বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০১৪

সৌন্দর্যের বেলাভূমি টেকনাফ

পাহাড়ের পাদদেশে সমতল, সেই সমতলের কানায় কানায় পূর্ণ জনপদ, আর জনপদকে এক পাশ হতে এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে একটি নদী। তার এ অটুট বন্ধন কখনও ছুটে যাবার নয়। এ নদী যুগ যুগ ধরে সে সভ্যতার বিকাশে সাক্ষী হয়ে আছে।

যে নদীর কলকল জল নিয়মিতই সে জনপদের কথা বর্ণনা দেয়। মানুষের সকল হর্ষ-বিষাদ নিয়ে সে নদী প্রতি মূহূর্তে ডুব দেয় অদূরে গর্ব ভরে প্রবাহিত সাগড়ে। পাহাড়ের গায়ে আঁচর কেটে বেড়ে ওঠা এ জনপদের সকল দু:খ-বেদোনা যেন নদীটি ধুয়ে নিয়ে সাগড়ে ফেলে আসে। আর সাগড় থেকে নিয়ে আসে বেঁচে থাকার অনেক উপকরণ। নদী মাতৃক বাংলাদেশের একেবারের শেষ অঞ্চলটির বর্ণনা করলে এমন কথাই বলবেন ভাবুক মন। রুপকথার দেশের গল্প শোনালেও সত্যি সত্যি এমন ভূমি আপনাকে নেমন্তন করছে আমাদেরই দেশে। নাম তার টেকনাফ। টেকনাফ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিনের ভূমি, বাংলাদেশ যেন টেকনাফ দিয়ে নেমে যাচ্ছে বঙ্গপোসাগড়ে। দেশের আর সব স্থান হতে টেকনাফ অনেকটা আলাদা, অনেক বৈচিত্রতাপূর্ণ সে কথা আমি বৈকি অনেকেই হয়ত: জানেনা। আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল সোনালী বাংলাদেশের এ দক্ষিণা বিন্দু টেকনাফ কে। এইত গত মাসের কথা। ভ্রমন পিপাসুদের মন তৃষ্ণার্ত। কোথাও বেড়িয়ে আসার আকাঙ্খা যেন মৌলিক চাহিদায় রুপান্তরিত হয়ে থাকে। পিকনিকে যাবার অতি উত্তম সময়টুকু পার করছি। তাই আমার মন ও খাঁচা বন্দি পাখির ন্যায় ছটফট করছে। যথারীতি অফিসে এলাম। হাজিরা খাতায় সাইন করতে করতেই সুখবরটি পেলাম। মনে হল বিধাতা আমরা উড়– উড়– মনকে প্রসন্নতা দানে এ উপহার তুলে দিচ্ছেন। অফিস থেকে আগামী বৃহস্পতি বার ভ্রমনে বেরুচ্ছি আমরা। পুলকিত মন যখন জানলো ছুটি সহ মোট তিন দিনের জন্য আমরা যাচ্ছি সেন্ট মার্টিনে, তখন বাঁধভাঙ্গা হাসি আমার মুখে লেগেই আছে। চললাম আমরা দারুচিনি দ্বীপের দেশ পানে। অফিস থেকেই বাস, মাইক্রো নেয়া। তবে ঢাকা ছাড়তে একটু দেরী হয়ে গেল। তাই চট্টগ্রামে পৌঁছুতেই সকালের সোনারোদ এসে লাগল চোখে-মুখে। আমরা ক্লান্ত, তাই যাত্রা বিরতি। পেট চো চো করছে সবার। জি. ই.সি.র মোড়ে নেমে খাবার খেলাম। আর দেরী নয় আবার ৬ ঘন্টার পথ। এ জার্নি বাই বাস। তবে আমার বেলায় জার্নী বাই মাইক্রো। ঠিক বিকেলে যেয়ে পৌঁছলাম কক্সবাজারের কলাতলীতে। সবাই হোটেলে কে কোন রুমে যেয়ে ফ্রেস হবে এ নিয়ে ব্যস্ত আমি তখন বিশ্বের সর্ববৃহত সমুদ্র সৈকতে পাখা মেলে উড়ছি। দূর সমুদ্র হতে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন এর হাতছানি আমাকে ব্যকুল করছিল বারবার। রাত পোহাতেই আমরা আবার পথ চলছি। সেন্ট মার্টিন যেতে হলে টেকনাফ যেতে হবে। সেখানেই নাফ নদীতে নোঙ্গর পেতে দাড়িয়ে আছে কেয়ারী সিন্দবাদ। আমরা আবার রওনা দিলাম। যত দক্ষিণে যাওয়া যায়। এলো মেলো পাহাড়ী পথ। নাইক্ষ্যংছড়ির বন গ্রামের ভেতর পাহাড়ী আঁকা বাঁকা পথ। মনে পড়ে খবরের কাগজে পড়েছিলাম এ অঞ্চল হতে প্রায়ই পর্যটকগণ অদৃশ্য হয়ে যায়। পুরো এলাকাটি উখিয়া জেলার অর্ন্তগত। সকাল ১০টায় পৌছলাম আমরা টেকনাফে। কিন্তু ঘটল অন্য ব্যাপার। পৌঁছার আগেই জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে। পাশের কৌতুকরসে ভরপুর কলিগ আমাকে জিজ্ঞেস করল " ট্রান্সলেট কর। টেকনাফে পৌঁছার পূর্বে জাহাজ ছাড়িয়া দিল"। ট্রান্সলেট তখন মাথায় আসছে না। মনে বড় রকমের একটা শংকা উকি দিচ্ছিল বারবার। কি ছেড়া দ্বীপে যাওয়ার সুতো ছিড়ে গেল! বুক শুন্যতা হু হু করে বাড়ছিল। আমরা টেকনাফের বন্দর গন্তব্যহীনভাবে দাড়িয়ে। স্থানীয় লোকজনদেও সাথে গল্প করে সময় পার করছি। আর নাফ নদের মুগ্ধতা অবলোকন করছি। ঠিক এমন সময় স্থানীয় এক ব্যক্তির বিনয়ী কণ্ঠ আমদের "টেকনাফে আপনাদের পা ফেলে যান আজ।" যেই বলা সেই কাজ। টেকনাফ দেখব আমরা। হোটেল ভাড়া হল। নামটা চমৎকার নেটাং মাথিন। পাহাড়ের নীচে হোটেলটি। যেন পাহাড়কে ছাদ বানিয়ে তৈরি। নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলে ম্যানেজার জানালেন, "নেটাং মাথিন মানে মাথিনের পাহাড়। মাথিন সম্পর্কে চমৎকার গল্প শুনলাম।" চললাম সবাই মাথিনের কুপ দেখতে। এ যেন সত্যিকারের লাইলি মজনু কাহিনী। স্থানীয় বার্মিজ মার্কেট পেলাম। যে যা পেলাম কিনে নিলাম যা ঢাকায় মেলেনা। আমরা চললাম টেকনাফের আরেকটি দর্শনীয় স্থান শাহ পরীর দ্বীপে। পাহাড়ের পাদদেশে অতীব সৌন্দর্যময় এক চারণভূমি। গবাদি পশুর ভীড়ে গ্রাম বাংলার রুপরেখার দৃশ্যপট হৃদয়ে ভেসে উঠল। সম্রাট শাহ সুজা এর নামে নামকরণ করা এ দ্বীপটি বাংলাদশের শেষ নিরবচ্ছিন্ন স্থলভাগ। ভাবতেই ভাল লাগে এমন একটি স্থানে আমরা দাড়িয়ে। বিশেষ করে শাহ পরী হতে নাফ নদীকে এতই চমৎকার দেখায় যে পৃথিবীর আর কোন নদী হয়ত: এত সুন্দর নয়। নদীর জল সাগড়ের নীলে ছোঁয়া। নাফ এর মোহনার খুব কাছাকাছি আমরা। এর পরই বঙ্গপোসাগর। ওপারে মায়ানমারের আরাকান রাজ্য। সেখানে আকাশ ছুঁই ছূঁই পাহাড়, তার ওপর সাদা মেঘের খেলা যেন মেঘকে মাথায় নিয়ে পাহাড় গুলো নাফ নদীতে স্নান করছে। নাফ এর স্রোত সামনে বিস্তৃত সাগরে গিয়ে মিশছে। নদী যদি এত সুন্দর হয়ে থাকে তাহলে টেকনাফ বীচ হবে সুন্দরতম। আমদের ব্যকুল হৃদয় প্রকৃতির আরও সৌন্দর্য অবলোকনে টেকনাফ সৈকতে গেলাম। বিকেল হয়ে এল। সূর্য যেন ক্লান্ত। দুর হতে সমুদ্রের গর্জন শুনছি। কাছে গিয়ে আমরা সবাই অবাক। সমুদ্রে ভাসছে অর্ধবক্র চাঁদ। একটি নয় অনেকগুলো। সেই চাঁদগুলোতে কোন বুড়ি নয় সুতো টানছেন জেলেরা। আমাদের গাঁয়ের নৌকাগুলো থেকে সম্পূর্ন আলাদা এসব নৌকো দেখতে ঈদের চাঁদের মতই দেখাচ্ছে। সৈকতে যেয়ে দেখি এমন নৌকো আরও অনেক । এদের সবগুলোতেই পতাকা লাগানো ও প্রত্যেকটি বাহারী রংয়ে রাঙায়িত। সমুদ্রের বুকে বীরদর্পে ঘুড়ে বেড়ায় বলে টেকনাফের নৌকাগুলোর আকৃতি এমন। টেকনাফ সৈকত দেখে আমরা বিমুগ্ধ। জোয়ার ভাটায় সাদা ফেনা হয়ে ঢেউ মুর্হুমহু আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। বালিতে লাল কাঁকড়া ছুটোছুটি করছে। পেছনের নারিকেল গাছ, বিস্তৃত বালুচর, রুপালী ঢেউ, তার বুকে ঘুরে বেড়ানো জেলেদের চাঁদসৃদশ সাম্পান। সত্যি মন কেড়ে নিলো টেকনাফ সুমুদ্র সৈকত। নেটাং মাথিনের দেশ টেকনাফ আমাদের দারুচীনি দ্বীপে যাওয়ার ব্যর্থতা পুরোটাই মুছে দিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন