হাবিবুর রহমান স্বপন
আন্দামান
নিকোবার দ্বীপ বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের সোজা দক্ষিণে অবস্থিত হলেও বৃটিশরা
যখন ভারত ছেড়ে চলে যায় তখন এই দ্বীপ পুঞ্জকে ভারতের ভাগে দিয়ে যায়।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ভারত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত আন্দামান-নিকোবার দ্বীপ
সমূহে বৃটিশরা ভারতীয় দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের শাস্তি দিতে কয়েকটি কারাগার
নির্মাণ করে। যাবজ্জীবন সশ্রম কারদণ্ড তো দেয়া হয়ই তার পর বহু বিপ্লোবীকে
ফাঁসি প্রদান করা হয়।
ছোট সময়ে বাবার কাছে শুনেছি তার পর ইতিহাসের শিক্ষকের কাছে জেনেছি, দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের হাত-পা বেঁধে জাহাজে করে নিয়ে যেয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। অনেককে দ্বীপগুলোর নির্জন স্থানে বা জঙ্গলে ফেলে আসা হতো। একে বলা হতো নির্বাসন বা দ্বীপান্তর। তারা হিংস্র প্রাণী বাঘ, শিয়াল, শকুন ইত্যাদির খাদ্যে পরিণত হতো। যাদের হত্যা ও নির্যাতন করা হয় তাদের অপরাধ তারা ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। শুনেছি সেখানে অসভ্য অধিবাসীরা বাস করে। তারা মানুষের মাংস খায়। আমার বহু দিনের ইচ্ছা সেই দ্বীপ দেখার। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম একবার সেখানে যাব। যেতে চাইলেই তো আর যাওয়া যাবে না। একে তো দুর্গম সমূদ্র বক্ষে দ্বীপসমূহের অবস্থান। দ্বীপ অভ্যন্তরের যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুবই খারাপ। এছাড়াও সেটি আলাদা একটি দেশের অংশ। ভারতের একটি প্রদেশ যা এখন কেন্দ্র শাসিত। দু:সাহসী কোন সঙ্গী না হলে তো সেখানে যাওয়া যাবে না। অতএব সঙ্গি খুঁজতে লাগলাম। আমার বাল্য বন্ধু রতন দাসকে অনেক বলে-কয়ে রাজি করানো গেল। শর্ত ওর খরচের অর্ধেক আমাকে বহন করতে হবে। ভ্রমণে ভাল ও বিশ্বস্ত সাথি দরকার তাই আমি ওর দাবি মেনে নিতে বাধ্য হলাম। ভিসা পাওয়া গেল। শুধু ভিসা হলেই তো হবে না, সেখানে যেতে হলে আবার ভারতের ‘প্যাসেস ডিপার্টমেন্ট’ থেকে বিশেষ পাশ নিতে হবে। কলকাতাস্থ এসসিআই (প্যাসেস ডিপার্টমেন্ট) অফিসে ২ কপি পাশপোর্ট সাইজের ফটোসহ নির্ধারিত ফরম পূরণ করে জমা দিতে হলো। তার সঙ্গে জমা দিতে হলো ৬ দিন আগে নেয়া কলেরা ও কমপক্ষে ৬ মাস আগে হামের টিকা নেয়া ডাক্তারের দেয়া সনদপত্র।
আন্দামানের প্রধান অংশ ৫ টি বড় বড় দ্বীপ নিয়ে গঠিত। আন্দামান ও নিকোবারের দ্বীপ সংখ্যা ছোট বড় মিলিয়ে মোট ৫শ ৭২ টি। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত এই দ্বীপপুঞ্জের বিস্তার ৭শ ২৭ কি:মি:। জন বসতি আছে ১শ ৩১ টি’তে। রাজধানী পোর্টব্লেয়ার। রাজধানী শহরটি আন্দামানে অবস্থিত। কলকাতা থেকে দূরত্ব ১২৫৫ কি:মি: এবং মাদ্রাজ থেকে ১১৯১ কি:মি:। কলকাতা এবং মাদ্রাজ থেকে জাহাজ এবং উড়োজাহাজে যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে বিমানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু এর জন্য চারদিন অপেক্ষা করতে হবে। জাহাজের টিকিট পাওয়া সহজ এবং সেটির নাম ‘এম ভি রামমোহন’ ছাড়বে বিকাল ৪ টায়। আমরা কলকাতা হগ মার্কেটের নিকটবর্তী হোটেল থেকে ট্যাক্সি যোগে খিদিরপুর বন্দরে পৌঁছলাম। তখন বেলা আড়াইটে। ইণ্ডিয়ান শিপিং কর্পোরেশনের অফিস থেকে পাশপোর্ট দেখিয়ে টিকিট নিতে হলো। যাত্রীদের বাক্স-পেটরা উঠলো। বলা বাহুল্য সেগুলো যথারীতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো। বিকাল সোয়া চারটায় সাত’শ ৪২ জন যাত্রী নিয়ে জাহাজ পোর্টব্লেয়ারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। নদী পথে বড় ফেরিতে নগরবাড়ি-আরিচা যাতায়াত করেছি বহুবার। যমুনা আর পদ্মার মোহনায় বড় বড় ঢেউ উঠলে ফেরি দুলতো আর প্রাণ কেঁপে উঠতো। একবার ফেরিতে ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম। যমুনার চরে আট ঘন্টা আটকে ছিলাম। রাতে ফেরির ক্যান্টিনে খাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় আধাপেট খেয়ে থাকতে হয়েছিল। যখন রওনা হলাম তখন বারবার সেই কথাটিই মনে হচ্ছিল। তবে ডিসেম্বর মাস আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। জাহজে সমূদ্রে যাত্রা মনে বড় ভয় সেই উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনা। বিভিন্ন দেশের নানা শ্রেণী-পেশার এবং নানা ভাষাভাষির মানুষ। আমরা দু’জন প্রথম শ্রেণীর টিকেট কেটেছি তাই প্রথম শ্রেণীর যাত্রী। খুঁজছিলাম বাংলাদেশের কেউ যাত্রী আছেন কি না। প্রথম শ্রেণীর যাত্রী এক দম্পতিকে পাওয়া গেল। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিম ও তার স্ত্রী গৃহবধু আরজিনা খাতুন। তারা ঢাকায় থাকেন। আমরা দেশের লোক পেয়ে স্বস্তি বোধ করছিলাম। তারাও আমাদের পেয়ে বেশ খুশি। ৩৪ জন ইউরোপ-আমেরিকার পর্যটক ছিলেন জাহাজে। অবশিষ্ট সকলেই ভারতীয়। ভারতীয়দের অনেকেই যাচ্ছেন তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে মিলিত হতে।
জাহাজ ছাড়ার সময় বেশ পুলকিত বোধ করছিলাম। সকল যাত্রি প্রফুল্ল চিত্তে ডেকে উঠে সৃষ্টি কর্তার নাম জপলেন। হুগলী নদীর কংক্রিটের চ্যানেল ধরে ধীর গতিতে জাহাজ অগ্রসর হলো। রাত সাড়ে ন’টা পর্যন্ত চললো। তার পর কিছুটা গতি বাড়লো। জোয়ারের পানি যখন চ্যানেলের প্রবেশ পথে আসলো তখন জাহাজ সমূদ্রের মোহনায়। জাহাজ প্রায় থেমে গেল। অতি সাবধানে ডুবো চর দেখে-শুনে কচ্ছপ গতিতে জাহাজকে অগ্রসর হতে হচ্ছে। শুধু আমাদের জাহাজই নয়। এভাবে আরও ৪ টি জাহাজ এবং ছোট-বড় শতাধিক নৌযান অপেক্ষায় আছে চ্যানেলের অনুকূল পানি প্রবাহের জন্য। বিশিষ্ট হিন্দু রাজা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিশেষ করে সতিদাহ প্রথার বিলুপ্ত করে যিনি সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন সেই মহান রাজা রামমোহনের নামকরণে ‘রামমোহন’ জাহাজ। চালচলন দেখে মনে হলো জাহাজটি প্রাচীন তাই চালচলন বুড়ো মানুষের মত ধীর-স্থির।
হুগলী নদীর মোহনায় সমূদ্র বক্ষে চরের মধ্যে কপিল মুনির আশ্রম। আশ্রমের চতুর্দিকে বেশ কিছু নারিকেল গাছসহ লম্বা গাছ-পালা দেখা গেল। জাহাজের দোতলায় মন্দির। সেখানে পূজা সমাপন করলেন একজন মধ্যবয়সী পুরোহিত। ততক্ষণে আমাদের জাহাজটি কপিল মুনির আশ্রম ছাড়িয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সমূদ্রের মধ্যে এখন জাহাজ। ক্রমশই গতি বাড়ছে বৃদ্ধ জাহাজ রামমোহনের। সাগরের পানি চিরে দ্রুত গতিতে (২৫ নটিক্যাল মাইল বেগে) অগ্রসর হচ্ছে ‘এম ভি রামমোহন’। রাতের খাবার খেয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম জাহাজের উপর দিয়ে চক্কর দিয়ে মাছ শিকারে ব্যস্ত শতাধিক গাঙচিল ও ডজন খানেক শংখ চিল। জাহাজের প্রোপেলারে সৃষ্ট ঘোলা পানির ঢেউ এবং পাখির মাছ শিকার দেখে যাত্রীরা উত্তেজিত। ছোট ছোট ট্রলার থেকে জাল ফেলে জেলেরা মাছ শিকার করছে। যার ক্যামেরা আছে সে মাছ শিকারী পাখীর ছবি তুলতে ব্যস্ত। শুরু হলো হৈ হুল্লোর। যুবক-যুবতীরা আনন্দে মেতে উঠলো তাদের সঙ্গে যোগ দিল ইউরোপ-আমেরিকার কয়েকজন যাত্রী। ব্যাণ্ডের তালে তালে নাচ-গান চললো প্রায় দুই ঘন্টা শিলিগুড়ির সংগীত দল ‘ঝংকার’ এর সদস্যরা মাতিয়ে রাখলেন যাত্রীদের। শিল্পীরা গণসঙ্গীত গেয়ে যাত্রীদের বেশ চাঙ্গা রাখলেন। আমি তো গান গাইতে পারি না। আমার বন্ধু রতন গানের ভাল শিক্ষক। সে যোগ দিল গানে। এক পর্যায়ে রতন তবলা সঙ্গত করার সুযোগ পেল। বেশ জমে গেল। রতনের বন্ধু হিসাবে সঙ্গীত দলের সদস্যদের সঙ্গে চা নাস্তাও আমার জন্য বরাদ্দ হলো। এভাবে দুপুর ১ টা পর্যন্ত চললো গান-বাজনা হৈ-হুল্লোর। দুপুর ২ টায় খাবারের ঘন্টা বাজলো। আমরা আড়াইটায় খাবার সংগ্রহ করে টেবিলে বসলাম। আগেই প্রতিটি যাত্রীর কাছ থেকে খাবারের মেনু জেনে নিয়েছিলেন জাহাজের কর্মীরা (নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে)। দু’প্রকার খাবার ভেজিটেরিয়ানদের জন্য ছানার ডালনা, ডাউল এবং ফুল কপি ভাজা এবং নন ভেজিটেরিয়ানদের জন্য দু’টি ডিমসহ ডাউল ও আলু ভাজা। উভয়ের জন্যই টক দই ছিল। আমি নন ভেজিটেরিয়ান আর আমার বন্ধু রতন ভেজিটেরিয়ান। আমি ওর কাছ থেকে একটু ছানার ডালনা পেলাম আর ওকে দিলাম ক’টুকরো আলু ভাজা।
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে বিকেলে অথৈ জলরাশি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এতো জল অথচ বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট সমগ্র বিশ্ব ব্যাপী। পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল এই কথাটি বই পড়ে জেনেছিলাম। এবার বাস্তবতা কিছু হলেও অনুভব করতে পারলাম। নীল আকাশ আর সমূদ্র একাকার হয়ে গেছে। সৃষ্টি কর্তার বিশালত্ব সমূদ্রের মাঝে না আসলে বোধ করি বোঝা দায়।
জাহাজ এম ভি রামমোহন সারারাত ধরে চলছে। ভোরে চার তলার রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। সমূদ্রের ঢেউ আছে তবে তা ভয়ঙ্কর না। পূবের আকাশে সূর্য উঁকি দিয়েছে। পানিতে সূর্যরশ্মী বিকিরণ ছড়াচ্ছে। দিনের শুরুই জানান দিচ্ছে বোধকরি দিনটি হবে রৌদ্রকরোজ্জ্বল। নীল জলের উপর নীলাকাশ, মনে হচ্ছিল আমি চলেছি স্বপ্নপূরীতে।
তৃতীয় দিন শুরু হলো চা-নাস্তা দিয়ে। জাহাজের প্রতিটি ডেকে পানাহারের ব্যবস্থা রয়েছে। আছে চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা। চলছে তাস, দাবা, লুডু খেলা। এছাড়াও রয়েছে সিনেমা দেখার সু-বন্দোবস্ত। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেকে ভীড় বাড়তে থাকে। গল্প-কথায় জমতে থাকে আসর। সকাল ১০ টায় আবার বসলো তারুণ্যের আসর। গান-বাজনা আর নাচ। লাউড স্পীকারে গীটার ও ড্রামের শব্দে জাহাজের শব্দ ও সমূদ্রের গর্জন যেন ম্ল¬ান হয়ে গেল। জাহাজ জুড়ে তারুণ্যের দাপাদাপি। যৌবনের জয় যেন চীরকালই। দ্বিতীয় দিনের মত তৃতীয় দিনেও চললো গান-বাজনা আর নাচ। সেই সাথে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সমন্বিত বাজনা। গীটারিস্ট সৌমিক রায় জনপ্রিয় সব বাংলা ও হিন্দি গানের সুরে গীটার বাজিয়ে জাহাজের যাত্রীদের নির্মল আনন্দ দান করলেন। মাঝে মাঝে বাঁশী বাজালেন কৃষ্ণ নগরের মধ্য বয়সী রাজেন্দ্রনাথ ঘোষ। দারুণ সে বাঁশীর সুর। বয়সের কারণে বেচারা একটানা দীর্ঘক্ষণ বাঁশী বাজাতে দম পান না। চললো বৈঠকী গান। নজরুল-রবীন্দ্র সংগীতসহ আধুনিক গান। রায়গঞ্জের সুব্রত কুমার চক্রবর্তী ভরাট গলায় গাইলেন হেমন্ত মুখার্জীর গান। মনে হলো যেন স্বয়ং হেমন্তই গাইছেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রফেসর রমা মূখার্জী ও তার ছাত্রী সুনয়না ঘোষাল গাইলেন রবীন্দ্র সংগীত। গভীর সমূদ্র বক্ষে আমাদের বহনকারী জাহাজ এম ভি রামমোহন এগিয়ে চলছে ঢেউ ভেঙ্গে। যাত্রীরা স্থলভাগ দেখার জন্য অধীর। তারুণ্যের দাপাদাপি হৈ হুলে¬ার চললো। দিনের মধ্য ভাগে দূরে দৃশ্যমান হলো আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের দু’চারটে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। আর সে কি আনন্দ যাত্রীদের।
জাহাজ অগ্রসর হচ্ছে আর দৃশ্যমান হচ্ছে ছোট-বড় দ্বীপ সমূহ। অপেক্ষার সময় আর যেন কাটে না। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সামনে, ডানে-বামে দৃষ্টি সীমার কাছাকাছি দূরত্বে অসংখ্য জোনাকি পোকার মত আলো দেখা যাচ্ছে। যত কাছে এগুচ্ছে সেই আলোর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে পানিতে। মাইকে ঘোষণা হলো এক ঘন্টা দশ মিনিটের মধ্যেই জাহাজ পোর্টব্লে¬য়ারে ভিড়বে। যাত্রীরা চঞ্চল হয়ে উঠলো। ক্রমশই পোর্টব্লে¬য়ারের আলোগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সময় যেন ফুরায় না। বন্দরের কাছাকাছি জাহাজ রামমোহন। বন্দর এলাকা এবং পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের গায়ে গায়ে শুধু আলো আর আলো। যাত্রীদের মধ্যে আবার হৈ হৈ রব, হর্ষধ্বনি এবং মাইকে হিন্দি গান। রাত তখন সাড়ে আটটা। জাহাজ থেকে নেমে ইমিগ্রেশন অফিসে গেলাম। কয়েকটি ফরম পূরণ করে হোটেলে থাকার অনুমতি পেলাম। পাশপোর্ট ও পারমিট মিললো পরদিন গোয়েন্দা অফিস থেকে। আমেরিকান ও ইউরোপিয়ানদের ছাড়পত্র দেয়া হলো খুবই দ্রুত। বেশ দেরিতে আমরা বাংলাদেশী চার জন ছাড়পত্র পেলাম। আমাদের ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তল্ল¬াশী একটু যেন বেশীই মনে হলো। বাঙালী মালিকানাধীন একটি হোটেলে আমরা উঠলাম। ভাড়াও বেশ কম। ভারতীয় মূদ্রায় মাত্র ৩ শ টাকা। বেশ পরিপাটি কক্ষে দুটি সিঙ্গেল খাট। রাতে ভাল নিদ্রা হলো।
ভোরে পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙলো। নারিকেল ও দেবদারু গাছে অসংখ্য পাখি। টিয়া, চড়–ই, আবাবিল, ময়না, ঘুঘু, মুনিয়া, শালিক, নানা প্রকার মাছরাঙা, বেলে হাঁস, বুনো রাজ হাঁস, বক ইত্যাদি। দৃষ্টি নন্দন সবুজ রাজকীয় পায়রা এবং সাদা-লাল-হলুদ রংয়ের বক দেখে যে কেউই মুগ্ধ হবেন। দেখলাম বুলবুল, শ্যামা, কোকিল এবং ছোট বড় কয়েক আকৃতির পেঁচা। বড় দেবদারু গাছের উপরের ডালে বেশ ক’টি পাখির বাসা লক্ষ্য করলাম। জলাশয়ের তীরে বিশাল আকৃতির হাড়গিলা ও মদনটেক পাখি এবং নানা প্রকার চিল দেখে আমার কৈশরের কথা মনে পড়ে গেল। আমরাই তো কত পাখি দেখেছি। পাখি শিকারীদের অত্যাচারে বাংলাদেশ থেকে পাখি বিদায় নিয়েছে। আন্দামানের পাখি দেখে আমার মনে হচ্ছিল, তাহলে কি আমাদের দেশের পাখিরা সব এই দ্বীপে এসে ঘর বেঁধেছে। এখানে কেউ পাখি শিকার করে না। শহরের গাছ গুলোতেও পাখি নিশ্চিন্তে রাত কাটায়। পাখিগুলো সকালে খাদ্যের অন্বেষণে দূরে পাখা মিললো। কিছু কাক এবং বানর দেখলাম শহরের সর্বত্রই। সকালের আন্দামানের রূপ দেখার জন্য হোটেলের আশ-পাশে হাটতে বের হলাম। কাছাকাছি একটি চা’য়ের স্টলে চা বিস্কুট খেলাম। দোকানদার বাঙালি। নাম রবিউল হোসেন। তার পূর্ব পুরুষ বা দাদা এখানে বসতি স্থাপন করেন ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে। আগে বাড়ি ছিল কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকায়। তিনি শুনেছেন তবে সেখানে কখনোই আসেন নি। তাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এই দ্বীপের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা বাঙালি। এর পরের অবস্থান তামিলদের। তামিলরা বড় ব্যবসায়ী ও কিছু কৃষক। আর বাঙালীরা ছোট চকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, কৃষক ও শ্রমিক। ভারতবর্ষের ইংরেজ গভর্ণর লর্ড কর্ণওয়ালিশের সময় ক্যাপ্টেন আর্কিবণ্ড বাংলা থেকে লোকজন নিয়ে পোর্টব্লে¬য়ারের অদূরে চাথামে বসতি করে দেন।
১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ২শ জনকে দীপান্তর দেয়া হয় আন্দামানে। ওই সব বন্দীরা ছিলেন ওহাবী আন্দোলনের অগ্রসেনা। যাদের সংখ্যা গরিষ্ঠই ছিলেন বাঙালি। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিদ্রোহীদের (সিপাহী বিদ্রোহের বীরদের) দীপান্তরে পাঠায় ইংরেজ সরকার রাজদ্রোহের দণ্ড দিয়ে। এসময় ৭শ ৭৩ জন বন্দীকে দীপান্তরে পাঠানো হয়। ম্যালেরিয়া, কলেরা, প্লেগ রোগে এবং বৃটিশ পুলিশের নির্যাতনে প্রথম দু’মাসেই মৃত্যু বরণ করেন ২শ ৯২ জন বন্দী। এখানে নির্বিচারে দীপান্তর ও ফাঁসির যজ্ঞ চলে লোকচক্ষুর অন্তরালে। সকাল ন’টায় বের হলাম পোর্টব্লে¬য়ারের সেই কুখ্যাত ভারতের ‘বস্তিল’ নামে পরিচিত সেলুলার জেল দেখতে। এটি এখন আর জেল নয়, একটি জাতীয় স্মারক। কিছুটা দূরে তালা লাগানোর ব্যবস্থা। এখানে প্রবেশ করলেই বোঝা যায় ব্রিটিশ শাসনের ভয়াবহ রূপ। সেলুলার জেলের দক্ষিণ দিকের কয়েকটি কক্ষে চিত্র ও বিভিন্ন মূর্তি অঙ্কন করে বন্দীদের দুঃসহ জীবন দেখানো হয়েছে। ছবিগুলো জীবন্ত। সেলুলার জেল ভবনটি তিনতলা। এর সাতটি উইং-এ সেল ছিল ৭শ ৫৬ টি। ১৯৪১-এর ভূকম্পনে ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানী সৈন্যদের কামানের গোলার আঘাতে চারটি উইং বিধ্বস্ত হয়ে যায়। বর্তমানে রয়েছে তিনটি উইং এবং রয়েছে মোট ২শ ৯৬ টি সেল। দোতালায় ১৩ টি ফলকে নামাঙ্কিত রয়েছে ৩শ ৩৬ জন আত্মদানকারী বীরের। যাদের বেশীরভাগই বাঙালি। জেলের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে তিন তলার একটি সেলে বিপ্লবী সাভাকার বন্দী ছিলেন। কক্ষটিতে সাভাকারের বিশাল একটি তৈলচিত্র রয়েছে। ঘরটির মেঝে কার্পেট দ্বারা পরিপাটি করে মোড়ানো। বিপ্লবী সাভাকারের ৬০ বছরের জেল হয়েছিল। দশ বছর কাটে তাঁর নির্জন জেলে। সেলটির সামনেই উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসির মঞ্চ। মঞ্চের ছাদ বরাবর মোটা লোহার রডে পাশাপাশি এখনো তিনটি ফাঁসির দড়ি ঝুঁলানো রয়েছে। এখানেই এক সঙ্গে তিন জনকে লটকিয়ে ফাঁসি দেয়া হতো। অন্যান্য বন্দীদের ফাঁসির দৃশ্য দেখতে বাধ্য করা হতো।
সেলুলার জেলের আঙিনায় রয়েছে একটি কারখানা। এখানে বন্দিদের কায়িক শ্রম দিতে বাধ্য করা হতো। কাজে গাভ্লতি দেখলেই চাবুক এবং বুটের লাথি। তাদের দিয়ে ঘানি টানানো হতো এবং কাঠ কাটতে দেয়া হতো। বিনিময়ে পেত কঙ্কর মিশ্রিত সামান্য ভাত। সামান্য পানি। অনেক সময় পানি না দিয়ে অমানুষিক যন্ত্রণা দেয়া হতো। ধারা বর্ণনায় যখন কথা গুলো শুনছিলাম তখন আমার রক্ত যেন হিম শীতল হয়ে যাচ্ছিল। আমার চোখে জল। বন্ধু রতন এবং হালুয়াঘাটের আব্দুল হাকিম ও তার স্ত্রী আরজিনা খাতুনকে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে দেখলাম। আমার মনে বৃটিশদের প্রতি ঘৃণার জন্ম নিল। যেমন ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানী হানাদের নির্যাতনের বর্ণনা শুনে ও দেখে আমার মনে পাকিস্তানীদের প্রতি ঘৃণা জন্মেছে।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বৃটিশদের এই অমানুষিক নির্যাতনের তীব্র নিন্দা জানান। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় ধীক্কার সভা। নির্যাতন নিপীড়নের পরও বন্দীরা বৃটিশ বিরোধী স্লোগান দিতেন। তাদের স্লে¬াগান ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। মহাত্মা গান্ধি এবং রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে অনশনকারীরা ইনকিলাব জিন্দাবাদ শ্লোগান দিয়েই অনশন ভাঙতেন। মৃত বন্দীদের দেহ সমূদ্রে ফেলে দেয়া হতো।
নেতাজী সুভাষ বোস ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আন্দামান গমন করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে ভারত সরকার ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে সেলুলার জেলকে জাতীয় স্মারক হিসেবে ঘোষণা করে তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সেখানে সুভাষ বোস এর একটি শ্বেত পাথরের মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে। জেলের ৭ টি বাহুর ৪টি ভেঙ্গে হাসপাতাল করা হয়েছে। প্রধান গেটের দু’পাশের ঘরগুলো এখন যাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। রাজবন্দীদের ছবি, জামা কাপড়, বিছানাপত্র, তাদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি রয়েছে। বৃটিশদের অত্যাচারের ভয়াবহ দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মূর্তি ও মডেলের সাহায্যে।
পরদিন সকালে বেশ বৃষ্টি হলো। এখানকার মাটিতে কাদা হয় না। কারণ বেলে মাটি। বৃষ্টির পানি কোথায়ও আটকে নেই। বেলে মাটি পানি শুষে নিয়েছে। পোর্ট ব্লেয়ারের মিনি চিরিয়াখানায় নানা প্রকার কুমির আছে। যেটা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। আমরা গেলাম সকাল সাড়ে দশটায়। ঘন্টাখানেক সময় থাকলাম। দেখলাম বিশাল আকৃতির কয়েকটি কুমির এবং ঘড়িয়াল। আলাদা আলাদা স্থানে রাখা হয়েছে। কুমিরগুলো বেশ তরতাজা। এখানে দেখার আরও একটি প্রাণী বড় আকৃতির কবুতর যা সাধারণ কবুতরের চেয়ে দ্বিগুণ। সবুজ রংয়ের দৃষ্টিনন্দন রং সে কবুতরের। জলদগম্ভীর স্বরে কবুতরগুলো বাকবাকুম করছিল। নানা প্রজাতির পাখি আর সাপ দেখলাম। চিরিয়াখানার অদূরেই বিশ্বের অধুনিকতম চাতাম স’মিল দেখতে গেলাম। বিশাল বিশাল গাছ স্বয়ংক্রিয় ক্রেনে তুলে মেশিনে ফেলা হচ্ছে মূহুর্তে তা বিভিন্ন সাইজের কাঠ হয়ে বের হচ্ছে। সেখান থেকে গান্ধী পাঠের বিশাল সবুজ চত্বরে বসে চা পান করে নিলাম। বেশ খানিক বিশ্রামও হলো। এর পর ঢুকলাম ‘সামুদ্রিকা’য়। এটি জীব যাদুঘর (এন্থোপোলজিক্যাল মিউজিয়াম)। এখানে রয়েছে নানা প্রকার সামুদ্রিক মাছ, ঝিনুক-শামুক, শৈবাল, তারা মাছ তিমি ও ডলফিনসহ নানা প্রকার সামূদ্রিক প্রাণীর কঙ্কাল। হ্যাঁ যে কথাটি বলা হয়নি তা হলো : আন্দামানে মাত্র ৩ রুপিতে ডাব মেলে। আমরা পানি হিসেবে দিনে বেশ কয়েকটি ডাবের পানি পান করলাম। আর এখানকার গড় তাপমাত্রা ২৩ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ডিসেম্বরে তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বিকালে
ছোট একটি জাহাজে আমরা প্রায় দেড়’শ জন গেলাম ভাইপার আইল্যাণ্ডে। সেলুলার
জেল তৈরির আগে এই দ্বীপে রাজবন্দীদের রাখা হতো। ভাইপার দ্বীপের প্রায় তিন’শ
ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর একটি পুরাতন ইমারত। এর পশেই গম্বুজ বিশিষ্ট একটি
উঁচু ঘর। ঘরের ছাদে মরচে পরা পুরাতন ফাঁসির মঞ্চ। এখানেই পাঞ্জাবের বীর
সন্তান শের আলীকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। এখানে ফাঁসি দিয়ে মৃতদেহ পাহাড় থেকে
গড়িয়ে দেয়া হতো সমূদ্রে। না জানি আর কতজনকে এখানে এভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে
ইংরেজরা ! সেলুলার জেল দেখতে ভারতীয়দের আগ্রহ বেশী। আমরাও সে তালিকায়।
ইউরোপ ও আমেরিকান পর্যটকরা আনন্দ-স্ফুর্তি করার জন্য বার ও ক্যাসিনোতে গেল।
ওরা আমাদের সঙ্গে ভাইপার আইল্যাণ্ডে গেল না।
সন্ধ্যবেলায় পোর্টব্লেয়ারের ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্সে যেয়ে স্পীড বোটে শান্ত সমূদ্রে চক্কর দিলাম। আমরা চার জন এক স্পীড বোটে প্রায় আধা ঘণ্টা ঘুরলাম। প্রায় শতাধিক বোটে পর্যটকরা সমূদ্রে দাপাদাপি করছে। আনন্দের পাশাপাশি ভয়ও হচ্ছিল। স্পীড বোটের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে তো নির্ঘাত মৃত্যু।
পরদিন আমাদের যাত্রা জলিদ্বীপে। সকাল ৮ টায় মিনি বাসে ওয়াণ্ডার জেটিতে পৌঁছে উঠলাম যন্ত্রচালিত একটি নৌকায়। ছোট্ট জোলা বা ক্যানেল পথে ঘন্টাখানেক চললাম। উভয় পাশে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। তীরে নেমে প্রথমেই চোখে পড়লো সাইনবোর্ড। তাতে লেখা : জীবিত কিম্বা মৃত কোন প্রাণী নেয়া তো যাবেই না এমনকি স্পর্শও করা যাবে না। এসব অপরাধ করলে জেল-জরিমানা হবে। যন্ত্রচালিত বোট থেকে নেমে ছোট নৌকায় উঠলাম। প্রতিটি নৌকায় ৮ জন। আমাদের নৌকায় মালদহের স্কুল শিক্ষক ননী গোপাল দত্তের স্ত্রী দিপালী দত্ত, পুত্র রাজিব ও কন্যা রানু, হালুয়াঘাটের হাকিম দম্পতি এবং আমরা দু’বন্ধু। নৌকাগুলোর তলায় কাঁচ। স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে সমূদ্রের তলদেশের সব কিছু দেখা যায়। নানা প্রকার মাছ, প্রবাল, ঝিনুক-শামুক ও জীবন্ত কোরাল। জলিদ্বীপের পরিধী খুব বিস্তৃত না। ১০ থেকে ১২ একর হবে। পশ্চিম ও দক্ষিণে ম্যানগ্রোভ বন এবং উত্তর থেকে পূর্বপার বরাবর সোনালী বালুর চর।
পানি যেন স্ফটিক স্বচ্ছ। কয়েক’শ নরনারী সমূদ্র তলদেশের সৌন্দর্য দেখতে ডুবুরীর সহায়তায় পানির নিচে রহস্যময় জগত দেখতে নেমেছে। আমার বন্ধু রতনকে বললাম নেমে পর পানিতে। ও সাহস পেল না। আমারও প্রচণ্ড ভয় হচ্ছিল। এর পরেও ঝুঁকি নিলাম। দুশো টাকার চুক্তিতে ডুবুরির কাছে কিছু সময় টেনিং নিয়ে নাকে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে ডুবুরির সঙ্গে নেমে পড়লাম পানিতে। পানির নিচের সৌন্দর্য টেলিভিশনে দেখেছি। এবার দেখলাম বাস্তবে। কি অপরূপা সমূদ্রের তলদেশ। জীবন্ত প্রবাল, নানা রংয়ের মাছ, ঝিনুক, শামুক। মিনিট দশ পর একটি লম্বা সাপ সাদৃশ্য বিরাট জলজীব আমার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে পানির উপরে উঠে এলাম। বেশ ভয়ই পেয়েছিলাম। পানির উপরে উঠে ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। যখন আমরা তীরে এসে চা পান করার জন্য ছোট্ট স্টলটির দিকে অগ্রসর হচ্ছি তখন দেখলাম বেশ জটলা। কৌতুহলি হয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখে ভয়ে তো আমি আরও জড়সড় হয়ে গেলাম। একজন পর্যটক যিনি পানিতে নেমেছিলেন আমার মতই সমূদ্র তলার রূপশ্রী দেখতে। তার বাম পায়ের হাটুর উপর দিকটায় বড় একটি ক্ষত। তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। মাঝারি ধরনের একটি মাছের আঘাতে থেতলে গেছে কলকাতার ব্যবসায়ী দেবু মুখার্জীর পায়ের উপরাংশ। ভাল লাগলো যারা সেখানে গাইড, তাদের সেবা যতœ দেখে। কিছ্ক্ষুণ পর দেখলাম আহত দেবু বাবু হাটহাটি করছেন এবং আমাদের অদূরে বসে সহযাত্রীদের সঙ্গে বসে হাসি-ঠাট্টায় মশগুল হয়ে পড়েছেন। আবারও নৌকায় উঠলাম। নৌকার তলদেশের স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখলাম সমূদ্রের সৌন্দর্য। বারবার দেখেও মন ভরে না। নিজের চোখকেও বিশ্বাস হয় না। সত্যিই পৃথিবীর রূপ এতো সুন্দর!
দুপুর বেলা জলিবয় দ্বীপের গাছের ছায়ায় বসে পোর্টব্লেয়ার থেকে নিয়ে যাওয়া খাবার খেতে বসেছি। পাশে এসে বসলেন দুই জোড়া যুবক যুবতী। ওরা এসেছে সুইডেন থেকে। মেয়ে দুটির পড়নে গেঞ্জি ও জিন্সের প্যান্ট। একটি মেয়ে অনিন্দ সুন্দরী। অপরজনও বেশ সুন্দরী। ছেলে দুটোর চেহারা মায়াবি। ওদের চালচলন বেশ স্মার্ট। আমার হাতে এসএলআর ক্যামেরা। ওদের ক্যামেরাও একই। রিটোরি ভ্যানাদ্রি নামের সুন্দরী মেয়েটি তার ক্যামেরা আমার হাতে দিয়ে ওদের ছবি তুলে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলো। আমি ওদের বেশ কয়েকটি ছবি ধারণ করে দিলাম। সুসান রজার নামের যুবকের মুখে সব সময় মিষ্টি হাসি। সুসান, রিটোরি, ক্লিওন ও ম্রিউরিট – ওরা ক’বন্ধু এসেছে ভারত দর্শনে। প্রথমেই আন্দামান-নিকোবার দেখবে এর পর যাবে আগ্রা-দিল্লী-ফতেহপুর ইত্যাদি স্থান দর্শনে। ওরা চার জনই পানিতে নেমেছিল সমূদ্রের তলদেশের সৌন্দর্য দেখতে। দারুণ উপভোগ করেছে। ওরা পানির নিচে বড় বড় মাছ ও শিশুক দেখেছে। দেখেছে চিংড়ি, রং বেরংয়ের কত মাছ ও প্রাণী। সে গল্পই ওরা হাত নাড়িয়ে-নাড়িয়ে করছিল। ম্রিউরিটের হাতে গিটার। সমূদ্রের পারে নির্জন ছায়াঘেরা স্থানে ওদের গিটারের ঝংকার বেশ ভাল লাগছিল। যেহেতু আমি ওদের ছবি ক্যামেরায় ধারণ করে দিয়েছি সে কৃতজ্ঞতায় ওরা যখন খাচ্ছিল তখন খুবই বিনয়ের সাথে আমাকে এবং আমার বন্ধু রতনকে দু’টুকরো রুটির সঙ্গে জেলি দিয়ে তা খেতে অনুরোধ করলো। যদিও কিছুক্ষণ আগে আমরা খাবার খেয়েছি তার পরেও ওদের অনুরোধ রাখতে হলো। পানিতে নেমে ভয় পেয়েছিলাম হেতু ক্ষুধাটাও বেশ বেশীই লেগেছিল।
পর দিন রঙ্গত যাওয়ার অপেক্ষায় বেশ পুলকিত বোধ করছিলাম। কারণ সেখানে যাওয়ার পথে আদিম মানুষ দেখা যাবে। তবে সেটা সবার ভাগ্যে জোটে না। সকাল সাড়ে দশটায় রঙ্গতের উদ্দেশ্যে বাসে উঠলাম। সুন্দর সড়ক। উঁচু নিচু পথ। ছোট ছোট পাহাড়। দু’ধারে বড় বড় গাছ। নির্জন সড়ক। বাসে আমরা যাত্রী ৩৮ জন। ৪ জন সশস্ত্র গার্ড। একজন গাইড। সমস্ত যাত্রাপথেই গাইডের ভূমিকা আমাদের সঙ্গ দেয়। আমরা যেন আমাজান বনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি। ঘন বনের মধ্য দিয়ে আমরা অতিক্রম করলাম ১শ ১০ কিলোমিটার। পুরো সড়ক পথই রোমাঞ্চকর। গভীর জঙ্গল, সবুজ উপত্যকা এবং ছোট-বড় অসংখ্য জনপদ। পাকা কামরাঙা, সফেদা, পেয়ারা, গাব ছাড়াও নানা প্রকার ফল সড়কের উপর পড়ে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জনমানবহীন এসব এলাকায় ফলবানবৃক্ষ প্রচুর। গাছগুলো প্রাকৃতিক ভাবেই জন্মেছে। হয়তো পাখির মল থেকে বীজ মাটিতে পড়ে গাছের জন্ম। কত নাম না জানা বনফুল দেখলাম। সমূদ্র, মুহুর্তে মুহুর্তে রং বদলায় তার রূপের পশরা নিয়ে। এবার কদমতলি খাঁড়ি পার হয়ে আমাদের বাস পৌঁছে বারাটাং। আমরা বাস থেকে নামতেই কিচিরমিচির শব্দ কানে এলো। বাম দিকে তাকিয়ে দেখে তো অবাক। প্রায় ৩০/৩২ জন আদিম মানুষ। জারোয়া সম্প্রদায়ের মানুষগুলো নানা বয়সের। ওরা সবাই উলঙ্গ। কোঁকড়ানো চুল, বেশ সুস্বাস্থের অধিকারি। গায়ের রং বেশ কালো অনেকটা আফ্রিকানদের মতো। ধুলো-মাটিতে একাকার সারা শরীর। পৌঢ়, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী এবং শিশুরা। আমাদের খুবই কাছাকাছি ওরা। হঠাৎ এক যুবক এগিয়ে এসে এক আমেরিকান পর্যটকের হাতের ব্যাগটি নিয়ে সরে পড়লো। বিপত্তি দেখা দিল। কিন্তু আমাদের গাইড এবং গার্ডরা ওদের দল নেতাকে কি সব বললো। পৌঢ় বয়সী দল নেতার ইশারায় যুবকটি ব্যাগটি ছুড়ে দিল গার্ড এর হাতে। গাইডের পরামর্শ মোতাবেক আমরা বাসে ওঠার সময় ওদের জন্য পারুটি, কলা, বিস্কুট, মিষ্টি, চানাচুর ইত্যাদি নিয়েছিলাম। সেগুলো দিলাম। এবার দারুণ খুশি । কলা ও মিষ্টি ওদের প্রিয়। আমাদের আগেই বলে দেয়া হয়েছিল কোন প্রকারেই ক্যামেরা বা মোবাইল ওপেন করা যাবে না বা ছবি তোলা যাবে না। ছবি তুললে পঁচিশ হাজার রুপি পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। ওরা যখনই আমাদের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছিল গার্ডরা ওদের সরিয়ে দিচ্ছিল খুব বিনয়ের সাথে। জারোয়া সম্প্রদায়ের নগ্ন মানুষগুলোর হাতে তীর-ধনুক এবং ধারালো ফালা। এক শিশু কন্যাকে কাঁধে ধরে আছে এক যুবক। এক শিশুকে দেখলাম মায়ের গলাজড়িয়ে ধরে স্তনে দুধ পান করছে আপন মনে। মা আমাদের কাছ থেকে পাওয়া কলাটি বেশ ছাল ছাড়িয়ে খেয়ে নিল। আমাদের বাস ফেরিতে উঠলো। ওরা বনের মধ্যে চলে গেল। গাইড বললেন প্রায় দিনই এসময় ওরা দল ধরে এখানে আসে কিছু পাওয়ার আশায়। কিছু মানে খাবার।
বারাটাং থেকে রঙ্গত এর দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। এই পথ অতিক্রম করতে আরও দুটি ফেরি পার হতে হবে। প্রথম ফেরি পার হয়ে বাস অগ্রসর হচ্ছে। দেখে মনে হলো নতুন বসতি স্থাপন হচ্ছে। জঙ্গল পরিস্কার করে জনবসতি গড়ে উঠছে। ছোট ছোট কয়েকটি গ্রাম চোখে পড়লো। এসব এলাকায় যারা বসতি গড়ে তুলছে তাদের প্রায় সকলেই বাঙালি। শুধু বাঙালি বললে পুরোপুরি বলা হলো না তারা সকলেই বাংলাদেশী। দ্বিতীয় ফেরি ঘাটে আমদের বাস থামলো। কিছুক্ষণ চা বিরতি। দু’টি চায়ের দোকান। দোকানদার বাঙালি। জিজ্ঞাসা করে জানলাম তার পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের উখিয়া এলাকা থেকে সেখানে গেছে। জঙ্গল পরিস্কার করে বাড়ি করেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ এলাকা থেকে ১৯৪৬ এর দাঙ্গার সময় বহু লোক ট্রলারে ভেসে আন্দামানে আশ্রয় নেয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ও কিছু লোক আন্দামানে পারি জমায়। এর পর আসে ১৯৭১ সালে বেশ কিছু পরিবার। তাদেরই বংশধররা এখন এখানে সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠি। মহাত্মা গান্ধী এবং জ্যোতি বসুর কৃপায় উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব লাভ করেছে। প্রত্যেকটি পরিবারকে ভারত সরকার দিয়েছে দশ একর করে জমি। এসব জমিতে ভাল ধান, ডাল, নারকেল, পেঁপে উৎপন্ন হয়। এখানকার ছেলে-মেয়েরা বিনা বেতনে কলেজ পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পায়। শুধু তাই নয় বই-খাতাও পায় খুবই স্বল্প মূল্যে। শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। তবে বাংলা আবশ্যিক। শিক্ষিতের হার ৮৫ শতাংশ। আপনি অবাক হবেন যখন দেখবেন চা’য়ের দোকানদার এবং ডাব বিক্রেতা আপনার সঙ্গে শুদ্ধ ইংরেজীতে কথা বলছে।
রঙ্গত পৌঁছে মনে হলো এটা বাংলাদেশেরই একটি বাজার। বেশীর ভাগ বাঙালি। একটি সুন্দর মসজিদও দেখলাম। অদূরেই মন্দির। দোকানপাট বাংলাদেশের দোকানগুলোর মতোই সাজানো। বিকালে ছোট্ট বাজারটিতে ঘুরলাম। থাকার ব্যবস্থা হলো একটি গেস্ট হাউজে। বেশ পরিপাটি করে সাজানো রুম। রাতে হোটেলে হরিণের মাংস দিয়ে পেট পুরে ভাত খেলাম। বন্ধু রতনসহ কয়েকজন ডাল ও নিরামিশ খেলো এবং আর আমরা ক’জন রুটি হরিণের মাংস খেলাম। হরিণের মাংস এখানে সহজলভ্য। গরু-মহিষ-ছাগল গৃহপালিত পশু হেতু তার মাংসের দাম চড়া। তাই হরিণ শিকার করে তার মাংস বিক্রি করা হয়। ভারতে হরিণ শিকার নিষিদ্ধ হলেও এই বিধি-নিষেধ আন্দামান-নিকোবারে নেই। ফাঁদ পেতে এবং তীর ধনুক দিয়ে হরিণ শিকার করা হয়। বন্দুকের গুলি নিক্ষেপ করে হরিণ শিকার করা যাবে না। আমাদের সঙ্গে একই হোটেলে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও হরিণের মাংস খেলেন। তাদের কাছেই বিষয়টি জানলাম।
রাতে হোটেলে ভাল ঘুম হলো। হ্যাভলক দ্বীপে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভোর ছ’টায় প্রায় দুই কিলোমিটার বাসে যেয়ে জেটি হয়ে জাহাজে উঠলাম। হ্যাভলক পৌঁছুতে দশটা বেজে গেল। দূরত্ব মাত্র ৪৫ কিলোমিটার। জাহাজ চললো ধীর গতিতে। চর দেখে-শুনে চলতেই বিলম্ব। বন্দর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে নারকেল বাগানের মাঝখানে একটি বড় দ্বিতল গেস্ট হাউজ এবং বেশ কয়েকটি কটেজ। একটি কটেজে আমাদের দু’জনের থাকার ব্যবস্থা। নির্জন এলাকা। সামনে সমূদ্র। দূরের দ্বীপটি চোখে পড়ে। আমাদের কটেজের অদূরে সমূদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। আমরা বিকালে বের হলাম সমূদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে। দুরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। আমাদের কক্সবাজারের সমূদ্র সৈকতের মত এতো দীর্ঘ ও প্রশস্ত না সৈকতটি তবে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। নানা রংয়ের নূরি-পাথর এবং শামুক ও ঝিনুক পর্যটকদের আকৃষ্ট করবেই। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা সমূদ্রের বালু চরে হাটলাম। এবার গাইড আমাদের ফিরতে তাগাদা দিলেন। যুবক-যুবতীরা তার কথায় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে সবাই সমূদ্র তীরে আনন্দে মাতোয়ারা। এবার গাইড তার হ্যান্ড মাইকে বললেন, ‘এখানে থাকা নিরাপদ না। কারণ মাঝে মধ্যেই বন্য হাতির দল এখানে আসে। তখন বিপদ হতে পারে।’ এই কথা শোনা মাত্র আমরা গুটিয়ে গেলাম। দ্রুত পায়ে ফিরে এলাম। এখানে অদূরে রয়েছে হস্তি প্রজনন কেন্দ্র। কিছু হাতিকে একটি ঘেরের মধ্যে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সেখানে রাতে জঙ্গল থেকে হাতি এসে তাদের সাথে মিলিত হয়ে আবার জঙ্গলে ফিরে যাবে। এভাবে হাতীর বংশ বৃদ্ধি হয়।
রাতে এখানকার একটি সাংস্কৃতিক দল নেচে গেয়ে মাত করে দিল। ওদের দলের সদস্য সংখ্যা ১৬ জন। সমান সংখ্যক মেয়ে ও পুরুষ। ঘাগড়ি এবং সর্ট সালোয়ার পড়ে মেয়েদের এবং কালো প্যন্টের সঙ্গে লাল রংয়ের ফতুয়া পড়ে যুবকদের বেশ দেখাচ্ছিল। ওদের মধ্যে ৪ টি মেয়ে উজ্জ্বল শ্যামলা আর অন্যরা শ্যামলা। মুখশ্রী সুন্দর। সবাই বাঙালী। প্রথমে ব্রতচারি নৃত্য দিয়ে শুরু করে পরে ভারতীয় বিভিন্ন নাচ এবং শেষে ব্রেক ড্যান্স হলো। এক পর্যায়ে আমাদের সকলকেই হাত ধরে টেনে নিয়ে নাচতে বাধ্য করলো। যারা নাচতে দ্বিমত বা অমত প্রকাশ করছিলেন তাদের কাছে এসে মেয়েরা বিনয়ের সাথে হাত ধরে ডেকে নিয়ে নাচিয়ে ছাড়লো। বাংলা-হিন্দি এবং ইংরেজি গান। আধুনিক বাদ্য যন্ত্র এবং লাউড স্পিকারের শব্দে নির্জন দ্বীপটি যেন ঝলসে উঠেছে। বাদ্য যন্ত্র সমূহ বাজাচ্ছিল ৬ জন মেয়ে এবং ৪ জন ছেলে। গিটার, ড্রাম, সানাই, ফ্লুয়েট, হারমোনিয়াম, ঢোল, খোল, করতাল, ঝুমুর ইত্যাদি। কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যটকের লম্প-ঝম্প এবং কৌতুক আমাদের বেশ আনন্দ দিয়েছিল।
পর দিন ভোরে আবার চারঘন্টা জাহাজে করে ফিরলাম রঙ্গত। রঙ্গত থেকে বাসে রওনা হলাম ডিগলিপুরের উদ্দেশ্যে। ধর্মপুর, শান্তিপুর, টুগাপুর শহর ছাড়িয়ে হাইওয়ের রকে আছড়ে পড়া সমূদের ঘ্রাণ নিতে নিতে পৌঁছে গেলাম মায়াবন্দরে। সেখানে বাঙালি আছে তবে তামিলরা সংখ্যা গরিষ্ঠ। কিছু উড়িয়াও আছে। মায়াবন্দরে দুপুরে খেতে বসলাম এক বাঙালি মুসলিম মালিকের হোটেলে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃস্টান সকলেই আমরা তৃপ্তি সহকারে খেলাম। এখানে জাত-পাতের বালাই নেই। প্রায় ঘন্টা ব্যাপী দুপুরের খাবার উৎসব চললো। খাদ্য তালিকায় রুটি-পরটা, ভাত। সঙ্গে সামূদ্রিক মাছ, সবজি, ডিম ও মুরগীর মাংস, জেলি। এর সঙ্গে টক দই ও আইস ক্রিম। হ্যাভলক এবং মায়াবন্দর দেখতে সারা বিশ্বের পর্যটকরা কেন আসে বুঝতে পারলাম। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। বড় বড় নারকেল ও দেবদারু গাছ ছাড়াও রয়েছে রেইন ট্রি। আছে নানা জাতের ফুলের সমাহার। দ্বীপ দুটির প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় ফুলের বাগান। কোন বাড়ির জানালায় গ্রিল দেখলাম না। সেখানে চোরের উপদ্রপ নেই। গেস্ট হাউজ হোটেল কিম্বা দোকানের চত্বরে ফুলের গাছ। জানা গেল ভারতের বক্স অফিস হিট করা হিন্দি, বাংলা, তামিল ও মালয়ী ভাষার বেশ কিছু সিনেমার দৃশ্য বিশেষ করে গানের দৃশ্য এই দ্বীপ দুটিতে স্যুটিং হয়েছে। আমরা মায়াবন্দরে একটি তামিল ছবির স্যুটিং ইউনিট দেখলাম। সৌন্দর্যের ডালি হচ্ছে মায়াদ্বীপ। তবে যেতে হবে আরও ভেতরে ৩০ কিলোমিটার। সেখানে সমূদ্র সৌকতের নীল জলরাশি দেখতে। যেহেতু আমাদের গন্তব্য ডিগলিপুর। অতএব বাসে উঠতে হলো।
মায়াবন্দর থেকে বাস উত্তর আন্দমানে প্রবেশ করতে সমূদ্রের খাঁড়ির উপর তৈরি করা চেঙ্গাপ্পা ব্রিজ পার হয়ে আরও প্রায় দেড় ঘন্টা জঙ্গল, উপত্যকার সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে পৌঁছানো গেল ডিগলিপুরে। তখন বিকাল বেলা। সূর্যাস্তের বাকি এক ঘন্টা। ডিগলিপুর নেমে মনে হলো বাংলার কোন এক মফস্বল শহরে এলাম। আমাদের জন্য থাকার ছোট্ট টিলার উপর এপি ডব্লু ডি-র গেস্ট হাউজ। রুমে ব্যাগ রেখে হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। টিলা থেকে নেমেই কিছু দূরে দোকানপাট। বাংলার রসগোল্লা, সিঙ্গারা, ডালপুরি দেখে ভাল লাগলো। চা-সিঙ্গারা খেয়ে একটি রিক্সায় উঠলাম দু’বন্ধু শহর ঘুরে দেখতে। রিক্সা চালক বাঙালি। ওর কাছেই জানলাম এখানেই রয়েছে আন্দামানের একমাত্র নদী কাপলং এবং পাহাড়চূড়া স্যাডেল পিক যার উচ্চতা ৭শ ৩২ মিটার। এই এলাকায় প্রচুর ধান উৎপন্ন হয় হেতু ডিগলিপুরের আরেক নাম ‘গ্রেনারি অব আন্দামান’। রাত ৮ টা পর্যন্ত আমরা ঘুরলাম ছোট্ট চিমছাম শহরে।
পরদিন ভোরে রওনা হলাম ছোট জাহাজে করে ৪০ কিলোমিটার দূরের রামনগর সমূদ্র সৈকতে। যতদূর চোখ যায় দেখা যায় বিস্তীর্ণ নিঃসঙ্গ বেলাভূমি। সারা দিন সেখানে হৈ-হুল্লোর গান-বাজনায় মেতে রইলাম আমরা। গান গাইল স্থানীয় একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। ওরা আন্দামানের পর্যটন দপ্তরের শিল্পী। আমাদের সফর সঙ্গী শিলিগুড়ির ঝংকার শিল্পী গোষ্ঠী আসর জমিয়ে দিল। দুপুরে হরিণের মাংসের বিরানী সঙ্গে দই। এর পর গা এলিয়ে দিয়ে ছাতার নিচে বিশ্র্াম। বিকাল গড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখে গেস্ট হাউজে ফিরলাম তখন রাত সাড়ে ৮ টা। রাতে একদল ছেলে-মেয়ে গেস্ট হাউজের সামনের খোলা চত্বরে নাচ-গানে মাত করে দিল। ওরা সংখ্যায় ২০ জন। এছাড়াও ৮ জন যান্ত্র শিল্পী। সমান সংখ্যক ছেলে ও মেয়ে। চোখ ধাধাঁনো রঙিন পরিধেয়। মেয়েদের ব্লাউজ আর পেটিকোটের মত ঘাগড়া। ছেলেদের পড়নে লুঙ্গি এবং ফতুয়া। মেয়েদের খোঁপায় ফুল ও পাখির পালক। ছেলেদের মাথায় গামছা সাদৃশ্য কাপড়, কাঁধে ধনুক এবং কোমরের থলের মধ্যে তীর। আদিবাসীদের নাচ দিয়ে শুরু হলো। বেশ কয়েকটি নাচের পর ছোট্ট নাটিকা। নাটিকাটিতে ওরা সুনামীতে যে বিপর্যয় হয়েছিল তা ফুটিয়ে তুললো। ২০০৮ এর ২২ মে এখানে সর্বশেষ সুনামী হয়। তাতে জীবন হানি ঘটে। এটাকে গীতিনাট্য বলা যায়। এর পর আমাদের পালা। নাচতে নাচতে ছেলে-মেয়েরা আমাদের নাচতে বাধ্য করলো। যারা নাচতে চাচ্ছিল না তাদেরও হাত ধরে উৎসাহ দিয়ে নাচিয়ে ছাড়লো। সুইডেনের চার যুবক যুবতী দারুণ নাচলো।
আমরা পর দিন সকালে নাস্তা করে রওনা হলাম কালিকাপুরের উদ্দেশ্যে। সেখানকার এরিয়াল বে জেটি থেকে যন্ত্রচালিত ছোট নৌকায় উঠে প্রায় এক ঘন্টা পর পৌঁছুলাম স্মিথ দ্বীপে। সামনে এক চোখ ধাঁধানো দৃশ্যÑএক চিলতে বেলাভূমি রাস্তা হয়ে যেন মিশেছে রস দ্বীপে গিয়ে। চারদিকে অদ্ভুত রকম শান্ত, কোথাও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই, চারদিকে শুধু অথৈ পানি আর পানি। বড় বড় ঢেউ হুটোপুটি করতে করতে আছরে পড়ছে সোনালী সৈকতে। সৈকতে উঠে আসা হারমিট কাঁকড়ার ঝাঁক ঢেউয়ের সাথে আবার ফিরে যাচ্ছে সমুদ্রে। মাত্র ৫ মিটার চওড়া এবং এক কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতের দু’দিকেই সমূদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। এক পাশের পানির রং গারো নীল অপর দিকের পানি হালকা আকাশি। সমূদ্র যত গভীর হয়, রং তত বদলায়। গাঢ় সবুজ থেকে হালকা সবুজ। ঘন নীল থেকে হালকা নীলÑএকই জায়গায় সমুদ্রের রঙের এই বিভিন্নতা আর কোথায়ও দেখা যায় না। হাঁটতে হাঁটতে আমরা রস দ্বীপে পৌঁছে গেলাম। দ্বীপে বিশাল বিশাল গাছ আর জঙ্গল। এখানে কোন হিংস্র জীব-জানোয়ার নেই। তাই ভয়ও নেই। গাছে গাছে অসংখ্য পাখি আর পাখি। প্রকৃতির এ এক অনন্য সৌন্দর্য। উত্তরে তাকালেই দেখা যায় মায়ানমারের কোককো দ্বীপ এবং উত্তর-পূর্ব কোণে ভারতের ল্যাণ্ডফল দ্বীপ। সৈকত আর দ্বীপের সৌন্দর্য অপূর্ব। আমাদের নৌকার চালক যুবক রামানন্দ জানায় আমরা যখন ফিরবো তখন দ্বীপের অনেক কিছুই দেখা যাবে না। সত্যিই তাই তিন ঘন্টা পর আমরা যখন ফিরলাম তখন স্মিথ ও রস দ্বীপের মধ্যবর্তী সৈকত জোয়ারের পানিতে ডুবে অদৃশ্য হয়ে গেছে। রাতে ডিগলিপুরে আনন্দ মেলায় গেলাম। নাচ-গান আর এক বৃদ্ধ যাদুকরের যাদু প্রদর্শন উপভোগ করলাম। সকাল ৭ টায় আবার তল্পী-তল্পা নিয়ে সবাই বাসে উঠলাম। দশ ঘন্টা বাস যাত্রা করে সন্ধ্যায় ফিরলাম পোর্ট ব্লেয়ারে। ফেরার পথে রঙ্গত ও টুগাপুরে যাত্রাবিরতি ছিল। অবশ্য দুটি ফেরি পার হওয়ার সময়ও কিছুটা বিশ্রাম মিলেছিল।
রাতে শুয়ে ঘুম এলো না। বারবারই মনে পড়ছিল ডিগলিপুরের ৪০/৪২ বছর বয়সী মিষ্টির দোকানদার ইউসুফ আলীর কথা। সুনামীতে যিনি দুই সন্তানকে হারিয়েছেন। তার ৮ বছরের মেয়ে এবং ৫ বছরের ছেলে সমূদ্র তীরে ঝিনুক কুড়াতে গিয়েছিল। সুনামীর ঢেউয়ে ওরা সমূদ্রে ভেসে গেছে। তার কান্না-চোখের জল আমাদেরও কাঁদিয়েছিল। ইউসুফের পূর্ব পুরুষের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে। তার প্রায় ৯০ বছর বয়স্কা মা বেঁচে আছেন। বৃদ্ধ মা এবং স্ত্রীর চোখে শুধুই জল। জীবনের প্রতি তার মনে হতাশা বাসা বেঁধেছে। আমাদের বললেন, মনে হয় বাংলাদেশে ফিরে যাই। কিন্তু তা বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়। আছে ঘর-বাড়ি, জমি-গরু-হাঁস-মুরগী ইত্যাদি। তিনি বললেন, তার জীবন এখন ফাঁকা মনে হয়। এক সময়ের ইউসুফের সুখের সংসারে এখন শুধুই কান্না আর হতাশা।
সকালে বিছানা থেকে উঠে পাশেই হোটেল কাউন্টারে গেলাম উড়োজাহাজের টিকিট সংগ্রহ করা যায় কি না। ভাগ্য এবার সুপ্রসন্ন। দুটো টিকেট পাওয়া গেল। আমরা চার জন বাংলাদেশী ও ১২ জন ইউরোপীয় পর্যটক দুপুরে কলকাতার দমদম বিমান বন্দরে নামলাম। # ২২ এপ্রিল, ২০১৩

ছোট সময়ে বাবার কাছে শুনেছি তার পর ইতিহাসের শিক্ষকের কাছে জেনেছি, দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের হাত-পা বেঁধে জাহাজে করে নিয়ে যেয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। অনেককে দ্বীপগুলোর নির্জন স্থানে বা জঙ্গলে ফেলে আসা হতো। একে বলা হতো নির্বাসন বা দ্বীপান্তর। তারা হিংস্র প্রাণী বাঘ, শিয়াল, শকুন ইত্যাদির খাদ্যে পরিণত হতো। যাদের হত্যা ও নির্যাতন করা হয় তাদের অপরাধ তারা ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। শুনেছি সেখানে অসভ্য অধিবাসীরা বাস করে। তারা মানুষের মাংস খায়। আমার বহু দিনের ইচ্ছা সেই দ্বীপ দেখার। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম একবার সেখানে যাব। যেতে চাইলেই তো আর যাওয়া যাবে না। একে তো দুর্গম সমূদ্র বক্ষে দ্বীপসমূহের অবস্থান। দ্বীপ অভ্যন্তরের যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুবই খারাপ। এছাড়াও সেটি আলাদা একটি দেশের অংশ। ভারতের একটি প্রদেশ যা এখন কেন্দ্র শাসিত। দু:সাহসী কোন সঙ্গী না হলে তো সেখানে যাওয়া যাবে না। অতএব সঙ্গি খুঁজতে লাগলাম। আমার বাল্য বন্ধু রতন দাসকে অনেক বলে-কয়ে রাজি করানো গেল। শর্ত ওর খরচের অর্ধেক আমাকে বহন করতে হবে। ভ্রমণে ভাল ও বিশ্বস্ত সাথি দরকার তাই আমি ওর দাবি মেনে নিতে বাধ্য হলাম। ভিসা পাওয়া গেল। শুধু ভিসা হলেই তো হবে না, সেখানে যেতে হলে আবার ভারতের ‘প্যাসেস ডিপার্টমেন্ট’ থেকে বিশেষ পাশ নিতে হবে। কলকাতাস্থ এসসিআই (প্যাসেস ডিপার্টমেন্ট) অফিসে ২ কপি পাশপোর্ট সাইজের ফটোসহ নির্ধারিত ফরম পূরণ করে জমা দিতে হলো। তার সঙ্গে জমা দিতে হলো ৬ দিন আগে নেয়া কলেরা ও কমপক্ষে ৬ মাস আগে হামের টিকা নেয়া ডাক্তারের দেয়া সনদপত্র।
আন্দামানের প্রধান অংশ ৫ টি বড় বড় দ্বীপ নিয়ে গঠিত। আন্দামান ও নিকোবারের দ্বীপ সংখ্যা ছোট বড় মিলিয়ে মোট ৫শ ৭২ টি। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত এই দ্বীপপুঞ্জের বিস্তার ৭শ ২৭ কি:মি:। জন বসতি আছে ১শ ৩১ টি’তে। রাজধানী পোর্টব্লেয়ার। রাজধানী শহরটি আন্দামানে অবস্থিত। কলকাতা থেকে দূরত্ব ১২৫৫ কি:মি: এবং মাদ্রাজ থেকে ১১৯১ কি:মি:। কলকাতা এবং মাদ্রাজ থেকে জাহাজ এবং উড়োজাহাজে যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে বিমানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু এর জন্য চারদিন অপেক্ষা করতে হবে। জাহাজের টিকিট পাওয়া সহজ এবং সেটির নাম ‘এম ভি রামমোহন’ ছাড়বে বিকাল ৪ টায়। আমরা কলকাতা হগ মার্কেটের নিকটবর্তী হোটেল থেকে ট্যাক্সি যোগে খিদিরপুর বন্দরে পৌঁছলাম। তখন বেলা আড়াইটে। ইণ্ডিয়ান শিপিং কর্পোরেশনের অফিস থেকে পাশপোর্ট দেখিয়ে টিকিট নিতে হলো। যাত্রীদের বাক্স-পেটরা উঠলো। বলা বাহুল্য সেগুলো যথারীতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো। বিকাল সোয়া চারটায় সাত’শ ৪২ জন যাত্রী নিয়ে জাহাজ পোর্টব্লেয়ারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। নদী পথে বড় ফেরিতে নগরবাড়ি-আরিচা যাতায়াত করেছি বহুবার। যমুনা আর পদ্মার মোহনায় বড় বড় ঢেউ উঠলে ফেরি দুলতো আর প্রাণ কেঁপে উঠতো। একবার ফেরিতে ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম। যমুনার চরে আট ঘন্টা আটকে ছিলাম। রাতে ফেরির ক্যান্টিনে খাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় আধাপেট খেয়ে থাকতে হয়েছিল। যখন রওনা হলাম তখন বারবার সেই কথাটিই মনে হচ্ছিল। তবে ডিসেম্বর মাস আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। জাহজে সমূদ্রে যাত্রা মনে বড় ভয় সেই উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনা। বিভিন্ন দেশের নানা শ্রেণী-পেশার এবং নানা ভাষাভাষির মানুষ। আমরা দু’জন প্রথম শ্রেণীর টিকেট কেটেছি তাই প্রথম শ্রেণীর যাত্রী। খুঁজছিলাম বাংলাদেশের কেউ যাত্রী আছেন কি না। প্রথম শ্রেণীর যাত্রী এক দম্পতিকে পাওয়া গেল। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিম ও তার স্ত্রী গৃহবধু আরজিনা খাতুন। তারা ঢাকায় থাকেন। আমরা দেশের লোক পেয়ে স্বস্তি বোধ করছিলাম। তারাও আমাদের পেয়ে বেশ খুশি। ৩৪ জন ইউরোপ-আমেরিকার পর্যটক ছিলেন জাহাজে। অবশিষ্ট সকলেই ভারতীয়। ভারতীয়দের অনেকেই যাচ্ছেন তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে মিলিত হতে।
জাহাজ ছাড়ার সময় বেশ পুলকিত বোধ করছিলাম। সকল যাত্রি প্রফুল্ল চিত্তে ডেকে উঠে সৃষ্টি কর্তার নাম জপলেন। হুগলী নদীর কংক্রিটের চ্যানেল ধরে ধীর গতিতে জাহাজ অগ্রসর হলো। রাত সাড়ে ন’টা পর্যন্ত চললো। তার পর কিছুটা গতি বাড়লো। জোয়ারের পানি যখন চ্যানেলের প্রবেশ পথে আসলো তখন জাহাজ সমূদ্রের মোহনায়। জাহাজ প্রায় থেমে গেল। অতি সাবধানে ডুবো চর দেখে-শুনে কচ্ছপ গতিতে জাহাজকে অগ্রসর হতে হচ্ছে। শুধু আমাদের জাহাজই নয়। এভাবে আরও ৪ টি জাহাজ এবং ছোট-বড় শতাধিক নৌযান অপেক্ষায় আছে চ্যানেলের অনুকূল পানি প্রবাহের জন্য। বিশিষ্ট হিন্দু রাজা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিশেষ করে সতিদাহ প্রথার বিলুপ্ত করে যিনি সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন সেই মহান রাজা রামমোহনের নামকরণে ‘রামমোহন’ জাহাজ। চালচলন দেখে মনে হলো জাহাজটি প্রাচীন তাই চালচলন বুড়ো মানুষের মত ধীর-স্থির।
হুগলী নদীর মোহনায় সমূদ্র বক্ষে চরের মধ্যে কপিল মুনির আশ্রম। আশ্রমের চতুর্দিকে বেশ কিছু নারিকেল গাছসহ লম্বা গাছ-পালা দেখা গেল। জাহাজের দোতলায় মন্দির। সেখানে পূজা সমাপন করলেন একজন মধ্যবয়সী পুরোহিত। ততক্ষণে আমাদের জাহাজটি কপিল মুনির আশ্রম ছাড়িয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সমূদ্রের মধ্যে এখন জাহাজ। ক্রমশই গতি বাড়ছে বৃদ্ধ জাহাজ রামমোহনের। সাগরের পানি চিরে দ্রুত গতিতে (২৫ নটিক্যাল মাইল বেগে) অগ্রসর হচ্ছে ‘এম ভি রামমোহন’। রাতের খাবার খেয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম জাহাজের উপর দিয়ে চক্কর দিয়ে মাছ শিকারে ব্যস্ত শতাধিক গাঙচিল ও ডজন খানেক শংখ চিল। জাহাজের প্রোপেলারে সৃষ্ট ঘোলা পানির ঢেউ এবং পাখির মাছ শিকার দেখে যাত্রীরা উত্তেজিত। ছোট ছোট ট্রলার থেকে জাল ফেলে জেলেরা মাছ শিকার করছে। যার ক্যামেরা আছে সে মাছ শিকারী পাখীর ছবি তুলতে ব্যস্ত। শুরু হলো হৈ হুল্লোর। যুবক-যুবতীরা আনন্দে মেতে উঠলো তাদের সঙ্গে যোগ দিল ইউরোপ-আমেরিকার কয়েকজন যাত্রী। ব্যাণ্ডের তালে তালে নাচ-গান চললো প্রায় দুই ঘন্টা শিলিগুড়ির সংগীত দল ‘ঝংকার’ এর সদস্যরা মাতিয়ে রাখলেন যাত্রীদের। শিল্পীরা গণসঙ্গীত গেয়ে যাত্রীদের বেশ চাঙ্গা রাখলেন। আমি তো গান গাইতে পারি না। আমার বন্ধু রতন গানের ভাল শিক্ষক। সে যোগ দিল গানে। এক পর্যায়ে রতন তবলা সঙ্গত করার সুযোগ পেল। বেশ জমে গেল। রতনের বন্ধু হিসাবে সঙ্গীত দলের সদস্যদের সঙ্গে চা নাস্তাও আমার জন্য বরাদ্দ হলো। এভাবে দুপুর ১ টা পর্যন্ত চললো গান-বাজনা হৈ-হুল্লোর। দুপুর ২ টায় খাবারের ঘন্টা বাজলো। আমরা আড়াইটায় খাবার সংগ্রহ করে টেবিলে বসলাম। আগেই প্রতিটি যাত্রীর কাছ থেকে খাবারের মেনু জেনে নিয়েছিলেন জাহাজের কর্মীরা (নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে)। দু’প্রকার খাবার ভেজিটেরিয়ানদের জন্য ছানার ডালনা, ডাউল এবং ফুল কপি ভাজা এবং নন ভেজিটেরিয়ানদের জন্য দু’টি ডিমসহ ডাউল ও আলু ভাজা। উভয়ের জন্যই টক দই ছিল। আমি নন ভেজিটেরিয়ান আর আমার বন্ধু রতন ভেজিটেরিয়ান। আমি ওর কাছ থেকে একটু ছানার ডালনা পেলাম আর ওকে দিলাম ক’টুকরো আলু ভাজা।
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে বিকেলে অথৈ জলরাশি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এতো জল অথচ বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট সমগ্র বিশ্ব ব্যাপী। পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল এই কথাটি বই পড়ে জেনেছিলাম। এবার বাস্তবতা কিছু হলেও অনুভব করতে পারলাম। নীল আকাশ আর সমূদ্র একাকার হয়ে গেছে। সৃষ্টি কর্তার বিশালত্ব সমূদ্রের মাঝে না আসলে বোধ করি বোঝা দায়।
জাহাজ এম ভি রামমোহন সারারাত ধরে চলছে। ভোরে চার তলার রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। সমূদ্রের ঢেউ আছে তবে তা ভয়ঙ্কর না। পূবের আকাশে সূর্য উঁকি দিয়েছে। পানিতে সূর্যরশ্মী বিকিরণ ছড়াচ্ছে। দিনের শুরুই জানান দিচ্ছে বোধকরি দিনটি হবে রৌদ্রকরোজ্জ্বল। নীল জলের উপর নীলাকাশ, মনে হচ্ছিল আমি চলেছি স্বপ্নপূরীতে।
তৃতীয় দিন শুরু হলো চা-নাস্তা দিয়ে। জাহাজের প্রতিটি ডেকে পানাহারের ব্যবস্থা রয়েছে। আছে চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা। চলছে তাস, দাবা, লুডু খেলা। এছাড়াও রয়েছে সিনেমা দেখার সু-বন্দোবস্ত। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেকে ভীড় বাড়তে থাকে। গল্প-কথায় জমতে থাকে আসর। সকাল ১০ টায় আবার বসলো তারুণ্যের আসর। গান-বাজনা আর নাচ। লাউড স্পীকারে গীটার ও ড্রামের শব্দে জাহাজের শব্দ ও সমূদ্রের গর্জন যেন ম্ল¬ান হয়ে গেল। জাহাজ জুড়ে তারুণ্যের দাপাদাপি। যৌবনের জয় যেন চীরকালই। দ্বিতীয় দিনের মত তৃতীয় দিনেও চললো গান-বাজনা আর নাচ। সেই সাথে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সমন্বিত বাজনা। গীটারিস্ট সৌমিক রায় জনপ্রিয় সব বাংলা ও হিন্দি গানের সুরে গীটার বাজিয়ে জাহাজের যাত্রীদের নির্মল আনন্দ দান করলেন। মাঝে মাঝে বাঁশী বাজালেন কৃষ্ণ নগরের মধ্য বয়সী রাজেন্দ্রনাথ ঘোষ। দারুণ সে বাঁশীর সুর। বয়সের কারণে বেচারা একটানা দীর্ঘক্ষণ বাঁশী বাজাতে দম পান না। চললো বৈঠকী গান। নজরুল-রবীন্দ্র সংগীতসহ আধুনিক গান। রায়গঞ্জের সুব্রত কুমার চক্রবর্তী ভরাট গলায় গাইলেন হেমন্ত মুখার্জীর গান। মনে হলো যেন স্বয়ং হেমন্তই গাইছেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রফেসর রমা মূখার্জী ও তার ছাত্রী সুনয়না ঘোষাল গাইলেন রবীন্দ্র সংগীত। গভীর সমূদ্র বক্ষে আমাদের বহনকারী জাহাজ এম ভি রামমোহন এগিয়ে চলছে ঢেউ ভেঙ্গে। যাত্রীরা স্থলভাগ দেখার জন্য অধীর। তারুণ্যের দাপাদাপি হৈ হুলে¬ার চললো। দিনের মধ্য ভাগে দূরে দৃশ্যমান হলো আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের দু’চারটে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। আর সে কি আনন্দ যাত্রীদের।
জাহাজ অগ্রসর হচ্ছে আর দৃশ্যমান হচ্ছে ছোট-বড় দ্বীপ সমূহ। অপেক্ষার সময় আর যেন কাটে না। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সামনে, ডানে-বামে দৃষ্টি সীমার কাছাকাছি দূরত্বে অসংখ্য জোনাকি পোকার মত আলো দেখা যাচ্ছে। যত কাছে এগুচ্ছে সেই আলোর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে পানিতে। মাইকে ঘোষণা হলো এক ঘন্টা দশ মিনিটের মধ্যেই জাহাজ পোর্টব্লে¬য়ারে ভিড়বে। যাত্রীরা চঞ্চল হয়ে উঠলো। ক্রমশই পোর্টব্লে¬য়ারের আলোগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সময় যেন ফুরায় না। বন্দরের কাছাকাছি জাহাজ রামমোহন। বন্দর এলাকা এবং পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের গায়ে গায়ে শুধু আলো আর আলো। যাত্রীদের মধ্যে আবার হৈ হৈ রব, হর্ষধ্বনি এবং মাইকে হিন্দি গান। রাত তখন সাড়ে আটটা। জাহাজ থেকে নেমে ইমিগ্রেশন অফিসে গেলাম। কয়েকটি ফরম পূরণ করে হোটেলে থাকার অনুমতি পেলাম। পাশপোর্ট ও পারমিট মিললো পরদিন গোয়েন্দা অফিস থেকে। আমেরিকান ও ইউরোপিয়ানদের ছাড়পত্র দেয়া হলো খুবই দ্রুত। বেশ দেরিতে আমরা বাংলাদেশী চার জন ছাড়পত্র পেলাম। আমাদের ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তল্ল¬াশী একটু যেন বেশীই মনে হলো। বাঙালী মালিকানাধীন একটি হোটেলে আমরা উঠলাম। ভাড়াও বেশ কম। ভারতীয় মূদ্রায় মাত্র ৩ শ টাকা। বেশ পরিপাটি কক্ষে দুটি সিঙ্গেল খাট। রাতে ভাল নিদ্রা হলো।
ভোরে পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙলো। নারিকেল ও দেবদারু গাছে অসংখ্য পাখি। টিয়া, চড়–ই, আবাবিল, ময়না, ঘুঘু, মুনিয়া, শালিক, নানা প্রকার মাছরাঙা, বেলে হাঁস, বুনো রাজ হাঁস, বক ইত্যাদি। দৃষ্টি নন্দন সবুজ রাজকীয় পায়রা এবং সাদা-লাল-হলুদ রংয়ের বক দেখে যে কেউই মুগ্ধ হবেন। দেখলাম বুলবুল, শ্যামা, কোকিল এবং ছোট বড় কয়েক আকৃতির পেঁচা। বড় দেবদারু গাছের উপরের ডালে বেশ ক’টি পাখির বাসা লক্ষ্য করলাম। জলাশয়ের তীরে বিশাল আকৃতির হাড়গিলা ও মদনটেক পাখি এবং নানা প্রকার চিল দেখে আমার কৈশরের কথা মনে পড়ে গেল। আমরাই তো কত পাখি দেখেছি। পাখি শিকারীদের অত্যাচারে বাংলাদেশ থেকে পাখি বিদায় নিয়েছে। আন্দামানের পাখি দেখে আমার মনে হচ্ছিল, তাহলে কি আমাদের দেশের পাখিরা সব এই দ্বীপে এসে ঘর বেঁধেছে। এখানে কেউ পাখি শিকার করে না। শহরের গাছ গুলোতেও পাখি নিশ্চিন্তে রাত কাটায়। পাখিগুলো সকালে খাদ্যের অন্বেষণে দূরে পাখা মিললো। কিছু কাক এবং বানর দেখলাম শহরের সর্বত্রই। সকালের আন্দামানের রূপ দেখার জন্য হোটেলের আশ-পাশে হাটতে বের হলাম। কাছাকাছি একটি চা’য়ের স্টলে চা বিস্কুট খেলাম। দোকানদার বাঙালি। নাম রবিউল হোসেন। তার পূর্ব পুরুষ বা দাদা এখানে বসতি স্থাপন করেন ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে। আগে বাড়ি ছিল কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকায়। তিনি শুনেছেন তবে সেখানে কখনোই আসেন নি। তাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এই দ্বীপের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দা বাঙালি। এর পরের অবস্থান তামিলদের। তামিলরা বড় ব্যবসায়ী ও কিছু কৃষক। আর বাঙালীরা ছোট চকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, কৃষক ও শ্রমিক। ভারতবর্ষের ইংরেজ গভর্ণর লর্ড কর্ণওয়ালিশের সময় ক্যাপ্টেন আর্কিবণ্ড বাংলা থেকে লোকজন নিয়ে পোর্টব্লে¬য়ারের অদূরে চাথামে বসতি করে দেন।
১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ২শ জনকে দীপান্তর দেয়া হয় আন্দামানে। ওই সব বন্দীরা ছিলেন ওহাবী আন্দোলনের অগ্রসেনা। যাদের সংখ্যা গরিষ্ঠই ছিলেন বাঙালি। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিদ্রোহীদের (সিপাহী বিদ্রোহের বীরদের) দীপান্তরে পাঠায় ইংরেজ সরকার রাজদ্রোহের দণ্ড দিয়ে। এসময় ৭শ ৭৩ জন বন্দীকে দীপান্তরে পাঠানো হয়। ম্যালেরিয়া, কলেরা, প্লেগ রোগে এবং বৃটিশ পুলিশের নির্যাতনে প্রথম দু’মাসেই মৃত্যু বরণ করেন ২শ ৯২ জন বন্দী। এখানে নির্বিচারে দীপান্তর ও ফাঁসির যজ্ঞ চলে লোকচক্ষুর অন্তরালে। সকাল ন’টায় বের হলাম পোর্টব্লে¬য়ারের সেই কুখ্যাত ভারতের ‘বস্তিল’ নামে পরিচিত সেলুলার জেল দেখতে। এটি এখন আর জেল নয়, একটি জাতীয় স্মারক। কিছুটা দূরে তালা লাগানোর ব্যবস্থা। এখানে প্রবেশ করলেই বোঝা যায় ব্রিটিশ শাসনের ভয়াবহ রূপ। সেলুলার জেলের দক্ষিণ দিকের কয়েকটি কক্ষে চিত্র ও বিভিন্ন মূর্তি অঙ্কন করে বন্দীদের দুঃসহ জীবন দেখানো হয়েছে। ছবিগুলো জীবন্ত। সেলুলার জেল ভবনটি তিনতলা। এর সাতটি উইং-এ সেল ছিল ৭শ ৫৬ টি। ১৯৪১-এর ভূকম্পনে ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানী সৈন্যদের কামানের গোলার আঘাতে চারটি উইং বিধ্বস্ত হয়ে যায়। বর্তমানে রয়েছে তিনটি উইং এবং রয়েছে মোট ২শ ৯৬ টি সেল। দোতালায় ১৩ টি ফলকে নামাঙ্কিত রয়েছে ৩শ ৩৬ জন আত্মদানকারী বীরের। যাদের বেশীরভাগই বাঙালি। জেলের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে তিন তলার একটি সেলে বিপ্লবী সাভাকার বন্দী ছিলেন। কক্ষটিতে সাভাকারের বিশাল একটি তৈলচিত্র রয়েছে। ঘরটির মেঝে কার্পেট দ্বারা পরিপাটি করে মোড়ানো। বিপ্লবী সাভাকারের ৬০ বছরের জেল হয়েছিল। দশ বছর কাটে তাঁর নির্জন জেলে। সেলটির সামনেই উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসির মঞ্চ। মঞ্চের ছাদ বরাবর মোটা লোহার রডে পাশাপাশি এখনো তিনটি ফাঁসির দড়ি ঝুঁলানো রয়েছে। এখানেই এক সঙ্গে তিন জনকে লটকিয়ে ফাঁসি দেয়া হতো। অন্যান্য বন্দীদের ফাঁসির দৃশ্য দেখতে বাধ্য করা হতো।
সেলুলার জেলের আঙিনায় রয়েছে একটি কারখানা। এখানে বন্দিদের কায়িক শ্রম দিতে বাধ্য করা হতো। কাজে গাভ্লতি দেখলেই চাবুক এবং বুটের লাথি। তাদের দিয়ে ঘানি টানানো হতো এবং কাঠ কাটতে দেয়া হতো। বিনিময়ে পেত কঙ্কর মিশ্রিত সামান্য ভাত। সামান্য পানি। অনেক সময় পানি না দিয়ে অমানুষিক যন্ত্রণা দেয়া হতো। ধারা বর্ণনায় যখন কথা গুলো শুনছিলাম তখন আমার রক্ত যেন হিম শীতল হয়ে যাচ্ছিল। আমার চোখে জল। বন্ধু রতন এবং হালুয়াঘাটের আব্দুল হাকিম ও তার স্ত্রী আরজিনা খাতুনকে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে দেখলাম। আমার মনে বৃটিশদের প্রতি ঘৃণার জন্ম নিল। যেমন ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানী হানাদের নির্যাতনের বর্ণনা শুনে ও দেখে আমার মনে পাকিস্তানীদের প্রতি ঘৃণা জন্মেছে।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বৃটিশদের এই অমানুষিক নির্যাতনের তীব্র নিন্দা জানান। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় ধীক্কার সভা। নির্যাতন নিপীড়নের পরও বন্দীরা বৃটিশ বিরোধী স্লোগান দিতেন। তাদের স্লে¬াগান ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। মহাত্মা গান্ধি এবং রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে অনশনকারীরা ইনকিলাব জিন্দাবাদ শ্লোগান দিয়েই অনশন ভাঙতেন। মৃত বন্দীদের দেহ সমূদ্রে ফেলে দেয়া হতো।
নেতাজী সুভাষ বোস ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আন্দামান গমন করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে ভারত সরকার ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে সেলুলার জেলকে জাতীয় স্মারক হিসেবে ঘোষণা করে তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সেখানে সুভাষ বোস এর একটি শ্বেত পাথরের মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে। জেলের ৭ টি বাহুর ৪টি ভেঙ্গে হাসপাতাল করা হয়েছে। প্রধান গেটের দু’পাশের ঘরগুলো এখন যাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। রাজবন্দীদের ছবি, জামা কাপড়, বিছানাপত্র, তাদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি রয়েছে। বৃটিশদের অত্যাচারের ভয়াবহ দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মূর্তি ও মডেলের সাহায্যে।
পরদিন সকালে বেশ বৃষ্টি হলো। এখানকার মাটিতে কাদা হয় না। কারণ বেলে মাটি। বৃষ্টির পানি কোথায়ও আটকে নেই। বেলে মাটি পানি শুষে নিয়েছে। পোর্ট ব্লেয়ারের মিনি চিরিয়াখানায় নানা প্রকার কুমির আছে। যেটা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। আমরা গেলাম সকাল সাড়ে দশটায়। ঘন্টাখানেক সময় থাকলাম। দেখলাম বিশাল আকৃতির কয়েকটি কুমির এবং ঘড়িয়াল। আলাদা আলাদা স্থানে রাখা হয়েছে। কুমিরগুলো বেশ তরতাজা। এখানে দেখার আরও একটি প্রাণী বড় আকৃতির কবুতর যা সাধারণ কবুতরের চেয়ে দ্বিগুণ। সবুজ রংয়ের দৃষ্টিনন্দন রং সে কবুতরের। জলদগম্ভীর স্বরে কবুতরগুলো বাকবাকুম করছিল। নানা প্রজাতির পাখি আর সাপ দেখলাম। চিরিয়াখানার অদূরেই বিশ্বের অধুনিকতম চাতাম স’মিল দেখতে গেলাম। বিশাল বিশাল গাছ স্বয়ংক্রিয় ক্রেনে তুলে মেশিনে ফেলা হচ্ছে মূহুর্তে তা বিভিন্ন সাইজের কাঠ হয়ে বের হচ্ছে। সেখান থেকে গান্ধী পাঠের বিশাল সবুজ চত্বরে বসে চা পান করে নিলাম। বেশ খানিক বিশ্রামও হলো। এর পর ঢুকলাম ‘সামুদ্রিকা’য়। এটি জীব যাদুঘর (এন্থোপোলজিক্যাল মিউজিয়াম)। এখানে রয়েছে নানা প্রকার সামুদ্রিক মাছ, ঝিনুক-শামুক, শৈবাল, তারা মাছ তিমি ও ডলফিনসহ নানা প্রকার সামূদ্রিক প্রাণীর কঙ্কাল। হ্যাঁ যে কথাটি বলা হয়নি তা হলো : আন্দামানে মাত্র ৩ রুপিতে ডাব মেলে। আমরা পানি হিসেবে দিনে বেশ কয়েকটি ডাবের পানি পান করলাম। আর এখানকার গড় তাপমাত্রা ২৩ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ডিসেম্বরে তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সন্ধ্যবেলায় পোর্টব্লেয়ারের ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্সে যেয়ে স্পীড বোটে শান্ত সমূদ্রে চক্কর দিলাম। আমরা চার জন এক স্পীড বোটে প্রায় আধা ঘণ্টা ঘুরলাম। প্রায় শতাধিক বোটে পর্যটকরা সমূদ্রে দাপাদাপি করছে। আনন্দের পাশাপাশি ভয়ও হচ্ছিল। স্পীড বোটের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে তো নির্ঘাত মৃত্যু।
পরদিন আমাদের যাত্রা জলিদ্বীপে। সকাল ৮ টায় মিনি বাসে ওয়াণ্ডার জেটিতে পৌঁছে উঠলাম যন্ত্রচালিত একটি নৌকায়। ছোট্ট জোলা বা ক্যানেল পথে ঘন্টাখানেক চললাম। উভয় পাশে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। তীরে নেমে প্রথমেই চোখে পড়লো সাইনবোর্ড। তাতে লেখা : জীবিত কিম্বা মৃত কোন প্রাণী নেয়া তো যাবেই না এমনকি স্পর্শও করা যাবে না। এসব অপরাধ করলে জেল-জরিমানা হবে। যন্ত্রচালিত বোট থেকে নেমে ছোট নৌকায় উঠলাম। প্রতিটি নৌকায় ৮ জন। আমাদের নৌকায় মালদহের স্কুল শিক্ষক ননী গোপাল দত্তের স্ত্রী দিপালী দত্ত, পুত্র রাজিব ও কন্যা রানু, হালুয়াঘাটের হাকিম দম্পতি এবং আমরা দু’বন্ধু। নৌকাগুলোর তলায় কাঁচ। স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে সমূদ্রের তলদেশের সব কিছু দেখা যায়। নানা প্রকার মাছ, প্রবাল, ঝিনুক-শামুক ও জীবন্ত কোরাল। জলিদ্বীপের পরিধী খুব বিস্তৃত না। ১০ থেকে ১২ একর হবে। পশ্চিম ও দক্ষিণে ম্যানগ্রোভ বন এবং উত্তর থেকে পূর্বপার বরাবর সোনালী বালুর চর।
পানি যেন স্ফটিক স্বচ্ছ। কয়েক’শ নরনারী সমূদ্র তলদেশের সৌন্দর্য দেখতে ডুবুরীর সহায়তায় পানির নিচে রহস্যময় জগত দেখতে নেমেছে। আমার বন্ধু রতনকে বললাম নেমে পর পানিতে। ও সাহস পেল না। আমারও প্রচণ্ড ভয় হচ্ছিল। এর পরেও ঝুঁকি নিলাম। দুশো টাকার চুক্তিতে ডুবুরির কাছে কিছু সময় টেনিং নিয়ে নাকে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে ডুবুরির সঙ্গে নেমে পড়লাম পানিতে। পানির নিচের সৌন্দর্য টেলিভিশনে দেখেছি। এবার দেখলাম বাস্তবে। কি অপরূপা সমূদ্রের তলদেশ। জীবন্ত প্রবাল, নানা রংয়ের মাছ, ঝিনুক, শামুক। মিনিট দশ পর একটি লম্বা সাপ সাদৃশ্য বিরাট জলজীব আমার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে পানির উপরে উঠে এলাম। বেশ ভয়ই পেয়েছিলাম। পানির উপরে উঠে ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। যখন আমরা তীরে এসে চা পান করার জন্য ছোট্ট স্টলটির দিকে অগ্রসর হচ্ছি তখন দেখলাম বেশ জটলা। কৌতুহলি হয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখে ভয়ে তো আমি আরও জড়সড় হয়ে গেলাম। একজন পর্যটক যিনি পানিতে নেমেছিলেন আমার মতই সমূদ্র তলার রূপশ্রী দেখতে। তার বাম পায়ের হাটুর উপর দিকটায় বড় একটি ক্ষত। তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। মাঝারি ধরনের একটি মাছের আঘাতে থেতলে গেছে কলকাতার ব্যবসায়ী দেবু মুখার্জীর পায়ের উপরাংশ। ভাল লাগলো যারা সেখানে গাইড, তাদের সেবা যতœ দেখে। কিছ্ক্ষুণ পর দেখলাম আহত দেবু বাবু হাটহাটি করছেন এবং আমাদের অদূরে বসে সহযাত্রীদের সঙ্গে বসে হাসি-ঠাট্টায় মশগুল হয়ে পড়েছেন। আবারও নৌকায় উঠলাম। নৌকার তলদেশের স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখলাম সমূদ্রের সৌন্দর্য। বারবার দেখেও মন ভরে না। নিজের চোখকেও বিশ্বাস হয় না। সত্যিই পৃথিবীর রূপ এতো সুন্দর!
দুপুর বেলা জলিবয় দ্বীপের গাছের ছায়ায় বসে পোর্টব্লেয়ার থেকে নিয়ে যাওয়া খাবার খেতে বসেছি। পাশে এসে বসলেন দুই জোড়া যুবক যুবতী। ওরা এসেছে সুইডেন থেকে। মেয়ে দুটির পড়নে গেঞ্জি ও জিন্সের প্যান্ট। একটি মেয়ে অনিন্দ সুন্দরী। অপরজনও বেশ সুন্দরী। ছেলে দুটোর চেহারা মায়াবি। ওদের চালচলন বেশ স্মার্ট। আমার হাতে এসএলআর ক্যামেরা। ওদের ক্যামেরাও একই। রিটোরি ভ্যানাদ্রি নামের সুন্দরী মেয়েটি তার ক্যামেরা আমার হাতে দিয়ে ওদের ছবি তুলে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলো। আমি ওদের বেশ কয়েকটি ছবি ধারণ করে দিলাম। সুসান রজার নামের যুবকের মুখে সব সময় মিষ্টি হাসি। সুসান, রিটোরি, ক্লিওন ও ম্রিউরিট – ওরা ক’বন্ধু এসেছে ভারত দর্শনে। প্রথমেই আন্দামান-নিকোবার দেখবে এর পর যাবে আগ্রা-দিল্লী-ফতেহপুর ইত্যাদি স্থান দর্শনে। ওরা চার জনই পানিতে নেমেছিল সমূদ্রের তলদেশের সৌন্দর্য দেখতে। দারুণ উপভোগ করেছে। ওরা পানির নিচে বড় বড় মাছ ও শিশুক দেখেছে। দেখেছে চিংড়ি, রং বেরংয়ের কত মাছ ও প্রাণী। সে গল্পই ওরা হাত নাড়িয়ে-নাড়িয়ে করছিল। ম্রিউরিটের হাতে গিটার। সমূদ্রের পারে নির্জন ছায়াঘেরা স্থানে ওদের গিটারের ঝংকার বেশ ভাল লাগছিল। যেহেতু আমি ওদের ছবি ক্যামেরায় ধারণ করে দিয়েছি সে কৃতজ্ঞতায় ওরা যখন খাচ্ছিল তখন খুবই বিনয়ের সাথে আমাকে এবং আমার বন্ধু রতনকে দু’টুকরো রুটির সঙ্গে জেলি দিয়ে তা খেতে অনুরোধ করলো। যদিও কিছুক্ষণ আগে আমরা খাবার খেয়েছি তার পরেও ওদের অনুরোধ রাখতে হলো। পানিতে নেমে ভয় পেয়েছিলাম হেতু ক্ষুধাটাও বেশ বেশীই লেগেছিল।
পর দিন রঙ্গত যাওয়ার অপেক্ষায় বেশ পুলকিত বোধ করছিলাম। কারণ সেখানে যাওয়ার পথে আদিম মানুষ দেখা যাবে। তবে সেটা সবার ভাগ্যে জোটে না। সকাল সাড়ে দশটায় রঙ্গতের উদ্দেশ্যে বাসে উঠলাম। সুন্দর সড়ক। উঁচু নিচু পথ। ছোট ছোট পাহাড়। দু’ধারে বড় বড় গাছ। নির্জন সড়ক। বাসে আমরা যাত্রী ৩৮ জন। ৪ জন সশস্ত্র গার্ড। একজন গাইড। সমস্ত যাত্রাপথেই গাইডের ভূমিকা আমাদের সঙ্গ দেয়। আমরা যেন আমাজান বনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি। ঘন বনের মধ্য দিয়ে আমরা অতিক্রম করলাম ১শ ১০ কিলোমিটার। পুরো সড়ক পথই রোমাঞ্চকর। গভীর জঙ্গল, সবুজ উপত্যকা এবং ছোট-বড় অসংখ্য জনপদ। পাকা কামরাঙা, সফেদা, পেয়ারা, গাব ছাড়াও নানা প্রকার ফল সড়কের উপর পড়ে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জনমানবহীন এসব এলাকায় ফলবানবৃক্ষ প্রচুর। গাছগুলো প্রাকৃতিক ভাবেই জন্মেছে। হয়তো পাখির মল থেকে বীজ মাটিতে পড়ে গাছের জন্ম। কত নাম না জানা বনফুল দেখলাম। সমূদ্র, মুহুর্তে মুহুর্তে রং বদলায় তার রূপের পশরা নিয়ে। এবার কদমতলি খাঁড়ি পার হয়ে আমাদের বাস পৌঁছে বারাটাং। আমরা বাস থেকে নামতেই কিচিরমিচির শব্দ কানে এলো। বাম দিকে তাকিয়ে দেখে তো অবাক। প্রায় ৩০/৩২ জন আদিম মানুষ। জারোয়া সম্প্রদায়ের মানুষগুলো নানা বয়সের। ওরা সবাই উলঙ্গ। কোঁকড়ানো চুল, বেশ সুস্বাস্থের অধিকারি। গায়ের রং বেশ কালো অনেকটা আফ্রিকানদের মতো। ধুলো-মাটিতে একাকার সারা শরীর। পৌঢ়, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী এবং শিশুরা। আমাদের খুবই কাছাকাছি ওরা। হঠাৎ এক যুবক এগিয়ে এসে এক আমেরিকান পর্যটকের হাতের ব্যাগটি নিয়ে সরে পড়লো। বিপত্তি দেখা দিল। কিন্তু আমাদের গাইড এবং গার্ডরা ওদের দল নেতাকে কি সব বললো। পৌঢ় বয়সী দল নেতার ইশারায় যুবকটি ব্যাগটি ছুড়ে দিল গার্ড এর হাতে। গাইডের পরামর্শ মোতাবেক আমরা বাসে ওঠার সময় ওদের জন্য পারুটি, কলা, বিস্কুট, মিষ্টি, চানাচুর ইত্যাদি নিয়েছিলাম। সেগুলো দিলাম। এবার দারুণ খুশি । কলা ও মিষ্টি ওদের প্রিয়। আমাদের আগেই বলে দেয়া হয়েছিল কোন প্রকারেই ক্যামেরা বা মোবাইল ওপেন করা যাবে না বা ছবি তোলা যাবে না। ছবি তুললে পঁচিশ হাজার রুপি পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। ওরা যখনই আমাদের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছিল গার্ডরা ওদের সরিয়ে দিচ্ছিল খুব বিনয়ের সাথে। জারোয়া সম্প্রদায়ের নগ্ন মানুষগুলোর হাতে তীর-ধনুক এবং ধারালো ফালা। এক শিশু কন্যাকে কাঁধে ধরে আছে এক যুবক। এক শিশুকে দেখলাম মায়ের গলাজড়িয়ে ধরে স্তনে দুধ পান করছে আপন মনে। মা আমাদের কাছ থেকে পাওয়া কলাটি বেশ ছাল ছাড়িয়ে খেয়ে নিল। আমাদের বাস ফেরিতে উঠলো। ওরা বনের মধ্যে চলে গেল। গাইড বললেন প্রায় দিনই এসময় ওরা দল ধরে এখানে আসে কিছু পাওয়ার আশায়। কিছু মানে খাবার।
বারাটাং থেকে রঙ্গত এর দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। এই পথ অতিক্রম করতে আরও দুটি ফেরি পার হতে হবে। প্রথম ফেরি পার হয়ে বাস অগ্রসর হচ্ছে। দেখে মনে হলো নতুন বসতি স্থাপন হচ্ছে। জঙ্গল পরিস্কার করে জনবসতি গড়ে উঠছে। ছোট ছোট কয়েকটি গ্রাম চোখে পড়লো। এসব এলাকায় যারা বসতি গড়ে তুলছে তাদের প্রায় সকলেই বাঙালি। শুধু বাঙালি বললে পুরোপুরি বলা হলো না তারা সকলেই বাংলাদেশী। দ্বিতীয় ফেরি ঘাটে আমদের বাস থামলো। কিছুক্ষণ চা বিরতি। দু’টি চায়ের দোকান। দোকানদার বাঙালি। জিজ্ঞাসা করে জানলাম তার পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের উখিয়া এলাকা থেকে সেখানে গেছে। জঙ্গল পরিস্কার করে বাড়ি করেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ এলাকা থেকে ১৯৪৬ এর দাঙ্গার সময় বহু লোক ট্রলারে ভেসে আন্দামানে আশ্রয় নেয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ও কিছু লোক আন্দামানে পারি জমায়। এর পর আসে ১৯৭১ সালে বেশ কিছু পরিবার। তাদেরই বংশধররা এখন এখানে সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠি। মহাত্মা গান্ধী এবং জ্যোতি বসুর কৃপায় উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব লাভ করেছে। প্রত্যেকটি পরিবারকে ভারত সরকার দিয়েছে দশ একর করে জমি। এসব জমিতে ভাল ধান, ডাল, নারকেল, পেঁপে উৎপন্ন হয়। এখানকার ছেলে-মেয়েরা বিনা বেতনে কলেজ পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পায়। শুধু তাই নয় বই-খাতাও পায় খুবই স্বল্প মূল্যে। শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। তবে বাংলা আবশ্যিক। শিক্ষিতের হার ৮৫ শতাংশ। আপনি অবাক হবেন যখন দেখবেন চা’য়ের দোকানদার এবং ডাব বিক্রেতা আপনার সঙ্গে শুদ্ধ ইংরেজীতে কথা বলছে।
রঙ্গত পৌঁছে মনে হলো এটা বাংলাদেশেরই একটি বাজার। বেশীর ভাগ বাঙালি। একটি সুন্দর মসজিদও দেখলাম। অদূরেই মন্দির। দোকানপাট বাংলাদেশের দোকানগুলোর মতোই সাজানো। বিকালে ছোট্ট বাজারটিতে ঘুরলাম। থাকার ব্যবস্থা হলো একটি গেস্ট হাউজে। বেশ পরিপাটি করে সাজানো রুম। রাতে হোটেলে হরিণের মাংস দিয়ে পেট পুরে ভাত খেলাম। বন্ধু রতনসহ কয়েকজন ডাল ও নিরামিশ খেলো এবং আর আমরা ক’জন রুটি হরিণের মাংস খেলাম। হরিণের মাংস এখানে সহজলভ্য। গরু-মহিষ-ছাগল গৃহপালিত পশু হেতু তার মাংসের দাম চড়া। তাই হরিণ শিকার করে তার মাংস বিক্রি করা হয়। ভারতে হরিণ শিকার নিষিদ্ধ হলেও এই বিধি-নিষেধ আন্দামান-নিকোবারে নেই। ফাঁদ পেতে এবং তীর ধনুক দিয়ে হরিণ শিকার করা হয়। বন্দুকের গুলি নিক্ষেপ করে হরিণ শিকার করা যাবে না। আমাদের সঙ্গে একই হোটেলে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও হরিণের মাংস খেলেন। তাদের কাছেই বিষয়টি জানলাম।
রাতে হোটেলে ভাল ঘুম হলো। হ্যাভলক দ্বীপে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভোর ছ’টায় প্রায় দুই কিলোমিটার বাসে যেয়ে জেটি হয়ে জাহাজে উঠলাম। হ্যাভলক পৌঁছুতে দশটা বেজে গেল। দূরত্ব মাত্র ৪৫ কিলোমিটার। জাহাজ চললো ধীর গতিতে। চর দেখে-শুনে চলতেই বিলম্ব। বন্দর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে নারকেল বাগানের মাঝখানে একটি বড় দ্বিতল গেস্ট হাউজ এবং বেশ কয়েকটি কটেজ। একটি কটেজে আমাদের দু’জনের থাকার ব্যবস্থা। নির্জন এলাকা। সামনে সমূদ্র। দূরের দ্বীপটি চোখে পড়ে। আমাদের কটেজের অদূরে সমূদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। আমরা বিকালে বের হলাম সমূদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে। দুরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। আমাদের কক্সবাজারের সমূদ্র সৈকতের মত এতো দীর্ঘ ও প্রশস্ত না সৈকতটি তবে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। নানা রংয়ের নূরি-পাথর এবং শামুক ও ঝিনুক পর্যটকদের আকৃষ্ট করবেই। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা সমূদ্রের বালু চরে হাটলাম। এবার গাইড আমাদের ফিরতে তাগাদা দিলেন। যুবক-যুবতীরা তার কথায় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে সবাই সমূদ্র তীরে আনন্দে মাতোয়ারা। এবার গাইড তার হ্যান্ড মাইকে বললেন, ‘এখানে থাকা নিরাপদ না। কারণ মাঝে মধ্যেই বন্য হাতির দল এখানে আসে। তখন বিপদ হতে পারে।’ এই কথা শোনা মাত্র আমরা গুটিয়ে গেলাম। দ্রুত পায়ে ফিরে এলাম। এখানে অদূরে রয়েছে হস্তি প্রজনন কেন্দ্র। কিছু হাতিকে একটি ঘেরের মধ্যে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সেখানে রাতে জঙ্গল থেকে হাতি এসে তাদের সাথে মিলিত হয়ে আবার জঙ্গলে ফিরে যাবে। এভাবে হাতীর বংশ বৃদ্ধি হয়।
রাতে এখানকার একটি সাংস্কৃতিক দল নেচে গেয়ে মাত করে দিল। ওদের দলের সদস্য সংখ্যা ১৬ জন। সমান সংখ্যক মেয়ে ও পুরুষ। ঘাগড়ি এবং সর্ট সালোয়ার পড়ে মেয়েদের এবং কালো প্যন্টের সঙ্গে লাল রংয়ের ফতুয়া পড়ে যুবকদের বেশ দেখাচ্ছিল। ওদের মধ্যে ৪ টি মেয়ে উজ্জ্বল শ্যামলা আর অন্যরা শ্যামলা। মুখশ্রী সুন্দর। সবাই বাঙালী। প্রথমে ব্রতচারি নৃত্য দিয়ে শুরু করে পরে ভারতীয় বিভিন্ন নাচ এবং শেষে ব্রেক ড্যান্স হলো। এক পর্যায়ে আমাদের সকলকেই হাত ধরে টেনে নিয়ে নাচতে বাধ্য করলো। যারা নাচতে দ্বিমত বা অমত প্রকাশ করছিলেন তাদের কাছে এসে মেয়েরা বিনয়ের সাথে হাত ধরে ডেকে নিয়ে নাচিয়ে ছাড়লো। বাংলা-হিন্দি এবং ইংরেজি গান। আধুনিক বাদ্য যন্ত্র এবং লাউড স্পিকারের শব্দে নির্জন দ্বীপটি যেন ঝলসে উঠেছে। বাদ্য যন্ত্র সমূহ বাজাচ্ছিল ৬ জন মেয়ে এবং ৪ জন ছেলে। গিটার, ড্রাম, সানাই, ফ্লুয়েট, হারমোনিয়াম, ঢোল, খোল, করতাল, ঝুমুর ইত্যাদি। কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যটকের লম্প-ঝম্প এবং কৌতুক আমাদের বেশ আনন্দ দিয়েছিল।
পর দিন ভোরে আবার চারঘন্টা জাহাজে করে ফিরলাম রঙ্গত। রঙ্গত থেকে বাসে রওনা হলাম ডিগলিপুরের উদ্দেশ্যে। ধর্মপুর, শান্তিপুর, টুগাপুর শহর ছাড়িয়ে হাইওয়ের রকে আছড়ে পড়া সমূদের ঘ্রাণ নিতে নিতে পৌঁছে গেলাম মায়াবন্দরে। সেখানে বাঙালি আছে তবে তামিলরা সংখ্যা গরিষ্ঠ। কিছু উড়িয়াও আছে। মায়াবন্দরে দুপুরে খেতে বসলাম এক বাঙালি মুসলিম মালিকের হোটেলে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃস্টান সকলেই আমরা তৃপ্তি সহকারে খেলাম। এখানে জাত-পাতের বালাই নেই। প্রায় ঘন্টা ব্যাপী দুপুরের খাবার উৎসব চললো। খাদ্য তালিকায় রুটি-পরটা, ভাত। সঙ্গে সামূদ্রিক মাছ, সবজি, ডিম ও মুরগীর মাংস, জেলি। এর সঙ্গে টক দই ও আইস ক্রিম। হ্যাভলক এবং মায়াবন্দর দেখতে সারা বিশ্বের পর্যটকরা কেন আসে বুঝতে পারলাম। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। বড় বড় নারকেল ও দেবদারু গাছ ছাড়াও রয়েছে রেইন ট্রি। আছে নানা জাতের ফুলের সমাহার। দ্বীপ দুটির প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় ফুলের বাগান। কোন বাড়ির জানালায় গ্রিল দেখলাম না। সেখানে চোরের উপদ্রপ নেই। গেস্ট হাউজ হোটেল কিম্বা দোকানের চত্বরে ফুলের গাছ। জানা গেল ভারতের বক্স অফিস হিট করা হিন্দি, বাংলা, তামিল ও মালয়ী ভাষার বেশ কিছু সিনেমার দৃশ্য বিশেষ করে গানের দৃশ্য এই দ্বীপ দুটিতে স্যুটিং হয়েছে। আমরা মায়াবন্দরে একটি তামিল ছবির স্যুটিং ইউনিট দেখলাম। সৌন্দর্যের ডালি হচ্ছে মায়াদ্বীপ। তবে যেতে হবে আরও ভেতরে ৩০ কিলোমিটার। সেখানে সমূদ্র সৌকতের নীল জলরাশি দেখতে। যেহেতু আমাদের গন্তব্য ডিগলিপুর। অতএব বাসে উঠতে হলো।
মায়াবন্দর থেকে বাস উত্তর আন্দমানে প্রবেশ করতে সমূদ্রের খাঁড়ির উপর তৈরি করা চেঙ্গাপ্পা ব্রিজ পার হয়ে আরও প্রায় দেড় ঘন্টা জঙ্গল, উপত্যকার সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে পৌঁছানো গেল ডিগলিপুরে। তখন বিকাল বেলা। সূর্যাস্তের বাকি এক ঘন্টা। ডিগলিপুর নেমে মনে হলো বাংলার কোন এক মফস্বল শহরে এলাম। আমাদের জন্য থাকার ছোট্ট টিলার উপর এপি ডব্লু ডি-র গেস্ট হাউজ। রুমে ব্যাগ রেখে হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। টিলা থেকে নেমেই কিছু দূরে দোকানপাট। বাংলার রসগোল্লা, সিঙ্গারা, ডালপুরি দেখে ভাল লাগলো। চা-সিঙ্গারা খেয়ে একটি রিক্সায় উঠলাম দু’বন্ধু শহর ঘুরে দেখতে। রিক্সা চালক বাঙালি। ওর কাছেই জানলাম এখানেই রয়েছে আন্দামানের একমাত্র নদী কাপলং এবং পাহাড়চূড়া স্যাডেল পিক যার উচ্চতা ৭শ ৩২ মিটার। এই এলাকায় প্রচুর ধান উৎপন্ন হয় হেতু ডিগলিপুরের আরেক নাম ‘গ্রেনারি অব আন্দামান’। রাত ৮ টা পর্যন্ত আমরা ঘুরলাম ছোট্ট চিমছাম শহরে।
পরদিন ভোরে রওনা হলাম ছোট জাহাজে করে ৪০ কিলোমিটার দূরের রামনগর সমূদ্র সৈকতে। যতদূর চোখ যায় দেখা যায় বিস্তীর্ণ নিঃসঙ্গ বেলাভূমি। সারা দিন সেখানে হৈ-হুল্লোর গান-বাজনায় মেতে রইলাম আমরা। গান গাইল স্থানীয় একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। ওরা আন্দামানের পর্যটন দপ্তরের শিল্পী। আমাদের সফর সঙ্গী শিলিগুড়ির ঝংকার শিল্পী গোষ্ঠী আসর জমিয়ে দিল। দুপুরে হরিণের মাংসের বিরানী সঙ্গে দই। এর পর গা এলিয়ে দিয়ে ছাতার নিচে বিশ্র্াম। বিকাল গড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখে গেস্ট হাউজে ফিরলাম তখন রাত সাড়ে ৮ টা। রাতে একদল ছেলে-মেয়ে গেস্ট হাউজের সামনের খোলা চত্বরে নাচ-গানে মাত করে দিল। ওরা সংখ্যায় ২০ জন। এছাড়াও ৮ জন যান্ত্র শিল্পী। সমান সংখ্যক ছেলে ও মেয়ে। চোখ ধাধাঁনো রঙিন পরিধেয়। মেয়েদের ব্লাউজ আর পেটিকোটের মত ঘাগড়া। ছেলেদের পড়নে লুঙ্গি এবং ফতুয়া। মেয়েদের খোঁপায় ফুল ও পাখির পালক। ছেলেদের মাথায় গামছা সাদৃশ্য কাপড়, কাঁধে ধনুক এবং কোমরের থলের মধ্যে তীর। আদিবাসীদের নাচ দিয়ে শুরু হলো। বেশ কয়েকটি নাচের পর ছোট্ট নাটিকা। নাটিকাটিতে ওরা সুনামীতে যে বিপর্যয় হয়েছিল তা ফুটিয়ে তুললো। ২০০৮ এর ২২ মে এখানে সর্বশেষ সুনামী হয়। তাতে জীবন হানি ঘটে। এটাকে গীতিনাট্য বলা যায়। এর পর আমাদের পালা। নাচতে নাচতে ছেলে-মেয়েরা আমাদের নাচতে বাধ্য করলো। যারা নাচতে চাচ্ছিল না তাদেরও হাত ধরে উৎসাহ দিয়ে নাচিয়ে ছাড়লো। সুইডেনের চার যুবক যুবতী দারুণ নাচলো।
আমরা পর দিন সকালে নাস্তা করে রওনা হলাম কালিকাপুরের উদ্দেশ্যে। সেখানকার এরিয়াল বে জেটি থেকে যন্ত্রচালিত ছোট নৌকায় উঠে প্রায় এক ঘন্টা পর পৌঁছুলাম স্মিথ দ্বীপে। সামনে এক চোখ ধাঁধানো দৃশ্যÑএক চিলতে বেলাভূমি রাস্তা হয়ে যেন মিশেছে রস দ্বীপে গিয়ে। চারদিকে অদ্ভুত রকম শান্ত, কোথাও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই, চারদিকে শুধু অথৈ পানি আর পানি। বড় বড় ঢেউ হুটোপুটি করতে করতে আছরে পড়ছে সোনালী সৈকতে। সৈকতে উঠে আসা হারমিট কাঁকড়ার ঝাঁক ঢেউয়ের সাথে আবার ফিরে যাচ্ছে সমুদ্রে। মাত্র ৫ মিটার চওড়া এবং এক কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতের দু’দিকেই সমূদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। এক পাশের পানির রং গারো নীল অপর দিকের পানি হালকা আকাশি। সমূদ্র যত গভীর হয়, রং তত বদলায়। গাঢ় সবুজ থেকে হালকা সবুজ। ঘন নীল থেকে হালকা নীলÑএকই জায়গায় সমুদ্রের রঙের এই বিভিন্নতা আর কোথায়ও দেখা যায় না। হাঁটতে হাঁটতে আমরা রস দ্বীপে পৌঁছে গেলাম। দ্বীপে বিশাল বিশাল গাছ আর জঙ্গল। এখানে কোন হিংস্র জীব-জানোয়ার নেই। তাই ভয়ও নেই। গাছে গাছে অসংখ্য পাখি আর পাখি। প্রকৃতির এ এক অনন্য সৌন্দর্য। উত্তরে তাকালেই দেখা যায় মায়ানমারের কোককো দ্বীপ এবং উত্তর-পূর্ব কোণে ভারতের ল্যাণ্ডফল দ্বীপ। সৈকত আর দ্বীপের সৌন্দর্য অপূর্ব। আমাদের নৌকার চালক যুবক রামানন্দ জানায় আমরা যখন ফিরবো তখন দ্বীপের অনেক কিছুই দেখা যাবে না। সত্যিই তাই তিন ঘন্টা পর আমরা যখন ফিরলাম তখন স্মিথ ও রস দ্বীপের মধ্যবর্তী সৈকত জোয়ারের পানিতে ডুবে অদৃশ্য হয়ে গেছে। রাতে ডিগলিপুরে আনন্দ মেলায় গেলাম। নাচ-গান আর এক বৃদ্ধ যাদুকরের যাদু প্রদর্শন উপভোগ করলাম। সকাল ৭ টায় আবার তল্পী-তল্পা নিয়ে সবাই বাসে উঠলাম। দশ ঘন্টা বাস যাত্রা করে সন্ধ্যায় ফিরলাম পোর্ট ব্লেয়ারে। ফেরার পথে রঙ্গত ও টুগাপুরে যাত্রাবিরতি ছিল। অবশ্য দুটি ফেরি পার হওয়ার সময়ও কিছুটা বিশ্রাম মিলেছিল।
রাতে শুয়ে ঘুম এলো না। বারবারই মনে পড়ছিল ডিগলিপুরের ৪০/৪২ বছর বয়সী মিষ্টির দোকানদার ইউসুফ আলীর কথা। সুনামীতে যিনি দুই সন্তানকে হারিয়েছেন। তার ৮ বছরের মেয়ে এবং ৫ বছরের ছেলে সমূদ্র তীরে ঝিনুক কুড়াতে গিয়েছিল। সুনামীর ঢেউয়ে ওরা সমূদ্রে ভেসে গেছে। তার কান্না-চোখের জল আমাদেরও কাঁদিয়েছিল। ইউসুফের পূর্ব পুরুষের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে। তার প্রায় ৯০ বছর বয়স্কা মা বেঁচে আছেন। বৃদ্ধ মা এবং স্ত্রীর চোখে শুধুই জল। জীবনের প্রতি তার মনে হতাশা বাসা বেঁধেছে। আমাদের বললেন, মনে হয় বাংলাদেশে ফিরে যাই। কিন্তু তা বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়। আছে ঘর-বাড়ি, জমি-গরু-হাঁস-মুরগী ইত্যাদি। তিনি বললেন, তার জীবন এখন ফাঁকা মনে হয়। এক সময়ের ইউসুফের সুখের সংসারে এখন শুধুই কান্না আর হতাশা।
সকালে বিছানা থেকে উঠে পাশেই হোটেল কাউন্টারে গেলাম উড়োজাহাজের টিকিট সংগ্রহ করা যায় কি না। ভাগ্য এবার সুপ্রসন্ন। দুটো টিকেট পাওয়া গেল। আমরা চার জন বাংলাদেশী ও ১২ জন ইউরোপীয় পর্যটক দুপুরে কলকাতার দমদম বিমান বন্দরে নামলাম। # ২২ এপ্রিল, ২০১৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন