শুক্রবার, ৪ জুলাই, ২০১৪

সাজানো সিঙ্গাপুর

সিঙ্গাপুরের ইউনিভার্সাল স্টুডিওর জুরাসিক পার্ক‘পুর’ মানে নগর। জনপদের নামের সঙ্গে ‘পুর’ যুক্ত হলে বিস্তৃত হয় তাৎপর্য। উদাহরণ—রংপুর, গাজীপুর, ফরিদপুর প্রভৃতি। সিঙ্গাপুরও তেমনই এক নগর। সাগরঘেরা একটা দ্বীপ-দেশ। সেই দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বিশাল এক সিংহমূর্তি—নাম মারলায়ন। সিঙ্গাপুর সদলবলে বেড়াতে যাওয়ার পর আমাদের এক বন্ধু ঘোষণা করল, নামটা ছিল আসলে সিংহপুর। এরা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না দেখে সিঙ্গাপুরের মতো শোনায়।

ঢাকা থেকে আকাশপথে কমবেশি চার ঘণ্টার দূরত্ব। কিন্তু গিয়ে মনো হলো সিঙ্গাপুর যেন বাংলাদেশেরই কোনো অংশ। রাস্তায় চলতে দেখা মেলে অনেক বাংলাদেশির। সিঙ্গাপুর শহরটা প্রায় পুরোটাই কৃত্রিম। প্রাকৃতিক বলতে শান্ত-সমাহিত সমুদ্রটাই শুধু। কিন্তু বিশ্বজুড়ে যেখানে যা কিছু ভালো, যা কিছু মহান—সবই যেন কপি-পেস্ট করে রাখা হয়েছে সিঙ্গাপুরে। দারুণ কিছু বানিয়ে ফেলতে তাদের উৎসাহে ভাটা পড়ে না মোটেও। সেটার পেছনে দিন-রাত সে কি যত্নআত্তি আর রক্ষণাবেক্ষণ, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন—তা সে কংক্রিটের ইমারত হোক আর সবুজ বন বা তৃণভূমিই হোক।

এত্তটুকুন একটা শহর, অথচ তার সবকিছু ঠিকঠাক ঘুরেফিরে দেখেশুনে নিতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগবেই। অবশ্য ‘সিঙ্গাপুর ফ্লায়ার’ নামে বিশাল যে চরকি বানিয়ে রাখা আছে, সেটায় চড়লে এক দফাতেই একনজর দেখে ফেলা যায় এ-মাথা ও-মাথা।
আমরা গিয়েছিলাম কয়েকটি পরিবার একসঙ্গে। একেকজনের একেক দিকে আগ্রহ। কেনাকাটা করতে গিয়ে কেউ ঢোকে প্রসাধনীর দোকানে, কেউ উঁকি দেয় ইলেকট্রনিকস অংশে, কেউ যায় কাপড়চোপড়ের সন্ধানে। শহরের প্রাণকেন্দ্র অরচার্ড পয়েন্টে ব্র্যান্ড দোকানগুলোয় উইন্ডো শপিং আর সত্যিকারের কেনাকাটার পর্ব হয়তো চায়না টাউন, ধোবি ঘাট বা লিটল ইন্ডিয়ায়। বাংলাদেশিদের প্রধান আকর্ষণ ‘মোস্তফা সেন্টার’-এর জন্য চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় রাখাই উচিত, অন্তত পুরোটা ঘুরে দেখতে হলেও।
একদিন সন্ধ্যায় খুব আয়োজন করে গেলাম নাইট সাফারিতে। শহরের পশ্চিম প্রান্তে ছোটখাটো কৃত্রিম জঙ্গল বানিয়ে রাখা আছে। পর্যটকদের ট্রামে চড়িয়ে জঙ্গল ঘোরানো হয়। রাতের আঁধারে বাঘ, সিংহ, হাতি, হরিণ, জেব্রা দেখার মধ্যে একধরনের গা-ছমছমে অনুভূতি কাজ করে। ছোট বাচ্চাদের মজাটাই মনে হয় বেশি, তবে বড়রাও কিছু কম যান না।
ঘুরতে গিয়ে কেনাকাটাও করতে পারবেনআরেক দিন খুব সকালে উঠে গেলাম ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে। দিনভর সময় কাটানোর দারুণ একটা জায়গা। সকাল ১০টায় খোলে, বিকেল পাঁচটা বাজলেই বন্ধ। কাজেই দেরি করার উপায় নেই। একপাশে মাদাগাস্কারের সব চরিত্র। সেখান থেকে দুর্ধর্ষ ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের শো। তারপর জুরাসিক পার্কে বহু যুগের হারিয়ে যাওয়া পৃথিবী দেখতে দেখতে আচমকা পানিতে পতন। পাশেই হয়তো প্রাচীন মিসর। সেখানে মমির প্রতিশোধ যে কত ভয়াবহ হতে পারে, সেটা বলার নয়। এরপর চতুর্মাত্রিক ‘শ্রেক’ দেখা শেষ করে, ‘ট্রান্সফরমার মোশন সিমুলেটর’-এ ১০০তলা থেকে পতনের অভিজ্ঞতা নিতেই হবে। পুরো বিবরণে যাচ্ছি না, ইউনিভার্সাল স্টুডিওর ওয়েবসাইটে গিয়ে বাকিটা জেনে নিন।

ক্যাবল কারে চড়ার জন্য আরেক দিন সকাল-সকাল উঠতে হলো। মাউন্ট ফেবার থেকে সোজা সান্তোসা আইল্যান্ড। সেখানে নানা রকম রাইড। প্রথমে কেউ কেউ নাক সিঁটকালেও, পরে অন্যদের চাপাচাপিতে রাইডে চড়ার জন্য স্বীকার করল, না চড়লে বিরাট মিস হতো।

যাহোক, ‘গার্ডেন বাই দ্য বে’-র টিকিট আগেই করা ছিল। কৃত্রিম ঝরনা, জলপ্রপাত, মেঘ, বৃষ্টি আর হাজার হাজার ফুলের মেলা। এই দারুণ গ্রিন হাউসের বাইরে বিশাল বিশাল সুপার ট্রি। রাত নামলে সেখানে আলো জ্বলে। মুগ্ধ চোখে সেটা কিছুক্ষণ দেখার পর গেলাম মারলায়ন পার্কে। উদ্দেশ্য, রিভার ক্রুজ। সমুদ্রের পানি টেনে এনে শহরের মাঝখানে নদী বানানো হয়েছে। সেই নদীতে নৌকায় চড়ে শহরটা দেখা আর আকাশছোঁয়া দালানগুলো কোনটা কততলা, সেটা গুনতে থাকা। আর একটু পর পর গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলা—আহ্, আমাদের দেশেও তো কত্ত নদী!
অভিভূত হওয়ার কিছু বাকি ছিল। রাতের বেলা মেরিনা বের চারপাশে শুরু হয় চোখজুড়ানো লেজার শো। সেটা না দেখলে সিঙ্গাপুর যাওয়াই বৃথা।
সিঙ্গাপুরে খাওয়াদাওয়ার অভাব নেই। হরেক দেশের, হরেক স্বাদের। দামি রেস্তোরাঁ যেমন আছে, তেমনি বেশ কিছু হকার্স সেন্টার আর ফুড কোর্টও দেখলাম। আমাদের সবচেয়ে পছন্দ হলো একধরনের আইসক্রিম। রাস্তার পাশে বিক্রি করে। দামে সস্তা, কিন্তু স্বাদ সেই রকম!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন