফেল টাওয়ার ছাড়া আর কোথায় বা হোতে পারে! এত সকালে চারদিক শুনশান, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ আইফেল টাওয়ার। মানুষের প্রযুক্তবিদ্যার দম্ভস্বরূপ সে যেন তার অস্তিত্ব জাহির করে চলেছে শতাধিক বছর ধরে। ১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবর্ষ পালনের উদ্দেশ্যে প্যারিসে বিশ্ব মেলা বসেছিল। এই মেলার প্রবেশ তোরণ নির্মাণের দায়িত্ব পরে গুস্তভ আইফেল নামে সেই সময়ের বিখ্যাত ফরসী ইঞ্জিনীয়ারের ওপর। মাত্র ২ বছরের চেষ্টায় ৩০০ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই আইফেল টাওয়ার নির্মিত হয়। এই ১২৪ বছরে ২কোটি ৫০ লক্ষ লোকের পদধুলি পড়েছে এই লৌহ মানবীর শরীরে। কত যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে আমাদের মত আরও কত শত মানুষের বিষ্ময়ের উদ্রেক ঘটাবে বলে।
আইফেল টাওয়ারের সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে সবুজ জলের সীন নদী, তার অপর পাড়ে বিশাল প্রাসাদ টোকাডরো। টোকাডরো পেরিয়ে চলতে থাকলাম শাঁ-জে-লিজে র দিকে। এই শাঁ-জে-লিজে হল প্যারিসের বিখ্যাত রাজপথ। যার একদিকে আর্ক দ্য ট্রোঁয়া আর অপর দিকে বিশ্ববিখ্যাত লুভরে মিউজিয়াম। ম্যাপ থেকে খুঁজে দিয়েনা এভিন্যু দিয়ে কিছুদূর যেতেই পৌঁছালাম নেপোলিয়ানের বিজয় স্তম্ভ আর্ক দ্য ট্রোঁয়া (Arch of Triumph)। বিশাল চওড়া রাজপথের ঠিক মধ্যিখানে এই বিজয় তোরণ। চারদিক থেকে অসংখ্য রাস্তা এসে মিশছে রাজপথে। ১৮০৫ এ অস্ট্রিয়া বিজয়ের পর প্রায় অধিকাংশ ইউরোপ নেপোলিয়ানের তথা ফ্রান্সের অধীনে চলে আসে। তাঁর সৈন্য বাহিনীর কৃতিত্ব কে স্মরণ করে রাখার জন্যে নেপোলিয়ান ১৮০৬ সালে এই তোরণ নির্মাণের নির্দেশ দেন যেখানে ১২৮ টি যুদ্ধ এবং তার জেনারেলদের নাম খোদিত থাকবে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নেপোলিয়ান তাঁর বিজয় তোরণ দেখে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর ১৫ বছর পর ১৮৩৬ সালে এর নির্মাণ শেষ হয় এবং এটি তৈরিতে খরচ হয় ৯.৩ মিলিয়ন ফা্রঁ। ইতিহাসের পরিহাসে এই তোরণের নীচ দিয়ে বহু বিজয়ী ফ্রান্সকে পরাজিত করে তাদের সেনবাহিনীর বিজয় পতাকা উড়িয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকরা সগৌরবে এই তোরণ এর মধ্যে দিয়ে কুচকাওয়াজ করেছে। আর্ক দ্য ট্রোঁয়ার বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে দেশ-কাল এর গন্ডির সীমা পেরিয়ে সৈনিক সমুদয় এর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হবেই। আর সেখানেই নেপোলিয়ানের জিত।

প্যারিসের বিখ্যাত এই রাজপথ শাঁ- জে- লিজে। কিন্তু ইংরাজি বানান অনুযায়ী এর উচ্চারণ হওয়ার কথা চ্যাম্প – এ লিজ (Champ elysees)। সে কথা বলার উপায় নেই আমাদের দুই পুত্রের সামনে, তাহলেই শুরু হয়ে যাবে পাক্কা আধঘন্টার ফ্রেঞ্চ ক্লাস। ১.৯০ কিমি পথের পশ্চিম প্রান্তে আর্ক দ্য ট্রোঁয়া আর পূর্ব প্রান্তে রয়েছে কনকর্ড স্কোয়ার, তুলারিস বাগিচা ও ল্যুভরে মিউজিয়াম। ফরাসী বিপ্লবের সময় এই কনকর্ড স্কোয়ারই বিপ্লবের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় যেখানে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয় গিলোটিনে। সীন নদীর ডানদিকে দেশের প্রধান বিচারালয় আর বাঁ দিকে কনকর্ড স্কোয়ার। মানসচক্ষে কল্পনা করার চেষ্টা করলাম ফরাসী বিপ্লবের সেই উত্তপ্ত দিনগুলো যখন কোর্ট থেকে আনা হচ্ছে মেরী আঁতিনয়েত কে সাধারণ মানুষের সামনে গিলোটিনে হত্যার জন্যে। কি ভয়ানক ছিল সেই সব মুহূর্ত!
শাঁ- জে- লিজের পশ্চিম প্রান্তের চার্লস দ্য গল এটোলে স্টেশন থেকে হলুদ লাইন ধরে ঠিক পাঁচটা স্টেশন পরে ল্যুভরে মিউজিয়াম। স্টশনে ঢুকে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল চারিদিকে সাবধান বাণী পকেটমার থেকে বাঁচার জন্যে, সমানে ঘোষণাও চলছে। এমন কিছু ভীড় ও নেই। সহজেই ট্রেনের কামরায় উঠলাম সাথে এক দল অল্প বয়সী মেয়েও উঠল। তাদের অকারণ ঠেলায় আমার ৬ জন দুভাগে ভাগ হয়ে গেলাম কামরার দু দিকে। এক স্টেশন পরেই খেয়াল করলাম বাবুজির ব্যাগ সামান্য খোলা এবং তার মধ্যের টাকার ব্যাগ উধাও! ল্যুভরে স্টশনে নেমে জানলাম ঐ মেয়ের দল মণিশের মাণিব্যাগ সুক্ষহস্তে হস্তান্তরিত করেছিল, কিন্তু ওর তাৎক্ষণিক তৎপরতায় এবং এক সহযাত্রীর সাহায্যে ব্যাগ ফেরত পায়। বুঝলাম শিল্পের শহর প্যারিসে পকেটমারদের শৈল্পিক হাত থেকে পর্যটকদের রক্ষা পাওয়া বেশ কঠিন।
এর পরের অভিঞ্জতাও সুখকর হলনা আমাদের। মিউজিয়ামের টিকিট বহু আগেই কাটা ছিল ইন্টারনেটে, শুধু তা সংগ্রহ করা বাকি, তাই কলকাতার পূজো প্যান্ডেলের মত বিশাল লাইন দেখেও কোন পরোয়া না করে আমরা চললাম সগর্বে। ঘড়িতে তখন একটা বাজে অর্থাৎ পাঁচ ঘন্টা নিশ্চিন্তে কাটাতে পারব পৃথিবী বিখ্যাত এই মিউজিয়ামে। টিকিট বুকিং আধিকারিকদের ইন্টারনেটের কাগজ দেখাতে তারা জানাল টিকিট সংগ্রহ করতে হবে শাঁ- জে- লিজের পাশের এক দোকান থেকে! প্রায় দু ঘন্টা অপেক্ষার পর মণিশ এসে জানাল শনিবার বলে সে দোকান বন্ধ আর সেটাও মোটেই ধারে কাছে নয়। বুঝলাম ভাষা বিভ্রাটে আমাদের এই হয়রানি। হতোদ্যম না হয়ে বিশাল সর্পিল লাইন পেরিয়ে প্রথম দরজা পেরিয়ে আরও অবাক হবার পালা। চারদিকে সব নির্দেশ ফরাসী তে লেখা। প্রায় আধঘন্টার চেষ্টায় অবশেষে টিকিট কেটে, মনের মধ্যে তরতরিয়ে গজিয়ে ওঠা রাগকে কোনরকমে দমন করে হাতে থাকা মাত্র ২ ঘন্টার সদ্ব্যবহারের আশায় এগোতে থাকলাম।
ল্যুভরে মিউজিয়ামটি ৩ ভাগে বিভক্ত। রিচ্যেলু, স্যুলি এবং ডেনন। প্রতিটি ভাগ দ্বিতল আর প্রতি তলায় প্রায় ১০০টা ঘর! পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬০,৬০০ বর্গ মিটারের এই বাড়িটিতে প্রায় ৩৫,০০০ দ্রষ্টব্য রয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন থেকে গ্রীক স্থাপত্য, নেপোলিয়ানের শয়নকক্ষ, বিংশ শতকের শিল্পীর চিত্র কি নেই সেখানে। কিন্তু এত অল্প সময়ে কি দেখব আর কি ছাড়ব, তাই প্রথমেই মোনালিসা দেখার নির্দশ অনুসরণ করে ডেনন এ প্রবেশ করলাম। মুহুর্তের মধ্যে স্থান-কাল সব পাল্টে গিয়ে এসে পড়লাম ২০০০ বছর আগের রোমান সাম্রাজ্যে। এখানে গ্রীক ও রোমান শাসকদের পাথরের মূর্তি , তাদের ব্যবহৃত জিনিষ রাখা। রোমান শাসকরা ঠিক যেন আ্যসটরিক্সের বই থেকে উঠে আসা চরিত্র, চোখে মুখে সেই ঊদ্ধত্য, স্বল্প বেশভুষা কিন্তু শরীরে দৃপ্ত পৌরুষ। তাদের পেরিয়ে দোতলায় ওঠার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন দ্য উইংড ভিক্টরি ওফ সামথরেস (The winged victory of Samothrace)। ২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে তৈরী মার্বেলের ৮ ফুট দৈর্ঘের এই মূর্তি গ্রীক বিজয়ের দেবী সামথরেস এর। দেবী যেন সমুদ্রের ঝোড়ো হাওয়া কে অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে আছেন নৌকার পুরোভাগে, হাওয়াতে ও জলের ঝাপটায় আভরণ অসংলগ্ন।

ডানদিকে ঘুরে প্রথম ঘরে ঢুকেই চারদিক ফাঁকা কিন্তু সবার চোখ ছাদের দিকে। সত্যি, কি যে অপূর্ব চিত্রিত ছাদ, কোন অকল্পনীয় ধৈর্য্য আর দক্ষতা থাকলো তবেই কোন মানুষ এরকম নিপুণ ভাবে সাজিয়ে তুলতে পারে একটা সাধারণ ছাদকে। এরকম ৩টে বড় ঘর পেরোনোর পর শুরু হল প্রাক শিল্পবিপ্লবের যুগের শিল্পীদের আঁকা একের পর এক অসাধারণ সব সৃস্টি। মাইকেল এঞ্জেলো আর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এই দুটো নামেই পরিচিত আমি। এখানে এসে মনে হল আমার এই অঞ্জানতা তৈরী হয়েছে শুধু মাত্র ইতিহাস বই এর পাতা মুখস্ত করার দৌলতে। আমার নাম না জানা শিল্পীরাও যে কি অনবদ্য সব শিল্পকর্ম সৃস্টি করেছেন যা তাদের অমর করে রেখেছে প্রায় সাতশ – আটশ বছর পরেও। এভাবে মুগ্ধ হতে হতেই এক সময় মোনালিসার সামনে এসে পড়লাম। তিনি তাঁর বিখ্যাত মুচকি হাসি দিয়ে যথারিতী বহু গুণমুগ্ধ ভক্তকে আকর্ষণ করে ভীড় জমিয়ে নিয়েছেন। মোনালিসার ঠিক বিপরীত দেওয়ালে রাখা একটা ছবি থেকে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারলামনা। এটি ইটালীয়ান শিল্পী পাওলো ভেরোনীস এর আঁকা ‘ওয়েডিং ফিস্ট এট কানা’ (wedding feast at Cana)। ৬৬৬ x ৯৯০ সেমি আয়তনের এই চিত্রটি ল্যুভরে মিউজিয়ামের সংগ্রহের সবচেয়ে বড় ছবি। কোন এক বিবাহবাসরে মদ ফুরিয়ে যাবার পর যিশু পানীয় জলকে সুরায় পরিণত করেন, সেইগল্প অবলম্বনে ভেরোনীসের সৃস্ট এই ছবিটি যাতে প্রায় ১৩০ টি মানব মুর্তি আছে, যদিও তারা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু দেখছে কিন্তু কেউ কথা বলছেনা এবং এক মাত্র যিশু ছাড়া কেউ দর্শকদের মুখোমুখি তাকিয়ে নেই। ভেনিসের চার্চের জন্যে ১৫৬৩ সালে অঙ্কিত এই অতিমানবীয় সৃস্টির সামনে দাঁড়িয়ে স্রস্টা কুর্ণিশ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।

এদিকে ঘড়ির কাঁটা যেন অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কখন যে ৬টা বাজল তা বুঝতে পারলাম ওখানকার কর্মচারীদের তৎপরতায়। কিছুই দেখা হলনা, কত আশা নিয়ে এসেছিলাম নেপোলিয়ানের ঘর, মাইকেল এঞ্জেলোর ‘ক্যাপটিভ’, ভারমীরের আঁকা চিত্র- সব অদেখা থেকে গেল।
ল্যুভরে থেকে বেড়িয়ে শাঁ- জে- লিজে ধরে হাঁটতে থাকলাম মেট্রোস্টেশন এর খোঁজে, ফিরতে হবে ল্যুই মালমাইসন। প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পর, এক ইংরাজী ভাষী যুবকের সাহায্যে যদিও বা কনকর্ড স্টেশন খুঁজে পেলাম, কিন্তু তাতে টিকিট কাটার কোন ব্যবস্থা নেই। আমাদের অপেক্ষা করতে বলে মণিশ ছুটল অপর প্রান্তে টিকিট কাটতে। অনেকেই আমাদের পাঁচ জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিঞ্জাসুদৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্লাটফর্মে অন্তর্হিত হচ্ছে। এক দশাশয়ী মহিলা হঠাৎ কি মনে করে আমাদের উদ্দ্যেশ্যে কিছু একটা বললেন ফরাসীতে আর তার প্রতু্যতরে অনি যা বলল তাতে মহিলা রেগে যারপরনাই বিরক্ত হয়ে প্লাটফর্মের গন্ডী ডিঙ্গিয়ে চলে গেলেন তরতরিয়ে। সেই মুহুর্তে তাতাই হাসিতে প্রায় ফেটে পড়ল। পরে বুঝলাম ও উদ্ধার করেছে যে ভদ্রোমহিলা অনি কে জিঞ্জেস করেছেন অমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা, আমরা কেন দাঁড়িয়ে আছি। তার উত্তরে অনি বলেছে- আমি ফরাসী পছন্দ করিনা, আমাদের বিরক্ত করোনা। তাই শুনে ও নিজেও অবাক। ৩ বছরের চর্চার অভাবে ওর বক্তব্য ‘আমরা ঠিক আছি,আমি ভালো ফরাসী জানিনা’ যে এই রকম বিস্ফোরক উক্তিতে পরিণত হবে তা বেচারা নিজেও বুঝতে পারেনি।
সেই মুহূর্তে অনি ঠিক করল ফ্রান্সে থাকাকালীন কিছুতেই আর ফরাসী বলবেনা।
রাত দশটা নাগাদ লুই মালমাইসঁ স্টেশনে এসে পৌঁছোলাম। সেখান থেকে বাসে করে যেতে হবে প্লেস রিচেল্যু। বাসের ড্রাইভার কে আমাদের গন্তব্য বলল মণিশ আর সাথে জিঞ্জেস করল ভাড়া কত। তার উত্তরে বাস ড্রাইভার ভাঙা ইংরাজিতে বলল ‘স্টেশন যাবে, এই তো সামনেই স্টেশন’। মণিশ যত বলে রিচ্যেলু সে তত স্টেশন দেখায়। কি বিপদে পড়া গেল। আর অনি তো ঠিকই করেছে আর বলবেনা কিছু ফরাসীতে। তাতাই ও নির্বাক। সেই মুহূর্তে চটজলদি বুদ্ধিতে মণিশ ওর আইপ্যাডে রাখা হোটেলের ম্যাপটা দেখাল। সেটা দেখতেই ড্রাইভার এক গাল হেসে বলল ‘ও রিচেল্যু, উঠে পড়, আমি নামিয়ে দেব’। এমনকি সহৃদয় বাস ড্রাইভার আমাদের টিকিটের পয়সা অবধি নিলনা। কিন্তু ওর বলা রিচেল্যু শুনতে আর যাই হোক রিচেল্যু শব্দের ধারে কাছে নয় এটা হলফ করে বলতে পারি।
পরদিন সকালে বেড়িয়ে পরলাম প্লেস রিচেল্যু চারপাশটা দেখব বলে।
ছোট্ট জনপদ এই রিচেল্যু। শহরের মধ্যিখানে একটা চার্চ, তাকে ঘিরে কিছু
দোকানপাট, একটা মিউজিয়াম আর কিছু আর্ট গ্যালারি। শহরের পরিসীমা যত ছোট হোক
না কেন ফ্যান্সের, তার পরিচয় যেন আর্ট গ্যালারির উপস্থিতিতেই। সেদিন
রবিবার বলে চার্চের সামনে বাজার বসেছে-শাক সব্জি থেকে ফল, মাছ, মাংস, হরেক
রকম রুটি – কি নেই সেখানে। গল্পে শোনা ফরাসি রুটি ‘ব্যাগেট’ সত্যি ফরাসিদের
দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। প্রায় প্রতিটি মানুষ এই লম্বা আকারের রুটি ব্যাগেট
কিনছে বাজার থেকে। এখানকার একটা রুটির দেকানে ঢুকে আমাদের তো সুগন্ধেই
প্রাণ আত্মোহারা। কত রকমের যে কেক আর মিষ্টি, তার থেকে কি কিনব বাছাই করা
মুশকিল। যাই হোক কেক পর্ব দিয়ে প্রাতরাশ সেরে প্যারিস অভিমুখে রওনা দিলাম
ট্রেনে করে।

আজ আর কোন ভুল না করে একেবারে সারাদিনের ট্রেনের টিকিট ব্যাগে পুরে চার্লস দ্য গল এটোলে থেকে হলুদ লাইন ধরে সোজা পৌঁছেগেলাম তুলারিস। এই তুলারিস বিখ্যাত বাগানের জন্যে। কিন্তু আমরা এসেছি এখান থেকে বাসে করে প্যারিস শহর ঘুরবো বলে। ১২টা নাগাদ একটা দোতলা বাস আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করল রয়্যাল ওপেরা দিয়ে। এরপর কনকর্ড স্কোয়ার, শাঁ-জে-লিজে দিয়ে আর্ক দি টো্রঁয়া দেখিয়ে তুলারিস বাগানের পাশ দিয়ে চলতে থাকল। ততক্ষণে সীন নদী আমাদের সঙ্গি হয়েছে। এক পাশে সীন নদীর সবুজ জল আর অন্য পাশে ল্যুভরে মিউজিয়াম, নাম না জানা একের পর এক রাজবাড়ি। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর সীন নদী দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল, মধ্যিখানে পর পর দুটো নদী ব-দ্বীপ – ইল-ডা-লে-সাইট আর সেন্ট লুইস। এর মধ্যে প্রথম দ্বীপ টি তেই অবস্থিত এদেশের প্রধান বিচারালয় প্যালাইস দ্য জাস্টিস যেখানে বিচার হয়েছিল মেরী আঁতিনয়েতের। এছাড়া এখানেই রয়েছে নর্টে ডাম ক্যাথিড্রাল। বাসে করে এসব দেখতে দেখতে কখন যে সীন নদীর অপর পারে পৌঁছেছি বুঝতেও পারিনি। হঠাৎ খেয়াল করলাম সীন নদীর পাড় ধরে অনেক সবুজ বাক্স তালা বন্ধ করে রাখা আছে, পরে জেনেছি ওগুলো সব বই এর দোকান এক একটা, যেখানে সব ঐতিহাসিক বই পাওয়া যায় – আর তাই সব দেকান ই নাকি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এর অন্তর্গত।

এরপর বাস আমাদের সোজা নিয়ে এল আইফেল টাওয়ার। বাসের গাইড বিশাল লাইন উপেক্ষা করে আমাদের পৌঁছে দিল একেবারে টাওয়ারের লিফ্টের কাছে। আগের দিন বম্ব আতঙ্কে প্রায় ১২০০ লোক কে বার করে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল আইফেল টাওয়ার। ৩২৪ মিটার উচ্চতার এই টাওয়ার প্রায় ৮১ তলা বাড়ির সমান। এতে তিনটে তল আছে। মাটি থেকে প্রথম তলা পৌঁছোতেই সিঁড়ি ৩০০ টা। তাই লিফ্টে ওঠাই শ্রেয়। দোতলায় উঠে হঠাৎ করে যেন প্যারিস শহরটা হাতের মুঠোয় চলে এলো। দূরের ব্যাসিলিকা স্যাক্রাকুর থেকে কাছের টোকাডরো, পূর্বের নর্টে ডাম থেকে পশ্চিমের স্টেডিয়াম, ছোটো বড় প্যালেস – সবই এক লহমায় চোখের সামনে। শহরটির মধ্যে দিয়ে বাহিত সীন নদী এর সৌন্দর্যের মূল উৎস। এখানে বেশ কয়েকটা দোকান এমনকি একটা রেস্ট্রুরেন্টও আছে!


দোতলার থেকে সর্ব্বোচ্চ তল বা ত্রিতিয় তলেও যাওয়া যায়, কিন্তু এবারের মত দোতলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নেমে এলাম আবার বাস্তবের মাটিতে।
পরদিন বাসে করে আবার লন্ডনের অভিমুখে যাত্রা করলাম সবাই মিলে কিন্তু মনের মধ্যে অজস্র না দেখা প্যারিস ভিড় করে আসতে থাকল এবং নতুন করে বুঝতে পারলাম কেন এই শহর সারা পৃথিবীর মানুষকে অমোঘ আকর্ষণ করে আসছে আদিঅন্ত কাল ধরে।

আজ আর কোন ভুল না করে একেবারে সারাদিনের ট্রেনের টিকিট ব্যাগে পুরে চার্লস দ্য গল এটোলে থেকে হলুদ লাইন ধরে সোজা পৌঁছেগেলাম তুলারিস। এই তুলারিস বিখ্যাত বাগানের জন্যে। কিন্তু আমরা এসেছি এখান থেকে বাসে করে প্যারিস শহর ঘুরবো বলে। ১২টা নাগাদ একটা দোতলা বাস আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করল রয়্যাল ওপেরা দিয়ে। এরপর কনকর্ড স্কোয়ার, শাঁ-জে-লিজে দিয়ে আর্ক দি টো্রঁয়া দেখিয়ে তুলারিস বাগানের পাশ দিয়ে চলতে থাকল। ততক্ষণে সীন নদী আমাদের সঙ্গি হয়েছে। এক পাশে সীন নদীর সবুজ জল আর অন্য পাশে ল্যুভরে মিউজিয়াম, নাম না জানা একের পর এক রাজবাড়ি। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর সীন নদী দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল, মধ্যিখানে পর পর দুটো নদী ব-দ্বীপ – ইল-ডা-লে-সাইট আর সেন্ট লুইস। এর মধ্যে প্রথম দ্বীপ টি তেই অবস্থিত এদেশের প্রধান বিচারালয় প্যালাইস দ্য জাস্টিস যেখানে বিচার হয়েছিল মেরী আঁতিনয়েতের। এছাড়া এখানেই রয়েছে নর্টে ডাম ক্যাথিড্রাল। বাসে করে এসব দেখতে দেখতে কখন যে সীন নদীর অপর পারে পৌঁছেছি বুঝতেও পারিনি। হঠাৎ খেয়াল করলাম সীন নদীর পাড় ধরে অনেক সবুজ বাক্স তালা বন্ধ করে রাখা আছে, পরে জেনেছি ওগুলো সব বই এর দোকান এক একটা, যেখানে সব ঐতিহাসিক বই পাওয়া যায় – আর তাই সব দেকান ই নাকি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এর অন্তর্গত।

এরপর বাস আমাদের সোজা নিয়ে এল আইফেল টাওয়ার। বাসের গাইড বিশাল লাইন উপেক্ষা করে আমাদের পৌঁছে দিল একেবারে টাওয়ারের লিফ্টের কাছে। আগের দিন বম্ব আতঙ্কে প্রায় ১২০০ লোক কে বার করে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল আইফেল টাওয়ার। ৩২৪ মিটার উচ্চতার এই টাওয়ার প্রায় ৮১ তলা বাড়ির সমান। এতে তিনটে তল আছে। মাটি থেকে প্রথম তলা পৌঁছোতেই সিঁড়ি ৩০০ টা। তাই লিফ্টে ওঠাই শ্রেয়। দোতলায় উঠে হঠাৎ করে যেন প্যারিস শহরটা হাতের মুঠোয় চলে এলো। দূরের ব্যাসিলিকা স্যাক্রাকুর থেকে কাছের টোকাডরো, পূর্বের নর্টে ডাম থেকে পশ্চিমের স্টেডিয়াম, ছোটো বড় প্যালেস – সবই এক লহমায় চোখের সামনে। শহরটির মধ্যে দিয়ে বাহিত সীন নদী এর সৌন্দর্যের মূল উৎস। এখানে বেশ কয়েকটা দোকান এমনকি একটা রেস্ট্রুরেন্টও আছে!


দোতলার থেকে সর্ব্বোচ্চ তল বা ত্রিতিয় তলেও যাওয়া যায়, কিন্তু এবারের মত দোতলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নেমে এলাম আবার বাস্তবের মাটিতে।
পরদিন বাসে করে আবার লন্ডনের অভিমুখে যাত্রা করলাম সবাই মিলে কিন্তু মনের মধ্যে অজস্র না দেখা প্যারিস ভিড় করে আসতে থাকল এবং নতুন করে বুঝতে পারলাম কেন এই শহর সারা পৃথিবীর মানুষকে অমোঘ আকর্ষণ করে আসছে আদিঅন্ত কাল ধরে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন