বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০১৪

ড্রাগন জাতির দেশে

মোল্লা বাড়ির বৌ বললেন তিনি সফরে যেতে চান। যে সে সফর না, বিদেশ সফর। বিদেশ যাবার নাম শুনলেই আমার হৃদকম্প শুরু হয়। ভিসার জন্য নানা ঝামেলা, ছূটোছুটি, সময় নষ্ট। সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা থাকলে দূতাবাসের কেরানির শীতল অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দেখে নিজেকে বিন লাদেনের অনুগত অবৈধ অভিবাসন সন্ধানী বলে মনে হয়। কিন্তু বিবির আবদার বলে কথা, আমি লাচার। বললাম, তথাস্তু, তবে এমন দেশে যাব যেখানে ভিসা লাগে না। কাছে-পিঠে এমন দুটো দেশ আছে, নেপাল ও ভুটান। নেপাল আগেই ঘোরা হয়েছে, তাই ভুটান যাওয়াই সাব্যস্ত হল। ভুটানের বিমানবন্দরে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে হাজির হলেই ওরা ঢুকার অনুমতি দিয়ে দেয়। ভারত ও মালদ্বীপ ছাড়া অন্য সব দেশের নাগরিককে আগে থেকেই ভিসার ব্যবস্থা করে রাখতে হয়। পৃথিবীতে বোধ হয় ভুটানই একমাত্র দেশ যেখানে ঢুকতে বাংলাদেশী নাগরিকদের উন্নত দেশের নাগরিকদের তুলনায় ভিসার ঝামেলা কম হয়।

ঢাকা থেকে ভুটানের ড্রুক এয়ারে চেপে ভুটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পারো পর্যন্ত যাওয়া যায়। চারদিকে পাহাড়, মাঝখানে এক চিলতে রানওয়ে। পাহাড়গুলো সবই বিধ্বস্ত র‍্যাংস ভবন থেকে অনেক উঁচু। বিমান চালকদের দক্ষতার তারিফ করতে করতে সেখানে নামলাম আমরা। ছোট বন্দর, অল্প সময়ে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস পার হয়ে এলাম। থিম্পু থেকে আমাদেরকে হোটলে নেবার জন্য এক লোক গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল।


চার ধারে পাহাড়ের মাঝখানে ছোট্ট পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

মাথাপিছু জিডিপির বিচারে ভুটান আমাদের চেয়ে ধনী, প্রায় তিন গুণ। তবে ভুটান মনে করে জিডিপি বা জিএনপি না, জিএনএইচ, মানে Gross National Happiness দিয়ে একটি জাতির অবস্থা বিচার করা উচিত। ভুটানে পৌঁছানোর কিছক্ষণের মধ্যেই অবশ্য আমার বিবির happiness উধাও হয়ে গেল। আমাদের গাড়িতে বসিয়ে ড্রাইভার গেছে অন্য দু'জন বাংলাদেশী পর্যটককে নিয়ে আসার জন্য। বহুক্ষণ ধরে তাঁদের আসার নাম নেই। বিবি কী ধরনের টক-ঝাল বাক্যবাণ তাঁদের প্রতি হানা যায় সে পরিকল্পনা আঁটছেন। শেষ-মেষ যখন দু'জন এলেন, চেহারা দেখে বোঝা গেল তাঁদের happiness অধমের বিবির থেকেও নিম্নস্তরে নেমে গেছে। দু'জনের একজন দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ বেনসন সিগারেট নিয়ে এসেছিলেন, ভুটানের কাস্টমস সিগারেটের দামের তিন গুণ শুল্ক আদায় করেছে। বাক্যবাণ তুণেই রয়ে গেল। পৃথিবীতে বোধ হয় ভুটানই একমাত্র দেশ যেখানে সিগারেট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিদেশীরা আড়ালে খেতে পারেন, তবে শুল্ক দিয়ে সিগারেট আনতে হয়। দোকানে পাওয়া যায় না।

রাজধানী থিম্পুর দিকে রওনা হলাম। গাড়িতে এক ঘন্টার রাস্তা। দু'ধারে পাহাড়, খাড়ি, নদী, জঙ্গল, সুন্দর দৃশ্য। দেখতে দেখতে আমার ব্যক্তিগত happiness অনেক বেড়ে গেল। ভুটানে সমতল ভূমির বড় অভাব। বিমান বন্দরের মতই থিম্পু উপত্যকা পাহাড়ের মাঝখানে। থিম্পু শহরের কেন্দ্রে আমাদের হোটেল। সামনে এক লেনের রাস্তা। সুশৃঙ্খল্ভাবে গাড়ি চলছে। অযথা হর্ন বাজানোর প্রবণতা নেই। পৃথিবীতে বোধ হয়ে ভুটানই একমাত্র দেশ যেখানে রাজধানীর রাস্তায় ট্রাফিক বাতি নেই।

রাস্তায় আমার ধারণার চেয়েও বেশি গাড়ি দেখলাম। বেশির ভাগই (আমার ছোট জরিপে ৯৫ শতাংশই) মারুতি-সুজুকি অথবা হিউন্দাই। আমার ধারণা ছিল ভুটানের নাগরিকদের সাধারণ্যে পশ্চিমা পোশাক পরা নিষেধ। সেই ধারণাও দেখলাম ভুল।

হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে দৃশ্য দর্শনে বেরুলাম। প্রথমে একটি বৌদ্ধ স্তুপ, তারপর পাহাড় চূড়ায় বৌদ্ধ মূর্তি। ভুটানের অধিকাংশ নাগরিক মহাযান ধারার বজ্রযান তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।


রামধনুর দিকে মুখ করে থিম্পু শহরের উপর নজর রাখছেন ভগবান বুদ্ধ


বৌদ্ধ স্তুপ।
কৈফিয়তঃ ভুটান ভ্রমণের উপর পোস্ট দিয়েছিলাম অনেক দিন হয়ে গেল। অসুস্থতা এবং নানা ব্যস্ততায় পরবর্তী কিস্তি দিতে দেরি হয়ে গেল, এজন্য দুঃখিত। প্রথম পর্বে যাঁরা মন্তব্য করেছিলেন তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ, তাঁদের উপদেশ মাথায় রাখলাম। তবে লেখা খুব বড় করতে চাই না। আরো দুই কিস্তি শেষ করে রেখেছি। শেষ কিস্তি শিগগিরই দিয়ে দেব। ছবিগুলো যাচ্ছেতাই হয়েছে, ক্যামেরা একটা কিনতে হবে! চোখের পীড়ার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি]

প্রথম পর্ব

বুদ্ধ পয়েন্টের মূর্তি দেখে আমরা নীচে নেমে থিম্পু শহরে ফিরে এলাম। হস্তশিল্পসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকানে ঘুরাঘুরি করে দিনের বাকি সময় কাটল। বেশির ভাগ পণ্যই ভারত থেকে আমদানী করা, দামও খুব বেশি। এত দাম দিয়ে কিছু কেনার ইচ্ছে হল না। আমাদের সফর সঙ্গীরা খবর দিলেন তাঁরা দোকানে রুচি চানাচুর ও ড্যানিশ বিস্কিটের মত বাংলাদেশী পণ্যও দেখেছেন। তবে দাম জিজ্ঞেস করেননি। ভুটানের শিল্প বলে তেমন কিছু নেই। বাজার ছোট (লোকসংখ্যা মাত্র ৭ লাখ), ভূ-প্রকৃত্রির জন্য পরিবহন খরচ বেশি, এই কারণেই হয়ত। ভারত থেকে পাহাড়ি, সর্পিল, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পণ্য আসে তাই দাম পড়ে বেশি।

এদেশের মানুষের আয়ের মূল উৎস কৃষি থেকে। মোট জমির মাত্র ৩ শতাংশ চাষযোগ্য। কিন্তু লোকসংখ্যা কম হওয়ায় তারা মশলা ও ফল চাষ করে রফতানি করে। বাংলাদেশেও আসে। জনসংখ্যা কম হওয়ার আরেক সুবিধা বেকারত্বের হার মাত্র ৪ শতাংশ। পাহাড়ি নদীতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অবারিত সুযোগ আছে, কল-কারখানা না থাকায় চাহিদা কম, ফলে বাড়তি বিদ্যুৎ ভারতে রফতানি হয়।

ভুটানের দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়ানোর সুবিধে হল দোকানীরা বিরক্ত করে না। কোন কিছু গছানোর প্রবণতা তাঁদের নেই। একটা বইয়ের দোকানও পেয়ে গেলাম। সেখানে ইংরেজি বইয়ের যে সংগ্রহ তা বাংলাদেশের কোন দোকানে নেই। আমি যে শহর বা দেশেই যাই স্থানীয় মানচিত্র ও তথ্যমূলক বই কিনি। ভুটানের উপর কিছু বই দেখলাম, কিন্তু কেনার মত টাকা সাথে ছিল না।

ভুটানের টাকার মান ভারতের রূপির সমান। নেপালের মত এখানেও ভারতের রূপি চলে। আমাদের কাছে সামান্য কিছু ভারতীয় মুদ্রা ছিলা, তাই দিয়ে সামান্য কিছু খাদ্য দ্রব্য কিনে চেখে দেখা হল। যেহেতু এখানে কেনা-কাটা করার মত তেমন কিছু নেই, হোটেল-খাবার-পরিবহনের টাকা আগেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে, আরো সামান্য কিছু স্থানীয় বা ভারতীয় মুদ্রা হলেই আমাদের চলে। মুশকিল হল আমাদের কাছে ডলারের ছোট নোট নেই। ১০০ ডলারের নোট ভাঙ্গালে যে পরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা পাওয়া যাবে তা খরচ করা সম্ভব হবে না। অল্প কিছু স্থানীয় মুদ্রা আর বাকিটা খুচরা ডলার হিসাবে ফেরত পেলে আমাদের সুবিধা হয়। হোটেলে বলল তাঁরা প্রতি ডলারে ৫২ ভুটানি মুদ্রা (নুলত্রাম) দিবে। তারাই বলল ব্যাংকে প্রায় ৫৬ নুলত্রাম করে পাওয়া যাবে।

হোটেলের উল্টোদিকেই ড্রুক পিএনবি ব্যাংক। ব্যাংকের লোগো এবং পিএনবি দেখে বোঝা যায় এটা ভারতের পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের ভুটানি প্রতিষ্ঠান। সকালে সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম তারা ৫৫ নুলত্রাম হারে ডলার ভাঙ্গিয়ে দেবে, কিন্তু কোনে খুচরা ডলার ফেরত দেবে না। ডলার না ভাঙ্গিয়েই দ্বিতীয় দিনের দৃশ্য দর্শনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।

প্রথম গন্তব্য থিম্পু ও গান্তের মধ্যবর্তী একটি গিরিপথ। চড়াই বেয়ে উঠতে হয় ৩৫০০ মিটার (থিম্পুর উচ্চতা ২১০০ মিটার)। পথে একটি চেক পোস্ট পড়ে, সেখানে পাসপোর্ট জমা দিয়ে যেতে হয়। ফেরার পথে ফেরত দিয়ে দেয়। এখানে দর্শনীয় জিনিস দু'টো। এক হল ১০৮ বৌদ্ধ স্তুপের সমারোহ। মাঝখানের স্তুপটি বড়। তার চার পাশে ১০৭টি ছোট স্তুপ। মুসলমানরা যে রকম দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে কাবাগৃহ প্রদক্ষিণ করে, বৌদ্ধরা তেমন মন্ত্র জপতে জপতে স্তুপ প্রদক্ষিণ করে। পার্থক্য হল মুসলমানরা ঘোরে কাবাকে বাঁয়ে রেখে, আর বৌদ্ধরা চক্কর দেয় স্তুপকে ডানে রেখে।


১০৮ স্তুপের সমাহার

স্তুপরাজির বিপরীতে একটি বৌদ্ধ বিহার। জুতো খুলে ভিতরে ঢুকে দেখা গেল সেখানে তিনটি বিশাল মূর্তি। মাঝখানেরটা ভিক্ষাপাত্র হাতে ভগবান বুদ্ধের। একজন ভিক্ষু সেখানে বসে বসে জপ করছিলেন। তিনি উঠে বাতি জ্বালিয়ে দিলেন আমাদের সুবিধের জন্য। তিনি জানালেন বুদ্ধের ডান পাশে যাঁর মূর্তি, তিনি গুরু পদ্মসম্ভবের। গুরু রিনপোচে নামে তিনি ভুটানিদের কাছে পরিচিত। বর্তমানের পাকিস্তানের সোয়াত অঞ্চল থেকে এসে তিনি ভুটানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন করেন। ভুটানিরা তাঁকে বুদ্ধের অবতার হিসাবে মানে। পদ্ম ফুল থেকে জাত রিনপোচের কথা পরে আরো আসবে।

আবহাওয়া ভাল থাকলে এখান থেকে বরফ ছাওয়া হিমালয়ের গিরিশৃঙ্গ দেখা যায়। একটা ছোট তালাবদ্ধ ঘরে পর্বত চূড়া দেখার জন্য টেলিস্কোপ আছে দেখলাম। তবে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় আমরা কিছুই দেখতে পারলাম না।

হোটেলে দুপুরের খাবার সেরে ফের বের হলাম। প্রথমে আরেক পাহাড় চূড়ায় বিবিএস বা ভূটান ব্রডকাস্টিং সিস্টেমের সম্প্রচার কেন্দ্র। বিবিএস-এর দেখার কিছু নেই, তবে ঐ পাহাড় থেকে প্রাক্তন রাজার প্রাসাদ, সংসদ ভবন, থিম্পুর প্রধান জং এবং মন্ত্রীদের আবাসিক এলাকা দেখা যায়। মন্ত্রীদের বাসস্থান সুন্দর কিন্তু সাদামাটা, ভূটানের অধিকাংশ বাড়ির মত টিনের চালে ছাওয়া। রাজা-বাদশাহরা সাধারণত আলিশান সমীহ জাগানিয়া ভবনে থাকেন, তাতে তাঁদের শক্তি ও আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটে। বর্তমানকালে পৃথিবীতে ভুটানই সম্ভবত একমাত্র দেশে যেখানকার রাজা স্বেচ্ছায় নিজের ক্ষমতা খর্ব করে গণতন্ত্রের ব্যবস্থা করেছেন। এই কাজটি করেন ভুটানের চতুর্থ রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক। এরপর তিনি তাঁর ছেলের উপর দায়িত্ব দিয়ে সিংহাসন ছেড়ে দেন। ওয়াংচুকের বাড়ি গাছপালার অবগুন্ঠনে ঢাকা, সহজে চোখেই পড়ে না। পাশেই বিশাল সংসদ ভবনের সদম্ভ উপস্থিতি। সংসদ ভবনের সামনে থিম্পুর জং। এখানে রাজার দফতর, দরবার ও কিছু মন্ত্রণালয়ের দফতর অবস্থিত।

জং-এর বিষয়টা একটু বলা দরকার। ভুটানের উত্তর সীমান্তে তিব্বত। তিব্বত থেকে বিভিন্ন সময় ভিন্ন মতাবলম্বী বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা ধর্মীয় নিগ্রহের শিকার হয়ে ভুটানে আশ্রয় নিয়ে তাঁদের ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করেছেন। এঁদের কারণে তিব্বত প্রায়ই ভুটানের উপর হামলা চালিয়েছে অতীতে। এমন এক ধর্মগুরু ছিলেন শবদ্রুং নাওয়াং নামগিয়াল। তিনি শুধু ধর্মবেত্তাই ছিলেন না, সামরিক বিশষজ্ঞও ছিলেন। তিনি ভুটানের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে কিছু দুর্ভেদ্য ভবন তৈরি করেন যা একাধারে প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনের কেন্দ্র হিসাবে কাজ করত। তিব্বতীদের আক্রমণ এখান থেকেই প্রতিহত করা হত। ক্ষুদ্র ভুটান বার বার বিশাল তিব্বতের আগ্রাসন রুখে দাঁড়িয়েছে। এ দুর্গ ভবনগুলোকেই বলা হয় জং। সেই জংগুলো এখনো অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দফতর হিসাবে কাজ করছে।

বিবিএস-এর চূড়া থেকে নেমে আমরা গেলাম সেই জং-এর কাছে। যখন পৌঁছুলাম তখন দিনের শেষে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্টানের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা অবনমনের কাজ শুরু হয়ে গেছে। পতাকাকে এরা খুবই সম্মান করে। আনুষ্ঠানিকভাবে যেখানে পতাকা উড়ে সেখানে হাতকাটা জামা বা স্যান্ডেল পরে যাওয়া যায় না; ফুল হাতা জামা ও জুতো পড়া নিয়ম।


ভুটানের ফ্ল্যাগ-এ ড্রাগনের ছবি। ভুটানি ভাষায় ড্রুক মানে ড্রাগন। ড্রুকয়ুল মানে ড্রাগন জাতির দেশ, ভুটান। ভুটান শব্দটা এসেছে সংস্কৃত 'ভূ উত্থান 'থেকে।


ছবির বামদিকে মাঝামাঝি সংসদ ভবন। তার ডানে ৪র্থ রাজার প্রাসাদ। সামনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দফতর। এগুলোর বাঁ পাশে জাতীয় পতাকা উড়ছে। আমরা জং-এ পৌঁছাতেই এই পতাকা নামানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছিল।


থিম্পুর জং।


পতাকা গুটিয়ে বাদ্য সহকারে ভবনের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।


জং-এর ভেতরের আঙ্গিনা থেকে তোলা দৃশ্য।

জং-এর একাংশে দর্শনার্থীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। সেদিকটা ঘুরে দেখে আমরা ফিরে চললাম হোটেলে। পরদিন প্রাতঃরাশ সেরে যেতে হবে পারোর পথে। স্থানীয় বা ভারতীয় মুদ্রার সংস্থান হল না। হোটেলের কর্মচারীদের বখশিস দেওয়া সম্ভাব হবে না। অন্তত সেদিন সম্ভব হবে না, তবে নানা কৌশল অবলম্বন করে পারো থেকেই তাঁদের যৎকিঞ্চিৎ বখশিস দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। 
পরদিন লুচি-শব্জী দিয়ে নাস্তা সেরে গাড়িতে রওনা দিলাম পারোর পথে। আগেই বলেছি এক ঘন্টার পথ। দু’ধারে সুন্দর, প্রাকৃতিক দৃশ্য। দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। পথে একটি জায়গা আছে যাকে ইংরেজিতে Confluence বলে। ভুটানি নামটা ধরতে পারলাম না। বাংলায় ত্রিবেণীসংগম বলা যেতে পারে। এখানে পারো ও থিম্পু নদী একধারায় মিলেছে। পাহাড়ি এলাকার রাস্তাও নদীর সমান্তরালে চলে, তাই এখানে তিনটি রাস্তাও মিলেছে; একটি যায় পারোর দিকে, আরেকটি থিম্পুর দিকে আর তৃতীয়টি ভারত সীমান্তে ফুটশোলিংয়ের দিকে। ত্রিবেণীসংগম পার হয়ে বেশ কিছু দূর গেলে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে পারোর বিমানবন্দর দেখা যায়। পরদিন এখান থেকেই দেশে ফিরব।


ত্রিবেণীসংগম। বাম দিকে পারো নদী, মাঝামাঝি থিম্পু নদী, ডানে মিলিত ধারা। থিম্পু নদীর সমান্তরাল থিম্পু যাবার রাস্তা দেখা যাচ্ছে।


পাহাড়ের উপর থেকে দেখা পারো বিমানবন্দর।

পারো খুবই ছোট, ছিম ছাম শহর। আমরা যখন পৌঁছালাম তখনো হোটেলের কক্ষ প্রস্তুত হয়নি, তাই মালপত্র রেখে পারোর আশপাশ ঘুরে দেখতে বেরুলাম। শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলে, অন্তত পারো-থিম্পুর সন্নিহিত এলাকায়, ঘরে ঘরে উঠোনে মোটর গাড়ি দেখা যায়। প্রায় প্রত্যেকের একটি ছোট গাড়ি, নিদেনপক্ষে একটি স্কুটার আছে। তবে ভুটানে স্কুটার-মোটর সাইকেল খুব কম চলে, কী কারণে জানি না। পারো শহরের বাইরে দেখলাম বহু রিসোর্ট আছে। একটি ফাইভ স্টার রিসোর্টও দেখলাম।

গাড়িতে আধা ঘন্টা মত চলার পর আমরা একটি ঐতিহাসিক জংয়ের ধ্বংসাবশেষের পাদদেশে উপস্থিত হলাম। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই জং থেকে তিব্বতীদের আক্রমণ প্রতিহত করা হত। পাহাড়ের চারদিকে ভুটানের জাতীয় বৃক্ষ সেডারের বনভূমি। ভূমিকম্পের সময় প্রদীপ পরে জংটিতে একবার আগুন ধরে গিয়েছিল, অর্থাভাবে এর সংস্কার করা আর সম্ভব হয়নি। এখন পরিত্যক্ত। চড়াই ধরে কয়েক মিনিট উঠার পর একটি কৃত্রিম নালা মত চোখে পড়ল, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে গেছে। আমাদের গাইড জানাল বন্দী তিব্বতীদের হত্যা করে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এই নালা দিয়ে নীচের নদীতে ফেলে দেওয়া হত। আরো উপরে জংয়ের ভেতরে একটি খোলা চত্ত্বর, সেখানে যোদ্ধাদের ঘোড়া বেঁধে রাখা হত। দেখলাম একদল ছেলে-মেয়ে সেখানে চড়ুইভাতি করছে। একজন জানাল তাঁরা বিশ্ব বন্ধু দিবস পালন করছে।


পাহাড় চূড়ায় জং-এর ধ্বংসাবশেষ।


এই নালা দিয়ে হতভাগ্য নিহত তিব্বতী সৈন্যদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গড়িয়ে পড়ত।


জং-এর ভেতরে এখানে সৈন্যদের ঘোড়া বাঁধা থাকত।


জং-এর ভেতরে এখন ঘোড়া নেই, বেওয়ারিশ কুকুর আছে।


জং-এর একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন।

জং থেকে হোটেলে ফেরার পথে সম্ভবত ভুটানের সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য চোখে পড়ল। পাহাড়ের খাড়ির উপরে একদম কিনারে বাঘের নীড় মন্দির (Tiger’s Nest Temple)। যেমন অদ্ভূত তার নাম, তেমনি অদ্ভুত তার অবস্থান। বাঘের আবার নীড় হয় কেমন করে? সে গল্প বলি। দেব-দেবী তো বটেই, আধুনিক যান-বাহন আবিষ্কারের আগে দরবেশ-সাধুরাও বাহন হিসাবে অসাধারণ নানান জীব-জন্তুতে সওয়ার হয়ে ভ্রমণ করতেন। হযরত শাহ মখদুম কুমিরের পিঠে চড়ে রাজশাহী গিয়েছিলেন (রেফারেন্সঃ মাসিক দ্বীন দুনিয়া )। কুমারখালীর দরবেশ শাহ সোনাবন্ধু বাঘের পিঠে চলাফেরা করতেন (রেফারেন্সঃ Islam in Kumarkhali)। আগে বলেছিলাম গুরু রিনপোচে ভুটানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ঘটান। তিনি বাঘের পিঠে এখানে এসেছিলেন। তবে হযরত সোনাবন্ধুর চেয়ে গুরু রিনপোচের কুদরতি বেশি ছিল, তাঁর বাঘ পাখির মত উড়তে পারত। বাঘের পিঠে উড়েই তিনি পাহাড় চূড়ায় পৌঁছেছিলেন। সেখানে নির্মিত মন্দিরের নামকরণের সার্থকতা এখানেই।


নেট থেকে নেওয়া ব্যাঘ্র নীড় মন্দিরের ছবি। সূত্রঃ The Blog of the Long Now

দুর্ভাগ্যবশত আমার উড়ন্ত বাঘ নেই, গাড়িতেও সেখানে যাওয়া সম্ভব না। চড়াই বেয়ে হেঁটে মন্দিরে পৌঁছাতে সামর্থভেদে দুই থেকে তিন ঘন্টা লাগে। আমার বিবির হাঁটুর ব্যথা ব্যারাম আছে, অন্য দুই সফর সঙ্গী হাঁটার ব্যাপারে চরম নিরুৎসাহী। এই পথ বেয়ে উঠতে শুধু দম থাকলেই চলে না, হিম্মতও লাগে যথেষ্ট। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের হাতে অত সময় নেই। কাজেই নীচ থেকে মন্দির দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল।

মধাহ্নভোজ শেষ করে হোটেলে উঠে হেঁটে শহর দেখতে বের হলাম। পনের-বিশ মিনিট হাঁটলেই মোটামুটি পুরো শহর ঘোরা হয়ে যায়। আজ রোববার, সাপ্তাহিক ছুটি। ছোট এক চত্ত্বরে দেখলাম বহু বাঙালির সমাবেশ। সিঙ্গাপুর-মালয়শিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে নির্মাণ কাজে প্রচুর বাঙলি শ্রমিক দেখা যায়। ভুটানেও তাই। তবে এরা বাংলাদেশী না, ভারতীয়। ভুটান সংলগ্ন কুচবিহার থেকে এরা বৈধভাবেই আসে শ্রমিক হিসাবে। স্থলপথে আসা, তাই আসার খরচ প্রায় শূণ্য। বেতনও তুলনামূলকভাবে ভাল, অন্তত ওদের ভাষ্য অনুযায়ী।

দোকানে দোকানে ঘুরি। ফল ছাড়া তেমন কিছু কেনার মত নেই। কিন্তু পকেটে ভারতীয় রূপি বা ভুটানি নুলত্রাম নেই। ভুটানের উপর বই আর মানচিত্র কেনার জন্য উশখুশ করছি। এক জায়গায় একটা বড় সুসজ্জিত দোকান পেয়ে গেলাম। ভেতরে হস্তশিল্পের সমাহার। দরজায় Visa-MasterCard-এর চিহ্ন দেখে ঢুকে পড়লাম। বইও আছে পেছন দিকে। একটা বই আর একটা মানচিত্র পছন্দ করে দোকানীর সামনে এসে দাঁড়ালাম থাইল্যান্ড-ভিয়েতনামের মত এখানেও বেশিরভাগ দোকানদার মহিলা। তাঁকে বললাম, আমি বই-মানচিত্র ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কিনব, কিন্তু তুমি কি দামের অতিরিক্ত ৫০০ নুলত্রাম কেটে ঐ পরিমাণ অর্থ আমাকে নগদ দিতে পারবে? আমার সমস্যা তাঁকে বুঝালাম। সে বলল এ রকম করাটা উচিত না, তবে সে নিজেও যেহেতু বিদেশ ভ্রমণ করে, সমস্যাটা সে অনুধাবন করে এবং আমার অনুরোধ সে রাখবে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
পরদিন সকালে বিদায় লগ্নে এই টাকা দিয়েই পারোর হোটেলের দু-তিনজন কর্মচারী ও আমাদের ড্রাইভার-গাইডের বখশিস দেওয়া হল। আর ড্রাইভারের মাধ্যমে থিম্পুর হোটেলের কর্মচারীদের বখশিসও পাঠানোর ব্যবস্থা হল। এরা সবাই খুব অমায়িক, হাসি মুখে আমাদের সব আবদার মেনেছে, তাই বখশিস দিতে মোটেও দ্বিধা ছিল না।


ভুটানি নুলত্রাম।

মোটের উপর ভুটানে ভালই সময় কাটল। যাঁরা প্রকৃতির সান্নিধ্য পছন্দ করেন, বনে ছাওয়া পাহাড়ে হাঁটতে ভালবাসেন, ভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চান, দেব মূর্তি দর্শনে যাঁদের মাথার চুল খাড়া হয় না, তাঁদের বেড়ানোর আদর্শ জায়গা ভুটান। যানজট, জনযট, লোড শেডিং, বায়ু দূষণ নেই। ইংরেজি মোটামুটি চলে। ভর গ্রীষ্মকালেও আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ, কোন ভবনেই এসি নেই, বৈদ্যুতিক পাখাও দুর্লক্ষ্য। তবে ঝকঝকে আকাশ ছোঁয়া ভবন, ঝলমলে নিয়ন বাতি, আলিশান শপিং মল, রোমাঞ্চকর বিনোদন পার্ক পাবেন না। শিশুরা এখানে ঘুরতে হয়ত আগ্রহ পাবে না। ভুটানে দ্রব্য মূল্য বেশি, কিন্তু উচ্চ মূল্যের বিলাসী পণ্য দোকানে নেই।

দেখতে দেখতে তিন দিন কেটে গেল। দেশে ফেরার পথে মনে হচ্ছিল বাহনটা বিমান না হয়ে বাঘ হলে একটু ব্যাঘ্র নীড় মন্দিরটা ঘুরে আসা যেত। হয়ত পায়ে হেঁটেই উঠব ভবিষ্যতে কোন একদিন।
[শেষ]

মন্তব্য

পাহাড়ের খাড়ির উপরে একদম কিনারে বাঘের নীড় মন্দির (Tiger’s Nest Temple)। যেমন অদ্ভূত তার নাম, তেমনি অদ্ভুত তার অবস্থান। বাঘের আবার নীড় হয় কেমন করে? সে গল্প বলি। দেব-দেবী তো বটেই, আধুনিক যান-বাহন আবিষ্কারের আগে দরবেশ-সাধুরাও বাহন হিসাবে অসাধারণ নানান জীব-জন্তুতে সওয়ার হয়ে ভ্রমণ করতেন। হযরত শাহ মখদুম কুমিরের পিঠে চড়ে রাজশাহী গিয়েছিলেন (রেফারেন্সঃ মাসিক দ্বীন দুনিয়া )। কুমারখালীর দরবেশ শাহ সোনাবন্ধু বাঘের পিঠে চলাফেরা করতেন (রেফারেন্সঃ Islam in Kumarkhali)। আগে বলেছিলাম গুরু রিনপোচে ভুটানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ঘটান। তিনি বাঘের পিঠে এখানে এসেছিলেন। তবে হযরত সোনাবন্ধুর চেয়ে গুরু রিনপোচের কুদরতি বেশি ছিল, তাঁর বাঘ পাখির মত উড়তে পারত। বাঘের পিঠে উড়েই তিনি পাহাড় চূড়ায় পৌঁছেছিলেন। সেখানে নির্মিত মন্দিরের নামকরণের সার্থকতা এখানেই। 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন