শুক্রবার, ৪ জুলাই, ২০১৪

ফুকেট; যে শহর কখনো ঘুমায় না

 থাইল্যান্ডের একটি শহরের নাম ফুকেট। লক্ষ্য ছিল ট্রেনে  ব্যাংকক থেকে ফুকেট যাওয়ার। বাসে এবং ট্রেনে যেতে সময় লাগে ১২ ঘণ্টার। খুব ভাল ভিআইপি বাসে গেলে খরচ পড়ে ৯০০ থেকে ১১০০ বাথ (২.৭৫ টাকা = ১ বাথ) বাংলা আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা। তবে একটু চালাক না হলে ভ্রমণটা একটু কষ্টদায়ক হবে। কারন অনেক বাস কাউন্টার থেকে ভিআইপি বাসের ছবি দেখিয়ে টাকা নিয়ে সাধারন বাসে ভ্রমন করায়। তবে আমরা এই ফাঁদ থেকে বেঁচে যাই কারন আমাদের সাথে ছিল আমার প্রানপ্রিয় এক দুলাভাই নাম তার মিঠু।
তিনি মোট ৮ বার ব্যাংকক ২ বার ফুকেট ভ্রমন করেন। তাই তিনি বাস না দেখে টিকেট কিনবেন না বলে চলে আসেন কাউন্টার থেকে। এবার পরিকল্পনা ট্রেনে যাওয়ার। তবে ব্যাংকক থেকে সরাসরি ট্রেনে ফুকেট যাওয়া যায় না। ব্যাংকক রেইলষ্টেশন থেকে সুরাত থানি এবং সেখান থেকে বাসে ফুকেট। ট্রেন খরচ অবশ্য অনেক কম। অবাক করা কাণ্ড হচ্ছে ট্রেনে উঠার পড়েই দেখতে পাই এয়ারহস্টেজের মতো কয়েকটা মেয়ে। উঠতেই জুস, পুডিং কেক, পানি ইত্যাদি খেতে দেয়। ৮ ঘণ্টা পর সুরাত থানি থেকে নেমে এবার নিজের চোখে ভিআইপি বাস দেখে টিকেট কিনলাম। সেখান থেকে প্রায় ৫ ঘণ্টা সময় লাগে ফুকেট যেতে। সেখান থেকে ট্যাক্সিতে করে যেতে হবে হোটেলে। মজার বেপার হচ্ছে বাংলাদেশে জনপ্রিয় এফ প্রিমিও, এক্স করলা, জি করলা, এলিঅন গাড়িগুলো সেখানে ট্যাক্সি এবং ভাড়ায় নিয়ে চালানো যায়।
  ফুকেটকে বিদেশীদের শহর বলা হয়।কারন পুরো ফুকেট জুড়ে ব্রিটিশ, আমেরিকান ও মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটকদের সমাগম। বাঙালি নাই বললেই চলে। হোটেলে থাকার খরচ অনেক বেশি হলেও অফ সিজনে ভাড়া অর্ধেক। সিজন হচ্ছে ডিসেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিল। মোটামুটি সাধারন হোটেলের ভাড়া আঠারশ থেকে ২ হাজার টাকা হলেও অফ সিজনে ভাড়া অর্ধেক। আমরাগ্যলারী নামক একটি হোটেলেঅবস্থান করি। ওয়েবসাইটে লিখা ছিল হোটেল থেকে সমুদ্রে হেটে যেতে মাত্র তিন মিনিট সময় লাগে তবে মানুষের নাকি অন্য কোন পশুর তা লেখা ছিল না। কারন আমাদের লাগতো ১২ থেকে ১৫ মিনিট। হোটেলটি ছিল “বাংলা রোড” নামে একটি জায়গায়। নাম বাংলা রোড হলেও বাংলা বা বাঙ্গালিদের সাথে কোন মিল নেই এই রাস্তার। সকালে সব ঠিকঠাক চললেও রাতে এই রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। সারা শহর আলোয় আলোকিত হয়। নাচ, গান, জাদু, কনসার্ট আরো কতকি। রেস্টুরেন্ট গুলোতে মদ ও বিয়ারের ছড়াছড়ি। আর মেয়েরা অর্ধলাঙ্গভাবে টেবিলে টেবিলে গিয়ে মানুষকে বিনোদন দেয়। বাঙালি হিসেবে দেখতে অবাক লাগে যে কিভাবে মানুষ এত ফুর্তি করে। আনন্দ ফুর্তি চলে ভোর ৬টা পর্যন্ত। আবার শুরু হয় রাতে।
 ফুকেটের রাস্তায় রাস্তায় হরেকরকমের খাওয়া পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ফল, নুডুলস, ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাই, সুপ, কেক আরও নাম না জানা অনেক খাবার। তাছাড়া কেএফসি, বার্গার কিং, মেগডোনাল্ডস, সাবওয়েতো আছেই। এদের দামের সাথে বাংলাদেশের আকাশ পাতাল তফাৎ। মাত্র দেড়শ টাকায় ১লিটার কোক, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইসহঅনেক মজার মজার খাবার পাওয়া যায় কেএফসিতে। সুইনসেন্স নামের একটি আইসক্রিমের দোকানে মাত্র চারশ বাথে আমরা ৯ স্কুপ আইসক্রিম এবং আরও হরেক রকমের বিস্কিট ও চেরি খাই যার মূল্য বাংলাদেশে ২ হাজারের কম হবে না। বাংলাদেশে যেমন ফুতপাথে চা, কেকের দোকান ঠিক তেমনি ফুকেটে রাস্তায় রাস্তায়ে থাই ও চাইনিজ খাবারের দোকান। দামও অনেক কম।
হোটেলে এবং শপিং মল গুলোতে বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ কার্ড পাওয়া যায়। সেখান থেকে একটা কার্ড বেছে নেই। এই কার্ড গুলো কেনার মাধ্যমে ফুকেটের বিভিন্ন দ্বীপ আমরা ঘুরবো সারাদিন। দাম ছিল জনপ্রতি ১২০০ বাথ। স্পীডবোটে সমুদ্র পারি দিলাম আমরা। বোটে আমাদের সাথে চিনা, আমেরিকান, জাপান, এবং সৌদি আরবের মোট ৩০ থেকে ৩৫ জন ছিল।
 বোটে আমাদের জন্য অনেক কোকাকোলা, বিস্কুট, পাউরুটি, কলা এবং খাবার পানি রাখা ছিল। থাই গ্রীন আপেলের তৈরি বিস্কুট খেতে খুব সুস্বাদু ছিল। একটা ফ্রিজভর্তি কোকাকোলা ছিল। যে যত খেতে পারে। সেখানে আমাদের মতো বাঙ্গালিরা কম যাবে? পেটে যায়গা নেই তবুও একটার পর একটা  বোতল খুলেছি আর খেয়েছি আমরা চার ভাই। থাইল্যান্ডের কলা বলে কথা। ২ টা নিয়েছি কিন্তু স্বাদ পুরো দেশি কলার মতো। যাক বিদেশে অন্তত দেশি কলার স্বাদ পেয়ে খুব ভাল লাগছিল।২৫০ মিলি. পেট বোতলে পানি ভর্তি ছিল তবে মজার বেপার হচ্ছে বিদেশিরা বোতল থেকে পাইপে করে পানি পান করছিল। সবার সামনে মান রাখতে গিয়ে আমরাও পাইপ দিয়ে পানি পান করেছি।
সবচেয়ে কষ্টদায়ক বেপার ছিল যে পাউরুটিগুলো অনেক শক্ত। কলা পাউরুটি খাওয়ার স্বাদটা মিটলো না।সমুদ্রের চারপাশে শুধু দ্বীপ আর দ্বীপ। চোখ ফেরানো যায় না। মায়াবী, ফি ফি আইল্যান্ড, মাংকি বীচ সহ আরও অনেক গুলো দ্বীপে আমাদেরকে নামানো হয়। সবচেয়ে অলৌকিক বিষয় ছিল মাংকি বীচ আইল্যান্ডে অনেকগুলো বানর বসবাস করে। আসে পাশে কোন বাড়িঘর বা খাবার দোকান নেই আর বানররা সমুদ্রের পানি ভয় পায় বলে পানি থেকেও কোন খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। শুধুমাত্র পর্যটকদের দেয়া কোক, পানি এবং কলা খায় তারা। আমাদের কলাগুলোও বানরের জন্যে আনা হয়েছিল তবে অনেক হাসি পেয়েছে যখন আমাদের গাইড বলল যে বোটের মাংকিগুলো সব কলা খেয়ে ফেলেছে।
 মাঝ সমুদ্র,গভিরতা ২০ মিটার। লাইফ জ্যাকেট পড়ে সবাই প্রস্তুত পানিতে গোসল করবে। আমিও মহামানবের মতো ভয়ে ভয়ে পানিতে নামবো।নেমে গেলাম আল্লাহ’র নাম নিয়ে। হাবুডুবু খেলাম ভাসতে কষ্ট হচ্ছিলো তবে কোন মতে এই অভিজ্ঞতাটাও নিয়ে ফেললাম। ঢাকায় গিয়ে বলতেতো পারবো সবাইকে। এরপর নিয়ে গেল সমুদ্রের আরেক পাশে এবার পানির ভিতর মাথা ঢুকিয়ে মাছ দেখা ও তাদের খাওয়ানোর পালা। এবার আমাদের গাইড অবাক হয়ে গেল আমাদের মতো মহামানবদের মহাকান্ড দেখে। যেই শক্ত পাউরুটি আমরা খেয়েছিলাম সেটা আনা হয়েছিল মাছগুলোকে খাওয়ানোর জন্য। মুখে অক্সিজেন মাস্ক পড়ে ঢুকে গেলাম ভিতরে। মনে হচ্ছিলো যেন টেলিভিশানে দেখছি। কানের মধ্যে শব্দ হচ্ছিলো পানির। সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো।সবকিছু শেষে সন্ধায় হোটেলে ফিরে আসলাম। এসে ভাবলাম এর হয়তো এইসব দেখার ভাগ্য হবে না। এবার কেনাকাটা করার পালা।
 কেনাকাটার জন্যে ব্যাংকক’র মতো বিখ্যাত না হলেও ফুকেটে বেশ কয়েকটি শপিং মল রয়েছে। এর মধ্যে জাংসিলন অন্যতম। পাতং বীচের পাশে অনেক বৃহদাকৃতির এই মল। বিদেশীদের শহর বলে সব পণ্যের দাম কিছুটা বেশি।তবে দৈলন্দিন ব্যবহৃত সব পাওয়া যায় এখানে। । তাছাড়া বিশ্ববিখ্যাত সব খাবারের দোকানগুলো রয়েছে এখানে। আরফুকেটের ফুটপাথে জার্সি থেকে শুরু করে পেনড্রাইভ, আইফোন সবই পাওয়া যায়। আমিও ফুটপাথ থেকে চেলসি’র একটি জার্সি কিনি তবে বাংলাদেশে সবাইকে বলেছি, “থাইল্যান্ড থেকে আনা। অরিজিনাল জার্সি।”দামও অনেক কম। মাত্র ২০০ বাথ। তবে ফুটপাথে একটাই সমস্যা ট্রায়েল দেয়ার জন্যে কোন জায়গা নেই। সব লজ্জা ত্যাগ করে আমিও সবার সামনে নিজের শার্ট খুলে জার্সিটা পড়ে দেখছিলাম ঠিক আছে কিনা। আমার ভাই বাপ্পিও ফুটপাথ থেকে রেই-বেনের একটি অরিজিনাল সানগ্লাস কিনে। দাম দেড়শ বাথ।
 ফুকেটের মানুষ অনেক নম্র ও ভদ্র। আমি যখন রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম তখনি দূর থেকে একটি মেয়ে স্কুটিতেকরে আসছিল। আমাকে দেখে প্রায় ১০ মিটার দূরে থেমে গেল। আমিও থেমে তাকে যেতে বললাম। মেয়েটি কিছু না বলে হাসি মুখে আমাকে যেতে বলল। আমিও একটি হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলাম আর ভাবলাম কোথায় আমরা আর কোথায় তারা। তবে তবে তবে ফুটপাথে থাইগ্লাস দেয়াঅনেক দোকান রয়েছে যেগুলোর বাইরে মেয়েরা বসে “মাসাজ, মাসাজ” বলে চিৎকার করছে। আমার দুলাভাইয়ের হাত ধরে ভিতরে যেতে বলছিল একটা মেয়ে। আমি সাংবাদিকতার ছাত্র। হাত ধরার সময়ে ভিডিও করতে ভুলিনি, আর ভিডিও আমার বোন মুমু’কে দেখাতেও ভুলিনি।আমার শরীরেও হাত দিয়েছিল, ভাইদের সামনে লজ্জা পেলেও বিষয়টা আমি উপভোগ করেছি।এমনকি সব বাঙালি এটা উপভোগ করবে। শরীর মাসাজ করার খরচ অবশ্য অনেক বেশি। পা মালিশ করাতে ঘণ্টায় দুই থেকে তিনশ বাথ আর শরীর মালিশ করাতে ৬০০ বাথের বেশি খরচ পড়ে। মনে অনেক খায়েশ থাকা সত্ত্বেও সকল ইচ্ছাকে মাটি করে শরীর মালিশ না করিয়েই ফিরে আসি ঢাকায়। যাই হোক আপনিও ঘুরে আসতে পারেন ফুকেটে। ফুকেটে ঘুড়তে বেশি কিছু না আপনার ইচ্ছা এবং লাখ খানেক টাকা হলেই চলবে। তবে কিছু টিপস মনে রাখলে হইতো আপনার ফুকেট ভ্রমন আরও ভালো হবে।
  • শপিং মলে নির্লজ্জের মতো দর কষাকষি করতে হবে। পর্যটকদের শহর বলে তারা অনেক বেশি দাম হাকায়।
  • থাইল্যান্ডের কথাও বাংলাদেশী টাকা ভাঙ্গানো যায় না। তাই বাংলাদেশ থেকেই টাকাকে ডলারে রুপান্তর করে নিয়ে যেতে হবে। এবং কোনভাবেই বিমানবন্দর থেকে টাকা ভাঙ্গানো যাবে না। তারা কমিশন বেশি রাখে।
  • ফুকেট শহরে হরেকরকমের খাবার ও বিনোদনেরমাধ্যম রয়েছে। নিজের আত্মাকে কষ্ট না দিয়ে যখন যেটা করতে ইচ্ছা করবে বা খেতে ইচ্ছা করবে কিছু না ভেবে আগে সেটাই করবেন কেননা পরবর্তীতে ঢাকায় এসে আফসোস করতে হবে।
 মোঃ আদনান রহমান

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন