শুক্রবার, ৪ জুলাই, ২০১৪

মালয়েশিয়ায় জোনাকীর ঝিকিমিকি

পায়ের নিচের সর্ষে আমায় বেশিদিন স্থির থাকতে দেয় না। শুধু ছেলে আর তার বাবার ছুটির দিকে পথ চেয়ে থাকা। কোথাও বেরিয়ে পড়ার জন্য মনটা অস্থির হয়ে যায়, সেটা দেশ-বিদেশ কোনো ব্যাপার নয়। এটা আমি অবশ্য আগের লেখাগুলোতেও বলেছি।
মালয়েশিয়া এবার আমাদের গন্তব্য। আট দিনের জন্য। আর এটাই ছিল আমার ছেলের জন্মদিনের উপহার। ভ্রমণ আমাদের পরিবারের তিনজনেরই অত্যন্ত প্রিয়।
যাক এসব কথা। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস ভোর চারটায় আমাদের পৌঁছে দিল কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে। প্লেনটা ল্যান্ড করার জন্য যখন নিচে নামছিল, রাতের আঁধারে তখন মনে হচ্ছিল সোনার মালায় জড়িয়ে থাকা আলোঝলমলে এক শহরে নামতে যাচ্ছি।
একজন যোগ্য নেতার হাতে পড়লে অল্প দিনেই একটি দেশ কোথায় যেতে পারে, মালয়েশিয়া তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। ঘুরতে যাই ঠিকই, কিন্তুু সারাক্ষণই আমার দুঃখিনী দেশের সঙ্গে তুলনা করতে থাকি।
ভাবলাম, এত ভোরে হোটেলে যাব? হোটেল বুকিং দেয়াই ছিল। আকাশ তখনও অন্ধকারে ঢাকা। এয়ারপোর্টেই অপেক্ষা আর চিন্তা করছি, ঘুমে দু’চোখ ভেঙে আসছে। শহর অনেক দূরে। এর মধ্যে সিকিউরিটির এক লোক আমাদের কাছে জানতে চাইল, আমরা কোথায় যাব, ট্যাক্সি ঠিক করে দিলে আমরা যাব কি না? আমরা একটু দ্বিধা করছি দেখে তিনি অভয় দিয়ে বললেন, মালয়েশিয়া পুরো দেশটাই যেমন ডিউটি ফ্রি, তেমনই পত্রসব ভত্বব.
আমাদের গন্তব্য ছিল বুকিত বিনতাং। একদম ট্যুরিস্ট সেন্টার। একজন ট্যুরিস্টের জন্য যা প্রয়োজন, সব হাতের কাছে। হোটেল খুঁজতে হলো না, ট্যাক্সি ড্রাইভার একেবারে হোটেলের সামনেই থামাল। রুমে ঢুকে সোজা বিছানায় গিয়ে গভীর ঘুম।
বাংলাদেশ টাইম ন’টায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে ট্যুরিস্ট অফিসের খোঁজে বের হোলাম। এ কাজটা আমরা যেখানে যাই, সেখানেই প্রথম করি এবং চেষ্টা করি তা যেন হয় সরকারি ট্যুরিস্ট অফিস। কারণ তারা কখনোই ফাঁকি দেয় না।
একবার দিল্লি সিটি ট্যুরে আমাদের এই তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। অনেক কিছুর মধ্যে লোটাস টেম্পলও ছিল লিস্টে। গাইড এক মাইল দূরে বাসে বসিয়েই ইশারা করে বলল, ‘ও হ্যায় লোটাস টেম্পল, ফটো খিচো, ফটো খিচো।’
ঘন গাছের ফাঁক দিয়ে টেম্পলের মাথাটা দেখা যাচ্ছে কী যাচ্ছে না! প্রতিশ্রুত ভ্রমণতালিকার অর্ধেকই বাদ দিয়েছিল।
মালয়েশিয়ান সরকারি ট্যুরিস্ট কোম্পানি থেকে আমরা পাঁচটা ট্যুর বেছে নিলাম। তার মধ্যে একটা ছিল ফায়ার ফ্লাইজ শো। বাংলায় এর নাম যে জোনাকি পোকা তা জানি কিন্তু পাঠক, ভ্রমণের সঙ্গে জোনাকির সম্পর্ক কী, বুঝতে পারছিলাম না। ভিন্ন ধরনের যে কোনো কিছুর প্রতি আকর্ষণই আমাদের যাওয়ার কারণ।
কথা হলো, দুপুর দুটায় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রোবাস, যাকে ওরা ভ্যান বলে থাকে, আমাদের ফেডারেল হোটেল থেকে তুলে নেবে। গন্তব্যে পৌঁছতে ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। সেদিন ছিল ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন। পাঁচদিন ধরেই দেখছি তার জন্য অল্পবয়স্ক যুবক-যুবতীর প্রস্তুতি।
ঠিক সময়ে ভ্যান এলো, আর আমরা উঠে বসলাম। আমাদের সাথি পর্যটক ছিল দুটো মেয়ে হংকংয়ের আর তিনজন ব্রিটিশ নর-নারী। এ তিনজনই একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে। পূর্বপরিচিত নন। এদের মধ্যে একজন ভদ্রমহিলা ছিলেন, যার বয়স কমপক্ষে আশি বছর।
ডিনার এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত নৌকা ভ্রমণের জন্য আমাদের দিতে হয়েছে মাথাপিছু ১৮০ রিংগিত করে। যাক, ভ্রমণ পালা শুরু হলো। শহর ছাড়িয়ে আমরা ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছি। রাবার আর পাম বাগানের মধ্যে দিয়ে কুয়ালা সেলাংঘর ন্যাচার পার্ক পার হয়ে অবশেষে এসে পৌঁছলাম বুকিত মেলাবতী পাহাড়ে।
সেখানে বিশাল বিশাল কড়ই গাছে ছাওয়া ছায়া ছায়া মসৃণ পিচঢালা রাস্তা। উঁচু রেলিং দিয়ে ঘেরা রাস্তার একদিকে অনেক নিচে সেলাংঘর সমুদ্রের তট দেখা যায়। রেলিংয়ের ওপর রয়েছে বেশ কিছু কামান সাজানো। অন্যদিকে পাহাড়ের গা ঘেঁষে রয়েছে ওলন্দাজদের নির্মিত লাইট হাউস, রয়েল মসোলিয়াম, বাচ্চাদের পার্ক। তবে সেখানে সবচেয়ে মজার ছিল রুপালি পাতার মতো কানওয়ালা বানর। বানরগুলো কাউকেই ভয় পাচ্ছিল না। এক বানর আমার হাত থেকে একটা একটা করে খুঁটে খুঁটে বাদাম খাচ্ছিল।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। গাইড আমাদের এখান থেকে অল্প দূরেই নিয়ে গেল ডিনার পর্ব সারার জন্য। উল্লেখ্য, কুয়াালা অর্থ শহর। আমাদের আসল গন্তব্যের যে জোনাকি দর্শন, তার একটু আগে নদীর ওপরেই বার্জের মধ্যে লোকাল রেস্টুরেন্ট। দারুণ মজার এবং অনেক ধরনের সামুদ্রিক খাবারের আয়োজন। সন্ধ্যা তখন রাতে পরিণত। নদীতে দুলছে রেস্টুরেন্ট।
চারিদিক খোলা শুধু উপরে ত্রিপল দেয়া বার্জটিতে। নদী থেকে ভেসে আসা মিষ্টি বাতাস আমাদের গায়ে মিষ্টি পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। একটা ভেসে থাকা গাছের ডালে একটা সাদা বক দেখতে পেলাম সে অন্ধকারেও। নদী দেখতে দেখতে আমরা গল্প করছি আর খাচ্ছি। ততক্ষণে আমাদের সবার মধ্যেই একটু একটু বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। এটাই আমরা সবাই উপভোগ করছিলাম মন দিয়ে। কারণ প্রায় সবার মনে একই চিন্তা—জোনাকি পোকা দেখার মধ্যে কীইবা আছে!
খাওয়া শেষ হলো। আবার যাত্রার পালা। এবার আমাদের অন্ধকারের মধ্যেই কোনো শব্দ না করে আস্তে আস্তে ভ্যান চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো অল্প একটু দূরে এক নদীর ধারে। নদীর নাম kampung kuantan। আধো আলো-আধো অন্ধকারে নেমে এলাম ভ্যান থেকে।
কটেজের মতো ছোটো ছোটো দু-একটা ঘর। চারিদিকে হালকা মৃদু বৈদ্যুতিক বাতির আলো। এর মধ্যে গাইড একটি ছাউনির নিচে আমাদের লাইন করে এনে দাঁড় করাল।
অনেক ট্যুরিস্ট ছিল, তবে আমরা তিনজন ছাড়া বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত আর কোনো দেশের ট্যুরিস্টই সেখানে দেখলাম না। আরবদের আমরা সবচেয়ে বেশি দেখেছি গেনটিং হাইল্যান্ডে, যেখানে সাউথ ইস্ট এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত এক ক্যাসিনো। মজার ব্যাপার, সেই ক্যাসিনোতে মালয়েশিয়ানদের প্রবেশ বা জুয়া খেলা সরকারিভাবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
যাক এ সব কথা, তখনও বুঝিনি কী ব্যাপার ঘটবে! ওরা আমাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে দিল। এর পর ব্যাটারিচালিত শব্দহীন এক একটি নৌকায় বারো জন করে পর্যটককে উঠানো হলো। সারি ধরে সিটে বসিয়ে বলে দেয়া হলো, কোনো ধরনের কথা না এবং কোনো ছবি তোলা চলবে না। ওই নিষেধাজ্ঞা না থাকলে হয়তো ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোয় জোনাকিরা তাদের আবাস ছেড়ে পালিয়ে যেত অচিরেই। এর জন্য সে অপরূপ দৃশ্যের কোনো নিদর্শনই আমাদের কাছে থাকল না।
আস্তে আস্তে নদীর পার ঘেঁষে নৌকা চলছে, কিন্তু একটুও শব্দ নেই। তার মধ্যেই অবাক বিস্ময়ে দেখলাম নদীর ধার ঘেঁষে সারি সারি ছোট ঝোপ। তার মধ্যে কোটি কোটি জোনাকি পোকা। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে মিটমিট করে জ্বলছে আর নিভছে।
কী যে সেই অপূর্ব দৃশ্য, আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। নদীর দু’পারে মাইলখানেক সারিবদ্ধ জায়গাজুড়ে পৃথিবীর বৃহত্তম জোনাকির কলোনি। আস্তে আস্তে দু’তীরই ঘুরিয়ে আনল এতটুকু শব্দ না করে।
নিঃশব্দতার সেই দম বন্ধ করা অপার সৌন্দর্য দেখে ফিরে এসে সবাই অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলাম, কারও মুখেই কোনো কথা নেই। তারপর সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘সত্যিই কী অপরূপ!’
পাঠক হয়তো বলবেন, আমাদের দেশে গ্রামে কত জোনাকি পোকা! তা আমিও জানি। কিন্তু একই জায়গায় এত জোনাকি পোকা এবং তার ওপর ওদের প্রদর্শনীর যে কৌশল, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর!
এ ব্যাপারে ধন্যবাদ জানাই মালয়েশিয়ান ট্যুরিজম সেন্টারকে।
রাত সাড়ে দশটায় গাইড আমাদের পৌঁছে দিল হোটেলে, আর বুকিত বিনতাংয়ের রাস্তাজুড়ে চলছে তখন বড়দিনের উত্সব।
জর্জ মাইকেলের ষধংঃ ঈযত্রংঃ সধংং গানটির সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ছেলেমেয়েরা নাচছে সান্তা ক্লজের পোশাকে। সঙ্গে অনেক অল্পবয়স্ক ট্যুরিস্টও ছিল।
কোনোরকম অশোভনীয় কিছু নেই। প্রচুর ট্যুরিস্ট আমাদের মতো ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দেখছিল তারুণ্যের উত্সব। সেখানে আমার ছেলেও রাত ১টা পর্যন্ত ওদের সঙ্গে আনন্দোত্সবে অংশগ্রহণ করে এলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন