Posted on June 22, 2013 by mahuya74
আইল অফ মাল কে কি ‘মালদ্বীপ’ বলা যায়? ব্যকরণগত দিক থেকে কোনো ভুল নেই
সে বিষয়এ আমি নিশ্চিত, আর একই শহরে যদি কযেকজন যদু মধু থাকতে পারে তাহলে
পাঁচ হাজার মাইল ব্যবধানে দুই মহাসাগরে দুটো স্থলভাগের নাম এক হবে তাতে
অবাক হবার ই বা কি? আমি যে মালদ্বীপের ভ্রমণ কাহিনী বলতে বসেছি তা
স্কটল্যান্ড এর উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত ছোট্ট একটা দ্বীপ| স্কটল্যান্ড এর
মূল ভূখন্ডের উবান থেকে জাহাজে করে মাত্র ৪০ মিনিটের পথ| কিন্তু মাত্র ৪০
মিনিটের মধ্যে যে এক অন্য পৃথিবীতে পৌছে যাওয়া যায়, প্রকৃতি কে নিবিড়
ভাবে অনুভব করা যায়, তা মালদ্বীপ না গেলে অজানা থেকে যেত| মাত্র ৮৭৫ বর্গ
কিলোমিটার এর দ্বীপ এ জনসংখ্যা আড়াই হাজার এর কিছু বেশি, প্রধান শহর একটাই
– টোবারমরি, রাস্তা একটাই – এ৮৪৯|এছাড়া বড় বসতি সালেন এবং তাতে বড়জোর
গোটা কুড়ি ঘরের বাস| কিন্তু যা অফুরন্ত, প্রাচুর্য্যে পরিপূর্ণ তা হল পশু,
পাখি আর ফুলে ভরা প্রকৃতি|
উবান শহর থেকে কালাডোনিয়ান ম্যাক্ব্রাইন জাহাজে করে ৪০ মিনিট যে কথা দিয়ে চলে গেল বুঝতে পারলামনা| যাবার পথে চারদিকে ছোট ছোট দ্বীপ, তাতে কোথাও একটা লাইট হাউস সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও তীরের ধারে ভাঙ্গা চোরা বাড়ি অজানা ইতিহাস বহন করে চলেছে আবার কোথাও মাথা উচু করে নিজের অস্তিত্ব জাহির করছে স্কটিশ দূর্গ| আমার এই প্রথম স্কটল্যান্ডএ আসা| স্কটিশ লান্ডস্কেপ অসামান্য সুন্দর শুনেছি, গ্লাসগ থেকে বিখ্যাত লক লমন্দ লেকের পাশ দিয়ে আসতে গিয়ে তার যথেষ্ট পরিচয় ও পেয়েছি| লক লমন্দ এর কালো গভীর জল আর তার তীর ধরে পাইন বনানীর ঘন সবুজ রং আর মেঘ রোদ্দুর খেলা প্রাচীন কাল থেকে কবি সাহত্যিকদের প্রেরণা দিয়েছে| স্কটল্যান্ড এর মূল ভূখন্ড থেকে মালদ্বীপ কে আলাদা করেছে ‘সাউন্ড অফ মাল’ প্রণালী| বাকি তিনদিক অতলান্তিক সমুদ্রে ঘেরা| এর পশ্চিমে বিছিন্ন ভাবে আয়না, উল্ভা, ত্রেশ্নিশ দ্বীপপুঞ্জ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে| উবান শহর থেকে কালাডোনিয়ান ম্যাক্ব্রাইন জাহাজে করে ৪০ মিনিট যে কোথা দিয়ে চলে গেল বুঝতে পারলামনা| যাবার পথে চারদিকে ছোট ছোট দ্বীপ, তাতে কোথাও একটা লাইট হাউস সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও তীরের ধারে ভাঙ্গা চোরা বাড়ি অজানা ইতিহাস বহন করে চলেছে আবার কোথাও মাথা উচু করে নিজের অস্তিত্ব জাহির করছে স্কটিশ দূর্গ|
মালদ্বীপ এর ক্রাগনিয়ার বন্দরে যখন জাহাজ ভিড়ল বিকেল ৩টে নাগাদ তখন কল্পনাও করতে পারিনি কি অপেক্ষা করেআছে আমাদের জন্যে| বন্দর বলতে আমরা ঠিক যেমন ভাবি এ তেমন বন্দর নয়| একটি মাত্র জেটি, তাতে একটিই জাহাজ যাতায়াত করে উবান থেকে প্রতি এক ঘন্টা অন্তর| জাহাজের পেটের থেকে বেরিয়েই এ৮৪৯ রাস্তা, সমুদ্র ধার ধীরে দু দিকে চলে গেছে| আমাদের গন্তব্য এখন উইগ- ম্যালারিস লজ| এখানে রাস্তার গতি নির্ধারিত করা আছে মাত্র ২০ মাইল/ঘন্টা, চারদিকের শোভা এতই মনকাড়া যে গাড়ি চালক কি ভাবে মনোযোগ রাস্তায় রাখছে সেটাই আশ্চর্যের| দ্বীপ ই বটে, নির্জন, শুনশান, পাখির আওয়াজ আর পাড়ে সমুদ্রের জল এর ছলাত ছল আওয়াজ ছাড়া নিস্তব্ধ চারদিক | মিনিট দশেক যাবার পর গাড়ির জিপিএস আমাদের যেখানে বাঁ দিকে ঢুকতে নির্দেশ দিল সেখানে কোনো পথ তো নেই বটেই বরং খাড়া পাহাড়ের ঢাল| অগত্যা লজএর মালিক এন্ড্রু কে ফোন করতে গিয়ে দেখা গেল মোবাইল এর কোনো কানেকশন নেই! সত্যি, দ্বীপ তো এমনি হওয়া উচিত, তাই না! বাকি পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বিহীন – তবেই না দ্বীপে থাকার মজা| কিন্তু ভোর ৪টে তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় সাড়ে ৫০০ মাইল পেরোনোর পর বোধহয় রোমান্টিসিজম উধাও হয় মন থেকে, তখন শুধু অবুঝ প্রাণ এক চা চায়| প্রায় চা এর তাগিদেই বোধহয় সামান্য সিগনাল সম্বল কে এন্ড্রুকে ফোনএ পাওয়া গেল, তার নির্দেশ মত সেখান থেকে একটা বাড়ি পরে কিনা আমাদের লজ! উইগ ম্যালিরিস এর অবস্থান ঠিক যেন ক্যালেন্ডারের কোনো ছবি | সামনে দিয়ে পাহাড়ি নদী লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে রাস্তা পেরিয়ে সমুদ্রের দিকে| বাঁ পাশে উঁচু পাহাড় ঘন সবুজ পাইন বনে ঢাকা, তার মধ্যে দিয়ে দুধ সাদা ঝরনা নামছে, আর অন্য দিকে মুক্ত চারণভূমিতে ভেড়ার দল নিশ্চিন্তে বিচরণ করছে|
ঘরে ঢুকে চা খেতে খেতে দেখলাম টেবিল এ একটা মাত্র বই রাখা, Mull in the making – কোনো মানে হয়! এসব আমাকে বিশ্রাম না নিতে দেবার সড়যন্ত্র| পশু পাখির বই ছেড়ে এই বইটাই রাখতে হল! অগত্যা ক্লান্তি ভুলে নিবিড় মনে ৪০ পাতার বই এক ঝলক যা দেখলাম তাতে মালদ্বীপ আমার কাছে এক নতুন অর্থ বহন করে নিয়ে এলো| সেই মুহুর্তে যদি ছুটে বেরিয়ে পড়তে পারতাম! রসালিন্দ জোন্স এর লেখা বই তে যা লেখা আছে তা সংক্ষেপে হল- এই মালদ্বীপ এর বয়স প্রায় ২৭০০ মিলিয়ন বছর| দ্বীপ ভূখন্ডটি আদতে বর্তমান গ্রীণল্যান্ড এর অন্তর্গত ছিল প্যালীয়জৈক যুগ পর্য্যন্ত যা কিনা প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর আগের কথা এবং তখন এর অবস্থান ছিল দক্ষিণ গোলার্ধে| মনে রাখতে হবে এসময় গ্রীণল্যান্ড নিজেই আমেরিকা পাতের সাথে যুক্ত ছিল|
উবান শহর থেকে কালাডোনিয়ান ম্যাক্ব্রাইন জাহাজে করে ৪০ মিনিট যে কথা দিয়ে চলে গেল বুঝতে পারলামনা| যাবার পথে চারদিকে ছোট ছোট দ্বীপ, তাতে কোথাও একটা লাইট হাউস সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও তীরের ধারে ভাঙ্গা চোরা বাড়ি অজানা ইতিহাস বহন করে চলেছে আবার কোথাও মাথা উচু করে নিজের অস্তিত্ব জাহির করছে স্কটিশ দূর্গ| আমার এই প্রথম স্কটল্যান্ডএ আসা| স্কটিশ লান্ডস্কেপ অসামান্য সুন্দর শুনেছি, গ্লাসগ থেকে বিখ্যাত লক লমন্দ লেকের পাশ দিয়ে আসতে গিয়ে তার যথেষ্ট পরিচয় ও পেয়েছি| লক লমন্দ এর কালো গভীর জল আর তার তীর ধরে পাইন বনানীর ঘন সবুজ রং আর মেঘ রোদ্দুর খেলা প্রাচীন কাল থেকে কবি সাহত্যিকদের প্রেরণা দিয়েছে| স্কটল্যান্ড এর মূল ভূখন্ড থেকে মালদ্বীপ কে আলাদা করেছে ‘সাউন্ড অফ মাল’ প্রণালী| বাকি তিনদিক অতলান্তিক সমুদ্রে ঘেরা| এর পশ্চিমে বিছিন্ন ভাবে আয়না, উল্ভা, ত্রেশ্নিশ দ্বীপপুঞ্জ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে| উবান শহর থেকে কালাডোনিয়ান ম্যাক্ব্রাইন জাহাজে করে ৪০ মিনিট যে কোথা দিয়ে চলে গেল বুঝতে পারলামনা| যাবার পথে চারদিকে ছোট ছোট দ্বীপ, তাতে কোথাও একটা লাইট হাউস সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও তীরের ধারে ভাঙ্গা চোরা বাড়ি অজানা ইতিহাস বহন করে চলেছে আবার কোথাও মাথা উচু করে নিজের অস্তিত্ব জাহির করছে স্কটিশ দূর্গ|
মালদ্বীপ এর ক্রাগনিয়ার বন্দরে যখন জাহাজ ভিড়ল বিকেল ৩টে নাগাদ তখন কল্পনাও করতে পারিনি কি অপেক্ষা করেআছে আমাদের জন্যে| বন্দর বলতে আমরা ঠিক যেমন ভাবি এ তেমন বন্দর নয়| একটি মাত্র জেটি, তাতে একটিই জাহাজ যাতায়াত করে উবান থেকে প্রতি এক ঘন্টা অন্তর| জাহাজের পেটের থেকে বেরিয়েই এ৮৪৯ রাস্তা, সমুদ্র ধার ধীরে দু দিকে চলে গেছে| আমাদের গন্তব্য এখন উইগ- ম্যালারিস লজ| এখানে রাস্তার গতি নির্ধারিত করা আছে মাত্র ২০ মাইল/ঘন্টা, চারদিকের শোভা এতই মনকাড়া যে গাড়ি চালক কি ভাবে মনোযোগ রাস্তায় রাখছে সেটাই আশ্চর্যের| দ্বীপ ই বটে, নির্জন, শুনশান, পাখির আওয়াজ আর পাড়ে সমুদ্রের জল এর ছলাত ছল আওয়াজ ছাড়া নিস্তব্ধ চারদিক | মিনিট দশেক যাবার পর গাড়ির জিপিএস আমাদের যেখানে বাঁ দিকে ঢুকতে নির্দেশ দিল সেখানে কোনো পথ তো নেই বটেই বরং খাড়া পাহাড়ের ঢাল| অগত্যা লজএর মালিক এন্ড্রু কে ফোন করতে গিয়ে দেখা গেল মোবাইল এর কোনো কানেকশন নেই! সত্যি, দ্বীপ তো এমনি হওয়া উচিত, তাই না! বাকি পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বিহীন – তবেই না দ্বীপে থাকার মজা| কিন্তু ভোর ৪টে তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় সাড়ে ৫০০ মাইল পেরোনোর পর বোধহয় রোমান্টিসিজম উধাও হয় মন থেকে, তখন শুধু অবুঝ প্রাণ এক চা চায়| প্রায় চা এর তাগিদেই বোধহয় সামান্য সিগনাল সম্বল কে এন্ড্রুকে ফোনএ পাওয়া গেল, তার নির্দেশ মত সেখান থেকে একটা বাড়ি পরে কিনা আমাদের লজ! উইগ ম্যালিরিস এর অবস্থান ঠিক যেন ক্যালেন্ডারের কোনো ছবি | সামনে দিয়ে পাহাড়ি নদী লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে রাস্তা পেরিয়ে সমুদ্রের দিকে| বাঁ পাশে উঁচু পাহাড় ঘন সবুজ পাইন বনে ঢাকা, তার মধ্যে দিয়ে দুধ সাদা ঝরনা নামছে, আর অন্য দিকে মুক্ত চারণভূমিতে ভেড়ার দল নিশ্চিন্তে বিচরণ করছে|
ঘরে ঢুকে চা খেতে খেতে দেখলাম টেবিল এ একটা মাত্র বই রাখা, Mull in the making – কোনো মানে হয়! এসব আমাকে বিশ্রাম না নিতে দেবার সড়যন্ত্র| পশু পাখির বই ছেড়ে এই বইটাই রাখতে হল! অগত্যা ক্লান্তি ভুলে নিবিড় মনে ৪০ পাতার বই এক ঝলক যা দেখলাম তাতে মালদ্বীপ আমার কাছে এক নতুন অর্থ বহন করে নিয়ে এলো| সেই মুহুর্তে যদি ছুটে বেরিয়ে পড়তে পারতাম! রসালিন্দ জোন্স এর লেখা বই তে যা লেখা আছে তা সংক্ষেপে হল- এই মালদ্বীপ এর বয়স প্রায় ২৭০০ মিলিয়ন বছর| দ্বীপ ভূখন্ডটি আদতে বর্তমান গ্রীণল্যান্ড এর অন্তর্গত ছিল প্যালীয়জৈক যুগ পর্য্যন্ত যা কিনা প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর আগের কথা এবং তখন এর অবস্থান ছিল দক্ষিণ গোলার্ধে| মনে রাখতে হবে এসময় গ্রীণল্যান্ড নিজেই আমেরিকা পাতের সাথে যুক্ত ছিল|
মেসোজয়িক যুগের শেষে আটলান্টিক মহাসাগর বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং
আমেরিকা পাত ও ইউরেশিয়া পাতের মধ্যে টান বাড়তে থাকে। এরপরের কেনোজৈক যুগে
আফ্রিকা পাত গন্ডোয়ানাল্যান্ড এর সাথে মিলিত ভাবে উত্তর দিকে সরে
হিমালয়, আল্প্সএর জন্ম দেয় এবংব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ কে ঠেলে সরিয়ে দেয়
নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে। এই সময় আটলান্টিক পাত আরও বৃদ্ধি পেতে থাকলে মালদ্বীপ
গ্রীনল্যাণ্ড এর থেকে পৃথক হয় এবং ডানদিকে সরে এসে বর্তমান অবস্থান পায়।
এই টানাপোড়েনের মধ্যে পরে বহুবার ভূগর্ভের লাভা বেরিয়ে এসে মালদ্বীপের
ভূমিরূপ গঠন গড়েছে বিভিন্ন যুগে। এই দ্বীপের ভূমিরূপ গঠনের শেষ শিল্পী হল
মাত্র ১২০০ বছর আগে শেষ হওয়া হিমযুগ।
আমরা যে ঘরটায় আছি তার ত্রিকোণ ছাদের দুই দিকে দুটো কাঁচের জানলা রয়েছে। ফলে প্রথম দিন রাতে যে অসাধারণ অভিজ্ঞতা হল তা না বললে এই লেখা অনর্থক হবে। ৫৮ ডিগ্রী অক্ষাংশে অবস্থিতির জন্যে মালদ্বীপে গ্রীষ্মকালে এমনিতেই রাতের দৈর্ঘ্য খুবই কম। সেদিন রাতে ১১ টা নাগাদ যে মুহুর্তে বৈদ্যুতিক আলো বন্ধ করে দিলাম সাথে সাথে এক অপার্থিব মেদুর আলোতে সারা ঘর ভরে উঠলো। ছাদের জানালা দিয়ে রাতের আলো এসে যেন ভিজিয়ে দিচ্ছে চারদিক। তার সাথে কাঁচের জানলার উপর বৃষ্টি পরার টাপুর টুপুর আওয়াজ। প্রকৃতির এমন যুগলবন্দির সাক্ষী থেকে প্রথম রাত কেটে যখন ভোর হল তখন বাইরে মেঘের ঘনঘটা সাথে অঝোরে বৃষ্টি।
প্রাতরাশ সারার সময় এন্ড্রু সাবধান বাণী শোনালো যে আটলান্টিক থেকে একটা নিম্নচাপ উত্তরমুখী চলছে এবং তারসাথে এই খারাপ আবহাওয়া, বৃষ্টি নিয়ে এসেছে। তাই আমরা যেন কোনভাবেই উত্তর দিকে না যাই। ১০ টা নাগাদ বৃষ্টি থেমে গেলে আমরা এ৮৪৯ ধরে দক্ষিণমুখো যাত্রা করলাম। মনে মনে ভাবলাম এটুকু তো দ্বীপ তার আবার উত্তর দক্ষিণ! কতটুকু বা সময় লাগবে দক্ষিণ থেকে পশ্চিম হয়ে উত্তর পৌঁছতে! রাস্তার দুধারে ঘন জঙ্গল আর তার মধ্যে রং বেরঙের ফুল ফুটে আছে। রাস্তার ধারে কিছুদুর অন্তর পাশে জায়গা করা আছে উল্টোদিক থেকে আসা গাড়িকে যাতে জায়গা দেওয়া যায়। পুরো দ্বীপটাই সহাবস্থানের মন্ত্রে বিশ্বাসী। প্রায় ২০ মিনিট এভাবে যাওয়ার পর দেখলাম বাঁদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে ডুয়ার্ট কাসল্ এর দিকে| সেই রাস্তা ধরে যেতে যেতে হঠাৎ খেয়াল করলাম জঙ্গল এর মধ্যে ব্লু বেল ফুটে আছে|

সামনে নীল জলের প্রণালী পেরিয়ে অপর পারে মূল স্কটিশ ভূখন্ড| সাদা পালতোলা নৌকার পাশ কাটিয়ে বিশাল জাহাজ পর্যটক বোঝাই করে আসছে উবান থেকে| এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার মূল রাস্তা এ৮৪৯ এ ফিরে এলাম, কিছুদুর যাবার পর আবার বাঁ দিকে রাস্তা চলে গেছে গ্রাস পয়েন্ট এ। জানিনা সেখানে গিয়ে কি দেখতে পাব! ব্লু বেল এর চাদর পাতা রাস্তা দিয়ে লক ডন এর পাশ দিয়ে চলতে থাকলাম প্রায় ৩ মাইল| স্কটিশ লক অর্থে হ্রদ হলেও এই ডন কিন্তু হ্রদ নয় প্রকৃতিগত ভাবে। গ্রাস পয়েন্ট এ পৌঁছে কুচকুচে কালো পাথরের রাশি দেখে যেই না ঘাসে পা রেখেছি অমনি পা ডুবে গেল জলের মধ্যে, বুঝলাম আদতে পুরো জায়গাটা ঘাসে ঢাকা জলাজমি। জুতো ভিজিয়ে যখন কালো পাথরে পৌঁছলাম আমার কোনো আক্ষেপ রইলনা। মিশমিশে কালো ব্যাসল্ট পাথরে সৃষ্ট গ্রাস পয়েন্ট দিয়ে গ্রেট গ্লেন চ্যুতিরেখা (ফল্ট লাইন) আরও দক্ষিন দিকে চলে গেছে।
এখান থেকে ফিরে আবার মূল রাস্তা ধরে স্পেল্ভ লেকের ধার দিয়ে ক্রগান ও ময় কাসল এর দিকে যেতে থাকলাম। লেকের নিস্তরঙ্গ জলরাশির পাশ দিয়ে প্রায় ৪ মাইল গিয়ে ক্রগান পৌঁছে দেখলাম সেটি একটা ছোট লজ। মাত্র একটা লজএর জন্যে একটা গোটা রাস্তা, তার থেকে বড় কথা ম্যাপ এ দেখানো আছে বসতি বলে! এদিকে ঘড়িতে তখন ২.৩০ বাজে, তাই খিদেও জানান দিচ্ছে সত্বর কিছু খাদ্যবস্তু চাই। কিন্তু কোথায় কি? জনবসতির চিহ্ন নেই কোথাও। তবু চলেছি আশায় ময় কাসল এর দিকে, দুর্গ যখন, চা কফি নিশ্চই থাকবে আশেপাশে। পথে সাইকেল আরোহী এক দম্পতিকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কোনো খাবার দোকান আছে কিনা, তারা জানালো এদিকে কোথাও কিছু নেই, কিন্তু এই রাস্তার শেষে সমুদ্রের মুখে তাদের ভাইঝির চা, কফির দোকান আছে। ওই দম্পতিকে তখন মনে হল সাক্ষাত ভগবানের দূত। তাদের কথামত আরও ২০ মিনিট যাবার পর রাস্তা সমুদ্রে মিশে গেল,কিন্তু কোথায় দোকান? বিফল মনোরথে গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে চোখে পড়ল রডোডেনড্রন গাছের আড়ালে একটা ছোট ঘর-এটাই সেই দোকান, কিন্তু মলিকহীন (Honesty shop) – চা কফি, বিস্কিট, কেক এমনকি মাছভাজা অবধি আছে- সবার গায়ে দাম লেখা। একটা বাক্স রাখা আছে টাকা রাখার জন্যে। দোকানের মালিকের সাহস আর মানুষের ওপর তার ভরসা কে কুর্নিশ করে এবংযথেষ্ট উদরপূর্তি করে আবার ফিরে এলাম এ৮৪৯ রাস্তায়।
আগেই বলেছি মালদ্বীপের মুল গঠনের মূলে রয়েছে আগ্নেয় শিলার পাহাড় যা প্রধানত দ্বীপের মধ্যভাগ জুড়ে বিরাজ করছে, এই পাহাড়গুলির তলদেশ দিয়ে সমুদ্রের ধার ধরে এ৮৪৯ ঘিরে আছে সারা দ্বীপকে। কত যে নাম না জানা নদী পার হলাম সাথে ব্লু বেল, রডোডেনড্রন, পাইন বন, সমুদ্রের নীল জল মিলে মিশে এক মোহোময় পরিবেশ।

হঠাৎ খেয়াল করলাম এ৮৪৯ থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে ডানদিকে যা নাকি ‘Scenic route’। মালদ্বীপের সৌন্দর্য্যে আমরা এতটাই মুগ্ধ যে এর পরও আর কোনো সুন্দর রাস্তা থাকতে পারে! তবুও কিঞ্চিত কৌতুহলের বশবর্তী হয়েই সেই রাস্তা ধরে এগোতে থাকলাম। এখানে পাহাড় হঠাৎ করে সমুদ্রে মিশেছে, সর্পিল পাহাড়ি পথের বাঁকে ইয়াকের মত দেখতে পাহাড়ি গরুর আর লোমশ ভেড়াদের চারণভূমি। সমুদ্রের তীরে রং বেরঙের পাখির মেলা আর উন্মুক্ত আটলান্টিকের মধ্যে এক একটা বিন্দুর মত দাঁড়িয়ে আছে স্টাফা, উলভা, লিটল কলোনি দ্বীপ। সুর্য্যাস্তের স্নিগ্ধ আলোর রেশ ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের ঢালে, তারই মাঝে এক এক পাহাড়ের উপর মেঘ ফুঁড়ে সূর্য্যের আলো স্পট লাইট ফেলে নাটকীয় মুহূর্ত তৈরী করেছে, আবার কোথাও সমুদ্র থেকে রামধনু উঠে পাহাড়ের ঢালে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঈশ্বর যেন অকৃপণ হাতে সাজিয়েছেন মালদ্বীপকে, এখানকার অধিবাসীরা তা সযত্নে সংরক্ষণ করছে।

পরের দিনের অভিঞ্জতা একাধারে ভয়ানক আবার অবিষ্মরণীয়। এদিন সমুদ্রপথে স্টাফা এবং ট্রেশ্নিশ দ্বীপ দেখতে সকাল ১১টার মধ্যে পৌঁছোলাম উলভা ফেরি। একেতেই জলে আমার চিরকালের ভয়, তাতে উলভা ফেরির ঘাট কে যে কোনো পুকুরের স্নানের ঘাট হার মানাবে, না আছে একটা সিঁড়ি, না কিছু। সাময়িক ভাসমান একটা ভেলা থেকে উঠতে হবে নৌকায়। উন্মুক্ত আটলান্টিকে যাব কিনা এতটুকু নৌকো করে! এর থেকে নৈহাটি – চুঁচড়ো পারাপারকারি নৌকো প্রায় তিনগুন! প্রমাদগুনে ভেবে যাচ্ছি আকাশ পাতাল। নৌকা চলা শুরু হলে চালক জানালেন সেদিন তিমি এবং হাঙর এর বিপদসঙ্কেত ঘোষিত হয়েছে। একই বলে বিপদ যখন আসে তখন একা আসেনা! মিনিট দশেক যেতেই বুঝতে পারলাম কি বেকামি করেছি এই নৌবিহারে এসে। সমুদ্রকে উত্তাল বললেও কম বলা হয় – বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে নৌকোর গায়ে, ফলে ঠিক কাগজের নৌকোর মত দুলছে এই সামান্য ভেলা। ছলাৎ ছলাৎ জল এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে জানলার কাঁচ। যতদূর চোখ যায় শুধুই উত্তাল সমুদ্র। তারই মধ্যে চালক কত কি যে বলে চলেছে, কিন্তু কিছুই কর্ণগোচরে যাচ্ছেনা। ইষ্টনাম জপতে জপতে ভাবছি কতক্ষণে স্টাফা দ্বীপে পৌঁছাবো। এই দ্বীপ ভূতত্ববিদদের কাছে খুবই গুরুত্বের। পুরো দ্বীপটি ব্যাসাল্ট শিলা গঠিত, প্রতিটা ব্যাসাল্ট স্তম্ভ ছয়কোণ যুক্ত। গ্রীণল্যান্ড থেকে লক্ষ বছর আগে মালদ্বীপ পৃথক হওয়ার সাক্ষীও এই স্টাফা দ্বীপ। কিন্তু এসবতো পুঁথেগত ঞ্জান, তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সব হিসেব পাল্টে দেয়। আমার যাবতীয় জানা ও দেখার ইচ্ছে তখন পরিণত হয়েছে এক খন্ড ভূখন্ডে যেখানে আমি এই জল থেকে নিস্তার পাব। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঘন্টার পর ঘন্টা চলেছি, আর কত দূর? হঠাৎ দেখলাম নৌকোর গতি একটু যেন কমল, চালক ঘোষনা করলেন আমরা স্টাফা দ্বীপের সামনে দাঁড়িয়েছি, কিন্ত সমুদ্র এত অস্থির যে নোঙর করা সম্ভব নয়। হায় ভগবান! আমার শেষ আশাটুকুও শেষ পর্য্যন্ত জলেই গেলো।
স্টাফা থেকে ট্রেশনিশ দ্বীপে পৌঁছতে লাগল আরও আধঘন্টা। তখন ঘড়িতে ২টো বাজে। নৌকো পাড়ে পৌঁছোনোর সাথে সাথে সবাই মুহুর্তের মধ্যে পাথর ডিঙিয়ে এক ছুট্টে দ্বীপের সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের তলদেশে পৌঁছে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এই দ্বীপে আসার কারণ হল পাফিন। সমুদ্রের ক্লাউন নামে পরিচিত এই ছোট্ট পাখি স্কটল্যান্ডের উত্তর পশ্চিম উপকূলের নির্জন দ্বীপের ভৃগুতটে বাসা বাঁধে।

বিশেষঞ্জ থেকে আনাড়ি ফটোগ্রাফার সবাই ক্যামেরা নিয়ে প্রায় মাটিতে শুয়ে পড়েছে ৩৫ সেমি উচ্চতা বিশিষ্ট পাফিনদের ছবি তোলার জন্যে। কিন্তু তাতে পাখিদের কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই। পৃথিবীর এরকম নির্জন প্রান্তে বাস করেও যে কি করে পাফিনেরা ক্যামেরার নৈকট্য সহ্য করে ‘পোজ‘ দিয়ে যাচ্ছে তা সত্যি বিষ্ময়ের। পাফিন বসতির মধ্যেই সাদা, বাদামী ও কালো রঙের খরগোশদের অবাধ বিচরণ। এই দ্বীপেরই অন্যদিকে হাজার হাজার সিগল পাখির বাস। বিকেলের রদ্দুর গায়ে মেখে পাফিন আর সিগলের ‘ফটোশুট‘ দেখার ফাঁকে কখন যে ৪টে বেজে গেছে বুঝতেই পারিনি। এবার ফেরার পালা-অর্থাৎ আবার ঢেউয়ের ইশারায় দুলতে থাকা। কিন্তু নৌকো চলতে শুরু করলে বুঝতে পারলাম এবেলা সমুদ্র বেশ শান্ত। ফেরার পথে আরও অনেক নাম না জানা দ্বীপের পাশ দিয়ে আসার সময় নানা রকমের সামুদ্রিক পাখি, কালো, ধুসর, সাদা ও হলুদ রঙের সীল মাছ দেখলাম। নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিলনা, সত্যি কি সচক্ষে দেখছি, না কি কোন ‘জিওগ্রাফিক চ্যানেল’ এর অনুষ্ঠান! উলভা ফেরিতে ফেরার ঠিক আগে দেখলাম একটা ঈগলকে দুটো কাক তাড়া করছে, কি কান্ড! সেদিনের মত নৌ-অভিযান শেষ করে যখন আবার মাল এর মাটিতে পা রাখলাম তখন প্রায় ৬টা বাজে, গধুলী আলোর সাজে মালদ্বীপ তখন অপরূপ সুন্দরী।
পরের দিন সকাল হতেই কোন পরিকল্পনা ছাড়াই বেরিয়ে পড়লাম। মালদ্বীপের আনাচে কানাচে সৌন্দর্য্যের এত মণিমুক্ত ছড়ানো রয়েছে যে তার জন্য কোন প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়না। সেদিন সলেম হয়ে দ্বীপের উত্তর পশ্চিমে যেতে থাকলাম উলভার পথ ধরে না-কিল লেকের পাশ দিয়ে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে। এই পাহাড়গুলোর উচ্চতা ৩০০ মিটার এর কম বেশি, কিন্তু অতিরিক্ত খাড়া ঢালযুক্ত। এক একটা বাঁক ঘুরলে দেখা যাচ্ছে দিগন্ত জোড়া আটলান্টিকের মধ্যে বিন্দুর মত ভেসে থাকা দ্বীপ- ঠিক যেন নিপুণ শিল্পীর শিল্পকর্ম। যত উত্তর দিকে যেতে থাকলাম, ভুমিরূপ তত পাল্টাতে লাগল। এখানে ভুমিরূপ অনেকটা মালভূমির মত, কিন্তু বড্ড ধূসর। এরই মধ্যে একটুকরো রূপোর খন্ড ক্যালাগরি তটভূমি। ছোট ছোট বালির ঢিবি ঘেরা দুধ সাদা বালিতে তৈরি এই তটভাগ। রোদ ঝলমলে সকালে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সমাবেশ ও চোখে পড়ার মত, বিশেষ করে এরকম নির্জন দ্বীপে।

কিন্তু এই সাদা বালির উৎস কোথায়, সারা দ্বীপে কোথাও বেলেপাথর বা অন্য কোন সাদা পাথরের চিহ্ন নেই। পরে দেখলাম একটা নোটিশ দেওয়া আছে যাতে কেউ যেন ঢিবি খুঁড়ে বালি না নেয়, তার কারণ এই বালি সম্পূর্ণ সমুদ্রের বায়ু বাহিত, হাজার হাজার বছর ধরে সঞ্চিত হয়ে এই তটভূমির সৃস্টি করেছে। এখান থেকে যতদূর চোখ যায় শুধুই অপার জলরাশি, তাই কোথায় এই শ্বেত শুভ্র বালির রাশির উৎস – এর উত্তর আজও আমার অজানা।
ক্যালাগরি থেকে এবার রাস্তা পূর্বমুখী। রুক্ষ, গাছপালা বিহীন, বন্ধুর অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে কিছুক্ষণ যাবার পরই ঘন নীল জলের এক হ্রদের সাথে সাক্ষাৎ হল। মালদ্বীপ জুড়ে অসংখ্য লেক থাকলেও সেগুলো সবই আসলে সমুদ্রের অংশ। কিন্ত এইমাত্র যে ফাইসা লেকের সম্মুখীন হলাম তা সব অর্থেই হিমবাহ সৃস্ট হ্রদ। এর দুই তীর ধরে ঘন পাইনের জঙ্গল, তীরে একটা নৌকো বাঁধা, যেন কারোর অপেক্ষায়। প্রকৃতি যে কত সহজ, সুন্দর হতে পারে তা সত্যি অবর্ণনীয়। এরকম সৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে স্থান-কাল সব তুচ্ছ হয়ে যায়।

ফাইসার রূপের মুগ্ধতা নিয়ে আবার একই রাস্তা ধরে আরও পূবে যেতে থাকলাম। এই রাস্তার শেষ টোবেরমরিতে-যা এই দ্বীপের এক মাত্র শহর। ম্যাপে দেখানো আছে রাস্তার বাঁ দিকে গ্লেনগর্ম স্টান্ডিং স্টোন পড়বে-অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের উপাসনা স্থান, সুতরাং সেখানেতো যেতেই হয়। কিন্তু সমস্যা হল কোন রাস্তা দেখানো নেই ম্যাপে। টোবারমরি যাবার পথে ঘাড়ে ব্যাথা হয়ে গেল বাঁ দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে, কোথাও স্টান্ডিং স্টোন এর চিহ্ন নেই। ঠিক যখন টোবেরমরি শহরে ঢুকতে যাচ্ছি তখন চোখে পড়ল বাঁদিকের গ্লেনগর্ম যাওয়ার দিকনির্দেশ। সে রাস্ত ধরে আরও আধঘন্টা চলার পর রাস্তা শেষ, এখান থেকে হাঁটা পথ আর্ডমোর পয়েন্ট যাওয়া যায়, যা কিনা এই দ্বীপের উত্তরের শেষ বিন্দু। স্টান্ডিং স্টোনের কোথাও কোন উল্লেখ নেই, কিন্তু একটা শীর্ণ রাস্তা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে উত্তর পশ্চিমে বেঁকে গেছে গ্লেনগর্ম দূর্গের দিকে। অগত্যা প্রাগৈতিহাসিক মানুষ ছেড়ে আধুনিক মানবের বাড়িই দেখতে চললাম।

রডোডেনড্রনে ঘেরা এই দূর্গ ১৮৬০ সালে নির্মিত এবং বর্তমানে টম উইলসন ও তার পরিবার বসবাস করে। তাদের সৌভাগ্যের কথা ভেবে একটু ঈর্ষা হল বৈকি। যে বাড়ির জানলায় দাঁড়িয়ে এক সাথে ১৫০ বছের ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে আদিগন্ত আটলান্টিক দেখা যায় দু বেলা, সেই বাড়ির বাসিন্দারা ভাগ্যবান তো বটেই। এখানেই কফি খেতে বসে নেহাত কৌতুহল বশেই জিঞ্জেস করলাম স্টান্ডিং স্টোন আদতেও আছে কি এই দ্বীপে? আমাদের অবাক করে তারা জানাল এই কফির দোকানের পাশ দিয়ে যে হাঁটা পথ গেছে তা অনুসরণ করে কিছুক্ষন গেলে ঐতিহাসিক পাথরের দেখা পাওয়া যাবে। সেই মত ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে কিছুদূর হাঁটতেই দেখতে পেলাম আমাদের কাঙ্খিত স্টান্ডিং স্টোন। ভৌগোলিক বিচারে একটা এই পাথরের বৃত্ত এক নতি বা ডিপ এর মধ্যে অবস্তিত যা বর্তমানে পশুচারণ ভুমি। ভাবলে অবাক লাগে ৯০০ থেকে হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মানুষ যখন ২ মিটারের বেশি উচ্চতার ৩টে পাথর দিয়ে এই বৃত্ত নির্মান করেছিল,তখন তাদের উদ্দেশ্য কি ছিল, আর এরকম দুর্গম স্থানে প্রায় একই মাপের তিনটে পাথর আনল কেমন করে।

এরকম আরও অসংখ্য প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে, সন্তর্পণে পাহাড়ি গরু, ভেড়ার পাশ কাটিয়ে যখন পৌঁছোলাম পাথর গুলোর পাশে, মাথা ছোঁয়ালাম অদিম মানবের স়স্টিতে তখন কিন্তু মনটা শান্তিতে ভরে উঠল। হয়ত অনেক চেষ্টার পর প্রাগৈতিহাসিক ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়ার তৃপ্তি, না কি প্রাচীন দেবতার আশীর্বাদ। কে বলতে পারে!
১৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দের মৎস্য বন্দর টোবেরমরি বর্তমানে মাল, উলভা ও আয়না দ্বীপের প্রধান শহর। নানা রঙে সজ্জিত এই শহর একেবারে পোস্টকার্ডের ছবি। বহু ইংরাজি সিনেমায় টোবেরমরির বাড়ি খুব সুন্দর করে দেখানো হয়েছে। এক ঝলক দেখলে এই সৌন্দর্য্যের রহস্য বোঝা যায়না, আসলে শহরের প্রধান রাস্তার এক দিকে অসংখ্য নৌকো নোঙর করা রঙ বেরঙের আর অন্যদিকে বাড়িগুলোর প্রত্যেকটাতে দুরকম রঙ, পাশের বাড়ির সাথে মিলিয়ে।

মাত্র ৯৮০ মানুষের বসতি বিশিষ্ট টোবেরমোরিতে সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনা চলতে থাকে ফলে পর্যটন এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা সামুদ্রিক মাছ ধরার পাশাপাশি। টোবেরমোরি ভাটিখানার স্কটিশ সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি ও নাকি পৃথিবী বিখ্যাত, তবে এ বিষয়ে আমার মতামত না দেওয়া শ্রেয় কারণ আমি ও রসে বঞ্চিত। টোবেরমরি সহ পুরো দ্বীপের সৌন্দর্য্যই যথেষ্ট যে কোনো মানুষকে মাতাল কে দেবার জন্যে।
সেদিন রাতে আমরা যখন সমুদ্রের পাড়ে বসে ‘ফিস এন্ড চিপস্’ খাচ্ছিলাম, তখন একটা সিগাল পাখি সারাক্ষণ সামনে বসে থাকল যেন অতিথী সেবায়। প্রকৃতির এই অফুরন্ত আন্তরিকতা স্মৃতির মণিকোঠায় জমা করে আবার রোজকার জীবনে ফিরে এসেছি আমরা, কিন্ত এখনও মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে আছে মনের প্রতিটা কোণে।
আমরা যে ঘরটায় আছি তার ত্রিকোণ ছাদের দুই দিকে দুটো কাঁচের জানলা রয়েছে। ফলে প্রথম দিন রাতে যে অসাধারণ অভিজ্ঞতা হল তা না বললে এই লেখা অনর্থক হবে। ৫৮ ডিগ্রী অক্ষাংশে অবস্থিতির জন্যে মালদ্বীপে গ্রীষ্মকালে এমনিতেই রাতের দৈর্ঘ্য খুবই কম। সেদিন রাতে ১১ টা নাগাদ যে মুহুর্তে বৈদ্যুতিক আলো বন্ধ করে দিলাম সাথে সাথে এক অপার্থিব মেদুর আলোতে সারা ঘর ভরে উঠলো। ছাদের জানালা দিয়ে রাতের আলো এসে যেন ভিজিয়ে দিচ্ছে চারদিক। তার সাথে কাঁচের জানলার উপর বৃষ্টি পরার টাপুর টুপুর আওয়াজ। প্রকৃতির এমন যুগলবন্দির সাক্ষী থেকে প্রথম রাত কেটে যখন ভোর হল তখন বাইরে মেঘের ঘনঘটা সাথে অঝোরে বৃষ্টি।
প্রাতরাশ সারার সময় এন্ড্রু সাবধান বাণী শোনালো যে আটলান্টিক থেকে একটা নিম্নচাপ উত্তরমুখী চলছে এবং তারসাথে এই খারাপ আবহাওয়া, বৃষ্টি নিয়ে এসেছে। তাই আমরা যেন কোনভাবেই উত্তর দিকে না যাই। ১০ টা নাগাদ বৃষ্টি থেমে গেলে আমরা এ৮৪৯ ধরে দক্ষিণমুখো যাত্রা করলাম। মনে মনে ভাবলাম এটুকু তো দ্বীপ তার আবার উত্তর দক্ষিণ! কতটুকু বা সময় লাগবে দক্ষিণ থেকে পশ্চিম হয়ে উত্তর পৌঁছতে! রাস্তার দুধারে ঘন জঙ্গল আর তার মধ্যে রং বেরঙের ফুল ফুটে আছে। রাস্তার ধারে কিছুদুর অন্তর পাশে জায়গা করা আছে উল্টোদিক থেকে আসা গাড়িকে যাতে জায়গা দেওয়া যায়। পুরো দ্বীপটাই সহাবস্থানের মন্ত্রে বিশ্বাসী। প্রায় ২০ মিনিট এভাবে যাওয়ার পর দেখলাম বাঁদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে ডুয়ার্ট কাসল্ এর দিকে| সেই রাস্তা ধরে যেতে যেতে হঠাৎ খেয়াল করলাম জঙ্গল এর মধ্যে ব্লু বেল ফুটে আছে|

সামনে নীল জলের প্রণালী পেরিয়ে অপর পারে মূল স্কটিশ ভূখন্ড| সাদা পালতোলা নৌকার পাশ কাটিয়ে বিশাল জাহাজ পর্যটক বোঝাই করে আসছে উবান থেকে| এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার মূল রাস্তা এ৮৪৯ এ ফিরে এলাম, কিছুদুর যাবার পর আবার বাঁ দিকে রাস্তা চলে গেছে গ্রাস পয়েন্ট এ। জানিনা সেখানে গিয়ে কি দেখতে পাব! ব্লু বেল এর চাদর পাতা রাস্তা দিয়ে লক ডন এর পাশ দিয়ে চলতে থাকলাম প্রায় ৩ মাইল| স্কটিশ লক অর্থে হ্রদ হলেও এই ডন কিন্তু হ্রদ নয় প্রকৃতিগত ভাবে। গ্রাস পয়েন্ট এ পৌঁছে কুচকুচে কালো পাথরের রাশি দেখে যেই না ঘাসে পা রেখেছি অমনি পা ডুবে গেল জলের মধ্যে, বুঝলাম আদতে পুরো জায়গাটা ঘাসে ঢাকা জলাজমি। জুতো ভিজিয়ে যখন কালো পাথরে পৌঁছলাম আমার কোনো আক্ষেপ রইলনা। মিশমিশে কালো ব্যাসল্ট পাথরে সৃষ্ট গ্রাস পয়েন্ট দিয়ে গ্রেট গ্লেন চ্যুতিরেখা (ফল্ট লাইন) আরও দক্ষিন দিকে চলে গেছে।
এখান থেকে ফিরে আবার মূল রাস্তা ধরে স্পেল্ভ লেকের ধার দিয়ে ক্রগান ও ময় কাসল এর দিকে যেতে থাকলাম। লেকের নিস্তরঙ্গ জলরাশির পাশ দিয়ে প্রায় ৪ মাইল গিয়ে ক্রগান পৌঁছে দেখলাম সেটি একটা ছোট লজ। মাত্র একটা লজএর জন্যে একটা গোটা রাস্তা, তার থেকে বড় কথা ম্যাপ এ দেখানো আছে বসতি বলে! এদিকে ঘড়িতে তখন ২.৩০ বাজে, তাই খিদেও জানান দিচ্ছে সত্বর কিছু খাদ্যবস্তু চাই। কিন্তু কোথায় কি? জনবসতির চিহ্ন নেই কোথাও। তবু চলেছি আশায় ময় কাসল এর দিকে, দুর্গ যখন, চা কফি নিশ্চই থাকবে আশেপাশে। পথে সাইকেল আরোহী এক দম্পতিকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কোনো খাবার দোকান আছে কিনা, তারা জানালো এদিকে কোথাও কিছু নেই, কিন্তু এই রাস্তার শেষে সমুদ্রের মুখে তাদের ভাইঝির চা, কফির দোকান আছে। ওই দম্পতিকে তখন মনে হল সাক্ষাত ভগবানের দূত। তাদের কথামত আরও ২০ মিনিট যাবার পর রাস্তা সমুদ্রে মিশে গেল,কিন্তু কোথায় দোকান? বিফল মনোরথে গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে চোখে পড়ল রডোডেনড্রন গাছের আড়ালে একটা ছোট ঘর-এটাই সেই দোকান, কিন্তু মলিকহীন (Honesty shop) – চা কফি, বিস্কিট, কেক এমনকি মাছভাজা অবধি আছে- সবার গায়ে দাম লেখা। একটা বাক্স রাখা আছে টাকা রাখার জন্যে। দোকানের মালিকের সাহস আর মানুষের ওপর তার ভরসা কে কুর্নিশ করে এবংযথেষ্ট উদরপূর্তি করে আবার ফিরে এলাম এ৮৪৯ রাস্তায়।
আগেই বলেছি মালদ্বীপের মুল গঠনের মূলে রয়েছে আগ্নেয় শিলার পাহাড় যা প্রধানত দ্বীপের মধ্যভাগ জুড়ে বিরাজ করছে, এই পাহাড়গুলির তলদেশ দিয়ে সমুদ্রের ধার ধরে এ৮৪৯ ঘিরে আছে সারা দ্বীপকে। কত যে নাম না জানা নদী পার হলাম সাথে ব্লু বেল, রডোডেনড্রন, পাইন বন, সমুদ্রের নীল জল মিলে মিশে এক মোহোময় পরিবেশ।

হঠাৎ খেয়াল করলাম এ৮৪৯ থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে ডানদিকে যা নাকি ‘Scenic route’। মালদ্বীপের সৌন্দর্য্যে আমরা এতটাই মুগ্ধ যে এর পরও আর কোনো সুন্দর রাস্তা থাকতে পারে! তবুও কিঞ্চিত কৌতুহলের বশবর্তী হয়েই সেই রাস্তা ধরে এগোতে থাকলাম। এখানে পাহাড় হঠাৎ করে সমুদ্রে মিশেছে, সর্পিল পাহাড়ি পথের বাঁকে ইয়াকের মত দেখতে পাহাড়ি গরুর আর লোমশ ভেড়াদের চারণভূমি। সমুদ্রের তীরে রং বেরঙের পাখির মেলা আর উন্মুক্ত আটলান্টিকের মধ্যে এক একটা বিন্দুর মত দাঁড়িয়ে আছে স্টাফা, উলভা, লিটল কলোনি দ্বীপ। সুর্য্যাস্তের স্নিগ্ধ আলোর রেশ ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের ঢালে, তারই মাঝে এক এক পাহাড়ের উপর মেঘ ফুঁড়ে সূর্য্যের আলো স্পট লাইট ফেলে নাটকীয় মুহূর্ত তৈরী করেছে, আবার কোথাও সমুদ্র থেকে রামধনু উঠে পাহাড়ের ঢালে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঈশ্বর যেন অকৃপণ হাতে সাজিয়েছেন মালদ্বীপকে, এখানকার অধিবাসীরা তা সযত্নে সংরক্ষণ করছে।

পরের দিনের অভিঞ্জতা একাধারে ভয়ানক আবার অবিষ্মরণীয়। এদিন সমুদ্রপথে স্টাফা এবং ট্রেশ্নিশ দ্বীপ দেখতে সকাল ১১টার মধ্যে পৌঁছোলাম উলভা ফেরি। একেতেই জলে আমার চিরকালের ভয়, তাতে উলভা ফেরির ঘাট কে যে কোনো পুকুরের স্নানের ঘাট হার মানাবে, না আছে একটা সিঁড়ি, না কিছু। সাময়িক ভাসমান একটা ভেলা থেকে উঠতে হবে নৌকায়। উন্মুক্ত আটলান্টিকে যাব কিনা এতটুকু নৌকো করে! এর থেকে নৈহাটি – চুঁচড়ো পারাপারকারি নৌকো প্রায় তিনগুন! প্রমাদগুনে ভেবে যাচ্ছি আকাশ পাতাল। নৌকা চলা শুরু হলে চালক জানালেন সেদিন তিমি এবং হাঙর এর বিপদসঙ্কেত ঘোষিত হয়েছে। একই বলে বিপদ যখন আসে তখন একা আসেনা! মিনিট দশেক যেতেই বুঝতে পারলাম কি বেকামি করেছি এই নৌবিহারে এসে। সমুদ্রকে উত্তাল বললেও কম বলা হয় – বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে নৌকোর গায়ে, ফলে ঠিক কাগজের নৌকোর মত দুলছে এই সামান্য ভেলা। ছলাৎ ছলাৎ জল এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে জানলার কাঁচ। যতদূর চোখ যায় শুধুই উত্তাল সমুদ্র। তারই মধ্যে চালক কত কি যে বলে চলেছে, কিন্তু কিছুই কর্ণগোচরে যাচ্ছেনা। ইষ্টনাম জপতে জপতে ভাবছি কতক্ষণে স্টাফা দ্বীপে পৌঁছাবো। এই দ্বীপ ভূতত্ববিদদের কাছে খুবই গুরুত্বের। পুরো দ্বীপটি ব্যাসাল্ট শিলা গঠিত, প্রতিটা ব্যাসাল্ট স্তম্ভ ছয়কোণ যুক্ত। গ্রীণল্যান্ড থেকে লক্ষ বছর আগে মালদ্বীপ পৃথক হওয়ার সাক্ষীও এই স্টাফা দ্বীপ। কিন্তু এসবতো পুঁথেগত ঞ্জান, তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সব হিসেব পাল্টে দেয়। আমার যাবতীয় জানা ও দেখার ইচ্ছে তখন পরিণত হয়েছে এক খন্ড ভূখন্ডে যেখানে আমি এই জল থেকে নিস্তার পাব। গলা শুকিয়ে কাঠ। ঘন্টার পর ঘন্টা চলেছি, আর কত দূর? হঠাৎ দেখলাম নৌকোর গতি একটু যেন কমল, চালক ঘোষনা করলেন আমরা স্টাফা দ্বীপের সামনে দাঁড়িয়েছি, কিন্ত সমুদ্র এত অস্থির যে নোঙর করা সম্ভব নয়। হায় ভগবান! আমার শেষ আশাটুকুও শেষ পর্য্যন্ত জলেই গেলো।
স্টাফা থেকে ট্রেশনিশ দ্বীপে পৌঁছতে লাগল আরও আধঘন্টা। তখন ঘড়িতে ২টো বাজে। নৌকো পাড়ে পৌঁছোনোর সাথে সাথে সবাই মুহুর্তের মধ্যে পাথর ডিঙিয়ে এক ছুট্টে দ্বীপের সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের তলদেশে পৌঁছে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এই দ্বীপে আসার কারণ হল পাফিন। সমুদ্রের ক্লাউন নামে পরিচিত এই ছোট্ট পাখি স্কটল্যান্ডের উত্তর পশ্চিম উপকূলের নির্জন দ্বীপের ভৃগুতটে বাসা বাঁধে।

বিশেষঞ্জ থেকে আনাড়ি ফটোগ্রাফার সবাই ক্যামেরা নিয়ে প্রায় মাটিতে শুয়ে পড়েছে ৩৫ সেমি উচ্চতা বিশিষ্ট পাফিনদের ছবি তোলার জন্যে। কিন্তু তাতে পাখিদের কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই। পৃথিবীর এরকম নির্জন প্রান্তে বাস করেও যে কি করে পাফিনেরা ক্যামেরার নৈকট্য সহ্য করে ‘পোজ‘ দিয়ে যাচ্ছে তা সত্যি বিষ্ময়ের। পাফিন বসতির মধ্যেই সাদা, বাদামী ও কালো রঙের খরগোশদের অবাধ বিচরণ। এই দ্বীপেরই অন্যদিকে হাজার হাজার সিগল পাখির বাস। বিকেলের রদ্দুর গায়ে মেখে পাফিন আর সিগলের ‘ফটোশুট‘ দেখার ফাঁকে কখন যে ৪টে বেজে গেছে বুঝতেই পারিনি। এবার ফেরার পালা-অর্থাৎ আবার ঢেউয়ের ইশারায় দুলতে থাকা। কিন্তু নৌকো চলতে শুরু করলে বুঝতে পারলাম এবেলা সমুদ্র বেশ শান্ত। ফেরার পথে আরও অনেক নাম না জানা দ্বীপের পাশ দিয়ে আসার সময় নানা রকমের সামুদ্রিক পাখি, কালো, ধুসর, সাদা ও হলুদ রঙের সীল মাছ দেখলাম। নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিলনা, সত্যি কি সচক্ষে দেখছি, না কি কোন ‘জিওগ্রাফিক চ্যানেল’ এর অনুষ্ঠান! উলভা ফেরিতে ফেরার ঠিক আগে দেখলাম একটা ঈগলকে দুটো কাক তাড়া করছে, কি কান্ড! সেদিনের মত নৌ-অভিযান শেষ করে যখন আবার মাল এর মাটিতে পা রাখলাম তখন প্রায় ৬টা বাজে, গধুলী আলোর সাজে মালদ্বীপ তখন অপরূপ সুন্দরী।
পরের দিন সকাল হতেই কোন পরিকল্পনা ছাড়াই বেরিয়ে পড়লাম। মালদ্বীপের আনাচে কানাচে সৌন্দর্য্যের এত মণিমুক্ত ছড়ানো রয়েছে যে তার জন্য কোন প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়না। সেদিন সলেম হয়ে দ্বীপের উত্তর পশ্চিমে যেতে থাকলাম উলভার পথ ধরে না-কিল লেকের পাশ দিয়ে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে। এই পাহাড়গুলোর উচ্চতা ৩০০ মিটার এর কম বেশি, কিন্তু অতিরিক্ত খাড়া ঢালযুক্ত। এক একটা বাঁক ঘুরলে দেখা যাচ্ছে দিগন্ত জোড়া আটলান্টিকের মধ্যে বিন্দুর মত ভেসে থাকা দ্বীপ- ঠিক যেন নিপুণ শিল্পীর শিল্পকর্ম। যত উত্তর দিকে যেতে থাকলাম, ভুমিরূপ তত পাল্টাতে লাগল। এখানে ভুমিরূপ অনেকটা মালভূমির মত, কিন্তু বড্ড ধূসর। এরই মধ্যে একটুকরো রূপোর খন্ড ক্যালাগরি তটভূমি। ছোট ছোট বালির ঢিবি ঘেরা দুধ সাদা বালিতে তৈরি এই তটভাগ। রোদ ঝলমলে সকালে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সমাবেশ ও চোখে পড়ার মত, বিশেষ করে এরকম নির্জন দ্বীপে।

কিন্তু এই সাদা বালির উৎস কোথায়, সারা দ্বীপে কোথাও বেলেপাথর বা অন্য কোন সাদা পাথরের চিহ্ন নেই। পরে দেখলাম একটা নোটিশ দেওয়া আছে যাতে কেউ যেন ঢিবি খুঁড়ে বালি না নেয়, তার কারণ এই বালি সম্পূর্ণ সমুদ্রের বায়ু বাহিত, হাজার হাজার বছর ধরে সঞ্চিত হয়ে এই তটভূমির সৃস্টি করেছে। এখান থেকে যতদূর চোখ যায় শুধুই অপার জলরাশি, তাই কোথায় এই শ্বেত শুভ্র বালির রাশির উৎস – এর উত্তর আজও আমার অজানা।
ক্যালাগরি থেকে এবার রাস্তা পূর্বমুখী। রুক্ষ, গাছপালা বিহীন, বন্ধুর অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে কিছুক্ষণ যাবার পরই ঘন নীল জলের এক হ্রদের সাথে সাক্ষাৎ হল। মালদ্বীপ জুড়ে অসংখ্য লেক থাকলেও সেগুলো সবই আসলে সমুদ্রের অংশ। কিন্ত এইমাত্র যে ফাইসা লেকের সম্মুখীন হলাম তা সব অর্থেই হিমবাহ সৃস্ট হ্রদ। এর দুই তীর ধরে ঘন পাইনের জঙ্গল, তীরে একটা নৌকো বাঁধা, যেন কারোর অপেক্ষায়। প্রকৃতি যে কত সহজ, সুন্দর হতে পারে তা সত্যি অবর্ণনীয়। এরকম সৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে স্থান-কাল সব তুচ্ছ হয়ে যায়।

ফাইসার রূপের মুগ্ধতা নিয়ে আবার একই রাস্তা ধরে আরও পূবে যেতে থাকলাম। এই রাস্তার শেষ টোবেরমরিতে-যা এই দ্বীপের এক মাত্র শহর। ম্যাপে দেখানো আছে রাস্তার বাঁ দিকে গ্লেনগর্ম স্টান্ডিং স্টোন পড়বে-অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের উপাসনা স্থান, সুতরাং সেখানেতো যেতেই হয়। কিন্তু সমস্যা হল কোন রাস্তা দেখানো নেই ম্যাপে। টোবারমরি যাবার পথে ঘাড়ে ব্যাথা হয়ে গেল বাঁ দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে, কোথাও স্টান্ডিং স্টোন এর চিহ্ন নেই। ঠিক যখন টোবেরমরি শহরে ঢুকতে যাচ্ছি তখন চোখে পড়ল বাঁদিকের গ্লেনগর্ম যাওয়ার দিকনির্দেশ। সে রাস্ত ধরে আরও আধঘন্টা চলার পর রাস্তা শেষ, এখান থেকে হাঁটা পথ আর্ডমোর পয়েন্ট যাওয়া যায়, যা কিনা এই দ্বীপের উত্তরের শেষ বিন্দু। স্টান্ডিং স্টোনের কোথাও কোন উল্লেখ নেই, কিন্তু একটা শীর্ণ রাস্তা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে উত্তর পশ্চিমে বেঁকে গেছে গ্লেনগর্ম দূর্গের দিকে। অগত্যা প্রাগৈতিহাসিক মানুষ ছেড়ে আধুনিক মানবের বাড়িই দেখতে চললাম।

রডোডেনড্রনে ঘেরা এই দূর্গ ১৮৬০ সালে নির্মিত এবং বর্তমানে টম উইলসন ও তার পরিবার বসবাস করে। তাদের সৌভাগ্যের কথা ভেবে একটু ঈর্ষা হল বৈকি। যে বাড়ির জানলায় দাঁড়িয়ে এক সাথে ১৫০ বছের ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে আদিগন্ত আটলান্টিক দেখা যায় দু বেলা, সেই বাড়ির বাসিন্দারা ভাগ্যবান তো বটেই। এখানেই কফি খেতে বসে নেহাত কৌতুহল বশেই জিঞ্জেস করলাম স্টান্ডিং স্টোন আদতেও আছে কি এই দ্বীপে? আমাদের অবাক করে তারা জানাল এই কফির দোকানের পাশ দিয়ে যে হাঁটা পথ গেছে তা অনুসরণ করে কিছুক্ষন গেলে ঐতিহাসিক পাথরের দেখা পাওয়া যাবে। সেই মত ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে কিছুদূর হাঁটতেই দেখতে পেলাম আমাদের কাঙ্খিত স্টান্ডিং স্টোন। ভৌগোলিক বিচারে একটা এই পাথরের বৃত্ত এক নতি বা ডিপ এর মধ্যে অবস্তিত যা বর্তমানে পশুচারণ ভুমি। ভাবলে অবাক লাগে ৯০০ থেকে হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মানুষ যখন ২ মিটারের বেশি উচ্চতার ৩টে পাথর দিয়ে এই বৃত্ত নির্মান করেছিল,তখন তাদের উদ্দেশ্য কি ছিল, আর এরকম দুর্গম স্থানে প্রায় একই মাপের তিনটে পাথর আনল কেমন করে।

এরকম আরও অসংখ্য প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে, সন্তর্পণে পাহাড়ি গরু, ভেড়ার পাশ কাটিয়ে যখন পৌঁছোলাম পাথর গুলোর পাশে, মাথা ছোঁয়ালাম অদিম মানবের স়স্টিতে তখন কিন্তু মনটা শান্তিতে ভরে উঠল। হয়ত অনেক চেষ্টার পর প্রাগৈতিহাসিক ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়ার তৃপ্তি, না কি প্রাচীন দেবতার আশীর্বাদ। কে বলতে পারে!
১৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দের মৎস্য বন্দর টোবেরমরি বর্তমানে মাল, উলভা ও আয়না দ্বীপের প্রধান শহর। নানা রঙে সজ্জিত এই শহর একেবারে পোস্টকার্ডের ছবি। বহু ইংরাজি সিনেমায় টোবেরমরির বাড়ি খুব সুন্দর করে দেখানো হয়েছে। এক ঝলক দেখলে এই সৌন্দর্য্যের রহস্য বোঝা যায়না, আসলে শহরের প্রধান রাস্তার এক দিকে অসংখ্য নৌকো নোঙর করা রঙ বেরঙের আর অন্যদিকে বাড়িগুলোর প্রত্যেকটাতে দুরকম রঙ, পাশের বাড়ির সাথে মিলিয়ে।

মাত্র ৯৮০ মানুষের বসতি বিশিষ্ট টোবেরমোরিতে সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনা চলতে থাকে ফলে পর্যটন এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা সামুদ্রিক মাছ ধরার পাশাপাশি। টোবেরমোরি ভাটিখানার স্কটিশ সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি ও নাকি পৃথিবী বিখ্যাত, তবে এ বিষয়ে আমার মতামত না দেওয়া শ্রেয় কারণ আমি ও রসে বঞ্চিত। টোবেরমরি সহ পুরো দ্বীপের সৌন্দর্য্যই যথেষ্ট যে কোনো মানুষকে মাতাল কে দেবার জন্যে।
সেদিন রাতে আমরা যখন সমুদ্রের পাড়ে বসে ‘ফিস এন্ড চিপস্’ খাচ্ছিলাম, তখন একটা সিগাল পাখি সারাক্ষণ সামনে বসে থাকল যেন অতিথী সেবায়। প্রকৃতির এই অফুরন্ত আন্তরিকতা স্মৃতির মণিকোঠায় জমা করে আবার রোজকার জীবনে ফিরে এসেছি আমরা, কিন্ত এখনও মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে আছে মনের প্রতিটা কোণে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন