কুয়ালালামপুর শহরঃ
লাঙ্কাউয়িতে পরের দিন সকাল সকাল উঠে ভেবেছিলাম যে সাইকেল ভাড়া করে আশপাশ আরেকটু ঘুরে দেখবো। কিন্তু সকাল থেকে মুশলধারে বৃষ্টি তা হতে দিলো না। ফ্লাইট ছিলো দুপুর দেড়টায়। যাওয়ার সময় একটু দরদাম করে একটা ট্যাক্সি-ভ্যানকে ৩০ রিঙ্গিতে রাজি করানো গেলো। অবশ্য একজন অতিরিক্ত যাত্রী সেই ক্যাব ড্রাইভার নিয়েছিলো। কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টকে সংক্ষেপে লেখা হয় KLIA. প্লেনের মধ্যে কথা প্রসঙ্গে সুমি আপু আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, আমরা কালিয়া এয়ারপোর্ট থেকে কুয়ালালামপুরে কিভাবে যাবো?” উত্তর দেয়ার আগে বেশ কিছুক্ষণ হেসে নিয়েছিলাম। আমাদের ফ্লাইটের পাইলট সম্ভবত আগে নসিমন জাতীয় কোন কিছু চালাতো। ল্যান্ডিং এর সময় যেভাবে আছাড় মেরে প্লেন ল্যান্ডিং করালো তাতে তাই মনে করা স্বাভাবিক। যে কয়বার প্লেনে উঠেছি, সবচেয়ে বাজে ল্যান্ডিং এর অভিজ্ঞতা ছিলো এটা।
প্রথমদিনের অভিজ্ঞতায় ভালোমতই কালিয়া চেনা হয়ে গিয়েছে। তাই কালিয়াতে নেমে লাগেজ কালেক্ট করে আমরা সোজা লেভেল-১ এ চলে গেলাম। উদ্দেশ্য ছিলো ট্রেনে উঠে কুয়ালালামপুরে চলে যাবো। কারণ আগেই দেখে রেখেছিলাম ট্রেনে যেতে সময় লাগে মাত্র ২৮ মিনিট, যেখানে ক্যাবে গেলে সময় লাগে প্রায় এক ঘন্টা। কিন্তু টিকিটের উচ্চমূল্য দেখে (৩৫ রিঙ্গিত) পিছু হটলাম। লেভেল-১ এরই অন্যপাশে গিয়ে ট্যাক্সি কুপন কেনা হলো। এখানে আবার কুপন নেয়ার সময় পুরো ভাড়া দিতে হয়না। ২ রিঙ্গিত দিয়ে কুপন নিয়ে আমরা বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। লাগেজের কারণে কার না নিয়ে আমরা নীল রঙয়ের জ্বীপ-ক্যাবে চেপে বসলাম। ক্যাব চালক মহিলা। আলাপ করে জানা গেলো তার নাম অ্যান আর বাড়ি ইন্দোনেশিয়ায়। প্রশস্ত চার লেনের রাস্তায় আমরা কুয়ালালামপুরের দিকে চলা শুরু করলাম। চারিদিকে কিছুদুর পর পর খালি মাঝাড়ি গড়নের সবুজ পাহাড়। তার মধ্যে পাম আর নানা ধরনের নাম না জানা গাছের মেলা। আর মাঝে মাঝেই পাশে আর মাথার উপরে ফ্লাইওভার দেখা যাচ্ছিলো। আরও ইন্টারেস্টিং জিনিস হচ্ছে পুরো রাস্তা ওয়ানওয়ে! মাঝখানে ডিভাইডার দিয়ে বিপরীত লেন বলে কিছু দেখলাম না। তবে এসব ইন্টারেস্টিং জিনিস উপভোগে বাগড়া দিচ্ছিলো ফেয়ার-মিটারের উর্ধগতি। এই মিটারের মান গিয়ে ঠেকেছিলো ১৫৪ রিঙ্গিতে! কারণ আমরা নিয়েছিলাম নীল রংয়ের এক্সিকিউটিভ ক্যাব। অন্য রঙয়ের ক্যাব নিলে মিটারে খুব বেশি হলে ৯০ রিঙ্গিত উঠতো।
অ্যান আমাদের সাথে আলাপ শুরু করলো। ও ভেবেছিলো যে আমরা সবাই মুম্বাই থেকে এসেছি, আর শুধুমাত্র সুমি আপু ফিলিপিন জাতীয় কোন দেশ থেকে এসেছে। এর মধ্যে সেতু ভাই বললো, “উই আর ফ্রম বাংলাদেশ এন্ড শি ইজ ফ্রম ফিলিপিন।” আমাদের সাথে সুমি আপুর রিলেশন কি সেটা বের করতে বেচারীর বেশ মাথা খাটাতে হলো। শেষে ক্ষান্ত দিলো। আমরা বাংলাদেশী শুনে অ্যান হঠাত করেই বলে উঠলো, “আমি তোমাকে বালোবাসি।” শুনেতো আমাদের আক্কেলগুড়ুম! কয় কি বেটি?! আমাদের অবাক করে দিয়ে মহিলা মহা খুশি। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “হোয়ার ডিড ইউ লার্ন দিজ?” এক গাল হেসে মহিলা জবাব দিলো, “আই হ্যাভ বাংলাদেশী ফ্রেন্ডস। হেই, দু ইউ ওয়ান্ত ওয়ান মোর?” আমরা সম্মতি দিতেই সে গড়্গড় করে বলা শুরু করলো, “দস তাকা, পনেরো তাকা, বিশ তাকা ভাংতি নাই। ” ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো। আর দেখতে দেখতে আমাদের হোটেলের এলাকা বুকিত বিংটাং চলে এলো। অ্যান ওর স্মার্টফোন বের করে হোটেল লোকেশনকে ডেস্টিনেশন হিসেবে সেট করে দিলো। তারপরে জিপিএস দেখে একদম হোটেলের সামনে নিয়ে এলো। পরে জেনেছিলাম যে, এটার জন্যে মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে পয়সা খরচ করে নেটে ঢুকতে হয়না। পুরো শহরকেই ওরা ফ্রী ওয়াইফাই সুবিধার আওতায় নিয়ে এসেছে! অ্যান আমাদের কাছ থেকে ১৫৪ এর বসলে ১৫০ রিঙ্গিত ভাড়া নিলো, আর ফিরে যাওয়ার সময় ১২০ রিঙ্গিতে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবার অফার দিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিলো।
বুকিত বিংটাং জায়গাটাকে বলা হয় গোল্ডেন ট্রায়াংগাল এরিয়া। তবে আমি এলাকাটির নাম দিয়েছি ক্রাইম-মাস্টার গোগো এরিয়া। এখানকার রাস্তাগুলো এক লেনের। সবগুলোই ওয়ানওয়ে। দুনিয়ার যত হোটেল, নাইট ক্লাব, মাসাজ পার্লার সবই মনেহয় এই জায়গায়। আমাদের হোটেলের পাশের রাস্তাতেই একটা চায়না স্ট্রিট। রাত হলে যখন ওরা রাস্তার উপরে লাগানো চাইনীজ ল্যাম্পগুলো জ্বালিয়ে দেয় তখন খুবই চমৎকার লাগে দেখতে। সব ধরনের চাইনীজ স্ট্রিট-ফুডের সমাহার পাবেন এখানে। আর তার পাশের রাস্তাতে পাবেন অ্যারাবিয়ান ফুড। কুয়ালালামপুরে রাত দশটার পরে মোটামুটি সব মার্কেট বন্ধ হয়ে গেলেও, বুকিত বিংটাং এলাকায় গভীর রাত পর্যন্ত সবকিছু খোলা থাকে। পুরুষদের রাস্তায় একা বের হওয়া বেশ রিস্কি ব্যাপার। ফুটপাতে একা একা হাটলে কখন কোন নারী এসে টান মেরে গায়েব করে দিবে, মাসাজ করার জন্যে বা অন্যকিছু করার জন্যে তা টেরও পাবেন না। তবে গার্লফ্রেন্ড বা বউ সাথে থাকলে আপনি পুরোপুরি সেফ। ওরাও সাথে মেয়ে দেখলে কোন ডিস্টার্ব করেনা।
আমরা হোটেলে গিয়ে পড়লাম বিপদে। রিসেপশনের বিশাল বপুর চাইনীজ মহিলার চিংচুং ইংরেজী প্রিপোজিশনের অনুপস্থিতিতে মোটামুটি দুর্ভেদ্য ও দুর্বোধ্য। তারপরও অনেক কষ্টে বুঝতে সমর্থ হলাম যে, বুকিং থাকা স্বত্তেও সে আমাদেরকে স্ট্যান্ডার্ড রুম দিতে পারছেনা। এর বদলে একটা ডিলাক্স রুম দিচ্ছে একদিনের জন্যে। আলাদা চার্জ এর জন্যে দিতে হবে না। আমরা রুমে লাগেজ ফেলে দৌড় লাগালাম পেট পূজো করার জন্যে। মোটামুটি নিরিবিলি একটা মাল্লু রেস্টুরেন্টে গিয়ে মুখোমুখি হলাম মিনি-টর্নেডোর। মিনি-টর্নেডো একজন ওয়েটারের নাম। ব্যাটা এতো তাড়াতাড়ি কথা বলে যে দম নেয়ার ফুরসত পায় না! অন্যদেরকেও দম নেয়ার ফুরসত দেয় না। আর এতো দ্রুত এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যায় যে, মাঝে মাঝে চেষ্টা করেও দেখা যায় না। ঢাকায় ফেরত আসার পরে এক বড় আপা বছর চারেক আগে ওনার কুয়ালা-ট্যুর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে, এক অতি দ্রুত গতির মাল্লু ওয়েটারের কথা বলেছিলেন। তখন বুঝতে পারলাম যে, এ বান্দা বিশ্ববিখ্যাত!
ব্যাঙ কাটা হচ্ছে
খাওয়া দাওয়া শেষে হোটেলে গিয়ে একটু রেস্ট করলাম সবাই। রাত নয়টার দিকে বের হলাম আশপাশ ঘুরে দেখতে। বুকিত বিংটাং এলাকা হচ্ছে কুয়ালার সবচেয়ে হ্যাপেনিং জায়গা। হোটেল থেকে একটু সামনে এগোলেই এখানকার সবচেয়ে বড় টেকনোলজী মল লয়াট-প্লাজা। সেটার উল্টো দিকেই চমৎকার কিছু ক্যাফে, যেখানে লাইভ কনসার্ট ধরনের গান হয় বা ডিজে মিউজিক বাজায়। দাঁড়িয়ে শুনলে পয়সা লাগে না। কিন্তু বসতে গেলেই পকেট হালকা করতে হবে। এদিকে কিছু ডিভাইডারওয়ালা রাস্তা দেখলাম। তবে রাস্তাগুলো উন্নত শহর হিসেবে বেশ সংকীর্ন মনে হলো। একেক পাশে মাত্র দুই লেন। আবার মাথার উপরে মনোরেলেরও দেখা পেলাম। উদ্দেশ্যবিহীন হাটাহাটির পরিকল্পনা থাকলেও দূর থেকে আকাশে উকি দেয়া আলোকসজ্জিত পেট্রোনাস টাওয়ারের দিকে সবাইকে নিয়ে হাটতে থাকলাম। নেটে পড়েছিলাম যে, বুকিত বিংটাং থেকে পেট্রোনাস পর্যন্ত নাকি এসি করা ওয়াকওয়ে আছে। সেটাও পেয়ে গেলাম। বেসিক্যালী এটা একটা লম্বা ফুটওভার ব্রীজ যেটা কিনা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সকাল থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত এটা খোলা থাকে। মাথায় চিন্তা আসতে পারে যে, এইখানে রাইতের বেলা ঠ্যাকঠুক খাওয়ার চান্স আছে কিনা? উত্তর হচ্ছে না। কারণ পুরো ওয়াকওয়ে তে সিসিটিভি তো আছেই, সেই সাথে কিছুদুর পরপরই রয়েছে সিকিউরিটির মানুষ। প্রায় মিনিট বিশেক হাটা শেষে আমরা পৌছে গেলাম পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের সামনে। এই ওয়াকওয়েতে সুমি আপুর ফিলিপিনো চেহারার কল্যাণে পরিচয় হলো অফিস ফেরতগামী দুইজন মিষ্টভাষী মালয় মেয়ের সাথে। তারা ফ্রীতে আমাদের বেশ কিছু তথ্য সরবরাহ করেছিলো যা পরবর্তীতে অনেক কাজে লাগে।
চলছে ভিক্ষা। বিভিন্নভাবে।
পেট্রোনাসের সামনে গিয়ে আমি আবেগাপ্লুতো। বুর্জ খলিফা দেখেছি। এবারে দেখছি পেট্রোনাস। দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু টুইন টাওয়ার। টাওয়ারের সামনের বাধানো চত্বরে মানুষের হাট বসেছে। সবার বসে থাকার কারণ বুঝলাম একটু পরেই, যখন সেখানে বাজতে শুরু করলো ডেজার্ট রোজ, আর সেই সাথে সামনের ফোয়ারার পানিগুলো সুরের তালে তালে অপার্থিব সব বর্ণ ধারণ করে নাচতে শুরু করলো। দুবাইয়ে সন্ধ্যার একটু আগেই বুর্জ খলিফা থেকে চলে আসায় এ জিনিস মিস হয়ে গিয়েছিলো। তখন আসলে বুঝতে পারি নাই যে কি মিস করেছিলাম। চত্বরের একেবারে সামনে গিয়ে বসলাম। রাত প্রায় দশটা বাজে। মাথার উপরে স্বগৌরবে দাঁড়ানো আলোকসজ্জিত টুইন টাওয়ার, কানে ভেসে আসছে ডেজার্ট রোজের যাদুকরী কম্পোজিশন, আর তার সাথে ফোয়ারার পানির অদ্ভুত নাচ। আহ! আর কি চাই?
.
গেনটিং হাইল্যান্ড ও ঈদের আগের রাতঃ
আগের দিন রাতে বেশ দেরী করে ঘুমানোর কারণে আমরা কেউই পরের দিন সকালে উঠতে পারলাম না। আমরা মোটামুটি সকাল এগারোটার দিকে নাস্তা সেরে বের হলাম গেনটিং হাইল্যান্ড যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এটি এখানকার আরেকটি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। প্রথমে বুকিত বিংটাং মনোরেল স্টেশন থেকে কে.এল.সেন্ট্রালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে টিকেট কাটলাম। টিকেটের খরচ পড়লো জনপ্রতি ২.১ রিঙ্গিত করে। দুবাই মনোরেলে যেরকম ম্যাগনেটিক কার্ড দিয়েছিলো টিকেট হিসেবে, এখানে সেরকম নয়। এখানে দিলো প্লাস্টিকের ম্যাগনেটিক কয়েন। নির্দিষ্ট জায়গায় কয়েন চেপে ধরলে স্টেশনে ঢোকার গেট খুলে যায়। কয়েনটি এরপর সংরক্ষণ করতে হয়। গন্তব্যে নামার পরে একইরকমভাবে কয়েনটা গেটের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দিলে গেট খুলে যায়। দুবাইতে একটা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম যেটা সময়ের অভাবে করার সুযোগ পাইনি। এবার সেটার সুযোগ মিললো সুমি আপুর কল্যাণে। উনি ঠিক সেতু ভাইয়ের সাথে থেকে কয়েন না ফেলেই একসাথে বের হয়ে গেলেন। সিকিউরিটি দেখে নাই, বা দেখলেও ওনাকে দেশী বোন ভেবে হয়তো ছেড়ে দিয়েছিলো। ফেরত আসার সময় একই স্টেশন থেকে তিনটা টিকেট কিনলাম বুকিত বিংটাং এর। আমরা তিনজন সদ্য কেনা বৈধ কয়েন দিয়ে ঠিকমতন ঢুকে গেলেও, সুমি আপু ওনার পুরানো কয়েন দিয়ে কিছুতেই আর স্টেশনে ঢুকতে পারছিলেন না। কিন্তু এমন ভাব করলেন যেন এন্ট্রি গেটের সেন্সর মেইড-ইন-জিঞ্জিরা। কাজ করছে না কোন কারণে। সিকিউরিটি গার্ডও কনফিউজড হয়ে ওনাকে গেট নেই এমন একটা অংশ দিয়ে ভিতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিলেন। বিদেশ-বিভুইয়ে কোনমতে ইজ্জতের ফালুদা হবার হাত থেকে রক্ষা পেলাম। বুঝতে পারলাম যে, কয়েনগুলোর মধ্যে স্টেশন নির্দিষ্ট করে দেয়া থাকে এবং একবার এন্ট্রি নিলে সেটা ওখানে রাইট হয়ে যায়। তখন আর অন্য কোন স্টেশনে এন্ট্রির সেন্সরে ছোয়ালেও কাজ করবেনা। শুধুমাত্র এক্সিটের ফুটো দিয়ে তা ফেললেই কাজ করবে।
কে.এল.সেন্ট্রাল স্টেশন মূলত কুয়ালালামপুর শহরের প্রধান রেলস্টেশন। তবে এটার নিচ থেকে কয়েকটা গন্তব্যের বাসও ছাড়ে। এই জায়গার মনোরেল স্টেশনটি তাদের মনোরেল রুটের শেষ স্টেশন। মনোরেল স্টেশন থেকে নেমে কিছুদুর পাবলিকের পিছনে পিছনে হেটে রাস্তা পার হলেই কে.এল.সেন্ট্রাল স্টেশন। ট্রেন স্টেশনটা বড় হলেও, বাস স্টেশনটা খুবই ছোট। গাবতলী বা মহাখালীর মতন ভাবলে ভুল করবেন। রেল স্টেশনের বিল্ডিং এর নিচের পার্কিং এরিয়া থেকে নির্দিষ্ট সময়ে মোটামুটি ৩-৪ টা কোম্পানীর বাস ছেড়ে যায়। ছাড়ার আগে বাইরে থেকে এসে কাউন্টারের সামনের পার্কিং প্লেসে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। খ্যাপ মারা ক্যাব ড্রাইভাররা দাঁড়িয়ে থেকে বিভিন্ন কথা বলে কনফিউজড করার চেষ্টা করতে পারে। তাদের কথা না শোনাই ভালো। আমরা গেনটিং হাইল্যান্ডের টিকেট কাটতে গিয়ে দেখি যে, বারোটা বা সাড়ে বারোটার বাসের টিকেট শেষ। তার পরের বাস ছাড়বে দুপুর আড়াইটায়। তখন ঘড়িতে বাজে মাত্র বারোটা! কি আর করার? আড়াইটার টিকেটই কাটলাম। জনপ্রতি পড়লো ১০.৫ রিঙ্গিতের মতন। তবে ফেরত আসার সময় সেই একই কোম্পানীর বাসের টিকেটের মূল্য রাখলো প্রায় অর্ধেক! বাকি সময়টা ওখানকার লিটল-ইন্ডিয়া এলাকায় ঘুরে কাটিয়ে দিলাম। সেখান থেকে ৮.৫ রিঙ্গিত দিয়ে একটা সিমও কিনে ফেললাম। এই একই সিম বুকিত বিংটাং এ বাংলাদেশী ভাইব্রাদাররা ২০ রিঙ্গিতে বিক্রী করতে চেয়েছিলো! আসলেই তারা দেশী মানুষদের খা-তীর করতে জানে!
গেনটিং হাইল্যান্ড আসতে সময় লাগলো ৪৫ মিনিটের মতন। যাওয়ার সময় গেনটিং এর পাহাড় কেটে বানানো প্রশস্ত রাস্তা আর সবুজের সমারোহ চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো গভীর ঘুমে নিমগ্ন থাকার কারণে। ফেরত আসার সময় নয়নভরে দেখে তা পুষিয়ে দিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় সবাই ভাল্লুকের মতন ঘুমালেও, কেবলমাত্র আমার স্ত্রী জেগে জেগে সবকিছু দেখে, ছবি তুলতে তুলতে এসেছিলো। গেনটিং বাস স্টেশনে নেমেই চলে গেলাম দোতলায়। বিভিন্ন ব্লগে পড়া পরামর্শ অনুযায়ী, প্রথমেই ফেরত আসার টিকেট কেটে ফেললাম। এখানেই বাধলো বিপত্তি। যখন কাউন্টারে জিজ্ঞেস করলাম যে, ভাই তোমাগো লাস্ট বাস কখন? এ প্রশ্ন শুনে আমাকে বললো, সাড়ে চারটা। আমিও সেই টিকেট কিনে ফেললাম। কিন্তু এ ব্যাটারা ইংরেজী শোনার সময় শুদ্ধভাবে বললে যে, তাদের কাছে তা দুর্বোধ্য ঠেকে বুঝতে পারি নাই। আসলে রাত নয়টা পর্যন্ত আসার বাস ছিলো। যাই হোক, বাসের কাউন্টারের পাশেই গেনটিং হাইল্যান্ডে ওঠার ক্যাবলকারের টিকেট। যদি শুধুমাত্র যাওয়ার টিকেট ক্রয় করেন, তবে মূল্য জনপ্রতি ৪ রিঙ্গিত করে। আমি আপ-ডাউন দুটোই কিনলাম। খরচ পড়লো জনপ্রতি ৭ রিঙ্গিত করে।
টিকেট কাউন্টারের ফ্লোর থেকে আরও উপরে উঠলে ক্যাবল-কারে ওঠার স্টেশন। সেখান থেকে ক্যাবল-কারে সাওয়ার হলাম। নিচের পাহাড়ের ভূমি থেকে ক্যাবল-কারের উচ্চতা বড়জোড় তিনতলা হবে। বেশিদুর দেখা যাচ্ছিলো না মেঘের কারণে। কিছুক্ষণ পরেতো আমরা মেঘের ভিতরেই ঢুকে গেলাম। এর মধ্যে ঝির ঝির করে বৃষ্টিও পড়া শুরু করলো। নিচে এবং চারিদিকে সাদা মেঘে ঢাকা চাদরে পাহাড়ের সবুজ, একটা স্বপ্নময় দৃশ্য তৈরী করেছিলো। উপরে ওঠার সময় ক্যাবল-কারের ভেন্ট দিয়ে হালকা হালকা ঠান্ডা বাতাস এসে গা জুড়িয়ে দিচ্ছিলো। আমার স্ত্রী তার কলিগের অভিজ্ঞতা শুনে গায়ে হালকা গরম কাপড় জড়িয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু পূর্বের শিলং ও চেরাপুঞ্জি যাওয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে আমার মধ্যে “এহ! কত দেখলং ” ম্যানিয়া চেপে বসেছিলো বিধায় পরনে শুধুমাত্র হাফহাতা পোলো-টিশার্ট আর জিন্স। ফলাফলস্বরুপ, মিনিট বিশেক পরে যখন আমরা উপরে পৌছালাম তখন ঠান্ডায় আমার মুখ হা হয়ে গেলো। প্রায় প্রতিটা ছবিতেই স্ত্রীর হাস্যজ্জ্বল চেহারার পাশে আমার ঠান্ডায় কাতর হা-মুখ। সব ছবির সৌর্ন্দয্য অ্যায়সি কি ত্যায়সি হলে গেলো আমার কারণে।
গেনটিং এর উপরে একটা বিশাল বড় হোটেল ভবন। কত তলা সেটা মেঘের কারণে দেখতে পারি নাই। চারতলা পর্যন্ত দেখতে পেরেছিলাম। হোটেল ভবনের নিচেই একটা শপিং মল আর ফুডকোর্ট। একদিকে দেখলাম একটা সিড়ি চলে গিয়েছে উপরের ক্যাসিনোতে। আপনি ক্যাসিনোতে ঢুকতে পারবেন পাসপোর্ট সাথে থাকলে। মুসলিম মালয়দের জন্যে ক্যাসিনোতে ঢোকা নিষেধ। পাহাড়ের উপরেই আরেক পাশে ছিলো একটা এমিউজমেন্ট পার্ক, যেটা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। মেঘ এবং বৃষ্টির কারণে সেটা তখন বন্ধ ছিলো। আমরা মোটামুটি একটা রাউন্ড মেরে ফেরত আসার জন্যে ক্যাবলকারে চেপে বসলাম। এইবারের রাইডে কেউই তেমন একটা ভয় পায়নি। এমনকি সেতু ভাইও অকুতোভয়! লাঙ্কাউয়ির তুলনায় এটা দুগ্ধপোষ্য শিশু। এসবই বলাবলি করে যখন মজা নিচ্ছিলাম, ঠিক তখনই কোন এক কারণে ক্যাবলকার এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। এদিকে আমার প্যানিকমিস্ট্রেস স্ত্রী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে প্যানিক ছড়ানো শুরু করেছে,”এইখানে না ওয়েদার খারাপ হলে ক্যাবলকার বন্ধ করে দেয়। ওয়েদার ঠিক না হলে আর চালু করে না। ” এসব শুনে বীরপুরুষ সেতু ভাইয়েরও আসলি রূপ বেরিয়ে পড়লো। “এই মিয়া, কি হইলো এইটার? বন্ধ হয়ে গেলো কেন? হায় হায়, আমরাতো বাস মিস করুম! ভুলভ্রান্তি যা করছি ভাই, মাফ কইরা দিও সবাই!” যাইহোক, প্যানিক বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঢিমাতালে ক্যাবলকার চলা শুরু করলো। তবে নিচে নেমে আমরা বাস মিস করলাম। কাউন্টারে বলার পরে তারা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমাদেরকে পরের বাসের টিকেট ম্যানেজ করে দিলো। তবে সিট পড়েছিলো একদম পিছনে।
কুয়ালাতে ফিরে এসে আমরা হোটেলে একটু রেস্ট নিয়ে নিলাম। তারপরে রাতে বের হলাম আবার। বুকিত বিংটাং এলাকায় শফি সাহেব টাইপের মেন্টালীটির মানুষজন অনেক কম। কারণ ঐ টাইপ পাবলিক বেশি থাকলে, তেতুল ফুলে ভরা এ এলাকা লালার বন্যায় তলিয়ে যেত। যাই হোক, খাওয়ার জন্যে ডিফারেন্ট কিছু ট্রাই করতে গেলাম চায়না-টাউন। একটা দোকানে বসলাম। সেতু ভাই রাতে কিছু খান না। উনি কিছু তাই নিলেন না। আমাদের পিছনেই ব্যাঙের পরিজ বানাচ্ছিলো। খেতে চাইলাম। কিন্তু স্ত্রীর তীব্র আপত্তির মুখে তা সম্ভব হলো না। আমি আর আমার স্ত্রী তখন নিলাম ফ্রাইড রাইস। পরিচিত খাবার। তবে দেশের মতন তেল চুপচুপে না। তেল ছাড়া একেবারে ঝরঝরে। সুমি আপু ডিফারেন্ট কিছু ট্রাই করার জন্যে নিলেন সিফুড নুডলস। আমরা খাওয়া শুরু করার পরে সুমি আপুর খাবার এলো। উনি প্রথমেই যে জিনিসটি তার খাবার থেকে চামচ দিয়ে তুলে ধরলেন, সেটা ছিলো কেঁচো জাতীয় কোন ওয়ার্ম। সেটা দেখেই আমার স্ত্রীর প্রায় বমি করে দেবার মতন অবস্থা। বেচারী আর খেতেই পারলো না। আমি নিজের ফ্রাইড রাইস খেলাম। সুমি আপুর পাত থেকে গোলগোল চাকা চাকা আরও কিছু জিনিস বের হলো। স্কুইড। উনি খেলেন না। আমি আর সেতু ভাই খেয়ে ফেললাম। খেতে ভালোই। পাশ থেকে স্ত্রীর দেয়া ইনফো থেকে জানতে পারলাম, লাঙ্কাউয়িতেও নাকি আমি মুরগী ভাজা মনে করে যা খেয়েছিলাম সেটা স্কুইডভাজা ছিলো। শুনলে আমার বমি হতে পারে ভেবে নাকি তখন তা আমাকে বলেনি। শুনে হাসলাম। বাঙ্গালী লোহা খায়া হজম কইরা ফেলায়, স্কুইড কোন চিজ? ফেরত আসার সময় চায়না টাউনে একটা চকলেটের দোকানে ঢুকলাম। সেখানে দেখলাম অনেক ধরনের গামিবিয়ার আছে। ওজন হিসেবে কিনতে পারবেন। টেস্ট করার জন্যে প্রত্যেক পদের উপরে একই জিনিস কিছু রেখে দেয়া আছে। সেতু ভাই সেগুলো টেস্ট করতে করতেই রাতের খাবার না খেয়েও পেট ভরে ফেললেন। বাঙ্গালী ফ্রী পাইলে আলকাতরাও নাকি খায়, আর এইগুলাতো সুস্বাদু গামিবিয়ার! পরের দিন ছিলো ঈদ। আমরা এখানে কাউকেই চিনিনা। তাই চাঁদরাত মনে হচ্ছিলো না। তবুও চাঁদরাতের স্বাদ নিতে আমরা অনেক রাত পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে সে রাতে হোটেলে ফিরেছিলাম।
তেতুল ফুলে ভরা বুকিত বিংটাং এলাকা

ঈদের দিন কুয়ালামপুরে চক্করঃ
ঈদের দিন সকালে উঠতে উঠতে বেলা হয়ে গেলো। বাইরে কোথাও গরুর গ ও দেখলাম না। পরবর্তীতে জেনেছিলাম যে, শহরের ভিতরে যত্রতত্র কুরবানী নিষেধ। আর তাই বেশির ভাগ মালয়রা ঈদের ছুটিতে আগের দিন রাতে বা খুব ভোর বেলায় তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। সেখানেই কুরবানী দেয়। আবার কুরবানী শেষে সেদিন বা তার পরের দিন চলে আসে। এটা সম্ভব হয়েছে তাদের উন্নত রাস্তাঘাট তথা যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। বাসে করে যেই দূরত্ব যেতে আমাদের দেশে জ্যাম ছাড়াই ৬ ঘন্টা লাগে, ওদের লাগে সাড়ে তিন ঘন্টা! ঈদের দিন এবং পরের দিন এখানে সরকারী ছুটি। মোটামুটি অনেক কিছুই পুরোপুরি বন্ধ। আমরা পড়লাম বিপদে। কি করবো তাহলে আজকে? আমার স্ত্রীর আবার টোকাই স্বভাব আছে। যেখানে যেই লিফলেট দেখে না কেন টপাটপ ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে। সেরকম একটা লিফলেটের কল্যাণে জানলাম যে, কুয়ালামপুর শহরে ট্যুরিস্ট বাস সার্ভিস আছে প্রতিদিনই সকাল নয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। আমরা সাথে সাথে সেই অফার লুফে নেয়ার ব্যাপারে একমত হলাম।
ট্যুরের নাম কুয়ালা হপ-অন হপ-অফ সার্ভিস। এটা মূলত একটা দোতলা বাস। এর মধ্যে দোতলার অর্ধেক খোলা, আর অর্ধেক ছাদ। পুরো শহর জুড়ে এর মোট ২৩ টা স্টপেজ। প্রতিটি স্টপেজের নাম এবং সেই সাথে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বাসে থাকা একজন গাইড মাইক্রোফোন দিয়ে বলতে থাকে। বুকিত বিংটাং এলাকায় এর ৭ নং স্টপেজ। আমরা স্টপেজের সামনে একজন অথোরাইজড লোকের কাছ থেকে টিকেট কাটলাম। পুরো শহরের ২৩ টা স্টপেজ কাভার করতে মোটামুটি দুই থেকে আড়াই ঘন্টা আগে। অবশ্য এ ব্যাপারটা ট্রাফিকের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। আমরা শহরের বিভিন্ন আকর্ষণীয় এলাকা দেখতে দেখতে এবং সেখানকার ইতিহাস শুনতে শুনতে ভ্রমণ করতে থাকলাম। আমার আবার বাসে বা গাড়িতে উঠলেই ঘুম পায়। কিন্তু স্ত্রীর অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘুমানোর সাহস করতে পারি নাই। আর মোটামুটি ঘন্টা আধা পরে ঘুমানোর কোন উপায়ই থাকলো না। কারণটা ছিলো এক আরবী পরিবার। ব্যাটারা প্রায় প্রতিটা লোকেশনের সামনেই এতো বিচ্ছিরীভাবে গলার ভিতর থেকে উচ্চারণ করা শব্দবানে শব্দদূষণ করছিলো যে, গাইডের ত্যাতাপ্যাতা ইংরেজীর মর্মার্থ বোঝা দুস্কর হয়ে পড়লো। তার উপরে, আরবী বাচ্চাগুলো কিছুক্ষণ পরপর বাইরে যাওয়ার দরজা খুলছিলো আর বন্ধ করছিলো। বিরক্তিকর অবস্থা। অবশেষে আমার স্ত্রী থাকতে না পেরে ওদের বলেই ফেললো একটু আস্তে কথা বলতে। কিন্তু তেমন একটা লাভ হলো না। আইন-গাইন চলতেই থাকলো। আমাদের পিছনে বসা দৈত্যাকৃতির ইউরোপিয়ান পরিবারটাতো বিরক্ত হয়ে নেমেই গেলো। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আরবীরা আগেও অসভ্য জংলী ছিলো, এখনও জংলী আছে, ভবিষ্যতেও জংলী থাকবে। আরবী জংলীগুলোকে এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
হপ-অন হপ-অফ আমাদেরকে চায়নাটাউন, সেন্ট্রাল মার্কেট, ন্যাশনাল মিউজিয়াম ঘুরিয়ে ওদের পার্লামেন্ট বিল্ডিং এর সামনে দিয়ে নিয়ে গেলো রাজার রাজপ্রাসাদে। এখানে মিনিট পাঁচেকের ব্রেক দিলো। আমরাও নেমে ছবিটবি তুলে একাকার অবস্থা করে ফেললাম। রাজকীয় গার্ডের ঘোড়ার সামনে ছবি তুললাম। সেতু ভাই যখন ছবি তোলার জন্যে পোজ দিলো, তখন ঘোড়া ভয়ানকভাবে মাথা নাড়াতে শুরু করলো। সেতু ভাই কোনমতে ছবি তুলেই ছিটকে সরে আসলেন ঘোড়ার কাছ থেকে। যাত্রা আবারও শুরু হলো। এবারে আমরা বোটানিক্যাল গার্ডেন, পুলিশ মিউজিয়াম আর বার্ডপার্কের সামনে দিয়ে ঘুরে চলে আসলাম ওদের পুরানো দাফতরিক ভবনগুলোর সামনে। বার্ড পার্কে নামার ইচ্ছে থাকলেও আবার যদি উঠতে না দেয় বাসে, সেই কথা চিন্তা করে নামি নাই। কিন্তু পরে জানতে পারলাম যে, এই রাইডের টিকেট আপনি চব্বিশ ঘন্টা ব্যবহার করতে পারবেন। কেনার পরে চব্বিশ ঘন্টা সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট স্টপগুলো থেকে এই বাসে ইচ্ছেমতন উঠতে বা নামতে পারবেন। এই কথা জানার পরে সিদ্ধান্ত হলো যে, আমরা এই বাসেই বসে থাকবো এবং আবার ঘুরে বার্ড পার্কে চলে যাবো। যাই হোক, বাস এরপরে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার ঘুরে চলে আসলো কে.এল টাওয়ারে। এটা হচ্ছে কুয়ালালামপুরের সবচেয়ে উঁচু কমিউনিকেশন টাওয়ার এবং ভবন। এখান থেকে ঘুরে আবারও বুকিত বিংটাং এলাকায় চলে আসলো বাস।
জাদুঘরের সামনে রেলইঞ্জিন
পার্লামেন্ট ভবন
রাজপ্রাসাদ
পুরানো দাফতরিক এলাকার ভবন
কে.এল. টাওয়ার
রাতের বেলায় কে.এল. টাওয়ার
আমরা বাসেই বসে থাকলাম এবং আবারও সব একই এলাকা ঘুরে চলে আসলাম বার্ড পার্কে। এটা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নেট দিয়ে ঘেরা পাখির স্বর্গরাজ্য। ঢুকতে গিয়ে দেখি জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ৪৮ রিঙ্গিত করে। এমন দাম দেখে পিছু হটলাম। বাইরে থেকেই কিছু ছবি তুলে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটালাম। তারপরে পাশের অর্কিড গার্ডেনে ঢুকে পড়লাম। এটাতে এন্ট্রি-ফি ছিলো আরও বেশি। কোন এক অজানা কারণে এন্ট্রি-ফী নেয়ার মতন কাউকে না পেয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। অর্কিডের কালেকশন বেশ ভালো ছিলো। এলাকাও বেশ বড়। এখানে এক জায়গায় টান্ডাসে গেলাম। বের হয়ে দেখি বৌ গায়েব। বৌহারা মানুষ হয়ে পাগলের মতন বৌকে খুজতে লাগলাম। এদিকে আমার বৌকে খুজতে গিয়ে সুমি আপুও গায়েব হয়ে গেলেন। সেতু ভাইও হয়ে গেলেন বৌহারা। দুই বৌহারা মানুষ পুরো অর্কিড গার্ডেন তন্ন তন্ন করে খুজেও নিজেদের বৌকে পেলাম না। যখন ভগ্নমনে অর্কিড গার্ডেন থেকে বের হয়ে আসলাম, তখন দেখি বৌয়েরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মেজাজ চরম খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু আমার বৌ ছোটবেলায় বাবার দেয়া শিক্ষানুয়ায়ী, “কোথাও হারিয়ে গেলে একেবারে প্রবেশ দরজার কাছে ফিরে আসতে হয়” নিয়ম মেনে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো বলে জানালে, অনেক কষ্টে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলাম।
বাইরে থেকে বার্ডপার্ক
অর্কিড গার্ডেনের ভিতরে
আমরা আবারও হপ-অন হপ-অফে সওয়ার হয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। সেতু ভাই মাঝখানে এক জায়গায় নেমে একগাদা স্ন্যাকস জাতীয় খাবার কিনলেন। ওনার উদ্দেশ্য ছিলো একই বাসে আরেকবার চক্কর মারবেন রাতের লাইটিং দেখার জন্যে। আমি মাফ চাইলাম। চক্কর মারতে মারতে মাথাও চক্কর মারা শুরু করেছিলো। তবে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটা বাজায় ওরাই মাইকে বলে দিলো যে, এটাই ওদের লাস্ট ট্রিপ। বুকিত বিংটাং এই ওদের লাস্ট স্টপ হবে আজকের মতন। তাই সবাই নেমে পড়লাম। সেতু ভাইয়ের মন চরম খারাপ হচ্ছে দেখে এই বলে সান্তনা দিলাম যে, সেদিন ঈদের রাত হওয়ায় বেশিরভাগ বড় বড় বিল্ডিং এর লাইট বন্ধ থাকবে। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটা দেখিয়েও দিলাম। উনি কিছুটা শান্ত হলেন। রাতের খাবার হিসেবে সেদিন এবং পরে আরও কয়েকদিন খেয়েছিলাম সাবওয়েতে। এর আগে কেএফসি, বার্গারকিং, ম্যাগডোনাল্ডস ইত্যাদি বিভিন্ন দোকানে খেয়েছি। কিন্তু এদের মধ্যে সাবওয়ে আমার কাছে সেরা মনে হলো। এখানে আপনি নিজের স্যান্ডউইচের মালমশল্লা নিজেই সিলেক্ট করে বানিয়ে নিতে পারবেন। খরচ অবশ্য স্ট্রিটফুডের চাইতে বেশি পড়বে। জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ রিঙ্গিতে খুব ভালো খাবার এসব দোকান থেকে খেতে পারবেন।
পুরানো বদভ্যাস থেকে বোনাস ছবি
ঈদের পরের দিন স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে সারাদিন হোটেলে কাটালাম। আমার মতন অলস মানুষের জন্যে অবশ্য ভালোই হলো। সারাটা দিন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম। সেতু ভাইরা এর মধ্যে গিয়ে ঘুরে আসলেন পূত্রজায়া থেকে। সেদিনের পরের দিন আমরা সবাই গিয়েছিলাম পেট্রোনাস টাওয়ার দেখতে। আমার জীবনের সেরা অভিজ্ঞতাটা সেখানেই হয়েছিলো যা লিখবো আগামী পর্বে।
লিখেছেনঃ তার-ছেড়া-কাউয়া (তারিখঃ বুধবার, ০৬/১১/২০১৩ - ১৮:২৪)
লাঙ্কাউয়িতে পরের দিন সকাল সকাল উঠে ভেবেছিলাম যে সাইকেল ভাড়া করে আশপাশ আরেকটু ঘুরে দেখবো। কিন্তু সকাল থেকে মুশলধারে বৃষ্টি তা হতে দিলো না। ফ্লাইট ছিলো দুপুর দেড়টায়। যাওয়ার সময় একটু দরদাম করে একটা ট্যাক্সি-ভ্যানকে ৩০ রিঙ্গিতে রাজি করানো গেলো। অবশ্য একজন অতিরিক্ত যাত্রী সেই ক্যাব ড্রাইভার নিয়েছিলো। কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টকে সংক্ষেপে লেখা হয় KLIA. প্লেনের মধ্যে কথা প্রসঙ্গে সুমি আপু আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, আমরা কালিয়া এয়ারপোর্ট থেকে কুয়ালালামপুরে কিভাবে যাবো?” উত্তর দেয়ার আগে বেশ কিছুক্ষণ হেসে নিয়েছিলাম। আমাদের ফ্লাইটের পাইলট সম্ভবত আগে নসিমন জাতীয় কোন কিছু চালাতো। ল্যান্ডিং এর সময় যেভাবে আছাড় মেরে প্লেন ল্যান্ডিং করালো তাতে তাই মনে করা স্বাভাবিক। যে কয়বার প্লেনে উঠেছি, সবচেয়ে বাজে ল্যান্ডিং এর অভিজ্ঞতা ছিলো এটা।
প্রথমদিনের অভিজ্ঞতায় ভালোমতই কালিয়া চেনা হয়ে গিয়েছে। তাই কালিয়াতে নেমে লাগেজ কালেক্ট করে আমরা সোজা লেভেল-১ এ চলে গেলাম। উদ্দেশ্য ছিলো ট্রেনে উঠে কুয়ালালামপুরে চলে যাবো। কারণ আগেই দেখে রেখেছিলাম ট্রেনে যেতে সময় লাগে মাত্র ২৮ মিনিট, যেখানে ক্যাবে গেলে সময় লাগে প্রায় এক ঘন্টা। কিন্তু টিকিটের উচ্চমূল্য দেখে (৩৫ রিঙ্গিত) পিছু হটলাম। লেভেল-১ এরই অন্যপাশে গিয়ে ট্যাক্সি কুপন কেনা হলো। এখানে আবার কুপন নেয়ার সময় পুরো ভাড়া দিতে হয়না। ২ রিঙ্গিত দিয়ে কুপন নিয়ে আমরা বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। লাগেজের কারণে কার না নিয়ে আমরা নীল রঙয়ের জ্বীপ-ক্যাবে চেপে বসলাম। ক্যাব চালক মহিলা। আলাপ করে জানা গেলো তার নাম অ্যান আর বাড়ি ইন্দোনেশিয়ায়। প্রশস্ত চার লেনের রাস্তায় আমরা কুয়ালালামপুরের দিকে চলা শুরু করলাম। চারিদিকে কিছুদুর পর পর খালি মাঝাড়ি গড়নের সবুজ পাহাড়। তার মধ্যে পাম আর নানা ধরনের নাম না জানা গাছের মেলা। আর মাঝে মাঝেই পাশে আর মাথার উপরে ফ্লাইওভার দেখা যাচ্ছিলো। আরও ইন্টারেস্টিং জিনিস হচ্ছে পুরো রাস্তা ওয়ানওয়ে! মাঝখানে ডিভাইডার দিয়ে বিপরীত লেন বলে কিছু দেখলাম না। তবে এসব ইন্টারেস্টিং জিনিস উপভোগে বাগড়া দিচ্ছিলো ফেয়ার-মিটারের উর্ধগতি। এই মিটারের মান গিয়ে ঠেকেছিলো ১৫৪ রিঙ্গিতে! কারণ আমরা নিয়েছিলাম নীল রংয়ের এক্সিকিউটিভ ক্যাব। অন্য রঙয়ের ক্যাব নিলে মিটারে খুব বেশি হলে ৯০ রিঙ্গিত উঠতো।
অ্যান আমাদের সাথে আলাপ শুরু করলো। ও ভেবেছিলো যে আমরা সবাই মুম্বাই থেকে এসেছি, আর শুধুমাত্র সুমি আপু ফিলিপিন জাতীয় কোন দেশ থেকে এসেছে। এর মধ্যে সেতু ভাই বললো, “উই আর ফ্রম বাংলাদেশ এন্ড শি ইজ ফ্রম ফিলিপিন।” আমাদের সাথে সুমি আপুর রিলেশন কি সেটা বের করতে বেচারীর বেশ মাথা খাটাতে হলো। শেষে ক্ষান্ত দিলো। আমরা বাংলাদেশী শুনে অ্যান হঠাত করেই বলে উঠলো, “আমি তোমাকে বালোবাসি।” শুনেতো আমাদের আক্কেলগুড়ুম! কয় কি বেটি?! আমাদের অবাক করে দিয়ে মহিলা মহা খুশি। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “হোয়ার ডিড ইউ লার্ন দিজ?” এক গাল হেসে মহিলা জবাব দিলো, “আই হ্যাভ বাংলাদেশী ফ্রেন্ডস। হেই, দু ইউ ওয়ান্ত ওয়ান মোর?” আমরা সম্মতি দিতেই সে গড়্গড় করে বলা শুরু করলো, “দস তাকা, পনেরো তাকা, বিশ তাকা ভাংতি নাই। ” ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো। আর দেখতে দেখতে আমাদের হোটেলের এলাকা বুকিত বিংটাং চলে এলো। অ্যান ওর স্মার্টফোন বের করে হোটেল লোকেশনকে ডেস্টিনেশন হিসেবে সেট করে দিলো। তারপরে জিপিএস দেখে একদম হোটেলের সামনে নিয়ে এলো। পরে জেনেছিলাম যে, এটার জন্যে মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে পয়সা খরচ করে নেটে ঢুকতে হয়না। পুরো শহরকেই ওরা ফ্রী ওয়াইফাই সুবিধার আওতায় নিয়ে এসেছে! অ্যান আমাদের কাছ থেকে ১৫৪ এর বসলে ১৫০ রিঙ্গিত ভাড়া নিলো, আর ফিরে যাওয়ার সময় ১২০ রিঙ্গিতে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবার অফার দিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিলো।
বুকিত বিংটাং জায়গাটাকে বলা হয় গোল্ডেন ট্রায়াংগাল এরিয়া। তবে আমি এলাকাটির নাম দিয়েছি ক্রাইম-মাস্টার গোগো এরিয়া। এখানকার রাস্তাগুলো এক লেনের। সবগুলোই ওয়ানওয়ে। দুনিয়ার যত হোটেল, নাইট ক্লাব, মাসাজ পার্লার সবই মনেহয় এই জায়গায়। আমাদের হোটেলের পাশের রাস্তাতেই একটা চায়না স্ট্রিট। রাত হলে যখন ওরা রাস্তার উপরে লাগানো চাইনীজ ল্যাম্পগুলো জ্বালিয়ে দেয় তখন খুবই চমৎকার লাগে দেখতে। সব ধরনের চাইনীজ স্ট্রিট-ফুডের সমাহার পাবেন এখানে। আর তার পাশের রাস্তাতে পাবেন অ্যারাবিয়ান ফুড। কুয়ালালামপুরে রাত দশটার পরে মোটামুটি সব মার্কেট বন্ধ হয়ে গেলেও, বুকিত বিংটাং এলাকায় গভীর রাত পর্যন্ত সবকিছু খোলা থাকে। পুরুষদের রাস্তায় একা বের হওয়া বেশ রিস্কি ব্যাপার। ফুটপাতে একা একা হাটলে কখন কোন নারী এসে টান মেরে গায়েব করে দিবে, মাসাজ করার জন্যে বা অন্যকিছু করার জন্যে তা টেরও পাবেন না। তবে গার্লফ্রেন্ড বা বউ সাথে থাকলে আপনি পুরোপুরি সেফ। ওরাও সাথে মেয়ে দেখলে কোন ডিস্টার্ব করেনা।
আমরা হোটেলে গিয়ে পড়লাম বিপদে। রিসেপশনের বিশাল বপুর চাইনীজ মহিলার চিংচুং ইংরেজী প্রিপোজিশনের অনুপস্থিতিতে মোটামুটি দুর্ভেদ্য ও দুর্বোধ্য। তারপরও অনেক কষ্টে বুঝতে সমর্থ হলাম যে, বুকিং থাকা স্বত্তেও সে আমাদেরকে স্ট্যান্ডার্ড রুম দিতে পারছেনা। এর বদলে একটা ডিলাক্স রুম দিচ্ছে একদিনের জন্যে। আলাদা চার্জ এর জন্যে দিতে হবে না। আমরা রুমে লাগেজ ফেলে দৌড় লাগালাম পেট পূজো করার জন্যে। মোটামুটি নিরিবিলি একটা মাল্লু রেস্টুরেন্টে গিয়ে মুখোমুখি হলাম মিনি-টর্নেডোর। মিনি-টর্নেডো একজন ওয়েটারের নাম। ব্যাটা এতো তাড়াতাড়ি কথা বলে যে দম নেয়ার ফুরসত পায় না! অন্যদেরকেও দম নেয়ার ফুরসত দেয় না। আর এতো দ্রুত এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যায় যে, মাঝে মাঝে চেষ্টা করেও দেখা যায় না। ঢাকায় ফেরত আসার পরে এক বড় আপা বছর চারেক আগে ওনার কুয়ালা-ট্যুর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে, এক অতি দ্রুত গতির মাল্লু ওয়েটারের কথা বলেছিলেন। তখন বুঝতে পারলাম যে, এ বান্দা বিশ্ববিখ্যাত!
ব্যাঙ কাটা হচ্ছে
খাওয়া দাওয়া শেষে হোটেলে গিয়ে একটু রেস্ট করলাম সবাই। রাত নয়টার দিকে বের হলাম আশপাশ ঘুরে দেখতে। বুকিত বিংটাং এলাকা হচ্ছে কুয়ালার সবচেয়ে হ্যাপেনিং জায়গা। হোটেল থেকে একটু সামনে এগোলেই এখানকার সবচেয়ে বড় টেকনোলজী মল লয়াট-প্লাজা। সেটার উল্টো দিকেই চমৎকার কিছু ক্যাফে, যেখানে লাইভ কনসার্ট ধরনের গান হয় বা ডিজে মিউজিক বাজায়। দাঁড়িয়ে শুনলে পয়সা লাগে না। কিন্তু বসতে গেলেই পকেট হালকা করতে হবে। এদিকে কিছু ডিভাইডারওয়ালা রাস্তা দেখলাম। তবে রাস্তাগুলো উন্নত শহর হিসেবে বেশ সংকীর্ন মনে হলো। একেক পাশে মাত্র দুই লেন। আবার মাথার উপরে মনোরেলেরও দেখা পেলাম। উদ্দেশ্যবিহীন হাটাহাটির পরিকল্পনা থাকলেও দূর থেকে আকাশে উকি দেয়া আলোকসজ্জিত পেট্রোনাস টাওয়ারের দিকে সবাইকে নিয়ে হাটতে থাকলাম। নেটে পড়েছিলাম যে, বুকিত বিংটাং থেকে পেট্রোনাস পর্যন্ত নাকি এসি করা ওয়াকওয়ে আছে। সেটাও পেয়ে গেলাম। বেসিক্যালী এটা একটা লম্বা ফুটওভার ব্রীজ যেটা কিনা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সকাল থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত এটা খোলা থাকে। মাথায় চিন্তা আসতে পারে যে, এইখানে রাইতের বেলা ঠ্যাকঠুক খাওয়ার চান্স আছে কিনা? উত্তর হচ্ছে না। কারণ পুরো ওয়াকওয়ে তে সিসিটিভি তো আছেই, সেই সাথে কিছুদুর পরপরই রয়েছে সিকিউরিটির মানুষ। প্রায় মিনিট বিশেক হাটা শেষে আমরা পৌছে গেলাম পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের সামনে। এই ওয়াকওয়েতে সুমি আপুর ফিলিপিনো চেহারার কল্যাণে পরিচয় হলো অফিস ফেরতগামী দুইজন মিষ্টভাষী মালয় মেয়ের সাথে। তারা ফ্রীতে আমাদের বেশ কিছু তথ্য সরবরাহ করেছিলো যা পরবর্তীতে অনেক কাজে লাগে।
চলছে ভিক্ষা। বিভিন্নভাবে।
পেট্রোনাসের সামনে গিয়ে আমি আবেগাপ্লুতো। বুর্জ খলিফা দেখেছি। এবারে দেখছি পেট্রোনাস। দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু টুইন টাওয়ার। টাওয়ারের সামনের বাধানো চত্বরে মানুষের হাট বসেছে। সবার বসে থাকার কারণ বুঝলাম একটু পরেই, যখন সেখানে বাজতে শুরু করলো ডেজার্ট রোজ, আর সেই সাথে সামনের ফোয়ারার পানিগুলো সুরের তালে তালে অপার্থিব সব বর্ণ ধারণ করে নাচতে শুরু করলো। দুবাইয়ে সন্ধ্যার একটু আগেই বুর্জ খলিফা থেকে চলে আসায় এ জিনিস মিস হয়ে গিয়েছিলো। তখন আসলে বুঝতে পারি নাই যে কি মিস করেছিলাম। চত্বরের একেবারে সামনে গিয়ে বসলাম। রাত প্রায় দশটা বাজে। মাথার উপরে স্বগৌরবে দাঁড়ানো আলোকসজ্জিত টুইন টাওয়ার, কানে ভেসে আসছে ডেজার্ট রোজের যাদুকরী কম্পোজিশন, আর তার সাথে ফোয়ারার পানির অদ্ভুত নাচ। আহ! আর কি চাই?
.
গেনটিং হাইল্যান্ড ও ঈদের আগের রাতঃ
আগের দিন রাতে বেশ দেরী করে ঘুমানোর কারণে আমরা কেউই পরের দিন সকালে উঠতে পারলাম না। আমরা মোটামুটি সকাল এগারোটার দিকে নাস্তা সেরে বের হলাম গেনটিং হাইল্যান্ড যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এটি এখানকার আরেকটি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। প্রথমে বুকিত বিংটাং মনোরেল স্টেশন থেকে কে.এল.সেন্ট্রালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে টিকেট কাটলাম। টিকেটের খরচ পড়লো জনপ্রতি ২.১ রিঙ্গিত করে। দুবাই মনোরেলে যেরকম ম্যাগনেটিক কার্ড দিয়েছিলো টিকেট হিসেবে, এখানে সেরকম নয়। এখানে দিলো প্লাস্টিকের ম্যাগনেটিক কয়েন। নির্দিষ্ট জায়গায় কয়েন চেপে ধরলে স্টেশনে ঢোকার গেট খুলে যায়। কয়েনটি এরপর সংরক্ষণ করতে হয়। গন্তব্যে নামার পরে একইরকমভাবে কয়েনটা গেটের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দিলে গেট খুলে যায়। দুবাইতে একটা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম যেটা সময়ের অভাবে করার সুযোগ পাইনি। এবার সেটার সুযোগ মিললো সুমি আপুর কল্যাণে। উনি ঠিক সেতু ভাইয়ের সাথে থেকে কয়েন না ফেলেই একসাথে বের হয়ে গেলেন। সিকিউরিটি দেখে নাই, বা দেখলেও ওনাকে দেশী বোন ভেবে হয়তো ছেড়ে দিয়েছিলো। ফেরত আসার সময় একই স্টেশন থেকে তিনটা টিকেট কিনলাম বুকিত বিংটাং এর। আমরা তিনজন সদ্য কেনা বৈধ কয়েন দিয়ে ঠিকমতন ঢুকে গেলেও, সুমি আপু ওনার পুরানো কয়েন দিয়ে কিছুতেই আর স্টেশনে ঢুকতে পারছিলেন না। কিন্তু এমন ভাব করলেন যেন এন্ট্রি গেটের সেন্সর মেইড-ইন-জিঞ্জিরা। কাজ করছে না কোন কারণে। সিকিউরিটি গার্ডও কনফিউজড হয়ে ওনাকে গেট নেই এমন একটা অংশ দিয়ে ভিতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিলেন। বিদেশ-বিভুইয়ে কোনমতে ইজ্জতের ফালুদা হবার হাত থেকে রক্ষা পেলাম। বুঝতে পারলাম যে, কয়েনগুলোর মধ্যে স্টেশন নির্দিষ্ট করে দেয়া থাকে এবং একবার এন্ট্রি নিলে সেটা ওখানে রাইট হয়ে যায়। তখন আর অন্য কোন স্টেশনে এন্ট্রির সেন্সরে ছোয়ালেও কাজ করবেনা। শুধুমাত্র এক্সিটের ফুটো দিয়ে তা ফেললেই কাজ করবে।
কে.এল.সেন্ট্রাল স্টেশন মূলত কুয়ালালামপুর শহরের প্রধান রেলস্টেশন। তবে এটার নিচ থেকে কয়েকটা গন্তব্যের বাসও ছাড়ে। এই জায়গার মনোরেল স্টেশনটি তাদের মনোরেল রুটের শেষ স্টেশন। মনোরেল স্টেশন থেকে নেমে কিছুদুর পাবলিকের পিছনে পিছনে হেটে রাস্তা পার হলেই কে.এল.সেন্ট্রাল স্টেশন। ট্রেন স্টেশনটা বড় হলেও, বাস স্টেশনটা খুবই ছোট। গাবতলী বা মহাখালীর মতন ভাবলে ভুল করবেন। রেল স্টেশনের বিল্ডিং এর নিচের পার্কিং এরিয়া থেকে নির্দিষ্ট সময়ে মোটামুটি ৩-৪ টা কোম্পানীর বাস ছেড়ে যায়। ছাড়ার আগে বাইরে থেকে এসে কাউন্টারের সামনের পার্কিং প্লেসে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। খ্যাপ মারা ক্যাব ড্রাইভাররা দাঁড়িয়ে থেকে বিভিন্ন কথা বলে কনফিউজড করার চেষ্টা করতে পারে। তাদের কথা না শোনাই ভালো। আমরা গেনটিং হাইল্যান্ডের টিকেট কাটতে গিয়ে দেখি যে, বারোটা বা সাড়ে বারোটার বাসের টিকেট শেষ। তার পরের বাস ছাড়বে দুপুর আড়াইটায়। তখন ঘড়িতে বাজে মাত্র বারোটা! কি আর করার? আড়াইটার টিকেটই কাটলাম। জনপ্রতি পড়লো ১০.৫ রিঙ্গিতের মতন। তবে ফেরত আসার সময় সেই একই কোম্পানীর বাসের টিকেটের মূল্য রাখলো প্রায় অর্ধেক! বাকি সময়টা ওখানকার লিটল-ইন্ডিয়া এলাকায় ঘুরে কাটিয়ে দিলাম। সেখান থেকে ৮.৫ রিঙ্গিত দিয়ে একটা সিমও কিনে ফেললাম। এই একই সিম বুকিত বিংটাং এ বাংলাদেশী ভাইব্রাদাররা ২০ রিঙ্গিতে বিক্রী করতে চেয়েছিলো! আসলেই তারা দেশী মানুষদের খা-তীর করতে জানে!
গেনটিং হাইল্যান্ড আসতে সময় লাগলো ৪৫ মিনিটের মতন। যাওয়ার সময় গেনটিং এর পাহাড় কেটে বানানো প্রশস্ত রাস্তা আর সবুজের সমারোহ চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো গভীর ঘুমে নিমগ্ন থাকার কারণে। ফেরত আসার সময় নয়নভরে দেখে তা পুষিয়ে দিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় সবাই ভাল্লুকের মতন ঘুমালেও, কেবলমাত্র আমার স্ত্রী জেগে জেগে সবকিছু দেখে, ছবি তুলতে তুলতে এসেছিলো। গেনটিং বাস স্টেশনে নেমেই চলে গেলাম দোতলায়। বিভিন্ন ব্লগে পড়া পরামর্শ অনুযায়ী, প্রথমেই ফেরত আসার টিকেট কেটে ফেললাম। এখানেই বাধলো বিপত্তি। যখন কাউন্টারে জিজ্ঞেস করলাম যে, ভাই তোমাগো লাস্ট বাস কখন? এ প্রশ্ন শুনে আমাকে বললো, সাড়ে চারটা। আমিও সেই টিকেট কিনে ফেললাম। কিন্তু এ ব্যাটারা ইংরেজী শোনার সময় শুদ্ধভাবে বললে যে, তাদের কাছে তা দুর্বোধ্য ঠেকে বুঝতে পারি নাই। আসলে রাত নয়টা পর্যন্ত আসার বাস ছিলো। যাই হোক, বাসের কাউন্টারের পাশেই গেনটিং হাইল্যান্ডে ওঠার ক্যাবলকারের টিকেট। যদি শুধুমাত্র যাওয়ার টিকেট ক্রয় করেন, তবে মূল্য জনপ্রতি ৪ রিঙ্গিত করে। আমি আপ-ডাউন দুটোই কিনলাম। খরচ পড়লো জনপ্রতি ৭ রিঙ্গিত করে।
টিকেট কাউন্টারের ফ্লোর থেকে আরও উপরে উঠলে ক্যাবল-কারে ওঠার স্টেশন। সেখান থেকে ক্যাবল-কারে সাওয়ার হলাম। নিচের পাহাড়ের ভূমি থেকে ক্যাবল-কারের উচ্চতা বড়জোড় তিনতলা হবে। বেশিদুর দেখা যাচ্ছিলো না মেঘের কারণে। কিছুক্ষণ পরেতো আমরা মেঘের ভিতরেই ঢুকে গেলাম। এর মধ্যে ঝির ঝির করে বৃষ্টিও পড়া শুরু করলো। নিচে এবং চারিদিকে সাদা মেঘে ঢাকা চাদরে পাহাড়ের সবুজ, একটা স্বপ্নময় দৃশ্য তৈরী করেছিলো। উপরে ওঠার সময় ক্যাবল-কারের ভেন্ট দিয়ে হালকা হালকা ঠান্ডা বাতাস এসে গা জুড়িয়ে দিচ্ছিলো। আমার স্ত্রী তার কলিগের অভিজ্ঞতা শুনে গায়ে হালকা গরম কাপড় জড়িয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু পূর্বের শিলং ও চেরাপুঞ্জি যাওয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে আমার মধ্যে “এহ! কত দেখলং ” ম্যানিয়া চেপে বসেছিলো বিধায় পরনে শুধুমাত্র হাফহাতা পোলো-টিশার্ট আর জিন্স। ফলাফলস্বরুপ, মিনিট বিশেক পরে যখন আমরা উপরে পৌছালাম তখন ঠান্ডায় আমার মুখ হা হয়ে গেলো। প্রায় প্রতিটা ছবিতেই স্ত্রীর হাস্যজ্জ্বল চেহারার পাশে আমার ঠান্ডায় কাতর হা-মুখ। সব ছবির সৌর্ন্দয্য অ্যায়সি কি ত্যায়সি হলে গেলো আমার কারণে।
গেনটিং এর উপরে একটা বিশাল বড় হোটেল ভবন। কত তলা সেটা মেঘের কারণে দেখতে পারি নাই। চারতলা পর্যন্ত দেখতে পেরেছিলাম। হোটেল ভবনের নিচেই একটা শপিং মল আর ফুডকোর্ট। একদিকে দেখলাম একটা সিড়ি চলে গিয়েছে উপরের ক্যাসিনোতে। আপনি ক্যাসিনোতে ঢুকতে পারবেন পাসপোর্ট সাথে থাকলে। মুসলিম মালয়দের জন্যে ক্যাসিনোতে ঢোকা নিষেধ। পাহাড়ের উপরেই আরেক পাশে ছিলো একটা এমিউজমেন্ট পার্ক, যেটা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। মেঘ এবং বৃষ্টির কারণে সেটা তখন বন্ধ ছিলো। আমরা মোটামুটি একটা রাউন্ড মেরে ফেরত আসার জন্যে ক্যাবলকারে চেপে বসলাম। এইবারের রাইডে কেউই তেমন একটা ভয় পায়নি। এমনকি সেতু ভাইও অকুতোভয়! লাঙ্কাউয়ির তুলনায় এটা দুগ্ধপোষ্য শিশু। এসবই বলাবলি করে যখন মজা নিচ্ছিলাম, ঠিক তখনই কোন এক কারণে ক্যাবলকার এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। এদিকে আমার প্যানিকমিস্ট্রেস স্ত্রী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে প্যানিক ছড়ানো শুরু করেছে,”এইখানে না ওয়েদার খারাপ হলে ক্যাবলকার বন্ধ করে দেয়। ওয়েদার ঠিক না হলে আর চালু করে না। ” এসব শুনে বীরপুরুষ সেতু ভাইয়েরও আসলি রূপ বেরিয়ে পড়লো। “এই মিয়া, কি হইলো এইটার? বন্ধ হয়ে গেলো কেন? হায় হায়, আমরাতো বাস মিস করুম! ভুলভ্রান্তি যা করছি ভাই, মাফ কইরা দিও সবাই!” যাইহোক, প্যানিক বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঢিমাতালে ক্যাবলকার চলা শুরু করলো। তবে নিচে নেমে আমরা বাস মিস করলাম। কাউন্টারে বলার পরে তারা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমাদেরকে পরের বাসের টিকেট ম্যানেজ করে দিলো। তবে সিট পড়েছিলো একদম পিছনে।
কুয়ালাতে ফিরে এসে আমরা হোটেলে একটু রেস্ট নিয়ে নিলাম। তারপরে রাতে বের হলাম আবার। বুকিত বিংটাং এলাকায় শফি সাহেব টাইপের মেন্টালীটির মানুষজন অনেক কম। কারণ ঐ টাইপ পাবলিক বেশি থাকলে, তেতুল ফুলে ভরা এ এলাকা লালার বন্যায় তলিয়ে যেত। যাই হোক, খাওয়ার জন্যে ডিফারেন্ট কিছু ট্রাই করতে গেলাম চায়না-টাউন। একটা দোকানে বসলাম। সেতু ভাই রাতে কিছু খান না। উনি কিছু তাই নিলেন না। আমাদের পিছনেই ব্যাঙের পরিজ বানাচ্ছিলো। খেতে চাইলাম। কিন্তু স্ত্রীর তীব্র আপত্তির মুখে তা সম্ভব হলো না। আমি আর আমার স্ত্রী তখন নিলাম ফ্রাইড রাইস। পরিচিত খাবার। তবে দেশের মতন তেল চুপচুপে না। তেল ছাড়া একেবারে ঝরঝরে। সুমি আপু ডিফারেন্ট কিছু ট্রাই করার জন্যে নিলেন সিফুড নুডলস। আমরা খাওয়া শুরু করার পরে সুমি আপুর খাবার এলো। উনি প্রথমেই যে জিনিসটি তার খাবার থেকে চামচ দিয়ে তুলে ধরলেন, সেটা ছিলো কেঁচো জাতীয় কোন ওয়ার্ম। সেটা দেখেই আমার স্ত্রীর প্রায় বমি করে দেবার মতন অবস্থা। বেচারী আর খেতেই পারলো না। আমি নিজের ফ্রাইড রাইস খেলাম। সুমি আপুর পাত থেকে গোলগোল চাকা চাকা আরও কিছু জিনিস বের হলো। স্কুইড। উনি খেলেন না। আমি আর সেতু ভাই খেয়ে ফেললাম। খেতে ভালোই। পাশ থেকে স্ত্রীর দেয়া ইনফো থেকে জানতে পারলাম, লাঙ্কাউয়িতেও নাকি আমি মুরগী ভাজা মনে করে যা খেয়েছিলাম সেটা স্কুইডভাজা ছিলো। শুনলে আমার বমি হতে পারে ভেবে নাকি তখন তা আমাকে বলেনি। শুনে হাসলাম। বাঙ্গালী লোহা খায়া হজম কইরা ফেলায়, স্কুইড কোন চিজ? ফেরত আসার সময় চায়না টাউনে একটা চকলেটের দোকানে ঢুকলাম। সেখানে দেখলাম অনেক ধরনের গামিবিয়ার আছে। ওজন হিসেবে কিনতে পারবেন। টেস্ট করার জন্যে প্রত্যেক পদের উপরে একই জিনিস কিছু রেখে দেয়া আছে। সেতু ভাই সেগুলো টেস্ট করতে করতেই রাতের খাবার না খেয়েও পেট ভরে ফেললেন। বাঙ্গালী ফ্রী পাইলে আলকাতরাও নাকি খায়, আর এইগুলাতো সুস্বাদু গামিবিয়ার! পরের দিন ছিলো ঈদ। আমরা এখানে কাউকেই চিনিনা। তাই চাঁদরাত মনে হচ্ছিলো না। তবুও চাঁদরাতের স্বাদ নিতে আমরা অনেক রাত পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে সে রাতে হোটেলে ফিরেছিলাম।
তেতুল ফুলে ভরা বুকিত বিংটাং এলাকা
ঈদের দিন কুয়ালামপুরে চক্করঃ
ঈদের দিন সকালে উঠতে উঠতে বেলা হয়ে গেলো। বাইরে কোথাও গরুর গ ও দেখলাম না। পরবর্তীতে জেনেছিলাম যে, শহরের ভিতরে যত্রতত্র কুরবানী নিষেধ। আর তাই বেশির ভাগ মালয়রা ঈদের ছুটিতে আগের দিন রাতে বা খুব ভোর বেলায় তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। সেখানেই কুরবানী দেয়। আবার কুরবানী শেষে সেদিন বা তার পরের দিন চলে আসে। এটা সম্ভব হয়েছে তাদের উন্নত রাস্তাঘাট তথা যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। বাসে করে যেই দূরত্ব যেতে আমাদের দেশে জ্যাম ছাড়াই ৬ ঘন্টা লাগে, ওদের লাগে সাড়ে তিন ঘন্টা! ঈদের দিন এবং পরের দিন এখানে সরকারী ছুটি। মোটামুটি অনেক কিছুই পুরোপুরি বন্ধ। আমরা পড়লাম বিপদে। কি করবো তাহলে আজকে? আমার স্ত্রীর আবার টোকাই স্বভাব আছে। যেখানে যেই লিফলেট দেখে না কেন টপাটপ ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে। সেরকম একটা লিফলেটের কল্যাণে জানলাম যে, কুয়ালামপুর শহরে ট্যুরিস্ট বাস সার্ভিস আছে প্রতিদিনই সকাল নয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। আমরা সাথে সাথে সেই অফার লুফে নেয়ার ব্যাপারে একমত হলাম।
ট্যুরের নাম কুয়ালা হপ-অন হপ-অফ সার্ভিস। এটা মূলত একটা দোতলা বাস। এর মধ্যে দোতলার অর্ধেক খোলা, আর অর্ধেক ছাদ। পুরো শহর জুড়ে এর মোট ২৩ টা স্টপেজ। প্রতিটি স্টপেজের নাম এবং সেই সাথে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বাসে থাকা একজন গাইড মাইক্রোফোন দিয়ে বলতে থাকে। বুকিত বিংটাং এলাকায় এর ৭ নং স্টপেজ। আমরা স্টপেজের সামনে একজন অথোরাইজড লোকের কাছ থেকে টিকেট কাটলাম। পুরো শহরের ২৩ টা স্টপেজ কাভার করতে মোটামুটি দুই থেকে আড়াই ঘন্টা আগে। অবশ্য এ ব্যাপারটা ট্রাফিকের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। আমরা শহরের বিভিন্ন আকর্ষণীয় এলাকা দেখতে দেখতে এবং সেখানকার ইতিহাস শুনতে শুনতে ভ্রমণ করতে থাকলাম। আমার আবার বাসে বা গাড়িতে উঠলেই ঘুম পায়। কিন্তু স্ত্রীর অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘুমানোর সাহস করতে পারি নাই। আর মোটামুটি ঘন্টা আধা পরে ঘুমানোর কোন উপায়ই থাকলো না। কারণটা ছিলো এক আরবী পরিবার। ব্যাটারা প্রায় প্রতিটা লোকেশনের সামনেই এতো বিচ্ছিরীভাবে গলার ভিতর থেকে উচ্চারণ করা শব্দবানে শব্দদূষণ করছিলো যে, গাইডের ত্যাতাপ্যাতা ইংরেজীর মর্মার্থ বোঝা দুস্কর হয়ে পড়লো। তার উপরে, আরবী বাচ্চাগুলো কিছুক্ষণ পরপর বাইরে যাওয়ার দরজা খুলছিলো আর বন্ধ করছিলো। বিরক্তিকর অবস্থা। অবশেষে আমার স্ত্রী থাকতে না পেরে ওদের বলেই ফেললো একটু আস্তে কথা বলতে। কিন্তু তেমন একটা লাভ হলো না। আইন-গাইন চলতেই থাকলো। আমাদের পিছনে বসা দৈত্যাকৃতির ইউরোপিয়ান পরিবারটাতো বিরক্ত হয়ে নেমেই গেলো। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আরবীরা আগেও অসভ্য জংলী ছিলো, এখনও জংলী আছে, ভবিষ্যতেও জংলী থাকবে। আরবী জংলীগুলোকে এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
হপ-অন হপ-অফ আমাদেরকে চায়নাটাউন, সেন্ট্রাল মার্কেট, ন্যাশনাল মিউজিয়াম ঘুরিয়ে ওদের পার্লামেন্ট বিল্ডিং এর সামনে দিয়ে নিয়ে গেলো রাজার রাজপ্রাসাদে। এখানে মিনিট পাঁচেকের ব্রেক দিলো। আমরাও নেমে ছবিটবি তুলে একাকার অবস্থা করে ফেললাম। রাজকীয় গার্ডের ঘোড়ার সামনে ছবি তুললাম। সেতু ভাই যখন ছবি তোলার জন্যে পোজ দিলো, তখন ঘোড়া ভয়ানকভাবে মাথা নাড়াতে শুরু করলো। সেতু ভাই কোনমতে ছবি তুলেই ছিটকে সরে আসলেন ঘোড়ার কাছ থেকে। যাত্রা আবারও শুরু হলো। এবারে আমরা বোটানিক্যাল গার্ডেন, পুলিশ মিউজিয়াম আর বার্ডপার্কের সামনে দিয়ে ঘুরে চলে আসলাম ওদের পুরানো দাফতরিক ভবনগুলোর সামনে। বার্ড পার্কে নামার ইচ্ছে থাকলেও আবার যদি উঠতে না দেয় বাসে, সেই কথা চিন্তা করে নামি নাই। কিন্তু পরে জানতে পারলাম যে, এই রাইডের টিকেট আপনি চব্বিশ ঘন্টা ব্যবহার করতে পারবেন। কেনার পরে চব্বিশ ঘন্টা সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট স্টপগুলো থেকে এই বাসে ইচ্ছেমতন উঠতে বা নামতে পারবেন। এই কথা জানার পরে সিদ্ধান্ত হলো যে, আমরা এই বাসেই বসে থাকবো এবং আবার ঘুরে বার্ড পার্কে চলে যাবো। যাই হোক, বাস এরপরে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার ঘুরে চলে আসলো কে.এল টাওয়ারে। এটা হচ্ছে কুয়ালালামপুরের সবচেয়ে উঁচু কমিউনিকেশন টাওয়ার এবং ভবন। এখান থেকে ঘুরে আবারও বুকিত বিংটাং এলাকায় চলে আসলো বাস।
জাদুঘরের সামনে রেলইঞ্জিন
পার্লামেন্ট ভবন
রাজপ্রাসাদ
পুরানো দাফতরিক এলাকার ভবন
কে.এল. টাওয়ার
রাতের বেলায় কে.এল. টাওয়ার
আমরা বাসেই বসে থাকলাম এবং আবারও সব একই এলাকা ঘুরে চলে আসলাম বার্ড পার্কে। এটা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নেট দিয়ে ঘেরা পাখির স্বর্গরাজ্য। ঢুকতে গিয়ে দেখি জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ৪৮ রিঙ্গিত করে। এমন দাম দেখে পিছু হটলাম। বাইরে থেকেই কিছু ছবি তুলে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটালাম। তারপরে পাশের অর্কিড গার্ডেনে ঢুকে পড়লাম। এটাতে এন্ট্রি-ফি ছিলো আরও বেশি। কোন এক অজানা কারণে এন্ট্রি-ফী নেয়ার মতন কাউকে না পেয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। অর্কিডের কালেকশন বেশ ভালো ছিলো। এলাকাও বেশ বড়। এখানে এক জায়গায় টান্ডাসে গেলাম। বের হয়ে দেখি বৌ গায়েব। বৌহারা মানুষ হয়ে পাগলের মতন বৌকে খুজতে লাগলাম। এদিকে আমার বৌকে খুজতে গিয়ে সুমি আপুও গায়েব হয়ে গেলেন। সেতু ভাইও হয়ে গেলেন বৌহারা। দুই বৌহারা মানুষ পুরো অর্কিড গার্ডেন তন্ন তন্ন করে খুজেও নিজেদের বৌকে পেলাম না। যখন ভগ্নমনে অর্কিড গার্ডেন থেকে বের হয়ে আসলাম, তখন দেখি বৌয়েরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মেজাজ চরম খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু আমার বৌ ছোটবেলায় বাবার দেয়া শিক্ষানুয়ায়ী, “কোথাও হারিয়ে গেলে একেবারে প্রবেশ দরজার কাছে ফিরে আসতে হয়” নিয়ম মেনে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো বলে জানালে, অনেক কষ্টে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলাম।
বাইরে থেকে বার্ডপার্ক
অর্কিড গার্ডেনের ভিতরে
আমরা আবারও হপ-অন হপ-অফে সওয়ার হয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। সেতু ভাই মাঝখানে এক জায়গায় নেমে একগাদা স্ন্যাকস জাতীয় খাবার কিনলেন। ওনার উদ্দেশ্য ছিলো একই বাসে আরেকবার চক্কর মারবেন রাতের লাইটিং দেখার জন্যে। আমি মাফ চাইলাম। চক্কর মারতে মারতে মাথাও চক্কর মারা শুরু করেছিলো। তবে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটা বাজায় ওরাই মাইকে বলে দিলো যে, এটাই ওদের লাস্ট ট্রিপ। বুকিত বিংটাং এই ওদের লাস্ট স্টপ হবে আজকের মতন। তাই সবাই নেমে পড়লাম। সেতু ভাইয়ের মন চরম খারাপ হচ্ছে দেখে এই বলে সান্তনা দিলাম যে, সেদিন ঈদের রাত হওয়ায় বেশিরভাগ বড় বড় বিল্ডিং এর লাইট বন্ধ থাকবে। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটা দেখিয়েও দিলাম। উনি কিছুটা শান্ত হলেন। রাতের খাবার হিসেবে সেদিন এবং পরে আরও কয়েকদিন খেয়েছিলাম সাবওয়েতে। এর আগে কেএফসি, বার্গারকিং, ম্যাগডোনাল্ডস ইত্যাদি বিভিন্ন দোকানে খেয়েছি। কিন্তু এদের মধ্যে সাবওয়ে আমার কাছে সেরা মনে হলো। এখানে আপনি নিজের স্যান্ডউইচের মালমশল্লা নিজেই সিলেক্ট করে বানিয়ে নিতে পারবেন। খরচ অবশ্য স্ট্রিটফুডের চাইতে বেশি পড়বে। জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ রিঙ্গিতে খুব ভালো খাবার এসব দোকান থেকে খেতে পারবেন।
পুরানো বদভ্যাস থেকে বোনাস ছবি
ঈদের পরের দিন স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে সারাদিন হোটেলে কাটালাম। আমার মতন অলস মানুষের জন্যে অবশ্য ভালোই হলো। সারাটা দিন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম। সেতু ভাইরা এর মধ্যে গিয়ে ঘুরে আসলেন পূত্রজায়া থেকে। সেদিনের পরের দিন আমরা সবাই গিয়েছিলাম পেট্রোনাস টাওয়ার দেখতে। আমার জীবনের সেরা অভিজ্ঞতাটা সেখানেই হয়েছিলো যা লিখবো আগামী পর্বে।
লিখেছেনঃ তার-ছেড়া-কাউয়া (তারিখঃ বুধবার, ০৬/১১/২০১৩ - ১৮:২৪)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন